ফাঁদ

ফাঁদ

যে যাই বলুক৷ আমার কিন্তু ওদের কথা বিশ্বাস করিনি৷”
আমার কাঁধে হাত রেখে বলল আব্বা৷
আব্বার সাথে আমার বুদ্ধি বয়স থেকেই বন্ধুর মতো সম্পর্ক৷
যে কথাটা বন্ধুকেও বলতে পারি না৷ সেটা আমি আব্বার কাছে বলতে পারি৷”

আব্বার কথার জবাব দিলাম না দিয়ে অসহায় ভাবে তাকালাম একবার৷
আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-আজ নাহয় কাল বিয়েতো করা লাগবেই৷ তুই না হয় একটু আগেই করে ফেললি৷”
এবারও আমি কথার জবাব দিলাম না৷ চোখেমুখে ব্যথিত হওয়ার আভা ফুটিয়ে রেখেছি৷
আব্বাও আমার দুঃখে ব্যাথিত হয়ে আফসোসের ঘোরে মাথা নাড়লেন৷

পাশের সোফায় আম্মা চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে আছেন৷ উনার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না উনার পুত্রধন এমন করতে পারেন৷

রিমির সাথে আমার দু’একবার চোখাচোখি হয়েছে৷ মেয়েটা আমার সামনে আসছে৷ মিনিটখানেক আশেপাশে ঘুরাফেরা করে আবার টুপ করে সরে যাচ্ছে৷

রিমি যখনই আমার সামনে আসছে৷ আমি তখনই চোখেমুখে বেদনার ছাপ বেশি করে ফুটিয়ে তুলছি৷

রিমির আম্মা এসে আমার আম্মাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন৷ সম্ভবত প্ল্যানিং করার জন্য৷
ঘন্টাখানেক আগে রিমির আব্বা মানে আমার হবু শ্বশুর আব্বা বলে গিয়েছেন,
আজকে আগদ হবে৷ আর বিয়েটা ছেলেমেয়ের ইচ্ছেনুযায়ীই হবে৷

পাশের সোফা থেকে আম্মা সরে যেতেই, আব্বা আমার কানের কাছে এসে বলল,
-আব্বাজান একটা কথা বলবো?
-হ্যা বলো৷
-তুমি যতই মুখের উপর বেদনা ফুটিয়ে রাখো! তুমি কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেক খুশি৷ তাই না?”
আমি আব্বার হাত চেপে ধরে রুমের চারিদিকে তাকালাম৷ না কেউ নেই৷ আব্বাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম৷
আব্বা আমাকে তারাতারি ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
-ঘরে গিয়ে বাপ-বেটা লুঙ্গি ড্যান্স দিবো৷ কিন্তু এখনই তুমি মুখে বেদনা ফুটিয়ে তুলো৷

আমি হালকা ভাবে গলা ঝাড়া দিয়ে আবারো বেদনা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি৷
রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানীর সুগন্ধ আসছে৷
আমি আব্বার দিকে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে বললাম,
-আব্বাজান আর বোধই মুখে বেদনার ফুল ফোটাতে পারবোনা৷ সুগন্ধে আমার জিব্বাটা ভিজে আসছে৷

আব্বা আমাকে শান্তনামূলক বাণী শোনালেন কিছুক্ষণ৷ শেষমেষ আব্বা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে,
কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয়৷”
আমিও আব্বার কথায় সায় জানালাম৷

বিরিয়ানী সুগন্ধটা আরো তীব্র হচ্ছে৷ রিমির আম্মার হাতের বিরিয়ানী আমার চেনা৷ এর আগেও অনেকবার খেয়েছি৷
কিন্তু এবারের মতো সুগন্ধী আর আসেনি৷

আমি সোফা ছেড়ে উঠতেই আব্বা আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললেন৷
পাশে বসিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
-তীরে এসে তরী ডোবাস না বাপ৷
– আমি আর পারছিনা আব্বা৷”
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম আমি৷

এবার আব্বা আবারও ব্যথিত হলো৷ আমাকে বসিয়ে রেখে সামনের রুম একটু ঘুরাঘুরি করে এসে বলল,
-চল বাইরে থেকে খেয়ে আসি বিরিয়ানী৷
-বাইরে খেলে ঘরেরগুলা মানে শ্বাশুরির বিরিয়ানীগুলা কে খাবে?
-নিজের বিয়েতে অতো খেতে নেই৷ ”

আব্বার সাথে রুম থেকে বেরোতেই রিমির ডাক পরলো৷ বাইরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই আব্বা বলল,
-একটু ঘুরাঘুরি করতে যাচ্ছি৷ বসে বসে ভালো লাগছেনা৷”

-না আব্বা একদম বাইরে যাবেন না আপনার ছেলেকে নিয়ে৷ পালিয়ে যাবে৷ আপনার ছেলে বহুত বড় ডপবাজ৷ প্রেমের শুরু থেকেই আমার সাথে এমন করে চলেছে!”

আমি ভেবে পেলাম না এই মেয়ের সাথে আমার প্রেম কবে হয়েছে৷ হ্যা আমি ভেতরে ভেতরে ভালোবাসতাম৷ কিন্তু এই মেয়ে আমাকে কখনো ভালোবেসেছে বলে মনে হয় নি৷

আমাদের বন্ধুত্বের অর্ধেক সময়ই গিয়েছে এই মেয়েকে শান্তনা দিতে দিতে৷ তার হ্যান্ডসাম প্রেমিকের সাথে সপ্তাহে ১৪বার ঝগরা হতো তার৷

যদিও তাদের ঝগরা হলে আমার আনন্দের সীমা থাকতো না৷

তারপরও আমি তার প্রেমিকের বিরোধী কিছু বলতাম না৷ সবসময় শান্তনা দিয়েই যেতাম৷

মাঝে মাঝে যখন শান্তনায় কাজ হতো না৷ মেয়েটা নাক টেনে কাঁদতো৷ আমি রেগে গিয়ে বলতাম,
-আমার মতো ভালো ছেলে ফেলে ঐ ছেলের সাথে প্রেম করতে গেলি কেন? মর এবার৷”
ঝাড়ি শুনে কান্নার স্পিড বাড়িয়ে দিতো৷
শেষমেষ আমার টিস্যুর প্যাকেটটা শেষ করে সেই চোখের জলগুলো মুছিয়ে দিতে হতো৷

পাশাপাশি রিকশায় বসে বাসায় ফিরিয়ে দিতাম৷ আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বসতৌ৷ আমি বুঝিনা এই মেয়ে কি চায়৷
রিমির আম্মা আমাকে ভালোবাসতেন৷ আমি যখনই রিমির সাথে আসতাম৷
বিরিয়ানী খাইয়েই ছাড়তো৷

মাঝে মাঝে আমার রিমির সাথে রাগারাগি হতো৷
সবকিছু বন্ধ৷ সেদিনগুলোতেও আন্টি বিরিয়ানী রান্না করে আমাকেই ফোন দিতো প্রথমে৷

প্রথম কয়েকবার রিমির খোঁচা শুনতে হয়েছিল৷ আমি নিজের মতোই খেয়ে যেতাম৷
তারপর থেকে আমি খেতে বসতেই আন্টি আমার কানের মধ্যে তুলো গুজে দিতেন৷

রিমির আব্বার সাথেও আমার মোটামুটি সম্পর্ক৷ ভদ্রলোকের রাজনীতি নিয়ে প্যাচাল আমার একদমই ভালো লাগে না৷

উনি ভাষণ দেন৷ আমি শুনি৷ মাথা নাড়ায় মাঝে মাঝে৷
আর মনে মনে বলি,
-এই বয়সে খাবেন আর ঘুমোবেন৷ তা না করে আপনি আছে এসব নিয়ৈ৷”

মনের কথা মনেই রেখে দিতাম৷ বিরিয়ানী খেয়ে চলে আসতাম৷
রিমির সাথে দিনকয়েক কথা বন্ধ থাকতো৷
আবার প্রেমিকের সাথে ঝগরা বাঁধিয়ে আমার পাশে এসে কান্না করতো৷

আমি শুনেও না শোনার ভান করতাম৷
তখন নিজে নিজেই বলতো,
-হ্যা এখন উনার দাম বেড়েছে৷ নতুন পেয়েছে মনে হয়৷”

আমি সেটাও কানে নিতাম না মাঝে মাঝে৷ তারপর পাশে বসা বান্ধবীকে বলতো,
-শোন৷ পরেরবার আম্মা যখন বিরিয়ানী রাঁধবে৷ আমি চুপিচুপি সেই বিরিয়ানী বিষ মিশিয়ে দিবো!”

আমি মুখ টিপে হাসতাম৷ তারপর হুট করে আমার শার্টের কলার চেপে বলতো,
-আমি কান্না করছি৷ শান্তনা দে বলছি৷”

শেষমেষ এই মেয়েটার সাথে কথা না বলে আর থাকা হতো না৷
শাস্তি হিসেবে নাক থেকে ঝড়ে পরা পানিগুলো আমার রুমাল দিয়ে মুছতো৷
আমার চুলগুলো মুটো করে ধরে বলতো,
-তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না বুঝলি৷ বিয়ে আমি তোকেই করবো৷”

পাগলামী গুলো আমাকে বড্ড হাসাতো৷ কিন্তু এই মেয়ে যে সত্যি সত্যি এটা করে ফেলবে আমি ভাবিনি৷

সপ্তাহখানেক আগে শফিক স্যারের এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার কথা ছিল৷ রাত জেগে লিখেছি আমি৷ কিন্তু চিত্র আঁকার বেলায় বরাবরই ফেল্টুস আমি৷
রিমির সাথে চুক্তি করেছিলাম, ও চিত্র আঁকবে৷ আর আমি লিখবো৷

চুক্তি অনুযায়ী সব ঠিকঠাক ছিল৷ ঝামেলা বাঁধলো ক্লাস টাইমে৷
ফোন দিয়ে অবস্থান জিজ্ঞেস করতেই বলল,
ওর সাথে ঘুরতে এসেছি রে৷”

আমি আর কিছু বলিনি৷ রাগে-ক্ষোভে আর ক্লাসেই ঢুকিনি৷
বাসায় গিয়ে ঘন্টাখানেক চিন্তা করেছি৷ ভেবে চিন্তে দিয়েছিলাম রিমির বাবার নাম্বারে কল৷
এই মানুষটাকে মেয়েটা বাঘের মতই ভয় পায়৷ আমাকে বারকয়েক বলেছে৷
ভুলক্রমে সে একবার তার বাবার নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছিল আমাকে৷
আমিঔ বুদ্ধিমান ছেলের মতো কন্টাক্ট নাম্বারে রেখে দিয়েছিলাম৷
বারকয়েক ব্ল্যাকমেইল ও করেছি রিমিকে৷
ভদ্রলোককে বানিয়ে বানিয়ে বলতেই দিব্যি বিশ্বাস করে ফেলেছেন৷

তারপরের দিনই রিমি হুট করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে৷ ব্যাপারটা অবশ্য আমারো খারাপ লেগেছে৷
আমি বারকয়েক কথা বলার চেষ্টা করেও পারিনি৷

মেয়েটার সাথে কথা না হওয়া দিনগুলো আমার বড্ড খারাপ কাটে৷ সবকিছুর মাঝে কিছু একটা নেই লাগে আমার৷ তারপরও আমি বুঝতে দিই না৷
পরের দুইদিনে আমার সামনে পরলেও কথা বলিনি৷

আসল ঘটনাটা ঘটলো কাল ক্লাস শেষে৷
ক্লাস শেষ করে বেরোতেই দেখলাম রিমির প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে৷
আমি দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম৷
এই বেটা হুট করেই আমার কলার ধরে টান দিয়েছিল৷
জিম করা মাশল আর শক্তপোক্ত হাত দেখেই আমার গলাটা শুকানো অবস্থা৷
মনে মনে বললাম,
আমাকে মারার দরকার নেই ভাই তুই চোখ গরম করে তাকালেই পালাবো আমি৷”

ঘুষি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে রেখেছিলাম৷ কিন্তু হুট করেই আমাকে ছেড়ে দিলো৷
পেছনে তাকাতেই রিমিকে দেখতে পেলাম৷

আমি আর দাঁড়াইনি৷
রিমি শ’খানেক কল দিয়েছিল৷ আমি ধরিনি৷
আজ সকালেও যথারীতি ফোন বাজলো৷

ফৌন ধরতেই রিমির আম্মু ওপাশ থেকে বলল,
বাবা তোমাকে আমি ভালো ছেলে ভেবেছিলাম৷ তুমি এভাবে ছলনা করলে আমার মেয়ের সাথে?
আমার মেয়ের কিছু হলে তোমাকে ছাড়বোনা বলে দিলাম৷”

তারপর হুট করেই ফোন কেটে দিল মহিলা৷ পাশে রাখা জগের পানিগুলো শেষ করেই রিমির বাসায় রওনা দিয়েছিলাম৷

বেল বাজানোর সাথে সাথেই রিমির বাবা দরজাটা খুলে দিলেন৷ তারপর রিমির দরজায় দু’টো টুকো দিতেই খুলে গেল দরজাটা৷

এই মেয়ের চেহারা দেখে আমার কিছুতেই মনে হচ্ছে না, সে মরতে চেয়েছিল৷

ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই আকাশ থেকে পরেছিলাম৷ আব্বা-আম্মা ভেতরে বসা৷
আব্বাকে জিজ্ঞেস করতেই ঘটনার সারাংশ শুনিয়ে দিলো৷

ফাজিল মেয়েটা আমার আব্বা-আম্মা, আর ওর আব্বা-আম্মার সামনে কেঁদে কেঁদে বলেছে,
আমি নাকি ওর সাথে তিন বছর যাবৎ প্রেম করে চলেছি৷ সেদিন নাকি অন্য মেয়ের সাথে রিক্সায় ঘুরতে গিয়ে ধরা পরেছি৷
যোগাযোগের সবকিছু বন্ধ করে রেখেছি৷

আমি আম্মাকে হাতে পায়ে ধরে বুঝাতে চেয়েও পারিনি৷ আব্বা বুঝেছে৷
যদিও ছেলের বৌ হিসেবে রিমিকে উনার মনে ধরেছে৷

ভেতরে ভেতরে আমার মনেও ধরে আছে অনেকদিন ধরেই৷

শ্বাশুরির হাতে রান্না করা বিরিয়ানী শেষ করে যখন ঢেঁকুর তুলছিলাম৷ রিমি তখন আমার পাশে বসলো৷
বিরিয়ানী খেয়ে তৃপ্তিময় চেহারাতে আর বেদনা ফুটাতে পারিনি৷
রিমি ফিসফিস করে বলল,
-কেমন দিলাম রে?
-তুই এটা কেন করলি?
-খুশি হোসনি?
-অন্যের প্রেমিকাকে বিয়ে করছি৷ এতে খুশি হওয়ার কি আছে? আমার বরং ভয় করছে৷
-কিসের ভয়?
-তোর প্রেমিকের জিম করা মাশল আর শক্তপোক্ত চেহারার৷ কোনদিন জানি আমি মুচড়ে ভেঙে ফেলবে৷”

কথা শুনে রিমি খিলখিল করে হেসে উঠে৷
আমি ঠোঁট দু’টো টিপে ধরে বললাম,
-আমাকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করছিস৷ ঐ বেটার কি হবে?
-ব্রেকাপ করে দিয়েছি৷ শালার সাহস কত! তোর গায়ে হাত তুলে৷
সেদিন চুমুও খেতে চেয়েছিল৷ তাই ব্রেকাপ করে ফেলেছি৷”

আমি নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বললাম,
তুই ছ্যাচড়া হলেও মেয়ে ভালো৷”
রিমি মুচকি হেসে বলল,
সবেতো কবজা পরিয়েছি৷ চ্যাং ধোলাই বাকি আছে৷ শ্বাশুরিকে হাত করে রেখেছি৷ বাকিটুকু বিয়ের পর বুঝবে তুমি৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত