প্রতিজ্ঞা

প্রতিজ্ঞা

সেই ছোট বেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। লেখাপড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ ছিল না। মা-বাবা স্কুলে যাওয়ার কথা বললেই বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে চলে যেতাম। সারাদিন ডাংগুলি, গোল্লাছুট, ফুটবল, হা-ডু-ডু, কানামাছি, বৌছি খেলে দিন পার করতাম। তপ্ত রৌদের সময় মেঘনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে বন্ধুদের সাথে সাতার কেটে ছুয়াছুয়ি খেলতাম। দুপুরের খাবারের কথা মনে করতাম না। পেঠে যখন বেশী ক্ষুধা অনুভব করতাম সেই বিকেল বেলায় বাড়িতে ফিরতাম। খাবার দাবার ও পড়াশুনা নিয়ে মা খুব বকাঝকা করতেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি সারাক্ষণ নিয়ম মতো আমার কর্তব্য পালন করেই যাচ্ছি।

পাখি শিকার করা ছিল আমার আরেকটি নেশা। খেলাধূলার ফাঁকে ফাঁকে যখন অবসর পেতাম তখন পাখি শিকারে বের হয়ে যেতাম। মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে ঘরের কোনে চড়ুই পাখির বাসা খুঁজে বের করতাম। বাসা ভেঙ্গে চড়ুই পাখির ছানা নিয়ে আসতাম। আশে পাশের ঝোপ ঝাড়ের পাশে টুনটুনির বাসা খুঁজতাম। কোথায় টুনটুনির আভাস পেলে বাসা ভেঙ্গে টুনটুনির ছানা নিয়ে আসতাম। আরেকটি নেশা ছিল ছাগল পালন করা। পড়াশুনার প্রতি টান না থাকায় বাবা একটি ছাগল এনে দিলেন। সেই ছাগল নিয়ে প্রতিদিন মেঘনার পাড়ে চলে যেতাম। সারাদিন ছাগল ছেড়ে দিয়ে খেলাধূলা ও পানিতে লাফালাফি করে দিন পার করতাম। এভাবেই চলত আমার শৈশবের দিনগুলি।

দিন যায়, রাত আসে। দিনে দিনে বড় হচ্ছি আমি। বয়স আমার ৮ বছর হয়ে গেল। আমি পড়াশুনার ধারধারেও নাই। আমার সমবয়ী অনেকেই স্কুলে যায়। আবার অনেকেই আমার মতো সারাদিন দুষ্টুমি করে দিন পার করে। আমার বন্ধু আজহারুল। একই দিনে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। সে এখন ক্লাশ টুতে পড়ে আর আমি কিছুই পড়িনা। এই নিয়ে আমার মায়ের খুব চিন্তা। তাকে দেখিয়ে মা আমাকে তিরষ্কার করে। স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন আমাকে বকাঝকা করেন মা।

মায়ের বকুনি খেয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে গেলেও অন্য ছেলেদের অত্যচারে বেঞ্চে বসতে না পেরে চলে আসতাম। আমাকে দেখতে একটু বড় লাগায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসি ঠাট্টা করত। তখন আমি লজ্জা পেতাম। বাড়ীতে এসে কেঁদে কেঁদে মাকে বলতাম, মা আমি আর স্কুলে যাব না।

আমার বড় ভাই আকবর হোসেন পড়াশুনায় খুবই ভাল। ক্লাশের ফাস্টবয়। ওনি প্রতি দিন প্রাইমারী স্কুলে যায়। রাতের বেলা প্রচুর পড়াশুনা করেন। আমাকে স্কুলে নেয়ার চেষ্টা করেও নিতে পারেন নাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য ভাই আমাকে মাঝে মাঝে মারতেন। তারপরও আমি স্কুলে যেতাম না।

ইতোমধ্যে বড় ভাই পঞ্চম শ্রেণী পাস করে ফেললেন। আমার দাদার স্বপ্ন ছিল আমার বড় ভাইকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। আলেম বানাবেন। তাই পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর বড় ভাইকে আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় ভাই ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। মাদ্রাসার পাশেই এক বাড়ীতে বড় ভাইয়ের লজিং ঠিক হলো। ঐ বাড়ীর তিনজন ছেলে আব্দুল আলী, মুঞ্জুর আলী ও জমির আলীকে বড় ভাই পড়াতেন। আব্দুল আলী ক্লাশ ফোরে, মুঞ্জুর আলী ক্লাশ থ্রিতে এবং জমির আলী ক্লাশ টুতে পড়ত। তাদেরকে পড়াতে গিয়ে বড় ভাই আমার কথা ভাবলেন। আমাকে ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন এবং তার ছাত্রদের সাথে আমাকে পড়াবেন। বড় ভাই বাবাকে চিঠি লিখলেন আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার কথা জানিয়ে। বাবা-মা ও দাদা সবাই রাজি হলেন। সবাই আমাকে বুঝালেন। আমার মতামত নিলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।

তিন মাস পর বড় ভাই বাড়ীতে আসলেন। বড় ভাই আমার সম্মতি পেয়ে খুশী হলেন।
দুই দিন বাড়ীতে থাকার পর বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। জীবনের প্রথম গ্রাম ছেড়ে নরসিংদী শহরে পা রাখলাম। শহরের চাকচিক্য দেখে খুব ভাল লাগল। বড় ভাই আমাকে নিয়ে বাসে উঠলেন। বাস যখন শেখেরচর আসল তখন আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমরা বাস থেকে নামার সাথে সাথে একটা আওয়াজ হলো। পিছন ফিরে দেখলাম আমাদের কাছ থেকে ২০০ গজ দূরে দুটো বাস মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মৃত্যু বরণ করল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল রাজপথ। জীবনের প্রথম শহরে এসেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলাম। যা হোক পরে আমরা প্রথমে বড় ভাইয়ের লজিং বাড়ীতে আসলাম।

পরদিন মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য আমি পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি পড়ে প্রস্তুত হলাম। বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় আসলেন। আমি যেহেতু গ্রাম থেকে আসছি। তেমন ভাল পড়াশুনাও করিনি। এখনও রিডিং পড়তে পারিনি। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ এখনও সবগুলো পড়তে পারিনি। সবগুলো অক্ষর এখনও ঠিকমত লিখতে পারিনি। এমন অবস্থায় আমাকে বড় ভাই প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার জন্য প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া কঠিন মনে হল। কিন্তু বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। বড় ভাই বললেন, কোন চিন্তা করিস না আমি পড়াব। সব পাড়বি।

মাদ্রাসা ১০ টা থেকে শুরু হয়। পরদিন আমি বড় ভাইয়ের সাথে মাদ্রাসায় আসলাম। বড় ভাই আমাকে প্রথম শ্রেণীতে বসিয়ে ওনি ওনার ক্লাশে চলে যান। আমি তখন সবার পিছনে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে অন্য ছাত্ররা বলাবলি করছে ও নতুন আইছে। যথারীতি আমি বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। শ্রেণী শিক্ষক মোতালিব স্যার ক্লাশে আসলেন। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আমিও সালাম দিলাম। স্যার খুবই রাগি। সবাই এই স্যারকে ভয় পায়। স্যার আমাকে নতুন দেখে বলল, এই ছেলে এদিকে আস। আমি এগিয়ে গেলাম স্যারের দিকে। স্যার বলল, তোমার নাম কি?
আমি বললাম, আমির।
আমির অর্থ কি জান?
না স্যার।
আমির মানে নেতা। তুমি যদি ভাল করে লেখাপড়া কর। ক্লাশে যদি রোল নং ১ হয় তাহলে এ ক্লাশের নেতা হতে পারবে। কি ভাল করে লেখাপড়া করবে?
আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, জি স্যার।
বাড়ি কোথায়?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
এতদূর থেকে কার সাথে আসলে?
আকবর ভাইয়ের সাথে।
ও আচ্ছা।
ঠিক আছে যাও। প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসবে।
আচ্ছা স্যার বলেই আমি আবার সবার পিছনে গিয়ে বসলাম।

আমার নামের অর্থ নেতা। ক্লাশের নেতা হওয়ার জন্য মোতালিব স্যারের কথায় সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আমি ভাল করে লেখাপড়া করব এবং ক্লাশের নেতা হবো। তাই প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসতে লাগলাম। ক্লাশের ফাস্টবয় রায়হান আমাকে ভাল চোখে দেখত না। সে আমাকে অবজ্ঞা করে কথা বলত। আমি তাকে বলতাম দেখিস আমার রোল নং ১ হবে। আমার বড় ভাই আমাকে পড়ায়।

বড় ভাই আব্দুল আলী, মঞ্জুর আলী ও জমির আলীর সাথে আমাকেও পড়াতে শুরু করলেন। আমিও মনযোগ দিয়ে পড়ছি। প্রতিদিন আমি পড়া মুখস্থ করে মাদ্রাসায় যাই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন হুজুর ও স্যারের নজরে আমি পড়ে গেলাম। তখন থেকে সবাই আমাকে আদর করছে। বিশেষ করে যারা জেনেছে আমি আকবর এর ভোট ভাই তারাতো আমাকে আরো বেশী করে আদর করছে আর আমার প্রশংসা করছে যে আমি এত ছোট হয়েও মা-বাবা ছেড়ে বড় ভাইয়ের সাথে লেখাপড়া করছি। একদিন আমাদের শ্রেণী শিক্ষক মোতালিব স্যার বললেন, আমির তুমি আর পিছনে বসবে না। এখন থেকে সামনে বসবে। কিন্তু স্যারের কথা ফাস্টবয় রায়হান মানতে নারাজ। তার কথা সে ক্লাশের ফাস্টবয়। সে ছাড়া অন্য কেউ প্রথম বেঞ্চে বসতে পারবে না। এই নিয়ে আমার সাথে রায়হানের মারামারি হয়। স্যার এই খবর জানতে পেরে রায়হানকে বেত দিয়েছে। সেই থেকে রায়হান আমাকে শত্রুর মতো মনে করত। কোন কিছু জিজ্ঞাস করলে বলতনা। নিজেকে বেশী বাহাদুর মনে করত।

একবার আলোচনা উঠলো ক্লাশের ফাস্টবয় রায়হানকে নিয়ে। সবাই বলাবলি করছে ও খুব মেধাবী। ওকে ঠেকাতে কেউ পারবে না। আমরা যা পারি না ও না পড়লেও সব পেড়ে যায়।
সুমন বললো, আমারতো মনে হয় না ওকে কেউ পিছনে ফেলতে পারবে।
আরেকজন পিছন থেকে বলে উঠল আমির ক্লাশের নতুন ছাত্র। সেও কিন্তু কম না। খুব মেধাবী। এই পর্যন্ত যতদিন ক্লাশে এসেছে ততদিন সে পড়া পেড়েছে। কোনদিন স্যারের পিটুনি খায়নি। ছাত্র হিসেবে খারাপ নয়। তা ছাড়া তার স্বভাব-চরিত্রও যথেষ্ট ভাল। সে প্রতিজ্ঞাও করেছে সে ক্লাশ টুতে ফাস্টবয় হবেই।

আরেকজন বলল, আসলে সবাই পাড়বে যদি সঠিক মনোবল, সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও পর্যাপ্ত পরিশ্রম করে। আমি কিন্তু আমিরের প্রতিভাকে অস্বীকার করছি না।
ততক্ষণে আমি বলে উঠলাম বন্ধুরা তোমরা চিন্তা করবে না। যে রায়হান আমাকে দেখতে পারে না তাকে আমি বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার পরই প্রমাণ করে দিব আমিও পারি।
রায়হান বলে উঠল, পারবি না আমাকে ঠেকাতে। চ্যালেঞ্জ তোর সাথে।
আমি বললাম, ঠিক আছে তোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।

দৃঢ় প্রতীজ্ঞা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি এখন আগের চেয়ে পড়ায় বেশী মনোযোগি হলাম। দিন যায় রাত আসে এভাবে চলতে চলতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে আসল। মে মাসের প্রথম সাপ্তাহে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হল। ক্লাশের সবাই দীর্ঘ চার মাস লেখাপড়া করেছে আর আমি মাত্র এক মাস লেখাপড়া করেছি। এমতাবস্থায় পরীক্ষা আরম্ভ হলো। পরীক্ষা দিলাম। কিছুদিন পর রেজাল্ট দিল। সবগুলো খাতার নম্বর যোগ করে দেখলাম। আমি রায়হানের চেয়ে ১০ নম্বরে পিছিড়ে রয়েছি।

শিক্ষক ছাত্র/ছাত্রীরা সবাই আমার রেজাল্ট দেখে অবাক হয়ে গেল। এত অল্পদিনে কিভাবে আমি এত ভাল রেজাল্ট করতে পারলাম। সকল স্যার ও হুজুররা আমার জন্য দোয়া করল। তারপর থেকে আমি আরো দ্বিগুন উৎসাহ পেলাম। এদিকে আমার বড় ভাইয়ের ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীও মনযোগ দিয়ে পড়ছে। আমাদের চারজনের প্রতি বড়ভাইয়ের একটাই নির্দেশ অবশ্যই মনযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং ক্লাশের ফাস্টবয় হতেই হবে। এর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।
দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষা দিলাম। সব পরীক্ষা ভাল হয় আমার। যথারীতি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হলে ক্লাসমেটসহ শিক্ষকবৃন্দ তো বটেই আমি নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেলাম। রেজাল্ট ভাল হবে শুধু এতটুকুই জানতাম এবং আমি ক্লাশের ফাস্টবয় হব সবাই জানত কিন্তু এতটা ভালো রেজাল্ট হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি সারা মাদ্রাসায় গড়ে সবচেয়ে বেশী নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও আরবী বিষয়ে মোট ৪০০ মার্কের পরীক্ষা হয়েছিল। সবগুলো বিষয়ে ১০০ থেকে ১০০ পেয়েছি। কিন্তু একশ থেকে একশ পাওয়ার বিধান ঐ মাদ্রাসায় না থাকায় প্রতি বিষয়ে ১ করে কম দিয়ে ৩৯৬ নম্বর প্রদান করে আমাকে। যা গড়ে ৯৯% হয়। গড়ে ৯৯% নম্বর একমাত্র আমিই পেয়েছি। আর আমাদের ক্লাশের রায়হান পেয়েছে মাত্র ৮০% নম্বর!

এদিকে আমার রেলাল্ট ভাল হওয়ার পাশাপাশি আরো জানলাম বড় ভাইসহ তার তিন ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীসহ সবাই যার যার ক্লাশে ফাস্টবয় হয়। এই ঘটনায় মাদ্রাসার সুপার অবাক হয়ে যান যে তা কি করে সম্ভব! সকল ছাত্রছাত্রী শিক্ষকবৃন্দ আমাদের প্রশংসা করতে লাগলেন।

তারপর থেকে একনাগারে আমি ক্লাশ টেন পর্যন্ত প্রতি ক্লাশে ফাস্টবয় ছিলাম। কেউ শত চেষ্টা করেও আমাকে আর পিছনে ফেলতে পারেনি। আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও মনোবল আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। আর অহংকারী রায়হান ক্লাশ ফাইভ পাস করার পর পড়াশুনা থেকে চিটকে পড়ল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত