মেঘ বৃষ্টি মায়াজাল

মেঘ বৃষ্টি মায়াজাল

সুনসান একটা নীরবতা চারদিকে। রাস্তার পাশে গাছগুলোর ছায়া পড়েছে রাস্তার মাঝে। নীরবতা ছাপিয়ে গাছের মধ্যে কিছু অজানা পাখির কিচিরমিচির কলরব। বটগাছটা নিথর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছ থেকে কিছু লতা ঝুলে আছে নিম্নমুখী হয়ে। সাবিনা কলেজ থেকে ফিরছে। ঠিক দ্বিপ্রহর। বটগাছটার কাছাকাছি এসে একটু ছায়ার জন্য দাঁড়ায়। খুব তৃষ্ণাও পেয়েছে। কলেজ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মুখে দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেয়। বটগাছের আশ্রয়ে, নির্মল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। মূল রাস্তা পেরোলেই একটি ছোট নদীর ছোট একটি শাখা বয়ে গেছে। অনেকটা ছোট খালের মতো। স্থানীয় লোকজন তার ওপরে ছোট একটি বাঁশের সাঁকো দিয়েছি। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য।

সাবিনা সাঁকোর ওপর ওঠে। এমদাদও তখন ঢাকা থেকে ফিরছে। সাঁকোর ওপর দুজন মুখোমুখি হয়। সাবিনা খিলখিল করে হেসে ওঠে। —আপনাকে নিচে ফেলে দেই?

এমদাদ হন্তদন্ত খেয়ে যায়। একই গ্রামের সাবিনা। এর আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে পথেঘাটে কিন্তু কখনো কথা বলেনি। আজ এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলা দেখে এমদাদ কোনো কথা না বলে নিজের জীবন বাঁচিয়ে খুব দ্রুত সাঁকো পেরিয়ে আসে। বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। পেছন থেকে জোর গলায় শোনা যায়—কী হলো পালাচ্ছেন কেন? ভয় পেয়েছেন নাকি?

এমদাদ কোনো রকমে বাড়ি এসে পৌঁছায়। ঢাকাতে একটা পত্রিকা অফিসে চাকরি করে এমদাদ। মাস শেষে বাড়ি আসে। আর মা অসুস্থ হলে বা কোনো দরকারে আসতে বললে আসে। এবার মা একটু তাড়া দিয়েই ছেলেকে আনিয়েছেন। ছেলের জন্য বউ ঠিক করবেন বলে। এমদাদের অবশ্য বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো নেই। নির্ভেজাল মানুষ। চাকরি করে। অন্য সময় বই পড়ে। বাড়িতে এলেও দু–একটা কবিতার বই নিয়ে আসে। বই পড়ে ও মায়ের কাছে থাকে। বন্ধু-বান্ধবও খুব একটা নেই বললেই চলে। কোনো মেয়েকে ভালো লাগলেও কখনো সাহস করে বলা হয়নি। তার চোখের সামনেই ওসব মেয়েরা অন্যের হয়ে গেছে। কখনো বলাও হয়নি, প্রেম করাও হয়নি। তবে দু-একজনের কথা ডায়েরিতে লেখা আছে। ওরা শান্তশিষ্ট আর লাজুক মেয়ে। আজকে সাবিনাকে দেখে আবার ওদের কথা মনে পড়েছে। ওরাও মেয়ে, সাবিনাও মেয়ে। কেমন অ্যাগ্রেসিভ। দাঁত বের করে হাসছিল। বলে সাঁকো থেকে ফেলে দেবে।

এমদাদ বাড়ি এসে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে। মা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন। কীভাবে যে ছেলেকে কথাটা বলবেন। ইতস্তত করতে থাকেন। এমদাদ বলে

—কি হইছে আম্মা। কিছু বলবেন?

—না মানে বলতে চাইছিলাম তোমার বিয়ের জন্য একটা মেয়ে ঠিক করছি। আমার ছোটবেলার সই কুলসুমের মেয়ে সাবিনা। কলেজে পড়ে। আজ বিকেলে তুমি আমার লগে সাবিনাগো বাড়িত যাইবা। এমদাদ মুখে ভাত দিতে গিয়ে থেমে যায়।

—কী সাবিনা! আর মেয়ে খুঁজে পাইলেন না।

—কেন সাবিনার কি হইছে। মেয়ে কোন দিক দিয়া খারাপ?

—ওর মাথায় মনে হয় ডিস্টার্ব আছে। লাজ শরম নাই। আজকে নদীর ঘাটে সাঁকোর ওপর আমার সঙ্গে দেখা হইছে। আমাকে বলে সাঁকোর থেকে ফেলে দেবে। আমি কোনো রকমে জান বাঁচিয়ে আসলাম।

—বলিস কী? মায়ের বিশ্বাস হতে চায় না। মেয়েটা একটু চঞ্চল কিন্তু এমন বেশরম না। তুমি ঠিক চিনেছ তো?

—হুম না চেনার কী আছে। এত বছর ধরে দেখে আসছি। এমদাদ খাওয়া শেষ করে ওঠে। মা বাসনপত্র সব গোছাতে থাকেন। এদিকে সাবিনাদের বাড়ি থেকে খুব শোরগোল শোনা যায়। মা বাসনপত্র রেখে সাবিনাদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন। এমদাদও পিছু পিছু যায়।

কলেজ থেকে ফিরেই সাবিনা সোজা ভাত-তরকারির হাঁড়ি নিয়ে বসে। হাঁড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে গপাগপ গিলতে থাকে। সাবিনার মা, ভাই-বোনেরা সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। খাওয়া শেষ করে লবণ-মরিচ আর চাকু নিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে বিশাল আম গাছের আগায় উঠে যায়। এক এক করে কাঁচা আম ছুরি দিয়ে ছিলে লবণ-মরিচ দিয়ে খেতে থাকে। এসব কাণ্ড দেখে সাবিনার মায়ের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না। দিশেহারা হয়ে সবাইকে ডাকতে থাকেন। ওরে তোরা কে কোথায় আছিস রে সাবিনারে ভূতে ধরছে। ধীরে ধীরে মানুষ জড় হতে থাকে। কেউ কেউ সাবিনাকে নামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হিতে বিপরীত হতে থাকে। যার যত গোপন কথা আছে সেটা ভরা মজলিশে ফাঁস করে দিতে থাকে। তাই যে এগিয়ে আসে সে আবার পিছু হটতে থাকে। কিন্তু সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাণ্ড দেখতে থাকে। ওর কাছে গেলে কিছু বলতে গেলে বিপদ। সন্তান সম্ভবা মহিলাদের কার কী হবে সেটা অকপটে বলে দিচ্ছে। তাই কেউ কেউ লজ্জায় পালাচ্ছিল। আবার কেউ কেউ সামনে এসে জানতে চাচ্ছে।

এমদাদের ভূত-প্রেতে তেমন বিশ্বাস নেই। সে এই সব মোটেও বিশ্বাস করছে না। এই মেয়ে ইচ্ছে করে এসব করছে। অভিনয় করে লোক হাসাচ্ছে নয়তো মাথায় গন্ডগোল আছে। এসব কাণ্ডকারখানা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতেও ইচ্ছে করে না। এর চেয়ে বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলেও ভালো। মা আসে না। তিনি বিচলিত হয়ে সাবিনার মাকে সান্ত্বনা দেন। সাবিনার বাবা ওঝা নিয়ে আসেন। ওঝা ঝাড়ফুঁক দেওয়া শুরু করে। ঝাড়ফুঁকের কারণে কী অন্য কোনো কারণে সাবিনা গাছ থেকে লাফিয়ে নামে। ওঝা ওঝার কার্যক্রম শুরু করে। হাতের কনিষ্ঠ আঙুল চেপে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জবাব দিতে না চাইলে শলার ঝাড়ু দিয়ে দুই–চার ঘা মারেন। পেতনি সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়। গেছো পেতনি বটগাছের নিচে ঘুমাচ্ছিল। সাবিনা তার পাশে বসে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই একলা পেয়ে সাবিনার ওপর ভর করে।

এবার ওঝা বলেন, তুই কি শলার ঝাড়ু মুখে করে পালাবি নাকি বোতল ভরতে হবে। পেতনি বলে, পালামু কেন? আমি কী তোরে ডরাই। তোর ঘাড় মটকাইয়া তারপর যামু। ওঝার আত্মসম্মানে লাগে। চারপাশে তাকিয়ে সবার দিকে একবার চেয়ে নেন। ওঝাকে তো নিজের ক্ষমতা দেখাতে হবে। ঝুলি থেকে কাচের বোতল বের করে নেন। ঝাড়ফুঁক আরও জোরেশোরে শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ ওঝার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে, বোঝাপড়া করে অতঃপর পেতনি খালি বোতলের ভেতর চালান হয়ে যায়। ওঝা বিজয়ের হাসি হেসে সোল্লাসে বোতলের ছিপি বন্ধ করে দেন। বোতলটি ঝুলিতে ভরে সাবিনার বাবাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে সুপারি বাগানে, নিরাপদ স্থানে মাটি খুঁড়ে বোতলটি রেখে মাটি চাপা দেন। ওঝার কাজ শেষ।

সাবিনা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকে। এমদাদের মা, সাবিনার মাসহ আরও কিছু নারী ধরাধরি করে সাবিনাকে ঘরে আনে। মাথায় পানি ঢালতে থাকে। চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়। চেতন ফিরলে সাবিনার কিছুই মনে থাকে না। যেন কিছুই ঘটেনি। এমদাদের মা ছেলের হবু বউয়ের অবস্থার উন্নতি দেখে আশঙ্কামুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। এখন তো আশঙ্কামুক্ত। এবার যদি এমদাদকে রাজি করানো যায়। কিন্তু এমদাদ যেরকম নির্ভেজাল ছেলে এই ভেজালকেতো ঘরে তুলবে বলে মনে হয় না। তবুও মা ছেলের ঘরে এসে বসেন। এমদাদ বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। বই থেকে মুখ সরিয়ে বলে, মা তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?

মা আমতা-আমতা করে বলেন—না, মানে বলতে চাইছিলাম, সাবিনাতো এখন পুরো সুস্থ। তুমিতো পরশুদিন চলে যাইবা। আজকে তো আর হবে না। চলো কালকে একবার সাবিনাগো বাড়িত যাই।

এমদাদ কখনো মায়ের ওপর কথা বলে না। কিন্তু আজ আর চুপ করে থাকতে পারে না। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকেই তো নিতে হবে। মায়ের ওপর একটু অভিমান নিয়েই বলে, ওই পাগল মেয়েকে তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলছ! ওই পাগলিকে আমি কেন কেউই বিয়ে করতে রাজি হবে না।

—ও পাগল না বাবা। খুব ভালো মেয়ে। ভূতে ধরেছে তাই তখন এমন করেছিল। ওঝা এসে এখন ভূত নামিয়েছে। এখন দিব্যি সুস্থ। সাবিনা দেখতে শুনতেও ভালো। তুমি না বিয়ে করলেও যে কেউ বিয়ে করতে চাইবে।

—মা আমিতো বলিনি সাবিনা দেখতে শুনতে খারাপ। সে দেখতে যথেষ্ট ভালো। কিন্তু ওর আচার-আচরণ, চালচলন আমার ভালো লাগেনি। যদিওবা ওর সঙ্গে কখনোই কথাবার্তা হয়নি। আমি এ রকম মেয়ে পছন্দ করি না। তুমি অন্য মেয়ে দেখ।

—তাহলে কি সাবিনার বাবা-মাকে নিষেধ করে দিমু?

—কীভাবে কী করবে সেটা তুমি ভালো জান।

এমদাদের মা সাবিনার মাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। এমদাদের মায়ের নীরবতা দেখে সাবিনার মা–বাবাও আর কিছু বলেন না।

এমদাদের ছুটি ফুরিয়েছে। সকাল সকাল নাশতা খেয়ে, কাপড়চোপড় নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশে। এদিকে সাবিনারও কলেজের সময় হয়েছে। কলেজব্যাগ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো না। বর্ষাকাল। খুব মেঘ করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। ঘরে এসে আবার ছাতা নিয়ে নেয়। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাবিনা তখন সাঁকোর গোড়ায় এসে পোঁছায়। এমদাদ তখন সাঁকোর মাঝখানে। খরস্রোতা শাখা নদী জলে টইটুম্বুর। দুই–তিন পা এগোতেই প্রবল বাতাসে সাবিনার ছাতা হাত থেকে ছুটে এমদাদের গায়ে এসে পড়ে। এমদাদ পেছনে ফিরে সাবিনাকে দেখে ভাবে নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ছাতা মেরেছে। এমদাদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পা চালায়। সাবিনা ছাতা নেওয়ার জন্য এমদাদের ঠিক পেছনে এসে ছাতা ধরে টান দেয়। এমদাদ দুই হাত দিয়ে শক্ত করে বাঁশের হাতল ধরে নাড়া দেয়। এমদাদের বাস তখন মেইন রোডে চলে এসেছে। আর পেছনে না তাকিয়ে সাঁকো পেরিয়ে সোজা বাসে উঠে যায়। তখনই পেছন থেকে চিৎকার আসে এমদাদ ভাই…।

এমদাদ তাকিয়ে দেখে শক্ত করে সাঁকো নাড়া দেওয়ায় ব্যালেন্স হারিয়ে সাবিনা পা পিছলে নিচে পড়ে গেছে। তবুও বাঁশের গোড়া ধরে ওঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্রোতের শক্তির কাছে সাবিনার শক্তি হার মানে। সাবিনা এমদাদ ভাই বলে চিৎকার দেয় তখন স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায়। এমদাদ দৃশ্যটা বাসে দাঁড়িয়েই দেখে। বাস থেকে নামবে কিনা ভাবতে ভাবতেই বাস ছেড়ে দেয়। সা সা করে বাস চলতে থাকে। এমদাদ জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী মনে হতে থাকে। পাগল হোক আর যাই হোক সাবিনাকে তার বাঁচানো উচিত ছিল। বাঁচার জন্য কতই না চেষ্টা করেছে মেয়েটা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্রোতে ভেসে অনেক দূর চলে গেছে। হয়তো বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত আর বাঁচতে পারল না। মনের অজান্তে চোখ বেয়ে দুই–তিন ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। নিজে নিজেই ভাবে। সাবিনাকে তো সে বিয়েও করতে চায়নি, জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবতেও পারে না। তাহলে এই চোখের পানি কীসের জন্য। এই কী শুধুই মায়া নাকি অন্য কিছু।

সেই রাতে এমদাদের আর ঘুম আসে না। চোখের সামনে শুধুই সাবিনার ভেসে যাওয়া ভাসতে থাকে। আর কানের মধ্যে বাজতে থাকে—এমদাদ ভাই বলে সাবিনার বিকট আওয়াজ। এমদাদ একবার টিভি ছাড়ে। না এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অবশেষে মনোযোগ ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বালিশে হেলান দিয়ে পাতার পর পাতা পড়তে থাকে। বইয়ের ওপর হঠাৎ যেন কীসের ছায়া পড়ে। এমদাদ মুখ তুলে তাকায়, জানালার কাছে খোলা চুলে ওপাশ ফিরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। এমদাদের বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে।

—কে কে ওখানে? আপনি আমার ঘরে কেন এসেছেন?

—আমি কে আর কেন এসেছি সেটা আপনি জানেন। তাহলে কেন জিজ্ঞেস করছেন? এ কথা বলে সাবিনা চেয়ার টেনে এমদাদের সামনে বসে। এমদাদের ভীতি কিছুটা কমে।

—বল কি বলতে এসেছ?

সাবিনা এবার চটে যায়। কী বলতে এসেছি মানে? কত কিছুই তো বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলার সুযোগ হলো কই। আমি কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে। আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনি আমাকে বাঁচালেন না কেন? তাহলে তো আজ আমি সত্যিকারে মানবী হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতাম।

—তাহলে তুমি সত্যিকারের মানবী নও?

—না, আমি সাবিনার প্রেতাত্মা।

—কীসের প্রেতাত্মা! আমি ওসব ভূত, প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। যাও এখান থেকে আমাকে আর বিরক্ত করতে আসবে না।

—ঠিক আছে আমি কাল আবার আসব। আমার প্রশ্নের জবাব চাই।

—জবাব না দিলে কি করবে? ঘাড় মটকাবে?

—নাহ্, প্রেম করব। —গেট আউট। আই সে গেট আউট। সাবিনা এমদাদের হাতের থেকে বইটা নিয়ে নেয়।

—বাহ্, রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস পড়ছেন। তাহলে এত আন রোমান্টিক হলেন কীভাবে?

—তোমার কথার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।

—বাধ্য না হলে সন্ধ্যা থেকে শুধু আমার কথা ভাবছিলেন কেন?

—আমি ভাবছিলাম? সেটা তোমাকে কে বলেছে।

—আমি প্রেতাত্মা তাই সব বলতে পারি। এখন আপনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। আমি বুঝতে পারছি। ঠিক আছে আজ যাচ্ছি। কাল আবার আসব। পলকেই সাবিনা হারিয়ে যায়। জানালার পর্দা বাতাসে এদিক সেদিক দুলতে থাকে।

পরদিন সন্ধ্যা থেকে এমদাদ খুব বিচলিত থাকে। রাতে এলে কী জবাব দেবে। ব্যাপারটা অন্য কারও সঙ্গে শেয়ারও করতে পারে না। অন্যরা ভাববে মাথায় নির্ঘাত সিট আছে। আর সে নিজেও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না। এটা বলতে যাওয়াও লজ্জার ব্যাপার। তবুও একটা উত্তর রেডি করতে হবে। এমদাদ কোনো রকমে একটা উত্তর রেডি করে নেয়। আর অপেক্ষা করতে থাকে কখন গভীর রাত হবে আর সাবিনা আসবে। এমদাদ জানালা খুলে রাখে। অবশেষে মাঝরাতে সাবিনা আসে।

—আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? এমদাদ চুপ করে থাকে। মিথ্যে বলে কোনো লাভ হবে না। সে সবই জানে।

—আপনি মনে হচ্ছে খুবই উদ্বিগ্ন। আমার প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন, সেটা ভেবে।

—নাহ, আসলে আমার বাস সেদিন ছেড়ে দিয়েছিল। না হলে আমি তোমার জন্য কিছু একটা করতাম। এ জন্য নিজেকে নিজে দোষারোপও করেছি। আসলে তোমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি বাঁশের হাতল ধরে জোরে নাড়া দিয়েছিলাম। এখন তুমি যদি মনে কর আমাকে শাস্তি দেবে, দিতে পার। আমি মাথা পেতে নেব। আর যদি মনে কর ক্ষমা করে দেবে, তাও করতে পার। সাবিনা চেয়ার টেনে এমদাদের মুখোমুখি বসে।

—আপনি আপনার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। তাই আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এমদাদ খুশি হয়। সাবিনা তুমি খুব ভালো মেয়ে। প্রেতাত্মারা এত ক্ষমাশীল হয় না। আম্মার কাছে শুনেছি, তুমি জীবিত থাকতেও ভালো মেয়ে ছিলে। নিজের প্রশংসা শুনে সাবিনা কিছুটা লজ্জিত হয়। এমদাদ বলে, সাবিনা তুমি বসো। আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসি। প্রেতাত্মারা খাওয়া দাওয়া করে কিনা আমি জানি না।

—আমি খাই। আপনি চা নিয়ে আসেন। চা খেতে খেতে দুজনে গল্প করব। এমদাদ চা নিয়ে আসে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, সাবিনা একটা সত্যি কথা বলি?

—বলেন।

আমি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার হ্যালুসিনেশন। সাবিনা চোখ বড় করে বলে, কী ডাকাতি কথা। বিশ্বাস না হলে আমাকে ছুঁয়ে দেখেন। সাবিনা এমদাদের হাত ধরে ফেলে। এমদাদ কিছু সময়ের জন্য ভিন্ন জগতে চলে যায়। এ তো মানবী নয় প্রেতাত্মাও নয়। মাঝরাতে আকাশ থেকে কোনো অপ্সরী নেমে এসেছে। তাকে ছুঁয়ে দেখতে বলছে। পরিপূর্ণ আবেগ নিয়ে এমদাদ সাবিনার দিকে চেয়ে থাকে। ঘোর কেটে যেতেই নিজের হাত সরিয়ে নেয়, প্রেতাত্মার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা কখনোই সম্ভব না।

সাবিনা এবার সপ্রতিভ হয়ে বলে, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই না?

—তোমাকে বিশ্বাস–অবিশ্বাসের কি আছে। তুমি তো শুধুই প্রেতাত্মা।

—প্রেতাত্মা কথাটার মাঝে আত্মা আছে কিন্তু। একটু ভেবে দেখেন।

—কথাটা ভালো বলেছ। প্রেতাত্মার মাঝে আত্মা আছে।

—আত্মার সম্পর্কই সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক। তাই নয় কি? অন্য সম্পর্কগুলো সব ক্ষণস্থায়ী আজ আছে কাল নেই।

কিন্তু যেই সম্পর্কগুলো আত্মার ওপর নির্ভরশীল সেগুলো মরে গিয়েও বেঁচে থাকে। যেমন আত্মা আমাকে বাঁচিয়ে এনেছে আপনার কাছে।

এমদাদ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই কোন মায়াজালে আটকে পড়ছে। এই জাল ভেদ করে সে কী করে বেরিয়ে আসবে।

সাবিনা বুঝতে পারে। বলে, আপনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আজ আমি যাই। আগামীকাল রাতে বৃষ্টি হবে। আপনি খিচুড়ি করে রাখবেন। দুজনে একসঙ্গে ডিনার করব। সাবিনা হাত নেড়ে জানালার কাছে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘরময় একটা সুশোভিত ঘ্রাণ বাতাসে ছেয়ে যায়।

পরের রাতে সাবিনা আবার আসে। সাবিনা এলে এমদাদের ভালো লাগে। পুরো ঘর আলোতে ভরে যায়। প্রেতাত্মা বললে হয়তো ভুল হবে। প্রেতাত্মারা তো এত সুন্দর হয় না, এত আলোও ছড়াতে পারে না। একে পরি বলা যেতে পারে।

এমদাদ কথামতো ডিনারের বন্দোবস্ত করে। সাধ্যমতো সবকিছু প্রস্তুত করে। দুজনে একসঙ্গে ডিনার সেরে নেয়, গল্প করে। আবার যথাসময়ে সাবিনা চলে যায়। সাবিনা চলে গেলে ঘরজুড়ে শূন্যতা বিরাজ করে। এমদাদের বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। সে তো প্রেতাত্মা একেবারে থেকে যেতে পারবে না।

পরদিন মেঘ করে বৃষ্টি নামে। সাবিনা আসে। ঝুম বৃষ্টি দেখে, সাবিনা এমদাদকে নিয়ে ছাদে চলে যায়। তুমুল বৃষ্টিতে দুজনে ভিজে একাকার হয়ে যায়। সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে সাবিনা চলে যায়। এই মেঘ, বৃষ্টি মায়াজালে এমদাদ ধীরে ধীরে পুরোই আবিষ্ট হয়ে যায়। এভাবে প্রতি রাতে সাবিনা আসে, আবার নির্দিষ্ট সময়ে চলে যায়।

এমদাদের বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে আসে। সাবিনা কী বাড়িতেও যাবে নাকি শুধু এখানেই থাকবে। আজ এলে জিজ্ঞেস করতে হবে। সাবিনা যথাসময় আসে। এমদাদ জিজ্ঞেস করে, আমি কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাব তুমি কি আমার বাড়িতে যাবে?

—কেন যাব না। আপনার গ্রামতো আমারও গ্রাম। অবশ্যই যাব। দুজনে গ্রামের আলে আলে ঘুরব, নৌকায় চড়ব, গাছে চড়ব। অনেক মজা হবে। যে কয়দিন থাকবেন আমি প্রতি রাতেই যাব। এমদাদ আশ্বস্ত হয়। সাবিনা রাত ফুরানোর আগেই জানালার কাছে গিয়ে হারিয়ে যায়। দমকা হাওয়া শরীর, মন, ঘরজুড়ে বয়ে যায়। পরদিন এমদাদ গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। সাবিনাও আসত। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে এমদাদ গ্রামে আসতেই সাবিনার বাবা টঙের দোকানে আরও কিছু মুরুব্বিসহ বসে কী যেন আলোচনা করছিলেন। এমদাদকে দেখেই সাবিনার বাবা এগিয়ে আসেন।

—বাবা তুমি এসেছ ভালো হয়েছে। আগামী শুক্রবার সাবিনার বিয়ে। তুমি তোমার মাকে নিয়ে অবশ্যই আসবে।

এমদাদ কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। স্থির হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রতিভ হয়ে কোনো রকমে বলে, ঠিক আছে চাচা আমি আম্মাকে নিয়ে আসব। এমদাদ বিদায় নিয়ে বাড়ি আসে। মাকে সাবিনার কথা জিজ্ঞেস করে। মা খোঁচা দিয়ে বলেন, তুমিতো রাজি হওনি এখন তারা আরও ভালো জায়গায় দেখে বিয়ে দিচ্ছে। এমদাদ কিছুই বলে না, বিমর্ষ হয়ে শুধু রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। টিনের ঘরে চাল বেয়ে রাত নেমে আসে, মাঝরাত হয়, ভোররাত হয়, ধীরে ধীরে আলো ফুটে যায়। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিন্তু সাবিনা আসে না। পরের রাতেও এমদাদ সারা রাত অপেক্ষা করতে থাকে, কিন্তু সাবিনার কোনো অস্তিত্বই মেলে না।

এমদাদ বুঝতে পারে এটা হ্যালুসিনেশন ছিল। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। সবকিছু বুঝেও না বুঝে থাকতে চায়। সাবিনার প্রেতাত্মাকে আবার পেতে চায়। বাস্তবতা জানতে চায় না। জানলে কষ্ট পাবে। কষ্ট বাড়বে, হয়তো কষ্ট এড়ানোর জন্য, হয়তো একটু ক্ষণিকের মায়ার জন্য।

রাত আসে রাত যায় সাবিনা আসে না। অপেক্ষা শেষ হয় না। অবশেষে আর থাকতে না পেরে এমদাদ সাবিনার বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। সাবিনার দেখা মেলে না। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় সাবিনা বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সাবিনাদের বাড়ির পেছনে একটা সুপারি বাগান আছে। সাবিনার ঘরের জানালা বরাবর বাগান। এমদাদ সেখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে সাবিনার আসা যাওয়া দেখা যায়। সন্ধ্যা অবধি এভাবে দেখতে থাকে। অবশেষে সন্ধ্যার সময় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে সাবিনার চোখে পড়ে। সাবিনা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

—এমদাদ ভাই, আপনি এখানে কি করছেন? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি।

—সাবিনা তুমি সেদিন পানিতে পড়ে মারা যাওনি?

—নাহ। আমি কেন মারা যাব। আমিতো সাঁতার জানি। আর আশপাশে মানুষজন ছিল। কত নৌকা ছিল। সবাই বাঁচিয়েছে।

—সবাই বাঁচিয়েছে কিন্তু আমি বাঁচাইনি। সেদিন আসলে আমার বাস ছেড়ে দিয়েছিল। তাই বাঁচাতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

—আপনি এটা বলার জন্য এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন? আমারতো ওসব মনেই নেই। কত দিন আগের কথা। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়িতে আসেন। আব্বা আছে, আব্বার সঙ্গে কথা বলবেন। চা খেয়ে যাবেন।

—নাহ। আমি বাড়িতে যাব না। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

—আমার সঙ্গে? কি কথা? এমদাদ খপ করে সাবিনার হাত ধরে ফেলে। সাবিনা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সাবিনা টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নেয়। —আপনার মাথা ঠিক আছে এমদাদ ভাই! দুই দিন বাদে আমার বিয়ে। আপনি কি এখানে নাটক করতে এসেছেন? কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আপনি এখন এখান থেকে চলে যান। আর কখনো আসবেন না।

সবচেয়ে ভালো হয় শহরে চলে গেলে। সাবিনা দৌড়ে ঘরে চলে আসে। এমদাদ জিনিসপত্র গুছিয়ে ঢাকায় চলে আসে। যদিও জানে হ্যালুসিনেশন তবুও রাতের জন্য, সাবিনার প্রেতাত্মার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দরজা, জানালা সব খুলে বসে থাকে। প্রহর কাটে, প্রভাত হয়। সাবিনার প্রেতাত্মা আসে না। এক রাত, দুই রাত এভাবে প্রতি রাত আসে যায় প্রেতাত্মার কোনো অস্তিত্ব মেলে না। মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়। জানালার পর্দা বাতাসে এদিক সেদিক দুলতে থাকে। সেই মেঘ, বৃষ্টি মায়াজালে কেউ আসে না। এমদাদের নিজেকে অসহায় লাগতে থাকে।

জীবনটাকে বোঝা মনে হতে থাকে। মরে গেলে ভালো হতো। প্রেতাত্মা হয়ে সাবিনার কাছে যাওয়া যেত। তবুওতো যাওয়া যেত। আজ সাবিনার বিয়ে। সন্ধ্যা থেকে এমদাদ একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। সিগারেট ছাড়া এমদাদের আর কোনো কিছুতে আসক্তি নেই। কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে মদ খেতে। সব ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু নাহ। এমদাদ বইয়ের পোকা। কোনো কিছু ভুলে থাকতে চাইলে বই পড়ে, মনযোগ ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য। দরজা–জানালা সব খুলে এমদাদ বই নিয়ে খাটের ওপরে শুয়ে পড়তে থাকে।

সাবিনার প্রেতাত্মা আসবে না। তবুও অপেক্ষা। মনের ঘোরেও যদি একবারের জন্য হলেও হ্যালুসিনেশন হয়। সাবিনা আসে। হঠাৎ যেন বইয়ের ওপর কীসের ছায়া পড়ে। এমদাদ মুখ তুলে তাকায়। সাবিনা দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে এমদাদ বলে, সাবিনা তুমি এসেছ। আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমিতো সবকিছুই বলতে পার। নিশ্চয়ই আমার মনের অবস্থাও বুঝতে পেরেছ। এত দিন আসনি কেন? তুমি জান আমি তোমার জন্য কত অপেক্ষা করেছি।

—আমি কী করে জানব। আমিতো জানতাম আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাননি। আমাকে ভূতে ধরেছিল বলে পছন্দও করেননি। সেদিন আপনি আমাকে বলার পর থেকে আমি অনেক ভেবেছি। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে পালিয়ে এসেছি। সাবিনার কোনো কথাই এমদাদ শুনতে পায় না। হতবিহ্বল হয়ে শুধু সাবিনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এদিকে সাবিনার মা আহাজারি করতে থাকেন। ওরে তোরা কে কোথায় আছিসরে সাবিনা ঘরে নাই। গ্রামের মানুষেরে মুখ দেখামু কেমনে, বরপক্ষরে কি জবাব দিমু। মাইয়া তুই এই কাম কেমনে করলি। এমদাদের মা সাবিনার মাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। সাবিনার বাবা লোকজন নিয়ে সাবিনাকে খুঁজতে বের হন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত