অসীম সব জানে

অসীম সব জানে

কালকের কী প্রোগ্রাম ? কিছু ঠিক করেছিস?

নারে। ঠিক করে ফ্যাল। আমি আছি।

আজ ?
কিছু না। বিন্দাস রেস্ট। প্রচুর ম্যাগাজিন জমে গেছে। মা অ্যাদ্দিন ছুঁতে দেয়নি। আজ সেগুলো
গিলব।

জানিস, আজ রাতে মেগাচ্যানেলে র্যাম্বো দেখাবে।

র্যাম্বো? সিলভেস্টার স্ট্যালোন?

ইয়েস। মিস করিস না।
ক্লাস এইটের শেষ পরীক্ষা দিয়ে উড়তে-উড়তে বাড়ি ফিরল রণিত। আঃ! এ বছরের
মতো মুক্তি। আর ওই চ্যাপ্টারগুলো পড়তে হবে না। রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত এনতার
ছুটি। মা-বাবার প্যানপ্যানানি নেই। এ কদিন শুধু জমিয়ে আড়াবেড়ানো, সিনেমা আর
গল্পের বই।
কীভাবে যে রণিত পরীক্ষা দিল এ বছর। পরীক্ষায় আদৌ বসতে পারবে কিনা, সিওর ছিল
না। অ্যানুয়ালের মাস দুয়েক আগে আচমকা ঘটে গেল ঘটনাটা। দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। দিন পনেরো
বই নিয়ে বসতেই পারেনি। বন্ধুদের মধ্যে ওর অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ ছিল। হাত-পা কাপত, মাথা
বিমঝিম করত।
বাবা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলেন। একসপ্তাহ টানা কাউন্সেলিং করতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টায় মানসিক বিপর্যয় থেকে বেরোতে পেরেছে রণিত। পড়ার চাপ তাতে
সাহায্যই করেছে।

কিন্তু এখন গুছিয়ে বসে পত্রিকার পৃষ্ঠা ওলটাতেই সেই ঘটনাটা এসে হাজির হল। গল্পে মন
বসাতে খুব চেষ্টা করল রণিত। হল না। বারবার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছটফট করতে
করতে । উঠে পড়ল।
ডুইংরুমে টিভি চলছে। কী হচ্ছে? মা দেখছে।
সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। রিয়্যালিটি গানের শো। সারা ভারত থেকে বাছাই করে নতুন গায়ক
গায়িকা হাজির করানো হয়েছে। তারা পরপর স্টেজে উঠে গান গেয়ে যাচ্ছে। একদিকে বিখ্যাত।
বিচারকরা কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে আছেন। মাথা দোলাচ্ছেন গানের তালে। শেষে প্রচুর
হাততালি দর্শকদের। বিচারকরা নাম্বার দিচ্ছেন।
এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলেই প্রায় সব চ্যানেলে একরকম শো। গান, নাচ। কোথাও আবার জোন্স,
আাকটিং। প্রচুর প্রাইজ মানি।

ভারতে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল, জানা যায়নি আগে। এদের মধ্যে কয়েকজন বেশ ভালো।
গাইছে।
ফোন বেজে উঠল। ও ধরল।
হ্যালো, রণিত? পিনাকী বলছি।
হ্যা, বল।
কাল বারোটায় স্টেশনে মিট করছি। তুই, আমি, শৌভিক আর রূপ। শিয়ালদা থেকে নন্দন।
সিনেমা ?
হ্যা। চলো, লেটস গো। বাংলা বই। একদম নাকি অন্যরকম। দিদিরা দেখে এসেছে। বলল।
ঠিক হ্যায়?
ঠিক হ্যায়।
র্যাম্বো মনে আছে তো? এগারোটায়।
অবশ্যই। থ্যাঙ্কস।
দশটা বাজে। মা উঠে পড়ল। রান্নাঘরের দিকে এগোল। ফ্রিজ থেকে বের করে খাবার গরম
করবে। ভাত বসাবে। বাবা একটু আগে চেম্বার থেকে ফিরেছেন। চান করে সোফায় এলিয়ে খবরের
কাগজ পড়ছেন।

বাবা, র্যাম্বো দেখেছ?
হ্যা, স্ট্যালোন। অ্যাবসৰ্বিং মুভি।
আজ মেগাটিভিতে এগারোটায় দেখাচ্ছে। দেখবে?
নারে। পারব না। কাল ফাস্ট আওয়ারে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে ইমপরট্যান্ট মামলা আছে।
ন’টায় বেরিয়ে পড়তে হবে। তুই দ্যাখ। এনজয় কর ।

পৌনে এগারোটায় রিয়্যালিটি শো শেষ হয়ে গেল। খাওয়া শেষ। মা থালা তুলে উঠে পড়ল।
রণিত রিমোট নিয়ে সেন্টার টেবিলে পা ছড়িয়ে আয়েশ করে বসল।
প্রায় আরম্ভ থেকেই ঝড়। র্যাম্বো—সিলভেস্টার স্ট্যালোন। দেবদূতের মতো নিস্পাপ, পবিত্র
মুখ। শরীর যেন গ্রিক ভাস্কর্য। যখন আাকশনে তখন ক্রোধ কাঠিন্য ফুটে বেরোচ্ছে পেশিতে। অন্যসময়
কোমল, মায়াবি।।

চ্যানেলে সিনেমা দেখায় একটাই বিরক্তিকর ব্যাপার। পনেরো মিনিট পরপর বিজ্ঞাপনের বিরতি।
যখন চরম রুদ্ধশ্বাস মুহুর্ত, কী হয়-কী হয়, ঠিক সেইসময় ইরফান। পাঠান বাইক চড়ে হাজির। বাইকের
বিজ্ঞাপন। বা শাহরুখ। কিংবা বচ্চন রঙের বিজ্ঞাপনে। মনোসংযোগ পুরো নষ্ট করে দেয়।
কোয়ার্টজ ক্লকে টুটাং-বারোটা বাজল। চারিদিক নিস্তদ্ধ হয়ে এসেছে। মফঃস্বল শহর ঘুমিয়ে
পড়েছে। বাবা-মার ঘর অন্ধকার।
আবার বিজ্ঞাপনের বিরতি চলছে। ঘুম-ঘুম পাচ্ছে রণিতের। বেসিনে গিয়ে চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে
এল। যত রাত হোক, পুরো সিনেমাটা দেখতে হবে। কাল সকালে ওঠার কোনও তাড়া নেই।
টিভি জুড়ে স্ট্যালোনের মুখ। মুখের প্রতিটি পেশিতে ঢেউ খেলছে, তীক্ষ চোখ সতর্ক সৃষ্টি ফেলছে।

হঠাৎ—হঠাৎ—
রণিত শিউরে উঠল।

এ তো স্ট্যালোন নয়। পরদায় আর স্ট্যালোন নেই। তার বদলে..তার বদলে..
অসীম তাকিয়ে আছে।
অসীম ? অসীম আসবে কোথেকে? মনের ভুল। হতেই পারে না।
চোখ মুছে তড়াক করে সোজা হয়ে বসল রণিত।

না—হ্যা, এ তো অসীম! অসীমের মুখ।

সেই ফরসা টুলটুলে মুখে পরিচিত হাসি। একদৃষ্টে দেখছে রণিতকে।
কুলকুল করে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর দিয়ে। কী দেখছে ও? অসম্ভব, অবিশ্বাস্য।

তাড়াতাড়ি রিমোট নিয়ে চ্যানেল পালটে দিল।
এ কী! এখানেও অসীম!

পাগলের মতো পটপট করে চ্যানেল পালটাচ্ছে রণিত।
সব চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেছে? অসীম। সবখানেই অসীম।
অসীমের ছবি এবার আর স্থির নয়। অসীম হাসছে। হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে রণিত।
কীরে রণিত, আমায় দেখতে চাইছিস না ?
অসীম কথা বলছে? হাত-পা জমে গেছে রণিতের। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।
আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড? সবাই তো সেরকমই জানে। বন্ধুকে দেখে খুশি হচ্ছিস না?
রণিত পাথরের মতো নিথর!
আমার যে তোকে ভীষণ । দরকার বন্ধু। পরীক্ষা চলছিল বলে তোকে বলতে আসিনি। এমনিতেই
তুই যা ভেঙে পড়েছিলি! সবসময় কাদতিস, পড়তে পারতিস না। সবটাই আমার জন্যে। আমি।
শুধু দেখেছি, কষ্ট পেয়েছিস। কিছু করার ছিল না।
রণিতের দু-চোখ বিস্কারিত, বাকশক্তিরহিত।
কীরে, কথা বল? অ্যাই রণিত, আমায় ভয় পাচ্ছিস কেন রে? তোর বন্ধুত্বের টানই তো ফিরিয়ে
এনেছে আমাকে। যেতে গিয়েও যেতে পারিনি। তুই আমায় একটু হেল্প করবি না, রণিত? একটু
হেল্প! কীরে, বল ?
আ-আমি.-তোকে..ত-তুই..
হ্যা, আমি আর বেচে নেই রে। আমার কোনও শরীর নেই। সেইজন্যেই আমি কিছু করতে
পারছি না। তোকে চাইছি। তুই আমায় ভয় পাচ্ছিস! প্লিজ, রণিত, একটু হেল্প কর।
হ-হেল্প ?
হ্যা, হেল্প। তাহলেই সত্যিটা প্রকাশ পাবে। সেদিন কী ঘটেছিল, কেউ জানে না। সবাই জানে,
পুকুরে ডুবে আমি আত্মহত্যা করেছি।
ত্ৰ-তুই সুইসাইড করিসনি?
নাঃ! কেন করব? শেষ পর্যন্ত তোর সঙ্গেই তো ছিলাম। মনে নেই? মিশন থেকে বেরিয়ে
মিশনপাড়া দিয়ে দুজনে হাটছিলাম। গল্প করতে করতে।
হ্যা মনে আছে। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে এল। ঝড় উঠল।
ঠিক বলেছিস। কালবৈশাখী। তারপরেই শুরু হল বড়-বড় ফোটায় বৃষ্টি। তুই বা-দিকের রাস্তা
ধরে ছুট দিলি। ছুটতে-ছুটতে বললি, ‘কাল স্কুলে দেখা হবে, ট-টা।’ মনে আছে?
হ্যা।
তোর বাড়ি কাছেই। মিশনপাড়ার শেষে। আমার বাড়ি সেই উত্তরপাড়া। অনেকখানি দূর। ভাবলাম,
কাছে কাকুর বাড়ি। সেখানে একটু থাকি। বৃষ্টি ধরলে বাড়ি ফিরব। ওখান থেকে বাড়িতে ফোন
করে জানিয়ে দেব।
কাকু মানে রামুকাকু?
হ্যা। কাকুর বাড়ি ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলাম। বাইরে একটা কালো বড় গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
ভিতরে অনেকের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। দরজা বন্ধ। জানলা দিয়ে উকি দিয়ে দেখি, বসার ঘরে
কয়েকজন ষণ্ডামতন লোক কাকুর সঙ্গে কথা বলছে। টেবিলের ওপর একটা সুটকেসে অনেক-অনেক
টাকা ভরতি! কালো, মোটা একজন হঠাৎ কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে বলল, ‘তুমি ও
নিয়ে ভেবো না, রামুদা। একটু বেচাল করলেই চালিয়ে দেব। খালাস।পিস্তল দেখে আমি আঁতকে
উঠেছি। মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে গেছে। অমনি—
অমনি?
অমনি ওরা মুখ ফিরিয়ে চেচিয়ে উঠেছে, কেকেরে?’ আমি কী করব, বুঝতে না পেরে ছুটে
পালাতে গেছি। বারান্দাটা জলে ছপছপ করছিল। পিছলে পড়ে গেলাম। ওঠার আগেই ওরা বেরিয়ে
এসে আমায় ধরে ফেলল।তারপর…?
কাকু বারবার কাকুতি মিনতি করছিল, ‘ওকে ছেড়ে দাও। ও কাউকে কিছু বলবে না। ও আমার একমাত্র ভাইপো। ওদের সর্দার মোটাটা উড়িয়ে দিল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে রামুদা? সাক্ষীর
শেষ রাখতে নেই। তুমি নিজে মরবে, আমাদেরও মারবে।’
তারপর…?
আর শুনে কী করবি, রণিত? তখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। রাস্তাঘাটে
একটাও লোক ছিল না। চ্যাংদোলা করে ওরা আমায় টানতে-টানতে নিয়ে গেল মিশনের পুকুরে।.উ:,
জলে দম আটকে মরতে কী কষ্ট রে। উঃ, এতটুকু বাতাসের জন্যে খাবি খাচ্ছিলাম.ওরা আমায়
জলে ঠেসে ধরছিল…
ত-তুই থাম! আর শুনতে পারছি না।
এইজন্যেই তো এতদিন আসিনি। তোকে বলিনি। তুই এত ভেঙে পড়েছিলি! আগে জানলে
তুই পরীক্ষাই দিতে পারতিস না।
দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে রণিত। কানার প্রবল বেগ ঠেলে আসছে বুক থেকে। আবার
সেই ছবিটা! অসীমের জলে ডোবা ফুলো-ফুলো নিম্পন্দ শরীর খাটে শোয়ানো। ওর মা আছাড়ি
পিছাড়ি কাদছেন।
শোন রণিত, কাদিস না রে। কেঁদে কী লাভ? আমি তো আর ফিরে আসতে পারব না। শুধু
একটা কাজ কর ভাই। ওদের মুখোশ খুলে দে। সত্যিটা সবাই জানুক।
কী করতে হবে?
কাল সকালেই তুই মেসোমশাইকে নিয়ে থানায় গিয়ে এই ঘটনাটা বল। কাকুকে পুলিশ কড়া
করে জেরা করলেই সব বলে ফেলবে। আমি সিওর, কাকু কোনও খারাপ দলের সঙ্গে যুক্ত। অত
টাকা.পিস্তল.অতগুলো খুনি, গুন্ডা.আমি চাই সবকটা ধরা পড়ুক। তবেই আমার শাস্তি হবে।
যাব, নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু পুলিশ কি আমার কথা বিশ্বাস করবে:
করবে। বলবি, যদি মিথ্যে হয়, তুই দায়ী থাকবি। আমি মারা যাওয়ার পরে তোকে তো অনেকবার
থানায় ডেকেছিল। ডাকেনি?
তাহলে? সবাই জানে, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রাণের বন্ধু। তুই আমার সব জানিস।
যন্ত্রের মতো ঘাড় নাড়ল রণিত।
চলি রে। আর বোধহয় দেখা হবে না। এই কথাগুলো বলার জন্যেই আমায় আটকে থাকতে
হয়েছিল।.
বাবিন, নটা বাজে। আমি বেরোচ্ছি। উঠবি না?
রণিত ধড়মড় করে উঠে বসল। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। সামনে বাবা। হাসছেন।
বাঝা। রাম্বো দেখতে-দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলি! টিভিটাও বন্ধ করতে পারিসনি। মা সকালে।
সুইচ অফ করেছে। তোকে নিয়ে আর পারা গেল না।
বাবা! বাবা! তোমায় এখনি আমার সঙ্গে যেতে হবে।
যেতে হবে? কোথায় ?
থানায়।
থানায়? কী বলছিস পাগলের মতো? আমি এখনই কোর্টে বেরোচ্ছি।
না, বাবা। তোমায় যেতেই হবে। আমি একা গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না। তুমি, প্লিজ, জানিয়ে
দাও, কোর্টে যেতে তোমার দেরি হবে। প্লিজ বাবা।
আরে! কী হয়েছে, বলবি তো?
বলব, সব বলব। তোমায় বিশ্বাস করতেই হবে। অসীম সুইসাইড করেনি। ওকে খুন করা হয়েছে।
থানায় গিয়ে এটা আমায় বলতেই হবে।

……………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………….

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত