গল্পের আড়ালের গল্প

গল্পের আড়ালের গল্প

সেদিন রাত ১২ টা হবে প্রায়। রুমে একা শুয়ে ছিলাম। ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা দরজা খোলার। বলে রাখা ভাল আমার রুমের সাথে এটাস্ট বাথ্রুম আছে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারনে ঢাকার একটা ফ্লাটে কয়েক জন ছাত্র মিলে থাকি । বাথরুম থেকে কেউ একজন আমার রুমে ঢুকছে।আগত লোকটার দিকে চাইতেই মৃদু হেসে বলল, আমি পাশের রুমের শাহেদের বন্ধু। কিছুটা অবাক হলাম কারন পাশের রুমে শাহেদ নামে কেউ থাকে না। এরপর আমার চোখ গেল দরজার দিকে। আমি দরজা লক করে ঘুমিয়ে যাই। আজও দরজাটা লক করা ছিল। তাহলে লোকটা ভিতরে এল কীভাবে? লোকটা তো মানুষ না! অন্যকিছু?

আমি এবার ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে কথা বলতে পারছিলাম না। লোকটা এবার বলল, টের পাইছেন তাইলে আমি মানুষ না।

আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালাম।
লোকটা বলল, রাস্তা দিয়া যাওনের সময় আপনের রুমের লাইট জলা দেইখা ঢুইকা পরছি। আপনার সাহস আছে। এর আগে যার লগেই দেহা করছি হেই অজ্ঞান হইছে। ঘটনাটা আপনারেই বলা যায়।
লোকটা গায়ের জামাটা কিছুটা তুলে দেখাল। পেটের ভিতর ছুরি ঢুকিয়ে দিলে যে রকম ফুটো হয় ওরকম একটা ফুটো। তাতে রক্ত ভরে আছে। পুরনো রক্ত। লোকটা রুমের ফ্লোরেই বসে গল্প শুরু করে দিল।

আমার নাম বাবু। মানসে আমাক ভোতা বাবু কয়া ডাকত। ছোড বেলায় আমার বাবায় দুই নাম্বার বিয়া কইরা আমার মায়রে খেদায় দিছিল। হের পর আমার মায় এক্সিডেন্টে মরল। তারপর থেইকা পকেট কাটছি। বড় হয়্যা ছিনতাই স্টার্ট করলেম। প্রথম দিন ওস্তাদে ভোতা ছুরি দিছিল। পাবলিকে ছুরিত ধার নাই বুঝবার প্যারে আমাক সেই কি মাইর। পরে ওস্তাদ কলো মাইর না খালি এ লাইনে টিকা যায় না তাই ওস্তাদ ইচ্ছা করেই কামডা করছিল। তখন থ্যেকাই সবাই আমাক ভোতা বাবু কয়া ডাকে।আমরা যারা ছিনতাই করত্যাম ত্যাগো একটা গ্রুপ আছিল।আমি ছিলাম দুই নম্বর রোডের লিডার। পাবলিকের ট্যাকা পয়সা মারলেও আমাগো গ্রুপের কিছু নীতি আছিল। এই যেমন ধরেন আমরা বাচ্চা আর মহিলার গায়ে হাত দিতাম না। হ্যারা ট্যাকা না দিতে চাইলে দুই তিনটা ঝারি দিলেই কাম হইত। আর মহিলাগো দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ত। কিন্তু কি করমু কন আমি যে ছিনতাই করি। মাঝে মাঝে পাশের এলাকার গ্রুপ এসে ঝামেলা করত। আমরা খেদায়া দিতাম। ওরা ট্যাকার জন্যে রেপ, মার্ডার এমন কোন কাম নাই যেটা করবার পারে না। হেই দিন ছিল সুক্কুর বার। ছুটির জন্যে পাবলিক রাস্তায় কম চলাফেরা করে। ইনকাম কম তাই আমাগো গ্রুপের সবাই এদিন ঘুমায়া পড়ে। আমি মাঝে মাঝে ডিউটি করি। একটা মহিলা আসতেছিল।

আমি সামনে গিয়া খারাইলাম। দেহি কাল’ই এই মহিলার সব কাইরা নিছি। তাই আজ ছাইড়া দিলাম। মহিলাডা কিছুদুর যাওয়ার পরে একটা মটরসাইকেল আইসা থামল। ওরা মহিলাটারে জোর করে ধইরা লেকের ঝোপে নিয়ে যেতে ধরল। আমি সবগুলারে চিনি। ওরাই আমাগো পাশের এলাকার গ্রুপ। এগো সাথে আমাগো ভেজাল ম্যালা দিনের। মাঝে মাঝে এলাকায় দেখলেই হগলে এক হইয়া খেদায়া দেই। কিন্তু আজ আমাগো গ্রুপের যার যার জায়গায় সবাই ঘুমাইছে। কল দিলেও পাওন যাইব না। আর ওগো দলে আছে ৩-৪ জনের মত। একা যদি যাই তাইলে একবারে পেটে চালায়া দিব। মহিলাডা আমারে ভাই বাচান বইলা চিৎকার দিতেছিল। এইখানে কিছু করন যাইব না বইলা আমি রাস্তা ছাইরা যাইতেছিলাম। কিন্তু মহিলাডা আমারে আরও জোরে ভাই বাচান বাচান বইলা ডাকতেছিল। আমার মায়েও নাকি এক্সিডেন্টের পরে বাচার লাইগা কত চেস্টা করছে। কিন্তু থানার ঝামেলার ভয়ে ভয়ে কেউ হাসপাতালে নিয়া যায় নাই। মনডায় কইল যাই কি হয় হইব। সাহস কইরা গিয়া কইলাম মাইয়াডারে ছাইরা দে। নাইলে কিন্তু আজ খবর আছে। ওরা কইল বাবু যা কইলাম। নাইলে আমাগো ম্যাজাজ খারাইলে তোরে ছারমু না। একজনে মা তুইলা গালি দিল।আমার নিজের মেজাজটাই খারাইয়া গেল। ছুরিটা নিয়ে গেলাম তেড়ে। আমার ছুরি নেওয়া দেইখা ওরা মাইয়াডারে ছাইরা আমারে ধরে আইল। ওগো সামনে ইচ্ছামত ছুড়ি ঘুরাইলাম দুইজনরে কাইত করলাম। কিন্তু একজন পিছন থেইকা লাঠী দিয়া এমুন বাড়ি দিল সহ্য করবার পারি নাই। পইরা গেলাম। এরপর ওগোর পালা। দুইজনে আমার প্যাটে ছুরি দিয়া প্যাচ দিল। কিছুক্ষন বাইচা ছিলাম। ছিনতাইকারী বইলা চিতাকার শুইনাও কেউ বাচায় নাই। আমি কিন্তু শান্তিত মরবার পারছি এই ভাইবা যে একটা ফালতু জীবনের বিনিময়ে একটা ভাল মানুষের জীবন বাচাইছি। বলেই লোকটা মিশে গেল।

এরপর আমার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেরে উঠে দেখি দরজাটা লক করা আর বাথরুমের দরজাটাও খোলা। কিন্তু লোকটা নেই। যেহেতু ঘুমিয়ে ছিলাম তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম ওটা স্বপ্ন ছিল। আর আমি মাঝে মাঝে বাথরুমের দরজা লক করতে ভুলে যাই।

কয়েক দিন পর অনলাইনে পত্রিকা পড়ার সময় স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল। নেটে ভোতা বাবু, ছিনতাই ইত্যাদি লিখে সার্চ দিলাম। কিন্তু ভোতা বাবু নামে কোন সার্চই আসছিল না। অবশেষে ছিনতাইয়ের নিউজগুলো পড়া শুরু করলাম। দুবছর আগের একটা ছিনতায়ের খবরে চোখ আটকে গেল। ছিনতাইকারীদের দু-গ্রুপের সংঘর্ষে ছিনতাইকারী ভোতা বাবু নিহত। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটাও সম্ভব? তবে কিছু সত্য ঘটনা মিথ্যার আড়ালে চাপা রয়ে যায়। যেমনটা চাপা পড়ে গেছে ভোতা বাবুর আত্যত্যাগের গল্পটা।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত