কলকাতার জঙ্গলে

কলকাতার জঙ্গলে

কাকাবাবু, তোমাকে একটা মেয়ে ডাকছে।

কাকাবাবু দোতলায় নিজের ঘরে বসে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কী একটা খুব পুরনো ম্যাপ দেখছিলেন মন দিয়ে। ম্যাপ দেখা কাকাবাবুর শখ, সময় পেলেই ম্যাপ নিয়ে বসেন। ম্যাপের আঁকাবাঁকা রেখার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থেকে উনি কী যে রস পান কে জানে! কয়েকদিন আগে সন্তুর ছোটমামা লন্ডন থেকে দু-তিনশো বছরের পুরনো কতকগুলো ম্যাপ এনে কাকাবাবুকে দিয়েছেন।

সন্তুর কথা শুনে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু, খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট। এই সময়ে সে খেলতে যায়। তার গলার আওয়াজে একটু বিরক্ত-বিরক্ত ভাব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে একটা মেয়ে ডাকছে? কে? কোথা থেকে এসেছে?

সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, একটা বাচ্চা মেয়ে। আগে কোনওদিন দেখিনি!

কাকাবাবু এবারে হেসে বললেন, একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে খুঁজবে কেন? কে পাঠিয়েছে, কী দরকার, এসব জিজ্ঞেস করিাসনি?

জিজ্ঞেস করলুম তো। আমাকে কিছু বলবে না। তোমাকেই নাকি ওর দরকার। বলে দেব যে, দেখা হবে না?

তুই মেয়েটিকে একটু স্টাডি করিসনি? কেন এসেছে বুঝতে পারলি না?

আমার কথার কোনও উত্তরই দিতে চায় না। কী রকম যেন রাগী-রাগী চোখ!

ঠিক আছে, ওপরে নিয়ে আয় আমার কাছে।

সন্তু মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে এল। কাকাবাবুর ঘরের কাছে তাকে পৌঁছে দিয়েই সে চলে গেল খেলতে।ক

সন্তু যাকে বাচ্চা মেয়ে বলেছে, সে আসলে প্ৰায় সন্তুরই বয়েসি। হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা একটা গাঢ় নীল রঙের স্কার্ট পরা, গায়ের রং খুব ফস নয়, কালোও নয়, চোখে আরশোলা-রঙের ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল খোলা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে কাকাবাবুর দিকে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, কী, এসো, ভেতরে এসো?

মেয়েটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আপনিই কাকাবাবু?

হ্যাঁ, আমি সন্তুর কাকাবাবু। তুমি কোথা থেকে এসেছ?

আপনিই গত বছর ইজিপ্টে গিয়েছিলেন? পিরামিডের মধ্যে ঢুকেছিলেন?

হাঁ!

ছবিতে আপনাকে অন্যরকমভাবে আঁকে। একটা ছবিতে আপনার গোঁফ ছিল না। এখন তো দেখছি আপনার মোটা গোঁফ।

তখন বোধহয় গোঁফ কামিয়ে ফেলেছিলাম।

আপনি এর পর কোথায় যাচ্ছেন?

কেন বলো তো, ঠিক নেই কিছু।

তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

এবার কাকাবাবুর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে, তা বেশ তো! কিন্তু তার আগে তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হোক। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কি কথা হয়? তুমি এসে বোসে। তোমার নাম কী?

মেয়েটি পায়ের জুতো খুলে রাখল। দরজার কাছে। তারপর কাকাবাবুর সামনের একটি চেয়ারে বসে বলল, আমার নাম দেবলীনা দত্ত। ব্যস, ওইটুকুই যথেষ্ট, আমার বাবা-মায়ের নাম কিংবা আমি কোথায় থাকি, সে-সব জিজ্ঞেস করবেন না, তার কোনও দরকার নেই!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ বেশ, তুমিই তোমার পরিচয়। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে বাইরে যাও, তা হলে তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি লাগবে না?

আমার মা নেই, আমার বাবা আমার কোনও কাজে বাধা দেন না। মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, এখন আমার দুমাস ছুটি, এখন আমি আপনার সঙ্গে যে-কোনও জায়গায় যেতে পারি।

তুমি আমার ঠিকানা জানলে কী করে?

আমাদের পাশের বাড়িতে রানা নামে একটা ছেলে আছে। ওরা নতুন এসেছে। সেই রানা একদিন বলছিল যে, সে সন্তুকে চেনে। ওর বন্ধু সন্তু আন্দামানে, নেপালে, ইজিপ্টে অনেক অ্যাডভেঞ্চারে গেছে। ওর কাছ থেকে আমি সন্তুর ঠিকানাটা জেনে নিলুম, তারপর বাসে চড়ে চলে এলুম।

তুমি বাসে করে এসেছ, তার মানে বেশ দূরে থাকে। তা তুমি যে আমার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাবে, তাতে অনেক বিপদ হতে পারে জানো তো? যখন-তখন আমরা মরেও যেতে পারি।

আমি বিপদ-টিপদ গ্ৰাহ্য করি না।

তুমি ক্যারাটে জানো?

ক্যারাটে? না।

সাঁতার জানো?

একটু-একটু, খুব ভাল জানি না।

ঘোড়া চালাতে জানো?

একবার দাৰ্জিলিং-এ গিয়ে ঘোড়ায় চেপেছিলুম।

এক ঘণ্টা না আধা ঘণ্টা?

উ উ, আধা ঘণ্টা?

তোমার মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিং আছে?

না।

কাকাবাবু ভুরু নাচিয়ে কৌতুকের সুরে বললেন, তাহ অলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে কী করে? সাঁতার ভাল জানো না, আর ঘোড়ায় চেপেছ মাত্র আধা ঘণ্টা! মনে করো, ডাকাতদল তাড়া করল, ঘোড়ায় চেপে পালাতে হবে। কিংবা নদী দিয়ে যেতে-যেতে নৌকোড়ুবি হয়ে গেল। কিংবা পাহাড়ের খাদে পড়ে গেলে

সন্তুকে যে আপনি সঙ্গে নিয়ে যান, তার এই সব ট্রেনিং আছে? দেখে তো মনে হয় ক্যাবলা!

ট্রেনিং ছিল না, কিন্তু সন্তু এখন সবই শিখে নিয়েছে। ওকে দেখলে শান্তশিষ্ট মনে হয়। সেটাই ওর সুবিধে। ডাকাতরা বুঝতে পারে না যে, ও একই দুতিন জনকে ঘায়েল করে দিতে পারে।

আপনি আমাকে সঙ্গে নেবেন না?

এখন কী করে নিই বলে। আগে তোমাকে তৈরি হতে হবে। কাল থেকেই ভাল করে সাঁতারটা শিখতে শুরু করে দাও, আর ময়দানে ঘোড়ায় চড়া শেখার ব্যবস্থা আছে…

ঠিক আছে, আমি আর কিছু শুনতে চাই না?

শোনো, দাঁড়াও, অন্ত রাগ করছ, কেন?

দেবলীনা বলল, আপনার কাছে আমি আর কোনওদিন আসব না, আপনার বইও পড়ব না! আপনারা মেয়েদের কোনও চান্স দিতে চান না, আপনারা ভাবেন, ছেলেরাই বুঝি সব পারে! ছেলেদের থেকে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক বেশি, তা জানেন?

একটু দাঁড়াও, আসল কথাটা শুনে যাও! সেটাই তো তোমাকে বলা হয়নি! এতক্ষণ তো তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম!

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, কী?

তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কারণ, আমি তো কোথাও যাচ্ছি না!

কেন?

কোনও ব্যাপারে কেউ আমার সাহায্য চাইলে তবেই তো আমি যাই। কেউ তো আমায় ডাকছে না।

বাজে কথা! সেই যে সুন্দরবনে আপনি একটা খালি জাহাজের রহস্য জানতে গিয়েছিলেন, তখন কি আপনাকে কেউ ডেকেছিল?

এখন তো সে-রকম কোনও রহস্যও নেই?

বুঝেছি, সব বুঝেছি। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না! আমিও চাই না আপনার সঙ্গে যেতে।

আর দাঁড়াল না। মেয়েটি দুপদাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল। ক্রাচ তুলে নিয়ে কাকাবাবু উঠে আসতে-আসতে তাকে আর দেখা গেল না। তার জুতোজোড়া পড়ে আছে। এতই রেগে গেছে যে, জুতো পরতেও ভুলে গেল।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, ওইটুকু মেয়ের এত রাগ!

তারপর তিনি আবার তাঁর ম্যাপ দেখার কাজে ফিরে গেলেন।

মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েই চলে গেলি, তারপর কী হল জানিস?

সন্তু বলল, একটু পরেই তো চলে গেল। দেখলুম, আমাদের ক্লাবের পাশ দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে যাচ্ছে।

আর কিছু দেখিসনি?

না তো!

মেয়েটির যে খালি পা ছিল, তা তোর লক্ষ করা উচিত ছিল। এই দ্যাখ, ওর জুতো ফেলে গেছে!

জুতোটা প্রায় নতুন, স্ট্র্যাপ লাগানো স্যান্ডাল, দাম খুব কম নয়। এখন এই জুতো কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, একপাশে সরিয়ে রেখে দে, মেয়েটি নিশ্চয়ই পরে নিতে আসবে।

নিজেই তিনি জুতোজোড়া তুলে নিয়ে নিজের জুতোর র্যাকে রেখে দিলেন।

কিন্তু মেয়েটি আর জুতো নিতে ফিরে এল না।

এর প্রায় পাঁচ-ছ দিন বাদে টিভি দেখতে-দেখতে সন্তু চমকে উঠল। খবর শুরু হবার আগে নিরুদ্দিষ্টদের ছবি দেখায়। সন্তু খেলার খবর শুনবে বলে টিভির সামনে বসে ছিল, হাতে তার একটি বই। হঠাৎ একবার চোখ তুলতেই সে দেখতে পেল একটি মেয়ের ছবি। এই মেয়েটি কয়েক দিন আগে কাকাবাবুর কাছে এসেছিল না? ঠিক সেই রকম দেখতে। ঘোষণায় বলা হল : দেবলীনা দত্ত নামের এই মেয়েটিকে গত পাঁচ দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চোখে চশমা, মাতৃভাষা বাংলা, কেউ যদি সন্ধান

সন্তু কাকাবাবুর ঘরে ছুটে এসে বলল, কাকাবাবু, সেদিন যে মেয়েটি এসেছিল, জুতো ফেলে গেছে, সে তার নাম বলেছিল?

কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, কেন রে? হ্যাঁ, বলেছিল, বেশ মিষ্টি নামটা, কিন্তু মনে পড়ছে না তো!

দেবলীনা দত্ত কি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস; কেন, কী হয়েছে?

সেই মেয়েটা হারিয়ে গেছে। টিভিতে এইমাত্র বলল?

কাকাবাবু সন্তুর কাছ থেকে সবটা ভাল করে শুনলেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেদিন মেয়েটির সঙ্গে আরও ভাল করে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু মেয়েটি যে হঠাৎ অমন রেগে যাবে, তা তিনি কী করে বুঝবেন? ওই বয়েসের মেয়েরা সাধারণত লাজুক হয়। তিনি এমন কিছু খারাপ কথা বলেননি যে, জুতোটুতো ফেলে দৌড়ে চলে যেতে হবে। মেয়েটি কি এখান থেকেই চলে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি? কিংবা কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেল?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটির ঠিকানা কী?

সন্তু বলল, জানি না তো?

টেলিভিশনে ঠিকানা বলেনি?

সন্তু মুখ নিচু করল। টিভির পদায় ঠিকানাটা ফুটে ওঠার আগেই সন্তু উঠে এসেছে। কাকাবাবু একটু বিরক্ত হলেন। আধখ্যাঁচড়াভাবে কোনও কাজই তাঁর পছন্দ হয় না।

তিনি বললেন, দাঁড়া, মেয়েটি আর একটা নাম বলেছিল, কী যেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, রানা, সে নাকি তোর বন্ধু, ওই নামে তোর কোনও বন্ধু আছে?

সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, রানা বলে একটি ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত ইস্কুলে, কিন্তু সে তো ক্লাস নাইনে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল, তারপর সে এখন কোথায় থাকে তা তো জানি না!

কাকাবাবু আপনমনে বললেন, মেয়েটা হারিয়ে গেল? আমাদের বাড়িতে এক-একা এসেছিল… আমাদের একটা দায়িত্ব আছে?

সন্তু বলল, এক কাজ করব? রকুকুকে ওর জুতোর গন্ধ শোকালে, রকুকু নিশ্চয়ই ওর বাড়ি খুঁজে বার করতে পারবে।

কাকাবাবু বললেন, তার চেয়ে অনেক সহজ উপায় আছে।

কাকাবাবু চলে গেলেন টেলিফোনের কাছে। সন্তু শিস দিয়ে ওর কুকুরটাকে ডাকতেই রকুকু ছুটে এল লেজ নাড়তে-নাড়তে। রকুকু একটা সাদা রঙের স্পিৎজ।

সন্তু তার নাকের কাছে দেবলীনার একপাটি জুতো চেপে ধরে বলল, এই, গন্ধ শুকে চল তো!

রকুকু কিছুই করল না। বিরক্তভাবে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে দুটো হাঁচি দিল।

কাকাবাবু টেবিলের কাছ থেকে বললেন, ওর জন্য ট্রেনিং দিতে হয়। যে-কোনও কুকুরই ওরকমভাবে ঠিকানা খুঁজতে পারে না?

তিনি বেশ কয়েকবার টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে তারপর একবার সাড়া পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, টিভি সেন্টার? অরবিন্দ বসু আছেন? নেই? ছুটিতে? শুনুন, একটু আগে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণায় আপনারা দেবলীনা দত্ত নামে একটি মেয়ের কথা বললেন…

ওপাশ থেকে কাকাবাবুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে একজন বললেন, ওসব খবর এখান থেকে জানানো যাবে না। নিউজ ডিপার্টমেন্টে খোঁজ করুন!

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, লাইন ছাড়বেন না। টেলিফোনের কানেকশন পাওয়া খুব শক্ত। ব্যাপারটা খুব জরুরি। একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে, বেশি দেরি হলে তার খুব খকতি হয়ে যেতে পারে, মেয়েটির বাড়ির ঠিকানাটা জানা আমার খুবই দরকার। আপনার গলার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আপনি ভাল লোক, আপনিই একটু কষ্ট করে ঠিকানাটা জেনে এসে আমাকে বলুন।

একটু ধরুন! কী নাম বললেন, দেবলীনা দত্ত?

একটু বাদেই ওপাশ থেকে আবার শোনা গেল, লিখে নিন, ৪৫/১ এফ, প্রিন্স আনোয়ার শা। রোড, বাবার নাম শৈবাল দত্ত।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি সত্যিই ভাল লোক।

ফোনটা নামিয়ে রেখে কাকাবাবু বললেন, দেখলি, সামান্য একটু প্ৰশংসায় কী রকম কাজ হয়ে যায়।

সন্তু বলল, মেয়েটা অত দূর থেকে এসেছিল?

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, তাই তো দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির বাবার সঙ্গে এক্ষুনি একবার দেখা করা দরকার।

কাকাবাবু, আমি সঙ্গে যাব?

একটু চিন্তা করে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তুই গেলে ভাল হয়। তা হলে আর দেরি করে লাভ কী! মেয়েটির জুতোজোড়া একটা প্যাকেটে ভরে নে।

রাস্তায় বেরিয়ে খানিকটা চেষ্টার পর একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। এই মাত্র প্রায় গোটা শহর জুড়ে লোডশেডিং হয়ে গেল। তার ওপর আবার টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় কিছুই দেখা যায় না। মনে হয় যেন ট্যাক্সিটা যাচ্ছে গভীর এক জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।

প্রিন্স আনোয়ার শা। রোডে বাড়ির নম্বর খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে ঢুকে একটা দোতলা বাড়ি। ওপরের একটি ঘরে নিয়ন আলো জ্বলছে। খুব সম্ভবত ব্যাটারির আলো।

কলিং বেল বাজবে না, তাই কাকাবাবু তাঁর একটা ক্রাচ দিয়ে দরজায় খটখট শব্দ করলেন। ভেতর থেকে একজন কেউ বলল, কে?

কাকাবাবু বললেন, শৈবাল দত্ত বাড়ি আছেন?

খালি গায়ে একজন লোক দরজা খুলল, তার হাতে টর্চ। সে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? বাবু তো এই সময় কারুর সঙ্গে দেখা করেন না।

কাকাবাবু বললেন, বাবুকে বলো, আমরা তাঁর মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।

লোকটি বলল, খুকুমণি? তার দেখা পেয়েছেন? কোথায় সে?

তোমার বাবুকে ডাকো, তাঁকেই সব কথা বলব!

লোকটি ওদের ভেতরে আসতে বলল না, দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে সিঁড়ি দিয়ে চটির ফটফট শব্দ করে নেমে এলেন শৈবাল দত্ত, তাঁরও হাতে একটি টর্চ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কী চাই আপনাদের? আমার মেয়ের সম্পর্কে কী বলছেন?

কাকাবাবু একটু এগিয়ে যেতেই শৈবাল দত্ত ধমক দিয়ে বললেন, কাছে আসবার দরকার নেই। যা বলবার ওইখান থেকেই বলুন।

কাকাবাবু হেসে উঠে বললেন, সত্যি, যা অন্ধকার, এর মধ্যে কারুকেই বিশ্বাস করা যায় না। আপনার ভয় নেই, আমরা চোর-ডাকাত নই। আমি একজন খোঁড়া মানুষ, আপনার সঙ্গে দুএকটা কাজের কথা বলতে এসেছি।

শৈবাল দত্ত কাকাবাবু ও সন্তুর সারা গায়ে ভাল করে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, ভেতরে আসুন। যা অবস্থা, এর মধ্যে কি আর ভদ্রতা-সভ্যতা বজায় রাখার উপায় আছে?

তিনি বসবার ঘরের দরজা খুললেন। খালি-গায়ে লোকটি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে গেল। সোফায় বসার পর কাকাবাবু বললেন, আমরা বাড়ি থেকে বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং হল। যদি আর দশ মিনিট আগে হত, তা হলে আমার এই ভাইপোটি টিভি দেখতে পারত না, আমরাও জানতে পারতুম না যে, আপনার মেয়ে দেবলীনা হারিয়ে গেছে।

শৈবাল দত্ত পা-জামা আর একটা বাটিকের পাঞ্জাবি পরে আছেন। পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর বয়েস মনে হয়, মাথায় অল্প টাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বার করে প্রথমে নিজে একটি ধরালেন, তারপর কাকাবাবুর দিকে প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিলেন।

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ, আমার চলে না। আমি প্রথমেই একটা কথা জানতে চাই, আপনার মেয়ে কি ইচ্ছে করে বা রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে? অথবা সে হারিয়ে গেছে বা কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে?

আপনারা কি পুলিশের লোক?

আমার প্রশ্নটা অনেকটা সেই রকমই শোনাল, তাই না? না, আমি পুলিশের লোক নই। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, এক সময়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে চাকরি করতুম, আমার পায়ে অ্যাকসিডেন্ট হবার পর আর কিছু করি না, বাড়িতেই থাকি। আর এ হচ্ছে আমার ভাইপো সন্তু! গত সপ্তাহে একদিন আপনার মেয়ে দেবলীনা আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই দিনটা ছিল মঙ্গলবার।

শৈবাল দত্ত বললেন, খুকু আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল? সে আপনাকে চিনল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, কারুর কাছ থেকে আমার কথা শুনেছে টুনেছে। বোধহয়। আমাকে সে আগে কোনওদিন দেখেনি, আমার ঠিকানা জোগাড় করে সে একলাই চলে গিয়েছিল আমার কাছে।

শৈবাল দত্ত ভুরু কুঁচকে বললেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমার মেয়ে আপনাকে চিনত না, আগে কখনও দেখেনি, তবু সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেল কেন?

সন্তু চুপ করে সব শুনছে। সে একটু অবাকও হচ্ছে। বেশির ভাগ লোকই কাকাবাবুর নাম শুনেই চিনতে পারে। অনেকেই নাম শোনামাত্র বলে ওঠে, ও আপনিই সেই বিখ্যাত কাকাবাবু? আর এই ভদ্রলোক কিছুই খবর রাখেন না!

কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, আপনি শুনলে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না, আমি এই খোঁড়া পা নিয়ে মাঝে-মাঝেই পাহাড়-পর্বতে যাই।

পাহাড়-পর্বতে বেড়াতে যান?

ঠিক বেড়াতে নয়, একটা কিছু কাজ থাকে, অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আমার এই ভাইপোটিও আমার সঙ্গে থাকে। আপনার মেয়ে দেবলীনা এই সব কথা যেন কার কাছ থেকে শুনেছে। তাই সে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, পরের বারে সে-ও আমার সঙ্গে যাবে।

আমার মেয়ে আপনাকে চেনে না শোনে না, অথচ সে আপনার সঙ্গে পাহাড়ে যেতে চাইল, আমি এর মানে বুঝতে পারছি না। গতবারই তো আমি তাকে দাৰ্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলুম। আমার সঙ্গেই তো সে যেতে পারে।

তা তো পারেই। তবু সে আমার কাছে গিয়ে ওই প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি লাগবে না? তাতে সে বলল, আমার বাবা আমার কোনও কাজে বাধা দেন না।

আমার মেয়ে এখন কোথায় আছে? আপনাদের বাড়িতে?

না, না…

এক সেকেন্ড দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি আসছি।

শৈবাল দত্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চটির শব্দ শুনে বোঝা গেল। তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছেন।

কাকাবাবু মুচকি হেসে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, ভদ্রলোক উঠে কোথায় গেলেন বল তো?

সন্তু ভুরু কুঁচকে ভাববার চেষ্টা করল। কাকাবাবুই আবার বললেন, কারুকে টেলিফোন করতে। খুব সম্ভবত টেলিফোনটা দোতলায়। উনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

সন্তু বলল, উনি যে তোমাকে চিনতে পারেননি। উনি কি কাগজ-টাগজও পড়েন না?

কাকাবাবু কবজি উলটে ঘড়িটা দেখলেন। পৌনে নটা বাজে। এ-বাড়িতে অন্য লোকজনের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে বিকট গর্জন করে একটা মোটরবাইক গেল।

শৈবাল দত্ত আবার নীচে নেমে এসে কাকে যেন হুকুম করলেন সদর দরজাটা বন্ধ করে দিতে, তারপর ঘরে ঢুকে খানিকটা উত্তেজিতভাবে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনাকে দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। আপনি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন বুঝতে পারছি না। আপনি কত টাকা চান?

টাকা? ওঃ হো-হো, আপনি কি ভেবেছেন…

বাঃ, আপনি আমার মেয়েকে পাহাড়-পর্বতে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তার জন্য খরচ লাগবে না? সেটা চাইতেই তো আপনি এসেছেন আমার কাছে?

কাকাবাবু শৈবাল দত্তের মুখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন। তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার রিভলভারটার লাইসেন্স আছে আশা করি?

শৈবাল দত্ত একটু থতমত খেয়ে বললেন, অ্যাঁ? হ্যাঁ, আছে।

হাতটা পকেট থেকে বার করুন। হঠাৎ আমাদের ওপর গুলি টুলি চালিয়ে বসবেন না যেন! আপনার মেয়ে হারিয়ে গেছে, সেজন্য আপনি খুব অস্থির হয়ে আছেন, বুঝতে পারছি। তবু অনুরোধ করছি, একটুখানি শান্ত হয়ে বসে আমার কথা শুনুন।

শৈবাল দত্ত কড়া গলায় বললেন, আগে আপনি জবাব দিন, আমার মেয়ে আপনার কাছে গিয়েছিল কেন? আপনি তাকে পাহাড়-পর্বতে নিয়ে যাবার লোভ দেখিয়েছিলেনই বা কেন?

কাকাবাবু হা-হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি তাকে লোভ দেখাব কেন? বরং আমি রাজি হলুম না বলেই তো সে রেগে গেল। আপনার মেয়ে বড় রাগী!

আপনি রাজি হননি?

একটি অচেনা মেয়ে এসে এ-রকম অদ্ভুত প্রস্তাব দিলে কেউ রাজি হয়? তার বাবা-মায়ের মতটা তো অন্তত আগে জানা দরকার। তা ছাড়া আমার এখন বাইরে কোথাও যাবার কথাও নেই। এই সব শুনে আপনার মেয়ে এমন রেগে গেল যে, জুতো না পরেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল!

এই কথা শুনে শৈবাল দত্তর মুখখানা বদলে গেল অনেকখানি। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, খুকু ছোটবেলা থেকেই বড় জেদি। রাগ করে অনেকবার খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়েছে।

ওর জুতোজোড়া আমরা সঙ্গে নিয়েই এসেছি। সন্তু, বার করে দে।

এই সময় আলো জ্বলে উঠল।

শৈবাল দত্ত ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে জুতোজোড়া হাতে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, খুকুরই জুতো। গত মাসে আমি বোম্বে থেকে এনেছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দেবলীনা আমাদের বাড়িতে মঙ্গলবার গিয়েছিল। সেইদিন থেকেই কি ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?

শৈবাল দত্ত বললেন, মঙ্গলবার? না, দাঁড়ান, আমি হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরলুম কবে? মঙ্গলবার! মঙ্গলবার রাত্তিরে আমি ফিরেছি। বুধবার সকালেও আমি খুকুর সঙ্গে কথা বলেছি। বুধবার বিকেল থেকেই ওকে পাওয়া যাচ্ছে না!

বাইরে একটা জিপ গাড়ি থামার আওয়াজ হল।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, পুলিশ।

তারপর শৈবাল দত্তের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললেন, বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেছে তো! আপনার ফোন পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছে।

শৈবাল দত্ত লজ্জিতভাবে বললেন, আমার একজন বিশেষ বন্ধু, তাকে আসবার জন্য টেলিফোন করেছিলুম…
হালকা ঘি-রঙের হাওয়াই শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে যিনি ঘরে ঢুকলেন, তাঁকে দেখলে টেনিস খেলোয়াড় মনে হলেও আসলে তিনি পুলিশের একজন বড়কতা, তাঁর নাম ধ্রুব রায়।

কী ব্যাপার, শৈবাল, তুমি কালপ্রিটকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছ?

এই বলেই তিনি কাকাবাবুকে দেখে চমকে গেলেন। এগিয়ে এসে বললেন, আরে, কাকাবাবু, আপনি এখানে?

কাকাবাবু বললেন, তোমার বন্ধু আমাকেই কালপ্রিট ভেবেছিলেন।

শৈবাল দত্ত ধ্রুব রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এঁকে চেনো?

ধ্রুব রায় হাসতে হাসতে বললেন, আরো কাকাবাবুকে কে না চেনে? তোমাকে সেই আন্দামানের ঘটনাটা বলেছিলুম না, সেই যে জারোয়াদের দ্বীপে রাজা হয়েছিলেন একজন বৃদ্ধ বিপ্লবী! এর জন্যই তো সেই সব কিছু জানা গিয়েছিল, ইনিই তো সেই রাজা রায় চৌধুরী!

শৈবাল দত্ত বললেন, আমি খুব দুঃখিত। মানে, ইনি অন্ধকারের মধ্যে এলেন, ভাল করে চেহারাটা দেখতে পাইনি, ওঁর কথাগুলোও ঠিক ধরতে পারছিলুম না, তাই আমার মনে হল উনি র‍্যানসাম চাইতে এসেছেন, আমার ওপর চাপ দিচ্ছেন।

কাকাবাবু বললেন, তোমার বন্ধুটি খুব সাবধানী। তোমাকে তাড়াতাড়ি আমরা পালিয়ে না। যাই!

ধ্রুব রায় জানলার কাছে গিয়ে বাইরে কাকে যেন বললেন, সব ঠিক আছে। তোমরা চলে যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।

তারপর ফিরে এসে বললেন, খুকুকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে শৈবাল একেবারে দারুণ বিচলিত হয়ে আছে। আমি তো বলেছি, এত নাভাস হবার কিছু নেই, ও নিজেই ঠিক ফিরে আসবে। এই তো প্রথম নয়, আগেও তো এরকম চলে গিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, আগেও চলে গিয়েছিল?

ধ্রুব রায় হালকাভাবে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। রাগ হলেই ও বাড়ি থেকে চলে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। ওর মা তো নেই, বাবাও মেয়ের জন্য বেশি সময় দিতে পারে না। ওকে ঠিকমতন দেখাশুনো করার কেউ নেই, সেই জন্যেই, ফ্র্যাংকলি বলছি, শৈবালের সামনেই বলছি, মেয়েটা বেশ স্পয়েন্ট চাইলড হয়ে গেছে! কারুর কথা শোনে না।

শৈবাল দত্ত বললেন, ওর জন্য তিন জন টিচার রেখেছি।

ধ্রুব রায় বললেন, আরে বাবা, টিচার রাখলেই কি ছেলেমেয়ে মানুষ করা যায়? বাবা-মায়ের শিক্ষাটাই আসল। ওকে ছোটবেলায় একটু শাসন করা উচিত ছিল। এখন অবশ্য বড় হয়ে গেছে। কিন্তু জানেন, কাকাবাবু, মেয়েটা খুব ব্রিলিয়ান্ট! এক্সট্রাঅর্ডিনারি। আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ওর তুলনাই চলে না। যেমন লেখাপড়ায় মাথা, তেমনি ওর সাহস। ঠিকমতন চললে ও মেয়ে অনেক বড় কিছু হতে পারবে। তা আপনি এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লেন কী করে?

কাকাবাবু বললেন, ওই দেবলীনা আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কোনও রকম ভুমিকা না করেই বলল, পরের অ্যাডভেঞ্চারে ও আমার সঙ্গে যেতে চায়!

ধ্রুব রায় বললেন, আপনার সঙ্গে যেতে আমাদেরই লোভ হয়। ওই বয়েসের ছেলেমেয়েদের তো হবেই। এবারে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমায় নিয়ে চলুন!

কাকাবাবু বললেন, মেয়েটি সম্পর্কে তা হলে বিশেষ চিন্তা নেই বলছ? আমার একটু অপরাধ-বোধ হচ্ছিল। আমার সঙ্গে দেখা করতে গেল, তার পর থেকেই নিরুদ্দেশ, তাই ভাবছিলুম, আমিও বোধহয় কিছুটা দায়ী!

ধ্রুব রায় বললেন, না, না, না, ও ঠিক ফিরে আসবে। বুদ্ধিমতী মেয়ে, ও কোনও বিপদে পড়বে না।

রাগ করে ও কোথায় গিয়ে থাকে?

এক-একবার এক-এক জায়গায় যায়। এই তো সেবারে, তখন ওর বয়েস কত হবে, বড়জোর তেরো, একলা ট্রেনে টিকিট কেটে পাটনায় চলে গিয়েছিল।

শৈবাল দত্ত বললেন, কিন্তু এবারে ও কোথায় যাবে? পাটনায় তো কেউ নেই, দুৰ্গাপুরেও যায়নি, আমি টেলিফোনে খবর নিয়েছি।

ধ্রুব রায় বললেন, কেন, ভিলাইতে ওর মামার বাড়ি যদি চলে যায়? সেখানেই গেছে আমার ধারণা।

ওর মামা তো ভিলাইতে এখন থাকে না, আমেরিকা চলে গেছে!

তা হলে কলকাতাতেই ওর কোনও বন্ধু-টঙ্কুর বাড়িতে আছে নিশ্চয়ই। তুমি চিন্তা করো না, আমি লোক লাগিয়েছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ-বাড়িতে আর-কেউ থাকে না?

শৈবাল দত্ত বললেন, আমার স্ত্রী মারা গেছেন অনেক দিন আগে। আমার এক পিসিমা আর তাঁর ছেলে থাকতেন। আমার এখানে। পিসতুতো ভাইটি একটা চাকরি পেয়েছে দুগাপুরে। পিসিমা কয়েক দিনের জন্য সেখানে গেছেন। এই কদিন খুকু বলতে গেলে একাই ছিল। চাকরির কাজে আমাকে প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই বাইরে যেতে হয়।

ধ্রুব রায় বললেন, এত বড় বাড়িতে এক-একা থাকতে কারুর ভাল লাগে? মাথার মধ্যে নানারকম উদ্ভট চিন্তা তো আসবেই! শৈবাল, তুমি এবারে মেয়ের দিকে একটু মনোযোগ দাও!

কাকাবাবু বললেন, আমরা তা হলে এবার উঠি। চলা রে, সন্তু!

ওঁরা দুজন কাকাবাবুদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

বাইরে রাস্তায় দুতিনটি ছেলে দাঁড়িয়ে গল্প করছে, সে-দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ওদের মধ্যে তোর বন্ধু রানা আছে?

সন্তু বলল, না তো!

আমি বড় রাস্তায় দাঁড়াচ্ছি, তুই গিয়ে রানার খোঁজ কর। সে দেবলীনা সম্পর্কে কী কী জানে, কেন সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, এসব জেনে আসার চেষ্টা কর। দশ মিনিটের মধ্যে আসিস।

কাকাবাবু ক্ৰাচে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে এলেন বড় রাস্তার দিকে। এর মধ্যেই রাস্তা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে। টিপটপ করে। কাকাবাবু একটা গাছতলায় দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খারাপ লাগছে।

সন্তু একটু বাদেই ফিরে এল। সে বলল, রানার বাড়ি ওই মেয়েটির বাড়ির পাশেই। কিন্তু রানার খুব জ্বর হয়েছে, ও ঘুমোচ্ছে, তাই কিছু জিজ্ঞেস করা গেল না,

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। এবারে দ্যাখ দেখি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় কি না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও সেখানে ট্যাক্সি পাওয়া গেল না, কাকাবাবুর সঙ্গে সন্তু সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।

যদিও লোডশেডিং নেই, তবু রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। দুচারটে সাইকেল-রিকশা মাঝে-মাঝে বেল দিতে-দিতে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। বৃষ্টি টিপটপ করে পড়েই চলেছে।

খানিকটা এগোতেই হঠাৎ ছায়ামূর্তির মতন তিনটি লোক ঘিরে ধরল ওদের। একজন চেপে ধরল। সন্তুর কাঁধ, একজন একটা ছুরি বার করে কাকাবাবুর মুখের সামনে ধরল, অন্যজন হিসহিসিয়ে বলল, কী আছে চটপট বার করে তো চাঁদু!

কাকাবাবু লোক তিনটিকে দেখলেন। কারুরই বয়েস খুব বেশি না, পাঁচশ-ছাবিবশের মধ্যে। খুব একটা গাঁট্রাগোট্টা চেহারাও নয়। তবে মুখে গুণ্ডা-গুণ্ডা ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।

কাকাবাবু বললেন, এত কম বয়েসে জেলে যাবার শখ হয়েছে বুঝি?

ওদের একজন বলল, এই বুড়ো, বেশি কথা নয়, বার করো, যা আছে বার করো?

কাকাবাবু বললেন, আমার কাছ থেকে কী-ই বা পাবে? আমি খোঁড়া মানুষ। আমার সঙ্গে রয়েছে একটা বাচ্চা ছেলে। আমাদের ওপর জুলুম কোরো না। আমাদের ছেড়ে দাও!

যার হাতে ছুরি সে বলল, হাতে ঘড়ি তো রয়েছে, খোলো শিগগির।

আর একজন বলল, পকেটে মানিব্যাগও আছে। সব আমাদের চাই।

কাকাবাবু বললেন, এটা একটা সস্তার ঘড়ি, তাও অনেকদিনের পুরনো। নিয়ে তোমাদের বিশেষ কিছু লাভ হবে না।

ছুরিওয়ালা ছেলেটি এবার ধমক দিয়ে বলল, ভালয়-ভালয় দেবে, না পেট ফাঁসাব?

কাকাবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে নাও! পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করেই কাকাবাবু সেটা বেশ জোরে ছুঁড়ে দিলেন রাস্তার উল্টোদিকে।

একজন বলল, এটা কী হল? চালাকি?

বলেই সে ছুটে গেল ব্যাগটা খুঁজবার জন্য। ছুরিওয়ালা ছেলেটি বলল, আমাদের সঙ্গে চালাকি করলে জানে মেরে দেব।

কাকাবাবু একবার সন্তুর চোখের দিকে তাকালেন, তারপর ঘড়িটি খুললেন আস্তে-আস্তে। ছুরিওয়ালা ছেলেটি সেটা হাত বাড়িয়ে নেবার আগেই কাকাবাবু সেটাকেও ছুঁড়ে দিলেন ওপরের দিকে।

গুণ্ডা দুজন ওপরের দিকে তাকাতেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে ছুরিওয়ালার হাতটাতে আঘাত হানলেন। সন্তুও অন্য লোকটিকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ঘড়িটাকে লুফে নেবার চেষ্টা করল। ঠিক পারল না। অন্ধকারে তো ভাল দেখা যাচ্ছে না, ঘড়িটা সন্তুর হাতে লেগে মাটিতে পড়ল। সন্তু ঘড়িটা তোলবার জন্য নিচু হতেই একজন তার পিঠের ওপর দিয়ে হাত বাড়াল, সন্তু নিখুঁত ক্যারাটের কায়দায় সেই হাতটা চেপে ধরে তাকে আছাড় মারল সপাটে।

ছুরিটা পড়ে গেছে রাস্তায়। কাকাবাবু সেই লোকটির চোখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, তুমি ছুরিটা তোলার চেষ্টা করলেই আমি তোমার মাথাটা গুঁড়ো করে দেব। সেটা কি ভাল হবে?

যে-লোকটা রাস্তার উলটো দিকে মানিব্যাগটা খুঁজতে গিয়েছিল, সে সেটা তুলে নিয়ে একবার এদিকে তাকাল। এদিকে এইসব কাণ্ড দেখে সে আর ফিরল না। চৌ-চোঁ দৌড় মেরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

ছুরি তুলে যে ভয় দেখাচ্ছিল, তাকে কাকাবাবু হুকুম করলেন, মাটিতে বসে পড়ে। কী সব বন্ধু তোমাদের, একজন তো একলা পালিয়ে গেল তোমাদের ফেলে?

সন্তু যাকে আছাড়ি মেরেছে, সে এমনই ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেছে যে, উঠে বসে গোল-গোল চোখে তাকিয়ে আছে। একটা বাচ্চা ছেলের কাছে সে এরকম জব্দ হবে, কল্পনাই করতে পারেনি।

কাকাবাবু বললেন, আমি তোমাদের প্রথমেই বারণ করেছিলুম, তখন শুনলে না। ওই যে দূরে একটা গাড়ি আসছে, ওই গাড়িটা থামিয়ে তোমাদের থানায় নিয়ে যাব! কিংবা, এখান থেকে কাছেই একটা গাড়িতে পুলিশের একজন

ওদের একজন কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, স্যার, এবারকার মতন ছেড়ে দিন! এবারকার মতন মাপ করুন।

কাকাবাবু বিরক্ত ভঙ্গি করে বললেন, একটু আগে আমাকে বলেছিলে বুড়ো আর তুমি, এখন হয়ে গেলুম স্যার আর আপনি। কাপুরুষ! নিরীহ লোকদের ওপর হামলা করার সময় লজ্জা নেই, ধরা পড়লেই অমনি কান্না!

সন্তু ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে ওদের পাহারা দিচ্ছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, সন্তু, ওদের পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত নয়?

একজন মরিয়া হয়ে ছুট লাগাল। অন্যজন উঠতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু বললেন, শোনো, তোমাদের মতন ছিচকে গুণ্ডাদের নিয়ে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না। যাও, তোমাকেও ছেড়ে দিলাম। তবে, তোমার যে স্যাঙাত আমার মানিব্যাগটা নিয়ে পালাল, তার কাছ থেকে ওটা আমায় ফেরত দিতে পারবে? ওর মধ্যে আমার ঠিকানা লেখা কার্ড আছে। ওর মধ্যে টাকা পয়সা বেশি নেই, কিন্তু ওই ব্যাগটা আমার পছন্দের।

লোকটি বলল, হ্যাঁ, দেব স্যার, নিশ্চয়ই দেব স্যার!

কাকাবাবু বললেন, মিথ্যে কথা বলতে তোমাদের মুখে আটকায় না। তা জানি। হয়তো ফেরত দেবে না। তবে এইসব গুণ্ডামি বদমাইশি ছেড়ে যদি ভদ্রভাবে জীবন কাটাতে চাও, তবে আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের কাজ যোগাড় করে দেবী! যাও!

লোকটা চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল।

দূর থেকে যে গাড়িটা আসছিল, সেটা বেঁকে গেল। ডানদিকের একটা রাস্তায়।

আবার হাঁটতে শুরু করে কাকাবাবু বললেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার। মাত্র রাত সাড়ে নটা এখন। এরই মধ্যে এত বড় রাস্তায় গুণ্ডার উপদ্রব। কলকাতা শহরটা কি নিউ ইয়র্ক কিংবা শিকাগো হয়ে গেল নাকি?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আপনার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে!

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নিয়ে বললেন, ঘড়ির জন্য আমার অত মায়া নেই। এটা সারিয়ে নিলেই চলবে। আমার নাকের ডগায় কেউ ছুরি দেখালে বড্ড রাগ হয়।

কাকাবাবু, আমি কিন্তু ওদের ছুরিটা নিয়ে এসেছি।

বেশ করেছিস! তোর একটা ছুরি লাভ হল। রেখে দে, পরে কাজ দেবে।

দূর থেকে আবার একটা গাড়ি আসছে, এটা কি ট্যাক্সি হতে পারে? অনেক সময় ট্যাক্সির ওপরের আলোটা জ্বলে না। কাকাবাবু থমকে দাঁড়ালেন।

না, ট্যাক্সি নয়, প্রাইভেট গাড়ি। ড্রাইভারের সিটে শুধু একজন লোক। গাড়িটা ওদের ছড়িয়ে খানিকটা চলে যাবার পর হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ব্যাক করে চলে এল ওদের কাছে।

গাড়ির চালক মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, মিঃ রায়চৌধুরী না? আরেঃ, আপনি এখানে কী করছেন?

কাকাবাবু লোকটিকে চিনতে পারলেন না। লোকটি মধ্যবয়স্ক, বেশ ভারী চেহারা, মুখে সরু দাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে… এখন ট্যাক্সি খুঁজছি।

লোকটি বলল, এত রাত্রে এদিকে তো ট্যাক্সি পাবেন না। কোথায় যাবেন? চলুন, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, আপনার অসুবিধে হবে। আমরা তো বাড়িতে যাব, আপনার বাড়ি কোন দিকে?

লোকটি বলল, কোনও অসুবিধে নেই। উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজবেন…

লোকটি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে পীড়াপীড়ি করতে কাকাবাবু সন্তুকে নিয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে। ভদ্রতা করে তিনি বসলেন সামনের সিটে। সত্যি তখন বৃষ্টিটা জোর হয়ে এসেছে।
একটুক্ষণ গাড়িটা চলার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কি এ পাড়ায় নাকি?

লোকটি বলল, না, আমার বাড়ি এখানে নয়। এ পাড়ায় এসেছিলুম একটা কাজে। কী অদ্ভুত যোগাযোগ বলুন তো, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কাকাবাবু পেছনের সিটের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, এ আমার ভাইপো সন্তু।

লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকেও তো চিনি! সন্তুও কিন্তু লোকটিকে কোথাও আগে দেখেছে কি না মনে করতে পারছে। না। তবে গলার আওয়াজটা যেন একটু চেনা-চেনা লাগছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামটা কী বলুন তো? ঠিক মনে করতে পারছি না।

লোকটি হা-হা শব্দে হেসে বলল, আমার নাম মনে নেই তো? ভাবুন, আর একটু ভাবুন, যদি মনে পড়ে।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন। সন্তু চুপ। কাকাবাবু বললেন, আপনি একটু আগে এসে পড়লে বেশ হত। তিনটে গুণ্ডা-মতন ছেলে আমাদের ওপর হামলা করতে এসেছিল।

এই রকম কথা শুনলে সবাই জিজ্ঞেস করে, তাই নাকি? কী করেছিল? তারপর কী হল?

কিন্তু এই গাড়ির চালকের সেরকম কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। সে অকারণে হা-হা করে হেসে উঠল।

সাউথ গড়িয়াহাট রোডে পড়ে গাড়িটা ডান দিকে বেঁকতেই কাকাবাবু বললেন, আমার বাড়ি ওদিকে নয়। বাঁ দিকে যেতে হবে, ভবানীপুরের দিকে।

লোকটি কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে বলল, জানি, আপনার বাড়ি কোথায়। এখন একটু অন্য দিকেই চলুন না। আমার বাড়িতে বসে একটা চা খেয়ে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন তো আর চা খাব না। আপনার বাড়িতে অন্য একদিন যাব।

লোকটি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল হু-হু করে।

কাকাবাবু বললেন, আরে, এ যে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। আমি এখন বাড়ি ফিরতে চাই। আপনার বাড়ি একেবারে উলটো দিকে দেখছি, আপনি বরং আমাদের এখানে নামিয়ে দিন। এখান থেকে ট্যাক্সি পেয়ে যাব।

লোকটি বলল, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, চলুন না, চলুন না?

কাকাবাবু এতক্ষণ উপকারী লোকটির সঙ্গে বিনীতভাবে কথা বলছিলেন, এবারে দৃঢ় গলায় বললেন, আপনি এখানে গাড়ি থামিয়ে দিন।

লোকটি খুব আলগাভাবে ডান দিকের ড্যাশ বোর্ড থেকে একটা রিভলভার বার করে বলল, আশা করি এটা ব্যবহার করার দরকার হবে না। চুপ করে বসে থাকুন। আমার বাড়িতে চলুন। সেখানে আপনার সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে।

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী ব্যাপার বলা তো, সন্তু! আজি সন্ধে থেকেই খালি ছোরা-ছুরি। আর রিভলভার দেখতে হচ্ছে!

সন্তু পেছনের সিটে বসে আছে। লোকটি সন্তুকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। সন্তুর কাছে যে একটা ছুরি আছে তা সে জানে না।

সন্তু বলল, আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমাদের নামিয়ে দিন এখানে!

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, খোকা, চুপ করে বসে থাকো!

সন্তু ছুরিটা বার করেই চেপে ধরল লোকটার ঘাড়ে। তারপর সে-ও হুকুমের সুরে বলল, এক্ষুনি গাড়ি থামান। হাত সরাবার চেষ্টা করবেন না। তা হলেই আমি এটা বসিয়ে দেব ঘাড়ে।

লোকটি একটুও ভয় না পেয়ে বরং অট্টহাসি করে উঠল। তারপর বলল, এ ছেলেটা দেখছি সেই রকমই বিছু আছে। বদলায়নি একটুও। পকেটে আবার ছুরি নিয়ে ঘোরে। কত বড় ছুরি?

কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা বেশ বড়ই। মানুষ মারা যায়।

লোকটি বিদ্রূপের সুরে বলল, একটা ছুরি থাকলেই বুঝি মানুষ মারা যায়? সবাই কি মানুষ মারতে পারে? তার জন্যও ট্রেনিং লাগে! এই খোকা, চালাও দেখি ছুরি, দেখি তুমি কেমন পারো?

সন্তুর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। লোকটা যা বলল, সেই কথাগুলো সে আগে যেন কোথাও শুনেছে? কোথায়? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ত্রিপুরায়। জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা বাড়িতে। এই লোকটাই সেই রাজকুমার!

স্টিয়ারিংয়ের ওপরেই লোকটির দুই হাত রাখা, এক হাতে রিভলভার। ও হাত ওঠাবার আগেই সন্তু ওর ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হাত কাঁপছে। সত্যি-সত্যি কি একজন মানুষকে মেরে ফেলা যায়?

সে আবার ভয় দেখাবার জন্য বলল, শিগগির গাড়ি থামান, নইলে কিন্তু… এই কথা বলার সময় তার গলাও কেঁপে গেল।

লোকটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, বললুম তো গাড়ি থামাব না, তুই কী করতে পারিস দেখি!

কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা সরিয়ে নে সন্তু। ইনি ভয় পাচ্ছেন না। ইনি যখন এত করে বলছেন, তখন এর বাড়িতে একটু চা খেয়েই আসা যাক। চা ছাড়া আমরা আর কিছু খাব না কিন্তু!

সন্তু আশা করেছিল কাকাবাবু লোকটিকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে কিছু একটা করবেন। কিন্তু কাকাবাবু সেরকম কিছুই করলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ও মশাই, আপনার বাড়ি আর কত দূরে?

লোকটি গম্ভীরভাবে বলল, আর একটু দূর আছে।

এই রাস্তা এখনও তেমন ফাঁকা নয়। বাস চলছে। বৃষ্টির মধ্যেও কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একটা চলন্ত গাড়ির ভেতরে যে রিভলভার আর ছুরির খেলা চলছে, তা কেউ বুঝতে পারছে না।

যাদবপুর পেরিয়ে গিয়ে একটা নির্জন জায়গার কাছাকাছি এসে গাড়িটা গতি কমিয়ে একেবারে থেমে গেল। লোকটি এবারে রিভলভারটি ডান হাতে উঁচিয়ে, মুখ ফিরিয়ে সন্তুকে বলল, গাড়ি থামাতে বলেছিলি, এই তো থামালুম, এবারে তুই নেমে যা।

কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আপনি বসে থাকুন। আরও খানিকটা দূরে যেতে হবে।

সন্তু বলল, আমি এক নেমে যাব?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, তোকে আমার দরকার নেই। এখান থেকে বাস পেয়ে যাবি। বাসভাড়া না থাকে তো বল, আমি দিয়ে দিচ্ছি!

সন্তু বলল, কাকাবাবুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই এক যাব না।

কাকাবাবু বললেন, তুই চালেই যা সন্তু। যতদূর মনে হচ্ছে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বেশি রাত হলে দাদা-বউদি চিন্তা করবেন তোর জন্য।

লোকটি কণ্ঠহাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তা বেশ দেরি তো হবেই!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আপনাকে ফেলে রেখে আমি এক ফিরে গেলে মা-বাবা আরও বেশি চিন্তা করবেন।

আমি কিছুতেই নামব না।

তবে ছুরিটা দে আমার কাছে। চুপ করে বসে থাকবি। একদম মুখ খুলবি না।

সন্তু তবু বলল, কাকাবাবু, এই লোকটা হচ্ছে রাজকুমার! সেই যে ত্রিপুরায় জঙ্গলগড়ের চাবি খোঁজার সময়…

কাকাবাবু বললেন, প্রথমটায় চিনতে পারিনি। তখন দাড়ি ছিল না, চেহারাটাও রোগ ছিল, তাই না?

লোকটি বলল, চিনেছেন তা হলে? কতদিন পর দেখা বলুন? অনেক কথা জমে আছে, না? তাই আপনাকে দেখে মনে হল, আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাই, খানিকক্ষণ গল্প-টল্প করা যাব।।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, গল্প ভালই জামবে মনে হচ্ছে।

রাজকুমার আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল। তারপর কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। গড়িয়া পেরিয়ে আরও কিছুদূর যাবার পর গাড়িটা ঘুরে গেল। ডান দিকে। এখানে একেবারে অন্ধকার ঘুরাঘুট্টি রাস্তা। রাজকুমার এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে যে, মনে হয় এদিককার পথঘাট তার বেশ ভালই চেনা।

মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করছে গাড়িটাকে। কাছাকাছি কোনও বাড়িতেই আলো জ্বলছে না। পথটা গেছে। একেবেঁকে, হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে পাশে বড়-বড় পুকুর। গাড়িটা এত স্পিডে যাচ্ছে যে, হঠাৎ কোনও পুকুরে নেমে যাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়।

এক সময় গাড়িটা একটা বেশ বড় বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজকুমার হর্ন বাজাল খুব জোরে-জোরে। শার্ট-পরা একজন লোক এসে খুলে দিল গেট।

কাকাবাবু বললেন, অনেক দূর! এখান থেকে রাত্তিরবেলা ফিরব কী করে?

রাজকুমার বলল, আজ রাত্তিরেই যে ফিরতে হবে, তার কী মানে আছে? এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

কাকাবাবু হঠাৎ ভুরু কোঁচকালেন। যেন অন্য কোনও কথা তাঁর মনে পড়ে গেছে।

লোহার গেটের পরে একটা বাগান। এখানেও একটা বিরাট কুকুর ডেকে উঠল বুক কাঁপিয়ে। রাজকুমার দুতিনবার শিস দিতেই নেকড়ে বাঘের মতন কুকুরটা তার পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

সন্তু নেমে দাঁড়িয়েছে, কাকাবাবু গাড়িতে বসেই রইলেন। রাজকুমার এসে বলল, কী হল, নামুন।

যেন একটা ঘোর ভেঙে কাকাবাবু বললেন, ও, হ্যাঁ, নামছি।

কাকাবাবু নেমে চারপাশটা দেখে বললেন, বাঃ, বেশ বাড়িটা তো। আপনার নিজের নাকি?

রাজকুমার বলল, প্রায় আমারই বলতে পারেন।

সন্তু ভাবল, বাড়ি আবার প্ৰায় আমার হয় কী করে? বাড়ি কি বই যে অন্য কারুর কাছ থেকে চেয়ে এনে ফেরত না দিলেই প্ৰায় নিজের হয়ে যায়?

এত বড় বাড়িতে একটাও আলো জ্বলছে না।

রাজকুমার বলল, লোডশেডিং মনে হচ্ছে। তিনতলায় উঠতে হবে, আপনার অসুবিধে হবে না তো, মিঃ রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু হেসে বললেন, না, না, অসুবিধের কী আছে? অন্ধকারে ক্রাচ নিয়ে তিনতলার সিঁড়ি ভাঙা, এ তো খুব আনন্দের ব্যাপার!

রাজকুমার কার উদ্দেশে যেন বলল, এই, একটা টর্চ নিয়ে আয়। সিঁড়িতে আলো দেখা!

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়েও থমকে গিয়ে রাজকুমার বলল, কিছু মনে করবেন না, মিঃ রায়চৌধুরী। একটা জিনিস চেক করে দেখতে চাই। আপনার হাত দুটো একবার ওপরে তুলুন।

কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গে কোনও অস্ত্ৰ আছে কি না দেখতে চান তো? কলকাতা শহরে সন্ধেবেলা বেড়াতে বেরুবার সময় আমি বন্দুক-পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরি না। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, সঙ্গে একটা কিছু রাখাই উচিত ছিল।

রাজকুমার তবু কাকাবাবুর সারা শরীর থাবড়ে-থাবড়ে দেখল। তারপর বলল, ঠিক আছে, চলুন।

টর্চের আলোয় দেখা গেল ভেতরে একটা বেশ চওড়া, টানা বারান্দা। তার একপাশ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি।

কাকাবাবু বললেন, একতলায় ঘর নেই? সেইখানে বসে গল্প-গুজব সেরে নিলে হয় না?

রাজকুমার এবারে বেশ কড়াভাবে বলল, না, ওপরেই যেতে হবে। আপনার ভাইপো আগে-আগে চলুক, আপনি মাঝখানে, তারপর আমি।

কাকাবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, চল রে, সন্তু, দেরি করে লাভ নেই। সন্তু তিনতলায় পৌঁছতেই অন্ধকারের মধ্যে একজন কেউ চেঁচিয়ে উঠল, কোন? কোন?

পেছন থেকে রাজকুমার বলল, ঠিক আছে, টাইগার, আমি আছি। তুমি পাঁচ নম্বর ঘরটা খোলো। আলো নেই কেন? কখন থেকে লোডশেডিং?

অন্ধকারের মধ্যেই টাইগার নামের লোকটি বলল, লোডশেডিং নেহি। মালুম হচ্ছে কি লাইনমে কুছু গড়বড় হয়েছে!

একটা তালা খোলার শব্দ হল। রাজকুমার টর্চের আলো ফেলে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, এগিয়ে যান, বা দিকের তিন নম্বর দরজা। আপনারা দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ান। আমি বাইরে আছি। টাইগার, আমার ঘর থেকে টিউবলাইটটা নিয়ে এসো।

টাইগার বলল, আপনার ঘরের চাবি তো হামার কাছে না আছে।

রাজকুমার বলল, ও, হ্যাঁ, তাই তো। ঠিক আছে, আমিই নিয়ে আসছি। তুই দরজার বাইরে দাঁড়া। মিঃ রায়চৌধুরী, টাইগারকে ঘটাতে যাবেন না যেন। ও বড্ড গোঁয়ার।

মিশমিশে অন্ধকার ঘরটার মধ্যে ঢুকে সন্তু হাতড়ে-হাতড়ে দেয়ালের কাছে গেল। তারপর সারা দেয়ালটা হাত ঝুলিয়ে দেখল। সে-দেয়ালে কোনও জানলা নেই। আর-এক দিকে যেতে সে কিসের সঙ্গে যেন ঠোক্কর খেল। হাত দিয়ে বুঝল, সেটা একটা খাট।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই তখন নেমে গেলেই পারতিস। বাড়ি পৌঁছে যেতিস এতক্ষণ।

সন্তু বলল, বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে কী বলতুম? একজন তোমাকে রিভলভার দেখিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, আর আমি পালিয়ে এলুম?

কাকাবাবু বললেন, আমাকে কি এত সহজে ধরে আনা যায়? আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই এসেছি। দেখাই যাক না। এদের কাণ্ড-কারখানাটা কী।

এবারে একটা টিউবলাইট হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরে এল রাজকুমার। সেই আলোয় দেখা গেল, ঘরটা বেশ বড়, দুপাশে দুটি খাট, মাঝখানে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। ঘরে একটাও জানলা নেই, দেয়ালে সাদা-সাদা তুলোর মতন কী যেন লাগানো। বোঝা যায়, বিশেষভাবে ঘরটা তৈরি।

বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে রাজকুমার বলল, একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি।

কাকাবাবু ক্ৰাচ দুটো দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে খাটে বসলেন। কোনও জানিলা নেই বলে ঘরটায় বেশ গরম। একটা পাখা আছে বটে, কিন্তু এখন বিদ্যুৎ নেই বলে সেটা চলছে না।

কাকাবাবুর বাঁ পায়ে একেবারেই শক্তি নেই, তবু তিনি সেই পায়ে গোলমতন একটা জুতো পরে থাকেন। ডান পায়ে স্বাভাবিক জুতো। তিনি জুতোর ফিতে খুলতে-খুলতে বললেন, তুইও জুতোমোজা খুলে ফ্যাল, সন্তু, রাত্তিরটা তো এখানেই থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

রাজকুমার ফিরে এসে বলল, আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করে এলুম। এবারে নিশ্চিন্তে বসে কথা বলা যাবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আপনাদের খাবার এসে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কী খাব জিজ্ঞেস করলেন না তো? আমি রাত্তিরে রুটি খাই।

রাজকুমার বলল, ভাত আর রুটি দুরকমই থাকবে। যেটা ইচ্ছে খাবেন। আর মাংস।

কাকাবাবু বললেন, মাংসতে যেন ঝাল না দেয়। ত্রিপুরার লোক বড় ঝাল খায়। আমি আজকাল ঝাল খেতে পারি না।

রাজকুমার বলল, না, না, একদম ঝাল নেই। এখানে ইওরোপিয়ান স্টাইলে রান্না হয়। স্টু-এর মতন।

সেই সঙ্গে খানিকটা স্যালাড।

হ্যাঁ, স্যালাড তো থাকবেই। আর যদি সুইট ডিশ কিছু চান…

সন্তুর মনে হল কাকাবাবু যেন কোনও হোটেলে এসে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন। অথচ রাজকুমারের হাতে এখনও রিভলভার ধরা।

রাজকুমার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলল, আপনাদের ডাবলি বেডঘর দিয়েছি। থাকার কোনও অসুবিধেই হবে না। সঙ্গে অ্যাটাচুড বাথরুম আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিতদিন থাকতে হবে? ব্যবস্থা তো বেশ ভালই দেখছি।

রাজকুমার বলল, থাকুন না। আমি তো বলেছি, ব্যস্ত হবার কিছু নেই।

ত্রিপুরা ছেড়ে এখন এখানেই থাকা হয় নাকি? জেল থেকে বেশ তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিল তো।

হ্যাঁ, ইলেকশনের সময় ছাড়া পেয়ে গেলাম। ভেতরে কিছু কলকাঠিও নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। সেবারে খুব জব্দ করেছিলেন আমাদের।

তোমরা তো আমার কথা বিশ্বাসই করেনি। খুব গুপ্তধন-গুপ্তধন বলে লাফালে। শেষ পর্যন্ত জঙ্গলগড়ে গিয়ে দেখা গেল কিছুই নেই। মানে, টাকা পয়সা নেই, কিন্তু অন্য জিনিস ছিল, যার দাম তোমরা বুঝবে না।

সেবারে আমাদের হাত ফসকে খুব জোর পালিয়েছিলেন। আর আপনার ভাইপো এই ছেলেটা, ওঃ কী সাংঘাতিক বিচ্ছু!

কলকাতায় এখন কী করা হচ্ছে? ব্যবসা-ট্যবসা?

ঠিক ধরেছেন। অর্ডার সাপ্লাই-এর ব্যবসা করছি। চলছে বেশ ভালই। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই ভাবলুম, পুরনো দিনের গল্প-টল্প করা যাক।

আমি আবার পুরনো গল্প একদম ভালবাসি না। আমার সঙ্গে কি হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, না অন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল?

এসব জিনিস কি হঠাৎ হয়? আপনাকে রাস্তায় দেখলুম। আর টপ করে তুলে নিয়ে এলুম? আপনি হচ্ছেন রাজা রায়চৌধুরী, অতি ধুরন্ধর ভি আই পি। আপনার জন্য অনেক রকম বন্দোবস্ত করতে হয়েছে। বেশ কিছু টাকাও খরচ হয়ে গেছে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রাজকুমারের মুখের দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, শুধু আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য এত ব্যাপার? টাকা খরচও করতে হয়েছে? কেন, আমাকে কি মেরো-টেরে ফেলার ইচ্ছে আছে নাকি তোমার?

রাজকুমার হেসে বলল, আরে না, না। ওসব কী বলছেন? পুরনো শক্ৰতা অত আমি মনে রাখি না। খুন-টুনের মধ্যে আমি এখন নেই। বললুম না, এখন আমি ব্যবসা করছি।

চেয়ার ছেড়ে উঠে রাজকুমার বলল, আচ্ছা, আবার কাল গল্প হবে। আজ আমি টায়ার্ড। তা ছাড়া খুব খিদেও পেয়ে গেছে। শুনুন, বাইরে টাইগার নামের লোকটি রাত্তিরে সব সময় থাকবে। ভুলেও কিন্তু ওকে ডাকবেন না। ও আমার কথা ছাড়া আর কারুর কথা শোনে না। কেউ ওকে কোনও কিছুর জন্য রিকোয়েস্ট করলে ও তার মাথায় ডাণ্ডা মারে! ওর কাছে একটা রবারের ডাণ্ডা আছে। সেটা দিয়ে মারলে রক্ত বেরোয় না, কিন্তু লাগে ভীষণ।

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমিও টায়ার্ড, খাবারটা এলে খেয়ে শুয়ে পড়ব। টাইগারকে ডাকার দরকারই হবে না। আচ্ছা, একটা ব্যাপার জানার কৌতূহল হচ্ছে।

রাজকুমার বলল, কৌতূহল কক্ষনো চেপে রাখতে নেই। পেট ফুলে যায়। বলে ফেলুন, বলে ফেলুন!

কাকাবাবু বললেন, আজি সন্ধেবেলা যে আমি আনোয়ার শা রোডে আসব, সেটা তুমি জানলে কী করে? আমার তো আসবার ঠিক ছিল না!

রাজকুমার বলল, ও, এই ব্যাপার? এটা আর এমন শক্ত কী? দিন দশেক ধরে আপনার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়েছিল। আপনি তো মশাই আচ্ছা! ঘরকুনো লোক। বাড়ি থেকে বেরুতেই চান না!

সকালবেলা একবার পর্কে ঘুরে আসতে যাই।

সে-সময় পার্কে অনেক লোক থাকে। তা ছাড়া, দিনের বেলা এসব কাজ হয় না।

ওই পার্কেই একবার একজন আমার পিঠে গুলি করেছিল?

না, না, আমি ওই সব গুলি-ফুলির মধ্যে নেই। মানে নেহাত দরকার না। পড়লে.যেমন এখন আপনি পালাবার চেষ্টা করলে আমায় গুলি চালাতেই হবে। কিন্তু সেটা আশা করি আপনিও চাইবেন না, আমিও চাইব না।

না, না, পালাবার চেষ্টা করব কেন? যখন যেতে ইচ্ছে হবে, তখন নিজেই চলে যাব, সেটাই তো ভাল, তাই না?

রাজকুমার আটহাসি করে উঠল। কাকাবাবুও হাসলেন। সন্তু ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই রকম বিপদের মধ্যেও কাকাবাবুইয়ার্কির সুরে কথা বলছেন! কাকাবাবুর যে কী উদ্দেশ্য সেটাই সে বুঝতে পারছে না।

কাকাবাবু আবার বললেন, দিন-দশেক ধরেন আমার বাড়ির সামনে লোক রেখেছিলে? খুব গরজ দেখছি? কী ব্যাপার?

রাজকুমার বলল, হ্যাঁ, গরজ একটু ছিল বটে। আপনি সকালবেলা একবার পার্কে যান, আর সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকেন। বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলুম। সেই জন্য আপনার জন্য একটা টোপ ফেলতে হল।

টোপ?

এখন ওসব কথা থাক। আবার কাল সকালে গল্প হবে। আপনাদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবার পর ব্যাটারি-লাইটটা কিন্তু নিয়ে যাব।

লোকটি দরজার একটা পাল্লা খুললে কাকাবাবু বললেন, তুমি কিসের ব্যবসা করছ, সেটা তো বললে না?

সেটা সিক্রেট! পরে আস্তে-আস্তে সবই জানতে পারবেন। গুডনাইট মিঃ রায়চৌধুরী! গুডনাইট সন্তু!
দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর কাকাবাবু বললেন, কী রে, সন্তু, কেমন বুঝছিস?

ঠিক ভয়ে নয়, দুশ্চিন্তায় সন্তুর মুখটা শুকিয়ে গেছে। জোর করে মুখে একটা ফ্যাকাসে হাসি ফুটিয়ে বলল, লোকটা খুব সাংঘাতিক। কী রকম সাপের মতন তাকায়?

কাকাবাবু বললেন, আমার ওপর ওর খুব রাগ আছে। তোর ওপরেও আছে। আমাদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়নি, অনেক প্ল্যান করে ধরে এনেছে। তার মানে, শুধু আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতেই চায় না, ওর অন্য কিছু প্ল্যান আছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, ও আমাদের গায়ে হাত তোলেনি একবারও। মারধোর করেনি।

সন্তু বলল, আমাদের বন্দী করে রেখে ওর কী লাভ? তাও এই কলকাতা শহরে?

কাকাবাবু বললেন, সেইটাই তো জানতে হবে। এই জায়গাটা কোথায় বুঝতে পারছিস? গড়িয়া ছাড়িয়ে এসে ডান দিকে বেঁকল। খুব সম্ভবত এটা বোড়ালের কাছাকাছি। বোড়ালের নাম শুনেছিস তো? আগে এটা একটা গ্রাম ছিল। মনীষী রাজনারায়ণ বসু এখানে জন্মেছিলেন। এই বোড়াল গ্রামে সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালি ফিলামের শুটিং করেছিলেন। আমি সেই শুটিং দেখতে এসেছিলুম। সুতরাং এখান থেকে বেরুলে আমাদের রাস্তা খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হবে না, কী বল?

সন্তু অবাক হয়ে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কাকাবাবু এখান থেকে বেরুবার কথা ভাবছেন কী করে? নীচের বাগানে একটা নেকড়ে বাঘের মতন কুকুর ঘুরছে। তিনতলায় গেরিলার মতন চেহারার একটা লোক পাহারা দিচ্ছে, তার নাম টাইগার। তার ওপর রয়েছে রাজকুমার। ঘরে একটাও জানলা নেই, এই রকম জায়গা থেকে বেরুবার কোনও উপায়ই তো সন্তু দেখতে পাচ্ছে না।

কাকাবাবু সন্তুর মুখের অবস্থা দেখে তার কাঁধ চাপড়ে বললেন, কী রে, ঘাবড়ে গেলি নাকি? হবে, হবে, একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়ে যায়।

সন্তু পাশের বাথরুমটার দরজা ঠেলে উঁকি মেরে দেখল। এমনিতে বেশ পরিষ্কার মনে হল, কিন্তু বাথরুমের জানলা নেই। জানলা একটা ছিল, সিন্টলের পাত দিয়ে সেটা পাকাপাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সন্তু বলল, বাথরুমের জানলাও বন্ধ!

কাকাবাবু বললেন, তাতে কী হয়েছে? ওপরের দিকে চেয়ে দ্যাখ, ছোট একটা ঘুলঘুলি আছে, সাফোকেশন হবে না। জানলা থাকলেই বা কী হত, আমি খোঁড়া মানুষ, আমি কি আর জানলা ভেঙে, পাইপ বেয়ে পালাতে পারতুম!

আলোটা তুলে নিয়ে সারা ঘর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে কাকাবাবু আবার বললেন, এই ঘরেও আগে তিনটে জানলা ছিল, সেখানে দেয়াল গেথে দিয়েছে। দ্যাখ, দেয়ালের রঙের একটু তফাত আছে। তার মানে এই বন্দিীশালার ব্যাপারটা নতুন। আমি একটা কথা ভাবছি, এ বাড়িতে কি আরও অনেক বন্দী আছে? লোকটার কথাবার্তা শুনে যেন সেই রকমই মনে হল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, রাজকুমার যে বলল, আপনার জন্য টোপ ফেলেছে, তার মানে কী?

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, সেটাও তো বুঝলাম না রে! আমি কি মাছ যে টোপ দেখলেই গিলে খাব? লোকটা বড় চালাক-চালাক কথা বলতে শিখেছে।

বাইরে খুব জোরে-জোরে কুকুরের ডাক আর একটা কোনও গাড়ির শব্দ শোনা গেল। খুব সম্ভবত মোটরবাইক।

কাকাবাবু দেয়ালের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, দেয়ালগুলো সাউন্ডপুফ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু খুব একটা সুবিধের হয়নি। এই তো বেশ শব্দ শোনা যাচ্ছে!

সন্তু বলল, দরজার গায়েও একটা গোল গর্ত রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, ওটা বাইরে থেকে কথা বলবার জন্য।

সন্তু কাছে গিয়ে গর্তটার গায়ে চোখ লাগিয়ে দেখল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ গর্তের ওপাশটা কিছুদিয়ে ঢাকা আছে এখন।

সন্তু সেই গর্তে মুখ লাগিয়ে চেঁচিয়ে বলল, একটু জল চাই! খাবার জল?

কেউ কোনও উত্তর দিল না। জলও এল না।

কাকাবাবু খাটের ওপর এলিয়ে বসে বললেন, যখন খাবার দেবে, তখন নিশ্চয়ই জল দেবে। কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে থাক।

খাটের ওপর শুধু একটা তোশক আর বালিশ পাতা। চাদর বা সুজনি টুজনি কিছু নেই। সন্তু খাটের ওপর চুপ করে বসে রইল। একটা ব্যাপারে তার অদ্ভুত লাগছে। বাইরে নানান জায়গায় গিয়ে সে আর কাকাবাবু অনেকবার ভয়ংকর-ভয়ংকর বিপদে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু কলকাতার মধ্যে কেউ তাদের এরকমভাবে বন্দী করে রাখবে, সেটা যেন এখনও বিশ্বাসই করা যাচ্ছে না। কলকাতায় তাদের কত চেনা শুনো, পুলিশের বড়কর্তারা কাকাবাবুকে কত খাতির করে, অথচ কিছুই করা যাচ্ছে না। একটা লোক তাদের গাড়িতে তুলে রিভলভার দেখিয়ে ধরে আনল, ব্যাস! এখন লোকটা ইচ্ছে করলেই তাদের মেরে ফেলতে পারে।

কাকাবাবু এখান থেকে উদ্ধার পাবার কী প্ল্যান করেছেন কে জানে। কিছুই তো বলছেন না!

খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবার পর হঠাৎ দরজার গায়ে গর্তটার ওপাশের ঢাকনা সরাবার শব্দ পাওয়া গেল। তারপর একজন বলল, খানা আ গিয়া। তুম লোগ সামনের দেওয়াল সাঁটকে খাড়া হয়ে যাও। মাথার ওপর হাঁথ তুলো।

কাকাবাবু বললেন, যা বলছে সেটা শোনাই ভাল। নইলে খাবার দিতে দেরি করবে।

তুললেন। সন্তুকেও দেখাদেখি তা-ই করতে হল। এই অবস্থাতেও সন্তুর মনে হল, তারা দুজন যেন গৌর-নিতাই।

দরজাটা খুলে গেল আস্তে-আস্তে। প্রথমে ঢুকল একজন বেঁটেমতন লোক, তার হাতে খাবারের পাত্র। তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল টাইগার। বেঁটে লোকটির পেছনে রয়েছে বলেই তাকে অনেক বেশি লম্বা-চওড়া দেখাচ্ছে। তার মুখখানা তামাটে রঙের। ভারতবর্ষের ঠিক কোন অঞ্চলের লোক সে, তা বোঝা যাচ্ছে না!

খাবার-টাবারগুলো সাজিয়ে দেওয়া হলে পর কাকাবাবু বললেন, জল কোথায়? আমাদের জল লাগবে!

বেঁটে লোকটি ভাড়ভেড়ে গলায় বলল, পাবে, পাবে সব পাবে, ব্যস্ত হচ্ছে কেন?

ওইটুকু চেহারার একটা লোক কাকাবাবুর মতন মানুষকে তুমি, তুমি বলে ধমকে কথা বলছে শুনে রাগে গা জ্বলে গেল সন্তুর। তার ইচ্ছে হল তক্ষুনি লোকটাকে একটা রুদা মারতে। কোনওক্রমে সে ইচ্ছেটা চেপে রাখল।

বেঁটে লোকটি আর একবার গিয়ে জল নিয়ে এল দুগেলাস।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, রাত্তিরে যদি আমাদের আরও জল লাগে?

বেঁটে লোকটি বলল, তখন বাথরুমের কলের জল খাবে! এটা কি বাপের হোটেল পেয়েছ নাকি..? আবদার!

সন্তু কাকাবাবুর দিকে তাকাল। কাকাবাবু মুচকি-মুচকি হাসছেন।

টাইগার বলল, আরো এ শম্ভো, এত বাত কিসের। আব তুই যা।

তারপর সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, খেয়ে লিন, তারপর মজেসে ঘুম মারুন। দেখবেন এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে যাবে। ই সব বাসনপত্র সব কাল সোকালে নিয়ে যাবে।

সে আস্তে-আস্তে পিছিয়ে বাইরে বেরিয়ে বন্ধ করে দিল দরজা।

রাজকুমার যা বলেছিল, খাবারটা মোটেই সে-রকম ভাল কিছু নয়। দুটো স্টিলের থালায় খানিকটা করে ভাত আর রুটি। দুটো ছোট্ট ছোট্ট টিনের বাটি, পাড়ার নাপিতেরা যে-রকম বাটিতে দাড়ি কামাবার জল নেয়, সেই রকম বাটিতে দুএক টুকরো মাংস আর ঝোল, একটুখানি করে পেঁয়াজ আর গাজর মেশানো স্যালাড। আর একটা বাটিতে সাদা থকথকে মতন একটা জিনিস, সেটা বোধহয় পুডিং, সেটা একেবারে অখাদ্য।

কাকাবাবু সেই খাবারই বেশ মন দিয়ে খেলেন। তারপর বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বললেন, এবারে শুয়ে পড় সন্তু! আর তো কিছু করবার নেই। কাল সকালে যা-হয় দেখা যাবে।

সন্তু বলল, রাজকুমার যে বলেছিল আলোটা নিয়ে যাবে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাই বলেছিল বটে। এখন যদি না নিতে চায় তা হলে থাক।

কাকাবাবু একটা হাই তুললেন।

দরজাটা খুলে গেল আবার। ক্লিপিং সুট পরে ঘরে ঢুকল রাজকুমার। তার এক হাতে রিভলভার, অন্য হাতে টর্চ।

সে বলল, ভাল করে খেয়েছেন তো। রান্না কেমন হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি আলোটা নিয়ে যাও, আমার ঘুম পেয়ে গেছে। রাজকুমার বলল, হ্যাঁ, ভাল করে খাবেন আর ঘুমোবেন। শরীরটা ঠিক রাখবেন। আপনার শরীর যদি খারাপ হয়, তা হলে খদের চটে যাবে।

খদের শব্দটা শুনে সন্তু আর কাকাবাবু দুজনেই অবাক হয়ে একসঙ্গে মুখ তুলে তাকাল।

রাজকুমার বলল, বুঝতে পারলেন না তো! আপনাকে এত মেহনত করে ধরে আনলুম কেন? আমার একটা স্বাৰ্থ আছে বুঝতেই পারছেন? আপনাকে আমি বিক্রি করে দেব।

কাকাবাবু কৌতুকের সুরে বললেন, বিক্রি? আমাকে? সাতচল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, একটা পা খোঁড়া, আমার মতন একজন অপদার্থ মানুষকে কে কিনবে?

রাজকুমার, বলল, সে আপনাকে ভাবতে হবে না। খদ্দের তৈরি আছে। ভাল দাম দেবে। সেইজন্যই তো আপনার যাতে অসুখ-বিসুখ না হয় সেটা দেখা দরকার।

তারপর সন্তুর দিকে ফিরে বলল, এ-ছেলেটার জন্যও খদ্দের পাওয়া যাবে। আরব দেশে পাঠিয়ে দেব!

কাকাবাবু বললেন, এটাই তোমার ব্যবসা? অর্ডার সাপ্লাই?

রাজকুমার ঠোঁট ফাঁক করে নিঃশব্দে হেসে বলল, দেখলেন তো, বলে ফেললুম? কোনও কথা পেটে চেপে রাখতে পারি না। হ্যাঁ, আজকাল এই ব্যবসাই করছি।

কাকাবাবু বললেন, একজন রাজার ছেলের পক্ষে চমৎকার ব্যবসা!

রাজকুমার বলল, তা যা দিনকাল পড়েছে, এখন বাঘে ঘাস খায় আর ব্ৰাহ্মণরাও জুতোর ব্যবসা করে। তবে কী জানেন, গরু ছাগল বিক্রির চেয়ে মানুষ বিক্রির কাজটা অনেক সহজ। লাভও বেশি।

টাৰ্চটা পকেটে ভরে সে এক হাতে লণ্ঠনটা তুলে নিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, যাঃ, আসল কথাটাই বলা হয়নি, যে-জন্য এলুম! হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। আপনাকে তো এখন বাইরে বেরুতে হচ্ছে না, সুতরাং ক্রাচ দুটো এ-ঘরে রাখার দরকার নেই। ও দুটো আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঘরের মধ্যে আপনি এমনিই চলাফেরা করতে পারবেন।

কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে হলে নিয়ে যেতে পারে। যথাসময়ে আবার আমাকে ফেরত দিও!

রাজকুমার বলল, হ্যাঁ, যথাসময়ে!

রাজকুমার ক্রাচ দুটো নিজের বগলে চেপে পেছন ফেরা মাত্র সন্তু এক দুঃসাহসিক কাণ্ড করল। সে বিদ্যুদ্বেগে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজের পা দুটো রাজকুমারের পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে কাঁচির মতন ফাঁক করে দিল। রাজকুমার দাঁড়াম করে আছড়ে খেয়ে পড়ল সামনে।

ব্যাপারটা দেখে কাকাবাবুও চমকে উঠলেন। রাজকুমারের হাত থেকে টিউব বাতিটা ছিটকে গেছে, ক্রাচ দুটোও পড়ে গেছে, কিন্তু রিভলভারটা সে ছাড়েনি।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র, সে হাতটা একবার তুলতে পারলে আর নিষ্কৃতি নেই।

কাকাবাবু এঁটো স্টিলের থালা একটা তুলে নিয়ে সেই হাতটার ওপর মারলেন সজোরে। রিভলভারটা গড়িয়ে চলে গেল খাটের তলায়।

রাজকুমার রিভলভারটা উদ্ধার করার চেষ্টা করল না, মুখে আর হাতে চোট লাগা সত্ত্বেও সে মাথা ঠিক রেখেছে। সে গড়িয়ে চলে গেল দরজার দিকে। সন্তু সঙ্গে সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে রিভলভারটা চেপে ধরে বলল, পেয়েছি।

ততক্ষণে রাজকুমার বেরিয়ে গেছে বাইরে। দাড়াম করে শব্দ হল দরজাটা বন্ধ করার।

গোল গর্তটা দিয়ে রাজকুমার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শয়তানের বাচ্চা, আমার সঙ্গে চালাকি? থাক আজ রাত্তিরটা, তারপর কাল সকালে দেখাব মজা তোদের। রবারের ডাণ্ডার মোর খেতে কেমন লাগে বুঝবি?

কাকাবাবু স্থির হয়ে বসে আছেন। রাজকুমার থেমে যাওয়ার পর তিনি বললেন, এ কী করলি, সন্তু? ইশ! এতে কী লাভ হল?

খাটের তলা থেকে রিভলভারটা নিয়ে বেরিয়ে আসার পর সন্তু ভেবেছিল, কাকাবাবু তার বুদ্ধি আর সাহসের প্রশংসা করবেন। কিন্তু কাকাবাবুর কথার মধ্যে মৃদু ভৎসনা শুনে সে ঘাবড়ে গেল।

সে কাচুমাচুভাবে বলল, ওই লোকটা তোমার সঙ্গে খারাপভাবে কথা বলছিল, তাতেই আমার রাগ হয়ে গেল। আমি আর মেজাজটা ঠিক রাখতে পারলুম না!

ওটা কিসের প্যাঁচ? কুংফু না ক্যারাটে? প্যাঁচ শিখেছিস বলেই কি যখন-তখন সেটা দেখাতে হবে?

ও তোমার নাকের সামনে সব সময় রিভলভারটা তুলে রেখেছিল কেন?

এখন কী করবি? এর পর তো ও রাইফেল-টাইফেল নিয়ে আসবে।

ওকে আমি এ-ঘরে আর ঢুকতেই দেব না!

এ-ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় না। ওরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, ওরা যখন-তখন ঢুকে পড়তে পারে। শোন, চোর-ডাকাতদের সামনে এসে কক্ষনো মাথা-গরম করতে নেই। ওদের সঙ্গে কি আমরা বন্দুক-পিস্তল নিয়ে লড়াই করতে পারব? তা পারব না। সব সময়েই ওদের শক্তি বেশি হয়। ওদের সঙ্গে লড়াই করতে হয় এই জায়গাটা দিয়ে।

কাকাবাবু নিজের মাথায় দুবার টোকা দিলেন।

সন্তু বলল, আমি সারা রাত জেগে থাকব।

কাকাবাবু একটা হাই তুলে বললেন, দ্যাখা পারিস কি না!

একজন কেউ হাই তুললেই কাছাকাছি অন্যজন হাই তোলে। সন্তু শুধু হাই তুলল না, সেই সঙ্গে তার চোখ বুজে এল।

তুই-তো এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছিস দেখছি!

সন্তু আচ্ছন্ন গলায় বলল, না, আমি জেগে থাকব।

তবু একটু পরেই আবার চোখ বুজে ফেলল সন্তু। মাথাটা বুকে এল। কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তাঁর নিজেরও চোখ টেনে আসছে। সন্তু এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়ছে কেন, এটা অস্বাভাবিক।

সন্তু অতি কষ্টে চোখ খুলে বলল, আমার এ কী হচ্ছে? আমি কিছুতেই চোখ চাইতে পারছি না। আমায় বিষ খাইয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, আমারও তো একই অবস্থা দেখছি। খাবারের সঙ্গে নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। মানুষ বিক্রি করা যার ব্যবসা সে শুধু শুধু বিষ খাইয়ে আমাদের মারবে কেন?

এর পর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওরা দুজন ঘুমে ঢলে পড়ল। সন্তু মেঝেতে বসে ছিল, সে আর খাটেও উঠতে পারল না, শুয়ে পড়ল সেখানেই।
ঘুম ভাঙার পর সন্তুর প্রথমেই মনে হল, বেঁচে আছি না মরে গেছি?

চারদিকে মিশমিশে অন্ধকার। দিন না। রাত্রি তা বোঝার উপায় নেই। কোথায় সে শুয়ে আছে?

পাশ ফিরতে গিয়েই সন্তু টের পেল তার হাত আর পা বাঁধা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

আস্তে-আস্তে তার আগেকার কথা মনে পড়ল। রিভলভারটা? যাঃ, রাজকুমারের কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে কোনও লাভই হল না। যারা তার হাত-পা বেঁধেছে, তারা নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে গেছে! এ-ঘরে যে একটা ব্যাটারির আলো ছিল, সেটাও নেই।

কাকাবাবু কোথায়?

সন্তু অতি কষ্টে উঠে বসল। হাতদুটো পিঠের দিকে মুড়ে বেঁধেছে, তাই টনটিন করছে কাঁধের কাছে। কাকাবাবু কোথায়?

সন্তু কাকাবাবুর নাম ধরে ডাকতে গেল, কিন্তু কোনও শব্দ শোনা গেল না। তার মুখও বাঁধা।

কাকাবাবুও কি কাছাকাছি কোথাও এরকম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছেন? এখনও ঘুম ভাঙেনি? সন্তু কান খাড়া করল, কোনও নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় কি না! কোনও শব্দ নেই। সন্তুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কাকাবাবু আর সে আলাদা হয়ে গেছে? কাকাবাবুকি নিজেই কোথাও চলে গেছেন? না, তা অসম্ভব!

কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছে, তাও বুঝতে পারছে না। সে। কিন্তু বেশ খিদে পেয়েছে। মাঝখানে কি গোটা একটা দিন কেটে গিয়ে আবার রাত এসে গেছে?

কিছুই করবার নেই, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া।

প্রত্যেকটা মুহূৰ্তকে মনে হচ্ছে বিরাট লম্বা। সন্তু মনে-মনে এক দুই গুনতে লাগল। এতে তবু সময় কাটবে।

চার হাজার পর্যন্ত গোনার পর সন্তুর আর ধৈর্য রইল না; কেউ কি তা হলে আসবে না? কিংবা রাজকুমারের লোকেরা তাকে একটা পাতাল-গুহায় ফেলে রেখে গেছে, এখান থেকে আর উদ্ধার পাবার আশা নেই? কিংবা এই জায়গাটারই নাম নরক?

আর একটা নতুন বিপদ দেখা দিল। সন্তুর দারুণ বাথরুম পেয়ে গেছে। হাত-পা বাঁধা, সে বাথরুমে যাবে কী করে? এবারে সন্তুর ডাক ছেড়ে কান্নার উপক্রম।

ঠিক এই সময় দরজা খুলে গিয়ে আলো ঢুকতেই সন্তু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে টাইগার। তার বিশাল চেহারা প্ৰায় পুরো দরজাটা ঢেকে দিয়েছে।

টাইগার বলল, ঘুম ভাঙ্গিয়েসে? ওরে বাপ রে বাপ, কী ঘুম, কী ঘুম! হামি তিন-তিনবার এসে দেখে গেলাম! আভি আখি খুলেসে?

টাইগার কোমর থেকে একটা ছুরি বার করে এগিয়ে এল সন্তুর দিকে।

এতক্ষণ পর একজন মানুষকে দেখেই সন্তুর ভাল লেগেছিল। হঠাৎ আলোতে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চোখটা ঠিক হতেই সে দেখল টাইগারের হাতে ছুরি। বাধা দেবার কোনও উপায় নেই। তা হলে এটাই কি তার শেষ মুহূর্ত?

টাইগার কিন্তু কাছে এসে সেই ছুরি দিয়ে ঘাঁচ-ঘ্যাঁচ করে কেটে দিল সন্তুর হাত আর পায়ের বাঁধন। সন্তুর তখন শুধু একটাই চিন্তা। মুখের বাঁধন খোলার আগেই সে হাত দিয়ে বাথরুমের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে কাতর শব্দ করতে লাগল।

টাইগার হেসে বলল, যাও, গোসল করকে আও!

সেদিকে ছুটে যেতে যেতে সন্তু ভাবল, টাইগারের মতন ভাল মানুষ আর হয় না। সে একজন দেবদূত!

বাথরুমে ঢুকে সন্তু নিজেই খুলে ফেলল মুখের বাঁধনটা।

খানিকটা বাদে সন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে দেখল টাইগার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত দিয়ে। মুখে মিটমিটি হাসি।

সে বলল, আরে লেড়কা, তুই কাল হামার সাহেবকে লাথ মেরেছিস? মাহেবের হাঁথি থেকে তুই পিস্তল ছিনাকে লিয়েছিস? বা রে লেড়কা, বাঃ, তোর তগত আছে।

থাবার মতন হাত দিয়ে সে থাবড়ে দিল সন্তুর পিঠ।

শত্রুপক্ষের কাছ থেকে এরকম প্ৰশংসা পেয়ে সন্তু খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল। টাইগার হয়তো ততটা শত্রুপক্ষ নয়, তার ব্যবহারে তো খারাপ কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাজকুমার মিথ্যেমিথ্যি ভয় দেখিয়েছিল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাইগারজি, আমার কাকাবাবু কোথায়?

টাইগার বলল, খোঁড়াবাবুকা তো খদের মিলে গেল, তাই ঝটপট বিক্রি ভি হয়ে গেল। লেকিন তোমার তো খদের আখুনো মেলেনি!

কাকাবাবু বিক্রি হয়ে গেছেন?

চলো, নীচে চলো। সাহেব তুমাকে বুলাচ্ছেন।

কাকাবাবু কাকাবাবু যাবার সময় আমাকে কিছু বলে গেলেন না?

তুমি তো তখন ঘুমাচ্ছিলো! চলো, বাহার আও!

নিশ্চয়ই খুব বেশি ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল তাকে। তাই মাথাটা এখনো টলছে। ঘরের বাইরে এসে সন্তু দেখল একটা বেশ টানা বারান্দা, সেখানে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে এখন। বারান্দার দুপাশে তিনটে তিনটে ছটা ঘর, একেবারে শেষে একটা জানলা। সেই জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয়। সদ্য সন্ধে হয়েছে।

সন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেল। কাল মাঝরাত্তির থেকে সে আজ সন্ধে পর্যন্ত ঘুমিয়েছে? সকাল, দুপুর কিছু টের পায়নি? এরকম তার জীবনে হয়নি। আগে।

কোণের আর-একটা ঘরের দরজা খোলা, বাকি সব বন্ধ। সেই ঘরগুলোতেও কি বিক্রির জন্য মানুষদের বন্দী করে রাখা হয়েছে?

টাইগার একটা টুল দেখিয়ে সন্তুকে বলল, বৈঠ যাও!

সেই টুলের পাশেই পড়ে রয়েছে একটা রবারের গদা। যা দিয়ে মারলে রক্ত বেরোয় না, কিন্তু সাংঘাতিক লাগে!

একটা দেয়াল-আলমারি থেকে টাইগার একগোছা দড়ি বার করতে করতে বলল, সাহেব তুমাকে নীচে ঝুলিয়েছেন, গাড়ি ভি তৈয়ার। মনে তো হচ্ছে, তোমার খদের মিলে গেল। দাও, হাঁথি বাড়াও!

টাইগার আবার তার হাত বাঁধবে। আপত্তি করে কোনও লাভ নেই; কোনও রকম গোলমাল করার শক্তিও নেই এখন সন্তুর। সে বাধ্য ছেলের মতন বাড়িয়ে দিল তার হাত দুটো।

ঠিক আগের মতনই হাতদুটো পেছন দিকে মুড়ে খুব শক্ত করে বাঁধা হল। তারপর পা। মুখটা বাঁধা হবে একটা বড় স্কার্ফের মতন কাপড় দিয়ে। সেটা আনতেই সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাইগারজি, সত্যি আমাকে বিক্রি করে দেবে?

টাইগার বলল, হ্যাঁ! তুমার ভয় লাগছে নাকি? আরে লেড়কা, তোমার তগত আছে, ভয় কী? আরব দেশে যাবে, বহোত রূপেয়া কামাবে, মাংস খাবে, খেজুর খাবে, ভাল থাকবে। এখানে কী আছে?

এমন আদর করে সে বলছে কথাগুলো যেন সে সন্তুকে মামাবাড়ির দুধভাত খাওয়াতে পাঠাচ্ছে।

এরা তাকে আরব দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছে শুনে সন্তুর ভয় হচ্ছে না। কিন্তু কাকাবাবুকে আর তাকে আলাদা আলাদা জায়গায় পাঠানো হবে কি না, সেইটাই তার প্রধান চিন্তা।

পা বাঁধা অবস্থায় সন্তু হটতে পারবে না। টাইগার অবলীলাক্রমে তাকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

একতলার উঠোনে আজ রয়েছে একটা স্টেশান ওয়াগান। তার সামনে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার। বিশাল কুকুরটা তার পায়ে মাথা ঘষছে। রাজকুমারের কপালে একটা স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো।

টাইগার সন্তুকে নামিয়ে দিতেই রাজকুমার ধমকে জিজ্ঞেস করল, এত দেরি হল কেন? আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি!

টাইগার বলল, এ লোড়কা গোসল করতে গেল যে!

সন্তুর সঙ্গে রাজকুমারের চোখাচোখি হতেই রাজকুমারের মুখটা রাগে বিকৃত হয়ে গেল। সে এগিয়ে আসতে-আসতে দাঁত কিড়ামিড় করে বলল, হারামজাদা ছেলে! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি শেষ করে দিই!

কাছে এসে সে সন্তুর বাঁ। গালে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরল।

সন্তুর চিৎকার করারও উপায় নেই। আগুনে পোড়ার জ্বালা অত্যন্ত সাংঘাতিক, তবু সন্তু চোখের জল আটকে রাখল। প্ৰাণপণে।

টাইগার এক টানে সন্তুকে সরিয়ে নিয়ে বলল, দাম কমে যাবে! খদ্দের কমতি দাম দেবে।

রাজকুমার বলল, নে, এটাকে গাড়িতে তোল!

টাইগার সন্তুকে উঁচু করে তুলে স্টেশন-ওয়াগনটার মেঝেতে শুইয়ে দিল। সন্তু চমকে উঠে দেখল, আগে থেকেই সেখানে আর-একজনকে শোয়ানো আছে। কিন্তু কাকাবাবু নয়। সন্তুরই বয়েসি একটি মেয়ে, ফ্রক পরা।

বিদ্যুৎ-চমকের মতন সন্তুর মনে হল, দেবলীনা?

রাজকুমার বলেছিল না যে কাকাবাবুর জন্য সে টোপ ফেলেছিল একটা? এই-ই তা হলে সেই টোপ! দেবলীনা কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, রাজকুমার নিজে কিংবা তার কোনও লোক সেটা লক্ষ্য করেছে। তারপর দেবলীনাকে ওরা চুরি করে নিয়ে গিয়ে ভেবেছে, নিশ্চয়ই কাকাবাবু দেবলীনার বাড়িতে খোঁজ নিতে যাবেন। ঠিক তাই-ই হয়েছে। দেবলীনার ঠিকানা জানা ওদের পক্ষে শক্ত কিছুই না। কাজ হয়ে গেছে, ওরা এখন দেবলীনাকেও বিক্রি করে দেবে!

মেয়েটি হয় ঘুমিয়ে আছে, অথবা অজ্ঞান। একেবারে নড়াচড়া করছে না।

একটু বাদে রাজকুমার উঠে এল গাড়ির মধ্যে। গাড়ি চালাবে অন্য কেউ। রাজকুমার একটা সিটের ওপর বসে হুকুম দিল, নাউ স্টার্ট।

তারপর রাজকুমার তার জুতোসুন্ধু পাটা তুলে দিল সন্তুর বুকের ওপর।

একজন মানুষের পা আর কত ভারী হতে পারে? সন্তুর মনে হচ্ছে, তার বুকের ওপর যেন একটা একশো কেজি ওজন চেপে আছে। প্ৰায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। রাজকুমার এর পর আর একটু জোরে চাপ দিলেই তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। অথচ বাধা দেবার কোনও উপায় নেই সন্তুর, সে অসহায়।

কাল রাত্তিরে রাজকুমারকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে রিভলভারটা কেড়ে নেবার চেষ্টাটা খুব ভুলই হয়েছে তার। সবচেয়ে বড় ভুল, সে শুধু রিভলভারটাই কাড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তারপর কী ঘটবে বা ঘটতে পারে সেটা ভাবেনি। এরকম ভুলের জন্য তার প্রাণটাও চলে যেতে পারত!

সেই ঘটনার আগে রাজকুমার অন্তত মৌখিক কিছু খারাপ ব্যবহার করেনি। শারীরিক অত্যাচারও করেনি। এখন সে শোধ তুলে নিচ্ছে।

গাড়ির জানলা দিয়ে যেটুকু দেখতে পাচ্ছে সন্তু, তাতে বুঝতে পারছে যে, তারা আবার শহরের মধ্যেই ঢুকছে। রাস্তায় আলো আছে, দুপাশে ঘেঁষাৰ্ঘেষি বাড়ি। তাদের অন্য কোনও নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। কী সাহস এদের! সন্ধেবেলা কলকাতার পথে-পথে অজস্র লোক, কত গাড়ি, মোড়ে-মোড়ে পুলিশ, তারই মধ্যে দিয়ে এরা হাত-মুখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে দুটি ছেলেমেয়েকে। চম্বলের ডাকাতরাও বোধহয় এত দুঃসাহসী নয়।

রাজকুমার আবার গুনগুন করে কী একটা গান গাইছে!

গাড়িটা চলছে তো চলছেই, গোটা কলকাতা শহরটাকে একেবারে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে চলেছে মনে হয়। হয়তো সন্তুদের বাড়ির পাশ দিয়েও যাচ্ছে। অদ্ভুত, অদ্ভুত ব্যাপার! মা-বাবা এতক্ষণ কী করছেন কে জানে!

বুকের ওপর কষ্টটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। গালের ছাঁকা-লাগা জায়গাটাতেও জ্বালা করছে। সন্তু পাশ ফেরার চেষ্টা করল, উপায় নেই। সে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।

গাড়িটা থামতেই সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল। রাজকুমার নেমে গেল। আগে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কেউ এল না। সন্তুর মনে হল তারা দুজন যেন মানুষ নয়, মালপত্র। অন্যদের সুবিধেমতন নামানো হবে।

একটু বাদে দুজন লোক এসে ওদের নামাল। সন্তু দেখল গাড়িটা ঢুকে এসেছে একটা গ্যারাজের মধ্যে। গ্যারাজের পেছনে একটা ছোট দরজা। সেই দরজা দিয়ে ওদের বয়ে নিয়ে যাওয়া হল দোতলায়। বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের, সিঁড়িগুলো মোর্বল পাথরের। ওপরের দালানেও সাদা-কালো চৌখুপ্লি পাথর বসানো!

একটা বেশ বড় ঘরে এনে ওদের শুইয়ে দেওয়া হল। সেই ঘরে গোটা চারেক জানলা, হাট করে খোলা। দুটো আলো জ্বলছে।

ধপধাপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিপর একজন মাঝবয়েসি লোক এসে ঢুকলেন ঘরে, হাতে একটা রুপো-বাঁধানো ছড়ি, ঠোঁটে পাতলা গোঁফ, মাথার কোঁকড়ানো চুলের মাঝখানে সিঁথি। আগেকার দিনের জমিদারদের মতন চেহারা।

তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে ওদের দেখলেন, তারপর তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, এই, ছেলেমেয়ে দুটোর বাঁধন খুলে দে! এঃ, কী বিচ্ছিরিভাবে বেঁধেছে। ওদের কি চোখের চামড়া নেই? খুলে দে, খুলে দে!

সন্তু বাঁধন-মুক্ত হয়ে উঠে বসে লোকটির দিকে চেয়ে রইল। তিনি ভুরু নাচিয়ে বললেন, কী, খিদে পেয়েছে? একটু বোসো, খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ওঁকে দেখলে গুণ্ডা-বদমাশ মনে হয় না একটুও, বরং সন্ত্রম জাগে। রাজকুমারের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে ধরে এনেছে কেন?

ভদ্রলোক বললেন, যা হয়েছে তা তো হয়ে গেছেই। আমার কাছে এসে পড়েছি, আর তোমাদের কোনও চিন্তা নেই। খাওয়া-দাওয়া করো, তারপর সব কথা হবে।

ভদ্রলোক চলে গেলেন, অন্য লোক দুটিও বাইরে বেরিয়ে গেল, খোলা রয়ে গেল। দরজাটা।

সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই গেল একটা জানলার ধারে। ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাজকুমার তাদের এইখানে পৌঁছে দিল, এবারে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি? তবে যে বলেছিল আরব দেশে পাঠাবে? কাকাবাবুর কী হল?

জানলার বাইরে একটা বাগান। সেখানে আলো নেই, ঘরের আলোতেই যেটুকু বোঝা যাচ্ছে। বাগানের শেষের দিকে একটা উঁচু পাঁচিল। বাগান দিয়ে দুজন লোক হেঁটে গেল। এটা যেন একটা স্বাভাবিক বাড়ি, বন্দিশালা বলে মনে হবার কোনও কারণ নেই। ঘরের দরজা খোলা, সেখানে কোনও পাহারাও নেই।

উঃ উঃ শব্দ শুনে সন্তু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। দেবলীনা ছটফট করছে। তার জ্ঞান ফিরে আসছে।

সন্তু দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মারল। কাছাকাছি কারুকে দেখা যাচ্ছে না। দোতলায় অনেকগুলো ঘর। চওড়া বারান্দাটা ডান দিকে আর বা দিকে বেঁকে গেছে।

সন্তু আবার ঘরের মধ্যেই ফিরে এল। এতটা স্বাধীনতা তাকে দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে কোনও ফাঁক থাকতে পারে। অপেক্ষা করেই দেখা যাক।

দেবলীনা শরীরটা মোচড়াচ্ছে, কিন্তু চোখ খুলছে না। একবার সে ফিসফিস ক:ে ালে উঠল, জল, জল খাব?

সন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনও জলের পাত্ৰ দেখতে পেল না। পাশেই বাথরুম রয়েছে। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। কল খুলে একটা কাচের জগে। করে খানিকটা জল এনে সে প্রথমে দেবলীনার চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল।

দেবলীনা এবারে চোখ মেলে বলল, কে? আমাকে মারছ কেন? আমায় মেরো না!

সন্তু চুপ করে রইল।

দেবলীনা নিজের মুখে হাত বুলোল। মুখ ঘুরিয়ে সারা ঘরটা দেখল, তারপর বলল, এই, আমার চশমা কোথায়? চশমা দাও!

সন্তু এবারেও কোনও উত্তর দিল না। সে বুঝতে পারছে, মেয়েটির এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

দেবলীনা বলল, চুপ করে আছ কেন? তুমি কে? আমার চশমাটা দাও!

সন্তু বলল, তোমার চশমা আমার কাছে নেই। আমার নাম সন্তু!

আর কোনও কথা হল না, এই সময় একটি লোক এল দু প্লেট খাবার নিয়ে। টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে খাওয়াতে মন দিল। খিদের সময় তার শরীর দুর্বল হয়ে যায়, মাথাও ঠিক কাজ করে না।

লোকটি আবার ফিরে গিয়ে জল নিয়ে এল।

দেবলীনা খাবারে হাত দেয়নি, সে একদৃষ্টি চেয়ে আছে সন্তুর দিকে।

সন্তু বলল, তোমার খিদে পায়নি? খেয়ে নাও!

দেবলীনা বলল, তোমার নাম সন্তু? মিথ্যে কথা! তুমি এখানে এলে কী করে? আমিই বা এখানে এলাম কী করে?

সন্তু বলল, আগে খেয়ে নাও!

আমি ডিম খাই না! আমি টেস্টও খাই না।

এখানে তুমি লুচি-মাংস কোথায় পাবে?

আমার কিছু চাই না। তুমি আমার খাবারটা খেয়ে নাও!

তুমি সত্যি খাবে না?

আমি আজেবাজে জায়গায় খাই না।

সন্তু দ্বিধা করল না, নিজের প্লেটটা শেষ করে সে দেবলীনার খাবারও খেতে শুরু করে দিল। তার মনে হল, মেয়েরা বোধহয় বেশি খিদে সহ্য করতে পারে। তার মা মাঝে-মাঝেই সারাদিন উপোস করে থাকেন।

সন্তুর খাওয়া শেষ হয়নি, বারান্দায় শোনা গেল। খট্‌খট্‌ শব্দ। সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুর শরীরে শিহরন হল। এই শব্দ তার খুব চেনা। কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ!

সত্যিই কাকাবাবু! সন্তু হাত থেকে আধা-খাওয়া টোস্টটা ফেলে দিল।

কাকাবাবু এক্ষুনি স্নান করেছেন মনে হচ্ছে, তাঁর মাথার চুল ভিজে। তিনি একলাই ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে আর কোনও লোক নেই। তিনি ওদের দেখে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, এই যে, তোরা এসে গেছিস? কেমন আছ দেবলীনা?

সন্তু বড়-বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি আগের ঘটনা সব দুঃস্বপ্ন ছিল, এখন তা কেটে গেছে?

দেবলীনা সন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?

সন্তুর এবার সন্দেহ হল, এই মেয়েটা সত্যিই দেবলীনা তো? কিংবা ওর মতন দেখতে অন্য কেউ?

কাকাবাবু কাছে এসে একটি চেয়ারে বসলেন। তারপর সন্তুকে বললেন, আমাকে ভোরবেলা ঘুমের মধ্যে এখানে নিয়ে এসেছে, বুঝলি? তাই তোকে জানিয়ে আসতে পারিনি। এখানে এসে জানতে পারলুম যে, দেবলীনাকেও ওরা ধরে রেখেছে।

দেবলীনা বলল, আপনি কাকাবাবু? আমি চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছি না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমার চশমাটা কোথায় গেল?

কাকাবাবু বললেন, তোমাদের বড় বেশি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল। সেইজন্যই ওরকম হচ্ছে। একটু বাদে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চশমাটা কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?

এই সময় একটা জাহাজের ভোঁ বেজে উঠল। খুব কাছে। সন্তু চমকে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, এ-বাড়িটা গঙ্গার একেবারে পাশে। রাত্তিরের অন্ধকারে চুপিচুপি অনেক কিছু জাহাজে তুলে দিতে পারে এখান থেকে।

দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, আমি বাড়ি যাব কখন?

কাকাবাবু হাসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে থুতনিটা ঘষতে-ঘষতে বললেন, তোমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে, না! দেখি, কী ব্যবস্থা করা যায়! দেবলীনা, তুমি আমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে যে, আমি তোমায় কোনও অ্যাডভেঞ্চারে নিয়ে যেতে চাই কি না! আর দ্যাখো, তোমার জন্যই আমি আর সন্তু কী রকম এক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়লুম। এরপর কী হয় কে জানে।

এই সময় খাকি প্যান্ট-শার্ট পরা একজন লোক এসে কাকাবাবুকে বলল, বাবু আপনাকে ডাকছেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে?

লোকটি আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল, চার তলায়?

কাকাবাবু মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে বললেন, আমার সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়, তা এরা কিছুতেই বুঝবে না! চলো, দেখি কী বলে!

দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, আমিও যাব?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এসো! তুমি এখানে এক-একা বসে থেকে কী করবে? যদি চোখে ভাল দেখতে না পাও, তা হলে সন্তু তোমাকে ধরে নিয়ে আসবে।

দেবলীনা বলল, এখন অনেকটা দেখতে পাচ্ছি।

খাকি পোশাক পরা লোকটি ঘরের বাইরে এসে বলল, আপনাকে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না। লিফট আছে, এদিকে আসুন।

কাকাবাবু বললেন, এরকম পুরনো বাড়ি, তাতেও লিফট! বেশ ভাল ব্যবস্থা তো!

সন্তুও অবাক হয়ে গেল। বড়-বড় থামওয়ালা বাড়ি, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, এখানেও লিফট?

দরজা খুলে লিফটে ঢুকে সন্তু আর একটা জিনিস দেখে অবাক হয়ে গেল। লোকটি বলল চার তলায় যেতে হবে, কিন্তু সে বোতাম টিপল ছ নম্বরের। আর লিফট গিয়ে ছ। তলাতেই থামল।

কাকাবাবুও নিশ্চয়ই এটা লক্ষ করেছেন। তিনি তাকালেন একবার সন্তুর দিকে।

লিফট থেকে নেমেই প্রথম যে ঘরটা চোখে পড়ল, সেখানে বসে আছে রাজকুমার আর টাইগার। রাজকুমার কায়দা করে সিগারেট টানছে। কাকাবাবু সেই ঘরের সামনে থমকে দাঁড়ালেন।

খাকি পোশাক পরা লোকটা বলল, এই ঘরে না, আপনি ডান পাশে চলুন। বাবু অন্য জায়গায় রয়েছেন।

কাকাবাবু রাজকুমারের দিকে আঙুল তুলে বললেন, তুমি চলে যেও না, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

রাজকুমার বলল, আমি চলে যাব? কেন? হা-হা-হা-হা! সে একেবারে অট্টহাস্য করে উঠল।
পাশের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে দেখতে পাওয়া গেল গঙ্গা। নৌকের ছোট-ছোট আলো। নীলচে আকাশে ছেড়া-ছোড়া সাদা মেঘ।

হঠাৎ সন্তুর মনে হল, সে যেন কতদিন আকাশ দেখেনি! একটা জানলাহীন ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তারপর হাত-পা-মুখ বেঁধে গাড়িতে করে কলকাতার একধার থেকে আর-একাধারে নিয়ে আসা হয়েছে। যেন কলকাতাটাও একটা জঙ্গল বা মরুভূমি বা পাহাড়ের গুহা।

কিন্তু এই জায়গাটা মোটেই ছাতলা উঁচু নয়। চারতলাই ঠিক। লিফটের বোতাম ওরকম কেন?

খাকি পোশাক পরা লোকটি যে ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, সেটা একটা ঠাকুরঘর। ভেতরে অনেক ঠাকুর-দেবতার ছবি ও মূর্তি, অনেক ফুল। একটা বাঘের চামড়ার আসনে বসে আছেন সেই ভদ্রলোক, কিন্তু এখন তাঁর সাজপোশাক অন্যরকম। তিনি পরে আছেন একটা টকটকে লাল রঙের কাপড়, খালি গায়ে সেই রঙেরই একটা চাদর জড়ানো। কপালে চন্দনের ফোঁটা।

তিনি চোখ বুজে পুজো করছিলেন। এতগুলো পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এই যে রায়চৌধুরীসাহেব, আসুন! দেখুন, আপনার ভাইপো এসে গেছে, ওই মেয়েটিকেও আনিয়েছি, ওদের খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ করে দিয়েছি। তা হলে আমার কথা রেখেছি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তা রেখেছেন।

লোকটি বলল, এবারে আপনার কাজ শুরু করে দিন। এই ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে এখন কী করবেন? বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন?

কাকাবাবু বললেন, তা মন্দ হয় না। ওরা আর শুধু শুধু এখানে থেকে কী করবে? সন্তু, তুই বাড়ি চলে যা!

সন্তু বলল, আমি এক? আর তুমি?

কাকাবাবু বললেন, আমাকে এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে।

সন্তু বলল, তা হলে আমি এখন যাব না। তোমার সঙ্গে যাব!

দেবলীনা বলল, আমিও যাব না, আমিও থাকব!

কাকাবাবু বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠে বললেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী চালাক দেখেছেন? ঠিক ধরে ফেলেছে। আপনি যে ওদের বাড়ি পাঠাবার নাম করে অন্য কোথাও নিয়ে আটকে রাখবেন, তা ওরা ঠিক বুঝে গেছে।

লোকটি অবাক হবার ভাব দেখিয়ে বলল, কেন, কেন, আমায় অবিশ্বাস করছেন কেন? বাচ্চা ছেলেমেয়ে, ওদের আটকে রেখে আমার কী লাভ?

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, ওরা তত বাচ্চা নয়। বেশ সেয়ানা। এখান থেকে একবার বেরুতে পারলেই ওরা পুলিশ ডেকে এই বাড়ি খুঁজে বার করবে।

আমি কি ওদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা করেছি যে, পুলিশ ডাকবে? আমি বরং ওই রাজকুমার ব্যাটার হাত থেকে ওদের ছাড়িয়ে এনেছি। কী বলো, খোকা-খুকুরা?

সন্তু চুপ করে রইল। দেবলীনার মুখ দেখে মনে হল, সে খুকু ডাক শুনে বেশ রেগে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, যাকগে, এবারে কাজের কথা বলুন।

বসুন। বসে-বসে কথা হোক। ওরাও যদি থাকতে চায় থাক।

আপনি আমার নাম জানেন, কিন্তু আপনার নাম তো জানা হল না। আগে আলাপ-পরিচয় হোক?

সে কী রায়চৌধুরীবাবু, আপনি এত অভিজ্ঞ লোক, আপনি আমায় চেনেন না? এ-লাইনে আমাকে সবাই একডাকে চেনে। তিন পুরুষ ধরে আমাদের জাহাজের ব্যবসা!

আমি বেশিরভাগ কাজই করেছি। বাইরে-বাইরে। কলকাতার এ-লাইনের লোকদের ভাল চিনি না। চেনা উচিত ছিল। তা, আপনার নামটা?

আমাকে সবাই মল্লিকবাবু বলে চেনে?

মল্লিকবাবু? হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাম শুনেছি। আপনাকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আপনি তো বিখ্যাত লোক। তা আপনারা যমজ দুভাই না? আপনি কোন জন, যোগেন না মাধব?

আমার নাম যোগেন। আর আমার ছোট ভাই, মানে যে ঠিক আমার বারো মিনিট পরে জন্মেছে, তার নাম মাধব।

লাইনের লোকরা আপনাদের জগাই মাধ্যই বলে। আপনাদের দুজনকে দেখতে হুবহু এক রকম, তাই না?

রায়চৌধুরীবাবু, দয়া করে আমার সামনে ওই নাম উচ্চারণ করবেন না। আমাদের শত্রুপক্ষের ব্যাটাচ্ছেলেরা ওই নাম রটিয়েছে।

সে যাকগে। এবারে কাজের কথাটা বলুন।

জগাই মল্লিক একবার আড়চোখে সন্তু আর দেবলীনার দিকে তাকাল। তারপর অখুশিভাবে বলল, এইসব ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে এসব কাজের কথা আলোচনা করা কি ঠিক? বললুম, ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমার নিজেরও এই বয়েসী ছেলেমেয়ে আছে।

কাকাবাবু পরিহাসের সুরে বললেন, ওরা বড় হচ্ছে! ওরা সব বুঝুক, শিখুক যে পৃথিবীটা কত শক্ত জায়গা! আপনার ছেলেমেয়েদের এসব শেখাচ্ছেন না? তারা বড় হয়ে আপনার কারবার বুঝে নেবে কী করে?

আমার ছেলেমেয়েদের আর এই কারবারে নামবার দরকার হবে না। আমি যা রেখে যাব, তাতেই তাদের তিন পুরুষ দিব্যি চলে যাবে।

সন্তু আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। এই সব বাজে কথা শুনতে তার একটুও ভাল লাগছে না। এই জগাই মল্লিক নামে লোকটা কাকাবাবুকে দিয়ে কী কাজ করাতে চায়? এই লোকটাকে প্ৰথমে দেখে তার ভাল লোক মনে হয়েছিল!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বলুন, মল্লিকবাবু।

জগাই মল্লিক বলল, ওই রাজকুমার নামে লোকটা আপনাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল। আপনার জন্যে নাকি ভাল খদের আছে। ইজিপ্টে কোন ব্যবসায়ীকে আপনি খুব শক্ৰ বানিয়েছেন, তাকে নাকি এক পিরামিডের তলায় আটকে রেখে আপনি খুব শাস্তি দিয়েছেন, সে আপনাকে পঁচিশ হাজার টাকায় কিনতে চায়।

কাকাবাবু ছদ্ম বিস্ময়ে বললেন, অ্যাঁ, মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা? আমার মাথার দাম। এত সস্তা?

এরকম অবস্থার মধ্যেও কাকাবাবুর কথা শুনে দেবলীনা ফিকফিক করে হেসে উঠল।

এতক্ষণে দেবলীনা সম্পর্কে সন্তু একটু সন্তুষ্ট হল। বিপদের মধ্যেও যে হাসতে পারে সে একেবারে এলেবেলে নয়।

দেবলীনার হাসি শুনে জগাই মল্লিক বলল, চোপ! বেয়াদপি করবে না।

কাকাবাবু বললেন, আহা, অন্যদিকে মন দিচ্ছেন কেন, আপনার কাজের কথাটা বলুন।

পূজারীর বেশ ধরে, এত ঠাকুর-দেবতার সামনেও জগাই মল্লিক ফশ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল, তারপর পর পর দুটো বড় টান দিল।

কাকাবাবু বললেন, শুনুন মল্লিকবাবু, এক সময়ে আমি খুব সিগার আর পাইপ খেতুম! সে-সব ছেড়ে দিয়েছি। এখন তামাকের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলুন!

জগাই মল্লিক একেবারে হাঁ হয়ে নিম্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। তারপর বলল, আপনি বেড়ে লোক তো মশাই? এটা আপনার বাড়ি না। আমার বাড়ি? আপনি বাঁচবেন কি মরবেন, সেটা নির্ভর করছে আমার ইচ্ছের ওপর। অথচ আপনি আমার ওপর হুকুম ঝাড়ছেন?

কাকাবাবু ইয়ার্কির সুরে বললেন, আহা, বাঁচা বা মরাটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হল কাজ, সেই কাজের কথা বলুন। আমি তো আপনাকে হুকুম করিনি। সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না বলে আপনাকে অনুরোধ করলুম!

সামনের কোষা-কুষির জলের মধ্যে সিগারেটটা ঠেসে নিভিয়ে দিয়ে রাগতভাবে জগাই মল্লিক বলল, ঠিক আছে, কাজের কথাই হোক। ওই রাজকুমার ব্যাটা তো আপনাকে পাঁচিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে ইজিপ্টে পাঠাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। মাঝপথে আমি খবর পেয়ে ভাবলুম, আরেঃ, আপনাকে তো আমারই খুব দরকারী! আপনার মতন একজন মাথাওয়ালা লোক শুধু শুধু ইজিপ্টে গিয়ে পচবেন কেন? আপনি আমার দু একটা কাজ করে দেবেন, তারপর আমি আপনার ভরণপোষণ করব।

কাকাবাবু মাথা নিচু করে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ!

জগাই মল্লিক। এতে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, দেখুন মশাই, আমরা বনেদি বাঙালি, আমরা খাঁটি ভদ্রলোক। আমরা পারতপক্ষে ভায়োলেন্স পছন্দ করি না, আমরা গুণীর কদর বুঝি!

কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে সুর পালটে বললেন, আমি কিন্তু ততটা ভদ্রলোক নই। আমি অনেক সময় লোকদের মারধোর করি, রিভলভার দিয়ে ভয় দেখাই। সে-রকম সে-রকম বদমোশদের পুলিশের হাতেও ধরিয়ে দিই। যাকগে সে-সব কথা। তা রাজকুমার আমাকে এককথায় আপনার হাতে তুলে দিল?

এমনি-এমনি দেয়নি। আমি তিরিশ হাজার দর দিয়েছি। রাজকুমারের সঙ্গে আমার কিছু কাজ-কারবার আছে। ব্যবসার স্বার্থে ওকেও আমার কথা শুনতে হয়, আমাকেও ওর কথা শুনতে হয়।

কাজ-কারবার মানে রাজকুমার যখন মানুষ পাচার করে তখন আপনি সেই সব লোকদের গোপনে আরবমুখে জাহাজে তুলে দেন। আগে জানতুম। এসব কাজ বোম্বে থেকেই হয়। কলকাতা থেকেও যে হয় তা আমার জানা ছিল না।

দেখুন রায়চৌধুরীবাবু, আমি চার্টার করা জাহাজে মাল পাঠাই। তা কেউ আলুর বস্তা পাঠাচ্ছে, না মশলা পাঠাচ্ছে, না জ্যান্ত মানুষ পাঠাচ্ছে, তা তো জানিবার দরকার নেই আমার। ওরা যদি কাস্টমস আর পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারে, তারপর আর আমার কী বলবার আছে! আমার হল মাল পাঠানো নিয়ে কথা!

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই, তা তো বটেই! কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। রাজকুমারের সঙ্গে আপনার আমাকে নিয়ে বোঝাপড়া হয়ে যাবার পরেও রাজকুমার আর টাইগার ওইদিকের একটা ঘরে বসে আছে কেন?

ওকে এখনও পেমেন্ট করিনি, তাই বসে আছে। ও কিছু না।

আমি যতদূর জানি, আপনাদের এ-লাইনের যা কাজ-কারবার সব মুখের কথায় বিশ্বাসের ওপর চলে। কেউ তো এরকম হাত পেতে নগদ টাকা নেবার জন্য বসে থাকে না! ও কেন বসে আছে তা আমি জানি বোধহয়! এবারে আসল সত্যি কথাটা বলে ফেলুন তো!

আরে, ছি, ছি, ছি! আমি কি আপনাকে মিথ্যে কথা বলছি! আপনি আমার দু একটা কাজ করে দেবেন, তার বদলে আপনাকে আমি মুক্তি দিয়ে দেব। আপনার এই ভাইপো-ভাইঝি সমেত!

উঁহু, এটা তো সত্যি কথা যে, আমি ছেলেমানুষ নই, জগাইবাবু!

জগাই নয়, যোগেন।

ওই একই হল। আমি জানি আপনার মনের ইচ্ছেটা কী। আপনি আমাকে দিয়ে আপনার জরুরি কাজ করিয়ে নেবেন আমাকে ছেড়ে দেবার লোভ দেখিয়ে। তারপর যে-ই আপনার কার্য উদ্ধার হয়ে যাবে, অমনি হয় আপনি আমাকে রাজকুমারের হাতে তুলে দেবেন অথবা মেরে ফেলবেন। আপনার লাল রঙের কাপড়-টাপড় দেখে মনে হচ্ছে আপনি কালীসাধক। আপনি কি ভেবেছেন কালীঠাকুরের সামনে আমাদের বলি দেবেন?

আরো ছি, ছি, ছি, কী যে বলেন! ওসব চিন্তা আমার মাথাতেই আসেনি। আমি শুধু চাই…

এমন সময় সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ হল। খাকি পাশাক-পরা লোকটি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক ওই রকমই পোশাক-পরা অন্য দুজন লোক দৌড়ে এল ঠাকুরঘরের কাছে। জুতো খুলে ভেতরে এসে জগাই মল্লিকের কানে কানে কী যেন বলতে লাগল।

জগাই মল্লিকের মুখের একটা রেখাও কপিল না। সে মন দিয়ে সব শুনে বলল, যা, ঠিক আছে। অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ওদের নীচের জলসা-ঘরে বসা। খাতির-যত্ন কর। শরবত খেতে দে। তারপর আমি আসছি।

সেই লোক দুটি চলে যাবার পর জগাই মল্লিক। তীব্রভাবে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে বলল, রায়চৌধুরীবাবু, আপনি কি পুলিশে খবর দিয়েছেন?

কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু সুযোগ পেলাম কই? আপনার লোক অনেক পরীক্ষা করে দেখেছে যে, আমার এই ক্রাচ-দুটোর মধ্যে কোনও লুকোনো ট্রান্সমিটারও নেই, কোনও অস্ত্ৰও নেই।

জগাই মল্লিক একটুক্ষণ চিন্তা করে বলল, পুলিশ এমনি রুটিন চেকেও আসে মাঝে-মাঝে, বুঝলেন। নাম কো ওয়াস্তে। ওদেরও তো মাঝে-মাঝে রিপোর্ট দেখাতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই! তা তো বটেই!

উঠে দাঁড়িয়ে জগাই মল্লিক বলল, আগেও অনেকবার এসেছে, বুঝলেন? আমাদের এই বাড়িটার ওপর শত্রুপক্ষের যে খুব নজর।

চমৎকার বাড়িখানা আপনার। দেখলে যে-কোনও লোকেরই লোভ হবে।

আপনাকে একটু গা তুলতে হচ্ছে যে, রায়চৌধুরীবাবু। বলা যায় না, পুলিশ হয়তো ওপরে উঠে এসে এ-ঘরেও উঁকিঝুঁকি মারতে পারে।

হ্যাঁ, কোনও অতি-উৎসাহী ছোকরা-অফিসার হলে সারা বাড়িটাই সার্চ করে দেখতে চাইবে হয়তো।

অবশ্য ঠাকুরঘরে ঢুকে বেশি কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করতে কোনও পুলিশই সাহস পায় না। পাপের ভয় আছে তো। যাই হোক, সাবধানের মার নেই। কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের আমি একটু অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখতে চাই।

একদিকের দেয়ালে একটা মস্ত বড় কালীঠাকুরের ছবি। জগাই মল্লিক সেটা নামিয়ে ফেলতে দেখা গেল, তার পেছনের দেয়ালে একটা কাঠের হ্যান্ডেল মতন লাগানো রয়েছে। জগাই মল্লিক সেই হ্যান্ডেলটা ধরে ঘোরাতে চেষ্টা করল। বেশ জোর দিয়েও কোনও কাজ হল না। তখন সে খাকি পোশাক-পরা লোকটিকে ডেকে বলল, এই পাল্টে, এদিকে এসে হাত লগা তো!

সেই লোকটি এসে খুব জোরে হ্যান্ডেল ঘোরাতেই দেয়ালটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। ওপাশে আর একটা ঘর আছে।

জগাই মল্লিক বলল, ঢুকে পড়ুন, আপনারা ওখানে চটপট ঢুকে পড়ুন। দেবলীনা কেউ কিছু বোঝবার আগেই ছুটে বেরিয়ে গেল ঠাকুরঘর থেকে। তারপর বারান্দার রেলিং ধরে চিৎকার করে উঠল, পুলিশ! পু…

বেশি চ্যাঁচাতে পারল না। কাছাকাছি অন্য লোক পাহারায় ছিল, সে ছুটে এসৈ মুখ চেপে ধরল। দেবলীনার। তার এক হাতে খোলা তলোয়ার।

জগাই মল্লিকের মুখখানা রাগে বীভৎস হয়ে গেছে, সে বলল, এই জন্যই আমি ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ-কারবার করি না! এই ওকে মারিস না, এদিকে নিয়ে আয়।

দেবলীনা নিজেকে ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, কিন্তু সেই লোকটার ভীমের মতন চেহারা। সে টানতে-টানতে দেবলীনাকে নিয়ে এল। ঘরের মধ্যে।

সন্তুও ভেবেছিল, নীচে যখন পুলিশ এসেছে তখন এই সুযোগে একটা গোলমাল বাধিয়ে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তো ভাল। জগাই মল্লিকের হাতে কোনও অস্ত্রই নেই, তাকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়। কিন্তু সে একবার কাকাবাবুর দিকে তাকাতেই কাকাবাবুঘাড় নেড়ে তাকে নিষেধ করলেন।

গোপন দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরের মধ্যে প্রথমে দেবলীনাকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। তারপর কাকাবাবু আর সন্তুকেও ঠেলে-ঠেলে ঢোকানো হল। ভেতরটা একেবারে ঘুটফুটে অন্ধকার। জগাই মল্লিক সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই দেখা গেল, সেই ঘরেও অনেক পাথরের মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে।

জগাই মল্লিক বলল, শুনুন, রায়চৌধুরীবাবু, কোনও রকম গণ্ডগোল করার চেষ্টা করলে আর এ-ঘর থেকে জ্যান্ত বেরুতে পারবেন না। সেরকম ব্যবস্থা করা আছে। এখান থেকে হাজার চ্যাঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। এই বিছুদুটোকে সামলান 1 এর পরের বার কিন্তু আমি আর দয়া-মায়া দেখাব না।

কাকাবাবু বললেন, আপনাকে বোধহয় একবার নীচে যেতে হবে। ঠিক আছে চলে যান, দয়া-মায়া নিয়ে এখন চিন্তা করতে হবে না?

জগাই মল্লিক এক পা এগিয়ে এসে বলল, ততক্ষণে আপনি একটা কাজ সেরে ফেলুন!

এক কোণে কালো কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢাকা রয়েছে। সেই কালো কাপড়টা তুলে জগাই মল্লিক বলল, এই দেখুন, চিনতে পারেন?।

কাকাবাবু বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠলেন। বললেন, এতক্ষণে বুঝলুম, আমাকে ধরে রাখার জন্য আপনার এত গরজ কেন?

দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে দুটি হুবহু একরকম কালো পাথরের মূর্তি। প্রায় দেড় হাত লম্বা। দুটো মূর্তিরই ডান দিকের কান ভাঙা!

জগাই মল্লিক বলল, আপনারই আবিষ্কার, আপনি তো চিনবেনই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে…

দুটো ছিল না। একটা ছিল। বালুরঘাট মিউজিয়াম থেকে চুরি যায়।

যে চুরি করেছে। সে কী সেয়ানা দেখুন! সঙ্গে-সঙ্গে একটি কপি বানিয়ে ফেলেছে। কোনটা আসল, কোনটা নকল ধরবার উপায় নেই। এখন দুটোই আমার হাতে এসে পড়েছে। আসলটার জন্য বিদেশের এক পার্টি অর্ডার দিয়ে রেখেছে, ভাল দাম দেবে। কিন্তু দুটোর মধ্যে কোনটা যে আসল সেটা বুঝতে পারছি না। জানেন তো, ফরেনে ভেজাল মাল পাঠালে ওরা কীরকম চটে যায়? নাম খারাপ হয়ে যায়? আমি সেরকম কারবার করি না?

কাকাবাবু মুর্তি দুটোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

জগাই মল্লিক বলল, আপনার জিনিস, আপনি আসলটা বেছে দিন। তারপর আপনার ছুটি। ভেজালটা আমি বালুরঘাটে পাঠিয়ে দেব। মিউজিয়ামে কটা লোকই বা যায়, সেখানে আসল মূর্তি রইল না নকল রইল, তাতে কিছু আসবে যাবে না! চটপট কাজ শেষ করে ফেলুন। আমি পুলিশকে ভজিয়ে ফিরে আসছি।!
জগাই মল্লিক বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সন্তু দেখল, এ-ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই।

কাকাবাবু বসে পড়ে দেবলীনার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ইশ, কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে!

দেবলীনা চোখ খুলে বলল, আমার বেশি লাগেনি।

কাকাবাবু বললেন, শোনো, ছেলেখেলার ব্যাপার নয়। একটু ভুল হলেই এরা যখন-তখন মেরে ফেলতে পারে। নিজে থেকে কিছু করতে যাবে না। আমি যা বলব, তাই-ই শুনবে। সন্তু, তোকেও এই কথাটা বলে রাখছি।

দেবলীনা বলল, নীচে পুলিশ এসেছে, আপনারা সবাই মিলে চ্যাঁচালেন না। কেন?

কাকাবাবু বললেন, তাতে কি কিছু লাভ হত? পুলিশ মানেই তো সবাই ভাল নয়? ঘুষখোর পুলিশও আছে। এরা টাকা পয়সা দিয়ে অনেক পুলিশকে হাত করে রাখে। সেরকম পুলিশ কেউ যদি জানতেও পারে যে আমরা এখানে বন্দী হয়ে আছি, তাও কিছু করবে না।

দেবলীনা অবিশ্বাসের সুরে বলল, পুলিশ ডাকাতদের ধরবে না? তা হলে আমরা এখান থেকে বেরুব কী করে?

কাকাবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে দেবলীনার মাথার রক্ত মুছে দিতে-দিতে সন্তুকে বললেন, তুই আমার একটা ক্রাচ দিয়ে এই ঘরের সব দেয়াল আর মেঝেটা ঠুকে ঠুকে দ্যাখ তো। যে দেয়াল দিয়ে আমরা ঢুকলাম সেটা বাদ দিয়ে।

সন্তু ঠিক বুঝতে না পেরেও একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে দেয়ালে ঠুকতে লাগল।

কাকাবাবু দেবলীনার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কোনওরকমে। তারপর বললেন, পুরনো আমলের বাড়ি। এতে যেমন আধুনিক লিফট বসিয়েছে, ইলেকট্রিক আলো আছে, তেমনি আবার গুপ্ত কুঠুরিও রেখে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ঘর থেকেও বেরুবার একটা রাস্তা আছে।

সন্তু ঠুকে-ঠুকে কোথাও ফাঁপা শব্দ পেল না।

কাকাবাবু ঘরের চারপাশটা দেখলেন। এক কোণে অনেকগুলো মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে, সেগুলো সরিয়ে ফেলে বললেন, এইখানটা ঠুকে দ্যাখ তো!

সন্তু এসে সেইখানে জোরে-জোরে ঠুকতেই ঠং ঠং শব্দ হল।

কাকাবাবু বললেন, দেখলি? তলাটা ফাঁকা। গুপ্ত কুঠুরি মানেই তা যাওয়া-আসার দুটো ব্যবস্থা থাকবেই। ফাঁদে পড়ে গেলে পালাবার একটা থাকে।

একটা চতুষ্কোণ দাগ রয়েছে মেঝের সেই জায়গাটায়। কিন্তু সেখানকার পাথরটা সরানো যাবে কী করে? সন্তু অনেক টানাটানি করেও সুবিধে করতে পারল না।

কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন বোধহয় খোলা হয়নি। জ্যাম হয়ে গেছে। দেখি, আমি চেষ্টা করি, এটা খুলতেই হবে।

তিনি প্রথমে ক্রাচ দিয়ে সেই রেখার চারপাশ ঝুঁকলেন। কোনও লাভ হল না। তারপর তিনি হাত দিয়ে টিপতে লাগলেন। চতুষ্কোণ রেখার একধারে একবার দুহাতের তালু দিয়ে জোরে চাপ দিতেই আর একটা দিক উঁচু হয়ে উঠল।

পরিশ্রমে কাকাবাবুর কপালে ঘাম জমে গেছে। তবু তিনি খুশি হয়ে বললেন, এইবার হয়েছে। তোরাও দুদিকে ধর, এই পাথরটা টেনে তুলতে হবে।

তিনজনে মিলে জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই একটা চৌকো পাথর খুলে বেরিয়ে এল। তার নীচে অন্ধকার গর্ত।

সন্তু তার মধ্যে হাত ঢোকাতে যেতেই কাকাবাবু বললেন, দাঁড়া, আগে আমি দেখে নিই!

তিনি তার মধ্যে ক্রাচটা ঢুকিয়ে দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলুম তাই-ই। একটা সিঁড়ি রয়েছে।

সন্তু সেই সিঁড়ি দিয়ে নামবার জন্য পা বাড়াতেই দেবলীনা বলল, আমি আগে যাব?

সন্তু বলল, ছেলেমানুষি কোরো না! আমাকে দেখতে দাও!

দেবলীনা বলল, মোটেই আমি ছেলেমানুষ নই। আমি বুঝি কিছু করব না।

সন্তু বলল, এটা মেয়েদের কাজ নয়।

ইশ, ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা বুঝি তা পারে না? সব পারে। কাকাবাবু, আপনি ওকে বারণ করুন, আমি আগে যাব।

কাকাবাবু বললেন, তলায় কিন্তু অনেক রকম বিপদ থাকতে পারে।

দেবলীনা বলল, আপনি ওকে সেই বিপদের মধ্যে পাঠাচ্ছেন, তাহলে আমি কেন যাব না? আমি যাবই যাব, আমি আগে যাব!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, যাও। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে নামবে। পায়ের তলায় কিছু না পেলে অন্য পা বাড়াবে না, সেখান থেকে ফিরে আসবে! এই বাড়িটা গঙ্গার ধারেই। এমনও হতে পারে, এই সিঁড়িটা একেবারে গঙ্গায় নেমে গেছে। তুমি ভাল সাঁতার জানো না, জলে নেমো না!

আর যদি সিঁড়ির নীচে কোনও লোক দাঁড়িয়ে থাকে?

থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে! যদি পুলিশ এই বাড়িটা ঘিরে ফেলে থাকে তা হলে তুমি পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে সব কথা খুলে বোলো! আর যদি ওদের লোক থাকে, তবে সেটা তোমার…নিয়তি!

তবু আমি যাব!

খুব সাবধানে, অ্যাঁ? দেবলীনা, তোমার কোনও বিপদ হলে আমাদের খুব কষ্ট হবে, মনে রেখো।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওকে বারণ করুন! ও পারবে না!

কাকাবাবু বললেন, না, যেতে চাইছে যাক!

দেবলীনা সেই গর্তের মধ্যে নেমে গেল। কাকাবাবু আর সন্তু দুদিক থেকে বুকে ওকে দেখবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু একে তো অন্ধকার, তার ওপর সিঁড়িটা সম্ভবত খাড়া নয়, বেঁকে গেছে, তাই কিছুই দেখা গেল না।

কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, এ-বাড়িটার অনেক রকম কায়দা। মাটির নীচে আরও দুটো তলা রয়েছে।

সন্তু বলল, লিফটে তাই ছটা বোতাম দেখলুম। বাইরের লোক তো ওই লিফট দেখলেই বুঝে ফেলবে।

নীচের তলা দুটো সম্ভবত মাল-গুদাম। যেখানে সাধারণ জিনিস রাখা আছে। পুলিশ সন্দেহ করলে সেই দুতলা খুঁজে দেখবে। ওপরে ঠাকুরঘরের পেছনেও যে আরও একটা ঘর আছে, সেটা মনে আসবে না। আগেকার দিনে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বড়লোকরা এইরকম ব্যবস্থা করে রাখত। এখন এরা নিজেরাই ডাকাত!

নীচে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না?

আর একটু অপেক্ষা করে তোকেও যেতে হবে।

কাকাবাবু, এই বিষ্ণুমূর্তিটা আপনি গত বছর আবিষ্কার করেছিলেন না?

হুঁ। আসল কষ্টিপাথরের তৈরি, ফোর্থ সেঞ্চুরির। অতি দামী জিনিস। বিদেশে এর দাম তো দশ-বারো লাখ টাকা হবেই! আমি বলেছিলাম, মূর্তিটা কলকাতার মিউজিয়ামে রাখতে। কিন্তু বালুরঘাটের লোক দাবি তুলল, আমাদের জিনিস, আমরা দেব না, আমাদের মিউজিয়ামেই রাখব। সেখান থেকে তিন-চার মাসের মধ্যেই চুরি হয়ে গেল।

এখন এরা এই দামী মূর্তিটা বাইরে পাঠিয়ে দেবে।

প্ৰথম চোরটা অতি চালাক। সঙ্গে-সঙ্গে একটা কপি তৈরি করে ফেলেছে। এখন এরা আর আসলটা চিনতে পারছে না।

এরা তো দুটোই বাইরে পাঠিয়ে দিলে পারে!

পাগল নাকি! বাইরের ক্রেতা যদি জানতে পারে যে, এই মূর্তির আরও কপি আছে, তা হলে হু-হু করে দাম পড়ে যাবে।

কাকাবাবু, কোনও সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না। আমি এবার যাব?

হ্যাঁ, সাবধানে নেমে দ্যাখ। মেয়েটি যেন বুঝতে না পারে যে, তুই ওকে সাহায্য করতে গেছিস।

সন্তু প্ৰথমে পা দুটো গলিয়ে বলল, সিঁড়ি বেশ চওড়া আছে, পড়ে যাবার ভয় নেই।

তারপর সে নেমে গোল কয়েক ধাপ। সন্তু অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কাকাবাবু নিজেও একটা পা গলিয়ে দেখে নিলেন। এই সিঁড়ি দিয়ে নামতে তাঁরও অসুবিধে হবে না। কিন্তু তিনি নামলেন না।

তিনি মূর্তি দুটি পরীক্ষা করতে লাগলেন।

একটুক্ষণের মধ্যেই সুড়ঙ্গের মধ্যে শব্দ পেয়ে তিনি মুখ ফেরালেন। সন্তু উঠে এল, হুড়মুড়িয়ে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, ওই মেয়েটা ফিরে আসছে। আমায় দেখতে পায়নি।

কাকাবাবু বললেন, তুই এপাশটায় এসে বোস।

দেবলীনা মুখ বাড়াতেই কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর বললেন, সত্যি সাহসী মেয়ে! কী দেখলে?

দেবলীনা অনেকখানি সিঁড়ি একসঙ্গে উঠে এসেছে, একটু হাঁপাতে লাগল। তারপর ভাল করে দম নিয়ে বলল, আমি দুদিন কিছু খাইনি তো, তাই খুব দুর্বল হয়ে গেছি।

কাকাবাবু বললেন, ইশ, ছতলা সিঁড়ি ভাঙা তো সোজা কথা নয়। কেউ তোমায় দেখতে পায়নি তো?

দেবলীনা বলল, নামবার সময় কী যেন একটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বোধহয় সাপ।

ইঁদুরও হতে পারে। তোমায় কামড়ায়নি তো?

না, কামড়ায়নি। সিঁড়ির দুপাশের দেয়াল শ্যাওলায় ভর্তি, অনেকদিন কেউ যায়নি বোধহয়।

একদম নীচে পর্যন্ত গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, কিন্তু ছতলায় নয়, তিনতলা। আমি গুনেছি। সেখানেই সিঁড়ি শেষ। তারপর একটা ছোট বারান্দা। সেই বারান্দার একপাশে একটা দরজা, সেটা বন্ধ।

সিঁড়িটা তা হলে মাটির তলা পর্যন্ত যায়নি। সেই বারান্দায় কী দেখলে?

কাছেই গঙ্গার জল চকচক করছে। ঢেউয়ের শব্দও শুনলুম। সেখানে কোনও লোক নেই মনে হল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই বারান্দা ডিঙিয়ে নীচে নামা যায় না?

দেবলীনা একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, তা যেতে পারে। একটু লাফাতে হবে। ওটুকু আমিও লাফাতে পারব। কিন্তু…কিন্তু কাকাবাবু পারবেন কি?

কাকাবাবু বললেন, আমার আর একটা পা-ও খোঁড়া হয়ে যাবে বলছ? সে দেখা যাবে। তা হলে, ওখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে না?

না, কোনও সাড়া-শব্দ নেই। ওদিকটায় বোধহয় কেউ আসে না। বারান্দার নীচে ঝোপঝাড় হয়ে আছে মনে হল। আমি উঁকি মেরে দেখেছি। চাঁদের আলোয় একটু-একটু দেখা যাচ্ছে।

বাঃ, দেবলীনা, ইউ হ্যাভ ডান আ ভেরি গুড জব! এবারে তোমাতে আর সন্তুতে মিলে একটা কাজ করতে হবে।

কাকাবাবু বিষ্ণুমূর্তি দুটোকে আবার পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, ইতিহাসে যার একটুখানি জ্ঞান আছে, সে-ই কোনটা আসল, কোনটা নকল চিনতে পারবে। কিন্তু চোর-ডাকাতদের তো সে বিদ্যেটুকুও থাকে না।

একটা মূর্তি তিনি দুহাতে উঁচু করে তুলে বললেন, প্রচণ্ড ভারী। দ্যাখো তো, তোমরা দুজনে এটা বয়ে নিয়ে যেতে পারো কি না? তারপর বললেন, না, না, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে, দুটো হাত এনগেজড থাকলে পড়ে যেতে পারিস। তাতে দারুণ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সন্তু, তুই আর দেবলীনা আগে নেমে যা, তারপর আমি মূর্তিটা তোদের হাতে তুলে দিচ্ছি।

সন্তু বলল, এটা নীচে নিয়ে গিয়ে কী করব?

কাকাবাবু বললেন, তোরা এটাকে খুব সাবধানে নিয়ে যাবি। দেখিস, কিছুতেই যেন হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে না যায়। এসব জিনিস অমূল্য, শুধু টাকার দাম দিয়ে এর বিচার হয় না। দিনাজপুরের একটা টিবি খুঁড়ে এটা আবিষ্কার করার সময় আমাকে সাপে কামড়েছিল। সন্তু, তোর মনে আছে?

সন্তু বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেবার আমার জ্বর হয়েছিল, আমি সঙ্গে যাইনি।

এই মূর্তিটা পাওয়ার জন্য আমায় প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। এটা আমার ভীষণ প্রিয়। এটা কেউ বিদেশে পাচার করবে, তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। এটা যদি তোরা নামাতে গিয়ে ভেঙে ফেলিস, তা হলেও আমার বুক ফেটে যাবে।

দেবলীনা বলল, না, না, আমরা সাবধানে নামাব।

কাকাবাবু বললেন, এটাকে বারান্দা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে তলার গাছপালার ঝোপে ফেলে দিবি, তারপর তোরা দুজনে বারান্দা ডিঙিয়ে নীচে নেমে এটাকে আবার গড়িয়ে ফেলে দিবি জলে।

দেবলীনা বলল, জলে ফেলে দেব? কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমাদের যদি পালাতে হয়, তা হলে এত বড় একটা ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। জলে ফেলে দিলে নষ্ট হবে না। পরে আবার খুঁজে বার করা সহজ হবে। আর দেরি কোরো না, নেমে পড়ে।

দেবলীনা বলল, আর আপনি? আপনি যাবেন না। আমাদের সঙ্গে? আপনি রং আগে আগে নামুন।

কাকাবাবু বললেন, আমি একটু পরে যাচ্ছি!

সন্তু বলল, পরে কেন? আমরা একবার বারান্দা দিয়ে নীচে নেমে পড়লে আপনার একলা নামতে অসুবিধে হবে।

কিছু অসুবিধে হবে না। আমি ঠিক চলে যাব। এখানে আর কী কী চোরাই জিনিস আছে, আমাকে একবার দেখে নিতেই হবে। তোরা আর দেরি করিসনি। এগিয়ে পড়?

দেবলীনা বলল, না, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। এসব জিনিস আর দেখতে হবে না।

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, আমার কথা শুনে চলতে হবে। আমি যা বলছি, তাই করো?

সন্তুরও এই ব্যবস্থাটা পছন্দ হল না। তবু সে প্রতিবাদ করল না। নামতে শুরু করল। কাকাবাবু ওদের হাতে মূর্তিটা তুলে দিয়ে বললেন, দেখো, খুব সাবধানে?
ওরা নেমে যাওয়ার পর কাকাবাবু অন্যান্য মূর্তি আর বাক্সগুলো খুলে দেখতে লাগলেন। বাক্সগুলো খোলা সহজ নয়। এক-একটা একেবারে সিল করা। কাকাবাবুর কাছে ছুরি টুরি কিছু নেই। তিনি তাঁর সাঁড়াশির মতন শক্ত আঙুল দিয়ে সেগুলো খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কোনও বাক্সেই হিরে-জহরত নেই। রয়েছে গাঁজা, আফিমের মতন নিষিদ্ধ জিনিস। একটা চৌকো বাক্স অনেক কষ্টে খুলে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। তার মধ্যে রয়েছে একটা ছোট্ট মাথার খুলি। মনে হয় চার-পাঁচ বছরের কোনও বাচ্চার। কাকাবাবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাদা ধপধাপে খুলিটার দিকে। বিদেশে এইসবও বিক্রি হয়? পয়সার লোভে মানুষ কত হীন কাজই না করে!

কয়েকটা বাক্স শেষ পর্যন্ত খোলা গেল না।

মূর্তিগুলো বেশির ভাগই কোনও-কোনও মন্দিরের দেয়াল থেকে খুবলে আনা। বেশির ভাগই তেমন দামী নয়, তবে মন্দিরগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।

একটা যুগল-মূর্তি কাকাবাবু খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর সন্দেহ হল, সেটা ওড়িশার বিখ্যাত রাজারানী মন্দির থেকে চুরি করে আনা হয়েছে। তাহলে এটাও খুব দামী হবে। কিন্তু তিনি ঠিক নিঃসন্দেহ হতে পারছেন না।

কাকাবাবু যেন ভুলেই গেলেন যে, কতখানি বিপদ তাঁদের ঘিরে ছিল এতক্ষণ। এখন একটা পালাবার রাস্তা পাওয়া গেছে। সন্তু আর দেবলীনা তাঁর জন্য নীচে অপেক্ষা করছে। তবু তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন সেই যুগল-মুর্তিটা।

হঠাৎ খট্‌ করে একটা শব্দ হতেই তিনি চমকে উঠলেন।

দেয়ালের দরজাটা আবার খুলে গেছে। সেখান দিয়ে রাজকুমার ঢুকল, সঙ্গে-সঙ্গে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

কাকাবাবু সাবধানে মূর্তিটা নামিয়ে রেখে হালকা গলায় বললেন, আরে, কী ব্যাপার? এ তো দেখছি, বাঘ আর ছাগল এক খাঁচায়! জগাই মল্লিক। কি তোমাকেও বন্দী করে ফেলল নাকি?

রাজকুমার পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, আমায় আটকাবে জগাই মল্লিকের এমন সাহস আছে? ওই ব্যাটা ধ্রুব রায় নামে অফিসারটা এসে পড়েছে, সে ঠাকুরঘরে এসে প্ৰণাম করতে চায়, তাই আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ছাগলের খাঁচায় আসতে হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তা ভালই হয়েছে। তুমি বোসো, তোমার সঙ্গে আমার কাজের কথাগুলো সেরে নিই!

রাজকুমার রিভলভারের নলে দুবার ফুঁ দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমার আর কোনও কথা নেই, রায়চৌধুরী। তোমাকে আমি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন তুমি জগাই মল্লিকের মাল। আর তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

বিক্রি করে দিয়েছ! টাকা-পয়সা পেয়ে গেছ?

সে-কথায় তোমার দরকার কী?

কিন্তু রাজকুমার, জগাই মল্লিক। আমাকে দিয়ে তার কাজ করিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেবে বলেছে। আমাকে ছেড়ে দিলেই যে তোমার বিপদ। তোমার কী ব্যবসা তা-ও আমি জেনে গেছি, আর তোমার কাজ-কারবার যেখানে চলে সেই জায়গাটাও খুঁজে বার করা আমার পক্ষে শক্ত হবে না।

জগাই মল্লিক তোমাকে ছেড়ে দেবে? সে অত কাঁচা? হা-হা-হা-হা। হঠাৎ হাসি থামিয়ে সে বলল, ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় গেল?

কাকাবাবু বললেন, তাই তো, কোথায় গেল, আমিও ওদের কথা ভাবছি!

বাজে কথা বোলো না। আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা কোরো না। ওদেরও এই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ও কী! ওখানে, ওখানে ওই গর্তটা…

ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ছেলেমেয়ে দুটো বাইরে একটু হাওয়া খেতে গেছে। এই জায়গাটা বড্ড বদ্ধ কি না!

কাকাবাবু অনেকটা আড়াল করে বসে থাকলেও মেঝের চীেকো গর্তটা রাজকুমারের চোখে পড়ে গেছে। তার চোখ চকচক করে উঠল।

সে বলল, বেরুবার পথ রয়েছে? তবু তুমি পালাওনি যে বড়? জায়গাটা সরু, তুমি গলতে পারোনি! সরে এসো, সরে এসো, আমি ঠিক গলে যাব।

দাঁড়াও, এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? আগে তোমার সঙ্গে কথাবার্তাগুলো হয়ে যাক?

আমার কোনও কথা নেই, সরে এসো।

আমার যে অনেক কথা আছে!

চালাকি করে সময় নষ্ট করছ? ছেলেমেয়েগুলোকে বাইরে পাঠিয়ে পুলিশে খবর দিতে চাও? আমি এক্ষুনি গিয়ে ওদের ধরে ফেলব।

এক্ষুনি তো তোমায় যেতে দেব না আমি!

রাজকুমার রিভলভারের নলটা কাকাবাবুর কপালের সোজাসুজি তুলে হিংস্রভাবে বলল, রায়চৌধুরী, আমি ঠিক দশ গুনব। তার মধ্যে সরে না। গেলে…

কাকাবাবু তার কথা শুনে নিজেই তখন গুণতে লাগলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত-আট-নয়-দশ! তারপর হেসে হেসে বললেন, কই, গুলি করলে না?

রাজকুমার এক পা এগিয়ে এসে গলার আওয়াজে আগুন মিশিয়ে বলল, তুমি কি ভাবছ। আমি ছেলেখেলা করছি? তুমি যদি সরে না দাঁড়াও তা হলে তোমাকে আমি কুকুরের মতন গুলি করে মারব। জগাই মল্লিক কী বলবে তাও আমি পরোয়া করি না?

আমার কথা শেষ না হলে তোমাকে আমি যেতে দেব না বলছি তো!

রাজকুমার সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে ট্রিগার টিপল।

শুধু একটা খট্‌ করে আওয়াজ হল, গুলি বেরুল না।

কাকাবাবু এবার অট্টহাস করে উঠে বললেন, দেখলে, দেখলে! আমার হচ্ছে চার্মড লাইফ, আমি গুলিগোলায় মরি না!

রাজকুমার বিমূঢ়ভাবে হাতের রিভলভারটার দিকে তাকিয়ে রইল। আরও কয়েকবার ট্রিগার টিপলেও খট্‌-খট্‌ শব্দ হল।

কাকাবাবু বললেন, ওটা দিয়ে আর কিছু হবে না। ওই খেলনাটা এখন ফেলে দাও! কাল রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ দিয়ে আমাদের অজ্ঞান করে দিয়েছিলে। জ্ঞান হারাবার আগে আমি বুঝতে পেরেছিলুম রিভলভারটা তুমি আবার নিয়ে যাবে। তাই আমি গুলিগুলো সব সরিয়ে ফেলেছি। তুমি একবার চেক করেও দ্যাখোনি।

রাজকুমার তখন সেই রিভলভারটাই কাকাবাবুর মাথার দিকে ছুঁড়ে মারবার জন্য হাত তুলতেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ দিয়ে ঘুরিয়ে মারলেন তার হাতে।

রাজকুমারের হাত থেকে সেটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লেগে আবার মেঝেতে পড়ল।

রাজকুমার এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে তুলে নিল কাকাবাবুর আর একটা ক্রাচ।

কাকাবাবু বসে ছিলেন, এই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন দেয়াল ঘেঁষে। রাজকুমারের চোখে চোখ রেখে তিনি শান্তভাবে বললেন, এখন আর ওটা নিয়ে তোমার কোনও লাভ নেই। শুধু শুধু আমার ক্রাচটা ভাঙবে। কোনওদিন লাঠিখেলা শিখেছি? আমি শিখেছি।

রাজকুমার দুহাত দিয়ে ক্রাচটা তুলে খুব জোরে মারতে গেল কাকাবাবুর মাথা লক্ষ্য করে, কাকাবাবু খুব সহজেই নিজের ক্রাচটা তুলে সেটা আটকালেন।

তারপর চলল। খটখট লড়াই।

এই সময় তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল সন্তু। রাজকুমার তার দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, রাজকুমার তাকে দেখতে পেল না, কাকাবাবু দেখতে পেলেন। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে মনস্থির করে ফেলল। অনেক পাথরের মূর্তি পড়ে আছে, তার একটা তুলে নিয়ে সে পেছন দিক থেকে রাজকুমারের মাথায় ঠুকে দেবে।

সন্তু এক লাফে ওপরে এসে একটা মূর্তি তুলে নিতেই কাকাবাবু বললেন, তোকে কিছু করতে হবে না, এই দ্যাখ।

এতক্ষণ কাকাবাবু যেন খেলা করছিলেন, এবারে তিনি বিদ্যুৎ গতিতে ক্রাচটা রাজকুমারের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে তার ঘাড়ে মারলেন।

উফ শব্দ করে রাজকুমার মাটিতে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে।

কাকাবাবু তাতেই থামলেন না, তিনি আবার মারলেন তার পিঠে।

রাজকুমার বলে উঠল, ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে? কাকাবাবু এক টানে রাজকুমারের হাত থেকে অন্য ক্রাচটা কেড়ে নিয়ে সন্তুকে বললেন, ওইখানে দ্যাখ। কতকগুলো কাপড় পড়ে আছে, ওইগুলো দিয়ে ওর হাত আর পা বাঁধ তো?

রাজকুমার টান-টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। সন্তু দুটো টুকরো কাপড় নিয়ে বেশ সহজেই বেঁধে ফেলল তার হাত ও পা। রাজকুমার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, কোনও বাধা দিতে পারছে না। তার ঘাড়ে খুবই জোর লেগেছে।

কাকাবাবুর মুখখানা বদলে গেছে। অসম্ভব রাগে। লাল লাল ছোপ পড়েছে তাঁর মুখে। ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়ছে তাঁর।

তিনি বললেন, বার বার তিন বার। এর আগে ত্রিপুরায় তোমাকে দুবার ক্ষমা করেছি। এবার আর তোমার ক্ষমা নেই। আমার কথা শোনার ধৈর্য ছিল না তোমার, না? এবার শোনাচ্ছি।

রাজকুমার হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, উঃ, ভীষণ ব্যথা! মরে যাচ্ছি! মরে যাচ্ছি!

কাকাবাবু বললেন, না, তুমি মরবে না, বেঁচে উঠবে ঠিকই। বাকি জীবন জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে না? পুলিশ তোমাকে যা-ই শাস্তি দিক, আমি নিজে তোমাকে আলাদা শাস্তি দেব! তুমি ছোট ছেলেমেয়েদের ওপর অত্যাচার করো, তুমি মানুষ বিক্রি করো, তুমি সমাজে থাকার অযোগ্য।

কাকাবাবু রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেট থেকে গুলি বার করলেন। বললেন, আগেই ওরা আমাকে সার্চ করেছে, তাই পরে আর পকেট দেখেনি। যাক, এতক্ষণে একটা ভালমতন অস্ত্ৰ পাওয়া গেল!

কাকাবাবু গুলিগুলো রিভলভারে ভরে সন্তুকে বললেন, তুই ওপরে উঠে এলি কেন? মেয়েটাকে এক ফেলে এলি?

সন্তু বলল, আপনার দেরি হচ্ছে দেখে…

তুই চলে যা নীচে।

এবারে আপনিও চলুন।

যাচ্ছি, একটু পরেই যাচ্ছি। আগে এই শয়তানটার সঙ্গে বোঝাপড়া করে যাই। ও যাতে জীবনে আর কোনওদিন কারুর ওপরে অত্যাচার করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করে যাব।

আমি থাকি না একটুখানি। একসঙ্গে যাব।

না। তোকে এখানে থাকতে হবে না। দেবলীনাকে এক ফেলে এসেছিস, ও যদি ভয় পেয়ে যায়? শিগগির যা!

কাকাবাবুর হুকুম অগ্ৰাহ্য করতে পারে না বলে সন্তু গর্তটার মধ্যে নামল। কিন্তু বেশি দূর গেল না। সিঁড়ির কয়েক ধাপ নীচে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

সে ভাবল, কাকাবাবুকি রাজকুমারকে গুলি করে একেবারে মেরে ফেলবেন নাকি? সে কান খাড়া করে রইল।

কিন্তু গুলির শব্দের বদলে কিসের যেন ধাপ-ধপ আওয়াজ হতে লাগল। আর রাজকুমার বিকট চিৎকার করে বলতে লাগল, মরে গেলাম! মরে গেলাম! আর করব না, আর করব না, এবারকার মতন। দয়া করুন!

কাকাবাবু বললেন, না, তোমায় দয়া করব না। যতই চ্যাঁচাও কেউ শুনতে পাবে না! তুমি একটু আগেই আমাকে খুন করতে চাইছিলে না?

সন্তু কাকাবাবুর এত রাগ অনেকদিন দেখেনি। অথচ এর আগে সারাক্ষণ কাকাবাবু রাজকুমারের সঙ্গে ইয়ার্কির সুরে কথা বলছিলেন।

সন্তুর খুব কৌতূহল হচ্ছে কাকাবাবু ওকে কী শাস্তি দিচ্ছেন দেখবার জন্য। কিন্তু মাথা তুলতে সাহস করল না। ওপরের ধপধপ আওয়াজটা থেমে গেল, কিন্তু রাজকুমারের কান্না চলতে লাগল।

হঠাৎ নীচের দিকে তাকাতেই সন্তুর বুক কেঁপে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠে আসছে। সিঁড়িটা যেখানে বেঁকে গেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে টর্চের আলো।

সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুর দুটো কথা মনে হল। টর্চের আলো নিয়ে যখন আসছে, তখন নিশ্চয়ই অন্য লোক। আর অন্য লোক যখন এই সিঁড়ির সন্ধান পেয়ে গেছে, তখন দেবলীনা নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে!

দেরি করার সময় নেই, সন্তু তরতার করে ওপরে উঠে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, কাকাবাবু, কেউ একজন আসছে! টর্চ নিয়ে!

কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে রাজকুমারের মুখটা চেপে ধরে ওর চিৎকার বন্ধ করে দিলেন। সন্তুকে বললেন, আর-একটা ন্যাকড়া নিয়ে আয়, ওর মুখটা বাঁধতে হবে। এটা আগেই করা উচিত ছিল।

সন্তু আর-একটা কাপড় নিয়ে এল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রাজকুমারের মুখ বাঁধা হয়ে গেল। এরই মধ্যে সে দুবার বাঁচাও, বাঁচাও বলে ফেলল।

কাকাবাবু সুইচ অফ করে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলেন। তারপর মেঝের গর্তটার পাশে এসে বসলেন। সন্তুও বসল। অন্য দিকে। অন্ধকার ফুড়ে টর্চের আলো এসে পড়ল ঘরের মধ্যে। কিন্তু যে লোকটি সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল, সে থেমে গেছে এক জায়গায়।

এই ছোট চৌকো গর্ত দিয়ে একজনের বেশি একসঙ্গে উঠতে পারবে না। যে আসবে, তাকে আগে মাথাটা বাড়াতেই হবে। একটা মাত্র ডাণ্ডার বাড়ি মেরে তাকে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যায়।

সেই কথা বুঝেই ওই লোকটি আর উঠল না, দাঁড়িয়ে পড়েছে। এখন ওপর থেকেও কেউ নীচে নামতে গেলে লোকটা সহজেই তাকে কাবু করে ফেলবে!

লোকটি কোনও সাড়াশব্দও করছে না।

কাকাবাবু আর সন্তু নিঃশব্দে বসে রইল সেখানে। তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। কিন্তু এই গর্তটার কাছে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লোকটা যে-কোনও সময়ে ওপরে উঠে আসতে পারে।

সন্তুর খুব অনুতাপ হচ্ছে দেবলীনাকে এক ফেলে আসার জন্য। অবশ্য সন্তু যখন তাকে বলেছিল, আমি একটু কাকাবাবুকে দেখে আসি, তুমি এখানে একা থাকতে পারবে?-সে বলেছিল, হ্যাঁ, পারব।

নীচের লোকটা টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। এখন একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে লোকটা হঠাৎ মাথা তুলতে পারে বলে কাকাবাবু তাঁর একটা ক্রাচ গর্তের মুখে আড়াআড়ি ভাবে রাখলেন।

তারপর এক-এক ঘণ্টার মতন লম্বা এক-একটা মিনিট কাটতে লাগল। কিছুই ঘটছে না। অসহ্য সেই প্ৰতীক্ষা! অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে থাকতে-থাকতে যেন চোখ ব্যথা করে।

তারপর একসময় পেছনের দেয়ালে ঘর্ঘর শব্দ হল। ওদিকের দরজাটা খুলে যাচ্ছে। কেউ ঢুকছে ওদিক থেকে। এবার দুদিকেই শত্রু। কাকাবাবু ক্রাচটা সরিয়ে নিয়ে চৌকো পাথরটা গর্তে চাপা দিয়ে সেখানে বসে পড়লেন। সন্তুর গা টিপে বুঝিয়ে দিলেন একেবারে চুপ করে থাকতে।

দরজাটা খোলার পর জগাই মল্লিক মুখ বাড়িয়ে বলল, আল ক্লিয়ার। এবারে বেরিয়ে আসতে পারো। আর কিছু চিন্তা নেই। এ কী, ঘর অন্ধকার কেন? রাজকুমার, রাজকুমার

কেউ কোনও সাড়া দিল না। শুধু রাজকুমারের মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ বেরুল।

জগাই মল্লিক ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, এত ভয় যে, আলো নিভিয়ে আছ? আমি থাকতে চিন্তার কী আছে? ও রাজকুমার, ও রায়চৌধুরীবাবু!

পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ হল।

দেয়াল হাতড়ে সুইচটা টিপে আলো জ্বেলেই সে আঁতকে উঠল।

কাকাবাবু তার দিকে রিভলভার উঁচিয়ে আছেন।

শান্ত গলায় কাকাবাবু বললেন, পাশার দান উলটে গেছে, জগাই মল্লিক। এবারে আমি হুকুম দেব!

চাটু করে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করে জগাই মল্লিক বলল, ওই পিস্তলটা বুঝি রাজকুমারের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন? ওটা একটা অপদাৰ্থ! কোনও কম্মের নয়! যাকগে, ভালই হয়েছে। আপনি আমার দিকে ওটা উঁচিয়ে আছেন কেন? আপনার সঙ্গে তো আমার কোনও ঝগড়া নেই! আমি ওই ব্যাটার কাছ থেকে আপনাকে উদ্ধার করে এনেছি!

কাকাবাবু বললেন, পেছনের দরজাটা খুলুন।

জগাই মল্লিক পেছন ফিরে দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে বলল, আরেঃ, এ দরজাটা কে বন্ধ করল?

দেয়ালের গায়ে কিল মেরে সে চেঁচিয়ে উঠল, এই খোল, খোলা! এই পন্টু, এই ভোলা?

কিন্তু এদিক থেকে কোনও আওয়াজই যায় না। কেউ দরজা খুলল না। খুব সম্ভবত জগাই মল্লিক একই দরজা খুলে ঢুকেছে, তারপর দরজাটা নিজে-নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে।

জগাই মল্লিক বলল, যাকগে, একটু পরে ওরা কেউ এসে খুলে দেবে।

কাকাবাবু বললেন, যে-করেই হোক, এক্ষুনি দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করুন!

ও দরজা তো ভেতর থেকে খোলা যায় না!

কোনও গোপন উপায় নেই?

না, তার জন্য ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? একটু বাদেই আমার কোনও লোক এসে খুলে দেবে। ওরা এখন নীচে পুলিশের লোকদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছে! পুলিশ সার্চ করে কিছুই খুঁজে পায়নি। এ কী, আমার বিষ্ণুমূর্তি? মোটে একটা কেন?

সে-মূর্তি স্বর্গে ফিরে গেছে।

অ্যাঁ? আর সেই মেয়েটা?

সেই মেয়েটাকে আপনার, লোক ঘাড় ধরে এই ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। তার কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছিল, তবু আপনি কোনও কথা বলেননি।

মেয়েটা পুলিশ এসেছে শুনেই টিয়াপাখির মতন চ্যাঁচাতে গেল কেন?

আপনি বলেছিলেন, আপনার ওই বয়েসি ছেলেমেয়ে আছে। আপনার ছেলে বা মেয়েকে কেউ ওইরকমভাবে ছুঁড়ে দিলে আপনি সহ্য করতেন?

আহা, ওসব ছোটখাটো কথা এখন থাক না। আমার বিষ্ণুমূর্তি কোথায় গেল?

ওই মূর্তিটা উদ্ধার করতে গিয়ে আমায় সাপে কামড়েছিল। ওটা আপনার হয়ে গেল কী করে?

আমি দাম দিয়ে কিনেছি।

টাকা দিয়ে সবই কেনা যায়, না? মানুষও কেনা যায়!

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। একটু সরে এসে বললেন, আপনার লোক এসে কতক্ষণে ঐ দরজা খুলবে, ততক্ষণ আমার ধৈর্য থাকবে না। তার আগেই আমার কাজ শুরু করতে হবে। ওই রাজকুমারের দিকে চেয়ে দেখুন। ওরা দুটো বুড়ো আঙুল আমি জন্মের মতন র্থেতলে দিয়েছি। বুড়ো আঙুল না থাকলে কী হয় জানেন? যার বুড়ো আঙুল থাকে না সে কোনও অস্ত্র ধরতে পারে না। ও এখন হাত দিয়ে অন্য সব কাজই করতে পারবে, কিন্তু কোনওদিন আর ছুরি-ছোরা-বন্দুক ব্যবহার করতে পারবে না।

রাজকুমার বড়-বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে। এই সময় কুঁ-বু শব্দ করে কিছু বলতে চাইল।

কাকাবাবু বললেন, এখন আমি যা বলব, তার যদি একটুও নড়াচড় হয়, তা হলে তোমারও ওই অবস্থা হবে জগাই মল্লিক?

তারপর সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, তুই ওই সিঁড়ির পাথরটা সরিয়ে দে!
জগাই মল্লিক দুহাত তুলে বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান, রায়চৌধুরীবাবু, আগে আমার একটা কথা শুনুন! আমি কি আপনার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেছি। আপনার কী চাই বলুন!

কাকাবাবু বললেন, আমি চাই, তুমি ওই সিঁড়ি দিয়ে প্রথমে নামবে!

মেঝের গর্তটার দিকে তাকিয়ে জগাই মল্লিক যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বিড়বিড় করে বলল, সিঁড়ি, সিঁড়ি, ওটার কথা তো–আমি নিজেই প্ৰায় ভুলে গেছলাম। দশ-বারো বচ্ছর ব্যবহার হয়নি। ওর মধ্যে সাপখোপ কী না কী আছে!

কাকাবাবু বললেন, সে-সব কিছু নেই। সিঁড়ির মাঝপথে রয়েছে। একজন মানুষ। সে তোমার লোকও হতে পারে, পুলিশের লোকও হতে পারে। তুমি আগে আগে নামবে। তোমার লোক যদি হয়, তুমি বলে দাও যেন গুলি টুলি না চালায়। চালালে, তুমিই আগে মরবে!

ওখানে কে আছে, আমি তো জানি না!

তা হলে গিয়ে দেখতে হবে। চলো!

শুনুন, শুনুন! আগে যা হয়েছে, হয়েছে, সব ভুলে যান। সব ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাকে আর আপনার ভাইপো-ভাইঝিকে এক্ষুনি বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। মা-কালীর নাম নিয়ে বলছি, আপনাদের গায়ে আর কেউ হাত ছোঁয়াবে না।

বিপদে পড়লেই যত রাজ্যের শয়তান-বদমাইশদের ধর্মের কথা মনে পড়ে। আর এক সেকেন্ড দেরি নয়। আর দেরি করলে প্রথমে তোমার দুপায়ে গুলি করব, তারপর জোর করে ধাক্কা দিয়ে তোমাকে ওই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে দেব।

জগাই মল্লিক অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। রাজকুমার আবার বুবু শব্দ করল মুখ দিয়ে।

কাকাবাবু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এইখানেই পড়ে থাকবে। কই জগাই মল্লিক, নামো?

জগাই মল্লিক গর্তটার কাছে মুখ নিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, এই নীচে কে আছিস? আমি বড়বাবু, আমি আসছি।

তলা থেকে কোনও সাড়া এল না।

কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে বললেন, আমি এটা দিয়েই কাজ চালাব, সন্তু তুই আর-একটা নিয়ে আয়। তুই আমার পেছন-পেছন আসবি।

জগাই মল্লিক মোটাসোটা মানুষ, পুরো সিঁড়িটা তার শরীরে ঢেকে আছে। কাকাবাবু তার পিঠে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে নামতে লাগলেন।

জগাই মল্লিক এক ধাপ করে নামছে, আর চেঁচিয়ে বলছে, এই কে আছিস, আমি বড়বাবু! আমি বড়বাবু!

সিঁড়িটা যেখানে প্রথম বেঁকেছে, সেখানে সে থমকে দাঁড়াল।

কাকাবাবু বললেন, থেমে লাভ নেই। আবার চেঁচিয়ে দ্যাখো, তোমার লোক আছে কি না। এগোতে তোমাকে হবেই।

জগাই মল্লিক আবার চ্যাঁচাল। কোনও সাড়া এল না।

তারপর সে বাঁকের মুখে এক পা রাখতেই ওপাশ থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে তার গলা ধরে টেনে নিয়ে গেল চোখের নিমেষে।

কাকাবাবু এক পা পিছিয়ে এলেন।

জগাই মল্লিকের ভয়ার্তা চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে শোনা গেল একটা ভারী শরীর গড়িয়ে পড়ার শব্দ। যে টেনে নিয়েছে, সে সিঁড়ি দিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। গড়ানোর শব্দ আর চিৎকার দুটোই এক সঙ্গে থেমে গেল।

কাকাবাবু দৃঢ় গলায় বললেন, ওপাশে কে? বাঁচতে চাও তো সরে যাও, নইলে আমি গুলি করব।

এবারে একজন বলে উঠল, হামার সাহেব কোথায় আছে? তুমাদের সাথে আছে?

সন্তুর সবঙ্গে একটা শিহরন খেলে গেল। এই গলার আওয়াজ তার চেনা। এ তো টাইগার নামে বিশাল চেহারার সেই লোকটা। টাইগার ওপরেই একটা ঘরে বসে ছিল। কখন নীচে নেমে গেছে, আর সিঁড়ির মুখটা খুঁজে পেয়েছে।

এই টাইগার কিন্তু সন্তুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। সে প্ৰভুভুক্ত, সে তার সাহেবের খোঁজ নিতে এসেছে।

সন্তু কাকাবাবুর পিঠে হাত দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, টাইগারজি, তোমার সাহেব নেই। তুমি সরে যাও, আমাদের যেতে দাও! আমাদের সঙ্গে সত্যি রিভলভার আছে।

ওপাশ থেকে টাইগার বলল, হামার সাহেব মরে গেছে?

কাকাবাবু বললেন, না, সে মরেনি। কিন্তু তার চাকরি আর তোমাকে করতে হবে না। তুমি যদি বাঁচতে চাও তো পালাও!

টাইগার বলল, সাহেবের জন্য হামি জান দেব, তবু ভাগব না!

কাকাবাবু বললেন, সাহেবের জন্য তোমাকে জান দিতে হবে না। তবে সাহেবের সঙ্গে যদি একসঙ্গে জেল খাটতে চাও, তবে থাকো।

কাকাবাবু বুঝে গেছেন টাইগারের কাছে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই। ছুরি-টুরি থাকতে পারে। তিনি মাথাটা বা দিকে হেলিয়ে টাইগারকে একপলক দেখে নিলেন। তারপর বললেন, সময় নষ্ট কোরো না, এবার তোমার পায়ে গুলি চালাবা! তুমি পিছু হটো!

টাইগার কয়েকটা সিঁড়ি নেমে যেতেই কাকাবাবু চট করে বাঁক ঘুরে বললেন, দাঁড়াও! আর এক পা নড়বে না! নড়লেই গুলি চালাব। শোনো, তোমাকে ছেড়ে দিতে রাজি আছি। কিন্তু তার আগে বলো, আমাদের সঙ্গের মেয়েটি কোথায়? তার কোনও ক্ষতি হলে তোমায় শেষ করে দেব!

টাইগার বলল, সে লেড়কি নীচে আছে। ঠিক আছে।

কাকাবাবু বললেন, আগে তাকে দেখতে চাই, তারপর তোমাকে ছাড়ব।–এক পা এক পা করে নামো।

কিন্তু টাইগার এবারে দৌড় মারার চেষ্টা করল। কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাতেই সে আছড়ে পড়ল। সেইসঙ্গে সিঁড়িতে প্ৰচণ্ড শব্দ হল গুলির।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, ইচ্ছে করে ওর গায়ে গুলি করিনি, শুধু ওকে ভয় দেখিয়েছি, ও বোধহয় এতক্ষণ বিশ্বাস করছিল না।

তারপর তিনি হেঁকে বললেন, এই ওঠে, টাইগার। এক পা এক পা করে নামবে। দেবলীনা যদি ঠিকঠাক থাকে, তবে তোমার ছুটি। আর তা না-হলে এতে আরও যে-কটা গুলি আছে সব তোমার মগজে ভরে দেব!

টাইগার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সাহেবের পিস্তল ছিনিয়ে নিয়েছেন। তবে হামার সাহেব খতম?

কাকাবাবু বললেন, তোমার সাহেবের কাজ-করবার সব খতম। তোমাকে অন্য চাকরি খুঁজতে হবে, যদি পুলিশের হাতে ধরা না পড়ো!

জগাই মল্লিকের দেহটা এক জায়গায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। টাইগার তাকে ডিঙিয়ে নামল। কাকাবাবু তার কাছে এসে নিচু হয়ে ওর নাকটা খুঁজে সেখানে হাত রাখলেন।

তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নিশ্বাস পড়ছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। ও থাক এখানে। এখন কিছু করা যাবে না।

সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পর যেখানে বারান্দা, সেখানে ভেতরের দিকে দরজা আছে একটা। সন্তু আগে এই দরজাটা বন্ধ দেখেছিল, এখনও বন্ধ। কিন্তু টাইগার সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে ঠেলতেই সেটা খুলে গেল।

এবারে টাইগার টর্চ জেলে বলল, ইধারে আসুন।

সন্তু বুঝল, টাইগার তাদের মতন বারান্দা ডিঙিয়ে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসেনি। মাটির তলার জায়গাটায় ঘুরতে-ঘুরতে সে কোনওক্রমে এই দরজাটা খুঁজে পেয়েছে, তারপর দরজাটা খুলে কিংবা তালা ভেঙে সে দেখতে পেয়েছে। সিঁড়িটা।

সেই ঘরের মধ্যে আবার একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি আছে। সেটা নেমে গেছে মাটির নীচে। ফের একতলা নামবার পর আবার একটা দরজা। টাইগার এক হ্যাঁচকাটানে সেই দরজাটা খুলতেই বাইরের টাটকা হাওয়া নাকে এল।

এই জায়গাটা ওপরের বারান্দার ঠিক তলায়। এখানে আগাছার জঙ্গল হয়ে আছে, তাই বাইরে থেকে দরজাটা দেখতে পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

টাইগার সেই ঝোপের মধ্যে টর্চের আলো ফেলে বলল, ইয়ে দেখিয়ে। হামি ওকে মারিনি, কিছু বলিনি, কোনও লেড়কিকে আমি মারি না। লেকিন ও হামার হাথ কামড়ে দিয়েছে!

একটা জলের পাইপের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে দেবলীনা। তার মুখে একটা রুমাল গোঁজা। চোখ বন্ধ, ঘাড়টা হেলে গেছে একদিকে।

দেবলীনাকে ওই অবস্থায় দেখেই সন্তুর বুকটা কেঁপে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, দ্যাখতো। ওর বাঁধন খুলে দে!

সন্তু খুব সাবধানে ওরা থুতনিটা ধরে উঁচু করে মুখ থেকে আগে দালা-পাকানো রুমালটা বার করল টেনে-টেনে। দেবলীনা চোখ মেলে তাকাল।

কাকাবাবু টাইগারকে বললেন, তুমি এখন যেতে পারো। আর এ-সব কাজ কোরো না। তোমার গায়ে শক্তি আছে, অন্য অনেক কাজ পাবে। আর কখনও যদি তোমাকে কোনও বদমাশদের দলে দেখি, তা হলে কিন্তু আর ক্ষমা করব না।

টাইগার অন্য কিছু বলল না, শুধু বলল, টৰ্চটা আপনাদের লাগবে। এই নিন।

টাৰ্চটা সে কাকাবাবুর পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

বাঁধন খুলে দেবার পর দেবলীনা ছুটে এসে কাকাবাবুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল হু-হু করে। কাকাবাবু তার পিঠে হাত ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ব্যস, ব্যস, সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কোনও ভয় নেই। বাবাঃ, তুমি যা বিপদে ফেলেছিলে এবারে আমাদের। তোমার জন্যই তো এত সব কাণ্ড হল?

দূরে একটা কুকুর ডেকে উঠল ঘেউ-ঘেউ করে।

কাকাবাবু বললেন, এখানেও পাহারাদার কুকুর আছে? আমার কুকুর মারতে খারাপ লাগে। দেখা যাক কী হয়। তোরা দুজনে আমার পেছন-পেছন আয়?

খানিকটা এগোতেই একটা কুকুর ডাকতে-ডাকতে ছুটে এল এদিকে। কাকাবাবু রিভলভারটা ধরে রাখলেন। সন্তু মুখ দিয়ে শব্দ করল, চুঃ, চুঃ!

কুকুরটা থমকে দাঁড়িয়ে ওদের দেখল। তারপর আবার দৌড়ে ফিরে গেল।

কাকাবাবু বললেন, তেমন বিপজ্জনক নয়।

বাড়ির পেছন দিকটা ঘুরে সামনের দিকটায় বাগানের কাছে আসতেই দেখা গেল পর পর দুটো জিপ-গাড়ি। বাগানে আলো জ্বলছে। গাড়ি দুটো সবে স্টার্ট নিয়েছে, একটা গাড়ির পাশে-পাশে হাঁটতে-হাঁটতে যে-লোকটি হেসে-হেসে কথা বলছে, তাকে দেখে সন্তুর চোখ কপালে উঠে গেল।

জগাই মল্লিক!

কাকাবাবু চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন, ধ্রুব! ধ্রুব!

পেছনের জিপটা থেকে একজন মুখ বাড়িয়ে বলল, কে? আমার নাম ধরে কে ডাকছে?

কাকাবাবু আবার বললেন, ধ্রুব, একটু শোনো?

জিপ দুটো থেমে গেল।

কাকাবাবু সন্তু আর দেবলীনাকে বললেন, তোমরা ওই গাছতলায় অন্ধকারে একটু লুকিয়ে থাকে। খানিকটা মজা করা যাক। সন্তু, ওই যে ওই লোকটাকে দেখছিস, ও কিন্তু জগাই মল্লিক নয়। তার যমজ ভাই মাধব মল্লিক।

ধ্রুব রায় জিপ থেকে নেমে পড়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। কাকাবাবু কাছে এসে বললেন, এই যে ধ্রুব, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।

ধ্রুব রায় বললেন, কাকাবাবু? আপনি এখানে? দুদিন ধরে আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ-মহল তোলপাড়।

কাকাবাবু হাসিমুখে বললেন, না, না, আমি নিজেই একটু বেড়াতে গিয়েছিলুম।

তারপর হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে মাধব মল্লিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই তো মাধ্যই মল্লিক, তাই না?

লোকটি নীরস গলায় বলল, মাধাই নয়, মাধব। আপনাকে তো চিনতে পারলুম না?

কাকাবাবু বললেন, আমি এমনিই একজন সাধারণ লোক। গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছিলুম, ভুল করে আপনাদের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়েছি।

তারপর ধ্রুব রায়কে বললেন, তুমি এই মাধ্যই মল্লিকবাবুকে তোমার জিপে একটু উঠে বসতে বলে। উনি একটু অপেক্ষা করুন, ততক্ষণে তোমার সঙ্গে আমি একটা প্ৰাইভেট কথা সেরে নিই!

মাধাই মল্লিক রেগে গিয়ে বলল, কেন, আমায় জিপে উঠে বসতে হবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, বসুন না! শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন, জিপে উঠে বসুন বরং। এসো ধ্রুব?

ধ্রুব রায় কাকাবাবুর ইঙ্গিতটা বুঝে একজন ইন্সপেক্টরের দিকে ইঙ্গিত করলেন মাধাই মল্লিকের ওপর নজর রাখবার জন্য।

তারপর কাকাবাবুর সঙ্গে হেঁটে এলেন খানিকটা।

বাগানের মাঝামাঝি এসে ধ্রুব রায় বললেন, এবারে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন!

কাকাবাবু বললেন, সে-সব পরে বলা যাবে। তার আগে একটা কথা। তুমি একবার আমার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাবে বলেছিলে না?

ধ্রুব বলল, হ্যাঁ, তা তো বলেছিলাম…

এখানেই সেরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার শুরু করা যায়।

এখানে মানে এই বাড়ির মধ্যে? আমরা তো একটা খবর পেয়ে সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছিলুম। সারা বাড়ি খুঁজে দেখা হল, সেরকম কিছুই নেই। মাটির তলায় কয়েকটা ঘর আছে অবশ্য, কিন্তু সেখানে শুধু সিমেন্টের বস্তা।

কাকাবাবু বললেন, এসো আমার সঙ্গে।

হাঁটতে-হাঁটতে পেছনের দিকের সেই ছোট বারান্দাটার তলায় এসে বললেন, এই যে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা দরজা দেখছ, এটা ঠেলে ঢুকে গেলে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দেখবে। সেটা দিয়ে উঠলে, এই মাথার ওপরে বারান্দাটার একদিকে আবার একটা গোপন সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে। দ্যাখো তো কিছু পাওয়া যায় কি না?

ধ্রুব রায় বললেন, আপনি আসবেন না?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমি পরে আসছি। তুমি এগোও। এই নাও, টৰ্চটা নাও! সোজা একেবারে চারতলায় উঠে যাবে।

ধ্রুব রায় সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করতেই কাকাবাবু বাগানের দিকে এগিয়ে এসে হাতছানি দিয়ে সন্তু আর দেবলীনাকে ডাকলেন।,

ওরা কাছে আসতেই কাকাবাবু বললেন, ধুবকে ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের আর সিঁড়ি ভাঙবার দরকার নেই, কী বল? ও ফিরে এসে দেবলীনাকে দেখে আবার অবাক হবে। ততক্ষণ আমরা গঙ্গার ধারে একটু বসি।

সন্তু আর দেবলীনাকে দুপাশে নিয়ে তিনি গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত