আবার যখের ধন (পর্ব ১৩)

আবার যখের ধন (পর্ব ১৩)

ফট্‌ করে একটা বিশ্রী আওয়াজ, তারপরেই গোঁ-গোঁ! কুমার বেশ বুঝলে, কার মাথায় লাঠি পড়ল ।

জঙ্গলের ভিতরে স্যাঁৎসেঁতে ভিজে জমির উপরে সে নিজের ক্লান্ত দেহটাকে বিছিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তার অদৃষ্টে আজ বিশ্রাম নেই। শত্রুরা তাদের আক্রমণ করেছে এবং বিমল নিশ্চয়ই তাদের কবলে গিয়ে পড়েছে। কাদের ফিস্ ফিস্ করে কথাও তার কানে গেল। সে একা । এখন আত্মরক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

নিবিড় অন্ধকারের ভেতরে মাটির উপর দিয়ে খুব সাবধানে গড়িয়ে গড়িয়ে সে ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল।

হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠলো। কিন্তু শত্রুরা যে কারা, সেটা দেখবারও সময় সে পেলে না, সড়াৎ করে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়েই কুমার গুড়ি মেরে যতটা জোরে-পারা-যায়, এগিয়ে যেতে শুরু করলে। ……মিনিট পনেরো পরে যখন সে থামল, তখন কাঁটা-ঝোপে তার গা বয়ে রক্ত ঝরছে এবং গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে তার সারা দেহ থেঁতো হয়ে গেছে।

মাটির উপরে পড়ে খানিকক্ষণ কুমার কান পেতে রইল কিন্তু শত্রুর আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কতকটা আশ্বস্ত হয়ে সে শুয়ে শুয়ে হাঁপাতে লাগল–

আর ভাবতে লাগল!….- বিমলের কী হলো ? সে বেঁচে আছে, না নেই? যদি এখনো বেঁচে থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধার করবার উপায় কী?….

আচম্বিতে কুমারের মনে হলো, তার পাশেই কে যেন খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে আরো ভালো করে সে শোনবার চেষ্টা করলে ।

হ্যাঁ, নিঃশ্বাস যে পড়ছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই! কিন্তু কে এ? মানুষ না জন্তু? অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।

সন্তর্পণের সঙ্গে কুমার আবার গড়িয়ে সরে যেতে গেল এবং একেবারে গিয়ে পড়ল একটা জ্যান্ত দেহের ওপরে!–সঙ্গে সঙ্গে আঁ আঁ করে একটা বিকট চিৎকার এবং সঙ্গে সঙ্গে কুমার মাটিতে শুয়ে শুয়েই সেই দেহটার উপরে জোড়া-পায়ে লাথি মারলে!

আবার চিৎকার হলো, “ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে রে, ওরে বাবা রে।”

এ যে মানিকবাবুর গলা! ধড় মাড়িয়ে উঠে বসে কুমার সবিস্ময়ে বললে, “অ্যাঁ, মানিকবাবু নাকি?”

—“ওরে বাবা রে, গেছি রে! ওরে বাবা রে, এই রাত-আঁধারে বন-বাদাড়ে নাম ধরে কে ডাকে রে! ওরে বাবা রে, শেষটা ভূতের হাতে পড়লুম রে!”

—“মানিকবাবু, মানিকবাবু শুনুন, আমি ভূত নই, আমি কুমার।”

–এই বলেই সে পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বালালে। জোড়া-পায়ের লাথি খেয়ে মানিকবাবু তখন মাটির উপর পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন, এখন কুমারের নাম শুনেই তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন এবং চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “অ্যাঁ কুমারবাবু? আপনি?”—বলতে বলতে মনের আবেগে তিনি কেঁদে ফেললেন।

কুমার অনেক কষ্টে মানিকবাবুকে শান্ত করে বললে, “আমরা তো আপনার খোঁজেই বেরিয়েছিলুম! কিন্তু আপনি এখানে এলেন কেমন করে?”

মানিকবাবু বললেন, “আরে মশাই, সে অনেক কথা, ভাবতেও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে_উঃ!’

কুমার বললে, “ভালো করে সব পরে শুনব তখন। এখন খুব সংক্ষেপে দুকথায় বলুন দেখি, ব্যাপারটা কী হয়েছিল?”

মানিকবাবু বললেন, “আচ্ছা, তবে সংক্ষেপেই শুনুন … কাল রাত্রে তাঁবুর ভিতরে লেপমুড়ি দিয়ে তো দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছিলুম হঠাৎ আমার ঘুম গেল ভেঙে! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আমার বিছানা যেন চলে বেড়াচ্ছে! প্রথমে ভাবলুম, আমি একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখছি কিন্তু তারপরেই বুঝলুম, এ-তো স্বপ্ন নয়,

এ-যে সত্যি! লেপের ফাঁক দিয়ে উকি মারতেই দেখলুম, চাঁদের আলোয় বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমি চলেছি! আমি একটু নড়তেই গরর-গরর করে একটা গর্জন হলো, আমিও একেবারে আড়ষ্ট! ও বাবা, ও যেন বুনো জন্তুর আওয়াজ! তোষক আর লেপ-শুদ্ধ সে আমাকে মুখে করে নিয়ে চলেছে, আর আমার দেহ তার মধ্যে কোনরকমে জড়িয়ে বন্দী হয়ে আছে! এখন উপায়? জানোয়ারটাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না, লেপ আর তোষক ফুঁড়ে তার দাঁতও আমার গায়ে বেঁধেনি।…হঠাৎ জানোয়ারটা একটা লাফ মারলে, কতকগুলো ঝোপঝাড় দুলে উঠল আর আমিও ভয়ে না চেঁচিয়ে পারলুম না– সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিছানার ভেতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে একটা ঝোপের ভিতর গিয়ে পড়লুম। তাকিয়ে দেখি, মস্ত একটা সিংহ আমার বিছানা মুখে করে লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল!! আমি যে আর বিছানার ভেতরে নেই, সেটা সে টেরই পেল না। তারপর আর বেশি কথা কী বলব, সিংহটা পাছে আবার আমাকে খুঁজতে আসে, সেই ভয়ে আমি তো তখনি উঠে চম্পট দিলুম-কিন্তু কোথায়, কোনদিকে যাচ্ছি সে কথাটা একবারও ভেবে দেখলুম না। তার ফল হল এই যে, কাল রাত থেকেই পথ হারিয়ে, পদে-পদে খাবি খেয়ে বনে-বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি -বাঁচবার আর কোন আশাই ছিল না।”

মানিকবাবুকে বাধা দিয়ে কুমার বললে, “তারপর কী হলো আর তা বলতে হবে না; আমি সব বুঝতে পেরেছি।”

মানিকবাবু বললেন, “কিন্তু আপনি একলা কেন? বিমলবাবু কোথায়?”

কুমার ভাঙা-ভাঙা গলায় বললে, “বিমল এখন ইহলোকে না পরলোকে, একমাত্র ভগবানই তা জানেন।”

মানিকবাবু সচমকে বললেন, “ও বাবা, সে কী কথা?”

“চুপ বলেই কুমার মানিকবাবুর হাত চেপে ধরলে । খানিক তফাতেই জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে অনেকগুলো আলো দেখা গেল ।

মানিকবাবু চুপি চুপি বললেন, “ও কিসের আলো?”

—“আলোগুলো এইদিকেই আসছে। নিশ্চয়ই শত্রুরা আমাদের খুঁজছে।

– “ শত্রু? শক্র আবার কারা?”

—“বোধ হয় ঘটোৎকচের দল ।”

—“ও বাবা, বলেন কী! এই বিপদের ওপরে আবার ঘটোৎকচ। গোদের ওপরে বিষফোঁড়া! তাহলেই আমরা গেছি!”– মানিকবাবু একেবারেই হাল ছেড়ে দিলেন।

আলোগুলো নাচতে-নাচতে ক্রমেই কাছে এসে পড়ল – অনেক লোকের গলাও শোনা যেতে লাগল! তারপর একটা কুকুরের চিৎকার – ঘেউ ঘেউ, ঘেউ !

কুমার একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে সানন্দে বলে, “এ যে আমার বাঘার গলা ? মানিকবাবু, আর ভয় নেই।রামহরি নিশ্চয়ই লোকজন নিয়ে আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। রামহরি, রামহরি! আমরা এখানে আছি। রামহরি!”–বলতে-বলতে সে আলোগুলোর দিকে ছুটে এগিয়ে গেল এবং বলা বাহুল্য যে, মানিকবাবুও কুমারের পিছনে পিছনে ছুটতে একটুও দেরি করলেন না।

কুমারের আন্দাজ মিথ্যা নয়। সকলের আগে আগে আসছে ঘেউ-ঘেউ করতে করতে বাঘা, তারপর একদল আস্কারি বা বন্দুকধারী রক্ষী । পোর্টার বা কুলির দল লণ্ঠন হাতে করে তাদের পথ দেখিয়ে আনছে।

কুমারকে দেখেই বাঘা বিপুল আনন্দে ছুটে এসে, পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের পা দুটো দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরলে । রামহরিও মহা-আহ্লাদে বলে উঠল, “জয়, বাবা তারকনাথের জয়! এই যে কুমারবাবু, এই যে মানিকবাবু। কিন্তু আমার খোকাবাবু কোথায়?”

কুমার বিমর্ষমুখে বললে, “রামহরি, বিমল আর বেঁচে আছে কিনা জানি না।”

রামহরি ধপাস করে বসে পড়ে বললে, “অ্যাঃ! বল কী?” কুমার দু’চার কথায় তাদের বিপদের কথা বর্ণনা করলে।

রামহরি তখন দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “তাহলে আর এখানে দেরি করা নয়! হয়তো এখনো গেলে খোকাবাবুকে বাঁচাতে পারব।”

ভোরের আলো যখন গাছের সবুজ পাতায়-পাতায় শিশুর মতন খেলা করে বেড়াচ্ছে, কুমার ও তার দলবল তখন একটা ঢিপির মতন ছোট পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল।

সেই ছোট পাহাড়টার উপরে উঠতে তাদের মিনিট-তিনেকের বেশি লাগল না। তারপরেই কুমারের চোখে যে-ভীষণ দৃশ্য জেগে উঠল, আমরা আগের পরিচ্ছেদেই তা বর্ণনা করেছি। কুমার এবং আর সকলে কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল ……প্রায় ত্রিশ ফুট নিচে, বাওয়ার গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রামু তখন মহাউৎসাহে বিমলের গলায় ফাঁসির দড়ি পরাতে ব্যস্ত ।

আর অপেক্ষা করার সময় নেই। রক্ষীদলকে ইঙ্গিত করে কুমার নিজেও একটা বন্দুক নিয়ে লক্ষ্য স্থির করতে লাগল।

মরা দেঁতো ফাঁসির দড়ি ধরে বিমলকে শূণ্যে টেনে তুলতে উদ্যত হল, সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে কুমারের, তারপর রক্ষীদের বন্দুক ঘনঘন অগ্নিবর্ষণ শুরু করলে।

দেখতে দেখতে শত্রুরা যে যেদিকে পারলে, প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলে, ঘটনাস্থলে রইল খালি বিমল আর জনকয়েক হত ও আহত জুলু আর কাফ্রি-জাতের লোক। কুমার ও রামহরি একছুটে নিচে নেমে গিয়ে বিমলের গলার বাঁধন খুলে দিলে।

বিমল হাসতে হাসতে বলল, “মানিকবাবুর কাকার অনুগ্রহে দিব্যি স্বর্গে যাচ্ছিলাম, তোমরা এসে আমার স্বর্গ-যাত্রায় বাধা দিলে কেন?”

পুরাতন ভৃত্য রামহরি ধমক দিয়ে বললে, “জ্যাঠামি করতে হবে না ঢের হয়েছে।”

কুমার বললে, “ওরা তোমাকে ফাঁসিতে লটকে দিচ্ছিল কেন বিমল?’

—“গুপ্তধনের ম্যাপ কোথায় আছে বলি নি বলে ।”

কুমার তৎক্ষণাৎ উদ্বিগ্ন স্বরে বললে, “সর্বনাশ! তাঁবুতে এখন বেশি লোকজন তো নেই? ওরা যদি এখন গিয়ে ম্যাপের লোভে আবার আমাদের তাঁবু আক্রমণ করে?”

বিমল নিশ্চিন্তভাবেই বললে, “তাহলে তাঁবুতে তারা ম্যাপ খুঁজে পাবে না।”

–“খুঁজে পাবে না? ”

— “না” — বলেই বিমল বসে পড়ল এবং নিজের জুতোর গোড়ালির এক পাশ ধরে বিশেষ এক কায়দায় টান মারলে। অম্‌নি গোড়ালির খানিকটা বাইরে বেরিয়ে এল এবং ভিতর থেকে সে একখণ্ড কাগজ বার করে কুমারকে দেখালে।

কুমার সবিস্ময়ে বললে, “ও কী ব্যাপার?”

বিমল বললে, “ম্যাপ। আমি অর্ডার দিয়ে কৌশলে এই জুতো তৈরি করিয়েছি। আমার জুতোর গোড়ালির একপাশ ফাঁপা….গুপ্তধনের ম্যাপ ওর মধ্যেই পরম আরামে বিশ্রাম করে!”

রামহরি বললে, “ছি ছি, খোকাবাবু! ওটা তো তোমার কাছেই ছিল, তবু ওটা তাদের হাতে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা কর নি? তুচ্ছ গুপ্তধনের জন্যে –”

বিমল বাধা দিয়ে বললে, “না রামহরি, না! সে শয়তানদের তুমি চেনো না,—আমি ম্যাপখানা দিলেও তারা আমাকে রেহাই দিত না! তাই আমি প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করি নি, বুঝেছ?…..যাক ও-কথা। এখন তাঁবুতে ফেরা যাক। কাল সকালেই আমরা উজিজি যাত্রা করব।”

 

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ১২)

আবার যখের ধন (পর্ব ১৪)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত