গফুর সাহেব

গফুর সাহেব

গফুর সাহেব একা মানুষ। বিয়ে থা করেননি। কিছুটা পাগলা কিছিমের। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। মাথায় ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। চুল দাড়ি পেকে সব সাদা। বয়স হয়েছে। একসময় সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ার করেছেন সেই কবে। এখনও শক্ত সমর্থ। পেনশনের টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। তার আয় দিয়েই মোটামুটি চলে যায়। কারো সাতে নেই পাঁচে নেই। আত্মপাকী মানুষ। নিজের রান্নাবান্না নিজেই করেন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেন। গোসল করেন। রান্নাবান্না করেন। তারপর খেয়েদেয়ে দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে পড়েন। পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে খালি পায়ে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ান। কোথায় যে ঘুরে বেড়ান তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তিনি কারো বাড়ি ঘরে বেড়াতে যান না। লোকালয়ে খুব একটা দেখা যায় না তাকে। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। কখনও নদীর ধারে, কখনও পাহাড়ে। কখনও দেখা যায় তিনি গাছপালার সাথে কথা বলছেন। রাস্তাঘাটে লোকজনের মুখোমুখি হলে এমনভাবে দ্রুত পা চালিয়ে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যান যেন জরুরী কোন কাজ করতে যাচ্ছেন- যা এই মুহূর্তে না করলে সবকিছু পন্ড হয়ে যাবে। লোকেরা বলাবলি করে গফুর সাহেবের মাথাটা নাকি এক্কেবারে গেছে।

সেই গফুর সাহেব পড়েছেন এক মহা সমস্যায়। সেদিন সন্ধ্যেবেলা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে যেখানে নদীটা দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়েছে সেখানে নদীর চরে একাকি বসেছিলেন। একাকি থাকতেই তার ভালো লাগে। শরত কাল। প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। চরজুড়ে কাশবন। কাশবনে ফুল ফুটেছে। সাদা সাদ ফুল। পাশ দিয়ে ধীরগতিতে বয়ে চলেছে নদী। ছোট ছোট ঢেউয়েরা নদীর বুকে খেলা করছে, লুটিপুটি খাচ্ছে। এই নদীকে ঘিরে গফুর সাহেবের কতো স্মৃতি! তন্ময় হয়ে ভাবছিলেন শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সোনালী দিনগুলির কথা। আধার ঘনিয়ে এসেছে। গফুর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গাঁয়ের দিকে পা বাড়ালেন। এমন সময় একটি শিশুর কান্না শুনতে পেলেন তিনি। চরের কাশ বনের ঝোপের আড়াল থেকেই আসছিল আওয়াজটা। তিনি স্পস্ট শুনতে পেলেন একটি শিশুর কান্না। এগিয়ে গেলেন গফুর সাহেব। ঝোপের মধ্যে একটি বছর দু’বছরের ছোট্ট শিশু হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। গফুর সাহেব খুব অবাক হলেন। কি করবেন না করবেন কিছুই ভেবে উঠতে পারলে না। চারদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলেন। না আশেপাশে কেউ নেই। তাহলে একটা ছোট্ট শিশু এখানে আসলো কোত্থেকে। তাজ্জব ব্যাপার! তিনি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। যাই হোক তিনি শিশুটিকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন। এবার তিনি লক্ষ করলেন যে শিশুটি ঠিক দেখতে স্বাভাবিক আর দশটা শিশুর মতো নয়। কান দু’টি জানি একটু কেমন। একটু লম্বাটে। দেখতে অনেকটা ভেড়ার কানের মতো। পালক বিহীন দু’টি চোখ দেখে গফুর সাহেব রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন। তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন প্রতিটি হাতে রয়েছে ছয়টি করে আঙ্গুল। গফুর সাহেবের ভ্রু কুচকে গেল। শিশুটি মানব শিশু তো? নাকি কোন এলিয়েন, টেলিয়েন? এমনতো নয় যে ভিনগ্রহ থেকে ঠুস করে খসে পড়েছে?

ভূত- টুত নয়তো আবার?
পরক্ষণেই ভাবলেন- কি আবুল তাবুল ভাবছি? ভূত- টুত আছে নাকি আবার। আর এলিয়েন? ওসবও তো মানুষের কল্পনা। পৃথিবীর মতো মহাকাশের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব সত্যি আছে নাকি? থাকলে থাকতেও পারে। তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন। পৃথিবীর সূর্যের একটি গ্রহ। এরকম অগণিত সূর্য রয়েছে মহাকাশে। সূর্য তো একটি মাঝারী আকারের নক্ষত্র। সূর্যের রয়েছে ৮টি গ্রহ। তাহলে ঐসব নক্ষত্রের প্রতিটিরও নিশ্চয় অনেকগুলি করে গ্রহ রয়েছে। গ্রহেরও থাকে উপগ্রহ। এরকম অগণিত গ্রহ উপগ্রহের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা কিংবা মানুষের চেয়েও উন্নত প্রাণি থাকার সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না।

গফুর সাহেবের ভাবনায় ছেদ ঘটল। শিশুটি কাঁদছে। হাত পা ছুড়ছে। শিশুটির কান্নার ধরণটি বেশ অদ্ভুত। ছন্দময়। বড় ছন্দময় সে সুর। ছোটবেলা গফুর সাহেব মায়ের কাছে হার্মোনিয়াম বাজানোর পাঠ নিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন হার্মোনিয়াম বাজানো শিখতে হলে ‘বোল’ শিখতে হবে। প্রথমেই শিখতে দিয়েছিলেন- সা- রে- গা- মা- পা- দা- নি- সা/ সা- নি- দা- পা-মা- গা- রে- সা, বোলটি। স্বর প্রথমে আস্তে আস্তে চড়তে থাকত তারপর আস্তে আস্তে একই গতিতে নিচে নেমে আসত। শিশুটির কান্নার উঠা-নামাটাও ছিল ঠিক তেমনি।

গফুর সাহেবের মনে হলো শিশুটির নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। অনেকক্ষণ কিছু খায়নি। তাই কান্না করছে। কিন্তু তিনি কী খেতে দিবেন? গ্রামের বাড়ি। বেশ রাত হয়ে গেছে। মনে পড়ল ঘরে তো চাল ডাল সবই আছে। একটু পাতলা করে খিচুরি পাকানো যায়। শিশুরা তো খিচুরি খেতে পছন্দ করে। শিশুটিরও নিশ্চয় পছন্দ হবে। তিনি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। দু’হাতে আস্তে করে তালি দিয়ে শব্দ করে বললেন, ‘কাঁদে না সোনা কাঁদে না।’ শিশুটি সত্যি সত্যিই কান্না বন্ধ করে দিল। এবার শিশুটি আনন্দসূচক উ- আ শব্দ করে গফুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তিনি দেখলেন শিশুটির গলায় তাবিজের মতো একটি লকেট ঝুলছে। দেখতে খুবই সুন্দর। চৌকোনা স্বচ্ছ কাচের ভিতর লাল সূর্যের মতো গোলক। উজ্জ্বল লকেটটির ভিতর থেকে যেন আলো টিকরে বেরিয়ে আসছে। তিনি লকেটটি হাত দিয়ে ধরে একটু নেড়ে চেড়ে দেখলেন। সত্যিই অসাধারণ।

গফুর সাহেব খিচুরি রান্না করলেন। চামচ দিয়ে একটু একটু করে খাওয়ালেন। শিশুটি খুব আগ্রহের সাথে চুকচুক করে খিচুরি খেল। মনে হয় খিচুরিটা ভাল হয়েছে। খিচুরি তিনি ভালোই পারেন। ছাত্রজীবনে গফুর সাহেব মেসে থেকে লেখাপড়া করেছেন। যখন কাজের বোয়া আসত না, তখন নিজেরা পালা করে রান্না বান্না করতেন। হাতেখড়িটা তখনই হয়েছে।

শিশুটি হাতপা নেড়ে খেলা করছে। দুদের মতো সাদা তুলতুলে শরীর। মায়াকাড়া মুখ। গফুর সাহেব সত্যিই মায়ায় পড়ে গেলেন। তিনি আদর করে শিশুটির গাল দুটি টিপে দিলেন, কপালে চুমু খেলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন শিশুটির শরীরের বেশ কটি স্থান কেটে গেছে। বন-ছনের ঘষা লেগে কেটে গিয়ে থাকবে। তিনি ক্ষতস্থান ভালো করে ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিলেন। খুবই ভালো লাগছে গফুর সাহেবের। যেন তিনি নতুন কাজ পেলেন। নতুন জীবন পেলেন। গভীর রাত পর্যন্ত শিশুটির সেবা-শুশ্রƒষা করলেন তিনি। শিশুটিকে বুকের কাছে রেখে আদর করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন খেয়ালই করেননি। ঘুম ভাঙল একটু দেরীতে। সূর্যের আলো দরজার ফাঁক গলে উকি দিচ্ছে বিছানায়। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। দেখেন শিশুটি বিছানায় নেই। তিনি দু’চোখ দু’হাতের তালু দিয়ে একটু ঘষে নিলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। না শিশুটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খাটের নিচে পড়ে গেল না তো? তিনি খাটের নিচে ভালোভাবে দেখলেন। না খাটের নিচেও নেই। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। না শিশুটি কোথাও নেই। বিছানার উপর শিশুটির গলার সেই লকেটটি পড়ে আছে। বালিশের কাছে মলম ও ডেটলের শিশিটিও দেখতে পেলেন। তিনি দরজা জানালার দিকে ভালো করে তাকালেন। না সবকিছু ঠিকই আছে। দরজা জানালা বন্ধই রয়েছে। তাহলে কোথায় গেল শিশুটি? শিশুটি কি হাওয়ায় মিশে গেল? গফুর সাহেব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি শিশুটির গায়ের উষ্ণতা এখনও বুকের মধ্যে অনুভব করছেন। হুহু করে কাঁদতে লাগলেন গফুর সাহেব। তিনি দরজা খুরে বাইরে এলেন। বারান্দা দেখলেন, আশপাশ দেখলেন। না কোথাও শিশুটিকে পেলেন না। সেদিন থেকে নাওয়া নেই খাওয়া নেই গফুর সাহেব শুধু শিশুটিকে খুঁজেই চলেছেন। যাকে সামনে পান তাকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘ছোট কোন শিশু কি আপনাদের চোখে পড়েছে?’ শিশুটিকে কুড়িয়ে পাওয়া থেকে হারিয়ে ফেলা পর্যন্ত সেই রাতের সমস্ত কথা তিনি মানুষকে বলে যেতে লাগলেন। আর বারবার মানুষের চোখের সামনে সেই লকেটটি উঁচু করে ধরে বলতে লাগলেন, এই তো সেই লকেট যেটি সেদিন শিশুটির গলায় ছিল। কিন্তু কেউই গফুর সাহেবের কথায় বিশ্বাস করল না। সবাই ভাবল, গফুর সাহেব বুঝি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত