থার্ডল

থার্ডল

শেষমেশ অনিমেষ বাবু নিজের মেয়ের জন্য একটা মনোমত পাত্র খুঁজে পেয়েছেন। গত পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে না জানি কয়েক শত পাত্র পক্ষের বাড়িতে গিয়ে দেখা দেখি করে তারপর এই ছেলেকে পছন্দ করেন।

না যা ভাবছেন তা নয় মৃন্ময়ী কোনো ডানা কাটা পরী না হলেও দেখতে শুনতে মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় সেটা জানতে হলে একটু বিজ্ঞানের চ্যাপ্টার ঘেঁটে দেখতে হবে। বলবো একটু পরে।

যাইহোক মৃন্ময়ী বিজ্ঞানের ছাত্রী , বর্তমানে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। প্রেম এ জীবনে করা হয়ে ওঠেনি। তার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কোনো ছেলেই তার মনের কথা তাকে জানাতে পারেনি অথবা বলা যায় জানানোর সাহস হয়নি। ভৌত বিজ্ঞানের দিদিমণি কে স্কুলের সমস্ত স্টাফ থেকে শুরু করে ছাত্রীরাও সমঝে চলে। নাকের ওপরে রাখা রিডিং গ্লাসের ফাঁক দিয়ে বছর পঁচিশের এই তরুণী যেন মহাদেবের তৃতীয় চক্ষুর অগ্নি বর্ষণ করছে দিনরাত।

স্বাভাবিক ভাবেই অনিমেষ বাবুর কন্যাটিকে নিয়ে চিন্তা হবেই। অনেক বেছে বেছে শেষে পায়রাডাঙ্গার ঘোষালদের বাড়ির মেজ ছেলেকে খুব পছন্দ হয়েছে। পাত্রপক্ষ ও এককথায় রাজী, আজকের বাজারে সরকারী চাকুরে বউ কটা লোকের ভাগ্যে জোটে। তাও পাত্র এমন কিছু আহামরি চাকরী করে না, একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের কর্মচারী।

ফাল্গুনের এক গোধূলি লগ্নে মৃন্ময়ী আর তন্ময়ের বিবাহ সম্পন্ন হলো। তন্ময় স্বভাবের দিক থেকে একটু চুপচাপ। মৃন্ময়ী ও নিজের দিদিমণি ইমেজের থেকে কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলত দুজনকেই গম্ভীর নব দম্পতি বলা যেতে পারে।

বৌভাতের দিন সকালে তন্ময়ের বিবাহিত দিদি মৃন্ময়ীর গয়নার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচে বলে

“বৌদি তোমার বাবা নয় রিটায়ার্ড করেছে তুমি তো চাকরী করো, একটু না হয় মোটা দুটো চুরি বানিয়ে নিতে নিজের জন্যে, এতো একটু চাপ লাগলেই মটকরে ভেঙ্গে যাবে মনে হচ্ছে।”

মৃন্ময়ী ছোট্ট করে একটা উত্তর দেয় “হুম।”

দুপুরে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়ে গেলে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে এমন সময় ডাক পড়ে

“মেজ বৌমা এদিকে এস সবার পাতে ঘি ভাত দিতে হবে।”

গুটিগুটি পায়ে মৃন্ময়ী খাবার ঘরে গিয়ে শশুরের পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ঘর ময় লোক মুখ চাওয়া চায়ি করছে দেখে নিজেই বলে

“আপনারা তো বললেন আপনার ছেলে আমার সব দায়িত্ব নিয়েছে। তাহলে আমার কোনো দায়িত্ব রইলো না, আজ থেকে আমি আর কোনো কাজ করবো না, সব আপনাদের ছেলের দায়িত্ব।”

ও কথা শুনে তন্ময়ের গলা শুকিয়ে কাঠ, অন্তত পাঁচ গ্লাস জল খেয়ে গুরুব করে ঢেকুর তুলে ডাইনিং টেবিল থেকে যেই উঠতে যাবে অমনি মৃন্ময়ীর ভিতরের দিদিমণি জেগে উঠেছে, ঠিক যেন হোমওয়ার্ক না করে আসা ছাত্র কে যেমন ধরে তেমনি খপ করে হাত দুটো ধরে বসিয়ে দিয়ে বলে

“তুমি আমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছো ,তাহলে আজ থেকে যতদিন বেঁচে থাকবো এ বাড়ির কোনো কাজ আমাকে করতে বলবে না। ”

ননদিনী রায় বাঘিনী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে

“এর মানে টা কি বৌদি? তুমি চাকরি করো বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ?”

“না মল্লিকা চাকরি করা না করার প্রশ্ন নয় , আমি চাকরি না করলেও সকাল থেকে সন্ধে অবধি যে হাউজ ওয়াইফরা ঘরের কাজ করে তাদের কাজ গুলো কি ফ্রী!!! তারা কাজ করছে বলেই সংসার চলছে না হলে শুধু নোট চিবিয়ে জল খেয়ে দিন কাটাতো ছেলেরা, তাহলে কে কার দায়িত্ব নিচ্ছে বলতো। ”

বাড়ির মধ্যে একেবারে পিনড্রপ সাইলেন্ট। শশুর মশাই পাঞ্জাবির পকেট থেকে ইনহেলার বার করে দুবার মুখে পাম্প করলেন। তন্ময় বুঝতে পেরেছে যে কি জিনিস তার ঘরে এসেছে। ননদিনী রায়বাঘিনী না পারছে কথা গুলোকে অস্বীকার করতে না পারছে মানতে।

বৌভাতের অনুষ্ঠান মিটলো, ঘোষালদের বাড়িতে যে সাইক্লোন এসেছে এটা ওরা খুব বুঝেছে। পরদিন সকালে বিয়েতে পাওয়া সব গিফট খুলে দেখা চলছে হটাৎ একটা শাড়ির প্যাকেট মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে মল্লিকা বলে

“বৌদি এটা তোমার জন্য আমি নিজে পছন্দ করে এনেছি।” শাড়িটার ওপরে রাখা দামের লেভেলটা তখনো রয়ে গেছে, মৃন্ময়ী খানিকটা সময় চুপ করে থেকে মল্লিকা কে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে

“মল্লিকা এ নাও তোমার তত্ত্বের শাড়ি , দাম তিন হাজার টাকা।”

চোখ কপালে তুলে মল্লিকা বলে

-এ কি কথা বৌদি, দাম বলে কি কেউ গিফট দেয়?

–কেন যদি প্রাইস ট্যাগ লাগিয়ে তুমি আমায় শাড়ি দিতে পারো আমি কি দোষ করলাম। তোমার থেকেই তো শিখছি।

মল্লিকা চলে যাবার সময় মৃন্ময়ী ডাক দিয়ে আবার বলে “নিউটনের থার্ড ল টা একটু পড়ে নিও মল্লিকা।”

মল্লিকা ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।

দুপুরে নন্দা জামাই এসেছে , ভাইয়ের বিয়ে মিটেছে আজ মল্লিকা নিজের বাড়ি ফিরে যাবে। মল্লিকার বর কলকাতার নামকরা দোকানের মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ঘোষালদের খাবার ঘরে এখন মিষ্টির সাইজ নিয়ে গভীর আলোচনা চলছে।

মল্লিকার বর দীপ্ত মৃন্ময়ী কে দেখে বলে “বৌদিদের ওখানকার মিষ্টি মানে তো নকুলদানা , এটা একবার চেখে দেখবেন , কলকাতার খাস দোকানের মিষ্টি।” মৃন্ময়ী ঘাড় নেড়ে হাসি মুখে সম্মতি জানায়।

আজ অষ্ট মঙ্গলা , বিকেলে মৃন্ময়ীর বাবা এসে নিয়ে যাবেন। আসবার সময় এক হাঁড়ি কমলা ভোগ নিয়ে এসেছেন। বৈঠকখানায় ঘর ভর্তি লোকের সামনে মৃন্ময়ী সেই হাড়ির ভিতর থেকে একসাথে দুটি কমলাভোগ নন্দাজামাইয়ের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মুখ বন্ধ করার আর উপক্রম নেই।

মল্লিকা ক্রুদ্ধ স্বরে বলে “বৌদি আমার বর কে কি মারতে চাও , একসাথে অত বড় দুটো মিষ্টি কেউ খাওয়ায়?”

“কেন মল্লিকা এটা তো নকুলদানা , দুটো কেন পাঁচটা একসাথে খেলেও নন্দা জামাইয়ের কিছু হবে না। ”

দীপ্ত মল্লিকা দুজনেই আবার বুঝলো কাকে বলে নিউটনের থার্ড ল।

অনিমেষ বাবু মুখ কাচুমাচু করে বসে সব দেখছেন, আরো খারাপ অবস্থা তন্ময়ের, ঠিক যেন বাঘের খাঁচায় তাকে কেউ ছেড়ে দিয়েছে। মরে ও শান্তি নেই।

শাশুড়ি বিহীন সংসারে ননদ মল্লিকার রাজত্বের অবসান হতে চলেছে তা ঘোষাল বাড়ির সবাই মনে মনে জানে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তন্ময়ের দাদার দুটো যমজ মেয়ে রুমি , সুমির সাথে মৃন্ময়ীর এক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারা নতুন কাম্মাকে পেয়ে খুব খুশী, কাম্মার কাছে পড়া, গান শেখা সব। কাম্মা পিসীর মত তাদের মা কে কথায় কথায় অপমান করে না, দুটো মেয়ে হয়েছে বলে অপয়া বলেও খোঁটা দেয় না।

বছর খানিক কেটেছে মৃন্ময়ীর ঘোষাল বাড়িতে, এখন এ বাড়ির অন্য চেহারা। এ সংসারে মল্লিকার কতৃত্ব আর তেমন নেই। সারা বাড়িতে একটা খুশির আমেজ। রোজ সকালে সবার ঘুম ভাঙ্গে রুমি সুমির গানের সুরে। দুই জা মিলে সংসারের হাল ধরেছে। ঘোষাল বাড়ির বড় কর্তা এখন দুই ছেলের ওপর সংসারের ভার ছেড়ে দিব্যি তীর্থ ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। সবাই মুখে প্রকাশ না করলেও জানে মৃন্ময়ী শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে রেখেছে।

কিছুদিনের মধ্যেই একটা সুখবর আসে মৃন্ময়ী মা হতে চলেছে। রুমি , সুমির খুব আনন্দ , বাড়িতে ছোট্ট একটা পুতুল আসবে , সারা বাড়ি যেন নতুন করে জেগে উঠেছে নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাতে। তন্ময়ের মা অনেক ছোট বয়সে মারা গেছেন, বড় বৌমার বেলায় মল্লিকার শাশুড়ি স্বাধ দিয়েছিলেন, এবার ও তাই। তন্ময়ের বাবা পরিতোষ ঘোষাল পাড়াশুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন করেছেন তার মেজ বৌমার স্বাধে।

ঘর ভর্তি লোকজনের মধ্যে মৃন্ময়ীর চোখ দুটো শুধু খুঁজছে তার দিদিভাই কে , সকাল থেকে দিদিভাই আর রুমি সুমির পাত্তা নেই। মৃন্ময়ীর শরীরটা ভালো তাই আর এই দিকটা নজর দিতে পারেনি।

তন্ময় কে ডেকে বলে “দিদিভাই কোথায় ? একটু ডেকে দাও , বলো আমি ডাকছি। সবাই এসে গেছে এবার তো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।”

-বৌদি বাড়ি নেই, আজ সকালে বাপের বাড়ি গেছে।

-কি ???

–হ্যাঁ , কাল রাতে মল্লিকা ফোনে বৌদিকে কি বলেছে জানিনা বৌদি বাপের বাড়ি চলে গেছে। কালকে ফিরে আসবে।

মৃন্ময়ীর সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠলো, সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে সে ছুটলো দিদিভাই কে আনতে।

“দিদিভাই আমার এত শুভদিনে তুমি আসবে না!!

“না মিনু আমি অপয়া, আমি তোর স্বাধের অনুষ্ঠানে গেলে তোর ও আমার মত মেয়ে সন্তান হবে। আমি চাই না যে তোকে ও কেউ আমার মত অপমান করুক।”

মৃন্ময়ীর কাছে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার।

“দিদিভাই তুমি না গেলে আজ ও বাড়িতে আমি ও যাবো না।”

রুমি সুমি কাম্মাকে দেখে খুব খুশী, প্রায় জোর করেই মৃন্ময়ী দিদিভাই কে নিয়ে এলো ঘোষাল বাড়িতে।

বাড়িতে ঢুকতেই মল্লিকার কথার তীর এসে আছড়ে পড়ে মৃন্ময়ীর ওপর।

“আচ্ছা মেয়ে মানুষ তুমি!! এই অবস্থায় বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে বেরিয়ে গেলে। তোমার দিদিভাই কে একদিন না দেখলেই কি চলছিল না।”

“না মল্লিকা আজকের অনুষ্ঠান দিদিভাই ছাড়া সম্পূর্ন হতে পারে না। এই মানুষটা এই নটা মাস ধরে সকাল দুপুর রাত আমার খেয়াল রেখেছে, সে না থাকলে আমার কোনো অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হবে না। তোমার না থাকলে ও চলবে । তুমি বরং আজ এস।

“বৌদি !!”

“হ্যাঁ মল্লিকা , তোমার ভাষায় তোমাকে বলছি তুমি আজ এস, তোমার ও দুবছর বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চা হয়নি, তুমি কোন সাহসে দিদিভাই কে অপয়া বলছো। ”

আহত বাঘিনীর মত গর্জে উঠে মল্লিকা বলে

“বাবা তুমি কিছু বলবে না। তোমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে তোমার মেয়েকে অপমান করছে।”

পরিতোষ বাবু ধীর গলায় বলেন “আজ বরং তুই আয়, পরে আরেকদিন আসিস। আজ আমার বাড়ির লক্ষীর স্বাধ, আজ কোনো অশান্তি চাই না।”

রাগে গ্লানি তে মাথা নিচু করে মল্লিকা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ওদিকে উঠোনে রুমি সুমি খেলছে আর বলছে “For Every action there is equal and opposite reaction.”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত