বাপ-ব্যাটার কাণ্ডকারখানা

বাপ-ব্যাটার কাণ্ডকারখানা

একমাত্র বাবার একমাত্র ছেলে অামি। বাবা কখনই অামার দুঃখ কষ্ট বুঝতে চাননি। সে হিসেবে বাবার একমাত্র ছেলে হয়েও কোনো লাভ নেই। সেদিন হঠাৎ বাবার একটা কথা শুনে চমকে উঠলাম,

‘নিলয়, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, পাত্রী দেখতে যেতে হবে।’

পাত্রীর কথা শুনে শক খেলাম। কতক্ষণ যে থমকে ছিলাম ঠিক মনে নেই। বাবার ধমকানিতে বাস্তব জগতে ফিরে এসে বললাম,

‘পাত্রী! কার জন্য বাবা?’
বাবা মুচকি হাসলেন। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে পাঞ্জাবী-পায়জামা পরতে লাগলেন। অামি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে অাল্লাহকে লাখো কোটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। এতদিনে অামার প্রতি তাহলে বাবার সুদৃষ্টি পড়েছে! ভাবতেই মনে মনে নাচতে শুরু করলাম। নিজের ঘরে গিয়ে রীতিমতো বরের সাজে সাজতে লাগলাম।
বাবা কিছুক্ষণ পরপর ড্রয়িং রুম থেকে চিৎকার করছিলেন,

‘কিরে তোর হলো? দেরি হয়ে যায় যে।’

অামি অামার কালো মুখটা ধবধবে সাদা করার জন্য বেশি করে স্নো-পাউডার ঘষতে শুরু করলাম। ঘষতে ঘষতে বাবাকে বললাম,

‘অারেকটু দাঁড়াও বাবা। স্নো-পাউডার অারেকটু ভালো করে মেখে নেই। পাত্রী তো অার পালাচ্ছে না। এত তাড়া কিসের!’

‘মেয়ে পছন্দ হলে কিন্তু অাজকেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবো।’ বাবা বললেন।
স্নো-পাউডার মাখা শেষ হলে বডি স্প্রেটা গায়ে দিয়ে নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলাম।

বাহ! অনেক সুন্দর ঘ্রাণ তো। সুন্দর না হয়ে যাবে কোথায়! ৩২০টাকার একটা কানা কড়িও কম নেয় নাই। এত করে দোকানদারকে বলেছিলাম,

‘ও কাকু, ৩০০ টাকা রাখেন। বাকি বিশ টাকা দিয়ে বাড়ি যেতে হবে। অাপনাকে পুরোটা দিলে অামাকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতে হবে।’

দোকান কাকু মুখে ভেংচি কেটে বলেছিলেন,

‘তাহলে অার সেন্ট মাখতে হবে না। বাড়ি গিয়ে অাদা-রসুন মেখে বের হইও।’
কী অার করার! পকেট ঝেড়ে পুরোটা ৩২০ টাকাই দোকানদারের হাতে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলাম অার দোকানদারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছিলাম।

যাকগে সেসব কথা, সেন্ট মাখতে মাখতে অাজব একটা দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম, সুশ্রী একজন রমনী অামার জন্য বাসরঘরে অপেক্ষা করছে। অামি বিছানায় বসতেই মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
‘অাপনি না অনেক ছুইট! অনেক কিউট, ঠিক বাচ্চাদের মতো। অাপনার গালগুলো গুলুগুলু।’

রমনীর কথা শুনে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো। অামি একজন তাগড়া যুবক! তাকে কিনা গুলুগুলু বলে! মনে হচ্ছিলো বাসরঘরেই ছ্যাকা খেলাম। জোরে জোরে বলতে লাগলাম,
‘অাল্লাহ! তোমার কাছে বিচার দিলাম।’
‘অাল্লাহ! তুমি অামারে উঠায়া নেও।’

অামার চিৎকার শুনে মাথায় একটা বারি খেলাম। নাহ! খু্ব কষ্ট পেলাম রমনীর ব্যবহার। মনে মনে ভাবছি, নাহ! এভাবে তো ছেড়ে দেয়া যাবে না। একে অাজই শেষ করে দিবো অামি।’

যেই গলা টিপে ধরার জন্য হাত এগিয়ে দিয়েছি তখনই একটা ঠাশ করে চড় খেলাম। চোখ খুলে দিয়ে বাবা। গালে হাত দিয়ে নেড়ে মাথা নিচু করলাম,

‘হারামী তখন থেকে ডাকছি না? বসে বসে স্বপ্ন দেখা বাদ দে। চল তাড়াতাড়ি।’
বাবা চলে গেলেন। অামি অায়নায় নিজের চড় খাওয়া গালটা অারেকবার দেখলাম। পাছে যদি দাগ বসে যায় অার অামার হবু শালিকারা ফাজলামো করে, সেজন্য।

নাহ! দাগ বসে নাই। এ রকম শুভ কাজের জন্য বাবার হাজারটা চড়-কিল খেতে অামি অনায়াসেই রাজি।

যাওয়ার পথে বাবা বাজারে নেমে পাঁচ কেজি রসগোল্লা কিনে নিলেন। রসগোল্লা দেখে অামি লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বারবার জিভে জল অাসছিল। এখন যদি অামাকে বলা হয়, বউ চাও না রসগোল্লা!
নিশ্চিত অামি বলবো রসগোল্লা চাই রসগোল্লা। বাবার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, তিনি অামার অবস্থা বুঝে যদি একটা রসগোল্লা বের করে অামাকে খাইয়ে দেন। অাজকের পর থেকে তো অামি অন্য কারোর হয়ে যাব। তখন তো বাবা ইচ্ছে করলেও অামাকে খাওয়াতে পারবে না। অামি বাবার দিকে তাকালেও বাবা বারবার তার শরীরে মাখা অাতরগুলোর ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করছিলেন অার পাঞ্জাবীটা ঠিক করছিলেন। বাবার কাহিনী দেখে বারবার হতভাগ হলেও ভাবলাম,

‘একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা! বাবার সাজবে না তো পাশের বাড়ির মটু চাচা সাজবে!’
‘দেখ তো বাবা অামাকে কেমন লাগছে? সব ঠিকঠাক অাছে তো?’
অামি হেসে বললাম,
‘হ্যাঁ বাবা। সব ঠিকঠাক অাছে। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।’
‘বাবা, একটা রসগোল্লা খাই?’

রসগোল্লা খাওয়ার কথা ঠাশ করে একটা চড় পড়লো গালে। নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে শপথ করলাম,
‘অামি শপথ করিতেছি যে, এখন থাকিয়া মেয়ের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অার রসগোল্লা খাইতে চাহিবো না। এতে যদি অামার মরণ হয় তবুও।’
বাবা বললেন,

‘হারামজাদা, রাস্তায় রসগোল্লা খায় নাকি? যত পারিস মেয়ের বাড়িতে গিয়ে খাইস।’
অামি অাচ্ছা বলে চুপ থাকলাম। এরই ফাঁকে বাবা চিরুনী বের করে মাথাটা অাঁচড়ে নিয়ে বললেন,
‘তুইও একটু অাঁচড়ে নে।’

হবু শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল অামার। বাড়িটা ছোট হলেও বেশ সাজানো গোছানো। বাবা অামার হাতে চিমটি কেটে বললেন,
‘কিরে বাড়ি পছন্দ হয়েছে তোর?’
অামি লজ্জা পেয়ে বললাম,
‘হ্যাঁ বাবা।’

কিছুক্ষণের মধ্যে নাস্তা দিলো একটা মেয়ে। সুন্দর করে সাজুগুজু করেছে। মনে হয় এটা অামার শালী। অামি অাড় চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিলাম। সেও তাকাচ্ছিলো, হঠাৎ ফিক করে হেসে চলে গেল।
একজন বয়স্ক লোক অাসলেন। বাবা তাকে সালাম দিলেন অার বললেন,
‘এই যে অামার ছেলে। বড়ই লক্ষ্মী।’
অামি সালাম দিলাম। বয়স্ক লোকটা বললেন,

‘মেয়ে পছন্দ হলে অাজই কিন্তু বিয়ের কাজটা সমাধা করতে চাই। অামরা দেরি করতে চাই না।’
বাবা বললেন,

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। অামাদের বাড়িটাও একদম খালি। লোকের প্রয়োজন অাছে। পার্মানেন্ট হলে বেশি ভালো। সেজন্যই অাসা।’

বয়স্ক লোকের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছিলো তার অামাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। নাহলে সরাসরি বিয়ের কথা বলবে কেন?

কিছুক্ষণ পর পাত্রীকে ইয়া বড় ঘোমটা সহ অানা হলো। অামার হবু শালিকা ঘোমটা তুলে দিয়ে বলো,
‘দেখেন। অার কোনোকিছু জানার থাকলে বলতে পারেন।’
বাবা বেশ লজ্জা পাচ্ছিলো। সাথে অামিও। বাবা বললেন,
‘কিছু জিজ্ঞেস করবো না। নিয়ে যান।’

পাত্রীকে নিয়ে গেল। ভাবলাম পাত্রীর বয়স অামার থেকে একটু বেশি হলেও রূপ-সৌন্দর্য্য সেটাকে ম্লান করে দেবে।

মনের মধ্যে ডিংকা-চিকা গান অানন্দ হচ্ছিলো। বাবা বললেন,
‘পছন্দ হয়েছে তোর নতুন মাকে?’
অামি যেন হাইভোল্ডেজ শক খেলাম। অবাক হয়ে বললাম,
‘মা!’

‘হ্যাঁ রে। ভেবেছিলাম অার বিয়েই করবো না। একলাই কাটিয়ে দেব বাকি সময়টা। পরে ভাবলাম বাড়িটা পুরো শূন্য। তাছাড়া তোকে দেখার জন্য হলেও একটা মানুষের প্রয়োজন। সেজন্য।’

অামি ফের ছ্যাকা খেলাম। এতক্ষণ ধরে পুষে রাখা কল্পনাগুলোকে নিমিষেই পুঁতে দিতে হবে ভাবিনি।
বাবা অামার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘যা তোর নতুন মায়ের কাছে। অার রসগোল্লা চাইতে ভুল করিস না কিন্তু।’
বলেই বাবা হেসে উঠলেন। অামি মনে মনে অাল্লাহর কাছে বিচার দিতে লাগলাম,
‘অাল্লাহ! তোমার কাছে বিচার দিলাম।’

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত