নাইন এম এম

নাইন এম এম

-তুই কি এগুলা বাদ দিবি না!
-কি বাদ দিবো?
-এই যে মারামারি, খুনাখুনি আর কতকাল চালাবি!
-যতকাল বেঁচে থাকবো।
-প্লিজ এখন এগুলো বাদ দে।
-তোর প্রব্লেম হলে বন্ধুত্ব নষ্ট করে চলে যেতে পারিস।
-সত্যি তুই কখনো বদলাবি না।
-জানিস যখন, বলিস ক্যানো তবে।
-ধ্যাত, গেলাম আমি তুই থাক। কাল আর ভার্সিটিতে আসবো না।
-না আসলে নাই।

নিধি রাগে জ্বলতে জ্বলতে চলে গেলো। অবশ্য তাতে আমার কিছুই নয়। আপন যারা তারাই তো দূরে ঠেলে দিয়েছে।]

রাতে হালকা খাবার খেয়ে কেবলি ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় মেলে দিয়েছি, তখনই নিধির কল। আলসামোর চরম পর্যায়ে প্রথমবার কল রিসিভ করতে ব্যর্থ হলাম। দ্বিতীয়বার কল দিতেই রিসিভ করার সাথে সাথে খেলাম এক ঝাড়ি, “এত্ত সময় লাগে রিসিভ করতে!”
-আচ্ছা সরি, বল এখন।
-আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছিস, পাশে তারা গুলো কি সুন্দর ঝিকিমিকি করছে।

জানালা থেকে পরদা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যি এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। নিমেষেই মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

-হুম, সত্যি খুব সুন্দর লাগছে, রাতের এই দৃশ্যটা।
-ওই আমার না ছাদে বসে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভূতের ভয়ে যেতে পারছি না।
-ঘুমা তবে…
-তুই আয় প্লিজ, তুই থাকলে আমার আর কোনো ভয় লাগবে না।
-এত্ত রাতে, পাগল হইলি নাকি!
-আসবি কি না!
-আসতেছি দাঁড়া।

অতঃপর নিশব্দে হাঁটা দিলাম, নিধির বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিঝুম এক পরিবেশের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছি একলা এক আমি। দুই পাশে গাছপালা। গাছের আড়ালে দেখা যাচ্ছে জোনাকিরা ঝাক বেঁধে চাঁদের সাথে তাল মিলিয়ে আঁধার রাতকে আলোকিত করে তুলছে। এ যেন দৃশ্যে এক অলংকার। জোনাকিদের আলোর খেলা আর ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের গান শুনতে শুনতে নিধিদের বাড়ি পৌছে গেলাম। নিচে দাঁড়িয়ে কল দিতেই নিধি জানালা দিয়ে উকি দিলো। তারপর কল রিসিভ করে…

-ছাদে আয়।
-আসবো কি করে।
-রেলিং বেয়ে ওঠ, কেঁচি গেট খুলতে গেলে সবাই জেগে যাবে।
-দাঁড়া দেখছি।

অতঃপর আমার ঢাইকিলো হাত কাজে লাগিয়ে ছাদে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তারপর ম্যাডামকে কল দিয়ে আসতে বললাম। দীর্ঘ পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর ম্যাডাম নারু, মুয়া, খই নিয়ে ম্যাডাম হাজির হলেন।

-এগুলা ক্যান!
-তোর পছন্দ তাই।
-অবশ্য ভালোই করছিস, সেই ক্ষুধা লাগছিলো।
-হুম। এখন বস, রাতে খাসনি কিছু।
-খেয়েছি, তবে পেটপুরে না।
-আচ্ছা তুই এগুলো খা, আমি আসছি।

বলেই দৌড়ে চলেগেলো। আমি আমার মতন সুন্দর এই দৃশ্যটাকে উপভোগ করে খেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম পায়েস হাতে হাজির।

-আমার জন্য আনছিস?
-হুম, তাও ফ্রিজের ঠান্ডা।
-ওয়াও দে।

তারপর লোভ না সামলাতে না পেরে শুরু করে দিলাম। নিধি এক মায়াবী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর খাওয়া শেষ করে নিধির সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। গল্পের মাঝে হঠাৎ নিধি প্রাশ্ন করে বসলো, “রফি তোর প্রথম মায়ের কি হয়েছিলো”।
আমি কিছুটা চমকে গেলাম। তারপর শুধু ছোট্ট করে বললাম “জানি না”।
-প্লিজ আমায় লুকাস না।
-এখানে লুকানোর কিছুই নেই।
-তার মানে আমি তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড না।
-সব কিছুতে এই এক কথার বাহানা দিবি না।
-আচ্ছা থাক বাদ দে।

তারপর চোখের কোণে থেকে দু-ফোঁটা পানি মুছে বলতে শুরু করলাম, “তখন আমার বয়স পাঁচ।বাবা-মায়ের ভালবাসা আর মমতায় বেড়ে উঠে কিছুটা বুঝতে শিখেছি। খুব সুখের সংসার আমাদের। কিন্তু সেখানে আগুন জ্বালাতে প্রবেশ করলো বাবার এক বন্ধু “রিহান”। মায়ের সাথে পরিচয় হবার পর আমাদের বাসায় রিহান আংকেলের আসা যাওয়া আস্তে আস্তে বেড়েই চললো। একদিন বাবা অফিসের কাজে বিদেশ চলে গেলো।

একমাস বাদে খুশি মুখে যখন বাড়ি ফিরে, তখন জীবনে এক বিশাল ধাক্কা খেলো “বাড়ি তালা দেওয়া”। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো মা আমায় দাদুর বাসায় রেখে তাঁর বন্ধুর সাথে চলে গিয়েছে। সেখান থেকেই আমার জীবনে কালো মেঘ জমা হলো। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর, ভালবাসা কি সেটা আর আমায় দেখা দেয়নি।”

-আচ্ছা বাদ দে, এমন একজন আসবে যে ভালবাসা দিয়ে তোর সব কষ্ট মুছে দিবে।
-তো তুই কান্না করছিস ক্যা।[একমুঠো হেসে]
-এমনি…

আরো কথা বলতে বলতে কখন যে ভোরের আলো আকাশ চিরে বেরিয়ে এলো খেয়ালি করিনি। তারপর বাড়ি ফিরে এলাম।

ছোট্ট একটা ঘুম দিয়েই ফ্রেস হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গেট দিয়ে ঢুকতেই চারজন এসে মাথায় বন্দুক ঠেকালো। আমি শুধু হাসলাম। একজন বন্দুক দিয়ে মাথায় আঘাত করে ওদের সাথে যেতে বললো। তারপর আমি শুধু নিচু হয়ে জুতার ফিতাটা বাঁধতে গেলাম। আর ঠাস ঠাস কয়েকবার গুলির আওয়াজ হলো। তারপর খেয়াল করলাম চারটা শরীর মাটিতে পরে আছে। কিছুক্ষণ পর লোক জড় হয়ে গেলো। আমি নিরবে সেখান থেকে বেড়িয়ে চলে আসলাম। সেদিন আর ভার্সিটিতে ক্লাস হলো না।

মাঠে গিয়ে গাছের আড়ালে যখন ছায়ায় বসে আছি, তখন নিধি কোনো আওয়াজ না করে পাশে এসে বসলো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালাম। দুজনেই চুপচাপ… তারপর নিধি কান্না জড়িত কন্ঠে শুরু করলো, “তুই এগুলো ছেড়ে দিচ্ছিস না ক্যানো, প্লিজ এখন তো এই খুনাখুনি থেকে বেড়িয়ে আয়।”
-তুই না আজ ভার্সিটিতে আসবি না! [কথার মোড় ঘুরিয়ে]
-আসতাম না, যখনি শুনেছি ভার্সিটিতে মার্ডার হয়েছে তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি।
-জানিস আমিও এর মাঝ থেকে বেড়িয়ে আসতে চাই, কিন্তু পুড়োনো শত্রুতা। আমার অথবা ভিপির দুজনের একজনের মৃত্যু ছাড়া এই ঝামেলা কখনোই মিটবে না।
-আর কি কোনো উপায় নেই!
-হুম আছে।
-কি?
-কাল দেখতে পাবি।
-বুঝিয়ে বল।
-এটা বলতে হয় না করে দেখাতে হয়, এখন চল কোথাও যাই। আজ সারাদিন তোকে সাথে করে ঘুরবো।
-সত্যি। [খুশি আর বিস্মিত দুটোর সংমিশ্রণে আমার দিকে তাকিয়ে]

নিধিকে সাথে করে সারাদিন অনেক জায়গায় ঘুরে যখন ক্লান্ত তখন নদীর ধারে ঝির ঝির বাতাসে দুজনে বসে জিরতে লাগলাম। ঠান্ডা বাতাস শরীর নয় যেন পুরো মনটাই ছুঁয়ে দিচ্ছে। তারপর নিধিকে “আসছি” বলে একটু দূরে এলাম। চারিপাশে খুঁজে খুঁজে অনেক ধরনের ফুল জোগার করে নিধির সামনে এসে হাঁটু গেরে ভালবাসার কথা জানালাম।

“চাঁদ সূর্যে মিশ্রিত এই পড়ন্ত সন্ধ্যায়,
তোমার হাতটা ধরতে চাই-
আর সবটা জুরে বলতে চাই,
ভালবাসি নিধি তোমায়।”

মেয়েটা আর কিছু ভাবতে না পেরে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো, আর শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো, “সেই প্রথম দিন থেকেই, আমিও ভালবাসি তোমায়।”

তারপর অনেক প্রেমের কথা বললাম। তখন পর্যন্তও নিধি জানেনা আমার মাথায় কি চলছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাতে চাঁদের আলো দেখা দিলো তখন নিধিকে বাসায় দিয়ে এসে ভিপি মিস্টার “আবিরের” বাড়ি গেলাম। কলিংবেল চাপতেই বালক ঘর খুলে দিলো। আমায় দেখে যখন চমকে গেলো তখন “ভাই আমায় মাফ করে দিন” বলে বুকে ঝাপিয়ে পরলাম।

ছেলেটাও নাটকের ছলে শান্তনা দিয়ে ওর ঘরে গেস্ট রুমে বসালো। ভুলটা করলো যখন চা বানানোর ছলে ওর রুমে গিয়ে আলমারি খুলে পিস্তলটা বেড় করলো। যখন বেড় করে পেছনে ঘুরলো তখন ওর দিকে আমার প্রিয় 9mm তাক করা।

এই পিস্তল দিয়েই খেলাটা শুরু হয়েছিলো। তাই শেষটা এই পিস্তল দিয়েই করলাম। টিগার চাপতেই আবিরের বুক ফুটো হয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো। বালকের মৃত্যুর আগে শুধু একটা কথাই বললাম, “এই খেলায় আমি অনেক পুরোনো পাপি।”

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কখন যে দুনিয়া ছেড়েছে সেটা অজানা।

তারপর এই খেলা পুরোটা শেষ করতে পুলিশের কাছে গিয়ে সারেন্ডার করলাম। নিধি সকালে থানায় এসে আমায় দেখে কান্না জুড়ে বসলো। আমি শুধু বললাম ভালো একটা উকিলের সাথে কথা বলতে।

হ্যাঁ, নিধির কারণে ছয় মাস বাদেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যাই। জেলে থাকতে একমাত্র নিধি ছাড়া আর কেউই খোঁজ নিতে আসেনি। তবে এতে কষ্টের বদলে ভালোই লেগেছে, সবার ভালবাসার চেয়ে একজনের ভালবাসা অধিক মূল্যবান, যদি সেটা সত্যি এবং নিঃসার্থ হয়।

তবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়েটা আর সেখানে থাকতে দেয়নি। সবার থেকে লুকিয়ে অনেক দূরে একদম নতুন এক শহরে নিয়ে আসে। নতুন কিছু করার আশায়, নতুন কিছু পাবার আশায়, নতুন করে কিছু গড়বার আশায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত