কুয়াশা – ০২

কুয়াশা – ০২

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে আজ ছসাতদিন ধরে। শ্রাবণের মাঝামাঝি। একবার শুরু হলে আর থামতেই চায় না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। Dienfa Workshop-এ অষ্টিন এইট ফিটি গাড়িটা অয়েলিং করবার জন্যে রেখে শহীদ পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে। ওয়াটারপ্রুফ পরা, পায়ে গাম -বুট, মাথায় টুপি। ভিজবার কোনও ভয় নেই। বৃষ্টিটা বেশ একটু চেপে এলো। শান্তিনগরের বিরাট পিচ ঢালা রাস্তাটা এমনিতেই খুব নির্জন থাকে। বৃষ্টির দিন, তাই লম্বা রাস্তাটা ধরে যতদূর দেখা যায়, জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

বেশ দূরে একজন লোককে হেঁটে আসতে দেখা গেল। ভিজে আসছে লোকটা। অনেকটা কাছে আসতেই শহীদ দেখলো, নিগ্রো একজন। ছ্যাৎ করে উঠলো তার বুকের ভিতরটা। গত কয়েকদিন ধরে জনকতক নিগ্রো তার ওপর নজর রাখছে। সে যেখানেই যায় ছায়ার মতো পিছু নেয় তাদের কেউ না কেউ। এ লোক তাদেরই দলের একজন।

কাছে এসে শহীদকে চিনতে পেরে সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল লোকটার। একটা মিষ্টি হাসি দিলো সে। শহীদের কাছে কিন্তু হাসিটা মােটেই মিষ্টি লাগলো না। নিকষ কালো মুখে চকচকে সাদা দাঁতগুলো ওকে যেন ভেংচি কাটলো। কী বীভৎস চেহারা!

শহীদ গম্ভীর মুখে এগিয়ে যায়। পকেটের মধ্যে রিভলবারটা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে। শহীদ ভাবে, কেন এই লোকগুলো তার পিছন ধরেছে? কী এদের উদ্দেশ্য? এমন বিকট হাসিরই বা অর্থ কি? ঢাকার বুকে হঠাৎ এতগুলো নিগ্রো কোথা থেকে এসে হাজির হলো?

দ্রুত হাঁটছে শহীদ। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে চায়। না, কেউ নেই আশেপাশে। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। সামনে একটা মাঠ আর একটা বড় দীঘি বাঁ পাশে রেখে একটা কাঁকরের সরু পথ শহীদের সুন্দর একতলা বাড়িটার গেট পর্যন্ত চলে গেছে। বৈঠকখানার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে মহুয়া, কামাল আর লীনা বসে গল্প করছে। ওদের দেখে শহীদের বুকের ওপর থেকে একটা ভারি পাথর যেন সরে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল। ডান পাশে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা অন্ধকার মতো। তারপরেই কাঁকরের রাস্তায় পড়বে সে।

হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন সাপটে ধরলো তাকে। শহীদ ছাড়াবার চেষ্টা করছে এমন সময় বাঁ পাশ থেকে প্রচণ্ড এক মুষ্ট্যাঘাত এসে পড়ল তার গালে। বোঁ করে ঘুরে উঠলো তার মাথাটা। কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। সামলে নেয়ার আগেই তার পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিলো আক্রমণকারী। শহীদ ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে অনেকটা। চেয়ে দেখলো তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন নিগ্রো! তাদের মধ্যে সবচাইতে লম্বা লোকটা এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, Dont shout. Otherwise you dead. Comes with me.

শহীদ চিন্তা করে দেখলো ওয়াটারপ্রুফ পরে, গামবুট পায়ে চার পাঁচজন ষন্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে লাগতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তারা অর্ধেক তৈরি বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।

শহীদ শেষ বারের মতো তার বাড়ির দিকে চেয়ে দেখলো কামাল, মহুয়া, লীনা তেমনি গল্প করছে। গফুর চা নিয়ে এসে রাখছে টেবিলের ওপর। এতো কাছে রয়েছে ওরা তবু কেউ জানছে না শহীদের এখন কতো বড় বিপদ। ক্ষোভে দুঃখে শহীদের হাসি পেলো। ইশ! গকুর যদি একটু জানতে পারতো তার দাদামণি এখন কতো বড় বিপদে পড়েছে। গফুর আর শহীদ একসাথে থাকলে এই নিগ্রো কজন টের পেতে কার সাথে লাগতে গেছে ওরা।

ঘরের মধ্যে এনে শহীদকে একটা রশি দিয়ে পিছমােড়া করে বেঁধে ফেললো ও। তারপর হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে নিজেদের ভাষায় কি যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। শহীদ তার একবর্ণও বুঝলো না। মিনিট কয়েক ওরা সেইভাবে অনবরত বলেই গেল। তারপর একজন উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা একটা লম্বা বাক্সের ডালা খুলে ফেললো। সেই লম্বা লোকটা এবার তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাক্সের দিকে চললো। শহীদের বুঝতে বাকি রইলো না, এবার তাকে বাক্সে পোরা হবে।

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঝড়ের মতো একটা মূর্তি ঢুকলো ঘরে। কালো আলখাল্লা পরা, মুখে মুখোশ। কেউ ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই সে পটাপট কয়েকটা ঘুসি চালিয়ে দিলো তিনজন কাফ্রির নাকের ওপর। কী প্রচণ্ড ঘুসি! যেমন বিরাট লম্বা চওড়া মূর্তি, তেমনি তার ঘুসির ওজন। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়লো তিনজনই। সবচাইতে জোয়ান নিগ্রোটা শহীদকে ফেলে দিলে মাটিতে। তারপর ঘুসি বাগিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেল মূর্তিটার দিকে। সামান্য সরে গিয়ে কি যেন একটু করলো আগন্তুক। ছিটকে ওপাশের দেয়ালে অত্যন্ত জোরে ধাক্কা খেলো জোয়ান নিগ্রোটা।

মাথাটা ভীষণভাবে ঠুকে গেছে দেয়ালের গায়ে। টু শব্দটি না করে সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে। এদিকে বাকি তিনজনের একজন টলতে টলতে উঠে দাড়িয়েছে। তলপেটে প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে সে আবার মাটিতে ঘুরে পড়লো।

সর্দারের পকেট থেকে শহীদের রিভলভারটা বের করে নিলো আগন্তুক। এবার সে শহীদের দিকে এগিয়ে আসছে। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে শহীদের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো, চলো, তোমাকে কিছুদূর এগিয়ে। দিয়ে আসি।

শহীদ আগে আগে চলেছে, পিছনে আলখাল্লা ধারী। বাড়ির কাছাকাছি এসে শহীদ বললো, এসো বন্ধু, আজ মহুয়ার হাতের তৈরি চা খেয়ে যাও। তোমার এই উপকারের জন্যে কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো ভেবেই পাচ্ছি না।

কোনো উত্তর নেই। শহীদ পিছন কিরে দেখলে কেউ নেই। তার অজান্তেই আগন্তুক কখন সরে পড়েছে।

শহীদের বুঝতে বাকি নেই, আলখাল্লাধারী কুয়াশা ছাড়া আর কেউ নয়। আর কারও এতো বড় বুকের বল নেই যে চারজন ষণ্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে খালি হাতে একা লড়তে যাবে।

কিন্তু কুয়াশার তো তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা। সে তাকে এমন অযাচিত ভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে কেন? সে তার বোনকে বিয়ে করেছে বলে? কিংবা ভালবাসা? শহীদ ঠিক বোঝে না। কুয়াশার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে।

কিন্তু এই নিগ্রোগুলো তাকে বন্দী করেছিল কেন? ওই বাক্সেতে পুরে ওকে কি পাচার করবার মতলবে ছিলো ওরা? কিন্তু কেন? কোথায়?

নানা প্রশ্ন তার মাথায় জট পাকায়। কোনটারই সমাধান পায় না সে।
পরদিন বিকেল বেলা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দুই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে শহীদের ড্রইংরুমের খোলা জানালা দিয়ে। বৃষ্টির কণাও কিছু কিছু এসে দামী পুরু কার্পেটের খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। বাতাসের ঝাপটার সাথে সাথে খুব সূক্ষ্ণ বৃষ্টির কণা এসে লাগছে চোখে মুখে।

লম্বা সোফাটায় শুটিসুটি মেরে শুয়ে শহীদ সঞ্চয়িতা পড়ছে আর মাঝে মাঝে বাইরে বৃষ্টির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। শহীদ দেখছে ভিজছে কার্পেটটা। ভিজুক, উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না।

বাইরে রহস্যময় বিরাট বট গাছটা যেন তার মনের মধ্যে কতো কী গোপন করে নীরবে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। যেন একটা বক। এক পায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাছের অপেক্ষা করছে। না, না, বক না, একটা মস্তবড় হিংস্র জংলী হাতী। কী এক যাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে কেবল চেয়ে রয়েছে, আর ভিজছে।

আরও দূরে দৃষ্টি যায় শহীদের। দূরে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটা লম্বা বাঁশের আগায় একটা ঝাড়ু আর টুকরি বাঁধা। বৃষ্টির দিন, তাই কাজ বন্ধ। আরেকটা বাঁশের মাথায় একটা কাক বসে বসে ভিজছে।

কি ভাবছো চুপচাপ? মহুয়া এসে ঢুকেছে কখন ঘরে, আরে বেশ তো তুমি, কার্পেটটা ভিজে যাচ্ছে আর নিশ্চিন্ত শুয়ে আছো। কাঁচের জানালা বন্ধ করে দিলো সে। তারপর কাছে এসে মাথার কাছে একটা সোফায় বসে শহীদের চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে দিলো।

কামাল কই?

লীনাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছে।

ওরা দুজনেই হাসলো। কামাল চিরকাল অঙ্কে লাড্ডু পেতো। লীনার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র একমাস বাকি। তাই কামালকে আবার শহীদের কাছ থেকে অঙ্ক শিখে নিয়ে ওকে শেখাতে হচ্ছে। কামালের সদা চিন্তিত মুখ দেখলে মনে হয় পরীক্ষা যেন ওরই।

মুহু, কী যেন খেতে ইচ্ছে করছো, শহীদ আবদারের সুরে বলে।

গফুরকে বড়া ভাজতে দিয়ে এসেছি। হয়ে গেছে প্রায়।

না, বড়া না, কী যেন আরেকটা জিনিস! হাত বাড়ায় শহীদ।

ধেৎ, কেউ দেখে ফেলবে যে! এই, না, সত্যি…

গফুর একটু কাশি দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। এক থালা ভর্তি বড়া। শহীদ সুবোধ বালকের মতো মিটমিট করে চেয়ে রইলো। টেবিলের ওপর থালাটা রেখে গফুর বললো, কামাল ভাই আর ছোটো আপাকে ডেকে দেবো দিদিমণি?

দাও।

গফুর চলে গেল। একটু পরে কামাল আর লীনা এসে ঢুকলো ঘরে। বড়া দেখেই কামাল পুলকিত হয়ে উঠলো। একটা বড় মুখে পুরে এক কামড় দিয়েই আর্তনাদ করে আবার হাতে নিলো। বড়ো গরম!

শহীদের মাথার কাছে বন্ধ করে রাখা সঞ্চয়িতা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকলো লীনা। বোধকরি একটা কবিতা আবৃত্তি করবার ইচ্ছা আছে, ভালো কবিতা খুঁজছে। হঠাৎ একটা চার ভাঁজ করা কাগজ বই থেকে বের করে শহীদকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কী দাদামণি? এটা তো এ বইয়ের মধ্যে ছিলো না?

ওটা বাবার একটা চিঠি। মার কাছে লেখা। আজ সকালে মার হাতবাক্স ঘাঁটতে, ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম। কামালের দিকে ফিরে বললো, এই চিঠির দুএকটা জায়গা, পড়ছি। শুনে রাখ, পরে তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।

শহীদ হাত বাড়িয়ে লীনার কাছ থেকে চিঠিটা নিলো। অনেক দিনের পুরনো চিঠি, কাগজটা হলদে হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কালি চুপসে গেছে, পড়া যায় না। কিছুক্ষণ চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়ে শহীদ পড়তে শুরু করলোঃ

আমাদের স্টীমার এখন তেলাগোয়া উপসাগরের মধ্য দিয়া লরেঞ্জো মারকুইসের দিকে চলিয়াছে। আগামীকাল আমরা সেখানে পৌছাইব।

কতকগুলি সামুদ্রিক পাখি আজ দুপুর হইতে স্টীমারের চতুষ্পার্শ্বে ঘুরিতেছে। এখন সূর্য অস্ত যাইতেছে। কেবল ইঞ্জিনের ধিকি ধিকি শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নাই। এই নিস্তব্ধতা বড় ভালো লাগিতেছে। ডেকের ওপর আমার পাশের চেয়ারে বসিয়া ইকবাল– সেও মুগ্ধ হইয়া বাহিরে চাহিয়া রহিয়াছে। মেঘগুলি সিদুরের মতো লাল হইয়া গিয়াছে। তাহার ছায়া আবার জলে পড়িয়াছে; ফলে চতুর্দিকে কেবল লাল আর লাল।

ডারব্যান হইতে কতকগুলি নিগ্রো আমাদের স্টীমারে উঠিয়াছে। আমার সহিত অত্যন্ত ভাব জমিয়া গিয়াছে। ইহারাও লিম্পোপো নদী দিয়া দক্ষিণ রোডেশিয়ায় যাইবে। ইহাদের ভাষা আমরা একেবারেই বুঝি না, তবু ইহাদের ভাবে ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করিবার ইচ্ছা দেখিয়া আমরা অত্যন্ত খুশি হইয়াছি। বিশেষ করিয়া আমাকে ইহারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। রোজ সন্ধ্যায় ইহারা আসিয়া আমার সামনে হাঁটু গাড়িয়া উহাদের নিজেদের ভাষায় কি কি সব উচ্চারণ করে। আমি একবর্ণও বুঝি না, কেবল মাথা নাড়ি।

এই নিগ্রোগুলি বান্টু শাখাভুক্ত। ইহারা যেমন সাহসী ও বলিষ্ঠ তেমনি হিংস্র। আমার সহিত স্টীমারের একজন খালাসী সামান্য দুর্ব্যবহার করিয়াছিল। আজ দুইদিন যাবৎ তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। আমার যতদূর বিশ্বাস এই নিগ্রোগুলি তাহাকে খুন করিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছে। কারণ আমার সহিত খালাসীর ঝগড়ার সময় তাহাদিগকে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিতে দেখিয়াছিলাম।

এহেন হিংস্র, বলিষ্ঠ ও সাহসী পথপ্রদর্শক লইয়া আমাদের লিম্পোপোর কুমীর নিধনে বিশেষ সুবিধা হইবে। জার্মান গভর্নমেন্ট ইদানীং ঘোষণা করিয়াছে প্রতিটি কুমীরের জন্য এক পাউও করিয়া পুরস্কার দিবে…

তোমার নিকট হইতে আমি এখন সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে কিন্তু বিশ্বাস করে৷ সানী, এক মুহূর্ত তোমাকে ভুলিয়া থাকিতে পারি না। অনেক রাতে যখন একফালি চাঁদ উঠে আকাশে, ভৌতিক চাঁদ-আবছা আলো, আবছা অন্ধকার-তখন জাগিয়া বসিয়া তোমার কথা ভাবি। তুমি যদি কাছে থাকিতে!…ইত্যাদি ইত্যাদি।

চাচাজান আর বাবা কি তাহলে কেবল শিকার করতে যাননি, টাকা পয়সার ব্যাপারও ছিলো? কামাল জিজ্ঞেস করলো।

টাকার কথা একটা আছে অবশ্যই, কিন্তু টাকা তাঁদের কম ছিলো না। আসলে গেছিলেন শিকার করতেই, সেই সাথে যদি কিছু টাকাও আসে তো মন্দ কি?

টাকা দেবে কে?

জার্মানী যখন গত মহাযুদ্ধে টাঙ্গাইনিকা দখল করে তখন ঘোষণা করে লিম্পোপো নদীর কুমীর শেষ করতে হবে। প্রতিটি মৃত কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড পুরস্কার। আমার বাবা আর তোমার বাবা গেছিলেন আসলে শিকার করতে। ওখানে গিয়ে যতদূর সম্ভব তাঁর পুরস্কারের কথা জানতে পারেন।

আচ্ছা, তোমরা ওদের মৃত্যু সংবাদ পেলে কি করে? মহুয়া প্রশ্ন করে।

লরেঞ্জো মারকুইস থেকে অ্যান্ডারসন বলে এক সাহেব, দয়া করে জানিয়েছিল।

শহীদ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। গফুর কফি নিয়ে এলো চার কাপ।

কফিতে এক চুমুক দিয়ে কামাল বললো, একটা গান গাও তো মহয়াদি, শ্রাবণের গান

এই বিকেল বেলা কি ভালো লাগবে?

খুব ভালো লাগবে, গাও তো তুমি। আমি সাথে পিয়ানো বাজাবো।

কামাল উঠে গিয়ে পিয়ানোর সামনে বসলো। একটু কেশে নিয়ে শুরু করলো, মহুয়া।

আমি শ্রাবণ আকাশে ওই, দিয়াছি পাতি
মম জল ছল ছল আঁখি মেঘে মেঘে…

যেমন সুন্দর সুর, তেমনি গলা। কলির শেষে এতো সুন্দর করে মীড় টানে মহুয়া! সাথে কামালের পাকা হাতে পিয়ানো, সমস্ত আবহাওয়া একেবারে গম্ভীর করে দিয়েছিল। আজকের এই বাদলা দিন যেন সম্পূর্ণ সুন্দর হলো গানটা শুনে। সবাই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, লীনা, ভুনিখিচুড়ি তৈরি করা শিখবে বলে, চলো আজ খিচুড়ি রাঁধবো।

মহুয়া আর লীনা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। কামাল কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলো। তারপর শহীদকে বললো, কি কথা বলবি বলে?

হ্যাঁ, কাছে আয়।

কামাল কাছের একটা সোফায় এসে বসলো। শহীদ বললো, শোন, তোকে গোড়া থেকে ব্যাপারটা বলি। এই যে চিঠিটা দেখছিস পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। শহীদ, এটা আজ সকালের ডাকে আফ্রিকা থেকে এসেছে। না, না, বাবা বা কাকা কারও লেখা নয়; কুফুয়া নামে একজন আফ্রিকান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসেছে।

বাবা আর কাকা গেছিলেন সিম্পোপো নদীতে কুমীর শিকার করতে। জার্মেনী তখন ঘোষণা করেছে প্রতিটি কুমীরের জন্যে এক পাউণ্ড করে পুরস্কার দেবে। বাবা আর কাকা এই ব্যবসায়ী কুফুয়ার সাথে যোগ দিয়ে কয়েকশো লোক জোগাড় করে কেবল মাত্র নদীর এক মাইল ঘেরাও করেই সাড়ে নয় হাজার কুমীর একদিনে মারেন। পরে আরও অনেক কুমীর এদের হাতে মারা পড়ে। ঠিক ঠিক টাকা দেয় জার্মান গভর্নমেন্ট। কিন্তু তাদের কুমীর নির্বংশ করার plan বাতিল করে দেয়। তোর বাবা হঠাৎ একদিন বেকায়দায় কুমীরের পাল্লায় পড়ে বাবা আর কুফুয়ার চোখের সামনে তলিয়ে গেলেন লিষ্পেপোর মধ্যে। বাবা নাকি ভীষণ আঘাত পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যান। রাইফেল কাঁধে লিস্পোপের ধারে ধারে দিন নেই রাত নেই পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে বহু কুমীর মারেন বাবা। তারপর একদিন তিনিও আর ফিরে এলেন না।

আমাদের ঠিকানা কুফুর কাছে ছিলো। সে জানতে আমাদের পরিবারে বড় আর কেউ নাই। তাই আজ সতেরো বছর পর আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি মনে করে চিঠি লিখেছে। আমার আর তোর সাত হাজার পাউণ্ড, অর্থাৎ প্রায় নব্বই হাজার টাকা কুফুয়ার কাছে জমা আছে। আমরা যেন সেখানে গিয়ে সে টাকার একটা ব্যবস্থা করে আসি, তার জন্যে সে আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। লিখেছে, বাবারা, আমার প্রচুর টাকা আছে, বন্ধুর ছেলেদের টাকা আত্মসাৎ করে আমি স্বর্গে যেতে পারবো না। তোমাদের টাকা পয়সা তোমাদের বুঝিয়ে দিয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই। তোমরা যতো শিগগির পারো রওনা হয়ে যাও। নইলে এই বুড়ো বয়সে আমাকে আবার যেতে হবে তোমাদের দেশে।

অদ্ভুত ভালো বুড়ো তো! কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে। কিছু Conspiracy-ও থাকতে পারে। কয়েকদিন ধরে কয়েকজন নিগ্রোকে এই বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখছি কেন বলতো? ঢাকায় নিগ্রো, আফ্রিকা থেকে চিঠি, কেমন সন্দেহ হচ্ছে।

তোরও নজর পড়েছে দেখছি! শহীদ হাসলো। তারপর গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বললো কামালকে। সবটুকু মন দিয়ে শুনে কামাল বললো, খুবই Serious বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার কিছু আঁচ করেছিস?

কিছু মাত্র না। আমি সকালে মার হাতবাক্স খুললাম। বাবার কোনও চিঠিপত্র থেকে কিছু বোঝা যায় কিনা দেখতে। একটা জায়গা একটু মিলেছে। চিঠিতে একখানে বাবা লিখেছেন কয়েকজন নিগ্রো স্টীমারে রোজ সাঁঝে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিড় বিড় করে কি মন্ত্র আওড়াত। কাল সাঁঝে আমাকে হাত পা বেধে ওরা আমার সামনেও হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র আওড়েছিল। মনে হয় এই নিগ্রোগুলো সেই একই দলের লোক, অথবা একই উপজাতি বা শাখার লোক।

সে যাক। এখন কি ঠিক করলি? যাবি লিম্পোপো নদীতে?

তাই জিজ্ঞেস করতেই তো তোকে ডাকলাম। আমার তো পুরোপুরি যাবার ইচ্ছে আছে। কিন্তু তোর মা ভীষণ কান্নাকাটি করবেন তুই যেতে চাইলে।

কিছু না। তুই গিয়ে খালি একবার মাকে বলবি, ব্যাস আর কিছু লাগবে না। তোর সাথে মা আমাকে দোজখেও পাঠাতে রাজি হবে।

এদিকে আবার মহুয়াও কান্নাকাটি করবে। ও কিছুতেই যেতে দিতে চাইবে না।

মহুয়াদিকে সঙ্গে নিয়ে যাবি।

বাঃ! Good idea! আমার মাথায় এ কথা একেবারেই আসেনি! পাটিগণিত করে তোর বুদ্ধি খুলে গেছে। শহীদ খুশি হয়ে উঠলো।

কিন্তু আমি যে কামাল আহমেদ আর তুই যে শহীদ খান, তা প্রমাণ করবি কি করে? আফ্রিকায় গেলাম, তখন যদি কুফুয়া বলে তোমাদের পরিচয় প্রমাণ করো, তখন?

বারে। আমাদের পাসপোর্ট থাকবে না সাথে? পাসপোর্টেই তো ছবি থাকবে।

পাসপোর্ট করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমাদের? মহুয়া এসে ঢুকলো ঘরে। ঠোঁটের একটু ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মিষ্টি মুখটা আরও মিষ্টি লাগছে।

কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে শহীদ বললো, আফ্রিকা।

মহুয়া ভাবলো শহীদ ঠাট্টা করছে। হেসে কামালের দিকে চাইলো। কামালের গম্ভীর মুখ দেখে ওর বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো।

আফ্রিকা? আফ্রিকা কেন?

লিম্পাপো নদীতে কুণীর শিকার করতে।

ধ্যাৎ, ঠাট্টা করছো।

না মুহ, ঠাট্টা না। সত্যিই যাচ্ছি।

কিছুতেই তোমাদের যাওয়া হতে পারে না।

যে কোনও অবস্থায় আমাদের যাওয়া চাই-ই, গম্ভীরভাবে বলে শহীদ।

আমার কথা শুনবে না? মহুয়ার চোখ ছল ছল করে।

দেখ, কামাল, মেয়ে মানুষের একমাত্র অস্ত্র তুলে নিয়েছে মহুয়া, আর একটু হলেই প্রয়োগ করবে।

মহুয়া হেসে ফেলে বললো, তাহলে বলো সত্যি সত্যিই আর যাচ্ছে না। বিয়ে করে, একটা মেয়ের ইহকাল পরকাল নষ্ট করে ওসব দেশে যাবার কথা ভাবতে হয় বুঝি?

সত্যি সত্যিই আমরা যাচ্ছি মহুয়াদি। তবে তুমি যদি কান্নাকাটি করো সেই ভয়ে তোমাকেও সাথে নেয়ার প্রস্তাব করেছি শহীদের কাছে। তাহলে রাজি আছে তো যেতে দিতে?

নাই বা গেলে অমন দেশে কামাল ভাই।

অনেক কারণ আছে যে যাবার।

কি কারণ?

শহীদ বললো, তোমাকে পরে সব বলবো মহুয়া। আমরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চিটাগাং থেকে রওনা হবো। গফুরকে বললেই হবে, ওই সমস্ত জিনিসপত্র বেধেছেদে ঠিক করে ফেলবে।

লীনা এসে ঢুকলো। কোথায় যাবে তোমরা দাদামণি?

আফ্রিকা।

সত্যি?

মহয়াদিও?

হাঁ।

আমিও যাবো। আবদার ধরে লীনা।

তুই কি করে যাবি। তোর তো সামনে পরীক্ষা। তুই ততোদিন চাচী-আম্মার কাছে থাকবি, আমরা যতো শিগগির পারি ফিরে আসবো।
আমাদের জাহাজ কি কলম্বো ঘুরে যাবে? কামাল জিজ্ঞেস করলো।

হাঁ। মধ্যেখানে মাত্র দুইটা হলটেজ। কলম্বো আর মরিশাস। কালকে আমরা চিটাগাং রওনা হচ্ছি। ঢাকায় আজই আমরা শেষ রাত কাটাবো। হয়তো আর কোনও দিন ফিরে আসবো না। চাচী আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিস তো? তুই রাতে আমাদের এখানে থাকবি, কাল খুব ভােরে প্লেন ধরতে হবে।

আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। রাত দশটার দিকে জিনিসপত্র নিয়ে এখানে চলে আসবো।

কামাল চলে গেল। রাত তখন আটটা। গফুর এসে ঢুকলো ঘরে।

লীনাকে চাচী আম্মার ওখানে দিয়ে এসেছিস?

হাঁ। ছোটো আপা খুব কাঁদছিল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শহীদ বললো, তোর দিদিমণিকে ডেকে দে তো।

গফুর দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগলো।

কিছু বলবি? শহীদ জিজ্ঞেস করে।

দাদামণি, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে। তোমাদের একলা বিদেশে যাওয়া হবে না।

তুই গেলে আমাদের কি সুবিধা হবে? আরও বাজে হাঙ্গামা বাধাবি।

শহীদ জানতো গফুর যাবেই যাবে। সে হয়তো তাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একা যেতে দিতেও পারতো। কিন্তু তার দিদিমণিকে সে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। তাকে সে কিছুতেই একা বিদেশে যেতে দিবে না। তার ধারণা, তাকে ছাড়া হাজার লোকের সাথে গেলেও শহীদরা একা একা যাচ্ছে। ওকে রেখে গেলে ও যে ভীষণ কষ্ট পাবে দিনরাত ভেবে ভেবে, বুঝতে পেরে শহীদ ওরও টিকেট কেটেছে।

তাহলে আমি দিদিমণির জিনিসপত্র খুলে রাখি। তোমরা যা খুশি করো গে যাও, দিদিমণিকে আমি যেতে দেবো না।

আমার বউ নিয়ে আমি যেখানে খুশি যাবো, তাতে তোর কি? শহীদ হাসে।

গফুর কোনও উত্তর পায় না এই কথার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সে। শহীদকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারে না কতো ভয়ের জায়গা আফ্রিকা। সে দেশে একলা দিদিমণির যাওয়া হতেই পারে না। বললো, তোমরা তো কুমীর শিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন দিদিমণিকে দেখবে কে?

ওর অবস্থা দেখে শহীদ তাড়াতাড়ি বললো, নারে গাধা। তোরও টিকিট করেছি। তোকে ছাড়া গিয়ে কি বিপদে পড়ি না পড়ি তার ঠিক আছে?

গফুরের ঠিক বিশ্বাস হয় না। যাবার সময় ঠিক দাদামণি একটা ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে। ঠিক হ্যায়। সেও পিছন পিছন যাবে। তখন না নিয়ে পারবে না। তাছাড়া সেদিন তার ফটোক তুলে কয়েকটা কাগজে লাগিয়েছে দাদামণি, তার ওপর আবার সে আঙুলের টিপও দিয়েছে- সেজন্যে আবার অল্প অল্প বিশ্বাসও হয় তার। আর কোনো কথা না বলে চলে গেল গফুর।

একটু পরেই মহুয়া এসে ঢুকলো। কামাল ভাই কই?

চলে গেল। দশটার সময় আসবে।

বারে। ভাত খাবে না এখানে? আমাকে চিংড়ীর কাটলেট করতে বলে না খেয়েই চম্পট দিয়েছে? আমি কতো কষ্ট করে তৈরি করলাম।

ওর জন্যে তুলে রাখলেই হবে।

গরম গরম তো আর খেতে পারলো না। যাকগে। তুমি চলো ভাত খাবে।

মহুয়া আর শহীদ খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। কাল আবার খুব ভােরে উঠতে হবে। কামালের জন্যে একটা ঘরে বিছানা করে দিয়েছে মহুয়া। টেবিলের ওপর গোটা চারেক কাটলেট ঢাকা দিয়ে রেখেছে। গফুর ওকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়বে।

অনেক রাতে মহুয়ার চিৎকার আর ধাক্কায় শহীদের ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলে শহীদ, কি, কি হয়েছে মহুয়া?

মহুয়ার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। আঙুল দিয়ে কাঁচের জানালার দিকে দেখালো।

বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। এ কয়দিন আকাশ পরিষ্কার ছিলো। রাতের মধ্যে মেঘ জমে বাইরেটা নিকষ কালো করে দিয়েছে। বিজলী চমকে উঠলো। সাথে সাথে শহীদও চমকে উঠে বালিশের তলায় হাত দিলো । দুইটা কালো মূর্তি জানালার গরাদ ধরে ঘরের মধ্যে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। গুডুম গুড়ুম করে মূর্তিগুলোর মাথার ওপর দিয়ে উপর্যপরি দুইবার গুলি ছুঁড়লো শহীদ। ঝন ঝন্ করে জানালার ওপরের দিকটার কাঁচ ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লো মূর্তি দুটো। তিন চার সেকেণ্ড পর হঠাৎ আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপরেই আর্তকণ্ঠে একজন মানুষের চিৎকার।

মহুয়া এলিয়ে পড়লো বিছানার উপর। শহীদ ব্যস্ত হয়ে ডাকে, মহুয়া! মহুয়া। অমন করছে কেন? কিছু হয়নি, ভয় পেয়ো না। ও মুহু। মুহু?

এমন সময় দমাদম দরজায় ধাক্কা পড়লো। শহীদ, দরজা খোল।

দরজা খুলতেই ছুটে ভেতরে ঢুকলো কামাল। টর্চ নিয়ে শিগগির বাইরে চল। আমি একটা লোককে জখম করেছি।

তুই-ই তাহলে আমার পরে গুলি ছুঁড়েছিলি?

সাত ব্যাটারীর একটা দীর্ঘ টর্চ নিয়ে ও বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে!

গেটের কাছে চল। কামাল আগে আগে যায়।

কই? নেই তো কেউ!

এইখানটায় পড়েছিল লোকটা। এই দেখ, রক্তের দাগ।

শহীদ চেয়ে দেখলো, সত্যি সত্যিই এক জায়গায় খানিকটা রক্তের দাগ। চারিধারে টর্চ ঘুরিয়ে দেখা গেল কোথাও কেউ নেই।

এই যে রক্তের দাগ। এই পথ ধরে সোজা চলে গেছে। খুব জখম হয়েছে ব্যাটা, অনেক রক্ত, চল দাগ ধরে এগোলে ব্যাটাদের পাবো। কামাল সামনে এগোয়।

এখন আর যাওয়ার দরকার নেই। হাঙ্গামা না বাড়ানোই ভালো। ভাের রাতে তো আমরা কেটেই পড়বে।

শহীদ আর কামাল ফিরে এলো জানালার ধারে। দুই জোড়া পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল বলে এই দাগগুলো মাটির মধ্যে গভীর হয়ে বসেছে।

দুই গুলি ছুঁড়লি কেন? কখন জাগলি ঘুম থেকে? শহীদ জিজ্ঞেস করে।

আমি একটা গুলির আওয়াজ শুনে জেগে গেছিলাম। জানালার ধারে আসতেই বিজলীর আলোয় দেখলাম দুইটা মূর্তি দৌড়ে গেটের বাইরে চলে যাচ্ছে। অমনি গুলি ঘুড়লাম। একজন চিৎকার করে বসে পড়লো দেখে ছুটে তোর ঘরে গেছিলাম।

শহীদ ঘরে এসে দেয়াল ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে। হঠাৎ মহুয়ার কথা মনে পড়তেই ছুটে নিজের ঘরে ঢুকলো। মহুয়া তখন উঠে বসেছে। কামালও পিছন পিছন এসে ঢুকলো ঘরে। মহুয়া বললো, পেলে ওদের? অনেক স্বাভাবিক গলা।

না। রক্তের দাগ ধরে, গেলেই পেতাম, কিন্তু দরকার নেই, তাই গেলাম না।

উঃ। বডে ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি তো প্রথম ভূত মনে করেছিলাম। এখন কয়টা বাজে কামাল ভাই?

সাড়ে তিন, শহীদ বললো, বড্ডো সাহসের পরিচয় দিয়েছো মহুয়া। Bravo, আফ্রিকা জঙ্গলে যাবারই উপযুক্ত।

লজ্জা পেয়ে মহুয়া বললো, না, এই, ঠিক আশা করতে পারিনি কিনা, তাই অতো ভয় পেয়েছিলাম। আর আমার দোষ কি। লোক দুটোর চোখগুলো যে কি সাংঘাতিক রকম জ্বলছিল, দেখলে তুমিও ভয় পেতে।

হা। গোঁ গোঁ আওয়াজ করে চিৎপটাং হয়ে বিছানায় পড়ে যেতাম।

মিছে কথা বলো না, আমি মােটেও গোঁ গোঁ করিনি।

তা করেনি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আফ্রিকা যাওয়া সম্ভব না। তোমার জিনিসপত্র বের করে রাখো, এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে কামালদের বাড়িতে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবো। আপাততঃ আমাদের একটু কফি খাওয়াবে? আর কোনোদিন হয়তো। তোমার হাতে কফি খেতে পাবো না।

মহুয়া নিঃশব্দে উঠে চলে গেল। স্টোভ জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিয়ে জানালা খুলে শহীদ আর কামালের দিকে পিছন ফিরে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

শহীদ বললো, কই মহুয়া, তোমার জিনিসপত্র খুলে রাখলে না? শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট দিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে আমরা কি করবো? তাড়াতাড়ি করো, আমরা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে রওনা হবে।

মহুয়া কোনো কথা বললো না, ওদের দিকে ফিরলেও না। ও রাগ করেছে বুঝতে পেরে শহীদ উঠে গেল ওর কাছে। এই বোকা মেয়ে ঠাট্টা বুঝতে পারো না? ঘোরো তো এদিকে, দেখি ও কি কাঁদছো কেন? ছিঃ, ছিঃ আমি ঠাট্টা করলাম, এদিকে তুমি কেঁদে অস্থির।

মহুয়া হাসবার চেষ্টা করলো। ধরা গলায় বললো, আর ভয় পাবো না। হঠাৎ ওদের দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম।

মনে থাকে যেন। আফ্রিকায় কতো কি বিপদ আসতে পারে। মনে মনে তৈরি না থাকলে ঘাবড়ে গিয়ে বিপদে পড়বে। এখন তাড়াতাড়ি আমাদের দুকাপ কফি খাওয়াও তো লক্ষ্মী।
ফ্লেমিংগো জাহাজ ছাড়লো চিটাগাং থেকে। মস্তবড় জাহাজ। কলম্বো আর মরিশাস হয়ে সোজা দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার ডারব্যান বন্দরে যাবে।

পাশাপাশি দুটো কেবিন পেয়ে গেছে শহীদরা। বড় কেবিনটায় শহীদ আর মহুয়া, আর মাঝারি কেবিনে কামাল। গফুর ডেকে ভালো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ফরিদপুরের মানুষ। যাত্রী হিসেবে নোয়াখালির পরেই ফরিদপুরের নাম। সব সময় এরাই ভালো ব্যবস্থা করতে পারে।

কামাল প্রচুর পরিমাণে বমি করেছে। জাহাজের ডাক্তার একটা মিকচার খেতে দিয়েছে তাকে। এখন সন্ধ্যার দিকে কিছুটা সুস্থ বোধ করছে সে।

মহুয়ার কিছুই হয়নি–ওর নৌকা চড়ে অভ্যাস আছে। আর গফুরের তো কথাই নেই। পদ্মা পারের মানুষ। সমুদ্র দেখে জিজ্ঞেস করবে, এ খালের নাম কি?

সন্ধ্যের পর সবাই কেবিনের সামনে ডেক চেয়ারে গিয়ে বসেছে। কয়টা চেয়ার আর মধ্যেখানে একটা টেবিল। ফুরফুর করে হাওয়া আসছে। জাহাজের খাবার ঘর থেকে অনেক মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ তালগোল পাকিয়ে একটা গোলমাল হয়ে এখানে এসে পৌঁছোচ্ছে। তবু ভাগ্য ভালো, তাদের কেবিন জাহাজের একেবারে সামনের দিকে। অনেকটা নিরালা। জাহাজের পেটের কাছের কেবিন হলে চিৎকার আর এঞ্জিনের শব্দ মিলে পাগল করে দিতো। এখানেও যে শব্দ কম, তা নয়। একঘেয়ে জল-কল্লোল। এ তবু সহ্য করা যায়।

অনেকক্ষণ বসে আছে তারা। দুবার কফি খেয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন অনুরোধ করেছিলেন dinner-টা সবার সাথে খাবার ঘরে খাওয়ার জন্যে। কিন্তু মহুয়া কিছুতেই রাজি হয়নি। কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে সুখ আছে। কাজেই তাদের খাবার সন্ধ্যার পর দিয়ে গিয়েছিল—অনেক আগে ওরা খেয়ে নিয়েছে।

তিনদিন আগে ছিলো পূর্ণিমা। চাঁদ আজ অনেক দেরি করে উঠছে। পুবের আকাশটা ফর্সা করে দিয়ে চাঁদ উঠলো। ছোটো ছোটো টুকরো মেঘ রয়েছে আকাশে। ঢেউয়ের মাথাগুলো চিকচিক করছে চাঁদের আলো পড়ে। বড় সুন্দর লাগছে শহীদের। পরিবেশটা বড় মিষ্টি। শহীদ বললো, জানিস কামাল, আমার মনে হয় পাহাড়ী ঠিক এই সময়কার রাগ। পাহাড়ী ঠুমরী শুনলে আমার মনে হয় একটা সুন্দর বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে বিরাট সমুদ্র! ঠিক এমনি করে চাঁদ উঠেছে। পাঞ্জাবী পাজামা পরে আছি, ফুরফুর করে মিষ্টি বাতাস আমার কাপড় নিশানের মতো ওড়াচ্ছে। মনটা কেমন জানি হয়ে গেছে। গাম্ভীর্য আবার সেই সাথে একটা আনন্দের পুলক। এমন মহান বিস্তারের সামনে এলে মনটা কিছুতেই ছোটো বা হাল্কা থাকতে পারে না। ঠিক এই সময় প্রিয়াকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে-তাকে আঙুল বাড়িয়ে দেখাতে ইচ্ছে করে পৃথিবী কতো সুন্দর।

ঠিক এমনি সময় গজ পনেরো দূর থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ এলো। সরোদের আওয়াজ! চমকে উঠে শহীদ, কামাল। স্বপ্ন না সত্যি? না ভুল শোনেনি তারা, বেজে উঠলো সরোদ। রাগ পাহাড়ী। উঃ, কি অদ্ভুত মিষ্টি! কুয়াশা, কুয়াশা ছাড়া এ আর কেউ , ফিসফিস করে বলে কামাল।

চুপ করে শোন। শহীদ ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখে।

অদ্ভুত বাজাচ্ছে কুয়াশা। চোখের সামনে স্পষ্ট ছবি যেন দেখতে পাচ্ছে শহীদ। এমন আর পাক-ভারতের কারও বাজানো সম্ভব না। এতো দরদ পাবে কোথায় অন্য লোকে? যেমন মিষ্টি তেমনি বোল্ড। যখন মিনতি তখন সুরটা কতো ইনিয়ে বিনিয়ে যায়; আর যখন পৌরুষ, তখন কী ভীষণ টোকা। যেন সব ভেঙে চুরমার করে দেবে। সরোদটা পুরুষের বাজনা। পুরুষের ঠিক মনের কথাটা সরোদে যতখানি প্রকাশ করা যায়। অন্য কোনো যন্ত্রে তা যায় না।

আধঘন্টাখানেক বেজে থেমে গেল বাজনা। সত্যিই। এমন বাজনা আর শুনিনি। মহুয়া অনেকক্ষণ পর কথা বলে।

শুনতে পারো না মহুয়াদি। পৃথিবীতে আর কেউ এতো ভালো জায় না।

কে বাজালো? মহুয়া মাথা নিচু করে বসে রইলো।

শহীদ বললো, কিন্তু কুয়াশা চলেছে কোথায়? আমাদের সাথে আফ্রিকা, না, আর কোথাও? আমি কল্পনাও করতে পারিনি এই জাহাজেই রয়েছে সে।

কিন্তু কুয়াশা কেন আমাদের পিছন পিছন চলেছে? কামাল বলে।

আল্লা মালুম!

আর দুদিন পর স্টীমার লরেঞ্জো মারকুইসে পৌছবে। ডারব্যানে নেমে এই স্টীমার ধরেছে শহীদরা। ডারব্যানে তাদের সাথে সাথে জন কতক নিগ্রো আর জন দশেক সাহেব জাহাজ থেকে নেমে স্টীমারে উঠেছে। এতদিন জাহাজে কিন্তু কোনও নিগ্রোকে দেখেনি শহীদ। খুব লক্ষ্য রেখেছিল শহীদ যাত্রীদের ওপর। তার সন্দেহ সত্য হয়েছে। একজন ফুলপ্যান্ট পরা লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে নামলো জাহাজ থেকে। এই দলটার মধ্যে লম্বা সর্দার, আর সেই সেদিন যে পথে তাকে দেখে বিটকেল হাসি দিয়েছিল, সেই লোকটাকে শহীদ দেখেই চিনতে পারলো। কিন্তু কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ না করে যেন চিনতে পারেনি এমনি ভাবে স্টীমারে গিয়ে উঠলো সে। ডারব্যান থেকে আরও বহু নিগ্রো যাত্রী উঠলো স্টীমারে। কিন্তু কুয়াশাকে দেখা গেল না।

শহীদ তাকে চিনতে পারেনি মনে করে গতকাল সর্দারটা তাদের সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করেছিল। তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কতো কথা বলে গেল সে, কতো মিষ্টি করে হাসি দিলো, কিন্তু মহুয়া কিছুতেই তার সামনে গেল না, কোনো কথাই বললো না।

তার কাছ থেকে জানা গেল যে তারা দক্ষিণ রোডেশিয়ার অধিবাসী। অতো Interlor-এ কেউ যায় না, তাই ওদের দেশ এখনও ভালো করে সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। দুএকজন যারা একটু আধটু বাইরে গেছে তারা অল্পস্বল্প ইংরেজি ও পুর্তুগীজ ভাষা জানে। লিষ্পোপোর ধারেই বোঙ্কারা অঞ্চলে ওদের বাড়ি। শহীদের সেদিকে শিকারে যাওয়ার ইচ্ছে আছে জেনে ভারি খুশি হয়ে নিমন্ত্রণ করলো সে। আদর আপ্যায়নের ক্রটি হবে না বলে ভরসা দিলো। শহীদ মনে মনে ভাবলো, তার নমুনা পেয়েছি দোস্তি।

অনেক চেষ্টা করেও এদের কি উদ্দেশ্য জানতে পারলো না শহীদ। কেন এরা এতদূর গেল? কেনই বা ফিরে এলো আবার ওদের সাথে? সবই শহীদের কাছে ঝাপসা লাগে।

দেখা যাক কি হয়, শহীদ ভাবে।

Gungunyanas Ford-এ পৌঁছলো শহীদরা খুব ভোরে। লিস্পোপোর স্রোতের উল্টো দিকে একশো মাইল লঞ্চে করে এসেছে তারা। লঞ্চ ঠিক বলা যায় না। মস্ত বড় একটা ক্যানো নৌকোয় এঞ্জিন বসানো। প্রচুর পরিমাণে তেল নিয়েছে তারা সাথে করে।

সেই নিগ্রোগুলো তাদের সাথে এক লঞ্চে আসতে চেয়েছিল। লঞ্চে জায়গা প্রচুর, শহীদের আপত্তি ছিলো না, বরং সুবিধাই হবে বলে মনে করেছিল। কিন্তু মহুয়া কিছুতেই রাজি হলো না। বাঘা, সেদিন রাতের সেই নিগ্রোর মুখ তার স্পষ্ট মনে আছে, সেই ভয়ঙ্কর লোককে নিয়ে আবার একই লঞ্চে এতদূর যাওয়া অসম্ভব।

শহীদ তাদের মানা করে দিয়েছে। ওরা একটা সাধারণ ক্যানো নিয়ে পিছন পিছন আসছে। Gungunyanas Ford-এ ওরা শহীদের সাথে দেখা করবে।

পথে অজস্র কুমীর দেখেছে তারা। কুমীরের ভয় অনেকটা কেটে গেছে মহুয়ার। জলে তো আছেই, ডাঙার ওপরও কিলবিল করেছে প্রচুর কুমীর। এতো বেশি যে মারতে ইচ্ছে করে না।

মাঝে মাঝে এঞ্জিনকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে পথে থেমেছে ওরা। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠলো লঞ্চ। মহুয়া শহীদকে জড়িয়ে ধরলো। ড্রাইভার বললো কুমীর লেজের ঝাপটা মেরে লঞ্চ উল্টিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছে।

কামাল লঞ্চের কিনারায় ছিলো। আরেকটু হলেই ছিটকে নদীতে পড়তো। এই নদীতে নাকি তিন সেকেণ্ড জলে পা ডুবিয়ে রাখলেই পায়ে টান পড়ে। আর সেখানে একটা জলজ্যান্ত মানুষ জলে পড়ে যাওয়া! চিন্তাও করা যায় না এরই নাম লিষ্পেপো, Crocodile River.
লঞ্চের হালের নিচের দিকটা লোহার। কারণ জিজ্ঞেস করায় ড্রাইভার বললো, কুমীরগুলো অনেক রকম বুদ্ধি খাটায়। যখন বড় বড় ক্যানো উলটিয়ে ফেলতে পারে না, তখন হাল ভেঙে ফেলে লেজের বাড়ি মেরে। ফলে স্রোতের মুখে নৌকা যেদিক খুশি সেদিকে চলে। পাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে হয় নৌকা ভাঙে এবং লোকগুলো কুমীরের পেটে যায়, নয় তো কোথাও গিয়ে আটকে থাকে। দিনের পর দিন কুমীরেরা অপেক্ষা করে থাকে। কোনো নৌকা যদি ভাগ্যক্রমে এসে পড়ে তো বেঁচে গেল, নইলে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যখন লোকগুলো ডাঙায় নামার চেষ্টা করে তখন ধরে নিয়ে যায় নিজ নিজ গর্তের মধ্যে।

নদীর দুপাশে ঘন বন। দেখলে মনটা দমে যায়। কেমন যেন ভয় ভয় করে। কয়েকজন জংলী লোকও দেখেছে ওরা। পাড়ে দাঁড়িয়ে গুদের মুখ ভ্যাঙাচ্ছিল। দূরে একটা হরিণ নেমেছিল জল খেতে, এঞ্জিনের শব্দ শুনে হকচকিয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্যে তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল গভীর অরণ্যে।

লঞ্চটা একজনই চালায়। ইংরেজ। যুবক। নাম জন ব্লাইদ। লঞ্চটা ওর নিজেরই। জন্ম এদেশেই। বাবা হয়তো এসেছিল ভাগ্য অন্বেষণে, সুবিধা পেয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড বড় শরীর মি. ব্লাইদের। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। দেখলে খুব সাহসী বলে মনে হয় তাকে। তেমনই আবার ভদ্রও খুব। Gungunyanas Ford-এ পৌঁছে কুফুয়াকে সে-ই খবর দিতে গেছে।

আধঘন্টা খানেক পর মি. ব্লাইদের সঙ্গে একজন বৃদ্ধ নিগ্রোকে আসতে দেখা গেল। খুব লম্বা ছিলো লোকটা। এখন কিছুটা নুয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। কাছে এলে হাতের পেশীর দিকে নজর গেল শহীদের। এখনও সতেজ। এই বয়সেও তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি আছে।

শহীদ হ্যান্ডশেক করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কুফুয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। একটু দূরে সরিয়ে আবার ভালো করে মুখ দেখলো। আবার জড়িয়ে ধরলো। Warm অভ্যর্থনার চোটে গরম হয়ে উঠলো শহীদ। মনে মনে ভাবছে সে, ম্যালা বিপদ রে বাবা!

এই রকম অবস্থায় কি করতে হয় বা বলতে হয় শহীদ বুঝতে পারলো না। এদের দেশের রীতিই বোধহয় এমন। আন্তরিকতার চাপে বুকের পাঁজর ভাঙার উপক্রম।

এতক্ষণে কথা বললো কুফুয়া, Shahid I suppose? Exactly like your father eh! (শহীদ না? একেবারে বাপের চেহারা পেয়েছে দেখছি!)

শহীদ একটা বিনয়ের হাসি দেবার চেষ্টা করলো। এদিকে তাকে ছেড়ে দিয়ে কুফুয়া এখন কামালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।-Youre Karnal, I guess. (আর তুমি বোধ হয় কামাল?)

Glad to meet you, Mr, Kufua, (আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম মি. কুফুয়া।)

what? Glad? I am simply overwhelmed. Any way. How have you enjoyed the journey? (আমি খুব খুশি হয়েছি। যাকগে, কেমন লাগলো যাত্রাটা।)

Oh, It was fine, (চমৎকার)।

প্রচুর পরিমাণে বকর বকর করলো কুফুয়া। তার সাথে ইসলাম খাঁ ও ইকবাল আহমেদের কি করে পরিচয় হলো, কি করে তারা কুমীর শিকার করেছিল, কেমন ভাবে। হঠাৎ ইকবাল আহমেদ কুমীরের খপ্পরে পড়লো, তা আবার অভিনয় করে দেখালো, সে কিসের কিসের ব্যবসা করে, মাসিক আয় কতো, তার আত্মীয়স্বজন কোথায় কে আছে, তাদের মধ্যে আবার কে কে মারা গেছে, কারা বেঁচে আছে, কারা শিগ্‌গিরই মারা যাবে, সব খবর শহীদদের জানতে আধঘন্টার বেশি লাগলো না। পনেরো ষােল বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত কি কি ঘটনা ঘটেছে সবই সবিস্তারে গড় গড় করে বললো সে। অন্য কাউকে কিছুই বলতে দিলো না।

তারপর হঠাৎ পকেট থেকে একটা চেক বই বের করে সাত হাজার পাউণ্ডের একটা চেক লিখে দিলো। বললো, লরেঞ্জো মারকুইসের লয়েডস ব্যাঙ্কে তোমরা এই চেক ভাঙিয়ে নিতে পারবে। কিংবা সেখানে জমা দিয়ে ঢাকা থেকেও টাকা তুলতে পার তোমরা। আমি এখন আর ব্যবসা দেখাশোনা করি না। বাড়িতে থাকি, ধর্ম কর্ম করি। আমার চার ছেলেই সব দেখাশোনা করে। আমি আর কতদিন, হয়তো আর একটা বছরও কাটবে না। আমার ছেলেরা অবশ্য অত্যন্ত সৎ, কিন্তু বলা তো যায় না, টাকা পয়সার ব্যাপার, যদি তোমাদের ঠকাতে চায়। তাই আমি নিজ হাতেই সব দেনা শোধ করে যাচ্ছি। মরবার সময় অশান্তি নিয়ে মরতে চাই না।

আপনার চার ছেলে এখন কোথায়? শহীদ জিজ্ঞেস করে।

ওরা লরেঞ্জো মারকুইসেই থাকে। এখানে কালে ভদ্রে আসে। এখন সবাই ওখানে আছে। এই সময়টা ব্যবসার season কিনা।

মহুয়া ওর নিজের হাতে তৈরি পরোটা আর হালুয়া দিলো কুফুয়াকে খেতে। খেয়ে অজস্র প্রশংসা করলো কুফুয়া। শহীদকে জিজ্ঞেস করলো, Who is she? (কে মেয়েটা?

My wife. (আমার স্ত্রী)

Oh good God! Why didnt you tell it before? Then you are my daughter-in-law, eh? Come, darling. Come forward. (তাই নাকি? আগে বলোনি কেন? তাহলে তো তুমি আমার পুত্রবধূ গো! এদিকে এসো তো লক্ষ্মী।)

কুফুয়ার অভ্যর্থনার রীতি মহুয়া নিজ চোখে দেখেছে। ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এক পা এক পা করে পিছনে সরছে সে। Dont be afraid darling. কুফুয়া এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো। তারপর নিজের গলা থেকে একটা হার খুলে বললো, You see the big stone? A solitaire diamond from our mine, Would you like to have it? বহুমূল্য হীরের হারটা মহুয়ার গলায় পরিয়ে দিলো সে। আপত্তি করবারও সাহস পেলো না মহুয়া।

তারপর সে শুরু করলো তাদের নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য জবরদস্তি। নিয়ে সে যাবেই। কয়েকদিন ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে তারপর দেশে ফিরতে পারে শহীদেরা। কুফুয়ার লোক তাদের নিয়ে একেবারে জাহাজে তুলে দিয়ে আসবে। লঞ্চ ছেড়ে দিতে বললো কুফুয়া।

কিন্তু শহীদ বললো যে দু একদিন সে কুফুয়ার বাড়িতে থাকতে পারে, কিন্তু তারপর সে যাবে দক্ষিণ রোডেশিয়ার বোঙ্কারা অঞ্চলে শিকার করতে। কাজেই লঞ্চ ছেড়ে দেয়া চলে না।

বোঙ্কারার নাম শুনেই চমকে উঠলো কুফুয়া। সামলে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বললো, ওখানে কেন শহীদ? আরও তো অনেক জায়গা আছে। Better go anywhere else.

কেন, ওখানে যাওয়ায় আপনার আপত্তি কিসের? বোঙ্কারা…

Sh…h…hবাধা দিয়ে মুখের ওপর হাত রাখলো কুফুয়া, এখানে ওই জায়গাটার নাম জোরে বলো না। ওদেশের বহুলোক এখানে আছে। বড় সাংঘাতিক তারা।

শহীদ বুঝলো ভেতরে আরও কথা আছে, সবটা বললো না কুফুয়া। ব্যাপারটা সেখানেই চেপে গেল শহীদ। বিকেল বেলায় কামাল, মহুয়া, গফুর সবাই বেড়াতে গেছে, সন্ধ্যার দিকে কুফুয়াকে একা পেয়ে শহীদ জিজ্ঞেস করলো, বোঙ্কারা সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?

কি শুনতে চাও?

প্রথমে বলুন ওখানকার লোক কেমন প্রকৃতির।

অত্যন্ত হিংস্র। ওরা প্রতিবছর কুমীরের কাছে নরবলি দেয়। আর সেজন্যে বাইরে থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যায়। আমাদের এখান থেকেও বছর বছর লোক ধরে নিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারিনি আমরা।

ওরা কি একেবারেই জংলী?

পুরোপুরি। ওদের দেশে দুই চারজন লোক আছে, যারা স্পাইয়ের কাজ করে। তারা মাঝে মাঝে বাইরে এসে সব রকম খবর নিয়ে যায়। তারা কিছু কিছু ইংরেজি বা পর্তুগীজ ভাষা বলতে পারে। শিক্ষা দীক্ষা বলতে কিছু নেই। ধর্ম হলো কুমীর দেবতার পূজা করা আর তাদের উদ্দেশে নরবলি দেয়া। ওদের দেশের শিশু থেকে শুরু করে বুড়ো পর্যন্ত অস্বাভাবিক গোঁড়া।

আচ্ছ, ওরা কি সুদূর ভারতবর্ষেও যায় মানুষ ধরবার জন্যে।

না। অতদূর যাওয়ার দরকার পড়ে না, এখানেই ওরা প্রচুর মানুষ পায়।

ওদের জীবিকা নির্বাহের উপায় কি?

প্রচুর পরিমাণে ফলের গাছ এমনিতেই ওদের অঞ্চলে আছে। তাছাড়া নানা রকমের ফলের চাষ করে ওরা। হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, বন্যষাঁড়, হাতি, হিপোপটেমাস, এসব জন্তু শিকার করে তার মাংস খায়। কেউ কেউ গম ভূট্টার খেতও করে, তবে খুব কম।

আপনি এসব জানলেন কি করে?

আমার যুবক বয়সে, তা প্রায় আঠারো উনিশ বছর হবে, একবার ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে বলি দেবে বলে। অনেক কষ্ট করে ছুটে আসতে পেরেছিলাম। তখনই ওদের সব কিছু দেখে এসেছিলাম। আমার এখনও মনে আছে কতো বন জঙ্গলে অনাহারে অনিদ্রায় ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র আমি। এখন সেসব কল্পনা করলেও গায়ে কাঁটা দেয়। গভীর রাতে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে নিচে বাঘ-সিংহের লড়াই দেখেছি। হাতির দল দাপাদাপি…

শহীদ দেখলো বুড়ো এখন মস্ত বড় গল্প ফেঁদে বসবে। তাড়াতাড়ি বললো, আমার কাছে কতগুলো ব্যাপার বড় অদ্ভুত লেগেছে। আপনাকে বললে আপনি হয়তো তার অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন।

দক্ষিণ রোডেশিয়া থেকে কয়েকজন নিগ্রোর ঢাকায় যাওয়ার এবং তাদের সাথে ফিরে আসবার কথা সবিস্তারে বললো শহীদ। বাবার চিঠি, শহীদের ওপর আক্রমণ, সেদিন রাতে ঘরে উঁকি দেয়া কিছুই বাদ দিলো না সে। কুফুয়া চুপ করে শুনলে সবটা। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে তার মুখ।

ঠিক এমনি সময় বাড়ির বাইরে দশ-বারো জন লোকের হট্টগোল শোনা গেল। কারা যেন এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। শহীদ ও কুফুয়া বেরিয়ে এলো বাইরে। কয়েকজন নিগ্রো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুফুয়া ওদের ভাষায় বোধকরি জিজ্ঞেস করলো, কি চাও তোমরা?

ওরাও কি যেন বললো। আবার কুফুয়া কথা বলে। কি কথা হচ্ছে শহীদ তার বর্ণও বোঝে না। কিন্তু কুফুয়া যে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তা সে বেশ বুঝতে পারলো। শহীদকে ঘরের ভিতর যেতে বললো কুফুয়া। শহীদ ভিতরে চলে এলো। এসেই দেখলো। কুফুয়ার স্ত্রী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তার ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিছুই বুঝলো না শহীদ। কুফুয়া আর পেণ্ডা ছাড়া কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবার উপায় নেই। আর কেউই ইংরেজি জানে না।

মিনিট পনেরো তর্কাতর্কি করে কুফুয়া ঘরের ভিতর এলো। একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল তুলে নিলো হাতে। শহীদকে বললো, আমি এই দরজার আড়ালে রইলাম, তুমি গিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে দাঁড়াও। ভয় পেয়ো না, আমি রয়েছি পিছনে।

শহীদ তার কথামতো বাইরে এসে দাঁড়ালো। কি ব্যাপার সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কুফুয়া এতো উত্তেজিত হয়েছে কেন?

জন দশ-বারো লোক এগিয়ে এলো শহীদের দিকে। তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ওরা। বিড়বিড় করে মিনিট দুয়েক তাদের নিজেদের ভাষায় কি মন্ত্র পড়লো। তারপর নিঃশব্দে ফিরে চললো তারা।

শহীদ বোকার মতো চেয়ে রইলো তাদের দিকে। কুফুয়া রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলো বাইরে, তারপর আচমকা গুলি ছুড়লো লোকগুলোর ওপর। একটা, দুইটা, তিনটা এমনি করে ছটা গুলিতে দুজন লোককে মাটিতে ফেললো সে। ভীষণ চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তারা। কুফুয়া এদিকে রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলে ফেলেছে। শহীদকে বললো, রিভলভার ছোঁড়, আমি ততক্ষণে গুলি ভরে নিই।

ব্যাপারটা এতো আচমকা ঘটে গেল যে শহীদের বুদ্ধি সম্পূর্ণ লোপ পাওয়ার উপক্রম হলো। এটুকু সে বুঝেছে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুতর, নইলে কুফুয়ার মতো স্থিরমস্তিষ্ক মানুষ শুধু শুধু খুন খারাপি করতে পারে না। শহীদ দ্রুত চিন্তা করছে। এই বিদেশে এসে মানুষ খুন করে জেল খাটবে নাকি শেষ পর্যন্ত?

কিন্তু চিন্তা করবার আর সময় নেই। শহীদ দেখলো বাকি চার-পাঁচজন নিগ্রোর একজন সংবিত ফিরে পেয়ে পিস্তল বের করেছে। ব্যাপারটা প্রথম তারা বুঝতে পারেনি। চোখের সামনে ছজন সাথীর লাশ দেখে হঠাৎ ওরা রুখে দাঁড়ালো। কুফুয়ার দিকে নিশানা করেছে পিস্তলধারী। গুলি করলো শহীদ। তার গুলি পিস্তলধারীর কপাল ফুটো করে ঢুকে গেল মগজের মধ্যে। অদ্ভুত একটু গোঙানি তুলে লুটিয়ে পড়লো লোকটা। কুফুয়ার ততক্ষণে গুলি ভরা হয়ে গেছে। চোখের নিমেষে বাকি চারজন চিৎকার করে ধরাশায়ী হলো। শহীদ আর কুফুয়া এগিয়ে গেল লাশগুলোর দিকে। একজন তখনও একটু একটু নড়ছিল। রাইফেলের আগাটা তার কপালে ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দিলো কুফুয়া, ব্যাস খতম। রক্তে মাটিটা লাল হয়ে গেছে।

চোখের সামনে এগারোটা মৃতদেহ পড়ে আছে। লোকগুলোকে তারাই খুন করেছে। অথচ কারণ জানে না শহীদ এই নির্মম হত্যার। গা-টা গুলিয়ে আসে শহীদের, কেমন একটু বমি বমি লাগে অতো রক্ত দেখে।

হঠাৎ দূরে অনেকগুলো আলো দেখা গেল। অনেক লোক যেন কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। বোধকরি গুলির আওয়াজ আর লোকগুলোর আর্তনাদ শুনতে পেয়ে লোকজন আসছে খবর নিতে। কুফুয়া রাইফেলের ওপর ভর দিয়ে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে রইলো।

এদিকে লোকগুলো ক্রমে এগিয়ে আসছে। শহীদ গিয়ে কুফুয়ার কাছে দাঁড়ালো। কুফুয়া গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছে। তার জামার আস্তিন ধরে একটু টান দিলো শহীদ। বললো, মানুষ এসে পড়ছে। কোনরকম অসুবিধা হবে না?

না। কুফুয়া তার দিকে কেমন অদ্ভুত করে তাকায়। শহীদ ভাবে, পাগল হয়ে গেল না তো ব্যাটা?

না, পাগল হয়নি। লোকগুলো এসে লাশ দেখেই খানিকটা পিছু হটে গেল। তারপর কুফুয়াকে দেখে অত্যন্ত নম্রভাবে কি যেন জিজ্ঞেস করলো। কুফুয় এগিয়ে গিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে তাদেরকে কিছু একটা বোঝালো। ওরা অদ্ভুত চোখে শহীদের দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার, তারপর পটাপট লাশগুলো তুলে নিয়ে কুফুয়ার পিছন পিছন লিতে শুরু করলো। শহীদও চললো ওদের সাথে সাথে। একটা কুপের মধ্যে লাশগুলো ফেলে কুফুয়ার বাড়ি থেকে কোদাল এনে মাটি কাটা শুরু করলো তারা। মাটি চাপা দিয়ে কবর দিলো তারা লোকগুলোকে। রক্তের দাগ চেঁছে ফেলা হলো। তারপর সবাই কুফুয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

এতো বড় পৈশাচিক ব্যাপার অত্যন্ত অবলীলাক্রমে যেন ঘটে গেল। এতগুলো খুন হলো, তার জন্যে কোনও চাঞ্চল্য নেই এদের মধ্যে। যেন হরদমই এমন ব্যাপার দেখে আসছে তারা। এদেশে পুলিস নেই নাকি? আইন নেই কোনও? এতোই সোজা এখানে খুন করে গুম করে ফেলা? নাকি এই লোকগুলোর ওপর সবাই চটা? এই খুনের সাক্ষী যারা তাদের মধ্যে থেকে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো? বড় অস্বস্তি লাগে শহীদের।

ঠিক এই সময় একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল দূর থেকে। গাছের তলায় আবছা আলো-অন্ধকারেও শহীদ স্পষ্ট দেখলে একজন নিগ্রো রাস্তায় পড়েই দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুকুয়া বাড়ির দিকে হাটছে চিন্তিত মুখে। কিছু না বলে শহীদ তার পিছন পিছন চলতে লাগলো।

শহীদ ভাবছে, মহুয়ারা ফেরে না কেন এখনও?
এদিকে বিকেল বেলা কামাল, মহুয়া, গফুর আর কুফুয়ার এক মেয়ে পেণ্ডা জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখে আসতে গেছে। শহীদ সকালে বেশ খানিকটা ঘুরে এসেছিল, তাই ও আর গেল না। গফুরেরও যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না, দিদিমণি যখন যাচ্ছে তখন সেও চললো ওদের পিছু পিছু!

জায়গাটা বেশ ছোটো। কিন্তু বহু লোকের বাস এখানে। কাঠের ব্যবসার মস্ত বড় একটা ঘাঁটি এই Gungunyanas Ford. কুফুয়ার বাড়ির দিকটা বেশ নির্জন কিন্তু আর একটু দক্ষিণে অনেক কুঁড়েঘর দেখা গেল পাশাপাশি। ঘরগুলো মাটির তৈরি। ওপরে খড় বা শনের ছাউনি। আলো-বাতাসের কোনো বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে। ছোটো একটা গর্ত মতো জায়গা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢােকা হয়, দরজাও নেই একটা। মেয়েরা কেউ বাড়ির সামনে মাটি কোপাচ্ছে, ভুট্টার খেত নিড়াচ্ছে কেউ বা ছেলে কাঁখে নিয়ে রান্না চড়িয়েছে। সবাই কামালদের দেখে কাজ ফেলে রেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। অদ্ভুত সব কাপড়-চোপড় পরা এতগুলো মানুষ কোথেকে এলো রে বাবা!

কামালরা আরও দক্ষিণে চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে। দূরে মেঘের মতো দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট পাহাড়। কিছুদূর গিয়ে একটা বিল পাওয়া গেল। চওড়া খুব বেশি না। কিন্তু অত্যন্ত লম্বা। বহুদূর গিয়ে বাঁ পাশে বেঁকে গেছে। আরও কতদূর গেছে কে জানে। পেণ্ডার কাছ থেকে জানা গেল ওটা একটা হ্রদ।

কামাল বললো, বাড়ির এতো কাছে এতো সুন্দর হ্রদ আছে আগে বলেননি কেন? বোকার মতো আমরা তোলা জলে স্নান করলাম।

বোকার মতো নয়, বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন, মি. কামাল। এখানে নামলে আর ফিরতে হতো না। চিরকালের জন্যে রয়ে যেতে হতো। সুন্দর পরিষ্কার ইংরেজিতে বললো পেন্ডা। মিশনারীদের স্কুলে পড়ে খুব ভালো আয়ত্ত করেছে সে ইংরেজি উচ্চারণ।

কি ব্যাপার, এখানেও কুমীর নাকি।

ছিলো না আগে। কুমীরের ভয়ে মানুষ লিম্পোপোতে নামতো না, আগে এখানেই স্নান করতো। কিন্তু কি করে জানি কুমীরেরা এ জায়গার খোঁজ পেয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল এই হ্রদ থেকে একজন মানুষকে মুখে নিয়ে একটা কুমীর লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠলো, তারপর প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মানুষজন তাড়া করেছিল। কিন্তু কেউ এগোতে পাড়লো না। লেজের প্রচণ্ড ঝাপটায় বড় বড় মাটির চাকা আর পাথর ছুড়তে ছুড়তে চলে গেল কুমীরটা। তারপর থেকে তিন-চারদিন একই ব্যাপার ঘটলো। প্রতিদিনই কয়েকজন মানুষ মুখে করে নিয়ে যায় কুমীর। রাতে চুপি চুপি এসে ঘাটের কাছে জলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে, দিনের বেলায় সুযোগ পেলেই একজন লোককে মুখে করে নদীতে চলে যায়। তারপর পাহারাদার বসিয়ে দেয়া হলো, কাউকে আর নামতে দেয়া হতো না। এখন আর কেউ নামে না এখানে। ভুল করে বিদেশী কেউ নামলে সাথে সাথে কুমীরের পেটে যায়।

এখানকার সবাই কি তাহলে তোলা জলে স্নান করে রোজ?

এখানে সবাই এক সপ্তাহ পর পর স্নান করে। কেউ কেউ আরও দেরিতে করে। তোলা জলে স্নান করতে অসুবিধে বিশেষ হয় না।

সূর্য অস্ত গেছে। মহুয়া বললো, ফেরা যাক এখন, পেণ্ড। অনেকদূর এসে পড়েছি, বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

আর একটু গিয়েই ফিরবো আমরা। ওই সামনের বাঁকটায় গেলেই দেখতে পাবেন, আমাদের এখানকার সবচাইতে আশ্চর্য জিনিস। পেণ্ডা দ্রুত হাঁটে।

বাঁকটায় পৌছেই আশ্চর্য হয়ে গেল সবাই। সামনে বিরাট মাঠ, এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল মাঠ আর মাঠ। গমের চাষ করা হয়েছে সে মাঠে। এখন গম পাকবার সময়। সোনালি হয়ে গেছে সমস্ত মাঠ। দূরে একটা গিরিশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। মাথায় তার জমে আছে বরফ। সূর্যের আলো পড়েছে বরফের ওপর। মনে। হচ্ছে যেন পাহাড়ের মাথাটা ধক্ ধক্ করে জ্বলছে। সে পাহাড় থেকে একটা মিষ্টি আলো চারদিকে একটা ছড়িয়ে পড়ে স্বপ্নের আবেশ মেখে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বিস্তার আর উচ্চতা ঠিক এমনভাবে বোধহয় আর কোথাও একত্র মেশেনি। এখানে এসে দাঁড়ালে মনটাও হয়ে ওঠে প্রশস্ত, আর বৃহৎ।

অনেকক্ষণ কামাল আর মহুয়া মােহগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পাহাড়ের ওপরের আলোটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কারও কোনদিকে খেয়াল নেই।

অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে পেণ্ডা বললো, চলুন, ফেরা যাক।

চলুন। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে কামাল। কিন্তু ফিরতে তার মােটেই ইচ্ছে করছে না। এ সৌন্দর্যের যতটুকু পারে পান করে নিতে চায় সে।

ধীরে ধীরে তারা বাড়ির দিকে চললো। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। কামাল বললো, এতো সুন্দর জায়গা, বিকেল বেলা কেউ বেড়াতে আসে না কেন?

সময় পেলে তো মানুষ আসবে। কেবল খেয়ে বেঁচে থাকবার চেষ্টাতেই এখানকার সব লোকের সময় চলে যায়। আমাদের দেশটা বড় গরীব। সব কিছুই শুষে নিচ্ছে ইংরেজ। সৌন্দর্য বোধটুকুও আর নেই। পেণ্ডার গলাটা কেমন যেন একটু ভারি হয়ে আসে। একটু কৃত্রিম হাসি হেসে বললো, কিন্তু আমার তো জীবন-সংগ্রাম নেই, তাই আমি প্রায়ই আসি এখানে সৌন্দর্য উপভােগ করতে, পয়সার অভাব না থাকলে জীবনে কতো রস ভােগ করা যায়।

কামাল মনে মনে আশ্চর্য হলো। এতো বোঝে এই কচি মেয়েটা! এর চোখ খোলা। সব কিছুই পরিষ্কার করে দেখবার ক্ষমতা আছে এর! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কামাল বললো, আচ্ছা, পেণ্ডা মানে কি?

পেণ্ড। মানে? একটু হেসে বললো, পেণ্ডা মানে ভালবাসা। হ্রদটার পাশ দিয়ে চলতে মহুয়ার খুব ভয় করছে। সে পেশুকে জিজ্ঞেস করলো, যে কোনো মুহূর্তে আমাদের একজনকে তো কুমীরে ধরে নিয়ে যেতে পারে, তাই না?

কি বললেন? কুমীর? না। ডাঙার ওপর ওরা আক্রমণ করে না। মানুষের সাড়া পেলে আরও ঝুপঝুপ জলে লাফিয়ে পড়ে। অবশ্য এমনও দেখা গেছে, একলা নিরস্ত্র পেয়ে ডাঙার ওপরেও মাঝে মাঝে আক্রমণ করেছে মানুষকে। কিন্তু তিন-চারজন দেখলে ওরা কখনও এগোয় না। আসলে কুমীর জাতটা অত্যন্ত ভীতু। ঠিক বড় লোকদের মতো।

হ্রদটা ছাড়িয়ে এলো তারা। আঁকাবাঁকা পথ। পথের দুপাশটায়-মাঝে মাঝে অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে। জায়গাটা ঘন অন্ধকার। তারপর আবার ফাঁকা।

গফুর বেশ একটু পিছিয়ে পড়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে ধীরে ধীরে আসছে। যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্যে সে ভালো করে নজর করে দেখেছে মাঝে মাঝে কামালদের। পথ হারিয়ে ফেললে ও আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। দাদামণিরা ইংরেজিতে কথা বলে ওদের সাথে, কিন্তু সে তাও জানে না। এখানকার একটা ব্যাটাও বাংলা বোঝে না।

কিছুদূর গিয়ে গফুর আর কামালদের দেখতে পেলো না। একটা ঘন অন্ধকার জায়গায় তারা অদৃশ্য হয়েছে। বিড়িটা শেষ হয়ে গেছে, একটা সুখ টান দিয়ে গফুর ফেলে দিলো বিড়ি। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চললো সে। অন্ধকার জায়গাটায় এসে পড়েছে, গফুর, এমন সময় কাছেই একটা ঝটপটির আওয়াজ শোনা গেল। কয়েকজন মানুষ মৃদুস্বরে কথা বলছে। গফুরের কেমন যেন সন্দেহ হলো। কামাল ভাইদের দেখা যাচ্ছে না কেন? সে কি জোরে ডাকবে নাম ধরে? না, তাতে বিপদ হতে পারে।

একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো সে। কাছেই একজন লোক টর্চ জ্বালালো। সেই আলোতে গফুর দেখলো, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে কামাল, পেণ্ডা আর তার দিদিমণি। সবারই মুখের মধ্যে কাপড় গোঁজা। কেউ চিৎকার করতে পারছে না। আট দশজন লোক তাদেরকে কাঁধের ওপর তুলে নিলো। তারপর পিছনে যতদূর দেখা যায় টর্চ জ্বেলে দেখে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো যে পথে ওরা গিয়েছিল সেই পথেই।

মাথায় রক্ত চড়ে গেল গফুরের। কিছু না পারে, অন্ততঃ একজন লোকের টুটি তো সে ছিড়ে ফেলতে পারবে। তারপর যা হয় হোক। তার দিদিমণিকে আক্রমণ করার মজা সে টের পাইয়ে দেবে। ওদের দিকে জোরে হাঁটা শুরু করলো গফুর। পরক্ষণেই আবার ভাবলো, এতো লোককে আক্রমণ করা মানেই এদের হাতে বন্দী হওয়া। তা সে চায় না। দাদামণিকে সব খবর দিতে হবে, নইলে উদ্ধারের কোনো পথই থাকবে না। এদের পিছনে পিছনে গিয়ে দেখতে হবে এরা যায় কোথায়।

বেশ কিছুটা পিছিয়ে এলো সে। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলো লোকগুলোর উপর।

কুফুয়ার বাড়ি বাঁ দিকের রাস্তায়, সে রাস্তায় না গিয়ে এরা ডান দিকের একটা পথ ধরলো। অনেকটা পিছনে গফুরও চললো। মাঝে মাঝে বড় ফাঁকা জায়গা পড়লে সে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় ধরা পড়বার ভয়ে।

ডান দিকের রাস্তা ধরে বরাবর মাইল দুয়েক চলে গেল তারা। এদিকে লোকালয় নেই। গাছ-গাছড়া বেশ ঘন হয়ে এসেছে। পথটা সরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। আর কিছুদূর গেলেই ঘন বনের মধ্যে পড়বে তারা।

আকাশে চাঁদ উঠছে এখন। বেশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে অন্ধকার। একটা বাঁক ঘুরতেই গফুর ডাকবাংলোর মতো ফুটফুটে একটা বাড়ি দেখতে পেলো। কাঠের বাড়ি, বাইরেটা চুনকাম করা। চাঁদের আলোয় ধব ধব করছে বাড়িটা।

লোকগুলো সে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন এগিয়ে গিয়ে দরজার তালা খুললো, তারপর সবাই ঢুকে পড়লো বাড়ির মধ্যে।

একটা গাছের আড়ালে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো গফুর। কেউ আর বাইরে আসে না। আরও খানিকক্ষণ পর চারজন লোক বেরিয়ে এলো বাড়িটা থেকে। তারা ফিরে চললো যে পথে এসেছিল সেই পথে। সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল বাড়িটার। অনেকখানি পিছনে থেকে গফুরও চললো ওদের সাথে সাথে। অনেকদূর গিয়ে একটা ছোটো খড়ের ঘরে ঢুকলো ওরা সবাই।

কিন্তু এই বাড়িগুলো এমন কেন? একটা এদিকে আরেকটা ওদিকে এবড়োখেবড়ো করে সাজানো। বিকেলবেলা বেড়াতে যাওয়ার সময় তো বাড়িগুলো এমন দেখেনি সে, পরিপাটি করে সাজানো ছিলো সেসব কুঁড়েঘর। পথ ভুল হলো নাকি? হ্যাঁ, ঠিক ভুল পথে এসেছে সে।

আবার অনেকদূর ফিরে গেল গফুর। রাস্তাগুলো এমন যে চেনা যায় না, একেঁবেকেঁ চলেছে পথ। এক রাস্তা থেকে আবার বহু রাস্তা বেরিয়েছে। ঠিক সমানই চওড়া। সেগুলো আবার ঠিক অন্য সব রাস্তার মতো এঁকেবেঁকে চলেছে। একটা রাস্তা আন্দাজ করে গফুর চলতে শুরু করলো। মাইলখানেক যাওয়ার পর দেখলো সামনে লিপোপো নদী। আবার ফিরে গেল সে।

এমনিভাবে অনেক ঘুরেও ঠিক রাস্তা সে কিছুতেই চিনতে পারছে না। রাগে, দুঃখে, ক্লান্তিতে তার অবস্থা কাহিল। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে। আর চলা যায় না। রাতও এদিকে অনেক হয়েছে। তার বুদ্ধি লোপ পাওয়ার উপক্রম হলো। অনেকক্ষণ রাস্তার উপর বসে রইলো। একটা বিড়ি খেলো। তারপর আবার চলা শুরু করলো সে। এদিকে আকাশে মেঘ করেছে অনেকক্ষণ ধরে। চাঁদ সেই যে মেঘের আড়ালে গেছে আধঘন্টা আগে আর বেরোবার নাম নেই। আবছাভাবে পথ দেখা যাচ্ছে। অনেকদূর এসে সে কতগুলো বাড়ি দেখতে পেলো। কিছুমাত্র উৎসাহিত হলো না সে। এই গোলকধাঁধায় পড়ে তার সমস্ত উৎসাহ নিভে গেছে ঘুরতে ঘুরতে। এদিকে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টি নেমে এলো বড় বড় ফোটায়।

আর চিন্তা করবার অবসর নেই। সে ছুটে গেল একটা বাড়ির সামনে। ছোট্ট দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগলো, কে আছো ভাই বাড়িতে ও ও ভাই, কে আছো?

একজন বৃদ্ধ নিগ্রো বেরিয়ে এলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছে সে। গফুর তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। আরও কয়েকজন লোক ঘুম থেকে উঠে এসেছে। গফুরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তারা। একজন কি জানি জিজ্ঞেস করলো গফুরকে। কিছু বুঝলো না গফুর। ওরা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করছে তাকে। প্রমাদ গোনে গফুর। আচ্ছা মুশকিলেই পড়া গেল তো। কেউ ওর কথা কিছু বুঝবে না। হঠাৎ ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ও, বললো, এই হারামজাদারা, তোরা কি আমাকে কুফুয়ার বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবি?

এইবার বুঝলো তারা। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কুফুয়া কুফুয়া করে কি কি সব বলাবলি করতে লাগলো। তারপর একজন জোয়ান নিগ্রো তার হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো। গফুরকে সঙ্গে আসতে ইশারা করে সে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ-ছ মাইল হাঁটার পর গফুর চিনতে পারলো, বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। লোকটার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তারপর একটা বিড়ি বের করে দিলো। লোকটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে নিজে বিড়ি ধরালো। বাংলায় বললো, এইভাবে খেতে হয়। বলে টান দিয়ে দেখালো। লোকটা বুঝতে পেরে বিড়িটা ধরিয়ে নিলো। একবারও কাশলো না দেখে গফুর বুঝলে তামাকে অভ্যাস আছে ব্যাটার। আরও কয়েকটা বিড়ি সে ধরিয়ে দিলো লোকটির হাতে। খুব খুশি হলো নিগ্রোটা। গফুর বাড়ি চিনতে পেরেছে দেখে সে ফিরে চলে গেল। একটা বিটকেল হাসি দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। বাড়ির কাছে এসেই থ হয়ে গেল গফুর। বাড়ি তো নেই, অনেক ছাই গাদা হয়ে রয়েছে। বাড়ি পুড়ে গেছে। কেউ নেই আশেপাশে। স্তম্ভিত হয়ে কাদার মধ্যেই মাটিতে বসে পড়লো গফুর।
শহীদ আর কুফুয়া ঘরে ফিরে এসে একটা চৌকিতে বসলো। শহীদ জিজ্ঞেস করলো, ধরা পড়বেন না পুলিসের হাতে?

না। ধরা পড়লেও ভয়ের কারণ নেই।

কেন?

যে লোকগুলোকে খুন করা হলো ওদের এদেশে প্রবেশাধিকার নেই। সরকারীভাবে বহু আগেই আইন পাস হয়েছে। এরা গায়ের জোরে প্রবেশ করে। আমাদের দেশের লোকের সাথে এরা এমনভাবে মিশে যায় যে এদের চিনে বের করে তাড়াতে পারছে না পুলিস। আর চিনতে পারলেও সব সময় সাহসও পায় না।

এরা থাকে কোথায়?

বোঙ্কারা। সেখানেই ওদের বাসা।

I see! অনেক মিলে যাচ্ছে। ঢাকায় যে সব লোক গেছিলো তারাও বোঙ্কারার লোক। তারাও আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র পড়েছিল।

হ্যাঁ। এই এদের নিয়ম, গম্ভীরভাবে বলে কুফুয়া।

এরা কি যে কোনও একজন নতুন লোকের সামনে এমনি করে?

সে সব বলতে গেলে অনেক কথা, শহীদ। তোমাকে পরে সব গুছিয়ে বলবো। এখন এ প্রসঙ্গ থাক। তোমাকে নিয়ে সকালবেলা বাইরে যাওয়াই উচিত হয়নি। I should have doubted this befor.

আপনি কি বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না, মি. কুফুয়া। Will you kindly make it clear?

পরে শহীদ, পরে।

আপাততঃ একটা কথার জবাব দেবেন কি?

কি কথা?

এতগুলো মানুষ শুধু শুধু খুন করলেন কেন?

Oh Shahid! Youre questioning like a pleader. যাক তোমার যখন এতোই আগ্রহ, তখন শোনো। এদের খুন না করলে আজ রাতে এ বাড়ি আক্রমণ করে বা যে করেই হোক তোমাকে ওরা ধরে নিয়ে যেতো বোঙ্কারায়। সকালে আমার সাথে তোমাকে দেখেছে ওরা। তাই সন্ধ্যায় এসে হাজির হয়েছিল তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে। আমি ভয় দেখিয়েছিলাম যে ঘরের মধ্যে আমার দশ-বারজন লোক আছে। ওদের কেবল মাত্র ইশারা করলেই তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। তাই ওরা শেষ পর্যন্ত এই শর্তে রাজি হয়েছিল যে ওরা কেবল প্রার্থনা করেই ফিরে যাবে। সত্যি সত্যিই তাই তারা যাচ্ছিলো। কিন্তু আমি চিন্তা করে দেখলাম এদের কিছুতেই বাঁচতে দেয়া যেতে পারে না। আজ এরা এমনিতেই ফিরে যাচ্ছে বটে কিন্তু যে কোনও উপায়ে এরা তোমাকে হস্তগত করবেই। তাই সব কজনকে শেষ করে দিলাম। এখন তোমাকে লুকিয়ে কোনও মতে ভারতগামী জাহাজে তুলে দিতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।

এরা আমাকে কেন নিয়ে যেতে চায়?

ছাড়বে না যখন, তখন গোড়া থেকেই বলি। দক্ষিণ রোডেশিয়ার বোঙ্করা অঞ্চলের অসভ্য অধিবাসীরা কুমীর পূজা করে। এর জন্যে তাদের একজন পুরোহিত থাকে। তাদের ধারণা পুরোহিতই একমাত্র কুমীরের কোপ থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এই পুরোহিতের সামনে রোজ সন্ধ্যায় এরা হাঁটু গেড়ে বসে কুমীর দেবতার আনুগত্য স্বীকৃতির শ্লোক উচ্চারণ করে। ওদের পুরোহিত যখন বুড়ো হয়ে যায়। তখন এরা দেশ-বিদেশে লোক পাঠায় আরেকজন পুরোহিত ধরে আনার জন্যে। নতুন পুরোহিতের চেহারা অনেকটা পুরোনো পুরোহিতের মতো হওয়া চাই। নতুন পুরোহিতকে কাজ বুঝিয়ে দেয়ার পর পুরোনো জনকে লিম্পোপোর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার চেহারা পুরনো বৃদ্ধ পুরোহিতের মতো দেখতে। তাই তাঁকে ছুটি দেয়ার জন্যে ওরা তোমাকে নিয়ে যেতে চায়।

শহীদের মাথায় বোঁ করে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরে গেল। তবে কি তার বাপকেও ওরা নিয়ে গেছে? নইলে তার ঠিকানা পেয়ে ওরা ঢাকায় যাবে কি করে? তার বাবা কি এখন বন্দী হয়ে বোঙ্কারার পুরোহিতের কাজ করেছেন? বাবার চিঠির আদ্যোপান্ত মনে পড়লো ওর।

তোমার মাথায় এখন যে সব চিন্তা ঘুরছে, সে সব কথা আমার মাথায়ও আজ সন্ধ্যায় ঘুরেছে। তাই অতো গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছো তো, কেন খুন করেছি এতো লোককে? ওরা তোমাকে দেখে ফেলেছিল, আর মনে মনে পুরোহিক হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল। ওদের পথ থেকে সরিয়ে না ফেললে তোমার খুবই বিপদ হতো। ওরা গিয়ে শত শত লোককে খবর দিতো। তাদের ঠেকাতাম কি করে?

ওদের সবাই কিন্তু মারা পড়েনি, মি, কুফুয়া। আমরা যখন বাড়ি ফিরে আসি তখন দেখেছি একজন লোক গাছের আড়াল থেকে সরে রাস্তায় পড়েই দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তাই নাকি? আগে বলেনি কেন? উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো কুফুয়া। চিন্তিত মুখে সারা ঘরে পায়চারি করতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, তোমাদের লঞ্চটা আছে না? আজ রাতে আমরা সবাই সেখানে গিয়ে থাকবে। গয়না গাটি টাকা-পয়সাও সাথে নিতে হবে। আজই রাতে হয়তো দল বেঁধে বাড়ি ঘেরাও করে খুনের প্রতিশোধ নিতে আসবে। তার আগেই আমাদের সরে পড়তে হবে। আমরা অল্প কয়েকজন ওদের অতো লোক ঠেকাতে পারবো না।

কিন্তু কামালরা ফিরছে না কেন? রাত তো অনেক হলো।

পেণ্ডার সাথে গেছে, অতএব পথ হারাবার ভয় নেই।

আমি ভাবছি কোনও বিপদে পড়লো না তো?

বোঙ্কারার লোক ছাড়া এখানকার সব লোকই মােটামুটি ভালো। তাছাড়া পেণ্ডা রয়েছে সাথে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে পেণ্ডা।

শহীদ কিন্তু অতোটা নিঃসন্দেহ হতে পারে না। মনটা খুঁত খুঁত করছে তার অমঙ্গল আশঙ্কায়। তাছাড়া ওরা যদি ফিরে এসে ওই নিগ্রোগুলোর হাতে পড়ে?

কুফুয়া বাড়ির ভিতরে গিয়ে কি কি যেন বললো ওর স্ত্রীকে। কিছুক্ষণ খুটখাট শব্দ হলো, তারপর দুজন চাকর আর স্ত্রীকে নিয়ে কুফুয়া বেরিয়ে এলো। শহীদ বললো, কামালরা ফিরে এসে যদি ওদের হাতে পড়ে?

পড়বে না। আমরা জিনিসপত্র লঞ্চে রেখে আবার ফিরে আসবো। গাছের আড়ালে থেকে পাহারা দেবো। ওরা এলেই দূর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবো। যাক, এখন তাড়াতাড়ি চলো লঞ্চে যাওয়া যাক। এরমধ্যে এসে পড়লে ওরা অপেক্ষা করবে।

লণ্ঠন হাতে নিয়ে তারা লঞ্চে গিয়ে উঠলো। দুইটা বড় বড় বাক্স নামিয়ে রাখলো কুফুয়ার চাকরেরা।

আর কিছু দামী জিনিস নেই বাড়িতে?

না। আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই আমাদের নতুন বাসায় উঠে যাচ্ছিলাম। সব জিনিসপত্র সেখানে পাঠানো হয়ে গেছে। But wheres your driver. shahid? (কিন্তু তোমার ড্রাইভারটা গেল কোথায়?)

তাই তো! মি. ব্লাইদ গেল কোথায়? নেই তো লঞ্চে।

শহীদ সবখানে খুঁজলো লঞ্চের কোথাও নেই মি. ব্লাইদ। কুমীরে খেলো না তো, শহীদ ভাবে। কুফুয়া বললো, চিন্তার কিছু নেই। আমরা তো বলেই গেছিলাম, তিন-চারদিনের আগে লঞ্চ ছাড়া হবে না। মি. ব্লাইদ বোধহয় এখন তাড়িখানায়। যুবক মানুষ, বুঝলে না? হঠাৎ সুর বদলে কুফুয়া বললো। কিন্তু আমাদের এখন ফিরতে হবে। Be quick.

কুফুয়ার স্ত্রীকে লঞ্চে রেখে ওরা চারজন চলে এলো বাড়ির কাছে। সকলের কাঁধে রাইফেল। পকেটে একটা পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের রিভলবারও নিয়েছে শহীদ। বাড়ি থেকে বেশ দূরে এক একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালো ওরা। কামালদের দেখলেই তাদের নিয়ে লঞ্চে চলে যাবে। আর যদি তার আগেই নিগ্রোগুলো এসে পড়ে, তাহলে তাদের নিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না ওরা ফিরে যায়। কুফুয়ার বাড়ির দুই পাশে অনেক ছোটো বড় গাছ জঙ্গলের মতো হয়ে আছে, ধরা পড়বার ভয় খুব কম।

বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। রাত দশটা কি এগারোটা বাজে। চারদিক নিঝুম হয়ে গেছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। জনপ্রাণী সবাই ঘুমে অচেতন। একটা ভীষণ কিছু ঘটবার আগে যেমন গুমােট হয়ে যায়, চারদিকটা তেমনি চুপ, তেমনি গুমােট।

হঠাৎ বহু দূরে অনেকগুলো পদধ্বনি শোনা গেল। যেন বীর দর্পে অনেক সৈনিক পা ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে। ক্রমেই শব্দটা স্পষ্ট হতে লাগলো। কুফুয়া এসে শহীদের পাশে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো, ওই শোনো। ওরা এগিয়ে আসছে। ভয় পাওনি তো?

না, ভয় পাইনি।

আরও এগিয়ে এলো তারা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো দেখা যাচ্ছে। ক্রমে আলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শহীদ দেখলো, জ্বলন্ত মশাল হাতে প্রায় শদুয়েক লোক এগিয়ে আসছে কুফুর বাড়ির দিকে। মশালের লাল আলো, আর নিগ্রোগুলোর কালো বিকট মুখ একটা ভয়াল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সকলের হাতে একটা করে বর্শা। আলো পড়ে চিকচিক করছে ফলাগুলো।

আরও ঘন জায়গায় সরে গেল শহীদ আর কুফুয়া। সামনে থাকলে এতো আলোতে ধরা পড়ে যেতে পারে।

লোকগুলো যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন সামনের লোকটাকে দেখে চমকে উঠলো শহীদ। এ তো সেই লম্বা সর্দার! আজই এখানে পৌঁছে এদের দলে যোগ দিয়েছে। সব লোকের মধ্যে কেবল তার হাতেই একটা রাইফেল। আজ তারা শহীদকে ধরে নিয়ে যাবেই।

ওরা ভাবছিলো, কাছাকাছি আসতেই গুলি ছুঁড়বে কুফুয়ার লোক। কিন্তু কোনও বাধা না পেয়ে বরাবর এসে থমকে দাঁড়ালো তারা বাড়ির সামনে। কিন্তু সে কিছুক্ষণের জন্যে। তারপরই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো কয়েকজন বাড়ির মধ্যে। কিছুক্ষণ পরেই আবার তারা বেরিয়ে এলো। সবাইকে ডেকে লম্বা লোকটা কি যেন বললো চিৎকার করে। হৈ-চৈ পড়ে গেল ওদের মধ্যে। আশেপাশে অন্ধকার জায়গাগুলো ওরা খোঁজা শুরু করলো। এই দেখে শহীদ আর কুফুয়া এক পা এক পা করে পিছনে হেঁটে অনেক দূর পিছিয়ে গেল।

হঠাৎ শহীদ লক্ষ্য করলো আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কুফুয়া বললো আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিলো ওরা। জিনিসপত্র ভাঙাচোরার শব্দ শহীদরা পেয়েছে, কিন্তু এতোটা আন্দাজ করেনি।

অনেকক্ষণ ওরা বাড়িটার চারপাশে হৈ-চৈ করলো, তারপর ফিরে চলে গেল।

ওরা বোধহয় লঞ্চে খোঁজ করতে চললো। ওখানে আপনার স্ত্রী একা রয়েছেন।

যাবে না ওরা লঞ্চে। রাতেরবেলা নদীর পঞ্চাশ হাতের মধ্যে ওরা যায় না। ধর্মের নাকি নিষেধ আছে। সেজন্যেই আমি জিনিসপত্র লঞ্চে উঠিয়েছি। কাল দিনের বেলা নতুন বাড়িতে চলে যাবো।

আমার জন্যেই আপনার এতো কষ্ট হচ্ছে। শহীদ বিনয় করে বলে।

Dont say this young man. I feel Insulted, আমার অতিথির জন্যে কি আর কেউ কষ্ট বরণ করবে? Will I bear it? I do all these surely for my own sake, not yours, একথা বলে আমাকে অপমান করো না।

কাঠের বাড়ি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে যেমন বেশি সময় লাগেনি, তেমনি আগুন নিভে আসতেও আধঘন্টার বেশি লাগলো না। সমস্ত ভস্ম হয়ে গেছে। স্তুপের মধ্যে অবশ্য আগুন এখনও গনগন করছে। কিন্তু তাও নিভে গেল প্রচণ্ড বৃষ্টিতে।

শহীদ, কুফুয়া আর কুফুয়ার চাকর দুজন তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। কামালরা এখনও ফিরছে না কেন? রাত আড়াইটা বেজে গেছে। নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে ওরা। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে অন্ততঃ একটা খবর তো পাঠাতো পেণ্ডা। কিন্তু এখন কোথায় খুজবে ওরা? ভাের পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। কুফুয়ার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে আবার চাঁদ উঠেছে। শহীদ দেখলো একজন লোক এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। কুফুয়া রাইফেল তুললো। শহীদ তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিলো হাতের ইশারায়। লোকটা এগিয়ে এসে দেখলো বাড়ি আর নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লোকটা মাটিতে বসে পড়লো। শহীদ এবার চিনতে পেরেছে। ডাক দিলো, কে ওখানে, গফুর না?

হাঁ দাদামণি। তুমি কোথায়? অকুল সাগরে কুল দেখতে পেয়েছে গফুর।

শহীদ বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে। জিজ্ঞেস করলো, কামাল, মহুয়া কই?

গফুর গড়গড় করে বলে গেল সব ঘটনা। শহীদ আবার ইংরেজিতে কুফুয়াকে বললো।

জিজ্ঞেস করো তো পথ চিনতে পারবে কিনা ও, কুফুয়া বলে।

গফুর বললো, পারবো যদি ওই বিলটা পর্যন্ত কেউ আমাকে নিয়ে যায়।

গফুরকে নিয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করে শহীদ আর কুফুয়া একটা জায়গায় এলো। সেখানে মাটিতে কি যেন একটা সাদা মতো পড়ে আছে। সেটা তুলে নিয়ে দেখলো, মহুয়ার রুমাল। গফুর এবার চিনতে পেরেছে। বললো, এই পথে সোজা গিয়ে একটা ডাকবাংলোর মতো বাড়ি, বাইরে দিয়ে সাদা রং করা।

কুফুয়াকে এই কথা বলতেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো কুফুয়া। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, ওই বাড়িটা, আমাদের বাড়ি। সামনের সমস্ত বন আমি কিনে নিয়েছি। সেখানে পাহারা দেবার জন্যে একটা বাড়ি তুলেছিলাম অনেক আগে, ইদানীং সেটা মেরামত করেছি। ওখানেই আমাদের উঠে যাওয়ার কথা। এদিকে আর কোনো বাড়িতে। তো white-wash করা নেই।

কুফুয়াই আগে আগে চললো পথ দেখিয়ে। অনেকদূর। পথ আর ফুরোয়ই না। সবাই ক্লান্ত। ধীরে ধীরে চলেছে তারা।

যখন দূর থেকে বাড়িটা দেখা গেল, গফুর চিনতে পেরে বললো, এই বাড়িই । দাদামণি।

সবাই বাড়িটার দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাড়ির ভিতরকার সব ঘরগুলোর দরজায় তালা দেয়া। কেবল একটা দরজা দুপাট খোলা। রাইফেল বাগিয়ে ধরে সবাই একসাথে ঢুকলো সে ঘরে।

দেখা গেল চারজন জোয়ান নিগ্রো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। আর কেউ কোথাও নাই।

কুফুয়া আশ্চর্য হয়ে বললো, My sons! (আমার ছেলে!)
কামাল মহুয়া আর পেণ্ডাকে কাঁধে করে লোকগুলো একটা ঘরে ঢুকলো। আলো জ্বেলে দিলো একজন। সেই আলোতে কামাল চেয়ে দেখলো পেণ্ডার চোখ বাঁধা। মহুয়ার চোখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। তিনজনেরই মুখের মধ্যে কাপড় গোঁজা। কথা বলবার উপায় নেইI

চারজন লোক বিদায় নিয়ে চলে গেল। একজন তাদের বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে এলো। এইবার তারা কামাল আর মহুয়ার মুখে গোঁজা কাপড় খুলে ফেললো। স্পষ্ট ইংরেজিতে একজন জিজ্ঞেস করলো, Where is the cheque kufua gave you this moming? কুফুয়ার চেকটা বের করে দিকি।

পেণ্ডা একটু চমকে উঠলো। কামালও যেন একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর ইংরেজিতে বললো, সেটা আমার কাছে নেই।

তবে কার কাছে আছে? এই ভদ্রমহিলার কাছে নিশ্চয়ই!

কামাল জানতো চেকটা মহয়ার কাছে ছিলো, আর সেটা ওর ভ্যানেটি ব্যাগের মধ্যেই ছিলো। সে তাড়াতাড়ি বললো, সে চেক আমাদের কারো কাছে নেই, আমার বন্ধু শহীদ সেটা নিজের কাছেই রেখেছে।

মিথ্যে কথা! গর্জে উঠলো লোকটা। ভালোয় ভালোয় চেকটা বের করে দাও। আমি কথা দিচ্ছি তারপর তোমাদের ছেড়ে দেবো। চাই কি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবো। আমি জানি সেটা তোমাদের দুজনের একজনের কাছেই আছে, শহীদের কাছে নেই।

তুমি সেকথা গায়ের জোরে বললেই হবে? আমি বলছি, নেই আমাদের কাছে।

তাহলে বাধ্য হবো তোমাদের search করতে।

সার্চ করলেও কিছু পাবে না।

Well lets try. বেশ দেখা যাক।

একজন লোককে ইশারা করতেই সে মহুয়ার ভ্যানিটি ব্যাগ তুলে নিলো। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো, কিন্তু কোনো চেক নেই ওর মধ্যে। তারপর লোকটা কামালের দিকে এগিয়ে এলো। সমস্ত শরীর তন্ন তন্ন করে খুজলে, কিন্তু চেক পাওয়া গেল না। এবার সে মহুয়ার দিকে এগোলো। কামাল চিৎকার করে ওঠে, খবরদার! মেয়েমানুষের শরীরে হাত দিয়ো না বলছি।

Then hand the cheque over. তাহলে চেক দিয়ে ফেলো।

আমাদের কাছে নেই তো দেবো কি করে?

সেই লোককে আবার ইশারা করলো লোকটা। সে এগিয়ে গেল মহুয়ার দিকে। ইশ, এখন যদি কামালের হাত পায়ের বাঁধন না থাকতো! টুটি টিপে ধরে খুন করতো সে ওই ব্যাটাকে। লোকটা মহুয়ার গায়ে হাত দিতে যাচ্ছে। কামাল অন্য দিকে মুখ ফিরায়।

ঠিক এমনি সময় দরজার কাছ থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

Hands up, you rascals! Dont move a single step. (মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও-একপা নড়বে না কেউ।)

চমকে ফিরে দাঁড়ালো সবাই। একটা প্ৰকাণ্ড নিগ্রো দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনের দরজা জুড়ে। হাতে উদ্যত রিভলবার।

সবাই মাথার উপর হাত তুললো। সেই ভীষণ দর্শন নিগ্রো এবার আদেশ দিলো ওদের একজনকে, Untie that gentleman. (ঐ ভদ্রলোকের বাঁধন খুলে দাও)

একান্ত অনুগত ভৃত্যের মতো লোকটা গিয়ে কামালের বাঁধন খুলে দিলো। এইবার নিগ্রোটা কামালকে উদ্দেশ্য করে পরিষ্কার বাংলায় বললো, তুমি এবার মহুয়া আর ওই মেয়েটার বাঁধন খুলে ফেলে। তারপর সব রশি একত্র করে এই ব্যাটাগুলোকে আচ্ছা করে কষে বাঁধে।

তাজ্জব বনে গেল কামাল। এই কাফ্রী মুল্লুকে অপরিচিত নিগ্রোর মুখে বাংলা কথা! কুয়াশা নয় তো। কিন্তু সে তো জাহাজ থেকে নামেনি!

হাঁ করে কি দেখছো কামাল? আমিই কুয়াশা।

বিস্ময়ে মহুয়ার মুখ হাঁ হয়ে গেল। অস্ফুট কণ্ঠে বললো, দাদা!

পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারজন নিগ্রোকেই কষে বেঁধে ফেললো কামাল। তারপর ওরা সবাই বেরিয়ে এলো সে বাড়ি থেকে। মহুয়ার হাত ধরে চলেছে কুয়াশা।

তুমি কি করে খোঁজ পেলে দাদা?

আমি তোদের কাছাকাছিই ছিলাম বোন।

ওরা বোধহয় এখানকার চোর ডাকাত, তাই না?

ওরা হচ্ছে কুকুয়ার চার ছেলে।

আঁ! কুফুয়ার ছেলেরা ডাকাত?

ডাকাত না। তোরা বিদেশ থেকে হঠাৎ উড়ে এসে নব্বই হাজার টাকা ধসিয়ে নিয়ে চলে যাবি, তা ওরা কিছুতেই সহ্য করবে না। কিন্তু বাবাকে কিছু বলতেও পারে না এদিকে। তাই প্ল্যান করে ঠিক করলো, কুফুয়া চেক লিখে দেয়ার পর তোদের কাছ থেকে ওরা কেড়ে নেবে সে চেক। তারপর তোরা লরেঞ্জো মারকুইসে পৌঁছবার আগেই সেটা ভাঙিয়ে নেবে ব্যাংক থেকে। কুফুয়া একবার চেক দিয়েছে, তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। তোরা সে চেক হারিয়েছিস তো তার কি? সে আর তোদের টাকা দেবে নাI

ভালো বুদ্ধি খাটিয়েছিল তো! একদিকে বাবাকেও শান্ত রাখতে পারলো, অন্যদিকে ওদের টাকা ওদের কাছেই রইলো।

আরও অনেক কথা হলো ওদের মধ্যে।

তোমরা কাল ভােরেই রওনা হয়ে যাও কামাল। নইলে আরও নতুন বিপদ আছে তোমাদের কপালে। শহীদ বোধহয় ফিরতে চাইবে না এতো তাড়াতাড়ি, বোধহয় বোঙ্কারায় যাবে। সেখানে হলেও কালই লঞ্চ ছেড়ে দিও।

এতো তাড়া কিসের? আগে দুচারদিন বেড়িয়ে নিই, তারপর…

তোমাদের পিছনে কেবল একদল শত্রু নেই কামাল। ভীষণ শক্তিশালী একটা দল গড়ে উঠেছে তোমাদের বিরুদ্ধে। সে দলে অনেক লোক আছে। আমাকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, শহীদকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পাবে। কিন্তু মনে রেখো কালই ভােরে লঞ্চ ছাড়া চাই।

এদিকে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। একটা বাঁক ফিরতেই সবাই থমকে দাঁড়ালো। কুফুয়ার বাড়ির দিকের আকাশটা লাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আগুনের লেলিহান শিখা এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। অনেক মানুষের গোলমাল শোনা গেল। ব্যস্ত হয়ে উঠলো কুয়াশা।

পেণ্ডার দিকে তাকিয়ে কুয়াশা বললো, তুমি এদের নিয়ে ঘুরপথে লঞ্চে গিয়ে ওঠো। আমি দেখি গিয়ে ওদিকে কি ব্যাপার।

কুয়াশা পিছন ফিরলো, অমনি তার জামায় টান পড়লো। কুয়াশা ঘুরে দেখে মহুয়া। মহুয়া মিনতি করে বলে, তুমি আমাদের সঙ্গে চলো দাদা। ওখানে বিপদের মধ্যে তোমার যাওয়া হবে না।

অবাক হয়ে মহুয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকে কুয়াশা। বহু যুগ সে কখনও কারও স্নেহ ভালবাসা পায়নি। জীবন পথে কঠোর সংগ্রাম করতে করতে সে প্রায় ভুলেই গেছে মায়া মমতা এসব কাকে বলে। কতদিনের কাঙ্গাল সে। আজ মহুয়ার কণ্ঠে স্নেহের সুর শুনে সে অবাক হবেই তো। তার কথা ভেবে কেউ উদ্বিগ্ন হয়, একথা সে বিশ্বাস করবে কি করে। কারও কাছে তো সে কোনদিন ভালবাসা পায়নি। কেউ তার জন্যে কখনও একবিন্দু উদ্বিগ্ন হয়নি। সবাই তাকে ঘৃণা করেছে, যে পেরেছে সেই নির্মম আঘাত হেনেছে।

আবার মহুয়া আবদার করে বলে, তুমি যেয়ো না দাদা।

উঃ। কুয়াশা সহ্য করবে কি করে ভালবাসার দাবি? চাপ চাপ কান্না তার বেরিয়ে আসতে চাইছে একসাথে। হৃদয়টা বুঝি গুড়ো হয়ে যাবে। কতদিন সে একটু স্নেহ, একটু ভালবাসা পায়নি। হৃদয়ে কতো জ্বালা, কতো অভিমান তার। এই প্রকান্ড মানুষটা এতো দুর্বল? সবাই যার নাম শুনলে চমকে ওঠে, নিঃশঙ্ক চিত্তে যে একটার পর একটা খুন করতে পারে, তার ভিতরটা এতো নরম, এতই স্পর্শকাতর? টন্ টন্ করে কুয়াশার গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রু নেমে আসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় সে বললো, শহীদের কোনো বিপদ হতে পারে, আমি যাই রে।

দ্রুত দীর্ঘ পদক্ষেপে চলে গেল কুয়াশা যেদিক থেকে আলো দেখা যাচ্ছে সেদিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেণ্ডার পিছন পিছন চলতে শুরু করলো মহুয়া।
ভােরের দিকে শহীদ, গফুর আর কুফুয়া লঞ্চে ফিরে এলো। সারা রাত্রির ধকলে শরীর অবশ হয়ে গেছে। ক্লান্তি নৈরাশ্য সব একসাথে ওদের যেন কাবু করে দিয়েছে। কিন্তু লঞ্চে উঠেই শহীদ দেখলো মহুয়া, কামাল, পেণ্ডা আর কুফুয়ার স্ত্রী বসে আছে। এক মুহর্তে শহীদের সমস্ত ক্লান্তি চলে গেল। সবকিছু শুনলো সে কামালের কাছ থেকে। মহুয়াও মধ্যে মধ্যে কথা যোগ করতে লাগলো। সব শেষে কামাল বললো, কুয়াশা উপদেশ হচ্ছে, এই মুহূর্তে এখান থেকে রওনা হয়ে যাও।

আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু তোদের না পাওয়া পর্যন্ত যেতে পারছিলাম না।

এখন কোথায় যাবি? লরেঞ্জো মারকুইসে?

না। দক্ষিণ রোডেশিয়া যাবো।

ওখানে আবার কেন?

সে অনেক কথা, পরে বলবো। এর মধ্যে এখানে অনেক ব্যাপার ঘটে গেছে, সে গল্পও শুনিস পরে। এখন দেখি লঞ্চ ছাড়বার বন্দোবস্ত করি।

কুফুয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো শহীদ। কুফুয়া তার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেল লঞ্চ থেকে। কুফুয়া অনেক করে মাফ চাইলো শহীদের কাছে।

শহীদ বললো, আপনার কি দোষ মি. কুফুয়া? আপনি কিছুমাত্র লজ্জিত হবেন না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা আজীবন মনে রাখবো। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাবার বন্ধুর উপযুক্ত কাজ করেছেন আপনি। ছেলেদের দুষ্কর্মের জন্যে আপনি কেন এতখানি লজ্জিত হচ্ছেন?

ফিরবার সময় একবার নামবে না তোমরা?

দেখি, যদি ফিরতে পারি তাহলে চেষ্টা করবো।

কিন্তু তোমাদের ডাইভার কই?

তাই তো, এখনও ফিরলো না।

এমন সময় টলতে টলতে মি. ব্লাইদ এসে উপস্থিত হলো। হাতে একটা খোলা বোতলে কিছু অবশিষ্ট আছে। সেটুকু গলায় ঢেলে সশব্দে বোতলটা মাটিতে আছড়ে ভাঙলো ব্লাইদ। শহীদ বললো, আমরা এক্ষুণি রওনা হচ্ছি মি. ব্লাইদ। আপনি লঞ্চ ছাড়বার ব্যবস্থা করুন।

Oh; yes, certainly. (নিশ্চয়, নিশ্চয়।)

টলতে টলতে লঞ্চে উঠে গেল সে। শহীদ আর কুফুয়া একটু হাসলো ব্যাটা ইংরেজের বাচ্চার রস দেখে। শীষ দিতে দিতে চলেছে সে।

কুফুয়া বললো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি তাই তোমাদের সঙ্গে গেলাম না। গেলে সুবিধা না হয়ে অসুবিধাই হতো তোমাদের। এখানকার আর কোনও লোককেও সঙ্গে দিতে চাই না। নিজের ছেলেকে দিয়ে বিশ্বাস নেই, অন্যকে বিশ্বাস করবো কি করে। কিন্তু এই চার্টটা তোমাকে দিচ্ছি, এতে তোমার উপকার হতে পারে। চার ভাঁজ করা। একটা কাগজ শহীদের হাতে দিলো কুফুয়া।

বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শহীদ লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চ ছেড়ে দিলো। কুফুয়া, তার স্ত্রী আর পেণ্ডা পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগলো। শহীদরাও রুমাল দোলালো।

ভোর ছটায় বড় সুন্দর করে সূর্য উঠলো। রাতের সমস্ত ক্লান্তি, সব কষ্ট হরণ করে যেন প্রভাত এলো আশার বাণী নিয়ে। সবার মন থেকে সব রকম দুশ্চিন্তা মুছে গেল। সবাই প্রাণকুন্ত সজীব হয়ে উঠলো।

পাশে গভীর জঙ্গল। পরিষ্কার জলে অজস্র কুমীর দেখা যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর তাদের চেহারা। আর সুন্দর করে উঠেছে সূর্য। ভয়ঙ্কর আর সুন্দর। দুটো একসাথে মিশলেই হয় সত্যিকার সৃষ্টি। ভয়ঙ্কর সবসময় সুন্দর, আর সৌন্দর্যের মধ্যে ভয় না থাকলে তা অপরিপূর্ণ।

মৃদু একটা এঞ্জিনের শব্দ। জল কেটে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ সমান গতিতে। কুল কুল করে ছোটো ছোটো ঢেউ লঞ্চের গায়ে এসে আছড়ে পড়ে। গত রাতের সে রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।

লঞ্চ একটু ধীরে ধীরে চালানো হচ্ছে। শীতকালে Gungunyaras Ford এর পশ্চিমে আর যাওয়া যায় না। এখন ভরা বর্ষা। বোঙ্কারা পর্যন্ত অনায়াসে যাওয়া যাবে। কিন্তু তবু সাবধানে চালানোই ভালো; বলা তো যায় না, কোথাও পাথর- টাথরে ঠোক্কর লেগে তলিয়ে যেতে পারে।

চা খেতে খেতে গল্প হয়। কামাল বলে, কিন্তু মহুয়া দি, চেকটা তো তোমার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যেই ছিলো, গেল কোথায় ওখান থেকে?

মহুয়া হাসলো, ওই তো মজা! বলো তো কোথায় ছিলো? ওরা যখন অন্ধকার জায়গায় তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, তখনই আমি বুঝেছিলাম ওদের কী মতলব। তাড়াতাড়ি চেকটা ব্যাগের পকেট থেকে বের করে কয়েক ভাঁজ করে বেণীর মধ্যে গুঁজে রেখেছিলাম।

সবাই হাসলো। শহীদ বললো, মেয়েমানুষ।

বেশ কিছুক্ষণ হলো সন্ধ্যা হয়েছে। কামাল সারাদিন হৈ-চৈ করেছে। মি. ব্লাইদের সাথে দোস্তি করে লঞ্চ চালানো শিখে নিয়েছে সে। এখন দেখা যায় বেশির ভাগ সময় সেই বসে আছে হাল ধরে, আর মি. ব্লাইদ পাশেই আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে সিগারেট টানছে।

পাড়ে অনেক কুমীর শুয়ে থাকে। খালি কুমীর আর কুমীর। জলে স্থলে একেবারে গিজ গিজ করছে। কামাল তিনটাকে গুলি করে মেরেছে। শহীদ নিষেধ করলে বলে, হাত সই করছি। মহুয়া তার পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল দিয়ে হাঁস, গিনি ফাউল, পারট্রিজ যা পায় মারার চেষ্টা করে, কিন্তু লাগে না একটাও।

বিকেলের দিকে একটা মস্ত বড় রাজহাঁস একা উড়ে আসছিল পশ্চিম থেকে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে মহয়ার রাইফেলটা নিয়ে গুলি করলো শহীদ। তার অব্যর্থ সন্ধান বিফল হলো না। ঘুরতে ঘুরতে রাজহাঁসটা নামতে লাগলো।

Excellent shot! মি. ব্লাইদ চিৎকার করে উঠলো। তারপর লঞ্চের মুখটা ঘুরিয়ে দিলো হাঁসটা যেখানে পড়ছে সেদিকে। কিন্তু আশ্চর্য, জলে পড়ার সাথে সাথেই তলিয়ে গেল হাঁসটা। সেখানকার জলে বেশ খানিকটা তোলপাড় হলো। কারও বুঝতে বাকি রইলো না ব্যাপারটা কি। সবাই একটু গম্ভীর হয়ে গেল। নদীর ভয়াবহতার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়ে কারও মুখে কিছুক্ষণ কথা সরলো না।

সাঁঝের বেলা হঠাৎ গফুর পাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে উঠলো, দাদামণি, দেখো কি জিনিস।

সবাই ছুটে গেল লঞ্চের একধারে। দেখা গেল পাড়ের ওপর প্রকাণ্ড শরীরের কয়েকটা জন্তু দাঁড়িয়ে। লঞ্চের মৃদু শব্দ শুনে ওগুলো জলে নামবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। শহীদ বললো, হিপোপটেমাস।

কামাল ততক্ষণে রাইফেল তুলে নিয়েছে। শহীদ বললো, এই কামাল, মারিস না, এগুলো মারা নিষেধ।

দুত্তোর নিষেধ। থ্রি নট থ্রি রাইফেলের বিকট আওয়াজে আশেপাশে বন জঙ্গল কেপে উঠলো। ঝপ ঝুপ করে সব কটা জন্তু প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে জলে নামলো। কেবল একটা স্থির হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর ধপাস করে কাত হয়ে জলে পড়লো।

রেগে গিয়ে শহীদ বললো, কেন শুধু শুধু মারলি? তোর কোনও ক্ষতি করছিল ওরা? সবকিছুতেই তোর বাড়াবাড়ি।

কামাল চুপ করে রইলো। কোনও উত্তর না দিয়ে ফিরে এসে চুপ করে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো।

হঠাৎ শহীদ যেন কী একটা বুঝতে পারলো। প্রতিহিংসা নয় তো? কামালের বাবাকে এই লিষ্পোপোতেই কুমীরে ধরে নিয়ে গেছিলো। কামালের মনে কি তারই কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছে? অবচেতন মনে কুমীরের প্রতি তার জাত বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছে হয়তো। তারই জন্যে খেপে গিয়ে সে কুমীর, হিপো যা পাচ্ছে মারছে। নইলে কামাল তো মনের দিক থেকে তার চাইতে অনেক বেশি নরম। শহীদের মনে পড়ে, কামালের শখের কুকুর বিড়াল বা কবুতর মারা গেলে এখনও সে কেমন ছেলে মানুষের মতো কাঁদে, সেই কামাল কি শুধু শুধু জন্তু জানোয়ার খুন করতে পারে?

কামালের প্রতি একটা সমবেদনায় ভরে ওঠে শহীদের মন। না বুঝে ওকে বড় কষ্ট দিয়েছে সে। এখন ওর মনটা কি করে খুশি করা যায় চিন্তা করতে লাগলো শহীদ।

কামালের পাশে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলো সে। চমকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার বাইরের দিকে চেয়ে বসে রইলো কামাল চুপচাপ। কেমন অস্বস্তি লাগে তার।

গফুর এলো কফি নিয়ে। দুকাপ শহীদ আর কামালের সামনে রেখে আর একটা মি. ব্লাইদকে দিয়ে এলো।

আমাদের দেশে কিন্তু এর হাজার ভাগের একভাগও কুমীর নেই দাদামণি, গফুর বলে।

কথা বলবার বিষয় পেয়ে শহীদ বেঁচে গেল। বললো, ঠিক বলেছিস। আগে যাও কিছু ছিলো, এখন আর নেই। বছর পনেরো কুড়ি আগেও বছরে কমপক্ষে হাজার কয়েক লোক কুমীরের পেটে যেতো। আজকাল একটা আধটা খবর কালে ভদ্রে আসে।

মহুয়া এসে বসলো। বললো, তুমি নিজের চোখে কখনও কুমীরের মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়া দেখেছো?

হ্যাঁ। কতবার দেখেছি।

বলো না, কি ভাবে নিলো। আবদারের সুরে বলে মহুয়া। কামাল ঘুরে বসলো। গফুরও কি একটা কাজের ছুতোয় কাছাকাছিই রইলো।

একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে শহীদ শুরু করলো, আমার তখন বছর পনেরো বয়স। ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ি। ফরিদপুর থেকে নৌকোয় ফিরছি ঢাকায়। নানা-বাড়ি গিয়েছিলাম আম-কাঁঠালের বন্ধে। চর-টেপাখোলার পুব দিক দিয়ে আসছি আমরা মস্ত এক পানসিতে করে। সাঁকের কাছাকাছি। আকাশের মেঘগুলো লাল হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছি সামনের রহমতপুর গ্রামে নৌকো বেঁধে রাতটা কাটিয়ে ভােরে আবার রওনা দেবো। কাছাকাছি আসতেই একটা আর্ত চিৎকার শুনলাম। তাড়াতাড়ি নৌকোর ছইয়ের ওপর উঠে দেখি একজন লোক একটা ছোটো কোষ নৌকোয় দাড়িয়ে লাফালাফি করছে, আর চিৎকার করে আমাদের ডাকছে। নৌকো একবার এদিক একবার ওদিক কাত হচ্ছে। মাঝিদের হুকুম দিলাম শিগগির করে ওর কাছে যেতে। ভাবলাম, ব্যাটা বোধহয় সাঁতারও জানে না, নৌকো চালানোও জানে না, নৌকোয় কিছু জল উঠেছে তাই ভয় পেয়ে চিৎকার করছে। এইটুকু বলে শহীদ নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট খেতে লাগলো। সবাই ভাবছে, এই শুরু করলো বুঝি, কিন্তু চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকলো ও। কামাল অধৈর্য হয়ে বলে, তারপর?

আসলে হয়েছিল কি, লোকটা নিশ্চিন্ত মনে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছিলো। নৌকায় বেশ অনেকখানি জল উঠেছিল, কিন্তু রহমতপুর কাছেই, তাই আর ছেচে ফেলেনি। নৌকাটা জল থেকে অল্প একটুখানি ডেসে ছিলো।

হঠাৎ পাশেই জলের মধ্যে একটা কি যেন দেখতে পেলো সে। কি ওটা? খেয়াল করে দেখলো মস্ত একটা কুমীর কটমট করে তার দিকে চেয়ে আছে। লোকটা ভয় পেয়ে গেল ভীষণ। চেয়ে দেখলো দূরে আমাদের নৌকার পাল দেখা যায়, আশেপাশে কোথাও আর কেউ নেই। কুমীরটাও বোধকরি এই নির্জনতার সুযোগ নেবার চেষ্টা করলো। সে ওই ডুবুডুবু নৌকার একধার দিয়ে উঠে আসবার চেষ্টা করতে লাগলো। লোকটা গিয়ে নৌকার মধ্যখানে দাঁড়ালো। কুমীর উঠবার চেষ্টা করলেই সে উল্টোদিকে ভর দিয়ে কুমীরের দিকটা উচু করে ফেলে। কুমীর সেদিক ছেড়ে এদিকে আসে। আবার সে ওদিকে ভর দেয়। এমনি করে বহুক্ষণ যুঝেছে সে। কুমীরও ছাড়বার পাত্র নয়, সেও অনবরত চেষ্টা করেই চলেছে নৌকায় উঠবার। বোধকরি খুব বেশি ক্ষুধার্ত ছিলো কুমীরটা।

এদিকে ধীরে ধীরে নৌকায় জল উঠছে। আর বুঝি ভাসিয়ে রাখা যায় না। এবার সে পাগলের মতো চিৎকার করে আমাদের ডাকতে লাগলো।

আমরা যখন খুব কাছাকাছি পৌঁছলাম, আর হাত পনেরে গেলেই লোকটাকে তুলে নিতে পারবো, ঠিক এমনি সময় ডুবে গেল কোষাটা। মানুষটাও ডুবে গেল। কিছুক্ষণ পরে দূরে একবার লোকটার মাথা দেখা গেল। জলে খুব আলোড়ন হলো, তারপর আবার ডুবে গেল। আর উঠলো না। নৌকার মাঝিরা সব বলে উঠলো, ইয়া আল্লা, বদর বদর।

শহীদ থামলো। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর কামাল বললো, কি হারামী জানোয়ার। তুই আবার এদেরই মারতে মানা করিস।
লিম্পোপো থেকে একটা খাল বের হয়ে বোঙ্কারা অঞ্চলে চলে গেছে। সেই খালের মুখের বেশ কিছু পশ্চিমে গিয়ে লঞ্চ নোঙর করা হলো। ঘাটের সাথে লঞ্চ লাগানো গেল না, জল খুব অল্প। লঞ্চ থেকে দুটো তক্তা নামিয়ে তার ওপর দিয়ে হেঁটে পাড়ে নামলো শহীদরা। মি. ব্লাইদ লঞ্চেই রইলো। এই বিকেল বেলা বনের মধ্যে যেতে মানা করলো মি. ব্লাইদ।

আমরা আশেপাশের জায়গাটা একটু দেখেই ফিরে আসবো। সন্ধ্যার আগে না ফিরলে মনে করবেন আমরা বনের মধ্যেই রাত কাটাবো।

এখানকার বন্য জন্তু জানোয়ার যেমন হিংস্র তেমনি চালাক। গাছের ওপরও রয়েছে মাম্বা নামে একরকম বিষধর সাপ। ক্যাম্প নিলেন না, খুব অসুবিধায় পড়বেন।

না, যথেষ্ট পরিমাণ দড়ি নিয়েছি, সাত ব্যাটারীর টর্চ আছে সাথে। খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু একটা কথা মি. ব্লাইদ, খুব জরুরী অবস্থায় না পড়লে কখনও গুলি ছুড়বেন না, তাহলে আমরা এখানে এসেছি সেকথা ওদের জানতে দেরি হবে না। আপনাকে তো এই অভিযানের গুরুত্ব কতখানি তা বলেছি।

হাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।

শহীদ মহুয়াকে লঞ্চে রয়ে যেতে বললো, কিন্তু সে কিছুতেই থাকবে না, সেও ওদের সঙ্গে যাবে। অনেক তর্কাতর্কি করে শেষ পর্যন্ত শহীদ, কামাল, মহুয়া আর গফুর বনের মধ্যে ঢুকলো।

কিছুদূর গিয়েই একটা সরু পথ পেলো তারা। একে বেঁকে চলেছে পথটা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একটু একটু আঁধার লাগলো তাদের। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শহীদ দেখলো ওপরে উজ্জ্বল আকাশ। বনের মধ্যে গাছের ছাউনির জন্যে অন্ধকার লাগছে। একটু দাঁড়িয়ে দিক নির্দেশক যন্ত্রের দিকে চেয়ে শহীদ দেখলো ঠিক পথেই চলেছে তারা। জংলীদের এলাকাটা আর বেশি দূর নয়। একবার দূর থেকে দেখেই ওরা ফিরে যাবে লঞ্চে। কাল ভােরে আবার রওনা হবে তারা।

আর আধমাইল খানেক গেলেই ওরা দেখতে পাবে জংলীদের আস্তানা। কিন্তু অন্ধকার বড় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। জঙ্গলও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। গফুর বললো, আঁধার হয়ে গেল যে! ফিরে চলো দাদামণি, কাল ভােরের বেলা আবার আসা যাবে।

আরে চল, বেশি দূর নেই। এতদূর এসে আর ফিরবো না। দেখেই যাই।

পথটা ধরে আরও অনেকদূর গিয়ে দেখা গেল একটা প্রাচীর। মোটা মােটা গাছ পাশাপাশি এমনভাবে বেড়ে উঠেছে যে তা ভেদ করে ওপাশে যাওয়া যায় না। পথটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। শহীদ বুঝলো ডান ধারের পথ ধরে খালটার কাছাকাছি যাওয়া যাবে। চার্ট খুলে দেখলো মন্দিরটা খালের কাছাকাছিই এক জায়গায়। সেই পথেই এগোলো তারা।

কিন্তু এই পথ হলো কি করে? এখান দিয়ে মানুষের যাতায়াত আছে নিশ্চয়ই। বন্য জানোয়ারের তৈরি পথও হতে পারে। শহীদ এতক্ষণ একথা ভাবেইনি। সচকিত হয়ে যতদূর দৃষ্টি যায়, দেখে নিলো সে ভালো করে।

সেই পথ ধরে অনেকদূর চলে গেল তারা। কিন্তু বনের মধ্যেটা ভীষণ অন্ধকার হয়ে এলো। সামনে আর কিছুই দেখা যায় না। এই অন্ধকারে পথ চলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। টর্চও বেশিক্ষণ জ্বালাতে ভরসা পাচ্ছে না শহীদ।

কামাল বললো, কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। শহীদ এই অন্ধকার আর ফেরা ঠিক হবে না।

তাই ভাবছি। আর এগোনো ঠিক না। সামনের বড় গাছটায় উঠে পড়বো।

আমি তো গাছে চড়তে জানি না। মহুয়া কাতর হয়ে বললো।

তাহলে নিচেই থাকতে হবে তোমাকে। কি আর করা। আমরা গাছে চড়ে বসে তোমাকে পাহারা দেবো।

নইলে ফিরে চলো লঞ্চে।

আর তো ফেরা সম্ভব না।

মহুয়া কি একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় বনের মধ্যে খচমচ করে শব্দ হলো। সবাই চমকে উঠে সেদিকে রাইফেল তুললো। শহীদ টর্চ জ্বেলে ধরলো। দুতিনটা শিয়াল। রাস্তার ওপর কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলো, তারপর একছুটে ডানপাশের ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লো।

বড় ডর লাগিয়ে দিয়েছিল। গফুর বললো।

নে, আর ডর পেতে হবে না, এই গাছটায় উঠে পড় চটপট।

গফুর একটা মস্ত বড় গাছে তরতর করে উঠে গেল রশি হাতে নিয়ে। নিচে টর্চ জ্বেলে ধরে রইলো শহীদ। একটা মােটা ডালে শক্ত করে রশিটা বেঁধে আরেক মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিতেই কামাল সেটা বেয়ে ওপরে উঠে গেল। এবার শহীদ মহুয়াকে বললো, তুমি আমার পিঠে চড়ে শক্ত করে গলা ধরে থাকো। উঃ! অত জোরে না, ব্যথা পাই। হাঁ, এই রকম করে ধরে থাকবে, ঢিল দিও না, খবরদার।

দক্ষ জিমনাস্ট শহীদ মহুয়াকে অনায়াসে পিঠে নিয়ে উঠে এলো গাছের উঁচু ডালে। বেশ মােটা ডাল। কারও যদি অফিসের দারোয়ানের মতো বেঞ্চিতে ঘুমানোর অভ্যেস থাকে তো অনায়াসে ডালের ওপর ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু শহীদদের কারো চোখে ঘুম নেই। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো তারা। সবাই বুঝতে পারছে, এভাবে ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। কতো রকম বিপদ, কত অসুবিধা। সাথে তারা মনে করে খাবার আনেনি। কেবল কাঁধে করে জল এনেছে সবাই এক এক বোতল।

কত রকম সাপ থাকতে পারে গাছে। দয়া করে একটা কামড় দিলেই ব্যাস খতম। কয়েকটা বানর ওদের আস্তানা বেহাত হয়ে গেল দেখে খ্যাচম্যাচ করে আপত্তি জানাচ্ছিলো এতক্ষণ। এবার তারা পাশের একটা গাছে গিয়ে নীরবে এইসব অপরিচিত অসভ্য আগন্তুকের উপর লক্ষ্য রাখছে।

কানের পাশ দিয়ে একেকবার পিন করে মশা ঘুরে যাচ্ছে। বোধকরি ভাবছে, ব্যাটারা, ঘুমিয়ে নাও তারপর দেখা যাবে।

হঠাৎ দূর থেকে একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেল। মহুয়ার বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠলো। শহীদের হাতটা ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, কিসের আওয়াজ?

সিংহ ডাকছে।

খুব কাছেই মনে হচ্ছে?

না। অন্ততঃ পক্ষে দুই মাইল দূরে রয়েছে এখন সিংহটা।

বাব্বা! মহুয়া একটা হাঁফ ছাড়ে, এতদূর থেকেই এতো জোরে শোনা যায়, কাছে হলে না জানি কতো জোরে শোনা যাবে! আচ্ছা, এই, বলো না সিংহ গাছে চড়তে পারে?

না পারে না। শহীদ হাসলো। পারলেও চিন্তা কি? এতগুলো রাইফেল রয়েছে কি করতে?

মহুয়া চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বোতল খুলে ঢক ঢক করে অনেকখানি জল খেলো। গফুর অন্যদিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলো। ও জানে দিদিমণির কতখানি ক্ষিধে পেয়েছে। সাথে খাবার নেই, সেজন্যে তার নিজেকে দোষী বলে মনে হতে লাগলো। সে কি করে দিদিমণির জল খেয়ে পেট ভরানো তাকিয়ে দেখবে?

বহুক্ষণ বসে রইলো তারা। শহীদ ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। তিনজন ঘুমাবে ডালের সাথে বাঁধা অবস্থায়, আর একজন ঘন্টা তিনেক জেগে থাকবে। তারপর এক জনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজে ঘুমাবে।

গফুর বললো, আমিই প্রথম জাগি দাদামণি।

থাক। আর চালাকি করতে হবে না। আমাদের কাউকে জাগাতে আপনার হাত উঠবে না, তা ভালো করেই জানি আমি। নিজেই সারারাত জেগে থাকবার চেষ্টা করবেন, আর ঢুলতে ঢুলতে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বাঘের পেটে যাবেন। আমিই থাকবো প্রথম জেগে।

কিন্তু গফুর কিছুতেই শহীদকে জাগা রেখে ঘুমাবে না। কামাল আর মহুয়াকে ডালের সাথে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেললো শহীদ।

আরও অনেকক্ষণ কাটলো। মহুয়া বোধকরি ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ বেশ কাছেই ডিম্ ডিম্ করে ঢাক বেজে উঠলো। আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ। এতো রাতে এভাবে ঢাক বাজে কেন? কেমন একটু হৈচৈ-এর শব্দও যেন পাওয়া যাচ্ছে। জংলীরা কি টের পেলো যে ওরা এতো কাছেই গাছের ওপর রয়েছে?

তরতর করে ডালের পর ডাল ধরে গাছের মগডালে উঠে এলো শহীদ আর গফুর! সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেশ কিছুটা দূরে মন্দিরটার কাছে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালা হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের ওপর ফুটবলের গোলপোস্টের মতো করে তিনটা কাঠ। ওপরের কাঠ থেকে ঝুলছে দুইটা মস্ত বড় বড় বাইসন। আগুনে পোড়ানো হচ্ছে তাদের। আর তারই চারপাশে অর্ধ উলঙ্গ জংলীরা নাচছে, চিৎকার করছে। মেয়ে পুরুষ সবাই আছে।

সবারই কোমরের কাছে একটু খানি কাপড় জড়ানো। বাকি দেহ উলঙ্গ। আজ বোধহয় ভালো শিকার পেয়েছে, তাই ওদের এত আনন্দ। একটু পরেই কামাল উঠে এলো শহীদের পাশে।

মহুয়া কই?

জেগে উঠে ভয় পাবে হয়তো, গফুর যা তো নিচে।

গফুর নেমে গেল। অনেকক্ষণ ওরা এমনি ভাবে বসে রইলো গাছের মাথায়। আগুন নিতে এসেছে। এবার ওরা পাশের একটা কূপ থেকে জল তুলে ঢালা শুরু করলো আগুনের মধ্যে। অনেক জল ঢালায় আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। কজন লোক বাইসনগুলো খুলে এনে মাটিতে রাখলো।

হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। ঢাকও বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকজন জংলীর হাতে ভর দিয়ে সাদা ধবধবে আলখাল্লা পরা একজন লোক কাছেরই একটা কুঁড়েঘর থেকে আসছে মন্দিরের দিকে এগিয়ে। অনেক মশাল জ্বালানো হয়েছিল। সেই আলোতে দেখা গেল লোকটা জংলী না। ওদের কালো কালো মুখের পাশে এই মুখটা অনেক ফর্সা লাগছে। বুক পর্যন্ত লম্বা পাকা দাড়ি। সৌম্য মূর্তি। কামাল বললো, ইসলাম কাকা না?

হু।

সেই কতো ছোটো বেলায় দেখেছি, কিন্তু এতদিন পরেও দেখে ঠিক চিনতে পেরেছি।

শহীদ কোনো উত্তর দেয় না। কি যেন ভাবছে সে।

হয়তো ভাবছে, এই যে মানুষটা জংলীদের পুরোহিতের কাজ করছেন তিনি তার বাবা। কতো যুগ তিনি একটা সভ্য মানুষের মুখ দেখেননি, একজন বাঙালী পাননি যে একটু কথা বলবেন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কতো শত মানুষকে বলি দিয়েছেন কুমীরের কাছে। সতেরো বছর! উঃ পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। কতো বিনিদ্র রাত হয়তো তিনি চোখের জলে ভেসে দেশের কথা, স্ত্রীর কথা, শহীদ, লীনার কথা ভেবেছেন। কতো কষ্ট কেটেছে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত।

সেই আলখাল্লা পরা লোকটা এসে দাঁড়ালো বাইসনগুলোর পাশে। একটা চকচকে ছুরি বের করে বেশ অনেকটা মাংস কেটে নিলো সেগুলোর শরীর থেকে। কিছুক্ষণ কি মন্ত্র পড়লো নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে। তারপর পুব দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো। মাংসের টুকরো দুটো নিয়ে সেই ছসাত জন লোক আলখাল্লাধারীর পিছন পিছন চলতে লাগলো। খালটার ওপর দিয়ে একটা ছোটো সাঁকো গেছে, সেই সাঁকোর ওপর গিয়ে মাংসের টুকরোগুলো জলে ফেলে দিলো লোকগুলো।

এইবার কয়েকজন জংলী ধারালো ছুরি দিয়ে ছাল ছাড়ানো শুরু করলো বাইসন দুটোর। আবার ঢাক আর হৈ-হল্লা শুরু হলো। আলখাল্লা পরা লোকটা আবার লোকগুলোর কাঁধে ভর করে কুঁড়ে ঘরটায় ঢুকে পড়লো। তাকে খুব অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে ।

শহীদ আর কামাল নেমে এলো নিচে। গভীর ভাবে চিন্তা করছে শহীদ। কিভাবে এখন অগ্রসর হওয়া যায়?
গভীর রাত। ঢাক, হৈ-হল্লা থেমে গেছে অনেকক্ষণ। জংলীরা বোধহয় যে যার ঘরে গিয়ে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। মহুয়া আঘোরে ঘুমােচ্ছে। গফুর বসে বসে ঝিমাচ্ছে ডালের ওপর। কোন সময়ে ঝুল লেগে পড়ে যাবে মাটিতে, তাই কামাল একটা রশি দিয়ে আলগোছে ওকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে। শহীদের ডিউটি শেষ করে সে কামালকে জাগিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছে কামালের জায়গায়, সেও বেশ অনেকক্ষণ হলো। বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে শহীদ।

সময় আর কাটতে চায় না। চারিটা দিক ভীষণ নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ খেয়াল করলে এই নিস্তব্ধতা একজন মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। চিন্তা করলেও মনে হয় যেন প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। ভাগ্যিস মাঝে মাঝে দূর থেকে বন্য জন্তুর ডাক শোনা যাচ্ছে। তাতে করে নীরবতাটা একটা অখণ্ড রূপ নিতে পারছে না।

এই নিঝুম নীরবতা প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করলে একটা অতীন্দ্রিয় সুরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। মনে হয় শব্দটা যেন পৃথিবীর ডাক। পৃথিবী নিরুদ্দেশের পান অবিরাম সমান গতিতে চলেছে, তারই একটানা একঘেয়ে শব্দ। এই ডাক চিরকালের। চলেছে, চলছে, চলবে।

বিরাট কিছুর সামনে গেলে যেমন মনটা ছেয়ে যায়, তেমনি এই নিস্তব্ধতা মনকে ছেয়ে ফেলে। চেতনা ছাড়া আর কিছুই বেঁচে থাকে না তখন। মাথাটা নিচু হয়ে আসে এক মহান বিরাটত্বের পায়ের কাছে। মনটা ভক্তিপুত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছে করে কারও কাছে। কিন্তু কার ওপর ভক্তি, কার আছে, আত্মসমর্পণ? ঠিক বোঝা যায় না।

এমনি সময় চমকে উঠলো কামাল। কুয়াশা! সরোদ বেজে উঠেছে। নিশ্চয়ই কুয়াশা! সে ছাড়া কেউ না। কাছেরই কোনো গাছ থেকে আসছে আওয়াজ। এখানে পর্যন্ত এসেছে কুয়াশা! অদ্ভুত। কোথায় তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কথা, আর সে কিনা, তাদের সাথে সাথে সুদূর আফ্রিকায় এসেছে, পাছে তাদের কোনও বিপদ হয়।

নিজের ভুলে নিজ হাতে সে তার বাবাকে খুন করেছে, এখন ছোটো বোন মহুয়ার যাতে কোনও কষ্ট না হয় তার চেষ্টা সে করছে। সে জীবন দেবে, তবু বোনটার সুখের ব্যবস্থা করে যাবে।

মালকোষ। ঠিক এই সময়কার রাগ। যখন মনটা শান্তি সমাহিত থাকে ঠিক তখনই মানুষের মন গায় মালকোষ। ধ্যানগম্ভীর মূর্তিতে যোগাসনে বসে গাইতে হয় এই রাগ। এতে প্রেম নেই, তাই মালকোষে কখনও ঠুমরী হয় না। মানুষের মন কেবল প্রেমে সন্তুষ্ট থাকে না, ভক্তি চাই, ধ্যান চাই, জ্ঞান চাই।

কামাল ভাবে; শহীদকে ঘুম থেকে ওঠাবে? না থাক, ও ঘুমাক। চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে কামাল।

কিসের শব্দ হয় যেন কামাল ভাই?

কামাল চেয়ে দেখে গফুরের তন্দ্রা কেটে গেছে। ও বলে, চুপ! বাজনা বাজছে, চুপচাপ শুনে যাও।

আবার চোখ বন্ধ করে কামাল। মনে মনে সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করেঃ

আরক্ত বর্ণে ধৃত রক্ত যষ্টি
বরৈ ধৃতা বৈরী কপালমালা
বিবঃ সুবীরে যুকৃত প্রবীৰ্য্যঃ
মালা মতো মালবো কৌষি কোয়ম

বাজনা বেজেই চলেছে। কিন্তু খুব আস্তে বাজাচ্ছে কুয়াশা, জংলীরা যেন শুনতে না পায়। কত বড় প্রতিভা, কতো সুন্দর মন, কামাল ভাবে। কিন্তু তাকে সারাজীবন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। কোনদিন কোথাও একটা সুখের নীড় বাঁধতে পারবে।

উচ্ছল যাযাবরের জীবন তার। কোথাও এতটুকু ভালবাসা এতটুকু স্নেহ নেই তার জন্যে। কতো একা সে! কামাল মরে যেত ওর অবস্থায় পড়লে।

কামাল চোখ খুললো। বাজনার আলাপ একটু দ্রুত হয়েছে।

ছোটো ছোটো তান চলেছে আলাপের সাথে সাথে। হঠাৎ কামালের চোখে পড়লো, ওটা কি? লম্বা কি একটা যেন ঝুলে রয়েছে ওপরের একটা ডাল থেকে। অল্প অল্প দুলছে সেটা। এটা তো ছিলো না আগে! চোখ রগড়ায় কামাল। না, তেমনি দেখা যাচ্ছে, চোখের ভুল না। সাত ব্যাটারীর টর্চ জ্বাললো কামাল। সেই আলোতে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল।

ওপরের একটা ডাল থেকে মস্ত বড় একটা সাপ নেমে এসেছে ঠিক মহুয়ার গলার কাছে। এরই নাম মাম্বা। কালনাগিনীর মতো ভয়ঙ্কর এর বিষ।

টর্চের আলোয় চকচক করছে সাপটার চোখ দুটো। সম্মােহিতের মতো একদৃষ্টে চেয়ে আছে সাপটা। জিভটা কেবল এক একবার লকলক করে বেরিয়ে এসে আবার অদৃশ্য হচ্ছে। ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে। আলোটা এতক্ষণে সহ্য হয়ে গেছে তার। এবার সে রাগে ফোলা শুরু করলো। কামাল হতভম্ব হয়ে চেয়েছিল এতক্ষণ। এবার তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রিভলবার বের করলো। গফুর তখনো ঢুলছে। সাপটা খুব সাবধানে নেমে আসছে। আর একটু নামলেই মহুয়ার গলায় ছোবল দিতে পারবে।

রিভলভার ছুড়লো কামাল। রাত্রির নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল এই প্রচণ্ড শব্দে। মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সাপটার। তিনচার সেকেন্ড শূন্যে দুলে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল সেটা।

সবাই চমকে জেগে উঠেছে। শহীদ উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি, কি হয়েছে কামাল?

সাপ মারলাম।

কই? কোথায় সাপ? তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ফেলে শহীদ।

কামাল নিচে হাত দিয়ে দেখালো। টর্চ জ্বেলে দেখা গেল মস্ত বড় একটা মাম্বা পড়ে আছে মাটিতে আঁকাবাঁকা হয়ে।

মহুয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। কামালের কথা শুনে আর মরা সাপ দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললো, আমি মনে করেছিলাম জংলীরা আক্রমণ করেছে বুঝি।

দাদামণি, আমাকে ধর। গফুরের আর্ত কণ্ঠস্বরে সবাই সচকিত হয়ে তার দিকে তাকালো। এতক্ষণ তার কথা কারও মনে হয়নি। ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে গফুর শূন্যের ওপর। গুলির আওয়াজ শুনে সে চমকে গাছ থেকে পড়ে যায়। কিন্তু কামাল আলগোছে বেঁধে রেখেছিল বলে এখনও সম্পূর্ণ পড়েনি, পায়ের সাথে কোনও মতে রশিটা ধরে উল্টো হয়ে ঝুলছে সে। চেষ্টা করেও আর উঠতে পারছে না, কেবল হাত পা ছুঁড়ছে। তার দুরবস্থা দেখে কামাল হেসে ফেললো। শহীদও না হেসে পারলো না।

তাড়াতাড়ি গফুরের পা ধরে ওপরে টেনে আনলো শহীদ। কামালের এতক্ষণে মনে হয়েছে, গুলির সঙ্গে সঙ্গেই বাজনা বন্ধ হয়ে গেছে। শহীদকে কিছুই বললো না সে। কুয়াশা ভাবছে না তো, তাকেই গুলি করবার চেষ্টা করেছে কামাল?

শহীদ ভাবছে গুলির পরিণামের কথা। জংলীদের মধ্যে কোনও সাড়া পড়লো কিনা দেখবার জন্যে গাছের মগডালে উঠে গেল সে। কিছুক্ষণ পর নেমে এসে রাইফেলটা তুলে নিলো কাঁধে। কামালকে বললো, তুই টর্চটা নিয়ে আয় তো আমার সঙ্গে, বোধহয় একটা ভালুক পাশের একটা গাছে উঠেছে। কিম্বা কোনও জংলী। কি যেন আবছা দেখা যাচ্ছে।

ধ্যাৎ, ভালুক কোনদিন গাছে উঠতে পারে? বানর টানর দেখেছিস।

আর বিদ্যা বাড়িস না তো, চল। বইয়ে পড়িসনি ভালুক গাছে উঠিয়া মৌচাক ভাঙিয়া মধু খায়? চল, টর্চটা নিয়ে চল।

যাস না শহীদ। ওটা ভালুক না, কুয়াশা। ভালুক ভেবে কি শেষে বন্ধুকে মারবি?

তুই কি করে বুঝলি যে ওটা কুয়াশা?

এতক্ষণ সরোদ শুনছিলাম ওর। গুলির শব্দে বন্ধ করে দিয়েছে বাজনা।

শহীদ বসে পড়লো ডালের ওপর। হাত ঘড়িতে দেখলো, সাড়ে চারটা বাজে।

বাকি রাতটুকু জেগেই কাটাই, কি বলিস?

রাজি। সিগারেট দে।

একটা সিগারেট নিজে ধরিয়ে কামালকেও একটা দিলো শহীদ। বললো, খুব ভােরে আমরা বনের অন্য দিকে চলে যাবো। গাছের ওপর থেকে দেখলাম জংলীদের দুটো কুঁড়েঘরে বাতি জ্বলে উঠলো। কয়েকজন লোক বাইরে এসে আমাদের এদিকটায় আঙ্গুল দেখিয়ে কি যেন বলাবলি করলো। তারপর আবার ঘরে ফিরে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো। এতো রাতে কেউ আর আসবে না। কিন্তু ভােরের দিকে ওরা বোধহয় দল বেঁধে এসে এ দিকটায় খোঁজ করবে।
বড় সুন্দর ভাবে জংলীরা ওদের আস্তানা সুরক্ষিত করেছে। চারপাশে খুব ঘন করে লাগিয়েছে গাছ। সে সব গাছ বড় হয় মােটা হয়েছে, ফলে একটার সাথে আরেকটা লেগে গেছে। ইউক্যালিপটাস গাছের মতো সাদা এই গাছগুলোর শরীর। কোনো বন্য জন্তুর পক্ষে এ প্রাচীর ভেদ করে ওধারে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের এলাকায় ঢুকতে হলে একটাই মাত্র পথ। সে পথ হচ্ছে খালটা। কিন্তু খালের আশপাশে ওদের এতো ঘন বসতি, যে কারও চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়া অসম্ভব। আজ পর্যন্ত কোনো পর্যটক কিংবা বিদেশী কেউ এদের এলাকায় ঢুকতে পারেনি। অনেক পাদ্রী চেষ্টা করেছে, কিন্তু নিজেরা কুমীরের পেটে গেছে। এরা মানুষ হয়নি।

কুফুয়ার একটা কথা শহীদের খুব মনে আছে। কথায় কথায় কুফুয়া বলেছিল, হ্রদের ধারে সবচাইতে বেশি শিকার পাওয়া যায়। তাই জংলীরা দিনের বেলা নানা রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে হ্রদটার আশপাশে শিকারে যায়।

শহীদরা ফিরে চললল লঞ্চে। সেখান থেকে দরকারী সব জিনিসপত্র নিয়ে সম্পূর্ণ এলাকাটা একবার ঘুরে দেখবে। তারপর যাহোক একটা কিছু করা যাবে।

যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা গেল লঞ্চ নেই নদীতে। সবাই থ খেয়ে গেল। এখন উপায়? তারা ফিরবে কিসে করে? ব্লাইদ কি ভয় পেয়ে চলে গেল ওদের ফেলে রেখে?

হঠাৎ একটা কাগজের উপর চোখ পড়লো শহীদের। একটা গাছের গায়ে পোস্টারের মতো করে সাঁটানো। সবাই কাছে গেল কাগজের ওপর লেখা।

5-30 A.M.

Mr Shahid,

I am seeing a mast proceeding in this direction. Perhaps it is our enemys boat. So I am moving towards west. You will find me within half a mile.

Blythe.

পশ্চিমে তো যাবো, কিন্তু যাবো কোন পথে? সবই তো ঘন বন। কামাল চিঠিটা ছিড়ে নিয়ে বলে।

এরই মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি চলে নইলে ধরা পড়ে যাবে। ওই দেখো নৌকো বাঁধা রয়েছে ঘাটে।

কামাল চেয়ে দেখলো সত্যি একটা নৌকো অদূরে পাড়ে বাঁধা। ব্যস্ত হয়ে কামাল বললো, ওরা বোধকরি নেমে পড়েছে। আমাদের খুঁজছে হয়তো, চলো তাড়াতাড়ি বনে ঢুকে পড়ি।

ঠিক এমনি সময়ে কয়েকজন লোকের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা গেল খুব কাছেই। ওরা এইদিকেই আসছে।

সবাই বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। বড় বড় গাছ তো রয়েছেই, হাঁটু পর্যন্ত ছোটো ছোটো অসংখ্য ঝাড়। মধ্যে মধ্যে কাঁটাও আছে। পা ছড়ে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে সাপে কামড়াতে পারে। কিন্তু ওদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, যতদূর সম্ভব সরে যেতে হবে।

বেশ অনেকদূর এসে কামাল জিজ্ঞেস করলো, এরা কারা রে? সেই জংলীর সর্দার দলবল নিয়ে এলো, না এখানকারই জংলীরা আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে?

কি জানি।

সর্দারটা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলো?

আসবেই তো। ওদের পুরোহিত মশাইকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস এতে সহজে?

আর একটু হলেই ধরে ফেলেছিল প্রায়!

চল, চল, কথা বলিস না। জোরে পা চালা। মহুয়ার কষ্ট হচ্ছে? কাঁধে-চড়বে আমার?

না আমি হাঁটতে পারবো। কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মহুয়া দেখাতে চায় না।

ঘাটের সাথে একদম লাগিয়ে লঞ্চ বেঁধে রেখেছে মি. ব্লাইদ। পাড়ের ওপর চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলো সে। শহীদদের দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠলো সে।

আপনার বোটের শব্দ শোনেনি তো ওরা? প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো শহীদ।

না। আমি বৈঠা বেয়ে উজানে এসেছি।

কি বলছেন! এতবড় লঞ্চ আপনি একা বৈঠা বেয়ে এনেছেন? সাংঘাতিক তো! বৈঠা পেলেন কই?

হালটা খুলে নিয়ে বৈঠা করে নিয়েছিলাম। একটু হেসে বললো মি. ব্লাইদ।

শহীদ আর কামালের মুখ হাঁ হয়ে গেল। একে প্রকান্ড হাল, তার ওপর নিচটা লোহা দিয়ে মােড়া; সেটাকেই আবার বৈঠা বানিয়ে স্রোত ঠেলে এতদূর আসা! সোজা কথা? হালটা কামাল তো তুলতেই পারবে না। সেটা বাওয়া তো কল্পনাও করা যায় না। মি. ক্লাইদের হাতের দৃঢ় পেশীর দিকে কামাল একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো। দেখে কিন্তু অতোটা মনে হয় না।

শহীদকে বাংলায় কামাল বললো, ব্যাটা গুল মারছে না তো?

না। দেখ না, হালটা পিছনে ওঠানো ছিলো, এখন ঠিক জায়গা মতো বেঁধে রাখছে।

কামাল ব্লাইদের কাছে গিয়ে বাংলায় বললো, কোন দোকানের চাল খাওয়া হয় মশায়ের? এতো শক্তি পাওয়া গেল কোথায়, আঁ? ব্যাটা ভীম কোথাকার!

What?

বলছিলাম, অদ্ভুত শক্তি আপনার। কামাল ইংরেজিতে বলে।

সাহেব বিগলিত হয়ে গিয়ে বললো, না এই সামান্য একটু আছে।

খাওয়া-দাওয়া করে সবকিছু গুছিয়ে নেয় শহীদ। কয়েকটা ব্যাগে পাউরুটি, মাখন আর বিস্কিটের টিন, কিছু রশি, ছুরি, বুলেট, কয়েকটা হাতবোমা, একটা বায়নোকুলার, সাত ব্যাটারীর টর্চটা, আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস ভরলো শহীদ। তারপর একেকজনের কাঁধে কয়েকটা করে ঝুলিয়ে দিলো। কি ভেবে কতকগুলো পেরেকও নিলো শহীদ। একেকজন দু বোতল করে পানি নিলো। টু-টু বোর রাইফেলটা সাথে নিলো মহুয়া এবার।

আবার এই জঙ্গল ভেঙে যেতে হবে আমাদের? কামাল চলতে চলতে জিজ্ঞেস করে?

না। সামনেই ভালো রাস্তা পাবো। তখন তো emergeny ছিলো, তাই ঢুকে পড়েছিলাম জঙ্গলেই। একটু ঘুরে এলে ভালো পথেই আসতে পারতাম। নদী থেকে প্রচুর রাস্তা উত্তরে চলে গেছে। কোনও না কোনও পথ পেয়েই যাবো আমরা।

এসব রাস্তা হয় কি করে? মহুয়া জিজ্ঞেস করে।

বন্য জন্তুরা জল খেতে আসে নদীতে। বিশেষ করে জংলী হাতিরা রাস্তা তৈরি করেI

তাহলে তো এসব রাস্তা খুব বিপজ্জনক।

একটা কথা কি জানো, হাতিই বলো আর খরগোসই বলো মানুষকে সব জন্তুই ডরায়। একজন বা দুইজন লোক হলে, আর খুব ক্ষুধার্ত থাকলে বাঘ, সিংহ বা কুমীর আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু আমরা চারজন। এই তিন জানোয়ারের কোনোটাই আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। অতএব ভয় কি? দল বেঁধে যদি আসে, চারজন সমানে গুলি ছুড়বো, কার সাধ্য এগোয়? তাছাড়া হাতবোমা তো রয়েছেই।

মহুয়া সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হলো। সে এখন বনের শোভা নিরীক্ষণ করতে করতে চলেছে। পথের পাশে কোনো নাম না জানা সুন্দর ফুল পেলে অমনি তুলে খোঁপায় গোঁজে, কিংবা শহীদ বা কামালের শার্টের বোতামের গর্তে পরিয়ে দেয়। বেরসিক গফুরের কানে পর্যন্ত একটা লাল ফুল গুঁজে দিয়েছে সে। গুনগুন করে গান ধরলো মহুয়া। ভালো রাস্তায় পড়েছে তারা। শহীদ আগে আগে চারদিকে অত্যন্ত সর্তক দৃষ্টি রেখে চললো।

মাইল দুয়েক উত্তরে গিয়ে বাঁ ধারে একটা পথ পাওয়া গেল। সেই পথে এগোলো শহীদরা। জংলী এলাকার খুব কাছে যেতে চায় না ওরা আপাততঃ।

আরও মাইল দুয়েক গিয়ে ওরা একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বিশ্রাম করতে বসলো। বেশ গরম। সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে কামাল আকাশের দিকে লক্ষ্য করে বললো, দক্ষিণে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হবে না তো?

শহীদও গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলো, খুব তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে মেঘটা। ভয়ানক ঝড় হবে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তার আগেই একটা ঘন গাছের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। উঠে পড়লো সবাই। একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় এসে দাঁড়ালো ওরা। গফুরকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে রশি বাঁধিয়ে ওরা গাছের নিচু একটা ডালে উঠে বসলো।

মহুয়া বললো, বৃষ্টি হবে হোক, কিন্তু গাছে উঠলাম কেন? এতে কি বৃষ্টি কম লাগবে?

আমরা যে কারণে এই গাছটা বেছে নিয়েছি Shelter হিসেবে, ঠিক সেই কারণেই তো কোনো হিংস্র জন্তু এখানে আশ্রয় নিতে পারে। ডালের উপর অনেকটা Safe.

শহীদের কথাই ঠিক। যখন টপ টপ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো তখন কোথেকে দুটা বানর ছুটে এসে এই গাছে উঠে পড়লো। কিন্তু কয়েক ফোঁটা পড়েই বৃষ্টি থেমে গেল হঠাৎ। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। একটু পরে উল্টোদিকে বইতে শুরু করলো বাতাস। গফুর বললো, খুব বড় ঝড় হতে পারে, দাদামণি।

আমারও তাই মনে হচ্ছে। কামাল বললো।

মিনিট পাঁচেক আবার চুপচাপ। তারপর শুরু হলো প্রলয় মাতন। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কী যেন গোঁ গোঁ করে ছুটে আসছে।

প্রচণ্ড আওয়াজ। মট মট করে গাছ ভাঙার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে সাইক্লোন।

ঝড়ের শব্দের সাথে সাথে জন্তু-জানোয়ারের ত্রাহী ত্রাহী চিৎকার। শহীদ বড়ো ভুল করেছে। এই বনটার বিশেষত্ব হচ্ছে গাছগুলো সব ছোটো বড়, অন্য অন্য বনের মতো সব সমান না। দক্ষিণ দিকের কয়েকটা গাছ খুব ছোটো, তারপর শহীদদের গাছটা মস্ত বড়। ফলে ঝড়ের ঝাপটা ছোটো গাছে না লেগে ওদের গাছে সোজা এসে লাগবে। একথা আগে ভাবেনি শহীদ। আগেই লক্ষ্য করেছিল সে, গাছগুলোর দৈর্ঘ্য অসমান। সমান হলে কেবল সামনের কয়েকটা গাছের ক্ষতি হতো, গোটা বন অক্ষত থাকতো। শহীদ ভাবছে নেমে যাবে কিনা। না, এখন আর সময় নেই। ঝড় এসে পড়লো বলে।

মহুয়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শহীদ এক হাতে তাকে ধরে আরেক হাতে একটা ডাল জড়িয়ে ধরলো। এসে পড়লো সাইক্লোন। ভীষণ ঝাপটা। গাছ যেন ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। ছিটকে পড়ে যাবে না তো তারা? কামাল উপরে চেয়ে দেখলো অজস্র পাতা ভয়ানক বেগে উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। দুইটা মস্ত বড় বড় ডাল কোথা থেকে যেন ভেঙে এসে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়লো কাছেই কোথাও। প্রচণ্ড শব্দ। কানে তালা লাগার উপক্রম। কয়েকটা জেব্রা এসে গাছের তলায় দাঁড়িয়েছে। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে তারা। তাদের পাশ দিয়ে একটা মস্ত বড় বাঘ উদভ্রান্তের মতো একদিকে ছুট দিলো। এতো উপাদেয় শিকারের প্রতি তার লক্ষ্যই নেই। প্রকৃতির এই দানবিক লীলায় সবাই সমান নিরুপায় হয়ে একটু আশ্রয় খোঁজে।

হঠাৎ মড়মড় করে গাছের একটা অংশ ভেঙে শূন্যে চলে গেল। মনে হলো যেন হৃদয়ের একটা অংশই শূন্য হয়ে গেল। ফাঁকা আকাশ দেখা যাচ্ছে। মহুয়া শহীদের বুকে মুখ গোঁজে।

কিছুদর দিয়ে পোঁ পোঁ করে ভীষণ আর্তনাদ তুলে কয়েকটা হাতি দৌড়ে চলে গেল পুবে।

মিনিট পাঁচেক পর সাইক্লোন কমলো। শোনা যাচ্ছে, ক্রমেই সে ভীষণ শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে। এবার বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ দেখে বোঝা গেল, বজ্রসহ প্রচণ্ড বারিপাত হবে। এই গাছে থাকলে নির্ঘাৎ ভিজতে হবে। শহীদরা গাছ থেকে নেমে পড়লো। তাদেরকে দেখতে পেয়ে জেব্রাগুলো একদৌড়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

কাছেই আরেকটা অক্ষত ঝাঁকড়া গাছ পাওয়া গেল। শহীদরা তাতে চড়ে বসতেই চেপে বৃষ্টি এলো।

ঝমাঝম ঝমাঝম বৃষ্টি পড়েই চলেছে, থামবার নাম নেই। ঘন্টাখানেক গাছের ওপর ঠায় বসে রইলো ওরা। কড় কড় ক্কড়াৎ করে বাজ পড়ছে এখানে-সেখানে। বিজলী চমকে উঠছে এই দিনের বেলাতেও।

হঠাৎ মহুয়া মাটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো, সাপ।

সবাই চেয়ে দেখলো, একটা মস্ত পাইথন গাছে উঠবার চেষ্টা করছে। ও উচু একটা জায়গা চায়, বৃষ্টির জলে নেয়ে গেছে একেবারে। গাছে উঠে এলে সর্বনাশ হবে। কামাল রাইফেল তুললো। বেশ অনেকক্ষণ সই করে গুলি করলো। পেটের কাছে কোয়ার্টার ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ছড়ে গেল সাপটার। সাৎ করে সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ফেললো সাপটা। কিন্তু চলে যাওয়ার নামও করলো না। কুন্ডলী পাকিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করলো কিছুক্ষণ, তারপর আবার গাছে উঠে আসার চেষ্টা করতে লাগলো।

এবার একেবারে চাঁদি সই করলো কামাল। ফুটো হয়ে গেল মাথাটা। থপ্ করে মাটিতে পড়ে গেল সাপটা। আশপাশের খানিকটা জায়গা লাল হয়ে গেল রক্তের রঙে।

মহুয়া বললো, দেখো, মরেনি এখনও। কি ভীষণভাবে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে।

মরে গেছে। মরবার পরেও অনেকক্ষণ এই রকম কুণ্ডলী পাকায় পাইথন। এর মধ্যেও যদি কোনো মানুষ পড়ে তো চাপ দিয়ে দলা করে দেবে। শহীদ ছুরি দিয়ে একটা ডাল কেটে ফেলে দিলো সাপটার কুণ্ডলীর মধ্যে। মড়মড় করে ভেঙে গেল ডালটা। তবু ছাড়ে না, সমানে চাপ দিয়ে চলেছে।

নামবো কি করো, মহুয়া সভয়ে জিজ্ঞেস করে।

সে দেখা যাবেখন। আপাততঃ বৃষ্টিটা তো থামুক। শহীদ জবাব দেয়।

বৃষ্টি পড়ে চলে ঝমাঝম, একটানা। একফোঁটা দুফোঁটা করে সবার গায়েই জল পড়ছে। মহুয়ার কোঁকড়া চুলের ওপর বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।

এমনি সময় খুব কাছ থেকে বেজে উঠলো সরোদ। সবাই একবার সবার দিকে চাইলো, কেউ কোনো কথা বললো না। কুয়াশা ছায়ার মতো তাদের অনুসরণ করছে। আর তা জানাতেও ওর অনিচ্ছা নেই। কিন্তু সরোদ বাজায় কেন? শহীদ ভালবাসে বলে, নাকি না বাজিয়ে থাকতে পারে না?

এটা কি রাগ শহীদ? আর কখনো শুনিনি তো, কামাল বলে।

গৌড় মল্লার।

রূপটা কি এই রাগের?

শহীদ বললো,

গৌড় সারং যো মালহার দোনো
মিলমিলে খেড়েকার
বোলত হয় বরখাতি রিমঝিম
গাও গৌড় মালহার।

সবাই চুপচাপ শুনছে। আধঘন্টার মতো বাজিয়ে থেমে গেল কুয়াশা। তবলা নেই। কিন্তু ওদের কারও খেদ থাকে না। আলাপেই সম্পূর্ণ রূপটা ফুটিয়েছে কুয়াশা, গতের দরকার নেই। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। এই অদ্ভুত মানুষটার উদ্দেশ্যে সবারই মাথা নিচু হয়ে আসে শ্রদ্ধায়। কতবড়, কতো উচু মানুষটা! বড় কষ্ট লাগে শহীদের।

বৃষ্টি ধরে এসেছে। শহীদরা নেমে এলো গাছ থেকে। তখনও কুণ্ডলী পাকাচ্ছে পাইথনটা।
অনেকদূর পশ্চিমে চলে গেছে শহীদরা। তারপর আবার উত্তরে। জংলী এলাকার কাছে এসে পড়েছে তারা। সেই সারি বাঁধা গাছগুলোর ধার দিয়ে তারা বাঁ দিকের পথ ধরে এগিয়ে চললো।

হঠাৎ কাছেই একটা রাইফেলের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালো শহীদ। পুবদিক থেকে এলো শব্দটা। আবার আওয়াজ। এবার আর একটু কাছে থেকে।

শিগগির বনের মধ্যে সরে আয়। সবাইকে নিয়ে শহীদ রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, গফুর দেখ তো এই গাছটায় চড়তে পারিস কি না। একটা মোটা গাছ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শহীদ।

গফুর চড়তে চেষ্টা করলো গাছটায়। কিছুদূর উঠেই ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল পা পিছলে। ভেজা গাছে এভাবে বেয়ে ওঠা সম্ভব না। সবাইকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত থাকতে আদেশ দিয়ে গফুরের কাঁধে চড়ে গাছটার একটা নিচু ডাল ধরলো শহীদ। তারপর খুব সাবধানে উঠে গেল গাছে। ধীরে ধীরে গাছের আগায় উঠে গেল শহীদ। সেখান থেকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে সে।

গাছের ওপর থেকে শহীদ দেখলো, ফুলপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরা চারজন নিগ্রো রাইফেল বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুবদিকে মুখ করে। আর তাদের সামনে বেশ কিছুটা দূরে বিশ-পঁচিশজন নেংটি-পরা জংলী দাঁড়িয়ে আছে। দুজন জংলী মাটিতে পড়ে আছে। একজনের কপাল থেকে তাজা রক্ত পড়ছে। এখান থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জংলীদের মধ্যে ভীষণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কেউ সাহস করে এগোচ্ছে না, দুজন সাথীকে চোখের সামনে মারতে দেখে। ফুলপ্যান্ট পরা লোকগুলো একপা একপা করে পিছনে সরছে। বোধ করি জংলীরা এদের আক্রমণ করেছিল, তাই এরা গুলি করে দুজনকে শেষ করে দিয়েছে, এখন পালাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই প্যান্ট পরা লোকগুলো কারা। জংলীরা এদের আক্রমণ করে কেন?

কিন্তু পিছনে ওরা কারা? দশ-বারোজন নেংটি পরা লোক মুগুর হাতে পা টিপে টিপে এগোচ্ছে প্যান্ট পরিহিতদের পিছন দিক দিয়ে। শহীদ একবার ভাবে, লোকগুলোকে সাবধান করে দেবে। কিন্তু তাতে নিজেদের বিপদ হতে পারে। জংলীরা তাদেরও আক্রমণ করবে। এই অবস্থায় চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

প্যান্ট পরা লোকগুলো অতি সাবধানে পিছনে হটে যাচ্ছে। ওরা টেরও পেলো না কী বিপদ ঘনিয়ে আসছে তাদের অজান্তে। সামনের জংলীরা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওরা পিছনে সরছে। শহীদ ভাবে ব্যাটারা ফিরে চায় না কেন একবার।

সৈনিকের মাথার পিছনে চোখ থাকে না; কিন্তু দেখা যায় যুদ্ধ- ফ্রন্টে চলতে চলতে হয়তো কেউ, কোনও কারণ নেই, হঠাৎ শুয়ে পড়লো মাটিতে। কি যেন সন্দেহ হয়েছে তার; আর অমনি তার মাথার ওপর দিয়ে কয়েক ঝাঁক গুলি চলে গেল সাঁ করে। মানুষ কি করে যেন তার বিপদের কথা আগেই টের পায়; কেউ লক্ষ্য করে, কেউ করে না। ঠিক সেই কারণেই, কিংবা শহীদের ইচ্ছাশক্তির জোরে একজন প্যান্ট পরা নিগ্রো ফিরে তাকালো পিছনে। চমকে উঠে কি যেন বললো সে। কিন্তু আর সময় নেই, পিছনের জংলীরা হাত পাঁচেকের মধ্যে এসে পড়েছে। প্রস্তুত হবার আগেই মুগুর হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো জংলীরা তাদের ওপর।

আধ মিনিটের মধ্যে ওদের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে মুগুর পেটা করে মাটিতে শুইয়ে ফেললো ওরা। সামনের লোকগুলোও এগিয়ে এসেছে। চারজনকেই হাত-পা বেঁধে ফেললো ওরা। তারপর তাদের প্রত্যেকের বাঁধা হাত আর পায়ের মধ্যে দিয়ে একটা করে বাঁশ ঢুকিয়ে দিলো। দুজন করে জংলী একেক জনকে কাঁধে তুলে নিলো। তারপর হৈ হল্লা করতে করতে রওনা হলো।

কিন্তু ফুলপ্যান্ট পরা নিগ্রোগুলোর মুখ দেখতে পেয়েই শহীদ চিনতে পারলো। কুফুয়ার চার ছেলে! চমকে ওঠে শহীদ। এরা এখানে কেন এরাই তাহলে তাদের ধাওয়া করে এসেছে! কী সাংঘাতিক! তাদেরকে খুন করে রেখে চেক নিয়ে যাওয়ার মতলবে এতদূরে এসেছে এরা! কাল রাতে কামালের সাপ মারার শব্দ শুনে জংলীরা। এদিকটা খোঁজ করতে এসেছিল। কুফুয়ার চার ছেলেকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে চলে গেল।

হৈ-চৈ যখন বেশ অনেকটা দূরে চলে গেছে, তখন শহীদ ধীরে ধীরে নেমে এলো গাছ থেকে। নিচে কামালরা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। ওরা এতক্ষণ কেবল হৈ-হল্লা শুনছে, কি ঘটছে কিছুই বোঝেনি।

শহীদ যা যা দেখেছে সব বললো ওদেরকে। কামাল বললো, যেমনি কর্ম তেমনি ফল। আমাদের খুন করতে এসে এখন যাও বাবারা, কুমীরের পেটে যাও।

ওদের কি মেরে ফেলবে জংলীরা? মহুয়া জিজ্ঞেস করে।

না মারবে না; মেঠাই-মণ্ডা খাইয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেবে, কামাল বলে।

তোর এই উচ্ছ্বাস রাখ তো, কামাল। আমাদের অনেক পথ চলতে হবে, রওনা হওয়া যাক, শহীদ বললো।

রওনা হলো শহীদরা। সারাদিন হাঁটার পর বিকেলের দিকে পাহাড়ের কাছটায় পৌঁছলো তারা। পথে এক জায়গায় বসে ওঁরা কিছু খেয়ে নিয়েছে। সবাই কিছু কিছু করে ব্রান্ডি ও খেয়েছে, কিন্তু তবু পুরোপুরি ক্লান্তি যায়নি। সবারই পা টন্ টন করছে। মহুয়ার তো সবচাইতে বেশি। কিন্তু মুখে কেউ কিছুই প্রকাশ করে না।

আর কিছুদূর যেতেই শহীদ যা চাইছিল তা পেয়ে গেল। ঝড় দেখেই শহীদ বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল। কামালকে বলেছিল, এর ফল ভালোও হতে পারে। কামাল তখন কিছুই বোঝেনি। এখন দেখলো, সারির মধ্যেকার পাশাপাশি তিনটা গাছ সম্পূর্ণ উপড়ে পড়ে আছে। আর তার জায়গায় টাটকা গর্ত। সেখানে অল্প জল জমেছে। গাছগুলো সাইক্লোনে ভেঙেছে। সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। ইচ্ছেমত ঝাপটা দিতে পেরেছে বাতাস।

ব্যাস। আর চিন্তা কি? এবার অনায়েসে জংলী এলাকায় ঢােকা যাবে।

কিন্তু ভেতরেও যেন বন দেখা যায়? কামাল বললো।

ওগুলো বন না। জংলীদের নিজ হাতে লাগানো ফলের বাগান। চল তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ি ভিতরে, নইলে কারও চোখে পড়ে যেতে পারি।

গাছের ওপর দিয়ে খুব সাবধানে পার হয়ে এলো ওরা। আসার সময় ব্যাগ থেকে। একটা রুটি আর কিছু মাখন বের করে শহীদ একটা ভাঙা গাছের ওপর রেখে এলো। কামাল ঠাট্টা করে বললো, কিরে, মন্ত্র পড়ে রেখে এলি নাকি। কোনও জবাব না দিয়ে সোজা পুবদিকে চলা শুরু করলো শহীদ।

সত্যি। জংলী হলে কি, লোকগুলোর রুচি আছে। গাছগুলোর তলা তকতকে পরিষ্কার। কোনো আগাছা জন্মাতে পারেনি সেখানে। নানারকম ফলের গাছ রয়েছে, কিন্তু কোনটা এলোমেলো না। যেখানে নারকেল, সেখানটায় কেবলই নারকেল, যেখানে আম, কলা বা অন্য কোনও ফল, সেখানে কেবল তাই। অনেকদূর পর্যন্ত নির্ভাবনায় চলে এলো শহীদরা। হঠাৎ কাছেই কথাবার্তার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো। চট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো তারা। দেখা গেল, চার-পাঁচজন জংলী একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে এই দিকেই আসছে। ভুট্টাখেতের পাশ দিয়ে এতক্ষণ আসছিল বলে শহীদরা দেখতে পায়নি ওদের। জংলীরা খেতের ঠিক পাশের বাগানটায় থামলো। দুতিনজন গাছে উঠে গেল। ওই সারিটার সবই আম গাছ। ডাল ধরে ঝাঁকি দিয়ে ওরা অনেক পাকা আম পাড়লো। মস্ত বড় বড় ফজলি আমের মতো আম। কয়েকটা গাছ থেকেই পাড়লো ওরা। তারপর ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে আম নিয়ে চলে গেলI

মহুয়া হঠাৎ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, একটা আমও দিলো না!

চাইলেই পারতে? কামাল বলে।

আর পা চলে না, দাদামণি। গফুর বসে পড়লো মাটিতে।

এই, এখানে শুয়ে পড়িস না। একটু এদিকে সরে আয়, পরিষ্কার ঘাস আছে এখানে। আমরা সবাই এখন শুয়ে-বসে বিশ্রাম করবো। আমাদের আজ অনেক পথ চলতে হবে। কিন্তু একটু আঁধার না হলে চলা ঠিক হবে না। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমরা এখানে বিশ্রাম করবো।

সবাই ঘাসের ওপর বসে পড়লো। গফুর একটু দূরে গিয়ে বসে পড়লো। বললো, দাদামণি, যাবার সময় আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিও। আমি একটু ঘুমাবো।

তো কাল বাহাদুরী করতে গেছিলি কেন গাধা? শহীদ স্নেহের সুরে বললো।

কামাল টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর শহীদও। আরও কিছুক্ষণ পর মহুয়াও শুয়ে পড়লো। সবচাইতে ক্লান্ত হয়েছে মহুয়াই। ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে শহীদ।

মহুয়া, ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু। এই কামাল, শরীরে মশা-মাছি বসতে দিস না।

কিস লিয়ে? আরাম পেয়ে উর্দু বেরোয় কামালের।

সি-সি মাছির নাম শুনেছিস?

চমকে উঠে বসলো কামাল। চোখ বড় বড় করে বললো, যে মাছি কামড়ালে জীবজন্তু ঘুমাতে ঘুমাতে মরে যায়?

হ্যাঁ।

সেগুলো তো আফ্রিকার মধ্যভাগে থাকে, কঙ্গোর কাছাকাছি।

কিছু কিছু সবখানেই থাকে। বিশেষ যেসব জায়গায় মিষ্টি ফলের গাছ আছে সেখানে বেশি থাকে।

কামাল চুপ করে আবার শুয়ে পড়লো। কিন্তু শহীদ লক্ষ্য করে, বড় বেশি হাত-পা নাড়ছে সে। শরীরের কোথায়ও একটু চুলকালেই ও ভাবে, এই বুঝি সি-সি মাছি কামড়াল। কারণে-অকারণে যেখান-সেখানে চুলকাচ্ছে সে। এদিক সেদিক কেবল মাছি দেখছে কামাল। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে শহীদ।

অতো ঘাবড়াবার দরকার নেই, কামাল। আমি সি-সি মাছির প্রােটেকশনের জন্যে অ্যানটিসাইড নিয়ে এসেছি সাথে করে। তবু একটু সাবধানে থাকা ভালো, কি দরকার শুধু শুধু ইনজেকশন নিয়ে।

এই কথায় কামাল আশ্বস্ত হলো অনেকখানি। বললো, আমি তো ঘাবড়াইনি মােটেও। মরতে তো একদিন হবেই।

কামাল অনেকটা নিশ্চিত হয়ে শুয়ে রইলো চিতপাৎ। মহুয়া এদিকে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। গাছের তলাটা ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। আর একটু পরেই ওরা রওনা হবে। শহীদ মহুয়াকে জাগালো আস্তে করে। কামাল আর গফুর তখন নাক ডাকাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। ব্যাগ থেকে দুইটা রুটি বের করলো শহীদ। মহুয়াকে বললো, তুমি এগুলো কেটে মাখন লাগাও তো, আমি দেখি কয়টা আম পেড়ে আনা যায় কিনা।

এখন আবার খাবে?

হাঁ, খেয়ে নিই। হয়তো সারারাত পথ চলতে হবে আমাদের। শহীদ চলে গেল আম আনতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো দশ-বারোটা ইয়া বড় বড় আম নিয়ে। মহুয়া তখন লক্ষ্মী মেয়েটির মতো রুটিগুলোতে মাখন লাগানো শেষ করেছে। গফুর আর কামালকে জাগিয়ে সবাই মিলে পেট পুরে খেয়ে নিলো।

আমগুলো যেমন বড়, তেমনি মিষ্টি। খেতে খেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কামাল বললো, লীনা বড় ভালবাসে আম খেতে।

মহুয়া হেসে ফেলে কি যেন ঠাট্টা করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু কি ভেবে থেমে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হাঁটা শুরু করলো শহীদরা। অনেক ভুট্টাখেত করেছে জংলীরা জায়গায় জায়গায়। তবে ফলের বাগানই বেশি। এক জায়গায় অজস্র কলাগাছ লাগিয়েছে ওরা। অনেকগুলো কাঁদি ঝুলে রয়েছে। সে কাঁদিও কাঁদি বটে। একজন মানুষের গলা পর্যন্ত উঁচু হবে এক একটা। শহীদরা এগিয়ে চলেছে পুবে। মন্দিরের কাছাকাছি যাবে তারা।

চাঁদের আলোয় বেশ দেখা যাচ্ছে পথ। মাঝে মাঝে ভুট্টাখেতের মধ্যে দিয়ে চলে তারা, মাঝে মাঝে ঘন বাগানের অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। কামাল বললো, এখানে বন্য জন্তুর কোনও ভয় নেই, তাই না শহীদ?

নেই। কিন্তু সাপের ভয় সমানই আছে।

বহুদূর চলে এলো তারা। পাঁচ ঘন্টা সমানে চলার পর দূর থেকে অনেকগুলো খড়ের-কুঁড়েঘর দেখা গেল। কয়েকজন লোককেও চলাফেরা করতে দেখা গেল বাড়ির আশপাশ দিয়ে। শহীদরা এবার খুব সাবধানে এগোচ্ছে। ধরা পড়ে গেলেই সর্বনাশ হবে। আর বেরোবার পথ নেই। এতো পরিশ্রম, এতো কষ্টের পরিণাম হবে মৃত্যু।

হ্যাঁ, এই কুঁড়ে ঘরটাতেই কাল রাতে শহীদের বাবা ঢুকেছিলেন। একটা ভুট্টাখেত পার হলেই ঘরটা। বেশ অনেকটা দূরে ঘন অন্ধকার গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ালো শহীদরা। দূরে কয়েকজন লোক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। ওটাই বোধ হয় এখানকার সড়ক। আজ জংলীরা সবাই অত্যন্ত ব্যস্ত। খুব বড় একটা ব্যাপার হবে আজ।

কামালদের প্রস্তুত থাকতে বলে শহীদ খুব সাবধানে ভুট্টাখেতের মধ্যে ঢুকে পড়লো। গফুর সাথে আসতে চাইলে ধমক দিয়ে তাকে থামিয়েছে শহীদ। সবাই দুরু দুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে রইলো গাছের তলে।

হামাগুড়ি দিয়ে ভুট্টাখেতটা পার হলো শহীদ। চারদিকে চেয়ে দেখলো, কেউ কোথাও নেই। সামনে হাত দশেক খালি জায়গা, তারপরই ঘরটা। আলোটা কমে এলো। শহীদ চেয়ে দেখলো একটা টুকরো মেঘ চাঁদকে আড়াল করেছে। নিঃশব্দে দুতিন লাফে শহীদ ঘরের পিছনে এসে দাঁড়ালো।

লম্বা কাঠ চেলা করে পাশাপাশি পুঁতে ঘরটা তৈরি করা হয়েছে। ওপরে খড়। বেশ মজবুত ঘরটা, কিন্তু কাঠের মধ্যে মধ্যে ফাঁক আছে। একটা ফাঁকে চোখ লাগিয়ে শহীদ দেখলো ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। খাটের ওপর শুয়ে আছেন তার-বাবা। কয়েকজন জংলী ঘরের মধ্যে মাটিতে বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে কি যেন কথা হচ্ছে।

শহীদের বাবা কি যেন বললেন ওদেরকে জংলী ভাষায়। সবাই বেরিয়ে গেল বাইরে।

লোকগুলো যখন অনেকদূর চলে গেল তখন শহীদ পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। ওকে চোরের মতো ঢুকতে দেখে ওর বাবা লাফিয়ে উঠে বসলেন বিছানায়। জংলী ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। শহীদ পরিষ্কার বাংলায় বললো, বাবা, আমি শহীদ, আপনার ছেলে!

স্তব্ধ হয়ে গেলেন ইসলাম খাঁ। তাঁর চোখ দুটোতে বিস্ময়। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? একী সম্ভব? নিশ্চয়ই স্বপ্ন।

আমার ছেলে, শহীদ? ইসলাম খাঁ ফিসফিস করে বললেন, I dont believe. আমি বিশ্বাস করি না। You are a beautiful dream, তুমি একটা মধুর স্বপ্ন!

শহীদের চোখে পানি ভরে উঠলো। দুঃখ আর করুণায় বিচলিত হলো অন্তর। বললো, বাবা… আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি আমি।

ইসলাম খানের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ-মুখ-শরীর কেঁপে ওঠে একটা প্রবল আবেগে। হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন তিনি। শহীদ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একেবারে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। চোখে অবিরল অশ্রুর স্রোত। মৃদু ফিসফিস স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! After seventeen years! God. আমার মােনাজাত তাহলে খোদা মঞ্জুর করেছেন।

শহীদ বললো, আমি একা না। কামাল আর আরও কয়েকজন এসেছে। ওদিকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তারা।

তুমি এখানে এলে কি করে, শহীদ?

সে অনেক কথা, বাবা। এখন তাড়াতাড়ি বলুন কি ভাবে আপনাকে নিয়ে সরে পড়া যায়। আমরা অনেক কষ্ট, অনেক পরিশ্রম করে এই পর্যন্ত এসেছি।

আজ এখানে চারজন লোককে কুমীরের কাছে বলি দেয়া হবে। আমাকেই নিজ হাতে দিতে হবে বলি। তারপর…

নদীর ধারে জংলীরা রাতের বেলা যায় না, তাই না? বাধা দিয়ে কাজের কথা বলে শহীদ।

না, যায় না। আমার সাথে মাত্র ছজন যাবে লোকগুলোকে পানিতে ফেলতে। আমরা…

ঠিক আছে। আমরা নদীর ধারে থাকবো। আপনি আমাদের কাছাকাছি এলেই আমরা গুলি করে দুজনকেই খতম করে দেবো। তারপর একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাবে, পালাবার। আমাদের লঞ্চ এখান থেকে মাইল চার-পাঁচেক দূরে নোঙর করা আছে। জলপথেই বোধহয় সুবিধা হবে যাওয়ার।

ছজনকে শেষ করতে পারো হয়তো, কিন্তু আরগুলো? এখানে প্রায় তিন হাজার লোক আছে। সবাই আসবে আজকের এই উৎসবে। এদের ঠেকাবে কি করে? এরা মরণকে ডরায় না।

এমনি সময় শোনা গেল কয়েকজন লোক কথা বলতে বলতে আসছে ওদের ঘরের দিকে। শহীদ দরজা দিয়ে বেরিয়ে কোথাও লুকোবার জন্যে চলে যাচ্ছিলো। ওর বাবা ওকে টেনে আনলেন। ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে, কথা বলো না।

দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বাটের দু ধার ধরে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর সাথে কি কি সব কথা বললেন। লোকগুলো খুব হাসলো, তিনিও হাসলেন। তারপর চলে গেল ওরা।

আধঘন্টার মধ্যেই আমাদের পূজা শুরু হবে। তোমরা এর মধ্যে চলে যাও নদীর পারে। আরেকটা কথা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলেছে। এখানকার লোকগুলো মহাপ্রলয় অর্থাৎ কেয়ামতকে ভীষণ ভয় পায়। ওদের বিশ্বাস একদিন একজন বিদেশী এসে ওদের দ্বারা নির্যাতিত হবে। সেই বিদেশীর অভিশাপে শুরু হবে মহাপ্রলয় আর তার ফলে এখানকার সব লোক মারা যাবে। আমি ওদের বলবো, যেন আঁচ করতে পারছি সেই মহাপ্রলয়ের বিদেশী এসেছে। এই-চারজনের মধ্যেই একজন হচ্ছে সেই বিদেশী। এদের বলি দেয়া চলবে না।

কিন্তু এই বললেই কি ওরা শুনবে?

না শোনাই তো ভালো। ঠিকই ওরা শুনবে না। অনেকে আমার কথা বিশ্বাস করবে, অনেকে করবে না। অবিশ্বাসীরাই সংখ্যায় বেশি হবে। তারা আমাকে বলবে আমার কাজ চালিয়ে যেতে। আমি ওদের কথামত মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে লোকগুলোকে নদীর ধারে নিয়ে যাবো। ঠিক সেই সময় যদি কথা নেই বার্তা নেই রাইফেলের গুলি ছোঁড়া শুরু হয়, তাহলে কারও মনে তিলমাত্র সন্দেহ থাকবে না যে কেয়ামত শুরু হয়েছে। যে যেদিক পারে পালাবে। তখন আমাদের সরে পড়ার খুব সুবিধা হবে।

খুব ভালো বুদ্ধি হয়েছে। আমরা যেই গুলি করবো অমনি আপনি বন্দীদের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেবেন। আমি এখন যাই।

শহীদ বাইরে বেরিয়ে এলো। এদিককার কাজ হয়ে গেছে। এবার ওদিকটা ঠিক রাখতে হবে। ভুট্টাখেতের দিকে কয়েক পা এগিয়েছে শহীদ, হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন সাপটে ধরলো তাকে। অত্যন্ত কষে ধরেছে সে। ভীষণ বলশালী হাতের পেশী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোতেও। পিছন থেকে চাপা গলায় শব্দ এলো, Now Shahid?

কিন্তু বেচারা শহীদকে চিনতো না। এক মুহুর্তের মধ্যে যুযুৎসুর এক পাঁচে পিছনের লোক সামনে চলে এলো। তারপরেই প্রচণ্ড এক লাথি তলপেটে। একটু কুঁজো হয়েছে অমনি তলপেটে আবার হাঁটু দিয়ে প্রচণ্ড এক গুতো। কোঁক করে পড়ে গেল লোকটা মাটিতে। কাছেই একটা শব্দ হলো। শহীদ চেয়ে দেখলো তার পাশে দাঁড়িয়ে মি. ব্লাইদ আরেকজনের তলপেটে হাঁটুর ভীষণ এক তো লাগলো। সেও নিঃশব্দে ঝুপ করে পাটিতে পড়লো। মি. রাইদ বললো, dead.

শহীদ বললো, আমারটাও dead; কিন্তু ইংরেজি ছেড়ে এখন বাংলা বলো তো, কুয়াশা। চলো আগে এগুলোকে টেনে ভুট্টাখেতের মধ্যে ফেলে দিই।

দুজনে জংলী দুটোকে টেনে ভুট্টাখেতের বেশ ভিতরে এনে রেখে দিলো। শহীদ লক্ষ্য করলে তাকে যে ধরেছিল, সে হচ্ছে সেই লম্বা সর্দার। যাক, আর কোনদিন সর্দারী করতে হবে না তাকে, এতক্ষণে আর এক দুনিয়ায় চলে গেছে সে।

তুমি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালে কখন? শহীদ জিজ্ঞেস করে।

ওই ব্যাটা তোমার মাথায় মারবার জন্যে মুগুর উঠিয়েছিল, তাই চট করে ধরলাম গিয়ে! কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কি করে?

তুমি এমন হাজারটা তাগড়াই মােচ লাগাও না কেন, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িও বেশ সুন্দর করে লাগিয়েছ, কিন্তু এমন সুন্দর চোখ দুটো কোথায় লুকোবে বলো তো বন্ধু?

তাহলে বলো আগেই চিনতে পেরেছে। আমাকে?

লরেঞ্জো মারকুইসে যেদিন প্রথম তোমার লঞ্চে উঠেছি, সেদিনই চিনেছি।

তাই তো, চোখ দুটোর জন্যে কিছু বের করতে হয় তো এবার! আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি অথচ তোমরা চিনতে পারছে না, এ ভেবে আমি কতো আনন্দই না পেয়েছি, অথচ…! ছিঃ!

হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে ওরা। কিছুদূর এসে কুয়াশা বললো, তুমি যাও, আমি আমার সরোদটা নিয়ে আসি।

কিন্তু তোমাকে যে আমার খুব দরকার, বন্ধু। আমরা আজই বাবাকে নিয়ে যেতে চাই। তারই কথাবার্তা হলো এখন। ওরা যখন কুফুয়ার ছেলেদের খালে ফেলতে যাবে তখনই আমরা গুলি ছোঁড়া শুরু করবো।

বেশ। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আমার সরোদটা নিয়ে আসি। কাছেই লুকিয়ে রেখেছি ওটা ভুট্টাখেতের মধ্যে।

ওটা থাক না এখন। আনতে গেলে দেরি হবে। আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে।

আচ্ছা চলো।

মি. রাইদকে দেখেই কামাল শহীদকে বললো, এই ব্যাটাকে আবার কোথেকে পেলি, শহীদ? হঠাৎ উড়ে এসে হাজির!

আমি কুয়াশা, কামাল। কুয়াশা হেসে বলে।

আঁ! কি বললেন? আপনি কুয়াশা? কুফুয়াদের ওখানে নিগ্রো সেজে ছিলেন, এখন দেখছি দিব্যি সাহেব।

তোমাকে কিন্তু মি. ব্লাইদের মতো লাগছে দাদা, মহুয়া বলে।

শহীদ হেসে ফেললো, ও-ই তো ব্লাইদ। এতদিন ছদ্মবেশে আমাদের লঞ্চ চালিয়েছে।

কামাল আর মহুয়া হেসে উঠলো। গফুর ভীষণ লজ্জা পেলো, এতদিন সাহেবকে বাংলায় যা-তা কথা বলেছে মনে করে।

আর দেরি করো না, চলো, খালের ধার এখনও অনেকখানি দূর। কুয়াশা চলতে শুরু করে।

খালের ধারের বিরাট ঝুপড়ীওয়ালা গাছটার নিচে দাঁড়ালো গিয়ে শহীদরা। গাছটার তলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। আত্মগোপন করে থাকবার পক্ষে এই জায়গাটাই সবচাইতে ভালো।

সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মন্দিরের সামনের মাঠের সবটুকু। অসংখ্য নারীপুরুষ সমবেত হয়েছে সেই মাঠে। ভীষণ হৈ-চৈ। কয়েকটা ঢাকের আওয়াজে কানে তালা লাগবার উপক্রম।

কামাল বললো, পল্টন ময়দানে ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনতেও এতো লোক হয় না।

ওদের একটু তাড়াতাড়ি করতে বলো না, রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে, মহুয়া বলে। সবাই একটু হাসে। শহীদ হাতঘড়ির দিকে তাকায়। আড়াইটা।

হঠাৎ গোলমাল থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সমস্ত মাঠটায় অখণ্ড নীবরতা থমথম করতে লাগলো। এতগুলো লোক একখানে, কিন্তু একটু শব্দ নেই। চার-পাঁচজন পরপরই একজনের হাতে একটা করে মশাল জ্বলছে। তার আলোতে থমথমে মুখগুলো ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে।

একটু পরেই উচু একটা পাথরের ওপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে উঠে দাঁড়ালেন ইসলাম খাঁ। সাদা আলখাল্লা পরেছেন তিনি। বন্দীদেরও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাথরের ওপর এনে রাখা হলো।

এবার ইসলাম খা চিৎকার করে কি যেন বললেন। সবাই হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর একটা গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য ভ্রমর উড়ে বেড়াচ্ছে আশপাশে। গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ শুনে কেমন যেন ভয় ভয় করে। কোনো এক অদৃশ্য মহাশক্তির সামনে মাথা নত হয়ে আসে।

থেমে গেল মন্ত্রোচ্চারণ। চারদিক নিস্তব্ধ। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো সবাই। এবারইসলাম খাঁ মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। কয়েকজন জংলী পাথরের ওপর উঠে এসে বন্দীদের পায়ের বাঁধন খুলে দাঁড় করালো। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করলেন ইসলাম খাঁ। মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে নানারকম কিম্ভুতকিমাকার অঙ্গভঙ্গি করলেন তিনি। তাই দেখে মহুয়া তো হেসেই খুন।

মন্ত্রপাঠ শেষ করে বাটি থেকে কি একটা জিনিস তুলে বন্দীদের কপালে মাখিয়ে দিলেন তিনি।

হঠাৎ অত্যন্ত কাঁপা শুরু করলেন তিনি। থরথর করে সমস্ত শরীর কাঁপছে। কপালের দুধারের রগ টিপে ধরেন ইসলাম খাঁ। ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে তাঁকে। কয়েজন জংলী এগিয়ে এসে তাঁকে ধরলো।

ময়দানের সবাই অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলো দেখা যাচ্ছে। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। কামাল উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, কি হলো চাচাজানের? শরীর খারাপ নাকি?

শহীদ হাসলো। বললো, অভিনয় শুরু হয়েছে। বুড়োর রস তো কম না।

কিসের অভিনয়?

পরে শুনিস। এখন কেবল দেখে যা। কাঁপতে কাঁপতে পাথরের ওপর বসে পড়লেন ইসলাম খাঁ।

এবার মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সবার মুখেই এক প্রশ্ন, কি হলো?

আবার উঠে দাঁড়ালেন ইসলাম খাঁ। হাত উঁচু করে থামতে ইঙ্গিত করলেন। সবাই চুপ হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ওদের কি কি সব বললেন।

ময়দানের সব লোককে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা গেল। ওরা নিজেদের মধ্যে কি কি বলাবলি করতে লাগলো। ক্রমে ভীষণ কলরব। কারও কথা কেউ শুনতে পায় না, সবাই কথা বলতে চায়।

আবার হাত ওঠান ইসলাম খাঁ। সবাই থেমে যায়। আবার কিছুক্ষণ কথা বলেন তিনি। এবার জন-পনেরো লোক এগিয়ে আসে তাঁর দিকে। বোধহয় এরাই মােড়ল এখানকার। কিছুক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে কথা বললো, তারপর ইসলাম খাঁকে কি যেন বললো। তিনি হাত নেড়ে ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে এলেন বন্দীদের কাছে। তিনি তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বোধকরি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন জোরে জোরে। সকালের মৃতদেহ দুটোও পাথরের ওপর নিয়ে আসা হলো। তিন-চারজন জংলী জল নিয়ে এলো কুঁজো করে। তারপর মৃতদেহ দুটোকে স্নান করালো সেই পাথরের ওপরই উলঙ্গ করে। তাদের কপালেওঁ সেই বাটি থেকে কি যেন নিয়ে মাখিয়ে দিলেন ইসলাম খাঁ।

তারপরই শুরু হলো ঢাক আর হট্টগোল। ওরা এগিয়ে আসছে। পাথর থেকে নেমে ইসলাম খাঁ খালের দিকে চলতে লাগলেন খুব ধীরে ধীরে। ছজন জোয়ান লোক বন্দী চারজন আর লাশ দুটোকে কাঁধে তুলে নিয়ে তার পিছন পিছন চলছে। আর বাকি সবাই কিছুটা দূরত্ব রেখে পিছন পিছন ভীষণ হৈ-হল্লা করতে করতে আসছে। কাছে এসে পড়েছে ওরা। খাল থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে এসে পিছনের জনতা থেমে গেছে। জংলীরা সব পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বুকের ভিতরটা টিপ টিপ করছে মহুয়ার। এখনি একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে। ফলাফল কি হবে তা এখনও অনিশ্চিত। হয়তো ওরা জংলীদের হাতে ধরা পড়বে। হয়তো বা পালিয়ে যেতে পারবে। চোখের সামনে দেখছে সে, শহীদের বাবা এগিয়ে আসছেন। চারদিকে সব চুপ। এই নিস্তব্ধতা সময়টাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। বড়ো আস্ত হাঁটছেন শহীদের বাবা। সময় যেন এগোতেই চাইছে না। শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে শিরশির করে ঠাণ্ডা একটা কিসের স্রোত অনুভব করে মহুয়া।

সবাই প্রস্তুত? শহীদ প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। প্রস্তুত। স্থির দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে থাকে কুয়াশা।

সকলেই উত্তেজনায় অল্প অল্প কাঁপছে। কামাল আর গফুরের কপাল ঘামতে শুরু করলো। শুধু পাথরের মতো নিল দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা আর শহীদ। অদ্ভুত এদের স্নায়ুর শক্তি। কোনো চাঞ্চল্য নেই।

আমি, কুয়াশা আর কামাল গুলি করবো। গফুর, তুই হাতবোমা নিয়ে তৈরি থাক। আমাদের গুলির পরই ছুঁড়বি।

এগিয়ে আসছেন ইসলাম খাঁ। সাঁকোটার ওপর গিয়ে জলে ফেলে দেয়া হবে মৃতদেহ আর বন্দীদের। সবাই চুপ করে অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

ইসলাম খাঁ অর্ধেক পথ এসেছেন, অমনি তিনটা রাইফেল একসাথে গর্জন করে উঠলো। তিনজন বাহক তৎক্ষণাৎ পড়ে গেল মাটিতে। আবার গর্জন করে উঠলো। রাইফেল। বাকি তিনজনও। শহীদের বাবা বসে পড়লেন বন্দীদের বাঁধন খুলবার জন্যে ।

এদিকে জংলীরা ভড়কে গেল। সত্যিই কি তাহলে মহাপ্রলয় শুরু হলো? এমন তো আর কখনো হয়নি।

এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে তাদের সামনের কয়েকজনের ওপর হাতবোমা পড়লো। সামনের লোকগুলো আর্তনাদ করে পড়ে গেল মাটিতে। কেউ কেউ আহত না হয়েও ভয়েই চিৎকার করছে আর মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।

ব্যাস, আর সন্দেহ নেই। মহাপ্রলয় এসে গেল। চারদিকে ভীষণ চিৎকার। মেয়েরাই চিৎকার করছে বেশি। যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করলো এবার প্রাণভয়ে।

আবার বোমা পড়লো, আবার পড়লো। সেই সাথে তিন তিনটা রাইফেল সমানে চলছে। প্রচণ্ড শব্দ, আহতদের আর্তনাদ। সবাই প্রাণপণে ছোটে।

দুমিনিটের মধ্যেই আহত আর মৃতদেহ ছাড়া জনপ্রাণীর চিহ্ন রইলো না সেখানে। দুএকজন আহত জংলী হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করছে।

বাঁধন খোলা হয়ে গেছে। শহীদের বাবা কুফুয়ার চার ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে আসছে শহীদদের দিকে। কিন্তু এখন পালাবার উপায় কি? কুয়াশা ছুটে গিয়ে নদীর ধারটা দেখে এলো। একটা নৌকাও নেই।

ইসলাম খাঁ বললো, এখানকার সব নৌকা আরও উত্তরে হ্রদের কাছে থাকে, এখানে তো একটাও পাওয়া যাবে না।

সর্বনাশ! শহীদের মাথায় যেন বাজ পড়লো। নৌকার আশায়ই সে এতো কিছু করছে। এখন উপায়? পালাবে কোন পথে? আবার এতো ঘুরে পাহাড়ের কাছ দিয়ে? অসম্ভব! ঠিক ধরা পড়ে যাবে জংলীদের হাতে।

আর হাতবোমা নেই? কুয়াশা জিজ্ঞেস করলো।

আর মাত্র একটা আছে। রাইফেলের গুলিও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। শহীদ বলে।

দাও তো আমার কাছে ওটা।

বোমা নিয়ে কুয়াশা এগিয়ে গেল গাছের সারির কাছে। তারপর ছুঁড়ে মারলো একটা গাছের গোড়া লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড আওয়াজে ফাটলো বোমা। ধুয়া সরে গেলে শহীদরা কাছে গিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে দেখলো দুটো গাছের গোড়ার দিকটা অনেকখানি গর্ত হয়ে কেটে গেছে। কিন্তু কিছুটা এখনও লেগে রয়েছে। গাছ দুটো ওদের দিকে একটু হেলে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার উপায়? একমাত্র সম্বল শেষ বোমাটাও গেল। কামাল বলে।

গাছ প্রায় কেটে গেছে। এখন গোটা কতক রাইফেলের গুলি লাগলেই পড়ে যাবে।

শহীদ, কুয়াশা আর গফুর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গুলি ছোঁড়া শুরু করলো। গোটা পঁচিশেক গুলি লাগতেই মড়মড় করে ভেঙে পড়লো একটা গাছ।

সবাই একে একে টপকে বেরিয়ে এলো জংলী এলাকা থেকে। ইসলাম খাঁ অত্যন্ত দুর্বল। শহীদ আর কুয়াশা তাঁকে হাত ধরে পার করে আনলো।

এবার যতো শিগগির সম্ভব লঞ্চে গিয়ে উঠতে হবে। শহীদ বলে। কিছুক্ষণ পরই যখন জংলীরা বুঝতে পারবে মহা-প্রলয়ে ওরা সবাই মরেনি, তখন আবার সাহস করে ফিরে আসবে এখানে। তখন আহতদের কাছ থেকে শুনবে আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা।

ওদের বৃক্ষ-প্রাচীরও দেখবে ভাঙ্গা। তখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়া করবে আমাদের, এই তো! কামাল বললো।

হ্যা। তার আগেই আমাদের পালিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি চলো সবাই।

কিন্তু ইসলাম খাঁ অসুস্থ। তিনি হাঁটতে পারছেন না। শহীদ কুফুয়ার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাদের দুজন কি আমার বাবাকে কাঁধে করে নিতে পারবে? আমরা খুবই ক্লান্ত, নইলে আমরাই নিতাম!

ওরা সকলেই সাগ্রহে এগিয়ে এলো। বড় ভাইটা হঠাৎ শহীদের দুই হাত ধরে ফেললো। মিনতি করে বললো, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন, মি. শহীদ, আমরা। এখানে এসেছিলাম আপনাদের খুন করে সাত হাজার পাউণ্ডের চেকটা কেড়ে নিতে। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের এখানে দেখে একথা বুঝতে পেরেছিলেন। তবু আপনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমরা এ ঋণ শোধ করতে পারবো না। আপনি জানেন না, নিগ্রোদের মধ্যে কেউ যদি কারও প্রাণ বাঁচায়, তবে সারাজীবন সে তার কেনা গোলাম হয়ে থাকে। নিগ্রো জাত কোনদিন কৃতঘ্নতা করে না। বলুন, আপনি ক্ষমা করেছেন, মি, শহীদ।

তোমাদের প্রাণ বাঁচানো আমার কর্তব্য ছিলো। তোমার বাবা আমাকে মস্ত বড় বিপদ থেকে কয়েকবার রক্ষা করেছেন। তাঁর কাছে আমি ঋণী ছিলাম।

তার কাছে, আমাদের কাছে নয়। তিনি আমাদের ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।

তোমরা যদি এখন থেকে আমাদের সঙ্গে ভালো হয়ে চলো, কোনও রকম চালাকির চেষ্টা না করো, তো তোমার বাবাকে বলে আমি তাঁর মত বদলাবার চেষ্টা করবো। তিনি আমার কথা শুনবেন, আমার যতদূর বিশ্বাস। আর আমিও তোমাদের ক্ষমা করবো।

আপনি আর আমাদের অবিশ্বাস করবেন না, মি. শহীদ। আর কোনও অসদুদ্দেশ্য নেই আমাদের।

শহীদের বাবাকে ওরা দুজন পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো, তারপর যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চলা শুরু করলো। দুদিনের অনবরত পরিশ্রম আর মানসিক উৎকণ্ঠায় মহুয়ার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। সে শহীদের কাঁধে ভর করে চলেছে।

সব মিলিয়ে তাদের চলাটা বড় ধীরে হচ্ছে। অথচ অনেক দ্রুত চলা দরকার। নদীর ঘাট এখনও বহুদূর।

শহীদ কি একটা কথা বলতে কুয়াশাকে খুঁজলো। চারিদিক চেয়ে দেখলো সকলের অজান্তে কখন জানি কুয়াশা অদৃশ্য হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে। শহীদ ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে।
ভোর পাঁচটা। অন্ধকার দ্রুত পরিষ্কার হয়ে আসছে। জংলী এলাকা থেকে প্রচণ্ড গোলমাল শোনা যাচ্ছে। অথচ শহীদরা এখনও পৌঁছতে পারলো না লঞ্চে। আরও আধ মাইল পথ যেতে হবে। পথে অনেকবার থামতে হয়েছে তাদের। শহীদের বাবা ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পরই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। মহুয়াকে শহীদ আর গফুর তুলে নিয়েছে পাঁজাকোলা করে। এই পথটুকু চলতে হলে ও ঠিক মরে যেতে।

হঠাৎ ঢাক বেজে উঠলো প্রচণ্ড শব্দে। অনেক লোকের হৈ-হল্লাও শোনা গেল। এটা ওদের যুদ্ধ ঘোষণার ঢাক। ইসলাম খাঁ বললেন।

তার মানে ওরা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে? কামাল জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ। ওরা সবাই যুদ্ধ-সাজে সেজে রওনা দিয়েছে। এখানে পৌঁছতে ওদের পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না।

দেড় ঘন্টার পথ পনেরো মিনিটে আসবে কি করে?

দেড় ঘন্টার পথ আমাদের কাছে। ইসলাম খাঁ হাসলেন। ওদের কাছে এটা পনেরো মিনিটের পথ! ওরা ঘন্টায় দশ-পনেরো মাইল চলতে পারে গভীর বনের মধ্যে দিয়েও।

তার মানে আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা ধরা পড়ছি? আমাদের আর গুলিও তো নেই বেশি। ঠেকাবো কি করে ওদের? কামাল হতাশ হয়ে পড়ে।

সবাই জোরে পা চালাও। শহীদ হুকুম দেয়।

প্রায় দৌড়ের মতো করে চলেছে ওরা। বাঁচতেই হবে তাদের। কোনও মতে লঞ্চে পৌঁছতে পারলে হয়। সমস্ত শক্তি একত্র করে সবাই প্রাণপণ ছুটছে। কিন্তু সমান গতিতে চলা যাচ্ছে না! পথের মাঝে প্রায়ই মােটা ডাল কিংবা আস্ত গাছ কালকের ঝড়ে ভেঙে পড়ে আছে।

থাম, থাম, আর পারি না। চিৎকার করে উঠেন ইসলাম খাঁ। ভীষণ হাঁপাচ্ছেন তিনি।

দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। কিন্তু বিশ্রাম করবার সময় নেই। অথচ ইসলাম খাঁ আর সহ্য কতে পারছেন না। সবাই প্রমাদ গুণলো। শেষকালে তীরে এসে তরী ডুববে?

আমাকে ফেলে রেখে তোমরা চলে যাও। আমাকে ওরা মারবে না, তোমাদের মারবে। আমার জন্যে তোমাদের সবাইকে আমি মৃত্যু বরণ করতে দেবো না। ইসলাম খাঁ নামার চেষ্টা করেন। এদিকে ঢাকের শব্দ ক্রমেই এগিয়ে আসছে। অনেক ঢাক একসাথে বাজছে। লোকজনের চিৎকার একেবারে কাছে এসে পড়েছে।

আধাে আলো আধাে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে শহীদরা আবার ছুটলো। আর অপেক্ষা করা যায় না। ঢাকের শব্দ যেভাবে এগিয়ে আসছে, আর বেশিক্ষণ লাগবে না তাদের ধরতে।

প্রাণপণে ছোটো সবাই। কেউ থামবে না। শহীদ চিৎকার করে বলে।

সবাই ছুটছে। খুব কাছে এসে পড়েছে ঢাকের শব্দ। হৈ-হল্লা আর পায়ের শব্দ শুনে বোঝা গেল, কম হলেও হাজার দুয়েক লোক হবে ওরা।

ওই তো নদীর ঘাট দেখা যায়। হ্যাঁ, এসে পড়েছে তারা। পিছনে জংলীরাও প্রায় এসে পড়েছে। ঢাকের শব্দে আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। ইসলাম খাঁ প্রাণপণে চিৎকার করছেন, থামাে, থামো আমাকে ফেলে রেখে যাও। বড় কষ্ট পাচ্ছি…

কিন্তু কেউ তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছে না। সমানে দৌড়ে চলেছে। কামাল সবচাইতে আগে আগে চলছে।

শহীদের মনে মনে একটা ভয় ছিলো। কালকের সাইক্লোনে যদি লঞ্চ ভেসে চলে, গিয়ে থাকে তাহলে সর্বনাশ হবে। নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখা গেল মােটা গাছের সাথে বাঁধা লঞ্চ ঠিক তেমনিই রয়েছে।

লাফিয়ে সবাই লঞ্চে উঠলো। জংলীরা এসে পড়েছে, কিন্তু আর ভয় নেই। জলে কেউ নামতে সাহস পাবে না। কামাল গাছের সাথে বাঁধা দড়িটা খুলে লঞ্চে উঠেই স্টার্ট দিলো।

ঘাট থেকে বেশ অনেকটা দূরে লঞ্চ সরিয়ে সবাই একটা হাঁফ ছাড়লো। অদ্ভুত একটা স্বস্তি। কিন্তু একটা কথা একসাথে সবার মনে পড়লো। কুয়াশা? কুয়াশা কই?

কামাল নোঙর ফেলে দিলো। কুয়াশা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

দি দিড়িম, দি দিড়িম ঢাক বাজছে। ওরা একেবারে কাছে এসে পড়েছে।

ঠিক এমন সময় ভীষণ বেগে নদীর ঘাটের দিকে ছুটে আসছে কে? কুয়াশা না? সেই তো! মহুয়া চিৎকার করে উঠলো, দাদা!

বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এলো সে। পাড়ে এসেই থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। পিছনে চেয়ে দেখলে পঁচিশ গজ দূরেই দেখা যাচ্ছে অর্ধ-উলঙ্গ কৃষ্ণ মূর্তি। এক হাতে ঢাল আর এক হাতে তীক্ষ্ণ বর্শা নিয়ে ছুটে আসছে এই দিকে। আর চিন্তা করবারও সময় নেই। সেই অবস্থায় লঞ্চ ঘাটে আসতে পারে না।

তরতর করে একটা মস্তবড় গাছে উঠে গেল কুয়াশা। জংলীরা এসে দাঁড়িয়েছে পাড়ে। ওরা দেখলো শহীদদের ধরা অসম্ভব। কিন্তু কুয়াশাকে তারা দেখেছে। সে পালিয়ে যাবে কোথায়? মহুয়া অস্থির হয়ে উঠলো।

দু-তিনজন লোক গাছের তলায় ঢাল রেখে কেবল বর্শাটা হাতে নিয়ে গাছে উঠে আসতে লাগলো। বেশ অনেকদূর এসেছে এমন সময় গাছের ওপর থেকে গুলি করলো কুয়াশা। প্রথম জন গুলি খেয়ে চিৎকার করে গাছ থেকে পড়ে গেল। দ্বিতীয় জন একটু থমকে থেকে আবার ওঠা শুরু করলো। আবার গুলি করে কুয়াশা। সেও পড়লো, মাটিতে।

শহীদ ভাবছে ওরা বুঝি ভয় পেয়ে গাছে ওঠা বন্ধ করবে। কিন্তু না, আরও অনেক লোক গাছের নিচে ঢাল রেখে উঠে আসতে লাগলো। ক্ষেপে গেছে ওরা। কুয়াশাকে তাদের চাই-ই। ধর্ম ছাড়া আর কিছুকে ভয় পায় না ওরা।

কুয়াশা গুলি করে চলেছে। হঠাৎ রাইফেলটা ক্লিক করলো। গুলি বেরোলো না। ফুরিয়ে গেছে গুলি। পকেট হাতড়ায় সে। না, নেই আর।

রাইফেলটা ছুঁড়ে মারে সে একজনের মাথায়।

কিন্তু তারপর? এবার উপায় কি? উঠে আসছে হিংস্র জংলীরা একজনের পর একজন। রাইফেল তুলে নিলো শহীদ। একজন পড়ে গেল গাছ থেকে আর্তনাদ করে। আবার একজন। আবার একজন।

ওরা চেয়ে দেখলো শহীদ গুলি করছে। এবার ওরা লঞ্চের দিকটা গাছ দিয়ে আড়াল করে উঠতে লাগলো।

আর উপায় নেই, গুলি লাগছে না ওদের গায়ে। উঠে আসছে ওরা ক্রমেই।

কুয়াশাও উপরে উঠছে। গাছের মগডালে উঠে গেল কুয়াশা। আর বাঁচবার কোনও উপায় নেই।

ওকি? লাফিয়ে পড়বে নাকি? কুয়াশা দাঁড়িয়ে উঠে ওপরের ডালটা দোলাচ্ছে। এতদূর লাফিয়ে আসা কি সম্ভব? তবু শেষ চেষ্টা করবে কুয়াশা। খুব জোরে একটা দোলা দিয়ে শূন্যে উঠে গেল সে।

লঞ্চ থেকে হাত পাঁচেক দূরে জলের মধ্যে পড়লো কুয়াশা। পরিষ্কার জল। অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। লঞ্চ থেকে সবাই দেখলো সাত-আটটা মস্ত বড় কুমীর কিলবিল করে উঠলো কুয়াশার আশেপাশে। অনেকখানি জল লাল হয়ে গেল । রক্তের রঙ। পিঠে বাঁধা সরোদের চকচকে দিকটা দেখা গেল ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে নিচে। মহুয়া চিৎকার করে উঠলো, মাগো!

ইসলাম খাঁ ওর পরিচয় আগা-গোড়া কিছুই জানেন না। বললেন, ব্যাটা আহাম্মক একটা। কে লোকটা, ড্রাইভার না?

কেউ কোনো উত্তর দেয় না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত