টুনটুনির প্রেম

টুনটুনির প্রেম

এক
জমিদার ঈশা খাঁর প্রাসাদের বাগানে টুনটুনি পাখিদের আড্ডা ছিল। সারাদিনই টুনটুনি পাখিরা এদিক সেদিক নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। বাগানের ছোট্ট ডুমুর গাছটিতে বাসা বেধেছিল মুকুল টোনার বাবা-মা। মুকুল টোনার জোড়া টুনটুনি পাখিটা অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিল। তাই সে ছিল একা। তার চোখ দুটি সব সময় একটা টুনির খোজে এদিক সেদিক চেয়ে দেখত। কিন্তু প্রতিদিনই সে ব্যর্থ হত। এদিকে তার মা-বাবা নতুন একজোড়া ডিম নিয়ে ব্যস্ত, তার দিকে ফিরে তাকাবারও সময় নেই তাদের। সুতরাং তার সময় এসেছে নিজের জীবনটা নিজেই বুঝে নেবার।

প্রতিদিনের মত আজও মুকুল টোনা একটা টুনির খোজে বসেছিল। কিন্তু সেই একই ঘটনা, প্রতিদিনের মত তাকে আজও একাই বসে থাকতে হল। তবে আজ কপাল মন্দ ছিলনা। ডুমুর গাছের নিচে বেগুন গাছে একটা ছোট ঘাস ফড়িং দেখে তার চোখ চক চক করে উঠল। তার খিধেও পেয়েছিল প্রচুর। সাথে সাথে সে পোকা খাওয়ার জন্য নিচে উড়াল দিল। কিন্তু তার ঠোঁটে পোকাটি ধরা দিলেও অন্য একটি পাখির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পরে গেল। কারণ একটা টুনি ঠিক একই ঘাস ফড়িং লক্ষ্য করে অনেকক্ষণ ধরে বেগুন গাছেই বসে ছিল। একই সাথে দুজনে শিকার ধরতে যাওয়ায় ধাক্কা খাওয়া। অন্য দিন মুকুল টোনা এরকম অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেলে ঝগড়া বাধিয়ে দিত, কিন্তু আজ যে কি হল, সে টুনিকে কিছু বলা বাদ দিয়ে তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকল। কিন্তু নীল টুনির মুকুল টোনাকে দেখে অবাক হবার কিছুই ছিলনা। শিকার হাড়িয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বলল, “অ্যাঁই আপনি কেমন টোনা, একটা টুনির খাবার কেড়ে খান”? সুপ্ত টুনির কথায় মুকুল টোনার হুঁশ ফিরে এলো। সে স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে আছার খেল। টুনির কথা শুনে তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সে একবার মনে করল টুনিকে তার শিকার ফিরিয়ে দিবে, কিন্তু কপাল মন্দ খিদের তাড়নায় ততোক্ষণে সেটা কখন যে পেটে চালান হয়ে গেছে তা সে বলতেই পারবেনা। মুকুলের মনটা কেমন ছট্ ফট্ করতে লাগল, টুনির কথা শুনে নয় বরং একটা সুন্দরী টুনিকে বাগে পেয়েও তার মন জোগাতে পারলনা। সুপ্ত টুনি নিজের কথার উত্তর না পেয়ে আরও রেগে গেল, ভাবল এই টোনাটা তাকে অবজ্ঞা করছে। তাই রেগে যেয়ে বলল, “অ্যাঁই আপনি কি আমার কথা শুনতে পান নাই? আমার শিকার খাইয়ে এখন ভান ধরছেন? থামেন আজই আমি কর্তার কাছে বিচার দিতেছি।” মুকুল টোনা কিছু বলতে চাইল কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হলনা। ততোক্ষণে নীল টুনি উড়াল দিয়েছে। তার এলে দুলে যাওয়া দেখে মুকুল টোনা আবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল।

দুই

সকাল বেলায় মুকুল টোনার বাড়িতে কে যেন ডাকা ডাকি শুরু করেছে। সে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে আসতেই শিমুল টোনা তার দিকে এগিয়ে আসে বলল, “এই যে সাহেব, কর্তা আপনাকে বেধে নিয়ে যেতে বলেছে। দিন দুপুরে বেগানা টুনির গায়ে হাত দেন”। মুকুল টোনা এ কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সেই টুনিটা বুঝি সত্যি কর্তার কাছে গিয়ে নালিশ করেছে।
কর্তা ডেকেছে শুনে মুকুল টোনা কর্তার বাড়ির দিকে ছুটল। পেছেনে তিন তিনটে টুনটুনি পাহাড়ায়। সে ভাবল সত্যিই আজ কিছু হতে যাচ্ছে। সেখানে যেয়ে দেখল জামরুল গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটা টুনটুনি বসে আছে।

সেখানে কিছুক্ষণ থেকে সে বুঝল, আসলে কিছুই হয়নি। শিমুল টোনা সুপ্ত টুনির সম্ভাব্য জোড়া, তাই সে গত দিনের ঘটনার এত বড় রটনা করেছে। মামলা গভীর করার জন্য তার এই প্রচেষ্টা। কর্তা তপু টোনা সবার মাঝে চুপচাপ বসে আছে। তাঁর মাথায় অনেক বুদ্ধি, যাকে বলে বুদ্ধির ঢেঁকি। মুকুল টোনা তাঁর কাছে এসে জবুথুবু হয়ে বসতেই সুপ্ত টুনি মুখ ভেংচিয়ে বলে উঠল, “উঁহু সে আইছে, সারাদিন ঘরে ঘুমায়, নিজের খাবার জোগাড় করতে পারেনা আর শুধু অন্যেরটা ছিনায়ে খায়”।

শিমুল টোনা: জী কর্তা, টুনি ঠিক কথাই বলেছে, দিন দুপুরে যার তার গায়ে ছোঁয়ার অভ্যাস তার আগে থেকেই”।
সুপ্ত টুনি: আমারে বললেই হইত, আমি তার জন্য খাবার ছেড়ে দিতাম।
মুকুলের প্রতি সুপ্ত টুনির এমন আকর্ষণ দেখে শিমুল টোনা কথা নিজের দিকে নিয়ে বলল, “কর্তা, টুনিকে অন্যায় ভাবে ছোঁয়ার অপরাধে তার শাস্তি হওয়া দরকার”।
হুজুগে বলাই টোনা বলে উঠল, “ জী কর্তা, সে আমার টুনির দিকেও কেমন করে তাকায়, তাকে দল ছাড়া করে দেন”।
মুকুল টোনা এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও এইবার এর প্রতিবাদে বলল, “কর্তা আমি নির্দোষ, আমি কিছুই দেখে করিনি”।
এতক্ষণ ধরে কর্তা তপু টোনা সকলের কথাই শুনছিলেন। এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। সবাই বুঝল মামলার রায় হতে চলেছে। তপু টোনা চোখ বন্ধ করেই কাব্যিক ভাষায় বলতে লাগল,

“যা হবার হয়েছে
মুকুল না হয় পাপ করেছে।
সে কি টুনটুনির জাত মেরেছে?
অকারণেই গোল বেধেছে”।

সবাই বুঝল এ মামলার রায় হবেনা। কর্তার মন খারাপ কারণ তাদের জমিদারের সাথে ভিনদেশের রাজার যুদ্ধ বেধেছে। তাই আজ সকালে কবি কাক ও ছোটকু কাক এসেছিল যুদ্ধে টুনটুনিদের সাহায্য চাইবার জন্য। কাকেরা অনেকেই যুদ্ধে মারা গেছে কিন্তু টুনটুনিরা নিশ্চিন্তে বসে আছে। কর্তা অপু টোনা সবাইকে ব্যাপারটা খুলে বললেন। তাদেরও কাক পাখিদের সাথে যুদ্ধে যাওয়া দরকার। শিমুল টোনা এতক্ষণ নিজের ভুল বুঝতে পেড়ে পাতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। নতুন একটা কাজ আরম্ভ হবে বলে উৎসাহ নিয়ে সবার মাঝে এসে বসল। ভাবল এইতো সুযোগ সুপ্ত টুনির কাছে নায়ক সাজবার। সে আগ বাড়িয়ে বলল, “টুনটুনি পাখিরা ছোট হলেও দুর্বল নয়, ঝগড়াটে কাকেরা যুদ্ধে যেতে পারলে আমরা কেন পারবনা? আমরাও তাদের মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে জানি তা এবার পাখি সমাজ জানুক”।
হুজুগে বলাই টোনা সাথে সাথেই বলে উঠল, “কর্তা আমি যাব যুদ্ধে”।
সাথে সাথেই সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। হুজুগে বলাই কাক কর্তা তপু কাকের লেখা যুদ্ধের সে রণ সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগল।

“চলরে ও ভাই টুনটুনি,
দেশের জন্য হতে খুনি
বাঁচি কি মরি না-জানি,
নিজেদের জয় হবে জানি।
ওরে ও ভাই টুনটুনি,
জীবনতো হল একটুখানি
মরতে হবে সবাই জানি
মরার মত মরতে পারে কয়জনি।
চলরে ও ভাই টুনটুনি।”

রণ সঙ্গীত শেষ হবার পর তপু টোনা সবাইকে বুঝিয়ে বললেন তারা আকারে ছোট হওয়ায় সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারবেনা। তাই তারা কাকদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। কথা মত অনেক কষ্টে টুনটুনি পাখিরা যুদ্ধের ময়দানে গেল। সেখানে কাকেরা আকারে বড় হওয়ায় কিছুতেই একটা তাবুতে যেতে পারছিলনা। কিন্তু সেখানেই মানসিংহের সেনাপতিরা যুদ্ধ নিয়ে শলা পরামর্শ করত। তাই শিমুল টোনাই এই কাজের জন্য নিযুক্ত হল। যাবার আগে নীল টুনির দিকে আড় চোখে চেয়ে দেখল। তারপর একটা একটা করে গাছ পেরিয়ে তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল। মুকুল টোনা তাঁর পিছু পিছু সংবাদ বাহক হিসেবে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ভেতর থেকে সংবাদ দেওয়া হল। মুকুল টোনা তা নিয়ে আসতে গিয়ে দেখল সৈন্যদের হুলু বেড়াল তাঁকে তাড়া করছে। তাই সে চুপচাপ লুকিয়ে গেল। ততোক্ষণে টুনটুনিরা ভয়ে অস্থির। না জানি মুকুল মারা পরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মুকুলকে ফিরে আসতে দেখে সবার মন থেকে কালো মেঘ সরে গেল। হুলু বিড়ালের সাথে জিতে আসায় সুপ্ত টুনির আনন্দ কে দেখে। যখন সে বুঝতে পারল সে মুকুল টোনার জন্য আনন্দ করছে তখন লজ্জায় একপাশে সরে গেল। কিন্তু বুদ্ধিমান তপু টোনা একেবারেই নিশ্চুপ ছিল। কারণ মুকুল আসলেও শিমুল তখনো আসেনি।

কিছুক্ষণ পরেই সেই হুলু বেড়ালটা মুখ ভর্তি টুনটুনি পাখির পাখা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসল। তারপর কারোই বুঝতে বাকি থাকলনা শিমুলকে এতক্ষণে হুলু বেড়ালটা ছিঁড়ে কলিজা বের করে খেয়ে ফেলেছে। তারপর টুনটুনি পাখিদের অবস্থা এমন হল যেন তাদের মুখের ক্ষণিকের সূর্যের হাসি মেঘের কান্নায় ভেসে গেল।

তিন
পরদিন শীতের সকালের আলো ফুটতেই টুনটুনি পাখিদের নতুন করে জীবন শুরু হল। সুপ্ত টুনি চুপ করে একাকী বসেছিল। মুকুল টোনা তার কাছে এসে বসল। কিছুক্ষণ বসে থাকবার পরেও যখন নীল টুনি কিছুই বলছিলনা তখন সে প্রথম নীরবতা ভাঙলো, “আজ অনেক গরম পরেছে তাই না?”

সুপ্ত টুনি একটু হেসে মুখ ফিরিয়ে নিলো, তারপর বলল, “ইশ্ ঘাস ফড়িংটা কত সুন্দর”। সাথে সাথেই মুকুল টোনা ঘাস ফড়িংটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত