নাগমতীর উপাখ্যা

নাগমতীর উপাখ্যা

দময়ন্তী অবাক চোখে নাগওয়াড়ি গ্রামটাকে দেখছিল।
দিগন্তবিস্তৃত গমক্ষেত ফুরফুরে হাওয়ায় হিলহিল করে দুলছে! তার উপর বিকেলের ঢলে যাওয়া গলন্ত আগুনের মত পড়ন্ত রোদ চাঁদোয়া ছড়িয়েছে । বিস্তীর্ণ মাঠের ওপরে কে যেন বিন্দু বিন্দু সোনালি ফোঁটা এঁকে দিয়েছে। দূর থেকে মনে হয় সোনালি রঙ যেন উৎসব লাগিয়েছে মাইলের পর মাইল জুড়ে। কাঁচা সোনার ঢল নেমেছে। কোথাও সোনালি গম, কোথাও কাঁচা সোনালি রঙের ভুট্টা। ভুট্টাক্ষেতের মধ্যে হাঁড়ি মুখো কাকতাড়ুয়ার লুকোচুরি। দুহাত ছড়িয়ে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্ষেতমজুরদের রোদে পোড়া কালো পিঠ ঘামে তেলতেলে। মনে হয়, মানুষ নয়—তেলরঙে আঁকা কতগুলো সিল্যুয়েট নড়াচড়া করছে মাঠের মধ্যে। কিছু শ্রমিক গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে উঠে আসছে ক্ষেত থেকে। আজকের মতন কাজ শেষ তাদের। মাঠ থেকে উঠে আসতে আসতে চিৎকার করে বলছে—‘হো-ই নামদেব, তুহানু কাম নু মুকাম্মল করা লাই হ্যায়? আজকের মত কাজ শেষ তোর?
নামদেব নামক ক্ষেতমজুরটি উত্তর দেয়—‘ জি গুরশরন। হুনা মৈনু চাওয়াল-রোটি শোট্টি খানা ঔর মস্ত সো’না। কল্‌হা মিলাগে!’
‘লোঢ়ি দে বারে না ভুলিও! তুরন্ত পঁহোছ যাইও।’
‘আ-হোঃ’।
আজ এখানে লোঢ়ি। লোঢ়ি এখানকার অন্যতম বিখ্যাত উৎসব। লোঢ়ির দিনটি ওদের সবার কাছে বিশেষ। আজকের দিনই নাকি বছরের সবচেয়ে ছোট দিন, এবং বৃহত্তম রাত্রি। পরের দিন ‘মকর সংক্রান্তি’। এই দিনটিতেই ওরা উৎসব করে। আগুন জ্বালায়। সেই আগুনে নানারকম শস্য খাদ্যদ্রব্য পোড়ায়। বাচ্চা ছেলেরা সকালবেলা থেকেই সব বাড়িতে লোঢ়ি’র ‘লুট’ চাইতে বেরোয়। টাকা, পয়সা, বাদাম, তিল ইত্যাদিই সেই ‘লুটের সামগ্রী’। পছন্দ মতন ‘লুট’ পেলে গান ধরে ‘ডাব্বা ভরায়া লিরা দা/ আয় ঘর আমীর দা’। অর্থাৎ দুহাত ভরে লুট দিয়েছে, তাই এই ঘর আমীরের। কিন্তু সবজায়গাতেই তো পছন্দমত ‘লুট’ পাওয়া যায় না। কোনও কোনও গৃহস্বামী ‘লুটের’ নাম শুনে দাঁত কিড়মিড় করে তাড়া করে। তখন ওরা গায় ‘হুক্কা ভাই হুক্কা/ আয় ঘর ভুক্কা!’ অর্থাৎ এখানে সব হাড়-হাভাতের দল বাস করে।
ভাবতে ভাবতেই দময়ন্তী সূর্যের দিকে তাকায়। হয়তো সত্যিই আজ বছরের সংক্ষিপ্ততম দিন। কারণ ইতিমধ্যেই সূর্যটা কমলা হতে শুরু করেছে। এখন ওরও অবসর নেওয়ার সময় হল। আকাশে দু একটা ছোট্ট সাদা মেঘের টুকরো গড়িমসী করে গড়াচ্ছিল। সন্ধের আলো নেমে আসতেই তাদের সাদা দেহে নানারকম রঙের খেলা শুরু হয়ে গেল। বিরাট ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটুকরো ঝিলের অংশ। সবুজ-হলুদ ক্ষেতের মধ্যে একটু তরল নীল রঙ। কখনও চিকিমিকি, কখনও ঝিকিমিকি করে শান্ত ভাবে বয়ে চলেছে। আকাশটা ইতিমধ্যেই একমুঠো ফাগ, আর অভ্র যেন ছিটিয়ে দিল তার গায়ে। নানারঙে ঝলমল করে উঠল ঝিলের জল!
এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল দময়ন্তী। দীর্ঘ বাইশ বছরের জীবনে এই প্রথম তার নিজের গ্রামে আসা। ঠাকুর্দা একসময় এই গ্রামের শিব মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। তখনও মা-বাবার সঙ্গে এই গ্রামে বেড়াতে আসার কোনও স্মৃতি নেই ওর। বাবা-মা পারতপক্ষে এ গ্রামের ছায়া মাড়াতেন না। ঠাকুর্দাও কখনও তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানাননি। বরং শহরে ওদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন নাতনিকে দেখতে। দু হাত ভরে নানারকমের জিনিস উপহার দিতেন। কিন্তু একবারও মুখ ফুটে বলেননি—‘তোরা একবার গ্রামের বাড়িতে আয়’। ছোটবেলায় যখন ওর বাকি বন্ধুরা মামাবাড়ি বা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত, তখন ছোট্ট দময়ন্তীও বায়না করত নিজেদের গ্রামে যাওয়ার। বাবা বলতেন—‘ঐ নরক একবার ছেড়ে এসেছি। আর কেউ ওখানে মরতে যায়?’
মা ভয় দেখাতেন—‘ও গ্রামে কেউ পড়াশোনা করে না। অল্পবয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তুই ওখানে গেলেই ‘পঞ্চো’ তোকে ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে। আর মা-বাবাকে দেখতে পাবি না। স্কুলে যেতে পারবি না’।
‘পঞ্চো’ তথা পঞ্চায়েতের ভয়ে তখনকার মত নিবৃত্ত হত দময়ন্তী। ‘পঞ্চো’ তার কাছে জুজুর চেয়ে কিছু কম ভয়ঙ্কর ছিল না। বড় হওয়ার পরেও সে ভয় যায়নি। বরং আরও বেড়েছে। সে শুনেছে, ‘পঞ্চায়েত’ যা খুশি তাই করতে পারে। তাদের এক কথায় কত মেয়েকে যে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কত ‘অনার কিলিং’ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তার ঠাকুর্দা কখন সখনও বলতেন সেই ইতিহাস! শুনতে শুনতে তার শিক্ষিত মানসিকতায় পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত প্রদেশের এই ছোট গ্রামটাকে নরকেরই আরেক নাম বলে মনে হত। এই সৌন্দর্যের পেছনে যে কতরকমের নারকীয় কান্ড লুকিয়ে রয়েছে তার কোনও হিসেব নেই।
এখানে কোনওদিন তার আসার কথা ছিল না। নিজের শিকড় সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ দময়ন্তী তবু কীসের যেন টানে চলে এল এখানে। আসার উদ্দেশ্যটা একমাত্র সে-ই জানে। তার সঙ্গী সোমকে সে ঘটনার বিন্দুমাত্র আভাসও দেয়নি সে। শুধু এইটুকু জানে, এখানে তাকে আসতেই হত। আজ হোক, কাল হোক—তার এখানে আসাটা অমোঘ। ভাগ্য নির্ধারিত।
‘অ’সাম ভিউ!’ তার বন্ধু সোম একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল—‘এমন মাইলের পর মাইল গমক্ষেত আগে কখনও দেখিনি! আমার মা-বাবা দুজনই শহুরে। গ্রামের বিউটি দেখার সুযোগ পাইনি। তুই খুব লাকি রে!’
‘নাগওয়াড়ি মানে জানিস?’ সে যেন একটু অন্যমনস্ক স্বরে উত্তর দেয়—‘সাপেদের গ্রাম!’
‘মানে?’ প্রায় ক্ষেতের মধ্যেই লাফিয়ে উঠল সোম—‘এখানে সাপ আছে নাকি?’
‘আপা এ চিহারে নু দেখা! ভয়ে একেবারে সফেদ হয়ে গেলি যে!’ খিলখিল করে হেসে ওঠে দময়ন্তী।
‘না, মোটেই না! সাপকে আমি ভয় পাই নাকি?’
‘মতবল্‌, তুই সাপকে ডরিস্‌ না!’
‘না, একদম না!’ সোম দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল—‘এই বিউটির মধ্যে মরতেও আমি রাজি’।
মনে মনে ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল সে। সোম এই গ্রামের ইতিহাস জানে না। তাই এই প্রত্যন্ত গ্রামের আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, সরল দৃশ্যকেই সত্যি ভেবে নিয়েছে! যখনই যা দেখছে, ক্যামেরাবন্দী করে নিচ্ছে। যেন এসবটাই কোনও দুর্মূল্য মুহূর্তের অংশ।
‘সমভাল্‌কে বাত করিও’। তার মুখে অম্লরসাক্ত হাসি—‘যা দেখা যায়, তা হয় না। গুলাব নাল কান্দে ভি হোন্দে হ্যায়’।
গোলাপের মধ্যে কাঁটাও থাকে। অত্যন্ত পরিচিত প্রবাদ। সোম অবশ্য কথাটাকে পাত্তা দিল না। বরং প্রসারিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল—‘সমঝিয়া। কিন্তু ওটা কী’!
দূরে, ক্ষেতের একপাশে অনেকটা ন্যাড়া জমি। তার বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ছোট্ট মন্দির। সন্ধ্যার আলো তার চূড়া স্পর্শ করতে না করতেই সেখানে আচমকা শঙ্খ বেজে উঠল। দূর থেকে ভেসে আসছে স্তব, ঘন্টাধ্বনি। কীসের মন্ত্র বলছে বোঝা মুশকিল। কিন্তু অস্ফুট উচ্চারণের মধ্যে এক অদ্ভুত পবিত্রতা খেলা করছে।
দময়ন্তী মৃদু হাসল—‘দাদাজি মৈনু ইক কহানি দস্যিয়া। দাদাজির মুখে শুনেছি ঐ মন্দিরের গল্প। ওটা নাগমতীর মন্দির। বাইশ বছর আগে ওটা ভাঙা শিবমন্দির ছিল। এখন বাইশ বছর ধরে নাগমতীর মন্দির ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই মন্দিরের জন্যই গ্রামের নাম নাগওয়াড়ি’।
‘শিবমন্দিরের বদলে আরেকটা মন্দির! তাও আবার নাগমাতার!’
‘আহোঃ! নাগমাতা নয়, নাগমতী’।
‘সে কী!’ সে অবাক। আজ পর্যন্ত অনেক রকম মন্দির দেখেছে। ঝকঝকে চকচকে মন্দির থেকে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা মন্দির—কিছুই তার তালিকায় বাদ নেই। কিন্তু শিবমন্দির রূপান্তরিত হয়ে অন্য কোনও মন্দির হতে এই প্রথম দেখছে। সোম উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সে ভীষণভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী। আর মন্দিরের সঙ্গে ফাউ হিসাবে কোনও গল্প পেয়ে গেলে তো কথাই নেই।
‘আজ লোঢ়ি’। আপনমনেই বলল দময়ন্তী—‘আজ সঙ্গে সঙ্গে নাগমতীরও পুজো হবে। মেয়েরা নাগমতীর চৌকিতে জল, দুধ ঢালতে আসবে। মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য প্রার্থনাও করবে’। বলতে বলতেই সে হাতঘড়ি দেখে—‘আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে আরতি’।
কথাটা শেষ করেই সে পা বাড়াল মন্দিরের দিকেই—‘চল্‌, আরতি দেখে আসি’।
‘আরতি দেখবি! তু-ই!’
সোম সরু চোখে দময়ন্তীকে জরিপ করছিল। দময়ন্তী চিরকেলে নাস্তিক। সোমের ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে সুযোগ পেলেই কথা শোনায়। মন্দির, দেবদেবীর বিষয়ে সে কোনওদিনই উৎসাহবোধ করে না। অথচ সেই মেয়েই এই অখ্যাত গ্রামের কোন এক অজ্ঞাত ‘নাগমাতার না নাগমতীর চৌকি’ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে!
‘কোনওদিন তো মন্দিরের ধারকাছ দিয়েও হাঁটিস না!’ সে বলে—‘আচমকা এত ভক্তি কোথা দিয়ে এল? এ তো রীতিমত ‘চমৎকার’’!
‘ভক্তি নয়!’ হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিল দময়ন্তী—‘চমৎকার বলতে পারিস। দাদাজির মুখ থেকে এই মন্দিরের গল্প শুনেছি আমি। এই মন্দিরের গড়ে ওঠাটাই একটা চমৎকার’।
‘মানে?’
‘মানে ঐ মন্দিরে যার পুজো হয়, তিনি কোনও দেবদেবী নন্‌’। সে মুচকি হাসল—‘এক সাধারণ নারী। এবং অবশ্যই তিনি একজন মানবী ছিলেন’।
‘তাতে আশ্চর্য কী!’ সোম উত্তর দেয়—‘জেসাসও মানুষ ছিলেন। শিরডির সাঁইবাবাও মানুষ’।
‘ঠিকই’। দময়ন্তী দ্রুত পায়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল—‘কিন্তু এই মহিলার তাদের মত কোনও দিব্যশক্তি ছিল না। মেয়েটির নাম ছিল রাণো। আর পাঁচটা সাধারণ ‘ঔরতের’ মতই ছিল সে। কারোর মেয়ে, কারোর ‘পত্নী, কারোর ‘পরজাই’, কারোর ‘ভাবিজি’’।
‘আর তার জন্যই কিনা আস্ত একটা মন্দির বানিয়ে ফেলা হল!’ সোম বলে—‘আমার ধারণা ছিল, পাঞ্জাবের গ্রামে মেয়েদের সম্মান-ইজ্জত অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অনেক কম! বাড়ির বৌ-মেয়েকে তো এরা মানুষ জ্ঞানই করে না! সেখানে একজন বাড়ির বৌয়ের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে! এমনকি লোকে তাকে পুজোও করছে!’ সে একটু থেমে যোগ করল—‘ কুছ তো ‘অটপটা’ হ্যায়! আমার বিশ্বাস হয় না’।
‘সেইজন্যই তো মন্দিরটা এত ‘খাস! এক অদ্ভুত কঁহানি আছে এর পেছনে।’ দময়ন্তী আঙুল তুলে মন্দিরের চূড়ার দিকে নির্দেশ করে—‘ঐ দ্যাখ্‌’।
মন্দিরের চূড়ায় পাথর খোদাই করে নানারকম ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পড়ন্ত আলোয় সিঁদুরে-কমলায় মাখামাখি হয়ে উঠেছে মন্দিরের চূড়ো। সেদিকে তাকাতেই নজরে পড়ল এক অদ্ভুত ভাস্কর্য! এক গর্ভবতীর গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছে এক প্রকান্ড কালনাগ! গর্ভবতী নারীটি পরম যত্নে ধরে রেখেছে সেই সাপের দেহ। অদ্ভুত স্নেহময় ভঙ্গিমায় নিজের স্তন্যপান করাচ্ছে কালনাগকে। যেন কালনাগ তারই সন্তান!
‘এ কী!’ বিস্ময়ে সোমের মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। কী ইঙ্গিত বহন করছে এই ভাস্কর্য! এ যে অসম্ভব!
‘ঠিক ধরেছিস’। দময়ন্তী মৃদু হাসল—‘রাণো সবদিক দিয়েই একজন সাধারণ নারী ছিল। কিন্তু একটা অসাধারণ কাজ সে করেছিল। মানবী হয়ে এক সাপকে জন্ম দিয়েছিল সে’।
‘সে কী!’ সোম শিউরে ওঠে—‘এরকম কখনও হয় নাকি? একজন মানুষ কখনও সাপকে জন্ম দিতে পারে? অসাভাওয়া!’
‘তুই অসম্ভব বললে তো চলবে না’। দময়ন্তী বলে—‘গোটা গ্রাম সাক্ষী। রাণো একটি সাপকে জন্ম দিয়েছিল। সে কথা এ গ্রামের ‘বাচ্চা বাচ্চা’ পর্যন্ত জানে!’
‘বাট হাউ!’ সোম অবিশ্বাসী কন্ঠে বলে—‘আই মিন্‌ দিস ইজ ইম্পসিব্‌ল্‌!…হতেই পারে না!’
‘হতেই পারে না! কিন্তু হয়েছে। গোটা গ্রামের চোখের সামনেই হয়েছে’। তার চোখ চকচক করে ওঠে। সন্ধ্যার মায়াবী আলো নরম আমেজে লেপ্টে গিয়েছে তার মুখে, দেহে। রাণো কী ছিল—স্বাভাবিক মানবী না দৈবীশক্তির আধার তা সোম জানে না। কিন্তু এইমুহূর্তে দময়ন্তীকে তার অলৌকিক অস্তিত্ব বলে মনে হচ্ছিল! দময়ন্তী মন্দিরের চূড়ার দিকেই চোখ রেখে বলল—‘সে ইতিহাস দাদাজির মুখে আমি খানিকটা শুনেছি। তুই শুনবি?
সোমের মনে হল—এ জিজ্ঞাসা নয়, আদেশ! সে বাধ্য ভাবে ঘাড় নেড়ে বলে—‘শুনবো’।
‘তবে শোন…!’
এখান থেকেই শুরু হল রাণোর মানবী থেকে দেবী হয়ে যাওয়ার আখ্যান। মানবীর গর্ভে এক সাপের তিলতিল করে বেড়ে ওঠার কাহিনী।

২.
সেদিন পঞ্চায়েতপ্রধান ওরফে ‘সরপঞ্জের’ মুখ ছিল থম্‌থমে। রাণো লক্ষ্য করে দেখেছে, এই লোকটা কোনওদিন হাসে না। বিরাট লম্বা সাদা দাড়ির শুভ্রতাও ওর মুখটাকে একটু নরম, একটু স্নিগ্ধও করে তুলতে পারেনি। বরং তাকে আরও বেশি নিষ্ঠুর করে তুলেছে। নিজের শ্বশুর হওয়ার দরুণ এ ক’মাস খুব কাছ থেকেই তো দেখছে লোকটাকে। ওকে দেখলে মনে হয়, আসলে ও মানুষ নয়। আসলে ও একটা পাগড়ি! অনেকগুলো চলমান পাগড়ির মধ্যে অভ্রভেদী অহঙ্কারে উঁচু হয়ে থাকা এক পাগড়ি বিশেষ। কোনওদিন এ পাগড়ি কারোর সামনে নত হওয়ার নয়। পরাজয় স্বীকার করতে, হেঁট হতে—এ পাগড়ি জানে না!
পঞ্চায়েতপ্রধানের চোখ হিংস্র কুটিলতায় ভরে ছিল। আজ সর্বসমক্ষে সতনামের বিবির বিচার হওয়ার কথা। অপরাধিনীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সঙ্গে! সারাগায়ে, মুখে রক্ত লেগে আছে। সারাদেহে এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে কালশিটে নেই! মার খেয়েছে প্রবল। দেখলেই মনে হয়, সে পাঞ্জাবি নয়। বরং তার মুখে পাঞ্জাবি মেয়েদের কাঠিন্য প্রধান সৌন্দর্যের চেয়ে মঙ্গোলীয় পেলবতা বেশি! রাণো মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই গ্রামের ‘হর দুসরি ঘরের কঁহানি’ এক। এই গ্রামে যত বিবাহিত মেয়ে আছে, তাদের মধ্যে পাঞ্জাবি মেয়ের সংখ্যা কম। কেউ বিহার থেকে, কেউ বঙ্গাল থেকে কিংবা কেউ বা অসম থেকে আমদানি হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, ওরা ঘরের বৌ মোটা দামে কেনে। যাদের টাকা আছে, বিয়ে একমাত্র তাদেরই হয়।
উপায় নেই। পাঞ্জাবে এমনিতেই মেয়ের সংখ্যা কম। তার ওপর গণহারে কন্যাশিশুহত্যা লেগেই আছে। কারোর বাড়িতে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে দুধের মালসায় ডুবিয়ে, শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়। সুতরাং বিয়ের জন্য মেয়ে আসবে কোথা থেকে? এ গ্রামের পুরুষদের সবারই যৌনজীবনের প্রবল আকাঙ্খা! কিন্তু কারোর ঘরে মেয়েসন্তান ইপ্সিত নয়! কারোর মাথায় এটা ঢোকে না, যে শুধুমাত্র পুরুষে যৌনতা হয় না। তার জন্য নারীও লাগে। অথচ নারী নেই!
এই তো, কদিন আগেই পরমিন্দরের বৌ এক কন্যাসন্তানের জননী হয়েছিল। এদিকে বৌয়ের গর্ভযন্ত্রণা চলছে। প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে বৌটা। অন্যদিকে বিরাট হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছে দুধ। আবার পাশাপাশি বাটা হচ্ছে চন্দন, হলুদ। পুত্রসন্তান হলে তাকে তেল,হলুদ, চন্দনে বরণ করে নেওয়া হবে। আর কন্যাসন্তান? তার জন্যই তো প্রকান্ড মালসায় গরম হচ্ছে দুধ।
পরমিন্দরের বিবির কপাল খারাপ। এক মেয়ের জন্ম দিল। তার শাশুড়ি তাকে ‘করমজলি, কালমুহি’, প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করতে করতে সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে ডুবিয়ে ধরলেন দুধের কুন্ডে। বৌটা প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করার পরেও দুর্বল বাধা দিতে পেরেছিল। আছাড়ি পিছাড়ি খেয়েছিল স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির পায়ে। কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না বুকের ধনকে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তার অসহায় কান্না, মাটিতে লুটিয়ে প্রার্থনা করার ফল একমাত্র ঝাঁটার বাড়ি, লাথি। তার বুক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে মেরে ফেলা হল সন্তানকে। তার চোখের সামনেই…!
রাণো আড়চোখে দেখল, সামনের ভিড়ের মধ্যে পরমিন্দরের বৌও আছে। সেও আজ বিচার দেখতে এসেছে। কিন্তু সতনামের বৌয়ের কী হাল হয় দেখার জন্য সে উদগ্রীব নয়। বরং ভাবলেশহীন মৃত চোখে তাকিয়ে দেখছে সবকিছু। যেন তামাশা দেখতে এসেছে। শেষে কী ঘটবে, তা সবই জানে ।
পঞ্চায়েতপ্রধান তখনও একমনে গড়গড়া টেনে চলেছেন। পাপ তো হয়েছে! বিরাট পাপ! মেয়েটার বেঁচে থাকার পাপ। সতনামের বিয়ের পর যখন ‘ভাঙড়া’ করতে করতে ওরা ফিরছিল, তখনই একটা বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তাতে সতনাম আর তার পরিবারের সবাই মারা যায়। সকলেই ধরে নিয়েছিল, বৌটাও মরেছে। তিনদিন তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সতনাম সপরিবারে যমের দোরে গিয়েছে, এমন ভেবে সকলেই নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু আচমকা তিনদিন পরে দেখা দিল এই নতুন আপদ। এই মেয়েটি এসে দাবি করে বসল, যে সে সতনামের বিবি! পঞ্চায়েত প্রধানের পায়ে এসে লুটিয়ে পড়ে বলল—‘ওগো, আমি সতনামের স্ত্রী! আমায় ‘সারানা’ দাও’।
পঞ্চায়েত প্রধান প্রথমে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তারপর সরোষে বললেন—‘ঝুঠা!’
‘ঝুঠ নয় গো হুজুর! আমি সত্যিই সতনামের বিবি!’
গ্রামের লোকেরা সকলেই একবাক্যে তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাকে মারধোর করতেও বাকি রাখেনি। তৎসত্ত্বেও মেয়েটি নিজের বক্তব্যে অটল রয়েছে। সে সতনামেরই বিবি।
‘সতনামের সঙ্গে যারা গিয়েছিল, যারা সেদিন ফিরছিল—তারা সবাই মরেছে’। পঞ্চায়েত প্রধান ভ্রুকুটি কুটিল দৃষ্টিতে তাকালেন—‘তবে তুই বেঁচে ফিরলি কী করে?’
মেয়েটি কী উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি। বেঁচে থাকার জন্যও যে কারণ থাকা দরকার, তার জন্য যে জবাবদিহিও করতে হতে পারে—তা তার কল্পনার অতীত!
‘তোর বর মারা গিয়েছে, তোর সাস্‌-সসুর মারা গিয়েছে! তুই তবে বাঁচলি কী করে!’ বলতে বলতেই সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে তার কন্ঠস্বর—‘তুই মানুষ তো?’
শুধু এইটুকু স্ফুলিঙ্গই বাকি ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সবাই বিশ্বাস করে ফেলল ও কোনও নারী নয়! আসলে পিশাচী! গ্রামের অমঙ্গল ডেকে আনার জন্যই এসেছে!
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বলে—‘কির্‌পা কর্‌কে মেরে তে ভিসাওয়াসা! আমায় বিশ্বাস করো। আমি কোনও ভূত-পেত্নী নই!’
‘তুই ভূত-পেত্নী নোস্‌?’ পঞ্চায়েতপ্রধানের গলায় কোনও কোমলতা নেই—‘প্রমাণ করে দেখা!’
‘এই দ্যাখো…এই দ্যাখো…!’ উন্মাদিনী তার বুকের ওপর পঞ্চায়েতপ্রধানের হাতটা টেনে নেয়—‘এই দ্যাখো, আমার নিঃশ্বাস পড়ছে। এই দ্যাখো, আমার দিল্‌ ধকধক্‌ করছে’।
পঞ্চায়েতপ্রধান সবলে হাত ছাড়িয়ে নিলেন—‘এসব তো তোর ছল-চাতুরি! এসবই নকল!’
মেয়েটি নিজের কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলল। দুহাত জুড়ে চুনী চুনী রক্তবিন্দু ফুটে উঠেছে—‘এই দ্যাখো, আমার খুন! শিরাছেঁড়া খুন’।
‘সব নকলি!’ তিনি বললেন—‘ওরকম রঙঢং সব পিশাচীরাই করে থাকে! প্রমাণ কী যে তুই বেঁচে আছিস?’
অসহায় মেয়েটি বুঝে উঠতে পারছিল না, কীভাবে প্রমাণ করবে। বেঁচে থাকাটা যে অপরাধের তা তার জানা ছিল না। বলাই বাহুল্য, সে প্রমাণ করতে পারেনি। অগত্যা গ্রামের লোকেরা প্রথমে তাকে পরিত্যাগ করল। ‘হুক্কা-পানি’ বন্ধ হল মেয়েটির। নিরূপায় হয়ে দোরে দোরে ভিক্ষা চাইতে গেল। কিন্তু কোথাও সহানুভূতি তো দূর, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল সবাই তাকে।
এরপর ওঝা এসে বোঝার চেষ্টা করল যে মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা! সর্ষে ছড়িয়ে, ঝাঁটার বাড়িতে বাড়িতে অচেতন করে দিল মেয়েটাকে। নিদান দিল, যে হাতে প্রকান্ড পাথর নিয়ে ভোর থেকে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে মাঠের মধ্যে। সর্বসমক্ষে! একফোঁটা জল খেতে পারবে না। সন্ধ্যা অবধি হাতের পাথর নামিয়ে রাখতে পারবে না। কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণার বালাই ত্যাগ করে তাকে খাড়া হয়ে থাকতে হবে গোটা একদিন!
সেই পরীক্ষা দিতেও বাধ্য হল সে! এবং বলাইবাহুল্য পরীক্ষায় ব্যর্থ হল। না খাওয়া দুর্বল শরীরে, হাতে অতবড় পাথর নিয়ে সে কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি! পড়ে গিয়েছিল। গ্রামশুদ্ধ সবাই চেঁচিয়ে উঠেছে—‘শয়তানী…শয়তানী! ও মরে গিয়েছে…মরে গিয়ে আমাদের সর্বনাশ করার জন্য ফিরে এসেছে!’
কিন্তু তারপরও মেয়েটা হাল ছাড়েনি। ও সবচেয়ে বড় পাপকাজটা করে ফেলেছে। দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার পরেও, অত মারধোর খাওয়ার পরেও সে বেঁচে আছে। এটাই তার অপরাধ। সে বারবার চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছে—‘আমি মরিনি…আমি বেঁচে আছি…আমি পিশাচী নই…!’
রাণো এসব বৃত্তান্ত শুনে মনে মনে আশঙ্কিত হয়েছিল। সে এখন আসন্নপ্রসবা। তার বুকের ভেতরটা যেন অমঙ্গল আশঙ্কায় কেমন কেমন করে উঠেছিল! দরকার কী মেয়েটার বাঁচার! ও কি জানে না, এখানে ওর প্রতিবাদের কোনও মূল্য নেই! যেখানে ওর বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই, যেখানে মৃত্যু দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে, সেখানে মূল্যহীন প্রাণটাকে ধরে রাখার মানে কী! ওর নারীজন্ম আর কত অপদস্থ হলে শেষ হবে!
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই আজ সবাই জমা হয়েছে পঞ্চায়েতপ্রধানের কাছে। গ্রামজুড়ে একটা পিশাচী ঘুরে বেড়াচ্ছে—এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। যেমন করেই হোক্‌, গ্রামের শোধন করতে হবে।
পঞ্চায়েত প্রধান অনেক ভেবেচিন্তে বললেন—‘ইসা গল দা সবুতা কন্দা হৈ কে ইয়ে কুড়ি ইনসান নহি! ও মানুষ নয়! কিন্তু আকস্মিক কারণে মৃত্যু হওয়ায় ও বুঝতে পারছে না যে ও মারা গিয়েছে! তাই ও শরীরের মায়া এখনও ছাড়তে পারেনি!’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল সতনামের বৌ! এত মানুষের চোখের সামনে সে ‘জিন্দা’ দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা সত্ত্বেও বিচারে নির্ধারিত হল সে মৃত! এ কী জাতীয় বিচার!
‘তু শৈতান!’ লাল লাল চোখ করে তার দিকে তাকালেন পঞ্চায়েত প্রধান—‘এখনও সময় আছে। মেনে নে যে তুই পিশাচী। এ গ্রাম ছেড়ে চলে যা!’
সতনামের বৌ আর কাঁদল না। একটা অদ্ভুত রাগ, একটা তেজে দীপ্ত হয়ে উঠল তার মুখ—‘না। আমি এখনও বেঁচে আছি’।
‘তুই বেঁচে নেই! শুধু শরীরের মায়া তোকে আটকে রেখেছে’।
‘না। আমি বেঁচে আছি! এখনও আমি বেঁচে আছি। মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ’।
‘এটাই তোর শেষ কথা?’
অবর্ণনীয় জোরের সঙ্গে উত্তর দিল মেয়েটি—‘আহোঃ। মৈনু জিন্দা হৈ। দুনিয়ার কোনও জবরদস্তি একে পাল্টাতে পারবে না’।
‘এ পরিস্থিতিতে একটা কাজই করণীয়! ওকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া! নয়তো ওর নিঃশ্বাসে গ্রামের ক্ষতি হবে!’
রাণোর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল! বলছে কী লোকটা! মুক্তি দেবে মানে? মেয়েটা এতদিন ধরে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বলে আসছে যে সে জীবিত! তার এই মূল্য! এর থেকে সে নিজেকে মৃত বলে মেনে নিলেই কি ভালো করত!
‘ওর দেহের অগ্নিসংস্কার করা প্রয়োজন’।
পঞ্চায়েতপ্রধান কথাটা মুখ থেকে খসাতে না খসাতেই মধ্যযুগীয় বর্বরতায় উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল গ্রামবাসীরা! তাদের হাতে ‘ঘাসলেট’এর ডাব্বা! সেই কেরোসিন তেল ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে হতভাগিনীর ওপর! জ্বলে উঠেছে একের পর এক মশাল। রাণো অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা কাঁদছে না! বরং জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। মশালের আগুনে তার মুখ অগ্নিভ সোনালী! ওকে এই মুহূর্তে নির্ভীক বলে মনে হচ্ছিল রাণোর! মেয়েটা মরে যাবে, তবু নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে ছাড়বে না! শেষ হয়ে গেল, তবু কিছুতেই মানল না যে সে মৃত!
পর্‌মিন্দরের বিবি খিলখিল করে হেসে উঠল। হাততালি দিয়ে বলল—‘ত-মা-শা! ত-মা-শা!’
বাকি ‘নৌটঙ্কি’ দেখার ইচ্ছে ছিল না তার। এই মুহূর্তে প্রচন্ড বিবমিষায় তার শরীর কাঁপছে। ঘৃণায় কাঁপছে, অপমানে কাঁপছে। এর আগে তো এই শব্দগুলোর অর্থই ভুলে গিয়েছিল রাণো! কিন্তু এখন ঐ স্থির, নিষ্কম্প মেয়েটার লড়াই দেখে বুকের ভিতরে কী যেন একটা হচ্ছে …!
দ্রুত পায়ে সে সেখান থেকে চলে গেল। ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে যেতে যেতেই তার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন চলে গেল সর্‌সর্‌ করে! আগে হলে সরীসৃপটার স্পর্শে ঘেন্নায় সিঁটিয়ে যেত রাণো। ভয়ে লাফিয়ে সরে যেত।
কিন্তু আজ সাপটাকে অতটা ঘেন্না হল না তার। বরং সাপটা যেন চলে যেতে গিয়েও থম্‌কে দাঁড়াল। তার কালো চকচকে ফণা তুলে ‘হিস্‌স্‌স্‌…হিস্‌স্‌স্‌’ আওয়াজ করছে। রাণো তার দিকে তাকিয়ে থাকে! সাপটা কি কিছু বলতে চাইছিল? দেখে মনে হয় যেন বলতে চাইছে–
ফণা কবে তুলবে তোমরা?

‘মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ। আমি এখনও বেঁচে আছি!’
রাণো রান্নাঘরে পরোটা ভাজতে ভাজতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবু তো মেয়েটার সাহস ছিল! সে বলতে পেরেছিল, আমি বেঁচে আছি। কিন্তু রাণো কি আদৌ সে কথা বলতে পারে? আদৌ কি সে বেঁচে আছে? শুধু সে একাই বা কেন, গোটা গ্রামের একজন স্ত্রীলোকও কি বলতে পারে এই শব্দটা? জানান দিতে পারে তার অস্তিত্ব? বলতে পারে ‘আমি এখনও বেঁচে আছি?’
বোধহয় কেউ পারে না। অন্তত রাণো নিজে কতদূর বেঁচে আছে তাতে সন্দেহ আছে। চোদ্দ বছরের মেয়েটার ভাগ্য সুনির্ধারিত করে দিয়েছিল এক ঘৃণ্য সাপ! বাবা-মা ক্ষেতে কাজ করছিল। সেই ফাঁকেই এসে এক বিষধর ছুবলে দিয়েছিল দুজনকে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি! বাবা-মা’র অন্ত্যেষ্টির পনেরো দিনের মধ্যেই তার কাকু-কাকিমা তাকে বেচে দিয়েছিলেন নারী-পাচারকারীদের হাতে! হ্যাঁ, তার নিজেরই কাকু-কাকিমা! মোটা টাকায় বিক্রি করে নিজেদের পুত্রসন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন! কাকিমা অবশ্য মুখে বলেছিলেন—‘ভয় পাস্ না। তোর জন্য ভালো ব্যবস্থাই করছি। বিয়ে শাদি হবে তোর, বাল-বাচ্চা হবে। সুখের মুখ দেখবি। যা করছি, তোর ভালোর জন্যই করছি’।
কাকিমাকে তখন একটা আস্ত সাপ বলে মনে হয়েছিল। ঠান্ডা নৃশংসতায় যেন শিকারকে কুন্ডলী পাকিয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে! মিষ্টি আর ঠান্ডা কথার পেছনে লুকিয়ে আছে বিষদাঁত। কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন লাল পড়ার মত ফোঁটায় ফোঁটায় বিষ ঝরছে। সুযোগ খুঁজছে ছোবল মারার!
শেষপর্যন্ত সেই দালালদের হাত ধরেই তার এই গ্রামে এসে পড়া। দালাল বলেছিল—‘যা, পটের বিবি হয়ে থাক্। তোর কপাল ভালো। যে সে ঘরে দিচ্ছি না তোকে! এ একেবারে পঞ্চায়েত প্রধানের ঘর! খুব আরামে থাকবি। কত টাকায় কিনেছে তোকে জানিস্‌? দেড় লাখ!’
নারীজন্মের জন্য দেড়লাখটা বোধহয় একটু বেশিই মূল্য। আর তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সে দেড় লাখের জোয়াল ঘাড়ে নিয়ে টেনে চলেছে নিশ্চুপে। দাম উশুল করতে হবে না? প্রথম দিকে প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ না করে উপায়ও ছিল না! আবার প্রতিবাদ করে উপায়ও ছিল না।
সেই দিনটার কথা আজও মনে পড়ে রাণোর। প্রথমে বেশ ঘটা করেই এ বাড়ির ছোট ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিজের নিয়তি ভেবে বিয়েটাকে মেনে নিয়েছিল সে। ফুলশয্যার দিন পাশের বাড়ির বৌটি এসে তাকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল। হবু বৌয়ের ফ্যাকাশে মুখ, অসহায় দৃষ্টি দেখে কিছু বোধহয় সন্দেহ হয় তার। সকলের অগোচরে ফিসফিস করে জানতে চায়—‘কোথা থেকে কিনেছে এরা তোমাকে?’
প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠেছিল সে। পাশের বাড়ির বৌটির কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না! তার হাবভাব দেখে প্রতিবেশীনী নিশ্চিত হল। ফিস্‌ফিস্‌ করে বলল—‘অত ভেবো না। এখানে সবার কঁহানিই এক। রইস আদমিদের ঘরে যত বৌ-বিবি দেখো না, সব বাইরে থেকে কেনা। এমনকি আমিও!’
রাণো চুপ করে থাকে। তাকে এ বাড়ির সবাই ‘বারি-বারিকি’তে এসে শাসিয়ে গিয়েছে। স্বামী বলেছে—‘কারোর কাছে মুখ খুলবি তো খুন করে ফেলব’। ভাশুর বলেছে—‘এখন থেকে তুই বোবা!’ আর শ্বশুর মিষ্টি করে শুনিয়ে গিয়েছেন—‘দেড় লাখ টাকায় কিনেছি তোকে! বেশি চালাকি করবি তো ‘বটি-বটি’ করে ছাড়ব!’
‘কত টাকায় কিনেছে তোমায়?’ বৌটি আরও একটু সাহসী—‘বলো না আমায়। আমি কাউকে বলব না!’
রাণো তবু চুপ করে থাকে। যাকে নিজের কাকু-কাকিমাই বিক্রি করে দেয়, সে কি দুনিয়ায় আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে? কে জানে, পাশের বাড়ির বৌটা হয়তো ওদেরই চর। একবার ইচ্ছে হল, কেঁদে ওঠে। কিন্তু তবু নিজেকে সামলায় রাণো। বিশ্বাস নেই, কাউকে বিশ্বাস নেই!
‘যে দামে কিনেছে, তার সবটাই উশুল করে ছাড়বে’। পাশের বাড়ির বৌ একটু থেমে বলে—‘হতভাগী। আর তোর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। এখানেই রোজ মরতে মরতে বাঁচবি, আর শেষপর্যন্ত এখানেই মরে বাঁচবি। আমাদের সবার ভাগ্য এক। মেয়েদের নসিবটাই নষ্ট হওয়ার!’ বলতে বলতেই তার গলা কেঁপে গিয়েছিল…!
ফুলশয্যার রাতে একা নিজের বিছানায় বসে নিজের পূর্বজন্মের কথাই ভাবছিল রাণো। একসময় সে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখত। পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়ার সাধ ছিল তার। দুই দিকে দুই বিনুনী দুলিয়ে স্কুলে যেত সে। বাবা যেত ক্ষেতে! আর মা? উনুনের আঁচে বসে বসে রুটি সেঁকত। মুখে বিনিবিনি ঘাম। একটা করে গরম রুটি সেঁকত আর তুলে দিত রাণোর পাতে! একটু দেরি হলেই চিৎকার করে ডাকত—‘রা-ণো, এ-এ-এ রাণো-ও-ও-ও!’
ভাবতে ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছিল তার। কে ভেবেছিল, প্রথমে বাবা, তারপর মা সাপের দংশনে মরে যাবে! সেই সাপটাকেও দেখেছিল রাণো। ফণা তোলা। সারা গা মিশমিশে কালো। একটা অসভ্য, ঘৃণ্য সরীসৃপ! তার এক ছোবলেই অমন সংসারটা নিমেষে ছারখার হয়ে গেল।
রাণোর সঙ্গে সাপের রাগ ও ঘৃণার সম্পর্ক তখন থেকেই চিরস্থায়ী। সব জিনিস সহ্য করতে পারে সে। কিন্তু সাপ!…
অথচ কপালের ফের! সেই রাত্রেই রাণোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সাপের! একটা নয়, একাধিক!
ফুলশয্যার বিছানায় বসে সে অপেক্ষা করছিল স্বামীর! স্বামী এল। কিন্তু একা নয়। সঙ্গে শ্বশুর এবং ভাশুর—দুজনেই বর্তমান। রাণোর স্বামী তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল—‘পাপাজি, তুস্যি শুরু হো যাও!’
শুরু হো যাও মানে! হতবিহ্বল রাণো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শ্বশুর ঘনিয়ে এসেছেন তার কাছে। আচমকা তার বুকের ব্লাউজ খুলতে খুলতে বললেন—‘জিয়াদা সোচিও মত! তুই আমাদের সবাইকে ‘খুশ’ রাখ, দেখবি তোকে রাণীর মত রাখব!’
রাণো লাফিয়ে ওঠে—‘এ কী! কী করছেন আপনি? আমি আপনার পুত্রবধূ! বেটি সমান!’
‘কী করছি?’ শ্বশুরমশাই, তথা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বিশ্রী হেসে বললেন—‘প্যায়ার-মোহব্বতই তো করছি! আমাদের গ্রামের নিয়ম। বাড়িতে যা আসবে তাতে ‘পেহ্‌লা হক্‌’ বুজুর্গের। তাই তোর ওপর প্রথম অধিকার আমার! সাড্ডা হক্‌।’
নিরূপায় রাণো তার স্বামীর দিকে ফিরেছিল! কিন্তু সে তখন মাটির দিকে দেখতেই ব্যস্ত! সেদিকে দেখা ছাড়া যেন এইমুহূর্তে আর কোনও কাজ নেই!
রাণো তার শ্বশুরের আলিঙ্গনে যুদ্ধ করতে করতে বলেছিল—‘ছেড়ে দিন। আমি কিন্তু চিৎকার করবো’।
‘জরুর চিল্লায়েগি!’ তিনি পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত পুত্রবধূর শাড়ি খুলে ফেলেছিলেন—‘পহেলিবার সবাই চিৎকার করে। তারপর আদত হয়ে যায়। পুরুষকে কীভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হয় জানিস তুই?’
বলতে বলতেই একটা অজগরের মতন উঠে এসেছিলেন তার দেহে। তারপর ক্রমাণ্বয়ে তার ভাশুর ও শেষপর্যন্ত স্বামী। ওদের হিলহিলে পুরুষাঙ্গ দেখে ঘৃণায় চোখ বুঁজে ফেলেছিল রাণো। সাপ! সাপ! একটা ঘৃণ্য সাপ যেন উঠে এসেছে তার গা বেয়ে! না, একটা নয়! একাধিক সাপ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। তার সারাগায়ে একের পর এক ছোবল মেরে চলেছে! দেড় লাখ টাকার জিনিস। দাম উশুল করে নিতে হবে না! যন্ত্রণায় চিৎকার করেছে রাণো! হাতে-পায়ে ধরেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তিনটে সাপ রাতের পর রাত তাকে ছোবল মেরে চলেছে। শ্বশুর, ভাশুর এবং সবশেষে স্বামী। শ্বশুর বিপত্নীক। ভাশুর অবিবাহিত। এই মাগ্যি গন্ডার জমানায় হয়তো তার জন্য মেয়ে আমদানি করতে পারেনি দালাল। তাই প্রতিরাতে রাণোর ঘরে সে ‘সুহাগরাত’ পালন করে!
আজকাল বাড়িশুদ্ধ সবাইকে সাপ বলে মনে হয় তার। গা ঘিনঘিন করে। বমি পায়! বমি করলে সবাই ভাবে, গর্ভবতী হওয়ার দরুণ হয়তো এই বিবমিষা! কিন্তু রাণো জানে, আসলে কতগুলো ঘৃণ্য সরীসৃপের সঙ্গে বাস করছে সে। ওদের ঘৃণা করে। ওরা মেরুদন্ডহীন সব এক একটা সাপ! এই সাপের দঙ্গলে রোজ ছোবল খায় সে, রোজ মরে। কী করে জীবনের শেষমুহূর্তেও বলবে—‘মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ! আমি এখনও বেঁচে আছি’।

৪.
তুস্যি কিভেম্‌ হো রাণো? আপানে বাচ্চে নু হাঢ়া?’
‘ঠিকা হৈ মৈনু!’ বিড়বিড় করে উত্তর দিল রাণো—‘মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ!’
উত্তরটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিবমন্দিরের পুরোহিত। রোজ সকাল-বিকেলে রাণো এখানে পুজো দিতে আসে। বলা ভালো, আসন্নপ্রসবা মেয়েটি পুত্রকামনা করতে আসে। মন্দিরে দুধ-হলুদ চড়ায়। একা আসে না। সঙ্গে পাহারাদার হিসাবে তার স্বামী সত্‌পাল থাকে। সত্‌পাল কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে বলল—‘কী কহা তুসিম! কী বলছিস্‌! যাজক নাল্‌ অ্যাওয়ে গল্‌ করান্দে হ্যায়? উনি এ গ্রামের পুরোহিত। সম্মান দিয়ে কথা বল্‌!’
প্রমাদ গুনলেন পুরোহিত। একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে রাণো। কিন্তু এর জন্য বুঝি বা মারধোর খেতে হয় তাকে। সবই বোঝেন তিনি। বোঝেন, সত্‌পাল আসলে শিখন্ডী মাত্র। অথবা রাণোর ব্যক্তিগত বডিগার্ড, পাহারাদার বা দারোয়ানও বলা যায় তাকে। তবে স্বামী বলা যায় না! সত্‌পালের বকলমে সবাই মিলে ভোগ করছে মেয়েটাকে। সবই জানেন, সবই বোঝেন। কিন্তু কিছু বলার নেই। কী বলবেন! কাকে বলবেন! রাণোর শ্বশুর তো নিজেই পঞ্চায়েতপ্রধান! তার বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা শুনবে না। বলবেও না!
‘ আরে! কোই না পুত্তর! যান্দে! ছাড়।’। তিনি বললেন—‘এতে মান সম্মানের কোনও ব্যাপার নেই। ঠিকই তো বলেছে রাণো। আমরা সকলেই একরকম বেঁচে আছি। ‘রব্‌ দি’ দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটাই তো আসল’।
সত্‌পালের কথাটা পছন্দ হল না। কিন্তু সে চুপ করে গেল। পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে তর্ক করার সাহস তার নেই। পুরোহিত মশাইয়ের হাসি পেল। এই তো সাহসের দৌড় এদের! এরা আবার নিজেদের স্বামী বলে!
রাণো তার পা ছুঁল। তিনি তার মাথা স্পর্শ করে বললেন—‘যুগ যুগ জিও। পুত্রবতী ভব’।
রাণো চোখ তুলে তাকায়। ঠাকুরমশাইয়ের মনে হল, তার দু চোখ যেন প্রত্যেক দিনের মতই প্রশ্ন করে—কেন পুত্রবতী ভব? কেন কন্যাবতী নয়? কিন্তু হয়তো তার নিজেরই মনে পড়ে যায় যে কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে ঠিক কী হবে! তাই অস্ফুট প্রশ্নটা চেপে যায়।
ভাবতে ভাবতেই সত্‌নামের বৌ এর শেষ পরিণতিটা মনে পড়ল তার। স্বচক্ষে ঘটনাটা দেখেননি তিনি। দেখার প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ঘটনার পিছনের কারণটা বোঝেন! সেই চিরাচরিত কারণ। সম্পত্তি ও জমিজমা। সত্‌নাম সপরিবারে মারা যাওয়ার ফলে তাদের বেওয়ারিশ জমিটা পঞ্চায়েতের দখলে চলে আসার কথা। কিন্তু সত্‌নামের বিধবা বৌ বেঁচে থাকলে সেই জমি গ্রাস করা যায় না। কারণ স্ত্রী হওয়ার দরুণ জমি-জমা ও সম্পত্তির ওপর তারই অধিকার বর্তায়। এতবড় ‘অন্‌হোনি’টা কীভাবে হতে দিতে পারে ‘পঞ্চ’! একটা দুদিনের মেয়ে এসে তাদের চোখের সামনে সত্‌নামদের এতবড় ‘পুশতেয়নি’ জমিটা হরফ করে নেবে? অত সহজে হাত ছাড়া হয়ে যাবে সম্পত্তি! অতএব ঘোষণা করে দাও যে ও মৃত! ‘পিশাচী’ বা ‘ডাইনি’! যেমন করেই হোক্‌, ওকেও মারো! একটা মেয়ের জীবনের দাম সত্‌নামের অতুল সম্পত্তির তুলনায় কতটুকুই বা!
পুরোহিত মশাইয়ের ভাবতেই আশ্চর্য লাগে! কোন্‌ আমলে পড়ে রয়েছে এরা! কেন কারওর মনে পঞ্চায়েতের রায়ের বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন জাগে না! এ গ্রামে নয় নয় করেও অন্তত হাফ-ডজন ডাইনিকে পুড়ে মরতে দেখেছেন তিনি। সত্‌নামের বৌ তার নবতম সংস্করণ। কিন্তু কারোরই ইতিহাস আলাদা নয়। যত ডাইনি আজ পর্যন্ত মরেছে, তারা প্রত্যেকেই ছিল সদ্যবিধবা। আর স্বাভাবিকভাবেই স্বামীর সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিকারিণী। কিন্তু বেঁচে থাকলে তবেই তো সম্পত্তি পাবে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জ্ঞাতি-গুষ্ঠীরই কেউ একদিন আচমকা আবিষ্কার করে ফেলে যে বিধবা মেয়েটি ডাইনি! আগেভাগেই রফা হয়ে যায় পঞ্চায়েতের সঙ্গে। নগদ কিছু টাকা, আর জমির কিয়দংশের বিনিময়েই পঞ্চায়েত ‘রাতোঁরাত’ মেয়েটিকে ডাইনি বলে মেনে নেয়। মেয়েটির বিপক্ষে সাক্ষী দেয় সেই সব জ্ঞাতিরা! বলে, মেয়েটিকে উলটো পায়ে হেঁটে যেতে স্বচক্ষে দেখেছে! তুক্‌তাক করতে দেখেছে! কিংবা তাকে নিজের চোখে রূপ পরিবর্তন করে ডাইনি হতে দেখেছে! ব্যস্‌! সেই মধ্যযুগীয় ‘দকিয়ানুসি’ প্রথা অনুযায়ী গ্রামকে ডাইনীমুক্ত করতেও সময় লাগে না! বেঁচে থাকলে তো সম্পত্তি হাতছাড়া হবে। তার চেয়ে ভালো, একেবারে পুড়িয়ে মারো। কেউ কিছু বলবে না। কেউ প্রশ্ন করবে না। কেউ জিজ্ঞাসাও করবে না, বেছে বেছে সদ্যবিধবারাই কেন ডাইনি হয়?
ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে যান পুরোহিত। এই গ্রামটায় তার নিজেরই আর থাকতে ইচ্ছে করে না। নিজের একমাত্র ছেলেকে পড়তে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে ওখানেই চাকরি-স্ত্রী-সংসার নিয়ে থিতু হয়ে গিয়েছে। এ গ্রামে ফিরে আসতে চায় না। তার শহুরে আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত মন এই গ্রামের নারকীয় ঘটনা মেনে নেয়নি কখনও। ভালোই হয়েছে। মনে মনে ভাবেন পুরোহিত মশাই। এ নরকে ফিরে এসে কাজ নেই…।
আচম্‌কা একটা হিস্‌হিস্‌ শব্দে সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি। রজ্জো এসেছে! রজ্জো এ মন্দিরের বাস্তুসাপ। একটা বিরাট চেহারার কালো মিশমিশে মেয়ে কেউটে। অনেকেই তাকে দেখে ভয় পায়। সে কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও কারোর ক্ষতি করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে দেখা যায় শিবলিঙ্গের গায়ে জড়িয়ে গোল হয়ে চুপ করে বসে থাকতে। অনেকসময় ফণা তুলে খাড়া হয়ে বসে। তখন তাকে দেখলে ভয় করে। মনে হয়, সত্যিই হয়তো এইমাত্র শিবের গলা থেকে নেমে এসেছে! লোকে রজ্জোকে ভয় পায়। ভক্তিও করে। তার জন্যও ভেট চড়ায়। কিন্তু রজ্জো কাউকেই পাত্তা দেয় না! বিদ্রোহিনী নারীর মত চকচকে উদ্ধত ফণা তুলে বসে থাকে। একদম স্থির, নিষ্কম্প! যতক্ষণ তার থাকার ইচ্ছে, ততক্ষণ থাকে। তারপর দীঘল দেহটাকে টেনে ফের সর্‌সর্‌ করে চলে যায় নিজের গর্তে।
সম্প্রতি রজ্জো সন্তানবতীও হয়েছে। মন্দিরের পুরনো এক গর্তে তার শিশু সন্তান-সন্ততিকে দেখেছেন তিনি। এখন মাঝেমধ্যে বেরিয়েও পড়ে ওরা। যতদিন ডিম ছিল, ততদিন রজ্জো ফণা তুলে বসে পাহারা দিত। একচুলও নড়েনি সেখান থেকে। শিবলিঙ্গের ধারেকাছেও আসত না তখন। এখন বাচ্চা একটু বড় হয়েছে। তাই আবার সে কিছুক্ষণের জন্য নিজের কোটর থেকে বেরিয়েছে।
মনে মনে আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন তিনি। সর্বনাশ করেছে! মন্দিরের ভেতরে রাণো একা। এখন হয়তো মন দিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ ঢালছে! ঠিক এমন সময়েই আসতে হল রজ্জোকে! রাণোর আবার সাপে ভীষণ ভয়। প্রচন্ড ঘেন্না করে সে সাপকে। প্রথমদিন যখন রজ্জোকে দেখেছিল সেদিন ভয়ে নীল হয়ে গিয়েছিল। কোনমতে বলেছিল—‘ওটা কি ঠাকুরমশাই! ইয়া কী হৈ!’
‘নাগিন!’ ঠাকুরমশাই হেসে বলেছিলেন—‘ভয় পাস্‌ না! ও কিছু করবে না’।
‘না…না…!’ ভয়ে, ঘেন্নায় চোখ বুঁজে থর্‌থর্‌ করে কাঁপছিল রাণো। তার মুখ রক্তহীন। সারা শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে! কোনমতে বলল—‘ওকে তাড়িয়ে দিন ঠাকুরমশাই! আমি…আমার ভীষণ ভয় করছে…ভীষণ ঘেন্না করছে…!’
ঠাকুরমশাই বলেছিলেন—‘ও বাস্তুসাপ রাণো। বেশিরভাগ সময়ই এখানে থাকে। কখনও কারোর কোনও ক্ষতি করেনি!’
তাতেও শান্ত হয়নি সে। বারবার বলেছে—‘না…না! ওকে তাড়িয়ে দিন,…তাড়িয়ে দিন…!’
তারপর থেকে রাণো এমন সময়ই আসে যখন রজ্জো থাকে না। এখনও রজ্জোর থাকার কথা নয়। এইসময় সে নিজের বাচ্চাকাচ্চাদের সামলায়। কিন্তু আজ সব নিয়ম ভেঙেই রজ্জো আগে এসে উপস্থিত! যেন রাণোর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছে। এখন নির্ঘাৎ মন্দিরে দুজনে একা! মুখোমুখি! রাণো ভয় পাবে। কে জানে, রজ্জোর বাচ্চাকাচ্চারাও তার সঙ্গে টহল দিতে বেরিয়েছে কিনা! যদি তাই হয় তবে সাড়ে সর্বনাশ!
ভিতর থেকে হিস্‌হিস্‌ শব্দটা আরও জোরে ভেসে এল! তার সঙ্গে নারীকন্ঠের ফিস্‌ফিস্‌! কী হল! রাণো কার সঙ্গে কথা বলে! ভয়ে প্রলাপ বকছে নাকি! ঠাকুরমশাই চেঁচিয়ে উঠলেন—‘ডর্‌ মৎ রাণো। মৈম্‌ চেতি আ রিয়া হৈ! আমি এক্ষুনি আসছি।’
মন্দিরের ভিতরটা অন্ধকার। শুধু ঘুলঘুলি দিয়ে ধূপের ধোঁয়ার মত এসে পড়ছে সোনালি রোদ! যেন বিন্দু বিন্দু আলো সুযোগ পেয়ে এলিয়ে পড়েছে শিবলিঙ্গের ওপরে। কয়েক ছিটে আলো আর অন্ধকার মিলে মিশে এক। শিবলিঙ্গের মাথাটা ভেজা। তাই আলো সেখানে চল্‌কে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। তৈলাক্ত কালো পাথরটা নিঝুম অন্ধকারে খানিকটা ডুবে রয়েছে। আবার মাথার কাছটা উদ্ভাসিত! রোদ যেন সেখানে পড়ে ঠিক্‌রে যাচ্ছে।
পুরোহিত দ্রুতপদে ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন! কিন্তু যা দেখলেন তাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না! স্খলিত স্বরে বললেন—‘মেরে রব্বা!’
ঐ আলো-আঁধারি কক্ষে দুই নারী মুখোমুখি! একজন মানবী, অন্যজন নাগিনী! রজ্জোর কালো চকচকে গায়ে এসে পড়ছে রোদের আলো। কালো রঙ যেন ঝলসাচ্ছে, ঝিলমিল করে উঠছে মসৃণ দেহ! ফণা তুলে সে শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরেছে। উল্টোদিকে রাণো! রাণোকে কেমন উন্মাদিনীর মত লাগছে। মাথার চুলগুলো খোলা! রাণোর মাথাটা সাপের মতই যেন আস্তে আস্তে দুলছে! রজ্জোও অন্যান্যদিনের মত নিষ্কম্প, অনড় নয়। তার ফণাও দুলছে! অবিকল রাণোর মাথার তালে তালেই ফণা দুলছে তার। পেন্ডুলামের মত ধীরগতিতে একবার ডানদিকে…একবার বাঁদিকে! ডানদিকে…বাঁদিকে! আবার ডানদিকে…বাঁদিকে…! যেন নকল করছে রাণোকে! সাপের চেরা জিভ দুবার চিড়িক চিড়িক করে বেরোল। পরক্ষণেই হিস্‌স্‌স্‌ করে গায়ে শিরশিরানি ধরানো শীতল শব্দ।
রাণোও যেন সমানতালে ‘হিস্‌স্‌…হিস্‌স্‌’ করে কী যেন বলছে! পুরোহিত শুনতে পেলেন সাপের হিস্‌হিসানির সঙ্গে একটানা সুর মিলিয়ে সেও বলে চলেছে—‘মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ…মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ…আমি আজও বেঁচে আছি…!’

‘সুন্দর মুন্ডরিয়ে হো!
তেরা কৌন ভিচারা হো!
দুল্লাহ্‌ ভট্টিওয়ালা হো!
দুল্লেহ্‌ দি ধি ভিয়ায়ে হো!
সের শক্কঢ় পায়ে হো…!’
আজ লোঢ়ি! বাইরে কোথাও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ছেলে-পিলেরা গান ধরেছে! ঢাকের তাল, সুর-বেসুরে মেশানো গলার চিৎকার নিজের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিল রাণো। আজ লোঢ়ি! আজ শুভদিন। শুভ মুহূর্ত!
এতদিন ধরে এই দিনটার জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিল। না, উৎসবের জন্য নয়। কবে রাণো গর্ভবতী হবে, কবে তাদের বংশধরের জন্ম দেবে সেই আশাতেই এক এক করে দিন গুনছিল পঞ্চায়েতপ্রধান ও তার ছেলেরা। ওরা ধরেই নিয়েছে যে রাণোর ছেলেই হবে। ‘পুত্তর’ই আসবে এই ঘরে। মেয়ে আসবার যেন কোনও সম্ভাবনাই নেই!
যখন ওরা জানতে পেরেছিল রাণো সন্তানসম্ভবা, সেদিন উৎসব লেগে গিয়েছিল বাড়িতে। একজোড়া সোনার বালা উপহার দিয়েছিলেন রাণোর শ্বশুরমশাই। রাত্রে আদর করতে করতে আহ্লাদ করে বলেছিলেন—‘কার বাচ্চা রে এটা? আমার?’
রাণো চুপ করেছিল। কী জবাব দেবে? শুনেছিল যে একমাত্র মা—ই নাকি বলতে পারে সন্তান কার। সন্তানের সমস্ত কিছু রহস্য একমাত্র তার মা জানে। কিন্তু রাণো নিজেই জানে না যে তার গর্ভে কার সন্তান বাড়ছে! প্রত্যেকদিন সে পর পর তিনজন পুরুষের হাতে ধর্ষিতা হয়! তিনটে সাপ এক এক করে প্রতি রাতে তাকে ছোবল মারে। তাদের মধ্যে কার বিষ তার গর্ভে জমেছে তা তার জানা নেই। এই অসহায়তা, এই না জানা যে কী ভয়ঙ্কর, তা একমাত্র রাণো জানে। তার বুকের মধ্যে কান্নার মেঘ জমে। ইচ্ছে করে বুক ফাটিয়ে, চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু উপায় নেই। তাকে কাঁদতে দেখলে ওরা মারবে। সেই ভয়ে কাঁদতেও পারে না রাণো। তার মধ্যে তার শ্বশুর, ভাশুর ও স্বামী ক্রমাগত জানতে চায়, সন্তানটা কার!
‘আচ্ছা, ছাড়্‌। যান্দে’। শ্বশুর তার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে—‘যারই পিল্লা হোক্‌, ক্ষতি নেই। কিন্তু মনে রাখিস্‌। পুত্তর হি জন্‌না। ছেলেই চাই আমাদের। কুড়িঁ চাই না। একটা ছেলে দে আমাদের। তোকে মাথায় করে রাখবো’।
নিজেকে সেই মুহূর্তে অসম্ভব অসহায় মনে হয়েছিল রাণোর। কী করে শুধুমাত্র পুত্রসন্তানেরই জন্ম দিতে হয়, সে কৌশল জানা নেই তার। মনের ভিতরে গভীর আশঙ্কাও গুড়গুড়িয়ে উঠেছিল। যদি ছেলে না হয়! যদি মেয়ে হয়, তবে কী হবে? নিজের চোখের সামনে পরমিন্দরের বৌ এর অবস্থা দেখেছে সে। তার চোখের সামনে সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে দুধের কুন্ডে চুবিয়ে মারা হয়েছিল। তারপর থেকে মেয়েটা কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আপনমনেই বিড়বিড় করে। সংসারের কোনও কিছুতেই যেন তার আগ্রহ নেই। শুধু মাঝেমধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আর বলে—‘তমাশা!…তমাশা!’
এই মুহূর্তে যন্ত্রণায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল রাণোর। সন্তানের জন্ম দিতে যে এত কষ্ট হয়, তা তার জানা ছিল না। মনে হচ্ছিল এবার মরেই যাবে হয়তো বা! পেটের ভিতরে উথাল পাথাল! একটা গোটা প্রাণ লড়াই করছে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য। প্রচন্ড বিদ্রোহে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে গর্ভের অন্দরমহল থেকে। যন্ত্রণায় প্রায় বেঁকে গিয়েছে রাণো। তার মাথার কাছে এই মুহূর্তে বসে আছে পরমিন্দরের বিবি । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যন্ত্রণার খানিকটা উপশম করার চেষ্টা করছে। পায়ের কাছে বুড়ি ধাই। কী যেন বলছে মাঝেমধ্যে। রাণো সেসব কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার চোখের সামনে সব কিছু যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে…কোথাও কিছু নেই…গভীর অন্ধকার…শুধু একটা মিশমিশে কালো অন্ধকার তাকে জড়িয়ে ধরছে…কোনও শেষ নেই সে অন্ধকারের…কুন্ডলী পাকিয়ে অজগরের মত চেপে ধরছে রাণোকে। একটা অব্যক্ত আশঙ্কা একটু একটু করে সাপের চেহারা নিচ্ছে…যদি ছেলে না হয়! যদি মেয়ে হয়! কে যেন তার মস্তিষ্কে ছোবল মারল! মাথার ভিতরে তিরতিরিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে! চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল টগবগিয়ে ফুটতে থাকা দুধের কুন্ড! এত কষ্টের পরে কী শেষে ঐ পরিণতি অপেক্ষা করছে! শ্বশুরের গলা তার কানের কাছে বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—‘পুত্তর হি জন্‌না! মুন্ডা হি জন্‌না! কুড়িঁ চাই না আমাদের!’ কেন চাই না? ওদের চাওয়ার ওপরে কি কিছু নির্ভর করে ঈশ্বর! যদি বেটি হয়! তবে কি তারও পরমিন্দরের বিবির মত অবস্থা হবে? ছেলে দিলে মাথায় করে রাখবে! কিন্তু মেয়ে দিলে! কী হবে? …রাণোর চোখের সামনে তার মেয়েকে ডুবিয়ে মারা হবে? তবে কী হবে? কী হবে?
রাণোর মনে হল সে বাইরের উনুনে ফুটতে থাকা দুধের আওয়াজ পাচ্ছে! প্রত্যেকটা আওয়াজ, প্রত্যেকটা অনুভূতি সূক্ষ্ম হয়ে ধরা দিচ্ছে তার ইন্দ্রিয়ে! ঐ তো…, ঐ তো চন্দন ঘষার শব্দ! ঐ তো শিল-নোড়ায় হলুদ বাটার আওয়াজ আসছে ঘষ্‌ঘষ্‌! ঐ তো দুধের টগবগ আওয়াজ! কী হবে! কী হবে! …সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না…দমবন্ধ হয়ে আসছে…! প্রবল যন্ত্রণার চূড়ান্ত পর্যায়ে সে কঁকিয়ে উঠে শুধু বলল—‘র—ব্বা!’
সঙ্গে সঙ্গেই প্রচন্ড শাণিত একটা কন্ঠের বিদ্রোহী চিৎকার! জন্মমুহূর্তের জানান দিচ্ছে ঐ শিশুকন্ঠের ক্রন্দন! কিন্তু চতুর্দিক এমন স্তব্ধ কেন! পরমিন্দরের বিবি একটু আগেও বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। এখন হঠাৎ চুপ করে গেল কেন! ও মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে কেন! এ তো শোক প্রকাশের লক্ষণ! কীসের জন্ম দিল তবে রাণো! ছেলে নয়?…
কানে এল ধাই বুড়ির অমোঘ উচ্চারণ—‘কুড়িঁ নু হ্যায়! মেয়ে হয়েছে’।
মুহূর্তের মধ্যে মনে হল কয়েকশো সাপের ছোবল খেল সে। মেয়ে হয়েছে! তবে কী হবে? এখন কী করবে সে! যন্ত্রণায় নয়—ভয়ে ভীষণ কান্না পেয়ে গেল রাণোর! শেষে তবে দুধকুন্ড! সেও তবে পরমিন্দরের বিবির মত পাগল হয়ে যাবে!
‘রা–ণো! রা–ণো!’
ক্লান্তিতে চেতনার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল রাণো। আচমকা কে যেন তাকে দুহাতে ঝাঁকুনি দিল। অতিকষ্টে চোখ মেলল সে। পরমিন্দরের বিবির ব্যাকুল মুখটা সামনে ভেসে উঠল! পরমিন্দরের বিবি তাকে পাগলের মত ঝাঁকাচ্ছে! চিৎকার করে বলছে—‘রা-ণো! রা—ণো!’
‘জি’।
‘এখনই বেহোঁশ হয়ে যাস্‌ না!’ পরমিন্দরের বিবির মুখটা একদম তার মুখের সামনে—‘ধাই বুড়িকে আমি দেখছি। তুই পালিয়ে যা!’
কোন্‌ অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে জোর দিল। সে দেখল, ধাই বুড়িকে জড়িয়ে ধরে চেপে ধরল পরমিন্দরের বিবি! কিছুতেই বাইরে গিয়ে ঘোষনা করতে দেবে না! বুড়ি ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁকপাঁক করছে।
‘তুই আমার সর্বনাশ করেছিলি! আর কারোর সত্যনাশ করতে তোকে দেব না!’ পরমিন্দরের বিবি প্রচন্ড রোষে টানাটানি করে ধাই বুড়ির হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে। ঝুপ্‌ করে তার কোলে রেখে বলল—‘রাণো, ভাগ যা!’
রাণো জানে বাইরে এখন তিনজন পুরুষ অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছে। ওরা জানতে চায়, ঘরে কী এল!
‘রাণো, ভা-গ যা!’
রাণো জানে বাইরে এখন একটা উনুনে দুধ ফুটছে। সেই ফুটন্ত দুধ তার কন্যাসন্তানের নিয়তি…। এই রক্তমাংসের টুকরোটা, রাণোরই দেহের অংশটা ডুবে যাবে ফুটন্ত দুধের মধ্যে…!
‘রাণো’। পরমিন্দরের বিবি ধাই বুড়িকে মাটিতে আছড়ে ফেলে বলল—‘বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখা যাবে না! তু ভাগ্‌! পিছনের দরজা দিয়ে পালা। আমার মেয়েটাকে এরা সবাই মিলে খুন করেছে। তুই তোর মেয়েকে বাঁচা…!’
রাণো তার সদ্যজাত কন্যাসন্তানকে বুকে চেপে ধরল! ঈশ্বর যেন তাকে চরম শক্তি দিলেন। সে টলতে টলতে কোনমতে উঠে দাঁড়ায়। কোলের কন্যাসন্তান তখনও কেঁদে চলেছে। তাকে অভয় দেওয়ার মত করে বলল—‘মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ… আমি এখনও বেঁচে আছি…!’

মেয়েটা সত্যি সত্যিই পালিয়ে গেল।
বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করছিলেন পঞ্চায়েতপ্রধান! এত বড় অপরাধ! একে তো কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে কালমুহি! তার ওপর পরমিন্দরের বিবির সঙ্গে ষড় করে পালিয়েছে! এত বড় সাহস! এত বড় স্পর্ধা!
‘সরপঞ্জজি!’ ধাই বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘এই পরমিন্দরের বিবি আমায় আটকে রেখেছিল। লড়কি হয়েছে তাই আমি জানাতে পারিনি। সেই ফাঁকেই পালিয়ে গেল রাণো!’
পরমিন্দরের বিবি আজ আর অপরাধীর মতন মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে নেই। বরং উদ্ধত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পঞ্চায়েতপ্রধানের দিকে। তার চোখে আগুন জ্বলছে! চোয়াল শক্ত। লোঢ়ির আগুনের মত তার দুই চোখের মণি দপ্‌দপ্‌ করে উঠছে! তাকে একটা প্রকান্ড চড় মেরে মাটিতে ফেলে দিলেন পঞ্চায়েতপ্রধান। সাপের মতই হিস্‌হিসিয়ে বললেন—‘তোকে তো আমি পরে দেখছি। আমার ঘরে ঢুকে ‘গদরিয়া’ মচাচ্ছিস্‌! বিদ্রোহ করবি! তোদের সব ‘গদর’ শেষ করছি আমি। আগে ঐ শয়তানীটাকে পেয়ে যাই। পালিয়ে যাবে কোথায়? কতদূর যাবে?’
চড়টা খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল পরমিন্দরের বিবি। তার ঠোঁট কেটে গিয়েছিল। ঠোঁটের রক্ত মুছে সে খল্‌খল্‌ করে হেসে উঠল। চিৎকার করে বলল—‘তমাশা! ত-মা-শা!’
তার চুলের মুঠি টেনে ধরলেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘বল্‌, কোথায় গিয়েছে রাণো! বল্‌, নয়তো তোকেও শেষ করে ছাড়ব’।
যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠা নয়, বরং আবার জোরে হেসে উঠল সে। ফের ফিস্‌ফিসিয়ে বলল—‘ত-মা-শা! ত-মা-শা!’
তার এই প্রবল ঔদ্ধত্য সহ্য করতে না পেরে স্বয়ং পরমিন্দরই কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। তাতেও মেয়েটার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যতই তাকে মারধোর করা হোক্‌ না কেন, সে শুধু হাসে। ডাইনির মত খিলখিলিয়ে হাসতেই থাকে।
‘সেয়ানা পাগল!’ পরমিন্দর বৌয়ের তলপেটে একটা লাথি কষিয়ে বলল—‘বল্‌, কোথায় গিয়েছে রাণো? ভালোয় ভালোয় সরপঞ্জজিকে বল্‌ বল্‌ছি। নয়তো কেটে ফেলব সা-লি! ’
‘পরমিন্দর’! হাত তুলে তাকে থামালেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘এসব নৌটঙ্কি, মারপিট ঘরে করিস্‌। এখন আগে রাণোকে খুঁজে বের করা দরকার!’
‘সেটাই তো করছি সরপঞ্জজি!’ দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দেয় পরমিন্দর—‘এ সালি জানে রাণো কোথায় গিয়েছে! কিন্তু মুখই খুলছে না কুতিয়া!’
সমান রোষে জবাব দিল পরমিন্দরের বিবি—‘আমি যদি কুতিয়া হই, তবে শা-লা তুই কুকুর! থুঃ থুঃ…! নিজের মেয়েকে খেয়েছিস্‌, আর কত খাবি!’
বলতে বলতেই একদলা রক্তাক্ত থুতু ছুঁড়ে দিল পরমিন্দরের মুখে! পরমিন্দর তার সাহস দেখে হতবাক! একটা ঘুঁষি তুলেও থম্‌কে গেল। তার বৌ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী আগুন সেই চোখে! এই কি পরমিন্দরের বিবি! এই কি সেই মেয়েটা, যার কোল থেকে অনায়াসে কেড়ে নিয়েছিল তার সদ্যোজাত মেয়েকে! নাকি অন্য কেউ!
ততক্ষণে রাণোদের বাড়িতে ছোটখাটো ভিড় জমে গিয়েছে। গোটা গ্রামই প্রায় উপছে পড়েছে। পঞ্চায়েতপ্রধানের ঘরের বৌ পালিয়ে গিয়েছে, তাতে অনেকেই মজা দেখতে এসেছে। আবার কেউ বা এসেছে বিদ্রোহিনীকে সাজা দেওয়ার ক্রিয়াকর্মে যোগ দেওয়ার জন্য। ঘরের বৌ-মেয়েকে মারার মধ্যে যে পৌরুষ প্রকাশ পায়, সেই বীরত্ব দেখানোর সুযোগ অন্যক্ষেত্রে বিশেষ পাওয়া যায় না। তাই এই মুহূর্তে সমস্ত বীরপুঙ্গবরা ভিড় জমিয়েছে রাণোদের বাড়িতে।
রাণোর বর সত্‌পাল মিনমিন করে তার দাদাকে জিজ্ঞাসা করে—‘এবার কী করব ভ্রাজি!’
তার ভ্রাজি কোনও উত্তর দিতেই যাচ্ছিল, তার আগেই একটা লোক চেঁচাতে চেঁচাতে এসে হাঁফশে পড়ল পঞ্চায়েত প্রধানের সামনে—‘হুজুর, রাণোর খোঁজ পেয়ে গিয়েছি!’
পঞ্চায়েতপ্রধান, সঙ্গে তার দুই ছেলে এবং গোটা ভিড়টাই প্রায় লাফিয়ে উঠল—‘কোথায়?’
‘চা-ওয়ালা কুলদীপ ওকে শিবমন্দিরের দিকে যেতে দেখেছে। এছাড়া লোঢ়ির পরবে কিছু ছেলেপিলে গমক্ষেতের পাশের ন্যাড়া জমিটায় আগুন জ্বেলে নাচা-গানা করছিল’। একনিঃশ্বাসে গড়গড়িয়ে বলে যায় লোকটা—‘ওরাও একজন ঔরতকে শিবমন্দিরে ঢুকতে দেখেছে’।
‘বহুত আচ্ছা’। দাঁতে দাঁত পিষলেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘অভি উসকি খবর করান্দে হৈ! মজা দেখিয়ে ছাড়ব সা-লিকে! চলা দে!’
গোটা গ্রামই প্রায় হাতে লাঠি নিয়ে চলল অপরাধিনীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সামনে পঞ্চায়েতপ্রধান ও তার দুই ছেলে। পিছন পিছন অগুনতি লাঠি আর পাগড়ির ভিড়। সবার হাতেই কেরোসিন তেলের লন্ঠন। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বিন্দু বিন্দু আলো জোনাকির মত উড়ে চলেছে কোথাও। সঙ্গে চলেছে দম্ভসর্বস্ব কতগুলো পাগড়ি আর লাঠি!
ভুট্টা আর গমক্ষেতে তখন মৃদু হাওয়ার শিরশিরানি। এই দঙ্গল বেঁধে যাওয়া মানুষদের দেখে হাওয়াও যেন কিছু বলতে চায়। গমক্ষেতে তখন জমাট বেঁধেছে চাপ চাপ অন্ধকার। সরু সিঁথির মত আলপথ দিয়ে হাতে বিন্দু বিন্দু আলো নিয়ে কিছু মানুষ নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে শিবমন্দিরের অভিমুখে। ওদের হাতে আলো! মনে অন্ধকার! এক ফোঁটা আলোর অনুপ্রবেশও ওদের চেতনায় হয়নি। হাওয়া যেন গমক্ষেতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিস্‌ফিস্‌ করে শোনাচ্ছে সতর্কবাণী—‘সাবধান…সাবধান! ওরা আসছে!’ অদূরেই গনগনিয়ে জ্বলছে লোঢ়ির আলো। সেই আলোয় লোকগুলোর হাতের লাঠি চকচকিয়ে উঠছে। জ্বলজ্বল করে উঠছে ওদের শিকারীর চোখ! কাঁপা কাঁপা ছায়া সতর্কভাবে পড়ছে গমক্ষেতের আলপথে। পড়েই দ্রুততার সঙ্গে লুকিয়ে পড়ছে ক্ষেতের জমাট অন্ধকারে! যেন ছায়াগুলোও আজ লজ্জিত! হাতের লন্ঠনের স্তিমিত আলো দুদিক সামান্য আলোকিত করেই অপাবৃত হয়ে যাচ্ছে কালো রঙে। ভুট্টাক্ষেতের লম্বা ঝাড় যেন উন্মুখ হয়ে মাথা তুলে অপেক্ষা করছে কোনও অপ্রিয় ঘটনার। কাকতাড়ুয়াটাও যেন হাওয়ায় দুলতে দুলতে বলছে—‘সাবধান…সাবধান…ওরা আসছে!’
শিবমন্দিরের ভিতরে তখন টিমটিমিয়ে জ্বলছিল তেলের প্রদীপ। পঞ্চায়েতপ্রধান মন্দিরের সামনে এসে থম্‌কে দাঁড়ালেন। ভিতরে ঢোকা কি উচিত হবে? পুরোহিত ঠাকুরই বা কোথায়?
একটু এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল, শিবমন্দিরের লাগোয়া পুরোহিত ঠাকুরের বাড়িতে একটা আস্ত তালা ঝুলছে। অর্থাৎ তিনি তার ঘরে নেই!
বাইরে দাঁড়িয়েই হুঙ্কার ছাড়লেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘রাণো, বাহারা আনা! বাইরে আয় বল্‌ছি!’
ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ এল না! শুধু পুরনো শিবমন্দিরের তেলের প্রদীপের শিখা একটু কেঁপে উঠল। সেই শিখায় ধরা পড়ল অস্ফুট এক নারীমূর্তির ছায়া! শিবমন্দিরের দরজার কাছে লম্বা হয়ে পড়েছে ছায়াটা! পঞ্চায়েতপ্রধান নিশ্চিত হলেন, রাণো ভেতরেই আছে!
তিনি প্রচন্ড অহঙ্কারে, জোরের সঙ্গে পা ফেললেন মন্দিরের চাতালে। কী ভেবেছে এই অসভ্য মেয়ে! ভিতরে বসে থাকলেই পার পেয়ে যাবে? অত সহজ?
‘রাণো! বেরিয়ে আয় বলছি!’ ফের চেঁচিয়ে উঠলেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘আমরা জানি তুই ভেতরে লুকিয়ে বসে আছিস। পালিয়ে কোথাও পার পাবি না! বেরিয়ে আয়’।
রাণো তার কথাকে অগ্রাহ্য করল। তার ছায়াটা এখন অল্প অল্প দুলছে! ওদিকে বাইরের হিংস্র জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাদের ধৈর্যে আর মানছে না। তারা এই বিদ্রোহী রমণীর রক্তদর্শন করতে চায়।
পঞ্চায়েতপ্রধান এবার ঢুকে গেলেন শিবমন্দিরের ভেতরে। পেছন পেছন গোটা গ্রামই গেল!
শিবমন্দিরের ভেতরে তখনও চলছে আলো ছায়ার খেলা। একটি মাত্র প্রদীপই জ্বলছিল শিবলিঙ্গের সামনে। তাতে গোটা দৃশ্যটা যেন আরও রহস্যময় মনে হয়! যদিও ভেতরের নারীমূর্তিকে তাতে দেখতে কষ্ট হয় না! দুনিয়ার ছায়া মেখে সে বসে রয়েছে ভেতরে। বিস্রস্ত চুল যেন সাপের মত ফণা তুলে এলিয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। ঋজু ভঙ্গিতে বসে আছে ঠিকই। তবু বসে থাকার ধরণটা যেন বড় ক্লান্ত! কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার কোলে কিছু রয়েছে। ডান স্তন উন্মুক্ত! সম্ভবত সে তার সন্তানকে স্তন্যপান করাচ্ছে। একটা অস্ফুট শব্দও শোনা যাচ্ছে!
‘লড়কি জনিয়ে আবার দুধ খাওয়ানো হচ্ছে!’ লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেন পঞ্চায়েতপ্রধান—‘এই কে আছিস্‌! কেড়ে নে! কেড়ে নে ওর বাচ্চাকে!’
রাণো কোনও উত্তর দিল না। সে তখনও নিবিষ্টমনে তার সন্তানকে স্তন্যদান করছে।
পঞ্চায়েতপ্রধান দাঁত কিড়মিড় করে নিজেই এগিয়ে গেলেন। রাণোর চুলের মুঠি চেপে ধরে বললেন—‘করমজলি! বাচ্চাটা আমাদের দিয়ে দে বলছি!’
‘আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিবি!’ এই প্রথম চোখ তুলল রাণো। তার চোখ সাপের মণির মত প্রদীপের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল—‘আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে এসেছিস! এই নে! আমার মেয়েকে নে!’
বলতে বলতেই সে বিদ্যুৎবেগে কোলের জিনিসটা ছুঁড়ে দিল নিজের শ্বশুরের দিকে! একটা প্রচন্ড হিস্‌হিসানি! পরক্ষণেই মারাত্মক ছোবল এসে পড়ল পঞ্চায়েতপ্রধানের চোখের ওপর! একটা…দুটো…তিনটে…ছোবলের পর ছোবল…ছোবলের পর…! পঞ্চায়েতপ্রধান বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে দেখলেন তার হাত থেকে পড়ে গেল রাণোর সন্তান! সে মানুষ নয়! সে একটা আস্ত জাত কেউটের বাচ্চা! মিশমিশে পেলব, মসৃণ কালো রঙের দেহ ঝিকমিকিয়ে উঠছে প্রদীপের আলোয়! মেয়ে কোথায়—এ তো নাগিন! তবে? কীসের জন্ম দিয়েছে রাণো?
‘আমার সন্তানকে কেড়ে নিবি!’ স্তনের ওপর আঘাত করে চিৎকার করে উঠল উন্মাদিনী—‘দুধে ডুবিয়ে মেরে ফেলবি! নে! এবার মার! মা—র!’
পঞ্চায়েতপ্রধান ততক্ষণে বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে পড়ে গিয়েছেন শিবলিঙ্গের ওপরে! বাচ্চা সাপ হলে কী হবে, জাত কেউটে! তার ছোবল কিছু কম ক্ষতিকর নয়! তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে…পাগড়ি খুলে পড়ল…!
‘এত সহজ নয়!’ মেয়েটির চিৎকার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল গোটা মন্দিরে—‘মৈনু জিন্দা হৈ! মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ! আমি এখনও বেঁচে আছি!’

৬.

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দময়ন্তী। আস্তে আস্তে বলল—‘সারা গাঁও দেখেছিল। রাণো এক নাগিনকে ব্রেস্টফিড করাচ্ছিল। সবাই ধরে নিল যে এক ইচ্ছাধারী নাগিনের জন্ম দিয়েছিল সে। যে প্রথমে জন্মেছিল নারীদেহ নিয়ে। পরে নাগিনের রূপ নিয়ে নেয়’।
‘তারপর থেকেই রাণোর নাম হয়ে গিয়েছিল নাগমতী!’ সোম বলল—‘তাই তো?’
‘হ্যাঁ!’ বলল দময়ন্তী—‘আর তারপর থেকেই সে পূজিত হয়ে আসছে!…এখানেই…!’
সোম বিড়বিড় করে আপনমনেই বলে—‘অসম্ভব, বিশ্বাস হয় না!’
দময়ন্তী চুপ করে থাকে। বিশ্বাস না হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সেদিন গ্রামবাসীরা যা দেখেছিল, তাকেই অটল বিশ্বাসে পরিণত করেছে। কিন্তু যা দেখেনি, তা কাউকে বলার নয়। কাউকে বলা যাবে না সে কথা। বলা যায় না! শুধু এ দুনিয়ায় কয়েকটা লোকই সে কথা জানে। তার মধ্যে দময়ন্তী অন্যতম।
সেরাত্রে রাণো এসে কেঁদে পড়েছিল পুরোহিত ঠাকুরের পায়ে। নিজের কন্যাসন্তানকে তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল—‘যে করেই হোক্‌, আমার মেয়েকে বাঁচান ঠাকুর। ওকে…ওকে নিয়ে আপনি পালিয়ে যান! আমি পালাতে পারব না। সে শক্তি আমার নেই। ওরা আমায় ধরে ফেলবে। তারপর ওরা ওকে মেরে ফেলবে!’
পুরোহিত ঠাকুর প্রথমে বুঝে উঠতে পারেন না কী করবেন। তার বিদ্রোহী মন মেয়েটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু উপায় দেখতে পাচ্ছিলেন না। একটা উপায় মনের মধ্যে উঁকি মারছিল। কিন্তু সে কাজটাও কঠিন!
তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শিশুকন্যাটিকে নিয়ে মন্দির ত্যাগ করেন। কিন্তু যাওয়ার আগে বলেন—‘কিন্তু রাণো, তুই কোথায় যাবি?’
‘আমি এখানেই থাকবো ঠাকুর!’ রাণো ক্লান্তভাবে জবাব দেয়—‘আমার আর কোথাও যাওয়ার শক্তি নেই!’
‘তবে!’ তিনি ভয়ার্তস্বরে বলেন—‘ওরা তো তোকে ধরে ফেলবে। তারপর বাচ্চা কোলে নেই দেখলে ফের খুঁজতে শুরু করবে। যখন দেখবে মন্দিরে আমিও নেই, তখন সব বুঝে ফেলবে ওরা! তখন কী করবি?’
‘কিচ্ছু বুঝবে না!’ তেজদীপ্ত হয়ে ওঠে মেয়েটির মুখ—‘আমার দেহে এখনও প্রাণ আছে। মৈনু আজে ভি জিন্দা হৈ। কোনওদিন আমার মেয়ে কোথায় গেল জানতে পারবে না ওরা। কথা দিলাম!’
সেই মুহূর্তেই শিশুকন্যাটিকে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান পুরোহিতমশাই। চলে যান শহরে—তার ছেলের কাছে। তার পুত্র-পুত্রবধূ ছিল নিঃসন্তান। তাদের হাতেই তুলে দেন শিশুটিকে। বলেন—‘লোঢ়ির সওগাত!…’
রাণোও শেষপর্যন্ত বাঁচেনি। বিষ ঢুকে গিয়েছিল তার দেহেও। সবার অন্ধত্বের সুযোগ নিয়েই সে কোলে তুলে নিয়েছিল বাস্তুসাপ রজ্জোর এক শিশু নাগসন্তানকে। বুকে চেপে ধরেছিল তাকে। শিশুসাপ তার বুকে বেশ কয়েকবার ছোবল বসায়! সেই ছোবলেই দর্‌দর্‌ ধারে পড়েছিল তার স্তনবাহিত অমৃতধারা। সাপটা চেটে চেটে সেই দুধই খাচ্ছিল! আর সবাই ভেবেছে…!
ইতিমধ্যেই নাগমতীর মন্দিরে আরতি শুরু হয়ে গিয়েছে। দময়ন্তীর ‘দাদাজি’, তথা সেই পুরনো শিবমন্দিরের পুরোহিতই আরতি শুরু করেছেন। আরতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে বিগ্রহের মুখ! আরতি করতে করতেই তিনি তাকালেন নাতনির দিকে!
চিরদিনের নাস্তিক দময়ন্তী তখন আরতি দেখছে। তার চোখ নাগমতীর বিগ্রহের দিকে। চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছে। করজোরে প্রণাম করল সে।
কে জানে, কার উদ্দেশ্যে!

*********************************************************

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত