বিশ্বাস

বিশ্বাস

প্রথম যেদিন রাত সাড়ে তিনটায় আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে বলে, গোসল করে আসলাম মাত্রই, সত্যি বলতে তখন আমার সামান্য খটকা লেগেছিলো। এতো রাতে কে গোসল করে? কেন করে? তার পরেরদিন ভোর চারটায় তাকে অনলাইনে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করো?’ সে বললো, ‘গোসল করে এসে বসে বসে চুল শুকাচ্ছি।’ তার পরদিন আবার দেখি ফজরের আজানের আগে অনলাইনে। দেখেই বুঝছি কি কাহিনী। জিগাইছি, ‘আজও গোসল করলা?’ সে লাজুক হাসির ইমো দিয়ে বললো, ‘উহু, এখনো করিনি। যাচ্ছি এখন।’ আমি মনে মনে নিজেকে বুঝালাম, যে গরম পড়তেছে আজকাল। আমারই রাতবেরাতে গোসল করতে ইচ্ছা করে। অথবা হয়তো ওদের বাসায় পানি থাকেনা দিনের বেলা। এজন্য কষ্ট করে এতো গভীর রাতে গোসল করা লাগতেছে। আহারে, বেচারী!

এতো গেল রাতের টেনশন৷ দিনেও আছে। আমার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া গার্লফ্রেন্ড, যে কিনা ড্যাডিস প্রিন্সেস আর মাম্মিস লিটল এঞ্জেল, সে কেন তিনবেলা বাসায় রান্না করে? তাও ভাত, তরকারি, সবজি, ডাল, সবকিছু৷ ডেইলি ডেইলি বলে, ‘বাসায় মেহমান এসেছে আজ অনেক পদ রান্না করতে হবে। তোমার সাথে গল্প করার টাইম নাই।’
রান্না করে মেসেঞ্জারে ছবিও দেয়। দেখেই বোঝা যায় খেতে বেশ হয়েছে। কোনোদিন শুনিনা যে সে কলেজে গেছে বা আজ কোনো ক্লাস অথবা পরীক্ষা আছে। অথচ রান্না প্রতিদিনই করে।  আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনা। পাছে যদি রাগ করে? ভাবে আমি ওকে সন্দেহ করছি। যদি ব্রেকাপ করে দেয়? তারচেয়ে আমি নিজেকে বোঝাই, হয়তো ওর রান্না করতে ভালো লাগে। কুকিং ওর হবি। আমার নিজেরই মাঝে মাঝে রান্না করতে ইচ্ছা হয়, আরো ও তো মেয়ে।

তবে রান্নার মাঝে শুক্রবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে প্রায় সারাদিনই আমাদের কথা হয়। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই তার ফোন অফ হয়ে যায়। ফেসবুকে মেসেজ দিলে বলে এখন কথা বলা প্রবলেম। কাল কথা হবে দিনের বেলা। তারপর আর অনলাইনে পাওয়া যায়না ওকে। আমি কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে যাই। বাথরুমের চাপে রাত তিনটা চারটার দিকে কখনো ঘুম ভাঙলে দেখি সে অনলাইনে। জিজ্ঞেস করি, ‘কি করো?’ আমার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার পড়ুয়া গার্লফ্রেন্ড সেই পুরাতন উত্তরই দেয়, ‘বালতিতে পানি ধরতেছি, গোসল করবো।’ আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করি, ‘খুব গরম, না?’ সে বলে, ‘আরে নাহ, এখানে তো রাতে বৃষ্টি হইলো। ঠান্ডা পড়ে গেছে।’ আমি আবার জিগাই, ‘দিনের বেলা পানি থাকেনা, নাকি?’ সে হাসে, ‘থাকবে না কেন? এটা কি তোমাদের ঢাকা পাইছো? মফস্বলে সারাদিনই পানি থাকে।’ আমি আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পাইনা। হয়তো রাতে গোসল করা ওর শখ। মানুষের কত অদ্ভুত শখই না হয়!

সমস্যা এখানেই শেষ না। ওর বিভিন্ন পোস্টে প্রায়ই একটা মেয়ে কমেন্ট করে, ‘মামী খুব সুন্দর লাগতেছে তোমাকে৷ মামী এই লেখাটা ভালো ছিলো। মামী তোমার সাথে একমত।’ আমার খুব রাগ লাগে। একটা বাচ্চা মেয়েকে আরেকজন মামী কেন ডাকবে? কি সমস্যা?

পরে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই যে, হয়তো ঐ মেয়ে মজা করে মামী ডাকে৷ অথবা তার মামার সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য আমার গার্লফ্রেন্ডকে পছন্দ করে রেখেছে, এজন্য বলে। আমার দুঃখ হয় ঐ মেয়েটার জন্য। যতই পছন্দ করে রাখুক তার মামার জন্য, আমার প্রেমিকা তো আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। ওকে এই পৃথিবীতে একমাত্র আমিই পাবো। আমার বন্ধুরা অবশ্য বলে, খোজ নিয়ে দেখ তোর গার্লফ্রেন্ড বিবাহিত। আমার খুব রাগ হয়। ওরা এতো উল্টাপাল্টা বলতে পারে৷ ইন্টার পড়ুয়া বাচ্চা একটা মেয়ে বিবাহিত কেন হবে?
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, ‘লাস্ট কবে দেখা করেছিস?’

– সে তো এক বছর হয়ে গেলো, আমি জানাই। আমাদের লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ। দুইজন দুই জেলায় থাকি৷ অনেকদিন পর পরই দেখা সাক্ষাৎ হয়।
– দেখ এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে৷ তোরে কিছু বলেনাই৷

আমি বন্ধুদের কথায় কান দেই না। আমার গার্লফ্রেন্ডের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। তবে মনে মনে যে খটকা লাগে না, তা না৷ যথেষ্ট চিন্তা হয়। টেনশনে ঠিকমত খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। সারারাত জেগে থাকি। গভীর রাতে দেখি আমার প্রেমিকা অনলাইনে এক্টিভ নাউ। জিজ্ঞেস করি, ‘কি করো?’ স্মাইলি ইমো পাঠিয়ে আমার প্রেমিকার যথারীতি উত্তর, ‘গোসল করে আসলাম। কাপড় শুকাতে দিচ্ছি।’

আমার মনের মধ্যে আরো সন্দেহ বাসা বাধে৷ বন্ধুরা হাসাহাসি করে। কিন্তু আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনা। যদি রাগ করে? যদি বলে, ‘আমায় বিশ্বাস করো না?’ ভালোবাসায় তো বিশ্বাসটাই সবকিছু।

একসময় আমি আমার বিশ্বাসের ফল পাই। আমার প্রেমিকার রাতে গোসল আর সারাদিনে রান্না বন্ধ হয়ে যায়।
গভীর রাতে যখন জিজ্ঞেস করি, ‘আজ গোসল করবা না?’ ও বলে, ‘উহু, এই সময় এসব করা ঠিক না।’ এসব করা বলতে সে কি বুঝিয়েছে? গোসলই বোঝানোর কথা, আর কি হবে! দুপুরে জিজ্ঞেস করি, ‘রান্না করবা না?’ ও আবারো না বলে। বলে, ‘এই সময় রান্নাঘরে যাওয়া ঠিক না। কাজের লোক রান্না করবে।’

আগে সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে কথা বলত আমার সাথে। এখন আমি কথা বলতে চাইলে বলে, ‘সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে অনেক পরিশ্রম হয়৷ এই সময় পরিশ্রম করা ঠিক না।’

আমি মনে মনে ভেবে বের করি এই সময় বলতে ও নিশ্চয় এই সরকারের শাসনামল বুঝিয়েছে৷ এটাই হবে৷ সময়টাই তো অন্যরকম। সবকিছু চিন্তাভাবনা করে করতে হয়। আগেরমত উল্টাপাল্টা কাজ করা যায় না।

এর বেশ কিছুদিন পর যে মেয়েটা কমেন্টে আমার প্রেমিকাকে মামী ডাকতো একদিন দেখি সেই মেয়ে ওকে ট্যাগ করে পোস্ট দিয়েছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ফুটফুটে একটা মামাতো ভাই হয়েছে আমার। সবাই দোয়া করবেন।’

এক মুহুর্তের জন্য আমার মনে হয় এই বাচ্চা আমার প্রেমিকার। আমার প্রেমিকা বিবাহিত। হার্টবিট মিস হয়। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যায় আমার। মনে হয় আমি ধোকা খেয়েছি।

কিছুক্ষণ পর হঠ্যাৎই আমার মাথায় অন্য একটা চিন্তা আসে৷ মনে পড়ে আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমার পরিচিত একটা ছেলে ছিলো যে তার প্রতিটা পোস্টে আমাকে ট্যাগ করতো। সেটা তার প্রোফাইল পিকচার হোক বা পার্সোনাল কোনো স্ট্যাটাস। সবকিছুতেই আন্দাজে ট্যাগ করে দিত কয়েকজনকে। আমাকেও দিত মাঝে মাঝে। আমার মনে হয় ঐ মেয়েও এরকম কেউ। যেকোনো পোস্টে যাকে ইচ্ছা ট্যাগ করে। এজন্যই তার কোন মামাতো ভাই হয়েছে আর সেখানে আমার প্রেমিকাকে ট্যাগ দিয়েছে।

হঠ্যাৎ করেই বিষয়টা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। খুব ভালো লাগে। এটাই হবে কাহিনী। আর আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে সন্দেহ করতেছিলাম হুদাই। তাও একটা গাধা টাইপ মেয়ের জন্য৷ ধুর। ভাগ্যিস আমার প্রেমিকা কিছু জানতে পারেনি। জানলে খুব রাগ করতো। আমার উচিত ছিলো ওর প্রতি বিশ্বাস রাখা। ভালোবাসায় বিশ্বাসই যে সব।

পরিশিষ্টঃ আমাদের প্রেম বেশ ভালোই চলতেছে। মেয়েটা আসলেই আমাকে ভালোবাসে। আমার নিজেকে ভীষণ হ্যাপি মনে হয়। রাতে ঘুমিয়ে ওকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে সুন্দর স্বপ্নের মাঝখানে ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ি দেখি রাত সাড়ে তিনটা বাজে। আমার প্রেমিকা অনলাইনে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি করো?’
সে অনেক্ষণ পর মেসেজ সীন করে বিরক্ত গলায় বলে, ‘কাথা ধুয়ে দিয়াসলাম।’

যাক, গোসল তো আর করেনাই৷ এতো রাতে কাথা ধোয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। ধুতেই পারে। হয়তো কাথা দিনের বেলা ধুতে বোরিং লাগে। অথবা রাতবেরাতে কাথা ধোয়া ওর শখ৷ মানুষের কত আজব শখ যে হয়! এখন যে আর গোসল করেনা এতেই খুশি আমি। আলহামদুলিল্লাহ ফর এভ্রিথিং!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত