সামাজিক মনোবিজ্ঞান নিয়ে মজার তথ্য

সামাজিক মনোবিজ্ঞান নিয়ে মজার তথ্য

মানুষের মধ্যে গোষ্ঠিচেতনার আবির্ভাব প্রথম কখন ঘটেছিল, তা নিয়ে অনেক মতবাদই আছে নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে। বিতর্কেরও শেষ নেই। তবে এ নিয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেননি তারা। সে যাই হোক, এখন জন্মগতভাবে আমরা সংঘবদ্ধ জীবনই বেছে নিয়েছি। কারণ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো মানুষই টিকে থাকতে পারে। আর এই সমাজে একসঙ্গে চলতে গেলে প্রয়োজন হয় একে অপরকে সহযোগিতা করার। সেটা হতে পারে সচেতন অবস্থায়, অথবা অবচেতন মনে।

মানুষ কেন অপরকে সাহায্য করে? আসলে এর পেছনে কাজ করে কিছু বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। এ নিয়ে গবেষণা করে মনোবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা, যাকে বলা হয় ‘সামাজিক মনোবিজ্ঞান’ বা ‘মনোসামাজিক বিজ্ঞান’। মানুষের গোষ্ঠিগত আচরণ নিয়ে কাজ করে এই শাখাটি। মানুষের সামাজিক আচরণ নিয়ে এ পর্যন্ত আমাদের অনেক তথ্যই দিতে পেরেছে সামাজিক মনোবিজ্ঞান।

এখানে তার ১০টি মজার বিষয় তুলে ধরা হলো:

১. আমরা অনেক সময় পথ চলতে চলতে অনেককে দুর্ঘটনায় পড়তে দেখি। কখনো নিজেরাও শিকার হই। এমন আকস্মিক দুর্ঘটনায় বা বিপদে সাহায্যের জন্য সবাই এগিয়ে আসে না। তারা চারপাশে ভিড় জমিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষটিকে দেখে। এর মধ্য থেকে গুটিকয়েক মানুষই তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এই যে এত লোকজন থাকার পরও গুটিকয়েক মানুষই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, এটাকে মনোবিজ্ঞান বলে ‘বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট’ (bystander effect)। এর মূলকথা হচ্ছে, ‘যত বেশি লোক কোনো একটা দুর্ঘটনা বা সমস্যার সময় উপস্থিত থাকবে, তাদের মধ্যে থেকে ততো কম মানুষই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।’ তার মানে উপস্থিত লোকের সংখ্যার সাথে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনার সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক।

২. অনেক সময় আমাদের চারপাশে এমন মানুষও দেখা যায়, যারা নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। অনেক বিপদ থাকার পরও তারা এই কাজ করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়, অবেডিয়েন্স এক্সপেরিমেন্টস’ (obedience experiments)। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী স্টেনলি মিলগ্রাম প্রথমে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন। এজন্য একে মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টসও বলা হয়ে থাকে।

১৯৬৩ সালের এক গবেষণায় তিনি দেখান, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিপদে পড়তে বা কোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে দেখেন তখন তিনি নিজের শরীরে এক ধরনের বৈদ্যুতিক শক অনুভব করেন, যা তাকে দুর্ঘটনাক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৭৪ সালে মিলগ্রাম এ নিয়ে একটি বই লিখেন- ‘অবেডিয়েন্স টু অথরিটি: অ্যান এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ’।

৩. ছোটবেলায় শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতা আমরা অনেকেই পড়েছি। চিলে কান নিয়েছে। এই খবর শুনে সবাই ছুটছে চিলের পেছনে। পরে কানের জায়গায় হাত দিয়ে দেখা যায়, কান জায়গামতোই আছে। দলবদ্ধভাবে এমন ভুল আমরা প্রায়ই করি। পরে আমাদের হুঁশ হয়।
যেমন ধরা যাক, নেতার কোনো সিদ্ধান্ত আমরা বিনাবাক্যে মেনে নিলাম। পরে দেখা গেল, সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল। আর দলের সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে ভুলটি করেছে। প্রত্যেকেই আসলে দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। ১৯৫১ সালে এ বিষয়টি নিয়ে প্রথম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন পোলিশ মনোবিজ্ঞানী সলোমন এলিয়ট আচ। তার এই তত্ত্বের নাম ‘আচস কনফর্মিটি এক্সপেরিমেন্টস’। এতে তিনি দেখান, প্রায় সমান তিনটি লাইনের মধ্যে কোন লাইনটি সবচে বড়- একটি দলকে তা বেছে নিতে বলা হলে, দলের কোনো নির্ভরযোগ্য সদস্য যখন ভুল লাইনটি বেছে নেন, তখন বাকি সদস্যরাও একই ভুল করেন।

৪. মানুষের সামাজিক আচরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পরিস্থিতির পরিবর্তন। একজন মানুষ কোনো একটি পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে যখন কোনো একটি কাজ করতে থাকেন, তখন হঠাৎ তাকে সে পরিবেশ থেকে সরিয়ে নেয়া হলে বেশিদিন আর কাজ চালিয়ে যেতে পারেন না। মনোবিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় ‘স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্টস’।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে গবেষণা চালান মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ জিম্বার্ডো। কলেজ ছাত্রদের একটি দলকে তিনি কারাগারে পাঠান। এতে দেখা যায়, কারাগারে তারা কোনো সাধারণ নিয়ম ছয়দিনের বেশি চর্চা করতে পারেন না। ছয়দিন পর নিয়ম ভুলে যান। ব্যত্যয় ঘটান। ফলে কারারক্ষীরাও তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে। পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে শিক্ষার্থীরা সেখানকার নিয়মকানুন মেনে চলতে পারেননি। কিন্তু কলেজে তারা ঠিকই নিয়ম মেনে চলতেন।

৫. সব সময় যার সঙ্গে আমাদের ‘মনের মিল’ হয়, আমরা তাদের বেশি পছন্দ করি। কারণ ওই মানুষের চিন্তার সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসটিও মিলে যায়। আর যাদের পছন্দ করি না, তাদের উপেক্ষা করি। তাদের সঙ্গে আমাদের মনের মিল হয় না। মনের মিলমিশের এই বিষয়টিকে মনোবিজ্ঞান ‘এক্সপেক্টেশন কনফার্মেশন’ নামে অভিহিত করে, যাকে বলা যায়, ‘প্রত্যাশা নিশ্চিতকরণ’। বিপণনে মনোবিজ্ঞানের এই তত্ত্বটি কাজে লাগানো হয়। ১৯৭৭ সালে প্রথম বিষয়টি তুলে ধরেন মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড এল অলিভার।

৬. সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে যখন আমরা শ্রেণিবিন্যাস করি, তখন আলাদা গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বেশি বেশি পার্থক্য তৈরির প্রবণতা কাজ করে আমাদের মধ্যে। আর আমরা একই গোষ্ঠির মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করি। এটা কখনো কখনো পূর্বানুমিত ধারণা বা সংস্কারের কারণেও হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় ‘সোশ্যাল আইডেন্টিটি থিওরি’।

৭. আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অথবা কোনো ব্যক্তি, ধারণা বা বস্তুকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করি- সেটা দুই রকম হতে পারে: স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট। স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যখন আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সচেতনভাবে গঠন করি এবং মূল্যায়িত বস্তু সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন থাকি। অন্যদিকে আমাদের অস্পষ্ট মনোভাব তৈরি হয়, যখন আমরা অচেতনভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করি। আমাদের সামাজিক আচরণে এই দুই ধরনের মনোভাবেরই শক্তিশালী প্রভাব আছে। এটাকে বলা হয় ‘সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স’।

৮. কোনো ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা, সামাজিক আদর্শ এবং সামাজিক শ্রেণিকরণের ওপর ভিত্তি করে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের মনোভাব তৈরি হয়। নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক গোষ্ঠিতে কোনো ব্যক্তির যে ভূমিকা তার ওপর ভিত্তি করেই তার প্রতি আমাদের আচরণ তৈরি হয়। এ কারণে আমরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করি। এক্ষেত্রে আমরা দেখি, কে, কোন সামাজিক গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত।
কখনো কখনো প্রথমবার দেখেই কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের বিশেষ অনুভূতি তৈরি হয় এবং সে অনুযায়ী তার কাছ থেকে আমরা আচরণ প্রত্যাশা করি। এই মনোভাবের কারণেই অনেক সময় আমাদের মধ্যে বৈষম্যের ধারণা তৈরি হয়। সামাজিক মনোবিজ্ঞান এ কারণে একে বলে ‘ডিসক্রিমিনেশন’।

৯. মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা সব সময় কাজ করে: সে যখন কোনো কাজে সাফল্য পায়, তখন এর পেছনে নিজের ‘অন্তর্নিহিত’ শক্তির কথা বলে গর্ব করে। আবার যখন ব্যর্থ হয়, তখন অপরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। একইভাবে মানুষ যখন অন্যের ব্যর্থতা মূল্যায়ন করে, তখন ব্যর্থ ব্যক্তির ওপরই ওই কাজের দায়ভার চাপায়। বলে, তার নিজের দোষেই এমন হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা যদি পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে খারাপ নম্বর পাই, তখন শিক্ষককে দোষারোপ করি। আর যদি একজন সহপাঠির ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে, তবে বলি, সে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেনি। মনোবিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে বলেন ‘অ্যাক্টর-অবজার্ভার বায়াস’ বা ‘অ্যাক্টর-অবজার্ভার অ্যাসিমেট্রি’। অর্থাৎ, আমরা যখন কোনো ঘটনা নিজেরা ঘটাচ্ছি, তখন তার সাফল্য-ব্যর্থতায় এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আর যখন অন্য কারো সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করছি, তখন অন্য ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এটা হচ্ছে নিজের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এই বিষয়টি প্রথমে আলোচনা করেন মনোবিজ্ঞানী ফ্রিৎজ হেইডার্স।

১০. বিভিন্ন গোষ্ঠি বা দলে দেখা যায়, মানুষ সাধারণত বেশিরভাগের মতামতের পক্ষে থাকে। অধিকাংশের মতামতে তারা কোনো আপত্তি তোলে না। মনোবিজ্ঞান এই প্রবণতাকে বলে ‘গ্রুপ থিংক’। দলের লোকেরা সব সময়ই সংঘাত এড়াতে চায় এবং একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে চায়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো তারা যুক্তিহীন সিদ্ধান্তই মেনে নেয়। একটা গোষ্ঠির মানুষের মধ্যকার ঐক্যের চেতনা থেকেই এ ধরনের আচরণ তৈরি হয়।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত