সুখের কান্না

সুখের কান্না

আনমনা এক দৃষ্টিতে আকাশের পানে চেয়ে আছে রূপ। বিয়ে হয়েছে তিন বছর।এই তিন বছরে তমাল তাকে খুব একটা সময় দেননি।সারাদিন অফিসের ব্যস্ততা নিয়ে থেকেছে।রূপ কেমন করে একা একা সময় কাটায় কখনো জানতেও চায়নি। তিন বছরে রূপ অনেক বার মা হওয়ার চেষ্টা করেছে। সেটাও হয়নি।বারবার ডাক্তারের কাছে তমাল কে যেতে বলে সে যায় না।এদিকে নিজের ও কোন সমস্যা নেই।ডাক্তার বলেছে।কিন্তু তমাল নিজের ব্যপার টা এড়িয়ে চলে।বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নিজেকে দূরে রাখে। রূপ বুঝতে পারে না।আবার জোরও করতে পারেনা। মনমরা থাকে সবসময়।

– তমাল আজও কি রাত করে বাসায় ফিরবে?
– তুমি যেভাবে বলছো মনে হয় আমি ইচ্ছে করে দেরিতে বাসায় ফিরি।
– তা হবে কেন?আসলে আজকে আপা বাসায় যেতে বলেছে।অনেকদিন আপাকে দেখি না।
– যাও।ধরে তো রাখিনি।
– এমন করে বলছো কেন?আমি কি তোমাকে না বলে কোনদিন কোথাও গিয়েছি? সবসময় তো এই কারাগারে পড়ে আছি।
– মানে কি রূপ? এটা কারাগার?
– তো কি।কখনো তুমি জানতে চেয়েছো আমি কিভাবে থাকি?কেমন করে সময় যায় আমার?নাকি আমাকে কখনো সময় দিয়েছো? ছুটির দিনে তাও অফিসের কাজ বাসায় করো।
– রূপ সেই আবার পুরানো কথা। ভালো লাগেনা সবসময় তোমার প্যানপ্যান।
– যেও না।নাস্তা করে যাও।
– তোমার নাস্তা তুমিই করো।

তমাল সবসময় এমন করে আমাকে কষ্ট দেয়। কি সুখ পায় জানি না।ওর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তীর্থের মত বসে থাকি। ও কবে আমাকে নিজের করে নিয়েছে।আমি ভুলেই গেছি।ওতো এমন ছিলো না।গত একটা বছর এমন করে আসছে।বিয়ের একটা বছরই ভালো ছিলো।তাও খালি ব্যস্ততা দেখিয়েছে।আমি জোর করে সব আদায় করতাম। তমাল তুমি ছাড়া আমার কে আছে? হাজার কষ্ট দিলেও আমি তোমার কাছে থাকবো। বড্ড ভালোবাসি তোমায়। এতো রাত হলো এখনো আসছে না।ফোন ও তুলছে না।রাগ তো আমার করার কথা।ওনি ই রাগ করে বসে আছে। আজকে আসুক। ওই যে মহারাজ চলে এলো।

– এতোরাত করলে যে? ফোনটা ধরলে না কেন?
-এতো প্রশ্ন?আগে ঢুকতে দাও।
– সরি।আসো।

ওর প্রিয় কালারের শাড়ী পড়েছি।একবারও খেয়াল করলো না? এমন কেন তমাল?

– ওমা এতো রান্না? আজকে আপার বাসায় যাওনি?
– না।ইচ্ছে করেনি।আর রান্না গুলো মন চাইলো তাই করলাম।
– ওহ্। কোন বিশেষ দিন?
– না।
– মজা হয়েছে সবকিছু।
– তাই নাকি।
– হ্যাঁ

খেয়েদেয়ে মহারাজা এখন ঘুমাবে।আর আমি এতো সুন্দর করে সেজেছি। ওনার খেয়াল ই নেই।
তমাল ইচ্ছে করছে তোমাকে খুন করি।

– ঘুমিয়েছো তমাল?
– বলো।শুনছি।
– তুমি খেয়াল করোনি?
– কি?
– কি আবার?আমি শাড়ী পড়েছি।তোমার প্রিয় কালার। আর সেজেছি।
– তাই নাকি।কিন্তু কেন রূপ?
– কেন আবার? তোমার জন্য।আজকে দু’ জনে গল্প করবো বারান্দায় বসে।আর আকাশ দেখবো।তমাল চলো না প্লিজ।
– এতো রাতে পাগলামো করছো নাকি।মাথা খারাপ।সকালে আমার একটা মিটিং আছে।আমার এখন আকাশ দেখার কোন ইচ্ছে নেই।তুমি পাগল।তাই বলে আমি কি পাগল হবো নাকি।
– এভাবে বলছো কেন?

সকালে তুমি রাগ করে চলে গেছো।তাই ভেবেছি তোমার রাগ ভাঙ্গাবো।তুমি তো কখনো আমার রাগ ভাঙ্গাও নি। সবসময় আমাকেই করতে হয়।

– রূপ প্লিজ।আমি খুব টায়ার্ড। ঘুমাবো।
– যাও যাও ঘুমাও।

ভালোবেসে ওর কাছে যেতে ইচ্ছে হয়।ও বুঝে না।দূরে ঠেলে দেয়। খুব রাগ হচ্ছে।তমাল কি অন্য কাউকে পছন্দ করে?না না এসব কি ভাবছি।আমার এই সাজ শুধু তোমার জন্য। তুমি বুঝো না কেন?কতদিন ও আমাকে আপন করে নেয়নি। আকাশের তারা গুলো এখন অসহ্য লাগছে। সকালে,,,,রূপ কই?অজানা সংশয়। বারান্দায় ঘুমিয়ে আছে।রাতে এভাবে না বললেই পারতাম।খুব কষ্ট পেয়েছে।কেন যে আমি দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছি। রূপ খুব কষ্ট পায়।

– রূপ এখানে তুমি?
– তুমি উঠে পড়েছো?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে আসো।আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি।
– শুন। হঠাৎ চমকে উঠলাম।তমাল কতদিন পর আমার হাত টা ধরলো ভালোবেসে।
– তমাল আসো।আমি রেডি করছি নাস্তা।
– সরি রূপ।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

তোমার দেরি হয়ে যাবে। কিছুদিন পর আগামীকাল আমাদের বিবাহবার্ষিকী। চার বছর হবে। ওকে কিছু বলবো না।দেখি ওর মনে থাকে কিনা। সারপ্রাইজ দিবো।

– তমাল আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি আসবে। কোন কারণ দেখাবে না।
– চেষ্টা করবো।

আসার। অপেক্ষা করো না খেয়ে নিও। অপেক্ষা মানে আজকে তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো।আজকে আমার মহারাজা কে শুধু ভালোবাসবো।  দু’ জনে ক্যান্ডেল ডিনার করবো। এখনো আসছে না।এতোরাত হলো ১২ টা বেজে গেলো। সবসময় এমন করে। এতোবার বেল দিচ্ছি। রূপ কোথায়? মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।আচ্ছা চাবি তো আছে।খুলে নি। রাত ১ টা বাজে।কতক্ষণ আর জেগে থাকবে। ওমা ঘর এতো সুন্দর করে সাজানো।রূপ ও সুন্দর করে সেজে আছে। আবার পাগলামো।মাঝেমাঝে যে কি হয় ওর। আচ্ছা ঘুমাক।জাগাবো না।আর আমি ডিনার সেরে এলাম।

সকালবেলা ওহ্ রূপ আমাকে আজকে জাগালো না।দেরি হবে আজকে অফিস। রূপ রূপ রূপ কই তুমি? ওমা কোথাও দেখছি না।কোথায় গেলো। এটা কি?চিঠি মনে হচ্ছে। তমাল, গতকাল আমাদের বিবাহবার্ষিকী ছিলো। তোমার কোনদিন কিছুই মনে থাকে না। নিজ হাতে সব সাজিয়েছি। রান্না করেছি তোমার পছন্দের। তুমি এলে না। কি সুখ পাও কষ্ট দিয়ে। চলে গেলাম তোমার জীবন থেকে। সত্যি বলছি কোন রাগ নেই তোমার উপর।আমি ব্যর্থ। ব্যর্থতার সব দায়ভার আমার। খোঁজার চেষ্ট করো না।পাবে না আমায়। ভালো থেকো। রূপ কি করেছি আমি।রূপ আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমি এসব ইচ্ছে করে করি।তোমাকে হারানোর ভয়ে।আমার সত্যটা জানলে তুমি হয়ত আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।ইচ্ছে করেই কষ্ট দেই।তাই তো আমি যা চেয়েছি সেটাই হলোতাহলে মানতে পারছিনা কেন?আমার তো খুশি হওয়ার কথা। সত্যি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। ফিরে এসো রূপ।

-আরে তমাল।
– আপা রূপ এসেছে?
– কেন?আসেনি তো।আসার কথা ছিলো?
– না আপা। আসলে ও কিছু না বলে কোথায় যেন চলে গেছে।আমার পরিচিত সব জায়গায় খুঁজেছি।পাইনি।
– কি বলো এসব।আমার বোনটা কোথায় গেছে?  কি হয়েছে?
– আপা সব আমার দোষ। আমাকে মাফ করবেন।
– আরে সেটা তো কথা না।রূপ কোথায় গিয়েছে? আমি ছাড়া ওর কে আছে? আসলে তো আমার কাছেই আসবে।
– জানি না আপা।ওর তো তেমন বান্ধবী ও নেই। কোথায় খুঁজবো? আচ্ছা আমি গেলাম। খবর পেলে জানাবো আপনাকে।
– ভাই আমার একটাই বোন। ওকে ছাড়া আমরা কিভাবে থাকবো?
– আপনি চিন্তা করবেন না।

ওকে আমি আমার কাছে ফিরে আনবো। অনেকদিন তো হয়ে গেলো।এবার ফিরে এসো রূপ। আর শাস্তি দিও না। আমি বেঁচে আছি মরার মত। তোমাকে ছাড়া এই জীবন জীবন না। আমি তোমাকে ছেড়ে বড্ড কষ্টে আছি।

– কি ব্যপার তমাল সাহেব?অনেকদিন খেয়াল করছি।মনমরা হয়ে থাকেন।
– কিছুনা স্যার।
– কোন ঝামেলা হয়েছে?
– না স্যার।
– তাহলে আপনার পরিবার ঠিক আছে?
– না মানে ইয়ে,,,,,
– আরে খুলে বলুন।আপনার সাথে কি স্যারের সম্পর্ক? আমি আপনাকে ছোট ভাই হিসেবে জানি। বলুন তো।
– স্যার,,,,,,
– এই ব্যপার।বুঝলাম। রূপ মানে আপনার ওয়াইফ এখন কোথায় আছে? জানেন না?
– না স্যার। জানলে তো নিয়ে আসতাম।
– মন খারাপ করবেন না। এক কাজ করুন।আপনি কয়দিনের ছুটিতে যান। রূপ কে আগে খুঁজে বের করুন।তারপর কাজ। আরে আগে নিজের জীবন। তারপর প্রোফেশনাল লাইফ।
– ধন্যবাদ।
– ইটস্ ওকে।

এতো খুঁজলাম সব পরিচিত জায়গায়।কোথাও পেলাম না। কোথায় আছো তুমি? হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। এটা কার নাম্বার? চেনা নাম্বার তো মনে হচ্ছে না। ধরি হয়ত হয়ত রূপ ফোন দিয়েছে।

– হ্যালো আপনি কি তমাল বলছেন?
– জ্বি।আপনি?
– আপনি আমাকে চিনবেন না।কিন্তু আমি আপনাকে ভালো করে চিনি।আমি আয়েশা।রূপের বন্ধু। ওর কাছে আপনার কথা এতো শুনেছি।আপনাকে আমার মূখস্ত হয়ে গেছে।
– আচ্ছা রূপ কোথায়?
– ও আমার কাছে।আমি সবকিছু জানি।

রূপ আপনাকে খুব ভালোবাসে।আমার কাছে আসার পর থেকে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে আপনার জন্য।
আমার খুব খারাপ লাগে।আবার আমাকে আপনার কাছে খবর দিতে মানা করে।ওর এই অবস্থা দেখে সহ্য হলো না।ওর মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার নিয়ে ফোন করলাম। প্লিজ ওকে নিয়ে যান।ও আপনাকে ছাড়া হয়ত বাঁচবে না।

– আপনি ঠিকানা দিন। আমি এখুনি আসছি।
– জ্বি আচ্ছা।
– ধন্যবাদ।

আমি জানতাম খবর পাবো।ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।কখনো না কোনদিন না।

– তুমি এখানে তমাল।
– হ্যাঁ।শাস্তি আছে তোমার। আমাকে ছেড়ে আসার।
– আমি কি ইচ্ছে করে এসেছি।তুমি তো আমাকে ভালোই বাস না।আমার থেকে কি লাভ?
– রূপ আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কষ্ট দেই।

একটা সত্যি তোমার কাছ থেকে গোপন করে আসছি।সত্যি টা জানলে তুমি হয়ত আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।নিজেকে তোমার কাছে ছোট করতে চাইনি সত্যি টা বলে।কষ্ট দিতাম যেন কষ্ট পেয়ে চলে যাও।কিন্তু তুমি যাওয়ার পর বুঝলাম।তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

– কি সত্যি তমাল?
– বলবো আজকে বলবো।তারপর তুমি চাইলে চলে যেতে পারো।বাধা দিবো না।
– আরে বলো না।
– আমাদের বিয়ে হলো চারবছর। তুমি বাচ্চার জন্য পাগল হয়ে থাকো।বারবার তুমি আমাকে ডাক্তার কাছে যেতে বলো।

আমি যেতে চাই না।তোমার কোন সমস্যা নেই আমি জানি। গতবছর তোমাকে না জানিয়ে আমি ডাক্তার কাছে যাই।মনের সন্দেহ থেকে।অনেক টেস্ট করিয়ে চলে আসলাম। পরদিন সকালে রাজ্জাক আঙ্কেল এর একটা ফোন আমার জীবনটাতে পঙ্গুত্ব দান করলো। ডাক্তার এর মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী আমি কোনদিন বাবা হতে পারবো না। আমি আঙ্কেল কে মানা করেছি তোমাকে কিছু না বলতে।
তাই ওনি কিছুই বলেনি। আমিও আস্তে আস্তে সব মেনে নিলাম। নিজেকে তোমার কাছে ছোট করবো না।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিবো।যেন আমাকে ছেড়ে যাও।কিন্তু পারিনি তোমাকে ছাড়া থাকতে। রূপ জানি না তুমি কি করবে? আমাকে ক্ষমা করো।

– আমি শুধু তোমাকে চাই তমাল আমার আর কিচ্ছু দরকার নেই বিশ্বাস করো আমার শুধু তোমাকে হলেই চলবে।
তুমি আগে এসব বললেও আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। এখন তো অভিমান করে এসেছি। যেন আমার শূন্যতা তুমি বুঝতে পারো। আমার যদি এমন হতো তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে?

– না রূপ। কখনো না।
– তাহলে আমি কি করে যাবো? তুমি কি করে ভাবলে?

উত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না। বুক ফেটে কান্না এলো।মনে হলো এটা সুখের কান্না। ওর এই সীমাহীন ভালবাসার কাছে আমি খুবি নগণ্য। কোথায় রাখবো ওর এতোটা ভালবাসা। কি দিয়ে শোধ করবো আমি। সুখের কান্নাটা আর থামাতে পারলাম না। চোখের সামনে থাকা স্বর্গটার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদলাম। ও হাত দিয়ে চোখের জল টুকু মুছে দিল। ওকে হয়তো মা হবার সুখটা কোন দিনও আমি দিতে পারবো না। তবে আমার শেষ নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত এক বিন্দু কষ্ট পেতে আর দিবো না ওকে। তাতে আমার মরন হলেও হাসতে হাসতে মেনে নিবো সেই মরণটাকে। আমি ভালবাসি রূপ। অনেক বেশি ভালবাসি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত