ছদ্মবেশী জুনিয়র

ছদ্মবেশী জুনিয়র

বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জুনিয়র ছেলে মেয়ে আসছে। সদ্য সিনিয়র হওয়া ব্যাচটির ছেলেগুলোর চোখে মুখে যেন ঈদের খুশির মত ছাঁপ দেখা যাচ্ছে। সিংগেল ছেলেদের টার্গেট থাকে যেমনে হোক একটা মেয়েকে তার প্রেমে ফেলতেই হবে। তাই সদ্য সিনিয়র হওয়া অনেক বড় ভাই জুনিয়রদেরকে র্যাগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের নম্বর সংগ্রহ করতে বলে। বেচারা জুনিয়র! যেমনেই হোক তার নম্বর সংগ্রহ করে বড় ভাইকে দেয়। তা না হলে আছে র্যাগের ভয়!

আমার লিকলিকে পাতলা চেহারা দেখে কেউই মনে করবেনা আমি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। যে কেউ আমাকে সদ্য ক্যাম্পাসে আসা জুনিয়রই মনে করবে। তাই ভাবলাম জুনিয়রদের যে কোন একটা ডিপার্টমেন্টের প্রথম ক্লাসে আমি যাব।

সেদিন সকাল আটটায় ফার্স্ট ইয়ারদের একটা ক্লাস ছিল ফিসারিজ ডিপার্টমেন্টে। আমি নিজেকে প্রস্তত করতেছি ক্লাসে যাওয়ার জন্য। আমার রুমমেট বললো, ‘ মামা তোর না সেমিস্টার ব্রেক চলছে, এখন আবার কিসের ক্লাস? ‘ আমি বললাম, ‘মামা তুই বুঝবিনা। ‘ এই বলে ক্লাস করার জন্য হাঁটা শুরু করলাম। আমার ক্লাস করার উদ্দেশ্য ছিল জুনিয়রদের সাথে মজা করা আর জীবনের প্রথম ক্লাস করার মজাটা কেমন হয় গ্রহণ করা। ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়রদের সাথে একাডেমিক ভবনে ক্লাস করার জন্য যাচ্ছি। সবাই ক্যাম্পাসের যাকে পাচ্ছে তাকেই সালাম দিচ্ছে…। কিন্তু আমি যে তাদের চার বছরের সিনিয়র সেটা তারা কেউই ভ্রক্ষেপ করতেছেনা।

ক্লাস করতে গেলাম। ক্লাসের প্রথমদিনে স্যারদের চেয়ে সদ্য সিনিয়র হওয়া বড় ভাইয়েরাই বেশি করে আসা শুরু করলো। এসে সবার নাম, ঠিকানা, বাসা কোথায় এসব জিগ্যেস করলো।

আমার পাশে একটা সুন্দর মেয়ে বসছিল। তার নাম অবন্তী, বাসা রংপুর। সেও আমার নাম, কোথা থেকে আসছি তা শুনলো। বড় ভাইদের টার্গেটে এখন অবন্তীর উপর পড়ে গেছে। ক্লাস শেষ করে যেই সিড়ি দিয়ে নিচে নামবো, অমনি, ‘এয় ভাইয়া, একটু এদিকে আসো তো তোমরা দুজন ‘- বলে এক বড় ভাই ডাক দিল। আমি ও অবন্তী গিয়ে তাদের সালাম দিলাম, ‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া’ । ওরা সালামের উত্তর দিয়ে জিগ্যেস করলো, ‘ আমরা যে তোমাদের ক্লাসে গিয়ে তখন কথা বলতেছিলাম, ‘ তোমরা হাসতেছিলা কেন? দেখলাম অবন্তীর পা কাঁপছে। ওর পা কাঁপানো দেখে আমিও পাঁ কাপানোর অভিনয় করে বললাম, ‘সরি ভাইয়া আর ভুল হবেনা।’ ‘ ঠিকাছে তোর নাম ঠিকানা বল’। আমি বললাম, ‘ আমি সালমান, বাসা কুড়িগ্রাম।’
উনি আবার বললেন,’ এয় মেয়ে তোমার নাম ঠিকানা বল?’ অবন্তী বললো, ‘ আমি অবন্তী, বাসা রংপুর। ‘ কি রকম লিঙ্গ বৈষম্যই না দেখালো বড় ভাইয়া। আমাকে সম্বোধন করলো ‘তোর’ আর অবন্তিকে ‘তোমার’ করে।

তারপর সেই বড় ভাইয়াটা আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললো, ‘তোর ফোন নম্বরটা দে। আজ রাতের মধ্যে তোরে ফোন দিয়ে যেন অবন্তীর নম্বরটা পাই তোর কাছ থেকে, নাহলে খবর আছে তোর। ‘
আমি ভয় পাওয়ার মত করে আস্তে বললাম, ‘ঠিক আছে ভাইয়া। ‘
তারপর তিনি অবন্তীকে বললো, ‘ ক্যাম্পাসের সিনিয়র আমরা , কখনো কোন দরকার লাগলে বলিও। আর সালমানের কাছে আমার ফোন নম্বর আছে তুমি কালেক্ট করে নিও। ‘

ক্লাস শেষে অবন্তীকে বিদায় জানিয়ে হলে ফিরতে ফিরতে প্রায় একটা বেজে গেল…। গোসল খাওয়া দাওয়া করে দিলাম এক ঘুম। একটা দিবা স্বপ্ন দেখতেছিলাম, দেখলাম অবন্তী মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বাচ্চাও হয়েছে একটা। আর সেই মেয়ে আমাকে বলতেছে, এয় বাবুটা হাগু করছে, তুমি ওর ডায়াপারটা চেঞ্জ করে দিয়ে বাবুকে ভাল করে ঘুম পাড়িয়ে দাও, আমি রান্না করতেছি। কখনো কোন বাচ্চার ডায়াপার কিংবা পায়খানা পরিষ্কার করিনি, আজকে করতে হল। ঐ অবন্তীর জোরাজুরিতে বাকি জীবনটা যে আরো কিভাবে কাটবে -তা ভেবে ভয় পাচ্ছি আমি।

‘ঐ মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ, আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানের তাগীদ ‘ গানটি আমার কানের পাশে বেজেই যাচ্ছে। ভাবলাম ঈদটা চলেই আসলো।গতবার তো সে প্রায় ১৫ হাজার টাকার শপিং করছে, এবার যে অবন্তী কতটাকা পকেট থেকে খসায় শপিং বাবদ আল্লাহ মালুম। কিন্তু বার বার গানটি বেজেই যাচ্ছে, হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সেই বড় ভাই ফোন দিয়েছে তিনবার এবং ‘ঐ মন রমজানের….’ গানটি ছিল আমার রিংটোন।

ফোন রিসিভ করে সালাম দিলাম,
-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম, অবন্তীর নম্বরটা দে।
-ভাইয়া নম্বরটা তো কালেক্ট করা হয়নি এখনো। কালকে দেই?
— না আগামী এক ঘন্টার মধ্যেই দিবি।
এই বলে উনি ফোন কেটে দিল।
অবন্তীর তো নম্বরও নাই, ফেবু আইডিও নাই, কি করি আমি!
আমার এক বান্ধবীর নাম অবন্তী, তাকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত বললাম, এবং তাকে ফার্স্ট ইয়ার হিসেবে ছেলেটার সাথে কথা বলার জন্য বললাম। সে নম্বর দেওয়ার পারমিশন দিল এবং আমি ঐ বড় ভাইয়াকে নম্বরটা মেসেজ করে দিলাম। বড় ভাই তার সাথে রাত্রে কথা বলছে কি না তা অবশ্য বান্ধবীটা জানায়নি আমাকে।

পরদিন সকালে আবার অবন্তী আর আমি পাশাপাশি বসলাম। আবার বড় ভাইয়েরা ক্লাস রুমে আসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলার ম্যানার শেখাতে।

ক্লাস শেষে সেই বড় ভাই, অবন্তীকে বললো, ‘ তোমার কণ্ঠটা হেভি সুইট ‘। আমাদের দুজনকে ভাইয়া হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালো ও। সাথে আরো অনেক ফ্রি উপদেশ দিল। আমি ভাবছি কখন জানি আমার বন্ধুদের চোখে পড়ে ধরা খেয়ে যাই।
প্রতি রাত্রেই বড় ভাইয়া আমার বান্ধবী অবন্তীকে ফোন দেয়, আর ফ্যাকাল্টিতে এসে আসল অবন্তীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। এভাবেই প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেল। একদিন ভাইয়া অবন্তীকে ফোন দিয়ে বলে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে আসতে, তারা সামনাসামনি কথা বলবে একান্তে।
বান্ধবী রাজী হয়ে মাইনকা চিপায় পড়ে গেল। সে আমাকে বললো, ‘দোস্ত এখন তুই সামলা, আমি আর পারবনা, কালকে দেখা করতে চাচ্ছে আমি বলছি যাবো, কিন্তু আসলে আমি যাব না। ‘

আমি ভাবছি বিষয়টা খোলাখুলি করা দরকার, ছেলেটা হয়ত অবন্তীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করছে, যদিও তাকে এখনো প্রপোজ করেনি সে।

শহীদ মিনারে বড় ভাইয়া ঠিক টাইমে গিয়ে প্রায় এক ঘন্টার মত ওয়েট করছে , অবন্তী আসেনি৷ পরদিন ক্লাসে এসে আমার সামনে অবন্তীকে অনেক কথা শুনিয়ে গেল ভাইয়া…। অবন্তী এর আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না। শুধু ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকলো।

আমার মাঝে খারাপ লাগা শুরু করলো অবন্তীর জন্য। আমার জন্য শুধু শুধু একটা মেয়ে কেন বকা খাবে বড় ভাইয়ের…।আমি তখন আমার বান্ধবী অবন্তী ও সদ্য সিনিয়র হওয়া বড় ভাইয়াকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ঢুকে দুজনকেই ভাল কিছু খাওয়ালাম। সেই বড় ভাইয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কোন জুনিয়র ছেলে তার সিনিয়র ভাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় তা হয়ত সে আজকে প্রথম দেখলো। বড় ভাইয়া আমাকে বললো, ‘ তোর পাশে মেয়েটা কে? ‘
আমি বললাম, ‘ আমার বান্ধবী, অবন্তী। ‘

বড় ভাইয়া তখন আমাকে বললো, ‘
–মজা করিস আমার সাথে?
– না ভাই সিরিয়াসলি বলছি।
–অন্য ফ্যাকাল্টির নাকি?
-জ্বি ভাইয়া, আর আপনি এতদিন এনার সাথেই কথা বলতেছিলেন। ইনি আমার বান্ধবী, এগ্রিকালচারে চতুর্থ বর্ষে পড়ে, আর আমিও চতুর্থ বর্ষেই পড়ি।

ছেলে অবিশ্বাস করে বসলো। আমি তখন বললাম, ভাইয়া তুমি সালমান রহমান লিখে ফেসবুকে সার্চ কর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবে। সে সার্চ করে দেখলো, ঠিকই তো। ‘

তখন সে মন খারাপ করলো এবং আমার সাথে খারাপ বিহেভিয়ারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো। আমিও বললাম, ছোট ভাই, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।সেদিন তুমি এমনভাবে আমাকে জোরাজুরি করছিলে যে আমার বান্ধবীর নম্বর দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আর আমি ক্লাস করছি মূলত সিনিয়র হয়ে প্রথম ক্লাসের স্বাদটা গ্রহণ করার জন্য।

সেদিনের পর থেকে আর ফার্স্ট ইয়ারদের ক্লাসে যাওয়া হয়নি।
ছেলেটা জুনিয়র অবন্তীকে আর ডিস্টার্ব করেনি কখনো। সে ভেবেছে হয়ত বড় ভাইয়া, ‘ জুনিয়র অবন্তীকে পছন্দ করে।’

আমার অষ্টম সেমিস্টারের ফাইনাল এক্সাম চলছে। পরীক্ষা দিয়ে এগ্রিকালচার ভবন থেকে বের হয়ে দেখলাম, অবন্তী মেয়েটা ভার্সিটির ফার্স্ট গেটের দিকে যাচ্ছে। আমাকে দেখে সে বললো, ‘ এয় সালমান, তুই কই ছিলিরে এতদিন? তোরে আমি অনেক খুঁজেছি..। এক সপ্তাহ ক্লাস করেই কোথায় হওয়া হয়ে গিয়েছিলি?

আমি বললাম,’ কই আবার ক্যাম্পাসেই তো ছিলাম। আর আমাকে অনেক খুঁজেছিস কেন? ‘
‘তুই পাশে থাকলে আমার মনে হত, ভাল একটা বন্ধু পেয়েছি, আর তুই আমাকে বড় ভাইদের কাছ থেকে যেভাবে আগলে রাখছিলি, তাই তোর অভাববোধটা ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম। তুই চলে যাওয়ার পর সেই বড় ভাইটা আর ডিস্টার্ব করেনি এমনকি ক্লাসের কেউই না। আমার চেয়ে অসুন্দর বান্ধবীদেরও দুই তিনটা প্রপোজ আসছে বাট আমাকে কেউ করেনি ইমিডিয়েট সিনিয়রদের থেকে। আমার চেহারা কি এতটাই খারাপ নাকি? আমি বললাম’ ধুর কি যে বলিস না তুই। ‘ তোরে যাতে আর কেউ প্রপোজ করে ডিস্টার্ব না করে সেই ব্যবস্থাটা করেই আমি ক্লাস থেকে বিদায় নিয়েছি। ‘ ওহ, তাহলে এই কথা? কেন এমনটা করছিলি?

‘তোর ভালর জন্য’ , আমি বললাম।
আচ্ছা এখন বল,’ তুই কোথায় ছিলি?’
তোকে তো ক্লাসে দেখি নাই আর কোনদিন , অন্য সাবজেক্ট আসছে নাকি মাইগ্রেশন হয়ে?

আমি বললাম হুম, ফিসারিজ থেকে এগ্রিকালচার আসছিলো, তবে সেটা আজ থেকে চার বছর আগে, এখন ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম দিচ্ছি আমি।

সে বললো, ‘হোয়াট? ‘ কি বলছিস এসব?

হুম তাহলে শোন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসটা করতে পারিনি কোন এক কারনে, তাই ভাবছিলাম লাস্ট ইয়ারে এসে মোস্ট জুনিয়রদের সাথে ক্লাসটা করব এবং সিনিয়র হয়ে সেটার অনুভূতি কি রকম তা অনুভব করব। আর তাই করা। ‘ আমি যে ফোর্থ ইয়ারে পড়ি তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি ফেসবুকে আমার নাম লিখে সার্চ কর, তাহলে বুঝতে পারবে। সে তাই করলো…।
-ভাইয়া, আপনি না অনেক মজার মানুষ, এমন কেউ করে নাকি!
–আমার আশা ছিল এটা করার। তাই করলাম।
– আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি?
–ফেসবুকে না রিয়েল লাইফে?
-দুটোতেই।
— ওকে অ্যাক্সেপ্টেড, তুমি আজ থেকে আমার রিয়াল ও ভার্চুয়াল লাইফের বন্ধু। এটাকে সব সময় আগলে রাখিও।

আমার মাস্টার্স শেষ, একটা ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি সম্প্রতি। অবন্তীরও থার্ড ইয়ার শেষ। আমাদের মাঝে সম্পর্কটা এখন আর বন্ধুত্বের মধ্যে নেই। বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। আরো কিছুদিন পরে পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হল। সেই বড় ভাইয়া ও আমার বান্ধবী অবন্তীকে দাওয়াত করছিলাম বিয়েতে।

বিয়ের দু বছর পর, আমাদের একটা বেবী হল, নাম রাখছি সিদরাতুল মুনতাহা। বাচ্চাটা প্রসাব পায়খানা করলে এখন মাঝে মাঝে আমাকেই ডায়াপার চেঞ্জ করতে হয়। এমনকি ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলাও তার ডায়াপারটা চেঞ্জ করতে হল। কেন যে সেদিন বিকালে এমন স্বপ্নটা দেখলাম। তাই হয়ত আজ এসব হচ্ছে আমার সাথে। তবে আমি অনেক সুখী অবন্তী ও মুনতাহাকে নিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় বাচ্চাটার ডায়াপার চেঞ্জ ও তার ময়লা পরিষ্কার করাতেই পিতা মাতারা এক ধরনের সুখ পায়…। এ সুখটা হয়ত সবার ভাগ্যে অনুভব করার সুযোগ হয়না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত