প্রেমের ছায়ামূর্তি

প্রেমের ছায়ামূর্তি

এই রুক্ষশ্রীহীন জীবনে নিখিলের অবান্তর ভাবনাগুলো কেন জানি উষ্কে দেয় ইমাকে। সন্ধ্যায় নিভৃতের কোণে প্রেমের অলীক সুখে মত্ত হতে চাওয়া নিখিলের সাথে ইমার স্ট্যাটাস মেলে না। চাইলেও ইমা পারে না নিখিলের ঘনিষ্ঠ চাওয়াগুলো পূরণ করতে। একটা সাধারণ মেয়ের সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিদ্যমান। নিখিল যখন বলে, “চলো না একটু ইচ্ছের সাইকেলে দুটি প্যাডেল মেরে আসি।”
ইমা তখন হাসে শুধু মিটিমিটি। নিখিলের ধৈর্য্যে তবু সুর কাটে না। সে আরও বলে, “অফিস থেকে লম্বা ছুটি নেব। তারপর কক্সবাজারে গিয়ে শুধু তুমি আর আমি থাকব।”
ইমা হৃষ্টচিত্ত অনুভব করে। কিন্তু সাধারণ মেয়েদের জল্পনাকল্পনায় বাস্তবতা খাপ খায় না। ইমা বলে, “কিন্তু আমরা তো এখনও বিয়ে করিনি।”
.
নিখিল তখনও অবুঝ শিশু, এই বুঝি হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে শুরু করবে। তবে নিখিলের সব চাওয়াই যে এরকম বেগতিক, সেটাও ঠিক নয়। খুব নির্দোষ অভিলাষেও মনটা তৃষিত হয় ওর। প্রযুক্তির এই যুগেও সে চিঠি চালাচালি পছন্দ করে। ইমা আপত্তি করলে বলে, “চিঠিতে আলাদা মজা আছে। মোবাইলের এসএমএস রোবটদের জন্য।”
.
সপ্তাহে একদিন তারা একে-অপরকে চিঠি দেয়। মাঝেমাঝে অনেক ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা তাতে থাকে। আজ সপ্তাহের সেই চিঠি দিবস, কিন্তু আজকের চিঠিতে যেন প্রাণ নেই। ইমা পড়তে গিয়ে বারবার অনুভব করে নিখিল যা বলতে চাইছে চিঠিতে তা নেই। শেষের দিকে বলা আছে, “বিকেলে দেখা করো। জরুরী!”
.
পার্কের কোণে বসে ইমা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্পের বই পড়ছিল। নিখিলের আসার সময় ফুরাতে ফুরাতে আশাও নিভে যেতে শুরু করেছে তখন। আকাশ তার প্রদীপ নিভিয়ে দিতে শুরু করেছে। ইমা তখন বইয়ের জগতে। যখন বোধোদয় হল তখন নিরিবিলি সন্ধ্যা। ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠতে যাবে তখনই ইমা লক্ষ্য করে পাশে কোনো ব্যাগ নেই। বই পড়বার মুহূর্তটা কাজে লাগিয়ে চোর তার কাজ সেরে নিয়েছে। ইমা ব্যাগ ছাড়াই উঠলো। পার্ক হতে বেরুবার সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো, “ম্যাডাম?”
.
ইমা থামলো আর তৎক্ষণাৎ এক তরুণ ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটির হাতে ভ্যানিটি ব্যাগটি। ছেলেটি ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে নিজ দায়িত্ব জ্ঞান করে নিজের সম্পর্কে পরিচয় দিতে থাকে।
.
“আমি ম্যাডাম পাভেল। থাকি এই পার্কেই। বিএ পাস।”
ইমা শুধু একটা ‘থ্যাংকস’ জানালো। তার এই উদাসীনতা পাভেল নামের ছেলেটির ভাল লাগলো না। সে কন্ঠস্বর খাদে ফেলে বলে, “দেখুন ম্যাডাম, এভাবে উদাসীন হলে চলে না। ব্যাগটা যে ফিরে পেয়েছেন তাতে হাজার শুকরিয়া। অথচ আপনি নির্বিকার!”
.
ইমা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে এড়াতে চাইলো। ছেলেটা বাউন্ডুলে। এ ধরনের কোনো ছেলের সাথে আলাপ-পরিচয় করবার কোনো মানে হয় না। কিন্তু পার্কে যেহেতু সে নিয়মিতই আসে কাজেই আরও একদিন পাভেলের সাথে তার দেখা হয়ে গেল। শুরুতেই সে বলল, “আপনি সেই ভ্যানিটি ব্যাগের ম্যাডাম না?”
ইমা কিছু না বুঝেই বলে, “হুম।”
“আমাকে চিনেছেন?”
“জ্বী না।”
“আমি পাভেল।”
“ও.. মনে পড়েছে।”
“ভাল দিনে দেখা হল ম্যাডাম। আমি বিয়ে করে ফেলেছি।”
“ভাল তো।”
“বউয়ের নাম রানি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
“নিশ্চয়। তা সে কই?”
“ফার্মগেটে।”
“ওখানে কেন?”
“ওখানেই তো আমাদের ফুটপাতের সংসার।”
ইমা অবাক হয়ে বলে, “মানে?”
“আমরা ফুটপাতে থাকি কারণ আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।”
“কেন?”
“আছে অনেক কাহিনী। পরে বলব।”
.
এই বলে পাভেল বিদায় জানিয়ে চলে গেল। ইমা আজও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই নিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসেছে। সে যে গল্পটি পড়ছে তার নাম ‘ভয়ের পুকুর’। সুন্দর গল্প। তবে শেষপর্যন্ত পড়া গেল না। নিখিল হঠাৎ গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, “ইমা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বলবে। আগে পাশে এসে বসো।”
“এখানে নয়.. চলো, কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”
“ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে এমন নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?”
.
নিখিল কিছু না বলে কপালের ঘাম মুছলো। দুজনে মিলে রেস্টুরেন্টে আসার পর নিখিল বলে, “ইমা, বাবার সেদিন হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তাই আমি আসতে পারিনি। সরি।”
“কী বলছ তুমি! আমাকে জানালে না কেন?”
“এখন তো জানলে। আর শোনো, তোমায় আর দরকার নেই।”
.
কথাটা ইমার কানে বাজতে লাগলো। দরকার নেই মানে কী? সে কি কোনো ব্যবহারি দ্রব্য যার দরকার ফুরিয়ে যাবে? ইমা বলল, “তার মানে?”
“বাবা আমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছেন। এখন তাকেই বিয়ে করতে হবে।”
“আমাদের এতদিনের সম্পর্ক…”
“ওসব ভুলে যাও। বাবার শরীরের যে অবস্থা ডাক্তার প্রেসার নিতে মানা করেছেন।”
“ও আচ্ছা। আমি তাহলে এখন প্রেসার হয়ে দাঁড়িয়েছি?”
“বোঝার চেষ্টা করো। বাস্তব এত সহজ না।”
.
ইমা নিঃশব্দে কেঁদে যেতে থাকে। কিছু বলে না।
.
ব্রেক-আপের পরও পার্কে যাতায়াত ছিল ইমার। একটাই উদ্দেশ্য, পাভেলের স্ত্রীকে দেখা। কে সেই মেয়ে যে তার ত্যাজ্যপুত্র হওয়া স্বামীকে ভালবেসে ফুটপাতে নেমে এসেছে? এটা কি আদৌ সম্ভব নাকি সিনেমার গল্প?
.
পাভেলের সাথে তার দেখা হল না তবে একদিন নিখিলের সাথে দেখা হয়ে গেল। নিখিল একা ছিল না। সাথে তার স্ত্রীও ছিল। সে শুধু দূর থেকে তাদের দুজনকে দেখছিল আর তিলতিল করে গড়া একটা ভালবাসার গল্পকে মিথ্যে হয়ে যেতে দেখছিল।
.
.
.
পাভেল দম্পতি সেদিন মাজারে যায়। গাজি-কালু-চম্পাবতীর মাজার। ঝিনেদা জেলার বারোবাজারে অবস্থিত। পাভেল হঠাৎ চাকরি পাওয়ার সুবাদে ঘুরতে বেরিয়েছে। মাজার থেকে ফেরার পথে পাভেল একটি মেয়েকে দেখে। খুব চেনা পরিচিত মনে হয় তাকে। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে মেয়েটি সত্যিই চেনা পরিচিত। তার নাম ইমা।
.
“ম্যাডাম, কেমন আছেন?”
“ভালো। আপনারা?”
“আমরাও ভাল।”
“রানিকে দেখার ইচ্ছা ছিল। আজ সেটা পূর্ণ হল।”
রানি মৃদু হেসে বলল, “ও প্রায়ই আপনার সম্পর্কে বলতো।”
পাভেল বলে, “আপনি কোনো কাজে এসেছেন বুঝি?”
“হ্যা। এদিকে একটা পেট্রোলপাম্প আছে তার ডিজাইনের কথা ভাবছি।”
“ম্যাডাম আপনি আর্কিটেকচার?”
“হুম। পেট্রোলপাম্প ডিজাইন করার সাথে ভাবলাম মাজারটি দেখে যায়।”
“ও আচ্ছা।”
“ঠিক আছে, তোমরা তাহলে এগিয়ে যাও, আমি আমার কাজ দেখি।”
“সিওর।”
.
পাভেল দম্পতি চলে গেল। ইমার এখানে আসবার আরও একটি বড় কারণ আছে। নিখিলকে দেখার জন্য তার এই আগমন। নিখিল এখানে এসেছে। সেও তার স্ত্রীকে নিয়ে মাজারে ঘুরছে। সত্যি বলতে, এই দুজনকে ইমা ফলো করে। কেন জানি এদেরকে একসঙ্গে দেখে সে প্রশান্তিবোধ করে। এই প্রশান্তির উৎস কোথায় সে জানে না।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত