আমার শিকড় আমি

আমার শিকড় আমি

আমার নাম আসিফ নেওয়াজ।বাবার নাম রফিক নেওয়াজ।নামের পদবী এক হলেও আমার বাবা আমার আসল পিতা না।পালক পিতা।এমনকি আমার মাও পালক।তারা আমাকে আমার তিনমাস বয়সে দত্তক নেন।আমার জন্মের পরবর্তী গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং। আমার সদ্য জন্ম নেয়া দেহটা কেউ একজন( কে সেটা আমি জানি না) ডাস্টবিনের পাশে রাতের অন্ধকারে ফেলে দিয়ে যায়।ঢাকার রাস্তায় জীবনযাপন করা অভুক্ত কুকুরগুলো আমাকে আবর্জনা ভেবে নাড়াচাড়াও শুরু করে।আমি চিৎকার করে উঠি।ততক্ষণে আমার বাম হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।আওয়াজ শুনে এক মহিলা কাছে এগিয়ে আসলে আমাকে দেখতে পান এবং উদ্ধার করেন।

এরপর হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে থাকতে শুরু করি।তবে আমার আঙুলটা আর খুজে পাওয়া যায় নি।মনে হয় কুকুরের পেটেই গেছে।যাইহোক এরপরে আমার বাবা মা আমাকে দত্তক নেন।হ্যা বাবা মা কি জিনিস তা বোঝার পর থেকেই আমি তাদের দেখে এসেছি।চিনে এসেছি।অবশ্যই তারা আমার বাবা মা।একটু আগে যে গল্পটা বললাম তার এক বিন্দুও মিথ্যা না।আমার এ গল্প বাংলাদেশের বড় বড় পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল।সবগুলো আমি ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে প্রিন্ট করে রেখেছি।তবে প্রশ্ন হতে পারে এসব আমি আমার মা বাবার কাছ থেকে জেনেছি কিনা।একদম ভুল।আমার বাবা মার একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি বেশ সুখেই ছিলাম।গোছালো সাদামাটা জীবন,বন্ধুবান্ধব, হৈ হুল্লোড় বেশ কাটছিল জীবন।ছাত্র হিসেবেও ছিলাম ব্রিলিয়ান্ট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পাই।ক্লাস পড়াশোনা ভালই চলছিল।জিন নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একদিন হঠাৎ শখ জাগলো DNA টেস্ট করি আমার।মূলত জানতে চাচ্ছিলাম আমাই আমার মায়ের কতটুকু আর বাবার কতটুকু পেয়েছি।এই একটি শখই আমার জীবনের নৌকা একবারে থামিয়ে দিল।আমি জানতে পারলাম আমি আমার মা বাবার কেউ না।আমি অন্য কেউ।যেদিন আমি রিপোর্টটা হাতে পাই সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি।সারারাত বসে ছিলাম চুপচাপ।আমি আমার জীবনে বোধহয় এত কাদিনি সেদিন যতটা কেদেছিলাম।বারবার মনে হচ্ছিল আমার চারপাশটা পুরোটা মিথ্যা।এরপরের টানা দু তিনদিন বাসা থেকে হওয়া বন্ধ করে দিলাম।কিছুই ভাল লাগত না।্মা অনেক ডাকাডাকি করত।ভাল লাগত না।কেন ভাল লাগবে?এযে আমার আসল মা না।ভাবতে খুব কষ্ট হত।চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইত।কোনরকমে আটকে রাখতাম।তবু মেনে নিতে খুব কষ্ট হত।
চতুর্থ দিনে রাতে আমার ঘর গুছানোর সময় টেবিলে রিপোর্টটা দেখতে পায় মা।আমি তখন বাথরুমে ছিলাম।সেদিন রাতে আমি আমার ঘর থেকেই টের পেলাম মা কাদছে।শুধু কাদছে।সেই রাতে বাবা আমার ঘরে আসলেন।এসে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুমি কি আমাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চাও?”
“না”
“তাহলে টেস্ট করালে কেন?”
“এমনি করেছিলাম।শখের বশে”বললাম আমি।মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।কাদতে কাদতে বলতে লাগলেন, “তুই আমার ছেলে।এসব টেস্ট আমি মানি না।তুই আমার ছেলে”
“থামো।যেভাবেই হোক আসিফ জেনে ফেলেছে।ওকে পুরোটা জানাতেই হবে”মাকে বললেন বাবা।
“কোন দরকার নেই”বললাম আমি।

“দরকার আছে।আমি বাবা হতে চেয়েছিলাম।তোমার মা শুধু মা হতে চেয়েছিল।আমরা আমাদের সন্তানের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে পারব না।তোমার পিসি ওপেন কর” আমি পিসি ওপেন করে দিলাম।বাবা তার জিমেইল ড্রাইভে ঢুকলেন।ড্রাইভের একটা ফোল্ডার ছিল আমার নামে।ওপেন করলেন।আমার সামনে ভেসে উঠল পত্রিকার বিভিন্ন পেজগুলো।আমি দেখলাম কিভাবে,কেমন করে একটা ডাস্টবিন থেকে ফেরেশতার মত দুই জন মানুষের কাছে এসেছি।মায়ের দিকে তাকালাম একবার।মা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বাবা আমাকে বললেন,

“এসব দেখার পর তুমি আমাদের বাবা মা বলে ডাকবে কিনা এটা তোমার বিষয়।তুমি এখন প্রাপ্তবয়ষ্ক।তব
ে এটা জেনে রেখো তুমি আমাদের দুজনের সন্তান থাকবে আজীবনই”বলে বাবা মাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি দেখলাম বাবা হাত দিয়ে চোখ মুছছে।

সারারাত পেপারের রিপোর্টগুলো ঘাটাঘাটি করে খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লাম আমি।আমার নতুন অতীত।প্রত্যেকটা রিপোর্ট পড়ছি আর আমার মনে বারবার একটাই প্রশ্ন-কেন?কি অপরাধে সদ্য জন্ম নেয়া আমিকে ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়েছিল।জানতেই হবে আমাকে।

“আসিফ নেওয়াজ”বলতেই রেটিনা স্ক্যানারটা চালু হয়ে গেল।ডান চোখটা স্ক্যানারের দিকে কিছুটা ঝুকে দিতেই স্ক্যান হল।দরজা খুলে গেল।আমার অফিসের চেম্বারে ঢুকলাম আমি।আমি এখন National DNA Database এ কর্মরত।আমি শুধু মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর খুজে পাওয়ার লোভে এখানে জয়েন করেছি।গত পাচ বছরের প্রতিটি দিন একটি মুহূর্তের জন্য আমি ভুলিনি।ভার্সিটি শেষে ঢাকা মেডিকেলের DNA ল্যাবে জয়েন করি।ওখানে যদিও ক্রাইম সিনের পাওয়া DNA গুলো সন্দেহভাজনদের সাথে ম্যাচ করে কিনা চেক হত।আর আসত একদল বাবা মা তাদের সন্তানের পিতৃত্ব আর মাতৃত্ব চিহ্নিত করতে।যখন যার স্যাম্পল পেতাম নিজের সাথেও টেস্ট করাতাম।কখনোই মিলত না।মাঝে মাঝে মুষড়ে পড়তাম খুব।তখন আমায় সান্তনা দিত শুধু রুবিনা।আমার স্ত্রী।হ্যা এর মাঝে আমি বিয়েও করেছি।সবকিছু জানার পর বহুদিন লেগেছিল আমার স্বাভাবিক হতে।বাবা মার সাথে স্বাভাবিক হয়েছিলাম ঠিকই।তবে কোথায় যেন একটা সুতো কেটে গিয়েছিল।ঢাকা মেডিকেলে যখন কাজ করতাম তখন পরিচয় হয় রুবিনার সাথে।সে ওখানে ইন্টার্ণ করছিল।সম্পর্কটা যখন প্রেমে গড়ায় একদিন রাতে সাহস করে আমার জীবনের গল্প বলেছিলাম ওকে।তার পরের দিন আমার সাথে দেখা করে বলেছিল, “সারারাত ঘুমাতে পারিনি আমি।আমি এত কাদিনি আমি। আজকেই আমরা বিয়ে করব”

“করুণ গল্প শুনে করুণা করতে চাচ্ছ?”বললাম আমি।
“না।এতদিন তুমি একা কেদেছে।এখন থেকে কাদলে একসাথে কাদব দুজনে”
হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেল আমাদের।বিয়ের আগে আমি রুবিনারও DNA টেস্ট করে নিয়েছিলাম। কিছু বলেনি রুবিনা।ও আমাকে বুঝেছে।পরে ঢাকা মেডিকেল ছেড়ে এই DNA এর ডাটাবেজের কাজে যুক্ত হই।দেশের সকল জায়গা থেকে DNA এর ডাটা স্টোরেজের জন্য আসতে থাকে।যুক্ত হয়ে পড়ি বিশাল কর্মযজ্ঞের মাঝে।আর চলতে থাকে আমার শিকড় খোজার কাজ।

এর মাঝে একজনের সাথে আমার ডিএনএ ২০% মিলে যায়।আমি ছুটে গিয়েছিলাম।লোকটা দরিদ্র কৃষক।দিন চলে কোন রকমে।আমার পরিচয় না দিয়ে নানা রকম কথাবার্তা বলে খোজ নিলাম কিছুই পেলাম না। এরপর থেকে যাদের সাথে আমার বেশি শতাংশে মিলে যেত ডিএনএ তাদের প্রোফাইল আলাদা করে রাখা শুরু করি।হাজার হোক এরা সবাই আমার বায়োলজিক্যাল আত্নীয়। আজকে খুব ভোরেই অফিসে চলে এসেছি।কারণ গতরাতে তিনটার সময় আমার অফিসের পিসি থেকে ম্যাসেজ এসেছে দুটো প্রোফাইল ৯৯.৯৯% মিলে গেছে।রুবিনাকে বলে বেরিয়ে এসেছি।অফিসের পিসি ওপেন করে ম্যাচ করা প্রোফাইল দুটোয় ক্লিক করতেই ডিটেইলস চলে এল সামনে।আজমেরী হক এবং শফিকুল আলম।ন্যাশনাল আইডির ডাটাবেজে লগইন করে ঠিকানা পেলাম দুজনের।দুটো ঠিকানা প্রিন্ট করে কাগজ দুটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার।

এই মুহূর্তে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছি আমি।ঝিনাইদহ জেলা শহরের একটা তিনতলা বাড়ির দোতলার একটা ঘরে।গতকাল অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েই উঠে পড়ি বাসে।ঠিকানা খুজে খুজে অবশেষে পেলাম আজমেরী হকের বাড়ি।একটা বাচ্চা মেয়ে দরজা খুলল।জিজ্ঞাসা করতেই ভেতরে ঢুকে বসতে বলল।তার নানু যোহরের নামায পড়ছে।

একটা ডিজিটাল ফটো ফ্রেম চোখে পড়ল।অনেকগুলো ছবি আসছে একটার পর একটা।বাচ্চা মেয়েটারও ছবি দেখা যাচ্ছে একজন মহিলার সাথে।মহিলাটার বয়স আমার কাছাকাছি হবে।মা হবে হয়তো।

“কে আপনি?”ঘুরে তাকাতেই দেখলাম মাকে।আমার আসল মাকে।আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া মাকে।আমি উঠে দাড়ালাম আর বললাম,
“আমি আসিফ নেওয়াজ”
“বসুন।আমার কাছে কি দরকার?”

“আমি ন্যাশনাল ডিএনএ ব্যাংক থেকে এসেছি।আপনার ডিএনএ এর সাথে ডাটাবেজের আরেকজন লোকের ডিএনএ ম্যাচ করেছে।অথচ আমাদের ডিটেইলস অনুযায়ী সে আপনার ছেলে হিসেবে আমাদের ডাটাবেজে এন্ট্রি নেই।আপনার মেয়ের ডিএনএ যদিও ম্যাচ করেছে আপনার সাথে”শেষের কথাটা মিথ্যা বলল আসিফ।ধপ করে বসে পড়ল মা একটা চেয়ারে।আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।তারপরে জিজ্ঞেস করল,
“একজনটা কে আপনি?”ধরা পড়ে গেলাম নাকি?কিভাবে?
“কি বলছেন?মানে?”ডিফেন্স দেয়ার চেষ্টা করলাম।
“মিথ্যা বলো না।তোমার চেহারা শফিকের সাথে অনেকটা মিলে যায়”শিট।এই সহজ জিনিসটা কেন মাথায় এল না।কিছু বললাম না আমি।

“কেমন আছো?”
“ভাল।আপনি?”

চারপাশটা মনে হল বড্ড চুপচাপ হয়ে আছে।যেন চারপাশও চাইছে এই স্বাভাবিক জীবনে হঠাৎ ঘটা অস্বাভাবিক মুহূর্তটা উপভোগ করতে।কোথাও কোন শব্দ নেই।এতদিন ধরে যা জানতে চাইছি তা আর জানতে ইচ্ছে করছে না।কি হবে জেনে?
“ভাল।তোমার নাম কি আসলেই আসিফ?”
“জি”
“কবে জানলে?”
“গতকাল জেনেছি আপনার পরিচয়।আর পুরো ঘটনা জানি পাচ বছর হল ”
“তোমার বাবা মা কেমন আছেন?”
“ভাল”
“দুপুরে খেয়েছো?”
“না”

“তাহলে আজ আমার সাথে খাও”বলে উঠে গেল মা।কিছু ভাল লাগছে না।রুবিনাকে কল করলাম। বললাম কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না।কেনর উত্তর।রুবিনা বলল,

“তুমি তো কোন জাজমেন্ট দিতে ওখানে যাওনি।জেনে তুমি চলে আসবে।উনি তো তোমার কিছু হন না”আসলেই তো কি হয় এই মহিলা আমার।কেউ না।তখনই বাচ্চা মেয়েটা ঘরে ঢুকল।
“নানু আপনাকে খেতে ডাকছে।আচ্ছা আপনি নানুর কি হন?”
“কেন?”
“নানু অনেক কাদছে”
“তাই নাকি?”
“হ্যা”
“আমি তো কেউ হই না”
“তাহলে কাদছে কেন?”
“কি জানি।কি নাম তোমার?”
“আলিশা”
“তোমার মা কোথায়?”
“জাপানে।সেমিনার চলছে আম্মুর।আমার আম্মু ডাক্তার”
“বাহ বেশ ভালো।খেতে চল”

“আমি তখন কলেজে পড়ি।তখনই শফিকের সাথে আমার পরিচয়।শফিক তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির ছাত্র। প্রেম,লুকিয়ে ক্লাস ফাকি দিয়ে ঘোরাঘুরি চলতে থাকে।শফিক ব্রিলিয়ান্ট ছিল খুব।তখন প্রেমের তিন বছর বয়স চলে।আমি ভার্সিটিতে আর শফিকের ভার্সিটি শেষের দিকে।তাই হারাবার ভয় ছিল না।শফিকের এক বন্ধুর বাসায় সময় কাটিয়েছিলাম।তখনো ভাবিনি এতকিছু হতে পারে।যখন টের পেলাম তুমি আসছ পৃথিবীতে শফিককে জানালাম।সে আমার সাথে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে।ফোন দিলে ফোন রিসিভ করত না।অসহায় পড়ি খুব।একদিন মার কাছে ধরা পড়ে যাই।খুলে বলি সব।মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।ততদিনে দেরি হয়ে গেছে।তুমি বড় হয়ে গেছে আমার মধ্যে।সেদিন রাতে আমি মাকে খুব অনুরোধ করেছিলাম জানো তোমাকে যেন কোনভাবে আমার কাছাকাছি কোথাও রেখে দেয়।

তোমার ডেলিভারী ডেটের আগেই আমার পেইন শুরু হয়।আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে।প্রায় একমাস হাসপাতালে থাকতে হয় আমায়।কতবার বাবা মাকে জিজ্ঞেস করেছি।হাসপাতালে থাকার সময় সবসময় বলত মরা বাচ্চা হয়েছে।পরে কবর দেখতে চেয়ে জোরাজুরি করায় পরে স্বীকার কর যে তোমাকে ফেলে দিয়ে এসেছে” থামলেন আজমেরী হক।আসিফ দেখল তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।

“পরে খোজ নিতে ইচ্ছে করল না?”
“তোমাকে দত্তক নেবার আগ পর্যন্ত প্রতিটি পত্রিকার নিউজ কেটে কেটে রেখে তোমাকে খুজেছি। ততদিনে তোমাকে দত্তক নিয়ে নেয় তোমার বাবা মা।তাদের নাম পরিচয় গোপন রাখায় আর জানতে পারিনি”
“আর শফিকুল আলম?”

“তুমি ওকে চিনতে পারোনি?দেশসেরা ইঞ্জিনিয়ার এখন সে।বড় বড় প্রজেক্টে নাম থাকে তার।টিভিতে প্রায়ই সাক্ষাতকার দেয় সে”
“আচ্ছা।ভাল থাকবেন।আসি”
“চলে যাবে?”
“হ্যা।এখানে থাকতে আসিনি আমি”

“আবার আসবে তো?”
“না।কখনো না।আল্লাহর কাছে প্রাথর্না করব যেন কখনোই আপনার মুখ আমার দেখতে না হয়”বলে বেরিয়ে এলাম।সন্ধ্যা নেমে আসছে।সন্ধ্যা নামতে না নামতে ছোট্ট শহরটা নীরব হতে শুরু করেছে। আমার চোখ ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসছে।

আমি হাতে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি কেবিনটার দিকে।দেশের নামকরা এক হাসপাতালের কেবিন।অনেক মানুষ দেখা করেছেন তার সাথে।আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতপ্রাপ্ত এই প্রকৌশলী গত পরশু সড়ক দুর্ঘটনায় দুটো পা হারিয়েছেন।পুরো জাতি বিমর্ষ।পেপার টিভিতে নিউজ চলছে তাকে নিয়ে।কেবিনটার দরজা খুলতেই প্রথমবারের মত একদম সামনাসামনি দেখতে পেলাম শফিকুল আলমকে।হাসিমুখে ফুলের তোড়া এগিয়ে দিলাম।রোগীকে কমলার রস খাওয়াচ্ছে নার্স।

“স্যার আপনার সাথে একটু কথা ছিল।ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে”
“যা বলার পুলিশকে তো বলেছিই”
“স্যার আমি আরো উপরের”বলে নার্সের দিকে ইশারা করতেই নার্স বেরিয়ে গেল।
“আরে জানা কথা।ব্রেক ফেল করেছে গাড়ির।এতে এত ইনভেস্টিগেশনের কি আছে?”কপাল কুচকে বললেন শফিকুল আলম।

“জানেন আমি মানুষটা খুব সাধারণ।ভালও বলতে পারেন।প্রতিশোধপ
রায়ণ না।কিন্তু আপনার গাড়ির ব্রেকের তারটা কেটে দিতে আমার একটুও খারাপ লাগে নি”বললাম আমি।লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

“কি বলছেন?কে আপনি?”
“আপনার এই যে এত বড় ক্যারিয়ার,এত নাম,যশ অবশ্যই এর পিছনে বিশাল ত্যাগ আছে আপনার।সেই ত্যাগটা আমি জানি।একটা জারজ বাচ্চা।ঠিক না?”
“তোমাকে আজমেরী পাঠিয়েছে?”

“তার কি ক্ষমতা?ভাল করে তাকান তো আমার দিকে?আজমেরী হক কিন্তু কয়েক পলকেই চিনে ফেলেছেন”
“তুমি?”বলে তোতলাতে লাগলেন শফিকুল আলম।

“হ্যা।আমার কপাল ভাল।বেচে গিয়েছি।তবে জানেন আমাকে তারা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল।রাস্তার একটা কুকুর আমার একটা হাতের আঙুল খেয়ে নিয়েছিল।এই যে দেখুন”বলে হাতটা দেখালাম আমি।
“কি চাও আমার কাছে?”মলিন কন্ঠে প্রশ্নটা হল।

“আপনার মত একটা রাস্তার কুকুরের কাছে একজন মানুষ আর কি চাইতে পারে?কিছুই না।ভেবেছিলাম মরে যাবেন।খালি পা হারালেন।তাই ভাবলাম দেখে আসি।আবার কবে না আবার মরেটরে যান।ভাল থাকবেন।আসি”

“তোমার নাম কি?”
“নাম জেনে কি করবেন?”
“এমনি”
“বলবনা।এমনিই”বলে বেরিয়ে আসলাম হাসপাতাল থেকে।গাড়িতে বসে আছি চুপচাপ।অবশেষে শেষ হল আমার শিকড় খুজে পাওয়ার গল্প।আমি আসিফ নেওয়াজ।আমার শিকড় আমি,কান্ডও আমি।আমি থেকেই নতুন শিকড়।হবে নতুন কোন গাছ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত