নতুন সূর্য

নতুন সূর্য

যাই বল ভাই , অনুষ্কা কে কিন্তু আমার দারুন লাগে …
– ধুর, কোথায় দীপিকা কোথায় অনুষ্কা
-আরে, ক্যাটরিনা র মতো সুন্দরী আর কেউ নেই ,কি দেখতে বস ……

এই হলো সুভাষচন্দ্র কলেজের ইকোনমিক্স অনার্স এর সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রদের রোজকার জটলা |এদের রোজকার নানারকম মুখরোচক আমিষ নিরামিষ আলোচনায় দীপিকা – প্রিয়াঙ্কা থেকে শুরু করে সানিয়া – মারিয়া কেউই বাদ যায় না …এছাড়া খেলা , রাজনীতি , কলেজের লোকজন সেসব টুকটাক তো চলছেই|ওদের মধ্যের রেড টি শার্ট পরা চশমা চোখে ফর্সা মতো ছেলেটির হ্যান্ডসাম বলে কলেজে বেশ নাম ডাক আছে |সে তার সুন্দর মুখের টিকালো নাকের চশমার ফাঁকের মধ্যে দিয়ে তাকে দেখলেই যে অনেক মেয়ের বুকের ভিতরটায় কিরকম হালচাল হয় , তা বুঝতে পারে | কিন্তু সে অনেক দূরের এক ডালে মই দিয়ে পরম আগ্রহে অপেক্ষারত, মনোসংযোগে একটুও বিঘ্ন ঘটাতে চায় না |

ও কয়েক দিন আগেই দিল্লী বেড়াতে গিয়েছিলো , কালই সবে কলেজ জয়েন করেছে , কয়েকদিনের নোটস গুলো জোগাড় করতে হবে ভাবছে …..একটু দূরেই একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আবিষ্ট চোখে নিরীক্ষণ করছিলো লাল টি শার্টের ওপরে ঝলমল করতে থাকা সুন্দর মুখটা |আর ওর মুখে ক্যাটরিনার প্রশংসা শুনতে শুনতে নিজের শরীরের দিকে দু এক বার তাকিয়ে ওড়নাটা সামলাতে সামলাতে মনে মনে নিজের চেহারার সাধারণত্বের সাথে ক্যাটরিনার টিভিতে দেখা মোমপালিশ করা শরীরের জেল্লার তুলনা করছিলো , আর ওর দীর্ঘ শ্বাসগুলো দীর্ঘতর হচ্ছিলো …..

ওর হাতে এ কদিনের নোটস এর জেরক্স , ওই অনিন্দ্যসুন্দর ছেলেটি , মানে অভিদীপ্তর এক ঝলক দেখা …ও ডাকবে অভিদীপ্তকে একবার ওর নাম ধরে ….ও এগিয়ে আসবে ওর দিকে |

– অভিদীপ্ত , তুই যে কদিন আসিস নি , তার নোটস গুলো , জেরক্স করিয়ে এনেছি |
– ওয়াও , দারুন , কত টাকার টোটাল জেরক্স হয়েছে বল |
– না ,এমন কিছু না …..
– থ্যাংকস রিনি |

রিনি মুগ্ধ চোখে ওর দেওয়া নোটস হাতে অভিদিপ্তর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে …. ওর মুখে নিজের নামটা শুনেই আজকের দিনটা যেন উজ্বল হয়ে উঠলো রিনির চোখে |

কলেজ ফাঙ্কশনে গ্রূপ ডান্সের সময় কেবলমাত্র একজন ঢুকলেই রিনির সামনে এগিয়ে আসার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে ……

নতুন কোনো ড্রেস পড়লে আয়নাকে পরিতৃপ্ত করলেও কলেজে একজনের চশমা পরা চোখের একটা দৃষ্টি র জন্য মনটা আকুল হয়ে থাকে …..

লাইব্রেরিতে ছেলেটির প্রয়োজনীয় জয়দেব সরখেলের ইকোনমিক্স বইটা নিজের কাজ শেষ হওয়ার আগেই দিয়ে দেয় রিনি …পরিবর্তে একটা থাঙ্কস আর সুন্দর মুখটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ..নিজেকে জ্যাকপট উইনার মনে হয় রিনির |

আস্তে আস্তে কলেজ লাইফ শেষের বাজনা বাজতে থাকে ….রিনির মনে বিদায়ের বাজনা ￰দ্রুততর হয়ে ওঠে ….আর…..চোখের দেখাও দেখা হবে না অভিদিপ্তকে, মনের ছায়ায় ছায়ায় গড়িয়ে চলে ওর দীপ্তিহীন চোখের স্বচ্ছ জলধারা |

এরই মধ্যে কলেজের থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টরা বর্ষশেষের রাত্রিটা স্মরণীয় করতে একটা পিকনিকের আয়োজন করলো|

পিকনিকের কয়েক দিন আগে থেকেই রিনি রূপচর্চার ম্যাগাজিন ঘেঁটে ব্যাসন আর হলুদের স্ক্রাবে ডুবিয়ে ফেললো নিজেকে ……যদি নিজের সুন্দর মনটাকে ছাপিয়েও সুন্দরতর ত্বকের মসৃণতায় তার চোখ টানতে পারে ……….

পিকনিকের দিন নিজের সবচেয়ে মহার্ঘ্য পোশাকটা পরে সারাদিন নিজের হৃদপিন্ডটাকে প্রানপনে আগলে রাখছিলো ও , কারণ অভিদীপ্ত আজ সঙ্গে এনেছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ,লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এর মালকিন ব্যবসায়ী কন্যা মোনালিসা কে|সে এই স্টুডেন্ট আয়োজিত পার্টিতে এই ডিসেম্বরের শীতেও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত পোশাকে পার্টি কেকের ওপর চেরি ফলের মতো শোভা পাচ্ছিলো |ওর হাতের দামি ট্যাব , গলার ডায়মন্ড নেকলেসের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিলো রিনির |ওর হাতের নেল পালিশ টার দামও রিনির সবচেয়ে দামি চুড়িদারটার চেয়ে বেশি ….ভাবছিলো রিনি|

তাও রিনির মাথায় যেন হঠাত কি ঘটে গেল , ওই বর্ষশেষের পার্টির আমেজেই হোক , বা অভিদীপ্ত মোনালিসার ঘনিষ্ঠতা দেখে উত্তেজিত হয়েই হোক , হঠাৎ করেই ও অভিদীপ্ত কে বলে উঠলো -আই লাভ ইউ …..

মুহূর্তের জন্য পিন পতনের নিস্তব্ধতা ….

নীরবতা ভাঙলো মোনালিসা অভিদিপ্তর যৌথ হাসির শব্দে ……তাতে যোগ দিলো বাকিরাও …

‘মাঝে মধ্যে দু একটা কাগজ সাপ্লাই দেয় বলে নিজেকে তোর প্রেমিকা ভেবে ফেলেছে রে ‘…..বললো অভিদিপ্তর এক দোস্ত |

‘আরে ও তো প্রায়ই অভির দিকে আড়ে আড়ে
তাকায়.’…..ফুট কাটলো আরেক জন |

রিনি তবুও কোন অসম্ভবের আশায় যখন জলভরা চোখে অভিদিপ্তর দিকে পরম মায়ায় তাকিয়ে ছিল , তখন অভি ওর দিকে এগিয়ে এলো , ঠোঁটে সেই এক চিলতে হাসি ……….

ঝকঝকে দাঁতের ফাঁক দিয়ে কেটে কেটে স্পষ্ট উচ্চারণ করে বললো …….
‘ রিনি , তোর যদি টাকার দরকার ছিল আগেই বলতে পারতি, এভাবে মোনার সামনে পার্টির মুড নষ্ট করার কি ছিলো..এই নে…..যা …তোর সারা বছরের দেওয়া জেরক্সের দাম এর চেয়ে বেশি হবে না ‘বলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো গান্ধীজির অবয়ব আঁকা একটা গোলাপি রঙের নোট…..অট্টহাসির শব্দে কান পাতা দায় হয়ে উঠলো …

করতালির শব্দে ফেটে পড়ছে হল …

আজ আর একটা বর্ষশেষের রাত…..

দেশের সেরা অডিটোরিয়ামে ফিউশন নৃত্য পরিবেশনা করছেনিখ্যাত নৃত্যশিল্পী রিনি সেনগুপ্ত …উপস্হিত আছেন বিনোদন জগতের অনেক নামি শিল্পীরা…. ……..

রিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর , সেই সঙ্গে হায়দ্রাবাদ ডান্স একাডেমির কৃতি ফিউশন ডান্সার …….

আজ ওর প্যাকড প্রোগ্রামে মিডিয়ার ভিড় …

হঠাৎ ওর চোখে পড়ে গেল এক কোণে ওর একটা হাসিমুখের ছবি পাওয়ার আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা চশমা পরা চোখের দিকে ..টিকালো নাক ….ফর্সা রঙটা পালিশের অভাবে মলিন ….

ওরই পুরোনো ব্যাচমেট অভিদীপ্ত বটব্যাল …..ইকোনমিক্সএ কোনোরকমে গ্রাজুয়েশন করে মিডিয়া সাইন্স পড়ে একটা জনৈক কাগজে টেম্পোরারি সাংবাদিক |

যে কিছুদিন আগের মেগা ইভেন্ট বিখ্যাত বিজনেসম্যান এর কন্যা মোনালিসার এক ফুটবলারের সাথে বিয়ের খবরটা কভার করার সুযোগও পায় নি …………

যে অনেক চেষ্টা করেও বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী রিনি সেনগুপ্তর একটা একক সাক্ষ্যাৎকার জোগাড় করে উঠতে পারে নি ….

তার মাইনে এখন হাতে গোনা কয়েকটা গোলাপি গান্ধীজির সমষ্টি মাত্র …….

রিনির সামনে এখন হাজার ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি ……….কালকে নতুন বছরের নতুন সূর্য ওঠার প্রতীক্ষা ………..নিজের সাফল্যের আলোয় দীপ্ত হয়ে ওঠা অদ্বিতীয়া রিনি সেনগুপ্ত |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত