‘বৃষ্টি ও কদম’

‘বৃষ্টি ও কদম’

এক.(মৃত্যুর পাশে কদম)
এই পাওয়ারহাউজের রাস্তাটা বড় অদ্ভুত! কিছু একটা হলেই লোকের ভিড় জমে যায়। সময়টা ভোর হোক বা সন্ধ্যে। আর এ তো রাস্তার ধারে পড়ে থাকা লাশ দেখা! পুরুষ লাশটার মুখে রক্ত ওঠা, ঠোঁটের কোণ বেয়ে তরল রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার দাগ। মাথার একটা পাশ থেতলে গেছে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য মৃত, তবু কি বোটকা ইঁদুর পচা গন্ধ আসছে লাশের অক্ষত শরীর থেকে! লাশের পাশে পড়ে আছে সাতটা কদম ফুল…!!!

দুই.(অনুভূতির আপেক্ষিকতা)
-তোর তো মাদকের নামে নাম রে! এটা একটা নাম হলো! ফালতু।
আমার কথা শুনে আফিম মন খারাপ করেছে বলে মনে হয় না। বরং নেশাগ্রস্থ মানবীর মত ওর চোখ মুখ হেসে ওঠে। আমি আবার ওকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করি, 
-তুই জানিস,আফিম একটা ড্রাগস ?
-জানি, আপনি তো আমাকে দেখলেই এই কথা বলেন |
-আফিম কিভাবে নেয় জানিস? 
আফিমের চোখে মুখে কৌতুহল,
-কিভাবে নেয়?
– আফিম নেয় ইঞ্জেকশন দিয়ে, আবার সিরাপ হিসেবেও পাওয়া যায়, আবার আফিম সাপোজিটরি ও আছে….!!!

আফিম বিমর্ষ চোখে আমার দিকে তাকায়,
– একটু পরে বলে, ইস….!!…আমার কাছে যদি আফিমের সিরাপ থাকত…!!! আফিম সিরাপ খাইতে খুব মজা, তাই না??
আমি হাসি। আফিম খুব সরল। আফিম নাম টা ওর সাথে যায় না। প্রায় একবছর ধরে ওকে দেখছি। ওর সাথে কথা বললেই নেশার ঘোরে উদাস লাগে আমার…!!
আমি দার্শনিক স্টাইলে বললাম,” এই মহাবিশ্বের সব কিছুই আপেক্ষিক.. মজা পাওয়ার বিষয় টাও আপেক্ষিক…!!! একজনের কাছে মজা লাগলে, তা অন্যকারো কাছে মজাদার নাও হতে পারে!”
_ সেটা আবার কিরকম…??
-আসলে সব অনুভূতি ই আপেক্ষিক…!! ধর, তুই প্রায় ই মদিনা হোটেলে গিয়ে তান্দুরি আর চিকেন গ্রিল খাস। সেটা তোর কাছে অমৃতের মত লাগে। কিন্তু তুই যদি কোন এক দিন স্টার হোটেলে গিয়ে তান্দুরি বা চিকেন খাইস, তাহলে সেটা তোর কাছে মজাদার লাগতেও পারে, নাও পারে। কারণ এইক্ষেত্রে তোর মস্তিষ্ক খাওয়ার সময় স্বাদের একটা সাপেক্ষবাচক তুলনা করবে..!! তুই প্রায়ই মদিনা হোটেলে যেই তান্দুরি আর চিকেন খাইতি, সেটার সাথে তুলনা করবে… যদি সেই স্বাদের থেকে সুস্বাদু হয়.. তাহলেই তোর কাছে স্টার হোটেলের খাবার মজা লাগবে..!! কিন্তু তুই যদি নিম পাতার সাথে স্টার হোটেলের তান্দুরি-চিকেনের তুলনা করিস, তাহলে তা সত্যিই অমৃত….!!! তাই একই জিনিস একইসাথে মজাদার আবার একইসাথে বিরক্তিকর…!! এটাই হচ্ছে আপেক্ষিকতা….. মজা না….??!!!!
-ভাই, আপনি কি গাজা খাইছেন…??
-বুঝলাম, ও কিছু বুঝেনি….
হঠাৎ আফিম উঠে দাড়াল…!!! কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল….

তিন.(বোতল বন্দি আফিম)
-আপুকে বলবেন, সাতটা কদম ফুল দিয়ে গেলাম….!!, ফুল দিয়েই চলে যাচ্ছিল আফিম…..
আমি টের পাই বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঘ্রাণের মাদকতায় ছুটির সকালটা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠছে। যেন আফিম এর ঘোরে ডুবে আছি….!!!
-আমি বললাম, কি রে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
-হ্যাঁ, সেই কোন সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আপনি টের পাননি?
-না। ঘুমালাম তো পুরো সকাল।
ঘুমের জড়তা ছেড়ে আমি বাথরুমের দিকে এগোতে লাগলাম….

-আমি তাহলে যাই সাকিব ভাই…..
আফিম দরজার বাইরে পা রাখতেই বৃষ্টির ঘ্রাণ মিইয়ে আসে। আফিমের মাদকতা যেন মিইয়ে যাচ্ছে..!! ঠিক তক্ষুণি কি যে একটা হয় আমার, আমি ছুটে গিয়ে আফিম কে বোতলে পুরে ফেলি….!!!
খানিক পরে বোতলবন্দি আফিমের তীব্র মাদকতায় চারপাশটা মোহময় হয়ে ওঠে! আফিমের কান্নাভেজা মুখে এখন বৃষ্টি ভেজা মাটি আর কদমের ঘ্রাণ!

চার.(আফিমের রূপভেদ, কদম)
আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, সীমাহীন অবশতা। হাত পা নাড়াতে পারছি না। আমি কি দাঁড়িয়ে আছি? না শুয়ে? মনে হচ্ছে অতলে শরীর ডুবে গেছে। অনেক কষ্টে ডান হাত উঠাই। ঠোঁটের কাছটা উসখুস করছে। ঠোঁটে হাত রাখি। এ কি ঠোঁটের কোণে রক্ত! আমি ঠিকই দেখেছি। খানিক আগে স্বপ্নে দেখা রক্তপানরত মুখটা তবে আমারই ছিল! আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করি।

পায়ের তলায় থকথকে কি? চোখ খুলতেই দেখি পায়ের তলায় লম্বা লম্বা কি যেন কিলবিল করছে। জোঁক! এত বড় বড় জোঁক এল কোথা থেকে? আমার পা বেয়ে সারি সারি জোঁক উঠছে। কি যে ভয় করছে! হঠাৎ চারপাশে অদ্ভুত ফিসফিসানি, সাকিব ভাই, ও সাকিব ভাই, সাতটা কদম ফুল দিয়ে গেলাম । বার বার একই ফিসফিসানি, সাকিব ভাই, ও সাকিব ভাই, সাতটা কদম ফুল দিয়ে গেলাম..!!! আপুকে দিয়ে দিয়েন….

আহ, কি কষ্ট ! আপু কে? সাকিব কে? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কোথায়? আশেপাশে কেউ কি আছে? কে আছে আমার? আর কোথায় কদমের ঘ্রাণ? চারপাশে ইঁদুর পচা চিমসে গন্ধ! হায় আল্লাহ, আমার মরণ দাও। অন্ধকার কি এতই ভয়াবহ! এতই দুঃসহ! অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যেতে যেতে আমি আবার সেই ফিসফিসানি শুনতে পাই, সাকিব ভাই, ও সাকিব ভাই, সাতটা কদম ফুল দিয়ে গেলাম… আপুকে দিয়ে দিয়েন…

অসহ্য! আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি। আমার কন্ঠনালী চিরে শব্দের বদলে রক্ত বের হয়ে আসে। কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। কি অদ্ভুত! হঠাৎ আলোয় ঘরটা ভরে গেল। আমি আমার ঘরেই আছি, তার মানে আমি বেঁচে গেলাম! চোখ মেলতেই আমি আঁতকে উঠি। কি অদ্ভুত চারপাশে এত শত শত হাজার হাজার কদম ফুল কোথা থেকে এল? ভেজা মাটি আর কদম ফুলের ঘ্রাণ….!!! ধীরে ধিরে ঘ্রাণ আরো তীব্র হচ্ছে….চারদিক আফিমের গন্ধে তীব্র মাদকতায় ভরে উঠছে….!!! আফিমের তীব্রতায় আমার ঘোর লেগে যায়…যেন হারিয়ে যাচ্ছি মহাকালের কোন এক ক্ষুদ্র প্রান্তরে….!!!
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম…
আবার সেই গাঢ় অন্ধকার! আবার সেই ফিসফিসানি!
সাকিব ভাই, ও সাকিব ভাই, সাতটা কদম ফুল দিয়ে গেলাম………

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত