বিমল জাহাজের ডেকের ওপর খানিকক্ষণ ছুটোছুটি করেও কাপ্তেনের দেখা পেলে না; তারপর খবর পেলে, কি কাজের জন্যে কাপ্তেন জাহাজের ইঞ্জিন-ঘরে গিয়েছে।
সে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেল। কাপ্তেন ইঞ্জিন-ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, এমন সময়ে বিমল তাকে গিয়ে ধরলে ।
বিমলকে অমন হন্ত-দন্ত হয়ে আসতে দেখে কাপ্তেন বললে, “ব্যাপার কী?”
বিমল খুব সংক্ষেপে সব কথা খুলে বললে। কাপ্তেন এক লাফ মেরে ইংরেজিতে একটা শপথ করে বললে, “অ্যাঁ, বল কী? সিন্দুকের ভেতর শত্রু! সে মানুষ না, ভূত?”
বিমল বললে, “সেটা এখনি জানতে পারা যাবে। সায়েব, তোমার লোকজনদের ডাকো-” বলেই পিছন ফিরে কুমার আর রামহরিকে দেখে বলে উঠলে, “একি, তোমরাও এখানে এসেচ কেন? যাও যাও, সেখানে পাহারা দাও গে। ছি ছি, তোমাদের কি বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছুই নেই?”
কুমার আর রামহরি অপ্রস্তুত হয়ে আগে আগে ছুটল, কাপ্তেনও চেঁচিয়ে লোকজনদের ডাকতে-ডাকতে তাদের পিছনে পিছনে চলল!
কাপ্তেনের হাঁক-ডাক শুনে অনেক লোক এসে জুটল। তারপর দলে খুব ভারি হয়ে সবাই যখন যথাস্থানে গিয়ে হাজির হল, তখন সিন্দুকও দেখা গেল না, কাফ্রি তিনজনও অদৃশ্য!
বিমল হতাশভাবে বললে, “ঘটোৎকচ আবার আমাদের কলা দেখালে! কুমার, রামহরি, তোমাদের বোকামিতেই এবারে সে পালাতে পারলে!”
কুমার দোষীর মতন সঙ্কুচিত-স্বরে বললে, “আমাদের দোষ আমরা মানচি। কিন্তু মানিকবাবু কোথায় গেলেন? তিনি তো এইখানেই ছিলেন।”
বিমল বললে, “তাইতো! মানিকবাবু কোন বিপদে পড়লেন না তো? মানিকবাবু, মানিকবাবু!”
ডেকের ওপরে একটা মস্ত কেঠো বা কাঠের বালতি উপুড় হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ সেটা নড়ে উঠল। কাঠের বালতিকে জীবনলাভ করতে দেখে বাঘা ভয়ানক অবাক হয়ে গেল এবং বালতির চারিদিক সাবধানে শুকে চিৎকার শুরু করে দিলে।
বালতির একপাশ একটু উঁচু হল এবং ফাঁক দিয়ে আওয়াজ এল, “ও বিমলবাবু, আপনাদের বাঘাকে সাম্লান, দম বন্ধ হয়ে আমি হাঁপিয়ে মারা যেতে বসেচি যে!”
বাঘা বালতির ফাঁকে নাক ঢুকিয়ে দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললে, “গরর্র্র্, গরর্র্র্।” ফাঁকটা আবার বন্ধ হয়ে গেল ।
কুমার বাঘার কান ধরে টেনে আনলে, বিমল কেঠোটা টেনে তুলে ধরলে এবং ভিতর থেকে হাপরের মতন হাঁপাতে হাঁপাতে গলদঘর্ম মানিকবাবু বেরিয়ে পড়লেন।
কুমার বললে, “মানিকবাবু, ওর মধ্যে ঢুকে কি করছিলেন?”
মানিকবাবু গায়ের ধুলো ঝাড়তে-ঝাড়তে বললেন, “প্রাণ বাঁচাচ্ছিলুম মশাই, প্রাণ বাঁচাচ্ছিলুম! বাইরে থাকলে ঘটোৎকচ কি আর আমাকে ছেড়ে কথা কইত?”
কাপ্তেন-সায়েব এতক্ষণ রেলিঙের ধারে দাড়িয়ে চোখে দূরবীণ লাগিয়ে কি দেখছিল, হঠাৎ দূরবীন নামিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, “পেয়েচি পেয়েচি,—তাদের দেখা পেয়েচি!” বিমল ও কুমার একদৌড়ে কাপ্তেনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
কাপ্তেন একদিকে আঙুল তুলে দেখালে, একখানা নৌকা তীরের দিকে বয়ে চলেছে, তার ওপরে মাঝি-মাল্লার সঙ্গে তিনজন কাফ্রি আর সেই সিন্দুকটা রয়েছে!
কাপ্তেনের হুকুমে তখনি জাহাজের দুখানা বোট নামিয়ে জলে ভাসানো হল এবং কয়েকজন খালাসী, জাহাজী গোরার সঙ্গে কাপ্তেন, বিমল ও কুমার গিয়ে সেই বোটের উপর চড়ে বসল। বোট বেগে এগুতে লাগল।
খানিকক্ষণ পরে বিমল বললে, “ঐ সেই ঠোঁটকাটা ঢ্যাঙা কাফ্রিটা সিন্দুকের ওপরে। ওরা বুঝতে পেরেচে যে, আমরা ওদেরই পিছনে যাচ্চি।”
কুমার বললে, “কিন্তু ওদের ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না যে, আমাদের দেখে ওরা কিছু ভয় পেয়েছে।”
কাপ্তেন তার রিভলভারটা নাড়তে নাড়তে বললে, “ঐ ঢ্যাঙা কাফ্রিটাকে দেখলেই আমার রাগ হয়। ওদের অপরাধের প্রমাণ পেলে কারুকে আমি ছাড়ব না। সব পুলিশের কাছে চালান করে দেব!”
জাহাজের বোট দুখানা কাফ্রিদের নৌকার খুব কাছে গিয়ে পড়ল। একটা কাফ্রি সেই মড়া-দেঁতো কাফ্রির কানের কাছে মুখ এনে কি বললে। কিন্তু মড়া দেঁতো কোন জবাব দিলে না, বিশাল বুকের ওপরে দুখানা বিপুল বাহু রেখে কালো ব্রোঞ্জের মূর্তির মতন স্থিরভাবে সিন্দুকের ওপরে বসে রইল।
বিমলের গা টিপে কুমার বললে, “বিমল, দেখ, দেখ!”
_“কী?”
—“ঐ যে আর একখানা নৌকা যাচ্ছে, তার ওপরে তিনজন লোক,–ঠিক যেন বাঙালির মতন দেখতে ।”
বিমল অল্পক্ষণ তাদের দেখে কাপ্তেনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঐ নৌকার লোকগুলোও কি আমাদের জাহাজে ছিল?”
কাপ্তেন দূরবীণ কষে ভালো করে তাদের দেখে বললে, “হ্যাঁ, ওরাও বাঙালি।”
—“কিন্তু জাহাজে তো ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি!”
—“না হওয়ারই কথা। ওদের ব্যবহার কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হত । ওরা কেবিনের বাইরে বড়-একটা আসত না, কারো সাথে মেলামেশা করত না। ওরা নাকি ইষ্ট আফ্রিকায় ব্যবসা করতে যাচ্ছে …হ্যাঁ, আর—একটা কথা মনে হচ্ছে বটে! একদিন ঐ ঢ্যাঙা কাফ্রি-শয়তানটাকে ওদের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলুম!”
বিমল মৃদুস্বরে বললে, “কুমার, আমার বিশ্বাস ঐ বাঙালি তিনজনের মধ্যে একজন হচ্ছেন আমাদের মানিকবাবুর গুণধর ছোট কাকা । মানিকবাবু আমাদের সঙ্গে থাকলে নিশ্চয়ই ওকে চিনতে পারতেন!”
কুমার বললে,“আমরা কিন্তু ভবিষ্যতে ওকে দেখলে আর চিনতে পারব না–এত দূর থেকে ভালো করে নজরই চলচে না! দেখ–দেখ, ওরা নৌকার বেগ বাড়িয়ে দিলে! ওরা বুঝতে পেরেছে যে, আমরা ওদের লক্ষ্য করচি!”
কিন্তু আর সেদিকে দৃষ্টি রাখবার অবকাশ ছিল না, কারণ জাহাজের বোট দুখানা তখন কাফ্রিদের নৌকার দুপাশে এসে পড়েছে!
কাপ্তেন দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “এই! নৌকা থামাও!”
কাফ্রিদের নৌকা থেমে গেল। কাপ্তেন, বিমল ও কুমার এক এক লাফে নৌকার উপরে গিয়ে উঠল, কাফ্রিদের কেউ কোন আপত্তি করলে না!
মড়া-দেঁতো তেমনি অটলভাবেই সিন্দুকের ওপরে বসেছিল। কাপ্তেন হুকুম দিলে, “তুমি উঠে দাঁড়াও।”
মড়া-দেঁতোর চোখ বাঘের চোখের মত জ্বলজ্বল করে উঠল কিন্তু পরমুহূর্তেই কাপ্তেনের হাতে চকচকে রিভলভার দেখে তার জ্বল জ্বলে চোখের আগুন নিভে গেল। যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই সে সিন্দুকের ওপর থেকে উঠে দাঁড়াল।
কাপ্তেন একটানে সিন্দুকের ডালাটা খুলে ফেলে মহা-আগ্রহে তার ভিতরটা দেখতে লাগল, তারপর হতাশভাবে বিমলের দিকে মুখ ফেরালে।
বিমল হেঁট হয়ে দেখলে, সিন্দুকের ভিতরে কেউ নেই।
কাপ্তেন বললে, “কিন্তু সিন্দুকের ভিতরে এত লোম কেন ? এ কিসের লোম ? এর ভিতরে কি ছিল ?”
মড়া-দেঁতো কোন জবাব দিলে না। মুখটা একবার খিঁচিয়ে নৌকার এক কোণে গিয়ে বসে পড়ল।
কাপ্তেন বিমলের দিকে ফিরে বললে, “তোমার মোড়কে যে লোমগুলি দেখেছিলুম, এগুলোও ঠিক সেই রকম দেখতে। এ সিংহ, বাঘ, ভালুক, জেব্রা, হরিণ কি বানরের গায়ের লোম নয়। তবে এ কোন জীবের লোম?”
বিমল কি জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু কি ভেবে চুপ মেরে গেল।
কাপ্তেন হতাশকণ্ঠে বললে, “রহস্যের কোন কিনারা হল না। এই কাফ্রি-শয়তানরা আগেই সাবধান হয়ে সিন্দুকে যে ছিল তাকে সরিয়ে ফেলেচে । চল, আর এখানে থেকে লাভ নেই!’
কুমার চারিদিকে চেয়ে দেখল, কিন্তু যে-নৌকায় তিনজন বাঙালি ছিল তাদের আর কোথাও দেখতে পেলে না।
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……
আবার যখের ধন (পর্ব ৬)
আবার যখের ধন (পর্ব ৮)











