গল্প নয় জীবন থেকে নেয়া

গল্প নয় জীবন থেকে নেয়া

ওরা দুই জন একই বয়সের। ছোট বেলা থেকেই ছিল ডানপিঠে।পাশাপাশি বাড়িতে থেকে বেড়ে উঠে দুইজনই।একই সাথে প্রাইমারি শেষ করে সেকেন্ডারি ছুঁতে চলছিল। সেই সময়কার ঘটনা।বেশ কাছাকাছি চলে আসে ওরা।মায়া-জালে আটকে যায়।ভালোবেসে ফেলে একে অন্যকে।জীবনের প্রথম প্রেমের ছোঁয়া চলতে থাকে।

ছেলেটির নাম অভ্র।বেশ সুদর্শন। আর মেয়েটি নাবিলা।অসম্ভব সুন্দরী। যেন স্বর্গের অনিন্দ্য সুন্দরী এক পরী।দারুন চটপটে আর স্মার্ট। উদাস দুটি চোখ যেন ঠিক ‘পাখির নীড়ের মত’।একবার তাকালে আর দৃষ্টি ফেরানো যায়না।

নাবিলার একটি চোখ দৃষ্টিহীন। তাঁকে দেখলে এমনটি মনে হয়না কখনো।বুঝারও সুযোগ নেই।দুটো চোখই যেন সর্বত্র অশান্ত।নীল আকাশের মতই উদারতায় ভরপুর।অভ্র নিজেও জানেনা এই দৃষ্টিহীনতার কথা।অভ্র যা জানে তা সে নিজেই ঘটিয়ে ছিল। নাবিলাও অভ্রকে বুঝতে দেয়নি দৃষ্টিহীন চোখের আড়ালে কত গভীর প্রেম ও অব্যক্ত ব্যথা লুকিয়ে আছে।

গড়িয়ে যায় কয়টি বছর।একদিনের ঘটনা।ওরা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে তখন।স্কুল ছুটি হয়েছে মাত্র। বাড়ি ফিরছে দুই জনই। প্রবল বেগে কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়েছে। রাস্তায় আটকে গেল দুইজনেই। একটি ভাঙ্গা বাড়িতে দ্রুত আশ্রয় নিল।বিকেল হলেও চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বজ্রপাতের বোমা ফাঁটানো শব্দে দুই জনই দিশেহারা।ভয় এবং আতঙ্কে জড়াজড়ি করে বসে ছিল কিছুক্ষণ।স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া সেই কী আবেগ আর উত্তাপ।দুটি শরীর এত কাছাকাছি আসা জীবনে এই প্রথম।

বাবার চাকুরী সূত্রে হটাৎ অভ্র চলে যায় অন্যত্র।ঢাকা ছেড়ে যশোরে। সেই থেকে আর দেখা নেই ওদের।নাবিলাও একদিন চলে যায় বিদেশে তাঁর বাবার সাথে।কিশোর-কিশোরী বয়ঃসন্ধিকালের তীব্র আকর্ষণে দুই জনেই দিশেহারা। কিছু বুঝার আগেই মারাত্মক সংক্রমণ ঘটে যায় দুই জনের মনে। কেউ কারোর খোঁজ নিতে পারে নাই। কিশোর প্রেমের করুণ ব্যাকুলতা আর দুটি হৃদয়ের তীব্র হাহাকার বাড়তেই থাকে দুই জনের ভিতর।

এই ভাবেই চলতে থাকে ওদের।চলে যায় দীর্ঘ সময়। দুই একবার যোগাযোগ হলেও একদিন যোগাযোগের শেষ সুযোগটিও হারিয়ে ফেলে তাঁরা। দুই জনই নিভৃতে খুঁজে ফিরে তাঁদের প্রথম ভালোলাগা কৈশোর প্রেম।একটিবার দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। কোনো উপায় নেই। এখন আর কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না।নেই কোনো গোপন অভিসার। স্কুল থেকে ফিরতে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাতে হাত রেখে বসে থাকা, কখনো চুমু দেয়া-এই সবই এখন বিষন্ন অতীত।

দীর্ঘ বারো বছর পর আবারও তাঁদের আকস্মিক দেখা হয়। ঢাকা ক্লাবের এক প্রীতি ভোজে।কী চরম উদ্দীপনায় উভয়ের আলাপচারিতা।দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাও ওদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।প্রথম দেখাতেই কাছে টেনে নেয়- যেন কৈশোরের হারানো প্রেম ফিরে পায় দুইজনে।

ওরা দুই জনই এখন উচ্চশিক্ষিত। তরুণী নাবিলা বিলাত থেকে পাশ করা ডাক্তার।বিলেতেই থেকে যাবার চিন্তা রয়েছে তাঁর।লন্ডনের একটি হাসপাতালে সবে মাত্র চাকুরী নিয়েছে। কিছুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে ঢাকায়।অভ্র একজন সরকারী কর্মকর্তা।তারুণ্য ঘিরে আছে তাঁকে। ঢাকায় সচিবালয়ে চাকুরী করছে দাপটের সাথে।

একদিন অভ্র জেনে যায় নাবিলার একটি চোখ দৃষ্টিহীন। খুবই বিব্রত হয় অভ্র। মন ভেঙ্গে যায় তাঁর। অন্ধ নাবিলাকে আর জীবনের সাথে জড়াতে চায় না।অভ্র ভাবছে তাঁর নিজের কথা।কত নামিদামি মানুষের সাথে তাঁর চলাফেরা এখন।চারিদিকে কত নামডাক। সমাজের উঁচু তলায় রয়েছে তাঁর উঠাবসা। জীবন সঙ্গিনীর একটি চোখ হবে দৃষ্টিহীন (!) এই নিয়ে ভাবতে চায়না অভ্র।ভাবছে যা হবার হয়েছে, আর এগুতে দেয়া যায়না।এখনই নাবিলাকে জানিয়ে দিতে হবে।

হলোও তাই। যেই কথা সেই কাজ। ভদ্র ভাবেই জানিয়ে দিল অভ্র তাঁর পক্ষে আর কিছুতেই নাবিলাকে নিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। নাবিলাও জেনে গেল একটি চোখের দৃষ্টিহীনতার কারণেই অভ্র তাঁকে আর জীবন সঙ্গিনী করে পেতে চায় না। অভ্রর মোহ থেমে গেল।একটি দৃষ্টিহীন চোখ হার মানিয়ে দিল তাঁর দুরন্ত কৈশোর প্রেমকে । যে চোখ দিয়ে নাবিলা অভ্রকে জীবনের নায়ক ভেবেছিল,সেই চোখই এখন অভ্রর কাছে অর্থহীন। চরম বিরক্তিকর। সম্রাট পুরুষের পৌরুষ্য যেন অভ্রুর অহংকার !

নাবিলা উন্নত বিশ্বে লেখাপড়া করেছে। খুব খোলামেলা। সে বুঝে যায় অভ্রর হীন মানসিকতা। নাবিলা ফিরে যায় বিদেশে।আর যাবার আগে অভ্রর জন্য রেখে যায় একটি দীর্ঘ চিঠি।

প্রিয় অভ্র,
‘আমি জানি তোমার প্রিয় নাবিলাকে তুমি এখন খুব ঘৃনা করছ।কারণ তুমি জেনেছ তোমার প্রিয় নাবিলার একটি চোখ দৃষ্টিহীন। যেটি জানতে পারতে আরো এক যুগ আগে।

মনে পড়ে অভ্র ! সেই ছোট বেলার স্মৃতি। তুমি স্কুল থেকে ফেরার পথে কত দুষ্টুমি করতে। সাথে আমিও। শুরুটা তুমিই করতে। মনে পরে ওই দিনগুলোর কথা? রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে আমার হাত স্পর্শ করার জন্যে তুমি কত ব্যাকুল হয়ে থাকতে।আমার হাতের ছোঁয়া পেতে তুমি আমাকে ধাক্কা দিতে এই ভেবে যেন আমিও তোমাকে একটি ধাক্কা দেই। আর তাতেই কী মজা পেতে তুমি! মনে পড়ে অভ্র স্কুল থেকে ফেরার পথে আমরা সেই দিনগুলোতে কত ধাক্কাধাক্কি খেলেছি?

তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আর একদিনের কথা। আমাকে ছুঁতে গিয়ে তুমি খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলে আমায়।আমার ডান চোখে প্রচন্ড আঘাত লেগেছিল সেইদিন।ভীষণ ব্যথা হচ্ছিল তখন। রক্ত ঝরেছিল। তুমি নিজে রুমাল দিয়ে কত যত্নকরে রক্ত মুছে দিয়েছিলে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।তুমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে।বলেছিলে আমি যেন বাড়িতে গিয়ে তোমার দেয়া আঘাতের কথা কাউকে না বলি।

হলোও তাই।তোমার বিপদ হবে জেনে বাড়িতে গিয়ে কাউকে বলা হয়নি তোমার কথা। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো থাকি কী করে বল? সেই দিন আমি নিজেই তোমার অপরাধের দায় মাথা পেতে নিয়েছিলাম-কারণ তুমি ছিলে আমার প্রথম ভালবাসা।বাবা-মাকে বলেছিলাম ভিন্ন কথা।তুমিও সেইদিন জানতে আমার মিথ্যে বলার কারণ।তুমি আমাকে অনেক ধন্যবাদও দিয়েছিলে। এও বলেছিলে তুমি আমার কাছে চির ঋণী থেকে গেলে।

তুমি জানতে আমি উন্নত চিকিত্সা নিয়েছিলাম। এবংএও জানতে আমার চোখটি ভালো হয়েছে। কিন্তু তুমি যেটি জানতে না তা হলো, আমার ডান চোখটির সন্দৌর্য বিনষ্ট না হলেও তা চিরতরে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছিল তখনই। থাক সেই কথা বলে তোমাকে আর বিব্রত করতে চাই না।ভালই হলো তুমি কীভাবে জেনে গেলে। ভাবছিলাম আমিই তোমাকে খুলে বলব তোমার প্রিয় নাবিলার দৃষ্টিহীনের প্রকৃত কারণ।

ভেবেছিলাম তোমার সাথে জীবনে আর কোনদিন দেখাই হবেনা। দীর্ঘ এক যুগ পর আবার আমাদের দেখা হলো। কথা হলো। এই কয়টি দিন তুমি কতই না ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে আমাকে পাওয়ার জন্যে। ভালই হলো তোমার দৃষ্টিহীন ভালবাসা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে আমার অন্তর্দৃষ্টি ।ভালো থেকো’।

তোমার দৃষ্টিহীন নাবিলা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত