মায়ের একমাত্র সম্বল

মায়ের একমাত্র সম্বল

–আম্মু ভিতরে আসবো?
–আয় বাবা!

অনুমতি নিয়ে আম্মুর রুমে ঢুকলাম, আম্মুর পাশে বসতে বসতে বললাম-
–একটা খুশির খবর আছে আম্মু, তার আগে বলো তুমি কেমন আছো? শরীর ভালো আছে তো?
আম্মু আমার প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন-
–জানিস বাবা মেহরাব? তোর বড় ভাইয়াও আগে প্রতিদিন আমাকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞাস করতো,, অফিস থেকে ফেরার সময় এটা সেটা আমার জন্য নিয়ে আসতো কিন্তু এখন দেখ, একিই বাসায় থাকার পরেও ১৩দিন হয়ে গেলো আমি আমার ছেলেটার মুখ দেখিনি যদি ঠিকমতো হাঁটার শক্তি আল্লাহ আমাকে দিতেন, তাহলে ওর রুমে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসতাম, বড্ড ইচ্ছা হয় ছেলেটাকে দেখতে!

কথাগুলো বলার সময় আম্মুর চোখের দিকে তাকালাম, দেখলাম আম্মুর চোখটা পানিতে ভরে গেছে… ৩দিন আগেই “বড় ছেলে” নামে একটা নাটক দেখে খুব বেশি আফসোস করছিলাম,, ইশশ… বিয়ের পর বড় ছেলেরা কি’রকম বদলে যায় ওটা কেনো দেখানো হলোনা? মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগের কথা, ভাবিকে ডাক দিয়ে আম্মু বলছিলেন-

–বউমা, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাওতো মা, ঔষধ খাবো!
কথাটা শুনে ভাবি রাগ করে আম্মুর রুমে এসে বললেন-

–নিজে উঠে গিয়ে পানি খেতে পারেন না? আমাকে কি আপনার চাকরানি বানিয়ে এই বাসায় আনা হইছে? এই বুড়ো বয়সে কেনো আমাকে আর আপনার ছেলেকে জ্বালাচ্ছেন? দয়া করে একটু শান্তি দিন আমাদের!

কথাগুলো বলে ভাবি রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন,, আমি পাশের রুম থেকে সব শুনেও কিছু বলতে পারলাম না, পরিবারের বেকার ছোট ছেলেদের সবকিছু শুনেও না শুনার ভান করে থাকতে হয়। আমি আম্মুর রুমে গিয়ে দেখলাম আম্মু পানি নেওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠার অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা… আমি টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি আম্মুর দিকে বাড়িয়ে দিলাম… আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওনার চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে,, আম্মুর চোখে পানি দেখে তখন আমার কেমন লাগছিলো সেটা বুঝাতে পারবনা আমি তাড়াতাড়ি আম্মুর হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম… বয়স বেড়ে গেলে গেলে জন্ম দেওয়া মানুষটাও কতোটা অসহায় হয়ে যায় সেটা আম্মুকে না দেখলে বুঝতাম না… ভাবি প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে আম্মুকে কথা শুনায়,, মনে মনে ঠিক করলাম ভাইয়াকে বিষয়টা জানাতে হবে, দেখি ভাইয়া কি বলেন!

সন্ধ্যায় ভাইয়া বাসায় আসলেন আমি ওনার রুমের সামনে গিয়ে বললাম-
–ভাইয়া আসবো?
–আয়, কিছু বলবি?
–হুম কিছু বলবো… ভাইয়া, ভাবি প্রতিদিন আম্মুকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে, যেটা শুনে আম্মুর অনেক কষ্ট হয়… আজকে জানো কি হইছে? ভাবিকে আম্মু ডাক দিছেলেন~
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-
–মেহরাব, সারাদিন বেকার বসে বসে ভাবির দোষ না খুঁজে একটা চাকরির খুঁজ কর… আর আম্মু তো বুড়ো হয়ে গেছেন তাইনা? কতোদিন বুড়ো মানুষের জ্বালাতন সহ্য করবে বল?
ভাইয়ার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই… কিছু সময় ভাইয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি… ভাইয়াকে অনেকগুলো কথা শুনাতে ইচ্ছা করলো, কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না… পরিবারের বেকার ছোট ছেলেদের কিছু বলতে হয়না, সবকিছু নীরবে সহ্য করে নিতে হয়… আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম-

–ঠিক আছে ভাইয়া, আমি তাহলে এখন যাই?
–আচ্ছা যা!
ভাইয়ার রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, দরজার সামনে এসে আবার ভাইয়াকে ডাক দিয়ে বললাম-
–ভাইয়া আম্মুর ঔষধ আনছো?
–না’রে, একদম ভুলে গেছি!
–ভাবির কিছু আনতে কোনোদিন কিছু ভুলে গেছো?

ভাইয়া আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে রাগ করে তাকালেন,, আমি মিথ্যা একটা হাসি দিয়ে ওখান থেকে চলে আসলাম… লাস্ট ৫-৬দিন ধরেই ভাইয়াকে বলছি আম্মুর ঔষধ শেষ, ফিরার সময় যাতে ঔষধ নিয়ে আসে… কিন্তু প্রতিদিন ফিরার পর ভাইয়ার একটাই উত্তর “ভুলে গেছি”… ভাগ্যিস ২টা টিউশনি করাই, টিউশনির টাকা দিয়ে যতোটা সম্ভব আম্মুর ঔষধ কিনার চেষ্টা করি… পরিবারের বড় ছেলেরা বিয়ের পর কেনো এমন বদলে যায়? সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি খুঁজে পাইনা…!!

–কি’রে বাবা মেহরাব? বললি একটা খুশির খবর শুনাবি, ওটা না বলে কোথায় হারিয়ে গেলি??
(আম্মু আমার গালে হাত দিয়ে কথাটা বললেন)
আম্মুর হাতের স্পর্শ পেয়ে বাস্তবে ফিরে আসলাম, আম্মুর হাতটা ধরে বললাম-
–আম্মু… খুশির খবর হচ্ছে যে, আমি একটা চাকরি পাইছি, মোটামোটি ভালোই বেতন… আমি আজকে থেকেই নতুন একটা বাসা খুঁজা শুরু করবো… তোমাকে এই জাহান্নামের মতো বাসায় থাকতে হবেনা…!!
কথাটা শুনা মাত্রই আম্মুর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পেলাম,, সাথে সাথে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন-
–আলহামদুলিল্লাহ বাবা, অনেক খুশি হইছি…!!
–আজকে টিউশনি থেকে আসার সময় বাসা খুঁজা শুরু করে দেবো আম্মু,, এখন আমাকে টিউশনিতে যেতে হবে, আমি যাই আম্মু? পরে এসে কথা বলবো…!!
–ঠিক আছে বাবা, তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস…!!

বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিলাম… উদ্দেশ্য মিহিদের বাসা,, মিহি… মিহির ছোট ভাই রাহাতকে পড়াতে গিয়েই মিহির সাথে পরিচয়,, প্রতিদিন দেখা হওয়ার ফলে আমাদের মধ্যে ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়,, আস্তে আস্তে মনের অজান্তেই আমরা একজন আরেকজনকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি.. চাকরি পেয়েছি সেটা অবশ্য মিহিকে সবার আগেই ফোন করে বলছি, এখন ওদের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো রাহাত আর ওদের বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া…!!

কলিংবেল চাপতেই মিহি দরজা খুলে দিলো, মিহির দিকে তাকানোর সাথে সাথে আমি অনেকটা অবাক হলাম… মিহিকে আমি ঠিক চিনতে পারছিলাম না,, ফ্যালফ্যাল করে অনেক সময় তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে!
–বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? রুমে আসবেনা??
মিহির কথা শুনে ঘোর কাটলো আমার, আমতা আমতা করে বললাম-
–ও হ্যা, আসছি!
–তোমার কি কিছু হয়েছে মেহরাব?
–কই? কিছু নাহ!
–মিথ্যা বলা মহাপাপ জানোনা? আচ্ছা আমি বলি কি হয়েছে?
–বলো?
–আমি আজকে প্রথমারের মতো শাড়ি পড়েছি, তাও আবার তোমার প্রিয় কালারের… চোখে কাজল দিয়েছি খুব যত্ন করে, এটাও তোমার পছন্দমতো.. আর এতে আমাকে খুব সুন্দর লাগছে,, তাই তুমি চোখ নামাতে পারছিলে না, তাইনা?

আমি মিহির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ওর কথা শুনছিলাম, এই মেয়েটা মুখের উপর গড়গড় করে সব সত্য বলে দেয়… আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে টপিক চেঞ্জ করে বললাম-
–তোমার সাথে আমার খুব জরুরী কিছু কথা আছে মিহি..!

–আব্বুর ও তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে, আব্বু ওনার রুমেই আছেন, আব্বু আসতে আসতে তুমি তোমার জরুরী কথাটা বলে ফেলো,, আমি শুনছি!

–মিহি… খুব বড় না হলেও আমার আর আম্মুর জন্য মোটামোটি ভালোই চাকরি পেয়েছি,, আমার বাসায় ভাইয়া-ভাবির অবস্থা তো তুমি জানো,, আম্মু ওই বাসায় কতোটা কষ্টে আছে সেটাও তো জানো, আমি চাচ্ছিনা আম্মুকে আর ওই বাসায় রাখতে… তাই ভাবছিলাম আজকে থেকেই ছোট একটা বাসা খুঁজা শুরু করবো.. রান্না করার জন্য আর আম্মুর দেখাশুনা করার জন্য একটা কাজের লোক ও প্রয়োজন…!!

কথাগুলো শেষ করার সাথে সাথে দেখলাম মিহির বাবা আমাদের দিকে আসছেন… আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে মিহির বাবাকে সালাম দিলাম

–আসসালামু-আলাইকুম আংকেল…!!
–ওয়ালাইকুম সালাম, মিহি মা আমাদের জন্য একটু চা নিয়ে এসো…!!
–ঠিক আছে বাবা…!!
মিহির বাবা মিহিকে কেনো অন্যরুমে পাঠিয়ে দিলেন আমি কিছুটা বুঝতে পারছিলাম, মিহির বাবা সোফায় বসতে বসতে বললেন-
–কেমন আছো মেহরাব?
–জ্বি ভালো, আপনি?
–এই আছি কোনোরকম, দেখো বাবা মেহরাব… আমি পরিষ্কার করেই কথা বলতে পছন্দ করি… তুমি কি মিহিকে ভালোবাসো?
আমি কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম-
–জ্বি আংকেল…!
–যদি মিহিকে ভালোবেসেই থাকো, তাহলে মিহির জন্য তোমাকে তোমার পাস্ট লাইফ ফেলে দিতে হবে,, পারবে?
–বুঝলাম না আংকেল..!

–দেখো বাবা, পৃথিবীর প্রত্যেকটা বাবা তার মেয়ের ভালো চায় তাইনা?? আমিও আমার মেয়ের ভালো চাই, কিন্তু তুমি মন থেকে চিন্তা করে দেখো বাবা, তুমি কি আসলেই আমার মেয়েকে সুখি রাখতে পারবে?? ছোট খাটো চাকরি করে আমার মেয়ের চাওয়া গুলো পূরণ করতে পারবে?? যে মেয়েটা কোনোদিন রান্নাঘরে ডুকেনি, সে কি করে তোমার

ফ্যামেলির সবার জন্য রান্না করবে বলো? যে মেয়েটার যত্ন নেওয়ার জন্য বাসায় ৫টা কাজের লোক, সে কি করে তোমার বুড়ো মায়ের যত্ন নিবে বলো?

আংকেলের কথাগুলো শুনে আমার চোখে ভাবির মুখ ভেসে উঠে, এরকম ই এক বড় ফ্যামেলি থেকে আমার ভাইয়ার বউ হয়ে গেছিলেন তিনি… ভাইয়াকে আলাদা করে দিছিলেন মায়ের কাছ থেকে… মিহিও কি এমনটাই করবে? আংকেল আবারো বললেন-

–দেখো বাবা, প্রেম করার সময় যদি আলাদা হয়ে যাও, তাহলে সেটাকে ব্রেকআপ বলে, ব্রেকআপ করলে প্যাচাপ ও করা যায়… কিন্তু বিয়ের পর ব্রেকআপ বলতে কোনো শব্দ থাকেনা,, যেটা থাকে সেটা হলো ডিভোর্স…!!

আমি আংকেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম-
–আপনি কি চাচ্ছেন আংকেল?
–আমি চাচ্ছি তুমি একেবারে মিহির লাইফে চলে এসো, অথবা একেবারে ওর লাইফ থেকে চলে যাও…!!
আমি বুঝতে পারলাম আংকেল আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন…!!
–ঠিক আছে আংকেল, আমি তাহলে আসি…!!

–তোমার ইচ্ছা, সব ছেড়ে যদি মিহির লাইফে আসতে পারো তাহলে এসো… মিহি অপেক্ষা করবে তোমার জন্য…!!

আমি আংকেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসছিলাম… দরজার কাছে আসতেই পিছন থেকে মিহির ডাক শুনতে পেলাম
–মেহরাব শুনোওও..!
মিহির ডাক শুনে আমি দাড়ালাম, মিহি আমার কাছে এসে বললো-
–কি হয়েছে মেহরাব? এভাবে আমাকে কিছু না বলে চলে যাচ্ছো কেনো?
মিহিকে কিছু বলার ইচ্ছা ছিলোনা, তারপরেও ছোট করে বললাম-
–আমাকে ভুলে যাও মিহি..!
–মানে কি মেহরাব? কি বলছো এসব?
আমি মিহির প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে হাটাঁ শুরু করলাম, মিহি পিছন থেকে কান্না করতে করতে বলছিলো-
–মেহরাবযেওওনা, আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওও…!
আমি মিহির কান্না শুনেও হাটঁতে থাকি… পরিবারের ছোট ছেলেদের সব কান্না শুনতে হয়না…!

আমি আমার ভাইয়া-ভাবিকে কাছ থেকে দেখেছি… ভাইয়াও ভালোবেসে মিহির মতো কোনো এক বড় ফ্যামেলির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন… আলাদা হয়ে গেছিলেন আমার আম্মুর কাছ থেকে… হুম আমি চাইলেই পারতাম আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমার লাইফে নিয়ে আসতে, আমি চাইলেই পারতাম মিহির সাথে জীবন কাটাতে,, কিন্তু বিয়ের পর?? এমন কোনো স্বামী স্ত্রী আছে যাদের মধ্যে ঝগড়া হয়না?? হয়তো আমার আর মিহির মধ্যেও কোনো একদিন ঝগড়া হতো, হয়তো এখনকার মতো ভালোবাসার আবেগটা তখন থাকতোনা… তখন? “তোমাকে বিয়ে করে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল করেছি” ভাবির মতো এই কথাটা মিহিও বলবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে? “হয়তো তোমার মাকে বাসায় রাখো, না’হয় আমাকে” ভাবির মতো মিহিও এই কথাটা বলবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে?
আমি মিহির বাসা থেকে বের হয়ে যাই ডান হাত দিয়ে চোখটা মুছে সব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলি,, আমাকে এখন বাসা খুঁজতে হবে, আমার জন্য আমার আম্মুর জন্য দিনশেষে আমিই আমার মায়ের একমাত্র সম্বল!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত