স্মরণ

স্মরণ

খালি শরীরে দুলাল কে অনেকটা অ্যাথলেটদের মত লাগে । পাড়া গাঁয়ের ছেলে কিন্তু অনেক পেশীবহুল শরীর। টানটান বুক অনেক লম্বা গড়ন। সেই দুলাল কিন্তু একেবারে গরীব ঘরের ছেলে। দুবেলা খাবারের জন্য তাকে ছুটতে হয় নানা কাজে। কাজে ফাঁকি কি জিনিস তা দুলাল জানেনা। দুলাল ভাবে আমি কাজ করি মালিক তাতে আমাকে যা দেয় তা দিয়ে আমার বাবা মা খাবে আমি খাব তাই ফাঁকি দিলে সেই খাবার হালাল হবে না । সে কথা নাকি এক হুজুর তাকে বলেছে। সে কথার পর থেকে যেখানে কাজ করে অনেক মনোযোগ দিয়ে কাজ করার চেস্টা করে ।

দুলালের বাবা আকরাম আলী একজন দরিদ্র কৃষক । তার সামান্য কিছু জমি আছে, তাতে তার সংসার চলে না । আকরাম আলীর সাত ছেলে দুই মেয়ে । মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে তার যা কিছু ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এখন বাপ বেটা মিলে অন্যের জমিতে কাজ করে যা পায় তাতে তাদের সংসার কোনমতে চলে। দুলাল ইদানিং ভাল কামাই রুজি করে। ছেলেটার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। এসব নিয়ে অনেক বেশী ভাবেন ইদানিং আকরাম আলী । অন্য ছেলে গুলো এখন ও কাজের লায়েক হয় নাই । তাই তাদের কে কাজে লাগানো যাচ্ছে না । ছোট দুই ছেলে আবার লেখাপড়া শিখবে বলে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। সংসারের কথা ভাবলে খারাফ লাগে আকরাম আলীর। আগের দিন গুলো কত ভাল ছিল। গোলাভরা ধান ছিল । তার বাবার সংসার অনেক ছোট ছিল। কিন্তু নিজের সংসার অনেক বড়।

চারদিকে মাঠে ঘাঠে অনেক পানি তাই কাজ কাম কিছু নাই । দুলালের সেদিকে খেয়াল দেবার সময় কোথায়। বর্ষা এলে দুলালের মনে অনেক আনন্দ। বর্ষা এলেই ফসলের মাঠ সব পানিতে তলিয়ে যায় । নদির জোয়ারের পানি আসে নিয়মিত। এছাড়া সারাদিন ঝর ঝর ধারায় ঝরে বর্ষার বৃষ্টি ধারা। চারদিকে পানিতে থই থই করে। গ্রামের ছেলেপুলে পানিতে লাফালাফি করে অনবরত। চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করে। পানিতে শাপলা ফুটে । শাপলা ফুল দুলালের একটা প্রিয় জিনিস। দুলাল সৌন্দর্যের জন্য শাপলা ভালবাসে না। সে ভালবাসে টাকার জন্য।সকাল বেলা শাপলা তুলে গঞ্জে নিয়ে গেলে কিছু টাকা পাওয়া যায়। তাতে তাদের পরিবারের জন্য একসের আটা কেনা যায় । যা দিয়ে তাদের সংসারের সকলের দুপুরের খাবার হয়ে যায়।আটার রুটির সাথে হেলেঞ্চা শাক ।অতি উপাদেয় ও লাগে তাদের কাছে । খালি পেটা থাকার চেয়ে এটা অনেক বেশী সুস্বাদু মনে হয় তাদের । সৌন্দর্য কে তারাই ভালবাসে যাদের পেটে ভাত আছে। যারা দুবেলা খাবার জুটাতে অনেক কস্ট করে তাদের কাছে সৌন্দর্য মুল্যহীন ।

গেল দুবছর ধরে বর্ষা এলে তাদের তেমন কস্ট হয়না । আগের বর্ষা গুলোতে সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে না খেয়ে কাটাতে হত।কিন্তু এখন বর্ষা এলে অন্তত না খেয়ে থাকতে হয়না। বর্ষা এলে বরঞ্চ একটু ভাল খাবার জোটে প্রতিদিন। বর্ষা আসার আগে থেকেই দুলালের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গঞ্জ থেকে সুতা কিনে এনে বাবার সাথে মিলে জাল বুনে। এই জাল বুনাতে তার মা রহিমা অনেক সহজোগিতা করে। নিজে ও সময় করে অনেক সময় জাল বুনে। বর্ষার পানিতে নতুন মাছ আসে দুলাল সেই মাছ নানা ভাবে শিকার করে মনের আনন্দে। নিজেরা ও খায় আবার মাছ বিক্রী করে ভালই টাকা পয়সা হাতে আসে। পাশের গ্রামের মফিজ মিয়া তাকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল। এক বর্ষায় বাড়ীতে কোন খাবার ছিল না । পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে সেদিন মফিজ মিয়ার দোকানে গিয়েছিল কিছু বাকীতে আনার জন্য। তখন মফিজ মিয়া তাকে বলেছিল আমি আর কতদিন বাকী দিমু। নিজে কিছু কাম কাজ কর। জবাবে দুলাল বলেছিল ,কি কাজ করব চাচা এখন তো জমিতে পানি কে কাম দিব।
দূর মিয়া এইডা কোন কথা হইল।খালে বিলে মাঠে কত মাছ। মাছ মার। মাছ বেছো । তাইলেই তো টাকা আইব।
লোকে কি বলবে চাচা মিয়া ।

কি বলবে মানি । না খেয়ে থাকার ছেয়ে লোকে কি বলবে শুনলে কি পেট ভরবে ভাতিজা।এছাড়া মাছ বিক্রি করলে এখন কেউ আর চাঁড়াল হয়না ।

সেইবার থেকে মাঠে জালপাতা,খালের মাঝে বাতা দিয়ে বেড় দেওয়া,বড়শী দিয়ে মাছ মারা,নানা ভাবে মাছ শিকার করতে থাকে দুলাল। এবার বর্ষা একটু আগেই এসে গেছে। এবারের প্রস্তুতিটা ও বেশ ভাল। চারখান কারেন্ট জাল এবার সংরহ করেছে , সেই সাথে আছে গেলবারের পুরানো বেশ কয়টি সুতী জাল। এছাড়া আছে অনেক গুলো বঁড়শী । বঁড়শী দিয়ে সবসময় মাছ পাওয়া যায় না । যেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয় সেদিন এই বঁড়শী গুলো বেশ কাজে আসে।বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রক্রিয়াটা বেশ দারুন । স্থানীয় ভাষায় এই বঁড়শী কে টাঙ্গা বরি বলে। একহাত লম্বা বাশের কঞ্চির মাথায় একহাত লাম্বা নাইলনের সুতার মাথায় গঞ্জ থেকে কিনে আনা বঁড়শী গাঁথা হয়।এভাবে প্রায় একশ বঁড়শী গেঁথে ঘরের কোনায় রেখে দেয় দুলাল । যাতে করে যেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হবে সেদিন যেন এগুলো পাততে পারে তাড়াতাড়ি। কাল রঙের বড়শীর মাথায় কেঁচো লাগাতে হয়। কেঁচো তুলার কাজটি তেমন কঠিন নয়। এটা দুলাল পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ করে ফেলে।

প্রথমে এক লোটা পানির মাঝে বিশাল্যকরন্যে ( বিষকাটালি ) পাতাকে পা দিয়ে দলাই মলাই করে চুবাতে হয়। তার পর কেঁচোর মাটি দেখে সেখানে সেই পানি ঢাললে কেঁচো মাটির তলা থাকে বেরিয়ে আসে সুরসুর করে। কেঁচো গুলকে ছোট ছোট করে কেটে বড়শিতে গেঁথে খালের ধারে পুতে দেয় দুলাল। নতুন পানিতে আসা মাছগুলো সেই খাবার খেতে গিয়ে বড়শিতে আটকে পরে।
আষাঢ় মাস শেষ হয়ে গেছে । এখন শ্রাবণ মাস। মাঠের মাঝে অনেক পানি । সেই পানিতে অনেক মাছ। প্রতিদিন অনেক মাছ ধরা পড়ছে দুলালের জালে। তা বিক্রি করে ভাল পয়সা আসছে হাতে। দিনরাত প্রতিনিয়ত সে মাঠের মাঝে মাছ মারছে , মনের আনন্দে। অথৈ পানির মাঝে জাল পেতে ভালই মাছ পায় দুলাল।

গতকয়দিন রাতের বেলা বেশ মাছ ধরা পড়ছে জালে। তাই বার বার পানিতে নামতে হয়। দুলালের মা বারবার বলে – বাবা এত রাতে পানিতে নামার দরকার নাই বাবা। সকালে যা পাস তাতেই তো চলে। এতবেশির কি দরকার।
চুপ কর বুড়ী। এইতো কয়টা দিন তারপর আর মাছ আসবে কোথা থেকে।

নারে বাপ রাত বিরাতে বাইরে যাওয়া ভাল না। তাই বলছি সাবধানে চলাপেরা করিস।রাতের বেলা কত কিছুর ভয়।
আরে বুড়ী তুই চিন্তা করিস না। আমার কিছু হবে না ।

(২)
আজ শনিবার । সকাল থেকে আকাশ মেঘে ডাকা । আলো আধারির সহবাস্থান। এই রোদ এই বৃষ্টি । দুলাল বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেল লাইনের পুলের উপর বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে ,মনের আনন্দে। দুলালের মনে আজকাল দোলা লেগেছে । পাশের বাড়ীর মেয়ে আমিনাকে তার মনে ধরেছে কতদিন। বলি বলি করে বলা হয়নি মনের কথা আজো।বাপ তার বিয়ার জন্য মেয়ে দেখছে। অথচ চোখের সামনে যে পড়ে আছে ,তাকে দেখে না বুড়া। আজ রাতে আমিনার সাথে কথা বলার একটা সুযোগ আছে। আমিনার বাবা বলেছে আজ যদি বড় মাছ মিলে তাহলে তা যেন তাকে দেওয়া হয়। আজ বড় ফাঁস জালগুলো সকাল থেকে মেরামত করে রোদে শুকাতে দিয়েছে। সন্ধ্যা নেমে এলেই মাঠের মাঝখানে পাতবে। এই বর্ষা শেষে বিয়ে এবার করবেই। মনে হাসছে দুলাল। আমিনা কি তাকে পছন্দ করবে । কেন পছন্দ করবে না , সে জোয়ান মর্দ কাম কাজ সবই করতে পারে । তাকে পছন্দ না করে যাবে কোথায়। গতকাল ভালদামে মাছ বেছেছিল । সেখান থেকে কিছু পয়সা সরিয়ে আমিনার জন্য দুইখান চুলের পিতা কিনেছে আজ রাতে দিবে বলে। মাসাল্লা আমিনার যা চুল একেবারে কোমর পর্যন্ত । এই চুলে বেনী করলে আমাইনার বেশ লাগে ।আমিনা দেখতে একটু কালো তাতে কি , তার চোখ দুটিতে কেমন মায়াভরা। গতপরশু আহসান ভাইয়ের বউয়ের সাথে বসে চুলে তেল দিচ্ছিল তখন দুলাল সেখানে জাল পরিস্কার করছিল। আহসান ভাইয়ের বউ জিজ্ঞেস করেছিল – মিয়া কেমন মাছ মারেন । একটা ও তো দেননা। আরে ভাই সব একা খাইয়েন না মাঝে মাঝে আমাগোরে ও কিছু দিয়েন। একসময় আমরা বহুত কামে আইমু।সে কারনে গতকাল একটা কারপিঊ মাছ আহসান ভাইয়ের বউ কে দিয়েছে। মাছ দেখে আহসান ভাইয়ের বউ বলে উঠল – কি ব্যাপার ঘুষ দেও নাকি দেওরা।

আরে না এমনি দিলাম।
এমনি না মিয়া। বুঝছি কি কারনে দিতাছ, তয় আগে কইবা না। দেখি একখান সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা।
তা অইলে তো আর কথা নাই ভাবি।
ঠিক আছে দেখবনি ।
চাচীরে কইমু নাকি, ঘরের কাছে বউ ঘুরে দেখতে পায়না ক্যান।
যা ভাল মনে করেন তাই কইয়েন ।

এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে চারদিকে।রাস্তার মেঠোপথে লোকজন তেমন নাই। কেমন ভুতুড়ে একটা নিস্তব্দতা। সেই নিস্তব্দতা বেদ করে মাঝে মাঝে দুরের নদী থেকে ভেসে আসে কোন মাঝীর মায়াবী সুরের গান। সূর্য পাটে নেমেছে কিনা বুঝার উপায় নাই। ঘড়ি থাকলে সময় বলা যেত।দুলাল সে আঁধারের পথ ধরে চলে মাঠের পানে। মাঠে যেতে হলে মীর্জা বাড়ীর জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়। মীর্জা বাড়ীর জঙ্গলের কাছে এলে কেমন যেন ভয় করে দুলালের। বুঝে উঠতে পারে না কিসের ভয়। জিন ভুতের কথা অনেক শুনেছে বাপের কাছে সেগুলো মনে পড়ে যায়। তখন ভয় আরো দিগুণ হয়ে যায়। একটার পর একটা বিড়ী ফুঁকে মীর্জা বাড়ীর জঙ্গল পার হয়। বর্ষার পানি ততটা ঠাণ্ডা নয়, তবে বেশ চুলকায়। সে কারনে কেরসিন মেখে এসছে দুলাল। বাম পায়ের তলায় কয়দিন ধরে কেমন একটা গাঁ হয়েছে, সেখানে খুব চুলকায় । তেনা দিয়ে বেঁধে রেখেছে শক্ত করে।কোমর সমান পানিতে নেমে যায় দুলাল। বাশের খুঁটির সাথে জাল জুড়ে দেয়, একেক জায়গায়। এরপর পাড়ে উঠে আসে। এখন মাঝরাতে আবার আসতে হবে মাছ ফেঁসেছে কিনা জালে। জালে ফাঁসা মাছ সকাল পর্যন্ত থাকলে পচে ফুলে উঠে। সেই মাছ কেঊ কিনতে চায় না। নিজেরা খেয়ে ও তেমন ভাল লাগে না । তাই রাতে কমপক্ষে একবার মাঠের পানিতে নামতে হয়। মাঠের পশ্চিম মাথায় খাল। সেই খালে নদী থেকে পানি আসে । আর সেই পানির সাথে নদী থেকে আসে রুই , কাতলা, কারফিউ, সরপুঁটি নানা জাতের বড় বড় মাছ। এসব মাছ পুকুরের চাষ করা মাছের চেয়ে অনেক সুস্বাদু। মাছের শরীরে তেল চকচক করে।হাওড়ে বিলে অবাধে বিচরন করে এসব মাছ অনেক বড় এবং পুষ্ট হয়ে উঠে । বাজারে এসব মাছের চাহিদা অনেক।সবাই এই মাছ কিনতে চায় বর্ষায়।

রাত পৌনে এগারটার দিকে দুলাল মাছ দেখার জন্য মাঠের দিকে যেতে থাকে। যাবার আগে আমিনাদের বাড়িতে যায়। আমিনার বাবা কে বলে –চাচা মিয়া যাইতাছি , দেহি আপনের ভাগ্যো কি মিলে।
সাবধানে যাইস,
আচ্ছা চাচা মিয়া।ঘরের এদিক উদিক তাকায় দুলাল কিন্তু যা খুজে তার চোখ তার দেখা নাই।
আমেনাদের বাড়ী থেকে বাইরে যাবার পথে কে যেন নিচু গলায় ডাকে।
এত রাইতে মাছ মারার কি দরকার। ঘুমনাই খালি মাছ আর মাছ।
এতক্ষণে বুঝতে পারে দুলাল। কে কথা বলছে নিচু স্বরে ।বুঝতে পারে ভাবীরে দেওয়া মাছ বিফলে যায় নাই ।
আরে রাইত কই। হবে তো হাঞ্জ রাইত
তারপরে ও রাইত বিরাতে মাছ ধরা ভাল না ,ভাবি কইছে মাছের লগে দেও থাহে
আর কি কইছে ভাবী
যা!আমার শরম করে।
কোমর থেকে ফিতা দুইখান বাহির করে আমিনার হাতে গুঁজে দিল। আর বলল – ভাবীর কাছে গিয়া কাইল বেনী বাঁধিস ।
আই অহন যাই
আছা সাবধানে।
ঠিক আছে।

আমিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুলাল মাঠের দিকে ছুটল। কোমরে গামছা বাঁধা পরনে সান্ডু গেঞ্জী। মীর্জা বাড়ীর জঙ্গল পেরিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে দুলাল। মীর্জা বাড়ীর জঙ্গলের মাঝে ভাঙ্গা কুঠুরিতে তাদের গ্রামের ছয় সাত জন জুয়া খেলছে , এই ঝড় বাদলের দিনে। দুলালের পায়ের পদশব্দ শুনে কেউ একজন বলে উঠল -কে যায়?
আমি দুলাল , মাঠে যাই, মাছ দেখতে
এত রাইতে কেনরে যাস তুই, তোর ঢর ভয় লাগে না।
এইতো কয়েকটা দিন।
যা। তবে ফিরে যাবার সময় বইল্যা যাইস।
ঠিক আছে ।বলে দুলাল মাঠের দিকে চলে গেল। জুয়াড়িরা আবার জূয়া খেলায় মনোনিবেশ করল।

অন্ধকার নিকষ কাল রুপ ধারন করে আছে চারদিক। কিছু ঝি ঝি পোকার চি চি শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। চারদিকে পানির স্রোত বয়ে যাওয়ার কলকল শব্দ শুনা যাচ্ছে অনবরত। মাঝে মাঝে পানিতে কোন মাছ কিংবা অন্য কিছুর ছলাত ছলাত শব্দ হয়। শব্দের মাঝে কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব । মনে সাহস নিয়ে মাঠের পানিতে নামে দুলাল। মুখে ধরা বিড়ী। বিড়ী মুখে থাকলে শরীরে অনেকটা সাহস থাকে । কিছু কচুরি পানা ভেসে এসে পেতে দেওয়া জালের সুতার সাথে আটকে আছে। এই কচুরি পানার চাক গুলো দেখলে দুলালের খুব বিরক্ত লাগে। কারন সাবধানে একেকটা চাক সরাতে তার বেশ সময় লেগে যায়। তারপর ও ধৈর্য ধরে দুটি চাক সরাল। একটা জালে বেশ বড় একটা মাছ ফেঁসেছে দেখে বেশ খুশি হল দুলাল। এর পাশে আরেকটা কচুরি পানার চাক দেখে বেশ বিরক্ত বোধ করল। এবার তাচ্ছিল্যোর সাথে বামহাত দিয়ে কচুরি পানার চাকটা সরাতে গেল।আর অমনি করে মাগো শব্দে চিৎকার করে উঠল।কচুরি পানার চাকে একটা সাপ বসেছিল । দুলালের হাত যখন পানার চাকে সাপের শরীর স্পর্শ করে , তখনি সাপ তার স্বভাবজাত ভাবে কামড় বসায় হাতে ।

সাপটা তার হাতের কব্জির নিছে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। সারা শরীর বিষে টনটন করে উঠল।চোখে সর্ষে ফুল দেখতে ফেল। ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে মুঠি করে ধরে পাড়ে উঠে এল কোনমতে। এরপর কোনমতে মীর্জা বাড়ীর জঙ্গলের কাছ পর্যন্ত আসতে পারল। যেখানে বসে লোকগুলো জুয়া খেলছিল তার সামান্য দূরে ঝপাস করে পড়ে গেল । জুয়া খেলায় মগ্ন লোকগুলো বাইরে এসে দেখল দুলাল কে। তারা দুলাল কে ধরা ধরি করে মফিজ মিয়ার মুদি দোকানের কাছে নিয়ে এল। বর্ষার রাত এখন বৃষ্টি পড়ছে দুলালের সারা মুখায়াব নীল রঙ ধয়ারন করে ফেলেছে। সবাই বুঝতে পারল সাপে কেটেছে। এক বুড়ো দুলালের বাম হাতের ক্ষত চিহ্নটা দেখতে পেল। পুরো গ্রামের মানুষ জেগে গেল নিমিষেই । ঝড় বাদলের তোয়াক্কা না করে সবাই দুলাল কে দেখতে চলে এল কাদামাটি মাড়িয়ে। আমিনা ভাবীর গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল সাবার অগোচরে । কেউ ওঝা আনতে ছুট দিল । কেউ দুলালের শরীরে ঝাড়ফুঁক করতে লাগল । শহর থেকে আসা কালাম সাহেব সবার আগে শক্ত করে হাত বাঁধলেন তার পর ভ্যান গাড়ীতে উঠিয়ে চার কিঃ মিঃ দূরে সরকারী হাসপাতালের দিকে ছুটলেন……………। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার দুলাল কে মৃত ঘোষনা করল।


আমিনা দুলালের কবরের পাশে এসে মাঝে মাঝে কাঁদে লোকচক্ষুকে ফাকি দিয়ে। অনেকে বলে সাপে কাটা মানুষ নাকি সাত দিন বেঁচে থাকে। এটা গ্রামের মূর্খ লোকের বিশ্বাস । কিন্তু আমিনা জানে যে চলে গেছে সে আর ফিরে আসবে না । তারপর ও প্রতিদিন মাথায় বেনী করে কবরের কাছে কেন আসে সে জানে না। সপ্তাহ বাদে পাশের গ্রামের মিন্টুর সাথে তার বিয়ে । সবাই বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত । বর্ষার বর্ষণ এখন ও পুরোপুরি থামেনি । আগামী বর্ষায় কেউ হয়ত দুলাল কে মনে রাখবে না । কিন্তু প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা আমিনাকে দুলালের কথা স্নরন করিয়ে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত