কক্সবাজার অভিশাপ

কক্সবাজার অভিশাপ

এলাকার বড় ভাইদের সাথে চলাচল থাকায় সমবয়সী ছেলেগুলো আমায় সচরাচর কিছুটা ভয় পায় বটে। তাই কথামতো কাজ করেও দেয়। এমনকি যাদের সাথে শৈশব বয়সে খেলাধুলা করতাম আজ কৈশোর শেষে তারাও কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকে। চাচাতো ভাইয়ের সুবাদে এলাকার বড় ভাইদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন আমি আর আমার চাচাতো ভাই এলাকার গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। সমবয়সী একটা ছেলে ডাক দিলো,

-হাসিব, কক্সবাজার যাবিনা? এলাকার সব ছেলেরা যাবে তিনদিনের সফরে।
-হুম যাবো। আজকেই টাকা জমা দিবো। কিন্তু কথা হচ্ছে তোর হাতে ওটা কি?
-কিছুনা।
-কিছুনা মানে!
-এলাকার বড় ভাইদের সামনে সিগারেট ধরাস, তোর সাহস কতো!
-বড় ভাই মানে! তুই আমার মাত্র তেইশ দিনের বড়!
-যাই হোক বড় তো? তাছাড়া রায়হান ভাই আছে আমার সাথে দেখছিস না? দে হারামি তোর সিগারেট!
তারপর ওর হাতে থাকা সিগারেটটা দিয়ে দিলো।
-আচ্ছা আমি রাতে রায়হান ভাইকে নিয়ে আসবো। জিরো পয়েন্টে থাকিস। কাজ আছে!
-আচ্ছা।
-ওই হালা দিয়াশলাই দে!

তারপর দিয়াশলাই দিয়ে বেনসন সুইসটা ধরালাম! আর চাচাতো ভাইয়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম। আহা ফ্রিতে তেরো টাকা ফাঁফরবাজি করে নিয়ে নিলাম! আর পিছন থেকে আবির চিৎকার করে বলতেছে হাসিব কাজটা ঠিক করলি না! আমার থেকে নিয়ে তুই টানছিস! চিটিংবাজি করে তেরো টাকা খাইছস তুই আমার, তোর মানিব্যাগে ঠাডা পড়বো, খুব তাড়াতাড়িই পড়বে! রাতে আবির সহ আরও কয়েকজন এলো। সকালে সবাই কক্সবাজার রওনা দিবো। আমাদের সাথে রায়হান ভাই ছাড়াও আরও কয়েকজন বড় ভাই আছে এলাকার।

-কিরে কি কাজ আছে হাসিব?
-ভাবতেছি তোদের দ্বারা হয়তো হবেনা!
-কি কাজ বলবি তো!
-কাল তো কক্সবাজার যাবো। রাতে একটা পিকনিক করবো। খাওয়াদাওয়া হবে!
-কি খাবি!
-মুরগি।
-কেমনে?
-প্রবাসী ইউনিটের সভাপতি এন্তাজ ভাইয়ের! পাকিস্তানি মুরগি একটা আছে। চার কেজির বেশি হবে! খোয়ার থেকে ধান্দা করবো!
-কি বলিস!
-হুম। রাজি থাকলে বল।
-হুম চল সবাই মিলে।

তারপর খোয়ারের ভেতর পেয়াজ কেটে দিয়ে মুরগি নিয়ে আসলাম রাতে। মুরগি যাতে ডাক না দেয় তাই পেয়াজ কেটে দিয়েছিলাম। সবকিছুর লিড রায়হান ভাই দিয়েছিল! দেড় কেজি পোলাও চাউলও দিলো রায়হান ভাই। আমার ঘর থেকে লুকিয়ে সব মশলাপাতি নিয়ে আসছিলাম। খাওয়া শেষে সবাই মিলে দুই লিটার কোল্ড ড্রিংক এনে খেলাম। সেই সাথে আবিরকে সাথে নিয়ে আবিরদের পথের সাথে নারকেল গাছের কয়েকটা কচি ডাব চুরি করে খেয়ে দিলাম! কি আজব কান্ড গৃহস্থ আছে সাথে, তবুও নাকি চুরি! সেদিনের মতো খেয়েদেয়ে যে যার বাড়ি গিয়ে সব রেডি করে আসতে গেলো। আলো ফুটবার আগে ভোরেই রওনা দিবো সবাই। আমিও বাড়ি এসে সব গোছগাছ করে আসতে গেলাম কক্সবাজার তিনদিনের সফরের উদ্দেশ্য! মুরগি আর ডাবের কথা কেউ জানলেও আমাদের আর পায় কে!
সকালে গাড়িতে ঘুমাচ্ছিলাম। রাতে কেউই ঘুমাইনি। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আরও তিনটি মিস কল বিদেশি নাম্বার থেকে! ওরেব্বাস! এন্তাজ ভাই নয়তো! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলাম!

-হাসিব।
-হুম ভাই।
-তোরা নাকি কাল রাত থেকে এলাকায় নেই। ওদিকে নাকি আমার মুরগিটাও নেই! চার কেজির উপরে মুরগিটা আমি আগামী মাসে এসে খেতাম! তোর ভাবী কত যত্ন নিয়ে পুষছিল!
-ভাই আমরা তো কিছু জানিনা! আমরা তো ভোরেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছি।
-একদম মিথ্যে বলবিনা। সারারাত মুরগি চুরি করে পিকনিক করে ভোরে বের হয়েছিস! তোরা কি মনে করেছিস আমি বুঝবো না! এলাকায় তোরা ছাড়া এ কাজ কেউ করবেনা। এসবের অভিজ্ঞতা আমারও ছিলো!
-নিজের যখন ছিলো তখন আমাদের বলছেন কেন!
-আমার আফসোস একটাই শেষ অব্দি তোরা আর মুরগি পেলি না! আমার মুরগিটাকেই! তোর ভাবী রাগারাগি করে তোদের অভিশাপ দিতাছে! আমি দেশে আসলে যা খাইতে চাস খাওয়াবো তোদের,তবুও আমার কিছু চুড়ি কইরা খাবি না!

-আচ্ছা ভাই!যাক শেষ অব্ধি বাঁচলাম! কিছুক্ষণ পর আবিরের মোবাইলে ফোন আসলো,
-হ্যালো মা।
-আবির আমাদের রাস্তার সাথে গাছটার একটা ডাবও নাই। কোন হারামজাদারা চুড়ি কইরা নিয়া গেছে! তাদের ধরতে পারলে কারেন্টের খাম্বায় ঝুলাইয়া রাখা দরকার।
-আরে মা! এখন বকাবকি করে কি হবে! ফিরে তো আসবে না। উল্টো মুখ ব্যথা হবে। আর রাস্তার সাথে গাছ এলাকার পোলাপান খাইতেই পারে!
আমি ওর কথা শুনে পাশে বসে হাসতেছি।

-আমি বুঝছি। এটা তোরাই করেছিস! তাই বকাবকি করলে তোর গাঁয়ে লাগবে বলেই এমন বলছিস!
-আমার গাঁয়ে লাগবে কেন! তুমি যেভাবে মা-বাপ তুলে গালাগালি করতেছো সব তো তোমাদের গাঁয়ে লাগার কথা!
-তবেরে! তুই এবার বাড়ি আয়!
ও তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে দিলো।

তারপর কক্সবাজার গিয়ে হোটেল থেকে জিরিয়ে এসে ইনানী বীচে সবাই নামলাম। একটা স্লিপিং টেবিলে জামাকাপড় রেখে সমুদ্রে নামছি সবাই। কিছুদূর যাওয়ার পর এক ঢেউ এসে রায়হান ভাইয়ের সানগ্লাসটা কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো!

-ঠিক আছে! আমি চেয়েছিলাম দেন নাই, তাই হারাইছে!
-ধুর বেডা তোর অভিশাপ লাগে নাই। তুই নিজেই তো একজাতের মাল! মনে হয় এন্তাজ ভাইয়ের বউ বাড়িতে বইসা বইসা আমাদেরকে অভিশাপ দিতাছে!
-হতে পারে!

বলতে বলতে আমি দেখলাম একশো টাকার দুইটা নোট ভাসে। হাতে নিয়েই রায়হান ভাইকে বললাম। অভিশাপ শুধু আপনারই লাগবে। আমার তো লাগে আশীর্বাদ!

-কিভাবে!
-এই দেখেন সমদ্রেও আমার কাছে টাকা ভেসে আসে!
-সময় ভালো হলে কপালের নাম হয় গোপাল।
-হাহাহা।
-হাসবি না হাসিব্বা। খারাপ সময় তোরও আসবে!

তারপর রিয়াদ ভাই আর রায়হান ভাই বললো তাদের তাদের কয়েকটা ফটো তুলে দিতে রিয়াদ ভাইয়ের মোবাইল দিয়ে। তারপর আমি মোবাইল নিয়ে ফ্ল্যাশ অন অফ করছি আর তারা সেই পোজ নিচ্ছে, কাঁধে হাত দিয়ে, পানিতে শুয়ে, বসে আরও কতভাবে!
রিয়াদ ভাই এসে বললেন,

-কই দেখি কেমন ফটো তুলেছিস!
-ভাই ফটোতো অনেক তুলছি কিন্তু গ্যালারিতে দেখতে পাচ্ছিনা!
-বললেই হলো! ক্যামেরা অটো সেভ সেটিং করা। ফটো তুলছিস কিন্তু গ্যালারিতে নাই তা অসম্ভব!
তারপর তিনি রিসেন্ট ভিজিট চেক করতেই বললেন,
-হারামি ফ্ল্যাশ লাইট অন অফ কইরা আমাদেরকে ছ্যাকা খাওয়াইলি। এবার তোর মজা বুঝাচ্ছি।

তারপর আমি দৌড় দিয়ে আমার প্যান্ট আর গেঞ্জির ব্যাগটা নিয়ে হোটেলের দিকে ছুটছি। আসার আগেই হোটেল ভাড়া করা হয়েছিলো এক কাকার মাধ্যমে। একবার পিছনদিকে তাকিয়ে দেখলাম রায়হান ভাই আর রিয়াদ ভাই আমাকে সমানে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে! ফাঁদে তুইও পড়বি, তখন বুঝবি মজা! হোটেলে এসে গোছল করতে লাগলাম। যে হাফপ্যান্ট পড়ে নামছিলাম তার পকেটগুলো থেকে কেজিখানেক বালু বেরিয়েছে! নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ফ্রি লবনবালু তো খেয়েছি কম হবেনা! কিছুক্ষণ পর আবির রুমে এসে জিজ্ঞাস করতে লাগলো,

-হাসিব তুই আমার প্যান্ট এনেছিস?
-না তো!
-আমি ফুলপ্যান্ট খুঁজে পাচ্ছিনা। যেটা সৈকতের টেবিলে রেখে বীচে নামছিলাম।
-হয়তো কেউ নিয়া গেছে!
-আহারে! আমার বারো শ’ টাকার অনলাইনে অর্ডার করা প্যান্টটা! যদিও ব্লু কালার অর্ডার করছিলাম কিন্তু

আসছিলো কালোর মতো কমন কালার। ওইটা ফ্যাক্ট না! কিন্তু কত শখ করে অনলাইন থেকে আনিয়েছি। শখের ঠেলায় দুইটা শক খাইলাম! একটা প্যান্টের কালার দেখে! আরেকটা দেশে আমাদের চাইতেও বড় বড় চিটিংবাজ বেশি!

-হুম বন্ধু। কাল রাতে নিজের গাছের ডাব খাইছিস চুরি করে আর ফোনে চাচীর অভিশাপ! এইজন্য গেছে!
-অভিশাপ না? তাহলে ফল তুইও পাবি!
-আমি চোরের উপর বাটপারি করি আমার আবার কে কি করবে!
-বাটপারের উপর ডাকাতি যেন না হয়ে বসে আবার!
-হবেনা।

তারপর খাওয়াদাওয়া করে সন্ধায় সূর্যাস্ত দেখার জন্য এবার সুকান্তা বীচের দিকে রওনা হলাম। ইনানী বীচ থেকে খানিকদূরেই।ইনানী বীচে সমুদ্রস্নান করা ভালো লাগলেও সূর্যাস্ত সুকান্তা বীচ থেকে দেখা ভালো কারণ সেখানে পাথরি বৈচিত্রের সাথে শামুক-ঝিনুক যেন প্রকৃতিকে সাড়া যাগায় অপার সৌন্দর্যের। সবার সাথে চিটিংবাজি করায় আমাকে ফেলেই চলে গেছে সেখানে। তাতে কি! আমিও রিক্সায় করে চলে যাবো। রিক্সায় উঠতে গেলাম, ওমা এক সুন্দরি হাত ইশারা করে ডাকছে! কাছে গিয়ে বললাম,

-আপু কিছু বলবেন?
-উঠে বসো।
-আমিতো সুকান্তা বীচে যাবো।
-সূর্যাস্ত দেখতে তো?
-হুম।
-আমিও সেখানেই যাবো। উঠে বসো।

মনেমনে ভাবলাম! কক্সবাজারে বোধহয় ফ্রি মাইন্ডে সবাই এভাবেই চলে। সুন্দরি কন্যা, মনে হয় ভার্সিটি পড়ুয়া। আমার সিনিয়র হবে। একেই হয়তো বলে চাঁন কপাল! আহা! তারপর উঠে বসলাম রিক্সায়। প্রথমবারের মতো এমন কোনো রমণীর সাথে রিক্সা ভ্রমণ। ফিলিংস তো সেই! এই বুঝি সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম হয়েই গেলো! আমিও প্রেমের গল্প রচনা করতে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন লাগছে! এবার এই খুশির ঠেলায় নাচতে ইচ্ছে করছে!

-কোথা থেকে এসেছো তুমি?
-এইতো আপি কুমিল্লা থেকে। আপনি?
-আমি স্থানীয় একটা ভার্সিটিতে পড়ি।
-আচ্ছা!

তারপর মেয়েটা আমার হাত ধরে বসলো। আমিও চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম! এই বুঝি চোখের দেখায় ভালোবাসা হবে!

-যাবে?
-কোথায়!
-রুমে!
-মানে!
-হাজার টাকা দিলেই হবে!

ওমাগো আজকাল এই ব্যবসায় ভার্সিটির মেয়েরাও সংখ্যায় ভালোই দেখি! আবার তারা রিক্সাওয়ালাদেরও পার্সেন্টিজ দেয়! আমিতো ভয়ে হাড় কাঁপুনি অবস্থা!

-না আপু। আমি এসবে নাই।
-তুমি যাবেনা?
-না!
-তাহলে মানিব্যাগ দাও! এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও রুমে যাবে নাকি মানিব্যাগ দিবে।
-কোনটাই না!
মেয়ে ঘাড়ের দিক দিয়ে কামিজের খানিকটা ইচ্ছে করে ছিঁড়ে দিয়ে বললো,
-এবার আমি চেঁচাবো! আর বলবো তুমি আমায় শারীরিক অত্যাচার করেছো! তখন গণধোলাই তো খাবেই সাথে জরিমানাও আছে!

আমি ভয়ে মানিব্যাগ বের করে দিলাম। চার হাজার টাকার থেকে দুই হাজার নিয়ে আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলো। আমি কন্যার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি! একটু মানবতা না দেখালে পুরো পকেট ফাঁকা হয়ে যেতো! আমিও মেয়েকে সমানে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছি। বদদোয়ার অভিশাপ আমিও পাইছি। তুইও পাবি। খুব শীঘ্র তোরও খারাপ সময় আসবে মেয়ে। অভিশাপ দিলাম, তুইও ফাঁসবি! বাবাগো! কার কবলে পড়লাম! কপালে এ কি ঠাডা পড়ছে!

সুকান্তায় যাওয়ার পর সবাই আমার কথা শুনে হাসি-ঠাট্টা করতেছে! আমি মরছি আর ওরা মশকারা করছে! আল্লাহ্‌ গো! এ কেমন বিষাদের সূর্যাস্ত! এমন রংহীন কেন সূর্যটা! আজকে মনে হচ্ছে আবিরের তেরো
টাকার বেনসন সুইস ধান্দার অভিশাপ, এন্তাজ ভাইয়ের বউয়ের মুরগি চুড়ির অভিশাপ, আবিরের মায়ের অভিশাপ তাদের গাছের ডাব চুরির জন্য, রায়হান ভাইদের সাথে চিটিংবাজি করার অভিশাপ সব একসাথে নামছে! ও আল্লাহ্‌! সূর্যাস্ত বুঝি এতো মন খারাপ করে দেওয়ার মতো বিষাদ হয়! এ কেমন সূর্যাস্ত, আবেগহীন!
আল্লাহ্‌, তোমার কাছে বিচার দিলাম! সব অভিশাপ ওই বদ মাইয়ার উপরে ফালাও! ঠাডা পড়ুক ওই মাইয়ার উপরে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত