প্রজন্ম

প্রজন্ম

“লদি ঘাটকে যা, ওলাওঠায় মর” নদির দিকে তাকিয়ে বৌকে গাল পাড়ছে মোক্ষদাবুড়ি। সপ্তমী স্নান করে ফিরছিল। ছেঁড়া কাপড়টা তার উদ্ধত যৌবন ঢাকতে পারে না। গামছা দিয়ে শরীরের ওপরের দিকটা ঢাকা চলে বটে, তবে তা যথেষ্ট নয়। সরু পায়ে চলা রাস্তাটির দুদিকে ঘন ঝোপঝাড়, বামুনদের আমবাগানের ছায়া– পথটাকে দিনের বেলাতেও অন্ধকার করে রাখে। প্রথম প্রথম এই পথ দিয়ে ফিরতে তার গা ছমছম করত, মনে হত, অন্ধকার তার সর্বনাশ করার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে , আজ আর সে ভয় নেই। চলতে চলতে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিল সপ্তমী। আজ থেকে ছবছর আগে এই বাড়ীতে সে বৌ হয়ে এসেছিল – মা বাবাকে জ্ঞান হবার পর সে দেখেনি, মামারা তার বিয়ে দিয়েছিল। মামারা গরীব হলেও খারাপ লোক ছিল না। মগনের সাথে তার মন্ত্র পড়ে বিয়ে হয়েছিল। জায়গা জমি বেশি না থাকলেও মগন এক মাত্র ছেলে, গতর খাটিয়ে কাজ করে পরিবার চালিয়ে নিত একরকম -যেটুকু অভাব ছিল সেটা পুষিয়ে দিতে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত সপ্তমীকে।

শ্বশুড়কে দেখেনি সপ্তমী, কিন্তু মোক্ষদাবুড়িও এমন ছিল না। বউবরণের দিন পুরোন কাঠের তোরঙ্গ খুলে বহুদিনের পুরোন এক জোড়া সোনার কানপাশা বের করে নতুন বউয়ের কানে পরাতে পরাতে বলেছিল, বেশ নক্কীমন্ত বউ হয়েচে, বেঁচে থাক মা, বেঁচে থাক। বুড়ির কথা ফলেনি, বছর ঘুরতে না ঘুরতে এই বেঁচে থাকাটাই সপ্তমীর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াল। এক শ্রাবণে তার বিয়ে হয়েছিল আর তার পরের শ্রাবণের দুপুরে রেললাইনের ধারে তাদের নিজেদের ধানজমিতে সাপে কাটল মগন বাগ্দীকে। সুস্হ সবল লোকটাকে ধরা ধরি করে সবাই যখন বাড়ী আনল তখন তার চোখ বুজে আসছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ মগন আর ছিল না, একবার শুধু হাত নেড়ে সপ্তমীকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বলেছিল, “বৌ আমি চললাম, মা টাকে দেখিস।” আর কিছু বলতে পারে নি মগন । মরা দেহটার ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল সপ্তমী, কিন্তু সবাই বেহুলা হয় না। হাতের শাঁখা ভেঙ্গে, সিঁদূর মুছে, বিধবার থান পরে যখন সে দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়াল তখন তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে । সেই শুরু । এরপর থেকে সে একটার পর একটা ঝড় সামলে চলেছে। জমি জমা এখন কিছুই নেই, সোনা দানা যা কিছু ছিল প্রায় শেষ । মাত্র দুটি পেট চালানোও দিনে দিনে তার ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছেলের মরা, জমি চলে যাওয়া — সব কিছুর জন্য তাকে দায়ী করে মোক্ষদা বাইরের লোকের কাছে সপ্তমীকে ডাইনি বানিয়ে দিয়েছে । বৌঝিরা তার থেকে তফাতে থাকে, নেহাতই এক আধজন ছাড়া এই গ্রামের সব মানুষ সপ্তমীকে এড়িয়ে চলে। এই হতভাগীর কুঁড়ে ঘরটি প্রায় গ্রামের শেষ মাথায়, চারপাশে বিশেষ কেউ বাড়ি করেনি বলেই হয়তো পড়শীদের নজর তাদের ওপর পড়ে কম।

বেড়াটা কষ্ট করে খুলে কলসী কাঁখে ভেতরে ঢুকে আসে সপ্তমী। মোক্ষদা বুড়ী এমনিতে চোখে ভাল দেখে না । প্রথমেই তার কোঁচকান চামড়ায় ঢাকা শীর্ণ ডান হাতটি চোখের ওপর তুলে ঠাওর করার চেষ্টা করল ।সপ্তমীকে দেখতে তার ভুল হয় না, এতক্ষণে তোর আসার সময় হল । মোক্ষদার ধারাল জিভ যেন বিষ ছড়ায় –“পোড়ারমুখী- ও আবাগীর বেটি, এই সোমত্থ বয়েসে কোথায় কি করে এল রে, হায় হায় এ আমার কি হল রে।” এসব শোনা সপ্তমীর অভ্যেস হয়ে গেছে, কিন্তু আজকে বুড়ির ইশারাটা তার মাথায় রক্ত তুলে দিল। মানুষ যখন খুব অসহায় হয়ে পড়ে তখন সামান্যতম অপমানও আর সামান্য থাকে না–প্রদীপের শেষ শিখার মত দপ্ করে জ্বলে ওঠে। একটা কাঠের উনুনে ভাত ফুটছিল, সপ্তমী আর থাকতে না পেরে সেই গরম ভাত শুদ্ধ হাঁড়ি বুড়ির সামনেই আছড়ে ভেঙ্গে ফেলল-

– বুড়ির গায়ে ফুটন্ত ভাত ছিটকিয়ে পড়ল, কিছুটা ভাত গিয়ে পড়ল উঠোনে। ভেজা কাপড়েই বাড়ীর বাইরে চলে গেল সপ্তমী।

বুড়ির সন্দেহে কিছুটা হলেও সত্যতা ছিল। গত কয়েক মাস ধরে আর একটা বিপদ সপ্তমীর কাঁধে এসে চেপেছে। সেটি হল সনাতন ।সনাতন এই গ্রামে থাকে না, নদির ওপারে রসুলপুর । ওখানে তার একটি ফলের দোকান আছে। এই গ্রামের কিছু দোকানীর সে মহাজন। টাকা আদায়ের কাজে, নতুন খদ্দের ধরার জন্যে, তাকে এদিকে মাঝে মধ্যে আসতে হয় । ঘরে তার বউ ছেলে আছে। ফিটফাট থাকে বলে বয়েস ঠিক বোঝা যায় না, বছর চল্লিশের কম বলেই মনে হয়। নদির ঘাটে ভিজে কাপড়ে একদিন সপ্তমীকে দেখে তার ভাল লেগে গেল। সেই ভাল লাগাটা কিশোরের প্রথম প্রেমের মত আবেগের তাড়নায় নয়, বরং প্রয়োজনের ভিত্তিতে। মানুষ চরিয়ে খায় সনাতন, অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ল সমাজ সংসারে কিছু না পাওয়া একটি অসহায় মেয়ের দুর্বলতম জায়গাটা।

আর বেচারী সপ্তমী-আশা তার ফুরোয় না। যেমন করে ডুবন্ত মানুষ খড় কুটো আঁকড়ে ধরে সেও সনাতনকে আশ্রয় করে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকল। প্রথমের দিকে চলছিল ভালোই। কিছু অর্থ সাহায্য, কিছু প্রতিশ্রুতি, বিনিময়ে উষ্ণ কিছু ছোঁয়া । শরীরের চাহিদার বদলে সামাজিক চাহিদা। কিন্তু প্রাচীন কাল থেকে অসম প্রতিপক্ষ হলে সবলের দাবী শুধু বেড়েই এসেছে – সপ্তমীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। পুরুষের সঙ্গ সপ্তমী প্রায় ভুলে গিয়েছিল, অপ্রত্যাশিত লোভ তাকে গ্রাস করল -সে ভুল করে বসল। যখন সে বুঝতে পারল যে সে মা হতে চলেছে, তখন বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে। জৈবিক নিয়মে মেয়েদের শরীরে এই সময়ে পরিবর্তন ঘটে। অভিজ্ঞতা থেকে বাড়ীর বড়দের, বিশেষতঃ মায়েদের এগুলি বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের অভিজ্ঞতাই মেযেদের সাবলম্বী করে তোলে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সপ্তমীর মা নেই, বুড়ি মোক্ষদা চোখে ভাল দেখে না তারপর আবার শ্বাশুড়ী বউয়ের সম্পর্কটা ঠিক স্বাভাবিক নেই, সপ্তমীর শরীরের খোঁজ মোক্ষদা পেল না- পেটের ভেতর সন্তান বাড়তেই থাকল। এর মাঝে আরও একটি ঘটনা ঘটছে – সনাতন যবে থেকে এই অনর্থ জানতে পেরেছে সেইদিন থেকে এ গ্রামে ঢোকাও তার বন্ধ হয়েছে। আমগাছের এই নির্জন বন এখন সপ্তমীর একমাত্র সঙ্গী। মুখ বিস্বাদ, সকালে বিকেলে তার পিতলের ঘটিটা নিয়ে এই ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসে নিয়ম মাফিক বমি করে আর বারবার ভয়ে ভয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখে -এই দিকে কেউ আসছে কিনা। তার মন বলে, সনাতনের খোঁজে একবার যায় কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে – সে বিধবা, একবার লোক জানাজানি হলে এই সমাজ কি তাকে আর জায়গা দেবে?

আমবাগানে সপ্তমী কিছুক্ষণ গুম্ মেরে বসে থাকল। তার মনে হল,, কাজটা আজকে ভাল করে নি। ঘরের ভেতর থেকে আর সাড়া শব্দ আসছে না। বুড়ী কি মরে গেল নাকি- হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল সপ্তমী। আবার ঘরে ফিরে এসে বড় অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখল সে। বুড়ী আর দাওয়ায় বসে নেই। শীর্ণ হাতে মাটি থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাতগুলি তুলে ফোকলা মুখে চেবানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বুড়ির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। সপ্তমী যেমনই হোক মোক্ষদার শেষ অবলম্বন । বুড়ী চিরকাল নিজেই কথা বলে এসেছে, আজকে হঠাৎ সপ্তমীর এমন ব্যবহার বুড়ীকে এক অনিশ্চিতের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সপ্তমী তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে সে চিন্তা মোক্ষদা করেনি এমন নয় – কিন্তু সম্ভাবনা আর ঘটনা এক নয়। সপ্তমী উঠোনে দাঁড়িয়ে পরিস্কার বুঝতে পারল, সে ভুল করেছে -অসহায় মোক্ষদাও কম নয়।

সেই দিন আবার শ্বাশুড়ি বউ এর বিবাদ মিটল। মোক্ষদার পাশে বসে সব কথা এক এক করে বলতে লাগল সপ্তমী- সনাতনের সাথে আলাপ হওয়া, তার টাকায় সংসার চালানোর কথা এমনকি তার পেটে যে বাড়ছে তার কথা, কিছুই সে গোপন করতে পারল না। তার ডাগর দুই চোখে হু হু করে জল বইতে লাগল- কিন্তু মনের পাথর আস্তে আস্তে হালকা হয়ে এল। যখন তার গল্প শেষ হল তখন বুড়ির কোলে সে শুয়ে পড়েছে। মোক্ষদার আগুনে পোড়া হাতটি তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সব হারানোর হাহাকার অসম বয়েসের দুটি নারীকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিল।

নিজের বিপদের দিনের কথা ভেবে চালের ভেতর গুঁজে রাখা শেষ সম্বল একটি সোনার মাকড়ি বার করে স্বপন স্যাঁকরার কাছে নগদ পাঁচশ টাকায় বিক্রি করে এল মোক্ষদা। তার পরের দিনই সদরের বাস ধরে সপ্তমীকে নিয়ে বড় ডাক্তারবাবুর কাছে হাজির হল। কিন্তু ভ্রূণ নষ্ট করারও একটি সময়সীমা আছে – সপ্তমী সেই সীমা পেরিয়ে এসেছে। ডাক্তার রাজী হল না। বাচ্চা নষ্ট করার কথা ঠিক সাধারণ অসুখের কথা নয়- মোক্ষদা অনেকবার ডাক্তারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু এই দুটি ভীতু অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ে না পারল নিজেদের অবস্হা বোঝাতে, না পারল এর কারণ সঠিক ভাবে বলতে। সপ্তমীর শরীরের ভেতর বাড়তেই থাকল একটা প্রাণ।

আশ্বিন মাসের আগে পুজো। গ্রামের একমাত্র দুর্গা মণ্ডপটিতে প্রতিমা বাধার কাজ প্রায় শেষ হতে চলল- অন্য বারের মত এবার আর সপ্তমী প্রতিমার গায়ে মাটি লাগানো দেখতে যায় নি। নদিতে চান করতে সে আর যায় না, আম বাগানেও বহুদিন আর আপন মনে কথা বলে নি সপ্তমী- সারাক্ষণ ঘরে বসে বসে নিজের অদৃষ্টের কথা ভেবে কাঁদতে থাকে। তার পেটের মধ্যে যে শিশুটি আছে তাকে দেখতে তার কম ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝেই পেটের মধ্যে কিছু নড়ে ওঠে, তখন সে বুঝতে পারে এই সন্তানটিও অন্য পাঁচটি সন্তানের মতো পৃথিবীতে আসার চেষ্টা করছে । কেউ বোধহয় তাকে ভালোবাসবে না, কেউ তার খোঁজ নেবে না- জানতেও পারবে না তার বাবা কে, তবু বেঁচে থাকার কি প্রবল উৎসাহ! কেমন করে সারা দিন পা নাড়ে,হাত নাড়ে- সপ্তমীর দুচোখে জল এসে যায়। বাচ্চাটিকে তো সপ্তমীও চায় না কিন্তু অদৃষ্টের কি পরিহাস, এই বাচ্চাটির জন্যেই সপ্তমীর মরাও হল না। নোংরা শাড়ীতে চোখের জল মুছে সপ্তমী দাওয়ায় গিয়ে মোক্ষদার পাশে বসে। দুই নারী যেন এক মহাপ্রলয় কামনা করতে করতে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মহালয়ার পেরিয়ে দিন দুয়েক গেল। সপ্তমীকে বার হতে দেয় না মোক্ষদা, লাঠি ঠুক ঠুক করে নিজে রামুমুদীর দোকানে গিয়ে ধার করে । রামু বহুদিনের পরিচিত লোক – মোক্ষদার দিকে তাকিয়ে সপ্তমীর কথা জিগেস করে-” মাসি সপ্তমীকে দেখিনা যে, কি ব্যাপার গো?” মোক্ষদা চালাকের মতো উত্তর করে , বৌটার শলিলটা বড় খারাপ হইছে রে রামু। এই দুঃখী পরিবারটিকে একটু একটু করে চোখের ওপর নিঃস্ব হতে দেখছে রামু – মায়া হয় তার, “মাসী এই মুসুর ডালটুক নিয়ে যাও, পয়সা এখন দিতে লাগবেনি, পরে দিও খন।” একটা কাগজের ঠোঙ্গা পলিপ্যাকের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় রামু। বুড়ী আবার লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে গ্রামের সীমানায় মিলিয়ে যায় – রামু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আহা রে।

ষষ্ঠীর সকাল বেলায় সপ্তমীর ব্যথা উঠল। মাটির ঘরের মেঝেতে চটের ওপর মাদুর পাতা -দরজা জানলা সব বন্ধ। প্রথম বার মা হতে চলেছে সপ্তমী, পেটটা তার মাঝে মাঝে প্রচণ্ড শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। শক্ত কাঠের মতো পাশবালিসে এপাশ ওপাশ করে ব্যথা কমল না। যন্ত্রণায় একবার চিৎকার করে উঠেই কি ভেবে মুখে কাঁথাটা গুঁজে দিল। তারপর কাঁথাটা কামড়ে অল্প গোঙ্গাতে লাগল। সহ্য তাকে করতেই হবে। তারপর ঝুড়িতে করে নদির জলে ভাসিয়ে দেবে বাচ্চাটাকে -তারপর ওর কপাল, যদি কেউ দেখতে পেয়ে কাছে রেখে দেয়। দেহের যন্ত্রণা ছাপিয়ে সপ্তমীর বুকের ভেতর থেকে এবার যেটা বেরিয়ে আসে সেটা কান্না ছাড়া কিছু না।

এদিকে সকাল থেকে সপ্তমীর গলা পাচ্ছে না মোক্ষদা। দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করে বুড়ি। অস্পষ্ট চোখে পড়ে কেমন যেন বেঠিক লাগছে বৌকে। ঘরে ঢুকে সপ্তমীর পেটে হাত দিয়ে বুড়ি ঠিক বোঝে। সপ্তমীর কপাল থেকে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে- করুণ চোখে তাকায় সে -“এট্টু জল দেন মা, এট্টু জল, আমি তো আর পারতেছি না।” বুড়ির অভিজ্ঞতা কম নেই, সপ্তমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে- “জল মুখে দিতি নেই রে বউ, বমি হবে।” ষষ্ঠীর বোধন শুরু হয়েছে। দুর্গা মণ্ডপের ঢাকের শব্দ সপ্তমীদের বাড়ী অবধি আসে না। তবু চারিদিকে সোনা রোদের সকাল, গ্রামের লোকজন পরব নিয়ে ব্যস্ত। তারই মাঝে প্রায় অন্ধকার ঘরে, স্যাঁতস্যাতে মেঝেতে হত দরিদ্র একটি গর্ভিণীর কথা কেউ জানতে পারে না।

ক্রমশঃ দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। দুর্গা মণ্ডপ জমে উঠল। একটি যাত্রার অনুষ্ঠানও আছে – রাত করে শুরু হবে। পাড়া গ্রামের একটিই পুজো, শিশু থেকে বুড়ো সবার আজ উৎসব । রাস্তা ঘাট একটু পরেই জনশূণ্য হয়ে উঠল। মোক্ষদা একবার সপ্তমীর হাতটা মুঠো করে ধরে মা দুর্গার নাম নিল, “ঠাকুর রক্কে কোরো।” সপ্তমীর সত্যিকারের ব্যথা উঠতে রাত গভীর হয়ে গেল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শেষের দিকটায় সপ্তমী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, কুপির আলোয় মোক্ষদা ভাল করে দেখল একটা মেয়ে। সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে। নাক মুখ আঙ্গুল দিয়ে পরিস্কার করে দিতেই ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। মোক্ষদার ফোকলা মুখে একটু হাসি ফুটল, নাড়ী কেটে বাচ্চাটাকে কাঁথায় মুড়ে একপাশে রেখে দিল বুড়ি। তারপর ফুলটা বেরোনর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সপ্তমীকে মুছিয়ে টুছিয়ে দিয়েই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মোক্ষদা। গভীর রাত, বুড়ী চোখে দেখেনা তবু যেন আজ সব প্রাণশক্তি কোন জাদুমন্ত্রে আবার সে ফিরে পেয়েছে। বুড়ি যখন ফিরল তখন সপ্তমী মড়ার মত পড়ে আছে। সারা গায়ে তার অসহ্য ব্যথা। একবার চোখ তুলে শুধু বলল, “মা ফেলে দিয়ে আসলেন ?” ঘন অন্ধকার শেষ রাতে মোক্ষদার মুখে নিভন্ত কুপির আলো পড়েছিল, অগণিত কোঁচকান বলি রেখায় কিছুই প্রকাশ পেল না।

পরদিন সকালে গ্রামে শোরগোল পড়ে গেল। কে বা কারা একটি দুধের শিশুকে নদির ঘাটের কাছে পোড়ো মন্দিরের চাতালে ফেলে রেখে গেছে। গরু ছাগল চরাতে গিয়ে কয়েকটি ছোট ছেলে সেটিকে দেখতে পায়। তারাই গ্রামে খবর দিয়েছে। সপ্তমীর দিন এ সব কি হচ্ছে, গ্রামের সম্ভ্রান্ত লোকজন সেখানে আর গেলেন না – কারণ প্রথমতঃ ঝোপ ঝাড়ে সাপ খোপ থাকতে পারে, আর কার না কার পাপ, শুভদিনে এসব দর্শন করাও অমঙ্গল। হরিহর মুখুজ্যে এ গ্রামের মাতব্বর, দুর্গা মণ্ডপে তার প্রচুর কাজ, বশংবদ একটি ছেলেকে ডেকে শুধু বললেন, – “এই যা তো সতু একবার দেখে আয় তো। মনে হয় না বেঁচে আছে, যদি বেঁচে থাকে তবে একটু মেম্বারকে বলিস যেন হাসপাতালে দিয়ে দেয়।” তবে সাধারণ লোকজন পোড়ো বাড়ীতে ভীড় করতে কসুর করল না। এদের পেছনে একটু বাদেই মোক্ষদাকে দেখা গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখল- মোক্ষদা আস্তে আস্তে বাচ্চাটির কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল, পরম যত্নে চাদরে জড়িয়ে বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে জঙ্গল ঠেলে রাস্তায় এসে নামল। দিগম্বর রাজমিস্ত্রী একপাশে দাঁড়িয়ে বুড়ীর কাণ্ডখানা দেখছিল, এত অবাক সে কস্মিন কালেও হয় নি। পাশ থেকে বলল-” মাসি তুমি একে কোথায় নিয়ে চললে? এ্যঁ, তুমিতো নিজেই খেতে পাওনি গো। বুড়ী কঠিন চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠল, “তুই নিয়ে গেলি না কেনে রে হতচ্ছাড়া । এখানে ফেলে রেখে মেরে ফেলতে পারবুনি। দিগম্বরের মুখ দিয়ে কথা সরল না। সত্যিইতো বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে সে তো নিজে এই চেষ্টাটা করতেই পারত – একগাদা হতভম্ব লোকের হাঁ করা মুখের ওপর দিয়ে মহারাণীর মত মোক্ষদা নিজের ঘরে ফিরে এল। এক কাঁখে বাচ্চাটাকে চেপে, বেড়াটা আটকে সে দাওয়ায় উঠতে উঠতে পুরোন সুরে বলতে লাগল-“ওলো ও আবাগীর বেটি, আর মটকা মেরে পড়ে থাকিস নি, এবার ওঠ, মেয়েটাকে কোলে নে।” সপ্তমী নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে, দরজার খুলতেই তার চোখ গেল মোক্ষদা বুড়ীর কোলে – একটা কচি হাত আঙ্গুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে কি যেন মুঠো করে ধরল। সপ্তমীর অঞ্জলী হচ্ছে, একটা দমকা বাতাস বহুদূরের ঢাকের অস্পষ্ট আওয়াজ হঠাৎই বয়ে নিয়ে এল ওদের দরজায়- একটু দূরেই ওই হাতটা, কচি একটা হাত মুঠো করে আছে। তিন প্রজন্মের নারী এখন একসাথে দাঁড়িয়ে আছে -এত বড় পৃথিবীতে ওদের একটু জায়গা হবে না, তা কি হয়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত