পাতাল দেবতা হেডেজ ও দেবী পার্সেফোন

পাতাল দেবতা হেডেজ ও দেবী পার্সেফোন

পাতাল দেবতা হেডেজ হলো দেবাধিপতি তথা আকাশ ও বজ্র দেবতা জিউসের ভাই। আর ফসল বা নিসর্গের দেবী ডিমিটারের কন্যা হলো তারুণ্য ও বসন্তের উদারতার দেবী পার্সেফোন। যদিও জিউসের শয্যাসঙ্গী ছিলো ডিমিটার, তবুও পার্সেফোন যে জিউসের কন্যা তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না! সে যাই হোক, মূল গল্পে আসি। একদিন পাতাল দেবতা হেডেজ হঠাৎ অনন্ত যৌবনা প্রাণবন্ত পার্সেফোনকে দেখে ফেলে, আর তৎক্ষণাৎ তার প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেবতা পাতাল ছেড়ে ভূপৃষ্ঠে উঠে এসে ঘুরতে থাকে পার্সেফোনের আশায়। আর অপেক্ষা করতে থাকে সঠিক সময়ের – ফুল কুড়ানো রাজকন্যা পার্সেফোনকে ধরার জন্য।

প্রেম মতাল হেডেজ তার প্রেমের গোপন কথাটি জিউসকে জানায়, জিউসের সাহায্য কামনা করে। অতঃপর দুই ভাই মিলে পার্সেফোনকে ধরার জন্য একটি পরিকল্পনা করলো। জিউস ধরিত্রী দেবী গায়য়াকে নির্দেশ দিলো মাঠে হলুদ ড্যাফোডিল ফুল ফোটাতে। উদ্দেশ্য ছিলো সে ফুলে পার্সেফোনকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করা।

একদিন সকালে দেবী ডিমিটার তার কন্যাকে নিয়ে অবতরণ করলো মাঠে। সেখানে ডিমিটার সাগর পরী, নদী-ঝর্ণার পরীদের সাথে পার্সেফোনকে ছেড়ে দিয়ে দেবী তার বিশাল শস্যক্ষেত্র দেখতে বের হলো।

পার্সেফোন যখন তার সাথীদের নিয়ে খেলায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ তার চোখ গেলো ড্যাফোডিলের দিকে, পার্সেফোন কিছুতেই সে ফুলের থেকে চোখ ফেরাতে পারলো না।

সে তার সঙ্গীদের ডাকলো ফুলের কাছে যেতে। কিন্তু জলপরীরা জানালো যে তারা কিছুতেই জলের এলাকা থেকে বেশী দূরে যেতে পারবে না, দূরের ঐ ফুলের কাছে গেলে তারা মারা যাবে। অগ্যতা পার্সেফোন নাচতে নাচতে একাই গেলো সে ফুলের কাছে এবং ধরিত্রী দেবী গায়য়ার বক্ষস্থল থেকে তুলতে চেষ্টা করলো সে ফুল। পার্সেফোনের প্রায় সবশক্তি চলে গেলো ড্যাফোডিলের গাছ ধরে টানাটানি করতে। অবশেষে উপরানো ড্যাফোডিলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে স্মিত হাসলো বালিকা। কিন্তু পরক্ষণেই গাছের উপরানো সে গর্ত ক্রমেই বড় হতে শুরু করলো।

গর্ত বড় হয়ে বিশাল আকার ধারণ করলো আর গ্রাস করতে চেষ্টা করলো পার্সেফোনকে। তীব্র বেগে পার্সেফোন সে গর্তের ভেতর দিয়ে পৌঁছে গেলো পাতালপুরীতে।

পৃথিবীর শষ্যক্ষেত্র দেখে ডিমিটার ফিরে আসলো সেখানে, যেখানে সে রেখে গিয়েছিলো তার কন্যাকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলোনা পার্সেফোনকে।

শুধু কান্নারত অবস্থায় দেখতে পেলো জলপরীদের। সখীর বিরহে কাতর জলপরী সায়েনের কান্নায় সেখানে সৃষ্টি হলো সায়েন নদীর। ডিমিটারকে তারা কিছুই বলতে পারলো না। শুধুমাত্র জলপরী সায়েন পার্সেফোনের কোমরবন্ধনীটি ধুয়ে বলতে পারলো যে পার্সেফোনের সাথে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। ক্রদ্ধ ডিমিটার তার মেয়েকে রক্ষা করতে না পারার অপরাধে পরী সায়েন ছাড়া সেখানকার সকল পরীদের অভিশাপ দিয়ে অদ্ভূত পা বিশিষ্ট ঘৃণীত সাইরেন বানিয়ে দিলো। কুৎসিত মোহিনী নারী সাইরেনরা তখন থেকে নাবিকদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে তাদের বিনাশ সাধন করতে থাকলো। তাদের ভেসে আসা মায়াবী সুরে নাবিকরা আকৃষ্ট হয়, ভেসে যায় সুরের সন্ধানে। সবশেষে নাবিকদের মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যায় সে মায়াবী সুর।

এদিকে হেডেজ পাতালপুরীতে জোর করে তার রানী করে রাখলো পার্সেফোনকে। দেবীর কুমারীত্ব লুন্ঠিত হলো দেবতার হাতে। কিছু ঘোড়ার ডাক শুনা গেলো শুধু; পাতালে প্রতিধ্বনিত হলো আর্তনাদ।

কন্যার শোকে পাগলপ্রায় হয়ে গেলো ডিমিটার, খুঁজে বেড়ালো সারা পৃথিবী। অবশেষে সে দেখা পেলো ডাকিনী, প্রেতাত্মা, মহাজাগতিক, যাদু ও মায়াবিদ্যার দেবী হিকেটের।

ডিমিটারের করুন অবস্থা দেখে হিকেট তাকে সূর্য দেবতা হিলিয়সের সাহায্য নিতে বললো। হিলিয়সের কাছে সাহায্য চাইলে হিলিয়স ডিমিটারকে অপহরণের সব ঘটনা বিস্তারিত জানালো।

তারপর ডিমিটার হেডেজের কাছে তার মেয়েকে ভিক্ষা চাইলো, আরো বললো যে – ফুলসম রাজকন্যা পার্সেফোন কিছুতেই অবরুদ্ধ পাতালে থাকতে পারবে না।

অতঃপর হেডেজ পরামর্শ করলো জিউসের সাথে; ঠিক করলো বছরের ছয় মাস পার্সেফোন পাতালে থাকবে আর ছয় মাস থাকবে তার মায়ের কাছে। পাতাল থেকে ফেরার সময় হেডেজ পার্সেফোনকে ছয়টি ডালিমের দানা খেতে বাধ্য করলো। বলা হয় যে ডালিমের দানা খেলে বন্দীকর্তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য থাকে বন্দী। ছয়টি ডালিমের দানা খেয়ে বছরের ছয় মাস পার্সেফোন বাধ্য হলো পাতালে থাকতে, বাকি ছয় মাস থাকলো সে মায়ের কাছে।

এখান থেকে সে দেশে আসলো বছরে ছয় মাস ব্যাপ্তির বসন্ত ও শীতকাল। যখন পার্সেফোন মায়ের কাছে ফিরে আসে, তখন পৃথিবীতে শুরু হয় বসন্তকাল। আর যখন পাতালে সে ফিরে যায়, তখন শুরু হয় শীতকাল।

এক সময় বাধ্যগত অপ্রত্যাশিত যৌন সম্পর্কটি বসন্ত দেবীর হৃদয়ে ভালোবাসার বসন্ত নিয়ে আসে। পার্সেফোন পাতালের সত্যিকারের রানী হয়ে হেডেজের সাথে শাসন করতে থাকে পাতালপুরী।

পার্সেফোনের মতো এখনো ফুলকুড়ানো ফুলময় মেয়েরা অপহরণের শিকার হয়। ডিমিটারের মত মেয়ের শোকে পাগল হয় কোন মা। পাতাল কিংবা কোন রাজ্যের রানী না হয়ে সে মায়ের রাজকন্যাটি অনেকক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে শরীর বিকিয়ে খায়। এখন আর পেশী শক্তির কাছে হার মেনে সবশেষে ভালোবাসা আসে না বসন্তের মত, শুধু ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিষ্ফল লুকানো ক্রন্দন। সে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজও নিরুপায় পার্সেফোনের দেখা মেলে ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত