একটি বৃষ্টি ভেজা রাত

একটি বৃষ্টি ভেজা রাত

বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে দুটো মন ভেসে যাচ্ছে স্মৃতির ভেলায়। এমনই এক বৃষ্টিভেজা রাতে তাদের দুজনের প্রথম আলাপ। পিয়াল টিউশন পড়ে ফিরছিল। হঠাৎ ঘনিয়ে আসে মেঘ। নামে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি। ও দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় একটা বন্ধ দোকানের সেডের নিচে। সেখানে কাকভেজা হয়ে দৌড়ে এসে উপস্থিত হয় রূপ। অফিসের মিটিং কাজের প্রেসারে আজ অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল। তাই অফিসের গাড়িটা না পাওয়ায় ভিড় বাসে করে এই স্টপেজে নেমে রিক্সা করে নেবে ভেবেছিল। কিন্তু বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত সেই উপায়ও নেই। অগত্যা অপেক্ষা করতেই হল। বিদ্যুৎ চমকের আলোতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাজুক মেয়েটির মায়া জড়ানো মুখটি দেখে মোহিত হয় রূপ।

জড়তা কাটিয়ে রূপই প্রথম বলে ওঠে, “কোনদিকে যাবেন?” পিয়াল তখন তার গ্রামের নামটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই রূপের মুখটা খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। “আরে নবপল্লীতে আপনার বাড়ি। আমি তো পাশের পাড়াতেই থাকি। ওখান দিয়ে যাতায়াত করি আপনাকে আগে তো দেখিনি।” পিয়াল হেসে বলে, “আমি আগে মামার বাড়ি থাকতাম। এখন এখানের কলেজে ভর্তি হয়েছি তাই বাড়ি চলে এসেছি।” কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামতে দেখে পিয়াল যখন রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে অগ্রসর হতে যাবে এমন সময়ে রূপ বলে ওঠে, “আমিও তো একই রাস্তায় গিয়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নামব। চলুন এক রিক্সাতেই উঠি। এই দুর্যোগের রাতে চারিদিক কেমন অন্ধকার। আপনাকে একা যেতে হবে না। আমি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।” রূপের এমন আন্তরিক ব্যবহারে পিয়াল আর না করতে পারেনি।

পরেরদিন অফিসে গিয়ে কিছুতেই রূপ মন বসাতে পারছিল না কাজে। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আগেরদিন বৃষ্টিভেজা রাতের সেই মায়া জড়ানো মুখটা। অপরদিকে পিয়ালের মনেও একই অনুভূতি। “ছেলেটা এত উপকার করল তাকে কিন্তু একটিবার ধন্যবাদটুকু দেওয়া হল না। আর একটিবার যদি দেখা হতো!” কিন্তু বিধাতা যে সেই বৃষ্টিভেজা রাতের সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে একটা সেতু গড়তে চাইছেন তা তো তাদের জানা ছিল না। হঠাৎ পিয়াল কলেজ ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখে রূপ দাঁড়িয়ে। দুজন দুজনকে দেখে এক সঙ্গে বলে ওঠে, “আরে আপনি!” তারপর দুজনেই হেসে ফেলে। রূপ জানায় আজ তার তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে তাই সে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিতে যাবে। পিয়াল জানায় তার রোজ এই সময়েই কলেজ ছুটি হয়। যেহেতু দুজনের গন্তব্যস্থল একই দিকে তাই দুজনে একসাথে একই বাসে ওঠে। ভাগ্যক্রমে পাশাপাশি সিটও জুটে যায়। শুরু হয় একে অপরের পরিচয় পর্ব। রূপ যেহেতু তিন চার বছরের সিনিয়র তাই রূপই প্রথম পিয়ালকে তুমি সম্বোধন করে। রূপ পিয়ালকে বলে যাতে ওকেও তুমি করেই ডাকে পিয়াল। দুজনের মধ্যে হঠাৎ-ই বন্ধুত্বের বীজ বপন হয়।

রূপ আর পিয়ালের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। পিয়ালের কলেজ কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথেই রূপ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। উভয়ের বাড়ির সম্মতিতে দুটি হৃদয় পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়। ভালোবাসার স্রোতে ভাসতে থাকে দুটো মন। যেন এক স্বর্গীয় সুখ এসে ওদের হাতের মুঠোতে ধরা দিয়েছে। ভালোলাগার আবেশে কেটে যায় ছ’টা মাস। কিন্তু সুখের বুদবুদ যে অতি ক্ষণস্থায়ী তা দ্রুতই বোঝা যায়। রূপের অফিসে জয়েন করা অল্প বয়সী কলিগের সঙ্গে বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। রূপের কাজের চাপ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। সাথে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে পরস্পরের কথোপকথন। ছুটির দিন গুলো ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতেই কেটে যায় রূপের। তখনই পিয়াল তুলনা টানে প্রেমিক রূপের সাথে উদাসীন স্বামী রূপের। দুটি চরিত্রের অদ্ভুত বৈপরীত্য পিয়ালের হৃদয়কে ভারাতুর করে তোলে।

আর অপরদিকে বারে বারে প্রেমিক রূপের সাথে স্বামী রূপের তুলনা করাটা বিরক্তিকর লাগে রূপের কাছে। ও কিছুতেই ওর প্রাইভেট কোম্পানির কাজের চাপের কথা বাস্তবতার কথা বুঝিয়ে বলে উঠতে পারে না পিয়ালকে। আর দিনের পর দিন অভিমানের পরত জমতে জমতে পিয়ালের মন নদীতে চরা পড়ে যায়। অপেক্ষায় থাকে কখন অভিমানের বেড়া ভেঙে ভালোবাসার স্পর্শে রূপ তার বুকে টেনে নেবে পিয়ালকে। দুজনের অলক্ষ্যেই ইগো নামক দস্যুটি ধীরে ধীরে দুজনের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। একদিন রূপের কলিগ কাম বান্ধবীর সাথে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলা নিয়ে দুজনের মধ্যে চরম অশান্তি হয়। রূপও রাগের মাথায় সেই বান্ধবীর সাথে পিয়ালের তুলনা টানে। ব্যাস সেই থেকে শুরু হয় সম্পর্কের চিড়। প্রায় প্রতিদিনের ভুল বোঝাবুঝি থেকে দুজনের স্বাভাবিক জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। শেষে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় মিউচুয়াল সেপারেশনের।

আজ এক বাড়িতে এক বিছানায় দুজনের শেষ রাত। কাল একটা সই শেষ করে দেবে তিল তিল করে গড়ে তোলা একটা সম্পর্ক। হাজারো ভুল বোঝাবুঝি ঝামেলা অশান্তির মাঝেও কেউ কাউকে ছেড়ে দূরে থাকেনি। কাল থেকে প্রথম দুজনের ঠিকানা আলাদা হবে। এটা দুজনের কেউই মেনে নিতে পারছে না। কত কথা এসে মনের পারে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু মুখ ফুটে আর কেউ বলে উঠতে পারছে না। বার বার দুজনেই ফিরে যাচ্ছে পুরোনো দিনে। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে উভয়ের। দুই দিকে পাশ ফিরে শুয়ে দুটো মন চাইছে পুনরায় ভেসে যেতে ভালোবাসার স্রোতে। সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে হঠাৎ রূপ পিয়ালকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে বলে ওঠে, “এমন একটা বৃষ্টিভেজা রাত কি আমাদের জীবনে আবার ফিরে আসতে পারে না!” অভিমানের বরফ গলতে শুরু করে। অশ্রু বিগলিত আঁখিতে পিয়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে রূপের বুকে। বাইরে একটা বৃষ্টিভেজা রাত আবার সাক্ষী থাকে ভালোবাসার একটি মধুর যাপনের মুহূর্তের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত