হৃদিতা ও তার বাবা

হৃদিতা ও তার বাবা

হৃদিতা আজকে অনেক খুশি। এতই খুশি যে রাক্ষসী ম্যাডামের ক্লাস করতেও আজকে তার খুব ভাল লাগছে। রাক্ষসী ম্যাডামের আসল নাম রাবেয়া খাতুন, কিন্তু তার রাক্ষসী মার্কা স্বভাব এর জন্য ক্লাসের সব মেয়েরা মিলে তার নাম দিয়েছে রাক্ষসী ম্যাডাম। এই ম্যাডামের ক্লাসের ৪০মিনিট পার করা মেয়েগুলোর জন্য রীতিমত নরক যন্ত্রণা !! কিন্তু আজকে হৃদিতার মনে হচ্ছে, “নাহ!! রাক্ষসী ম্যাডামটা আসলে এত খারাপও না !!”

দুপুর ১২টা বেজে ২০মিনিট এ হৃদিতার স্কুল ছুটি হল। দারোয়ান চাচা ঘন্টাটা বাজানোর সাথে সাথে হৃদিতার মনে হল এক ছুটে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেটের কাছে চলে যায় সে। আর তাই ক্লাস থেকে ম্যাডাম বের হওয়া মাত্র ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে পানির ফ্লাস্কটা হাতে নিয়ে এক দৌড় দিল সে, এক দৌড়ে একদম গেটের সামনে। আর সেখানে গিয়েই দেখল তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা বড় ডেইরী মিল্ক, অনেক বড়টা। কি মজা, খুশিতে হৃদিতা বাবার কাছে গিয়ে তার গালে একটা চুমু দিল। আজকে তার খুব আনন্দের দিন। প্রতি মাসে এরকম একটা দিন তার বাবা তাকে স্কুল থেকে নিতে আসে। সেদিন তারা দুজন সারাদিন ঘোরে, আর তারপর সন্ধ্যাবেলা বাবা তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর আবার এক মাস বাবার চেহারাটা দেখা হয়না বাচ্চা মেয়েটার।

হৃদিতার বাবা ফরহাদ হোসেন বেশ হাসিখুশি মানুষ। মজার মজার গল্প করতে পারার কারণে যেকোন জায়গায় গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই আড্ডার মধ্যমণি হয়ে যান সহজেই। এভাবেই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে শাহানার সাথে পরিচয় তার। পরিচয়ের অল্পদিনের মাথায় পরিণয়, এবং অতঃপর বিয়ে। বিয়ের ২বছরের মাথায় জন্ম হয় হৃদিতার। আর তার কিছুদিন পর থেকেই তাদের মধ্যে মনোমালিন্যের শুরু। ছোটখাট বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা কাটাকাটির এই শুরুটা বছর চারেকের মধ্যে শেষ হয় ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে। আর আইন এর কথামত হৃদিতার কাস্টডি পান শাহানা। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মেয়ের বন্ধুত্বটা অনেক ভাল থাকায় ফরহাদ সাহেব আর হৃদিতা দুজনেরই খুব কষ্ট হয় আলাদা থাকাতে। আর এজন্যই শাহানার অনুমতি নিয়ে প্রতি মাসের একটা দিন ফরহাদ সাহেব হৃদিতাকে নিজের কাছে রাখেন। সেদিন হৃদিতার স্কুল ছুটির পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোটা সময় তিনি মেয়ের সাথে কাটান। এসময়টায় ফরহাদ সাহেব শুধুই একজন বাবা, নিজেকে দৈনন্দিন জীবনের বাকি সব সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে একদম মুক্ত করে শুধুমাত্র হৃদিতার বাবা হয়ে কাটান তিনি মাসের এই একটা দিন। আর হৃদিতার চেষ্টা থাকে বাবার সাথে এমন সব আনন্দ করা যাতে সামনের একটা মাস যখন বাবাকে অনেক মিস করবে সে তখন যেন এই সময়গুলোর কথা মনে করে কান্না থামাতে পারে সে। আর আজকেও তেমন একটি দিন। শুধুমাত্র পিতা এবং কন্যার দিন।

স্কুল থেকে বের হয়ে ফুটপাথ ধরে বাবার সাথে হাঁটছে হৃদিতা। ডান হাত দিয়ে বাবার বাম হাতের তর্জনীটা ধরে আছে সে। সবসময় এভাবেই ধরে সে বাবার হাত। শুধু তর্জনী। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা ফুচকার গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে গেল হৃদিতা। “বাবা, ফুচকা খাব।” বাইরের খাবার খাওয়ার ব্যপারে মেয়ের উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা হৃদিতার মায়ের। এজন্যই এসব খাবারের আবদার ভয়েও সে মার কাছে করেনা। বাবাকে একদমই ভয় পায় না হৃদিতা। তার বাবা অনেক ভাল। কখনো না করে না কোন কিছুতে। আসলে এই একটা দিন মেয়েকে খুব হাসিখুশি দেখতে চান ফরহাদ সাহেব, তাই মেয়ের কোন আবদারই অপূর্ণ রাখেন না। তাই বাবা-মেয়েতে মিলে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বেশ মজা করে ফুচকা খেলেন তারা। এরপর মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় উঠলেন তিনি। এই দিনের বেশ অনেকটা সময় তারা দুজন রিক্সা করে ঘুরে বেড়ান। আর এই রিক্সা ভ্রমণের মাঝে চলতে থাকে ফরহাদ সাহেবের আইকিউ টেস্ট। “বাবা তুমি কি জান আইনস্টাইন কে?” “বাবা তুমি কি জান মানুষ আগে বানর ছিল?”

“বাবা তুমি কি বলতে পারবা রংধনুতে যে রঙ গুলা থাকে সেগুলা কি কি?” এভাবে গত একমাসে নিজের অর্জিত সকল বিদ্যা বাবাকে মহা উৎসাহে প্রদর্শন করে হৃদিতা। আর ফরহাদ সাহেব এমনভাবে অবাক হবার ভঙ্গী করেন, যেন হৃদিতা না বললে এত কিছু কখনোই জানতেন না তিনি। আর এতে নিজের জ্ঞানের সম্ভারে তৃপ্ত হৃদিতার মুখে বিজয়ীর যে হাসি ফুটে ওঠে তা দেখে আনন্দ পান তিনি। দুপুরের দিকে মেয়েকে নিয়ে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলেন ফরহাদ সাহেব। হৃদিতার চায়নিজ ফুড খুব পছন্দ। চায়নিজে বসে চিকেন ফ্রাইয়ে কামড় বসানোর ফাঁকে ফাঁকে গত এক মাসে স্কুলে কি কি হল যথারীতি সব বাবাকে বলা শুরু করলো হৃদিতা। “জান বাবা আমাদের রাক্ষসী ম্যাডাম না সেদিন একটা মেয়ের আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিয়ে শাস্তি দিল। মেয়েটা এত কাঁদল জান বাবা।” “বাবা তোমাকে বলেছিলাম না যে আদৃতা একটা খেলনা পুতুল কিনেছিল, যেটা হ্যাপী বার্থডে গান গাইতে পারে, সেটার মাথাটা না ওর ছোট ভাই আকিব ভেঙ্গে দিয়েছে। আর তাই আদৃতা রাগ করে আকিবের বল জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে।” “বাবা জান অরিনের আম্মু না রেজাল্ট খারাপ করায় রাগ করে বাসার ডিশের লাইন কেটে দিয়েছে, অরিন এখন আর কার্টুন দেখতে পারে না।” “বাবা আমার যে একটা লাল চুলের ব্যান্ড ছিল না? সেটা না হারিয়ে গিয়েছে স্কুলে বরফ-পানি খেলার সময়।” এভাবে নিজের সারা মাসের সব গল্প এই ফাঁকে বাবাকে বলে ফেললো হৃদিতা। এরপর বিকেল বেলা বাবার সাথে মুভি দেখতে গেল। “আমার বন্ধু রাশেদ”। বইটা বাবা তাকে ২মাস আগে কিনে দিয়েছিল। বইটা পড়ে অনেক কেঁদেছে হৃদিতা। রাশেদের জন্য এত্ত বেশি খারাপ লাগছিল যে পরের ৩দিন মন খারাপ হয়ে ছিল তার। আজকে যখন বাবা বললো যে এই গল্পটা নিয়ে মুভি হয়েছে আর আজকে তারা সেটা দেখতে যাবে, হৃদিতা চিন্তায় পড়ে গেল। সিনেমা হলে সবার সামনে কান্নাকাটি করলে বাবা ভেঙ্গাবে না তো তাকে? চিন্তার বিষয়!!

কান্নাকাটি করলে বাবা তাকে খুব ভেঙ্গায়। কিন্তু তবুও সে দেখতে যাবে। বাবার পাশে বসে বাবার হাতে পপকর্ণ খেতে খেতে মুভি দেখা, ইস কতদিন যে এমন ভাবে সময় কাটানো হয় না তার!! এটা ভেবে আবার কান্নাকাটির দুঃশ্চিন্তা চলে গেল তার। এরপর দুজন মিলে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুভি দেখে যখন বের হয়ে রিক্সা নিল তখন হৃদিতার চোখে পানি। নাহ, রাশেদের জন্য কাঁদছে না সে। বাবার সাথে কাটানোর জন্য বরাদ্দ আজকের সময়টা শেষ। এটা ভেবেই বারবার কান্না চলে আসছে তার। আর সে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে বাবা চোখের পানি দেখতে না পায়। তাহলে আবার তাকে ভেঙ্গাবে দুষ্ট বাবাটা। বলবে, “আমিতো জানতাম আমার মেয়ে অনেক ব্রেইভ, অনেক স্ট্রং। সে একদম কান্নাকাটি করে না। এখন তো দেখছি সে তার ফ্রেন্ড মিতুর মত একটুতেই ভ্যা করে কেঁদে দেয়।” কেমন লাগে কথাটা শুনলে? মিতু হল তাদের ক্লাসের সবচেয়ে বোকা মেয়ে, একদম হাবা টাইপ। কেউ কিছু বললেই ভ্যা করে কেঁদে দেয়। আর বাবা কি না বলে সে মিতুর মত? ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা !! এই লজ্জার ভয়েই বাবার সামনে কাঁদে না হৃদিতা। ফরহাদ সাহেব সবসময় একটা কাজ করেন এই সময়টায়। হৃদিতা যখন প্রতিবার যাবার বেলায় কেঁদে দেয় এবং নানান কায়দায় সেই কান্না লুকানোর চেষ্টা করে তিনি এমন একটা ভাব করেন যেন তিনি আসলেই দেখতে পান নি মেয়ের চোখের পানি। আর সেই ফাঁকে নিজের চোখটাও মুছে নেন। মেয়েটাকে আবার এক মাস দেখতে পারবেন না এটা মনে হলেই চোখ ভিজে যায় তার। “আইন গুলা কেন এমন?” “বাচ্চা কেন সবসময় মার কাছেই থাকবে?” “বাবারা কি বাচ্চাদের ভালবাসে না?” ছেলেমানুষি এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকেন তখন তিনি। নাহ, জবাব কখনোই পান না।

হৃদিতার বাসা এসে গেছে। ইস, বাসাটা এত কাছে কেন তাদের? রাস্তায় কেন একটু জ্যাম পড়ল না? কেন রিক্সার চাকাটা নষ্ট হয়ে গেল না? এসব কথা মনে হয়ে আবারো হৃদিতার চোখ ভিজে যাচ্ছে। এখনি তাকে বাসায় উঠে যেতে হবে, বাবা তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। এরপর আবার এক মাস বাবার সাথে দেখা হবে না তার। এসব ভাবতে ভাবতে বাবার তর্জনীটা ধরে সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো হৃদিতা। বাবার গালে একটা চুমু খেয়ে বললো, “বাবা তুমি ভাল থেক। আমার জন্য একদম চিন্তা করবে না। আমি অনেক ভাল থাকব। ঠিকমত পড়াশোনা করবো। প্রতিদিন দুধ খাব। আর একদম মিতুর মত করে কান্নাকাটি করবো না। আমি তোমার ব্রেইভ গার্ল বাবা, সত্যি !!” ফরহাদ সাহেব মিষ্টি করে হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিলেন একটা। মেয়েটা এত মিষ্টি হয়েছে। ইচ্ছে করছে আরো একবার জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু তিনি ধরবেন না। মেয়েটা আরো কাঁদবে তাহলে। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে খুব। তিনি চান না হৃদিতা তাঁর চোখের পানি দেখুক। মেয়েকে আর কিছু না বলে উল্টা দিকে ফিরে হাঁটা দেন তিনি। রাস্তায় বের হবার কিছুক্ষণ পরেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি দেখে খুশি হয়ে গেলেন ফরহাদ সাহেব। রাস্তার কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝবে না এখন। কেউ আর তাকে দেখে মনে মনে ভাববে না “কি ব্যপার? এই লোকটা কাঁদছে কেন??”

লিখেছেন – ফারহানা নূসরাত |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত