থাপ্পড়

থাপ্পড়

– নি,কি করো?
– ফুটবল খেলি।
– আরে ধুর! খালি ফাইজলামি করো! রান্না করছো আর বলো যে ফুটবল খেলছি!
– দেখতেই তো পাচ্ছো রান্না করছি,তাইলে আবার জিজ্ঞেস কেন করো?
– ওমা! দশটা না, পাঁচটা না,একটা মাত্র বউ আমার, তার খোঁজখবর নিবো না আমি! এইটা কেমন কথা!
– খোঁজ খবর যে নিতে আসোনি, তা আমি ভালো করেই জানি। কি মতলব নিয়ে আসছো বলে তাড়াতাড়ি বিদেয় হও। গরমে রান্নাঘরে কানের কাছে ভ্যাজরভ্যাজর ভাল্লাগেনা।
– কি, আমি শুধু ভ্যাজরভ্যাজর করি?
– অবশ্যই করো। একশো বার করো। তুমি হচ্ছো ভ্যাজরভ্যাজরের রাজা।
– নিজের একমাত্র স্বামীকে এই কথাটা বলতে পারলা তুমি!
-পারছি যে, তাতো নিজের কানেই শুনতে পারছো। আবার শুনতে চাও?

এই বলেই বউয়ের হাতের তরকারির খুন্তিটা উপরে উঠতে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়লাম। বলা যায়না, নীরা যে মানুষের মানুষ তাতে গরম খুন্তি দিয়ে যেকোনো সময় পাছায় ডলা দিতে পারে। এর আগে একবার এই কাজ সে করেছিলো। জিন্সের প্যান্ট পরে থাকায় সেবার রক্ষা পেয়েছিলাম। কিন্তু লুঙ্গি পরে এই দুঃসাহস দেখাতে যাওয়ার কোনো মানে হয়না।

যা বলতে গিয়েছিলাম তাই তো বলা হলো না! মাঝখান থেকে বউয়ের হুমকির মুখে,খুন্তির ভয়ে রান্নাঘর থেকে পিছু হটতে বাধ্য হলাম। নিজেকে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আসা সৈনিকের মতো লাগছে! নীরার স্বভাবটাই এমন।

অনেক দিন আগের কথা,ও তখন রোকেয়া হলের ১১১০ নম্বর রুমে থাকতো। আমি থাকতাম জহুরুল হক হলের ৩৭৫ নম্বর রুমে। দুইজনেই পড়তাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এক সাথে ক্লাস,পরীক্ষার প্রিপারেশন,গ্রুপ স্ট্যাডি এইসব করার কোন ফাঁকে যে মন দেওয়া নেওয়ার কাজটাও করে ফেলেছি তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। বুঝেছি দ্বিতীয় বর্ষে উঠে।

থার্ড সেমিস্টারে মিডটার্মের কিছুদিন আগে ওর পক্স উঠলো। এক দিনের মধ্যে সারা শরীরে গোটাগোটা পানিভরা বিচি উঠে ভরে গেলো। পরদিন সকালে ওর বাবা এসে ওকে নিয়ে গেলো। ওর গ্রামের বাড়ি ছিলো বাগেরহাটে।

বাড়ি যাওয়ার একদিন পর ফোন করে ও চুপ করে ছিলো। এপাশ থেকে আমি হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছি। ও চুপচাপ। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম ওর ফোন থেকে বাড়ির কেউ আবার চেক করে দেখছে না তো! আমি যখন এই সাতপাঁচ ভাবছি তখন হঠাৎ ও বলে উঠলো, “সারা গায়ে পক্স উঠছে। প্রচন্ড ব্যথা! সেই ব্যথাও আমাকে ততটা কষ্ট দিতে পারছেনা যতটা কষ্ট তোকে না দেখতে পেয়ে প্রতিনিয়ত পাচ্ছি! তোর কি এমন হচ্ছে? ” এই বলেই ফোন রেখে দিলো। শেষ দিকের কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে গেলো ওর। আমি ফোন কানে ধরেই ঠায় বসে রইলাম। পারে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটাকে ছাড়া এতো বড়ো একটা জীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। কিছুতেই না।

মিডটার্মের দিন সবাই পরীক্ষা দিলো,আমি দিতে পারলাম না। কিংবা ইচ্ছা করেই দিলাম না। কারণ নীরা তখনও বাড়ি। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। পরীক্ষা ছিলো ১০ টায়। আমি নয়টার দিকে কলম টলম নিয়ে বের হয়ে হল গেট পর্যন্ত যেয়ে কি মনে করে কলাভবন না গিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইর ক্যান্টিনে যেয়ে খিচুড়ি ডিম খেয়ে রুমে এসে ফোন সাইলেন্ট করে ঘুম দিলাম। টাইট ঘুম।

ঘুম ভাংলো মাযহারের ধাক্কাধাক্কিতে। ও পরীক্ষার হলে আমাকে না দেখে অনেকবার ফোন করেছে। আমি ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম,এইজন্য ঠিক পাইনি। ওকে বললাম ঘুমেত্তে উঠতে পারিনিরে! বাদবাকি পরীক্ষাগুলোও দিলাম না। সবাইকে বললাম যেহেতু পুনরায় পরীক্ষা দিতেই হচ্ছে, সুতরাং একটা না দিয়ে বরং সবগুলোই দিবো।

এর দিন পনেরো পরের কথা, নীরা সুস্থ হয়ে হলে ফিরে এসে শুনলো যে আমি পরীক্ষা দেইনি। ও জিজ্ঞেস করলো, কিরে গাধা, পরীক্ষা দিলি না কেন? আমি বললাম, “তুই ছাড়া শুধু পরীক্ষার হল আর ক্যাম্পাসই না,গোটা পৃথিবীটা যে কী বিশ্রী, তা কি তুই জানিস?” আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে। আমি ওর হাতে হাত রাখলাম। ও বললো, “কোনদিন ছেড়ে দিবি না তো এই হাত?” কি যেন ছিলো ওই একটা বাক্যে! লক্ষ্য করলাম আমার চোখেও পানি এসে গেছে! কান্না জিনিসটা আসলেই সংক্রামক কিনা!

তখন আমরা তৃতীয় বর্ষে পড়ি। ২৭ সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিন উপলক্ষে ও আমার পছন্দের সব খাবারগুলা রান্নাবান্না করেছে। টিউশনির টাকা জমিয়ে জমিয়ে ২৫০০ টাকা দিয়ে আমার জন্য একটা আড়ংয়ের পাঞ্জাবি কিনেছে। ও যে টিউশনিটা করতো তার বেতন ছিলো ৩৫০০ টাকা। সুতরাং এতো দামী পাঞ্জাবীটা কিনতে হয়তো অনেকদিন ধরে টাকা জমানো লেগেছে। ও এতকিছু করেছে তা আমি জানতাম না।

সবকিছু ঠিকঠাক করে ও যখন আমাকে ফোন দেয় তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আর জন্মদিনের কথা তো ভুলেই গেছি। ঘুমের মধ্যে ফোনে নাকি ও আমাকে নিচে নামতে বলছে আর আমি নাকি বলছি “নামছি”। আসলে আমি ঘুমের মধ্যে কি বলি না বলি তার ঠিক থাকে না। পাঁচ মিনিট পরে আবার কল দিলে আমি ঘুমের মধ্যেই কল কেটে দিয়ে ফোন অফ করে রাখছি। এই ঘটনা সকাল ১১ টার। বিকেলে ঘুম ভাঙার পর আমার আর এসব মনে নেই। ও আমার হল গেটে এক ঘন্টা খাবার আর পাঞ্জাবি সহ অপেক্ষা করে পরে ওর হলে চলে গেছে। আমি সারাদিন আর কোনো খোঁজখবর নেইনি,নীরাও আর কল দেয়নি রাগে। রাতে শোয়ার আগে একবার ফোন দিলে ও রিসিভ করেনি।

পরদিন ক্লাসে যেয়ে দেখি ও চুপচাপ এক কোনায় বসে আছে। আমি বললাম কিরে, একা-একা বসে আছিস কেন? ও কিছু বললো না। আমি আবার বললাম, কিরে কথা বলছিস না কেন? এবার আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাস করে একটা শব্দ হলো। একটু পারে বুঝলাম ও আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিয়েছে। ভোজবাজির মতোই ঘটনাটা ঘটে গেলো। ক্লাসের সবাই আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

পরে ও আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে রিক্সায় করে চারুকলায় নিয়ে সব খুলে বললো। তখন অবশ্য মাফ চেয়েছিলো। আমি নিজেও লজ্জা পেয়েছিলাম। এই হচ্ছে নীরার স্বভাব। সুতরাং যে মেয়ে ১২০ জনের মধ্যে প্রেমিকের মুখে চড় দিতে পারে, সেই মেয়ে ফাঁকা বাড়িতে জামাইর পাছায় খুন্তির ছ্যাঁকা দিলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ঘড়ি দেখলাম,দুপুর প্রায় একটা বাজে। আজ যেহেতু অফিসে যাইনি, সেহেতু একটা হেবি ঘুম দেওয়া যেতে পারে। শোয়ার ঘরে যেয়ে দেখি ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ওষুধের প্যাকেট। পেস্ক্রিবশনে দেখি পোড়া ক্ষতের ওষুধ আর একটা মলম লেখা। বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো। কার কোথায় পুড়লো? আব্বা মা বাসায় নেই, দুইদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। বাসায় শুধু আমি আর নীরা। আমি দ্রুত রান্নাঘরে গেলাম।

নীরাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘরে পোড়া ক্ষতের ওষুধ কেন? কার কি হয়েছে? ও সেই উত্তরের আশপাশ দিয়ে না গিয়ে তেতো স্বরে বললো হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসো,খাবার দিচ্ছি। আমি কথা না বাড়িয়ে টেবিলে বসতেই দেখি পুড়পুড় করে একের পর এক শুধু আমার পছন্দের সব খাবার আসছে! করলা ভাজি, মুড়িঘণ্ট, বেগুনভাজা, বেগুন ভর্তা,শুটকি ভর্তা, পাবদামাছের ঝোল,দেশি মুরগীর ঝালঝাল তরকারি, গরুর কালাভুনা, দইমিষ্টি সহ আরও কয়েক পদ।

আমি খাবারের দিক থেকে অবাক চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে দেখি ও মিটমিট করে হাসছে। তখন মনে পড়লো যে আজ আমার জন্মদিন। আমি বললাম পা পুড়লো কিভাবে, আগে তাই বলো। না হলে কিন্তু খাবো না। তখন ও বললো, সকালে আমি বাইরে যাওয়ার পর ওর পিরিয়ড শুরু হয়। তখন ও রান্না করছিলো। গরম তেলে ঝাল পেয়াজ ভাঁজার সময় পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলো। ব্যথার চোটে কুকড়ে গেলো। হাতের চামচে নাড়া লেগে কড়াই থেকে গরম তেল এসে পায়ে পড়ে পায়ের পাতার কিছু অংশ পুড়ে গেছে! পরে বাসার নিচে ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ আনিয়ে নিয়েছে। লম্বা ম্যাক্সি পরা থাকায় এতক্ষণ আমি লক্ষ্য করিনি।

এবার যেই আমি পা দেখার জন্য উঠতে গেলাম, ও বাধা দিয়ে বললো,উঠবা না। তুমি চেয়ারের তলায় হাত দাও। আমি হাত দিয়ে দেখি একটা খাম টেপ দিয়ে আটকানো।

খামের মুখ খুলে চিঠিটা বের করলাম। চিঠিটা নীরাই লিখেছে আমাকে।

“আমার ভুলো রাজা, শুভ জন্মদিন। সবকিছু ভুলে যাও ঠিক আছে,তাই বলে নিজের জন্মদিনটাও ভুলে যাবে! কবে দেখা যাবে নিজের বউকেও ভুলে বসে আছো! এরপর যদি আবার ভুলতে দেখি তাইলে আমার সেই থাপ্পড়ের কথা মনে আছেনা?”

চিঠি থেকে চোখ তুলে নীরার দিকে তাকিয়ে দেখি ও মিটমিট করে হাসছে। এরপর ও চেয়ার থেকে নেমে আমার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার গলা পেচিয়ে ধরে আস্তে আস্তে বললো, ” শুভ জন্মদিন সিয়াম।দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো,সেই প্রার্থনা আমি করবো না।” আমার চেয়ে এক ঘন্টা হলেও বেশি বাঁচো,সেই প্রার্থনা করি। কারণ আমার আগে যদি চলে যাও,তাহলে আমি একা হয়ে যাবো। তুমি নেই এমন একটা পৃথিবীতে এক ঘন্টা বেঁচে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত