অবশেষে ভালোবেসে

অবশেষে ভালোবেসে

‘ভীতু’ ক্যাটাগরিতে নোবেল দেওয়ার নিয়ম থাকলে আমার পুরস্কার কেউ ঠেকাতে পারত না। কারণ ভীতু হিসেবে আমার পারফর্মেন্স বরাবরই ঈর্ষনীয়। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমার এই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখে কারো না আবার নজর লেগে যায়। আমি তখন মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম না, তবে কোনদিন সামনের বেঞ্চে বসার সাহস পাইনি। বসতাম পেছনের বেঞ্চে, ঠিক দরজাটার কাছে। পাশে একটা জানালাও থাকতো। এহেন আসন বেছে নেওয়ার কারণ ছিল একটাই ভয়।

ভার্সিটিতে ভর্তির আগেই অনেকের মুখে শুনেছিলাম এখানে নাকি যেকোন সময় মারামারি লেগে যেতে পারে। আর মারামারির নির্দিষ্ট ভ্যনুও নাকি নেই। ক্যান্টিনেও হতে পারে, ক্যাম্পাসেও হতে পারে আবার ক্লাসরুমেও হতে পারে। তাই আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম এবং দরজার পাশে বসতাম। যাতে অবস্থা বেগতিক দেখলে ঝেড়ে দৌড় দিতে পারি। একদিন ক্লাসে বসে আছি। হঠাৎ ঠাস করে একটা আওয়াজ। আমি আধ ঘুমে ছিলাম। আওয়াজটা শুনে কয়েকশো পার্সেন্ট নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, শুধু মারামারিই নয়, একেবারে গুলাগুলি লেগে গেছে।

আমি ‘মাগো’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে দরজার কাছে আসতেই দেখি দরজাটা ভেজানো। খুলতে দেরী হতে পারে। কিন্তু দেরি হলে যদি গুলাগুলির মধ্যে পড়ে যাই! তাই সময় নষ্ট না করে জানালা দিয়ে মারলাম এক লাফ। বাইরে গিয়ে পড়তে পড়তে স্যারের গলা শুনতে পেলাম, এই ছেলে যাচ্ছো কোথায়! কে শুনে কার কথা। আমি লাফ দিয়ে পড়েই দৌড়। যখন দৌড় থামলো তখন মনে মনে এক গাদা ধন্যবাদ দিলাম কর্তৃপক্ষকে। যেহেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের ক্লাসটা নিচ তলায় ফেলেছিলেন। আজ যদি দোতলা বা তিনতলায় ফেলতেন তাহলে এই বিপদের সময় জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাঁচতে পারতাম? একটু পরেই টের পেলাম পুরোপুরি বাঁচতে পারিনি। লাফানোর সময় ঘষা লেগে হাতের চামড়া উঠে গেছে।

পরদিন ক্লাসে গেলাম ব্যান্ডেজ নিয়ে। আমাকে দেখে সবাই হাসির প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ফেললো। মানে কে কত বেশি হাসতে পারে। আমি বুঝতে পারছিলাম না গতকাল গোলাগুলির ঘটনা ঘটা সত্বেও আজ কেন তারা এভাবে হাসছে। একটু পরেই অবশ্য সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল। আমি আসলে যে আওয়াজটাকে গুলির আওয়াজ মনে করে জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছিলাম সেটি ছিল বেলুন ফাটার আওয়াজ। যে স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন তার ছিল সেদিন বার্থডে। কয়েকজন ছাত্র তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে বেলুন, ফুল এবং আরো কী কী যেন নিয়ে এসেছিল। ক্লাসের পরই স্যারকে দিতো। কিন্তু চাপ লেগে একটা ফেটে যায়। আমি আধো ঘুমে নেই আওয়াজকেই গুলির আওয়াজ মনে করে..

হাসি প্রতিযোগিতার পর যখন ক্লাস শুরু হলো তখন সবাই চুপ হয়ে গেল। শুধু একজন ছাড়া। মিতু। সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ননস্টপ হাসতে লাগলো। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু স্যারের সামনে তাকে ধমক দেবো, সেই সাহস আমার নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাস শেষ হলে বোঝাবো মজাটা। একসময় ক্লাস শেষ হলো। আমি গিয়ে দাঁড়িয়েও পড়লাম মেয়েটার পাশে। ধমক দিতে যাবো, এমন সময় মনে হলো আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত পায়েও হালকা ভাইব্রেশন অনুভব করলাম। খুব ভালোভাবেই বুঝে গেলাম, কাউকে ধমক বা ঝাড়ি দেওয়ার দুরূহ কাজটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মিতুর পাশে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন দেখলাম হাত পায়ের ভাইব্রেশন বেড়েই চলছে, তখন নিজের সিটে প্রত্যাবর্তন করে বসে পড়লাম।

আমার কাণ্ড কারখানা দেখে মিতু এবার তার হাসির ভলিয়ম বাড়িয়ে দিল। আমি সহ্য করতে না পেরে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলাম। এর দুদিন পরের ঘটনা। আমি টিউশনি করে হলে ফিরছি, চারুকলার কাছে আসতেই একটা ছেলে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বললো যা আছে দিয়ে দিতে। ছেলেটা এমনই পুচকে আর এমনই কঙ্কালসার মার্কা যে, আমি এক ঘুষি দিলে চারুকলার বাউন্ডারি ছাড়িয়ে ওপাশে গিয়ে পড়বে। কিন্তু ঘুষি যে দেবো, হাত তো মুষ্টিবদ্ধ হতে হবে, নাকি! বারবার আমার মনে হচ্ছিল ভয়ে আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো শরীর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ছেলেটাকে আর দ্বিতীয়বার কথা বলতে হলো না। তার প্রথম আদেশেই আমি আমার পরনের প্যান্টটা রেখে সব কিছু তার হাতে সমর্পণ করলাম। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে নিতে গিয়ে যখন দেখলো দু তিনটে ফুটো আছে, তখন আর নিল না। আমি প্যান্ট আর স্যান্ডো গেছি পরে চলে এলাম হলে।

এই বেশে আমাকে হলে ফিরতে দেখে আমার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জেনে নিতে দেরি করলো না আমার রুমমেট এবং অন্যান্যরা। তারা এই মর্মে আমাকে যাচ্ছেতাই বলতে লাগলো যে, একটা কাঠবডি সাইজের ছেলে কীভাবে তোর মত পালোয়ানের কাছ থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। পরদিন ক্লাসে গিয়ে শুনি সবার মুখে শুধু আমার নাম। আমার এক রুমমেট আমার সাবজেক্টে পড়ত। সে-ই পুরো ক্লাস জুড়ে এই ঘটনা ছড়িয়েছে। এরমধ্যে আমি খেয়াল করলাম মিতু আমার দিকে তাকিয়ে সেদিনের চেয়েও জোরে জোরে হাসছে। এবার মনে হলো আমার ওপর অলৌকিক একটা সাহস ভর করেছে। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলামÑতুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসো কেন? আমার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল মিতু। সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে আগের মত হাসি হাসি মুখ করে বললো, একটা মেয়ে একটা ছেলেকে দেখে কেন হাসে বোঝো না তুমি?

এবার মনে হয় আমি কয়েক হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের শক খেলাম। শকের ঝাঁকুনি যখন থামলো তখন আমি লজ্জায় রক্ত শাপলার মত লাল হয়ে অনেকটা দৌড়ে পালিয়ে গেলাম মিতুর সামনে থেকে। শুরু হলো তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা। আর দেখবোই বা কেন। জীবনে কেউ আমাকে কোনদিন এমন রোমান্টিক কথা বলেনি। এরপর আমি প্রতিদিন ক্লাসে এসে এমন জায়গায় বসতাম যেখান থেকে মিতুর মুখটা সরাসরি দেখা যায়। মিতু আমার দিকে তাকিয়ে হ্সাত আর আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। এতো সহজে আমার প্রতি একটা মেয়ে এতোটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, আমি চিন্তাই করতে পারছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কী, তখনও আমি এক বিন্দু বুঝতে পারিনি মিতু আমাকে নিয়ে মজা করছে। আমাকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পাচ্ছে।

একদিন ক্লাস শেষে রুমে ফিরে দেখি যে বইটি নিয়ে আমি ক্লাসে গিয়েছিলাম তার ভেতরে একটা চিরকুট। এতে লেখা,আমি তোমাকে ভালোবাসি। ইতি-মিতু। চিরকুটটি দেখে আমি আনন্দে কতক্ষণ বাকরুদ্ধ ছিলাম, বলতে পারবো না। টিউশনির সময় হয়ে গেল। টিউশনী শেষে রুমে ফেলার সময় আবারও সেদিনের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়লাম। তবে আজ একা নয়, ওরা চারজন। তারা সবকিছু দিয়ে দেওয়ার আদেশ জারি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি সব দিলাম বটে, তবে মানিব্যাগটা রেখে দিলাম হাতে। তারা এটা নেওয়ার জন্যে আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে যখন ওরা দেখলো লোকজন চলে আসছে, তখন মানিব্যাগ নিতে না পারার রাগে আমাকে ছুরি মেরে পালিয়ে গেল।

পরদিন হাসপাতালের বেডে অন্য সবার মত আমাকে দেখতে গেল আমার সহপাঠীরাও। তাদের বিস্ময় কিছুতেই কাটছিল না। তাদের প্রশ্ন, বেলুন ফাটার আওয়াজকে গুলির আওয়াজ মনে করে যে ছেলে জানালা দিয়ে লাফ দেয়, পুচকে ছিনতাইকারীর হাতে যে সবকিছু সপে দিয়ে চলে আসে, সে কীভাবে এতোগুলো ছিনতাইকারীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে! আমি বললাম, কী করবো। মানিব্যাগটা তো দিয়ে দিতে পারি না। একজন জিজ্ঞেস করলো, কেন, মানিব্যাগে কয় টাকা ছিল? আমি বললাম, ছাব্বিশ টাকা।

এবার ছি ছি পড়ে গেল সবার মধ্যে। তুই এমন কঞ্জুস? ছাব্বিশ টাকার জন্যে নিজের জীবন বাজি ধরলি? আমি এবার মানিব্যাগ থেকে মিতুর লেখা সেই চিরকুটটি বের করে বললাম,টাকার জন্যে না। মানিব্যাগে এই চিরকুটটি ছিল। ওরা মনিব্যাগটা নিয়ে গেলে আমি এটা পেতাম কোথায় বল! ওদের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল মিতু। আমার কথা শুনে তার সেই দুষ্টুমি ভরা চোখ তলিয়ে যেতে লাগলো জলে। আমি আর কিছু বললাম না। কিছু বললো না মিতুও। তারপর সে সবার সঙ্গে চলে গেল ঠিকই, তবে একটু পরই আবার একা এসে দাঁড়াল আমার সামনে। আমার হাত ধরলো। এই হাত সে আজও ছাড়েনি।

লিখেছেন – ইকবাল খন্দকার |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত