হেরোপাটি

হেরোপাটি

রোজ সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ হলো ঘুমচোখেই খবরের কাগজের কর্মখালি অংশটি বার করে পেন দিয়ে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সেগুলো মার্ক করা।তারপর ফ্রেশ হয়ে , একটার পর একটা ফোন নম্বরে ফোন করে ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা।তিন মাস ধরে এই করছি। আমার বাবার নাম পরিতোষ মুখার্জী, পেশায় করণিক তাও রাজ্য সরকারের অধীনে।বুঝতেই পারছেন কী পরিমাণ চাপ আমার! আমার মা না ওতো শত বোঝেনা কিছু! শুধু খিদে পেলে খাবার দিয়ে যাবে সামনে ,আর একটাই কথা,

-পাপাই একটু বেশি বেশি করে খা।
নাও, ওনাকে কে বোঝাবে বড় হওয়ার জ্বালায় এই নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে।উঠতে বসতে বাবার খোটা ভাতের সাথে মিশিয়ে খাচ্ছি,

-রাহুল, এভাবে কতদিন আর? কতদিন টানব তোকে?
রাহুল আমার ভালো নাম, পুরো নাম রাহুল মুখার্জী।মাথা নীচু করে থাকতাম।চোখ দিয়ে টস টস করে জল ভাতে পড়ত।মা মনে হয় দেখত, আঁচলের খোটা দিয়ে মাঝে মাঝে চোখ মুছত।হবে নাই বা কেন? সেই ছোট্ট থেকে স্কুলে প্রথম নাহলে দ্বিতীয় হতাম।বাবার খুব স্বপ্ন ছিল, খুব বড় অফিসার হব।বলত আমায়,

-পাপাই আমি তো অফিসারের অধীন কাজ করি।তোর আন্ডারে একদিন অনেক কর্মচারী কাজ করবে দেখিস।
চোখ বড় বড় করে শুনতাম কথা গুলো, আর গিলতাম বসে।বাধ সাধল কলেজের রেজাল্টটা ।অঙ্কে মার্কসটা খুব কম আসল, তাই কোনরকমে অনার্সটা বাঁচল।শুরু করলাম পরীক্ষা দেওয়া, একটার পর একটা।কিছুতেই ধরতে পারছি না, কোথায় পিছিয়ে আমি।টিউশনি করিয়ে যখন ফিরতাম বাড়িতে, দেখতাম রাস্তার পাশের বস্তির বাড়িতে শুয়ে থাকা ছেলে মেয়ে গুলো।বড় পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।চাঁদের আলো পড়ছে কারো মুখে।ওরা মনে হয় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার থেকে অনেক অনেক দূরে, খুব খুব ভালো আছে।বাড়ি এসে যখন বাবার ফিস ফিস করে কথা গুলো শুনতাম মাকে বলছে,

-কতদিন টানব বলতো? একটা যদি চাকরি ভালো জোগাড় করতে পারত।
দুটো কাজ পেয়েছিলাম, বেশি না ৬০০০ মাইনে, ট্যালিতে কাজ।গেলাম কয়েক মাস, খুব দম বন্ধ লাগত, মনে হত কোনো একটা খাঁচায় ঢুকছি।বাইরে থেকে মালিক আঙ্গুল ঢুকিয়ে লেজে নাড়া দিচ্ছি, আর আমি এদিক সেদিক করে বেড়াচ্ছি।পারলাম না আর।যেদিন ছেড়ে এসেছিলাম,কাজটা বাবাকে বললাম,

-বাবা কাজটা ছেড়ে দিয়েছি।
বাবা শুধু বলল,
-তোকে কিছু বলব না আর, জন্ম দিয়েছি, মানুষ তো করতেই হবে।
কথাগুলো বড্ড লাগল হঠাৎ করে।কোনোদিন মদ খাইনি আজো, সেদিন সুদীপকে বললাম ,

-বিয়ার খাওয়াবি?
অনেক “না” এর পর আনল দুটো শিশি।পুকুরের পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম আর গিলছি সঙ্গে।একটাই আর্তনাদ ছিল,

-বাবা তোমার কথা রাখতে পারলাম না।
প্রথম বলে হয়ত, মাথাটা বেশি ঘুরছিল।চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম।মাথায় একটু লাগল।চোখে অন্ধকার দেখলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই ।

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম সুদীপ নেই।একটু দূরে মোটা মত একটা ছেলে বসে।কালো একটু গায়ের রং।নড়ে চড়ে উঠতেই, সে এসে পাশে বসল,

-জ্ঞান ফিরল? উফ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
বললাম,
-আপনি? মানে তুমি? আর সুদীপ কোথায়?
সে বলল,
-এসে যাবে?আমি? বলছি পরে, আগে বলো তুমি কে?
মাথায় হাত দেওয়া আমার।হাত বোলাতে বোলাতে বললাম,
-রাহুল
সে বলল,

-তা ভর সন্ধ্যে কী মনে করে?ভদ্র বাড়ির ছেলে মনে হচ্ছে।মাতলামি করছ!!ছিঃ
শুয়ে পড়লাম পুকুরের পাড়ের ঘাসে।শরীরটা খুব হালকা লাগছে।ওই বিয়ারটা মনে হয় বেরিয়ে গেছে।বললাম,

-আজই প্রথম
সে বলল অবাক হয়ে,
-কী মনে করে?
বললাম সব।শুনে কি পেট ফেটে হাসি তার।বলল,
-এতেই এই! হেরোপাটির দলে তাহলে তুমিও নাম লেখালে?
বললাম,

-উপায় নেই।প্রচন্ড রেগে উঠল, বলল,
-উপায় নেই মানে? এই ভাবে যদি সবাই আমরা হারতে হারতে মাথা নত করে দিই জীবন নামের ভদ্রলোকের কাছে, সে তো না লড়েই একটার পর একটা ম্যাচ জিতে যাচ্ছে!তাকে কিছু এফর্ট দিতে হচ্ছে না।হেভি রাগ হলো।উঠতে যাচ্ছি, হাত ধরে বলে,

-দশ মিনিট দেবে?
বললাম,
-কী হবে?
-উফফ! দেবে কী?
-হমম
-একটু দাঁড়াও।

ছুটে গিয়ে দেখি একটা ফাইল নিয়ে এল।হাতে কটা কাগজ দিল।দেখলাম তাতে লেখা”নিলয় কর্মকার, বয়স ২৬। যোগ্যতা পি এইচ ডি কমপ্লিট ২০১৬ তে”।বললাম একটু অবাক হয়ে,

-উড়ে বাপরে! তা কিছু এপ্লাই করো নি?
বলল,

-কাজ??পাগল! সামান্য ঝাড়ুদারের পোস্টের জন্য জানো ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম।পরীক্ষা দিয়ে এসে রেজাল্ট জানার পরে এসে শুনি প্রার্থী বাছাই হয়ে আছে।কী আর করা! এ অফিস , ও অফিস ঘুরে ক্লান্ত হয়ে শেষে এই পুকুরের পাশে এসে বসলাম।

বললাম,
-তারপর?
বলল,
-তারপর আর কী!ওই দেখো!

চেয়ে দেখি ওই ছেলেটার মত একটা ছেলে জলে ভাসছে।দেহটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে, বড্ড পচা গন্ধ।সে তাও বলছে,
-বাবাটার জন্য আমারও খুব কষ্ট হয়…

বুকের কাছে বিশাল একটা চাপড়ে চোখ খুললাম।সুদীপ দু হাত দিয়ে বুকে প্রেশার দিচ্ছে।আমার মুখ দিয়ে শেষ জল টুকু বেরিয়ে এসেছে।বাবা একটু দূরে দাঁড়িয়ে।মা চোখ খুলেছি দেখে কাঁদতে কাঁদতে ভেজা শরীরটা বুকে টেনে নিল।আমি শুধু চোখ বন্ধ করে ভাবছি “কী ছিল এটা? মৃত্যুর কোলে চুমু খেয়ে চলে আসা।কিন্তু কেন?”সব প্রশ্নের উত্তর চাই এখন।সাত পাঁচ ভাবছি, বাবা সামনে এল, বলল,

-বুড়ো হয়েছি।পায়ে হাত দিতে পারব না, ক্ষমা কর আমায়, আর কোনোদিন তোকে কিছু বলব না।আমায় ছেড়ে যাস না।তুই ছাড়া আমাদের কেউ নেই।

এবার কেঁদে ফেললাম আমি।বড্ড ভুল করতে যাচ্ছিলাম, ফিরিয়ে দিল “নিলয়” এদের কাছে।জানে ও মা বাবাকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রনা,….

বছর ঘুরল।এই সামনের মাসে আমার কোচিং টার এক বছর হবে।কিসের কোচিং? যারা সরকারি পরীক্ষা দিতে চায়, তাদের পড়াই, ওই যতটা পারি।বাবাকে বলি,

-কর্মচারী নয়, অনেক অনেক কুঁড়ি আছে আমার কাছে জানো?
শুধু একটাই লক্ষ্য এই দেশের সব হেরোপাটিদের আস্তে আস্তে ঠিক জিতিয়ে দেব, নইলে ওই নিলয় গুলোর সংখ্যা যে বেড়ে যাবে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত