তাহাদের সংসার

তাহাদের সংসার

পাম্পটা ঠিক ছিল জানা গেল নতুন পাম্প নিয়ে আসার পর। পাম্পে জল উঠছিল না। প্লাম্বার মিস্ত্রি বিজয় এল ঠিক সন্ধেবেলায়। সারাদিন বালতি বালতি জল বয়েছে কত্তা গিন্নি। কত্তার চেয়ে গিন্নি বেশি। কত্তা শুধু টিভির টক শো দ্যাখেন। খেলা দ্যাখেন। তার ফাঁকে, বিজ্ঞাপনের বিরতি কালে কিংবা এক ইনিংস শেষ হয়ে অন্য ইনিংস আরম্ভ হওয়ার মধ্যবর্তীকালীন সময়ে এক বালতি, দুই বালতি। এ বাড়ির রিজারভার বলতে বড় চৌবাচ্চা। সেখেন থেকে পাম্পে জল ওঠে ট্যাঙ্কে। তারপর সেই জল আসে গিজারে, কমোডের সিস্টারনে, শাওয়ারে, বেসিনে। চৌবাচ্চা থেকে জল তুলে তুলে গিন্নি হয়রান। কত্তাও। প্লাম্বার মিস্ত্রি এসে বলল, পাইপে হাওয়া ঢুকে গেছে।

হাওয়া বের করে জল ভরে দাও। কত্তা অখিলেশ বললেন। তখন পনের বছর আগের ন্যাট ওয়েস্ট ট্রফিতে সৌরভ জামা খুলছে। তিনি পুরোন খেলাও দ্যাখেন। স্মৃতি সততই সুখের। কত্তা গিন্নির দুই টিভি। একটাতে লীলাবতীর সংসার, অন্যটাতে খেলা কিংবা টক শো, বেকায়দা কোঁদল…রেপড হয়েছে ইস্কুলের মেয়ে, কেন আগে কি রেপ মার্ডার হত না? জঙ্গিরা হামলা করেই যাচ্ছে, তাই নিয়ে প্রাক্তন পুলিশ আর সেনা অফিসাররা গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করছেন। সব শোনেন আর দ্যাখেন অখিলেশ। দেখা ছাড়া আর কাজ কী? মত আছে সমস্ত বিষয়ে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না। তিনি ফেসবুক-ট্যুইটার বোঝেন । বেশ লাগে ইন্টারনেট। কিন্তু স্ট্যাটাস লিখতে গেলে ভাবেন কী লিখবেন? যদি কারোর কারোর বিরদ্ধে যায় তা, কী ঝামেলা লাগবে যে। তাই সব স্ট্যাটাসে লাইক মেরেই চুপ করে যান। আর দ্যাখেন কম বয়সী মেয়েদের ছবি। কিন্তু তা গিন্নিকে লুকিয়ে। এ বাদ দিয়ে টিভিই ভরসা। ফোন-ইন প্রোগ্রামে ফোন লাগাতে চেষ্টা করেন, হয় না।

তিনি দু বছর হলো সিক্সটি প্লাস। সিনিয়র সিটিজেন। পেনশন এবং সুদে সংসার চলে। রেলের টিকিটে ৪০ পারসেন্ট ছাড়। বাসে দুটো সিট নিয়ে কমবুড়ো-বেশিবুড়োয় ক্যাঁচাল হয়। তিনি বাসে ওঠেন কম। ওলা কিংবা উবের ডেকে নেন। মোবাইল ফোনেও ইন্টারনেট আছে। হোয়াটস অ্যাপ। ফেসবুক। ইউ টিউব। আর গাড়ি ডাকার অ্যাপস। ছেলে তার বউ নিয়ে পাশের পাড়ায় আস্তানা গেড়েছে। এই ফ্ল্যাট তিন ঘরের। কিন্তু তাদের প্রাইভেসি থাকছিল না। অথচ দুজনেই সারভিস করে। সারাদিন বাড়ির বাইরে। সন্তান আছে একটি। তার জন্য সারাক্ষণের এক মাঝবয়সী বিধবা আছে। আসলে বুড়ো বুড়ি না পছন্দ ছেলের বউয়ের। তাতে অসুবিধে নেই। তাঁরাও স্বাধীন। অন্ধকার মুখ দেখতে হয় না।

প্লাম্বার মিস্ত্রি রোগা, চিমটে মারা রবারের পাইপ যেমন হয়। একাজে তার খুব দক্ষতা। এক ঘণ্টায় ফিনিশ করে জল তুলে দেখিয়ে দিল। কী ভাবে হাওয়া বের করতে হয় আর কী ভাবে জল ভরতে হয় দেখতে দেখতেও দেখলেন না কত্তা। তিনি দেখে কী করবেন? নিজে তো আর সারাই করবেন না পরের বারে। এই মিস্ত্রিকেই ডাকতে হবে আবার।

জল উঠতে লাগল। কিন্তু একদিন বাদে আবার পাম্প ঘড়ঘড় করতে লাগল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। হিসহিস করতে লাগল। আবার এল বিজয়। আবার হাওয়া বের করে জল ভরে দিল পাইপে। আড়াইশো টাকা তার ভিজিট।

আবার দু’দিন বাদে পাম্প চলতে লাগল কিন্তু জল স্থির। গিন্নি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, দ্যাখো, জল টানছে, কিন্তু জল উঠছে না কেন?

প্লাম্বার বিজয়ের এবার লজ্জা হলো, ফোনেই বলল, জল উঠছে না মানে হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে, আপনি পাম্পটা একবার বাঁকাকে দেখিয়ে নিন, পাম্প পুরোন হয়েছে তো।

বাঁকা এ তল্লাটের সেরা ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। বেঁটে, কৃষ্ণকায়, গোলগাল কিন্তু খুব গম্ভীর। তাকে তিনবার ফোন করে একবার পাওয়া গেল। দুবার ফোন বাজল, কিন্তু ধরল না। এইটা তার অভ্যেস। আর যেদিন বলবে, সেদিন আসবে না, পরের দিন কি তার পরের দিন আবার ফোন পেলে আসবে। এসে পাম্প দেখল। এটা ওটা খুলল। পাইপে জল ভরে দিল। জল তুলে দিল। গিন্নি মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, আবার বিকল হবে না তো ?

গম্ভীর বাঁকা বলল, ঠিকই তো আছে, দেখুন।

জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। তিনদিনের মাথায় আবার সেই অবস্থা। টিভির সিরিয়াল, খেলা, হত্যা, রেপ, রাজনৈতিক কোঁদল, সব গেল। ইন্টারনেট বন্ধ। ফেসবুকের ঝড় তাঁর অপ্রত্যক্ষ রয়ে গেল। টিভি ধারাবাহিক লীলাবতীর সংসারেও এমন হয়নি। ছেলেটা বাড়ি থেকে বউ নিয়ে চলে গিয়েও ফিরে এল, ছেলের বউ জিনস ছেড়ে শাড়ি গয়না পরে এসে লীলাবতীর পায়ের ধুলো নিল। লীলাবতী তাকে চুমু খেয়ে বলল, সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক। অনেক গোলমালের পর মেয়ের বিয়ে হলো ধুমধাম করে, রূপবান জামাই হলো, কী গরম কী শীত স্যুট বুট পরেই থাকে। সব মেয়েগুলো, আইবুড়ো আর বিয়ে হওয়া মেয়ে, কাজের বউ আর বসের বউ, সকলেই কত সুন্দর শাড়ি পরে গয়না পরে, জিনস পরে টপ পরে। লীলাবতীর সংসারে কোনোদিন জলের পাম্প খারাপ হয় না। এই সংসারে প্লাম্বার বিজয় টাকা নিয়ে গিয়ে নতুন পাম্প কিনে আনল। সেই পাম্প ফিট করে পুরোন পাম্প প্যাক করে রেখে গেল। ২০০ টাকা দর দিয়ে গেল। খারাপ পাম্প লোহা লক্কড় হয়ে গেছে। কী হবে রেখে, কিন্তু কী মনে হতে গিন্নি রেখে দিল। গিন্নি কিছুই ফেলতে চায় না। সংসার তো তারই গড়া। হায় হায়, তারপরের দিনই জল আবার স্থির। পাম্প চলছে। নতুন পাম্প, তবু টানতে পারছে না জল। বিজয় আবার এল। এটা ওটা দেখে, পাইপের হাওয়া বের করে জল ভরে পাম্প চালিয়ে জল তুলতে তুলতে বলল, আসলে বেশি সময় একনাগাড়ে পাম্প চালিয়ে এই হচ্ছে। জল ফুরিয়ে দিলে তো পাইপে হাওয়া ঢুকে যাবেই। অর্ধেকের বেশি খালি করবেন না জল। সেইটা করছেন, তাই এমন হচ্ছে। সব ঠিক আছে। আগের পাম্পও।

আগে বলনি কেন, চার হাজার গেল পাম্পে, ফালতু গেল? অখিলেশ রেগে গেলেন।

বিজয় বলে, জানতাম না তো পাম্প চালিয়ে দিয়ে আপনারা টিভি দ্যাখেন।

হুঁ, তাতে হয়েছে কী, সবাই করে। গিন্নি মল্লিকা বললেন দাপুটে গলায়, তুমি সিরিয়াল দ্যাখো না, লীলাবতীর সংসার?

বিজয় মিনমিনে গলায় বলল, দেখি তো, কিন্তু আপনি ওই সময়ে পাম্প চালিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন যে, পুরোন পাম্পটা রেখে দিন, খারাপ হয়নি।

রেখে কী করব? অখিলেশ জিজ্ঞেস করলেন।

বিজয় বলল, তাহলে দিয়ে দিন স্যার, আমি দেখছি কী করা যায়, পাম্প রেখে দিলে নষ্ট হয়ে যাবে আপনা আপনি।

লীলাবতীর সংসারে নতুন সমস্যা এসে হাজির হয়েছে। মেয়ের শাশুড়ি খুব দজ্জাল। চোখ রাঙিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারেন না। তাই নিয়ে সুন্দরী মেয়ে স্বামীকে বলছে, নতুন ফ্ল্যাট দেখতে। ছেলে আবার মায়ের খুব ন্যাওটা। উফ, দারুণ হচ্ছে ধারাবাহিক। একেবারে সব সংসারের গল্প। ঠিক এর ভিতরেই এই সংসারে মাইক্রোওভেন বিকল হলো। লীলাবতীর সংসারে এমন হয় না। টেলিফোন খারাপও হয় না। ওদের ইলেক্ট্রিক বিল বেশি ওঠে না, তাই নিয়ে তাই সমস্যা হয় না। কিন্তু মাইক্রোওভেন ছাড়া মল্লিকা গিন্নির চলে না। কত্তা ফোনে ডেকে পাঠালেন সাতগাছির মুন্নাকে। সে ওয়ারান্টি পার করা মাইক্রোওভেন, ওয়াশিং মেশিন সারায়। দুদিন বাদে তার টাইম হলো। দেখে শুনে বলল, মেগাটোন গেছে, ১৫০০ টাকা লাগবে।

নতুনের দাম কত?

দশ বারো হাজার হবে, এক এক কোম্পানির এক এক দাম।

তাহলে মেগাটোন নিয়ে এস।

আনব স্যার, দুশো টাকা দিন। মুন্না হেসে তার মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিতে লাগল তাঁদের মাইক্রোওভেনের মেগাটোনের। মেগাটোন দিয়েই অপারেট করা হয় চৌকোনো বাক্সটিকে। তার ভিতরে কেক তৈরি হয়, খাবার গরম হয়। মেশিন বাক্সটি ঘুমিয়ে আছে। মুন্না ছবি নিয়ে চলে গেল। দিন সাত বাদে একদিন এসে নতুন মেগাটোন ফিট করে মেশিন চালাতে গিয়ে দ্যাখে ঘুম তার ভাঙল না। ইসস! আপনার মেশিনটাই গেছে স্যার, নতুনই কিনতে হবে।

আগে বলতে পারতে। কত্তা রেগে গেছেন, কিন্তু রাগ প্রকাশও করতে পারছেন না। মুন্না তার ওয়াশিং মেশিন সারাবে তো ক’দিন বাদে এসে। খারাপ তো হবেই। মুন্না, বিজয়, বাঁকার আসা-যাওয়া লেগেই আছে। তিনি তবু বললেন, তুমি বুঝতে পারলে না, দেড় হাজার টাকা জলে গেল!

কিন্তু এটা না করলে তো ধরাই যেত না মেশিনটা খারাপ হয়েছে না ভাল আছে। বলে মুন্না তার ব্যাগ গুছোতে লাগল।

গুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কত্তা। গালে চড় মেরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে মুন্না। তখন মুন্না হেসে বলল, আচ্ছা, আমি ওটা খুলে নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সিল ভাঙা হয়েছে তো, অর্ধেক দামে নিয়ে যাবো, সাড়ে সাতশো দিন, পুরোনটাই লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।

এর চেয়ে সুবিধে আর কিসে হতে পারে? সাড়ে সাতশো তো লাভ হলো। কত্তা পরের দিন গেলেন মাইক্রোওভেন কিনতে। ধনতেরাসের বাজার শুরু হয়ে গেছে। সোনা চাঁদি থেকে বাসনকোসন, মেশিনপত্তর কেনার প্রকৃষ্ট সময় এইটা। কেনাও হবে পুণ্য অর্জনও হবে। কিছু ছাড় হবে হয় তো।

ক্যালকুলেটরে আঙুল চালাতে চালাতে পান পরাগ গালে কপালে গেরুয়া সিঁদুর সেলসম্যান বলতে লাগল, ইয়েস স্যার আসল দাম চোদ্দ হাজার সাতশো, এখন ধনতেরাসের দাম টেন পয়েন্ট টু থ্রি পারসেন্ট ছাড় দিয়ে তের হাজার দুশো, দুশো ছাড় দিয়ে থারটিন থাউজান্ড। এত সুবিধে কে দেবে? পুরোন খারাপটার জন্য আরো পানশো বাদ। সাড়ে বারোতে হয়ে যাবে। কত্তা ট্যাক্সিতে ডবল ভাড়া দিয়ে ধনতেরাসে অর্জন করা সামগ্রী ঘরে নিয়ে এলেন। পুরোনটা নিয়ে গেল সঙ্গে আসা দোকানের কর্মচারী…উলু উলু উলু…টিভিতে লীলাবতীর সংসারে উলুধ্বনি। গিন্নি বললেন, মেয়ের ননদ প্রেম করে, তাকে ধনতেরাসে জড়োয়া হার দিল লাভার, কতখানি সোনা গো, সে বিলেতে থাকে, আর মেয়ে তার বরকে নিয়ে আইসল্যান্ড উড়ে যাচ্ছে, বর ওইদেশে চাকরি পেয়েছে, হ্যাঁ গো আইসল্যান্ড কোথায়, খুব শীত?

হ্যাঁ, খুব শীত। অখিলেশ বললেন।

তাহলে অত দামি দামি শাড়ি পরবে কী করে?

ঘরে পরবে, ফায়ার প্লেস বা রুম হিটার তো থাকবেই। অখিলেশ বললেন।

বাহ! গিন্নি খুব খুশি। ধনতেরাসের কেনা-কাটা তো হলো। এই মাইক্রোওভেন আরো ভালো। পাশের ফ্ল্যাটের টুবলুকে ডাকল গিন্নি। সে শক্তপোক্ত যুবক। সে পারবে ফিট করে দিতে। টুবলু এসে মেশিনকে তার সিংহাসনে তুলল। গিন্নি উলু দিলেন। সিঁদুরের ফোটা দিলেন। প্লাগ লাগিয়ে সুইচ দিল টুবলু। মেশিনে আলো জ্বলল না। টুবলু এদিক ওদিক করতে করতে বলল, ও মেসোমশায়, আপনার লাইন তো খারাপ হয়ে আছে, দাঁড়ান আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে আসি।

কত্তা গিন্নি পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে। লাইন খারাপ তাই চলছে না নতুন মেশিনও। টুবলু ফিরে এল টেস্টার, রেঞ্জ আর একটু তারের মুখে বালব নিয়ে। প্লাগ পয়েন্টে তারের মুখ ঢুকিয়ে দেখাল বালব জ্বলছে না। টেস্টার দিয়েও দেখিয়ে দিল। তারপর প্লাগের বোর্ড খুলে তারে তারে জুড়ে লাইন চালু করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, নতুন কিনলেন, আগেরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল?

কত্তা শুনলেন লীলাবতীর সংসারে ডায়ালগ হচ্ছে খুব। কত্তা বললেন, ওই শোনো।

লাইন খারাপ বোঝেননি ?

কত্তা না পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন, লীলাবতীর সংসার তো, এমনি হয়, তোমার কথা আগে মনে পড়ল না।

গিন্নি বললেন, হুঁ, লীলাবতীর সংসার তো। আসলে তো কত্তা গিন্নির সংসার। কতদিন আর টানবে তারা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত