দ্য ওআরজিঃজিপার

দ্য ওআরজিঃজিপার

ডিসেম্বর ১৯৯৭ A4 (আফটার ওয়ার্ল্ড ওয়ার ফোর)

সেন্ট্রাল সিটি, কিংডম অফ প্যাসিফিয়া

বিল্ডিংটা বহুতল। পুরোটা কাচে ঘেরা, যদিও বাইরে থেকে ভেতরের কোন দৃশ্য চোখে পড়ে না একদমই।

ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে হাতের ছুড়িটা থেকে। হাঁটুর কাছটায় প্যান্টের কাপড়ে মুছে নিল সেটা। কাঁধ থেকে তুলে

নিল অ্যাসল্ট রাইফেল। চেক করে আবার আগের জায়গাতে রেখে এগোল।

প্রথমেই মেইনগেটটা লাগিয়ে দিল। সাথে আনা বড় বড় দুটো ইলেক্ট্রনিক লক লাগিয়ে দিলো সেটাতে। এগুলো খুলতে

গেলে এখন ষোল অংকের দুটো সংখ্যা প্রয়োজন হবে পাসওয়ার্ড হিসেবে। চট করে পাসওয়ার্ডটা ক্র্যাক করা সহজ

নয়। কয়েক লক্ষ্য ভ্যারিয়েশন আছে।

অবশ্য এটা তেমন কোন সমস্যা নয় ধ্রু’র জন্য। এর আগেও এখানে এসেছে। এবং পাসওয়ার্ডটাও মনের পর্দায় ভালোভাবেই আঁটা আছে।

কাজ শেষ করে ঘুরলো। মেঝেতে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ খোঁজার পরে অবশেষে পেল কাঙ্ক্ষিত সাইন। মেঝেতে পড়ে থাকা কয়েকটা সবুজ রঙের ফোঁটা। হাঁটু গেঁড়ে বসে চেক করল। খুশীতে মনের ভেতরে জোয়ার বয়ে গেল যেন।
রক্ত এগুলো! দানবগুলোর রক্ত!

হাতের অ্যাসল্ট রাইফেলটা শক্ত করে ধরল। যে কোন সময় দেখা দেবে সবুজ রক্তের মালিকের স্যাঙ্গাৎরা। খুব বেশীদুর এগিয়ে যেতে পারেনি সে, কারণ রক্তের ফোঁটাগুলো এখনো কাঁচা।
হলওয়ে ধরে এগুতে শুরু করল। রক্তের ফোঁটাগুলোকে ফলো করছে।

দানবটাকে শেষ না করা অবধি কোন শান্তি নেই ওর। বর্তমানে এটাই ওর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। শুধু একটা জিনিসই জানে, দানবগুলোকে শেষ করে দিতে হবে। যেভাবেই হোক তাদেরকে ট্র্যাক করে একটা একটা করে ধরে বের করে নিতে হবে ওদের জীবনীরস। তা না হলে এই পৃথিবীতে যে অল্প সংখ্যক হোমো সেপিয়েন্স এখনো বেঁচে আছে, তাদেরকে হারাতে হবে।
এটা একটা যুদ্ধ! ইট’স আ ব্লাডি ওয়র!
যদিও গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো, হতে পারতো ওর রিভেঞ্জ স্টোরি। কিন্তু এটা তা নয়।
গল্পটা ভিন্ন। এটা যুদ্ধের গল্প এবং যুদ্ধটা টিকে থাকার। সারভাইভালের ওয়র এটা।

জুলাই ১৯৯৫ A4
ধীরে ধীরে চোখ মেলল ধ্রু। ভোরের কোমল রোদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে চোখের উপর। কোনমতে বিছানা থেকে শরীরটা তুলল। চোখ দুটো জ্বলছে খুব। অতিরিক্ত কম ঘুমানোর ফল এটা।

রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বাইরে ছিল ও। ফ্ল্যাটে পৌঁছে ভেবেছিল হালকা রেষ্ট নিয়ে কিছু একটা বানিয়ে খাওয়াদাওয়া করবে। কিন্তু বিছানা পর্যন্ত পৌঁছানোর মতো শারীরিক বা মানসিক শক্তি কোনটাই ছিল না। বেডরুমের সোফায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এখন উঠল, বিছানা থেকে।
কাজটা কার বুঝতে অসুবিধে হলো না।

“ধ্রু, ঘুম ভেঙ্গে গেছে তোমার?” মিষ্টি একটা কন্ঠ ভেসে এল পেছন থেকে।

বিছানার যেদিকে মাথা রাখে ধ্রু, সেদিকেই দরজাটা। হাসিমুখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রু’র স্ত্রী ফ্লোরা। ভেলভেট কালারের একটা পোষাক পড়ে আছে সে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কাঁধে।
“হুম,” পাল্টা হাসল ধ্রু।

বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো ফ্লোরা। “শুনেছো, গত রাতে তিন কিংডমের প্রেসিডেন্টদেরকে খুন করা হয়েছে। নোভাডা, নর্থ ইউনিয়ন আর ক্রেডিয়ার প্রেসিডেন্ট এসাশিনেট হয়েছেন।”

এক হাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল ধ্রু। “বিশ্বাস করো, এর পেছনে আমার হাত নেই। আমি গত রাতে শুধু রেকি করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।”

গম্ভীর শোনালো ফ্লোরার কন্ঠ। “তুমি বলেছিলে এই কাজ ছেড়ে দেবে।”

স্ত্রীর পেটে হাত রাখল ও। “আর দুটো… বিলিভ মি।” একটু থেমে আবার শুরু করল। “জানি, কাজটাকে তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু এছাড়া আর করার কিছু নেই-ও। এখন সময়টা কঠিন, জব পাওয়াটা স্বপ্ন সত্যি হবার মতোই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট একটা কোম্পানী দাঁড় করাতে গেলেও যে ক্যাপিটাল দরকার, সেটুকু নেই আমাদের। এসাশিনেশনে আজকাল মিলিয়ন মার্কও পাওয়া যায়না। অথচ অন্তত ত্রিশ লাখ মার্ক না হলে… আমার কাছেও এত মার্ক নেই। আর তাছাড়া, জুনিয়র ধ্রুর কথাও তো ভাবতে হবে, তাই না?”

ধ্রুর ঠোঁটে হাত রাখলো ফ্লোরা। অনুনয়ের সুর ফুটে উঠলো ওর কন্ঠে, “আর দুটো… রাইট?”

“আই প্রমিজ।” ওকে জড়িয়ে ধরল ধ্রু। চুমু খেলো ঠোঁটে। “এই দুটোই হবে আমার শেষ কাজ। তারপর ফিফথ ওয়ার্ল্ডের কোন দেশে গিয়ে ছোট্ট একটা কোম্পানী শুরু করবো। আমাদের বাচ্চাকে সুন্দর একটা পরিবেশে বড় করবো।”

“এনাইডা কেমন হবে? শুনেছি কিংডমটা নাকি স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখনো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের কোন কিংডমের নজর পড়েনি ওখানে। সময়মতো ওখানে পাড়ি দিয়ে বড় কোন এলাকা ক্লেইম করতে পারলে ভালো হবে আমাদের জন্য। সুন্দর একটা পরিবেশ হবে জুনিয়র ধ্রুর জন্য।”

“আমি খোঁজ নেবো এ সম্পর্কে।” ফ্লোরার গালের দু’পাশে চাপ দিয়ে বলল ধ্রু।
হাসি দিলো ফ্লোরা। স্বর্গীয় সে হাসি। এমন হাসির জন্য পৃথিবীর যে কাউকেই খুন করতে পারে ধ্রু।

অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে ধ্রু। ফোর্থ ধাপে দেখা যাচ্ছে রক্তের একটা ফোঁটা।
প্ল্যানটা সাজিয়ে নিয়েছে আগেই। গত পনেরোটা দিন এর পেছনেই কাটিয়েছে। এই বিল্ডিংটার ব্লুপ্রিন্টটা ভালোভাবে স্টাডি করেছে। এছাড়া গত চারদিন এই বিল্ডিঙের পাশেই থেকেছে, সব পর্যবেক্ষণ করেছে।
প্ল্যানের প্রথম অংশ ঠিকভাবেই সফল হয়েছে। এখানকার চীফকে স্যাবোটাজ করেছিল তারই বিল্ডিঙের এক ব্লক দূরে। নিজের বাসায় ফিরছিল তখন বুড়ো। অ্যাম্বুশের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় সে। আবার এসে সেঁধিয়ে গেছে এই বিল্ডিঙে। আহত সে, আহত হয়েছে ওর হাতের অ্যাসল্ট রাইফেলের বুলেটেই।

এবার ওর টার্গেট তিনতলার বিশাল পাওয়ার এন্ড সার্ভার রুমটায়। পুরো বিল্ডিঙের পাওয়ার কন্ট্রোল করা যায় এই রুম থেকে। ওখানে ঢুকে প্রথমে পাওয়ার বাইপাশ করে দিতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে পুরো বিল্ডিঙের সমস্ত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে ওর হাতে।

দ্রুত পায়ে ধাপগুলো পার হল। ঘুরে উপরের ধাপে উঠতেই ফার্স্ট ফ্লোরের গোড়ার দিকে দেখা দিল দুজন লোক। হাতে পিস্তল তাদের।

হাতের অ্যাসল্ট রাইফেলটা সোজা করাই ছিলো। বিন্দুমাত্র দেরী না করে ট্রিগার টানল ধ্রু। পরের ন্যানো সেকেন্ডে রাইফেলের মাথাটা একটু বাঁকিয়ে আবার ট্রিগার টিপে দিল। প্রায় একইসাথে মেঝেতে পড়ল লোক দুজন।
লাশগুলোকে টপকে ফার্স্ট ফ্লোরে প্রবেশ করল ও। চোখের কোণায় নড়াচড়া ধরা পড়তেই রাইফেল ঘোরাল ওদিকে।
“শীট,” গাল পাড়ল নিজের মনেই। দেরী হয়ে গেছে।

লাথিটা চলে এসেছে। পায়ের জুতোটা পড়লো ওর বা হাতের কব্জির ঠিক নিচে, যে হাতটা দিয়ে ধরে রেখেছে অ্যাসল্ট রাইফেলের মাজল। খট করে শব্দ হলো একটা। ঝাঁকি লেগে চাপ লেগে গেল ট্রিগারে। লাফিয়ে উঠল অস্ত্রটা। ছুটে গেল হাত থেকে। মেঝেতে মাথা কুটল টার্গেটহীন বুলেট।

পরের লাথিটাও চলে এসেছে ইতোমধ্যেই। কোনমতে কাঁধ পেতে নিল সেটা। পুরো শরীরটা যেন কেঁপে উঠল ওর।

এতক্ষণে লোকটার দিকে নজর দেবার সময় পেল ও। মোটামুটি বিশালদেহী বলা চলে একে। যেমন লম্বা, তেমন পাশ। সাড়ে ছয় হবে, মনে মনে মাপল। দু’ হাত সামনে বাগিয়ে আসছে।

শেষ মুহূর্তে লোকটার হাতের কাছ থেকে সরে যেতে সক্ষম হল ধ্রু। ঘুরেই লাথি ঝাড়ল দানবটার হাঁটু লক্ষ্য করে। নিমেষেই পা’টা উঁচু করল লোকটা। ওর জুতোর এক ইঞ্চি নিচ দিয়ে বাতাস কাটল ধ্রুর লাথি। ভারসাম্য হারাল বুকে লোকটার কাঁধের ধাক্কায়। পিঠ দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। মাথাটা ঠুকে গেল মেঝেতে।
ট্রেইনড মাল!

চোখে অন্ধকার দেখছে মনে হল ওর কাছে। চারদিক কালো কালিতে যেন ভরে যাচ্ছে। এরই ভেতর গলায় লোকটার দু’হাতের চাপ অনুভব করল। শরীর ঝটকা দিতে চাইল, কিন্তু পুরো শরীর ওর উপর উঠিয়ে দিয়েছে বিশালদেহী। মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে ধ্রুকে।

কিছুটা ঘাবড়ে গেল ধ্রু। খানিকটা ভয় এবং কিছুটা আশঙ্কাও জেঁকে বসল মনে।

ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে লোকটা। ইচ্ছে করলেই ওর কন্ঠার হাড় ভেঙ্গে দিতে পারে সে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মোষের মতো শক্তি ধরে লোকটার শরীরে। তবে সেটা করতে চাচ্ছে না বিশালদেহী, অন্তত এমনটাই মনে হল ধ্রুর কাছে। ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে মারতে চাইছে।

কালো কালি যেন আরও কালো হচ্ছে চোখের সামনে। জমাট কালো হয়ে উঠেছে পৃথিবীটা ওর।
দম ফুরিয়ে আসছে ওর। পুরো শরীরটা নিথর হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ফুসফুসে যেন আগুণ ধরে যাচ্ছে। রাগে ভয়ে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে।

সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ A4
মনটা ফুরফুরে লাগছে আজকে ধ্রুর। দুটো কাজের প্রথমটা সমাধা করেছে আজকে। হাতে এসেছে কড়কড়ে সাত লাখ মার্ক। দ্বিতীয় কাজটা শেষ হলে পাওয়া যাবে আরও সাত লাখ।

ওর কাছে আগে থেকে থাকা মার্ক আর এগুলো হিসেব করলে টেনেটুনে তেইশ লাখ মার্ক হবে। বাকিটা নিয়ে পরে চিন্তা করলেও চলবে। কোনভাবে যোগাড় করে ফেলতে পারবে সেগুলো। তারপর ধ্রু, ফ্লোরা আর অনাগত ধ্রু জুনিয়র মিলে পাড়ি জমাবে এনাইডার পথে।

এনাইডা সম্পর্কে গত দেড় মাসে ভালোভাবে খোঁজ নিয়েছে ও। চমৎকার একটা দেশ বলা যায় এটাকে। কোন দূষণ নেই ওখানে। এখনো ওখানকার মানুষ বসবাস করছে প্রকৃতির সাথে একাত্ন হয়ে।

ফ্লোরার সাথে আলাপ করে ওখানে বিশ মিনোট জায়গা ক্লেইম করার জন্য এপ্লাই করেছে। জায়গাটা একটা ছোট পাহাড় এবং তার চারপাশে অনেকটা জঙ্গল নিয়ে গড়ে উঠেছে। একটা শাখানদীও চলে গেছে পাহাড়টার পাশ ঘেঁষে। সুন্দর পরিবেশ। অনেকটা স্বপ্নের মত।

ফ্লোরা আর ও একমত হয়েছে, পাহাড়টার উপর ছোট্ট একটা কটেজ তৈরী করবে। সিন্থেটিক জিনিসপত্র আজকাল খুব চলছে। তবে ফ্লোরার পছন্দ প্রাকৃতিক জিনিস। আশেপাশে জঙ্গলের অনেকটা আছে ক্লেইম করা জমিটাতে। সেখান থেকে বড় বড় বেশ কিছু গাছ কেটে তৈরী করবে কটেজ। নিচতলায় পোলট্রি খামার হবে একটা, দু’তলায় হবে চারটে রুম। একটা ওদের মাষ্টার বেডরুম, একটা স্টাডি, একটা জুনিয়র ধ্রু বড় হলে থাকবে, অন্যটা ড্রয়িং এবং ডাইনিং হিসেবে ব্যবহার করবে। একটা ছোট্ট আউট হাউজও থাকবে। বন্ধুবান্ধবরা যদি কখনো বেড়াতে যায় ওদের ওখানে, তাহলে থাকতে পারবে।

হাতের আর্টিফিশিয়াল ফুলগুলোর দিকে চাইল ধ্রু। এক তোড়া নিয়েছে দেড় হাজার মার্ক। এগুলো ফ্লোরার জন্য নিয়েছে। আজকাল আসল ফুল পাওয়া যায়না বললেই চলে ফার্স্ট কিংডমগুলোতে। যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর দাম পড়ে প্রায় মিলিয়ন মার্কের কাছাকাছি, তাও বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে জীবিত রাখা হয় সেগুলো।

চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় দু’ হাজার বছর হতে চললো। যুদ্ধের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন বোমা ব্যবহার করার ফলে সারা পৃথিবী ভরে গেছিলো রেডিয়েশনে। ধীরে ধীরে কমে এসেছে রেডিয়েশন।

যুদ্ধের আগেই যারা বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার স্যাটেলাইটগুলোতে ছিলো, তারা ছাড়া পৃথিবীর বুকে আর কেউই ছিলো না। যুদ্ধ শেষ হবার তিনশো বছর পর আবার পৃথিবীতে নেমে আসে তারা। তখনও পৃথিবীর বায়ুমন্ডল থেকে পুরোপুরি বিদায় নেয়নি রেডিয়েশন। এর ভেতরও পৃথিবী নিজেকে নতুন করে সাজানো শুরু করেছিলো। ঐ পরিবেশেই নতুন করে পৃথিবীতে কলোনি গড়েছে মানুষ।

ধীরে ধীরে ভাগ হয়ে গেছে পৃথিবীর মানুষ। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গড়ে তুলেছে নতুন কলোনী। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশ, আবার নতুন করে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছে তারা। কাজ করেছে প্রকৃতি নিয়ে, কাজ করেছে কলকারখানা নিয়ে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে আবার পৃথিবীকে।
লিফট থেকে ধীরপায়ে নেমে এলো ধ্রু। পৌঁছে গেছে ফ্ল্যাটের সামনে।

পকেট থেকে কীকার্ড বের করে দরজার পাশে রাখা প্যানেলের উপর রাখল দু’ সেকেন্ড। তারপর সেটা আবার পকেটে পুরে প্যানেলে বুড়ো আঙ্গুলটা চেপে ধরল। এক সেকেন্ড পর খুট করে একটা শব্দ হল। দরজাটা খুলতেই চমকে গেল। মুহূর্তেই ওর সামনে ঝুলে পড়ল একটা সাদা পর্দা।

দ্রুত এক পা পিছিয়ে গেল ও। সাদা রঙের পর্দাটা দু হাতে সরানোর চেষ্টা করল। হাত থেকে ইতোমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে ফুলের তোড়াটা। ঠিক তখনই কি যেন একটা আঘাত করল ওর মাথায়। অস্ফুট একটা চিৎকার বের হয়ে এল ধ্রুর গলা বেয়ে। মাথায় যেন বিস্ফোরিত হয়েছে কোন আগ্নেয়গিরি।

ধাতস্ত হতে সময় লাগল । কতক্ষণ সাদা চাদরটা সহ পড়ে ছিল মেঝেতে, বলতে পারবে না। ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে এল শরীরে। উঠে বসে প্রথমেই সরাল চাদরটা। মাথাটা প্রচণ্ডরকম ভারী মনে হচ্ছে নিজের কাছে।

কোন মতে দরজা টপকে ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করল। ফ্ল্যাটের ভেতরে নজর যেতেই চমকে উঠল।
লাল রক্তের পুকুরের উপর উপুর হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরা।

বিস্ফোরিত হল যেন ধ্রুর চোখ দুটো। হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই পাঁচ সেকেন্ড। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল স্ত্রীর লাশের দিকে।

দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে ফুসফুসে। যে কোন সময়ই আগুনটা ছড়িয়ে পড়বে সারা শরীরে। দুনিয়াটা কাঁপছে যেন। ভুমিকম্প হচ্ছে কি?

হঠাত করেই হাতের আঙ্গুলে ঠান্ডা একটা কি যেন ছোঁয়া পেতেই আশা জাগলো মনে। সম্ভবত ছুঁড়ির বাঁটটা।
শক্ত করে জিনিসটা ধরল। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছে, সাথে আনা ছুঁড়ির বাটই এটা। খাপ থেকে বের করে আনল জিনিসটা, আমূল বিঁধিয়ে দিল দানবটার শরীরে।

প্রায় সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো লোকটা। হালকা হয়ে গেলো তার হাতের চাপ।

ছোড়াটা ঝটকা দিয়ে বের করে আবারও বসিয়ে দিল লোকটার শরীরে। প্রায় একই সময় পা দুটোকে ভাঁজ করে নিয়ে এসেছে বুকের কাছে। একই সাথে ছুটে গেল সে দুটো। জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে উড়ে গেল যেন লোকটা। অবশ্য এক সেকেন্ড কাটার আগেই ধপ করে দেহটা পড়ল মেঝের উপর।

কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ধ্রুর চোখের সামনেটা পরিষ্কার হতে। দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই সামনের দিকে চাইল। প্রায় সাথে সাথেই অবাক হল। লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে।

এক হাত সামনে বাগিয়ে দিয়েছে সে। দ্রুত লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল ও হাতটাকে। প্রায় সাথে সাথে ঘুরে গিয়েই ছোড়াটা হাত বদল করে বিঁধিয়ে দিল লোকটার গলায়। পর পর দু’বার ওটা দিয়ে আঘাত করার সময় পেল, তারপরেই নিজের গলায় দানবটার হাতের স্পর্শ পেল আবার।

ছোড়ার আঘাতে জায়গায় জায়গায় সবুজ রঙের রক্ত বেরুচ্ছে লোকটার শরীর থেকে। তবুও দানবটার শরীরের শক্তি মনে হলো না কোন অংশে কমেছে। কিভাবে যেন ছুঁড়ে দিল সে ওকে। ছোড়াটা ছুটে গেল হাত থেকে। যখন উঠে দাঁড়াল, খেয়াল করল লোকটার থেকে আট ফুট দূরে পড়ে আছে ও। ছোড়াটা পড়ে আছে এক হাত দূরে।

মেঝে থেকে উঠার সময়ই ছোড়াটা তুলে নিয়েছে ধ্রু। হাঁটুর অন্যপাশ থেকে বের করল আরেকটা ছুড়ি। দুটোকে বাগিয়ে ধরে এবার আক্রমণ চালাল সাড়ে ছয় ফুটি দানবটার উপর।

একের পর এক কোপ বসাতে লাগল ধ্রু লোকটার বুকে, পেটে, গলায়। পুরো পাঁচ সেকেন্ড পর মেঝেতে পড়ে গেল লোকটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে অন্তত বিশ জায়গা থেকে।

থামল না ধ্রু। একের পর এক কোপ অব্যহত রাখল। লোকটা মারা যাবার আগ পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হবার কোন উপায় নেই।

আরও পাঁচ সেকেন্ড কোপানোর পর ক্ষান্ত দিল ও। ততক্ষণে লোকটার প্রাণ উড়ে গেছে শরীর থেকে। বড় একটা ভারী বস্তার মতো পড়ে আছে সে মেঝেতে।

ছোড়া দুটোর রক্ত মুছে খাপে রেখে দিল হাঁটুতে বাঁধা খাপে। মেঝে থেকে অ্যাসল্ট রাইফেলটা তুলে নিয়ে রওনা হল সিড়ির দিকে। তিনতলায় উঠতে হবে ওকে।

তিনতলায় পাওয়ার এন্ড সার্ভার রুমটা খুঁজে পেতে তেমন কোন সমস্যা হলো না। দুজন গার্ড ছিলো, অ্যাসল্ট রাইফেলের দুই বুলেট কপালে নিয়ে ধরাধাম ত্যাগ করলো তারা। দ্বিতীয় কাজটা সহজ। একে একে সব কমিউনিকেশন এবং পাওয়ার লাইন বাইপাশ করে দিয়ে ক্ষান্ত দিল এতে।

এমন সময় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। দ্রুত পাওয়ার এন্ড সার্ভার রুমের দরজার কাভার নিল ধ্রু।
জানে না ওদিকে কতজন গার্ড এসেছে, তবে পায়ের শব্দে মনে হলো খুব বেশী হবে না। বড়োজোর তিন থেকে চারজন।

এরা কোন ঝামেলা নয় ওর জন্য, অন্তত ঝামেলা হবার কথাও নয়। বিল্ডিঙের সাধারণ কর্মচারী ওরা, আনআর্মড কমব্যাটের ব্যাপারে তেমন কোন জ্ঞান থাকার কথা নয়।

হলোও তাই। অনভিজ্ঞ লোকের মতো পিস্তল বাগিয়ে হিরো হতে চাইলো এক লোক। পিস্তল ধরা হাতটা আগে বাড়িয়ে যেই রুমে প্রবেশ করেছে, এক লাথিতে তার হাতের কব্জিটা সাইজ করল ধ্রু। এক হাতে তাকে টেনে দরজার পেছনে এনে পেছনদিক থেকে তার গলায় চেপে ধরল অ্যাসল্ট রাইফেল। রাইফেলের মাজল এখনো কিছুটা উত্তপ্ত, চেঁচিয়ে উঠল সে।

“কজন তোমরা?” কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।
“পা…পাঁচজন।”
“তোমাকে সহ?”

জবাব দিতে চাইলো না সে, উল্টো একটা হাত দিয়ে আঘাত করতে চাইলো ওর পেটে। উদ্দেশ্য বুঝতে সময় লাগলো না, তাই দ্রুত ছেড়ে দিল তাকে। পাছায় লাথি খেয়ে মৃত গার্ডদের একজনের উপর পড়লো সে। উঠতে গিয়েও থমকে গেলো বুলেটের আঘাতে।

প্রায় সাথে সাথেই ঝাঁজরা হতে লাগলো দরজা এবং রুমের ভেতরের অংশ। বাইরের গার্ডরা গুলি করছে।

মনে মনে গুনতে লাগল ধ্রু। জানে, সাধারণ কর্মচারী এরা, সাথে এক্সট্রা ম্যাগাজিন থাকার কথা নয়। খুব দ্রুতই অস্ত্রের বুলেট ফুরিয়ে যাবে।

পাঁচ সেকেন্ড পর ওর ধারণাই সত্য প্রমাণিত হলো। থেমে গেলো গোলাগুলি। বোকার মতো ম্যাগাজিন শেষ করে এখন নিজেদের ভেতর চেঁচাচ্ছে লোকগুলো। ধিক্কার দিচ্ছে একজন আরেকজনকে।

অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে এবার দরজা আকড়ে দাঁড়াল ধ্রু। দুজনকে লক্ষ্য করে দুটো বুলেট পাঠিয়ে দিল নিমেষেই। ঠিক তখনই চোখের কোনে নড়াচড়াটা ধরা পড়ল।

“বাল!” মনে মনে উচ্চারণ করল ধ্রু।

কিছু বুঝতে পারার আগেই এল আঘাতটা। পিস্তলের বাট তুলে আক্রমণ করতে এসেছে একজন।

কোন মতে মাথাটা সরিয়ে কাঁধ পেতে নিল সেটা। তারপরই ঘুরে গিয়ে পা বাঁধিয়ে দিল তার হাঁটুতে।
কিকটা করেই ডিগবাজি দিয়েছে ও। ইতোমধ্যেই হাত থেকে ছুটে গেছে রাইফেল।

ঘুরে দাঁড়ানোর পর পরই ওদের তিনজনের মুখোমুখি হল ও। সুসজ্জিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, অস্ত্র ফেলে প্রশিক্ষিত সৈন্যের মত হাত সামনে বাগিয়ে ধরেছে। যে কোন সময়ই আক্রমণ করবে। যদিও তাদের চেহারা দেখেই অনুমান করল ধ্রু, জীবনে কখনোই এরা হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটের ব্যাপারে কোন জ্ঞান অর্জন করেনি।
“বোকার হদ্দ কোথাকার!” একটু জোড়েই উচ্চারণ করল ও।

মৃদু হাসল। কঠোর ট্রেনিং পেয়েছে জীবনে, নিজ হাতে খুন করেছে জনা ত্রিশের উপর লোককে। এদের মতো অন্তত পাঁচজনকে হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটে সাত সেকেন্ডের মাথায় শুইয়ে দিতে সমস্যা নেই ওর।

জায়গাটা একটা পার্ক। কৃত্রিমভাবে কয়েক হাজার পার্ক তৈরী করা হয়েছে এই কিংডমে মানুষদের অবসর সময় কাটানোর জন্য, এটা ওরকমই।

ফ্লোরার শেষকৃত্য থেকে ফেরার সময় অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে কল আসে ধ্রুর সেলফোনে। ফোন করে এখানে আসতে বলেছে। এখানে আসার কোন ইচ্ছেই ছিলো না ওর। তবে ফ্লোরার খুন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কথা উল্লেখ করেছে লোকটা।

লোকটা কে, তা জানা নেই। কেনই বা এমন সময়ে কল করেছিলো, সেটাও জানা নেই। তবে যেহেতু বলেছে ফ্লোরার খুন সম্পর্কে কিছু জানে, সেহেতু না এসে পারেনি। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা আগেই চলে এসেছে এখানে।

ব্যাপারটা কোন ধরণের ফাঁদ কি না, এ বিষয়ে একটা সন্দেহ রয়েই গেছে মনের মাঝে। এ কারণে প্রথমে এখানে এসেই পুরো এলাকাটায় একটা চক্কর কেটেছে আগে। সন্দেহজনক কিছু যদিও চোখে পড়েনি, এখনো পর্যন্ত।
তবে এও জানে, পার্কের ভেতরে অন্তত ওকে কেউ ফাঁদে ফেলতে পারবে না। প্রচুর নারী এবং শিশু থাকে এই জায়গাটাতে, এছাড়াও রয়েছে পার্কের নিজস্ব গার্ড এবং ল এনফোর্সমেন্ট বাহিনীর লোক। এম্বুশ করার জন্য পারফেক্ট নয় জায়গাটা। তবুও সতর্কতার মার নেই ভেবে সাথে একটা হ্যান্ডগান রাখতে ভুলেনি। আপাতত জিনিসটা কোমরে বেল্টের সাথে আটকানো আছে।

আরও পাঁচ মিনিট পর এল তারা। দুজন লোক, একজন ধ্রুর সমবয়েসী, আরেকজন একটু বয়েস্ক।
চুপচাপ ওর দু’পাশে এসে বসলো তারা। চুপচাপ চলে গেলো কয়েক মুহূর্ত।

“ফ্লোরার মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত,” মুখ খুললেন বয়েস্ক লোকটা। “আন্তরিকভাবেই দুঃখিত।”
“আমি আপনাদেরকে কি কোনভাবে চিনি?” লোকটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল ধ্রু।
“নাহ,” জবাব দিলো ওর সমবয়েসী লোকটা। “আমাদেরকে আপনি চেনেননা। তবে আপনাকে চিনি, খুব ভালোভাবেই। ইনফ্যাক্ট, গত মাস দুয়েক ধরে আপনার ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি আমরা।”
“এর ভেতরেই এমন ঘটনা ঘটে যাবে, তা আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না।” আন্তরিক মনে হলো বয়েস্ক লোকটার গলা।
“কে আপনারা? ফোনে বললেন ফ্লোরার হত্যা সম্পর্কে তথ্য আছে আপনাদের কাছে।”
“এ কারণেই আপনাকে ফোন করেছিলাম,” সমবয়েসী লোকটা বলে উঠলো। “আমি সায়লর। আর ইনি আমার চীফ, বেন। আমরা একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, নাম ‘অর্গানাইজেশন’। আমাদের কাজ রিপারদেরকে প্রতিরোধ করা।”
“রিপার?” ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো আমার।

“ভয়ঙ্কর একটা সংস্থা। একইসাথে বর্বর, নৃশংস এবং সাইকোপ্যাথদের গ্রুপ বলা যায় একে। এদের উদ্দেশ্যটাও অদ্ভুত, নিজেদেরকে আরও উন্নত করে গড়ে তোলা।”
“কিভাবে?”

“নতুন করে কিছু বলার নেই আপনাকে। ফোর্থ ওয়ার্ল্ড ওয়ারের তিনশো বছর পর পৃথিবীর বাইরের স্যাটেলাইটগুলো থেকে এখানে নেমে আসি আমরা- এটা তো সবাই জানে। সবাই এও জানে আমরা মানুষরা আজ দুটো ভাগে বিভক্ত। সাধারণ মানুষ, যারা পুরনো মানুষ বা লালরক্ত বিশিষ্ট পৃথিবীর আদি মানবদের বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে, এবং যিপার, যারা রেডিয়েশনের প্রভাবে কৃত্রিমভাবে বিবর্তিত হয়ে সবুজ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।”
“এখানে রিপাররা আসছে কিভাবে? আর ফ্লোরার মৃত্যুর সাথেই বা এদের সম্পর্ক কি?”

“সম্পর্ক আছে,” বলল বেন। “রিপাররা পারফেক্ট হিউম্যান বডি চাচ্ছে, যাদের সাহায্যে তারা নিজেদেরকে আরও উন্নত করে তুলতে পারবে।”

ব্যাখ্যার ভঙ্গীতে বলল সায়লর। “আমরা যারা যিপার, তাদের বিবর্তিত হবার প্রক্রিয়াটা প্রাকৃতিক ছিলো না। অতিরিক্ত রেডিয়েশনের ফলে খুব দ্রুত মিউটেটেড হয়ে গেছি, সবুজ রক্তের অধিকারী এ কারণেই আমরা। কিন্তু এতে আমাদের কোন হাত নেই, পুরো কৃতিত্ব বা দোষ যাই বলুন, সবই আমাদের পূর্বপুরুষদের। চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে ইচ্ছেমতো পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করেছিল তারা। যার ফলে নিজেরাও মারা গেছে, আমাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়াতেও আঙ্গুল লাগিয়ে গেছে। বর্তমানে তাই পৃথিবীতে আমাদের সংখ্যা বেশী। প্রতি হাজারে মাত্র পাঁচজন আদি মানুষের জন্ম নেয়, বাকিরা যিপার হিসেবে জন্মাচ্ছে।”

“এগুলো জানি আমি।” বিরক্ত কন্ঠে উচ্চারণ করল ধ্রু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সায়লর। আবার শুরু করল, “তাহলে গোটা বিষয়টা সংক্ষেপে সারছি। রিপাররা আসলে যিপারদেরই একটা গ্রুপ, যারা চাইছে আমাদের যিপারদের চেয়েও উন্নত হতে। এক কথায় আরও বিবর্তিত হতে চায় তারা, চায় আরও এডভান্সড হতে। কারণটাও অনুমান করা কষ্টকর নয়। আমরা যিপাররা আদি মানুষদের চেয়ে সবদিক থেকেই উন্নত। ওরা চাচ্ছে পারফেক্ট হিউম্যান, সেটা আদি মানুষ বা যিপার- যে কারও ভেতর থেকেই

আসতে পারে। এন্ড দে নিড সাম… তারা এটাকে বলে সোর্স কোড, যা আছে শুধু হিউম্যান ব্রেইনের একটা নির্দিষ্ট অংশে। হিউম্যান ব্রেইনকে এখনো পুরোপুরিভাবে বুঝে উঠতে পারিনি আমরা কেউই। ব্রেইনের এই অংশটা খুবই ক্রিটিক্যাল। এই কোডটা কোন মানুষ থেকে পেতে চাইলে সে কোনভাবেই বাঁচবে না। এই কারণেই তারা খুন করছে যিপার এবং আদি মানুষ- উভয়কেই। ওরা চাচ্ছে যিপারের ব্রেইন এবং আদি মানুষের ভেতর থাকা আদিম শক্তি। এ কারণেই মানুষের বডি থেকে ব্রেইনকে আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা, মানে অর্গানাইজেশন চাচ্ছি ওদেরকে থামাতে।”

“এ বিষয়ে সরকার কিছু করছে না কেন?”

“রিপারদেরকে রুখতে সরকারই তৈরী করেছে অর্গানাইজেশন। আমরা সরকারী লোক। গত চার বছর ধরে লেগে আছি রিপারদের পেছনে। কিন্তু রিপাররা খুবই সুসংগঠিত, আর তাছাড়া তাদের কার্যক্রমও সুবিস্তৃত। রিপাররা ঠিক কবে সংগঠিত হয়েছে এখনো জানতে পারিনি, তবে এরা যে অনেক পুরনো সংগঠন তা তাদের কাজের ধারা দেখলেই বোঝা যায়। ধীরে ধীরে কাজ করছে এরা, কারও কোন সন্দেহের উদ্রেক না করেই। কত বছর ধরে, কে জানে! আর তাছাড়া এখন পরিস্থিতিটাই এমন যে যা খুশী তাই করছে মানুষ। উগ্রতা বাড়ছে, ইচ্ছে করলেও সরকার সবাইকে নিরস্ত্র করতে পারছে না।”
“এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?”

“আপনার কাছে আসার আগে আপনাকে নিয়ে স্টাডি করেছি। আমরা জানি আপনি কে এবং কি কি কাজে আপনি কেপেবল। আমরা বেশ কয়েকদিন ধরেই চাইছিলাম আপনাকে রিক্রুট করতে। কিন্তু এরই ভেতর আপনার জীবনে একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেছে। একেবারে লাষ্ট মোমেন্টে খবর পেয়েছিলাম আমরা, রিপাররা আপনার স্ত্রীর পেছনে লেগেছে, কিন্তু ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক… অনেক দেরী হয়ে গেছিল আমাদের।”

“এখন আমাকে কি করতে বলছেন?”
“ইয়ে… আসলে… একটু আগেই বলেছি আপনাকে রিক্রুট করার ইচ্ছে আছে অর্গানাইজেশনের। এও জানি এমন মুহূর্তে আপনাকে এমন অফার দেওয়াটা দৃষ্টিকটু দেখা যায়। কিন্তু এছাড়া আসলে উপায়ও নেই। দিনকে দিন

রিপারদের দৌড়াত্ন বেড়েই যাচ্ছে। কারও পরোয়া করছে না এখন তারা। দু’মাস আগেই তিন দেশের তিন প্রেসিডেন্ট খুন হয়ে গেছে তাদের হাতে। প্রতি সপ্তাহেই খুন করছে ওরা। এই খবরটা পাবলিকও করতে পারছি না আমরা… বুঝতেই পারছেন, মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে যাবে। এবং এরফলে একটা ক্রাইসিস শুরু হবে। ইকোনমি থেকে শুরু করে মানুষের সামাজিক জীবনেও এটা প্রভাব ফেলবে।”

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ রইল ধ্রু। কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না।

ওর কাঁধে হাত রাখল সায়লর। “আপনাকে এখনই কিছু জানাতে হবে না। সময় নিন। আমরা পরে কখনো যোগাযোগ করব আপনার সাথে।”

উঠে দাঁড়াল লোক দুজন। মৃদু নড করে ঘুরে হাটা শুরু করল।
নিজের মাথা দু হাতে চেপে রাখল ধ্রু। ভেতরে অগ্নিশিখা জ্বলছে।

লোকগুলোর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে রিপারদের ছাড় নেই ওর হাত থেকে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। প্রয়োজন হলে নরক পর্যন্ত যাবে রিপারদের তাড়া করে।

এরপর থেকেই শুরু হলো ধ্রুর অর্গানাইজেশনের সাথে কাজ করা। একের পর এক রিপারদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে থাকল ও। এর আগে কাজটা ছিলো ওর জন্য পেশা, আর এখন…

খালি চেম্বারে খটাস শব্দে হ্যামারটা পড়তেই নড়ে উঠল ধ্রু। শেষ হয়ে গেছে রাইফেলের ম্যাগাজিন। ফেলে দিল অস্ত্রটা।

করিডোরের ফাঁক থেকে এখনো উঁকি দিচ্ছে দুটো চেহারা।

কোমর থেকে দু হাত দুই পিস্তল তুলে নিল। তবে ভাগ্যটা মন্দ, পিস্তল তোলার আগেই পড়ে গেল সিঁড়িতে। একটা বুলেট এসে থাবা মেরে গেছে, বা হাতের বাইসেপ ঘেঁষে উত্তপ্ত ছোয়া দিয়ে চলে গেছে।

এক সেকেন্ড সময় লাগলো নিজেকে সামলে নিতে। আরও কয়েকজন আসছে, উপর থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। কালবিলম্ব না করে দৌড় দিল ও।

করিডোরের ফাঁক দিয়ে দেখা সেই দুজনের চেহারা আবারও দেখা গেল। সেকেন্ডের অর্ধেকের মাঝে দুজনের কপালে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে করিডোরে প্রবেশ করল ধ্রু। করিডোর ধরে ছুটে আসছে আরও কয়েকজন।

বা হাতের বাইসেপ জ্বলছে। তবে সেদিকে তোয়াক্কা না করে দৌড়ের গতি আরও বাড়াল ও। একের পর এক আগুণ ঝরিয়ে চলেছে দুহাতের পিস্তল, আর এক এক করে করিডোরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে লোকগুলো।
একই সময়ে শেষ হয়ে গেলো দুই পিস্তলের ম্যাগাজিন। বা হাতেরটাকে ছেড়ে দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলো কোমরের পেছনদিকে। লম্বা একটা ম্যাগাজিন চ্যাম্বার চলে এসেছে ঘাড়ের নিচ থেকে পিঠ বেয়ে কোমর পর্যন্ত। ম্যাগাজিন চেম্বার থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে ডান হাতের পিস্তলটা রিলোড করে নিলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে হাঁটুর কাছ থেকে বাঁ হাতে উঠে এলো ছোড়াটা। বড় করে শ্বাস নিয়ে এগোল সামনের দিকে।

করিডোরটার বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়লো লোক চারজনের উপর। এদিকেই আসছে।
ডানহাতের পিস্তল আর বাঁ হাতের ছোড়ার উপর চাপ বাড়ল। পরের মুহূর্তেই যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড় লাগাল লোকগুলোকে লক্ষ্য করে।

ছয় পা এগোনোর পর পরই কিছুটা ঝুঁকে গেল ধ্রু। ইতোমধ্যেই সামনের লোকগুলো রাইফেল তাক করেছে ওর দিকে।

দৌড়ের তালেই ছোট্ট একটা লাফ দিল ও। সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ পর মেঝেতে জুতোর সোল নামতেই পিছলাতে শুরু করল বাচ্চাদের মত।

পিছলে প্রথম লোকটার কাছে পৌঁছে গেল ও। মাথা নিচু করে রেখেছে, শরীর বাঁকা হয়ে গেছে- এ কারণে লোকটার রাইফেল লক্ষ্যস্থির করে আছে ওর মাথার তিন ইঞ্চি উপরে।

লোকটার গলায় ছোড়াটা আমূল বিঁধিয়ে দিয়ে ডানহাত সোজা করল ধ্রু। পর পর দুটো বুলেট বের হয়ে গেলো পিস্তল থেকে।

এমন সময় করিডোরের পাশের এক দরজা দিয়ে বের হলো আরও ছয়জন। সবার হাতে রাইফেল।
গলায় ছোড়া বেধা লোকটার শরীরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আগাতে লাগল ধ্রু। কেভলার ভেষ্ট পড়ে আছে লোকটা, যে কারণে ওপাশ থেকে ওকে লক্ষ্য করে যে গুলিগুলো ছোড়া হচ্ছে তা থেকে রক্ষা পাচ্ছে লোকটার এপাশে থাকা ধ্রু।

দ্রুত হাতের পিস্তল খালি করল ধ্রু। খালি চেম্বারের উপর হ্যামার পড়ার শব্দ কানে আসতেই সেটাকে চালান করে দিলো হোলস্টারে। বদলে হাতে তুলে নিল ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা লোকটার হাতে থাকা রাইফেল। পরবর্তী দু’ সেকেন্ডে খালি হয়ে গেল সেটার ম্যাগাজিনও।

এখানকার ঝামেলা শেষ করে আবার সিঁড়ি ধরল ধ্রু। যেতে হবে পরের ফ্লোরে। হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে ম্যাগাজিন চেঞ্জ করে নিল।

ফ্লোরটাতে পা দিয়েই সতর্ক হয়ে গেল ও। ফ্লোরটা একটা গ্যারাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, স্পষ্ট বুঝতে পারছে। গ্যারাজের একেবারে উল্টোদিকে একটা ল্যাডার জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে। তারপাশে কংক্রিটের বাঁকানো রাস্তা। এই

পথেই এই বিল্ডিঙের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাড়ি এখানে এনে পার্ক করা হয়।
শক্ত করে পিস্তল বাগিয়ে গ্যারাজে প্রবেশ করল। চারদিকে সতর্ক চোখ বুলাচ্ছে।
“ইউ আর লেইট।” হঠাত করেই একদিক থেকে ভেসে এলো একটা কন্ঠ।
পাই করে সেদিকে ঘুরল ও। ওখানে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর সমবয়েসী একটা লোক।
একটা ফিল্টার টিপড সিগারেট ধরাচ্ছে লোকটা। লাইটারটা পকেটে রেখে সিগারেটে কষে একটা টান দিলো।
সায়লর!

একুশ দিন আগে

একটা বিল্ডিঙের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে ধ্রু। বারবার তাকাচ্ছে হাতের সেলফোনটার দিকে। এখনো টার্গেটের ডিটেইলস এসে পৌছেনি।

ত্রিশ সেকেন্ড পর ওর হাতে কেঁপে উঠল যন্ত্রটা। দ্রুত মেসেজ অপশনে চোখ বুলাল। একটা ফ্ল্যাট নাম্বার দেওয়া আছে। টার্গেট ব্লাইন্ড, দুজন।

দ্রুত সেলফোনটা পকেটে রেখে এগুতে শুরু করল ও। লিফটে করে চলে এল কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে। জ্যাকেটের আড়ালে থাকা পিস্তলটা চেক করে আগের জায়গায় রেখে দিল।

ফ্ল্যাটটার সামনে এসে সেলফোনের মেসেজ অপশনটা আবারও ওপেন করল। ফ্ল্যাটের নাম্বার মিলিয়ে নিয়ে নক করল দরজায়।

দরজা খুলে যেতেই জ্যাকেটের আড়াল থেকে পিস্তলটা বের করে লোকটার কপালে ধরল ধ্রু।

কিন্তু এ কি?
প্রায় সাথে সাথেই জমে গেল ও।

এ যে ফাউলার! ফ্লোরার আপন ভাই! কিন্তু এ কি করে হয়? ফাউলার তো একজন সাংবাদিক। সে কি করে এখানে…
মুহূর্তের ভেতর কয়েকশো প্রশ্ন ভীর করল ধ্রুর মনে।
এখানে রিপারের দুজনকে খুন করতে পাঠানো হয়েছে ওকে। ফাউলার কি তাহলে রিপারদের একজন? কিন্তু… কিন্তু কেন?

সবচেয়ে বড় কথা ফাউলার যদি রিপারদের কেউ হয়-ও, তবু অন্তত ফ্লোরা বেঁচে থাকতো। নিজের বোনকে অসম্ভব ভালোবাসতো ফাউলার। নিজের বোনের উপর রিপাররা হিট নিতে যাচ্ছে জেনেও সে চুপচাপ বসে থাকার মত মানুষ নয়। অন্তত তখন না জানলেও এতদিনে জেনে যাবার কথা না?

“তুমি এখানে?” চোখে স্পষ্ট বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল ফাউলার।
পিস্তলটা নামিয়ে রাখল ধ্রু। “তুমি এখানে কি করছো?”
“এটা… এটা আমাদের অফিস।”

“অফিস?” হা হয়ে গেল ও। “তোমার অফিস এটা? কিন্তু তোমার অফিস তো আমি চিনি। এখানে…”
কথাটা শেষ করার আগেই সেলফোনটা বেজে উঠল ওর। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল সায়লরের গলা। “মিশন এবোর্ট… চলে এস ওখান থেকে।”

“মানে কি?” খেঁকিয়ে উঠল ধ্রু। “আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে কেন?”
“ইট’স আ মিষ্টেক। মিসইনফরমেশন পেয়েছিলাম আমরা। তোমার টার্গেট মুভ করছে।”
“মিসইনফরমেশন? এটা কিভাবে সম্ভব? অর্গানাইজেশন মিসইনফরমেশন পায় কিভাবে?”
চোখের কোনা দিয়ে খেয়াল করল ধ্রু, ফাউলারের চেহারা থেকে যেন রক্ত সরে গেছে। হা হয়ে গেছে সে।
“আমরা গড নই ধ্রু, আমাদের ভুল হতেই পারে।”
“ভুল হতেই পারে?” আবারও খেঁকিয়ে উঠল ও। “আর একটু দেরী করলে অঘটন ঘটে যেত এখানে।”

এমন সময় ফ্ল্যাটের ভেতরে একটা আওয়াজ পাওয়া গেলো। কাচের কিছু ভাঙ্গার শব্দ।
পেছনদিকে ঘুরলো ফাউলার ব্যাপারটা কি দেখার জন্য। ওর পেছন পেছন ধ্রুও ঢুকে পড়ল ফ্ল্যাটে।
জানালার কাছে একজন লোক পড়ে রয়েছে। পুরো শরীর লাল রক্তে ভরে আছে তার।
চিৎকার করে উঠল ফাউলার। তারপরই থম মেরে গেল। দ্রুত এগিয়ে গেল লাশের দিকে।
ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল সায়লর। “গড ড্যাম ইট, ওখান থেকে বেরিয়ে এস ধ্রু। তোমার টার্গেট মুভ করছে।”

আমার দিকে ফিরল এ সময় ফাউলার। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, “অর্গানাইজেশন! অর্গানাইজেশন এখানেও পৌঁছে গেছে।”

“ফাক!” গালি দিয়ে ওপাশ থেকে কল কেটে দিল সায়লর।

দু’ সেকেন্ড সেলফোনের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ধ্রু। তারপর সেলফোনটাকে পকেটে পুরে ফাউলারের দিকে এগিয়ে গেল।

“কি বললে তুমি?” ফাউলারের কাঁধে হাত রাখল ।
“অর্গানাইজেশন!” কাঁপতে কাঁপতে উচ্চারণ করল ফাউলার। “অর্গানাইজেশনের খুনীরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে।”

“কি করেছো তোমরা যে অর্গানাইজেশনের খুনীরা তোমাদের পেছনে লেগেছে?”
“আমরা? আমরা কি করবো?” খেঁকিয়ে উঠল সে। “করছে তো ঐ অর্গানাইজেশন। সারা পৃথিবী থেকে আদি মানুষদেরকে সরিয়ে দেবার প্ল্যান করেছে ওরা। চাইছে নিজেদেরকে আরও উন্নত করতে।”

“মানে কি?” মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লেও হয়তো এতোটা অবাক হত না ধ্রু। “খুলে বলো সব।”
ধীরে ধীরে সব খুলে বলল ফাউলার। সবকিছু শুনে বেদিশা হয়ে যাবার যোগাড় হল যেন ধ্রু।
ফ্লোরা মারা যাবার পর পরই অর্গানাইজেশন নামে একটা প্রতিষ্টানের অস্তিত্বের কথা জানতে পারে ফাউলার, যারা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী বলে দাবী করে। যিপারদেরকে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করছে তারা। আর এ কারণে পৃথিবীজুড়ে খুন করছে আদি মানুষদেরকে।

ওদের টার্গেট পৃথিবীর সমস্ত আদি মানুষ, যাদের ব্রেইন থেকে সোর্স কোড উদ্ধার একত্র করে একটা পারফেক্ট মডেল তৈরী করতে চাইছে তারা। আর এ কারনে ভাড়া করছে পৃথিবীর উচ্চ মাপের খুনীদের। যাদেরকে টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব, তাদেরকে কিনছে। আর যাদেরকে টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব নয়, তাদেরকে বিভিন্নভাবে ম্যানুপুলেট করে নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে তারা।

“তুমি যা বলছ, জেনে বলছ তো?” ফাউলারকে প্রশ্ন করল ও।

“অবশ্যই। ফ্লোরাকে মেরেছে ওরা, খুন করেছে আরও অন্তত দশ হাজার আদি মানুষকে। তার সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। অর্গানাইজেশনের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করছি আমি ফ্লোরা মারা যাবার পর থেকেই। আজ মিডিয়ানের সাথে এটা নিয়েই আলাপ করার কথা ছিলো। ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে অর্গানাইজেশন সম্পর্কে। আমরা ভেবেছিলাম আমার আর ওর যোগাড় করা তথ্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠাবো আমরা যাতে অর্গানাইজেশনের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।”
“কিন্তু… হাউ ইজ দিস পসিবল? রিপারদের কি হলো তাহলে?”
“রিপার?” বিস্মিত মনে হল ওকে। “রিপার আবার কারা?”

রিপারদের ব্যাপারে সায়লর যা বলেছিল সব ব্যাখ্যা করল ধ্রু। অর্গানাইজেশন ওর সাথে যোগাযোগ করার পর থেকে এখনো পর্যন্ত যা হয়েছে, কিছুই বাদ রাখল না।

সব কথা শোনার পর মলিন হাসল ফাউলার। “অর্গানাইজেশন তোমাকেও বোকা বানিয়েছে ধ্রু! … হাহ! … ম্যানুপুলেট করেছে তোমাকে। রিপার নামে কোন সংগঠনের কোন অস্তিত্বই নেই।”

হা হয়ে গেল ধ্রু। মানে কি এসবের?

উঠে দাঁড়ালো ফাউলার। নিজের ল্যাপটপটা টেনে এনে ওর সামনে রাখল। একটা ফাইল ওপেন করে বলল, “মিডিয়ান অর্গানাইজেশনের মেইনফ্রেম হ্যাক করে এই তথ্যগুলো পেয়েছে। এখানে এ যাবত অর্গানাইজেশনের করা সমস্ত অপরাধের লিষ্ট আছে। এছাড়া আগামী পাঁচ বছরে তারা কি করবে, তার প্ল্যানও আছে এখানে। এই লিষ্টে ফ্লোরার নামও আছে।”

ধীরে ধীরে পুরো লিষ্টটার উপর নজর বোলাল ও। এরকম শকড জীবনে এর আগে একবারই হয়েছিল, ফ্লোরাকে যখন মৃত অবস্থায় দেখেছিল।

শার্টের বাঁ হাতা সবুজ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। এতক্ষণ ঝরঝর করে রক্ত বের হয়েছে। ফার্স্ট এইড কিট থেকে কিছু সল্যুশন ব্যবহারের পর বন্ধ হয়েছে সেটা আপাতত। আর কিছু করার নেই এখন আর। ব্যান্ডেজ ছিলো না ফার্স্ট এইড বক্সে, তাই বাঁধতে পারছে না ক্ষত জায়গাটা।

হিটটা আসতে যাচ্ছে, আগেই বুঝতে পেরেছিল বেন। তবে এত পরে আসবে, তা ভাবেনি। একুশ দিন আগে যখন ভুলটা চোখে পড়েছিল সায়লরের, তখন থেকেই অপেক্ষা করছিল সে এই হিটের জন্য। কিন্তু দেরী করেছে ধ্রু… অনেক দেরী করে ফেলেছে। আর এই কারণেই বোধহয় সতর্কতায় ঢিল দিয়েছিল বেন। আর এই সুযোগে…
শান্তিতে অফিস থেকে বের হয়েছিলো সে। গাড়িটা চালাচ্ছিল সায়লর, পেছনের সিটে ছিলো সে এবং এক সুন্দরী তরুণী। এমন সময় গুলিবর্ষণ শুরু হয় গাড়ি লক্ষ্য করে। পর মুহূর্তেই ছোট একটা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে গাড়িটা। একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে গেছিলো গাড়িটা বিস্ফোরণের ধাক্কায়। ঐ অবস্থাতেই গাড়িটা চালিয়ে আবার অফিসে এনে ঢুকিয়েছে সায়লর। অবশ্য এর ভেতরই একটা বুলেট আঘাত করেছে বেনের বাঁ কাঁধে। তবে সায়লর না থাকলে পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারতো। অফিসে এসেই দ্রুত ছাদে নিয়ে এসেছে সায়লর তাকে। ভাগ্য ভাল হেলিকপ্টারটা ছিলো। দ্রুত পাইলটকে ডেকে তাকে এটায় করে বিদায় করেছে সে।

বাস্টার্ড! দাঁতে দাঁত চাপল বেন। ব্লাডি হিউম্যান!

বেনের সামনে বসে আছে সেই সুন্দরী তরুণী। একটা সেলফোনে কথা বলছিল এতক্ষণ, এইমাত্র শেষ হলো তার কথা বলা।

খেঁকিয়ে উঠলো বেন। “ব্যাকআপের কি অবস্থা?”
“আট মিনিট,” দ্রুত জবাব দিল তরুণী, “ম্যাক্স!”
“অনেক সময়!” মুখ বিকৃত করল বেন। “সায়লর ততক্ষণ…

“ঠিকই সামলে নেবে। প্রশিক্ষিত সৈনিক সে। ধ্রুর চেয়ে কম ট্রেনিং পায়নি।”
“এবং গত ছয় বছর ডেস্কজব করেছে সায়লর,” চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলল বেন। “শরীরে চর্বি জমে গেছে ওর, সে খেয়াল আছে?… অর্গানাইজেশনের এক সময়কার বেষ্ট অপারেটর এখন একজন চর্বিসর্বস্ব অফিসকর্মী।”

ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো মেয়েটার। “এখানে সায়লরকে দোষ দিতে পারো না তুমি। সবার লাইফেই আপ ডাউন থাকে। … আর, আমার মনে হয়, সায়লর এটা উপভোগই করবে। প্রচন্ড পরিমাণ আত্নতুষ্টিতে ভোগে সে, নার্সিসিষ্ট একটা।”

 

“আর এই নারসিসিষ্টের জন্যই অর্গানাইজেশন এত গতি পেয়েছে। ও ঠিকভাবে হাল না ধরলে এতদিনে সব ফাঁস হয়ে যেত সাধারণ মানুষদের সামনে।”

পাশের সীট থেকে ল্যাপটপটা তুলে নিলো এ সময় তরুণী। দশ সেকেন্ড পর ল্যাপটপের স্ক্রিনটা বেনের চোখের সামনে ধরলো। বিল্ডিঙের আপার লেভেলের গ্যারাজের দৃশ্যটা ফুটে উঠেছে সেখানে। সায়লর সিগারেট টানছে একদিকে দাঁড়িয়ে। তার কাছ থেকে পনেরো হাত দূরে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রু।
চেহারা বিকৃত হয়ে গেলো বেনের। “নাহ! শালা… সায়লরটার জন্য মায়া লাগছে।”

হাসিটা বিস্তৃত হলো মেয়েটার ঠোঁটে। “আমার মনে হয় শোটা দেখা উচিৎ তোমার। আমি বেট ধরছি, তুমি এটা এঞ্জয় করবে।”

“ইউ আর লেইট,” কন্ঠটা শুনেই ঘুরল ধ্রু। পিস্তলটা বাগিয়ে রেখেছে সামনে।

হাসিমুখে এগিয়ে এল সায়লর। কালো শার্ট, কালো একটা ব্লেজার পড়ে আছে সে। সিগারেটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে নিজের হাত দুটো মাথার উপর উঠিয়ে দেখালো। “আনআর্মড। কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে, দেখতেই পাচ্ছো। অস্ত্র ছাড়া কারও গায়ে নিশ্চয়ই গুলি করবে না তুমি?… ইয়েপ! যা গেস করেছিলাম তোমার সম্পর্কে, সেটাই সত্য।”

পিস্তলটা ওর দিক থেকে এক চুলও সরায়নি ধ্রু। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে।

“আমাদেরকে স্যাবোটাজ করেছো, পিছু নিয়ে বিল্ডিঙে ঢুকেছো। এবং তুমি এ পর্যন্তও আসতে পেরেছো। এর মানে ধরে নিতে পারি নিচের সবাই শেষ। … উমমম… কেন এখানে এসেছো ধ্রু?”

“কিছু প্রশ্নের জবাব চাইতে।” দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করল ধ্রু।

“কিছু প্রশ্নের জবাব চাইতে?” হাসিটা বিস্তৃত হলো ওর চেহারায়। “কিছু প্রশ্নের জবাব চাইতে তুমি একটা গাড়িতে স্যাবোটাজ করেছো এবং এই বিল্ডিঙের সাতাশজনকে খুন করেছো? বাহ! এ কেমন প্রশ্ন তোমার ড্যুড? ইউ কুড জাষ্ট কল মি! কল করে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলেই ভালো হতো না? শুধু শুধু এতোজনকে খুন করা কি খুবই প্রয়োজন ছিলো?”

“সান অফ আ বিচ,” গাল দিয়ে উঠল ধ্রু।

“ওকে ওকে…” আরও এক পা এগিয়ে এল সায়লর। “ওকে… জিজ্ঞেস করো তোমার প্রশ্ন। জবাব দেবার জন্য তৈরী আমি।”

“ফ্লোরা… ফ্লোরাকে খুন করেছে কে?”
“অর্গানাইজেশন,” দ্রুত জবাব দিল সে। “ইনফ্যাক্ট… প্ল্যানটা অর্গানাইজেশনের ছিলো… শর্ট অফ… কিন্তু খুনটা আমিই করেছি। ইউ নো… আই লাইক…”
একটা পাশবিক হাসি ফুটে উঠল সায়লরের ঠোঁটে।

সাথে সাথেই ট্রিগারে চাপ দিল ধ্রু। সায়লরের পায়ের কাছে এসফল্টে মাথা কুটল বুলেট। লাফিয়ে উঠল সায়লর।

“হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম ম্যান?” খেঁকিয়ে উঠল সায়লর। “কি… হচ্ছে টা কি? ইট’স জাষ্ট গুড বিজনেস, নাথিং পার্সোনাল। আই জাষ্ট ডিড মাই জব, দ্যাট’স ইট!”

“দ্যাট’স ইট? দ্যাট’স ইট! আমার স্ত্রী,” পিস্তলটা নিচে নামিয়ে এক পা আগাল ধ্রু। “ফ্লোরা প্রেগনেন্ট ছিলো!”
“ছিলো তো ছিলো, তো?” ভ্রু কোঁচকাল সায়লর। “এমন তো না যে এটা তোমার জন্য খুব একটা কঠিন কিছু কিংবা আনএক্সপেক্টেড কিছু। অর্গানাইজেশনে যোগ দেওয়ার আগে ফ্রিল্যান্স কিলার ছিলে তুমি, তেইশজনকে খুন

করেছো। অর্গানাইজেশনে যোগ দিয়ে খুন করেছো আরও বারোজনকে। বিনিময়ে পেমেন্ট পেয়েছো প্রতিটা হিটের জন্য। … এটা ঠিক যে আজকে রেকর্ড পরিমাণ খুন করেছো তুমি, অলরেডী সাতাশজন শেষ। এন্ড… আনফরচুনেটলি… এর জন্য কোন পেমেন্ট পাচ্ছো না তুমি।”

“ফ্লোরা আমার স্ত্রী ছিলো। ওর পেটে আমার বাচ্চা ছিলো। দুজনকেই খুন করেছিস তুই?”
“বাহ! নিজের গায়ে লাগলেই তখন জ্বলে না? অন্যের ব্যাপারে কি? তুমি যাদের খুন করেছো আজ পর্যন্ত তারাও কারো না কারো স্ত্রী বা স্বামী ছিলো, তারাও কারো না কারো বাবা-মা বা সন্তান ছিলো। অন্যের প্রিয়জনকে তুমি খুন করলে ঠিক আছে, আর তোমার প্রিয়জনকে খুন করলেই রক্ত মাথায় উঠে যায়, না?… আজব!”
“আমি যাদেরকেই খুন করেছি তাদের পেছনেই কোন না কোন কারণ ছিলো?”

“ছিলো? … উমমমম.. হাসালে ড্যুড!” নিজের কপালে হাত রাখলো সায়লর। “তোমার নবম ভিক্টিম, যখন তুমি ফ্রিল্যান্সার ছিলে, লেক্সার কথা মনে আছে? চব্বিশ বছর বয়েসের কালো চুলের মেয়েটা, এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের বাইরে থেকে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে যাকে খুন করেছিলে, তার কি দোষ ছিলো?”

“ছয় বছর আগের কথা সেটা।”

“রাইট,” উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সায়লরের চেহারা। “ব্রাভো ম্যান, চমৎকার তোমার স্মরণশক্তি। আমি তো ভেবেছিলাম মনেই করতে পারবে না। তা, লেক্সাকে মনে আছে তোমার?”

“আছে… সাংবাদিক ছিলো সে।”

“হুম… সব মনে আছে দেখি। লেক্সা হায়াতের আরেকটা পরিচয় ছিলো। … আমার স্ত্রী ছিলো লেক্সা, এবং সেও তোমার ফ্লোরার মতো প্রেগনেন্ট ছিলো। এবং তুমি তাকে খুন করেছো।”

বিস্ময়ে হা হয়ে গেল ধ্রু।
লেক্সা হায়াত সায়লরের স্ত্রী ছিলো?

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত