উল্কা-রহস্য

উল্কা-রহস্য

জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। প্রায় চৌকোমতন জায়গাটাতে শুধু ঘাস হয়ে আছে, অনায়াসেই একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটা যায়। অনেক গভীর জঙ্গলের মধ্যেই হঠাৎ-হঠাৎ এরকম এক-একটা ফাঁকা জায়গা থাকে। কেন যে এখানে বড় গাছ জন্মায় না তা কে জানে!

সেই জায়গাটার এককোণে একটা গোল পাথরের ওপর বসে আছেন কাকাবাবু। প্রচণ্ড রোদ বলে তাঁর মাথায় একটা টুপি। তাঁর পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, ডান হাতে আলগা করে ধরে আছেন রিভলভার।

সন্তু দাঁড়িয়ে আছে কাকাবাবুর পেছনদিকে। তার মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় সে খুব ভয় পেয়েছে। বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও সে বেশি ভয় পায় সাপকে। সাপটা রয়েছে ফাঁকা জায়গাটার প্রায় মাঝখানে, কালো রঙের গা, প্রায় দু হাত লম্বা, খুব আস্তে-আস্তে সেটা পাথরটার দিকেই এগোচ্ছে আর এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে কী যেন খুঁজছে।

সন্তু প্রায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কাকাবাবু, মারো! ওটাকে মাররা!

কাকাবাবু যেন সন্তুকে ভয় পাওয়াবার জন্যই মজা করে বললেন, আর একটু কাছে আসতে দে না!

সন্তু বলল, যদি সড়াৎ করে দৌড়ে চলে আসে!

কাকাবাবু বললেন, সাপকে, কখনও দৌড়তে দেখেছিস? আমি তো দেখিনি!

সন্তু বলল, লাফিয়ে উঠতে পারে! পারে না?

কাকাবাবু বললেন, তা পারে। কিন্তু সাপটা এখন হাই জাম্প দেওয়ার মেজাজে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না! ও বোধ হয় আমাদের দেখতেই পায়নি!

সন্তু বলল, ওই যে, ওই যে মাথা তুলছে!

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, বিষাক্ত সাপই বটে। বেশ বড় ফণা। তবে সাপ দেখলেই যে সেটাকে মেরে ফেলতে হবে তার কোনও মানে নেই। ও বেচারারা নিরীহ প্রাণী, সাধারণত মানুষের কোনও ক্ষতি করে না।

রিভলভারটা তুললেন কাকাবাবু। সাপটার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, আগে সাপ দেখলেই আমার খুব ঘেন্না করত। পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে কম সাপ তো দেখিনি! যখন বয়েস কম ছিল, তখন সাপ দেখলেই মেরে ফেলতাম। এখন একটু মায়া-দয়া বেড়ে গেছে রে! এখন মনে হয়, ও যদি আমাদের ক্ষতি না করে তা হলে শুধু-শুধু মেরে কী হবে?

সন্তু বলল, আমরা ওইদিকে যাব কী করে?

কাকাবাবু বললেন,তুই একটু নাচতে পারবি?

সন্তু কোনও উত্তর দিল না বলে কাকাবাবু হেসে বললেন, সার্প তাড়াবার সবচেয়ে ভাল উপায়টা জানিস না বুঝি? যখন দেরাদুনে থাকতাম, তখন আমাদের ওখানকার বাড়ির বাগানে প্রায়ই সাপ আসত। আমার এক সহকর্মী আমার সঙ্গে থাকতেন, তাঁর নাম ফজলে রব্বি। সেই রব্বিসাহেব রোজ ভোরবেলা বাগানের ফুল গাছগুলোতে জল দিতে যেতেন পায়ে ঘুঙুর বেঁধে। হাতে জলের ঝারি নিয়ে তিনি নেচে-নেচে গান গাইতেন। সেইজন্যই…

সন্তু কাকাবাবুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, রিভলভারটা আমায় দাও, আমি গুলি করব।

কাকাবাবু বললেন, আগে নাচ শুরু কর না! দ্যাখ তাতে কী ফল হয়। আমি গান গাইছি, তুই নাচবি! এক দুই তিন! মম চিত্তে নিতি নিত্যে কে গো নাচে, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ!

সন্তু বাধ্য হয়ে ধুপধাপ করে নাচ শুরু করতেই সাপটা ফণা মেলে অনেকখানি সোজা হয়ে উঠল। কাকাবাবুর থেকে তার দূরত্ব বড়জোর দশ বারো হাত। সে মুখ ঘুরিয়ে এদিকে দেখল, চিড়িক-চিড়িক করে দুবার বেরিয়ে এল তার জিভ।

সন্তুর বুকখানা ভয়ে হিম হয়ে গেছে। সে এবার পেছন ফিরে পালাবার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু তার হাত চেপে ধরে বললেন, থামলি কেন! বেশ তো হচ্ছে। আরও জোরে নাচ, আরও জোরে!

কাকাবাবু গানটাও জোরে-জোরে গাইতে লাগলেন।

সাপটা এবার ফণাটা নামিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে উলটোদিকে চলে যেতে লাগল সরসর করে। স্পষ্ট বোঝা গেল সেটা ভয় পেয়ে পালাচ্ছে।

কাকাবাবু উল্লাসের সঙ্গে বললেন, দেখলি, নাচ আর গান দিয়ে কীরকম সাপকে জব্দ করা যায়? রব্বিসাহেব ঘুঙুর পরে নেচে-নেচে সাপ তাড়াতেন। তাঁরকাছে আমি এটা শিখেছি।

সন্তু বলল, আমি জানি, সাপ কানে শুনতে পায় না। মাটিতে পায়ের। আওয়াজ করলে সেই ভাইব্রেশন ওরা টের পায়। কিন্তু টের পেলেই কি পালায়? অনেক সময় মানুষকে তো কামড়ে দেয়!

কাকাবাবু বললেন, সে একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়লে কিংবা ওদের গায়ে পা লাগলে ওরা ভয়ের চোট কামড়ে দেয়। নিজে থেকে তেড়ে গিয়ে কামড়ায় না।

সাপটা ঘাসের মধ্যে মিশে গেলেও একটু-একটু দেখা যাচ্ছে। সেটা এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে সন্তুদের ঠিক উলটোদিকে।

সন্তু অসন্তুষ্টভাবে বলল, তুমি ওটাকে মারলে না। ওটা তো আশপাশেই রয়ে যাবে। সন্ধের পর যদি ওর গায়ে পা লেগে যায়?

কাকাবাবু বললেন, ওটাকে মারলেই তো পৃথিবীর সব সাপ শেষ হয়ে যাবে। এখানেও নিশ্চয়ই আরও আছে। আমাদের একটু সাবধানে পা ফেলতে হবে সন্ধের পর।

আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। এরই মধ্যে পশ্চিমদিক থেকে একখণ্ড মেঘ ভাসতে-ভাসতে আসছে। এখানে মেঘ অনেক নিচু দিয়ে আসে। একখানা মেঘের তলায় আর-একটা মেঘ স্পষ্ট দেখা যায়।

এই মেঘটা সূর্যকে ঢেকে দিতেই গরম অনেক কমে গেল। হাওয়া বইতে লাগল ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা। একটু আগে রীতিমতন গরম ছিল, রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছিল, আবার একটু পরেই শীতে কাঁপুনি ধরলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

কাকাবাবু রিভলভারটা পকেটে ভরে মাথা থেকে টুপিটা খুললেন। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, বৃষ্টি হবে নাকি রে?

সন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, আসুক বৃষ্টি। একটু না হয় ভেজা যাবে। ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ সন্তু, যেখানে সাপটা ছিল, সেখানে কতগুলো পাখি এসে বসল। প্রকৃতির এই এক মজা! একটু আগে যেখানে ছিল বিষাক্ত সাপ, এখন সেখানে কতকগুলো সুন্দর পাখি! ওগুলো কী পাখি বল তো?

সন্তু সেগুলোর দিকে একপলক তাকিয়েই বলল, চড়াই পাখি!

কাকাবাবু বললেন, তুই একদম পাখি চিনিস না। চড়াই পাখি অত ছোট হয় নাকি?

সন্তু বলল, বাচ্চা চড়াই ছোট হবে না? ওগুলো বাচ্চা!

কাকাবাবু বললেন, ওদের গায়ের রংও আলাদা। ওগুলো হচ্ছে মুনিয়া। এইসব পাহাড়ি জঙ্গলে অনেক মুনিয়া পাখির ঝাঁক দেখতে পাওয়া যায়।

তারপর একটু হেসে কাকাবাবু আবার বললেন, কিংবা, তুই কি বলতে চাস, কেউ চড়াই পাখির বাচ্চাদের গায়ে রং করে ছেড়ে দিয়েছে?

সন্তু প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। এই জঙ্গলে কে আবার চড়াই পাখির বাচ্চা ধরে-ধরে রং করবে? সন্তু সেরকম কথা ভাবতে যাবেই বা কেন?

কাকাবাবু বললেন, এই নিয়ে একটা গল্প আছে। মুনিয়া অনেকরকম হয়। এক জাতের মুনিয়াকে বলে ক্যানারি। তারা সুন্দর শিস দেয়, গানের মতন শোনায়। অনেকটা দোয়েল পাখির মতন। সাহেব-মেমরা খুব ক্যানারি পাখি পোষে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে, যখন ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা জাহাজেই বেশি যাতায়াত করত, প্লেনের চল হয়নি, তখন অনেক সুন্দর বন্দরে এই ক্যানারি পাখি পাওয়া যেত। বন্দরের ঘাটে জাহাজ লাগলে স্থানীয় লোকেরা নৌকো করে এসে নানারকম জিনিস বিক্রি করত, তার মধ্যে ক্যানারি পাখিও থাকত। এডেন বন্দরে খুব ক্যানারি পাখি পাওয়া যেত।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এডেন, না আডেন?

কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবারে, আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে কিছু ভুল বলবার উপায় নেই। তোরা অনেক কিছু জানিস। হ্যাঁ, আসল উচ্চারণটা আডেন ঠিকই, বাংলায় আমরা বরাবর এডেনই বলেছি। তুই ক্যানারির গল্পটা জানিস নাকি?

সন্তু বলল, না। সেটা বলো!

কাকাবাবু বললেন, সেই বন্দরে ক্যানারি পাখির খুব ডিমান্ড ছিল। সব বিক্রি হয়ে যেত। সেইজন্য ভেজালও চলত খুব। কেউ-কেউ চড়াই পাখির বাচ্চার গায়ে রং করে ক্যানারি পাখি বলে চালিয়ে দিত। একবার একজন লোক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে খুব দরাদরি করে খাঁচাছু একটা ক্যানারি পাখি কিনল। দাম ঠিক হল এক পাউন্ড। নৌকো থেকে খাঁচাটা তুলে দেওয়া হল জাহাজে। আর সাহেবটি একটা পাউন্ডের কয়েন ছুঁড়ে দিল দোকানির হাতে। তারপর জাহাজ যখন ছেড়ে দিল, সাহেব-খদ্দেরটি দোকানিকে আর ধরতে পারবে না, তখন দোকানি চেঁচিয়ে বলল, ও মিস্টার, দ্যাট ক্যানারি উইল নেভার সিংগ। সাহেব খদ্দেরটিও চোখ টিপে বলল, অ্যান্ড দ্যাট কয়েন উইল নেভার রিং?

সন্তু হাসতে-হাসতে বলল, খাঁচাটাই লাভ হল। নকল টাকা দিয়েছে!

কাকাবাবু বললেন, জাহাজে যাওয়ার সময় এইরকম অনেক মজা হত। আমিও একবার গিয়েছিলাম।

উঠে দাঁড়িয়ে, দু হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে কাকাবাবু বললেন, এখানে এসে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক ঝাঁক টিয়া, দুরকম বুলবুলি, শালিক, কাঠঠোকরা আর ময়না দেখেছি। খুব বড় পাখি তো চোখে পড়েনি একটাও!

সন্তু বলল, যে পাখিগুলোর গায়ে অনেকরকম রং, ওগুলো কী পাখি?

কাকাবাবু বললেন, ওইগুলোই তো কাঠঠোকরা। সরু ঠোঁট। ওরা গাছের গায়ে গর্ত করে। কাঠঠোকরা আর মাছরাঙা পাখি খুব রংচঙে হয়।

সন্তু বলল, কাকও দেখতে পাইনি!

কাকাবাবু বললেন, জঙ্গলে সাধারণত কাক দেখা যায় না। কাক থাকে মানুষের কাছাকাছি। শহরে বা গ্রামে। কিন্তু হাঁস-টাঁসের মতন বড় পাখি তো দেখলাম না একটাও। তা হলে ওই পাখিগুলো আসে কোথা থেকে?

সন্তু বলল, কী জানি! কাকাবাবু ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে বললেন, চল, জঙ্গলের মধ্যে আর একটুখানি ঘুরে দেখি। যদি বড় পাখির সন্ধান পাওয়া যায়।

এমন সময় ফাঁকা জায়গাটার অন্য প্রান্তে একটা লোককে দেখা গেল। সেই লোকটি আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে।

সন্তু লোকটিকে দেখেই চেঁচিয়ে বলল, সাবধান! সাবধান! ওইদিকে একটা সাপ আছে!

লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু খুব একটা চমকে উঠল না। সন্তুদের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? সাপ? কোথায়?

সন্তু বলল, এই ঘাসের মধ্যে আছে। আমরা একটু আগেই দেখেছি। ওইদিকেই গেছে।

লোকটি মুখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। তারপর কোমর বেঁকিয়ে ঝুঁকে, সাবধানে পা ফেলে-ফেলে সাপটাকে খুঁজতে লাগল।

সন্তু বলল, বাবাঃ! লোকটার কী সাহস!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সাহস আছে ঠিকই। কিন্তু লোকটার পায়ের দিকে দ্যাখ, হাঁটু পর্যন্ত ভোলা গামবুট পরে আছে। সাপ সাধারণত পায়েই কামড়ায়, ওকে কিছু করতে পারবে না!

লোকটি কিছুক্ষণ সাপটাকে খুঁজল, কিন্তু পেল না। সেটা নিশ্চয়ই কোনও গর্তে ঢুকে পড়েছে।

এবার সে ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে সন্তুদের কাছে এসে বলল, আপনারা সাপটাকে ভাল করে দেখেছিলেন? বিষাক্ত সাপ ছিল? আপনারা সাপ চেনেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বিষাক্ত সাপ। অনেকটা ফণা তুলেছিল।

লোকটি বলল, ইস্! খুব মিস্ হয়ে গেল। আর একটু আগে এলে..

কথা থামিয়ে সে হাত জোড় করে নমস্কার করল। তারপর কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয়ই রাজা রায়চৌধুরী? আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম। আপনি সার্কিট হাউসে এসে উঠেছেন শুনলাম।

কাকাবাবুও প্রতি-নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?

লোকটি বলল, চিনবে কী করে? আমার সঙ্গে তো আপনাদের আগে আলাপ হয়নি। আমার নাম পীতাম্বর পাহাড়ী। হ্যাঁ, সত্যিই আমার পদবি পাহাড়ী। আমার বাড়ি মেদিনীপুর, সেখানে কোনও পাহাড় নেই অবশ্য, তবু আমরা পাহাড়ী। এই নামের জন্যই বোধহয় এখন আমাকে পাহাড়ে-পাহাড়ে কাটাতে হয়। আমি এখন এখানেই থাকি। সাপ ধরার ব্যবসা করি।

সন্তু বলল, সাপ ধরা?

লোকটি বলল, হ্যাঁ। সাপ ধরে-ধরে বিষ বের করি। সেই বিষ ভাল দামে বিক্রি হয়। ওষুধ তৈরির কাজে লাগে। কথায় আছে না, বিষে বিষক্ষয়! বিষ দিয়েও ওষুধ তৈরি হয়।

সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিজে সাপ ধরেন? কী করে ধরেন? খালি হাতে?

লোকটি বলল, আমার একটা লম্বা লোহার চিমটে আছে। সেটা দিয়ে ধরা খুব সোজা। খালি হাতেও ধরতে শিখে গেছি। মাথার পেছনদিকটা খপ করে চেপে ধরলে সাপ তো আর কিছু করতে পারে না। মাগুর মাছের মতন!

কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবা, খালি হাতে সাপ ধরা! আপনি তো সত্যিই খুব সাহসী লোক মশাই!

লোকটি বলল, প্র্যাকটিস! প্র্যাকটিস!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার কাছে যাচ্ছিলেন কেন, পীতাম্বরবাবু?

এমন সময় ঝাঁ করে বৃষ্টি এসে গেল। বেশ বড় বড় ফোঁটা। সবাই মিলে সরে গিয়ে দাঁড়াল একটা বড় গাছতলায়।

লোকটি বলল, আমাকে বাবুটাবু বলবেন না। পীতাম্বর নামটাও আমার পছন্দ নয়। আমাকে শুধু অম্বর বলে ডাকবেন। আমি এখন সাপ ধরে বেড়াই বটে কিন্তু একসময় তো কলেজে-টলেজে পড়েছি। শহরেও থেকেছি। তখন আপনার নাম শুনেছি। আপনার সম্পর্কে কাগজে লেখায় পড়েছি। এই ছেলেটি নিশ্চয়ই সন্তু?

সন্তু দু হাত তুলে নমস্কার করল।

অম্বর সন্তুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, এই রে, তোমাকে ধরেছে!

সন্তু আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কী ধরেছে?

অম্বর বলল, যা ধরবার তাই ধরেছে! এইরকম পোশাকে কি কেউ আসামের জঙ্গলে আসে? তাও এই বর্ষাকালে!

সন্তু ভয়ে-ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে?

সন্তু পরে আছে একটা নীল রঙের ফুলপ্যান্ট আর একটা হালকা নীল রঙের। হাওয়াই শার্ট। পায়ে চটি। কাকাবাবু সব সময় ফুলহাতা শার্ট গায়ে দেন, পায়ে। মোজা আর শু। কাকাবাবুর একটা পায়ের পাঞ্জা ভাঙা আর বিকৃত বলে তাঁর জন্য অর্ডার দিয়ে বিশেষ ধরনের জুতো বানাতে হয়।

অম্বর বলল, পায়ে ফুলমোজা আর গামবুট পরে আসা উচিত। তুমি যে একটা পা মাঝে-মাঝে নাড়ছ, তাতেই বুঝতে পেরেছি। প্রথম প্রথম সুড়সুড়ির মতন লাগে।

অম্বর বসে পড়ে সন্তুর ডান পায়ের প্যান্ট অনেকখানি তুলে ফেলল। হাঁটুর ১৭৬

নীচে এক জায়গায় গুঁটলি মতন হয়ে আছে।

কাকাবাবু অস্ফুট গলায় বললেন, জোঁক!

অম্বর বলল, সাপের হাত থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু এখানে জোঁক ধরবেই! পা বেয়ে তো ওঠেই, অনেক সময় গাছের ওপর থেকেও টুপ-টুপ করে খসে পড়ে!

সন্তু নিচু হয়ে জোঁকটাকে টেনে তুলতে গেল, কিন্তু সেটা ইলাস্টিকের মতন লম্বা হয়ে গেল, ছাড়ানো গেল না। অম্বর বলল, অত সহজ নয়। এখন তো দেখছ এইটুকু, তোমার রক্ত খেয়ে-দেয়ে ফুলে অ্যাও বড় হয়ে যাবে?

কাকাবাবু বললেন, একটা ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। শিগগির ডাকবাংলোয় চলো!

অম্বর বলল, ব্যস্ত হবেন না, আমার কাছে ওষুধ আছে। সব সময় সঙ্গে রাখি।

পকেট থেকে সে একটা ছোট প্লাস্টিকের কৌটো বের করল। সেটা থেকে দু আঙুলে খানিকটা সাদা জিনিস তুলে নিয়ে বলল, এটা কী বলুন তো? স্রেফ নুন। আমরা যে নুন খাই, সেই নুন। জোঁকের মাথায় নুন বলে একটা কথা আছে জানেন তো? এবার দেখুন, তাতে কী হয়!

সে খানিকটা নুন ছিটিয়ে দিল জোঁকটার গায়ে। অমনি সেটা ছটফটিয়ে টুপ করে খসে পড়ে গেল। তারপর কিলবিল করতে লাগল মাটিতে পড়ে।

সন্তু সেটা থেঁতলে দিতে গেল চটি দিয়ে।

অম্বর বলল, ওরকমভাবে জোঁক মারা যায় না। ওদের গা রবারের মতন। একমাত্র নুনেই জব্দ। নুন ওদের চামড়ার মধ্যে ঢুকে যায়। সন্তু ঘেন্নায় মুখখানা কুঁচকে বলল, অদ্ভুত প্রাণী। মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচে!

অম্বর বলল, ওরা বাঘেরও রক্ত খায়। একসঙ্গে অনেকগুলো জোঁক। লাগলে বাঘও কাবু হয়ে যায়!

কাকাবাবু নিজের বুকের কাছে জামাটা ঘষতে-ঘষতে বললেন, আমার আবার এখানটায় কী হল? হঠাৎ চুলকোচ্ছে। আমারও জোঁক লাগল নাকি?

টপটপ করে জামার বোতামগুলো খুলে ফেললেন কাকাবাবু। গেঞ্জির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা পোকা বের করে আনলেন। বাচ্চা আরশোলার সাইজের।

অম্বর সেটা দেখে বলল, এটা এমন কিছু খারাপ পোকা নয়। আর একরকম আছে। গায়ে একটু লাগলেই ঘা হয়ে যায়।

সন্তু বলল, বাবারে বাবাঃ! সাপ, জোঁক, বিষাক্ত পোকা, আরও কী কী আছে এ জঙ্গলে? বাঘ, হাতি, গণ্ডার?

অম্বর বলল, বাঘ বিশেষ দেখা যায় না, তবে লেপার্ড আছে। সেগুলো এমন কিছু ভয়ের নয়। বরং ওরাই মানুষ দেখলে ভয় পায়। মাঝে-মাঝে একরকম ভাল্লুক এসে পড়ে, সেগুলো বড্ড হিংস্র। একদিন আমি গভীর জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ একটা ভাল্লুকের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। ঝোপের সঙ্গে মিশে থাকলে হঠাৎ ওদের দেখাই যায় না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তারপর আপনি কী করলেন? আপনার কাছে বন্দুক ছিল?

অম্বর বলল, না। আমি বন্দুক কোথায় পাব? হাতে শুধু একটা সাপ ধরার চিমটে। তা দিয়ে তো আর ভাল্লুকটার সঙ্গে লড়া যায় না? ওরা প্রথমেই এক থাবা দিয়ে চোখ অন্ধ করে দেয়। তখন আমি কী করলাম জানো? আমি হাসতে শুরু করলাম। এটা আমার ছোটবেলা থেকে স্বভাব, ভয় পেলেই কান্নার বদলে মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে আসে। যত বেশি ভয় পাই, তত বেশি জোরে হি-হি করে হাসি। কীরকম শুনবে? হি-হি-হি-হি!

অম্বর সত্যিই ভয় পাওয়ার মতন মুখখানা কুঁচকে, প্রচণ্ড জোরে, বন কাঁপিয়ে হেসে উঠল।

তাই শুনে কাকাবাবু আর সন্তুর ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল।

অম্বর বলল, আমার সেই হাসি শুনে ভালুক বাবাজি পেছন ফিরে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে চোঁ-চোঁ দৌড়। ভাবল, এ আবার কী অদ্ভুত জন্তু রে বাবা!

অম্বরের এই কাহিনীটা বানানো গল্প, না সত্যি, তা ঠিক বুঝতে পারল না সন্তু। তবে লোকটিকে তার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। সব কথাই মজার সুরে বলে। মুখখানা দেখলে ভালমানুষ বলে মনে হয়।

অম্বরের লম্বা ধরনের চেহারা। বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। মাথা ভর্তি চুল। গালে অল্প-অল্প দাড়ি। কথা বলার সময় তার চোখ দুটো কৌতুকে জ্বলজ্বল করে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই জঙ্গলে এতসব খারাপ-খারাপ জিনিস রয়েছে, তবু আপনি এখানে একা-একা ঘুরে বেড়ান?

অম্বর বলল, কী করব বলো? এটাই যে আমার কাজ। টাকাপয়সা রোজগারের জন্য মানুষকে কতরকম কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এখানে একটু ঝুঁকি আছে বটে, তবু তো আমার স্বাধীন ব্যবসা। মাথার ওপর কোনও ওপরওয়ালা নেই। কারুর হুকুম শুনতে হয় না আমাকে।

কাকাবাবু বললেন, বাঙালির ছেলেদের এরকম কোনও কাজ করতে দেখলে আমার আনন্দ হয়। বেশিরভাগই তো সাধারণ একটা চাকরি খোঁজে। কোনওরকমে একটা চাকরি জোটালেই ধন্য মনে করে।

অম্বর জিজ্ঞেস করল, আমি না হয় নিজের কাজের জন্য এখানে পড়ে আছি। আপনারা এখানে এসেছেন কেন? বেড়াতে? রাজা রায়চৌধুরী তো কোথাও শুধু-শুধু বেড়াতে যাওয়ার লোক নন।

সন্তু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।

কাকাবাবু বললেন, অনেকটা বেড়াতেই এসেছি বলা যায়। এর আগে আসিনি। তা ছাড়া আর একটা উদ্দেশ্য হল পাখি দেখা।

অম্বর মুচকি হেসে বলল, পাখি মানে…জাটিংগা বার্ডস? বুঝেছি। তা হলে আজ রাত্তিরে আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব!

যেমন হঠাৎ বৃষ্টি এসেছিল, তেমনই হঠাৎ থেমে গেল। আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। ওরা তিনজনে এগোতে লাগল ডাকবাংলোর দিকে।
ডাকবাংলোটা একটা টিলার ওপরে।

বারান্দায় বসলেই সামনের দিকে পাহাড়ের ঢেউ দেখা যায়। একটার পর একটা পাহাড়, সবই গভীর জঙ্গলে ঢাকা। চতুর্দিকে শুধু সবুজ। মাঝে-মাঝে মেঘ এসে সব কিছু ঢেকে দেয়, একঝাঁক বৃষ্টি হওয়ার পরই আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়।

পুরনো আমলের বাংলো। মস্ত বড় বড় ঘর। প্রায় পুরো বাড়িটাকে ঘিরে বিশাল চওড়া বারান্দা।

সন্তু আর কাকাবাবুকে দেওয়া হয়েছে একটা ঘর। আর-একখানা ঘরে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তা ছাড়া আর কোনও লোক নেই। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির মুখে রবীন্দ্রনাথের মতন দাড়ি, সবই সাদা নয় অবশ্য, কাঁচাপাকা। তিনি বারান্দার এককোণে একটা চেয়ার নিয়ে পাহাড়ের দিকে চেয়ে বসে থাকেন একা-একা। অন্য কারও সঙ্গে আলাপ করেন না। কাকাবাবুরা দু দিন আগে এসেছেন। এর মধ্যে বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতে শুধু নমস্কার-বিনিময় হয়েছে, আর কোনও কথা হয়নি।

জঙ্গল থেকে ফিরে কাকাবাবু আর সন্তু বারান্দাতেই বসলেন অম্বরকে নিয়ে। বেয়ারাকে বলা হল চা দিতে। অম্বর অনেক জঙ্গলের গল্প শোনাতে লাগল।

একটু বাদেই বেয়ারা চা নিয়ে এল। এখানকার বেয়ারারা খুব কেতাদুরস্ত। হেলাফেলা করে চা দেয় না। বড় ট্রের ওপর সুন্দর ছবি আঁকা পোর্সলিনের টি-পট। কাপগুলোও বেশ ভাল দেখতে, কোনওটাই চলটা-ওটা কিংবা কানাভাঙা নয়। একটা প্লেটে আলাদা করে বিস্কুট আর কাজুবাদাম।

বেয়ারাটি জিজ্ঞেস করল, চা আমি কাপে ঢেলে দেব, সার?

অম্বর বলল, না, আমি ঢেলে দিচ্ছি, তুমি আর-একটু চিনি নিয়ে এসো। আমি চিনি বেশি খাই।

কাপে চা ঢালতে-ঢালতে অম্বর বারান্দার কোণের বৃদ্ধটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি ওখানে একা বসে আছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না! উনি একা থাকতেই ভালবাসেন বোধ হয়! দু দিন ধরে এইরকমই তো দেখছি!

অম্বর বলল, এইরকম একটা সুন্দর জায়গায় বিকেলবেলা কেউ একা বসে থাকবে, এর কোনও মানে হয়?

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে, অম্বর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ডেকে বলল, নমস্কার সার! আমার নাম পীতাম্বর পাহাড়ী! আপনাকে তো চিনলাম না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন অম্বরের দিকে। তারপর বেশ চিবিয়ে-চিবিয়ে ইংরেজিতে বললেন, আমিও আপনাকে চিনি না। চিনতেই যে হবে, তার কোনও মানে নেই।

অম্বর একগাল হেসে বলল, না, কোনও মানে নেই। আমি এখানে প্রায় বছরখানেক আছি তো। ছোট জায়গা, সবাই সবাইকে চেনে। এখানে যেসব সরকারি অফিসার আসেন, তাঁদেরও আমি চিনি। বর্ষার সময় এখানে কেউ বেড়াতে আসে না। তাই আমি ভেবেছিলুম, আপনি বুঝি কোনও সরকারি কাজে এসেছেন।

বৃদ্ধ লোকটি বললেন, না, আমি বেড়াতেই এসেছি!

অম্বর বলল, ভাল কথা। আসুন না, আলাপ-পরিচয় করা যাক। আপনি আমাদের সঙ্গে চা খাবেন?

বৃদ্ধ লোকটি একবার কাকাবাবুদের টেবিলের দিকে তাকালেন। একটু দোনামনা করলেন মনে হল। তারপর বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ! এক কাপ চা খেলে অবশ্য মন্দ হয় না!

তিনি উঠে এলেন কাকাবাবুদের টেবিলের দিকে।

সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ লোকটির জন্য একটি চেয়ার টেনে দিল।

কাকাবাবু বললেন, আপনাকে বোধ হয় বিরক্ত করা হল।

বৃদ্ধটি চেয়ারে বসে বললেন, না, না, তা নয়। আপনাদের তো দেখছি দু দিন ধরে। আসল ব্যাপার কী জানেন, আমি নিজে থেকে কারুর সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। এইটা আমার দোষ। সারা জীবন যে-চাকরি করেছি, তাতে তো লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার বিশেষ সুযোগ ছিল না। এখন রিটায়ার করেছি বটে, তবু সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে।

বৃদ্ধের হাতে একটা চায়ের কাপ তুলে দিয়ে অম্বর জিজ্ঞেস করল, আপনি কী কাজ করতেন?

বৃদ্ধটি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে একটা মুগার চাদর। এক হাতে একটা রুপোবাঁধানো বেতের লাঠি।

চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে বড় একটা চুমুক দিলেন তিনি। তারপর মুখ তুলে বললেন, আমি হাইকোর্টের জজ ছিলাম।

অম্বর হি-হি-হি-হি করে হেসে উঠল।

কাকাবাবু বেশ রাগ রাগ চোখ করে অম্বরের দিকে তাকালেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথার ওপরে হেসে ওঠা অত্যন্ত অসভ্যতা।

অম্বর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাইকোর্টের জজ হলে বুঝি লোকজনের সঙ্গে মেশা যায় না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বললেন, না!

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই। বিচারকদের কত লোককে শাস্তি দিতে হয়। সেই লোকদের সঙ্গে যদি রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যায়, তারা অপমান করতে পারে, মেরেও বসতে পারে।

বিচারক বললেন, যতদিন চাকরি করেছি, তখন সব সময় আমার সঙ্গে পুলিশ থাকত। দু বছর আগে রিটায়ার করেছি। এখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আমার বউ ছেলেমেয়ে কেউ নেই। তাই একা-একা থাকি।

অম্বর বলল, এখন আপনি রিটায়ার করেছেন বটে। কিন্তু ধরুন আপনি যাদের শাস্তি দিয়েছেন, জেল খাটিয়েছেন, ভুল করেও তো কেউ-কেউ শাস্তি পায়, সেরকম কারুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়? সে যদি প্রতিশোধ নিতে চায় :

বিচারক কোনও উত্তর না দিয়ে অম্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এই সময় একটা জিপ এসে থামল বাংলোর সামনে। তার থেকে দুজন লোক নেমে গুড ইভনিং, গুড ইভনিং বলতে বলতে উঠে এল সিঁড়ি দিয়ে। দুজনেই সুট পরা, এবং মুখে ইংরেজি বললেও নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের চা খাওয়া শেষ। আপনারা চা খাবেন? দিতে বলব?

লোক দুটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। তাদের একজন বলল, না, না, দরকার নেই। আমরা এইমাত্র চা খেয়ে এসেছি।

কাকাবাবু অন্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। লোক দুটির নাম কুমার সিং আর ভুবন দাস। দুজনেরই বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি।

জজসাহেব নিজের নাম বললেন, পি কে দত্ত। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই কাজের কথা বলবেন। আমি এবার যাই।

কাকাবাবু যদিও বললেন যে, না, না, কাজের কথা কিছু নেই, তবু জজসাহেব আর বসলেন না। বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে হেঁটে গিয়ে এঁদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে, পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসলেন।

অম্বর জিজ্ঞেস করল, আপনারা পাখি দেখতে কখন যাচ্ছেন?

কুমার সিং বলল, আর একটু পরেই। সন্ধে নামবার ঠিক সঙ্গে-সঙ্গে। বৃষ্টি হলে তো কিছু দেখা যাবে না। মেঘ জমছে, বেশি রাত্তিরের দিকে আবার বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।

অম্বর বলল, আমার কয়েকটা টর্চের ব্যাটারি কিনতে হবে। আমি একটু বাজারের দিকটা ঘুরে তারপর আপনাদের সঙ্গে ওখানে যোগ দেব। ব্যাপারটা আমারও দেখা হয়নি।

কথাটা কুমার সিং-এর তেমন পছন্দ হল না। সে বলল, ওখানে খুব বেশি ভিড় হলে মুশকিল হবে!

অম্বর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখানেই থাকি। আমি তো ইচ্ছেমতন যে-কোনও জায়গায় যেতে পারি, তাই না?

তারপর সে বলল, চলি কাকাবাবু! চলি সন্তু, একটু পরে দেখা হবে!

অম্বর বেরিয়ে যেতেই ভুবন দাস জিজ্ঞেস করল, লোকটা এখানেই থাকে বলল। আগে তো দেখিনি। কী করে?

কাকাবাবু বললেন, আজই আলাপ হল আমাদের সঙ্গে। ও বলল, ও সাপ ধরার ব্যবসা করে।

ভুবন দাস বলল, সাপ ধরার ব্যবসা মানে? সাপুড়ে?

কাকাবাবু বললেন, না, না। সাপ ধরে সাপের বিষ বের করে। সেই বিষ বিক্রি হয়।

কুমার সিং বলল, সাপের বিষ বের করা সোজা নাকি? সাপুড়েরা ছাড়া অন্য কেউ পারে না। এখানে একটা লোক সাপ ধরে বেড়াচ্ছে, অথচ আমরা সে-খবর আগে শুনিনি, এ কি হতে পারে?

ভুবন দাস বলল, আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, ও একা-একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, এ-কথা ঠিক। ওর পকেটে সব সময় নুন থাকে।

কুমার সিং আর ভুবন দাস দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেল। একজন জিজ্ঞেস করল, নুন? তার মানে? পকেটে নুন রাখে কেন?

কাকাবাবু একপলক সন্তুর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর হাসতে শুরু করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, তার আমি কী জানি! ও নুন রাখে, আমাদের দেখাল।

ভুবন দাস বলল, নিশ্চয়ই অন্য কোনও মতলব আছে!

প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্য কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমি একটু তৈরি হয়ে নিই বেরোবার আগে? ওখানে কতক্ষণ লাগবে তা তো জানি না, আমরা কি রাত্তিরের খাবারটা খেয়ে নিয়ে যাব, না, ফিরে এসে খাব?

কুমার সিং বলল, না, না, আমরা এখানে বারণ করে দিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। আপনাদের জন্য বাইরে এক জায়গায় খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আপনাকে সার একটু কষ্ট করে তখন খানিকটা হেঁটে যেতে হবে। সবটা গাড়ি যায় না।

কাকাবাবু বললেন, সে ঠিক আছে। আজ তো পাহাড়ের অনেকটা নীচে নেমে গিয়ে জঙ্গল দেখতে গিয়েছিলাম। খুব একটা অসুবিধে হয়নি।

কাকাবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন। কুমার সিং আর ভুবন দাস এবার দুটো সিগারেট ধরাল। ওরা কাকাবাবুকে খুব সমীহ করে। ওঁর সামনে সিগারেট খায় না।

কুমার সিং সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে, মিঃ সন্তু? সন্তু বলল, খুব ভাল। জায়গাটা দারুণ! খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে?

অসুবিধে? বড্ড বেশি-বেশি খাচ্ছি। এখানকার রান্না চমৎকার। আজ দুপুরে মাছ আর মাংস দুরকম হয়েছিল।

আমাদের বলা আছে। যখন যা ইচ্ছে হয় চাইবেন। কোনওরকম লজ্জা করবেন না মিঃ সন্তু। গাড়ির দরকার হলেও খবর দেবেন বেয়ারাকে, গাড়ি এসে যাবে।

পাহাড়ে এসে আমার পায়ে হেঁটে ঘুরতেই ভাল লাগে।

মিঃ রায়চৌধুরীর তো একটা পা খারাপ, ওঁর কষ্ট হবে।

এরা সন্তুকে আপনি আপনি বলে আর মিঃ সন্তু বলে ডাকে, এতে সন্তুর একটু হাসি পায়। কিন্তু সে আপত্তি করেনি। এরা প্রথম থেকেই যত্ন করছে খুব।

কুমার সিং-এর মুখে মস্তবড় গোঁফ, কিন্তু দাড়ি নেই। চেহারা দেখলে মনে হয় মিলিটারির লোক। এ শিখ নয়, মাথায় পাগড়ি নেই, বাংলা বলে ভালই, তবে উচ্চারণে কিছুটা টান আছে। ভুবন দাসের ছোটখাটো, চেহারা, দেখে বাঙালি বলেই মনে হয়, তবে এরও বাংলা উচ্চারণ একটু অন্যরকম। বোধ হয় অনেকদিন এখানে থাকতে-থাকতে উচ্চারণটা বদলে গেছে।

এরা দুজনেই এই হাফলঙে কাঠের ব্যবসা করে।

একটু বাদে সন্তুও ঘরে গিয়ে জামা-প্যান্ট বদলে এল।

সন্ধের পর বেশ শীত পড়ে, গরম জামা সঙ্গে রাখা দরকার।

প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে, তবে এখনও পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি।

কাকাবাবু একটা ওভারকোট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে যেতে হবে। শীতের মধ্যে আমার বারবার চা-তেষ্টা পায়।

বেয়ারাকে বলা হল চা বানিয়ে দিতে।

ততক্ষণ ওরা বাংলোর সামনের বাগানে এসে দাঁড়াল। আকাশের একদিকে বেশ জমাট মেঘ। শেষ সূর্যের আলোতে সামনের একটা পাহাড়ের চূড়া একেবারে লাল হয়ে আছে।

কাকাবাবু কুমার সিং-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো কাঠের ব্যবসা করেন, এজন্য কি আপনাদের জঙ্গলে যেতে হয়? নাকি অন্য লোকজন যায়, আপনারা শহরে বসে ব্যবসাটা চালান।

কুমার সিং বলল, না, না, আমাদের দুজনকেই রেগুলার জঙ্গলে যেতে হয়। গাছ চিনিয়ে দিতে হয়। অনেক সময় রাত্তিরেও জঙ্গলে থেকে যাই।

কাকাবাবু বললেন, কোথায় থাকেন? জঙ্গলের মধ্যে আপনাদের ঘরটর করা আছে?

কুমার সিং বলল, না, সেরকম কিছু নেই। গাড়িতেই শুয়ে থাকি। ট্রাকের ওপর বিছানা পেতে দিব্যি ঘুমনো যায়।

সন্তু বলল, বাঃ, বেশ তো! আমারও ইচ্ছে করে ওইরকমভাবে জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটাতে।

কুমার সিং বলল, এখানে বেশ কিছুদিন থাকুন। একদিন নিয়ে যাব আমাদের সঙ্গে, মিঃ সন্তু। তবে জঙ্গলে কিন্তু মাঝে-মাঝে বাঘ আসে, ভয় পাবেন না তো?

সন্তু বলল, আপনারা দেখেছেন বাঘ?

কুমার সিং বলল, অনেকবার। আমাদের সঙ্গে অবশ্য বন্দুক থাকে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাঘ, মানে লেপার্ড?

কুমার সিং বলল, না, না, লেপার্ডের মতন ছোট জানোয়ার নয়, আসল বাঘ। টাইগার। এখানকার জঙ্গলে অনেক টাইগার আছে। আপনারা আজ দুপুরবেলা খালি হাতে জঙ্গলে গিয়ে ভাল করেননি।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলে ভাল্লুক-টাল্লুকও আছে। নাকি?

কুমার সিং বলল, ভাল্লুক? না, না, এদিকে ভাল্লুক দেখতে পাওয়া যায়। ভাল্লুক খুব আছে অরুণাচলের জঙ্গলে। এখানে নেই।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

জজসাহেব এখনও ঠায় বসে আছেন বারান্দার একটা চেয়ারে। একটুও নড়ছেন না। ঠিক যেন ধ্যানমগ্ন।

কাকাবাবু কুমার সিং-কে বললেন, বিচারকমশাইকে ডাকব নাকি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য?

ভুবন দাস বলল, থাক না, কী দরকার। বেশি ভিড় বাড়লে হয়তো কিছুই দেখা যাবে না।

সন্তু বলল, উনি কোথাও যেতে চান বলেও তো মনে হয় না। এর মধ্যে চা এসে গেল, সবাই উঠে পড়ল গাড়িতে।

বাংলোটা টিলার ওপর। এখান থেকে যেতে হবে জাটিংগা, নেমে যেতে হবে নীচের দিকে। বর্ষার জন্য রাস্তা তেমন ভাল নয়। জিপটা লাফাচ্ছে অনবরত। অন্ধকার নেমে এসেছে।

পাহাড় ঘুরে-ঘুরে নামতে লাগল গাড়ি। এক সময় আসল রাস্তাটা ছেড়ে একটা সরু রাস্তা ধরল। সে রাস্তাটাও ঢালু, তাই জিপের স্টার্ট বন্ধ করে দেওয়া হলেও গড়িয়ে-গড়িয়ে নামতে লাগল, শুধু জ্বালা রইল হেড লাইট।

কুমার সিং ফিসফিস করে বলল, যাতে গাড়ির আওয়াজ না হয় সেইজন্য, স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছি। এর পর সার, কেউ আর জোরে-জোরে কথা বলবেন না!

একটা ফ্রি ক্রিং শব্দ শোনা গেল তখুনি। হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল সামনে-সামনে একটা সাইকেল যাচ্ছে। তাতে বসে আছে পীতাম্বর পাহাড়ী।

জিপটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য সাইকেলটা থামল। তারপর অম্বর হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, এই যে, কাকাবাবু, সন্তু, আমি এসে গেছি! কুমার সিং বলল, এই রে, লোকটা খুব জ্বালাবে দেখছি!

আর একটু যাওয়ার পর জিপটাকে থামিয়ে দেওয়া হল একটা গাছের নীচে। ভুবন দাস নিজে আগে নেমে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, সাবধানে নামবেন। এই জায়গাটা এবড়ো-খেবড়ো, আমার হাত ধরুন।

কাকাবাবু একটা টর্চ জ্বেলে বললেন, না, ঠিক আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি।

ভুবন দাস বলল, আপনাকে তো দু হাতে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হবে, আমি আলো দেখাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসুন।

খুব যত্ন করে সে কাকাবাবুকে জিপ থেকে নামিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল।

মিনিট-পাঁচেক হাঁটার পর ওরা পৌঁছল একটা সমতল জায়গায়। চারপাশে গাছপালা থাকলেও মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা। সেখানে কেউ একটা মশাল। জ্বেলে মাটিতে পুঁতে রেখেছে। মনে হয়, কেরোসিন তেলে ডোবানো কাঠ ও ন্যাকড়া-ট্যাকড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে মশালটা, বেশ জোর আলো, ধোঁয়াও বেরোচ্ছে গলগল করে।

মশালটাকে ঠিক মাঝখানে রেখে, বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে দু দিকে মাটির ওপর বসে আছে তিন-চারজন মানুষ। তাদের মধ্যে একজন সাহেব।

কাকাবাবু এক জায়গায় বসে পড়লেন। কাছেই সাহেবটি। তার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি না, মাথার চুল লালচে রঙের। এখন বাতাসে বেশ শীত-শীত ভাব, তবু সে একটা পাতলা গেঞ্জি ও জিক্স-এর প্যান্ট পরে আছে।

কাকাবাবুকে দেখে সে হাতজোড় করে নমস্কার করল, তারপর ইংরেজিতে বলল, আমার নাম কার্ল জরগেন, আমি হাইডেলবার্গ শহর থেকে আসছি।

কাকাবাবু হাসিমুখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। ছেলেটির চোখের রং নীল। মুখখানা শান্ত ধরনের। সে জাতে জার্মান, বেশ রোগা-পাতলা চেহারা। চোখের দৃষ্টিতে খানিকটা লাজুকলাজুক ভাব।

কাকাবাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেই অতদূর জার্মানি থেকে এসেছ? এই জায়গাটার নাম তো বাইরের বেশি লোক জানে না। তুমি কী করে জানলে যে, এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে?

কার্ল আস্তে-আস্তে বলল, এই জাটিংগার পাখিদের কথা আমি প্রথম পড়ি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায়। তারপর আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাতেও কিছু খবর বেরিয়েছে। পাখিদের জীবনযাত্রা ও ব্যবহার সম্পর্কে আমার বিশেষ কৌতূহল আছে। এটাই আমার গবেষণার বিষয়। সেইজন্যই আমি এখানে সতিই কী ঘটে তা দেখতে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি তা হলে একজন অরনিথোলজিস্ট? এখানে উঠেছ। কোথায়?

কার্ল বলল, রেলস্টেশনের পাশে একটা হোটেলে। আটদিন ধরে আমি এখানে আছি।

কুমার সিং বলল, স্টেশনের কাছে তো কোনও হোটেল নেই! মানে, ছোটখাটো আছে বোধ হয়, কিন্তু বিদেশিদের থাকার মতন..

কাকাবাবু বললেন, এরা অনেক কষ্ট করেও থাকতে পারে। আচ্ছা কার্ল, তোমার মুখ থেকেই শুনি, তুমি এখানে কী দেখেছ এ পর্যন্ত? আমরা পরশু এসে পৌঁছেছি, কিন্তু সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই এখানে আর আসিনি। কাল সন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ল, এরা সবাই বলল, বৃষ্টির দিনে কিছু দেখা যায় না। তুমি কি একদিনও কিছু দেখেছ?

কার্ল বলল, আমি এখানে প্রত্যেকদিন এসে বসে থাকি। বৃষ্টি না থাকলেও এক-একদিন কিছুই ঘটে না। শুধু একদিনই সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা দেখেছিলাম!

কাকাবাবু বললেন, কী সেই আশ্চর্য ব্যাপার?

কার্ল হেসে বলল, আজ বৃষ্টি নেই। একটু পরে হয়তো আপনি নিজেই সেটা দেখতে পাবেন।

মশালটা এখনও দাউদাউ করে জ্বলছে। আর-একজন কে যেন একটু দূরে আর-একটা মশাল পুঁতে দিল। কাকাবাবুরা বসে আছেন সেই মশাল থেকে বেশ খানিকটা দূরে, অন্ধকারে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। কাকাবাবু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে চুমুক দিতে লাগলেন।

কথা বলছে না কেউ। কেটে গেল পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট।

অম্বর হঠাৎ বলে উঠল, এ যে দেখছি ধৈর্যের পরীক্ষা! কুমার সিং বলল, চুপ, চুপ!

অম্বর তাকে গ্রাহ্য না করে বলল, আকাশে কোনও পাখি দেখা যাচ্ছে না। কাছাকাছি কোনও বড় গাছও নেই।

কাকাবাবু তার দিকে চেয়ে শুধু দু বার মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও এখন কোনও কথা বলতে চান না।

অম্বর চুপ করে থাকার পাত্র নয়। সে এবার সন্তুর দিকে ফিরে বলল, রাত্তিরে কি কোনও পাখি ওড়ে?

সন্তু ফিসফিস করে বলল, প্যাঁচা, বাদুড়, বুনো হাঁস।

ঠিক তক্ষুনি ঝটাপটঝটাপট ও ধপাস করে শব্দ হল।

কোনও মশালের ঠিক ওপরে নয়, একটু দূরে একটা পাখি এসে পড়েছে। ছোটখাটো পাখি নয়, প্রায় হাঁসের মতন। পাখিটা পড়েছিল মুখ থুবড়ে, সোজা হয়ে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।

কিন্তু পাখিটাকে ভাল করে দেখার আগেই পেছনের অন্ধকার থেকে দু-তিনজন লোক ছুটে এল। তাদের হাতে লাঠি। তাদের একজন পাখিটাকে জাপটে ধরেই আবার দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে।

কার্ল দারুণ বিরক্তভাবে বলল, ওঃ গড! আবার সেই ব্যাপার!

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কী হল? ওই লোকগুলো এল কোথা থেকে?

কার্ল বলল, এই লোকগুলো লুকিয়ে থাকে। আমাদের ভাল করে দেখতেই দেয় না। ওরা পাখিগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে মাংস খায়। মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এটা আটকাতে পারেন না?

কাকাবাবু তাকালেন কুমার সিং-এর দিকে।

কুমার সিং বলল, গ্রামের লোকদের আমরা আটকাব কী করে? পাখি তো কারও সম্পত্তি নয়। যে আগে ধরতে পারবে তার?

কার্ল বলল, আগুনের কাছাকাছি এসে পাখিগুলো কী করে সেটা আমি দেখতে চাই। এরা কিছুতেই দেখতে দেবে না!

অম্বর বলল, সত্যিই তা হলে পাখি পড়ে এখানে? আমি আগে বিশ্বাস করিনি। এখানকার লোকেরা পাখি শিকার করে খায়। ওরা ছাড়বে কেন?

আবার একটা পাখি এসে পড়ল। এবার প্রায় মশালের ওপরে। কিন্তু পাখিটা কঁক করে একটা শব্দ করে আগুন থেকে দূরে সরে গেল। একবার লাফাবার চেষ্টা করেও পারল না।

এবারও অন্ধকার থেকে ছুটে এল কয়েকটা লোক। একজন পাখিটাকে ধরার আগেই অন্য একজন পাখিটার গায়ে একটা লাঠির ঘা মেরে কী যেন বলে উঠল চেঁচিয়ে। অর্থাৎ, সে পাখিটাকে আগে ছুঁয়ে দিয়েছে। এটার ওপর তারই অধিকার।

কার্ল আবার বলে উঠল, আমাদের দেশ হলে এই লোকগুলোকে পুলিশ দিয়ে আটকে রাখা যেত। এরা পাখিগুলোকে ধরে-ধরে খেয়ে ফেললে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হবে কী করে?

অম্বর বলল, আমারই তো একটা ধরতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, এই পাখির মাংস বেশ টেস্টফুল হবে!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অন্য সময় এই ধরনের পাখি এখানে দেখতে পাওয়া যায় না?

অম্বর বলল, না, আমি দেখিনি।

কার্ল বলল, পাখিগুলো কোথা থেকে আসে, তা কেউ বলতে পারে না। রাত্রে মশাল জ্বাললে এখানে এসে ধূপ-ধপ করে পড়ে।

কাকাবাবু বললেন, এরা আগুন দেখে আত্মহত্যা করতে আসে?

কার্ল বলল, আগুন দেখলে অনেক পোকা আসে। কিন্তু পাখিরা মরতে আসে, এমন শোনা যায়নি। তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা, শুধু এই জায়গাটাতে আগুন জ্বাললেই পাখিগুলো আসে। এখান থেকে আধ মাইল দূরে গিয়ে আগুন জ্বালুন, একটাও পাখি পড়বে না।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক এক জায়গাটাতেই আলো দেখে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, নাকি?

কার্ল বলল, শুধু এই জায়গার আলো ওদের চোখ ধাঁধাবে কেন? অন্য জায়গায় আলো জ্বললে তো ওদের কোনও অসুবিধে হয় না। ছোটখাটো পাখিও নয়, বড় পাখি, অনেকটা উঁচু দিয়ে উড়তে পারে, ওরা ইচ্ছে করে আগুনের কাছে আসবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, প্রকৃতির মধ্যে যে কতরকম বিস্ময়ই আছে! এখনও আমরা অনেক রহস্যই বুঝতে পারি না। মেক্সিকোর উপসাগরে একসময় হাজার-হাজার তিমি মাছ ডাঙায় উঠে আত্মহত্যা করতে এসেছিল। একসঙ্গে অত তিমি মাছের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল কেন, কে জানে!

কার্ল বলল, সমুদ্র দিয়ে আজকাল সব সময় বড় বড় পেট্রোলের ট্যাঙ্কার যায়। সেইসব জাহাজ থেকে অনেক সময় পেট্রোল জলে পড়ে যায়। সমুদ্রের জলে পেট্রোল ভাসলে শুধু তিমি মাছ নয়, সবরকম জলজ প্রাণীর খুব কষ্ট হয়। তারা নিশ্বাসের অক্সিজেন পায় না। মানুষের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই বোধ হয় তিমি মাছেরা প্রতিবাদ জানাতে চায়।

আবার শূন্যে ডানা ঝটপট ঝটপট শব্দ হল। আর-একটা পাখি পড়ছে। সেটা মাটি ছোঁয়ার আগেই কার্ল বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল। লুফে নিল পাখিটাকে।

অন্ধকার থেকে তিন-চারজন লোকও ছুটে এসেছে। তারা লাঠি দিয়ে পাখিটাকে মারবার চেষ্টা করল। কার্ল ততক্ষণে পাখিটা তার জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দু হাত দিয়ে আড়াল করেছে। একটা লাঠির ঘা পড়ল তার পিঠে।

কার্ল লোকগুলোকে বলল, আমায় মারছ কেন ভাই? আমার মাংস তো তোমরা পুড়িয়ে খেতে পারবে না।

কার্ল দৌড়ে চলে এল কাকাবাবুর কাছে, লোকগুলোও তাড়া করে এল তাকে।

কার্ল ব্যাকুলভাবে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আমাকে হেল্প করুন।

কাকাবাবু সেই পাহাড়ি লোকদের ভাষা জানেন না। তিনি কুমার সিংকে বললেন, আপনি এদের বলুন, এই সাহেব এই পাখিটাকে আগে ধরেছে। এটার ওপর সাহেবেরই অধিকার। ওটা কেড়ে নিতে চাইছে কেন? তা হলে কিন্তু আমিও বাধা দেব।

কুমার সিং লোকগুলোকে ধমকে তাড়িয়ে দিল।

এদিকটায় অন্ধকার বলেই পাখিটা দারুণ ছটফট করছে।

কার্ল কাকাবাবুকে বলল, আপনি এই পাখিটাকে জোরে চেপে ধরুন তো।

কাকাবাবুর হাতে পাখিটা দিয়ে সে পকেট হাতড়াতে লাগল। সন্তু আর কুমার সিং দুখানা টর্চ জ্বালল, তবু পাখিটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, সে এমনই ছটফট করছে।

কার্ল পকেট থেকে একটা ছোট্ট তামার চাকতি বের করল, তাতে রাবার ব্যান্ড লাগান। সে পাখিটার একটা পা ধরে তাতে চাকতি আটকে দিল। তারপর কাকাবাবুর হাত থেকে পাখিটা নিয়ে সে পেছনদিকে খানিকটা ছুটে গিয়ে তাকে জোরে ছুঁড়ে উড়িয়ে দিল আকাশে।

নিজের জায়গায় আবার ফিরে এসে কার্ল কাকাবাবুকে বলল, আমি দেখতে। চাই এই পাখিটাই আবার ফিরে আসে কি না?

কাকাবাবু বললেন, এটা একটা ভাল এক্সপেরিমেন্ট।

অম্বর বলল, এর পরের পাখিটাকে আমি ধরব। এখানকার লোকের কি বিশ্বাস জানেন? একদিন এখানে একটা সোনার পাখি পড়বে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, সোনার পাখি?

অম্বর বলল, গ্রামের আদিবাসীরা সেই কথা বলাবলি করে। এখানে তো এই জাতের পাখি নেই। এগুলো আকাশ থেকে পড়ে। আকাশ থেকেই যখন পড়ছে তখন একদিন না একদিন স্বর্গ থেকে একটা সোনার পাখিও নেমে আসবে নিশ্চয়ই!

কুমার সিং নাক দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, হুঁ। যতসব বাজে কথা!

অম্বর তবু ইয়ার্কির সুরে বলল, কে বলতে পারে, হয়তো এর পরেরটাই। সোনার পাখি হবে?

কিন্তু অম্বরের আশা পূর্ণ হল না।

হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। প্রায় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি যাকে বলে। কাকাবাবু আর সন্তু দুজনেই রেইন কোট এনেছে, গায়ে দিয়ে নিল তাড়াতাড়ি।

কার্ল বলল, আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে, আর আশা নেই। জাটিংগার পাখিরা একটু বৃষ্টি হলে আর আসে না।

কাকাবাবু বললেন, বৃষ্টিতে মশালের আগুন দেখা যায় না।

বৃষ্টির ফোঁটা মশালের আগুনের ওপর পড়ছে আর ছ্যাঁক-ছ্যাঁক শব্দ হচ্ছে। একটুক্ষণের মধ্যেই দুটো মশালই নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।

কার্ল বলল, আগের দিন গ্রামের লোকদের সামনে আমি পাখি ধরতে সাহস করিনি। আজ আপনারা ছিলেন বলেই আমি এক্সপেরিমেন্টটা করতে পারলাম। কাল দেখতে হবে ওই পাখিটা ফিরে আসে কি না। আপনারা কাল আসবেন।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই আসব!

কুমার সিং বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাল আমরা সবাই আবার আসব।

কাকাবাবু বললেন, ক্যামেরায় ছবি তুললে হত। সন্তু, তুই ক্যামেরাটা আনতে ভুলে গেছিস আজ।

সন্তু লজ্জা পেয়ে বলল, একদম মনেই পড়েনি।

কুমার সিং বলল, আমি মনে করিয়ে দেব। আমারও ক্যামেরা আছে।

তারপর কুমার সিং কাকাবাবুকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, সার, আজ তো আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই। চলুন, এবারে আমরা খেতে যাই। খানিকটা দূরে যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাওয়া যাক। আচ্ছা, ওই জার্মান ছেলেটিকে সঙ্গে নিতে পারি না? ওকে আমার বেশ ভাল লেগেছে। ওর কাছ থেকে এই পাখিদের বিষয়ে আরও অনেক কিছু জানা যেত।

কুমার সিং বলল, সেটা আমাদের মালিক ঠিক পছন্দ করবেন না।

কাকাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মালিক? মালিক আবার কে?

কুমার সিং একটু থতমত খেয়ে বলল, মালিক মানে আমাদের এক বন্ধু। তার নাম মালিক। এখানকার একজন বড় ব্যবসায়ী। সে আপনাকে আর মিস্টার সন্তুকে নেমন্তন্ন করেছে নিজের বাড়িতে। সেখানে অন্য তোক নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া এই জামান সাহেবের সঙ্গে তো আপনার কালকে দেখা হবেই।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তা হলে চলুন।

কাকাবাবু কার্লের কাছে বিদায় নিলেন। অম্বরকে কিছু বলার আগেই সে বলল, আপনারা এখন কোথায় যাচ্ছেন? আমি যেতে পারি আপনাদের সঙ্গে?

কুমার সিং বলল, আমরা অনেক দূরে যাব। আমাদের নেমন্তন্ন আছে।

কাকাবাবুরা এসে আবার জিপে উঠলেন। এবারে জিপটা উঠতে লাগল ওপরের দিকে। খাড়া রাস্তা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। চতুর্দিকে অন্ধকার। জঙ্গল থেকে একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ আসছে।

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম দেখলি? কিছু বুঝতে পারলি?

সন্তু বলল, রাত্তিরবেলা অত বড়-বড় পাখি আকাশ থেকে পড়ছে, এটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি কিছু কারণ খুঁজে পেলে?

কাকাবাবু বললেন, আরও কয়েকটা দিন দেখতে হবে। এখনও কিছু ধরা যাচ্ছে না।

মিনিট পনেরো চলার পর জিপটা থামল। কুমার সিং বলল, আর গাড়ি যাবে না। এখান থেকে একটু হাঁটতে হবে। বেশি না, মিনিট পাঁচেক। আমাদের বন্ধুর বাড়িটা একটা পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়। গেলে দেখবেন খুব সুন্দর লাগবে।

কাকাবাবুরা গাড়ি থেকে নামলেন। ভুবন দাস টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। গাড়ির ড্রাইভারও এবার আসছে সঙ্গে। কাকাবাবু একবার হোঁচট খেতেই কুমার সিং তাকে ধরে ফেলে বলল, ইস, লাগল নাকি? কাকাবাবু বললেন, না, কিছু হয়নি!

ভুবন দাস বলল, ডান পাশটা সাবধান। ওদিকে খাদ। আপনি সার, বাঁ দিক ঘেঁষে চলুন।

সন্তুর হাতেও একটা টর্চ। সে ডান দিকে আলো ফেলে বলল, ওরে বাবা, বেশ গভীর খাদ, তলা দেখা যাচ্ছে না।

কুমার সিং বলল, হ্যাঁ। এই খাদটা খুব গভীর।

একপাশে খাড়া পাহাড়, আর একদিকে খাদ, মাঝখানে সরু পথ। এদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। খানিকক্ষণ হাঁটার পর। মনে হল, ওপর থেকে কোনও বড় জন্তু বা পাথর গড়িয়ে পড়ল নীচের রাস্তায়। ধুপ করে আওয়াজ হল।

কাকাবাবু বললেন, ওটা কী? কুমার সিং বলল, ও কিছু না। ব্যস, আর যেতে হবে না। এইখানেই! কুমার সিং পেছন ফিরে কাকাবাবুর মুখখামুখি দাঁড়াল। ভূবন দাসের টর্চের আলোয় দেখা গেল কুমার সিং-এর হাতে একটা রিভলভার চকচক করছে।

ভুবন দাস কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কুমার, এখন থাক।

কুমার সিং কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলল, শাট আপ! রায়চৌধুরী, এবার তোমার খেলা শেষ!

কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে বললেন, এ কী ব্যাপার? আমার সঙ্গে মজা করছেন নাকি? আমার দিকে ওরকম রিভলভার খেলাচ্ছলেও তুলতে নেই। আমি পছন্দ করি না।

কুমার সিং অন্য হাতে কাকাবাবুর মুখে একটা খুঁসি চালাতে কাকাবাবু সেই

উদ্যত মুষ্টিটাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করেও পারলেন না।

পেছন থেকে কে যেন হ্যাঁচকা টানে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো কেড়ে নিল। কাকাবাবু টাল সামলাতে পারলেন না। হাত দুটো ব্যবহার করার আগেই কেউ তাঁর হাত দুটো পেছনে মুড়ে নিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। সেই সঙ্গে-সঙ্গেই আর-একজন একটা গামছাজাতীয় জিনিস দিয়ে বেঁধে ফেলল তাঁর মুখ। কাকাবাবু কোনওরকম বাধা দেওয়ার সুযোেগই পেলেন না।

কুমার সিং কাকাবাবুর কোমরে খুব জোরে একটা লাথি কষিয়ে বলল, যা, এবার পাতালে যা!

কাকাবাবু ছিটকে পড়ে গেলেন খাদের দিকে।
ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, কাকাবাবু প্রথমে কিছু বুঝতেই পারলেন না।

কুমার সিংরা সবাই মিলে দুদিন ধরে দারুণ যত্ন করছে, খাওয়াচ্ছে দাওয়াচ্ছে, অনেক জায়গা দেখাচ্ছে, তাদের সঙ্গে শত্রুতার কোনও প্রশ্নই নেই। তবু হঠাৎ তারা এরকম ব্যবহার করবে, সেরকম কোনও সন্দেহই হয়নি।

কাকাবাবু শুধু বুঝতে পারলেন, তিনি একটা খাদে গড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা!

একটু আগেই টর্চের আলোয় দেখা গেছে যে, খাদটা খুব গভীর। এত উঁচু থেকে পড়লে বাঁচার কোনও আশাই নেই।

কাকাবাবু ভাবলেন, তা হলে কি এবার সত্যি মরতে হবে?

এর আগে কতবার, কতরকম বিপদে পড়তে হয়েছে। সাঙ্ঘাতিক বুদ্ধিমান শত্রুদের মুখখামুখি পড়েও কাকাবাবুর কখনও মৃত্যুভয় হয়নি। তাঁর এমনই প্রবল আত্মবিশ্বাস যে, সব সময়েই মনে করেন, কোনও না কোনও উপায়ে বেঁচে যাবেনই। একদিন-না-একদিন সব মানুষকেই মরতে হয়। কিন্তু অন্য লোকের ইচ্ছেয় তিনি কিছুতেই মরতে রাজি নন।

কিন্তু এখানে এটা কী হল? কোনও কথা নেই বার্তা নেই, লোকগুলো তাঁকে ঠেলে ফেলে দিল? আগে থেকে বিপদের একটুও আঁচ পাননি তিনি।

কাকাবাবু গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছেন। কোনও পাথরের খাঁজ কিংবা গাছের ডাল যে ধরে ফেলবেন, তারও উপায় নেই। তাঁর হাত দুটো পেছনদিকে বাঁধা।

কুমার সিং আর ভুবন দাসকে আগে কখনও দেখেননি কাকাবাবু। লোক দুটো অতি-সাধারণ, দুর্ধর্ষ বদ লোক হওয়ার যোগ্যতাও এদের নেই, শুধু-শুধু তাঁকে ওরা মারতে চাইল কেন?

এক জায়গায় কিসে যেন খুব জোরে কাকাবাবুর মাথা ঠুকে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এবার বুঝি জ্ঞান চলে যাবে।

কাকাবাবু ভাবলেন, জীবনে কি কিছু ভাল কাজ করিনি? দু-চারজন মানুষের কি উপকার করিনি আমি? তবু এরকম অকারণে প্রাণ দিতে হবে?

এর পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ঠিক কতক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরল তা তিনি বুঝতে পারলেন না। চোখৃ. খোলার পর প্রথমেই তিনি ভাবলেন, সন্তু? সন্তু কোথায়? তার কী হল?

তারপর তিনি বোঝবার চেষ্টা করলেন, কোথায় এসে পড়েছেন, হাত-পা কিছু ভেঙেছে কি না।

চতুর্দিকে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাথার মধ্যে এখন ঝিমঝম করছে বটে, কিন্তু শরীরে আর কোথাও ব্যথা নেই। শীতের ভয়ে আজ একটা বেশ মোটা ওভারকোট গায়ে দিয়ে বেরিয়েছিলেন, তাই শরীরে চোট লাগতে পারেনি। একটা মস্তবড় গামছা দিয়ে ওরা মুখটা বেঁধেছে, তার গিটটা পেছনদিকে, তার জন্যও মাথাটা বেঁচে গেছে।

যাক, তা হলে এ-যাত্রাতেও মরতে হল না। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে কাকাবাবু ভাবলেন, হুঁ, এবারে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু কোথায় এসে পড়া গেল? পিঠের কাছটা নরম-নরম। কাকাবাবু অনুভব করলেন, তিনি যেন একটা দোলনায় শুয়ে আছেন। সেটা তাঁর শরীরের চাপে একটু-একটু নিচু হচ্ছে। তাঁর মুখে লাগছে লতাপাতার স্পর্শ।

এক সময় দোলনাটা ছিঁড়ে গেল। কাকাবাবু আবার পড়ে গিয়ে গড়াতে লাগলেন।

কিন্তু এবারে বেশি নীচে পড়েননি, জায়গাটাও খাড়া নয়, ঢালু। বেশি জোরে গড়াচ্ছেন না। পা দিয়ে মাটিতে চাপ দিতে দিতে নিজেই থেমে যেতে পারলেন।

এবারে কোনওরকমে উঠে বসে তিনি ভাবলেন, লোকগুলো মহাবোকা! মেরে ফেলতেই যখন চেয়েছিল, তখন জায়গাটা ভাল করে দেখে নিতে পারেনি? আসামে বেশি বৃষ্টি হয় বলে এখানকার সব জঙ্গলেই লতা-গুল্ম আর আগাছায় ভর্তি, কঠিন পাথর দেখাই যায় না, ঢাকা পড়ে থাকে। এই খাদটাও পুরো খাড়া নয়। এক জায়গায় ঢালু হয়ে গেছে। এরকম জায়গায় পড়লেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুবই। .ওরা ঠিকমতো জায়গা বাছেনি।

সন্তুকে ওরা কী করল? ধরে রেখেছে?

কাকাবাবু বেশি নড়তে-চড়তে সাহস করলেন না। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, আবার কোথাও খাদ আছে কি না কে জানে! এ পর্যন্ত যখন বাঁচা গেছে, তখন দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করাই ভাল।

হঠাৎ তাঁর দুপুরবেলার সাপটার কথা মনে পড়ে গেল। সেপ্টেম্বর মাস, বর্ষা এখনও শেষ হয়নি, এই সময় সব সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। অন্ধকারে কোনও সাপের গায়ে পা দিলে আবার এক বিপদ হবে। সবচেয়ে ভাল উপায় একেবারে চুপ করে বসে থাকা। কিংবা শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া। নড়াচড়া না করলে সাপ কামড়াবে না। ঘুমন্ত লোকের গায়ের ওপর দিয়ে বিষাক্ত সাপ চলে গেছে, তবু কামড়ায়নি, এমন শোনা গেছে অনেকবার।

কাকাবাবু শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম আসবার আশা নেই।

তিনি একাগ্র হয়ে ভাববার চেষ্টা করলেন, কুমার সিং, ভুবন দাস কিংবা এখানকার অন্য কোনও লোককে আগে দেখেছেন কি না। না দেখেননি, এই জায়গাতেও তিনি আসেননি। এদের সঙ্গে শত্রুতা থাকার কোনও কারণ নেই। এরা কি তবে ভাড়াটে গুণ্ডা?

শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে লাগলেন কাকাবাবু। বারবার ভাবছেন সন্তুর কথা। যখন তাঁকে কুমার সিং ঠেলে ফেলে দেয়, তখন সন্তু একটু পেছনে পড়েছিল। সন্তু কি ব্যাপারটা দেখেছে? যদি দেখে থাকে, তা হলে সেই সময়ে সাহায্য করার বদলে সন্তু যদি পেছন ফিরে দৌড়ে পালিয়ে যায় তা হলে সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দুজনে একসঙ্গে মরা কিংবা ধরা পড়ার কোনও মানে হয় না।

আবার বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে, কোনও উপায় নেই।

কাকাবাবুর একটা গাধার কথা মনে পড়ল।

একবার হাজারিবাগে একটা ডাকবাংলোয় থাকার সময় কাকাবাবু জানলা দিয়ে একটা গাধাকে দেখেছিলেন। কোনও ধোপার গাধা হবে, দড়ি দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা। দারুণ বৃষ্টি পড়ছিল, প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলল সেই বৃষ্টি, সেই গাধাটাকে কেউ খুলে দেয়নি। সেটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, আর মাঝে-মাঝে করুণ সুরে ডাকছে। কাকাবাবু একবার ভেবেছিলেন, তিনি ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গাধাটাকে খুলে দেবেন। তারপর মনে হয়েছিল, তিনি খুলে দিলে গাধাটা যদি পালিয়ে যায়? ধোপা এসে চ্যাঁচামেচি করলে কী বলবেন?

কাকাবাবুর মনে হল, তাঁর অবস্থাও সেই গাধাটার মতন।

এত জোর বৃষ্টি হচ্ছে যেন মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়ছে। অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে মাঝে-মাঝে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। বোধ হয় গড়িয়ে পড়ছে। পাথর। এর মধ্যে একটা মাথায় এসে পড়লেই সর্বনাশ!

একসময় বৃষ্টিও থামল, ভোরের আলোও ফুটল।

এত বৃষ্টিতে ভিজে কাকাবাবুর ঠাণ্ডা লেগে গেছে খুব। তিনি হাঁচ্চো-হাঁচ্চো করে কয়েকবার হাঁচলেন। ওভারকোটটা ভিজে এমন ভারী হয়ে গেছে, যেন মনে হচ্ছে গায়ের ওপর একটা বর্ম চাপানো।

আর একবার হ্যাঁচ্চো করতেই তিনি তার একটা প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। বৃষ্টির জন্যই বোধ হয় তাঁর মুখের বাঁধনটা একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল, হ্যাঁচ্চোর চোটে তা একেবারেই খুলে গেল।

আবার তিনি পর-পর দুবার হাঁচ্চো করলেন, এবার তিনবার প্রতিধ্বনি হল।

কাকাবাবুর খটকা লাগল। প্রতিধ্বনি বেশি হচ্ছে কেন? এ কী অদ্ভুত জায়গা!

আবার তাঁর নাক শুল-শুল করছে, হ্যাঁচ্চো করতে যাবেন, তার আগেই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন।

তা হলে তো এটা প্রতিধ্বনি নয়, কাছাকাছি কোথাও মানুষ আছে।

আলো ফুটতেই নানারকম পাখি ডাকতে শুরু করেছে। কাকাবাবুর মাথার কাছে ভোঁ-ভোঁ করছে একটা ভোমরা।

এখানে বড় গাছ বিশেষ নেই, ঝোপঝাড়-আগাছাতেই ভর্তি। কাকাবাবু যেখানে শুয়ে ছিলেন, তার পাশেই বেশ বড় গর্ত একটা। অন্ধকারে হাঁটতে গেলে ওটার মধ্যে পড়লে নির্ঘাত পা ভাঙত। পাহাড়ের নানা জায়গা থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে সেই গর্তটায় পড়ছে, কলকল শব্দ হচ্ছে।

কাকাবাবু একটা গাছে পিঠ দিয়ে আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। ওভারকোটটা খুলে ফেলতে পারলে ভাল হত, কিন্তু হাত যে বাঁধা! তবু ভাগ্যিস ওরা পা বাঁধেনি।

একটু দূরে আর-একবার হাঁচ্চো শুনে তিনি সেদিকে সাবধানে এগোলেন। একেই তাঁর একটা পা অকেজো, তার ওপর হাত দুটোও বাঁধা, ঢালু জায়গায় হাঁটতে গেলে যে-কোনও মুহূর্তে তাঁর পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তিনি এক-একটা গাছ দেখে-দেখে সেই পর্যন্ত গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাল সামলে নিচ্ছেন।

একটু পরে দেখতে পেলেন, এক জায়গায় ঝোপের মধ্যে একটা হলদে রঙের রেন কোটের অংশ দেখেই চিনলেন ওটা সন্তুর।

তিনি দুইবার সন্তুর আম ধরে ডেকেও কোনও সাড়া পেলেন না।

এবারে তিনি প্রায় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সন্তুর পাশে।

হাত ভোলা নেই তাই মাথা দিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দিলেন সন্তুর পিঠে। সঙ্গে-সঙ্গে বলতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, আর ভয় নেই। আমি এসে গেছি!

তবু সন্তু সাড়া দিল না। একটু নড়চড়লও না।

কাকাবাবুর একবার বুক কেঁপে উঠলেও পরক্ষণেই ভাবলেন, ও তো হেঁচেছে কয়েকবার। তা হলে অজ্ঞান হয়ে আছে।

তিনি কোনওক্রমে সন্তুকে চিত করিয়ে দিয়ে দেখলেন, ওর নিশ্বাস পড়ছে। ওর মুখের একটা পাশে রক্ত লেগে আছে। সন্তুর হাতও বাঁধা নয়, মুখও বাঁধা নয়।

কাকাবাবু একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। যাক, সন্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে, সে বেঁচে আছে। ওর জ্ঞান না ফিরলে এখান থেকে যাওয়া যাবে না। সবচেয়ে আগে তাঁর হাতের বাঁধনটা খোলা দরকার। যদি নাইলন না হয়, সাধারণ দড়ি দিয়ে বেঁধে থাকে, তা হলে কোনও ধারালো পাথরে কিছুক্ষণ ঘষলেই কেটে যাবে।

সেরকম কোনও পাথর চোখে পড়ল না। ঢালু জায়গা, এখান দিয়ে অবিরাম বৃষ্টির জল গড়ায়, তাই সব পাথরই মসৃণ। কাকাবাবু একটা গাছ বেছে নিয়ে তার কাছে গিয়ে উলটো হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সেই গাছের গায়ে ঘষতে লাগলেন হাতের বাঁধন।

সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে গাছটা নরম হয়ে আছে। দড়ির ঘষায় গাছের চোকলাবাকলা খসে পড়ছে, দড়ির কিছু হচ্ছে না। দড়িটা যদি নাইলনের হয়, তা হলে সারাদিন ধরে ঘষলেও কোনও লাভ হবে না।

অজ্ঞান অবস্থাতেই সন্তু আর-একবার হেঁচে উঠল। হাতের ঘষাটা থামিয়ে কাকাবাবু সন্তুর দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর চোয়ালটা কঠিন হয়ে গেল। তিনি মনে-মনে বললেন, বেঁচে যখন গেছি, তখন এখান থেকেও উদ্ধার পাবই ঠিক। তারপর কুমার সিং আর ভুবন দাসের টুটি চেপে ধরতে হবে। পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই গিয়ে ওরা লুকোতে পারবে না।

আরও কয়েকবার দড়ির বাঁধনটা ঘষে-ঘষে কাটার চেষ্টা করে কাকাবাবু হাল ছেড়ে দিলেন। দড়িটা নিশ্চয়ই নাইলনের, গাছে ঘষে কোনও লাভ হবে না। সন্তুর হাত-পা বাঁধা নেই, সন্তু জেগে উঠলেই তাঁর বাঁধনটা খুলে দিতে পারবে।

কাকাবাবু কাছে গিয়ে সন্তুকে ধাক্কা দিলেন। সন্তু চোখ মেলছে না। এটা ঘুম হতেই পারে না, সন্তুর ঘুম এত গাঢ় নয়। সন্তু অজ্ঞান হয়ে আছে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে অজ্ঞান? খুব বেশি চোট লেগেছে ওর? থুতনির কাছে একটা জায়গায় অনেকখানি কেটেছে, সেখান থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। তবে ওই ক্ষতর জন্য তো অজ্ঞান হয়ে থাকার কথা নয়। •

হাত বাঁধা অবস্থায় কাকাবাবুর এখন আর কিছুই করার সাধ্য নেই। তিনি কাছে বসে রইলেন, আর মাঝে-মাঝে সন্তুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।

এইরকমভাবে কেটে গেল আরও এক ঘন্টা।

আস্তে-আস্তে রোদ ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে আর জঙ্গলে।

ভিজে ওভারকোটটা গা যেন কামড়ে ধরে আছে। কাকাবাবু শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন। মাঝে-মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘুম এসে যাচ্ছে, জ্বরও এসেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে জেগে থাকতেই হবে।

পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার পরেও বেঁচে গেছেন বটে, কিন্তু জবজবে ভিজে পোশাক পরে এমনভাবে বসে থাকলে ঠাণ্ডা লেগেই মরতে হবে।

আরও অনেকটা সময় কেটে গেল, তবু সন্তুর জ্ঞান ফিরল না।

হঠাৎ খানিকটা দূরে কিসের যেন একটা শব্দ শোনা গেল।

এতক্ষণ পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি জঙ্গলে। কোনও জন্তু-জানোয়ার দেখা যায়নি। এখন যেন মনে হচ্ছে বড় কোনও জানোয়ার জঙ্গলের লতা-পাতা-ডাল ঠেলে-ঠেলে আসছে এদিকেই।

বাঘ কিংবা ভাল্লুক হতে পারে না, তারা চলার সময় শব্দ করে না। হাতি হতে পারে। আসামের জঙ্গলে প্রচুর হাতি আছে। তারা এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে চলে আসে। হাতিরা তাড়া করে এসে মানুষ মারে না সাধারণত, তাদের চলার পথ থেকে দূরে সরে থাকলেই হল। কিন্তু হাতিরা যদি এখান থেকেই যেতে চায়? তা হলে তাদের পায়ের চাপেই চ্যাপটা হয়ে যেতে হবে!

সন্তুকে কাকাবাবু সরাবেন কীভাবে? কোন দিকেই বা সরাবার চেষ্টা করবেন?

এবার যেন মানুষের গলার গুনগুন আওয়াজ পাওয়া গেল!

কোনও মানুষ এদিকে আসছে বুঝতে পেরে কাকাবাবুর প্রথমে খুব ভরসা জাগল। এবার সাহায্য পাওয়া যাবে।

পরে মুহূর্তেই মনে হল, যদি কুমার সিংরা আসে? ওরা হয়তো দেখতে আসছে, কাকাবাবু আর সন্তু সত্যি-সত্যি মরেছে কি না!

ওরা কাকাবাবুর রিভলভারটা কেড়ে নেয়নি, সেটা এখনও রয়ে গেছে। কোটের পকেটে। কিন্তু হাত বাঁধা, সেটা ব্যবহার করার কোনও উপায় নেই। অসহায় রাগে কাকাবাবু ছটফট করতে লাগলেন। তবু এই অবস্থাতে, তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, যদি কুমার সিং আসে, তাকে সাঙ্ঘাতিক শাস্তি দিতেই হবে।

এবার লোকটিকে দেখা গেল। পীতাম্বর পাহাড়ী!

তার হাতে একটা লম্বা চিমটে, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুট, মাথায় টুপি। সে গুনগুন করে গান গাইছে। কাকাবাবু তাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন না। চুপ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

অম্বর এদিকেই আসছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর চিমটে দিয়ে বাড়ি মারছে ঝোপঝাড়ে। তারপর হঠাৎ কাকাবাবুকে দেখতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর চোখ দুটো গোল-গোল করে বলল, এ কী, এ কী, এ কী! কাকাবাবু! এত সকালে জঙ্গলে? পাহাড়ের এত নীচে? বেড়াতে এসেছেন বুঝি? আপনার তো বেড়াবার খুব শখ!

তারপর সন্তুর দিকে চোখ পড়তেই সে আবার বলল, ও কী? সন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? অ্যাকসিডেন্ট? কী করে হল? কোথা থেকে পড়ে গেল?

কাকাবাবু এবার গম্ভীরভাবে বললেন, অম্বরবাবু, আমার হাতের বাঁধনটা খুলে দেবেন প্লিজ?

অম্বর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, অ্যাঁ? আপনার হাত বাঁধা? কে এমন করল? নিশ্চয়ই কুমার সিং? লোকটা ভাল না, প্রথম দেখেই আমি বুঝেছিলাম! কাল রাত্তিরে আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। ওই লোকটা যেতে দিল না! কখন থেকে এইরকম হাত বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন? ঠিক কী হয়েছিল খুলে বলুন তো?

কাকাবাবু বললেন, আপনি আগে আমার হাত দুটো খুলে দিন।

অম্বর কাকাবাবুর পাশে বসে পড়ে বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ওরে বাবা, এ যে নাইলনের দড়ি। খুব শক্ত করে গিট বেঁধেছে। জলে ভিজে আরও শক্ত হয়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, আমার ওভারকোটের ভেতরের পকেটে দেখুন একটা ছুরি আছে।

অম্বর বলল, ছুরি তো আমার কাছেও আছে। জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরি, সবসময় কাছে একটা বড় ছুরি রাখি। কিন্তু নাইলনের দড়ি ছুরি দিয়েও সহজে কাটা যায় না। হাত দিয়েই গিটটা খুলতে হবে। আপনি আমাকে অম্বরবাবু বলছেন কেন? অম্বর আর তুমি বলে ডাকবেন। আপনার সম্পর্কে কত লেখা পড়েছি। এবার আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আমিও ঢুকে পড়লাম, ভাবতেই আমার দারুণ মজা লাগছে। এবারে বইটার নাম কী হবে? দস্যুর কবলে কাকাবাবু। তার মধ্যে আমিও একটা ক্যারেকটার। পীতাম্বর পাহাড়ী! না, না, আমার নামটা শুধু অম্বরই রাখবেন। পাহাড়ী পদবিটা অবশ্য রাখতে হবে, নইলে আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করবে না।

একটানা কথা বলতে বলতে এক সময় সে বলল, এই যে গিটটা খুলেছে।

কাকাবাবু হাত দুটো সামনে আনতে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেললেন। সারারাত ধরে হাত দুটো পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধা ছিল বলে কাঁধের কাছে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা হয়ে গেছে।

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে হাত দুটো সামনে-পেছনে করলেন কয়েকবার। তারপর খুলে ফেললেন ওভারকোটটা।

ঝুঁকে পড়ে সন্তুকে দু হাতে তুলে ধরে ব্যাকুলভাবে ডাকলেন, সন্তু! সন্তু!

অম্বর বলল, অন্য গল্পে থাকে, সন্তু অনেক কায়দা করে আপনাকে বিপদ থেকে বাঁচায়। এখানে সন্তু এতক্ষণ চুপ করে শুয়ে আছে কেন? ওর তো হাত-পা বাঁধা নয়। এই যে সন্তুবাবু, উঠুন!

কাকাবাবু এবার ধমকের সুরে বললেন, আপনি এটাকে মজার ব্যাপার ভাবছেন? গল্প ভাবছেন! এটা জীবন মরণের প্রশ্ন। সন্তু অনেকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে আছে। সাঙ্ঘাতিক কোনও আঘাত না লাগলে ও অজ্ঞান হয়ে থাকত না। ওকে এক্ষুনি ওপরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সন্তুকে কোলে করে ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি রাস্তাটা দেখিয়ে দিন?

ধমক খেয়ে খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে গিয়ে অম্বর বলল, আপনি কোলে করে সন্তুকে নিয়ে উঠবেন! অসম্ভব! আপনারা অনেক নীচে নেমে এসেছেন। এখান থেকে হাফলঙ শহর অনেক উঁচু। কোনও সিঁড়িও নেই। আপনার একাই তো উঠতে কষ্ট হবে খুব। আপনার ক্রাচ দুটো কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই। যেতেই হবে। সন্তুকে এক্ষুনি ডাক্তার দেখাতেই হবে।

অম্বর বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, ব্যবস্থা করছি।

কোমর থেকে একটা ভোজালি বের করে সে একটা গাছের ডাল কাটল। তারপর সেটার পাতা-টাতা হেঁটে লাঠির মতন বানিয়ে কাকাবাবুর হাতে দিয়ে বলল, আপনি এটা নিয়ে আস্তে-আস্তে আসুন, কাকাবাবু! সন্তুকে আমার কাছে দিন। এভাবেও পুরোটা ওঠা যাবে না। কাছেই পাহাড়িদের একটা ছোট গ্রাম দেখে এসেছি। ওখান থেকে ঘোড়া জোগাড় করতে হবে।

সন্তু তো আর ছোটখাটো ছেলে নয়, সে কলেজে পড়ে, চেহারাটাও বড় হয়েছে বেশ। তাকে কোলে নিয়ে পাহাড়ি পথে ওঠা সহজ কথা নয়। অম্বর সন্তুকে কাঁধে নিয়ে চলল, একটু বাদেই হাঁপাতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল পাহাড়িদের বসতিটা। সন্তুকে নামিয়ে অম্বর ছুটে গিয়ে দুটো ঘোড়া জোগাড় করে আনল। সঙ্গে একজন লোক। কাকাবাবু একটা ঘোড়ায় চাপলেন, অন্য ঘোড়াটিতে অম্বর বসল সন্তুকে নিয়ে। পাহাড়ি লোকটি হেঁটে-হেঁটে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

এক সময় ওরা পৌঁছে গেল ডাকবাংলোর সামনে।

দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় বিচারকটি বসে আছেন বাংলোর বারান্দায়। এখন আর তিনি উদাসীন ভাব করলেন না। ওদের দেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন, কী ব্যাপার মিঃ রায়চৌধুরী, আপনারা সারারাত কোথায় ছিলেন? এ কী চেহারা! আপনার ভাইপোটিরই বা কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।

অম্বর বলল, অ্যাকসিডেন্ট না ছাই! গুরুতর ব্যাপার। কাকাবাবুর হাত বাঁধা ছিল।

বিচারক আঁতকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? হাত বাঁধা? সে কী? ভোরবেলাতেই একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন। তিনি বললেন, একজন মিস্টার সিং ডায়েরি করে গেছে যে, কলকাতার দুজন লোক পা পিছলে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে।

কাকাবাবু এসব কথা কিছুই এখন শুনতে চান না।

তিনি অম্বরকে বললেন, শিগগির একজন ডাক্তার ডেকে আনো প্লিজ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি বলে অম্বর ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

ডাকবাংলোর একজন বেয়ারাকে সামনে দেখে কাকাবাবু বললেন, তাড়াতাড়ি গরম জল নিয়ে এসো!

বেয়ারাটি ধরাধরি করে সন্তুকে ঘরের মধ্যে এনে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দৌড়ে গরম জল আনতে চলে গেল।

কাকাবাবু সন্তুর ভিজে সোয়েটার আর জামাটা খুলে ফেললেন। তারপর দুখানা কম্বল চাপা দিলেন ওর গায়ে। অজ্ঞান অবস্থাতেও সন্তুর শরীরটা শীতে কেঁপে-কেঁপে উঠছে।

কাকাবাবু সন্তুর মাথার চুলে আঙুল দিয়ে খুঁজতে লাগলেন, কোনও গভীর ক্ষত আছে কি না। সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। মুখের কাটা জায়গা থেকে এখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে।

বেয়ারা চটপট গরম জল আনতেই তিনি তাতে তোয়ালে ভিজিয়ে সন্তুর সারা গা ঘষে দিতে লাগলেন। গরম জলের ছোঁয়ায় সন্তু উ-উ শব্দ করতে লাগল।

অম্বর ছেলেটি সত্যিই খুব করিৎকর্মা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে একজন ডাক্তারকে প্রায় ধরেই নিয়ে এল।

ডাক্তারটি সন্তুর মাথার কাছে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো?

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, পা পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে গেছে।

তিনি অম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন, এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলার দরকার নেই।

বিচারকও ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আর কিছু বললেন না।

ডাক্তার সন্তুকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কাকাবাবু পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। একবার ডাক্তারের হাত কাকাবাবুর গায়ে লেগে গেল। তিনি চমকে উঠে বললেন, সাঙ্ঘাতিক গরম! আপনারও তো খুব জ্বর হয়েছে দেখছি!

কাকাবাবু অস্থিরভাবে বললেন, আমাকে নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। আপনি ওকে ভাল করে দেখুন!

কাকাবাবু সন্তুর সোয়েটার আর জামা-গেঞ্জি খুলে ফেলেছিলেন, প্যান্টটা খোলেননি। ডাক্তারবাবু প্যান্টটাও টেনে খুলে ফেলার পর দেখা গেল সন্তুর বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরটা একটা টেনিস বলের মতো ফুলে আছে।

কাকাবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, এ কী!

ডাক্তার বললেন, এই হাঁটুতেই তো সবচেয়ে বড় ইনজুরি দেখছি! আর কোথাও তেমন কিছু নেই। মাথাতেও আঘাত লাগেনি, বমিটমি করেনি!

তিনি সন্তুর সেই হাঁটুতে একটু টিপে দেখতে যেতেই সন্তু ছটফটিয়ে উঠল।

ডাক্তার এবার তাঁর ব্যাগ খুলে ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ বের করলেন। সন্তুকে একটা ইঞ্জেকশান দেওয়ার পর তিনি বললেন, এখন ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই। ভাল। ও আসলে যন্ত্রণার চোটে অজ্ঞান হয়ে আছে। জ্ঞান ফিরে এলে আরও কষ্ট পাবে। আমার মনে হচ্ছে, ওর হাঁটুর মালাইচাকি গুঁড়িয়ে গেছে!

কাকাবাবু বিবর্ণ মুখে ফিসফিসিয়ে বললেন, মালাইচাকি গুঁড়িয়ে গেছে?

ডাক্তার বললেন, এক্ষুনি এক্স-রে করা দরকার। এখানে একটাই মেশিন ছিল, তাও খারাপ হয়ে গেছে। ওর পা-টা সারাজীবনের মতন জখম হয়ে গেল। বোধ হয় ওর হাঁটুর কাছ থেকে কেটে বাদ দিতে হবে। এখানে ওর ঠিকমতন চিকিৎসা করানো যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে শিলচর কিংবা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া উচিত।

কাকাবাবু পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, আমি এক্ষুনি ওকে শিলচর নিয়ে যাব! ট্রেন কটায়? গাড়ি! একটা গাড়ি চাই!

অম্বর আর বিচারক কাকাবাবুকে জোর করে টেনে সন্তুর বিছানার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

বিচারক বললেন, শান্ত হোন! মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এমনভাবে ভেঙে পড়লে আরও মুশকিল হবে।

কাকাবাবুর দু চোখ জলে ভরে গেল। তিনি অসহায়ভাবে বললেন, সন্তু! সন্তু খোঁড়া হয়ে যাবে? আমার মতন? আমি এক্ষুনি ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই। একটা গাড়ি, যত টাকা লাগে লাগুক, একটা গাড়ি…

বিচারক বললেন, আমি আজই শিলচর ফিরছি। আমার জন্য একটা গাড়ি আসছে এক ঘন্টার মধ্যে। সেই গাড়িতেই আমরা চলে যাব।

কাকাবাবু বললেন, এক ঘন্টা? আমি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে চাই না। ট্রেন যাবে না এখন?

অম্বর বলল, সার, জজসাহেব ভাল কথাই বলেছেন। অন্য একটা গাড়ি ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দুপুরের আগে ট্রেন নেই। ট্রেনে ছ-সাত ঘন্টা সময় তো লাগবেই। গাড়িতে শিলচর পৌঁছনো যায় চার ঘন্টায়। জজসাহেবের গাড়িতে গেলেই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবেন।

সেটাই ঠিক হল শেষ পর্যন্ত। রাস্তায় সন্তুকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য দু-একটা ওষুধ দিয়ে ডাক্তারবাবু বিদায় নিলেন। অম্বর চটপট গুছিয়ে দিল সব জিনিসপত্র।

বেয়ারা ব্রেকফাস্ট আনলেও কাকাবাবু কোনও খাবার খেলেন না। শুধু গরম কফি খেলেন দু কাপ। প্রচণ্ড জ্বরে তাঁর শরীর ঝাঁ ঝাঁ করছে।

গাড়ির প্রতীক্ষায় তাঁরা বসে রইলেন বারান্দায়।

বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, কিছু মনে করবেন না, সব ব্যাপারটা জানতে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে। আপনার মুখ আর হাত বাঁধা ছিল। তার মানে, আপনাকে কেউ খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে?

কাকাবাবু মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লেন।

বিচারক আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভাইপোটিকেও ফেলে দিয়েছিল?

অম্বর বলল, নিশ্চয়ই তাই। সন্তুকেও কাছেই অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে।

বিচারক বললেন, আপনার মতন একজন ভদ্রলোক, এখানে পাখি দেখতে এসেছেন, কারও সঙ্গে ঝগড়া হয়নি, তবু হঠাৎ আপনাকে মেরে ফেলতে চাইবে কেন? আগে থেকে কি এখানকার কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল?

কাকাবাবু এবার দুদিকে মাথা নাড়লেন।

অম্বর আবার বলল, ইনি হচ্ছেন রাজা রায়চৌধুরী। বহু রহস্যের সমাধান করেছেন। কত আন্তজাতিক ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছেন। এঁর শত্রু থাকবে না? আপনি যেমন কাল বললেন, জজ হিসেবে আপনি অনেক চোর-ডাকাতকে শাস্তি দিয়েছেন, সেইজন্য আপনার ওপর অনেকের রাগ আছে। ইনি তো চোর-ডাকাতদের চেয়েও বড়-বড় রাঘববোয়ালদের শাস্তি দিয়েছেন। এঁর ওপর অনেকেই প্রতিহিংসা নিতে চাইবে।

বিচারক বললেন, এঁর সেই পরিচয়টা আমার জানা ছিল না। তবে তো খুব সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। কুমার সিং, ভুবন দাসও কি সেই দলের? ভোরবেলা একজন পুলিশ এসে বলে গেল, কুমার সিং জানিয়েছে যে, আপনাদের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ওরা অনেক খোঁজাখুজি করেও আপনাকে পায়নি। গুয়াহাটিতে খুব জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় ওরা হঠাৎ চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেইজন্যই পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়ে গেল।

অম্বর বলল, ওরাই তো ঠেলে ফেলে দিয়েছে। রাত্তিরবেলা নেমন্তন্ন খাওয়াবার নাম করে নিয়ে গেল।

বিচারক বললেন, ওদের দুজনকে কি আপনি আগে চিনতেন মিঃ রায়চৌধুরী? আপনি যে এখানে আসবেন, তা কি ওরা আগে থেকে জানত?

কাকাবাবু এবার আস্তে-আস্তে বললেন, না, ওদের আমি চিনি না। তবে ওরা জানত যে আমি আসছি। ওরাই আমাকে নেমন্তন্ন করে এনেছে। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, এই সময় আমার আসামের এই জায়গায় আসবার কথাই ছিল না। আমি গোপালপুরে ছুটি কাটাতে যাব ঠিক ছিল। অনেকদিন সমুদ্রের ধারে থাকিনি। গোপালপুর-অন-সি-তে আমাদের দুজনের জন্য হোটেলও বুক করা হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন আগে কলকাতায় একটা পার্কে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি আমাকে জাটিংগার পাখিদের কথা বললেন।

বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, সেই ভদ্রলোক কি ভুবন দাস কিংবা কুমার সিং?

কাকাবাবু বললেন, না। অন্য একজন মাঝবয়েসী লোক। আমি রোজ ভোরে পার্কে বেড়াতে যাই। একটা বেঞ্চে বসি। এক ভদ্রলোক সেই বেঞ্চে আমার পাশে বসলেন। তাঁর হাতে একটা পত্রিকা। সেই পত্রিকায় জাটিংগার পাখিদের ছবিটবি দিয়ে একটা লেখা ছিল। ভদ্রলোক নিজে থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ করে সেই পত্রিকাটি দেখিয়ে বললেন, আপনি জাটিংগার এই আকাশ থেকে পাখি পড়ার রহস্য সম্পর্কে কিছু জানেন?

আমি বলেছিলাম, ও সম্পর্কে শুনেছি বটে, কিন্তু বিশেষ কিছু জানি না। সে

ইদিন ওই পর্যন্তই কথা হল। পরদিন সকালে সেই ভদ্রলোক আবার এলেন, ওই পাখির কথা তুলে বললেন, আপনি তো কত রহস্য ভেদ করেন, একবার এই পাখির রহস্য ভেদ করে আসুন না!

আমি বললাম, গুণ্ডা বদমাশের চেয়ে পাখিদের রহস্য দেখতেই আমার ভাল লাগবে ঠিকই। পরে একসময় দেখতে যাব। এবার আমি গোপালপুরে যাচ্ছি।

তিনি বললেন, গোপালপুর তো যে-কোনও বছরই যেতে পারেন। জাটিংগার পাখি কবে শেষ হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। এবারেই দেখে আসুন না! হাফলঙে আমার এক আত্মীয় কাঠের ব্যবসা করে। সে আপনার থাকার জায়গা, ঘোরাঘুরির সব ব্যবস্থা করে দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না।

আমি তখন বললাম, ঠিক আছে, গোপালপুর থেকে ঘুরে আসি, তারপর যাব।

তিনি বললেন, কালকেই আমাদের একটা গাড়ি কলকাতা থেকে সোজা হাফলঙ যাচ্ছে। একজন মাত্র যাত্রী থাকবে। আপনি স্বচ্ছন্দে যেতে পারেন। এতখানি পাহাড়ি রাস্তা বেড়াতে-বেড়াতে যাবেন, দেখবেন খুব ভাল লাগবে। গাড়িতে আসা হবে শুনে আমার লোভ হল। আসামের এদিকে আগে আসিনি। সন্তুও নেচে উঠল, তাই গোপালপুরের বদলে আমরা এখানে চলে এলাম।

অম্বর বলল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনাকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে টেনে এনেছে।

কাকাবাবু বললেন, কুমার সিংরা প্রথম থেকেই তো আমাদের খুব খাতির করছিল। জায়গাটাও খুব সুন্দর।

বিচারক বললেন, তা হলে কলকাতার পার্কের ওই লোকটারই রাগ আপনার ওপর। কোনও কারণে সে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। সেইজন্যই আমি অচেনা লোকের সঙ্গে বেশি কথা বলি না।

কাকাবাবু বললেন, সেই লোকটিকেও আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয়নি।

বিচারক বললেন, একেই বলে নিয়তি! আপনি যদি এখানে না এসে গোপালপুর যেতেন, তা হলে এসব দুভোগ কিছুই হত না। আপনার ভাইপোর পা-টাও নষ্ট হত না! তবু ভাগ্যিস প্রাণে বেঁচে গেছেন? গোপালপুর-অন-সি জায়গাটা খুব ভাল, তাই না? আমি কখনও যাইনি।

কাকাবাবু আর কোনও কথা বললেন না। গুম হয়ে বসে রইলেন।

একটু পরেই গাড়িটা এসে গেল। সন্তুকে এনে শুইয়ে দেওয়া হল পেছনের সিটে। কাকাবাবু তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসলেন। ইঞ্জেকশানের প্রভাবে সন্তু এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছ, তার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই।

অম্বর বলল, সার, আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে? যদি কোনও কাজে লাগতে পারি?

কাকাবাবু তার হাতটা ধরে বললেন, না, তার আর দরকার নেই। উত্তেজনার মাথায় তোমাকে অনেক বকাবকি করেছি। কিন্তু তুমি আমাদের খুব উপকার করেছ। তোমার আছে কৃতজ্ঞ।

অম্বর বলল, ওসব কী বলছেন, সার। এমন কিছুই করিনি। চিন্তা করবেন।, সন্তু ভাল হয়ে উঠবে। আবার দেখা হবে।

কাকাবাবু বললেন, আশা করি আবার দেখা হবে।

গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে নামতে লাগল। বেশ কিছুটা নেমে আসার পর দেখা গেল কার্ল জরগেন নামে জার্মান ছেলেটি কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে-হেঁটে আসছে। সে হাত তুলে গাড়িটা থামাল।

কাকাবাবু জানলা দিয়ে বললেন, তুমি লিফ্ট চাও? তোমাকে কোথাও নামিয়ে দিতে হবে?

ছেলেটি হেসে বলল, না, আমি হেঁটে-হেঁটে ঘুরতেই ভালবাসি। পাখি খুঁজতে বেরিয়েছি। কিন্তু আপনি কি ফিরে যাচ্ছেন নাকি? আজ সন্ধেবেলা আসবেন না?

কাকাবাবু বললেন, একটা খুব জরুরি কারণে আজ চলে যেতে হচ্ছে। সন্ধেবেলা আসব না। তবে, এখানে পরে আবার কখনও ফিরে আসব।

দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চিত ফিরে আসব। কুমার সিং আর ভুবন দাস এখন পালিয়েছে বটে। কিন্তু যেখানেই লুকিয়ে থাক, আমার হাত থেকে ওরা কিছুতেই নিষ্কৃতি পাবে না। ওদের শাস্তি দিতেই হবে।
আগাগোড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ, ছোট-ছোট পাহাড় ঘুরে-ঘুরে এগিয়ে চলল গাড়িটা। পাশে-পাশে দেখা যায় জাটিংগা নদী। বর্ষার জলে একেবারে ভর্তি, স্রোতও খুব। মনে হয় যেন নদীটা মাঝে-মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে।

নদীর ধারে-ধারে রেল লাইন। উলটো দিকের একটা ট্রেন যাচ্ছে। ছোট ট্রেন, দূর থেকে খেলনার মতন মনে হয়। পাহাড়ের মাঝে-মাঝে টানেল, ট্রেনটা এক-একবার ঢুকে যায় অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে। গাড়ি অবশ্য বাইরে দিয়েই। যায়।

জজসাহেব বসেছেন সামনের সিটে। মাঝে-মাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখছেন সন্তুকে। গাড়িতে উঠেই তিনি বলেছেন যে, শিলচরে তাঁর চেনা একজন ডাক্তার আছেন। খুব ভাল ডাক্তার। তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন, দরকার হলে অপারেশানও করতে পারবেন।

একবার গাড়িতে খুব জোর ঝাঁকুনি লাগতেই সন্তু চোখ মেলে চাইল।

কাকাবাবু অমনি মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, সন্তু, খুব ব্যথা করছে?

সন্তু কোনও কথা না বলে কয়েক মিনিট চেয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, হ্যাঁ, ব্যথা আছে। খুব বেশি না। কাকাবাবু, তোমার কিছু হয়নি?

কাকাবাবু বললেন, না, আমার কিছু হয়নি!

সন্তু খুব একটা নিশ্চিন্ত ভাব করে বলল, ও! তোমার কিছু হয়নি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি আর-একটু ঘুমোই?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ঘুমো ঘুমো!

গাড়ির ড্রাইভারটি বেশ দক্ষ। রাস্তা অনেক জায়গায় বেশ খারাপ হলেও চার ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে দিল শিলচর শহরে।

ব্রিজের ওপর এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম হয়েছে, সেখানেই দেরি হতে লাগল খানিকক্ষণ। কাকাবাবু অধৈর্য হয়ে উঠলেন।

পাশ থেকে একজন মোটর সাইকেল আরোহী হঠাৎ বলে উঠল, আরে, কাকাবাবু! আপনি এদিকে কবে এলেন?

যুবকটিকে দেখে কাকাবাবুর মুখখানাতে স্বস্তি ফুটে উঠল। এর নাম প্রবীর চৌধুরী। কাকাবাবুর এক বন্ধুর ছেলে, ডাক্তার।

কাকাবাবু বললেন, প্রবীর? তুমি এখানে কী করছ?

প্ৰবীর বলল, আমি তো এখানকার এক চা বাগানে ডাক্তারি করছি দু বছর ধরে। আপনি জানতেন না? আমি মাঝে-মাঝে শিলচর শহরে আসি কিছু কেনাকাটা করবার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, খুব ভাল হল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে। শোনো প্রবীর, সন্তুর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, একটা পা ভেঙে গেছে বোধ হয়। এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্ৰবীর বলল, তাই নাকি? আমার বন্ধুর নার্সিং হোম আছে। চলুন, সেখানে গিয়ে আমি দেখছি। আমার বন্ধুটিও দেখবে।

জজসাহেব বললেন, না, না, তার দরকার নেই। আমার চেনা ডক্টর ভার্গব এখানকার খুব নামকরা ডাক্তার। আমি তাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আর কোনও অসুবিধে হবে না।

এর মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে গেল, গাড়িটা আবার স্টার্ট দিল। প্রবীরের মোটর বাইক আড়ালে পড়ে গেল একটা ট্রাকের।

মিনিট-দশেক পর গাড়িটা থামল একটা বড় বাড়ির সামনে। সেটা একটা নার্সিং হোেম বলে মনে হয়।

জজসাহেব প্রথমে নিজে নেমে গিয়ে তোক ডেকে আনলেন। সন্তুকে নিয়ে শোওয়ানো হল একটা ঘরে। তারপর জজসাহেব বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। ডক্টর ভার্গব ওপরে আছেন। আমি তাঁকে ডেকে আনছি। উনি ব্যস্ত থাকলেও আমি অনুরোধ এলে এক্ষুনি আসবেন।

সন্তুর এখন ঘুম ভেঙে গেছে। সে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, কোনও কথা বলছে না। মাঝে-মাঝে শুধু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে তার মুখ। কাকাবাবু হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার কপালে।

মিনিট-পাঁচেক বাদেই বিচারকের সঙ্গে নেমে এলেন ডাক্তার ভার্গব। বেশ বলশালী চেহারা, দাড়ি-গোঁফ কামানো, মাথায় টাক, গায়ের রং খুব ফর্সা।

তিনি সন্তুর মাথা, বুক, পেট আর পা পরীক্ষা করলেন খুব মনোযোগ দিয়ে। সন্তুকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কোথায় কতটা লাগছে। সন্তুর নাম, কোন কলেজে পড়ে, কী পড়তে ভাল লাগে, এরকম নানা কথাও জানতে চাইলেন।

তারপর কাকাবাবুকে বললেন, ভগবানকে ধন্যবাদ দিন, এ ছেলেটি বেঁচে গেছে। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। মাথায় তেমন চোট লাগেনি, কথাবার্তা পরিষ্কার বলছে। কয়েকটা এক্স-রে করতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, আর পা-টার অবস্থা?

ডাক্তার ভার্গব একটু সরে এসে বললেন, পায়ের অবস্থাটাই বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে অপারেশান করে বাদ দিতে হবে। প্রাণটাই বেঁচে গেছে, সেই তুলনায় একটা পা যাওয়া আর এমন কী ক্ষতি? তবে এক্ষুনি নয়, দিন-দশেক দেখা দরকার। যদি অপারেশান না করে পা-টা রাখা যায়।

কাকাবাবু বললেন, দিন-দশেক? তা হলে আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই।

ডাক্তার ভার্গব বললেন, এই অবস্থায় ওকে নাড়াচাড়া করা আরও বিপজ্জনক। এই যে এতখানি রাস্তা এনেছেন, গাড়ির ঝাঁকুনিতে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্তত চার-পাঁচদিন একদম চুপচাপ শুইয়ে রেখে দেখা যাক।

এই সময় পাশ থেকে একজন বলল, কাকাবাবু একটা কথা বলব?

কাকাবাবু চমকে গিয়ে দেখলেন ডাক্তার প্রবীর চৌধুরী কখন এসে কাছে। দাঁড়িয়েছে।

প্রবীর ডাক্তার ভার্গবকে বলল, নমস্কার সার। আমি একজন জুনিয়ার ডাক্তার। তবে আমার বন্ধু ডাক্তার ভূপেন বড়ঠাকুর এখানে অনেকদিন প্র্যাকটিস করছেন, তাঁকে চেনেন নিশ্চয়ই। ওঁর নিজের বাড়িতেই নার্সিং হোম, সেখানে যদি সন্তুকে নিয়ে রাখা যায়, তা হলে কাকাবাবুও কাছে থাকতে পারবেন।

ডাক্তার ভার্গব বললেন, এখানেও কাছেই হোটেল আছে, সেখানে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

জজসাহেব বললেন, না, না, এখান থেকে আর সরানো ঠিক হবে না। ছেলেটির আরও ক্ষতি হয়ে যাবে।

প্ৰবীর বলল, ভূপেন বড়ঠাকুরের চেম্বার কাছেই। নিয়ে যাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান আছে। ওখানে নিয়ে গেলে আমরা সবাই মিলে চব্বিশ ঘন্টা ওর কাছে থাকতে পারি।

এবার সন্তু বলে উঠল, আমি প্রবীরদার সঙ্গে যাব?

ভার্গব ডাক্তার দু কাঁধ কাঁপিয়ে বললেন, পেশেন্ট নিজে যদি থাকতে না চায়, তা হলে আমি জোর করে তো ধরে রাখতে চাই না! নিয়ে যান তা হলে!

প্রবীর সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে ছুটে বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবু জজসাহেবকে প্রচুর ধন্যবাদ দিলেন। ভার্গব ডাক্তারকেও বললেন, আপনি ভালভাবে ওকে পরীক্ষা করে দেখেছেন, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

ভার্গব ডাক্তারকে টাকা দিতে চাইলেন কাকাবাবু, কিন্তু তিনি নিলেন না।

সন্তুকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে আসা হল ভূপেন বড়ঠাকুরের চেম্বারে। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুকে এক্স-রে করার ঘরে নিয়ে গেলেন।

প্ৰবীর বলল, জানেন কাকাবাবু, যখনই শুনলাম, সন্তুকে ভার্গব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনই আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। ডাক্তার হিসেবে ভার্গব খারাপ নন, কিন্তু উনি রুগিদের বেশিদিন ধরে রাখেন। যে রুগিকে চার-পাঁচদিনে ছেড়ে দেওয়া যায়, তাকেও উনি দশ বারোদিন আটকে রাখেন। তা ছাড়া সন্তুর পা ভেঙে গেছে, উনি তো হাড়ের ডাক্তার নন। ভূপেন ডাক্তারের একজন সহকর্মী আছেন, ডাক্তার ইউসুফ, তাঁকে বলা যেতে পারে হাড়ের অসুখের জাদুকর।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, তোর কী হয়েছিল মনে আছে? তোকে ওরা ঠেলে ফেলে দেওয়ার আগে তুই কিছু বুঝতে পেরেছিলি?

সন্তু বলল, আমায় কেউ ঠেলে ফেলে দেয়নি তো!

প্রবীর অবাক হয়ে বলল, তা মানে? আপনাদের কে ঠেলে ফেলে দেবে?

কাকাবাবু বললেন, দুজন লোক। আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, তারপর একটা খাদের পাশে…তোমাকে সব ঘটনাটা পরে বলব। সন্তু, তুই কী বললি? তোকে কেউ ফেলে দেয়নি?

সন্তু বলল, না। হঠাৎ ওখানে দেখলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে হুড়মুড় করে দু-তিনজন লোক নেমে এল। ওরা ওখানে লুকিয়ে ছিল। আমি পেছন ফিরে তাদের দেখতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছি। তার মধ্যে ওরা তোমার হাত বেঁধে ফেলেছে। আমি দেখলুম, কুমার সিং তোমাকে লাথি মেরে খাদে ফেলে দিল। তারপর ওরা আমাকেও ধরতে গেল। সামনে আর পেছনদিকে, দুদিকেই ওরা। একজন আমার একটা হাত ধরেও ফেলেছিল, আমি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই খাদের মধ্যে লাফ দিলাম!

কাকাবাবু একটা ভয়ের শব্দ করে বললেন, অ্যাঁ! বলিস কী? তুই ইচ্ছে, করে ওই গভীর খাদে লাফিয়ে পড়লি?

সন্তু ফ্যাকাসেভাবে হেসে বলল, হ্যাঁ।

কাকাবাবু বললেন, কেন এরকম কাণ্ড করলি সন্তু? ওরা হয়তো তোকে মারত না?

সন্তু বলল, তা বলে ওদের হাতে ধরা দেব? ওরা তোমাকে খাদে ফেলে দিয়েছে, আমি নিজের চোখে দেখলাম, তখন আমার একটাই কথা মনে হয়েছিল। তোমার ভাগ্যে যা ঘটবে, আমারও তাই হবে।

প্ৰবীর বলল, তুই কী সাঙ্ঘাতিক ছেলে রে সন্তু! ইচ্ছে করে খাদে লাফিয়েছিস? লোকগুলো কে? তাদের পুলিশ ধরেনি?

কাকাবাবু বললেন, এসব কথা অন্য কাউকে এখন বলার দরকার নেই।

অ্যাম্বুলেন্সটা শিলচর শহর ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় একটা বাড়ির সামনে থামল। বেশ পরিষ্কার, সাজানো-গোছানো বাগানও রয়েছে সামনে, দেখলে নার্সিং হোম বলে মনেই হয় না।

ডাক্তার বড়ঠাকুরকে ডেকে প্রবীর তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।

তিনি তাঁর এক সহকারীকে ডেকে সন্তুকে পাঠিয়ে দিলেন এক্স-রে করার জায়গায়। তারপর কাকাবাবুর দিকে কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার ছবি আমি কাগজে দেখেছি। কিন্তু এখন তো আপনাকেই খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।

প্রবীর কাকাবাবুর কপালে হাত দিয়ে বলল, বেশ জ্বর!

কাকাবাবু বললেন, ও এমন কিছু না। বেশি বৃষ্টিতে ভিজেছি। সন্তুর পা-টা আপনি ভাল করে দেখুন। যদি ওর একটা পা সত্যিই বাদ দিতে হয়…

হঠাৎ কাকাবাবুর সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল। হু-হু করে জল এসে গেল দু চোখে। বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে তিনি উঠছিলেন, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। ঘুরে পড়ে গেলেন মাটিতে!

দুই ডাক্তার ধরাধরি করে কাকাবাবুকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল একটা বিছানায়।

প্রবীর ফিসফিস করে বলল, কারা যেন কাকাবাবুকে হাফলঙ পাহাড়ে হঠাৎ ঠেলে একটা খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। উনি যে বেঁচে গেছেন, সেটাই একটা চরম আশ্চর্য ব্যাপার। ওঁর নিশ্চয়ই কোথাও খুব চোট লেগেছে, তারপর সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছেন। কিন্তু সন্তুর জন্য এমনই চিন্তিত যে নিজের চিকিৎসার কথা একবারও ভাবেননি।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার। আজ রাতটা ভাল করে ঘুমোলেই অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবেন।

প্ৰবীর বলল, সে উনি ঘুমোবেন না। একটু বাদে জ্ঞান ফিরলেই আবার সন্তুর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবেন।

কাকাবাবুকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ওরা দুজনে চলে গেল সন্তুর দেখাশোনা করতে।

পরদিন সকালে চোখ মেলেই কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।

সে-ঘরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে প্রবীর।

কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, সন্তু কোথায়?

সন্তু কেমন আছে? প্রবীর বলল, সন্তু ভাল আছে। আপনার শরীর কেমন?

কাকাবাবু বললেন, আমি ঠিক আছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? কাল বিকেল থেকে? আমি এক্ষুনি সন্তুকে দেখতে চাই!

প্ৰবীর বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি আপনার জন্য একজোড়া ক্রাচ আনছি। ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে আপনার অসুবিধে হবে।

প্রবীর ক্রাচ আনতে গেল, তার মধ্যে কাকাবাবু খাট থেকে নেমে এসে দরজার কাছে এলেন। তাঁর জ্বরটা এখনও পুরো ছাড়েনি। ঠাণ্ডা লেগে মাথাটা ভারী হয়ে আছে, তবু শরীর সুস্থ মনে হচ্ছে অনেকটা।

প্রবীর ক্রাচ নিয়ে ফিরে এসে বলল, ভাল খবর আছে। এক্স-রে করে দেখা গেছে সন্তুর হাঁটুর মালাইচাকি মোটেই গুঁড়িয়ে যায়নি। ডক্টর ভার্গব ওটা কী করে বললেন, কে জানে! অত তাড়াতাড়ি তো এক্স-রে হয় না।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর পা তা হলে ঠিক হয়ে যাবে?

প্রবীর বলল, মালাইচাকি গুঁড়িয়ে যায়নি। তবে সরে গেছে। অপারেশান করতে হতে পারে। কিন্তু পা কেটে বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।

কাকাবাবু প্রবীরের কাঁধ ধরে বললেন, প্রবীর, আজ সকালে তুমি আমায় সত্যিকারের ভাল খবর শোনালে!

প্রবীর হেসে বলল, এর পর হয়তো আরও একটা ভাল খবর শুনবেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী? কী? প্ৰবীর বলল, আর-একটু অপেক্ষা করুন।

সন্তুর ক্যাবিনে এসে দেখলেন, বিছানায় আধ-শোওয়া হয়ে সন্তু টোস্ট আর ওমলেট খাচ্ছে। দুজন ডাক্তার বসে আছেন তার কাছে।

ডাক্তার বড়ঠাকুর ছাড়া অন্য ডাক্তারটির দিকে ইঙ্গিত করে প্রবীর বলল, কাকাবাবু, আপনাকে যে একজন হাড়ের ডাক্তারের কথা বলেছিলাম, ইনিই সেই ডাক্তার ইউসুফ। ইনি এক-এক সময় আশ্চর্য কাণ্ড করে ফেলেন।

ইউসুফ ডাক্তার মাঝবয়েসী, সাদা রঙের কোট পরা, মুখখানা ভালমানুষ ধরনের। তিনি কাকাবাবুর দিকে হেসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড কিছু না। হাড় যদি না ভাঙে, শুধু এদিক-ওদিক সরে যায়, তা হলে অনেক সময় অপারেশান ছাড়া ঠিক করে দেওয়া যায়। আমি সেই চেষ্টাই একবার করব। আগে ওর খাওয়া হয়ে যাক।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হয়ে গেছে। আর খাব না!

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, একটু ব্যথা লাগবে। সহ্য করতে পারবে তো? সন্তু দুবার মাথা নাড়ল।

সন্তুর যে-পায়ে চোট লেগেছে, সেই পায়ের প্যান্ট উরু পর্যন্ত কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। হাঁটুর কাছে অনেকটা ফোলা।

সন্তুর পা-টা লম্বা করে দিয়ে ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোতে লাগলেন।

সন্তু মাঝে-মাঝে ব্যথায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। দুরুদুরু করছে কাকাবাবুর বুকের ভেতর। তিনি ভাবছেন, উলটোপালটা কিছু করতে গিয়ে আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে কি না।

ডাক্তার বড়ঠাকুর ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে সবাইকে একেবারে চুপ করে থাকতে বললেন। ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোচ্ছেন, মাথাটা ঝুঁকে গেছে, বিড়বিড় করে নিজের মনে কী যেন বলছেন তিনি।

সবাই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কাকাবাবু চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছেন।!

হঠাৎ ইউসুফ ডাক্তার পা-টা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলেন। সন্তু বিকট চিৎকার করে উঠল। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে সে বলি দেওয়া ছাগলের মতন ছটফট করতে করতে বলতে লাগল, আঃ, আঃ, মরে গেলুম! মরে গেলুম।

কাকাবাবু আর্তভাবে বললেন, কী হল? ছেলেটাকে মেরে ফেললে? অ্যা, মেরে ফেললে?

ডাক্তার বড়ঠাকুর কাকাবাবুকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। রাগের চোটে কাকাবাবু রিভলভারটা খোঁজার জন্য পকেটে হাত দিলেন।

ইউসুফ ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, ঠিক হয়ে গেছে। আর অপারেশান করার দরকার হবে না।

সন্তুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কী হল? তুমি যে বললে ব্যথা পেলেও সহ্য করতে পারবে? খুব বেশি লেগেছে?

তারপর তিনি জোর করে সন্তুকে বিছানা থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন মেঝেতে।

সন্তুর চিৎকার থেমে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। সে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ২১০

বলল, দাঁড়াতে পারছি? অ্যাঁ? আমি আবার দাঁড়াতে পারছি?

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, শুধু দাঁড়ানো নয়, তুমি হাঁটবে। চলো, আমার সঙ্গে বাগানে। আর কোনও অসুবিধে হবে না। হাঁটুর ফোলাটা আস্তে-আস্তে কমে যাবে।

প্রবীর বলল, মিরা! মিরাল!

কাকাবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সত্যিই তো দেখছি মিরা। ডাক্তার ভার্গব বলেছিলেন, ওর পা কেটে বাদ দিতে হবে।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, কাকাবাবু, আপনি মাথার ঠিক রাখতে পারেননি! আর-একটু হলে আপনি ইউসুফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিলেন। তাই আপনাকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম।

কাকাবাবু লজ্জিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, আমার মাথার ঠিক ছিল না। জীবনে আমি অনেক বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এবারের মতন ভয় পাইনি কোনওবার। আমি খোঁড়া মানুষ, সন্তু আমার অন্ধের যষ্টি। আমি খোঁড়া, সন্তুও যদি সারাজীবনের মতন খোঁড়া হয়ে যেত…তা হলে…তা হলে…আমার দাদা বউদির কাছে মুখ দেখাতাম কী করে? তা হলে আমি আত্মহত্যা করতাম।

তারপর তিনি ইউসুফ ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনি যে আমার কতখানি উপকার করলেন, তা আমি বোঝাতে পারব না। কী করে যে আপনার ঋণ শোধ করব, তা জানি না।

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, না, না, আমি আর বেশি কী করেছি? খানিকটা ভাগ্যের ব্যাপার আছে। মালাইচাকিটা ভাঙেনি! ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আমি কিছু করতে পারতাম না।

প্ৰবীর বলল, কাকাবাবু, আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না? ভাগ্যিস ব্রিজের ওপর আমার মোটর বাইকটা আপনাদের গাড়ির পাশাপাশি এল, তাই আপনাদের আমি দেখতে পেলাম। না হলে, ডাক্তার ভার্গবের ওখানে আপনাদের কতদিন পড়ে থাকতে হত তার ঠিক নেই।

কাকাবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে ওরকমভাবে দেখা হয়ে যাওয়াটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। একেই বলে বোধ হয় নিয়তি। তোমাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা শুধু সন্তুকে বাঁচাওনি,আমাকেওবাঁচিয়েছ!

প্ৰবীর বলল, তা হলে আজ খুব ভাল করে খাওয়াদাওয়া হোক। এবার আপনাদের খুব জোর একটা ফাঁড়া কেটে গেল।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া হোক। খরচ কিন্তু আমি দেব।

তারপর তিনি একটু লাজুকভাবে হেসে বললেন, আমাকে এখন কিছু খেতে দিতে পারো? হঠাৎ টের পাচ্ছি, খুব খিদে পেয়েছে। পরশু রাত্তির থেকে তো কিছু খাইনি।

কাকাবাবু, আপনাকে যে একজন হাড়ের ডাক্তারের কথা বলেছিলাম, ইনিই সেই ডাক্তার ইউসুফ। ইনি এক-এক সময় আশ্চর্য কাণ্ড করে ফেলেন।

ইউসুফ ডাক্তার মাঝবয়েসী, সাদা রঙের কোট পরা, মুখখানা ভালমানুষ ধরনের। তিনি কাকাবাবুর দিকে হেসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড কিছু না। হাড় যদি না ভাঙে, শুধু এদিক-ওদিক সরে যায়, তা হলে অনেক সময় অপারেশান ছাড়া ঠিক করে দেওয়া যায়। আমি সেই চেষ্টাই একবার করব। আগে ওর খাওয়া হয়ে যাক।

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হয়ে গেছে। আর খাব না?

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, একটু ব্যথা লাগবে। সহ্য করতে পারবে তো? সন্তু দুবার মাথা নাড়ল।

সন্তুর যে-পায়ে চোট লেগেছে, সেই পায়ের প্যান্ট ঊরু পর্যন্ত কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। হাঁটুর কাছে অনেকটা ফোলা।

সন্তুর পা-টা লম্বা করে দিয়ে ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোতে লাগলেন।

সন্তু মাঝে-মাঝে ব্যথায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। দুরুদুরু করছে কাকাবাবুর বুকের ভেতর। তিনি ভাবছেন, উলটোপালটা কিছু করতে গিয়ে আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে কি না।

ডাক্তার বড়ঠাকুর ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে সবাইকে একেবারে চুপ করে থাকতে বললেন। ইউসুফ ডাক্তার হাত বুলোচ্ছেন, মাথাটা ঝুঁকে গেছে, বিড়বিড় করে নিজের মনে কী যেন বলছেন তিনি।

সবাই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কাকাবাবু চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছেন না!

হঠাৎ ইউসুফ ডাক্তার পা-টা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলেন। সন্তু বিকট চিৎকার করে উঠল। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে সে বলি দেওয়া ছাগলের মতন ছটফট করতে করতে বলতে লাগল, আঃ, আঃ, মরে গেলুম! মরে গেলুম!

কাকাবাবু আর্তভাবে বললেন, কী হল? ছেলেটাকে মেরে ফেললে? অ্যা, মেরে ফেললে?

ডাক্তার বড়ঠাকুর কাকাবাবুকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। রাগের চোটে কাকাবাবু রিভলভারটা খোঁজার জন্য পকেটে হাত দিলেন।

ইউসুফ ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, ঠিক হয়ে গেছে। আর অপারেশান করার দরকার হবে না।

সন্তুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কী হল? তুমি যে বললে ব্যথা পেলেও সহ্য করতে পারবে? খুব বেশি লেগেছে?

তারপর তিনি জোর করে সন্তুকে বিছানা থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন মেঝেতে।

সন্তুর চিৎকার থেমে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। সে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ২১০

বলল, দাঁড়াতে পারছি? অ্যাঁ? আমি আবার দাঁড়াতে পারছি?

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, শুধু দাঁড়ানো নয়, তুমি হাঁটবে। চলো, আমার সঙ্গে বাগানে। আর কোনও অসুবিধে হবে না। হাঁটুর ফোলাটা আস্তে-আস্তে কমে যাবে।

প্ৰবীর বলল, মিরা! মিরা!

কাকাবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সত্যিই তো দেখছি মিরা। ডাক্তার ভার্গব বলেছিলেন, ওর পা কেটে বাদ দিতে হবে।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, কাকাবাবু, আপনি মাথার ঠিক রাখতে পারেননি! আর-একটু হলে আপনি ইউসুফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিলেন। তাই আপনাকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম।

কাকাবাবু লজ্জিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, আমার মাথার ঠিক ছিল না। জীবনে আমি অনেক বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এবারের মতন ভয় পাইনি কোনওবার। আমি খোঁড়া মানুষ, সন্তু আমার অন্ধের যষ্টি। আমি খোঁড়া, সন্তুও যদি সারাজীবনের মতন খোঁড়া হয়ে যেত..তা হলে…তা হলে…আমার দাদা-বউদির কাছে মুখ দেখাতাম কী করে? তা হলে আমি আত্মহত্যা করতাম।

তারপর তিনি ইউসুফ ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনি যে আমার কতখানি উপকার করলেন, তা আমি বোঝাতে পারব না। কী করে যে আপনার ঋণ শোধ করব, তা জানি না!

ইউসুফ ডাক্তার বললেন, না, না, আমি আর বেশি কী করেছি? খানিকটা ভাগ্যের ব্যাপার আছে। মালাইচাকিটা ভাঙেনি! ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আমি কিছু করতে পারতাম না।

প্ৰবীর বলল, কাকাবাবু, আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না? ভাগ্যিস ব্রিজের ওপর আমার মোটর বাইকটা আপনাদের গাড়ির পাশাপাশি এল, তাই আপনাদের আমি দেখতে পেলাম। না হলে, ডাক্তার ভার্গবের ওখানে আপনাদের কতদিন পড়ে থাকতে হত তার ঠিক নেই।

কাকাবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে ওরকমভাবে দেখা হয়ে যাওয়াটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। একেই বলে বোধ হয় নিয়তি। তোমাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা শুধু সন্তুকে বাঁচাওনি,আমাকেও বাঁচিয়েছ!

প্ৰবীর বলল, তা হলে আজ খুব ভাল করে খাওয়াদাওয়া হোক! এবার আপনাদের খুব জোর একটা ফাঁড়া কেটে গেল।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া হোক। খরচ কিন্তু আমি দেব।

তারপর তিনি একটু লাজুকভাবে হেসে বললেন, আমাকে এখন কিছু খেতে দিতে পারো? হঠাৎ টের পাচ্ছি, খুব খিদে পেয়েছে। পরশু রাত্তির থেকে তো কিছু খাইনি।

ডাক্তার বড়ঠাকুর বললেন, অ্যাঁ? পরশু থেকে কিছু খাননি? কাল আপনাকে কিছু খেতে দেওয়ার কথা আমাদের মনেই পড়েনি।

কাকাবাবু বললেন, পরশু তো ওরা নেমন্তন্ন খাওয়াবে বলে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু খাওয়াবার বদলে দিল ধাক্কা?

ডাক্তার বড়ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কারা? আপনাদের খুন করে ওদের লাভ কী হত?

কাকাবাবু মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তা এখনও জানি না। তবে জানতে পারব ঠিকই। যাদের জন্য সন্তু খোঁড়া হয়ে যাচ্ছিল আর-একটু হলে, তাদের সবকটাকে আমি খোঁড়া করে ছাড়ব।
পরদিনই কাকাবাবু কলকাতার প্লেনের টিকিট কাটলেন। সন্তু একবার জিজ্ঞেস করল, আমরা হাফলঙ ফিরে যাব না?

কাকাবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, না। কলকাতায় গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর কী করব ভেবে দেখা যাবে।

শিলচর বিমানবন্দরটি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। ডাক্তার বড়ঠাকুর আর প্রবীর গাড়ি করে পৌঁছে দিতে এল। প্রবীর অনেকবার অনুরোধ করেছিল, তাদের চা-বাগানে কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য। কাকাবাবু রাজি হননি।

প্লেনটা ঠিক সময়েই এসেছে। দুই ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু আর সন্তু এগিয়ে গেল সিকিউরিটির দিকে। সন্তু এখন মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছে, শুধু তার একটা কানে খুব ব্যথা। কানেও যে চোট লেগেছিল, সেটা পায়ের ব্যথার সময় তেমন টেরই পায়নি।

প্লেন ছাড়ার পর কাকাবাবু একটা খবরের কাগজ চেয়ে নিলেন। বেশ কয়েকদিন খবরের কাগজের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না।

সন্তু বসেছে জানলার ধারে। আজ আকাশ মেঘলা, কিছুই দেখার নেই, তবু সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। বাংলা কাগজ শেষ করে তিনি একটা ইংরেজি কাগজ চাইলেন। তাড়াতাড়ি পাতা উলটে-উলটে কোনও একটা খবর খুঁজতে লাগলেন, সেই খবরটা পড়ে তিনিই সামনের সিটের ভদ্রলোকের কাছ থেকে আর-একটা ইংরেজি কাগজ চেয়ে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ রেখে চুপ করে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।

সন্তু একবার একটা কাগজ নিয়ে খেলার খবরগুলো দেখে নিল ভাল করে। অন্য কোনও খবর পড়তে তার ইচ্ছে হল না।

এক ঘন্টার মধ্যে প্লেন পৌঁছে গেল দমদম।

বাইরে বেরিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, একটা ট্যাক্সি ধরে দিলে তুই বাড়ি চলে যেতে পারবি তো?

সন্তু চমকে গিয়ে বলল, আমি একা যাব! তুমি যাবে না?

কাকাবাবু বললেন, না। আমার একটা কাজ আছে।

সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, এয়ারপোর্টে কাজ আছে?

কাকাবাবু একটু আমতা-আমতা করে বললেন, না, ঠিক এয়ারপোর্টে কাজ নেই। আমাকে আজই ভুবনেশ্বর যেতে হবে।

সন্তু আরও অবাক হয়ে বলল, ভুবনেশ্বর? কেন?

কাকাবাবু এবার খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন, তোকে সব কথা বলতে হবে নাকি? ভুবনেশ্বরে যাব, আমার ইচ্ছে হয়েছে।

সন্তু বলল, তা হলে আমি যাব না কেন? আমরা তো হাফলঙে আট-দশদিন থাকব, বলে এসেছিলাম বাড়িতে। মোটে তিন-চারদিন পরেই ফিরে এলাম। এখনও অন্য জায়গায় ঘুরে আসতে পারি।

কাক বাবু বললেন, তোর শরীর ভাল নয়। তোকে এখন কয়েকদিন শুয়ে থাকতে হবে।

সন্তু বলল, তোমারও তো শরীর খারাপ। আমি বেশ ভাল আছি। তুমি ভুবনেশ্বর গেলে আমি যাবই!

কাকাবাবু চোখ গরম করে বললেন, দ্যাখ সন্তু, তোকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। এবার থেকে আমার সঙ্গে তোকে আর কোথাও নিয়ে যাব না ঠিক। করেছি।

সন্তু কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞেস করল, কেন? আমি কিছু দোষ করেছি?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই দোষ করেছিস। তোকে আর কোনওদিন আমার সঙ্গে নেব না!

কাকাবাবুর রাগ থেকেও সন্তু ঠিক ভয় পেল না। হাতের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সে বলল, আমি একা কিছুতেই বাড়ি যাব না। আমি এখানেই থাকব।

কাকাবাবু সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

এয়ারপোর্ট থেকে অনবরত লোকজন বেরোচ্ছে আর ঢুকছে। বাইরে বেশ রোদ। গরম। এখানে আকাশে মেঘ নেই, অথচ শিলচরের আকাশে ছিল জমাট মেঘ। বাতাসও বেশ ঠাণ্ডা ছিল।

কাকাবাবু একটা ফাঁকা জায়গার দিকে সরে গেলেন। সন্তুও কাছে এসে দাঁড়াল।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোকে আমি সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু তার আগে তোকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তুই ইচ্ছে করে খাদে লাফ দিয়েছিলি কেন? পাগল ছাড়া এরকম কেউ করে?

সন্তু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে আবার বললেন, ওরকম আর কখনও করবি না। এবারে আমরা দুজনেই অদ্ভুতভাবে বেঁচে গেছি। আমাকে আচমকা ঠেলে দিয়েছিল। তোকে তো না ফেলে দিতেও পারত। হয়তো দু-একদিন ধরে রেখে দিয়ে পরে ছেড়ে দিত। সব সময় বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয়। আমাকে যদি মেরেও ফেলে, তবু তুই পালিয়ে গিয়ে কিংবা যে-কোনও উপায়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবি। না বাঁচলে তো কিছুই করা যায় না। বেঁচে থাকলে তবু আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারবি। বদমাশ লোকগুলোকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারবি! আমার বয়েস হয়েছে, আমি এখন মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তোকে বেঁচে থাকতেই হবে।

সন্তু চুপ করে আছে দেখে কাকাবাবু বললেন, কী, মনে থাকবে তো? আর কোনওদিন ইচ্ছে করে ঝাঁপ দিবি না!

সন্তু দু দিকে মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নাছছাড়বান্দা ছেলে, চল তা হলে। কিন্তু কেন এখন ভুবনেশ্বর যাচ্ছি তা জিজ্ঞেস করা চলবে না।

এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে চেনেন কাকাবাবু। তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই দুটো টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। দু ঘন্টা বাদেই ভুবনেশ্বরের প্লেন।

ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করলেন কাকাবাবু। শহরের দিকে গেলেন না। গাড়ি ছুটল বেরহামপুরের দিকে।

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল সন্তু। এবার সে আপন মনে বলল, বুঝেছি!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝেছিস।

সন্তু বলল, ভূবনেশ্বরে তোমার কোনও কাজ নেই। আমাদের গোপালপুর-অন-সি যাওয়ার কথা ছিল, তুমি সেখানেই যাচ্ছ।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক ধরেছিস তো! আসলে এবারে সমুদ্রের ধারে গিয়ে কটা দিন কাটাব ঠিক করেছিলাম, হঠাৎ চলে যেতে হল পাহাড়ে। সমুদ্র মনটাকে টানছে। তাই ভাবলাম, যাই একবার, সমুদ্র-দর্শন করে আসি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভুবনেশ্বর থেকে পুরী অনেক কাছে। সেখানে গেলে না কেন?

কাকাবাবু বললেন, পুরীতে বড় ভিড় হয়। গোপালপুরে আমরা একটা বাংলো বুক করেছিলাম মনে আছে? তাড়াহুড়োতে সেটা ক্যানসেল করানো হয়নি। সেখানে গেলে বোধ হয় জায়গা পাওয়া যাবে। শোন, সেখানে গিয়ে শুধু খাবি আর শুয়ে থাকবি। সম্পূর্ণ বিশ্রাম।

সন্তু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, আর তুমি?

কাকাবাবু বললেন, আমিও বিশ্রাম নিতেই যাচ্ছি। কেউ তো আমাদের ওখানে যেতে বলেনি, কেউ কোনও কাজের ভারও দেয়নি। শুধু সমুদ্র দেখব আর শুয়ে-শুয়ে বই পড়ব!

ওরা গোপালপুরে পৌঁছে গেল সন্ধের ঠিক একটু আগে।

এখানে কয়েকটা হোটেল আছে। কিছু-কিছু ফাঁকা বাড়িও রয়েছে, লোকেরা সেই বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য থেকে যায়।

কাকাবাবু গাড়িটা থামালেন একটা বাংলোর সামনে। এটা সরকারি বাংলো, কাকাবাবুর নামে এখনও রিজার্ভেশান রয়েছে, জায়গা পেতে কোনও অসুবিধে হবে না।

জিনিসপত্র নামাবার পর পেছনদিকের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সন্তুর বুকটা ধক করে উঠল। সকালবেলায় ছিল পাহাড় অঞ্চলে। এখন সামনে বিশাল সমুদ্র। লাল রঙের সূর্য আধখানা ড়ুবেছে জলে, সামনে লাল রঙের ঢেউ, আকাশে কতরকম ছবি।

অনেকদিন সমুদ্র দ্যাখেনি সন্তু। তার এত ভাল লাগছে যে, সে যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।

সন্তু সেইভাবে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট। একটু বাদে কাকাবাবু এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন।

দুজনেই একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রের দিগন্তে সূর্যাস্ত, দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়, তাই না রে? কোনও পাহাড়ের ওপরে উঠে দাঁড়ালেও দেখা যায় কতখানি নীল আকাশ, আর চোখ যতদূর যায় শুধু সবুজ। কী চমৎকার আমাদের এই পৃথিবী। তবু মানুষ এখানে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে পারে না। লোভ করে, হিংসে করে, খুনোখুনি করে!

সন্তু চুপ করে রইল। কাকাবাবু আপনমনে আবৃত্তি করলেন :

কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে
প্রচেতঃ! হা ধিক্ ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায়, এই কি হে তোমার ভূষণ
রত্নাকর?

হঠাৎ থেমে গিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার লেখা বল তো?

সন্তু টপ করে বলে দিল, মাইকেল মধুসূদন। মেঘনাদবধ কাব্য!

কাকাবাবু হেসে বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আর পরবার উপায় নেই। তারা এত কিছু জানে! আমাদের সময়কার ছাত্রছাত্রীরা এত সহজে বলতে পারত না। তোদর বুঝি মেঘনাদবধ পাঠ্য ছিল?

সন্তু বলল, না। আমি এমনিই পড়েছি। অনেক শক্ত-শক্ত কথা আছে, তবু পড়তে বেশ ভাল লাগে। রত্নাকর মানে যে সমুদ্র, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু প্রচেতঃ মানেও যে সমুদ্র, সেটা আমাকে ডিকশনারি দেখে জানতে হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, সমুদ্র নয়, বরুণ দেবতা। কথাটা আসলে প্রচেতস কিংবা প্রচেতা, তাই না?

সন্তু বলল, অত আমি জানি না।

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, সূর্য ড়ুবে গেল। শোন, আমরা এখন বেরুব। এখানকার ম্যানেজার বলল, বাংলোতে আর কোনও লোক নেই। আজ রাত্তিরে ওরা খাবার দিতে পারবে না। বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে। কাল থেকে এখানেই সব পাওয়া যাবে।

সন্তু বলল, এক্ষুনি খেতে যাব?

কাকাবাবু বললেন, সারাদিনে দুবার প্লেন পালটাতে হয়েছে। তারপর গাড়িতে এতখানি রাস্তা। অনেক ধকল গেছে। আজ বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। দুপুরে তো ভাল করে খাওয়া হয়নি।

জামা-প্যান্ট না বদলেই বেরিয়ে পড়ল সন্তু।

রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ওরা দুজনে হাঁটতে লাগল জলের ধার দিয়ে। সন্তু জুতো খুলে ফেলে প্যান্ট গুটিয়ে পা ভেজাতে লাগল। নরম বালিতে ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে কাকাবাবুর একটু অসুবিধে হয়, কাকাবাবু তাই একটু দূরে রয়েছেন। সূর্য ড়ুবে গেলেও বিশেষ অন্ধকার হয়নি। এরই মধ্যে জ্যোৎস্না হয়েছে খানিকটা। ঢেউগুলো অবিরাম এসে ভেঙে পড়ছে তীরে।

মাঝে-মাঝে দু-একটা জেলে-নৌকো টেনে তোলা আছে পারের ওপর। ভোরবেলা জেলেরা এইসব নৌকো ভাসিয়ে মাছ ধরতে যায়। সন্তু একটা নৌকোয় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে টের পেল, তার সেই হাঁটুতে এখনও খানিকটা ব্যথা আছে।

একটা ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনে সন্তু জলের দিকে তাকাল। বড় বড় ঢেউগুলো যেখানে ভাঙছে, তার থেকেও খানিকটা দূরে একটা স্পিড বোট যাচ্ছে মনে হল। সন্তু থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সেটাকে।

ঢেউয়ের ওপর লাফাতেলাফাতে স্পিড বোটটা যেন এদিকেই আসছে।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্পিড বোটটা তীরের কাছে এসে থামল। সেখানে প্রায় একহাঁটু জল। বোট থেকে একজন লোক নেমে জল ঠেলে এগোতে লাগল, বোটটা আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সমুদ্রে।

প্যান্ট-কোট পরা লোকটির মুখভর্তি দাড়ি। এক হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলো ফেলে তিনি চারপাশটা দেখলেন। সন্তু দাঁড়িয়ে আছে একটা নৌকোয় হেলান দিয়ে, তার মুখে আলো পড়ল।

তার আগেই সন্তু সেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে। হাফলঙের ডাকবাংলোর সেই জজসাহেব!

দুজনেই দুজনকে দেখে খুব অবাক হয়েছে।

বিচারকই প্রথম বললেন, আরে, তুমি এখানে? কী আশ্চর্য? কী আশ্চর্য!

দূর থেকে গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু ডাকলেন, সন্তু? সন্তু?

এবার বিচারক আর সন্তু দুজনেই এগিয়ে গেল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু কিছু বলার আগেই বিচারক উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, এ তো দারুণ আনন্দের ব্যাপার। আপনার ভাইপোর পা ঠিক হয়ে গেছে? আপনাদের এখানে দেখতে পাব, ভাবতেই পারিনি! হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হঠাৎ এখানে?

বিচারক বললেন, আমার তো কিছুই করার নেই। ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। আপনার মুখে সেদিন গোপালপুর-অন-সির নাম শুনলাম। তাই ভাবলাম, সে-জায়গাটা কখনও দেখিনি, যাই ঘুরে আসি। আপনারাও যে এখানে আসবেন, তা কল্পনাও করিনি। আগে জানলে একসঙ্গে আসা যেত!

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর পা সেরে গেল। তাই আমরা এখানে এসেছি বিশ্রাম নিতে।

বিচারক বললেন, ভাল, ভাল, খুব ভাল! আছেন তো কয়েকদিন। দেখা হবে। এখন যাই হোটেলে। একটা স্পিড বোটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। জলের ছিটে লেগে জামা-টামা সব ভিজে গেছে। এক্ষুনি পালটাতে হবে। বুড়ো হয়েছি তো। ঠাণ্ডা লেগে গেলেই মুশকিল।

বিচারক কাকাবাবুর সঙ্গে করমর্দন করলেন। সন্তুর পিঠ একবার চাপড়ে দিয়ে বললেন, ব্রেভ ইয়াংম্যান! পরে দেখা হবে, চলি!

টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে তিনি চলে গেলেন রাস্তার দিকে।

কাকাবাবু বললেন, রিটায়ার্ড জজ। সময় কাটে না। তাই নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ভদ্রলোকের বউ, ছেলেমেয়ে কেউ নেই!

সন্তু বলল, হাফলঙে উনি বাংলো ছেড়ে একটুও বেরুতেন না। সবসময় বারান্দায় বসে থাকতেন। আর এখানে এসেই স্পিড বোটে চেপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বেশ সাহস আছে!

কাকাবাবু বললেন, কেউ-কেউ পাহাড়ে ভয় পায়, কিন্তু জল ভালবাসে। আবার এর উলটোটাও আছে। পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে তোর কোনটা বেশি ভাল লাগে রে সন্তু?

সন্তু বলল, দুটোই!

কাছাকাছি একটা হোটেলে খাওয়ার জন্য ঢুকে পড়ল দুজনে। বর্ষাকাল বলেই বোধ হয় টুরিস্ট বেশি নেই। সমুদ্রের ধারও ফাঁকা। হোটেলেও ভিড় দেখা গেল না।

মাংস নেই, শুধু দু-তিন রকমের মাছ। এখানে মাছ শস্তা। বেশ ভাল চিংড়িমাছ ভাজা, ডাল আর অন্য একটা মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া হয়ে গেল।

মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। হোটেল থেকে বেরিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমার কিন্তু এর মধ্যেই খুব ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। চল, আজ রাতটা ভাল করে ঘুমোব।

সন্তু বলল, আমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম পাবে না। আমি বেশি রাত্তিরে আর-একবার সমুদ্রের ধারে যাব। ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।

কাকাবাবু বললেন, থাকব তো কয়েকদিন। কাল রাত্তিরে যাস!

এবার আর হেঁটে ফেরা নয়। একটা সাইকেল রিকশা নেওয়া হল। বাতাসে মাছ-মাছ গন্ধ। হাফলঙের হাওয়া আর এখানকার হাওয়ায় কত তফাত। জাটিংগাতে ঠিক এই সময় ফাঁকা জায়গাটায় মশালের সামনে আকাশ থেকে ধুপ-ধুপ করে কয়েকটা পাখি পড়েছিল।

উলটো দিক থেকে আর একটি সাইকেল রিকশা আসছে। তাতে বসে আছেন একজন লোক। মাথায় বড় বড় চুল, কাঁধে একটা ঝোলা। পায়ের কাছে একটা সুটকেস।

রিকশাটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সন্তু একঝলক রিকশার যাত্রীটির মুখ দেখতে পেল। দারুণ চমকে সে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। সেই সাপুড়ে যুবক, পীতাম্বর পাহাড়ী!

সে সন্তুদের দেখতে পায়নি, রিকশাটা পেরিয়ে চলে গেল। কাকাবাবু ঠিক লক্ষ করেছেন। তিনি খানিকটা মজার ভঙ্গিতে বললেন, কী ব্যাপার, পাহাড় থেকে লোকেরা সমুদ্রের ধারে চলে আসছে? হাফলঙের দুজনকে দেখা গেল এরই মধ্যে!

বিচারককে দেখার চেয়েও পীতাম্বর পাহাড়ীকে দেখে সন্তু খুব বেশি অবাক হয়ে গেছে। রিটায়ার্ড জজের হাতে কোনও কাজ নেই, অনেক পয়সা-কড়ি আছে, তিনি যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারেন। কিন্তু যে-লোকটা জীবিকার জন্য বনে-জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়ায়, সে কেন হঠাৎ এই সমুদ্রের ধারে আসবে?

কাকাবাবু বললেন, এই পীতাম্বর, মানে অম্বর, খাদের তলা থেকে তোকে আর আমাকে উদ্ধার করেছে। অনেক সাহায্য করেছে। ওর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, ও সেই সাতসকালে খাদের অত নীচে গেল কেন? শুধু সাপ ধরার জন্য? নাকি ও জানত যে, আমাদের ওখানে পাওয়া যাবে?

সন্তু চমকে বলল, অ্যাঁ?

কাকাবাবু বললেন, সাপটাপ খুব একটা খুঁজছিল বলে তো মনে হয় না। বন-জঙ্গল ভেদ করে সোজা যেন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল।

সন্তু বলল, ও জানত যে, আমাদের কোথায় ফেলে দেওয়া হবে? কী করে জানবে? কুমার সিং-দের সঙ্গে তো ওর ভাব ছিল না। কুমার সিং প্রথম থেকেই ওকে পছন্দ করেনি।

কাকাবাবু বললেন, সেটা অভিনয় হতে পারে। আমাদের সামনে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে, ওরা দুজনে দুজনকে সহ্য করতে পারছে না।

সন্তু বলল, ও যদি কুমার সিং-দের দলেরই লোক হবে, তা হলে আবার আমাদের উদ্ধার করতে গেল কেন?

কাকাবাবু বললেন, সেটা একটা শক্ত প্রশ্ন বটে। এর উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে। ওর সাপ ধরার কথাটা সত্যি কি না, সেটাও জানা দরকার। খুব ভাল ট্রেইনিং না থাকলে এমনি-এমনি জঙ্গলে গিয়ে বিষাক্ত সাপ ধরা চাট্টিখানি কথা নাকি?

সন্তু বলল, ও জোঁকের ভয়ে জঙ্গলে ঘোরার সময় পকেটে নুন রাখে। কিন্তু কুমার সিং আর ভুবন দাসরা তো সেরকম কিছু বলল না। ওরা জোঁকের কথা জানেই না মনে হল। কিংবা যারা জঙ্গলে রোজ ঘোরে, তারা বোধ হয় জোঁকের ভয় পায় না।

কাকাবাবু বললেন, ওই জঙ্গলে জোঁক আছে এটা ঠিক। নুন দিয়ে খুব সহজে জোঁক মারা যায় এটাও ঠিক। অম্বর বলেছিল, ওখানকার জঙ্গলে বড়বড় বাঘ নেই, লেপার্ড আছে আর ভাল্লুক আছে। কুমার সিংরা বলল, ওখানে লেপার্ড নেই, ভাল্লুক একেবারেই নেই। বড় বড় বাঘ আর গতি আছে। তা বলে কারা ঠিক কথা বলছে?

সন্তু বলল, অম্বরের ভাল্লুকের গল্পটা বানানো মনে হয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, কুমার সিং-এর জঙ্গলের মধ্যে লরিতে শুয়ে থাকা আর বাঘ এসে পড়ার গল্পটা তোর বানানো মনে হয়নি? ওদের বিশেষ অভিজ্ঞতা

আছে বলে তো মনে হয় না!

সন্তু বলল, আমার মাথায় যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে! তা হলে ওরা সবাই কি সত্যিই এক দলের?

কাকাবাবু জোরে হেসে উঠে বললেন, তোকে আর এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আজ রাত্তিরে টেনে এক ঘুম দে।

সাইকেল রিকশাটা থামল বাংলোর সামনে।

ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল পুরোদস্তুর পোশাক পরা দুজন পুলিশ বসে আছে সেখানে।

কাকাবাবুকে দেখেই একজন উঠে দাঁড়াল। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, আপনিই মিঃ রাজা রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।

পুলিশ জিজ্ঞেস করল, আপনার নামে এই বাংলোর ঘর পাঁচদিন আগে বুক করা ছিল? আপনি তখন আসেননি কেন?

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কিছু একটা অসুবিধে ছিল। তাই আসিনি। কেন, না-আসাটা অপরাধ নাকি?

পুলিশটি সেকথার উত্তর না দিয়ে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটি কি আপনার ভাই?

সন্তুর চেহারা এখন বেশ বড়সড় হয়েছে। কাকাবাবুর শরীরে এখনও বয়েসের ছাপ পড়েনি। তাঁর চওড়া বুক ও হাতের মাল্ল দেখলেই বোঝা যায়। তিনি একজন বেশ শক্তিশালী পুরুষ। অনেকেই আজকাল সন্তুকে তাঁর ভাইপো ভাবে না, মনে করে ওরা দুই ভাই।

অন্য পুলিশটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের দুজনকে একবার থানায় যেতে হবে। এস. পি. সাহেব একবার আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

কাকাবাবু বললেন, থানায়? তা যেতে পারি। আমি যাব। এই ছেলেটি আমার ভাইপো। ওর শরীর ভাল নয়, ও যাবে না। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমিও যাব। একজন পুলিশ বলল, আপনারা দুজনেই গেলে ভাল হয়।

কাকাবাবু জোর দিয়ে বললেন, না, ও যাবে না। আপনারা কি আমাদের অ্যারেস্ট করতে এসেছেন নাকি? ওয়ারেন্ট আছে?

অন্য পুলিশটি বলল, না, না, সেরকম কিছু নয়। ঠিক আছে, আপনি একলাই চলুন।

কাকাবাবু বললেন, আমি নিজেও যেতে রাজি হতে না পারতাম। আপনাদের বলতাম, আপনাদের এস. পি.-কে এখানে ডেকে আনতে। তিনি কী জানতে চান, এখানে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু সেটা বলছি না, কারণ আমি নিজেই একবার থানায় যেতাম। কাল সকালে আমার কয়েকটা খবর নেওয়ার আছে।

তারপর তিনি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ঘরে যা, সন্তু। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসছি।
ঠিক এক ঘন্টা বাদেই ফিরে এলেন কাকাবাবু।

সন্তু ইজিচেয়ারে শুয়ে একটা বই পড়ছে। দরজাটা ভেজানো। দরজার বাইরে শোনা গেল তিন-চারজন লোকের গলার আওয়াজ। তারা খাতির করা সুরে বলছে, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না, সার। আমাদের একজন লোক সব সময় এখানে থাকবে। আপনার জন্য গাড়ি রেডি থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার কিছু লাগবে না এখন। গুড নাইট।

সন্তু প্রথমে পুলিশ দেখে একটু চমকে উঠেছিল। পরে সে কাকাবাবুর সঙ্গে থানায় যেতে চেয়েছিল এই মজাটাই দেখার জন্য। যে পুলিশ দুজন এসেছিল, তারা কাকাবাবুকে চেনে না। কিন্তু থানায় গেলে এস. পি. কিংবা বড় অফিসাররা কাকাবাবুর পরিচয় পেলেই তাঁদের ব্যবহার বদলে ফেলবেন।

কাকাবাবু ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি বন্ধ করে দিতেই সন্তু বলল, আমি দুটো জিনিস জেনে গেছি।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? তুই কী কী জেনেছিস শুনি?

সন্তু বলল, আমরা গোপালপুরে না এসে আসামের হাফলঙে চলে গিয়েছিলাম। পার্কে একটা লোক তোমাকে পাখির রহস্যের কথা বলে তোমার মন ভুলিয়ে দিয়েছিল। আসলে লোকটির মতলব ছিল তোমাকে এই সময় গোপালপুরে আসতে না দেওয়া।

কাকাবাবু বললেন, এটা ঠিক ধরেছিস। আমি যে পাখি ভালবাসি, তাও খবর রেখেছে লোকটা। অন্য কোনও রহস্যের কথা বললে কিংবা আমাকে কোনও তদন্তের ভার দিতে চাইলে আমি কিছুতেই যেতে চাইতাম না। জাটিংগার পাখিদের কথা বলল, আরও বলল, পরের দিনই একটা গাড়ি যাচ্ছে, আসামে, তাই চলে গেলাম।

সন্তু বলল, ঠিক সেই সময় আমাদের এই বাংলোর পাশের ঘরে আর একজন ভদ্রলোক থাকতেন। সেই ভদ্রলোককে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। যারা এই কাজটা করেছে তারা তোমাকে ভয় পায়। তুমি এখানে উপস্থিত থাকলে তারা সেই ভদ্রলোককে চুরি করতে পারত না, সেই জন্য তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কাকাবাবু বললেন, তুই এটা জানলি কী করে? আগেরটা তবু আন্দাজ করা যায়।

সন্তু বলল, এই বাংলোর একজন বেয়ারা আমাদের ঘরে এসেছিল জল দিতে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ল। সেই বলল, আমাদের পাশের ঘর থেকে একজন লোক রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। তখনই আমি দুই আর দুইয়ে চার করে নিলাম। লোকটি যেদিন নিরুদ্দেশ হল সেইদিন আমাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসামে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। শুধু তাই নয়, আসামে আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের পাশের ঘরে কে ছিল জানিস? রঘুবীর পদ্মনাভন! বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। ব্যাঙ্গালোরে এক সময় আমরা পাশাপাশি থাকতাম। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সেই পদ্মনাভনকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে ওর সব জিনিসপত্র পড়ে আছে, এমনকী টেবিলের ওপর ওর ডায়েরির খাতাটাও খোলা, কিন্তু সে নেই। খবরের কাগজে দু-তিনদিন ধরে এসব খবর বেরুচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছু জানতে পারিনি। শিলচর থেকে প্লেনে আসবার সময় কাগজ পড়েই আমি বুঝতে পারলাম, কেন আসামে টেনে নিয়ে খাদের মধ্যে আমাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমি আর পদ্মনাভন একই সময় পাশাপাশি ঘরে থাকলে দুজনে আড্ডা দিতাম। তা হলে কি আর কেউ তাকে ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারত?

সন্তু বলল, কিন্তু একজন বৈজ্ঞানিককে চুরি করে নিয়ে গিয়ে কার কী লাভ হবে?

কাকাবাবু বললেন, অনেকের অনেকরকম মতলব থাকতে পারে। পদ্মনাভন খুব নামকরা বৈজ্ঞানিক, প্রতিভাবান। কিন্তু খানিকটা উদ্ধত আর অহঙ্কারী ধরনের। কড়া কড়া কথা বলে। দুঃসাহসী। এই ধরনের মানুষের শত্রু থাকা স্বাভাবিক।

সন্তু বলল, যারা এই কাণ্ডটা করেছে, বোঝাই যাচ্ছে, তারা বেশ একটা বড় দল। তা হলে নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এরা কি বিদেশি স্পাই?

কাকাবাবু বললেন, সেব্যাপারটা এখনও ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। রাত্তিরবেলা দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ করে শুতে হবে, সন্তু। আমাদের ওপর আবার আক্রমণ হতে পারে। যদিও পুলিশ নজর রাখছে বাড়িটার ওপর, তা হলেও নিজেদের সাবধান থাকা দরকার। পদ্মনাভন উধাও হওয়ার পর পুলিশ আর কারুকে এখানে থাকতে দিচ্ছে না এখন। আমাদের আগে থেকে রিজার্ভেশান ছিল বলে ঢুকে পড়েছি।

সন্তু বলল, পুলিশ তাই প্রথমে আমাদের সন্দেহ করেছিল।

কাকাবাবু বললেন, পুলিশের বড় বড় কর্তারা সব এখন এখানে এসেছে। ডি. আই. জি. পট্টনায়ক আমাকে খুব ভাল চেনে। সন্তু, তুই কিন্তু একা-একা একদম বাইরে বেরুবি না।

সন্তু ঘাড় নেড়ে আবার বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। বেয়ারাটি বলছিল, এখানে নাকি কিছুদিন আগে আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়েছিল। তার সঙ্গে পদ্মনাভনের উধাও হওয়ার সম্পর্ক আছে? তারা খসে পড়ার ব্যাপারটা আবার কী?

কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো আসল ব্যাপার।

কাকাবাবু গায়ের শার্ট আর জুতো-মোজা খুলে ফেললেন। ব্যাগ থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি আর তোয়ালে বের করে বললেন, দাঁড়া, বাথরুম থেকে আসছি। তারপর শুয়ে-শুয়ে বাকিটা আলোচনা করা যাবে। তুই ততক্ষণ সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দে। পুলিশের ধারণা, পদ্মনাভনকে যারা চুরি করেছে, তারা এখনও এখানেই রয়ে গেছে।

সন্তু সব বন্ধ করে দিল। তার মনে পড়ল, সে টিনটিনের একটা অ্যাডভেঞ্চার গল্প পড়েছিল, সেটার নাম শুটিং স্টার। আকাশ থেকে বিরাট একটা জিনিস খসে পড়েছিল। তারপর বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে টিনটিন গিয়েছিল সেটা দেখতে। কিন্তু সেটা একেবারে আজগুবি গল্প। গ্রিনল্যান্ডের কাছে সমুদ্রে পড়েও সেটার খানিকটা পাহাড়ের মতন উঁচু হয়েছিল। সেটা এমনই জিনিস যে, তার ওপরে একটা আপেলের বীজ ফেললে সঙ্গে-সঙ্গে আপেল গাছ হয়ে যায়, একটুক্ষণের মধ্যেই তাতে অসংখ্য আপেল জন্মায়। একটা ছোট্ট মাকড়সা হয়ে যায় বিরাট জানোয়ার। এরকম কখনও হতে পারে?

একটু বাদে কাকাবাবু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আকাশ থেকে কখনও কোনও তারা পৃথিবীতে খসে পড়তে পারে? বেয়ারাটা নিশ্চয়ই বাজে কথা বলেছে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা যেগুলোকে তারা বলি, সেগুলো পৃথিবীতে খসে পড়ে না ঠিকই। সেরকম একটা তারা এসে ধাক্কা মারলে সঙ্গে-সঙ্গে পৃথিবীর বারোটা বেজে যাবে। তবে আকাশ থেকে কিছু-কিছু জিনিস পৃথিবীতে খসে পড়ে, এটা তো ঠিক! যেমন দেখলি না জাটিংগার পাখিগুলো? অম্বরের ধারণা, একদিন একটা সোনার পাখিও পড়বে!

কাকাবাবু হেসে ফেলতেই সন্তু বলল, ওগুলো নিশ্চয়ই আকাশ থেকে খসে পড়ে না। অন্য কোনও জায়গা থেকে উড়ে আসে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, পাখির কথা থাক। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি হয়, তা তো মানবি? শিলাবৃষ্টি বললে সাধারণত বৃষ্টির সময় বরফের টুকরো পড়ার কথা বোঝায়, কিন্তু কখনও কখনও পাথরের টুকরোও পড়ে।

সন্তু বলল, সে তো জানি। মিটিওর।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক হল না, মিটিওর আর মিটিওরাইট, এই দু ভাগে ওদের ভাগ করা যায়। বাংলায় ওদের আলাদা নাম নেই। সবগুলোকেই বলে উল্কা। এই উল্কাগুলো হচ্ছে ছোট-বড় নানা ধরনের পাথর কিংবা ধাতুর টুকরো, যেগুলো আকাশে ঘুরে বেড়ায়। রাত্তিরবেলা অনেক সময় দেখা যায় আকাশে একটা আলোর রেখার মতন একদিক থেকে অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে, তখন ছুটন্ত তারার মতনই মনে হয়। অনেকগুলো আবার নীচের দিকে নেমে আসে।…

এত জোরে এই উল্কাগুলো ছোটে, কত জোরে জানিস, প্রতি সেকেন্ড ষাট, সত্তর, আশি কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে, পৃথিবীর আবহাওয়ার সঙ্গে ঘষা লাগলেই ওরা আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে, তাতেই গলে-পুড়ে ছাই কিংবা ধোঁয়া হয়ে যায়। সব আমরা চোখেও দেখতে পাই না। প্রতিদিন নাকি কয়েক কোটি উল্কা এরকম পৃথিবীর হাওয়াতে এসে ছাই হয়। বৃষ্টির সঙ্গে ধুলোবালি হয়ে মেশে। কিন্তু কোনও-কোনওটা বেশ বড় টুকরো হলে পৃথিবীতে পড়ে। সেগুলোকে বলে মিটিওরাইট।

সন্তু বলল, তা হলে সত্যি-সত্যি আকাশ থেকে কিছু পৃথিবীতে খসে পড়ে?

কাকাবাবু বললেন, পড়ে তো বটেই। হঠাৎ দুম করে একটা মিটিওরাইট এসে পড়াটা অসম্ভব কিছু নয়। মাঝে-মাঝে পড়েছে একরম। এ-পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যেটাকে পাওয়া গেছে, সেটার ওজন ৬০ টন! কত বিশাল বুঝতে পারছিস? কোনও একটা মিটিং-এর ওপর পড়লে শত-শত লোক মারা যেত। সেটা অবশ্য পড়েছিল আফ্রিকার জঙ্গলে। আমেরিকার আরিজোনাতেও এরকম একটা মিটিওরাইট বা উল্কা বহুকাল ধরে পড়ে আছে। অনেক সময় মাঠের মধ্যে কিংবা পাহাড়ের খাঁজে দেখা যায় একটা পুকুর কিংবা ছোটখাটো হ্রদ। কেউ সেগুলো বানায়নি। খুব সম্ভবত আকাশ থেকে উল্কা পড়ে সেসব জায়গায় গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছিল, তারপর বৃষ্টির জলে ভরে গেছে। এই শতাব্দীতেই সাইবেরিয়াতে একটা মস্তবড় উল্কা পড়ে বহু গাছপালা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখানেও সেইরকম একটা মিটিওরাইট পড়েছে?

কাকাবাবু বললেন, সেইরকমই তো শোনা যাচ্ছে। অনেক লোক দেখেছে যে, আকাশ থেকে জ্বলন্ত তারা ছুটে আসছে, সেটা শেষ পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেল না। ঝপাং করে সমুদ্রের জলে পড়ল।

কাকাবাবু নিজের খাটে শুয়ে পড়ে গায়ের চাদরটা টেনে দিলেন।

সন্তুর এক্ষুনি শুতে ইচ্ছে করছে না। কাকাবাবুকেও সে কখনও এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে দ্যাখেনি। এমনিতে তাঁর অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়া অভ্যেস। তা হলে নিশ্চয়ই এখনও কাকাবাবুর জ্বর আছে।

কাছে এসে সে কাকাবাবুর কপালে হাত দিয়ে দেখল বেশ গরম।

সে বলল, কাকাবাবু, তোমার তো বেশ জ্বর। তুমি কোনও ওষুধ খাবে না?

কাকাবাবু বললেন, না, আর দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি, একটু একটু করে কমছে। এবার আপনি সেরে যাবে। তুই এক কাজ কর, পকেট থেকে রিভলভারটা এনে দে, বালিশের নীচে রাখব। তারপর আলো নিভিয়ে দে।

পাশাপাশি দুটো খাট। মাথার দিকে জানলা। সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকলেও শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের জলের ঝাপটার শব্দ। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে। বোধ হয় ঝড় উঠেছে।

ঘর অন্ধকার করে দেওয়ার পর সন্তু শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, কাকাবাবু, এই উল্কাগুলো কী দিয়ে তৈরি হয়?

কাকাবাবু বললেন, পাথর। কিংবা লোহা। কখনও কখনও একটু দস্তাও মিশে থাকে। ওগুলো তো পৃথিবীর মতন গ্রহ-ট্ররই টুকরো। এমনিতে ওগুলোর কোনও দাম নেই।

তা হলে ওই একটা উল্কাপাতের সঙ্গে পদ্মনাভনের অদৃশ্য হওয়ার সম্পর্ক কী?

অনেকের ধারণা, ওই উল্কার টুকরোগুলোর মধ্যে সোনা কিংবা প্লাটিনামের মতন কোনও দামি ধাতু থাকতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, কেউ-কেউ মনে করে, ওর মধ্যে এমন একটা কোনও ধাতু পাওয়া যেতে পারে, যা এ-পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। পৃথিবীর কেউ সেরকম ধাতুর কথা জানে না। যদি সত্যিই সেরকম কোনও ধাতু বৈজ্ঞানিকের হাতে পড়ে, তা হলে তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাবেন!

ও, এই ব্যাপার। কিন্তু এখানকার উল্কাটা তো সমুদ্রের জলে ড়ুবে গেছে?

হ্যাঁ, ড়ুবেই গিয়েছিল। উল্কাটা যখন পড়ে, তখন পদ্মনাভন এখানে ছিল না। সে এসেছিল ভুবনেশ্বরে একটা সেমিনারে বক্তৃতা দিতে। উল্কাটা পড়ার তিনদিন বাদে এখানকার একটা জেলের জালে একটা পাথর ওঠে। গোপালপুরের কাছে সমুদ্র খুব গভীর নয়। এক-এক জায়গায় অনেক দূর পর্যন্ত কোমরজল। মাছ ধরতে গিয়ে একজন জেলে একটা অদ্ভুত ধরনের পাথর পেয়ে গেল। সেটা একটা ফুটবলের ঠিক আদ্ধেকটার মতন। ফুটবলের মতন একটা গোল পাথরকে যদি আধখানা করে কাটা যায়, তার একটা টুকরো যেমন হয়।

সমুদ্রে তো নানারকম পাথর পাওয়া যায়। কী করে বোঝা গেল যে, সেটা একটা উল্কার টুকরো?

তুই ঠিক ধরেছিস। সেটা উল্কার টুকরো হতেও পারে, নাও হতে পারে। তবে সেটাকে দেখলে নাকি মনে হয়, সেটাকে সদ্য ভাঙা হয়েছে। আকাশ থেকে ওইরকম একটা গোল পাথর পড়তে-পড়তে ছোট হয়েছে। শেষ মুহূর্তে দুটুকরো হয়ে একটা টুকরো পড়েছে গভীর সমুদ্রে, অন্যটা কাছাকাছি। মাছ-ধরা জেলেটি ওইরকম একটা টুকরো পাওয়ার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দ্বিতীয় টুকরোটা পায়নি।

জেলেটা কী করে বুঝল, সেটা কোনও দামি জিনিস?

সাধারণ উল্কার টুকরো হলেও সেটা এমন কিছু দামি হত না। কিন্তু সেই জিনিসটার ওপরের দিকটা নাকি সাধারণ পাথরের মতন, কিন্তু ভেতরের দিকটা গাঢ় সবুজ আর খুব ঝকঝকে উজ্জ্বল। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করে।

সবুজ পাথর? তা হলে নিশ্চয়ই পান্না!

পান্না? তুই কী করে জানলি যে, পান্না সবুজ হয়?

রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে। আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। এই লাইন দুটো মুখস্থ রাখলেই জানা যায় যে, পান্না হয় সুবজ আর চুনী হয় লাল।

বাঃ, বেশ তো। এটা আমার জানা ছিল না। সবুজ পাথরটা পান্না হতে পারে, আবার অনেক সাধারণ পাথরও সবুজ হয়। তবে আলো পড়লে যদি সত্যিই জ্বলজ্বল করে, তা হলে সেটা পান্না ছাড়াও অন্য কিছু হতে পারে। জেলেটার কাছে সেই পাথর দেখে এখানকার অনেক টুরিস্ট সেটা কিনতে চাইল। ঘর সাজাবার জন্য। কেউ পঞ্চাশ টাকা, কেউ একশো টাকা দাম দিতে চায়। জেলেটা দাম হাঁকল এক হাজার টাকা! অত টাকা কেউ দিতে চায় না। তবু দর উঠতে লাগল। পাঁচশো, সাতশো পর্যন্ত। তারপর এক বড়লোক মাড়োয়ারি বলল, সে এক হাজার টাকাই দেবে। জেলেটা তখন আরও দাম বাড়াল। সে বলল, এক হাজার টাকাতেও সে দেবে না। তার আড়াই হাজার টাকা চাই।

পদ্মনাভন তখন কোথায়?

সে তখনও ভুবনেশ্বরে। এখানে একজন জেলে একটা অদ্ভুত পাথর পেয়েছে যেটা উল্কার টুকরো হতে পারে, এই খবর কয়েকটা কাগজে ছাপা হয়েছিল। সেই খবর পদ্মনাভনের নজরে পড়ে। তখন সে কারুকে কিছু না জানিয়ে ভুবনেশ্বরে চলে আসে। পাথরটার দাম এর মধ্যে আরও বেড়ে গেছে। পদ্মনাভন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাথরটা কিনে নিল।

এতসব খবর কি তুমি আগে জানতে, কাকাবাবু?

কিছু না। কলকাতার কাগজে কিছু বেরোয়নি। আজই পুলিশের কাছে সব শুনলাম। পুলিশও জেনেছে পরে। একটা জেলে যে একটা অন্যরকম পাথর পেয়েছে, তা নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে, সে ব্যাপারেও পুলিশ মাথা ঘামায়নি। পদ্মনাভন এসেই টপ করে অত দাম দিয়ে পাথরটা কিনে নেওয়ার পর অনেকে জানতে চাইল লোকটি কে? তার পরিচয়টাও বেরিয়ে গেল। যখন লোকে। শুনল যে, একজন অতবড় বৈজ্ঞানিক ছুটে এসে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা পাথর কিনেছে, তখন সকলেরই কৌতূহল বেড়ে গেল। তা হলে আকাশ থেকে নিশ্চয়ই দারুণ কিছু একটা মাটিতে নেমে এসেছে।

জাটিংগার সেই সোনার পাখির মতন? এটা বেশ মজা না, আমরা আসামে গিয়েছিলাম আকাশ থেকে পড়া পাখি দেখতে, আর সমুদ্রের ধারে এসেও শোনা যাচ্ছে আকাশ থেকে পড়া এক পাথরের কথা!

তাই তো দেখছি রে!

তারপর কী হল?

পদ্মনাভন পাথরটা কেনার পর তা নিয়ে নানারকম গুজব ছড়াতে লাগল। সত্যি-মিথ্যে অনেক কাহিনী ছাপা হতে লাগল এখানকার কাগজে। বোম্বের টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজেও উল্কাপাথরে নতুন ধাতু? এইরকম একটা খবর বেরুল। এতদিনে টনক নড়ল এখানকার পুলিশের। আকাশ থেকে সত্যিই যদি কোনও সোনার পাখি কিংবা দামি পাথর খসে পড়ে, তবে তার মালিক হবে গভর্নমেন্ট। মাটির তলা থেকে কিছু পাওয়া গেলেও একই নিয়ম। পুলিশ এসে পদ্মনাভনকে বলল সেই পাথরটা থানায় জমা দিতে। কিন্তু ছোটখাটো পুলিশ অফিসারকে পদ্মনাভন পাত্তা দেবে কেন? সে যেমন খামখেয়ালি, তেমনই বদমেজাজি। পুলিশদের ধমক দিয়ে সে বলল, সে নিজেই সরকারের লোক। তার কাছে পাথরটা থাকা মানেই গভর্নমেন্টের কাছে থাকা। কথাটা মিথ্যে নয়। সে ব্যাঙ্গালোরের একটা সরকারি বিজ্ঞান সংস্থার হেড। ধমক খেয়ে পুলিশ চলে গেল বটে, কিন্তু এই বাংলোর সামনে পাহারা বসাল। পদ্মনাভনও অদ্ভুত কাণ্ড করল, সে পাথরটা নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ফিরে গেল না, এখানেই রয়ে গেল সাতদিন। সব সময় দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকত। তাতে লোকের কৌতূহল বাড়তে লাগল আরও।

ঠিক সেই সময়টায় আমাদের এখানে আসবার কথা ছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু আমরা চলে গেলাম আসাম। এর মধ্যে পদ্মনাভন একদিন উধাও। বাইরে পুলিশ পাহারা ছিল। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে কেউ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।

পাথরটাও নেই?

সেটা তো থাকবেই না।

আচ্ছা কাকাবাবু, এমন হতে পারে না? পাথরটা যদি সত্যিই মহা মূল্যবান হয়, তা হলে পদ্মনাভন অন্যদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য নিজের জিনিসপত্র সব ফেলে শুধু পাথরটা নিয়ে নিজেই চলে গেছেন?

সেরকমও হতে পারে হয়তো। পদ্মনাভন বিচিত্র ধরনের মানুষ। তবে, পদ্মনাভনের জুতো, চটি সবই পড়ে আছে। সে খালি পায়ে গেছে। আমি পদ্মনাভনকে যতটা চিনি, তাতে সে খালি পায়ে কোথাও যাবে, এমন মনে হয় না।

কিন্তু যারা পাথরটা চুরি করতে চায়, তারা পদ্মনাভনকে শুধু-শুধু এতদিন আটকে রাখবে কেন?

যারা আমাদের পাহাড়ের খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, তারাই যদি এই ব্যাপারটায় জড়িত থাকে তবে পদ্মনাভনকে খুন করা তাদের পক্ষে কিছুই না। কিন্তু পদ্মনাভনের ডেড বডি পাওয়া যায়নি। আমার ধারণা, পদ্মনাভনকে এখনও আটকেই রাখা হয়েছে। আর তাকে আটকে রাখার একটাই কারণ থাকতে পারে।

কী সেটা, কী?

থাক, সে-সম্পর্কে আমি এখন কিছু আলোচনা করতে চাই না। এখন ঘুমো তো!

এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসছে না, কাকাবাবু। তা হলেও চোখ বুজে থাক। একটু বাদে ঘুম এসে যাবে। শোন, সন্তু, আমরা এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছি। এখানে একটা উল্কা খসে পড়েছে কিংবা পড়েনি, কিংবা পদ্মনাভন কেন উধাও হয়ে গেল, তা নিয়ে আমাদের বেশি মাথা ঘামাবার তো দরকার নেই। কেউ আমাদের সেই দায়িত্ব কি দিয়েছে? আমরা এসেছি শরীর ভাল করতে।

আর কোনও কথা না বলে সন্তু আপনমনে একটু হাসল।

এখানে এতসব রহস্যময় কাণ্ডকারখানা ঘটেছে, তা নিয়ে কাকাবাবু মাথা ঘামাবেন না, তা কখনও হতে পারে? কেউ দায়িত্ব দিক বা না দিক কাকাবাবু এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না। কাকাবাবুর স্বভাব সে ভালই জানে।

কাকাবাবু পাশ ফিরে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন মনে হল।

সন্তু এপাশ-ওপাশ ছটফট করল খানিকক্ষণ। সমুদ্র আর বাতাসের গর্জন বেশ বেড়েছে। সন্তুর খুব ইচ্ছে করছে, দরজা খুলে বারান্দায় যেতে। কিংবা একেবারে জলের ধারে গিয়ে বসতে। রাত্তিরবেলার সমুদ্রের একটা আলাদা রূপ আছে।

কিন্তু কাকাবাবুর পাতলা ঘুম। দরজা খুললেই তিনি টের পেয়ে যাবেন। আজ সকালেই দমদম এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুর কাছে কয়েকটা প্রতিজ্ঞা করেছে। আজই উলটোপালটা কিছু করলে কাকাবাবুর কাছে খুব বকুনি খেতে হবে!

একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

আবার কিছুক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙল বিকট কোনও শব্দে। গুলির আওয়াজ। পরপর দুবার।

কাকাবাবু সন্তুর আগেই উঠে পড়ে আলো জ্বেলেছেন। রিভলভারটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, তোকে উঠতে হবে না সন্তু, আমি দেখছি!

সন্তু তবু তড়াক করে নেমে পড়ল খাট থেকে।

বাইরে এবার গোলমাল শোনা যাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলোর একজন বেয়ারার গলা চেনা যায়। কাকাবাবু দরজাটা খুলে ফেললেন।

বাংলোর বাইরে চৌকিদার, বেয়ারা ও দুজন পুলিশ একসঙ্গে চ্যাঁচামেচি করে কী যেন বলছে। কাকাবাবু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কে গুলি ছুঁড়ল?

একজন পুলিশ কাকাবাবুকে স্যালুট করে বলল, সার, চোর এসেছিল। আপনাদের পাশের ঘরের জানলা ভেঙে ঢুকেছিল। তারপর যখন পালাচ্ছে, তখন আমরা ঠিক দেখে ফেলেছি।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল?

পুলিশটি বলল, হ্যাঁ সার। দেখুন না, জানলা ভাঙা। ভেতরের অনেক কিছু ওলোটপালট করেছে।

সন্তু বলল, আহা, কী পাহারা দেওয়ার ছিরি! চোর যখন জানলা ভেঙে ঢুকল, তখন পুলিশ টেরও পায়নি। চোর যখন বেরিয়ে আসছে, তখন দেখেছে?

পুলিশটি আবার বলল, দুজন ছিল। একজনের পায়ে বোধ হয় গুলিও লেগেছে। কিন্তু ধরা গেল না। ওরা মোটর বাইক এনেছিল। আপনারা ভেতরে যান, সার, কোনও চিন্তা করবেন না। আমরা রাত জেগে পাহারা দেব।

পাশের ঘরটি পদ্মনাভনের ঘর। কাকাবাবু বললেন, আমি ঘরটা একবার দেখব।

সে-ঘরের দরজায় চাবি দেওয়া ছিল, খোলা হল। ভেতরটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। টেবিলের সবকটা ড্রয়ার ওলটানো, জামা কাপড়গুলো মেঝেতে ছড়ানো। কার্পেটের একটা দিক খানিকটা গুটিয়ে গেছে।

কাকাবাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সবদিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখলেন খানিকক্ষণ।

তারপর বললেন, যাক, কোনও কিছুতে হাত দেওয়ার দরকার নেই। কাল সকালে ডি. আই. জি. সাহেব এসে দেখবেন।

তারপর তিনি নিচু গলায় বললেন, মনে হচ্ছে, আমার থিয়োরিটাই ঠিক।
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে সন্তু আর কাকাবাবু গেলেন সমুদ্রের ধারে বেড়াতে।

আকাশ খানিকটা মেঘলা। বেলাভূমিতে খুব বেশি লোক নেই। কিছু ছেলেমেয়ে স্নান করতে নেমেছে। দূরে-দূরে দেখা যাচ্ছে খেলনা নৌকোর মতন ভাসছে জেলে ডিঙি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোর পায়ের ব্যথাটা কেমন রে, সন্তু? স্নান। করতে নামবি নাকি?

সন্তু বলল, বাঃ, সমুদ্রের ধারে এসে চান করব না? পায়ের ব্যথাটা একদম সেরে গেছে। হাঁটুর ফোলাটাও নেই।

কাকাবাবু বললেন, ইউসুফ-ডাক্তার সত্যিই মিরাক্ল করেছেন দেখছি। আমিও স্নান করব। তবে এখন নয়, দুপুরবেলা। এখন কিছুক্ষণ সমুদ্রের টাটকা হাওয়া খাওয়া যাক। এর মতন ভাল জিনিস আর হয় না। পৃথিবীতে টাটকা বাতাস খুব কমে যাচ্ছে দিন দিন।

জলের খুব কাছাকাছি গিয়ে দুজনে বসল বালির ওপর। কাকাবাবু ক্রাচ দুটো পাশে রেখে বাবু হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে।

সন্তু বালি দিয়ে একটা দুর্গ বানাতে লাগল, বাচ্চা বয়েসে সে বাবার সঙ্গে পুরী বেড়াতে এসেছিল। তখন সে প্রায় সারাদিন সমুদ্রের ধারে বসে বালি দিয়ে কতরকম ঘর-বাড়ি, পাহাড়, দুর্গ বানাত। মনে পড়ছে সেই কথা।

দুজনেই খানিকক্ষণ চুপচাপ।

হঠাৎ এক সময় সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, উল্কা পাথরটার মধ্যে সত্যি-সত্যি নতুন কোনও ধাতু আছে কি না, সেটা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না করে কি বোঝা যাবে? পদ্মনাভন বাংলোর ঘরে বসে খালি চোখে দেখে বুঝতে পারতেন? ওঁর ঘরে তো কোনও যন্ত্রপাতি নেই।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে সন্তুর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

তারপর ধমকের সুরে বললেন, দিলি তো আমার ধ্যান ভাঙিয়ে? তোর মাথায় বুঝি শুধু ওইসব ঘুরছে? বলেছি না, এসব নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই!

সন্তু হাসল।

কাকাবাবু আবার বললেন, সমুদ্রের ধারে বসে তোর কোনও কবিতা মনে পড়ছে না? সমুদ্র সম্পর্কে একটা কবিতা শোনা তো!

সন্তু একটুক্ষণ ভেবে বলল, ঠিক মনে পড়ছে না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আয়, দুজনে মিলে একটা বানানো যাক। আমি একটা লাইন বলছি, তুই পরের লাইনটা বসিয়ে দিবি।

একটুখানি চুপ করে থেকে কাকাবাবু বললেন :

আকাশের নীল রং মিশে গেছে সাগরে

সন্তু প্রায় কিছু চিন্তা না করেই বলল :

ঝিনুক কুড়োতে যাব জাগো সব জাগো রে!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ মিলিয়েছিস তো। আচ্ছা, এর পর কী হতে পারে? ঢেউগুলো, ঢেউগুলো নিয়ে কিছু একটা…

বড় বড় ঢেউগুলি পাহাড়ের মতো প্রায়

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বলল :

তিমিমাছ লাফ দিয়ে যেন পিলে চমকায়!

কাকাবাবু হেসে বললেন, খুব সোজা মিল পেয়ে যাচ্ছিস, তাই না? দাঁড়া, এবার একটা শক্ত দিচ্ছি।

ভুরু কুঁচকে মিনিটখানেক চিন্তা করার পর কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এটার সঙ্গে মিলিয়ে দে তো দেখি।

মেঘ ডাকে গুরু-গুরু কাঁপে সারা অম্বর

সন্তু এবার কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে কে যেন বলল, এই তো স্বয়ং অম্বর এখানে হাজির।

কাকাবাবু ও সন্তু একসঙ্গে পেছনদিকে মুখ ফেরাল। পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে, একগাল হেসে দাঁড়িয়ে আছে পীতাম্বর পাহাড়ী!

দু হাত তুলে সে বলল, নমস্কার, কাকাবাবু, দেখুন, আমি এখানেও এসে গেছি! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন, তাই না? নিশ্চয়ই আমাকে দেখে খুব : অবাক হয়েছেন!

কাকাবাবু যে আগেই জানতেন ওর আসবার কথা, তা প্রকাশ করলেন না। হেসে বললেন, আরে, পীতাম্বর, কী খবর? হঠাৎ তুমি এখানে?

সে বলল, পীতাম্বর না সার, শুধু অম্বর বলুন। আপনারা চলে আসার পর আমার মন কেমন করতে লাগল। ভাবলুম, কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসি। কথায় আছে না, উঠল বাই তো কটক যাই! তাই দেখুন কটক না হোক গোপালপুর এসে গেছি!

বালির ওপর ধপাস করে বসে পড়ে সন্তুর কাঁধে চাপড় মেরে সে আবার বলল, কী খবর, সন্তুবাবু? পা একেবারে ফিট হয়ে গেছে?

প্রথম দিন জঙ্গলের মধ্যে সাপ-ধরা পীতাম্বর পাহাড়ীকে দেখে সন্তুর বেশ ভাল লেগেছিল। কিন্তু সেই লোকটির হঠাৎ গোপালপুর চলে আসা সত্যি বেশ সন্দেহজনক।

সন্তু খানিকটা আড়ষ্টভাবে বলল, হ্যাঁ, ভাল হয়ে গেছে। আপনি ভাল আছেন?

অম্বর বলল, আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি। আমি কক্ষনো খারাপ থাকি না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানেও সাপ ধরতে এলে নাকি? সমুদ্রের ধারে বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায় বলে তো শুনিনি!

অম্বর বলল, না, না, এখানে সাপ ধরতে আসিনি। এসেছি বেড়াতে। টাকা রোজগারের জন্য বনে-জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়াই, তা বলে কি আমাদেরও মাঝে-মাঝে ছুটি নিতে ইচ্ছে হয় না? কুঁজোরও তো চিৎ হয়ে শুতে সাধ জাগে মাঝে-মাঝে!

শেষের কথাটা সন্তু ঠিক বুঝতে পারেনি, তার মুখ দেখেই সেটা ধরা যায়। তার দিকে চেয়ে অম্বর বলল, কুঁজো মানে বুঝলে? জলের কুঁজো নয়, যে-লোকের পিঠে কুঁজ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে হাঞ্চ ব্যাক।

সন্তু বলল, আসামের জঙ্গলটাই তো একটা বেড়াবার জায়গা। সেখান থেকেও লোকে অন্য জায়গায় বেড়াতে যায়।

অম্বর বলল, পাহাড় আর জঙ্গল দেখতে-দেখতে একঘেয়ে হয়ে গেলে, তখন সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে করে। তা ছাড়া আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, এখানে এলে আপনাদের দেখতে পাব। দেখুন, কেমন মিলে গেল!

সন্তু বলল, এ জায়গাটা খুব ভাল।

অম্বর বলল, কাল রাত্তিরে হোটেলে এসেই শুনলাম, এখানে একজন বৈজ্ঞানিক রহস্যময়ভাবে উধাও হয়েছে। তোমরা সেই গেস্ট হাউসেই আছ। কাকাবাবু যখন এসে পড়েছেন, তখন নিশ্চয়ই রহস্যের সমাধান হবে। আমি তোমাদের কোনও কাজে লাগতে পারি? কাকাবাবু, আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চারে আমি সঙ্গে থাকতে চাই। আমি কিছুদিন বক্সিং শিখেছিলাম।

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, আমরা এখানে ওসব কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাই না। দুজনেরই শরীর ভাল না, এখানে বিশ্রাম নেব শুধু।

একটা মোটরবোট গোঁ-গোঁ শব্দ করতে করতে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। জেলে নৌকোগুলোর পাশ দিয়ে সেটা বেশ সুন্দরভাবে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। জলে যারা সাঁতার কাটতে নেমেছে, তাদের মধ্যে দুজন চলে গেছে অনেকটা দূরে। আগে মনে হচ্ছিল সেখানে খুব গভীর জল, কিন্তু লোক দুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে তাদের মোটে বুক-জল। আবার বড় ঢেউ উঠতেই তারা সামনে ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে গেল।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অম্বর, সেদিন ভোরবেলা গাছের নীচে তুমি যখন আমায় দেখতে পেলে, তখন আমার হাত বাঁধা ছিল। মুখটাও কি বাঁধা ছিল?

অম্বর অবাক হয়ে বলল, না তো!

কাকাবাবু বললেন, আমার মুখের বাঁধনটা নিজে নিজেই খুলে গিয়েছিল। তুমি আসবার আগেই। তোমাকে কি আমি বলেছিলাম যে, আমার মুখটাও বাঁধা ছিল আগে?

অম্বর বলল, না, তাও বলেননি। এই প্রথম শুনলাম। ফেলে দেওয়ার সময় আপনার মুখটাও ওরা বেঁধে দিয়েছিল বুঝি? সন্তুর বাঁধেনি?

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে তো ওরা ধরবার আগে নিজেই লাফ দিয়েছে! যাকগে, থাক ওসব কথা।

অম্বর বলল, হঠাৎ এ-কথাটা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনিই মনে পড়ল।

অম্বর জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন? কলকাতায় গেলে দেখা করব। দাঁড়ান, লিখে নিচ্ছি।

নিজের পকেট ও কাঁধের ঝোলাটা হাতড়েও সে কলম খুঁজে পেল না। কাকাবাবু নিজের বুকপকেট থেকে কলমটা দিয়ে বললেন, এটাতে লিখে নাও!

ঠিকানা লেখার পর ফেরত দেওয়ার জন্য সে বাড়িয়ে দিতেই কাকাবাবু বললেন, ওটা তোমার কাছেই থাক। তোমার কলম নেই।

অম্বর বলল, না, না, আমার আছে। হোটেলে ফেলে এসেছি। আপনার কলম নেব কেন? এত দামি কলম।

কাকাবাবু বললেন, এমন কিছু দামি নয়। তুমি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। তোমাকে এই সামান্য একটা জিনিস আমি দিতে চাই।

অম্বর বলল, আমি এমন কিছুই করিনি। হঠাৎ সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম। এ তো সবাই করে।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এই কলমটা নিলে আমি খুশি হব।

অম্বর বলল, তা হলে ঠিক আছে, নিচ্ছি। আপনার ব্যবহার করা কলম। এটার দাম আমার কাছে অনেক?

কাকাবাবু আবার সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরালেন।

অম্বর সন্তুকে রলল, তোমরা ছড়া মেলাবার খেলা খেলছিলে। আমার সঙ্গে খেলবে? আমিও খেলতে পারি। অম্বরের সঙ্গে কী মিলবে জানো? শম্বর!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তার মানে কী?

অম্বর বলল, একরকমের বড় হরিণ, দ্যাখোনি কখনও? মাথায় ডালপালার মতন শিং। মেঘে কালো অম্বর, ভয়ে কাঁপে শম্বর! ঠিক হল না? তোমার নাম

তো সন্তু। তার সঙ্গে মিল দিতে পারো অধিকন্তু!

কাকাবাবু উঠে পড়ে বললেন, দশটার সময় আমার কাছে একজন দেখা করতে আসবে। বাংলোয় ফিরবি নাকি রে, সন্তু?

কাকাবাবুর গলার আওয়াজ শুনেই সন্তু বুঝতে পারল, তিনি সন্তুকে সঙ্গে নিয়েই ফিরতে চান। সন্তু বলল, হ্যাঁ, আমারও একটা কাজ আছে।

কাকাবাবু বললেন, চলি, অম্বর। তুমি বোসো তা হলে।

অম্বর যেন এখানে বেশ অনেকক্ষণ ধরে জমিয়ে গল্প করার মেজাজ নিয়ে এসেছিল, কাকাবাবুরা হঠাৎ বিদায় নিতে চাইছেন দেখে সে বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল।

বাংলোর দিকে ফিরতে-ফিরতে কাকাবাবু নিচু গলায় বললেন, অম্বর ছেলেটা হয়তো খারাপ নয়। কিন্তু ওকে দেখলেই আমার আসামের সেই ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে আর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই, আমাদের খাদের মধ্যে ফেলে দিল?

সন্তু বলল, এরকম আগে কখনও হয়নি। কিন্তু ওই অম্বর পাহাড়ী বাইচান্স সেই সময় খাদের নীচে হাজির হয়েছিল বলেই তো মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, তোর তাই মনে হচ্ছে? এই ছেলেটা ওই বদমাশের দলের কেউ নয়।

সন্তু বলল, ওদের দলের হলে আর আমাদের বাঁচাবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনও হতে পারে যে, দেখতে এসেছিল আমরা সত্যি মরে গেছি কি না। যখন দেখল মরিনি, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, তখন ও আমাদের সাহায্য করে নিজে ভাল সাজবার চেষ্টা করল।

সন্তু বলল, ইচ্ছে করলে তখনও অম্বর আমাদের মারতে পারত। আমি অজ্ঞান আর তোমার হাত বাঁধা ছিল।

কাকাবাবু বললেন, খুব সাঙ্ঘাতিক ক্রিমিনাল না হলে দিনের আলোয় মারতে পারে না। ও বোধ হয় তেমন পাকা নয়। আর-একটা জিনিস লক্ষ কর, যারা আমাদের ফেলে দিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে ও এখন আর কোনও কথাই বলছে না। আমরা চলে আসার পর তাদের আর কোনও খোঁজখবর পাওয়া গেল কি না, সে-বিষয়েও উচ্চবাচ্য করল না একবারও।

ডাকবাংলোর পেছনদিকেও একটা গেট আছে। সেখান দিয়ে ঢুকে এসে কাকাবাবু আবার বললেন, আমি এখানেও বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। পদ্মনাভনকে যারা ধরে নিয়ে গেছে, তারাই কি সত্যি আমাদের আসামে পাঠিয়েছিল? তা হলে তারা এখানেও তো আমাদের আর-একবার মারবার চেষ্টা করতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে কিন্তু।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পর দেখা গেল দুজন মিস্ত্রি পদ্মনাভনের ঘরের ভাঙা জানলাটা সারাচ্ছে। কাকাবাবু ঘরটায় একবার উঁকি দিলেন।

বেরিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, তখন তুই একটা ভাল প্রশ্ন করেছিস, সন্তু। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাথরটা কেনার পরেও পদ্মনাভন গোপালপুরের এই বাংলোয় এতদিন থেকে গেল কেন? তার মতন বৈজ্ঞানিকের তো উচিত ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনও ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে পাথরটা পরীক্ষা করে দেখা। অবশ্য পদ্মনাভন খামখেয়ালি, পাগলাটে ধরনের লোক।

সন্তুর কাছে চাবি, সে নিজেদের ঘরের দরজা খুলল। কাকাবাবু একজন বেয়ারাকে দেখতে পেয়ে বললেন কফি দিতে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, দশটার সময় কে আসবে?

কাকাবাবু বললেন, কেউ আসবে না। কফিটা খেয়ে আমি একবার বেরুব। একবার থানায় যেতে হবে। আমার কয়েকটা ফোন করার দরকার। থানা থেকেই সুবিধে। তুই ঘরে থাক, আমি ঘুরে আসছি।

সন্তু বলল, আমি শুধু-শুধু এখানে বসে থেকে কী করব? আমিও তোমার সঙ্গে যাই থানায়!

কাকাবাবু বললেন, তোর যাওয়ার দরকার নেই তো কিছু। তুই এখানে বিশ্রাম নে। বাইরে বেরোস না।

সন্তু এবার অধৈর্য হয়ে বলল, আমার যথেষ্ট বিশ্রাম হয়ে গেছে। সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এসেও আমি ঘরের মধ্যে বসে থাকব নাকি?

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে চেয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। তারপর নরমভাবে বললেন, আমি এবার ভয় পেয়ে গেছি রে, সন্তু। হ্যাঁ, আমি রাজা রায়চৌধুরী, আমিও ভয় পাচ্ছি। তোকে একা-একা সমুদ্রের ধারে যেতে দিতে আমার সাহস হচ্ছে না। যারা আমাদের পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, তারা এখানেও আমাদের মারবার চেষ্টা করতে পারে। আমাকে একবার থানায় যেতে হচ্ছে। সেখানে ডি. আই. জি. ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট আর কয়েকজন সরকারি অফিসার আসবেন। সেখানে তোকে নিয়ে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। তুই এখন ঘরের মধ্যেই থাক। আমি যতক্ষণ না ফিরে আসি ততক্ষণ বাইরে যাবি না। তবে, তোকে একটা কাজ দিয়ে যাচ্ছি। তুই পদ্মনাভনের ঘরটার দিকে নজর রাখবি। আমার ধারণা, চোরেরা ওখানে আবার ফিরে আসবে। দিনের বেলাতেও আসতে পারে।

কফি খেয়ে নিয়ে কাকাবাবু বেরিয়ে পড়লেন।

সন্তু শুয়ে পড়ল বিছানায়। তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে।

সে একটা বই পড়বার চেষ্টা করল। ভাল লাগল না। একটু পরে সে বাইরের বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। আকাশ কালো হয়ে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি নামল। একটু পরেই বেশ জোর বৃষ্টি শুরু হল। সব লোকও হুড়োহুড়ি করে পালিয়ে গেল, বেলাভূমি একেবারে ফাঁকা।

যাক, এই সময় সমুদ্রের ধারে বেড়ানো যেত না। বাংলোতে ফিরে আসতেই হত। বারান্দায় বসেই সমুদ্র দেখা যেতে পারে।

বৃষ্টির মধ্যেই একটা জিপগাড়ি চলে গেল বালির ওপর দিয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন দাড়িওয়ালা জজসাহেব। ওঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলে সন্তু হাত তুলবে ভাবল। কিন্তু জজসাহেব এদিকে তাকালেনই না। জজসাহেব কোন হোটেলে উঠেছেন তা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

বৃষ্টি চলতে লাগল অনেকক্ষণ।

সময় কাটাবার জন্য ডাকবাংলোর একজন বেয়ারাকে ডেকে খানিকক্ষণ গল্প করল সন্তু। উল্কাপাত আর পদ্মনাভনের উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা আবার শুনল, কিন্তু নতুন কিছু জানা গেল না।

দুপুরবেলা একজন তোক একটা চিঠি নিয়ে এল কাকাবাবুর কাছ থেকে। কাকাবাবু লিখেছেন :

সন্তু, আমার ফিরতে খানিকটা দেরি হবে। তুই আমার জন্য অপেক্ষা করিস না। খেয়ে নে। সরকারি অফিসাররা ওঁদের সঙ্গে আমাকে লাঞ্চ খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছেন। তা ছাড়াও কলকাতা থেকে একটা টেলিফোন আসার জন্য আমাকে বসে থাকতে হবে। দুই বাংলোতেই থাকিস, কেউ ডাকলে তার সঙ্গে বাইরে যাবি না।

চিঠিটা পেয়ে সন্তু ভাবল, তা হলে কি সমুদ্রে স্নান করতেও যাওয়া হবে না? গোপালপুরে এসে বাথরুমে স্নান?

বৃষ্টি অবশ্য এখনও থামেনি। এখানে বোধ হয় বৃষ্টির মধ্যে কেউ স্নান করতে যায় না। সন্তু ঠিক করল, যাই-ই হোক না কেন, কাল সকালেই সে দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রে নামবে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে সন্তু একটা বই নিয়ে বসে রইল ইজি চেয়ারে। মাঝখানের দরজাটা খোলা। একটা সরু বারান্দার ওপাশেই পদ্মনাভনের ঘর। মিস্তিরিরা চলে গেছে, সেই ঘর এখন তালাবন্ধ। সন্তু মাঝে-মাঝে সেই ঘরটার দিকে তাকাচ্ছে। কাকাবাবু নজর রাখতে বলেছেন।

ওই ঘরে এখনও চোরেরা আসতে পারে। তার মানে, পদ্মনাভনের পাথরটা এখনও পাওয়া যায়নি। সেইজন্যই কাকাবাবু ধরে নিয়েছেন যে, পদ্মনাভন বেঁচে আছেন। যারা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা পদ্মনাভনকে খুন করবে না। তা হলে তো পাথরটা পাওয়াই যাবে না।

এক সময় খানিকটা ঝিমুনি এসে গিয়েছিল সন্তুর। দরজায় খটখট শব্দ হতে আবার জেগে উঠল। বেয়ারা আর-একখানা চিঠি নিয়ে এসেছে। এটা কাকাবাবুর চিঠি নয়। এটা লিখেছে অম্বর।

সন্তু, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল খানিকক্ষণ গল্প করার। কিন্তু বাংলোর সামনে একজন পুলিশ আমাকে ভেতরে যেতে দিল। তোমার সঙ্গেও দেখা করতে দেবে না। কী ব্যাপার বুঝতে পারলাম। আমি রিপোজ হোটেলে আছি, রুম নং ১০। যদি ইচ্ছে হয়, চলে আসতে পারো। এই হোটেলে খুব ভাল পাঁপড় ভাজা ও ফিশ ফ্রাই পাওয়া যায়।

ইতি—অম্বর

চিঠিটা পড়ে সন্তুর বেশ রাগ হল। কী ব্যাপার, সে কি এই বাংলোতে বন্দী নাকি? অম্বরকে ভেতরে আসতে দিলে কী ক্ষতি ছিল। সে যদি অন্য দলের লোকও হয় তা হলে সে কি দিনের বেলা সন্তুকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? অত সোজা নাকি?

তার একবার ইচ্ছে হল, এক্ষুনি রিপোজ হোটেলে চলে যেতে। ঘরের মধ্যে বসে থাকতে আর একটুও ভাল লাগছে না। বৃষ্টিও থেমে গেছে।

জুতো পরতে গিয়েও সন্তু পা সরিয়ে নিল। কাকাবাবু বারণ করেছেন, আজকের দিনটা সে মেনে চলবে। এরকম ভাবে ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়াও ভাল।

কাকাবাবু ফিরলেন বিকেল পাঁচটার সময়।

জামা খুলতে-খুলতে বললেন, দু-একটা খবর শুনে সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল রে, সন্তু! বছর তিনেক আগে পদ্মনাভনকে আর-একবার কারা যেন জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। উটকামণ্ডের কাছে। সন্ধেবেলা মাঝরাস্তায় জোর করে গাড়ি থামিয়ে কারা যেন টেনে-হিচড়ে তাকে অন্য গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিল। এই সময় একটা মিলিটারি কনভয় এসে পড়ে। তখন আততায়ীরা পদ্মনাভনের মাথায় একটা আঘাত করে তাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। আঘাতটা খুব গুরুতর হয়নি, পদ্মনাভন বেঁচে গেছে সে যাত্রায়। আরও একবার বোম্বে এয়ারপোর্টের বাইরে, বেশ গভীর রাত্তিরে কেউ ছুরি মেরেছিল তাকে। সেবারেও ছুরিটা লেগেছিল তার বুকের ডান দিকে, সেই অবস্থাতেও পদ্মনাভন লোকটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করেও পারেনি। তার মানে বুঝতে পারছিস, পদ্মনাভনের অনেক শত্রু আছে।

সন্তু বলল, অর্থাৎ এবারে যারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা যে উল্কা পাথরটার জন্যই পদ্মনাভনকে চুরি করেছে, তার কোনও মানে নেই।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক তাই। সন্তু বলল, আগে দুবার ওঁকে মারবার চেষ্টা হয়েছে, তবু উনি একা-একা ঘুরে বেড়ান?

কাকাবাবু বললেন, বৈজ্ঞানিকরা সাধারণত নিরীহ আর ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ হয়। কিন্তু পদ্মনাভন যেমন দুঃসাহসী, তেমনই বেপরোয়া। সঙ্গে কোনও পাহারাদার নিয়ে ঘোরার মানুষই তো নয়। পুলিশের কাছেও সাহায্য চায় না। লোকটা খুব দুর্মুখও বটে, ছোটখাটো দোষের জন্য তার সহকারীদের এমন খারাপভাবে বকুনি দেয় যে, অনেকে তার অধীনে কাজ করতেই চায় না। এত দোষ থাকলেও পদ্মনাভন খুবই প্রতিভাবান, কোনও একদিন বিজ্ঞানে সে নোবেল প্রাইজ পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

সন্তু বলল, যদি উল্কা-পাথরটাই আসল ব্যাপার না হয়, তা হলে যারা ওঁকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা আর গোপালপুরে থাকবে কেন? অন্য জায়গায় চলে যাবে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, তুই তো ঠিক লাইনেই ভাবতে পারিস দেখছি। তা হলে তো আমি এবার পুরোপুরি রিটায়ার করলেই পারি। পাথরটা হাতাবার মতলব না থাকলে, অন্য কোনও কারণে যদি পদ্মনাভনকে গুম করে থাকে কেউ, তা হলে সে আর এখানে বসে থাকবে কেন? পদ্মনাভনের হাত-মুখ বেঁধে একটা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত কিছু নয়। তা হলে আর তাকে এখানে খোঁজাখুঁজি করার কোনও মানে হয় না। তবে, আর-একটা প্রশ্ন আসে। পদ্মনাভনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার ঘরে দুবার হামলা হয়েছে। জানলা ভেঙে লোক ঢুকে সারা ঘর তছনছ করছে। কী খুঁজছে তারা? পাথরটা নিশ্চয়ই? আর তো কোনও মূল্যবান জিনিস এখানে থাকার কথা নয়।

সন্তু বলল, দুপুরবেলা শুয়ে-শুয়ে আমি আর-একটা কথা ভেবেছি। এই যে চোরেরা পদ্মনাভনের ঘরে আসছে, এটা পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যও তো হতে পারে? মনে করো, যারা পদ্মনাভনকে চুরি করেছে, তারা উল্কা-পাথটাও পেয়েছে। তারপর সেই জিনিসটা আর পদ্মনাভনকে নিয়ে তারা চলে গেল অনেকদূরে। এখানে দুটো লোককে ঠিক করে গেছে, যারা মাঝে-মাঝে এই ঘরের মধ্যে এসে হামলা করে যাবে। তাতে সবাই ভাববে, ওরা জিনিসটা খুঁজে পায়নি। এই সুযোগে ওরা অনেকদূরে চলে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, তোর মতন এতটা বুদ্ধি কি ওদের আছে? যদি সেরকমই হয়, তা হলে ওদের বেশিদূর যেতেও হবে না। পাশের রাজ্য হচ্ছে অন্ধ্র। সেখানে পালিয়ে গেলে এ রাজ্যের পুলিশ আর খোঁজখবর করবে না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি কাকে ফোন করতে গিয়েছিলে?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, পাঞ্জাবে!

তারপর কিছু না বলে চলে গেলেন বাথরুমে। সন্তু ভেবেই পেলেন না, কাকাবাবু হঠাৎ কেন পাঞ্জাবে ফোন করতে গেলেন। এখান থেকে কতদূর পাঞ্জাব!

একজন বেয়ারা এসে বিকেলের চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। বাইরে আবার বৃষ্টি নেমেছে ঝমঝম করে। আজ আর সমুদ্রের ধারে কেউ বেড়াতে পারবে না।

কাকাবাবু বেরিয়ে আসার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমাকে কি এখানে পুলিশের পাহারায় থাকতে হবে? অম্বরবাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, পুলিশ তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা কী ব্যাপার।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বাইরের পুলিশটি আমাকে সে-কথা বলল বটে। আসলে কী হয়েছিল জানিস, ওই অম্বর বাইরের গেট দিয়ে সোজা ভেতরে আসতে চাইলে বোধ হয় বাধা দিত না। কিন্তু অম্বর বাড়ির পাশ দিয়ে পেছনদিকে আসছিল, পদ্মনাভনের ঘরের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল। তাইতেই পুলিশের সন্দেহ হয়। তখন পুলিশটি গিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করে। তারপর পুলিশের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। অম্বর নিজেই তখন চিঠি লিখে চলে গেছে।

সন্তু অবাক হয়ে বলল, জানলার কাছে উঁকি মারছিল?

কাকাবাবু বললেন, আরও ব্যাপার আছে। আমি যখন এখান থেকে বেরুই, তখন অম্বর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি থানার জানলা থেকেও অম্বরকে দেখেছি। ডি. আই. জি. সাহেবের বাড়ি গেলাম, সেখান থেকে বেরোবার পর দেখি অম্বর রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে গেল। অম্বর আমাকে ফলো করছে নাকি? এ তো মজার ব্যাপার।

চা শেষ করে কাকাবাবু বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আপনমনে বললেন, বিচটা একেবারে ফাঁকা। বৃষ্টিতে আর কেউ বেড়াতে বেরোতে পারছে না। আমরাই বা এখন কোথায় যাব। সন্তু, তুই বরং বাড়িতে চিঠি। লেখ। কিংবা বই পড়।

তারপর ভেতরে এসে বললেন, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না রে! জ্বরটা ছেড়ে গেলেও মাথায় খুব ব্যথা। ভেতরে-ভেতরে ঠাণ্ডা লেগে আছে।

সন্তু বলল, তা হলে তো কলকাতায় ফিরে গেলেই হয়। তুমি কোনও ওষুধ খাচ্ছ না। পদ্মনাভনের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের যদি মাথা ঘামাবার দরকার না থাকে, তা হলে আমাদের কলকাতায় ফিরে যাওয়াই তো ভাল।

কাকাবাবু বললেন, কালকের দিনটা দেখা যাক। তার মধ্যেও শরীরটা ভাল না হলে কলকাতায় চলে যাব।

এর পর দুজনেই দুখানা বই নিয়ে বসল।

এক ঘন্টা পরে একজন পুলিশ এসে কাকাবাবুকে একটা চিঠি দিল। চিঠি পড়ে কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে।

তারপর সন্তুকে বললেন, আজও আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ব। মনে হচ্ছে যেন আবার জ্বর আসছে।

কাকাবাবু আটটার মধ্যে খাবার দিয়ে দিতে বললেন। সন্তুকেও খেয়ে নিতে হল। তারপর কাকাবাবু পোশাক বদলে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বুকের ওপর একটা বই।

এক সময় তাঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেল বইখানা। একটু-একটু নাক ডাকতে লাগল।

শিলিং-এর মাঝখানে একটা মোটে জোরালো আলো। ঘরে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে বটে কিন্তু সেটা খারাপ। সন্তু মুশকিলে পড়ে গেল। আলো জ্বেলে রাখলে কাকাবাবুর ঘুমের অসুবিধে হবে। কিন্তু সন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘুমোবে কী করে?

কাকাবাবু ঘুমের মধ্যে দু-একবার ছটফট করতেই সন্তু নিভিয়ে দিল আলো। অন্ধকার হয়ে গেলেই যেন বাইরের শব্দ বেড়ে যায়। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সে শুনতে লাগল বাইরের বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ।

সেই শব্দ শুনতে-শুনতে, আর অন্ধকারের মধ্যে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে-করতে এক সময় সন্তুরও চোখ জড়িয়ে এল।

আজও সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল মাঝ রাত্তিরে। আজ কোনও হইচই কিংবা গুলির শব্দ হয়নি। কোনও শব্দই নেই। তবু ঘুম ভাঙল কেন সন্তু প্রথমে বুঝতে পারল না।

তারপর তার মনে হল, মাথার কাছে একটা জানলা খোলা, সেখান দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। সন্তু গায়ে কোনও চাদর-টাদর দেয়নি, তাই শীত করছে। তার। জানলাটা খুলে গেল কী করে? কিংবা জানলাটা কি শোবার আগে সে বন্ধ করেছিল? ঠিক মনে পড়ছে না। হঠাৎ জেগে উঠলে আগের কথা মনে আসতে অনেকটা সময় লাগে।

বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া, জানলা বন্ধ করতেই হবে।

সন্তু উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘও কেটে গিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে এর মধ্যে। সমুদ্র যেন এগিয়ে এসেছে খানিকটা

কাছে।

হঠাৎ সন্তু পেছন ফিরে তাকাল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল সঙ্গে-সঙ্গে। কাকাবাবুর বিছানাটা ফাঁকা। কাকাবাবু নেই।
সন্তু আলো জ্বেলেই দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে। বাথরুমের দরজা খোলা। বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ, তবু সন্তু সেই দরজা খুলে একবার দেখল, সেখানেও কেউ নেই।

কাকাবাবুকে কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, এটা সন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন নেই। সেরকম কিছু হলে সন্তুর ঘুম ভাঙত না, তা কি হয়। কাকাবাবুর ক্রাচ জোড়া নেই, জুতো নেই। বালিশের তলায় হাত দিয়ে সন্তু দেখল, রিভলভারটাও নেই।

কাকাবাবু নিজেই কোথাও বেরিয়েছেন এত রাত্রে! সন্তুকে ডাকেননি।

সন্তুর প্রথমে খুব অভিমান হল। এরকম আগে কখনও হয়নি। সন্তুকে বাদ দিয়ে কোথাও যাননি কাকাবাবু। এবার তিনি সন্তুকে অনেক কিছুই বলছেন না। পাঞ্জাবে কাকে টেলিফোন করলেন?

সন্তুর হাঁটুতে অত্যন্ত চোট লেগেছিল বলেই কাকাবাবু এবার বেশ ঘাবড়ে গেছেন। সন্তুর বিশ্রাম নেওয়া দরকার বলেই তিনি নিজের অসুখের ভান করে তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। কাকাবাবু বলেছিলেন, এখানে তাঁদের বিপদের আশঙ্কা আছে, অথচ তিনি এই রাত্তিরে বেরিয়ে গেলেন একা-একা?

ঘরের অন্য দরজাটাও বন্ধ। ইয়েল লক, বাইরে বেরিয়ে টেনে দিলেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। কাকাবাবু খুব সাবধানে আওয়াজ না করে বেরিয়ে পড়েছেন। সন্তু জামাজুতো পরে নিল, চাবিটা পকেটে নিয়ে বাইরে এসে দেখল, বাংলোর সব কটা বারান্দায় আলো জ্বলছে। কোথাও কেউ জেগে নেই। গেটের কাছে একটা টুলে বসে ঘুমে ঢুলছে একজন পুলিশ কনস্টেবল।

কাকাবাবু কোথায় যেতে পারেন, তা সন্তু আন্দাজ করতে পারল না। কোথায় সে কাকাবাবুকে খুঁজতে যাবে?

অভিমানটা যেন বাষ্পের মতন গলা ঠেলে ওপর উঠতে চাইছে। কাকাবাবু তাকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন?

এখন সন্তু একা-একা ঘরে শুয়ে থাকবে নাকি? অসম্ভব!

সামনে দিয়ে বেরুতে গেলে হয়তো পুলিশটি জেগে উঠবে। সন্তু ফিরে এল নিজের ঘরে।

বারান্দার রেলিং টপকে বাগানে নেমে পেছনদিকের গেটটা খুলল নিঃশব্দে। তারপর খুব সাবধানে চারদিকটা দেখে নিল। কোথাও কেউ নেই। বেলাভূমিতেও জনমানবের চিহ্ন নেই। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলেও হাওয়া বইছে খুব জোরে।

সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সন্তু প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেল। ঢেউয়ের মাথায় পর পর কতকগুলো মালা ভেসে আসছে। জ্বলজ্বল করছে মালাগুলো। এত মালা আসছে কোথা থেকে?

তারপর সন্তুর মনে পড়ল, ওগুলো আসলে ফসফরাস। ঢেউয়ের সাদা ফেনায় ফসফরাস মিশে থাকে, দিনের আলোয় দেখা যায় না, অন্ধকারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অনেকদিন সমুদ্রের ধারে আসেনি সন্তু, তাই তার মনে ছিল না।

ব্যাখ্যাটা জানার পরেও মনে হয় সমুদ্রের বুকে ভাসছে শত-শত আলোর মালা। একেবারে তীরের কাছে এসে সেগুলো ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

সন্তু চলে এল একেবারে জলের রেখার সামনে।

আজও অনেক জেলে ডিঙি তোলা আছে পাড়ের ওপর। সেগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সন্তু খানিকটা দূরে একটা আলো দেখতে পেল।

চতুর্দিকে অন্ধকারের মধ্যে আলোর বিন্দু। কৌতূহলী হয়ে সন্তু নৌকোগুলোর আড়ালে-আড়ালে এগোল সেই দিকে।

খানিকটা কাছে যাওয়ার পর সন্তু বুঝতে পারল, জলে একটা মোটর বোট ভাসছে, আলো জ্বলছে তার ভেতরে।

ডাকবাংলোর বেয়ারার সঙ্গে গল্প করতে করতে সন্তু শুনেছিল, এখানে এখন খুব ভাল চিংড়ি মাছ উঠছে বলে বড়-বড় মাছের ব্যবসায়ীরা এসে উপস্থিত হয়েছে। তাদের মোটর বোট আছে। তিন-চারখানা মোটর বোট এখানে ঘোরাঘুরি করে। সমুদ্রের বুকে অনেকখানি বেড়াবার জন্য সেই বোট ভাড়াও পাওয়া যায়। সে-কথা শুনেই সন্তুর খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার বোটে করে সমুদ্রের বুকে বেড়াবার।

পাশাপাশি দুখানা বোট রয়েছে, তার মধ্যে আলো জ্বলছে একটাতে।

আরও কাছে গিয়ে সন্তু শুনতে পেল কারা যেন কথা বলছে একটার ভেতরে। কী বলছে শোনা যাচ্ছে না।

চটপট জুতো খুলে হাতে নিয়ে, প্যান্ট গুটিয়ে সন্তু জলের মধ্যে নেমে পড়ল। ঢেউ-এর শব্দের জন্য জলের মধ্যে তার পায়ের শব্দ কেউ শুনতে পাবে না। বোটের সামনের দিকের ক্যাবিনে আলো জ্বলছে। সন্তু চলে এল তার কছে। খুব সন্তর্পণে কাচের জানলার একপাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, দুজন লোক ভাত খাচ্ছে মুখোমুখি বসে। তাদের মধ্যে একজন লোককে সন্তু আগে কোথাও দেখেছে।

মুখের মাত্র একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে সন্তু, তাই ঠিক বুঝতে পারল না লোকটাকে কোথায় দেখেছে সে। এখানেই, না অন্য কোথাও, কিন্তু চেনা চেনা। লাগছে ঠিকই। গোপালপুরে এসে বেশি লোকের সঙ্গে সন্তুর দেখাই হয়নি!

তা হলে?

একটা বড় ঢেউ এসে ধাক্কা মারতেই বোটটা বেশ দুলে উঠল, সন্তুও পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। প্যান্ট ভিজে গেল অনেকটা। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।

বোটের গা ধরেধরে ফিরে আসতে-আসতে সন্তুর মনে হল, ভেতরে গিয়ে লোকটার মুখ একবার দেখে এলে হয় না?

পরক্ষণেই তার আবার মনে হল, এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যদি সে ধরা পড়ে যায়? কাকাবাবু কিছু জানতে পারবেন না। কাকাবাবু অনেকবার করে বারণ করেছেন তাকে বাইরে যেতে।

হয়তো এটা একটা সাধারণ মাছধরা বোট। ভেতরের লোকটাকে সন্তু কলকাতায় কোথাও দেখে থাকতে পারে। তবু লোকটাকে ভাল করে না দেখে তার কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনের মধ্যে অস্বস্তি থেকে যাবে।

ওই দুটো লোক ছাড়া বোটে আর কেউ নেই মনে হচ্ছে। ওরা ভাত খাওয়ায় ব্যস্ত। সন্তু টপ করে একবার উঠে ভেতরে গিয়ে ভাল করে দেখে আসতে পারে ধরা পড়তে যাবে কেন?

আর দ্বিধা না করে সন্তু খুব আস্তে-আস্তে নিঃশব্দে উঠে পড়ল বোটের ওপর। না দাঁড়িয়ে সে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোতে লাগল সিঁড়ির দিকে। এটা মোটর বোট আর লঞ্চের মাঝামাঝি। ওপরের ডেকে কিছু নেই, নীচে শুধু একটা ক্যাবিন।

সমুদ্রের ঢেউ কখনও থামে না, অনবরত ঢেউয়ের গর্জনে ওপর থেকে নীচের লোক দুটোর কথাবার্তা শোনার কোনও উপায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে পা টিপেটিপে নামল সন্তু। ক্যাবিনের দরজাটা খোলা। লোক দুটো এখনও খাচ্ছে।

একজন লোক সন্তুর অচেনা। বাকি লোকটাকে সন্তুর চিনতে কোনও অসুবিধে হল না। আসামে জাটিংগার পাখি দেখতে যাওয়ার সময় সন্ধেবেলা যে জিপটায় চেপে গিয়েছিল সত্তরা, সেই জিপের ড্রাইভার।

আসামে তাদের খাদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গোপালপুরের পদ্মনাভনের উধাও হওয়ার সম্পর্ক সত্যি তা হলে আছে? আর কোনও সন্দেহ। রইল না! সন্তু লাফ দেওয়ার আগে এই লোকটা তাকে ধরতে এসেছিল। এই লোকটা এখানেও এসেছে।

এক্ষুনি গিয়ে কাকাবাবুকে খবরটা দেওয়া দরকার। পুলিশ এই লোকটাকে ধরতে পারলেই সব খবর বেরিয়ে যাবে। সন্তু একা এখানে কিছু করতে পারবে না।

সন্তুর সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে আসা উচিত, তবু সে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা কী কথা বলছে, তা না শুনে কিছুতেই সে ফিরে যেতে চাইছে না।

ওদের মধ্যে একজন বলল, আজ হাওয়ার খুব জোর। এর মধ্যে বোট চালানো খুব রিস্কি।

অন্য লোকটি বলল, সারাদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি আর ভাল লাগে না। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। আজ আর কি কোথাও যেতে হবে?

ড্রাইভারটি বলল, এখনও বুঝতে পারছি না। আমিও ভাবছি শুয়ে পড়ব। এখানে দুজনের জায়গা হয়ে যাবে।

অন্য লোকটি বলল, হ্যাঁ, হয়ে যাবে কোনওরকমে।

অতি সাধারণ কথাবার্তা। এটা সাধারণ মাছধরা বোটও হতে পারে। আসামের ড্রাইভারটা এখানে এসে কাজ নিয়েছে? তা হলেও ওই লোকটা যে সন্তুকে মারতে গিয়েছিল, তাতে তো সন্দেহ নেই। ওকে পুলিশে ধরাতেই হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়।

সন্তু পেছন ফিরতেই শুনতে পেল ড্রাইভারটি বলছে, শুনছি তো আজকের বেশি আর থাকতে হবে না। কাল পদ্মনাভনকে সরিয়ে দেবে।

পদ্মনাভন! এরা জানে পদ্মনাভন কোথায় আছে। পুলিশ কিংবা কাকাবাবু যা জানতে পারেননি, সন্তু বাইচান্স তা জেনে ফেলেছে।

সন্তু তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ডেকের ওপর মুখ বাড়িয়েই আবার নিচু করে নিল মাথা। সর্বনাশ! দুজন লোক টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে একেবারে বোটের কাছে এসে গেছে।

একজন আলো ফেলল ডেকের ওপর। অন্যজন চেঁচিয়ে ডাকল, বাঘা! বাঘা।

নীচের ক্যাবিন থেকে একজন উত্তর দিল, যাই!

চোখের পলকে রেলিং ধরে গড়িয়ে নেমে এসে সন্তু চলে গেল সিঁড়ির নীচে। সে জায়গাটা ঘন অন্ধকার, কিসের যেন বস্তা রাখা হয়েছে কয়েকটা। আর-একটু হলেই সন্তু ধরা পড়ে যেত। তার বুকটা ধড়ফড় করছে। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। এখান থেকে যে-কোনও উপায়ে পালাতেই হবে।কাকাবাবুকে খবরটা দিতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যাবে সব কিছু।

অন্য লোক দুটো উঠে এসেছে বোটের উপর। সন্তুর নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করল। আর এক মিনিট সময় পেলে সে নেমে পড়ার সময় পেয়ে যেত। ড্রাইভারটিকে চিনতে পারার পরই তার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল।

এঞ্জিনের গোঁ-গোঁ শব্দ শুরু হল। বোটটা এবার স্টার্ট দেবে। সন্তু ভাল সাঁতার জানে। কিন্তু সে যে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারও উপায় নেই। একবার সে উঁকি মেরে দেখল সিঁড়ির ঠিক ওপরেই একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মোটর বোটটা ছুটতে শুরু করল।

এত রাত্রে কি এরা মাছ ধরতে যাচ্ছে? বোটটায় সন্তু মাছধরা জাল দেখতে পায়নি। ভেতরে মাছ-মাছ গন্ধও পায়নি। এরা কোথায় যাচ্ছে কে জানে?

একটুও নড়াচড়া না করে সন্তু নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। ধরা পড়লে আর বাঁচার উপায় থাকবে না। কুমার সিং-এর ড্রাইভার তাকে ঠিক চিনতে পারবে। যারা পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, তারা এখানে তাকে মেরে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। তার দেহটাও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনওদিন। হাঙর-টাঙরেরা খেয়ে ফেলবে। কাকাবাবু জানতেই পারবেন না, সন্তু কোথায় গেল!

মোটর বোটটা তীব্র বেগে ছুটছে। আর লাফাচ্ছে অনবরত। মাঝে-মাঝে জলের ঝাপটা চলে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ভিজে যাচ্ছে সন্তুর সারা গা, ওপরে লোকগুলো কী যেন কথা বলছে, শোনা যাচ্ছে না কিছুই।

কতক্ষণ ধরে বোটটা চলছে তা বুঝতে পারছে না সন্তু। মনে হচ্ছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা। হয়তো অতটা নয়, তবু একভাবে একটুও নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে তার এক-একটা মিনিটকেই এক ঘন্টা বলে মনে হচ্ছে। হাঁটুর কাছটা চুলকোচ্ছে, কিন্তু নিচু হতেও সাহস করছে না সন্তু।

কেউ একজন নামছে সিঁড়ি দিয়ে। পাতলা কাঠের সিঁড়ি, মাঝখানে ফাঁক-ফাঁক। সিঁড়ির পেছনে জায়গাও খুব কম। লোকটার পা সন্তুর গায়ে লেগে যেতে পারে। সন্তু নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কিন্তু তার বুকের মধ্যে ধৰ্ধক আওয়াজটা কি শোনা যাবে।

এই সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় পেছন ফিরে নামতে হয়, আর ওঠবার সময় সামনের দিকে ফিরে। এবার হয়তো লোকটা সন্তুকে দেখতে পাবে না, কিন্তু ওঠবার সময়?

ধরা পড়ে গেলে সন্তু কী দিয়ে লড়াই করবে? হাতের নখ আর দাঁত ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র নেই তার কাছে। এদের হাতে মরার চেয়ে যে-কোনও উপায়ে সে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করবে। তারপর যা হয় হোক। কিন্তু এরা চারজন।

হঠাৎ এঞ্জিনের আওয়াজটা থেমে গেল। সমুদ্রের বুকে এতদূর এসে এরা থামছে কোথায়? এখানে কোনও দ্বীপ আছে? গোপালপুরের কাছাকাছি কোনও দ্বীপের কথা সন্তু শোনেনি।

যে-লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল, সে আবার দুপদাপ করে ওপরে উঠে গেল। সে একটু ভাল করে তাকালেই সন্তুকে দেখতে পেয়ে যেত। কিন্তু সে কিছুই সন্দেহ করেনি।

বোটটা একেবারে থেমে গেছে। কয়েকজন নামছে মনে হল। সন্তু তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে। সবাই নেমে যাচ্ছে কি না আগে বোঝ দরকার।

মিনিট পাঁচেক পরে আবার একজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে ক্যাবিনের মধ্যে ঢুকে গেল। ওপরে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার একটা ঝুঁকি নিতেই হবে।

সন্তু টপ করে সিঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওপরের ডেকে উঁকি মারল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্তু এক দৌড়ে সামনের দিকে চলে এসে একটা লাফ মারতে গিয়েও থেমে গেল।

মোটর বোটটা জলে ভাসছে বটে, কিন্তু একটু দূরেই তীর দেখা যাচ্ছে। সন্তু জলের মধ্যে লাফ দিলে ঝপাং করে শব্দ হবে। ক্যাবিনের ভেতরের লোকটা সেই শব্দ শুনে ফেলতে পারে। অন্য লোকগুলো নেমে চলে গেছে, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না।

সন্তু লাফ না দিয়ে বোটটার একদিক ধরে ঝুলে পড়ে খুব আস্তে জলে নামল। তারপর একটু হেঁটে ডাঙায় পৌঁছেই একটা দৌড় লাগাল।

মুক্তি! মুক্তি! ওরা তাকে ধরতে পারেনি। আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না।

এই জায়গাটা গোপালপুর থেকে যতই দূরে থোক, দিনের আলো ফুটলে সন্তু ঠিকই ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় খুঁজে পাবে। রাত্তিরটা তাকে লুকিয়ে কাটাতে হবে। যতদূর সম্ভব সরে যেতে হবে এই লঞ্চ থেকে।

এখানকার আকাশে মেঘ বিশেষ নেই। খানিকটা জ্যোৎস্না ফুটেছে। জায়গাটা ঠিক কী রকম, তা সন্তু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল।

এটা কোনও দ্বীপ কিনা তা বোঝা গেল না। বেলাভূমির বেশ কাছেই পর পর সার দেওয়া অনেকগুলো বাড়ি। পঞ্চাশ-ষাটটা তো হবেই। একটু কাছে গিয়ে সন্তু যে কটা বাড়ি দেখতে পেল, সবগুলো ভাঙা। কোনওটার দেওয়াল ধসে গেছে, কোনওটার ছাদ নেই, কোনও বাড়িতেই মানুষ আছে বলে মনে হয় না।

গোপালপুরেও এরকম কিছু ভাঙা বাড়ি দেখেছে সন্তু। যারা সমুদ্রের খুব কাছে বাড়ি বানিয়েছিল, কোনও একদিন সমুদ্র প্রবল উত্তাল হয়ে এগিয়ে এসে ঢেউয়ের ধাক্কায় তাদের বাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এখানেও বোধ হয় এক সময় গোপালপুরের মতন একটা শহর গজিয়ে উঠেছিল, সমুদ্র হঠাৎ একদিন এগিয়ে এসে দিয়েছে সব লণ্ডভণ্ড করে। সমুদ্র তার সীমানার ওপর হস্তক্ষেপ সহ্য করে না।

এর যে-কোনও একটা ভাঙা বাড়িতে সন্তু রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে। রাত্তিরে আর কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না। কাল সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাকাবাবুকে খবরটা দিতে হবে।

একটা ভাঙা বাড়িতে ইট-ফিট সরিয়ে সন্তু সবেমাত্র বসেছে, এই সময় দেখতে পেল একজন লোক আবার বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বোটটার দিকে। লোকটা বোটের ওপর উঠে গেল। এক মিনিট বাদেই কিছু একটা জিনিস নিয়ে নেমে এল আবার।

চাঁদের আলো লোকটার মুখে পড়েছে। সন্তুর চিনতে কোনও কষ্ট হল না। কুমার সিং!

এই লোকটা কাকাবাবুকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল। সন্তুর কাছে যদি এখন রিভলভার থাকত তা হলে সে ঠিক লোকটাকে গুলি করত।

এরা সবাই এখানে আড্ডা গেড়েছে। এতগুলো বাড়ির মধ্যে কোনটাতে ওরা লুকিয়ে আছে তা জানা দরকার। পুলিশ ডেকে এনে একটা-একটা করে বাড়ি খুঁজে দেখতে গেলে ওরা তার মধ্যে পালাবে।

সন্তু বেরিয়ে এসে কুমার সিংকে অনুসরণ করতে লাগল।

মাঝে-মাঝে সে পেছনদিকটাও দেখে নিচ্ছে। কিছুতেই সে ধরা দেবে না। চিহ্নগুলোও মনে রাখছে ভাল করে।

এটা একটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর। শুধু যে সামনের দিকের বাড়িগুলোই ভেঙেছে তা নয়, পেছনদিকেও সব বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে খুব সম্ভবত সমুদ্রের ঢেউ এখানেও বাড়িগুলোর ওপরে এসে পড়ে। তাই কেউ আর সারাবার চেষ্টা করেনি। গোটা শহরটাই পরিত্যক্ত।

কুমার সিং অনেকগুলো বাড়ির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে বাড়িটার দরজা বলে কিছু নেই। পুরো দোতলাটাই ভেঙে পড়েছে সামনের দিকে। এক সময় বেশ বড় বাড়ি ছিল বোঝা যায়। হোটেল-টোটেলও হতে পারে।

সন্তু চলে গেল পেছনদিকে।

ভেতরের কোনও একটা ঘর বোধ হয় আস্ত আছে, সেখান থেকে একটা আলোর শিখা আসছে।

বাড়িটা চেনা হয়ে গেল, এখন সন্তুর ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু ওই ঘরটার মধ্যে কে-কে রয়েছে তা দেখার দারুণ কৌতূহল কিছুতেই দমন করতে পারল না সন্তু। এখানে চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে গেছে, অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

সন্তু একটু-একটু করে এগিয়ে গেল ভেতরে।

যে ঘরে আলো জ্বলছে সে ঘর থেকে কিছু কথাবার্তাও ভেসে আসছে।

এ বাড়ির দোতলাটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেও ওপরে ওঠার সিঁড়িটা রয়ে গেছে। সন্তু পা টিপেটিপে সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। তারপর শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। ঘরের ছাদটায় একটা ফুটবলের মতন গোল গর্ত হয়ে আছে। সেখান দিয়ে ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়।

একদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে একজন লম্বা মতন লোক। হাত-পা বাঁধা, মুখে দশ-বারো দিনের দাড়ি, মাথার চুল উসকো-খুসকো। এই

তা হলে পদ্মনাভন! কাকাবাবুর আগে সই পদ্মনাভনের হদিস পেয়ে গেল।

পদ্মনাভনের সামনে টুলের ওপর বসে আছে একজন তোক। তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সন্তু। সেই লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুমার সিং।

সেই লোকটি হিন্দিতে কুমার সিংকে জিজ্ঞেস করল, রাও এল না?

কুমার সিং বলল, উনি মোটর বোটে এলেন না। গাড়িতে আসছেন।

লোকটি বিরক্তভাবে বলল, কেন, বোটে এল না কেন? জায়গা তো ছিল!

কুমার সিং বলল, আজ খুব হাওয়া দিচ্ছে। সমুদ্র খুব রাফ। তাই উনি বোটে আসতে ভয় পেলেন। সেইজন্য গাড়িতে আসবেন।

লোকটি বলল, রাও একটা ভিতুর ডিম। গাড়িতে আসবে তো এত দেরি করছে কেন? আজ রাতেই এখান থেকে হায়দরাবাদ চলে যাব। জায়গাটা খুব হট হয়ে উঠছে।

তারপর লোকটি পদ্মনাভনের দিকে ফিরে বলল, শুনলে তো? আজ রাতেই আমরা এ জায়গা ছেড়ে চলে যাব। যথেষ্ট হয়েছে। দিনের পর দিন কাজ নষ্ট।

পদ্মনাভন কোনও কথা বললেন না। লোকটি আবার বলল, পাথরটা কোথায় আছে বলবে? না মরবে?

পদ্মনাভন বললেন, পাথরটা নেই, এ-কথা কতবার বলব! আমার কাছেও নেই। তোমরা আমার ঘর খুঁজে দেখেছ, সেখানেও নেই।

লোকটি বলল, কোথাও বালির মধ্যে পুঁতে রাখতে পারো। সেই জায়গাটা বলে দাও, তোমাকে ছেড়ে দেব। পাথরটা চাই, তোমাকে মারতে চাই না।

পদ্মনাভন বললেন, আমি কি তোমার মতন বোকা যে, এই কথা বিশ্বাস করব? পাটা পেলেও তুমি আমাকে মারবে তা জানি। পাথরটা তুমি পাবে না। সেটা আমি নষ্ট করে ফেলেছি। ওটা ঝুটো পাথর।

লোকটি বলল, পাঁচ হাজার টাকায় কিনে তুমি পাথরটা নষ্ট করে ফেলেছ? কী করে নষ্ট করলে? সেটা আমাকে দেখাও।

পদ্মনাভন এবার বেশ তেজের সঙ্গে বললেন, ওরে গাধা, আমি কি তোর মতন মিথ্যে কথা বলি? বলছি নষ্ট করে ফেলেছি, সত্যি নষ্ট করেছি। ওটা তুই কিছুতেই পাবি না।

কুমার সিং বন্দী পদ্মনাভনকে এক লাথি মেরে বলল, আমাদের মালিককে তুই গাধা বলছিস। তোকে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব!

পদ্মনাভন বললেন, যেভাবেই আমাকে মারো, পাথরটা পাবে না।

সেই লোকটি বলল, কীভাবে মারব, বলে দিচ্ছি। এখন তোমার শরীরে ইঞ্জেকশান দিয়ে চারগুণ ঘুমের ওষুধ ভরে দেব। তুমি আরামসে ঘুমোবে। তারপর তোমাকে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দিয়ে আসব। ঘুমোতে-ঘুমোতেই তুমি মরে যাবে জলে ড়ুবে। জলের প্রাণীরা যদি তোমার শরীরটা খেয়ে নাও ফেলে, ভাসতে ভাসতে তীরে এসে লাগে, তা হলেও খুনের কোনও চিহ্ন থাকবে না। হাত-পা বাঁধাও থাকবে না। পুলিশ ভাববে, তুমি নিজেই সমুদ্রে ড়ুবে গেছ। অ্যাকসিডেন্ট। আমরা গোপালপুরের দিকে না গিয়ে এখান থেকেই চলে যাব।

পদ্মনাভন বললেন, এটা তো বেশ ভাল ব্যবস্থা। আমার কোনও কষ্ট হবে। রাজীব, তোের এই গুণ্ডাটাকে বারণ কর আমাকে লাথি মারতে।

লোকটি বলল, যতই সাহসের বড়াই করো, আজ তোমার শেষ রাত।

তারপর সে কুমার সিংকে জিজ্ঞেস করল, ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ আনতে মাধব রাও এত দেরি করছে কেন?

কুমার সিং বলল, সিরিঞ্জ আমিই এনেছি, সার।

লোকটি বলল, তা হলে কাজ সেরে ফেলা যাক। আমি ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিচ্ছি, তোমরা একে বোটে করে সমুদ্রের অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দাও। কই দেখি সিরিঞ্জ আর অ্যামপিউল।

সন্তুর গলা শুকিয়ে গেছে। এরা সত্যি-সত্যি পদ্মনাভনকে মেরে ফেলবে? কোনওরকমে আটকানো যায় না?

ওদের কথা থেমে গেছে। ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিল নাকি?

উত্তেজনা দমন করতে না পেরে সন্তু গর্তটার মধ্যে মুখ বাড়াবার চেষ্টা করতেই একটা কাণ্ড হল।

সেই গর্তের পাশটা ফেটে গিয়ে ছাদের খানিকটা অংশ সন্তুকে নিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল নীচে। পড়তে-পড়তেও সন্তু একটা রড ধরে ঝুলবার চেষ্টা করল, পারল না।

পড়ার পর বেশি চোট না লাগলেও উঠে দাঁড়াবার সময় পেল না সন্তু, কুমার সিং দৌড়ে এসে তার টুটি চেপে ধরল।

রাজীব নামের লোকটি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ আবার কে? ছাদে উঠে বসে ছিল?

কুমার সিং বলল, এই বিচ্ছুটা রাজা রায়চৌধুরীর সঙ্গে ছিল। ওর ভাইপো হয়।

রাজীব বেশ ভয় পেয়ে বলল, মাই গড! তা হলে সে লোকটাও এসে পড়েছে নিশ্চয়ই। সে লোকটা তো জাদুকর। কিছুতেই মরে না।

কুমার সিং বলল, না, রাজা রায়চৌধুরী কী করে আসবে? তাকে আমি দেখেছি, রাত বারোটার সময় সি ফ্রন্ট হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। নিজের চোখে দেখেছি। সে আমায় দেখতে পায়নি। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই আমাদের বোটের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল।

রাজীব গর্জন করে উঠল, অপদার্থের দল। মোটর বোটে কেউ লুকিয়ে থাকে কি না, তা ভাল করে দেখে নিতে পারো না? এখন এ ছেলেটাকে নিয়ে

কী করা যায়?

কুমার সিং বলল, পাহাড়ের খাদে পড়ে গিয়েও মরেনি। আর চান্স নেওয়া উচিত নয়। সার, এর গলা মুচড়ে শেষ করে দেব?

রাজীব বলল, না, না, আমি এখানে খুনের কোনও চিহ্ন রাখতে চাই না। একেও ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেকশান করে দিলেই হয়। তারপর জলে ফেলে দেব। দুজনকে এক জায়গায় ফেলবে না। অন্তত চার-পাঁচ মাইল দূরে।

সন্তু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারল না। কুমার সিং তার দুহাত মুচড়ে পেছনে নিয়ে এসে এক হাতে তার গলাটা টিপে রেখেছে। কুমার সিং-এর সঙ্গে জোরে সে পারবে না, তার নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে।

কুমার সিং-এর ড্রাইভার এর মধ্যে এক কলসি জল নিয়ে এল।

রাজীব বলল, আমাকে গেলাসে জল দে তো, তারপর কাজ শেষ করে ফেলব।

জল খেয়ে নিয়ে রাজীব সিরিঞ্জে ওষুধ ভরল।

পদ্মনাভন সন্তুর দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ধন্যবাদ; যুবক। তুমি আকাশ থেকে খসে পড়লে, তার ফলে আমি অন্তত পাঁচ মিনিট বেশি বেঁচে গেলাম। না হলে আগেই এরা আমাকে শেষ করে দিত।

তারপর রাজীবের দিকে ফিরে বললেন, রাজীব শর্মা, তুমি এক সময় বিজ্ঞানী ছিলে, এখন মানুষ খুন করতে যাচ্ছ? তুমি এত নীচে নেমে যাবে? পুলিশ তোমাকে ধরতে না পারলেও তুমি নিজে তো জানবে তুমি খুনি। সারা জীবন পাপী থেকে যাবে।

রাজীব বলল, এখন নিজের প্রাণের ভয়ে ওসব বড়-বড় কথা বলছ। একদিন ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে, মনে নেই?

পদ্মনাভন বললেন, তুমি পর পর কয়েকটা কাজে ভুল করেছিলে, তারপরেও আমার মুখে-মুখে তর্ক করেছ, তাই তোমাকে বকেছি। তোমাকে তো তাড়িয়ে দিইনি। তুমি নিজেই চলে গেলে।

রাজীব বলল, তুমি আমাকে টিকতে দাওনি। তুমি স্বার্থপর। তুমি কক্ষনো চাওনি যে, অন্য কারুর সুনাম হোক। শুধু নিজে বিখ্যাত হতে চেয়েছিলে।

পদ্মনাভন বললেন, কাজে ভুল করলে নাম করবে কী করে? সে যাই হোক, ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে গিয়ে তোমার ক্ষতি কিছু হয়নি। তুমি ব্যবসা করে এর মধ্যেই বিরাট বড়লোক হয়েছ শুনেছি। তবু আমার ওপর এত রাগ?

কুমার সিং বলল, সার, এইসব কথা বলে লোকটা দেরি করিয়ে দিচ্ছে।

রাজীব বলল, ঠিক বলেছ। ওর কোনও চালাকি আর শুনছি না। ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিচ্ছি। বাঘা, ওকে চেপে ধরে থাক তো।

পদ্মনাভন বললেন, ঠিক আছে। আমাকে মারতে চাও যখন, মারো। কিন্তু এই ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। অতটুকু ছেলে, ওর জীবনের আরও কতখানি বাকি আছে। ওকে মেরো না!

রাজীব বলল, ছেড়ে দেব! আর বেরিয়ে গিয়ে ও সব বলে দেবে না?

পদ্মনাভন বললেন, তোমাদের ও চেনে না। তোমরা পালিয়ে গেলে ও যাকে যাই বলুক, তাতে তোমাদের কোনও ক্ষতি হবে না। ওকে ছেড়ে দাও,

আমি পাথরটার সন্ধান তোমাদের বলে দিচ্ছি।

সন্তু চমকে পদ্মনাভনের দিকে তাকাল। উল্কা-পাথরটা তা হলে নষ্ট হয়নি! সেটা এখনও লুকোনো আছে।

রাজীব বলল, পাথরটা আমাকে দেবে? কোথায় আছে সেটা?

পদ্মনাভন বললেন, আমার ঘরের কার্পেটের তলায় ভাল করে খুঁজে দেখো!

রাজীব শর্মা এবার হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর হিংস্র গলায় বলল, পদ্মনাভন, তুমি আমাদের অত মুখ ভেবেছ? তোমার ঘর অনেকবার খুঁজে দেখা হয়েছে। কার্পেটের তলায় অতবড় একটা পাথর থাকবে?

বাঘা এসে পদ্মনাভনের দু হাত চেপে ধরল। সিরিঞ্জটা উঁচু করে তুলল রাজীব শর্মা।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা গুলির শব্দ হল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রাজীব শর্মা।

তারপর হাত বাঁধা একটা লোককে কেউ ঠেলে ফেলে দিল ঘরের মধ্যে। তার পেছনে রিভলভার হাতে কাকাবাবু।

হাত বাঁধা লোকটাকে দেখে চমকে উঠল সন্তু। দাড়িওয়ালা জজসাহেব!

কাকাবাবু রিভলভারটা সকলের দিকে ঘুরিয়ে তীব্র গলায় বললেন, কেউ একটু নড়লেই সোজা গুলি চালাব। কোনওরকম দয়া-মায়া করব না। তোমরা সবাই অমানুষ!

কুমার সিং সন্তুকে ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। রাজীব শর্মার হাতে গুলি লেগেছে, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে।

কাকাবাবু ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বললেন, পদ্মনাভন, তুমি বিপদ নিয়ে খেলা করার অভ্যেসটা এখনও ছাড়লে? এ যে সাঙ্ঘাতিক খেলা।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী? তুমি ঠিক সময়ে এসে পড়লে? এবারেও তা হলে বেঁচে গেলাম? এই রাস্কেলগুলোর হাতে আমার একটুও মরতে ইচ্ছে করছিল না। এই জায়গাটার সন্ধান পেলে কী করে?

মাটিতে পড়ে থাকা জজসাহেবের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাকাবাবু বললেন, এই মাধব রাও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল?

সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, কাকাবাবু! সাবধান!

কুমার সিং কাকাবাবুর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে একটা লোহার রড দিয়ে মারতে গেল। সন্তু লাফিয়ে উঠেও তাকে ধরতে পারল না। কাকাবাবু ঘুরে দাঁড়াবার আগেই কুমার সিং লোহার রড দিয়ে মারল কাকাবাবুর হাতে। রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল ঘরের এককোণে।

কুমার সিং চেঁচিয়ে বলল, বাঘা, ওটা ধর ধর।

এই সময় নাটকের মতন একটা কাণ্ড হল। বাইরে থেকে আর-একজন লোক লাফিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। বাঘাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে রিভলভারটা তুলে নিল সে।

পীতাম্বর পাহাড়ী ওরফে অম্বর! তার কাঁধে পরিচিত ঝোলা।

অম্বর রিভলভারটা নাচাতে-নাচাতে বলল, সাবধান! সাবধান! আমি কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট! কেউ বেগড়বাঁই করলেই গুলি মারব! কাকাবাবু আর সন্তু ছাড়া আর যাকে-তাকে গুলি মারব!

তার হাতটা এমন থরথর করে কাঁপছে দেখেই বোঝা যায় সে জীবনে কখনও। রিভলভার ধরেনি। তবু সে সেটা নিয়ে লাফাচ্ছে আর বলছে, সাবধান! সাবধান।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়াবার সময় ক্রাচ দুটো ফেলে দিলেন। তারপর অম্বরকে আদেশের সুরে বললেন, অম্বর, তুমি ওটা সন্তুর হাতে দিয়ে দাও।

কাঁপা কাঁপা হাতে সন্তুকে দিতে গিয়ে অম্বর রিভলভারটা মাটিতে ফেলে দিল। আবার ঘরের মধ্যে শুরু হয়ে গেল একটা হুটোপুটি। সন্তু পা দিয়ে রিভলভারটা সরিয়ে দিল অনেক দূরে।

কুমার সিং লোহার রডটা তুলে এবার সরাসরি মারতে গেল কাকাবাবুর মাথায়।

কাকাবাবু সোজা তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুটো হাত তুললেন মাথার ওপর। কাকাবাবুর একটা পা ভাঙা, কিন্তু তাঁর দু হাতে কতখানি জোর,

তা অন্য লোকে বুঝতে পারে না। রাগে তাঁর মুখখানা লাল হয়ে গেছে।

কুমার সিং খুব জোরে মারলেও কাকাবাবু রডটা ধরে ফেললেন। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সেটা। তারপর কুমার সিং-এর একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন।

ধোপারা যেমনভাবে কাপড় কাচে, সেইভাবে কাকাবাবু কুমার সিংকে শূন্যে তুলে এক আছাড় মারলেন। প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হল। মনে হল, যেন কুমার সিং-এর মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

কাকাবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আমার দিকে রিভলভার তুলেছিলে, আমাকে লাথি মেরে খাদে ফেলে দিয়েছিলে, আবার আমার হাতে মেরেছ, তোমাকে আমি এমন শাস্তি দেব-

অম্বর বাঘাকে দুটো ঘুসিতে কাত করে চলে এসেছে কাকাবাবুর পাশে। কাকাবাবু রাগের চোটে আবার কুমার সিংকে শূন্যে তুলে আছাড় মারতে গেলেন।

এবার অম্বর কাকাবাবুর কাঁধ চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, কী করছেন? ও যে মরে যাবে! ছেড়ে দিন, ওকে এবার আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি ওকে কী শাস্তি দিই দেখুন!

কাকাবাবু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন। সত্যিই তো, আর-একবার আছাড় দিলে লোকটা শেষ হয়ে যাবে। তিনি কুমার সিংকে আস্তে নামিয়ে দিলেন মাটিতে।

কুমার সিং-এর মাথা ফেটে চৌচির হয়নি, কিন্তু লেগেছে প্রচণ্ড। একদিকের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ভয়ে মুখখানা চুপসে গেছে তার। সে ভেবেছে, কাকাবাবুর বুঝি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিছুতেই তাঁকে মারা যায় না।

কাঁধের ঝোলাটা থেকে একটা ছোট্ট বেতের বাক্স বের করল অম্বর। তার ঢাকনা খুলতে-খুলতে সে বলল, আমি কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট! এবার তোমার কী অবস্থা করি দ্যাখো! অন্য লোককে মারতে তোমার হাত কাঁপে না, তাই না?

বেতের বাক্সটা থেকে ফস করে একটা সাপ বের করে সে ছুঁড়ে দিল কুমার সিং-এর গায়ে। সে বিকট চিৎকার করে উঠল। বলতে লাগল, বাঁচাও! বাঁচাও!

সাপটা বেশ বড়। ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করতে-করতে সেটা জড়িয়ে ধরল কুমার সিংকে।

অন্য সবাই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল।

সন্তু ফ্যাকাসে মুখে বলল, এ কী করলেন? ওকে সাপে কামড়ে দেবে?

অম্বর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওটার বিষ দাঁত নেই। আমি ভেঙে রেখেছি। এই সাপটা আমি সব সময় সঙ্গে রাখি লোককে ভয় দেখাবার জন্য।
পদ্মনাভন ব্যায়ামের ভঙ্গিতে হাত দুটো ছুঁড়তে-ছুঁড়তে বললেন, ওফ, সারা গায়ে ব্যথা হয়ে গেছে।

ভাঙা বাড়িগুলোর বাইরে ফাঁকা জায়গায় বালির ওপর বসেছেন কাকাবাবু। সন্তু আর অম্বর তাঁর দুপাশে। এখন জ্যোৎস্না অনেক স্পষ্ট। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় দুলছে অনেক ফসফরাসের মালা। ঢেউগুলো ভেঙে পড়ছে ওদের খুব কাছে এসে, মালাগুলো টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে জোনাকির মতন।

পদ্মনাভন আবার বললেন, এবার ভেবেছিলাম আর আশা নেই। আর কয়েক মিনিট দেরি হলেই ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে আমাদের সমুদ্রে ফেলে দিত। তুমি একেবারে ঠিক সময়ে কী করে এলে, রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু বললেন, আর-একটু আগে আসতে পারতাম। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে খানিকটা সময় চলে গেল। এমন সব অদ্ভুত নিয়মকানুন ওদের। এই জায়গাটা ওড়িশার বাইরে, অন্ধ্রপ্রদেশে। আমি ওড়িশার গোপালপুর থেকে একটা পুলিশের গাড়ি আর তিনজন পুলিশ সঙ্গে এনেছি। তারা এদিকে এসে বলে যে, অন্ধ্রের পুলিশকে আগে খবর দেওয়া দরকার। আমি বললাম, পরে খবর দেবে! ওরা বলল, আগে খবর না দিলে সেটা বেআইনি হবে। বুঝে দ্যাখো ব্যাপার! খবর দিতে-দিতে যদি আসামি পালিয়ে যায়? কিংবা আরও সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটে যায়। তখন আমি পুলিশদের বললাম, ঠিক আছে, তোমরা অন্ত্রের পুলিশদের খবর দাও, ততক্ষণ আমি একাই এগোচ্ছি।

দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুখানা পুলিশের জিপ। রাজীব শর্মা আর তার দলবলকে বেঁধে পুলিশরা একখানা গাড়িতে ভরছে। কুমার সিং-এর গা থেকে। সাপটাকে তুলে এনে অম্বর আবার সেটাকে রেখে দিয়েছে বেতের বাক্সটাতে।

পদ্মনাভন জিজ্ঞেস করলেন, মাধব রাও-কে তুমি কোথায় পেলে? মাধব রাও যে এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে, সেটা আমি জানতাম না! ছি ছি ছি, ওর মতন লোকও খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে!

কাকাবাবু বললেন, ওই মাধব রাও এক রিটায়ার্ড জজ সেজে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি ওঁকে কী করে সন্দেহ করলে? আমার তো সব সময়েই মনে হয়েছে, উনি নিরীহ ভালমানুষ!

অম্বর বলল, আমিও তো তাই ভেবেছি।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, রিটায়ার্ড জজ পি. কে. দত্ত আর পীতাম্বর পাহাড়ী—এই দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আসামে। আবার তিনদিন পরেই এই দুজনকে দেখা গেল গোপালপুরে। এটা সন্দেহজনক নয়? মনে হয় না, এই দুজনেই এক দলের?

অম্বর প্রায় ব্যথা পাওয়ার সুরে বলল, সে কী, কাকাবাবু? আমাকে সন্দেহ করেছিলেন? আমি তো আপনার ভক্ত।

কাকাবাবু বললেন, তবু, একটি বাঙালির ছেলে আসামের জঙ্গলে বিষাক্ত সাপ ধরে বেড়াচ্ছে, এটা বিশ্বাস করা শক্ত নয়?

অম্বর বলল, এখন দেখলেন তো, আমার সঙ্গে সবসময় একটা সাপ থাকে? বন্দুক-পিস্তলের চেয়েও এটা বেশি কাজে লাগে! এখানে এলাম আপনাদের দেখা পাওয়ার জন্য, আর আপনারা আমাকে এড়িয়ে-এড়িয়ে চলতে লাগলেন। আমি ঠিক করেছিলুম, আপনাদের একটা অ্যাডভেঞ্চারে আমি সঙ্গী হব। দেখলেন তো, ঠিক হয়ে গেলুম! আমি আপনাকে সব সময় ফলো করেছি। ফলো করতে করতে এখানে পৌঁছে গেছি!

কাকাবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, অম্বর। থ্যাঙ্ক ইউ! তোমাকে সন্দেহ করাটা আমার ভুল হয়েছে। রিটায়ার্ড বিচারকমশাইকে কখন সন্দেহ করলাম জানো? তার একটা কথায় আমার খটকা লেগেছিল। শিলচরে ও ডাক্তার ভার্গবের কাছে বলল, পাহাড়ের খাদে আমাকে আর সন্তুকে হাত আর মুখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। সন্তুর হাত-মুখ বাঁধা ছিলই না। আমার যে মুখ বাঁধা ছিল, সেটা ও জানল কী করে? অম্বর আসবার আগেই আমার মুখের বাঁধন খুলে গিয়েছিল। আমি অম্বরকে কিছু বলিনি, অম্বরও জজসাহেবকে কিছু বলেনি। তা হলে? আমাদের যে হাত-মুখ বেঁধেই ফেলে দেওয়া হবে, সেই প্ল্যানটাই ও জানত আগে থেকে? তা ছাড়া, শিলচরে গিয়ে ও ডাক্তার ভাবের কাছে থাকার জন্য আমাদের জোর করছিল। ওখানে আমাদের আটকে রাখাই ছিল ওর মতলব।

পদ্মনাভন বললেন, মাধব রাও রিটায়ার্ড জজ না ছাই। ও তো একজন জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট!

কাকাবাবু বললেন, সেটাও আমি জানলাম এখানে এসে। জজসাহেবরা রিটায়ার করলেও লোকে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কেউ তাদের ক্রিমিন্যাল বলে সন্দেহ করে না। পুলিশও খাতির করে তাদের। সেইজন্য বুদ্ধি করে ও রিটায়ার্ড জজ সেজেছিল। দত্ত পদবীটা বাঙালিদের হয়, অসমিয়াদের হয়, পাঞ্জাবিদেরও হয়।

অম্বর ফস করে বলল, ঠিক বলেছেন। ফিল্মস্টার ছিল সুনীল দত্ত, সে তো পাঞ্জাবি!

কাকাবাবু বললেন, আমি কলকাতায় ফোন করে হাইকোর্টের সমস্ত জজদের একটা লিস্ট চাইলাম। তখন জানা গেল যে, পি. কে. দত্ত নামে কোনও জজ এদিকে নেই। পাঞ্জাবে একজন ছিলেন, সদ্য রিটায়ার করেছেন। তখন ফোন করলাম পাঞ্জাবের অমৃতসরে। সেখান থেকে খবর পেলাম, রিটায়ার্ড জজ পি. কে, দত্ত অত্যন্ত অসুস্থ, তিনি আছেন হাসপাতালে। তখন সব ফাঁস হয়ে গেল।

পদ্মনাভন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওর পিছুপিছু এখানে চলে এলে?

কাকাবাবু বললেন, তোমাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, তা জানা যাচ্ছে। তখন আমি ঠিক করলাম এই নকল জজসাহেবটা যদি ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকে, তা হলে ও কোনও-না-কোনও সময়ে তোমার কাছে যাবেই। সুতরাং ওকে ফলো করলে তোমার হদিস পাওয়া যেতে পারে। আজ রাত্তিরে ও একটা গাড়ি নিয়ে বেরোতেই আমি কয়েকটা পুলিশ সঙ্গে নিয়ে ওর পিছু ধাওয়া করলাম। রাস্তা দারুণ খারাপ, গাড়ি চলেছে খুব আস্তে-আস্তে, তাই আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হয়েছে, যাতে ও টের না পায়

অম্বর হেসে বলল, ভাগ্যিস রাস্তা খারাপ ছিল! তাই আমি সাইকেলে আপনাদের সঙ্গে-সঙ্গে ঠিক এসে পড়েছি। কাকাবাবু, আপনি নকল জজকে ফলো করেছেন, সে টের পায়নি। আর আমিও যে আপনাকে ফলো করছি, তা আপনিও টের পাননি!

কাকাবাবু বললেন, সত্যি, তোমার এলেম আছে।

পদ্মনাভন বললেন, মাধব রাও এই খুনিদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল! দ্যাখো রায়চৌধুরী, রাজীব শর্মার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল, সে দোষ করেছিল বলে তাকে আমি গালাগালি দিয়েছিলাম, এজন্য আমার ওপর তার রাগ আছে। এর আগেও সে দু-একবার আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে! কিন্তু মাধব রাও! আমি কখনও তার কোনও ক্ষতি করিনি। এক সময় সে আমার সঙ্গে কাজ করেছে, তারপর নিজেই ছেড়ে চলে গেছে। বিশ্বাস করো, আমি ওর সঙ্গে কোনওদিন খারাপ ব্যবহার করিনি! তবু আমার ওপর ওর অসম্ভব হিংসে ছিল। আমার খ্যাতি হচ্ছে, ওর কেন ততটা হচ্ছে না। শুধু এই হিংসেতেই মানুষ এমন পাগল হয়ে যায়? আমাকে খুন করতেও ওর আপত্তি নেই!

কাকাবাবু বললেন, শুধু তোমাকে কেন? ও তো সন্তু আর আমাকেও খুন করতে চেয়েছিল। রাজীব শর্মার সঙ্গে ও হাত মিলিয়েছে। তারপর রাজীব ভার নিয়েছে তোমাকে সরাবার, আর মাধব রাও ভার নিয়েছে আসামে আমাদের সরিয়ে দেওয়ার। লোকটা কিন্তু এমনিতে খুব ভিতু। এখানে গাড়ি থেকে নামবার পর যেই আমি ওর মাথার পেছনে রিভলভার ঠেকালাম, ও ভয় পেয়ে হাউমাউ করে উঠল। স্বীকার করে ফেলল সব। আবার বলে কী, আমাকে আর সন্তুকে একেবারে খুন করার ইচ্ছে ওর ছিল না। সেইজন্য হাফলঙের পাহাড়ে এমন একটা খাদের ধরে নিয়ে আমাদের ঠেলে ফেলার ব্যবস্থা করেছিল, যেখানে অনেক ঝোপঝাড়, গাছপালা আছে। যাতে আমরা মরে না গিয়ে আহত হয়ে বেশ কিছুদিন শুয়ে থাকব, তাতেই ওর কাজ হয়ে যাবে!

পদ্মনাভন বললেন, রাস্কেল! পাহাড় থেকে ঠেলে দিলে কে আহত হবে, আর কে মরবে, তার কি কোনও ঠিক আছে? পড়ার সময়েই তো অনেকে হার্ট ফেইল করে মরে যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা পদ্মনাভন, একটা ব্যাপার আমি এখনও বুঝিনি। জেলের কাছ থেকে উল্কা-পাথরটা কেনার পরও তুমি গোপালপুরের বাংলোয় অতদিন রয়ে গেলে কেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল না। শুধু-শুধু কেন বসে রইলে?

পদ্মনাভন বললেন, তোমার জন্য! কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, আমার জন্য? তার মানে?

পদ্মনাভন বললেন, ডাকবাংলোতে এসেই জানলাম, পাশের ঘরটা তোমার নামে বুক হয়ে আছে! তখনই আমি ঠিক করলাম, বাঃ চমৎকার! রায়চৌধুরী এসে পড়লে আমার আর কোনও সমস্যা থাকবে না। তাই আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তোমার জন্য। কিন্তু তুমি এলেই না! আমি বাংলোর লোকদের বলে রেখেছিলাম, ওই ঘর যেন আর কাউকে দেওয়া না হয়!

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্যই আমাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে আসামে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোমার সমস্যাটা কী ছিল?

পদ্মনাভন বললেন, পাথরটা আমি কেনার পরেই রাজীব শর্মাকে দেখতে পেলাম! রাজীবের এমনই দৃভাগ্য, ও আমার ঠিক এক ঘন্টা পরে পৌঁছেছে।

হলে আমার থেকেও বেশি দাম দিয়ে ও পার্থরটা কিনে নিত। আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাথরটা কেনার পর সবাই ভাবল, ওটা খুবই দামি জিনিস।

কাকাবাবু বললেন, খুব স্বাভাবিক। তোমার মতন একজন বৈজ্ঞানিক অত টাকা দিয়ে তো একটা পাথর কিনবে না! সবাই ভাববে, নিশ্চয়ই ওর মধ্যে অন্য কিছু আছে।

পদ্মনাভন বললেন, রাজীব শর্মা ওটা পাওয়ার জন্য খেপে গেল। আমার কাছে অন্য লোক পাঠাল, দশ হাজার টাকা দিয়ে ওটা কিনতে চেয়ে। আমি রাজি হইনি। রাজীব আমার পুরনো শত্রু। ব্যবসা করে এখন অনেক টাকা হয়েছে ওর, হাতে অনেক দলবল আছে। পাথরটা নিয়ে আমি গোপালপুর থেকে বেরোবার চেষ্টা করলেই ও জোর করে কেড়ে নেবে। আমাকে মেরে দিতেও পারে। এর আগে ও আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছে!

কাকাবাবু বললেন, তুমি পুলিশের সাহায্য নিলে না কেন?

পদ্মনাভন বললেন, আমি পুলিশের ওপর ভরসা করি না। পুলিশের চেয়েও তোমার ক্ষমতার ওপর আমার বিশ্বাস অনেক বেশি। দ্যাখো, আমি ভুল করিনি। শেষ পর্যন্ত তুমিই তো এসে আমাকে বাঁচালে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, পাথরটার শেষ পর্যন্ত কী হল? লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলে?

পদ্মনাভন মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ। কার্পেটের নীচে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কার্পেটের নীচে?

কয়েক পলক পদ্মনাভনের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, ও, বুঝেছি!

সন্তু ব্যস্তভাবে বলল, কী হল? কী হল? আমি বুঝতে পারছি না তো! অতবড় একটা পাথর কার্পেটের নীচে কী করে লুকনো যাবে? কার্পেটটা উঁচু হয়ে থাকবে না? তা ছাড়া ওরা কার্পেট নিশ্চয়ই উলটে দেখেছে!

পদ্মনাভন বললেন, শোনো ইয়াংম্যান। আমি মিথ্যে কথা বলি না। আমি ওদের বলেছিলাম, পাথরটা নেই। এই তিনটেই সত্যি। তবু ওরা বোঝেনি!

অম্বর বলল, যা বাবা! এ যে একটা ধাঁধা!

কাকাবাবু বললেন, একটু বুদ্ধি খাটালে ধাঁধারও উত্তর পাওয়া যায়। সবারই বুদ্ধি থাকে। কিন্তু সবাই সেটা ব্যবহার করতে জানে না। কার্পেটের নীচে কী থাকে? ধুলো! পদ্মনাভন ওই উল্কা-পাথরটাকে গুঁড়িয়ে ধুলো করে কার্পেটের নীচে রেখে দিয়েছে। তাই কেউ বুঝতে পারেনি!

পদ্মনাভন বললেন, পাথরটার এমনিতে তো কোনও দাম নেই আমার কাছে। উল্কা-পাথরের মধ্যে নতুন কোনও মেটাল পাওয়া যায় কিনা, তাই নিয়ে সারা পৃথিবীতে গবেষণা হয়। এই পাথরটা একটু অন্যরকম দেখতে, ভেতরটা সবুজ, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। এটার মধ্যে যদি এমন কোনও মেটাল পাওয়া খায়, যা পৃথিবীতে নেই, তা হলেই এক বিরাট ব্যাপার হবে, সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে। সেইজন্য আমি ঘরে বসেই কয়েকটা পরীক্ষা করলাম।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, যন্ত্রপাতি পেলেন কোথায়?

পদ্মনাভন বললেন, এর জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি লাগে না। প্রথমে আমি একটা ছোট ছুরি দিয়ে চেঁছে দেখলাম, কেন ওটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। পাথরটা বেশ কয়েকদিন সমুদ্রের জলে ড়ুবে ছিল। ওর গায়ে ফসফরাস লেগে গেছে। তোমরা সবাই জানো, অন্ধকারে ফসফরাস জ্বলজলে হয়ে যায়। ছুরি দিয়ে চাঁছতেই সেটা উঠে গেল। এবার দেখা দরকার, সেটা শুধুই পাথর, না তার মধ্যে কোনও ধাতু মিশে আছে। তাই একটা হাতুড়ি দিয়ে আমি সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলাম।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তাতে জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেল না?

পদ্মনাভন বললেন, পাথর হিসেবে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু ধাতু থাকলে গুঁড়ো করলেও ক্ষতি নেই। লোহার, গুঁড়োকে আবার লোহার পিণ্ড করা যায় না? গুঁড়ো করার সুবিধে এই, আমার সুটকেসের মধ্যে ধুলো হিসেবে ছড়িয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে পারব, কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। এরপর ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখব।

কাকাবাবু বললেন, পদ্মনাভন, তোমার দোষ এই, তুমি সব সময় বিপদের ঝুঁকি নিতে ভালবাস। আমার মতে, প্রথম দিনই পুলিশের সাহায্য নিয়ে তোমার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল।

পদ্মনাভন বললেন, বিপদকে এড়াতে চাইলেই কি আর বিপদ এড়ানো যায়? তুমি বলতে চাও, এখান থেকে ব্যাঙ্গালোর পর্যন্ত পুলিশ আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত? মাঝখানে পাহারাদার পুলিশ ঘুমিয়ে থাকত, আর রাজীব শমার ভাড়াটে গুণ্ডারা গুলি করে আমায় মেরে পাথরটা নিয়ে পালাত! তবে রায়চৌধুরী, একটা কথা বলে রাখছি। যদি এই পাথরটা থেকে সত্যিই বড় কিছু আবিষ্কার করা যায়, তা হলে তোমার নামটাও তার সঙ্গে যুক্ত হবে। আমি যদি মরে যেতাম, তা হলে তো কিছুই হত না। কার্পেটের তলায় ধুলোর কথাও কেউ জানত না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, না, আমার নামটাম দরকার নেই। আমার কথা লোকে যত কম জানে, ততই ভাল। এমনিতেই আমার শত্রুর অভাব নেই!

অম্বর বলল, কাকাবাবু, এর পর থেকে অন্য অ্যাডভেঞ্চারেও আমাকে সঙ্গে নেবেন তো?

কাকাবাবু বললেন, আর আমি কোনও অ্যাডভেঞ্চার-ট্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি না। এর পর আবার আমরা আসামে যাব। সেখানে অম্বর তোমার সাপধরা দেখব। তা ছাড়া জাটিংগা-পাখির রহস্যটা ভেদ করতে হবে না? কী বল, সন্তু?

সন্তু মাথা নাড়ল।

পদ্মনাভন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পাখির রহস্য? সেটা কী ব্যাপার?

কাকাবাবু বললেন, সে একটা অন্য গল্প। তোমাকে পরে বলব। এখন চলো, গোপালপুরে ফেরা যাক।

রাজীব শর্মার মোটর বোটের চালককে আগেই বন্দী করা হয়েছে। গাড়ির রাস্তা খুব খারাপ বলে কাকাবাবু ঠিক করে রেখেছিলেন, মোটর বোটেই। ফিরবেন। কাকাবাবুই চালাতে জানেন।

তীরের কাছে সাদা রঙের বোটটা একটা রাজহংসীর মতন দুলে-দুলে ভাসছে। সবাই মিলে উঠল সেই বোটে। কাকাবাবু এঞ্জিনে স্টার্ট দিলেন।

ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে অম্বর বলল, সন্তু, আমি যদি একটা গান ধরি, তোমার আপত্তি আছে? আমি নিজে গান বানাই, নিজেই সুর দিই। শুনবে?

ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়েও চিৎকার করে সে গাইতে লাগল :

গোপালপুরে উল্কা পড়ল একখানা
তাই নিয়ে ভাই কত কাণ্ড-কারখানা..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত