ছোট্ট নিদ্রিতা

ছোট্ট নিদ্রিতা

সাইকেল দিয়ে বহু দূরে প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিলাম । মাত্রই পৌছালাম বাসায় । গেইট দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঢুকলাম । বাসার উপরতলা থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পাচ্ছি প্রচন্ড ।

বুঝলাম ফুফু আর চাচারা এসে গেছে । সাইকেলটা শক্ত করে ধরলাম । এটাকে আলগী দিয়ে দোতালায় উঠাতে হয় ।
সিড়ি অর্ধেকও পার হইনি , ফুফাতো আর চাচাতো ভাইবোনরা ” ভাইয়া ,ভাইয়া” করতে করতে দৌড়ে আসতে লাগলো ।
ভয় পেয়ে গেলাম খুব ! একবার ভাবলাম ঘুরে দৌড় দিব নাকি! ! সাইকেলটা না থাকলে হয়তো তাই করতাম , কিন্তু এই অবস্থায় এটা সম্ভব না ।

তৈরি হলাম এক অসম যোদ্ধা হিসেবে । লাভ হলো কচু !
ঐ ব্রিটিশগুলা প্রায় ২-৩ গজ দূর থেকে লাফ দিতে থাকলো । সুপারম্যানের মতো উড়ে উড়ে এসে আমার ঘাড়ে চড়ে বসতে লাগল ।

আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ । এতো বোঝা নিয়ে এত্তো সরু একটা সিড়িতে দাড়িয়ে থাকাটা অনেক কষ্টকর ।
অনেক বুঝিয়ে আর অনুরোধ করে ঐ পিচ্চি ইবলিশগুলাকে নামালাম ।
তারপর এক দৌড়ে সাইকেল নিয়ে উপরে । আতংকিত হয়ে দেখলাম ইবলিশগুলাও পিছনে দৌড়ে আসছে ।
দৌড় থামালাম না । দৌড়ের উপরেই সাইকেলটাকে কোনমনে বারান্দার রেলিং এর সাথে ঠেস দিয়ে রাখলাম ।
তারপর সোজা আম্মার রুম এ !

আম্মার রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম । মনে মনে হাফ ছেড়ে বাচলাম ।
ঠিক এই সময় একটা তীক্ষ কন্ঠ বলে উঠলো “এই আপনি যেখানে আছেন সেখানেই দাড়ান । চুপ । না হয় গুলি করে দিবো । আমি সিআইডি ইন্সপেক্টর বলছি !”

আমি এত্তো জোরে কন্ঠোস্বর শুনে ভয়ে একটা লাফ দিলাম ।
পরিমরি করে দরজা খুললাম । তাড়াহুড়ায় আমার পায়ে লেগে আম্মার একটা ফুলের টব সশব্দে মাটিতে পরলো ।
ততক্ষনে বাসার মোটামুটি সবাই হাজির । সবাইকে দেখে আমি একটু সাহস করে কন্ঠস্বরের উত্সের দিকে তাকালাম ।
সবিস্ময়ে দেখলাম আম্মার ঘরের আবছা অন্ধকারে একটা পিচ্চি দাড়ানো ।
আব্বা রুমে ঢুকে লাইট জ্বালালেন ।
কন্ঠস্বরের মালিককে দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ ! ৪ বছরের পিচ্চি নিদ্রিতা দাড়িয়ে আছে ।
আমার সবচেয়ে আদরের কাজিন সে । বড় চাচার মেয়ে ।
তার হাতে একটা কাঠের স্কেল । স্কেলটাকে সে অনেকটা বন্দুকের মতো ধরে আছে ।
মুখের ভঙ্গিমা অনেক সিরিয়াস ।
ওর এধরনের অদ্ভুত কান্ড দেখে সবাই হাসতে লাগলো । আর তখন সে মহাক্ষেপা সবার ওপর । বার বার কোকড়ানো চুল ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বলতে লাগলো “সিআইডি মামা তোমাদেরকে মেরে দিবে ।”
আম্মা হাসতে হাসতে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলেন । আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিক করে একটা হাসি দিয়ে বলল “ভাইয়া ভয় পাইছে । হি হি !”
আমি চোখ রাঙ্গানি দিলাম ওকে । সাথে সাথে ও বলল”দায়া মামাকে বলে দিবো । তোমাকে মেরে দিবে কিন্তু ।”
আমি আর কি বলবো ! হেসে দিলাম ওর কথা শুনে ।


নিদ্রিতা ভীষন চঞ্চল । সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না । ওর আবার মেকআপ করার খুব শখ ।
ঈদের সময় যখন বাসায় আসে , সারাটা বাসা সে একাই মাতিয়ে রাখে ।
আর যখনই দেখে কেউ মেকআপ করছে তখনই তার আশেপাশে ঘুরঘুর করে ।
সবচেয়ে মজা লাগে যখন ওকে কেউ লিপস্টিক দিয়ে দেয় ।
লিপস্টিক মুছে যাওয়ার ভয়ে বেচারি দুই ঠোট এক করে না । এমনকি কথা বলার সময়ও দুই ঠোট এক করে না ।
সে সারা দিন বসে বসে সিআইডি আর ডোরেমন দেখে । কেউ যদি বকা দেয় তাহলে থমথমে চেহারায় সিরিয়াস ভাব এনে বলে “সিআইডি মামা তোমাকে মেরে দিবে ।”

একদিন ওর সাথে বসে বসে টিভি দেখছি , আমার ভাল লাগছিলো না দেখতে । তাই টিভি দেখা বাদ দিয়ে পেপার পড়তে লাগলাম ।
নিদ্রিতা খেয়াল করলো ব্যাপারটা , হটাত্ বললো “ভাইয়া দেখো , সিআইডি মামা এখন খারাপ লোকটাকে ধরে ফেলবে ।”
আমি বললাম “নাহ,তুমি দেখো…আমি দেখবো না ।”
ও কতক্ষন চুপচাপ বসে রইলো, তারপর বলল “ভাইয়া । তোমাকে একটা পাপ্পি দিবো । তুমি দেখো প্লিজ ।”
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা । নিদ্রিতা সাধারনত কাওকে চুমো দেয় না । ওটা খুব দুর্লভ জিনিস ।
আমি বুঝলাম ওর কাছে খারাপ লাগছে যে আমি টিভি দেখছি না ।
আমি হেসে দিলাম । আর আমার হাসি দেখে ওর মুখেও একটা নিষ্পাপ হাসি ফুটে উঠলো ।ও দৌড় দিয়ে এসে আমার কোলে ঝাপিয়ে পরলো ।
স্বভাবতই আদর করতেই হলো ।সে মানুষের কাছ থেকে আদর কেড়ে নেয় ।


আর একদিন আমার মেজাজ খুব খারাপ । মেজাজ খারাপ হলে আমি আবার কাওকে সহ্য করতে পারি না ।
নিদ্রিতা আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকলো । বুঝলাম কোন মতলব আছে ।
রাগত স্বরে বললাম “কি হইছে তোমার ? যাও এখান থেকে ।”
সে আস্তে আস্তে বলল”ভাইয়া চিপস্ খাবো ।”
আমি আরো রেগে বললাম “যাও তো এখান থেকে । না হলে একদম একটা রুমের মধ্যে আটকে রাখবো ।”
সে ফিক্ করে একটা হাসি দিয়ে বলল “দায়া মামা এক লাথি দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে ।”
সে কথাটা এমন ভঙ্গিমায় বলল যে আমার প্রচন্ড হাসি পেলো ।
আমাকে হাসতে দেখে ও তো মহাখুশি । তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে থাকলো ।
ওকে নিয়ে দোকানে গেলাম ।
সেখানে গিয়ে আরেক বিপদ ! ! কিছুই ওর পছন্দ হচ্ছে না ।
১৫ মিনিট ধরে এটা ওটা দেখাচ্ছে , আবার বলছে “না এটা না” ।
বিরক্ত হয়ে গেলাম । ওকে বললাম “তুমি দুষ্টমি করছো। আমি চলে যাই ।”
আমি ওকে দেখানোর জন্য বাসার দিকে ফিরে হাটা ধরলাম । ও কতক্ষন করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো।
তারপর দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে রাগত গলায় বলল “পচা দোকান । কিচ্ছু নাই । এই জন্যই তো দায়া মামা তোমার চুল কেটে ফেলেছে ।”

দোকানদার আঙ্কেল থতমত খেয়ে গেলেন । আঙ্কেলের আবার মাথা স্টেডিয়াম স্ট্যাইল । মানে মাঝখানে চুল নেই । আঙ্কেল ওর কথা শুনে পচন্ড জোরে হেসে উঠলেন । নিদ্রিতাকে কোলে তুলে দোকানে নিয়ে গেলেন ।
ওর যা মন চাচ্ছে আঙ্কেল তার সামনে দিচ্ছে । ও তো মহাখুশি । ওর হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার মনটাও ভালো হয়ে গেছে ততক্ষনে ।. . . .

কিছুদিন আগে সে বাসায় এসেছিলো । ও নাকি স্কুলে ভর্তি হইছে ! !
রাশভারী চেহারা নিয়ে সে ঘরে ঢুকলো । আমাদের পরিবারের সবাই তখন সেখানে বসে আছে ।
আব্বা ওকে জিজ্ঞেস করলো “আম্মু । কেমন আছো তুমি?”
ও গম্ভীর গলায় জবাব দিলো “মোটা চিকন !”
আমরা সবাই তো অবাক ! এটা কি উত্তর দিলো !
আমার ছোট বোন ওকে বলল “ও তুমি কি বলতে চাইছো মোটামুটি ?”
সে কঠোর গলায় বলল “না । আমি মোটা চিকনই বলতে চেয়েছি । মোটার বিপরিত চিকন । ভালোর বিপরিত খারাপ ।”
ওর এই উত্তর শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো ।
তারপর সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো ।
সবার হাসি দেখে নিদ্রিতাও হেসে দিলো ।
আম্মা আবার ঐ দিন ভাপা পিঠা বানাইছিলো । তো সবাই পিঠা খাচ্ছে । নিদ্রিতাকে একটা পিঠা দেওয়া হলো ।
সে চুপচাপ পিঠাটা খেলো । তারপর দৌড়ে গেলো আম্মার কাছে । গিয়ে বলল “চাচি । আরেকটা পিঠা দাও তো ।”
আম্মা খুব ভালো করেই জানেন যে নিদ্রিতা একটা পিঠাই ঠিকমতো খায় না । ঐ দিন যা ও খেয়েছে ।
কিন্তু একটা পিঠা খাওয়ার পর আরেকটা পিঠা চাওয়াটা আম্মার কাছে সন্দেহজনক মনে হল ।
আম্মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন “কি করবা আম্মু ? খাবা ?”
সে বলল “না চাচি । অনেক শীত তো , তাই পিঠার উপরের ধোয়া দিয়ে হাত গরম করবো ।”
ওর এই কথা শুনে হাসতে হাসতে সবার নাকে মুখে উঠলো ।
আর ও মহাবিজ্ঞের মতো মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো ।


দেখতে দেখতে আমাদের সেই ছোট্ট নিদ্রিতার বয়স ৬ এ পরলো । সোনালি স্মৃতিঘেরা সেই মধুর দিনগুলো আজো মনে পরে ।
নিদ্রিতা আগের মতো আর এতো আনন্দ করে না । এখন সে কেজি তে পড়ে ।
এখন সে আগের মতো এতো প্রানচন্বল নেই ।
পড়াশুনার চাপ আর একা থাকতে থাকতে সে অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছে ।
ওর “ভাইয়া” ডাকটার মধ্যে একটা আশ্চর্য টান আছে । যেটা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি ।
ওর অনেক মজার মজার ছবি আর ভিডিও আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি । মাঝে মাঝে সেগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে ।
নিদ্রিতার ছোট বোনের নাম নিবৃতা । নিবৃতা অনেক ছোট। কথা বলতে পারে না ঠিক মতো । তারপরও সে মহাদুষ্ট ।
মাঝে মাঝে নিবৃতার ঐ দুষ্টমির মধ্যে আগের সেই ছোট্ট নিদ্রিতাকে খুজে পাই ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত