দ্যা রিভেঞ্জ

দ্যা রিভেঞ্জ

– বাইরের খাবার খাবি না, জানালা দিয়ে মাথা বের করবি না, আর পৌঁছে মাত্র আমাকে ফোন দিবি ।
– মা, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমি এখনো স্কুলেই পড়ি ! আমি বড় হয়েছি না ?
– না, মোটেও বড় হস নাই! মায়ের কাছে সন্তানরা কখনো বড় হয়না । আর কেন এমন করি ? যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি ।

– আরেহ! তুমি দেখি সিরিয়াস হয়ে গেলে ! আমি তো দুষ্টামি করে বলেছিলাম ।
– সাবধানে যাস মা । তুই তো অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলি । এখানকার পরিস্থিতির কথা জানিস না । দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না।
– মা, আমি আমার যে বান্ধবীগুলোর সাথে যাচ্ছি এরা সবাই এক একটা বিচ্ছু । এরা সবাই মিলে যে কত অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে- সেটা যদি জানতে তাহলে অবাক হয়ে যেতে । আমি তো চার বছর সুইজারল্যান্ডে ছিলাম, সেখানকার মেয়েরা যে একা একা কত কিছু করে এসব যদি জানতে…
– আমার কিছু জানার দরকার নাই । তুই গিয়ে মাত্রই আমাকে ফোন দিবি- এটাই আমার ফাইনাল কথা ।
– ঠিক আছে মা, তাই হবে । লাভয়্যু ।
– লাভয়্যু টু ।

মেয়েকে বাসে তুলে দিয়ে মিসেস রায়হান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । আজকালকার মেয়েরা এত জিদ্দি হয়েছে ! একবার মাথায় যেটা আসবে সেটা করেই ছাড়বে । মেয়ে মাইশা মাত্রই গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করে দেশে ফিরেছে । বিদেশ থেকে আসার সময় শুধু ডিগ্রীই আনেনি, নিয়ে এসেছে মাথাভর্তি পাগলামিও । মাইশা, তানিয়া, সেঁজুতি, নীরা, হৃদি– সেই নার্সারি থেকেই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী । মাইশা ফিরে আসার পর থেকে তাদের বন্ধুত্বটাও জমেছে বেশ । সেই সাথে চলছে পাগলামিও । এই যেমন এখন- বান্ধবীরা সবাই মিলে ঠিক করেছে কক্সবাজারে ট্যুরে যাবে । কিন্তু সঙ্গে কোন গার্জিয়ান যাওয়া চলবে না । প্রথমে কারো বাবা-মা ই মানতে চায়নি । কিন্তু সন্তানের আবদার বলে কথা ! না মেনেও আর উপায় কি ?

জানালার পাশের সিটে বসা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মিসেস রায়হানের চোখ ঝাপসা হয়ে এল । তা না হলে দেখতে পেতেন ২৭-২৮ বছরের ফর্সা মতন একটি ছেলে বাসে চেপে বসেছে । যার চোখে ছিল টকটকে লাল, সেখানে ছিল ভয়ংকর প্রতিশোধ স্পৃহা আর তীব্র ঘৃণা ।

দুই.

একে খান মোড়, চট্টগ্রাম।
ভোর সাড়ে পাঁচটা, আকাশ তখন আঁধার কাটিয়ে মাত্র পরিষ্কার হতে শুরু করেছে । মাইশাদের বহনকারী গ্রীণলাইনের স্ক্যানিয়াটা মাত্র কাউন্টারে এসে থেমেছে ।
এখন এক ঘন্টার যাত্রাবিরতি । রাতের দীর্ঘ জার্নির পর এখন যাত্রীরা এখন একটু ফ্রেশ হবেন, লাইট স্ন্যাক্স নিবেন ।
সারা রাত গুটুর গুটুর করে শেষ দিকে এসে ঘুমিয়ে পড়া মাইশার দলটা আড়মোড়া ভেঙ্গে নামতে শুরু করেছে । এত যাত্রীর ভিড়ে কেউ লক্ষ্য করল না সেই ফর্সামতন ছেলেটিও নেমে এসেছে তাদের সাথে ।

তিন.

ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে সেঁজ্যুতি লক্ষ্য করল– বাকি তিনজন ওয়েটিং বেঞ্চে বসে আছে কিন্তু মাইশা কোথাও নেই। হয়ত এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে গেছে ভেবে তাকে চমক দেয়ার জন্য বাকি তিনজনকে নিয়ে সেও চুপি চুপি গেইট দিয়ে বেরিয়ে পড়ল । মিনিট দশেক চারপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তারা মাইশার দেখা কোথাও পেল না । প্রথমে ব্যাপারটা তারা দুষ্টামি হিসেবে নিলেও এখন একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করেছে । মাইশাকে ফোন দিয়ে ফোনটা সুইচড অফ ‍পাওয়ার পর ভয়টা আতঙ্কে রূপ নেয় । চারপাশে যারা আছেন, কাউন্টারের লোকজনসহ সবাইকে তাদের অপর সঙ্গীনীটার কথা জিজ্ঞাসা করে সবার কাছ থেকেই নেতিবাচক উত্তর পায় । কেউ দেখেনি কিন্তু একটা মেয়ে সবার সামনে থেকে হুট করে গায়েব হয়ে গেল- এটা কোন ধরনের কথা ? ভয় পেয়ে হৃদি ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে শুরু করেছে । বাকি সবার অবস্থাও শোচনীয় ।
কাঁপা কাঁপা হাতে নীরা ফোনটা বের করে রায়হান চৌধুরীকে ফোন করল । ব্যারিস্টার রায়হান চৌধুরী, মাইশার বাবা ।

চার.

মাথার উপর ফুল স্পীডে ফ্যান ঘুরছে । কিন্তু তার বাতাস সম্ভবত নাঈমকে ঠান্ডা করতে পারছে না । কপালে জমে উঠা বিন্দু ‍বিন্দু ঘামই তার প্রমাণ । আহমেদ নাঈম, আকবর শাহ থানার এস পি । বয়স ত্রিশের কোঠায় । লম্বায়, চড়ায় তাকে যথেষ্ট সুপুরুষ বলা যায় । তবে এস পি সাহেবের ফর্সা মুখ এখন অপমানে লাল হয়ে আছে । কান দিয়ে উত্তাপ বেরুচ্ছে ।

তার এহেন দূরবস্থার কারণ এই মাত্র রাখা ফোনটা । সরাসরি আইজি স্যার লাইনে ছিলেন । যাচ্ছেতাই ব্যবহার দিয়েছেন তাকে, তার কভারেজ এলাকা থেকে আজ সকালে প্রখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার রায়হান চেীধুরীর মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে ।

কেইসটা আইজি সাহেব নিজে হ্যান্ডেল করছেন । চট্টগ্রামের পুরো পুলিশ ফোর্সকে এলার্ট করা হয়েছে । ঘড়ি ধরা ২৪ ঘন্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে । এর মাঝে মেয়েটিকে উদ্ধার করে এর সঙ্গে জড়িত পুরো ক্রিমিনাল গ্যাংটাকে অ্যারেস্ট করতে হবে । কোন বিকল্প নেই । জাস্ট ডু অর ডাই !

ফ্যাক্সে আসা মাইশার ছবিটা একজন কন্সটেবল এসে নাঈমের টেবিলে রেখে গেল । নাঈম এক নজর ছবিটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল । অনেক কাজ বাকি…

পাঁচ.

দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই নীল প্রথমে চোখে কিছু দেখতে পেল না । আলো থেকে হঠাত অন্ধকারে আসলে যা হয় আরকি । তারপর ধীরে ধীরে চোখ আঁধার সওয়া হয়ে এল ।
বায়েজীদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার অপজিটে কুঞ্জছায়া আবাসিকের ভেতরের দিকে ছোট খাটো এক তলা একটা বাসা । রেকর্ড অনুযায়ী এই বাড়টির মালিক জনাব মাহমুদ হাসান । তবে তিনি এখন নেই । নেই বাড়িতে বাড়িতে নেই না, তিনি আসলে পৃথিবীতেই নেই । বছর পাঁচেক আগে হার্ট এট্যাকে মৃত্যুবরণ করেন । তার অবর্তমানে উত্তোরাধিকার সূত্রে এই বাড়ির মালিক তারই বড় ছেলে আহমেদ হাসান নীল ।
ছয় রুমের এই বাড়িটার একা বাসিন্দা নীল । কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই বাসায় থাকা হয়না বলে বাড়িটা খালি পড়ে থাকে । এজন্য বাড়িটাকে মৃত্যুপুরী বললেও খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না ।

অন্ধকারটা কিছুটা সয়ে আসতেই নীল ভিতরে ঢুকল । একটি রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল । খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে তাকাল ।বিছানায় একটি মেয়ে শুয়ে আছে । জিরো ওয়াটের একটা নীলাভ বাল্বের আলোয় মেয়েটির চেহেরায় আশ্চার্য সরলতা ধরা পড়েছে । পুরো বিষয়টাকেই তার কাছে অপার্থিব মনে হচ্ছে ।

কত নিশ্চিন্তে মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে । সে কি জানে আগামী কয়েক ঘন্টায় তার জীবনের সমস্ত সমীকরণ পাল্টে যাবে ? হঠাত করেই অজানা, অচেনা মেয়েটির প্রতি দরদে তার বুকটা ভরে উঠল । তার খুব ইচ্ছে হতে লাগল মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে । ঠিক তখনই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু বিভৎস মুখ, কিছু পুরানো স্মৃতি, কিছু যন্ত্রণার আত্মচিতকার । সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, অজান্তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল । মেদহীন পেটা শরীর, টকটকে লাল চোখ নিয়ে ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো…

ছয়.

ঘুম ভাঙ্গতেই মাইশা নিজেকে একটি অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে । হাতের অনুভব দিয়ে বুঝতে পারে বিছানায় শুয়ে আছে । সে তো স্টেশনে ছিল, এখানে এল কি করে কিছুই বুঝতে পারে না । ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে । সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে যাবে কিন্তু মুখ খোলার ঠিক আগ মুহুর্তেই খট করে রুমের লাইট জ্বলে উঠল । চোখ বোলাতেই ঘরের এক কোণায় চেয়ারে বসা ফর্সামতন একটি ছেলের উপর চোখ পড়ল । ছেলেটিকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন ? তাকে কি আগে কোথাও কি দেখেছে সে ?
ছেলেটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । উঠে দাঁড়ানোর শব্দে মাইশার ভাবনায় ছেদ পড়ল । সে কি ! ছেলেটির চোখটি এত লাল কেন ? সম্ভবত এটাকেই বলে রক্তচক্ষু, যার দিকে তাকালে ভয়ে ভিতরটা হিম হয়ে আসে ।
ছেলেটি ধীর পায়ে তার দিকে এগুতে লাগল । তার প্রতি পদক্ষেপের সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাইশার ভয় ।

প্রথমে সাহায্য প্রার্থনা, এরপর করুণা ভিক্ষা, সবশেষে ভয়ানক আত্মচিৎকার । তারপর সুনশান নিরবতা পুরো বাড়িটিকে গ্রাস করল ।

সাত.

পাঁচলাইশ থানার ওসি আব্দুর রহমানকে খানিকটা চিন্তিত মনে হচ্ছে । হাতে আরো একটা রেপ কেইস এসেছে । তবে এটি নিয়ে তিনি চিন্তিত নন । প্রতি সাপ্তাহেই এমন দু চারটা কেইস আসে । তার চিন্তার কারণ মেয়েটি ।
থানার সেকেন্ড অফিসার কেইস ফাইল করতে গিয়ে মেয়েটিকে দেখে এসেছে । এসে জানিয়েছে আগের দিনের নিখোঁজ মেয়েটির সাথে আজকের ভিক্টিম মেয়েটির চেহারায় অনেক মিল আছে । আর এটিই রহমান সাহেবের চিন্তার কারণ ।
সত্যিই যদি ভিক্টিম ব্যরিস্টার রায়হান চৌধুরীর মেয়ে হয় তবে কপালে অনেক হ্যাঁপা আছে । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রহমান সাহেব ।অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে ।

আট.

পরদিন একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়া ছোট্ট একটি খবর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চোখের ঘুম কেড়ে নিল । প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে সেই খবরের বিস্তারিতে বলা হয়েছে- আগের দিন নিখোঁজ হওয়া প্রখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার ব্যারিস্টার রায়হান চৌধুরীর মেয়েকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে । রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে একটি সাদা মাইক্রো বাসে করে মেয়েটিকে অজ্ঞাত পরিচয়ধারী কে বা কারা সি.এম.সি গেইটের সামনে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় ফেলে গেছে । মাইক্রো বাসটিতে কোন নাম্বার প্লেট ছিল না ।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- অপরাধীকে সনাক্ত করতে তারা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । তবে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা মুখ খুলতে রাজি হননি ।

নয়.

নিবিড় পরিচযা কেন্দ্রের (IC U) স্বচ্ছ কাচটুকুর ভেতর দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন মিসেস রায়হান । তারপর পাশে দাঁড়ানো স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ঠুকরে কেঁদে উঠলেন । তার কোন পাপের শাস্তি স্রষ্টা তার মেয়েকে দিলেন, কেন এমনটা হল এসব নিয়ে বিলাপ করতে করতে এখন প্রায় বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছেন ।
ডাক্তার জানিয়েছে- শারীরিক ভাবে পেশেন্টের খুব বেশী ড্যামেজ হয়নি । এটা দ্রুতই রিকোভার করা যাবে, কিন্তু মেন্টালি কতটা রিকোভার করা যাবে এটাই এখন চিন্তার বিষয় । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে- এই রকম পেশেন্টরা মেন্টাল শক কাটাতে না পেরে হয় সুইসাইড করে না হয় উন্মাদ হয়ে যায় । এক্ষেত্রে কোনটা ঘটবে সেটা সময় বলে দেবে ।
স্ত্রীকে কি স্বান্তনা দিবেন, ঘটনার আকস্মিকতায় মিস্টার রায়হান নিজেই হতবিহবল হয়ে গেছেন । খুব অসহায় লাগছে তার নিজেকে । আজ বুঝতে পারছেন একজন ধর্ষিতা মেয়ের পিতার মানসিক অবস্থা কেমন হয় । এ যেন- “কি যাতনা হায় বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশু বিষে দংশেনি যারে” । নিজের সাথে না ঘটলে কখনোই এই অনুভূতির যন্ত্রনা আঁচ করা সম্ভব না ।

দশ.

প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে ।
মাইশা এখন অনেকটা সুস্থ । তবে হাসি খুশী সদা চঞ্চল মেয়েটির মুখ থেকে হাসি চিরতরে মুছে গেছে । স্থায়ী বিষন্নতা এসে ভর করেছে সেখানে । ঘর থেকে একদম বেরুতে চায়না, কোথাও যেতে চায় না, কারো সাথে মিশতে চায়না। বেশীর ভাগ সময় একা একা রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে । মাঝে মাঝে বান্ধবীরা আসে ওকে দেখতে । কিন্তু তাদের সঙ্গেও আজকাল মিশতে চায় না । সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । পৃথিবীতে থেকেও যেন সে কোথাও নেই ।
মেয়েকে একটা মূহুর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে চান না মিসেস রায়হান । ভয় হয়, আড়াল হলেই যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে ? আর মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন করেন । মায়ের মন তো !

এগারো.

নিজের কেবিনে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন মিস্টার রায়হান । আসলে ঠিক পড়ছিলেন না । পত্রিকাটা হাতে ধরা ছিল ঠিক কিন্তু তিনি কিছু দেখছিলেন না । তার দৃষ্টি ছিল সীমা রেখার বাইরে, সবকিছু ঝাপসা সেখানে । এমন সময় পিওন এসে তাকে একটি পেট মোটা খাম দিয়ে গেল । জানাল- দারোয়ানকে কে নাকি তার নাম বলে তাকে দিতে দিয়ে গেছে ।

পিওন কে যেতে বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খামটি খুললেন তিনি । বেশ কিছু ফটোগ্রাফস আর একটি চিঠি । ফটোগ্রাফসের দিকে তাকাতেই এলিভেন কেভির শক খেলেন মি. রায়হান । একি দেখছেন তিনি । এযে তার মেয়ের…

মুহুর্তেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল । নিমিষের ব্যবধানে দুনিয়াটা অসহ্য হয়ে উঠল । তীব্র চিৎকারে রিডিং টেবিলটাকে উপড়ে ফেললেন । টেবিলের উপর স্তুপ করে রাখা ফাইলগুলো রুমজুড়ে ছিটকে পড়ল । কিছু অফসেট এখনো বাতাসে উড়ছে । কিন্তু তার সেই তীব্র আর্তনাদ ক্লায়েন্টের সুবিধার জন্য করা ছোট্ট সাউন্ড প্রুফ কেবিনটার চার দেয়ালেই ঘুরপাক খেতে লাগল । দেয়াল ভেদ করে বাইরের পৃথিবীর কারো কানে তা পৌঁছল না ।

মিনিট পাঁচেক পর খানিকটা শান্ত হয়ে চিঠিটা খুললেন তিনি । ছাপার হরফে বাংলায় টাইপ করা চিঠি, পড়তে শুরু করলেন তিনি-

“প্রিয় রায়হান সাহেব,
কেমন আছেন ?
প্রশ্নটি কি খুব বেশী অবান্তর হয়ে গেল ? অবশ্য মেয়ের এমন ছবি দেখার পর কোন বাবাকে এই প্রশ্নটি করা অবান্তরই বটে । আর প্রিয় বলে সম্বোধন করলাম কেন ? অসহায় মানুষদের দেখলে আমার কেমন জানি মায়া লাগে তাদের জন্য । নিজের আপন লোক মনে হয় তাদের । হা হা হা… !!

যে ছবিগুলো দেখছেন, শুধু সেই ছবিগুলোই নয়, পুরো ঘটনার বেশ কিছু এঙ্গেলের কয়েকটি ভিডিও ফুটেজও আছে আমার কাছে । কোন একদিন ইউটিউবে আপলোড করে তার লিংকটা আপনাকে ইমেইল করে দেবো ! কি বলেন ?

কি ? আমাকে সামনে পেলে খুন করে ফেলবেন, টুকরো টুকরো করে সেই টুকরোগুলো কুকুরকে খাওয়াবেন এমনটাই ভাবছেন নিশ্চয়ই ? ভাবাটাই স্বাভাবিক । কিন্তু জানেন, ভাবনাগুলো বেশিরভাগ সময় কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় ! এই যে আমাকেই দেখুন না, পাঁচ বছর আগে আপনাকে নিয়েও আমি ঠিক এমনটাই ভাবতাম ! কিন্তু দেখুন না, আপনি এখনো দিব্যি সুস্থ আছেন !

অবাক লাগছে ? জানতে ইচ্ছে করছে কে আমি ? কি চাই আপনার কাছে ? কেন এমনটা করলাম ?
যান, কৌতুহলটা মিটিয়ে দিচ্ছি । আমি… কেউ না ! কিছু চাইও না আপনার কাছে । আর কেন এমনটা করলাম ? সেই অনেক জটিল হিসাব নিকাশের ব্যাপার । অত জটিল হিসাব নিকাশে না গিয়ে আসুন আপনাকে একটি গল্প শোনাই ! গল্প শোনার মুড আছে তো ?

গল্পটা কোন রূপকথার রাজকুমারীর গল্প না । খুব সাধারণ একটি মেয়ের গল্প । ‘প্রাপ্তি’ তার নাম । রূপে গুণে সবদিক থেকেই ছিল অসাধারণ । পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছেও ছিল সে রাজকন্যার মতই আদুরে । মা ছিল না তার, বাবা আর বাউন্ডুলে বড় ভাইকেই নিয়েই ছিল তার স্বপ্নের দুনিয়া ।

তবে তার এই স্বপ্নের দুনিয়াতে ও একটু খানি দুঃস্বপ্নের উপস্থিতি ছিল । কলেজে যাওয়া আসার পথে রোজ কিছু বখাটে তাকে জ্বালাত ।লজ্জায় কাউকে কিছু বলত না মেয়েটা । মুখ বুঝে সহ্য করে যেত সব ।

দিনকে দিন সেই বখাটেদের উৎপাত বাড়াতেই থাকে । একদিন বাধ্য হয়েই ভাইটিকে সব জানিয়ে দেয় সে । সব শুনে ভাইয়ের তো মাথা খারাপ । বয়সে তরুণ, গায়ে টগবগে রক্ত– বন্ধুদের সাথে নিয়ে গিয়ে সেই বখাটেদের শায়েস্তা করে আসে ।

তারপর কিছুদিন সব চুপচাপ । বোকা মেয়েটি ভেবেছিল তার দুঃস্বপ্নের বুঝি ইতি ঘটতে চলছে । কিন্তু কে জানত দুঃস্বপ্নের যে সবে শুরু হতে চলছে ?

একদিন সকালে মেয়েটি ঘর থেকে বের হল ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যায় আর ঘরে ফিরিল না । রাত বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বাপ- ছেলের টেনশন । এ বাড়ি– ও বাড়ি করে ওর সব বন্ধু- বান্ধবের বাড়িতে খোঁজা হল । কিন্তু কোথাও মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। থানায় জিডি হল । মেয়েটির খোঁজ মিলল তিনদিন পর অর্ধনগ্ন, অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার ধারে পড়ে ছিল । স্যার, বহুল আলোচিত ‘প্রাপ্তি রেফ কেইসে’র কথা কি আপনার মনে পড়ে ? আসামি পক্ষের হয়ে কেইসটা তো আপনিই লড়েছিলেন ! আইনের মারপ্যাঁচ, পেশাগত দক্ষতা, আর ভুয়া সাক্ষীর জোরে অপরাধীদের বানিয়ে দিয়েছিলেন ধোয়া তুলসী পাতা আর আমার নিষ্পাপ ছোট বোনটাকে বাজারি মেয়ে বানিয়ে ছেড়েছিলেন ।

হ্যাঁ, প্রাপ্তি– আমার ছোট বোন । আমিই তার হতভাগ্য ভাই । আপনার জন্য কেইসটা একটা জয়োৎসব ছিল। কিন্তু আপনার মিথ্যাচার পলকের ব্যবধানে আমার পরিবারটাকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। লজ্জায়, ক্ষোভে আমার পিচ্চটা আত্নহত্যা করে । আর কন্যা বিয়োগের শোক সইতে না পেরে আব্বুটাও হার্ট এট্যাকে আমাকে ছেড়ে চলে যায় ।

আম্মুকে তো খুব ছোট বেলায় হারিয়েছি । আব্বু আর বোনটাকে নিয়েই ছিল আমার দুনিয়া । চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে দুজনকে হারিয়ে বেঁচে থাকার অর্থটাই হারিয়ে ফেলি । আর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই আমার লক্ষ্য স্থির করে দেয় । চলে তো যাবই, তার আগে পৃথিবীর কিছু জঞ্জাল পরিষ্কার করে গেলে ক্ষতি কি ?

গত পাঁচটি বছর একটি রাজনৈতিক দলের জন্য খেটেছি । হেন কোন কাজ নেই যা তাদের জন্য করি নি । বিনিময়ে অর্থ এবং ক্ষমতা দুটোই কামিয়েছি দেদার ।

যে বদমাইশগুলোর জন্য আমার সাজানো পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায় তাদের অনেক আগেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছি । বাকি ছিলেন শুধু আপনি । চাইলে আপনাকে সরিয়ে দিতে পারতাম । কিন্তু আপনার পাপের বোঝা এতটাই ভারী যে একবার মৃত্যু আপনার সাজা হিসেবে খুব কম হয়ে যায় । আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিই । যাতে বেঁচে থেকেই আপনি প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করতে পারেন ।

আপনার মেয়ের জন্য একটু কষ্ট হচ্ছে । বেচারি বিনা দোষেই সাজা পেল । কিন্তু আমার বোনটারও তো কোন দোষ ছিল না । তারপরও তো এই পৃথিবীর প্রতি একগাদা অভিমান নিয়েই তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় । কিছুই করার নেই। এটাই নিয়তি।

ও হ্যাঁ– চাইলেই আপনি আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারেন । তবে একটা কথা মনে রাখবেন, দীর্ঘ ওকালতি জীবনে একের পর এক সাফল্য দ্বারা অর্থ-যশ-খ্যাতির পাশাপাশি শত্রুও কম কামান নি । তাদের কেউ না কেউ তো আমার পক্ষ হয়ে লড়বেই । টাকা ছড়ালে যে ভুয়া স্বাক্ষীর অভাব হয় না- এটা তো আপনার চেয়ে ভাল অন্য কারো জানার কথা না ! তারা সবাই মিলে দেখবেন আমাকে একদম দুধে ধোয়া শিশু আর আপনার মেয়েটিকে পতিতা বানিয়ে ছাড়বে । তাছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতাও এখন আমার দলটির হাতেই । গত নির্বাচনে তাদের জন্য অনেক খেটেছিলাম। আগামী নির্বাচনেও তো তাদের আমাকে দরকার হবে । বুঝতে পারছেন কি কিছু ?

সো… অল দ্যা বেস্ট মি. রায়হান চৌধুরী ।”

দু পৃষ্ঠা জুড়ে লেটার হেডে টাইপ করা চিঠিটা এখানেই শেষ। চিঠির নিচে কারো স্বাক্ষর নেই। পড়া শেষ হতেই রায়হান সাহেব হাতের মুঠোয় চিঠিটা দলা পাকিয়ে নিলেন। ধীর পায়ে হেঁটে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার দৃষ্টি অসীমে নিবদ্ধ । একটু পরে চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল। কে জানে এই অশ্রু অনুশোচনার অশ্রু নাকি এক ধর্ষিতা মেয়ের পিতার অসহায় চোখের অশ্রু ?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত