কাকাবাবু আর বাঘের গল্প

কাকাবাবু আর বাঘের গল্প

বিকেলবেলা কাকাবাবু বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছেন, সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে হন্তদন্তভাবে উঠে এসে সন্তু ডাকল, কাকাবাবু, কাকাবাবু…

আজকাল কাকাবাবু রোজ দাড়ি কামান না। আগে প্রত্যেকদিন সকালে দাড়ি কামিয়ে নিতেন দাঁত মাজার সঙ্গে সঙ্গে। এখন যেদিন বাড়ি থেকে বেরোবার দরকার না থাকে, সেদিন দাড়ি কামানোও বাদ দিয়ে দেন।

কোথাও বেড়াতে গেলে পরপর তিন-চারদিনও মনে থাকে না। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজায়, তাতে হাত বুলিয়ে তিনি মুচকি মুচকি হাসেন।

গোঁফটা অবশ্য একরকমই আছে।

এখানেও তো বেড়াতেই এসেছেন, কোনও কাজ নেই। শুধুই বেড়ানো। তাই তিনদিন তিনি গালে ব্লেড ছোঁয়াননি। তা হলে, আজ বিকেলবেলা দাড়ি কামাতে শুরু করলেন কেন?

কারণ, আজ সন্ধেবেলা রাজবাহাদুর প্যালেসে গান-বাজনার আসর বসবে, সেখানে যেতে হবে। গানের আসরে দাড়ি কামিয়ে, ফিটফাট পোশাক পরে যেতে হয়। না হলে গায়ক বা গায়িকাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাঁরা ভাবেন, যে লোকটি দাড়ি না কামিয়ে, প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরে এসেছে, সে তাঁদের প্রতি সম্মান জানাচ্ছে না।

সবেমাত্র আধখানা গাল কামানো হয়েছে, অন্য গালটায় ফেনা মাখানো। কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সন্তু, হাঁপাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?

সন্তু নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আজ আবার বাঘ বেরিয়েছে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আবার গুজব? তুই বাঘটা দেখেছিস, না ডাক শুনেছিস?

সন্তু বলল, না, আমি শুনিনি। কিন্তু লোকে বলছিল…।

কাকাবাবু বললেন, লোকে তো অনেক কথাই বলে। কোথায় শুনলি লোকের কথা?

সন্তু বলল, আমি আর জোজো ইকো পয়েন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেকেই বলল, বাঘের ডাক শুনেছে। সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল। দোকান টোকানও সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, কালও তো কত লোক বাঘ আসছে, বাঘ আসছে বলে হল্লা তুলেছিল। আমাদের মান্টো সিংহ বলল, সে নিজের কানে বাঘের ডাক শুনেছে। অথচ আমরা কেন শুনলাম না বল তো? আমরা কি কানে কম শুনি?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওখানে দুটো লোক জোর দিয়ে বলল, কাল রাত্তিরে নাকি বাঘটা বাজারের কাছে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছে। ওরাও ডাক শুনেছে।

কাকাবাবু বললেন, বাজারে? জঙ্গলে খাবারদাবার ফুরিয়ে গিয়েছে, তাই বাঘ শহরে এসেছে বাজার করতে। দাঁড়া, দাড়ি কামানোটা শেষ করে নিই। তারপর এসব গল্প শুনব।

একটু পরে মসৃণ গালে আফটার শেভ মাখতে মাখতে কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে।

আগেরদিন সন্ধেবেলা পর্যন্ত খুব গরম ছিল। অক্টোবর মাস, কিন্তু এখনও এইসব জায়গায় শীত আসার নাম নেই। সারাদিন অসহ্য গরমের পর হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছিল সাড়ে ছটার সময়। আধঘণ্টা বৃষ্টির পর, যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎই থেমে গেল। তারপর বইতে শুরু করল ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া।

কিন্তু তখনও ঘরের মধ্যে বসে থাকলে গরম লাগে, বাইরেটাই মনোরম। তাই কাকাবাবু কেয়ারটেকার মান্টো সিংহকে বলেছিলেন, সামনের চাতালে দু-একটা শতরঞ্চি পেতে দাও না, আমরা ওখানে বসে হাওয়া খাব।

বাংলোর ঠিক পাশেই মস্ত বড় খাদ। তার ওপাশে পাহাড়। সেই পাহাড়ের আড়াল থেকে একসময় চাঁদ উঠে আসে। দিনেরবেলা এমন কিছু মনে হয়, তবে রাত্তিরবেলা পাহাড়টাকে খুব রহস্যময় দেখায়। ওখানকার জঙ্গলে কোনও বাড়িঘর নেই। একটা ঝরনা আছে, খুব বড় নয়। তাই দিনেরবেলা সেটার আওয়াজ শোনা যায় না, শুধু চোখে দেখা যায়। আর রাত্তিরবেলা ঝরনাটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আওয়াজ বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মান্টো সিংহ প্রথমে বাইরে শতরঞ্চি পেতে দিতে রাজি হয়নি।

সে বলেছিল,সাহাব, এখানে কেউ রাত্তিরে বাইরে বসে না। হঠাৎ শের এসে পড়তে পারে।

কথাটা শুনে কাকাবাবু হেসে উঠেছিলেন।

কাকাবাবু এখানে দুবার এসেছেন। মাণ্ডুতে কখনও বাঘের উপদ্রবের কথা শোনা যায়নি। উলটো দিকের পাহাড়ের জঙ্গলটাতেও তিনি জিপগাড়িতে ঘুরেছেন, কিছু হরিণ আর খরগোশ আর ময়ুর আছে বটে, বাঘের কোনও চিহ্ন নেই।

বাইরে এমন সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া, জ্যোৎস্না ফুটেছে, এই সময় ঘরের মধ্যে বসে থাকার কোনও মানে হয়?

কাকাবাবু জোর করেই শতরঞ্চি পাতিয়েছিলেন।

এই বাংলোর একটা ঘরে আরও একটি বাঙালি দম্পতি আছে, নির্মল রায় আর তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী রায়। আর ওঁদের চার বছরের ছেলে টিটো। স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার, দুজনেই বেশ ভাল গান করেন। ওঁরা এসেছেন ভিলাই থেকে, সন্তু-জোজোর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে।

ওঁরাও এসে বাইরের চাতালের সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন। একটুক্ষণ গল্পের পরই শুরু হল গান। সন্তু ভাল মাউথঅর্গান বাজাতে পারে, কিন্তু গান গাইতে পারে না। জোজো বরং ভালই গান জানে। কিন্তু এমনিতে সে খুব বাক্যবীর হলেও গান গাইতে বললেই লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে ফেলে বলতে থাকে, না, না, আমি গাইতে পারি না!

নির্মল আর জয়ন্তী রায় পরপর চারখানা গান গেয়ে ফেললেন।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ চমৎকার। আর-একটা হোক!

তখনই মান্টো সিংহ উত্তেজিতভাবে এসে বলেছিল, সাহাব, সাহাব, অন্দর মে চলা যাইয়ে! সত্যি আজ বাঘ বেরিয়েছে। একবার এই বাংলোর সামনে থেকে বাঘ একটা মেমসাহেবকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল!

কাকাবাবু তবু তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, যাঃ, এখানে বাঘ কোথা থেকে আসবে? এ তল্লাটে বাঘ আছে নাকি?

মান্টো সিংহ বলল, হাঁ সাব, আছে। জঙ্গল থাকলে বাঘ থাকবে না? মাঝে মাঝে এদিকে এসে পড়ে?

জয়ন্তী তাঁর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, আঁ, বাঘ বেরিয়েছে? আর আমরা এমন খোলা জায়গায় বসে আছি? আমি বাবা ঘরে যাচ্ছি!

টিটো বলল, মা, বাঘ এসেছে? কোথায়, কোথায়?

জোজো তাকে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি টিটো? বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না?

টিটো বলল, লড়াই করব, আমার বন্দুক কোথায়? বন্দুক তো আনিনি!

জোজো বলল, কেন, খালি হাতে বুঝি বাঘ মারা যায় না? এই যে সন্তু, ও এক ঘুসিতে বাঘকে অজ্ঞান করে দিতে পারে। আর আমার আসল নাম কী জানো? ভোম্বল দাস। সিংহের মামা আমি ভোম্বল দাস/দেড়খানা বাঘ আমার এক এক গেরাস!

টিটো বলল, তার মানে কী? তার মানে কী?

জোজো একটা হাত তুলে বলল, ভাত খাওয়ার সময় এক গেরাস করে খেতে হয়? আমি এক গেরাসে দেড়খানা বাঘের মুড়ো খেয়ে ফেলতে পারি!

মান্টো সিংহ এর মধ্যে শতরঞ্চির এক কোনা ধরে টানতে শুরু করেছে। সে বলল, উঠুন, উঠুন, নইলে আমার নামে দোষ পড়বে!

সবাইকে এবার উঠতেই হল।

কাকাবাবু রাগ দেখালেন না বটে, কিন্তু তাঁর ভুরু কুঁচকে আছে। এবার সবাই মিলে বসলেন ডাইনিং রুমে।

বেশ বড় এই ঘরটা খানিকটা উঁচুতে। এর তিন দিকের দেওয়াল কাচের। বাইরের দিকটা সব দেখা যায়। কিন্তু এখন তো খাদের উলটো দিকের পাহাড়টার কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্নায় মনে হচ্ছে, কয়েকটা বড় বড় গাছ যেন লেগে আছে আকাশের গায়ে।

টিটোকে নিয়ে সন্তু আর জোজো কাচের দেওয়ালের কাছে কিছুক্ষণ বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। তারপর টেবিলের কাছে ফিরে এসে জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই অনেক জায়গায় বাঘ দেখেছেন? একটা বাঘের গল্প বলুন!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বাঘ দেখেছি অনেক জায়গায়। এই মধ্যপ্রদেশে বেশ কয়েকটা রিজার্ভ ফরেস্ট আছে। সেসব জঙ্গলে গেলেই দেখা যেতে পারে বাঘ। কিন্তু আমরা হলাম সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের দেশের মানুষ! ওদের মতো অত বড় হিংস্র বাঘ তো আর কোথাও নেই! রয়াল বেঙ্গল টাইগারের তুলনায় এখানকার বাঘেরা ছেলেমানুষ! এই বাঘেরাই মানুষ দেখলে ভয় পায়! আমি সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বাঘ দেখতে পাইনি। লোকে বলে, সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে একবার যার চোখাচোখি হয়, সে আর প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে পারে না।

এইটুকু বলে কাকাবাবু থেমে যেতেই জয়ন্তী বললেন, ও মা, বাঘের গল্প হল কোথায়?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আসল গল্প বলতে পারবে জোজো। ও নিশ্চয়ই নিজের চোখে অনেকবার বাঘ দেখেছে!

সন্তু বলল, জোজো, তুই তো রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে একটা চিতাবাঘ দেখেছিলি, তা জানি। তুই কখনও সুন্দরবনের বাঘ দেখেছিস?

জোজো বলল, পৃথিবীর সব দেশ থেকেই তো বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাই সেভ দ্য টাইগার, অর্থাৎ বাঘ বাঁচাও সমিতি নামে একটা সমিতি হয়েছে। সেই সমিতির প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন প্রিন্স আলফ্রেড, মানে সুইডেনের যুবরাজ। গত বছর তিনি কলকাতায় এসেছিলেন।

সন্তু বলল, তোর সঙ্গে বুঝি যুবরাজের আলাপ আছে?

জোজো বলল, আমার সঙ্গে থাকবে কী করে? তবে আমার বাবাকে চেনেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, সুইডেনের রাজকুমার ইংরেজি বলতে পারেন না। তিনি সুইস ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না।

সন্তু বলল, সুইডেনের ভাষা তো সুইস নয়। সুইডিশ!

জোজো সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস! সুইডিশ, সুইডিশ! কলকাতা শহরে আমার বাবা ছাড়া তো আর কেউ সুইডিশ ভাষা জানে না। তাই রাজকুমারকে কলকাতায় এলে বাবার সাহায্য নিতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বাবাকেই রাজকুমারের কথা বুঝিয়ে বলতে হয়।

সন্তু বলল, তুইও তখন সঙ্গে ছিলি নিশ্চয়ই? রাজকুমার কী বললেন। মুখ্যমন্ত্রীকে?

জোজো বলল, আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাইনি। বাবার মুখে শুনেছি। রাজকুমার তোত বাঘ বাঁচাও সমিতির সভাপতি। তিনি রিপোর্ট পেয়েছেন যে, সুন্দরবনের সব বাঘ দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। তারা ঠিকমতো খেতে পায় না। তাই তিনি নিজের চোখে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চেহারা দেখতে চান।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কোথায় রয়াল বেঙ্গল টাইগার দেখবেন? চিড়িয়াখানায়?

জোজো বলল, ধ্যাত! চিড়িয়াখানার বাঘরা তো গান্ডেপিন্ডে খায় আর পেট মোটা হয়। উনি আসল জঙ্গলের বাঘ দেখবেন ঠিক করেছেন।

সন্তু বলল, কাকাবাবু যে বলল, সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘ দেখা খুবই শক্ত। আর একবার চোখাচোখি হলে…

জোজো বলল, কাকাবাবু ঠিকই বলেছেন। সুন্দরবনের জঙ্গল তো আর অন্য জঙ্গলের মতো নয়। নামে সুন্দর, আসলে ভয়ংকর। ভিতরে গাড়ি চলে। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কখন যে বাঘ খুব কাছের ঝোপঝাড়ের মধ্যে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তা বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ পিছন থেকে লাফিয়ে পড়ে একজনকে টেনে নিয়ে যায়। কাগজে পড়িসনি, কদিন আগেই তো কয়েকজন লোক ওখানকার নদীর ধারে কাকড়া ধরছিল, হঠাৎ একটা বাঘ এসে বিশ্বনাথ বলে একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে গেল!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, রাজকুমার পায়ে হেঁটে যেতে রাজি হলেন?

জোজো বলল, পাগল নাকি? মানে, রাজকুমারের সাহস আছে, কিন্তু তিনি রাজি হলেও আমাদের গভর্নমেন্টের লোক মানবে কেন? যদি কোনও বিপদ হয়ে যায়! তা হলে ইন্ডিয়ার নামে কত বদনাম হয়ে যাবে।

নির্মল রায় বললেন, ঠিকই তো। সুইডেনের রাজকুমার, তার সবরকম দেখাশুনো করাই তো আমাদের উচিত।

টিটো বলল, সুন্দরবনের বাঘ বুঝি খুব জোরে লাফাতে পারে?

জোজো বলল, হ্যাঁ, একলাফে নদী পেরিয়ে যেতে পারে।

টিটো বলল, হনুমান আর বাঘ যদি একসঙ্গে লাফায়, তা হলে কে জিতবে?

জোজো বলল, বাঘ তো জিতবেই। কেন বলো তো? বাঘ তো আগেই হনুমানটাকে খেয়ে ফেলবে।

টিটো এখন হি হি করে খটখটিয়ে হেসে উঠল, যেরকম হাসি শুধু চার বছরের বাচ্চারাই হাসতে পারে।

জয়ন্তী রায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী হল?

জোজো বলল, সুন্দরবনের সজনেখালিতে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। তিনতলার সমান উঁচু। সেখানে উঠে বসে থাকলে অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখা যায়, বাঘও আছে। সেই আমরা দল বেঁধে গিয়ে…।

জয়ন্তী বললেন, ওই ওয়াচটাওয়ারে আমরাও একবার গিয়ে বসে ছিলাম। তিন ঘণ্টা। কিছু দেখতে পাইনি, শুধু কয়েকটা হরিণ।

সন্তু বলল, হরিণ বুঝি কিছু না? জয়ন্তী বললেন, হরিণ তো অনেক দেখা যায়।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুমি থামলে কেন?

জোজো বলল, রাজকুমারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হল। সেই ওয়াচটাওয়ার দুদিন পাবলিকের জন্য বন্ধ! আমরা অনেক খাবারদাবার নিয়ে মোটা গদিপাতা বিছানায় গিয়ে বসলাম।

নির্মল রায় জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মানে কজন?

জোজো বলল,রাজকুমার আলফ্রেড, তাঁর এক বন্ধু কিম, একজন সরকারি অফিসার, বাবা আর আমি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তোকে সঙ্গে নেওয়া হল কেন?

জোজো বলল, আমার বাবাকে অনেক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু ওষুধ খেতে ভুলে যান ঠিক সময়। তাই আমাকে সঙ্গে যেতে হয়, ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই তো। সঙ্গে যাওয়াই ভাল।

জোজো বলল, ওয়াচটাওয়ারের সামনেটা মোটা জালে ঘেরা থাকে, যাতে বাঘ এসে আক্রমণ করতে না পারে। জালের বাইরে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, আর কাছাকাছি ঝোপঝাড়। ফাঁকা জায়গাটায় একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হল একটা শুয়োরকে। শুয়োর বাঘের খুব প্রিয় খাদ্য। বেঁধে রাখলেই শুয়োর খুব চ্যাঁচায়। সেটাই তো বিজ্ঞাপন। ওই চাচানি শুনে বাঘ আসবেই। কিন্তু আমরা সকাল, দুপুর, বিকেল-সন্ধে পর্যন্ত বসে রইলাম। বাঘের দেখা নেই।

জয়ন্তী রায় বললেন, আগেই তো বলেছি, ওই টাওয়ারে বসে বাঘ দেখা যায় না। সুন্দরবনের বাঘ খুব চালাক।

জোজো বলল, আমরা কিন্তু বাঘ দেখেছি।

জয়ন্তী বললেন, তবে যে বললে সারাদিন বসে থেকেও…।

জোজো বলল, আপনি তো আমাকে পুরোটা বলতে দিচ্ছেন না।

নির্মল রায় বললেন, আঃ জয়ন্তী, ওকে বলতে দাও।

জোজো বলল, মুশকিল হচ্ছে কী, দিনেরবেলা তো বাঘ বেরোয় না সাধারণত। ওরা নিশাচর প্রাণী। রাত্তিরবেলা এসে শুয়োরটাকে ধরে নিয়ে গেলেও অন্ধকারে আমরা কিছু দেখতে পাব না। তাই শুয়োরটাকে খুলে নিয়ে আমরাও নেমে গেলাম গেস্ট হাউসে। সেখানে রাত্তিরে বেশ ভালই খাওয়া দাওয়া হল। তারপর আড্ডা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী খেলি রে জোজো?

জোজো বলল, টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল, মুর্গ মুসল্লম, তার মানে মুর্গির পেট কেটে তার মধ্যে চাল আর ডিম ঢুকিয়ে সেলাই করে রান্না, আর কঁকড়ার ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, রাজকুমার খেলেন এত কিছু?

জোজো বলল, রাজকুমারের জন্যই তো কলকাতা থেকে স্পেশ্যাল কুক নিয়ে গিয়ে এত কিছু রান্না করা হয়েছিল। কিন্তু খেতে বসে তিনি বললেন, তিনি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, এখন শুধু নিরামিষ খান। তাই খেলেন শুধু ভাত-ডাল-বেগুনসেদ্ধ আর দই। তাঁর বন্ধুটা অবশ্য চেটেপুটে খেল সবই। ইলিশ খেয়ে বলতে লাগল, এরকম ভাল মাছ সে জীবনে খায়নি।

সন্তু বলল, পরদিন সকালে আবার গেলি?

জোজো বলল, সারারাত আমার ভাল করে ঘুমই হল না। মাঝে মাঝে জানলার দিকে চেয়ে দেখছি, কখন ভোর হয়। কিছুতেই ভোরের আলো ফুটছে না। একসময় আলো জ্বেলে দেখি, সাড়ে সাতটা বাজে। তবু রোদুর ওঠেনি কেন? জানলার কাছে গিয়ে দেখি, সারা আকাশ ঘন মেঘে কালো হয়ে আছে, আর একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে। বাবা আগেই জেগে উঠেছিলেন, বাবা বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও সবাই। এইটাই ভাল সময়। এইরকম অন্ধকার থাকলে বাঘ বেরোতে পারে।

আমরা সবাই গিয়ে আবার ওয়াচটাওয়ারে উঠে বসলাম। শুয়োরটাকেও খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল। তারপর অপেক্ষা। রাজকুমারের হাতে দূরবিন। কেউ কোনও কথা বলছে না। খুব বেশিক্ষণ না, ঘণ্টাখানেক মোটে কেটেছে।

জয়ন্তী উদগ্রীব হয়ে বললেন, দেখা গেল বাঘ?

জোজো বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, বাঘ দেখা অত সহজ নাকি? এ কি সার্কাসের বাঘ যে, খেলা দেখাবে? খুব কাছেই একটা ময়ূর পাঁও পাঁও করে ডেকে উঠল। কয়েকটা বাঁদর কিচিরমিচির করতে করতে এক ডাল থেকে আর-এক ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে পালাল, তিনটে হরিণ ছুটে গেল খুব জোরে। এতেই বোঝা যায়, কাছাকাছি কোথাও বাঘ এসেছে। শুয়োরটাও ভয় পেয়ে দড়ি ঘেঁড়ার চেষ্টা করছে।

কাকাবাবু বললেন, এটা জোজো একদম ঠিক বলেছে। বাঘ বেরোলেই জঙ্গলের অন্য প্রাণীরা ভয় পেয়ে পালায়! জোজোর গল্প একেবারে নিখুঁত।

জোজো বলল, কয়েকটা ঝোপে কড়কড় শব্দ হল। মনে হল, ওইদিক দিয়ে বাঘটা আসছে। অবশ্য অন্য কোনও প্রাণীও হতে পারে। তারপর খুব কাছের একটা ঝোপ নড়ে উঠল। রাজকুমার দূরবিনে দেখে বললেন, একটু হলুদ হলুদ রং দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত একটা বাঘ এসেছে। বাবা বললেন, একটা মুশকিল হবে। বাঘটা দেখে নিচ্ছে শুয়োরটার কাছে কোনও ফাঁদ পাতা আছে কিনা। কিন্তু তারপর তো বাঘটা হেঁটে হেঁটে আসবে না, সেটা ওদের স্বভাব নয়। ও একক্লাফে এসে শুয়োরটাকে তুলে নিয়েই আর-একলাফে অদৃশ্য হয়ে যাবে। চোখের নিমেষে ঘটবে ঘটনাটা। ভাল করে দেখাই যাবে না। তা হলে কী করে বোঝা যাবে, বাঘটা রোগা না মোটা?

রাজকুমার বললেন, আমি কিন্তু বাঘটাকে ভাল করে দেখতে চাই, ক্যামেরায় ফোটোও তুলতে চাই!

সন্তু বলল, মেলোমশাই নিশ্চয়ই একটা কিছু উপায় বের করলেন?

জোজো বলল, হ্যাঁ। বাবা রাজকুমারের বন্ধুকে সুইডিশ ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করলেন। সেও কী যেন উত্তর দিল। বাবা তখন বললেন, ঠিক আছে! আরও খানিক পরে বাঘটা ঝোপ থেকে একটু মাথা বের করতেই বাবা বললেন, এবার! রাজকুমারের বন্ধুটি চিৎকার করে বলে উঠল, স্ট্রাটাস, স্ট্রাটাস! আর বাবাও হাত তুলে খুব জোরে বললেন, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ! ব্যস, বাঘটা লাফাতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেখানেই থেকে গেল, শরীরটা অর্ধেক উঁচু, একেবারে নট নড়নচড়ন!

জোজো একটু চুপ করল। কাকাবাবু একটু একটু হাসছেন, আর সকলের চোখে মুখে দারুণ কৌতূহল!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী হল? বাঘটা লাফাতে পারল না?

জোজো বলল, লাফাবে কী করে? ছেলেবেলা স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলিসনি? কারও দিকে তাকিয়ে জোরে স্ট্যাচু বললে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। নড়াচড়া করে না, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলে না। বাঘটারও সেই অবস্থা!

সন্তু বিরক্তভাবে বলল, আমরা ছেলেবেলায় স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলেছি ঠিকই, কিন্তু বাঘ কি খেলেছে? বাঘ কি স্ট্যাচু কথাটার মানে জানে?

জোজো হো হো করে হেসে উঠে বলল, দুর বোকারাম। খেলার কথা তো এমনিই বললাম, তাও বুঝলি না? বাঘের সঙ্গে কি খেলা করা যায়? তবু যে বাঘটা আর নড়তে চড়তে পারছে না, তার কারণ কী?

জয়ন্তী বললেন, আমরা কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না।

জোজো বলল, আমার বাবা যে বললেন, তিষ্ঠ! তার মানে কী? থামো! এই বনে বাবা বাঘটাকে হিপনোটাইজ করলেন, তারপর তো ওর আর নড়াচড়ার ক্ষমতাই রইল না। অবশ্য মাত্র দুমিনিট।

নির্মল রায় অবিশ্বাসের সুরে বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ করা যায়?

জোজো বলল, সবাই পারে না। এই অবস্থায় বাঘটার ফোটো তোলা হয়েছিল, কলকাতায় গেলে দেখাতে পারি। দিব্যি মোটাসোটা চেহারা।

জয়ন্তী রায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর দুমিনিট পরে কী করল বাঘটা?

এর পরের অংশটা আর শোনা গেল না। মান্টো সিংহ দৌড়ে এ-ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, সাহাব, অপলোগ শুনা?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কী শুনব?

মান্টো সিংহ বলল, বাঘটা ডাকল। দুবার। সে কাছেই এসে পড়েছে!

কাকাবাবু বললেন, কই, আমরা তো কিছু শুনিনি।

মান্টো সিংহ বলল, বহুত আদমি শুনেছে। দুবার ডেকেছে।

জয়ন্তী রায় বললেন, আমরা গল্প শুনছিলাম, তাই শুনতে পাইনি?

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই ছুটে গেল জানলার কাছে।

গেস্ট হাউসের দরজাটরজা সব বন্ধ, বাঘ এলেও ভিতরে ঢুকতে পারবে। কাচের দেওয়াল কি ভেঙে ফেলতে পারে? খুব পুরু কাচ, আর অনেকটা উঁচুতে। এত দূর বাঘ লাফাতে পারবে না।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর বাঘের ডাক শোনা গেল না। দেখা গেল। কিছু। গল্প আর জমল না।

আজ আবার সেই বাঘের কথা। সন্তুরা বাইরে থেকে শুনে এসেছে।

কাকাবাবুর তবু বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে, কেউ গুজব ছড়াচ্ছে। বাঘ অনেক সময় জঙ্গলের কাছাকাছি কোনও গ্রামে ঢুকে পড়ে। খিদের জ্বালায় গোরু-মোষ মারে। সামনে কোনও মানুষ পড়ে গেলে তাকেও মেরে দিতে পারে। কিন্তু এটা তো প্রায় একটা শহর। এখানে বাঘ আসবে কেন? বাঘের প্রাণের ভয় নেই?

কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, দাঁড়া, কর্নেল সরকারকে ফোন করে দেখি, কী ব্যাপার। উনি নিশ্চয়ই জানবেন।

কর্নেল প্রিয়ব্রত সরকার আর্মিতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। আগে আগে রিটায়ার করে এখানেই বাড়ি করে থেকে গিয়েছেন। বেশ জবরদস্ত চেহারা, তবে হাসিখুশি মানুষ। আজ রাজবাহাদুর প্যালেসে গান-বাজনার আসর বসার কথা। কর্নেল সরকারই সেই ব্যবস্থা করে কাকাবাবুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

কর্নেল সরকার ফোন ধরার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী সরকারসাহেব, গান-বাজনা কখন শুরু হবে? আপনি গাড়ি পাঠাবেন বলেছিলেন।

কর্নেল সরকার বললেন, রায়চৌধুরীমশাই, বাংলায় একটা কথা আছে জানেন তো? বর্ষাকালে কেন কোকিল ডাকে না? কারণ, তখন চতুর্দিকে ব্যাঙেরা ডাকাডাকি করে, তাই কোকিল চুপ করে থাকে। আজ এখানে সেই অবস্থা। বাঘ এসে যদি ডাকাডাকি করে, তা হলে গায়িকা গান করবেন কী করে? আজকের অনুষ্ঠান ক্যানসেড!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই বাঘ ডাকাডাকি করছে? আপনি শুনেছেন নাকি?

কর্নেল বললেন, না, আমি শুনিনি। তবে অনেকেই আমাকে বলছে যে, কাল রাত থেকে নাকি বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে!

কাকাবাবু বললেন, এখানে কি সত্যি বাঘ আসতে পারে? আগে কখনও এসেছে?

কর্নেল বললেন, বছর পাঁচেক আগে নাকি একটা বাঘ কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়েছিল। একজন বৃদ্ধ লোককে মেরেও ছিল। তবে তখন আমি এখানে ছিলাম না। কতটা সত্যি তা বলতে পারব না। আজ আর কেউ ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছে না। রাস্তা একেবারে শুনশান।

কাকাবাবু বললেন, আমরাও তা হলে সারা সন্ধে গেস্ট হাউসেই বসে থাকব?

কর্নেল বললেন, আমি আসছি আপনাদের ওখানে। যদি আপত্তি না থাকে, আপনাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোব। ঘুরব অনেক জায়গায়। আর তার মধ্যে যদি হঠাৎ বাঘটার দেখা পাওয়া যায়, তা হলে বেশ মজাই হবে।
কর্নেল সরকার এসে পৌঁছোলেন ঠিক আধঘণ্টা পরে।

তাঁর একটা জিপগাড়ি তিনি নিজেই চালান। বিয়ে করেননি, তাই তাঁর বউ-ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একাই থাকেন, গান-বাজনার খুব শখ, তাতেই

সময় কাটে।

জোজো আর সন্তু এর মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছে। ওদের নিয়ে কাকাবাবু উঠলেন জিপে। তিনি বসলেন কর্নেলের পাশে, সন্তু আর জোজো পিছনে।

কর্নেলের সিটের পাশে একটা রাইফেল।

কাকাবাবু বললেন, একেবারে বন্দুক সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন?

কর্নেল বললেন, বলা তো যায় না, সত্যিই যদি একটা বাঘ এখানে ঘোরাঘুরি করে, আর আমাদের দেখলে দাঁত-মুখ খিচিয়ে তেড়ে আসে, তখন একটা কিছু তো করতেই হবে!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বাঘকে তো মারতে পারবেন না। বাঘ মারা নিষেধ!

কর্নেল হেসে বললেন, কী মজার ব্যাপার বলুন তো! আমরা তো আর বাঘ মারি না। কিন্তু বাঘেরা তো আর সেকথা জানে না। তারা দিব্যি মানুষ মারে!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখনও বাঘ শিকার করেছেন?

কর্নেল বললেন, করেছি। অনেক বছর আগে। একসময় জঙ্গলে জঙ্গলে খুব ঘুরতাম। এখন বাঘ তো দূরের কথা, কোনও জন্তু-জানোয়ারই মারতে ইচ্ছে করে না। রাইফেলটা সঙ্গে রেখেছি, যদি বাঘ আসে, তাকে ভয় দেখাবার জন্য।

জিপটা রাস্তায় বাঁক নেওয়ার পর কর্নেল বললেন, আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, এই জায়গাটা পুরোটাই একটা দুর্গ ছিল। মাঝে কয়েকটা রাজপ্রাসাদ দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। হিন্দু রাজাদের আমল থেকেই এটা তৈরি হয়, তারপর মুসলমানরা এসে দখল করে নেয়। তারাও অনেক সুন্দর সুন্দর মহল। বানিয়েছে। হাতবদলও হয়েছে অনেকবার।

জোজো জিজ্ঞেস করল, এখানে একটা রাস্তার নাম হাতি চড়াও কেন? ওখানে কি হাতি ঘুরে বেড়াত?

কর্নেল বললেন, বুনো হাতি নয়। রাজা-বাদশাদের তো পোষা হাতি থাকতই। ওখানে রাস্তাটা ঢালু, আর পাশেই হিন্দোল মহল। লোকে বলে, বেগমরা হাতির পিঠে চেপে ওই পথ দিয়ে আসতেন, সোজা মহলের উপরে পৌঁছে যেতেন।

সন্তু বলল, সত্যিই, রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। গাড়িও চলছে না।

কর্নেল বললেন, বাংলায় একটা কথা আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। এখানেও সন্ধে হতে না-হতেই সবাই বাঘের ভয়ে বাড়ি পালিয়েছে।

সন্তু বলল, আমরা যদি হঠাৎ বাঘটাকে দেখতে পাই, তা হলে ভালই হয়। বাঘটা তো আমাদের আক্রমণ টাক্রমণ করতে পারবে না। সঙ্গে জোজো আছে। ও ঠিক একটা কিছু করে বাঘটাকে ভয় পাইয়ে দেবে।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আমায় কিছু করতেই হবে না। কাকাবাবু বাঘটাকে হিপনোটাইজ করে দেবেন! ব্যস!

কাকাবাবু বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা তো আমার নেই।

কনেলসাহেব বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ! কখনও শুনিনি! হা হা হা…।

তিনি খুব হাসতে লাগলেন।

গাড়িটা আস্তে আস্তে চলতে লাগল নির্জন রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে পুরনো আমলের বড় বড় গেট। কোনওটার নাম আলমগির দরওয়াজা, কোনওটার নাম ভাঙ্গি দরওয়াজা, রামপাল দরওয়াজা, জাহাঙ্গির দরওয়াজা। কর্নেলসাহেব এই গেটগুলোর ইতিহাস শোনাতে লাগলেন, একসময় এই মার এত সুনাম ছিল যে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির আর তাঁর বিখ্যাত বেগম নুরজাহান এখানে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে।

জোজো বলল, এই নুরজাহানের নামেই তো তাজমহল বানানো হয়েছিল, তাই না?

সন্তু বলল, যাঃ! তাজমহল তো বানিয়েছেন শাহজাহান। তাঁর বেগম মমতাজ মহলের নামে। তুই ইতিহাসের কিচ্ছু জানিস না!

জোজো বলল, ওসব পুরনো কথা মুখস্থ করে কী লাভ! আমি জানি ভবিষ্যতের কথা। বল তো মঙ্গলগ্রহের জল তেতো না মিষ্টি?

কাকাবাবু এবং কর্নেল দুজনেই কৌতূহলের সঙ্গে তাকালেন জোজোর দিকে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, মঙ্গলগ্রহে জল আছে বুঝি?

জোজো বলল, নিশ্চয়ই আছে। দারুণ তেতো। নিমপাতার রসের মতো। তাই তো মানুষ মঙ্গলগ্রহে গিয়ে থাকতে পারবে কি না, তাই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।

সন্তু বলল, মঙ্গলগ্রহে যদি জল থাকেও, তা তেতো না মিষ্টি, তা বোঝা যাবে কী করে? মানুষ তো এখনও মঙ্গলগ্রহে নামেনি?

জোজো বলল, মানুষকে খেয়ে দেখতে হবে কেন? কম্পিউটার বলে দিয়েছে। এখন তো কম্পিউটারই সব কিছু বলে দেয়!

কর্নেল হেসে বললেন, খুব ইন্টারেস্টিং! জোজোর কাছে গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে হবে তো!

কাকাবাবু বললেন, জোজোর কাছ থেকে এমন অনেক কিছু জানতে পারবেন, যা কোনও বইয়ে লেখা নেই!

একটু পরে কর্নেল বললেন, বাঘের তো সাড়াশব্দ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। চলুন, আমরা অন্য কোনও জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসি। যাবেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ভালই হয়। এখনই গেস্টহাউসে ফেরার ইচ্ছে নেই। কোথায় যাওয়া যায়?

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা উজ্জয়িনী গিয়েছেন তো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা তো প্রথমেই উজ্জয়িনী এসেছি। সেখানে একটা কাজ ছিল। তারপর এই মাণ্ডুতে তিন-চারদিন থেকে যাওয়া।

কর্নেল বললেন, আর এখানে সবচেয়ে নাম করা জায়গা হচ্ছে বাঘ গুহা। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।

কাকাবাবু বললেন, অনেক দিন আগে আমি বাঘ গুহা দেখতেও গিয়েছিলাম। সন্তু আর জোজো দেখেনি। ওদের ভাল লাগতে পারে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, বাঘ গুহায় কি বাঘ আছে?

কাকাবাবু বললেন, না, বাঘটাঘ নেই। ওখানে পরপর কয়েকটা গুহার মধ্যে ছবি আঁকা আছে, অনেক পুরনো জন্তুর। অজন্তা গুহার কথা জানো

তো? সেইরকম, তবে অত বড় নয়, অত বেশিও নয়।

সন্তু বলল, ওই গুহার নাম বাঘ গুহা কেন?

কর্নেল বললেন, সেটা আমি বলতে পারি না। তবে ওখানে যে বাঘ থাকে না, সেটা একেবারে শিয়োর।

কাকাবাবু বললেন, এখানে তো বাঘকে কেউ বাঘ বলে না। হিন্দিতে বলে শের। কর্নেল, ওখানে একটা ছোট নদীও আছে, সেটার নামও বাঘ নদী,আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই?

জোজো বলল, এখন থাকুক বা না থাকুক, একসময় নিশ্চয়ই ওখানে অনেক বাঘ ঘুরে বেড়াত। এখনও দু-একটা থাকলেও থাকতে পারে।

সন্তু বলল, আগেকার দিনের বইয়ে লেখা হত ব্যাঘ্র। সেটা সংস্কৃত, তাই না? তার থেকে বাংলায় হয়েছে বাঘ। কিন্তু হিন্দিতে শের কী করে হল?

কাকাবাবু বললেন, অতশত তো জানি না। পরে জেনে নিতে হবে।

জোজো বলল, আমরা বাঘ গুহায় যাব। চলুন, চলুন!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু সে তো খুব কাছে নয়। আজ পৌঁছোব কী করে?

কর্নেল বললেন, আমি গাড়ি চালিয়ে আপনাদের নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই রাত্তিরে তো গুহার মধ্যে কিছু দেখা যাবে না। তবে এখন তিরিশপঁয়তিরিশ কিলোমিটার দূরে গেলে ধার নামে একটা ছোট শহর পাওয়া যাবে। সেখানে হোটেলে টোটেলে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে দেখতে যাব বাঘ গুহা।

জোজো বলল, রাত্তিরে আমাদের গেস্টহাউসে ফেরা হবে না? তা হলে তো কিছু জামা-কাপড় নিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিকই বলেছে। আমরা তো তৈরি হয়ে আসিনি। সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নিতে হবে। কর্নেলসাহেব, খানিকক্ষণের জন্য গেস্টহাউসে ফিরে গেলে হয় না? খুব কি দেরি হয়ে যাবে?

কর্নেল বললেন, না, না, দেরির কী আছে? আমি সারারাতও গাড়ি চালাতে পারি। তবে আমার বিশেষ কিছু লাগে না। এই এক জামা-প্যান্টেই আমার তিন-চার দিন চলে যায়।

গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরা হল। অন্য একটা রাস্তা, শর্টকার্ট হবে।

জামি মসজিদের কাছে এক জায়গায় দেখা গেল বেশ কিছু লোককে। তারা উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলাবলি করছে!

কর্নেল সেই ভিড়ের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থামালেন। কর্নেলকে এখানে অনেকেই চেনে। গাড়ি দেখে ছুটে এসে কয়েকজন লোক চিৎকার করে এখানকার ভাষায় কী যেন বলতে লাগল।

কর্নেল কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, মনে হচ্ছে সত্যিই পালে বাঘ পড়েছে। নামুন, দেখা যাক, কী ব্যাপার।

সবাই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।

রাস্তার একপাশে খানিকটা উঁচু-নিচু মাঠের মতন। তার মধ্যে একটা ছোট বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে আরও কিছু মানুষের জমায়েত হয়েছে। সেখানে শোনা যাচ্ছে একটা কোনও প্রাণীর আর্ত চিৎকার।

রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে কর্নেলসাহেব সদলবলে হাজির হলেন সেই বাড়িটার কাছে। জনতা দুভাগ হয়ে তাঁর রাস্তা করে দিল।

একটা বড় ছাগল কিংবা ভেড়া মাটিতে পড়ে ছটফট করছে আর চাচাচ্ছে, তার সারা গায়ে রক্ত।

সেটা একটা রামছাগল। শোনা গেল যে, বাঘ এসে ওটাকে আক্রমণ করেছিল, কিন্তু অত বড় প্রাণীটাকে নিয়ে যেতে পারেনি। খানিকটা মাংস খুবলে নিয়েছে শুধু। পাশের খাঁচায় চারটে হাঁস ছিল, দুটো হাঁস নেই। ছাগলের বদলে হাঁস দুটোকেই নিয়ে গিয়েছে বাঘ।

তা হলে বাঘ যে এসেছিল,এবার তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু কেউই বাঘটাকে চোখে দেখেনি। তিন-চারজন অবশ্য বলল, তারা বাঘের গর্জন শুনেছে, তারপরই লাঠিফাঠি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের কথা কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে, তা বোঝা মুশকিল।

এই ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র আধঘণ্টা আগে।

দু-তিনজন বলল, বাঘটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। হাঁস খেয়ে কি তার পেট ভরবে? নিশ্চয়ই আবার রামছাগলটার মাংস খেতে আসবে। বাঘের তো সেরকমই স্বভাব।

কাকাবাবু বললেন, এত লোকজন দেখে আর বাঘ আসবে না। তার কি প্রাণের ভয় নেই? বাঘটা যখন এসেছিল, তখন রাস্তায় তো কোনও লোকই ছিল না নিশ্চয়ই!

দু-তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল, ছিল স্যার। একজন চোর ছিল।

কর্নেল বললেন, তার মানে? চোর ছিল? তাকে কে দেখেছে?

এবার কয়েকজন লোক কর্নেলদের নিয়ে গেল বাড়িটার ডান পাশে।

এখানে একটা মুদির দোকান। দরজায় তালা বন্ধ। কিন্তু পিছনের জানলা ভাঙা। সেই জানলা দিয়ে একটা চোর ঢুকেছিল ভিতরে। ক্যাশবাক্সে বেশ কিছু টাকা ছিল, চোর কিন্তু তা নিতে পারেনি। কয়েক প্যাকেট বিস্কুট আর দুপ্যাকেট গুঁড়ো দুধ নিয়েছে শুধু। ওইসব নিতে নিতেই বাঘটা এসে পড়ায় সে টাকাপয়সা না নিয়েই পালিয়েছে।

চোর আর বাঘ যে একই সময়ে এসেছিল, তা কী করে বোঝা গেল?

মুদিদোকানের মালিক এগিয়ে এসে বলল, সাহেব, আমি নিজে সাতটার সময় দোকান বন্ধ করেছি। তখন সব ঠিক ছিল।

আর-একজন বলল, জানলা ভেঙে চোর ঢুকবে, আর টাকাপয়সা না নিয়ে পালাবে, তা কখনও হয়? নিশ্চয়ই সে সময়ই বাঘ এসে পড়ে, তাই সে ভয়ে পালিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, কিংবা চোরটাকে বাঘও দেখে ফেলে। তাই সেও ভয় পেয়ে রামছাগলটাকে পুরোপুরি খেতে পারেনি।

জোজো বলল, কিংবা চোর আসেনি, বাঘটাই কাচের জানলা ভেঙে মুদিখানার ভিতরে ঢুকেছে। বাঘের তো টাকাপয়সার দরকার নেই। তাই শুধু বিস্কুট আর দুধ নিয়েছে।

সন্তু বলল, রোজ মাংস খেয়ে খেয়ে বাঘের অরুচি হয়ে গিয়েছে। তাই একদিন দুধ আর বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।

কর্নেল বললেন, এখন আর এটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। একটা সত্যিকারের বাঘ এসে ঢুকেছে এখানে। সে একটা ছাগল মেরেছে, এরপর মানুষও মারতে পারে। এর তো একটা ব্যবস্থা করতেই হয়।

তিনি রাইফেলের নলটা আকাশের দিকে উঁচিয়ে একবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলেন। সেই শব্দ কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করিয়ে দিল সবাইকে।

রাইফেলটা নামিয়ে কর্নেল বললেন, যদি কোনও কারণে বাঘটা কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকে, তা হলে এই শব্দ শুনে সে পালাবার চেষ্টা করবেই।

সেরকম কিছু ঘটল না, বাঘের আর কোনও চিহ্ন নেই।

কর্নেল বললেন, তা হলে আমাদের আর আজ রাত্তিরে বেরোনো হচ্ছে। না। বাঘটাকে এই মাণ্ডু থেকে তাড়াবার একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আমারও কিছুটা দায়িত্ব আছে।

কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে আছেন। যেন কিছু একটা ব্যাপার তার পছন্দ হচ্ছে না। তবু তিনি বললেন, তা ঠিক, আজ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।

জোজো হতাশভাবে বলল, এখানকার একটা বাঘের জন্য আমাদের বাঘ গুহায় যাওয়া হবে না?

এই সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে সেখানে থামল।
এই অঞ্চলের পুলিশের বড়কর্তার নাম সুলতান আলম। তাঁর চেহারাটা দেখার মতো। ছফুটের বেশি লম্বা, তেমনই স্বাস্থ্যবান, বেশ ফরসা গায়ের রং। তাঁর গোঁফটা কাকাবাবুর চেয়েও অনেক বেশি মোটা আর দুদিকে সূচলো, মাথার চুল থাক থাক করা।

তাঁকে দেখলে ইতিহাস বইয়ের কোনও ছবির কথা মনে পড়ে।

তিনি কর্নেলসাহেবকে আগে থেকেই চেনেন। কাকাবাবুর নাম শোনার পর খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী? মানে, আপনি কি সেই রাজা রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, সেই মানে কী?

সুলতান আলম বললেন, আপনি আরকিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খুব বড় অফিসার ছিলেন না একসময়?

কাকাবাবু বললেন, সে অনেক দিন আগেকার কথা।

সুলতান আলম বললেন, আপনার কি সেলিম রহমান নামে কাউকে মনে আছে? আপনার আন্ডারে কাজ করতেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। সে খুব আমুদে লোক ছিল আর ভাল গান গাইত।

সুলতান বললেন, সেই সেলিম রহমান আমার মামা। তাঁর কাছে। আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনিই তো সম্রাট কনিষ্কর মুন্ডু খোঁজার জন্য কাশ্মীরের সোনমার্গ গিয়েছিলেন।

জোজো বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাকাবাবু ইজিপ্টের ফেমাস পিরামিডের মধ্যেও ঢুকেছিলেন।

সন্তু চোখ দিয়ে জোজোকে বকুনি দেওয়ার চেষ্টা করল। কাকাবাবু এসব বলা পছন্দ করেন না।

সুলতান এবার কর্নেলের দিকে ফিরে বললেন, কী কর্নেলসাহেব, কী দেখলেন এখানে? সত্যি সত্যি বাঘ এসেছিল?

কর্নেল বললেন, এখন আর অবিশ্বাস করা যাচ্ছে না। একটা রামছাগলকে থাবা মেরেছে। দুটো হাঁসও নিয়ে গিয়েছে।

জোজো বলল, একটা চোরও এসেছিল। বিস্কুট আর দুধ চুরি করেছে।

সুলতান একটু অবাক হয়ে বললেন, চোর? চোরের সঙ্গে বাঘের কী সম্পর্ক?

জোজো বলল, চোর আর বাঘটা একসঙ্গে এসেছিল!

এটাকে একটা হাসির কথা মনে করে পুলিশসাহেব হা হা করে হাসলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন বাড়িটার কাছে।

ছাগলটা এখনও ছটফট করছে আর প্রচণ্ড জোরে চাচাচ্ছে। একটুক্ষণ সেটার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বললেন, এমনভাবে কামড়েছে, এ প্রাণীটা তো আর বাঁচবে না মনে হচ্ছে। শুধু শুধু আর একে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?

কোমর থেকে রিভলভারটা বের করে তিনি একবার মাত্র গুলি চালালেন। ছাগলটা সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল।

কয়েকজনের অনুরোধ শুনে সুলতান পাশের দোকানটাও দেখতে গেলেন। ভাঙা জানলা আর ভিতরের জিনিসপত্র ছড়ানো উঁকি মেরে দেখলেন শুধু। তারপর জনতাকে বললেন, এখানে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে হল্লা করার দরকার নেই। এখনই দারোগাবাবু আসছেন আরও পুলিশ নিয়ে। তারা পাহারা দেবে। আপনারা ভয় পাবেন না, বাড়ি যান। সামান্য একটা বাঘ, কালকেই আমরা ওকে ধরে ফেলব।

কাকাবাবুদের কাছে ফিরে এসে তিনি বললেন, পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ব্যাপারইনা ঘটে। মাণ্ডুতে বাঘ?বুঝলেন, কর্নেল, আমি আগে বিশ্বাসই করিনি। আমার তো এখানে থাকার কথা নয়। আমি গতকালই এসেছি এক আত্মীয়র বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। একজন যে-ই খবর দিল, অমনই আমি নিজের চোখে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম। এসব ব্যাপার নিয়ে তো আমার মাথা ঘামাবার কথা নয়। স্থানীয় পুলিশ ভার নেবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকদের ডাকতে হবে। আমি এসেছি শুধু নিজের কৌতূহলে।

কর্নেল বললেন, এটা টুরিস্ট সিজন। বাঘের ভয়ে যদি সব টুরিস্ট পালিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু লোকজনদের খুব ক্ষতি হবে। বাঘটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে ফেলা দরকার।

সুলতান বললেন, ধরে ফেলাটা সহজ নয়। বরং মেরে ফেলা সহজ। কিন্তু বাঘ মারা যে এখন নিষেধ? আগে ধরারই চেষ্টা করতে হবে। সেটা বনবিভাগের দায়িত্ব।

কর্নেল বললেন, এ ব্যাপারে আমি বনবিভাগকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি বোধহয়।

সুলতান বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে যখন দেখাই হয়ে গেল, চলুন না, কোথাও বসে গল্প করি। এই কর্নেলের বাড়িতেই যাওয়া যেতে পারে। উনি খুব ভাল রান্না করেন, চটপট অনেক কিছু বানিয়ে ফেলতে পারেন। আপনার সঙ্গের ছেলে দুটিকে বরং ঘরে ফিরে যেতে বলুন। ওরা যদি ভয় পায়, আমার বডিগার্ড সঙ্গে যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, ওরা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। আপনারাই বরং আমাদের গেস্টহাউসে চলুন। আমি অন্য কোথাও গেলে আমাকে তো আবার পৌঁছে দিতে আসতে হবে কাউকে।

একটু পরে সবাই চলে এলেন গেস্টহাউসে। বসা হল ডাইনিং রুমের একটা টেবিলে। বাইরেটা আজও অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে ঝরনার জলের শব্দ।

সুলতান আলম কাকাবাবুকে বললেন, আপনাকে এই ছোট্ট জায়গায় দেখতে পাব, এটা আশাই করিনি। এখানেও কি কোনও রহস্যের সন্ধানে এসেছেন নাকি? খুব পুরনো জায়গা, কোথাও কোনও গুপ্তধন টুপ্তধন থাকতেও পারে।

কাকাবাবু বললেন, না, না, ওসব কিছুনা। আমি এসেছিলাম উজ্জয়িনীতে একটা কাজে। আমার ভাইপো সন্তু আর তার বন্ধু জোজো আমার সঙ্গে অনেক জায়গায় যায়। তাই ভাবলাম, ওদের এই মাণ্ডু জায়গাটাও দেখিয়ে নিয়ে যাই। কয়েকদিন থাকার পক্ষে তো এটা খুব সুন্দর জায়গা।

সুলতান বললেন, তা ঠিক। উজ্জয়িনীতে আপনার কী কাজ ছিল?

কাকাবাবু বললেন, সেটাও ঠিক কাজ বলা যায় না। আসল কারণটা শুনলে আপনারা হাসবেন।

সন্তু আর জোজোর মুখে এর মধ্যেই হাসি ফুটে উঠেছে।

কর্নেল বললেন, শুনি, শুনি, আসল কারণটা শুনি।

কাকাবাবুবললেন, উজ্জয়িনীতে আমার এক পিসিমা থাকেন। পিসেমশাই হাইকোর্টের জজ ছিলেন, মারা গিয়েছেন অনেক দিন। আর পিসিমাও ছিলেন এক কলেজের অধ্যক্ষা, তাও রিটায়ার করেছেন বহু বছর আগে, এখনও নানারকম কাজটাজ করেন।

সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম আপনার পিসিমার?

কাকাবাবু বললেন, সুপ্রভা রায়। চেনেন?

সুলতান ভুরু উঁচিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি? সুপ্রভা রায়কে এ তল্লাটে কে না চেনে? সবাই তাঁকে ডাকে বড়কাদিদি। গরিব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেন, বস্তির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখান। কত বয়স হবে এখন, এইট্টি ফাইভ? তবু সারাদিন ব্যস্ত। তবে মহিলার খুব কড়া মেজাজ। একবার আমাকেও ডেকে খুব ধমকে ছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার পিসিমা খুব মেজাজি মানুষ। তিনি একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন, আমি আর কতদিন বাঁচব ঠিক নেই। রাজা, তোকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তুই শিগগিরই এখানে চলে আয়। তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথাও আছে। সেই টেলিগ্রাম পেয়ে আমি ভাবলাম, সত্যিই তো পিসির অনেক বয়স হয়েছে, কখন কী হয় ঠিক নেই। একবার দেখা করাই উচিত। তাই চলে এলাম।

সুলতান বললেন, কিন্তু সুপ্রভা রায়ের তো কোনও অসুখবিসুখ করেনি? তিনদিন আগেও আমি দেখেছি, একটা বস্তির মধ্যে হেঁটে-হেঁটে ওষুধ বিলি করছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমিও এসে দেখলাম, পিসিমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই আছে। এই বয়সেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে পারেন। যাই হোক, তবু দেখা হয়ে গেল। এমনিতে তো আর এদিকে আসা হয় না। সন্তুদের এখন কলেজ ছুটি, ওরাও কোথাও বেড়াতে যেতে চাইছিল।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, উনি আপনাকে জরুরি কথা কী বললেন?

কাকাবাবু হেসে বললেন, সেটাও এমন কিছু জরুরি নয়। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হারে রাজা, তুই কি আর বিয়ে করবি না? আমি বললাম, না পিসিমা, আমারও তো যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে, আর আমি বিয়ের ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাব না! তা শুনে পিসিমা বকুনি দিয়ে বললেন, ঝঞ্ঝাট আবার কী? বিয়ে মানে কী ঝঞ্ঝাট! এই বয়সেও অনেকের বিয়ে হয়।

সুলতান বললেন, ঠিকই তো বলেছেন বড়কাদিদি। আপনার বয়সে অনেক মানুষের বিয়ে হয়। বলুন, পাত্রী দেখব নাকি?

কাকাবাবু বললেন, মাথা খারাপ! ওসবের আর প্রশ্নই ওঠে না। যাই হোক, খানিকক্ষণ বকাঝকার পর পিসিমা বললেন, শোন, আমার এই যে বাড়ি, বাগান, ব্যাঙ্কের সব টাকাপয়সা, এই সব আমি রামকৃষ্ণ মিশনের নামে উইল করে দিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ে নেই, তোদেরও এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু কয়েকজনের নামে কয়েকটা জিনিস আমার কাছে আছে। যেমন, আমার শাশুড়িমা একটা খুব দামি হিরের আংটি আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এটা রাজার বিয়ের সময় তার বউকে দিবি। সেই আংটিটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছে। তুই বিয়ে করলি না, এখন সেই আংটি নিয়ে আমি কী করব? সেটা তোকে নিতে হবে। আমি বললাম, পিসি, আমি তো আংটি পরি না। ওটা নিয়ে আমি কী করব? তুমি আংটিটাও দান করে দাও। তাতে পিসি বললেন, আমার শাশুড়িমা তোর নাম করে রেখে গিয়েছেন। তা আমি কী করে অন্য লোককে দেব? ওটা তোকে নিতেই হবে! জোর করে সেটা তিনি আমায় গছিয়ে দিলেন।

কর্নেল বললেন, তা হলে তো স্যার, ওই আংটির জন্যই আপনার একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত।

কাকাবাবু বললেন, যা বলেছেন! ও আংটি আমি সন্তুকে দিয়ে দেব ঠিক করেছি!

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমিও আংটি পরি না। আমি আংটি চাই, আংটি চাই না!

কর্নেল বললেন, তুমি পরবে না। তোমার তো একসময় বিয়ে হবে, তোমার বউ পরবে!

সন্তু তবু বলল, না, আমি আংটিফাংটি চাই না।

সুলতান বললেন, এ যে দেখছি একটা আংটি-সমস্যা হয়ে গেল! যাই হোক, দামি আংটি বলছেন, সাবধানে রাখবেন। এখানে তো চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছে।

কর্নেল বললেন, আংটিটা চুরি গেলে আংটি-রহস্য নামে বেশ একটা গল্প হয়ে যাবে।

জোজো বলল, আংটি-রহস্য নিয়ে সত্যজিৎ রায় গল্প লিখে ফেলেছেন। আর সে গল্প জমবে না।

সুলতান বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, যখন এখানে এসেই পড়েছেন, তখন এই বাঘের রহস্যটা সমাধান করে দিন। শহরের মতো জায়গায় বাঘ ঢুকবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, না, না, এর মধ্যে আমি নেই। বাঘের রহস্য সমাধান করার ক্ষমতাই আমার নেই। বাংলায় একটা কথা আছে, বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা। আমি সেধে সেধে সে ঘা করতে চাই না। আপনারাই কিছু করুন, আমরা গল্প শুনব।

সুলতান বললেন, আমার বাবা চারখানা বাঘ মেরেছিলেন। আমিও বাঘ শিকার করতে পারি। কিন্তু ফাঁদ পেতে বাঘ ধরা আমার দ্বারা হবে না। কাল আমি উজ্জয়িনী ফিরে যাচ্ছি। কর্নেলসাহেব যা করার করবেন।

কর্নেল বললেন, বাঘের কথাটা প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে নাকি এরকম একটা বাঘ ঢুকে পড়েছিল মাণ্ডুতে। সেবারে দুজন মানুষকেও মেরেছিল। তাই এখানকার লোক বাঘের কথা শুনলেই এত ভয় পায়।

সুলতান বললেন, মাস দুয়েক আগে ধার শহরেও একটা বাঘ এসেছিল নাকি। গুজব কি না জানি না। একটা মোষ আর একটা শুয়োর মেরেছিল। কিন্তু কেউ বাঘটাকে স্বচক্ষে দেখেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, ঘটনাটা আমারও কানে এসেছে। তবে তখন আমার গুজব বলেই মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, সেটাও সত্যি হতে পারে। এদিকে তো অনেক ছোট ছোট পাহাড় আর কিছু কিছু জঙ্গলও আছে। জন্তু-জানোয়ার অনেক কমে গিয়েছে, বড় জানোয়ার কিছু নেই-ই বলতে গেলে। তবু দু-একটা বাঘ-ভালুক থেকে যেতেও পারে।

সুলতান বললেন, বাঘের দেখা না পাওয়া গেলেও ভালুক তো এখনও আছে যথেষ্ট। আমি নিজেও তিন-চারবার দেখেছি। বুনো ভালুক শহরে ঢোকে। না। কিন্তু হাইওয়ের উপরে এসে পড়ে কখনও কখনও!

কর্নেল বললেন, জন্তু-জানোয়ার যে কখন কোথায় হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাবে, তার কোনও ঠিক নেই। আপনার মনে আছে, গতবছর ঠিক এই সময় উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের সামনে হঠাৎ একটা মস্ত বড় পাইথন ধরা পড়েছিল। অত বড় সাপটা ওখানে এল কী করে বলুন তো?

সুলতান বললেন, সাপ যে কোথায় কী করে ঢুকে পড়ে, তা বলা মুশকিল। একবার ইন্দোরে আমাদের বাড়ির বেডরুমে একটা সাপ দেখেছি!

কর্নেল বললেন, ছোটখাটো সাপ সুড়ুত করে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু অত বড় একটা পাইথন, কোথা থেকে এল, কেউ দেখতে পেল না?

সুলতান বললেন, আকাশ থেকে তো পড়েনি, নিশ্চয়ই শিপ্রা নদীর পানিতে ভেসে এসেছে। খুব বন্যার সময় বাঘও ভেসে আসতে পারে।

কর্নেল বললেন, এখন তো সেরকম কোনও বন্যা হয়নি। তা ছাড়া, পাহাড়ের উপর দিকে তো বন্যা হতে পারে না, বন্যা হয় নীচের দিকে।

সুলতান বললেন, যাই হোক, দেখতে হবে, এই বাঘটা যাতে মানুষ না মারে। মানুষ মারলেই খবরের কাগজে হইচই পড়ে যাবে।

একটু পরে আজ্ঞা ভঙ্গ হল।

কর্নেল আর সুলতান আলম চলে যাওয়ার পর মান্টো সিংহ এসে বলল, সাহাব, আজ অনেক দোকান বন্ধ ছিল, তাই মুরগি পাওয়া যায়নি। আপনাদের আজ নিরামিষ খেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, তাতে কোনও আপত্তি নেই। বেগুন আছে তো? বেগুনভাজা করে দাও!

জোজো জিজ্ঞেস করল, আন্ডা হ্যায় তো? অমলেট করকে দেও।

মান্টো সিংহ বলল, আন্ডা ভি নেহি। আলুভাজা হবে।

জোজো বলল, বাঘটা তো মহাপাজি! ওর জন্য আমাদের নিরামিষ খেতে হবে? আর ও নিজে দিব্যি হাঁসের মাংস খাবে?

সন্তু বলল, আমাদের কী সুবিধে বল তো! আমরা নিরামিষও খেতে পারি, আবার মাছ-মাংসও ভাল লাগে। বাঘ-সিংহরা নিরামিষ খেতে জানেই না!

পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সূর্য দেখাই গেল না। বৃষ্টি কখনও বেশ জোরে, কখনও টিপিটিপি। দুপুরবেলা কিছুক্ষণের জন্য থামলেও আবার শুরু হল ঝমঝমিয়ে।

এরকম বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোই যায় না। কাকাবাবু বই পড়েই কাটিয়ে দিলেন সারাদিন। সন্তু আর জোজো অনেকটা সময়ই বসে রইল জানলার ধারে। বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসাভাবে দেখা যাচ্ছে খাদের উলটো দিকের পাহাড়টা।

নির্মল আর জয়ন্তী রায়দের আজ ফিরে যাওয়ার কথা। একটা গাড়ি ভাড়া করা আছে। কিন্তু সেই গাড়িটা আসছে না। ওঁরা ছটফট করছেন। টিটো সেজেগুজে একেবারে রেডি। সে সন্তু আর জোজোর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, বৃষ্টির সময় বাঘেরা কী করে?

সন্তু বলল, বৃষ্টিতে ভিজলেই বাঘেদের সর্দি হয়। তাই ওরা গুহার মধ্যে বসে থাকে।

জোজো বলল, বসে থাকে না, শুয়ে থাকে। গান গায়।

চোখ বড় বড় করে টিটো জিজ্ঞেস করল, বাঘেরা গান করতে পারে?

জোজো বলল, হ্যাঁ। আমি শুনেছি। আমি ওদের একটা গান জানি। শুনবে?

টিটো লাফাতে লাফাতে বলল, শুনব, শুনব!

জোজো সুর করে গাইতে লাগল,

হালুম হুম হা গোঁ গোঁ গোঁ
এ্যারর ব্র্যার ঘ্রার ওয়াম হোঁ হোঁ
হালুম হুম হা…

এই সময় ভাড়ার গাড়িটা এসে গেল। বৃষ্টি এখনও পড়ছে।

টিটো কিন্তু এখন আর যেতে চায় না। সে বাঘের গান আরও শুনবে। সে জোজোকে আঁকড়ে ধরে রইল। শেষ পর্যন্ত তাকে জোর করেই তোলা হল গাড়িতে।

ওরা চলে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, জোজো, তুই বাঘের এই গানটা এইমাত্র বানালি? না, আগেই তৈরি ছিল?

জোজো বলল, এইমাত্র বানালুম!

সন্তু বলল, সুরটুর দিয়ে? সত্যি, এটা তোর অদ্ভুত ক্ষমতা। তোর গল্পগুলোও।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, গল্প নয়। আমি যা বলি, তা সব সত্যি ঘটনা।

সন্ধের পর কর্নেলসাহেব কাকাবাবুকে ফোন করে বললেন, আজ সারাদিন বেরোননি তো? বেরোবেন কী করে? পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোও ডেঞ্জারাস। আমিও তাই বেরোইনি। তবে, আজ সারাদিন এখানে কী ঘটেছে, তা শুনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না, শুনিনি। মান্টো সিংহকে অনেকক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। কিছু ঘটেছে নাকি?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এই বৃষ্টির মধ্যেও বাঘটা বেরিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? কেউ দেখেছে?

কর্নেল বলল, পুলিশের খবর অনুযায়ী, দুজন দেখেছে। বাঘটা একটা খামারবাড়িতে ঢুকে একটা মোষকে অ্যাটাক করেছিল। মোষটা বাঁধা ছিল, বেশ বড় মোষ, তারও তো গায়ে বেশ জোর, বাঘটা তাকে মারতে পারেনি, খানিকটা মাংস খুবলে নিয়েছে। সে-বাড়ির মালিক উপরের জানলা দিয়ে বাঘটাকে দেখতে পেয়েও ভয়ে নীচে নামেনি। কাছাকাছি আরও একটা বাড়ির গোয়ালঘরে ঢুকে বাঘটা একটা বাছুরকে মেরেছে। সেখানে একজন বুড়ি তখন গোয়ালঘরেই ছিল, সে আহত হয়েছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বুড়িকেও কামড়েছে নাকি?

কর্নেল বললেন, না। আপনি তো জানেন, এদিককার বাঘ ম্যানইটার হয়। সাধারণত মানুষকে অ্যাটাকও করে না। বুড়িটা হয়তো অত সামনাসামনি বাঘ দেখে ভয়ের চোটেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। পড়ে গিয়ে তার মাথায় চোট লেগেছে।

কাকাবাবু বললেন, সেটা হওয়াই সম্ভব।

কর্নেল বললেন, আজও একটা দোকানঘর ভেঙে চুরি হয়েছে। কিন্তু চোর টাকাপয়সা কিছু নেয়নি। নিয়েছে বিস্কুট আর গুঁড়ো দুধের টিন।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? বাঘের চেয়ে এই চোরটাই দেখছি বেশি ইন্টারেস্টিং। বাঘ জন্তু-জানোয়ার মারবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটা চোর টাকাপয়সা খোঁজে না, শুধু দু-এক প্যাকেট বিস্কুট আর দুধ চুরি করে। এ কি কেউ কখনও শুনেছে? আর এই চোর কি বাঘের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়?

কর্নেল বললেন, সত্যি, এ ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। শুনুন, সেই বুড়ি বলেছে, বাঘ একটা নয়, দুটো।

কাকাবাবু বললেন, অ্যাঁ এর মধ্যে আবার বেড়ে গেল?

কর্নেল বললেন, বুড়ির কথা কতটা বিশ্বাস করা যায়, জানি না। ভয়ের চোটে চোখে ডাল্ট দেখতে পারে। তবে বুড়ি জোর দিয়ে বলেছে, একটা বড় বাঘ, তার সঙ্গে একটা ছোট বাঘ। তার মানে বাঘের সঙ্গে তার বাচ্চা। বাঘ কি তার বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে লোকালয়ে এসে হামলা করে? নাকি বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে আসে?

কাকাবাবু বললেন, আমি বাঘ সম্পর্কে অতশত জানি না। বাঘের বাড়ি কীরকম হয়, তাও দেখিনি।

কর্নেল বললেন, যাই হোক, শুনুন স্যার। এখানকার বনবিভাগের এক অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, সামনের পাহাড়টায় একবার তল্লাশ করতে যাব, সম্ভবত বাঘটা ওখানেই ডেরা বেঁধেছে। আপনারা সঙ্গে যেতে চান?

কাকাবাবু বললেন, অবশ্যই যেতে চাই। আজ রাত্তিরেই যাওয়া হবে?

কর্নেল বললেন, না। এখন গিয়ে লাভ নেই। বৃষ্টি থেমে আসছে। খুব ভোরবেলা বেরোব। আপনাদের আমার গাড়িতে তুলে নেব। তা হলে ছেলে দুটোকে বলুন। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে।
এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। ঠিক যেন একটা পাতলা চাঁদরের মতো অন্ধকার গুটিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। জেগে উঠছে পাখিরা। কতরকম ডাক তাদের। ছোট্ট ছোট্ট পাখিগুলো কী জোর শিস দিতে পারে।

একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে গাছপালা। কাল সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে গাছগুলো আজ একেবারে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।

একটাই রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের উপরের দিকে। পরপর দুটো গাড়ি, সামনেরটা কর্নেলের, পিছনের জিপটা বনবিভাগের। ফরেস্ট রেঞ্জার ত্রিলোক সিংহ উঠেছেন কর্নেলের গাড়িতে। ওঁর জন্ম জলপাইগুঁড়িতে, তাই ভালই বলতে পারেন বাংলা।

খানিকটা উপরে উঠে দেখা গেল, আকাশ একেবারে নীল, একটুও মেঘ। নেই, পুব দিকে লাল রঙের ছোপ ধরেছে। এখনই সূর্য উঠবে।

জোজো বলল, ওঃ, কতদিন সানরাইজ দেখিনি। হাউ বিউটিফুল!

সন্তু বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, এখনও তো সানরাইজ হয়নি। আগেই বিউটিফুল বলে ফেললি?

কাকাবাবু বললেন, সত্যি, অনেক দিন সূর্যোদয় দেখা হয়নি। কর্নেল, গাড়িটা একটু দাঁড় করান। ভাল করে দেখি।

অনেক দূরেও একটা পাহাড়ের ঢেউ। তার আড়াল থেকে উঠে আসছে। প্রথম সূর্যের ছটা। সমস্ত গাছের পাতায় এখন লাল রঙের আভা। প্রতি মিনিটে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে সব কিছু।

অনেক দূরে পিয়াও পিয়াও করে ডেকে উঠল একটা ময়ূর।

কর্নেল বললেন, ঝরনাটার কাছে কয়েকটা গুহামতো আছে। ওই দিকটায় আগে খোঁজ করতে হবে। বাঘটা দিনেরবেলা ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, কর্নেলসাহেব, আমরা জঙ্গলে এসে শুধু জন্তুজানোয়ার খুঁজি। প্রত্যেক জঙ্গলের যে নিজস্ব রূপ আছে, তা আমাদের চোখেই পড়ে না।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, স্যার, আজ বোধহয় আমাদের শুধু জঙ্গলের রূপ দেখেই ফিরে যেতে হবে। বাঘ দেখার কোনও আশা নেই।

কর্নেল বললেন, সে কী মশাই, আপনি আগেই এই কথা বলছেন কেন?

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, আমি এখানে তিন বছরের জন্য পোস্টেড। এই তিন বছরে কখনও এদিকের কোনও জঙ্গলে বাঘ দেখিনি। বাঘের কথা শুনিওনি। মাঝে মাঝে গুজব ওঠে অবশ্য, তার কোনওটাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়নি। আমার দৃঢ় ধারণা, এ অঞ্চলে কোনও বাঘ নেই। মাণ্ডু শহরে বাঘ ঢুকেছে বলে এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

কর্নেল বললেন, এখন তো আর অবিশ্বাস করার উপায় নেই। পরপর দুদিন বাঘ হানা দিয়েছে, কয়েকটা জন্তু মেরেছে। বাঘ তো শিকারের খোঁজে বহু দূর দূর পর্যন্ত চলে যায়। এক জঙ্গল থেকে আর-এক জঙ্গলে চলে আসে, তাই না! হয়তো সেই রকমই এই বাঘটা অনেক দূর থেকে এসে পড়েছে।

জোজো বলল, আমাদের সুন্দরবনে বাঘেরা নদী সাঁতরে ওদিকের বাংলাদেশে চলে যায়। ওদিকেও একটা সুন্দরবন আছে। বাঘ তো সীমান্তটিমান্ত কিছু মানে না!

ত্রিলোচন সিংহ তবু বললেন, আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারব না।

কাকাবাবু বললেন,আমার কী মনে হয় জানেন? ওই যে রহস্যময় চোর, তাকে ধরে ফেলতে পারলে তার কাছ থেকে বাঘটার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, চোর ধরা পুলিশের কাজ। আমাদের সেটা কাজ নয়। আমাদের কারবার বুনো জন্তু-জানোয়ার নিয়ে।

কর্নেল কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ কথাটা কেন বলছেন? চোরের সঙ্গে বাঘের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, সম্পর্ক থাকবেই, তা আমি বলছি না। তবে, যেখানেই বাঘ, সেখানেই চোর, এটা শুনে আমার মানিকরামের ঘটনা মনে পড়ছে। আপনি জানেন সে ঘটনা? বছর দুয়েক আগে, আমাদের কলকাতার কাছে সল্টলেকে আর উলটোডাঙায় হঠাৎ খুব চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। রহস্যময় চুরি। ফ্ল্যাটবাড়ির আটতলা, দশতলা। সেই সব ঘর থেকেও চুরি। দরজা বন্ধ, তবু। গরমকালে অনেকেই জানলা কিংবা বারান্দার দরজা খুলে রাখে। অত উঁচুতে তো চোর উঠতে পারে না। তবু চুরি হতে লাগল। টাকাপয়সা, গয়না। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল, চোর একটা বাঁদর। সে পাইপ বেয়ে উপরে উঠে আসে। তারপর কোনও দরজা বা জানলা খোলা পেলে ঢুকে পড়ে। কোনও শব্দও হয় না।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, বাঁদর? সে গয়না কিংবা টাকাপয়সা নেবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, সেই হচ্ছে কথা। ওই বাঁদরটার নামই মানিকরাম। আসলে ওটা একটা পোষা বাঁদর। যে-লোকটা পুষেছে, সে বাঁদরটাকে ট্রেনিং দিয়েছে টাকাপয়সা, গয়না চুরি করার।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, তার মানে, আপনি কী বলতে চান, একজন কেউ একটা বাঘ পুষেছে, আর তাকে দিয়ে চুরি করাচ্ছে? অত সোজা নয়। আজ পর্যন্ত কেউ বাঘ পুষতে পারেনি। আর বাঘ কখনও চুরি করতে শিখবেও না। মানুষই চুরি করে, বাঘ চুরিটুরির ধার ধারে না।

কাকাবাবু বললেন, বাঘ কেন চুরি করবে? চোরটা বাঘ নিয়ে গিয়ে মানুষদের ভয় দেখায়, তারপর নিজেই চুরি করে।

কর্নেল বললেন, কিন্তু এত সব কাণ্ড করে চোরটা শুধু দু-এক প্যাকেট বিস্কুট আর দুধ নেবে, টাকাপয়সা ছোঁবে না! এ কি চোর না সাধু?

এবার কাকাবাবু নিজেই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, এই ধাঁধাটার উত্তর আমি এখনও জানি না। নিশ্চয়ই একটা কিছু উত্তর আছে।

ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করা হল জঙ্গলে। বাঘের কোনও নামগন্ধ নেই। চোখে পড়ল দু-চারটে খরগোশ আর ময়ূর। এক জায়গায় একদঙ্গল বাঁদর। তারা মনের সুখে লাফালাফি করছে।

ঝরনাটার কাছে গাড়ি থেকে নেমে দেখা হল ভাল করে। সেখানে গুহা ঠিক নেই, কয়েকটা বড় বড় পাথর, মাঝে একটু একটু ফাঁক। কিছু নেই সেখানে।

ক্রমশ রোদ চড়া হচ্ছে।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, এবার বোধহয় আমাদের ফিরতে হবে। বেশি রোদে কোনও প্রাণীই বেরোতে চায় না। আর ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, ফেরাই উচিত। আমার কাজের লোক ফ্লাস্কে চা আর স্যান্ডউইচ দিয়ে দিয়েছে। কোনও একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে খেয়ে নেওয়া যাক।

কাকাবাবু বললেন, একটা ফাঁকা জায়গা দেখে থামুন।

কর্নেল গাড়িটা আস্তে আস্তে চালিয়ে ফাঁকা জায়গা খুঁজছেন, হঠাৎ সামনের রাস্তায় তিড়িং তিড়িং করে দুবার লাফিয়ে একটা হরিণ এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল।

ত্রিলোচন সিংহ উত্তেজিতভাবে বললেন, দেখলেন, দেখলেন, একটা হরিণ!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, দেখলাম তো সবাই। ত্রিলোচন সিংহ বললেন, এই জঙ্গলে হরিণ আছে। তার মানে বাঘের খাবার আছে। বাঘ তা হলে হরিণ না মেরে শহরে ঢুকে ছাগল-মোষ মারার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? এটা তো বাঘের স্বভাব নয়?

কর্নেল বললেন, একটা কারণ থাকতে পারে। যদি বাঘটা বুড়ো হয় কিংবা আহত হয়, তা হলে আর হরিণের সঙ্গে দৌড়ে পারে না। তখন দড়ি দিয়ে বাঁধা পোষা জন্তু-জানোয়ার মারাই তো ওদের পক্ষে সহজ!

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, বুড়ো বাঘ যদি মানুষের কাছাকাছি যায়, তা হলে মানুষ আর কতদিন তাকে ভয় পাবে? মানুষই একদিন তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকবে না।

স্যান্ডউইচের প্যাকেটটা খুলে কাকাবাবু বললেন, এ তো দেখছি অনেক খাবার। পিছনের গাড়ির লোকদেরও ডাকুন। ওরাও খাবে।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, ওরাও নিজেদের খাবার এনেছে। পুরি আর ভাজি। ওদের ডাকার দরকার নেই।

গাড়িটা থেমেছে সুন্দর জায়গায়। সামনে অনেকখানি খাদ। তারপর নীচে দেখা যাচ্ছে উপত্যকা। খানিক দূরে রুপোলি রঙের নর্মদা নদী।

সবাই নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। সন্তু আর জোজো লাফিয়ে লাফিয়ে একটা গাছের ডাল ছোঁওয়ার চেষ্টা করছে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাকাবাবু ত্রিলোচন সিংহকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা যে ফাঁদ পেতে বাঘ ধরেন শুনেছি, সেটা ঠিক কী ব্যাপার? মাটিতে গর্ত করতে হয়?

ত্রিলোচন বললেন, না, না, ওসবের দরকার হয় না। বাঘটাকে একবার স্পট করতে পারলে আমরা কাছাকাছি কোথাও ওয়েট করি। দলে তিনচারজন থাকলে ভয়ের কিছু থাকে না। দলের একজন শুয়োরের ডাক নকল করে ডাকতে পারে। তাই শুনে বাঘটা কাছে এলেই তার উপর জাল ছুড়ে দেওয়া হয়। সেই জালে আটকা পড়লেই বাঘ কাবু হয়ে যায়।

কাকাবাবু বললেন, যদি জালটা ঠিকমতো বাঘের গায়ে না পড়ে?

ত্রিলোচন বললেন, ওই গাড়িতে আছে সুরজমল নামে একজন, সে দারুণ এক্সপার্ট। সুরজমল কখনও মিস করে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এইভাবে আপনারা কটা বাঘ ধরেছেন?

ত্রিলোচন হেসে বললেন, বললাম না, তিন বছরে এখানে একটাও বাঘ দেখিনি। ধরব কী? তবে, যখন আমি চিত্রকূটে পোস্টেড ছিলাম, সেখানে একটা লেপার্ড ধরেছি, সেটা দারুণ হিংস্র ছিল। এই সুরজমলও ওখানে ছিল তখন, আমার সঙ্গে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে।

কাকাবাবু বললেন, বাঘটা ধরার পর কী করেন?

ত্রিলোচন বললেন, জালে বেঁধে ওকে গাড়ির মাথায় তোলা হয়। তারপর সোজা চিড়িয়াখানায়।

কর্নেল খাদের ধার দিয়ে হাঁটছিলেন, এবারে কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?

কাকাবাবু বললেন, কীসের আওয়াজ?

কর্নেল বললেন, কেউ যেন চিৎকার করছে। মানুষের গলা।

কাকাবাবু কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করে বললেন, আমি শুনতে পাচ্ছি না। কোন দিক দিয়ে আসছে আওয়াজটা?

কর্নেল বললেন, ওই খাদের তলা থেকে। কোনও মানুষ নীচে পড়েটড়ে গিয়েছে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, চলুন, দেখা যাক।

সবাই মিলে খাদের ধারে এসে উঁকি দিলেন।

কর্নেল ডান দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বললেন, এই দিকে আসুন। এখানে শোনা যাচ্ছে।

ডান দিকে আরও খানিকটা এগোনোর পর আওয়াজটা একটু স্পষ্ট হল। কেউ যেন কাঁদছে।

একটা সরু পায়েহাঁটা রাস্তা নেমে গিয়েছে খাদের নীচের দিকে। এখানে খাদটা খুব গভীর নয়, খানিকটা নীচেই কিছুটা সমতল জায়গা, সেখানে কয়েকটা বড় বড় গাছ।

সন্তু সেই রাস্তাটা দিয়ে নেমে গেল। উপর থেকে সবাই দেখছে।

সন্তু এক জায়গায় থেমে একটা হাত তুলে বলল, আওয়াজটা আসছে। ওই বড় গাছটা থেকে। ওখানে কেউ বসে আছে।

এবার কর্নেল আর ত্রিলোচন সিংহও নেমে গেলেন সেদিকে। কাকাবাবুর পক্ষে ঢালু রাস্তায় নামা মুশকিল, তবু তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে নামতে লাগলেন কষ্ট করে।

বড় গাছটায় অনেক ডালপালা, ওপরের দিকটা পাতায় ঢাকা। সেই গাছের তলা পর্যন্ত গিয়ে সন্তু বলল, এখন দেখতে পাচ্ছি। একটা ছেলে বসে আছে। ওখানে।

এবার সে আরও জোরে কেঁদে উঠে কী যেন বলতে লাগল। তার ভাষা বোঝা যাচ্ছে না।

ত্রিলোচন সিংহ গাছের তলায় গিয়ে তাকে কী সব জিজ্ঞেস করলেন।

তারপর কাকাবাবুদের দিকে ফিরে বললেন, ছেলেটা একটা অদ্ভুত কথা বলছে। ও নাকি একটা শেরের প্রায় সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি গাছে উঠে গিয়েছে। এখন ভয়ে নামতে পারছে না।

এতক্ষণ জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে বাঘের লেজও দেখা যায়নি। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, বাঘ এখানে নেই। এখন ছেলেটা বলছে…ও কী দেখতে

কী দেখেছে কে জানে!

কর্নেল চেঁচিয়ে বলল, উতরো, উতরো। ডর নেহি। মেরে পাস রাইফেল হ্যায়।

এবারে ছেলেটা প্রায় সরসর করে নেমে এল নীচে। ষোলো-সতেরো বছর বয়স, রোগা, কালো চেহারা, শুধু একটা নেংটি পরা, খালি গা।

জোজো কাকাবাবুকে বলল, ছেলেটা এই জঙ্গলে একা একা ঢুকেছে। ওর সাহস তো কম নয়।

কাকাবাবু বললেন, বুঝতেই তো পারছ, ওরা খুব গরিব। শুকনো কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে আসে। সেই কাঠ বিক্রি করে ওরা চাল-ডাল কেনে। সাহস থাকলে ওরা বাঁচবে কী করে?

কর্নেল ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথায় শের দেখেছিস?

ছেলেটার মুখ এখনও ভয়ে শুকিয়ে আছে। সে একদিকে হাত দেখাল। সেটা ফাঁকা জায়গা।

এখানে গুহাটুহাও কিছু নেই। শুধু একটা বড় গাছ ঝড়ে উলটে পড়ে আছে। একদিকে।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, আমরা এত চেষ্টা করেও শের দেখতে পেলাম। আর তুই দেখে ফেললি? শুয়োরটুয়োর কিছু দেখিসনি তো?

সন্তু বলল, কাল অত বৃষ্টি হয়েছে, বাঘ এলে তো পায়ের ছাপ থাকবে।

কর্নেল বললেন, সবই তো পাথর, এখানে আর পায়ের ছাপ পড়বে কী করে?

পাথর হলেও এক জায়গায় কিছু ঘাসও আছে। সেখানে পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কি না, সন্তু তা দেখতে লাগল উবু হয়ে।

ত্রিলোচন সিংহ ছেলেটিকে বললেন, চল আমাদের সঙ্গে। আজ আর তোকে কাঠ কুড়োতে হবে না। আমি তোকে অন্য কাজ দেব।

হঠাৎ শোনা গেল বুক কাঁপানো বাঘের গর্জন। ভেঙে পড়া গাছটার আড়াল থেকে একলাফে চলে এল একটা বাঘ। সত্যিকারের বাঘ।

সরু রাস্তাটা দিয়ে কাকাবাবু পুরোটা নীচে নামেননি। দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে। জোজো তাঁর পাশে। ত্রিলোচন সিংহ সবেমাত্র কাঠ-কুড়োনো ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছেন, আর একটু নীচে কর্নেল, আর সন্তু বসে আছে সেই ঘাসের পাশে।

এই সময় বাঘের আবির্ভাব।

সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্য ছবির মতন চুপ। কে কী করবে বুঝতে পারছেন না।

ত্রিলোচন সিংহ ফিসফিস করে বললেন, এ তো একটা বেশ বড় বাঘ। না, বাঘিনি, বুড়ি হয়ে গিয়েছে। এরা খুব হিংস্র হয়। মানুষকে অ্যাটাক করতে পারে।

বাঘিনিটা থাবা গেড়ে বসে গর-র গর-র করছে। এত মানুষজন দেখে ভয় পাওয়ার বদলে সে বোধহয় বিরক্ত হয়েছে খুব। তার খুব কাছে সন্তু।

ত্রিলোচন সিংহ এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, সুরজমল, জালটা নিয়ে এসো। জালটা।

বনবিভাগের লোকরা দাঁড়িয়ে আছে খাদের ওপারে।

সন্তু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই বাঘিনিটা লাফ দিল তার দিকে। সন্তুর ঘাড়ে যদি সে পড়ত, তা হলে আর তার রক্ষে ছিল না। কিন্তু ঠিক সময়ে সন্তুও সরে গিয়েছে অন্য দিকে।

ত্রিলোচন সিংহ এবার আরও জোরে চেঁচিয়ে বললেন, কর্নেলসাহেব, মারুন, ওকে মারুন।

কর্নেল এর মধ্যে রাইফেল তাক করেছেন। গুলি চালালেন ঠিক দুবার।

বাঘিনিটা প্রচণ্ড গর্জন করে দুপায়ে উঠে দাঁড়াল একবার, কিন্তু আর লাফাতে পারল না। ধপ করে পড়ে গিয়ে কাঁপল কয়েকবার, ঘোলাটে হয়ে গেল চোখ। তারপর একেবারে নিঃস্পন্দ।

জোজো বলে উঠল, শেষ? খতম।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, স্যার, আপনার হাতের টিপ তো দারুণ। ঠিক সময় মেরে ফেলেছেন। নইলে, সন্তু ছেলেটিকে বাঁচানো যেত না।

রাইফেলের নলের ডগায় ফুঁ দিতে দিতে কর্নেল গম্ভীরভাবে বললেন, আমি জীবজন্তু মারা অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি। এবারও মারিনি। মিস্টার সিংহ, যে-জিনিস আপনাদের কাছে থাকা উচিত ছিল, তা আমি নিজের কাছে রাখি। ঘুমের বুলেট। বাঘিনিটা মরেনি, দু-তিন ঘণ্টার জন্য নিশ্চিন্ত, ও অজ্ঞানের মতো ঘুমোবে।

সন্তু নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, ঘুমোচ্ছে?

কর্নেল বললেন, কাছে গিয়ে দেখো, নাক দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে কি না! আই অ্যাম শিয়োর, ও ঘুমোচ্ছে।

জোজো চেঁচিয়ে বলল, সন্তু, এদিকে চলে আয়।

সন্তু তবু বাঘিনিটার কাছে গিয়ে নাকে হাত নিয়ে বলল, হ্যাঁ, নিশ্বাস পড়ছে।

ত্রিলোচন সিংহ বললেন, উফ, যদি গুলি চালাতে একটু দেরি হত…ভাবতেও এখনও ভয় করছে।

কর্নেল বললেন, আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। বাঘ নিয়ে এরকম ছেলেখেলা করা উচিত হয়নি। জঙ্গলে সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। আমরা ওই কাঠুরে ছেলেটার কথা বিশ্বাস করিনি। এখনই বাঘিনিটাকে জালে বেঁধে গাড়িতে তোলো।

কাকাবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ওদিকের ঝোপটা নড়ছে! সাবধান, সাবধান?

সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।

সেই ঝোপটা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা বাচ্চা-বাঘ। কয়েক লাফে সে চলে এল বাঘিনিটার কাছে। সন্তুই এখনও সবচেয়ে কাছে, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সন্তুর উপরে।

কাকাবাবু বললেন, কর্নেল, গুলি করবেন না। গুলি করবেন না।

সন্তু এক ঝটকায় বাচ্চা-বাঘটাকে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর সে-ও খুব অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এ কী! এটা তো বাঘ নয়!

এবারে বোঝা গেল, বাচ্চা-বাঘটা সত্যিই বাঘ নয়। একটা ছেলে। তার গায়ে বাঘের চামড়া জড়ানো। এখন মুখটা বেরিয়ে এসেছে। একটা দশ-বারো বছরের ছেলের মুখ।

ঠিক বাঘেরই মতন গরগর করে সে আবার উঠে সন্তুর একটা হাত কামড়ে ধরল। সন্তু এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমায় কামড়াচ্ছিস? এবার আমিও মারব কিন্তু!

কর্নেল কাছে গিয়ে বাঘের বাচ্চা নয়, মানুষের বাচ্চাটাকে এক চড় কষিয়ে বললেন, অ্যাই, তুই কে রে?

কাকাবাবু আপন মনে বললেন, মনে হচ্ছে, এই সেই বিস্কুট-চোর!
বাঘিনিটা সত্যিই বাঘিনি। তার একটা পা খোঁড়া। বয়সও হয়েছে যথেষ্ট। দৌড়ে জঙ্গলের প্রাণী ধরার ক্ষমতা আর নেই বলেই সে মানুষের বসতিতে হানা দিতে শুরু করেছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে জালে বেঁধে বনবিভাগের লোকেরা নিয়ে চলে গেল। কোনও চিড়িয়াখানায় চালান করে দেওয়া হবে।

কিন্তু মানুষের বাচ্চাটাকে রাখা হবে কোথায়?

ছেলেটা ওই বাঘিনির সঙ্গে থাকত কী করে?

ছেলেটার হাতের নখ, পায়ের নখ বড় বড়। বেশ ধারালো। মাথার চুল ধুলো-ময়লা মাখা। জামা-প্যান্ট কিছুই পরা নেই, শুধু একটা বাঘের ছাল জড়ানো ছিল গায়ে। কোনও কথা বোঝে না, কথা বলতেও পারে না, শুধু গ-র-র গ-র-র আওয়াজ করে। চোখের দৃষ্টিও হিংস্র বুনো জন্তুর মতো।

কিন্তু জন্তু তো নয়, দশ-এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।

কাকাবাবু বললেন, বাঘ-সিংহদের একটা গুণের কথা শোনা গিয়েছে। তারা বাচ্চা-ছেলেমেয়েদের কখনও মারে না। সম্ভবত খুব ছোট বয়সে এই ছেলেটা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল, এই বাঘিনিটা ওকে নিজের সন্তানের মতন লালন-পালন করে। আগেও এরকম দু-একটা ঘটনার কথা কাগজে পড়েছি। তখন ঠিক বিশ্বাস করিনি। এখন দেখছি, এরকম সত্যিই হতে পারে।

কর্নেল বললেন, পৃথিবীতে কিছু কিছু এরকম ব্যাপার এখনও আছে, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। কত মানুষ কুকুর-বিড়াল পোষে, বাঘ-ভাল্লুকও পোর চেষ্টা করে। এখন দেখছি, বাঘও পুষেছে একটা মানুষের বাচ্চাকে।

ছেলেটা এখন গেস্টহাউসে কাকাবাবুর ঘরে ঘুমোচ্ছে।

বনবিভাগের লোকেরা বলে দিয়েছে, তারা ওর দায়িত্ব নিতে পারবে না। সেটা ওদের কাজ নয়।

পুলিশ বলেছে, ছেলেটা তো ক্রিমিনাল নয়। ওকে জেলে ভরে রাখা যাবে। যতদিন না ওর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়, ততদিন ওকে কোনও অনাথআশ্রমে রাখা যেতে পারে।

মাণ্ডুতে কোনও অনাথ আশ্রম নেই। ওকে পাঠাতে হবে উজ্জয়িনী কিংবা ভোপালে। তার জন্যও সময় লাগবে, আগে খোঁজখবর নিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, যতদিন না কিছু ব্যবস্থা হয়, ও আমাদের কাছেই থাক।

অনাথআশ্রমে পাঠানোর ব্যাপারেও কাকাবাবুর খুব আপত্তি আছে। সেখানে পাঠালে ওকে বাঁচানো শক্ত হবে। ও কারও কথা বুঝবে না, নিজেও কিছু বোঝাতে পারবে না। ওর স্বভাবটাও হিংস্র। কেউ ওকে বিরক্ত করলে ও আঁচড়ে-কামড়ে দেবে, তখন অন্যরা ওকে মারবে, মারতে মারতে মেরেও ফেলতে পারে।

ছেলেটা সন্তুকে আঁচড়েও দিয়েছে, কামড়েও দিয়েছে। অতটুকু ছেলে, কিন্তু ওর গায়ে বেশ জোর। কিন্তু সন্তুর সঙ্গে পারবে কেন! একটুক্ষণের মধ্যেই সন্তু ওকে মাটিতে চিত করে ফেলে হাত দুটো চেপে ধরেছিল। তখনও গর্জন করছিল রাগে। তারপর কিছুক্ষণের জন্য ওকে বেঁধে রাখা হয়।

এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই খুলে দেওয়া হয়েছে বাঁধন।

ছেলেটা বোধহয় ভেবেছিল, গুলি করে বাঘিনিটাকে মেরেই ফেলা হয়েছে। ও তো জানে, বাঘিনিটাই ওর মা। তাই রাগে-দুঃখে আক্রমণ করেছিল সন্তুকে। সন্তুই সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল বলে।

ছেলেটা ঘরের মধ্যে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। কাকাবাবু, সন্তু আর জোজো। অন্যরা একটু আগে ফিরে গিয়েছেন। এখন সকাল সাড়ে দশটা।

আজ আর বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই। আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। কলকাতায় এরকম নীল আকাশ বড় একটা দেখা যায় না।

জোজো বলল, দশ-এগারো বছরের ছেলে, কিন্তু কথা বলতে পারে না কেন? ও কি বোবা?

কাকাবাবু বললেন, না, না, বোবা নয়, মুখ দিয়ে তো নানারকম আওয়াজ করছে। মানুষের বাচ্চারা তো বাবা-মায়ের কিংবা অন্যদের কথা শুনে শুনে ভাষা শেখে। ও যদি দু-তিন বছর বয়সে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে যেটুকু ভাষা শিখেছিল, তাও ভুলে গিয়েছে এতদিনে।

সন্তু বলল, বাঘেদের নিশ্চয়ই নিজস্ব ভাষা আছে। ও বোধহয় বাঘের ভাষা শিখে নিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হতেই পারে। তোরা বোধহয় টারজানের সিনেমা দেখিসনি। আমাদের ছেলেবেলায় টারজানের সিনেমা খুব জনপ্রিয় ছিল। টারজানও জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে মানুষ হয়েছিল, সে ওদের ভাষাও জানত। টারজান মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করলে অমনই দৌড়ে চলে আসত হাতির পাল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, টারজানের সিনেমা এখন পাওয়া যায় না?

কাকাবাবু বললেন, খোজ করে দেখতে হবে। ডিভিডি পাওয়া যেতে পারে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আপনি যে বললেন, এই ছেলেটাই বিস্কুট চুরি করত, কিন্তু ও বিস্কুট খেতে শিখল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, কী করে শিখল, তা তো ঠিক বলতে পারব না। তবে, মনে হয়, জঙ্গলে তো অনেকে পিকনিক করতে যায়। সেরকমই কোনও দল খাবারদাবার নিয়ে বসেছিল, হঠাৎ বাঘের ডাক শুনে সব ফেলেটেলে ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর এই বাঘিনি আর ছেলেটা সেখানে এসে পড়ে। বাঘ কখনও নিরামিষ খাবার খায় না। কিন্তু মানুষের পেটে তো নিরামিষও সহ্য হয়। তাই ছেলেটা অন্যদের ফেলে যাওয়া বিস্কুট টিস্কুট হয়তো চেখে দেখেছিল। তারপর ভাল লেগে যায়। এটা আমি মনে মনে কল্পনা করছি।

জোজো বলল, আজ আমরা ওকে বিস্কুট খেতে দিয়ে দেখব, খায় কি না।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওর নাম কী হবে? ওর আগে কোনও নাম ছিল কি না কে জানে! ও নিজে বলতেও পারবে না। ওর একটা নতুন নাম দেওয়া দরকার।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। তোরা একটা নাম ঠিক কর।

জোজো বলল, হারিয়ে যাওয়া ছেলে, ওর নাম হোক হারান।

সন্তু বলল, এটা বড় পুরনো ধরনের। আর খুব বাঙালি-বাঙালি। ও তো বাঙালি ছেলে নয়।

জোজো বলল, তা হলে নাম হোক বাজবাহাদুর। এখানে এসে বাজবাহাদুর আর রূপমতীর গল্প খুব শুনছি।

সন্তু বলল, ও নামও এখন চলে না।

কাকাবাবু বললেন, আমার এক বন্ধু ছিলেন শার্দুল সিংহ। খুব ভাল বক্সিং জানতেন। এখানে কারও কারও এ নাম হয়, শার্দূল।

জোজো জিজ্ঞেস করল, শার্দুল মানে কী?

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানিস?

সন্তু মাথা নেড়ে বলল, জানি। শার্দুল মানে বাঘ।

জোজো বলল, ওরে বাবা, ও নাম চলবে না। ও যখন স্কুলে ভরতি হবে, তখন ওই নাম শুনলেই অন্য ছেলেরা ওকে খেপাবে।

সন্তু বলল, তুই ভাবলি, ও স্কুলে যাবে?

কাকাবাবু বললেন, যাবে না কেন, যেতেই পারে। প্রথম কয়েকটা মাস ওকে খানিকটা আদর-যত্ন করে রাখতে হবে, স্নেহ-মমতা দিয়ে বোঝাতে হবে যে, মানুষ ওর শত্রু নয়। মানুষ ওর আপনজন। সেটা বুঝে ওর স্বভাবটা একটু নরম হলে, ও মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে, তখন লেখাপড়াও শিখবে!

সন্তু বলল, তা হলে ওর নাম হোক আরণ্যক। এই নামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী চমৎকার একটা বই পড়েছি।

কাকাবাবু বললেন, আরও ছোট করে শুধু অরণ্যও হতে পারে। আর পদবি হতে পারে চৌধুরী। বাঙালি, অবাঙালি অনেকেরই চৌধুরী পদবি হয়।

জোজো বলল, অরণ্য যদি ভালনাম হয়, তা হলে ডাকনাম হোক বুনো।

নাম ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ছেলেটি। তার দুচোখে দারুণ অবাক অবাক ভাব।

বাঘের চামড়ার বদলে সন্তুর একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। দুটোই ওর গায়ে ঢলঢল করছে।

জোজো বলল, অ্যাই শোনো, এখন থেকে তোমার নাম হয়েছে অরণ্য চৌধুরী। আমরা বুনো বলে ডাকব।

কাকাবাবু বললেন, বুনো নামটাও খারাপ নয়। একজন পণ্ডিতের নাম ছিল বুনো রামনাথ।

ছেলেটা এসব কিছুই বুঝল না। সে যেন খুবই বিরক্ত হল।

মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ করে সে দৌড়ে এল বারান্দার কাছে। রেলিংটা ধরে একটা ডিগবাজি খেয়ে লাফিয়ে পড়ল নীচে তারপর দৌড়োল গেটের দিকে।

কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু, ধর, ধর ওকে!

সেকথা শোনার আগেই সন্তু নীচে নামতে শুরু করেছে।

বয়সের তুলনায় ছেলেটা খুব জোরে ছোটে। কিন্তু সন্তুর সঙ্গে পারবে কেন! ফোর ফর্টি মিটার রেসে সন্তু ফার্স্ট হয়।

গেটের কাছে পৌঁছোনোর আগেই ছেলেটাকে ধরে ফেলল সন্তু।

ছেলেটা সন্তুকে আঁচড়ে-কামড়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। সন্তু তার কাঁধটা শক্ত করে ধরে বলল, অ্যাই, কামড়াবি না, তা হলে আমিও মারব কিন্তু!

বারান্দার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, না সন্তু, মারিস না।

ছেলেটা একবার সন্তুকে বেশ জোরে কামড়ে দিতেই সন্তু তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। সে আবার ছুটল পাইপাই করে।

তখনই গেট দিয়ে ঢুকছে মান্টো সিংহ। সন্তু চেঁচিয়ে বলল, মান্টো সিংহ, পাকড়ো উসকো।

মান্টো সিংহ দুহাতে ছেলেটাকে ধরে উঁচু করে তুলে ফেলল। ছেলেটা হাত-পা ছুড়ছে আর ঠিক বাঘের মতোই গ-র-র গ-র-র আওয়াজ করছে। মান্টো সিংহ তাকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এসে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চেপে ধরে রইল।

কাকাবাবু বললেন, এবার ওকে ছেড়ে দাও।

মান্টো সিংহ বলল, ইয়ে ভাগ যায়গা।

জোজো দৌড়ে গিয়ে ডাইনিংরুম থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি বিস্কুট নিয়ে এসে ছেলেটার সামনে বাড়িয়ে দিল।

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বিস্কুটের প্যাকেটটা প্রায় কেড়ে নিয়ে কচমচ করে খেতে লাগল। একটার পর-একটা।

কাকাবাবু বললেন, ওর খিদে পেয়েছিল। মান্টো সিংহ, এক গেলাস দুধ নিয়ে এসো তো!

সন্তু বলল, ও দুপুরে কী খাবে? আমাদের মতো ভাত-রুটি খেতে পারবে?

কাকাবাবু বললেন, আজকেই বোধহয় পারবে না। আস্তে আস্তে অভ্যেস করাতে হবে।

জোজো বলল, ওকে কি কাঁচা মাংস দিতে হবে? ও তো রান্না করা মাছমাংস খায়নি কখনও।

কাকাবাবু বললেন, খুব খিদে পেলে আমরা যা দেব, তাই-ই খাবে।

সন্তু নিজের বুকে একটা আঙুল ঠেকিয়ে বলল, আমি মানুষ।

তারপর ছেলেটির দিকে আঙুল তুলে বলল, তুমি মানুষ! আমরা সবাই মানুষ। তুমি বাঘ নও।

বিস্কুট খেতে খেতে ছেলেটি সন্তুর দিকে তাকিয়ে রইল।

জোজো বলল, বল তো, আমি! আমি! আমি! ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনও শব্দ উচ্চারণ করল না।

জোজো আবার বলল, মানুষ! মানুষ! মানুষ!

মান্টো সিংহ একটা কাচের গেলাস ভরতি দুধ এনে বলল, লে বাচ্চা, পি লে!

ছেলেটা ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল গেলাসটার দিকে। তারপর এক ঝটকায় সেটা ফেলে দিল মান্টো সিংহের হাত থেকে।

গেলাসটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে তো ভাঙলই, খানিকটা দুধ ছিটকে গিয়ে পড়ল কাকাবাবুর প্যান্টে।

মান্টো সিংহ রেগে গিয়ে হাত তুলে বলল, মারে গা এক ঝাঁপড়!

কাকাবাবু বললেন, না, মারবে না। ওকে আস্তে আস্তে শেখাতে হবে।

সন্তু বলল, ও দুধের প্যাকেটও চুরি করত। তা হলে দুধ খেতে চাইছে কেন?

কাকাবাবু বললেন, ও খেয়েছে গুঁড়ো দুধ চেটে চেটে। গেলাস ভরে দুধ তো কখনও দেখেনি। মান্টো সিংহ তোমার কাছে গুঁড়ো দুধ আছে?

মান্টো সিংহ বলল, না, নেই।

কাকাবাবু বললেন, এক প্যাকেট বিস্কুট তো প্রায় শেষ করে ফেলেছে। আপাতত ওকে আর-এক প্যাকেট বিস্কুট দাও।

মান্টো সিংহ বলল, সাহাব, একে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসুন। নইলে একে সামলানো যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, এখন ওকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলে ও আর বাঁচবে। এতদিন বাঘিনিটার সঙ্গে ছিল, বাঘিনিটার ভয়ে অন্য কোনও জানোয়ার ওর ক্ষতি করতে পারেনি। এখন ও তো একটা বাচ্চা ছেলে, একা একা খাবার জোগাড় করবে কী করে?

সন্তু বলল, আমরা ওকে ঠিক সামলাতে পারব। কাকাবাবু, আমরা ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারি না? আমাদের বাড়িতে থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, আগে দেখতে হবে, ওর মা-বাবার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় কি না। ওর মা-বাবা কিংবা কোনও আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাঁদের

অনুমতি ছাড়া তো আমরা ওকে আমাদের কাছে রাখতে পারব না?

জোজো বলল, একজন বুড়ি মহিলা বলেছিলেন যে বড় বাঘটার সঙ্গে একটা বাচ্চা-বাঘ আছে, কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি।

সন্তু বলল, ওর গায়ে একটা বাঘের চামড়া জড়ানো ছিল, সেটা কি ও নিজেই বুদ্ধি করে জড়িয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, ও যদি বাঘের ভাষা শিখে গিয়ে থাকে, তা হলে বাঘিনিটাই বোধ হয় ওকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল।

জোজো বলল, ওর কথা বুঝতে হলে, আমাদেরও কি বাঘের ভাষা শিখতে হবে?

সন্তু বলল, জোজো, তুই সেটা সহজেই পারবি। কয়েকটা দিন চিড়িয়াখানায় গিয়ে একটা বাঘের খাঁচার পাশে বসে থাক।

জোজো বলল, আমি হালুম ডাকটার মানে জানি! জানি, কিন্তু এখন বলব না।

সন্তু বলল, বাঘের ভাষা শেখার আগে আপাতত ওর হাত আর পায়ের নখ কেটে দেওয়া দরকার। আঁচড়ে আমার রক্ত বের করে দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক, এখানে ক্ষৌরকার পাওয়া যাবে মান্টো সিংহ?

মান্টো সিংহ বলল, বাজারের কাছে একটা সেলুন আছে। সেখানে খোঁজ করতে হবে। এখানে ক্ষৌরকার নেই।

জোজো বলল, ওকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে ওর চুলে একটা কলকাত্তাই ছাঁট দিলেও তো হয়।

সন্তু বলল, সেলুনের লোকদের যদি ও আগেই আঁচড়ে-কামড়ে দেয়? আমি নেলকাটার দিয়ে ওর নখ কেটে দিতে পারি। দেখি চেষ্টা করে।

একটা নেলকাটার নিয়ে এসে সন্তু প্রথমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে কুটুস কুটুস করে নিজের এক হাতের নখ কাটল। তারপর ওর দিকে সেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দ্যাখো, মানুষের হাত এরকম হয়। মানুষের অত বড় নখের দরকার হয় না। এবার তোমার হাতটা সুন্দর করে দিই?

ছেলেটা সন্তুর নখ কাটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, সন্তু ওর একটা হাত ধরতে যেতেই ও এক ধাক্কা দিয়ে সন্তুকে সরিয়ে দিল। চেয়ার ছেড়ে আবার দৌড় লাগাল রেলিং-এর দিকে।

কিন্তু এবারে কাকাবাবুই ওকে ধরে ফেললেন হাত বাড়িয়ে।

ছেলেটা কাকাবাবুর ঘাড় কামড়ে ধরল বেশ জোরে।

সন্তু এসে ওর চুল ধরে টেনে সরিয়ে আনল। কাকাবাবুর কাঁধে দাঁতের দাগ বসে গিয়েছে, একটু একটু রক্ত বেরোচ্ছে।

জোজো বলল, এবার ওকে বেশ করে মারা দরকার। ওকে বোঝাতে হবে যে, কামড়ালে ফামড়ালে শাস্তি পেতে হবে ওকে।

কাকাবাবু বললেন, না, মারলে ও বুঝবে না। ভাল ব্যবহার দিয়ে ওর মন জয় করতে হবে।

ঘাড়ে রুমাল চেপে ধরে কাকাবাবু ছেলেটির দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, ওহে অরণ্যকুমার চৌধুরী, তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। মানুষ মানুষকে কামড়ায় না, বুঝলে?

এই সময় দেখা গেল, গেটের সামনে আট-দশজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। মান্টো সিংহ কথা বলছে তাদের সঙ্গে।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, মনে হচ্ছে খবর রটে গিয়েছে। লোকজন দেখতে আসছে ওকে। এখনই লোকজনের সামনে ওকে বের করা ঠিক হবে না। সন্তু, তুই ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যা তো। দরজা বন্ধ করে রাখবি।

সন্তু আর জোজো ছেলেটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে।

এর মধ্যেই খবর ছড়িয়েছে যে, জঙ্গল থেকে আনা হয়েছে একটি ছেলেকে, তার শরীরটা বাঘের মতো আর মাথাটা মানুষের মতো। অর্থাৎ অদ্ভুত একটা জন্তু। সুতরাং তাকে দেখার জন্য তো কৌতূহল হবেই।

লোকগুলো উঠে এল বারান্দায়।

কাকাবাবু প্রথমে ভালভাবে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, তারা ভুল শুনেছে। অদ্ভুত কোনও প্রাণী নয়। সে একেবারেই স্বাভাবিক মানুষের সন্তান। তাকে দেখার কিছু নেই।

লোকরা তা মানতে চায় না। তারা অন্তত একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। সবাই মিলে সেই দাবি জানাতে লাগল।

এবারে কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, সে এখন ঘুমোচ্ছে। তাকে

কিছুতেই বিরক্ত করা চলবে না। দেখতে চাইলে বিকেলবেলা আসুন।

মান্টো সিংহকে তিনি বললেন, বাইরের গেট বন্ধ করে দাও!

আরও অনেক লোক এসে ফিরে গেল।

দুপুরবেলা কাকাবাবু ছেলেটিকে খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের ঘরেই খাবার আনালেন।

কাচের প্লেট ভেঙে ফেলতে পারে, তাই একটা স্টিলের থালায় ওর জন্য সাজিয়ে দেওয়া হল ভাত আর রুটি। খানিকটা তেঁড়স আর বেগুনের তরকারি। মুরগির ঝোলের ঝোলটা বাদ দিয়ে কয়েকটা টুকরো রাখা হল একপাশে।

প্লেটটার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে ছেলেটি এক টুকরো মুরগি তুলে নিয়ে মুখে দিল।

তারপরই মুখোনাকে বিচ্ছিরি করে সেটা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।

জোজো বলল, এই বুনো, এভাবে খাবার ফেলতে নেই। ঘর নোংরা করলে তোকেই পরিষ্কার করতে হবে কিন্তু!

কাকাবাবু বললেন, ওর বোধহয় ঝাল লেগেছে। একটুও ঝাল খাওয়া তো ওর অভ্যেস নেই।

তিনি একটা মুরগির ঠ্যাং নিজের জলের গেলাসে ড়ুবিয়ে ঝোল-মশলা ভাল করে ধুয়ে ফেললেন। তারপর সেটা ছেলেটির থালায় দিয়ে বললেন, এবার এটা খেয়ে দ্যাখো।

সে সেটা নিয়ে দু-তিন কামড় দিল, তবু ঠিক পছন্দ হল না। ফেলে দিল।

সন্তু বলল, সেদ্ধ করা খাবার ওর ভাল লাগছে না। কাঁচা মাংস দিলেই হত।

কাকাবাবু বললেন, না, ওকে এই খাবারই অভ্যেস করতে হবে। আয়, আমরা আমাদের মতো খাই, দেখি ও কী করে?

তিনজনে নিজেদের খাবার খেতে লাগলেন, ও তাকিয়ে দেখল। একটা রুটি নিয়ে দুহাত দিয়ে ছিড়ল, কিন্তু মুখে দিল না। ভাতও আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল শুধু।

শেষ পর্যন্ত কাকাবাবুদের খাওয়া হয়ে গেল, ছেলেটা খেল না কিছুই।

সন্তু বলল, তা হলে কি ওকে শুধু বিস্কুট খাইয়ে রাখতে হবে?

কাকাবাবু বললেন, এখন আর কিছু দেওয়ার দরকার নেই। দেখা যাক, খিদে পেলে শেষ পর্যন্ত কী করে?

ঘণ্টাখানেক পরে ছেলেটি আবার পালাবার চেষ্টা করল। এবার আর তাকে ধরা গেল না।

কাকাবাবু বসে ছিলেন বারান্দায়। সন্তু বাথরুমে, জোজো পাহারা দিচ্ছিল বুনোকে। সে চেয়ারে বসে চোখ বুজে ঢুলছিল। হঠাৎ একসময় সে চোখ মেলে দেখল, জোজো একা রয়েছে ঘরে।

সে এত জোরে ধাক্কা দিল জোজোকে যে, জোজো চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে গেল মাটিতে। দৌড়ে বাইরে এসে, কাকাবাবু বই থেকে চোখ তুলে কিছু বোঝার আগেই সে বারান্দার রেলিং টপকে লাফিয়ে নেমে গেল নীচে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু তিনি তো ছুটতে পারবেন না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই তাঁর অনেক সময় লেগে যায়। তিনি ডাকতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, শিগগির আয়।

সন্তুর বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে যতটা সময় লাগল, ততক্ষণে বুনো পৌঁছে গিয়েছে গেটের কাছে। সন্তু তাড়া করে গিয়ে গেটের বাইরে আর তাকে দেখতে পেল না।

সামনের রাস্তাটা আঁকাবাঁকা। ও কোন দিকে যেতে পারে! জঙ্গলের দিকেই যাবে নিশ্চয়ই।

গেস্টহাউসের কর্মচারীদের কয়েকটা সাইকেল সেখানে দাঁড় করানো আছে। এরা তালাটালা দেয় না। সন্তু ঝট করে একটা সাইকেলে চেপে চালাতে লাগল বাঁইবাঁই করে।

ছেলেটাকে কোথাও দেখা গেল না।

খানিকটা গিয়ে সন্তু থেমে গেল। যত জোরেই ছুটুক, ছেলেটা তো এর মধ্যে এত দূর আসতে পারবে না। তা হলে কি উলটো দিকে গিয়েছে?

অথবা ছেলেটা যদি খাদে নেমে যায়?

রাস্তার একটা পাশে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে অনেকখানি। সেখানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়। দু-একটা বাড়িও আছে। অনেক নীচে একটা সরু নদী, তার ওপাশে অন্য পাহাড়টায় ঘন জঙ্গল। ছেলেটার পক্ষে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে খাদের মধ্য দিয়ে জঙ্গলে যাওয়াই সহজ।

কিন্তু সন্তু তো সাইকেল নিয়ে খাদে নামতে পারবে না।

সন্তু দেখল, জোজোও আর-একটা সাইকেল নিয়ে আসছে।

সে কাছে আসার পর সন্তু বলল, এই দেখ, এই খাদ দিয়ে যদি বুনো নেমে গিয়ে ওধারের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, তা হলে তো পুরো জঙ্গলটা আবার খুঁজে দেখতে হবে।

জোজো বলল, আমরা দুজনে গিয়ে খুঁজলে কি পাব?

সন্তু বলল, কোথাও লুকিয়ে বসে থাকলে পাওয়া মুশকিল।

জোজো হতাশভাবে বলল, আর ওকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। লস্ট কেস। ও তো কিছুতেই আমাদের কাছে থাকতে চাইছে না।

সন্তু জোর দিয়ে বলল, ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। ওইটুকু ছেলে জঙ্গলে একা একা বাঁচবে কী করে? আরও লোকজন ডেকে, গাড়ি নিয়ে আবার ওই জঙ্গলে যেতে হবে।

জোজো বলল, চল, কাকাবাবুকে গিয়ে বলি। এই সময় শোনা গেল একটা কুকুরের ডাক।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্তু দেখতে পেল, খাদের খানিকটা নীচে একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে একটা কুকুর ডাকছে। আর ল্যাজ নাড়াচ্ছে।

জোজো বলল, কুকুরটা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। ঝোপের মধ্যে কী যেন আছে।

সন্তু বলল, কী আছে, আমাদেরও দেখতে হবে।

সাইকেলটা রেখে সে সরসরিয়ে নেমে গেল।

কুকুরটা ঝোপের চারপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে, আর জোরে জোরে ডেকেই চলেছে। বেশ বড় কুকুর।

জোজো বড় সাইজের কুকুর দেখলে একটু ভয় পায়। সন্তুর ভয়ডর নেই। তার নিজেরই একসময় রকুকু নামে পোষা কুকুর ছিল।

সে কুকুরটার পাশে গিয়ে মুখ দিয়ে আঃ আঃ শব্দ করতে করতে ঝোপটার মধ্যে তাকাল।

সেখানে উবু হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে বুনো। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।

সন্তু কুকুরটাকে সামলে, হাত বাড়িয়ে বলল, আয় বুনো, বেরিয়ে আয়।

ছেলেটা তবু বেরোল না।

সন্তু আরও কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আয়, ভয় নেই। ভয় নেই।

ছেলেটা এবার বেরিয়ে আসতেই কুকুরটা আরও জোরে ডাকতে লাগল। ছেলেটা জড়িয়ে ধরল সন্তুকে।

সন্তু বলল, তুই কুকুর দেখে ভয় পাচ্ছিস! এরপর যদি একটা ভাল্লুক এসে পড়ে, তখন তুই কী করবি? তোর বাঘিনি-মা তো তোকে আর বাঁচাতে পারবে না!

ছেলেটাকে ধরে ধরে সন্তু নিয়ে এল উপরের রাস্তায়। কুকুরটা খানিকটা পিছন পিছন এসে এক জায়গায় থেমে গেল। সম্ভবত নীচের কোনও বাড়ির পোষা কুকুর।

জোজো বলল, এবার মনে হচ্ছে ছেলেটাকে বেঁধে রাখতেই হবে। কী রে, আর আমাদের কতবার দৌড় করাবি?

সন্তু বলল, সাইকেলে চাপবি? কোনওদিন চাপিসনি তো। দ্যাখ, কেমন লাগে।

সন্তু তাকে সামনের রডে বসিয়ে দিল। ছেলেটা বিশেষ আপত্তি করল না।

এর মধ্যে কাকাবাবু বারান্দা থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন গেটের কাছে। ওদের দেখে বললেন, পাওয়া গিয়েছে? যাক, খুব চিন্তা হয়েছিল।

জোজো বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, বাঘ-সিংহরা কি হাসতে পারে? কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন? আমি ঠিক জানি না। যত দূর শুনেছি, মানুষই শুধু হাসতে পারে, কাঁদতেও পারে। জন্তু-জানোয়াররা ওসব জানে না। হায়েনার হাসির কথা আবার শোনা যায়। ওটাও হাসি নয়, ওরকমই হায়েনার ডাক।

জোজো বলল, এ ছেলেটা বাঘের সঙ্গে মিশে মিশে হাসতে শোনেনি। সব সময় মুখটা গোমড়া করে থাকে। কিন্তু মানুষের বাচ্চা হিসেবে ওর তো হাসতে পারা উচিত। একবার পরীক্ষা করে দেখব?

কাকাবাবু বললেন, তুমি ওকে হাসাবে? কিন্তু ও তো তোমার গল্প বুঝবে না।

জোজো বলল, সন্তু, ওকে জোর করে চেপে ধর তো।

সন্তু সাইকেল থেকে ছেলেটাকে নামাতেই জোজো ওর বগলে কাতুকুতু দিয়ে দিল।

ছেলেটা প্রথমে ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল।

জোজো আরও কাতুকুতু দিতেই ও হি-হি-হি-হি করে হেসে উঠল। ঠিক একটা দশ বছরের সরল ছেলের মতো। মুখে আর হিংস্র ভাবও নেই।

সেই হাসি দেখে সন্তু আর কাকাবাবুও হাসতে লাগলেন।

সন্তু বলল, বাঘকে কাতুকুতু দিলে হাসে কি না সেটা কি কেউ পরীক্ষা করে দেখেছে?

কাকাবাবু বললেন, আমার এক বন্ধু বলেছিল, গন্ডারকে কাতুকুতু দিলে কী হয়?

গন্ডারের চামড়া তো খুব মোটা। তাই আজ কাতুকুতু দিলে সাতদিন পরে হেসে উঠবে!
এরপর তিনদিন কেটে গিয়েছে। কাকাবাবুদের এবার কলকাতায় ফিরতে হবে।

এর মধ্যে ছেলেটার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আরও দু-তিনবার পালাবার চেষ্টা করেছে বটে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি। এখন ওর একটা হাত দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, সেই দড়ির আর-একটা দিক বাঁধা সন্তুর বাঁ হাতে। সেই দড়ির গিঁট খোলার ক্ষমতা ওর নেই। রাত্তিরেও ওই অবস্থায় শুয়ে থাকে সন্তুর পাশে। দড়িতে টান পড়লেই জেগে ওঠে সন্তু।

দ্বিতীয় দিনেই দু-তিনজন মিলে ওকে জোর করে চেপে ধরেছিল, সন্তু কেটে দিয়েছে ওর হাত-পায়ের লোম। মাথার চুলও হেঁটে দেওয়া হয়েছে। খানিকটা।

তারপর ওকে চান করানো হয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, চান করাবার সময় কিন্তু ও মোটেই আপত্তি করেনি। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে লাফালাফি করেছে অনেকক্ষণ। মনে হয়, আগে দুএকবার ও কোনও ঝরনার জলে মাথা ভিজিয়েছে।

ওর নিজের সাইজের দুসেট প্যান্ট-শার্ট কিনে আনা হয়েছে। সেই সব পরিয়ে, মাথার চুল আঁচড়ে দিলে ওকে ভালই দেখায়। মুখোনা সুন্দর।

কিন্তু এখনও কোনও কথা বলে না। মাঝে মাঝে বাঘের মতো গরগর শব্দ করে। সেরকম শব্দ করলেই জোজো ওকে কাতুকুতু দিয়ে হাসায়।

এদিককার অনেক কাগজে ওর খবর আর ফোটো ছাপা হয়েছে। কেউ ওর। নাম দিয়েছে টাইগার বয়, কেউ বলেছে নয়া মুগলি, কেউ বলেছে বাচ্চা টারজান। খবরের কাগজের লোকেরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্পও লিখেছে ওর নামে। ও নাকি এক গাছের ডগা থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে চলে যেতে পারে, জ্যান্ত ইঁদুর আর খরগোশ ধরে কামড়ে কামড়ে খায়, ওর সারা মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকে। অবিকল বাঘের মতো ডাকতে পারে।

সেসব কিছু না।

সে মোটেই কঁচা মাংস খায় না। একদম ঝাল-মশলা না-দেওয়া রান্না করা মাংস খেতে শিখেছে। ভাত খায় না, কিন্তু রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে শুধু শুধু খায়। কলা খায়। তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার আইসক্রিম। একটা আইসক্রিম খেয়েই আর-একটার জন্য হাত বাড়ায়।

এখনও কেউ তার বাবা কিংবা মা কিংবা আত্মীয় বলে দাবি করেনি।

বাঘিনিটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোপালে। ঘুম ভাঙার পর সে কিছুক্ষণ খুব জোরে ডাকাডাকি করেছিল। নিশ্চয়ই খুঁজছিল ছেলেটাকে,

তারপর ঝিমিয়ে পড়েছে। সব সময় ঘুম ঘুম ভাব।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বাঘিনিটাকে দূরের কোনও জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। বনের প্রাণী বনেই থাকবে।

কিন্তু বনবিভাগের বড় বড় অফিসার ওকে পরীক্ষা করে দেখে বলেছেন যে, বাঘিনিটা এতই বুড়ি হয়ে গিয়েছে যে, জঙ্গলে গেলে আর বেশিদিন বাঁচবে না। অন্য প্রাণী শিকার করার ক্ষমতা নেই, তাই এখন মানুষ মারার চেষ্টা করবে। আদিবাসীদের সামনে পড়লে তারা ওকে মেরে ফেলতে পারে অনায়াসে। তার চেয়ে চিড়িয়াখানায় আদরযত্ন করলে ও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে।

ছেলেটা থাকবে কোথায়? কাকাবাবু ওকে অনাথআশ্রমে পাঠাবার ঘোর বিরোধী। এর মধ্যে দুটো অনাথআশ্রম জানিয়েও দিয়েছে যে, তারা জায়গা দিতে পারবে না।

কাকাবাবু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু আইন-কানুনের কিছু ঝামেলা আছে।

সুলতান আলমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল। তিনি বললেন, আপনি ওর দায়িত্ব নিতে চান, সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু ওর কোনও আত্মীয় খোঁজখবর করে কি না, তার জন্য অন্তত দিনদশেক সময় দেওয়া দরকার।

কাকাবাবু বললেন, দশদিন ওকে কোথায় রাখবেন? আমাদের তো কাল ফিরতেই হবে। সন্তু আর জোজোর কলেজ খুলে যাচ্ছে।

সুলতান বললেন, তা হলে কয়েকটা দিন ওকে থানাতেই রেখে দিতে হবে। আর তো কোনও উপায় দেখছি না।

কাকাবাবু বললেন, ওইটুকু ছেলে, থানায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে থাকবে? তারাই তো ওকে নষ্ট করে দেবে।

সুলতান বললেন, না, ক্রিমিনালদের সঙ্গে অত কমবয়সি ছেলেকে রাখা যায় না। সেটা বেআইনি। অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতেই হবে।

কাকাবাবু বললেন, যেখানেই রাখুন, সব সময় ওর দিকে মনোযোগ না দিলে ও তো আবার জঙ্গলে পালিয়ে যাবে। আপনার পুলিশ কি ওর খোঁজ করবে? তাদের কী দায় পড়েছে!

সুলতান বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন রায়চৌধুরীসাহেব। ও পালিয়ে গেলে পুলিশ আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তা হলে কী করা যায় বলুন তো?

কাকাবাবু বললেন, আমি বরং ওকে সঙ্গে নিয়ে যাই। সন্তু আর জোজোর সঙ্গে ওর অনেকটা ভাব হয়ে গিয়েছে। ওরা ছেলেটার দেখাশুনো করবে। এর মধ্যে কেউ যদি এসে ছেলেটাকে দাবি করে, ঠিক প্রমাণট্রমান দেখায়, আমি নিজের খরচে কলকাতা থেকে ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব। আমার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি। আপনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সে আমাকে চেনে। তার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে জানতে পারবেন।

সুলতান বললেন, কী বলছেন রায়চৌধুরীসাহেব, আমি এর মধ্যে সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে দেখা করে আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। আপনি তো গ্রেট ম্যান। আপনি আন্দামানে সবুজ দ্বীপের রাজাকে আবিষ্কার করেছিলেন না? আপনি এ ছেলেটির ভার নিতে চাইছেন, এটাও তো একটা খুব বড় কথা। ঠিক আছে, আপনি ওকে নিয়ে যান। আমি লোকাল পুলিশকে বলে দিচ্ছি, কাল সকালেই আপনাদের ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে। গাড়ির ব্যবস্থাও ওরাই করবে।

সন্তু আর জোজো পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল। ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এর মধ্যেই ছেলেটার উপর ওদের মায়া পড়ে গিয়েছে। ওকে রেখে চলে যেতে হবে ভেবে ওদের মন খারাপ করছিল।

সন্ধেবেলা বুনোকে আইসক্রিম খাওয়াতে খাওয়াতে ওরা দুজন ওকে কথা বলাবার চেষ্টা করছে, বারান্দায় বসে। কাকাবাবু একটু দূরে একটা ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছেন।

এখনও পর্যন্ত বুনো একটাও কথা বলেনি। কিন্তু চোখ বড় বড় করে শোনে।

সন্তু নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, এটা আমি আর তুমি। তারপর ওর বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, এটাও আমি। আর এদিকে তুমি।

জোজো বলল, ম্যায় আউর তুম!

সন্তু বলল, এটা বাড়ি। আর ওটা জঙ্গল।

জোজো বলল, ইয়ে কোঠি। আর উয়ো, জঙ্গল, জঙ্গল। অ্যাই সন্তু, জঙ্গলের হিন্দি কী রে?

সন্তু বলল, হিন্দিতেও জঙ্গল। ইংরেজিতেও তো জাঙ্গল!

জোজো বলল, এখন ইংরেজি শেখানোর দরকার নেই।

সন্তু বলল, আমি বাড়ি যাব। আমি জঙ্গলে যাব না।

জোজো বলল, আমি রুটি খাব। কাচা মাংস খাব না।

সন্তু বলল, আমি আইসক্রিম ভালবাসি।

জোজো বলল, অ্যাই সন্তু, আইসক্রিমের বাংলা কী?

সন্তু বলল, এই রে, আইসক্রিমের বাংলা তো জানি না। মালাই বরফ কি বলা যেতে পারে?

জোজো বলল, সেটা তো অন্যরকম।

সন্তু বলল, ওসব কথা এখন থাক। আইসক্রিমকে আইসক্রিম বললেই চলবে। বুনো, আমি মানুষ, তুমি মানুষ!

এইরকমভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ।

তারপর দেখা গেল, সিঁড়ি দিয়ে তিনজন লোক উঠে আসছে উপরের বারান্দায়।

তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার রায়চৌধুরী হ্যায়?

সন্তু কাকাবাবুকে দেখিয়ে দিল।

সেই লোকটি হাতজোড় করে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমার নাম মোহনকুমার, আমি এখানকার থানার ওসি। আর এঁরা দুজন সুরজ সিংহ আর তাঁর সেক্রেটারি বিলাস রাও।

কাকাবাবু বললেন, বসুন, বসুন।

মোহনকুমার বললেন, এঁরা দুজন জঙ্গলের ছেলেটিকে নিতে এসেছেন। সুরজ সিংহ এই ছেলেটির কাকা।

সুরজ সিংহ জোজোর দিকে তাকিয়ে গদগদভাবে বললেন, আও মেরে লাল, মেরে পাশ মে আও!

তিনি দুহাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন জোজোকে।

জোজো কুঁকড়ে গিয়ে বলল, আমি না, আমি না। এ।

সন্তু বলল, আগেই ওর গায়ে হাত দেবেন না। ও কিন্তু কামড়ে দিতে পারে।

এবার সুরজ সিংহই ঘাবড়ে গিয়ে দূরে সরে গেলেন। তার বিশাল চেহারা, ঝলমলে পোশাকপরা, মাথায় পাগড়ি। আর সেক্রেটারিটি সরু ও লম্বা, পায়জামা আর কুর্তা পরা।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওর কাকা হন? ওর বাবা, মা?

সুরজ সিংহ বললেন, আমার বড় ভাই বেঁচে নেই। এই ছেলেটির মা, আমার ভাবী, বেঁচে আছেন। ছেলের শোক তিনি আজও ভুলতে পারেননি। কাগজে ওর ফোটো দেখেই চিনতে পেরেছেন। খুব কান্নাকাটি করছেন।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি হারিয়ে গিয়েছিল কতদিন আগে?

সুরজ সিংহ বললেন, সাত বরষ আগে। তখন ওর বয়স ছিল তিন বছর। এই দেখুন, ফোটো।

তিনি লম্বা জামার পকেট থেকে একটা ফোটো বের করে দেখালেন। একটা বাচ্চার অস্পষ্ট ফোটো। তিন বছরের ছেলের সঙ্গে দশ বছরের ছেলের চেহারার মিল অনেক সময় বোঝাই যায় না। তখন ওর মাথায় চুলই ছিল না বলতে গেলে, এখন মাথা ভরতি চুল।

সুরজ সিংহ বললেন, ওর নাম ছিল বলবীর। বলবীর সিংহ।

তিনি ডাকলেন, বলবীর, বলবীর! ইধার দেখো!

বুনো তা গ্রাহ্যও করল না।

কাকাবাবু বললেন, এই সাত বছরে ও সব কিছু ভুলে গিয়েছে! ছেলেটি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল কী করে?

সুরজ সিংহ বললেন, আর বলবেন না, সে বড় লজ্জার কথা। আমাদের বাড়ি ইন্দৌর। জয়েন্ট ফ্যামিলি, বাপ-কাকা-জ্যাঠাদের ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চোদ্দোজন। সে বছর ছেলেমেয়েরা সবাই গেল পিকনিক করতে। বলবীর তখন খুবই ছোট, কিন্তু আমার মেয়ে লছমি ওকে খুবই ভালবাসে। সে নিয়ে গেল জোর করে। গিয়েছিল এক জঙ্গলে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ইন্দৌর জঙ্গল আছে?

সুরজ সিংহ বললেন, শহর থেকে কিছুটা দূরে, ছোটখাটো জঙ্গল, সেখানে কোনও হিংস্র জন্তু থাকার কথা নয়, মাঝে মাঝে দু-একটা ভালুক দেখা যায়, তা অত মানুষ থাকলে ভালুক কী করবে? বাচ্চা ছেলে বলবীর ছিল খুব দুরন্ত, দৌড়োদৌড়ি করে চলে যেত এদিক-সেদিক। ওখানেও খেলা করছিল। আর সবাই ফুর্তি করছিল, হঠাৎ শোনা গেল এক বাঘের গর্জন। খুব কাছে। বাঘের ডাক শুনলে কী হয় জানেন তো? অন্যদের কথা মনে থাকে না, সবাই নিজের জান বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা সবাই দৌড় মেরে একটা মিনিবাস ছিল, তাতে উঠে পড়ল। ড্রাইভারও বাস চালিয়ে দিল জোরে। অনেকটা যাওয়ার পর খেয়াল হল, আর সবাই উঠেছে, শুধু বলবীর নেই। তখন আমার মেয়ে কাঁদতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, আপনার মেয়ের কত বয়স ছিল?

সুরজ সিংহ বললেন, চৌদ্দো বছর। এ জন্য আমার মেয়েকে অনেক মেরেছি। সে ভেবেছিল, রণবীর নামে একটা বড় ছেলে ছিল, সে নিশ্চয়ই ছোট্ট বলবীরকে তুলে নেবে। যাই হোক, সে ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগল। বাসের ড্রাইভারটি ছিল সাহসী, সে বলল, চলো ফিরে যাই! ফিরে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি হল। বাঘের চিহ্ন নেই, বাচ্চাটাও নেই। পাশে একটা ছোট নদী ছিল, সেখানেও দেখা হল, কিন্তু বাচ্চাটার আর কোনও খোঁজ মিলল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, ছেলেটাকে বাঘেই মেরে ফেলেছে। এখন বুঝতে পারছি, বাঘে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মারেনি। এরকম অদ্ভুত ব্যাপারও ঘটে। তবে বাঘটাকে ধন্যবাদ। সে আমাদের বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আপনাকেও ধন্যবাদ।

কাকাবাবু বললেন, আমি বিশেষ কিছু করিনি। এখানে একজন কর্নেলসাহেব আছেন। তিনিই সার্চপার্টির ব্যবস্থা করেছেন। ঠিক সময়ে বাঘিনিটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন।

সুরজ সিংহ বললেন, আর দেরি করতে পারব না! বাচ্চাটাকে তা হলে নিয়ে যাই?

কাকাবাবু বললেন, আজই নিয়ে যাবেন?

সুরজ সিংহ বললেন, আমার ভাবী খুবই উতলা হয়ে আছেন আর কাঁদছেন। তিনি খুবই অসুস্থ, বেশিদিন বাঁচবেন না।

কাকাবাবু বললেন, ও তো আপনাদের কাউকে এখন চিনবে না। তাই বলছিলাম, দু-একদিন আপনি এখানে থাকুন, একটু ওর সঙ্গে ভাব করে নিন।

সুরজ সিংহ বললেন, আমার তো অত সময় নেই। নিজের ব্যাবসার কাজ ফেলে এসেছি। তা ছাড়া ও আমাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু নিজের মাকে দেখে ঠিক চিনবে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মাকে কখনও ভোলে না।

কাকাবাবু চুপ করে গেলেন।

বুনো এতক্ষণ সন্তু আর জোজোর মাঝখানে বসে ছিল। এত কথা সে কিছুই বোঝেনি। এবার সে উঠে চলে যেতে লাগল ঘরের মধ্যে। সন্তুও উঠে দাঁড়াল।

সুরজ সিংহ বললেন, বলবীর, অন্দর মাত যাও। ইধার আও। মেরা পাস আও।

বুনো তবু তা শুনল না।

সুরজ সিংহের সেক্রেটারিটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন, একটুও নড়াচড়া করেননি। এবার তিনি লাফিয়ে উঠে বুনোর ঘাড়টা চেপে ধরলেন।

বুনো সঙ্গে সঙ্গে কামড়ে দিল তার অন্য হাত। তিনি উঃ করে উঠলেন।

কাকাবাবু তাকালেন পুলিশ অফিসারের দিকে।

তিনি বললেন, স্যার, আমাদের উপর অর্ডার আছে, এর বাড়ির লোক নিতে চাইলে তাদের হাতে দিয়ে দিতে হবে। আমরা দায়িত্ব নিতে পারব না। এই লেড়কা, চল।

তিনি কাছে যেতেই বুনো তার দিকেও হিংস্রভাবে তাকাল।

মোহনকুমার ঠাস করে এক চড় কষালেন তার গালে। এবারে সেক্রেটারিটিও বুনোর অন্য গালে এক চড় কষিয়ে দিলেন।

কাকাবাবু বলে উঠলেন, এ কী, মারছেন কেন? মারছেন কেন?

মোহনকুমার বললেন, কামড়াতে আসছে, মারব না! দুষ্টু ছেলেদের না মারলে তারা কথা শোনে না।

কাকাবাবু বললেন, মোটেই তা নয়। ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। একটু একটু করে শেখাতে হবে।

সুরজ সিংহ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না রায়চৌধুরীসাহেব। আমরা ওর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করব। এতদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে। ওর অত ভাইবোন ওকে এত আদর করবে, তাতেই ও ভুলে যাবে।

মোহনকুমার একটা হাতকড়া বের করে আটকে দিলেন বুনোর দুহাতে। সন্তু ওর দড়ির বাঁধনটা খুলে দিল।

মোহনকুমার ওর হাতকড়াটা ধরে টেনে বললেন, চল এবার!

বুনো শক্তভাবে দাঁড়িয়ে বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠল।

সেক্রেটারি তাকে ঠেলতে লাগলেন পিছন থেকে। বুনো কিছুতেই যাবে। পুলিশ অফিসারটি জোর করে টানতে টানতে নামাতে লাগলেন বারান্দা থেকে। ঠিক যেন একটা চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা বাচ্চা চোর।

বুনোর চিৎকার শুনে গেস্টহাউসের সব কর্মচারী আর অন্য ঘরের লোকরাও বেরিয়ে এসে উঁকি মেরে দেখছে।

বলির পাঁঠাকে দড়ি বেঁধে হাড়িকাঠের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার সময় সে যেমন চাচায়, বুনোও সেরকম চ্যাঁচাচ্ছে।

গেটের বাইরে একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে বুনোকে তুলে অন্য সবাই উঠে পড়ল। শোনা গেল গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কাকাবাবু আর জোজো-সন্তু। একটুক্ষণ তিনজনেই চুপ।

একটু পরে সন্তু বলল, কাকাবাবু, বুনোকে ওইভাবে জোর করে ধরে নিয়ে গেল…।

কাকাবাবু বললেন, কী আর করা যাবে, বল? ওর বাড়ির লোক যদি নিয়ে যেতে চায়? আমরা তো বাধা দিতে পারি না।

সন্তু বলল, লোকগুলো খুব নিষ্ঠুর। যদি ওকে আরও মারে?

কাকাবাবু বললেন, কিছু লোক আছে এরকম, ছোটদের গায়ে হাত তোলে। অন্যভাবেও যে শিক্ষা দেওয়া যায়, তা বোঝে না। তবে, ওর অনেক ভাইবোন, তাদের মাঝে গিয়ে পড়লে ওর নিশ্চয়ই ভালই হবে। আর জঙ্গলে পালাতে পারবে না।

সন্তু বলল, ইন্দৌর অনেক দূর। সেখান থেকে বাঘিনিটা এখানে এসেছে, মাঝখানে তো জঙ্গল নেই, তবু কারও চোখে পড়ল না?

কাকাবাবু বললেন, অনেক কিছুরই এখনও ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। বাঘেরা এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। রাত্তিরের দিকে ফাঁকা মাঠঘাঠ, নদী, ফসলের খেত দিয়েও আসে। ছেলেটাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। তবু কারও চোখে পড়েনি। সেটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! তবে, বাঘিনিটা যদি বুড়ি না হয়ে যেত, তা হলে এবারেও বোধ হয় অত সহজে ধরা দিত না।

একটুক্ষণ আবার সবাই চুপ।

এবারে জোজো বলল, আচ্ছা সন্তু, ওই বুনোর কাকাটা প্রথমে আমাকেই বুনো ভেবে জড়িয়ে ধরতে এসেছিল কেন বল তো? আমাকে কি দেখে মনে হয় জংলি ছেলে?

সন্তু বলল, শুধু তাই নয়। তোকে ভেবেছিল দশ বছরের বাচ্চা!

জোজো বলল, ধ্যাত!

কাকাবাবু বললেন,কালকের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করতে হবে। আর তো আমাদের এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। পুলিশও আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করবে না। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নাও।

কাকাবাবু মান্টো সিংহকে ডাকতে লাগলেন।

জোজো বলল, যাই বলুন আর তাই বলুন, ছেলেটার উপর বেশ মায়া পড়ে গিয়েছিল। প্রায় ভাব হয়ে গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। মনটা খুব খারাপ লাগছে।

সন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
খানিক পরে এসে পৌঁছোলেন কর্নেল। তাঁর হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। বারান্দায় উঠে টেবিলের উপর রাখলেন সেটা।

কাকাবাবু আবার বই নিয়ে বসেছেন, মুখ তুলে বললেন, আসুন, কর্নেল।

কর্নেল বললেন, বাড়ি থেকে মান দোপিঁয়াজা বানিয়ে এনেছি। একটুও ঝাল নেই। দেখতে হবে, ছেলেটা খেতে পারে কি না। সে কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, সে তো নেই।

কর্নেল বললেন, নেই মানে? আবার পালিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না, পালায়নি। গত দুদিন সে আর পালাবার চেষ্টা করেনি। কিছুক্ষণ আগে ওকে নিয়ে চলে গেল।

কর্নেল এবার দারুণ অবাক হয়ে বললেন, নিয়ে চলে গেল? কে?

কাকাবাবু বললেন, ওর কাকা। খবরের কাগজে ওর ফোটো দেখে চলে এসেছেন ইন্দোর থেকে। ও তিন বছর বয়সে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, এল আর নিয়ে চলে গেল? ছেলেটা কি ওর কাকাকে চিনতে পেরেছিল?

কাকাবাবু বললেন, না, তা চিনবে কী করে? ছেলেটা সহজে যেতেও চায়নি।

কর্নেল বললেন, তা তো হবেই। ভদ্রলোককে বললেন না কেন, দু- তিনদিন এখানে থেকে ধীরেসুস্থে ওকে বুঝিয়ে তারপর নিয়ে গেলেই হত।

কাকাবাবু বললেন, আমি সেটা বলেছিলাম। ইনি বললেন, ওঁর সময় নেই, ব্যাবসার কাজ আছে।

জোজো আর সন্তুও কর্নেলের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।

জোজো বলল, দেখুন না, ওকে কীরকম বিচ্ছিরিভাবে টানতে টানতে নিয়ে গেল, হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে।

কর্নেল বললেন, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে? কেন? ও কি ক্রিমিনাল নাকি?

সন্তু বলল, দু-তিনজন মিলে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে গিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আপনি যদি দেখতেন সে দৃশ্য। ছেলেটা শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে বাচ্চা বাঘের মতোই হুংকার দিচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, আমি থাকলে ওকে যেতে দিতামই না।

কাকাবাবু হেসে বললেন, কী করতেন? ওর নিজের কাকা নিতে এসেছে। মা কান্নাকাটি করছে। আপনি আটকে রাখতেন কোন অধিকারে। সঙ্গে পুলিশও ছিল। পুলিশের উপর তো কথা বলা যায় না।

কর্নেল বললেন, পুলিশ অফিসারের নাম কী?

কাকাবাবু বললেন, মোহনকুমার। তবে, ওর কাকাকে মনে হল ভাল লোক। তবে আমি বলেছি, দেখবেন, ছেলেটার সঙ্গে যেন কেউ খারাপ ব্যবহার না করে। উনি বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। মাকে দেখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তা তো হতেই পারে।

একটুক্ষণ গুম হয়ে থেকে কর্নেল বললেন, সন্তু, জোজো, তোমরাই মাংসটা খাও। একটু কাঁচালঙ্কার ঝাল মিশিয়ে নিতে পারো।

তারপর তিনি কাকাবাবুকে বললেন, রায়চৌধুরীসাহেব, কাল তা হলে আমরা সকালবেলা বেরিয়ে পড়ি? এই দশটা আন্দাজ, কী বলেন?

কাকাবাবু বললেন, কাল সকালে? কোথায় যাব?

কর্নেল বললেন, বাঘ-গুহার ছবিটবি দেখতে যাব। আগেই তো সেরকম কথা ছিল। মাঝখানে এই সব ঝাটের জন্য যাওয়া হল না। এখন ঘুরে আসা যাক।

কাকাবাবু বললেন, সে আর হবে না। কাল সকালেই আমরা ফিরে যাচ্ছি।

কর্নেল বেশ আশ্চর্য হয়ে বললেন, কাল সকালেই ফিরে যাবেন? সে কী? কেন, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। না, না, কাল আপনাদের যাওয়া হবে না।

কাকাবাবু বললেন, কর্নেল, আর দেরি করা যাবে না। গাড়ি ঠিক করে ফেলেছি, সকাল সাড়ে দশটায় রওনা হব।

কর্নেল বললেন, আপনি না হয় বাঘ-গুহা দেখেছেন, কিন্তু অমন চমৎকার জায়গা এই ছেলে দুটো দেখবে না?

কাকাবাবু বললেন, এই ছেলে দুটোর কলেজ খুলে যাচ্ছে। আমার নিজেরও কিছু কাজ আছে।

কর্নেল বললেন, আপনার আবার কাজকী? আপনাকে তো অফিসটফিসে যেতে হয় না?

কাকাবাবু এবার হেসে বললেন, যারা অফিসে যায় না, তারা বুঝি কেউ কোনও কাজ করে না? আমার কিছু কিছু কাজ থাকেই।

কর্নেল বললেন, হা, কাজ থাকে, আবার তার থেকে ছুটিও বের করা যায়। আর ওদের কলেজ, দু-চারদিন ফাঁকি দিলে এমন কিছু ক্ষতি হয় না। আমরাও কলেজ জীবনে এরকম ফাঁকি দিয়েছি। কী, তোমরা বাঘ-গুহা দেখতে চাও না?

সন্তু আর জোজো কিছু বলল না। কাকাবাবু যা বলবেন, তার উপরে তো ওরা কোনও কথা বলতে পারে না!

কাকাবাবু বললেন, ওরা পরে আবার আসবে। তখন নিজেরা সব কিছু ঘুরে দেখবে। এবারের মতো বেড়ানো শেষ।

কর্নেল বললেন, আশপাশে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। আমি ঠিক করেছিলাম, আপনাদের নিয়ে ঘুরব। আমি সব ভাল চিনি, আমার চেয়ে ভাল করে আর কেউ দেখাতে পারবে না। এমনকী ভাবছিলাম, একবার ইন্দৌরও ঘুরে আসব। ওই ছেলেটার বাড়িটাও দেখে আসা হবে। মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ছেলেটা কী করল, মাকেও চিনতে পারল কি না, তা জানতে আপনাদের ইচ্ছে করে না?

কাকাবাবু বললেন, আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? বাড়ির লোক নিয়ে গিয়েছে, ও ছেলে নিশ্চয়ই আস্তে আস্তে মানিয়ে নেবে নিজেকে।

আমাদের মতো বাইরের লোকের আর নাক গলানো উচিত নয়।

হঠাৎ খুব তেড়ে বৃষ্টি এসে গেল। পাহাড়ি জায়গায় যেমন হয়। এত জোর বৃষ্টির ছাঁট যে, বারান্দায় আর বসা যাবে না।

সবাই উঠে গেলেন ঘরের মধ্যে।

কর্নেলসাহেব আরও কিছুক্ষণ ধরে কাকাবাবুকে আর কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে যেতে লাগলেন। কিন্তু কাকাবাবু অনড়।

কিছুক্ষণ অন্য গল্পও হল, তারপর কর্নেল বিদায় নিলেন বৃষ্টির মধ্যেই।

তারপরেই মান্টো সিংহ এসে কাকাবাবুদের ডাকল খাবারের ঘরে যাওয়ার জন্য।

আজই এই গেস্টহাউসে কিছু নতুন লোক এসেছে, তাদের মধ্যে অবশ্য বাঙালি কেউ নেই। তাদের মধ্যেও কয়েকজন কাকাবাবুর কাছে টাইগার বয়ের কথা জানতে চাইল। কিন্তু তাঁর আজ গল্প করার মুড নেই।

খাওয়ার পর নিজেদের ঘরে ফিরে এসে কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোদের সুটকেস গুছিয়ে নে। কাল সকালের জন্য ফেলে রাখিস না। আমরা চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। রাস্তায় কোথাও ব্রেকফাস্ট খাব।

সারা ঘরেই জিনিসপত্র ছড়ানো।

বড় ঘরটায় একটা খাটে কাকাবাবু, অন্য খাটে জোজো আর সন্তু। এর মধ্যে কয়েক দিন বুনো ছেলেটি শুয়েছে সন্তুর সঙ্গে, আর জোজো গিয়েছে। কাকাবাবুর খাটে। বুনো অনেক জিনিস এদিক-সেদিক ছুড়ে দিত। যেসব জিনিস সে আগে কখনও দেখেনি, যেমন ঘড়ি, টর্চ, সাবান এইসব সে হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকে দেখেছে, তারপর ফেলে দিয়েছে।

একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিয়ো থেকে হঠাৎ মানুষের গলা শুনে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার একটা প্যান্ট আর শার্ট পড়ে আছে খাটের নীচে।

সন্তু আর জোজো টপাটপ সব তুলে ভরতে লাগল দুটো সুটকেসে।

প্রায় সবই তোলা হয়ে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, হারে জোজো, সেই হিরের আংটিটা কোথায় গেল? সেটা তো দেখছি না?

জোজো বলল, সেটা তো একটা ভেলভেটের বাক্সে ছিল এখানে এই টেবিলের উপরে। দুপুরেও দেখেছি। তারপর তুই রাখিসনি?

সন্তু বলল, না তো?

জোজো বলল, তা হলে কাকাবাবু বোধহয় কোথাও সরিয়ে রেখেছেন। সন্তু বাইরের বারান্দায় এসে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কি হিরের আংটিটা আছে?

কাকাবাবু বই থেকে চোখ তুলে বললেন, উঁহু।

সন্তু বলল, সেটা কোথাও পাচ্ছি না।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, কোথায় আবার যাবে? ভাল করে খুঁজে দ্যাখ।

এরপর আবার দুজনে মিলে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কোথাও সে আংটি নেই। এ ঘরের বাইরে তো সেটা কখনও নিয়ে যাওয়া হয়নি।

তা হলে কি চুরি?

তা ছাড়া আর অন্য কিছু তো ভাবা যাচ্ছে না। এবার কাকাবাবুকে আবার বলতেই হল।

কাকাবাবু একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। ঘরের মধ্যে এসে চারদিক তাকিয়ে বললেন, পাওয়া যাচ্ছে না? অন্য কেউ নিয়েছে নিশ্চয়ই।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কে নিতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, তা তো বলা মুশকিল। আমরা তো বাইরে বেরোবার সময় দরজায় তালা দিই না। যে কেউ এসে নিয়ে যেতে পারে। আমাদেরই জিনিসটা সাবধানে রাখা উচিত ছিল। যাকে-তাকে সন্দেহ করা আমি পছন্দ করি না। ধরে নাও হারিয়েই গিয়েছে।

তবু একটু পরে মান্টো সিংহ ঘরে জলের বোতল দিতে এলে, জোজো জিজ্ঞেস করে ফেলল, মান্টো সিংহ, হিরের আংটি দেখা? হিয়া পর থা।

মান্টো সিংহ বলল, নেহি তো! নেহি দেখা।

জোজো বলল, একটা ভেলভেটের বাক্সে ছিল, কেউ নিয়ে গিয়েছে।

মান্টো সিংহ বলল, ওই জঙ্গল কা লেড়কা, ও নিয়ে যায়নি তো?

কাকাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,যাঃ, বাজে কথা বোলো না। ও ছেলেটা আংটির কিছুই বোঝে না। টাকাও চেনে না। ও কেন নিতে যাবে? গিয়েছে, গিয়েছে, ওই আংটির কথা ভুলে যাও!

কাকাবাবু ও বিষয়ে আর কাউকে কোনও কথাই বলতে দিলেন না।

পরদিন সকালবেলা চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হয়ে নিল সন্তু আর জোজো। সুটকেস বন্ধ করা হয়ে গিয়েছে। তবু মন খুঁতখুঁত করছে ওদের দুজনের। আবার খুঁজে দেখল সব জায়গায়। কোথাও নেই সেই আংটি।

খানিক পরেই এসে গেলেন কর্নেল। বললেন, আপনাদের বিদায় জানাতে এলাম। আপনারা দেখছি একদম রেডি।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, রেডি। একটু পরেই ভাড়ার গাড়ি এসে যাবে।

কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, আপনাদের সেই দামি আংটিটা চুরি গিয়েছে শুনলাম?

কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, হা, কিন্তু আপনি তা জানলেন কী করে?

কর্নেল বললেন, গেটের কাছেই মান্টো সিংহ বলল আমাকে। ও লোকটি খুব বিশ্বাসী, ও চুরি করবে না।

কাকাবাবু বললেন, ওকে আমরা সন্দেহও করিনি।

কর্নেল বললেন, তা হলে কাকে সন্দেহ হয়?

কাকাবাবু বললেন,কাউকেই না। ওইটুকু একটা ছোট্ট জিনিস, কেউ নিয়ে লুকিয়ে রাখলে খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। শুধু শুধু কাউকে সন্দেহ করার তো কোনও মানে হয় না।

কর্নেল বললেন, আপনি কত বড় বড় রহস্যের সমাধান করেছেন। আর এই সামান্য একটা আংটি-চোরকে ধরতে পারবেন না?

কাকাবাবু হেসে বললেন, সামান্য বলেই পারব না। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। চোর ধরা আমার কাজ নয়।

কর্নেল বললেন, তা হলে আমিই চেষ্টা করি। ডিটেকটিভ গল্পে পড়েছি, যাদের একেবারেই সন্দেহ করা যায় না, তাদের মধ্যে একজন কেউ কালপ্রিট হয়। সেইভাবে শুরু করা যাক। প্রথমেই ধরা যাক আপনি, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনাকে সন্দেহ করার কোনও উপায়ই নেই, কারণ আংটিটা আপনারই। নিজের জিনিস কেউ চুরি করে না। কী বলো, সন্তু?

সন্তু একটু হাসল।

কর্নেল বললেন, সন্তুকেও সন্দেহ করা যায় না, কারণ আংটিটা ওকেই। দেওয়ার কথা। ও কেন চুরি করবে শুধু শুধু। তবে, জোজো, তাকে সন্দেহ করা যেতে পারে। সে ইচ্ছে করলে, মানে, তার পক্ষেই আংটিটা নেওয়া সবচেয়ে সুবিধেজনক।

জোজো ফস করে রেগে উঠে বলল, কী, আপনি আমাকে আংটি-চোর বলছেন? আমাদের বাড়িতে ওরকম কত আংটি আছে আপনি জানেন? কত রাজা-মহারাজারা এসে আমার বাবাকে উপহার দেন। হিরের আংটি, মুক্তোর আংটি, চুনি-পান্নার আংটি। আমাদের বাথরুমেও ওসব আংটি গড়াগড়ি যায়।

কর্নেল বললেন, তোমাদের বাড়িতে অনেক আংটি, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বাথরুমে আংটি গড়াগড়ি যায় কেন?

জোজো বলল, আমার মা নতুন নতুন আংটি পরেন। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে আংটি খুলে রাখেন, আর পরে নিতে ভুলে যান। ওগুলো সেখানেই পড়ে থাকে।

কর্নেল বললেন, ও।

জোজো এবার আঙুল তুলে বলল, আপনাকেও সন্দেহ করা যেতে পারে। আপনিও আমাদের ঘরে এসে বসেছিলেন।

কর্নেল বললেন, এটা ঠিক বলেছ। খুব বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। আমাকে তো সন্দেহ করা যেতেই পারে। আমি তো ইচ্ছে করলেই আংটিটা টপ করে পকেটে ভরে নিতে পারতাম!

তিনি নিজের হাতটা কোটের পকেটে ভরলেন। তারপর ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে হাতটা আবার বের করে বললেন, এই দ্যাখো! আমিই নিয়েছিলাম। কেন বলো তো?

সন্তু অস্ফুটভাবে বলল, ক্রিপটোম্যানিয়াক!

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, না, না, ক্রিপটোম্যানিয়াক মানে তো যারা কোনও দরকার না থাকলেও গোপনে অন্যের জিনিস নিয়ে নেয়, আমি তা নই! আমি আংটিও পরি না। এটা নিয়েছিলাম, যাতে তোমাদের আরও দু-তিনদিন এখানে আটকে রাখা যায়। কাল অত করে অনুরোধ করলাম, তোমাদের কাকাবাবু কিছুতেই থাকতে রাজি হলেন না। ভেবেছিলাম, এরকম একটা দামি জিনিস হারালে নিশ্চয়ই অনেক খোঁজাখুঁজি করবেন, পুলিশে খবর দেবেন। এমনকী, বুনো ছেলেটাকে সন্দেহ করলে ইন্দৌরও যেতে রাজি হতে পারেন। এখন তো দেখছি, ইনি একজন মহাপুরুষ! এক লাখ-দেড় লাখ টাকা দামের একটা জিনিস হারিয়ে গেল কিংবা চুরি হল, তাও উনি গ্রাহ্যই করলেন না? পুলিশে খবর দিলেন না?

কাকাবাবু হেসে বললেন, মহাপুরুষ টহাপুরুষ কিছু নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে আমি জানি, আংটি চুরি গেলে পুলিশ কোনও দিনই তা খুঁজে দিতে পারে না। শুধু শুধু আর এখানে বসে থেকে লাভ কী? আর, ওই বুনোকে আমি কিছুতেই সন্দেহ করতাম না। যে কথা বলতে পারে না, অর্থাৎ মিথ্যে কথাও শেখেনি। যারা মিথ্যে কথা বলতে শেখে না, তারা চুরিও করে না।

কর্নেল বললেন, তা বোধহয় ঠিক। যাই হোক, চলেই যখন যাচ্ছেন, আপনাকে দু-একটা খবর দিই। কাল আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে আমি একবার থানায় গিয়েছিলাম। মোহনকুমার লোকটা ভাল নয়, ঘুষটুষ খায়। যাই হোক, ওর কাছ থেকে আমি সুরজ সিংহের ঠিকানা নিয়ে নিলাম। কারণ, ওই বুনো ছেলেটা কেমন থাকেটাকে, তা আমার একবার দেখে আসার ইচ্ছে আছে। ইন্দৌরের পুলিশ কমিশনার সুজনপ্রসাদ আমার বিশেষ বন্ধু। কাল রাত্তিরেই তাকে ফোন করে বললাম, সে যেন ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে একটু খোঁজখবর নেয়। প্রথম প্রথম কিছু প্রবলেম তো হতেই পারে, পুলিশ যদি সাহায্য করে…।

কাকাবাবু বললেন, এটা আপনি ভালই করেছেন।

কর্নেল বললেন, আজ সকালেই সুজন প্রসাদের ফোন পেয়েছি। সে বলল, ইন্দৌর শহরে সুরজ সিংহ নামে কোনও ব্যবসায়ী নেই, যে ঠিকানা সে দিয়ে গিয়েছে, ওই নামে ইন্দৌর কোনও রাস্তা নেই। সবটাই মিথ্যে।

জোজো বলল, ও মা, তা হলে ওরা বুনোকে কোথায় নিয়ে গেল? কর্নেল বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, ও লোকটা বুনোর কাকা নয়।

জোজো বলল, আমারও একবার তাই মনে হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন,যাঃ! ওই বয়সের কত গরিবের ছেলে রাস্তায় থাকে, ভাল করে খেতে পায় না, কেউ কি তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়? তবে এই ছেলেটার জন্য কেন একজন লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এত দূর ছুটে আসবে? হয়তো ঠিক ইন্দৌর নয়, কাছাকাছি অন্য কোনও শহরে ওদের বাড়ি।

কর্নেল বললেন, সুরজ সিংহ আপনাকে কোনও কার্ড দিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না। আমিও চাইনি। পুলিশের কাছেই তো ঠিকানা রেখে গিয়েছে। আপনার বন্ধু সুজনপ্রসাদকে আবার খোঁজ নিতে বলুন।

সন্তু বলল,দমদম কিংবা বরানগরে যারা থাকে, তারাও তো বাইরে এসে বলে, কলকাতায় থাকি। সেইরকম সুরজ সিংহরাও বোধহয় ইন্দোরের আশপাশে কোথাও…।

কর্নেল বললেন, অত তাড়াহুড়ো করে ছেলেটাকে নিয়ে গেল, ইন্দৌর ঠিকানাটা মিলছে না, তাই কীরকম যেন রহস্যজনক লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, সব কিছুর মধ্যে এমন রহস্য খুঁজে লাভ নেই। ছেলেটা ভালই থাকবে আশা করি। আমাদের তো এর বেশি আর কিছু করার নেই। চল রে সন্তু। এবার আমাদের বেরোতে হবে।

কর্নেল বললেন, আপনাদের কিন্তু আবার এখানে আসতে হবে। অনেক কিছুই তো দেখা হল না।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। দেখা যাক, আবার কবে হয়। আপনি কলকাতায় গেলে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবেন। তখন অনেক গল্প হবে।

কর্নেল একে একে সন্তু আর জোজোকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। তারপর কাকাবাবুর হাত ধরে বললেন, আবার দেখা হবে। ভাল থাকবেন?
কলেজ থেকে ফিরে সন্তু দেখল, কাকাবাবুর ঘরে দুজন ফরসা বিদেশি বসে আছেন, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা।

নিশ্চয়ই কোনও দেশ থেকে কাকাবাবুকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। এরকম আজকাল আসছে অনেকেই। কাকাবাবু সহজে যেতে চান না। বিদেশে তাঁর থাকতে ইচ্ছে করে না বেশি দিন।

সন্তুর আজ ব্যাডমিন্টন কম্পিটিশনের খেলা আছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছটার সময়। সে একটু পরেই বেরিয়ে গেল।

সে ফেরার পর কাকাবাবু তাকে ডেকে বললেন, কী রে, তোর খেলার রেজাল্ট কী হল?

সন্তু বলল, জিতেছি। এবার সেমিফাইনাল। পরশু দিন আবার খেলা।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেমিফাইনালে কার সঙ্গে খেলতে হবে?

সন্তু বলল, একটি জাপানি ছেলে। জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, জাপানিরা ব্যাক-হ্যান্ডে খুব ভাল খেলে। কাল একটু প্র্যাক্টিস করে নে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আজ বিকেলে যে সাহেবরা এসেছিল, তারা কোন দেশের?

কাকাবাবু বললেন, নিউজিল্যান্ডের। ওদের মধ্যে একজন আমার অনেক দিনের চেনা। এবার মনে হচ্ছে একবার যেতেই হবে। কয়েকবার যাব বলে যেতে পারিনি। ওখানে একটা দ্বীপে মাঝে মাঝেই রাত্তিরবেলা আলো জ্বলে ওঠে। নীল রঙের, বেশ জোরালো আলো। কিন্তু সে দ্বীপে কোনও বাড়িঘর নেই। মানুষ থাকে না। জাহাজ থেকে আলোটা দেখা যায়। অথচ জাহাজ থেকে সে দ্বীপে নেমে খুঁজলেও সে আলোর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। ফিরে গিয়ে জাহাজে উঠলেই আবার দেখা যায় সেই আলো। ওরা দেশবিদেশ থেকে বেশ কয়েকজনকে ডাকছে, ব্যাপারটা দেখে যদি রহস্য উদ্ধার করা যায়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কবে যেতে হবে তোমাকে?

কাকাবাবু বললেন, আর দিন দশেকের মধ্যে।

সন্তু অমনই আবদারের সুরে বলল, আমি যেতে পারি না? শুনেছি নিউজিল্যান্ড খুব সুন্দর দেশ।

কাকাবাবু বললেন, আহা! তোর এখন কলেজ খোলা, তা ছাড়া খেলা চলছে, তুই যাবি কী করে?

সন্তু আরও কিছু বলতে গেল, এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোন। কাকাবাবু ইঙ্গিত করলেন সন্তুকে ফোনটা ধরার জন্য।

সন্তু ফোন তুলে গলা শুনে বলল, কর্নেলকাকা? কেমন আছেন?

মা থেকে ফিরে আসার পর এক মাস কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝেই ফোন করেন কর্নেল। কাকাবাবুর সঙ্গে গল্প হয়।

এখন তিনি বললেন, সন্তু? শোনো, বাঙালিদের সঙ্গে ফোনে কিংবা দেখা হলে প্রথম কথাই হচ্ছে, কেমন আছেন, তাই না? উত্তরে বলতে হয়, ভাল আছি। কিন্তু আমি আজ তা বলতে পারছি না। আমি ভাল নেই।

সন্তু বলল, কেন, কী হয়েছে?

কর্নেল বললেন, আমাকে বাঘে কামড়েছে!

সন্তু বলল, আঁ! কী বলছেন, আবার ওখানে বাঘ বেরিয়েছে?

কর্নেল এবার হাসতে হাসতে বললেন, না! সেরকম কিছু না। আমার পা ভেঙে গিয়েছে। আমি এখন শয্যাশায়ী।

সন্তু কাকাবাবুকে বলল, কর্নেলকাকার পা ভেঙে গিয়েছে।

ফোনটা সে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।

কাকাবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কী ব্যাপার কর্নেলসাহেব, পা ভাঙল কী করে?

কর্নেল বললেন, সন্তুকে এমনই ভয় দেখাচ্ছিলাম। এমন কিছু হয়নি। যাকে বলে শুকনো ডাঙায় আছাড়। সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম, পায়ে রবারের চটি, এক পায়ের চটি হঠাৎ খুলে গেল, সেটাকে ধরতে গিয়ে গড়িয়ে গেলাম। একেবারে নীচে। এক পায়ে ফ্র্যাকচার, অন্য পায়েও বেশ লেগেছে। এখন একেবারে শয্যাশায়ী। আপনার মতো ক্র্যাচ বগলে নিয়ে কোনওরকমে বাথরুমে যেতে পারি। তাও নার্স রাখতে হয়েছে। এখন একমাস বাড়িতে বন্দি।

কাকাবাবু বললেন, ইস, দুটো পায়েই লেগেছে!

কর্নেল বললেন, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। কী আর করা যাবে। যে-কোনও লোকেরই হতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, কী আর বলব? সাবধানে থাকবেন। বেশি নড়াচড়া করবেন না।

কর্নেল বললেন, শুনুন, আমার অ্যাকসিডেন্টের খবর দেওয়ার জন্য আপনাকে ফোন করিনি। আর-একটা খবর দিতে চাই। সেই সুরজ সিংহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সে মোটেই বুনোর কাকা নয়। সে একটা সার্কাসের মালিক। সে বুনোকে দিয়ে তার সার্কাসে বাঘের খেলা দেখাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, আঁ! ওইটুকু ছেলেকে দিয়ে সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে?

কর্নেল বললেন, এবার বুঝতে পারছেন, অন্য গরিবের ছেলে কিংবা রাস্তার ছেলের সঙ্গে বুনোর কী তফাত? সে বাঘকে ভয় পায় না? সেই জন্যই ওই সুরজ সিংহ অত দূর থেকে এসে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়েছে। এখন নিজের কাজে লাগাচ্ছে। আরও খবর পেয়েছি যে, ওর সার্কাসে যে লোকটা বাঘের খেলা দেখাত, সে হঠাৎ মারা গিয়েছে। বাঘের খেলা না দেখালে সার্কাসে টিকিট বিক্রি হয় না, তাই ও বুনোকে সেই কাজে লাগাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু অতটুকু ছেলেকে কাজে লাগানো তো বেআইনি। সার্কাসে বাঘ-সিংহের খেলা দেখানোও এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

কর্নেল বললেন, ওসব আইনটাইন শহরে মানা হয়। গ্রামের দিকে কেউ ওসব গ্রাহ্য করে না। কত বাচ্চাকে মারধর করে এখনও খাটানো হয়। শুনুন স্যার, খবরটা আপনাকে দিলাম, কিন্তু আপনি এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। আপনি আর অত দূর থেকে কী করবেন? আমি একটু সেরে উঠি, তারপর ওই সুরজ সিংহ ব্যাটাকে ধরব। তখন কী হয়, আপনাকে আবার জানাব।

কাকাবাবু বললেন, কোথায় সার্কাস দেখাচ্ছে, আপনি জানেন?

কর্নেল বললেন, তাও জানি। চিত্রকূটে। সেটা কোথায় আপনি জানেন?

কাকাবাবু বললেন, মোটামুটি ধারণা আছে।

কর্নেল বললেন, যাই হোক, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি সেরে উঠেই ওই সুরজ সিংহের গলা টিপে ধরব।

কাকাবাবু বললেন, আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।

টেলিফোনটা রেখে দিয়ে কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। সন্তু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাঁর মুখের দিকে।

কাকাবাবু বললেন, বুনোর কী হয়েছে তুই শুনলি?

সন্তু বলল, ওকে দিয়ে সার্কাসের কাজ করাচ্ছে?

কাকাবাবু বললেন,হ্যাঁ। কাজটা খুবই অন্যায়। কিন্তু আমরা কী করে দায়িত্ব নেব বল? তা ছাড়া এখন এত কাজ, আমি যে বইটা লিখছি, সেটা শেষ করার জন্য তাড়া দিচ্ছে, এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড যেতে হবে…।

সন্তু চুপ করে রইল।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের দায়িত্ব নেই ঠিকই, তবু মনটা কেমন কেমন করছে।

সন্তু বলল, আমার খুবই খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে দেখি। কাকাবাবু, চলো না যাই চিত্রকূটে?

কাকাবাবু বললেন, আমি যদি বা কাজ ফেলে যেতে পারি, তুই যাবি কী করে? তোর খেলা, কলেজ।

সন্তু বলল, পরেও অনেক খেলা যাবে। কলেজেও কয়েক দিন না গেলে কিছু হবে না। শনি-রবি তো ছুটিই। এটা একটা ছেলের জীবনের ব্যাপার। যদি কিছু করা যায়…!

কাকাবাবু বললেন, চল, তা হলে। জোজোকে কিছু জানাবার দরকার আছে?

সন্তু বলল, একেবারে কিছু না জানিয়ে গেলে ও দুঃখ পাবে। ওকে ফোন করে দেখি।

সন্তু ফোন নিয়ে বসল। কাকাবাবু মধ্যপ্রদেশের একটা ম্যাপ নিয়ে দেখতে লাগলেন।

পরদিনই ওরা তিনজন প্লেনে চেপে চলে এলেন গ্বালিয়র। রাত্তিরটা একটা হোটেলে থেকে, পরদিন একটা গাড়ি ভাড়া করে যাত্রা শুরু হল।

দিনটা সুন্দর, আকাশে পাতলা-পাতলা মেঘ, গরম কমে এসেছে। এদিককার রাস্তাও ভাল।

কিছুদূর যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা যে চিত্রকূটে যাচ্ছি, সেটাই কি রামায়ণের চিত্রকূট?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, রামায়ণে চিত্রকূটের সুন্দর বর্ণনা আছে। চিত্রকূট পাহাড় আর জঙ্গল, এখানেই নাকি রাম-সীতা-লক্ষ্মণ থেকেছেন অনেক দিন। তলায় মন্দাকিনী নদী। তবে রামায়ণের সময়কার মতো অমন শান্ত, সুন্দর জায়গা আর এখন নেই। পাশেই শহর হয়ে গিয়েছে। রেলস্টেশনও হয়ে গিয়েছে।

জোজো বলল, নিশ্চয়ই অনেক লোকজনও আছে। নইলে আর সার্কাস চলবে কী করে?

কাকাবাবু বললেন, এরকম এক-এক জায়গায় তিন-চারদিন সার্কাস চলে, তারপর তাঁবু গুটিয়ে আর-একটা শহরে চলে যায়। এখান থেকেও চলে গিয়েছে কি না দেখতে হবে খোঁজ নিয়ে।

চিত্রকূট রেলস্টেশনের কাছে পৌঁছে দেখা গেল সার্কাসের বিরাট বিজ্ঞাপন।

তলায় লেখা, আজই শেষ দিন।

সন্ধে হয়ে এসেছে।

কাকাবাবু বললেন, চলো, আগেই সার্কাস দেখে আসি। থাকার জায়গা পরে ঠিক করব।

ড্রাইভারকে যেতে বললেন সার্কাসের ময়দানে।

বেশ মস্ত বড় তাঁবু। চারদিকে আলো ঝলমল করছে। ভিতরে বাজনা বাজছে খুব জোরে।

গেটের কাছে গিয়ে জানা গেল, খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে আধঘণ্টা আগে।

কাকাবাবু বললেন, তাতে ক্ষতি নেই। বাঘের খেলা শেষের দিকেই হয়।

টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লেন তিনজন।

তখন চলছে একজন ক্লাউনের খেলা।

তারপর চারটে ঘোড়া দৌড়োল, তাদের পিঠের উপর দাঁড়িয়ে দুজন পুরুষ আর দুজন মেয়ে। এরও পরে ট্র্যাপিজের খেলা, বাঁদরের খেলা।

একটু পরে স্টেজটা একেবারে খালি হয়ে গেল। তারপরই দুমদুম করে খুব জোরে বেজে উঠল ড্রাম। ভা-পো-পোঁ করে বিউগল। বোঝাই গেল, এবার বিশেষ কেউ আসছে।

একটা চাকা লাগানো বিরাট খাঁচা। ঘরঘর শব্দে সেটাকে পিছন থেকে ঠেলে নিয়ে এল তিনজন লোক। তারপর উপর থেকে তার টেনে খুলে দেওয়া হল সেই খাঁচার দরজা।

ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বাঘ। বেশ বড়।

তার পা দুটো মোটা শিকল দিয়ে বাঁধা।

বাঘকে নিয়ে খেলা দেখার কেউ নেই। উইংসের পাশ থেকে একটা লোক একটা লম্বা চাবুক দিয়ে বাঘটাকে মারতে লাগল। সেই চাবুকটায় শব্দ হতে লাগল চটাস-চটাস করে।

সেই চাবুকটা লাগছে আর বাঘটা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। চলতেই লাগল এরকম।

জোজো ফিসফিস করে বলল, বাঘটাকে শুধু শুধু এরকম কষ্ট দিচ্ছে। কেন?

সন্তু বলল, কষ্ট না দিলে বাঘটা আওয়াজ করবে না, তাতে লোকে ভয়ও পাবে না।

কাকাবাবু বললেন, জন্তু-জানোয়ারদের কষ্ট দিয়ে এরকম খেলা দেখানো এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

একটু পরে আরও একটা নিষ্ঠুর ব্যাপার শুরু হল।

উইংসের পাশ থেকেই একটা গামলাভরতি মাংস ঠেলে দেওয়া হল বাঘটার সামনে। সেই গামলার একটা আংটায় দড়ি বাঁধা।

বাঘটা যেই মাংসে মুখ দিতে আসছে, অমনি সেটা টেনে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরকম চলল পাঁচ-ছবার।

অর্থাৎ বাঘটা চাবুক খেয়ে রেগে আছে। তার উপর সামনে মাংস দেখেও খেতে পারছে না। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই। রাগে সে অনবরত গরগর করছে।

এই সময় উপর থেকে দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হল একটা ছেলেকে। তারও পা-দুটো বাঁধা, হাতদুটো খোলা।

দর্শকরা সবাই ভয়ের আওয়াজ করে উঠল। ক্ষুধার্ত, রাগী বাঘটা নিশ্চয়ই ওকে এবার খাবে।

ছেলেটাকে উপর থেকে নামানোর সময় বাঘটা একটা জোর হুংকার দিয়েছে। ছেলেটা তার কাছে নামার পর সে একটা থাবা তুলেও থেমে গেল। তারপর মুখটা উপরের দিকে তুলে একটা অদ্ভুত অন্যরকম আওয়াজ বের করল।

জোজো বলল, এই তো আমাদের বুনো।

ছেলেটার গায়ে একটা কটকটে লাল রঙের জামা আর একটা সবুজ হাফপ্যান্ট। গলায় একটা ঘণ্টা বাঁধা। এদিক-ওদিক মুখ ফেরালেই টুং টাং শব্দ হচ্ছে।

বাঘটা ছেলেটার গায়ের গন্ধ শুকতে এলে সে যেন কী বলে উঠল। বাঘটাও শব্দ করল দুবার। ঠিক যেন কথা বলছে দুজনে।

কয়েকবার সেরকম কথা বলার পর বাঘটা বুনোর পিঠে মাথা ঘষে আদর করল একটুখানি। তারপর ঢুকে গেল খাঁচার মধ্যে।

সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগল। সে হাততালি আর থামতেই চায় না।

একটা বাঘ মানুষকে আদর করছে। এই দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে? মানুষ আর বাঘ কথা বলছে, এরকম কেউ কখনও শুনেছে?

কাকাবাবুর মুখোনা রাগে গনগন করছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর দেখার দরকার নেই। চল বাইরে।

বাইরে এসে তিনি একজন লোককে জিজ্ঞেস করলেন, মালিক কোথায় আছে?

লোকটি হাত তুলে পিছনের একটা ছোট তাঁবু দেখিয়ে দিল।

সেই তাঁবুর সামনে একজন লোক পাহারা দিচ্ছে। সে হাত তুলে বলল, কাঁহা যাতা?

কাকাবাবু বললেন, মালিকের সঙ্গে কথা বলব। এখনই।

লোকটি বলল, এখন দেখা হবে না। মালিক ঘুমোচ্ছেন।

কাকাবাবু বললেন, ডেকে তোলে। এই অসময়ে ঘুমোবে কেন?

লোকটি তবু বাধা দিতে গেলে, কাকাবাবু একটা ক্র্যাচ তুলে তার বুকে ঠেকিয়ে বললেন, হঠ যাও!

সেই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দেখা গেল, সত্যিই একটা ইজিচেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে বিশাল চেহারার সুরজ সিংহ। মেঘের মতো নাক ডাকছে।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে ডাকলেন, সুরজ সিংহ, উঠুন।

তাতেই লোকটির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে প্রথমে তিনি খুবই অবাক হলেন। তারপর উঠে বসে বললেন, রায়চৌধুরীসাব, আইয়ে, আইয়ে। সার্কাস দেখতে এসেছেন? কেমন লাগল?

কাকাবাবু বললেন, খুব খারাপ!

সুরজ সিংহ একগাল হেসে বললেন, আপনার ভাল লাগেনি, এই লেড়কা দুজনের নিশ্চয়ই ভাল লেগেছে। এরকম বাঘের খেলা আর কোথায় পাবেন?

সন্তু আর জোজো চুপ করে রইল।

কাকাবাবু আবার বললেন, ওইটুকু ছেলেকে দিয়ে আপনি খেলা দেখাচ্ছেন, সেটা অন্যায়। সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানোই এখন বেআইনি। আপনাকে এ জন্য শাস্তি পেতে হবে। আপনি এ ছেলেটার কাকা নন। আপনি মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ছেলেটিকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন। কেউ

আমাকে মিথ্যে কথা বলে ঠকালে আমি তা সহ্য করতে পারি না।

সুরজ সিংহ বললেন, আরে বসুন, বসুন। অত রাগারাগি করছেন কেন? আমি ছেলেটির কাকা নই, আপনিই বা ওর কে? কেউ নন, আপনারও কোনও রাইট নেই। আমি বরং ছেলেটাকে চাকরি দিয়েছি, এখানে খেতেপরতে পাবে, এতে দোষ কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, দশ বছরের ছেলের চাকরি? তাও হাত-পা বেঁধে? ওই বয়সের ছেলে এখন লেখাপড়া শিখবে, আর পাঁচটা ছেলের মতন খেলাধুলো করবে। তারপর আঠেরো বছর বয়স হলে ও বাঘের খেলা দেখাবে না কি অন্য কাজ করবে, তা ও নিজে ঠিক করবে। ওকে জোর করে আটকে রাখার কোনও অধিকার নেই আপনার। ছেলেটাকে ফেরত দিন।

টেবিল থেকে একটা মোটা খাম তুলে নিয়ে কাকাবাবুর দিকে ছুড়ে দিয়ে সুরজ সিংহ বললেন, এতে বিশ হাজার রুপিয়া আছে। এটা নিয়ে চুপচাপ চলে যান। কেন ঝামেলা করছেন? ও ছেলেকে আমি ফেরত দেব না, আমার সার্কাস কানা হয়ে যাবে।

কাকাবাবু এবার আরও দপ করে জ্বলে উঠলেন। দুপা এগিয়ে গিয়ে বললেন, কী, আমাকে ঘুষ দেবার চেষ্টা? সুরজ সিংহ, তুমি আমাকে চেনো না। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আমি এখনই তোমার এই সার্কাসের তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি।

খামটা তুলে তিনি ছুড়ে মারলেন সুরজ সিংহের মুখে। তাতেও না থেমে তিনি বাঁ-হাতের উলটো পিঠ দিয়ে তাকে এক জোর থাপ্পড় কষালেন। তারপর বললেন, ছোট ছেলেদের যারা কষ্ট দেয়, তারা কি মানুষ? তাদের আমি সহ্য করতে পারি না। তোমার নিজের ছেলেমেয়ে নেই?

সুরজ সিংহ বললেন, ওসব বড় বড় কথা ঢের শুনেছি। বাঙ্গালিবাবু, তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ, তুমি এখান থেকে জিন্দা বেরোতে পারবে না। তোমাকে মেরে বালিতে পুঁতে দেব? কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি?

তাঁবুর এক কোণে একটা রাইফেল দাঁড় করানো। সুরজ সিংহ সেটার দিকে হাত বাড়িয়েও ধরতে পারলেন না। কাকাবাবু তার আগেই পকেট থেকে রিভলভার বের করে তার হাতের তালু ফুটো করে দিলেন।

যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে সুরজ সিংহ চেঁচিয়ে ডাকলেন, জগদীশ, কাদের, জলদি ইধার আও!

সন্তু তড়াক করে টেবিলটা ডিঙিয়ে গিয়ে রাইফেলটা তুলে নিল। তার নলটা সুরজ সিংহের বুকে ঠেকিয়ে ধরল।

জোজো বলল, ও কিন্তু সত্যি রাইফেল চালাতে জানে।

দুজন গুন্ডামতো লোক ডান্ডা হাতে নিয়ে ঢুকে এল ভিতরে।

কাকাবাবু তাদের দিকে ফিরে বললেন, ওসব ডান্ডাফান্ডা ফেলে দাও। আমি যা বলছি শোনো। বাচ্চা ছেলেটিকে দিয়ে বাঘের খেলা দেখিয়ে তোমাদের মালিক অন্যায় করেছে। আমরা তাকে নিয়ে যাব। তোমরা মেনে নাও। আর যদি বাধা দিতে চাও, তোমাদের মালিকও মরবে, তোমাদেরও দু-চারজন মরতে পারে। এ ব্যাপারে আমার কোনও দয়ামায়া নেই!

যে লোকটি গালে রং মেখে ক্লাউনের খেলা দেখাচ্ছিল, সে এবার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। ওই বাচ্চাটাকে দেখে আমাদেরও কষ্ট হয়। ওকে আফিম খাইয়ে রাখে। এই জগদীশ, এই কাদের, হাতিয়ার ফেলে দে।

সার্কাস শেষ হয়ে গিয়েছে। গুলির আওয়াজ শুনে আরও কয়েকজন খেলোয়াড় উঁকিঝুঁকি মারছিল। এবার তারাও কয়েকজন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাচ্চাটাকে ফেরত দেওয়াই উচিত। অত ছোট ছেলেকে দিয়ে খেলা দেখাতে তাদেরও খারাপ লাগে।

এরপর সব ব্যাপারটাই সহজ হয়ে গেল। ওরাই বুনোকে ধরে-ধরে এনে তুলে দিল গাড়িতে। সে কখনও ঝিমোচ্ছে। কী ঘটছে তা বুঝতেই পারছে না। আফিম খাওয়ানোর কথাটা তা হলে সত্যি।

সে রাত্রেই ফিরে আসা হল গ্বালিয়র হোটেলে।

সকালেও বুনোর ঘুম ভাঙতে চায় না। সন্তু আর জোজো ঠেলা দিয়ে দিয়ে তাকে জাগাল।

সে চোখ মেলে অবাকভাবে দেখতে লাগল হোটেলের ঘর। ওদের দুজনকে। বোঝা গেল, চিনতে পেরেছে, খুশিও হয়েছে। কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই।

জোজো বলল, আইসক্রিম খাবি? কলকাতায় যাবি?

সন্তু বলল, কলকাতায় প্রথম শহর দেখবে। অত বড় বড় বাড়ি। ও কতটা ঘাবড়ে যাবে কে জানে!

জোজো বলল, তার আগে তো প্লেনে চাপবে। আকাশে উড়বে। ওর কেমন লাগবে?

জোজো বুনোর দিকে তাকিয়ে বলল, কী রে, প্লেনে চাপবি? এই দ্যাখ, এইভাবে…?

দুহাত মেলে জোজো প্লেন ওড়ার ভঙ্গি করে ঘুরতে লাগল ঘরময়।

কাকাবাবুও তৈরি হয়ে নিয়েছেন। ফোনে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছে।

এইসময় বেজে উঠল সন্তুর মোবাইল ফোন। কর্নেলের গলা।

তিনি বললেন, সন্তু, কনগ্রাচুলেশন!অপারেশন চিত্রকূট সাকসেসফুল। আমি কাল রাত্তিরেই খবর পেয়ে গিয়েছি। আমার ঠিক মনে হয়েছিল, তোমার কাকাবাবু এরকম খবর শুনে স্থির থাকতে পারবেন না। ঠিক ছুটে আসবেন।

কাকাবাবু ঠিক তখনই হোটেলের অফিসঘরে গিয়েছেন।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, ওঁর সঙ্গে আমি পরে কথা বলব। তোমাদের আর-একটা কথা বলি। সেই বাঘিনিটাকে এখন থালিয়ার চিড়িয়াখানায় ট্রান্সফার করা হয়েছে। ওখানে একটা খাঁচা খালি ছিল। তোমরা বুনোকে যদি কলকাতায় নিয়ে যাও, তা হলে যাওয়ার আগে একবার বাঘিনিটাকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো।

কাকাবাবু সেকথা শুনে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে। একদম তৈরি হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব, এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে ঘুরে যাব চিড়িয়াখানা। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

সকাল সাড়ে নটায় চিড়িয়াখানা সবেমাত্র খুলেছে, এর মধ্যেই এসে গিয়েছে বেশ কিছু মানুষ। ওঁরা তিনজন ভিতরে ঢোকার পরই বুনো সোজা ছুটে গেল বাঘের খাঁচাগুলোর দিকে। কী করে ও চিনল কে জানে।

পর পর তিনটে বাঘের খাঁচা। যে-খাঁচাটায় বাঘিনিটা আছে, বুনো গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানকার তারের জালে।

তারপর একটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড শুরু হল। বাঘিনিটা জাল ধরে দাঁড়িয়ে উঠে হাঁক হাঁক করে ডাকতে লাগল, আর বুনোও চাচাতে লাগল তারস্বরে।

সব লোক ছুটে এল সেই দৃশ্য দেখতে। চিড়িয়াখানার ম্যানেজারও এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

কাকাবাবু তাঁকে সব বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এ ঘটনা শুনেছি বটে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন আর ছেলে, তাই না?

মিনিট দশেক এরকম চলার পরই বাঘিনিটা হঠাৎ ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। আর নড়াচড়া নেই।

কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, এ কী, মরে গেল নাকি? আমরা এলাম, আর আজই মরে গেল?

ম্যানেজার বললেন, না, মরেনি। আগেও এরকম কয়েকবার হয়েছে। বাঘিনিটা খুবই অসুস্থ, বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না, কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায়।

বাঘিনিটা নিস্তব্ধ, বুনোও সেখানে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়।

কাছেই চেয়ার-টেবিল পাতা, কাকাবাবু সেখানে বসলেন, কফি খাওয়ালেন ম্যানেজারবাবু। এরকমভাবে কেটে গেল আধঘণ্টা।

কাকাবাবু জোজোকে বললেন, আর তো দেরি করা যাবে না। আজকের ফ্লাইট ছেড়ে দেবে। এবার বুনোকে ডাক।

সন্তু জোজোর কাছে এসে বলল, চল বুনো, এবার আমাদের যেতে হবে।

বুনো শক্ত করে চেপে ধরে রইল জালটা।

জোজো বলল, কী রে, বাড়ি যাবি না আমাদের সঙ্গে? বুনো মুখও ফেরাল না। কয়েকবার টানাটানি করেও তাকে জাল থেকে ছাড়ানো গেল না।

কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, ও যদি যেতে না চায়, আমি জোর করে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নই। যতদিন বাঘিনিটা বেঁচে থাকবে, ও হয়তো এখানেই থাকতে চাইবে।

ম্যানেজার বললেন, থাকতে চায়, থাক। না, না, ওকে দিয়ে কাজ করাব না। এমনি থাকবে।

কাকাবাবু জোজোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে চল, আর তো কিছু করার নেই! গাড়ির দিকে এগোনো যাক।

একেবারে গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখা গেল, ছুটতে ছুটতে আসছে বুনো। সন্তুর পাশে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি! একটু থেমে বলল, বাড়ি। আবার বলল, যাবে। একসঙ্গে বলল, আমি বাড়ি যাবে! আমি বাড়ি যাবে? সেই সঙ্গে কাঁদতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, ও কথা বলছে! তার চেয়েও বড় কথা, ও কাঁদছে। ঠিক মানুষের মতো!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত