প্রতিবেশী

প্রতিবেশী

গতবছরের শেষের দিকেই জেনেছিলাম এ বছর সামনের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া উঠবে। কিন্তু জানতাম না সেই ভাড়াটিয়ার এত সুদর্শন,রাজপুত্রের মতো একটা ছেলে থাকবে। প্রথমদিন ছেলেটাকে দেখেই আমার মনে হলো,এই ছেলে এদেশের ছেলে হতেই পারে না। নিশ্চয়ই কোনো দেশের রাজার ছেলেকে এরা চুরি করে নিয়ে এসেছে।
প্রথমদিন বাড়ির মালপত্র ওঠানোর তদারকিতে ব্যস্ত ছিলো ছেলেটা,আমি তখন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি।

ছেলেটাকে দেখে মাথা ঘুরে পড়তে গিয়েও অনেক কষ্টে তাল সামলালাম। তারপর বাড়ি ফিরে ভাবতে শুরু করলাম, জীবনে কি কি পুন্য করেছি…যার ফলস্বরূপ পাশের বাসায় এতো সুন্দর একটা ছেলে এসে উঠছে? তারপর থেকে মাথার ভেতর একটাই হিন্দি গান বাজে, ‘মেরে সামনে ওয়ালে খিড়কি ম্যে,এক চান্দকা টুকরা রেহতা হ্যায়।’
সামনের বাসাটা আমাদের বাসা থেকে বেশী দূরে নয়। দুইটা বাসার মধ্যে দশ থেকে পনের কদম পায়ে চলা পথ। ছেলেটার ঘরটাও এমন জায়গায় যে আমার জানালায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে দূরবীন দিয়ে একটু চেষ্টা করলেই দেখা যায়। বেশীরভাগ সময় সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। আমি সবসময় একটা দূরবীন তাক করে তার দিকে লক্ষ্য রাখি।

ছেলেটার সাথে এ পর্যন্ত আমার কখনো সরাসরি কথা বা দেখা হয়নি। সে এখনো আমাকে দেখেনি।আমিও সেই প্রথমদিনই তাকে একবার দেখেছিলাম সামনে থেকে,সে আমাকে খেয়াল করেনি। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ভালোভাবে হলো না। সে একটা সাইকেল নিয়ে বাড়ির পেছনদিকের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। আমি তখনই কি মনে করে ঐদিকে গিয়েছি। তার আগের রাতেই বৃষ্টি হয়েছে, পিচ্ছিল মাঠে আমি আছাড় খেয়ে পড়লাম। ছেলেটা দৌড়ে এসে আমাকে টেনে তুলল। লজ্জার সীমা রইলো না আমার।

এরপর আরেকদিন আমি মুখে ফেসপ্যাক মেখে ছাদে বসে আছি এমনসময় সেই ছেলেটা তার মায়ের সাথে আমাদের ছাদে এলো। আমাকে দেখে তারা দুজনই আঁতকে উঠলো,আর তাদের দেখে আমি। নিজেকে সামলে নিয়ে তার মা বললেন, আজ আমাদের অনেক কাপড় কাচা হয়েছে তো, সব আমাদের ছাদে ধরলো না,তাই তোমাদের ছাদে নেড়ে দিতে এলাম সেই সময়ই নিচের থেকে আমার ছোটভাই চিৎকার করে বলে উঠলো, আপু! তোর না আজকে ফ্যান পরিস্কার করার কথা? ময়লার চোটে তোর ফ্যান ঘোরা বন্ধ করে দিয়েছে, এত পিচাশ কেন তুই? লজ্জায় আমার ইচ্ছে করছিলো সেখানেই উনিশ/বিশ কিছু একটা খেয়ে মরে যাই। অনেক কষ্টে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে এলাম।

বিকালে ছেলেটা নিশ্চয়ই ছাদের কাপড়গুলো তুলতে আসবে! অনেক চিন্তাভাবনা করে আমি আকাশী রঙের একটা সুতি শাড়ি পরলাম। সুন্দর করে সাজালাম। তারপর ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।আজ দূরবীন আনিনি। আমার আর তার মধ্যকার দূরত্ব আজ দূরবীন মেটাবে না,সে নিজেই ছাদে আসবে।

ছাদে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেন জানি সেই শব্দে কোনো কোমলতা নেই। এত সুন্দর একটা ছেলের পদধ্বনি ছন্দময় হওয়া দরকার ছিলো তাকিয়ে দেখি চায়নিজ টাইপের নাকবোঁচা,চোখ গর্তে ঢুকানো একটা ছেলে ছাদে এসে উঠলো। তার সাথে আমার নায়কের মা। চায়নিজটা আমাকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই মুগ্ধ দৃষ্টি কি আমি চেয়েছিলাম!? নায়কের মা পরিচয় করিয়ে দিলেন, এই হচ্ছে আমার বড় ছেলে।এবার মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ার দেবে। খুব ভালো ছাত্র।

মনে মনে মুখ ঝামটা দিয়ে আমি বললাম,তা আমি কি করবো? আমি কি করবো? হাজারহোক হবু শ্বাশুড়ি, তাদেরকে আমি কাপড় তুলতে সাহায্য করলাম। নায়কের শার্ট, টিশার্টগুলো গভীর যত্নে তুলে দিলাম তার মায়ের হাতে। এ ঘটনার কয়েকসপ্তাহ পর নায়কের মা তার দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। যথারীতি প্রতিবার যা হয় তাই হলো।

আমি তখন কেবল ঘুম থেকে উঠেছি। এলোমেলো অগোছালো ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে নায়কের সামনে পড়লাম। আজ পর্যন্ত সে আমার কোনো ভালো রুপ দেখেনি, একবার কাদামাটিতে মাখামাখি অবস্থায়, একবার ফেসপ্যাক মাখা অবস্থায় আর আজ ঘুম থেকে সদ্য ওঠা ফোলা ফোলা চোখমুখে… আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন?
নানান কথার পর নায়কের মা আমার আব্বুকে বললেন, আপনার মেয়েকে আমাদের পছন্দ, আমার ছেলের জন্য….
খুশীতে আমার মনের ভেতর তখন লাড্ডু ফুটছে। ইচ্ছা করছে স্পিকারে ফুল ভলিউমে একটা হিন্দি গান ছেড়ে দিয়ে নাচতে শুরু করি।

ভাবী আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন শাড়ি পরে সাজিয়ে দিতে। সাজতে সাজতেও আমি খুশীতে মুখে দুই হাত দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি। ভাবী বিরক্তমুখে বলছেন,বিয়ের কথা উঠলে এত লাফাইতে আছে? লজ্জা পাইতে হয়!
ধূরো,লজ্জা! আমার এত ভালো লাগছে,এত ভালো লাগছে, এত ভালো লাগছে!!!! সাজিয়ে দিয়ে ভাবী বললেন, ছাদে চলে যাও। শান্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করছে! আমি নাচতে নাচতে ছাদে উঠে গিয়েই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। অপেক্ষা করছে নাকচ্যাপ্টা চায়নিজটা! তাইলে কি আন্টি এই ছেলের সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছেন?

আমার হাজারো আপত্তি, কান্নাকাটি সত্ত্বেও চায়নিজটার সাথে আমার বিয়ে পাকা হয়ে গেছে।আমার নায়ক,যার আসল নাম তন্ময় সে এখনি আমাকে ভাবী ভাবী বলে ডাকা শুরু করেছে। প্রায়ই সে আমাদের বাড়ি আসে, ভাবী ভাবী বলে ঘরে ঢোকে। তার ভাইয়ের বিয়ের পরে তার পালা এটা ইশারা ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়ে গল্প করে তার কেমন মেয়ে পছন্দ।

আমার নিজেকে বাহুবলীর আনুশকার মতো লাগে। এক ভাইকে চাইলাম,অন্য ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। যদি প্রথমদিন কাদামাটি আর ফেসপ্যাকের আস্তরনসমেত তার সামনে না পড়ে সুন্দর একটা শাড়ি পরা অবস্থায় পড়তাম তাইলে আজ হয়ত বিয়েটা তন্ময়ের সাথেই হতো আমার।

আমি ঠিক করে রেখেছি এ জীবন রাখবো না। একটা চিঠিতে মনের কথা সব লিখে রেখে আমি ঘুমের ওষুধ খাবো। যদি মরে যাই গেলাম, বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমার বিয়ে তন্ময়ের সাথেই হবে। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে,একটা কৌটায় ত্রিশটা ঘুমের ওষুধ জমিয়েছি। মরার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন এরমধ্যেই তন্ময় সব জেনে গেল। আমি তাকে পছন্দ করি,তার ভাইকে না। দূরবীন দিয়ে আমি তার দিকে লক্ষ্য রাখতাম ইত্যাদি সব ঘটনা জেনে গেল। কিভাবে!?

আমাদের দুই বাড়ির মাঝখানে পাশে আরেকটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে সুমাইয়া নামে ক্লাস সেভেনে পড়া একটা মেয়ে আছে। আমি যেমন তন্ময়ের দিকে লক্ষ্য রাখতাম,সে লক্ষ্য রাখত আমার কর্মকান্ডের দিকে। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমি ছাদে বসে কাঁদতাম তাও সে লক্ষ্য করেছে। তারপর তন্ময়কে সব খুলে বলেছে। তন্ময় আমাদের বাড়িতে এসেছে। “ভাবীর সাথে একটু আলাদা করে কথা বলব” বলে আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে এসেছে।

তন্ময় সব জেনে গেছে শুনে আমি ছলছল চোখে ওর হাত ধরে বললাম,চলো পালিয়ে যাই। তন্ময় আঁতকে উঠে বললো, আপনার কি মাথা খারাপ হইছে ভাবী? আমি আপনাকে আমার বড়বোনের মতো দেখি। আমার বোন নাই,আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে আমার ভাবীই হবে আমার বোন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম তন্ময়ের গালে। বললাম, আমাকে ভাবীর চোখে দেখতে তোমার লজ্জা করে না? কোন সাহসে আমাকে বোনের চোখে দেখলা তুমি? মা-বাবাকে বলে একটা বোন দত্তক নাও,তাও দয়া করে আমাকে বোন ডাকবা না। আর শোনো, তোমার ভাইকে আমি বিয়ে করবো না।

-দেখেন ভাবী… ইয়ে মানে, লাবণ্য! আমাদের পরিবারের একটা মান ইজ্জত আছে, আপনাদেরও আছে। এখন বিয়ে ভেঙে গেলে কি অবস্থা হবে আপনি ভাবতে পারছেন? প্লিজ আমি আপনার পায়ে পড়ি না,না,না, পায়ে পড়ে কোনো লাভ হবে না। আমিতো দুই ফ্যামিলির ইজ্জতের কথা চিন্তা করেই বলছি, তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলে দুই ফ্যামিলির ইজ্জত রক্ষা হবে।

-ছিঃ ছিঃ, ছিঃ ছিঃ!!

ছিঃ ছিঃ করতে করতে তন্ময় চলে গেল। বাকি দিনগুলি সে আর আমার সামনে এলো না। বিয়ের দিন সকাল থেকে দুই পরিবারই চিন্তিত। আমি পার্লার থেকেই পালিয়ে গিয়েছি বান্ধবীর বাসায়। বিয়ের সময়টা চলে গেলে ফিরে আসবো।

বান্ধবীর বাড়িতে বসে আমি একটা টেক্সট মেসেজ লিখছিলাম তন্ময়ের কাছে, “তোমাকে আমি বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করবো না। তুমি আমার কথা শোনো নাই,আজ তোমার জন্য দুই পরিবারের ইজ্জত নষ্ট হলো!”

আমার মেসেজ টাইপিং শেষ হওয়ার আগেই আমার ফোনে তন্ময়ের মেসেজ এলো, তন্ময় লিখেছে, “দেখেন ভাবী, আমি জানি আমার প্রতি আপনার ফিলিংস এটা খুবই সাময়িক। ভাইয়া খুব ভালো একজন মানুষ,তার সাথে থাকতে থাকতে আপনি আমাকে ভুলে যাবেন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে আজ ঢাকা চলে যাচ্ছি, ততদিন আসবো না যতদিন আপনার আর ভাইয়ার সম্পর্ক ঠিক না হয়।” দুঃখের মধ্যেও হাসি পেলো আমার। আজ বিয়ের দিন অথচ আমিও পালিয়েছি আবার তন্ময়ও পালিয়েছে,বাকি আছে চায়নিজ শান্ত!

তারপরই শান্ত এর মেসেজ এলো, “লাবণ্য! আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারছি না। মেডিকেল থার্ড ইয়ারের একটা মেয়ের সাথে গত দেড়বছরের রিলেশনশিপ। মাঝে তার সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার বিয়ের খবর শুনে আজ সে বাড়ি থেকে পালিয়ে স্টেশনে এসে বসে আছে। আমাকে যেতে হবে। ক্ষমা করো!” হাসিমুখে আমি আমার বড় ভাইয়ের ফোনে একটা মেসেজ লিখলাম, “ভাইয়া,সময় ভালো না, তোমরাও পালিয়ে যাও,আর পাশের বাসার ওদেরকেও বলো পালিয়ে যেতে।” এখন আমার মাথার ভেতর বাংলা গান বাজছে, এই ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে, চল পলায়ে যাই!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত