সবুজ বনের ভয়ংকর-কিয়াংয়ের আবির্ভাব

সবুজ বনের ভয়ংকর-কিয়াংয়ের আবির্ভাব

অচল মোটরবোটটা হয়ে উঠেছে আমাদের উদ্ধারের আশায় প্রতীক। অথচ বুঝতে পারছিলুম, প্রিয়বর্ধন যত পাকা মিস্তিরির ভান করুক, ওটা সচল করার মতো জ্ঞানবুদ্ধি ওর নেই। তবু সময়টা বেশ কেটে যায় আশায় আশায়। প্রিয়বর্ধন নানা ভঙ্গিতে চিত-উপুড়-কাত হয়ে কিংবা হাঁটু দুমড়ে গম্ভীরমুখে খুটখাট করে এবং কোনও এক জলদস্যু কাপ্তেন রোজারিও, তার পর্তুগিজ বউ আর ছেলে এনজেলোর গল্প শোনায়। রোজারিও নাকি তার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এই দ্বীপে বাস করতে এসেছিল। সঙ্গে ছিল সারাজীবনের লুণ্ঠিত ধনরত্ন। কিন্তু ওর চেলারা কীভাবে খোঁজ পেয়ে সারারাত এখানে হানা দেয়। ওদের হত্যা করে। তারপর নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিজেরাও খুন হয়ে যায়।

এই কাহিনী শুনে আমার মনে হচ্ছিল, কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদ রহস্যের কিছুটা যেন আঁচ করতে পেরেছি। খুব উত্তেজনার সময় মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়, দ্বীপের গাছপালার কোষে কোষে যেন তা সাড়া তুলতে সমর্থ। সেই উত্তেজনার সময়কার সব কথাবার্তা তাই রেকর্ড হয়ে যায় কোষগুলিতে। তারপর সম্ভবত আবহাওয়ার তাপমাত্রার হেরফের ঘটলে সেটাই হয়ে ওঠে রেকর্ডগুলি বেজে ওঠার কারণ। লক্ষ্য করেছি, স্টপ ইট চিৎকার নির্দিষ্ট সময় অন্তর বেজে ওঠে না। বেজে ওঠে হঠাৎই। কাজেই আবহাওয়ার হেরফেরের মধ্যেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে।

মানুষের চিন্তাতরঙ্গের চাপ যে উদ্ভিদের ভেতরও সাড়া জাগায়, তা আধুনিক বিজ্ঞানীরা তো প্রমাণ করেছেনই। কর্নেলের কাছে মার্কিন বিজ্ঞানী ক্লি ব্যাকস্টারের গবেষণার কথা শুনেছিলুম। ব্যাকস্টার প্রথমে ছিলেন অপরাধ-বিজ্ঞানী এবং লাই-ডিটেকটর পরীক্ষক। 1966 সালে একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে গাছের সাহায্যে হত্যাকারীকে ধরে ফেলেন। ব্যাকস্টার গ্যালভানোমিটার যন্ত্র সেই গাছের সঙ্গে যুক্ত করে সন্দেহযোগ্য লোকদের একে একে যন্ত্রটার সামনে দাঁড় করান। তারপর একটা লোক সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকস্টার দেখলেন, গ্যালভানো মিটারের সংকেত কাঁটা প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। অর্থাৎ সেই গাছটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সেই লোকটাকেই এই গাছটা খুন করতে দেখেছিল। পরে সে সব স্বীকার করে। তারপর জগতে সাড়া পড়ে যায়।

প্রিয়বর্ধনকে কিওটা দ্বীপের গাছপালার রহস্য বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। প্রাণের বিবর্তনের একটা স্তরে যখন উদ্ভিদ আর প্রাণী পৃথক হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত তখনই প্রকৃতির কী খেয়ালে এই দ্বীপে মাঝামাঝি একটা প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল, যারা প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই-ই! তাই তারা স্বাভাবিক উদ্ভিদের চেয়ে বেশিমাত্রায় চেতনাসম্পন্ন। তাদের বোধশক্তি প্রাণীদের মতোই, অথচ তাদের দেহ উদ্ভিদের মতো। আবার কোনও কোনও উদ্ভিদ প্রাণীদের মতোই চলাফেরা করতেও সমর্থ। যেমন ওই অদ্ভুত ক্যাকটাসগুলো—যারা ক্যারিবো, উংচু আর ফুতাংকে ধরে নিয়ে গেছে।

তিনদিন ধরে আমরা সারা দ্বীপ তন্নতন্ন খুঁজেও হতভাগ্য লোক তিনটিকে দেখতে পাইনি। কখনও মাকড়সা ক্যাকটাসগুলোকে একলা বা দলবেঁধে ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু সাহস করে কাছে গেলেই তারা ঝটপট একগুচ্ছের শিকড় মাটিতে ঢুকিয়ে বকধার্মিক সেজে দাঁড়িয়ে থেকেছে—যেন কিছু জানে না। ক্যাকটাস না ক্যাকটাস। প্রিয়বর্ধন দাঁত মুখ খিচিয়ে বলেছে, ন্যাকা! কোথায় গুম করেছ বদমাশগুলোকে, বলো শিগগির! নইলে ঘ্যাচাং করে গোড়াটা কেটে ফেলব।

মাকড়সা-ক্যাকটাস নিশ্চয় বুঝতে পারে, প্রিয়বর্ধনের যত তড়পানি. শুধু মুখেই। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আজ সকালে ভারি মজা হয়েছিল। যেই প্রিবর্ধন বকাবকি করতে গেছে, একটা মাকড়সা ক্যাকটাস আচমকা একটা শুড় বের করে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। আর বেচারার সে কী ত্রাহি চিৎকার! শেষে আমি অনেক তোষামোেদ অনেক কাকুতিমিনতি করলুম। তখন খুঁড়টা খসে গিয়ে ছোট হতে হতে স্প্রিংয়ের মতো গুটিয়ে মাকড়সা-ক্যাকটাসটার ভেতর লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধন ল্যাজ তুলে দৌড়ে ক্যাম্পে চলে গেল। সেই থেকে আর নড়তেও চায় না। আবার মোটরবোটটা নিয়ে খুটখাট করে যাচ্ছে।

এদিকে ক্যারিবোদের আনা খাবারদাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা একবেলা গাছের ফলে বা বলয়সাগরের মাছ ধরে খিদে মেটাচ্ছি। অবশ্য খিদেয় মারা পড়ার আশঙ্কা নেই। দ্বীপে অসংখ্য ফলের গাছ আছে এবং অনেক গাছই দয়ালুদাতা।

আরেকটা কাজ দুজনে নিয়মিত করে যাচ্ছি। তা হল রেডিও ট্রান্সমিশন যন্ত্রের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে মেসেজ পাঠানো। কোনও কোনও কেন্দ্রে মেসেজ গণ্ডগোল ঘটাচ্ছে। দু পক্ষের কথাবার্তা জড়িয়ে-মুড়িয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটা বিকট ঘড়ঘড় শব্দ তুলছে। বিগড়ে যাওয়ার ভয়ে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কখনও দৈবাৎ কোনও কেন্দ্রে যদি আমাদের মেসেজ ধরা পড়ছে, কড়া ধমক অথবা ঠাট্টাতামাশা করা হচ্ছে। কিওটা নামে দ্বীপটা সরকারি মতে রূপকথা। এটাই হয়েছে সমস্যা। রুবি আইল্যান্ডে নৌবাহিনীর বেতারকেন্দ্র যদি দৈবাৎ ধরতে পারি, আমাদের আশা আছে তারা আমাদের মেসেজকে উড়িয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু কিছুতেই ওই কেন্দ্র ধরতে পারি না।

একদিন দুপুরে বহুদূরে একটা হেলিকপ্টারকে উড়তে দেখলুম। দুজনে আনন্দ নেচে উঠলুম। নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলুম ওটার দিকে। কিন্তু নচ্ছার হেলিকপ্টারটা দূর দিয়েই চলে গেল। প্রিয়বর্ধন রেগে গাল দিতে শুরু করল। ওকে বুঝিয়ে বললুম, ভেবে দেখ প্রিবর্ধন, কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় হাজার-হাজার এমন দ্বীপ আছে। কোন দ্বীপটা যে কিওটা, সেটা খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজা একই কথা। ধৈর্য ধরো। ওই হেলিকপ্টার আবার হয়তো আসবে এবং এই দ্বীপের ওপর দিয়েও উড়ে যাবে। তখন আমাদের দেখতে পাবে।

এরপর আমরা ঠিক করলুম, হেলিকপ্টারের শব্দ পেলেই আমরা শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাব। ধোঁয়ায় আকৃষ্ট হয়ে এদিকে ওদের চোখ পড়বেই।

কিন্তু আরও দুদিন কেটে গেল বৃথা। হেলিকপ্টারটা আর এমুখখা হল না।

তিনদিনের দিন দক্ষিণের বনভূমি পেরিয়ে খাড়ির মাথায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি, প্রিয়বর্ধন ক্যাম্পে আছে, সেই সময় নিচের একটা চাতালমতো জায়গায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলুম। তিনটি সবুজ রঙের মানুষের মতো কারা পড়ে আছে। একেবারে উলঙ্গ তারা। ঝুঁকে ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখি, হতভাগ্য ক্যারিবো, ফুতাং আর উংচু!

দ্রুত তাদের কাছে নেমে গেলুম। উপুড় হয়ে পড়ে আছে তারা। সারা গায়ে সবুজ দাগড়া-দাগড়া ছোপ। তাদের দেহে প্রাণ নেই। তিনটি লোভী মানুষের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলুম। সেই মারাত্মক ক্যাকটাস-প্রাণীর পাল্লায় পড়ে শ্বাসরোধ হয়ে সম্ভবত এরা মারা পড়েছে। কিন্তু ওই বিকটা সবুজ ক্ষতচিহ্নগুলি কি রুবিদ্বীপে শোনা সেই সবুজ এলার্জি রোগের চিহ্ন?

হতভাগ্য মানুষ তিনটির জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ক্যাকটাস-প্রাণীরা তাদের এখানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরা মানুষ এদের মরা পড়ে থাকবে, এটা খারাপ লাগল। তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে প্রিয়বর্ধনকে ডেকে আনলুম।

প্রিয়বর্ধন সব দেখে বলল, কীভাবে এদের সদগতি করবে ভাবছ? এখান থেকে ওঠানো অসম্ভব। ক্যারিবো খ্রিস্টান, ফুতাং আর উংচু বৌদ্ধ। বরং এক কাজ করা যাক। এদের ঠেলে নিচের জলে ফেলে দিই। জয়ন্ত, সব শাস্ত্রেই বলেছে জল জিনিসটা শুদ্ধ৷ এদের আত্মার মুক্তি হবে। তাছাড়া নাবিকদের মৃত্যু হলে সমুদ্রের জলেই তাদের ফেলে দেওয়া চিরকাল সবদেশেরই রীতি।

দুজনে মৃতদেহ তিনটি ঠেলে নিচে খাড়ির জলে ফেলে দিলাম।

কিন্তু তারপর যা ঘটল তাতে আমরা আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওপরে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলুম। বলয়-সাগরের জল থেকে ভোঁস করে একটা লম্বাটে বিরাট মাথা বেরিয়ে এল। মুখটা কতকটা উটের মতো, কিন্তু সুচালো। লম্বা গলা। ছোট মাথা। কিন্তু শরীরটা তিমির মতো বিশাল। স্বচ্ছ জলে তার চারটে পাখনার মতো পা দেখা যাচ্ছিল। সেই বিকটাকৃতি সামুদ্রিক প্রাণীটি মহানন্দে মরা তিনটিকে পাখনা-পায়ে আটকে নিয়ে ভোঁস করে তলিয়ে গেল।

ওমনি আমার মনে পড়ে গেল ব্রিটেনের লক নেস (Loch Ness) হ্রদের কিংবদন্তিখ্যাত জলচর প্রাণী নেসি (Nessie) এর কথা। এই রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক জলচর প্রাণীটির ছবি পর্যন্ত ক্যামেরায় তুলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বহু খোঁজ করেও তার পাত্তা পাওয়া যায়নি আজও। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওই হ্রদের ভেতর কোনও গভীর সুড়ঙ্গে তার বসবাস।

এ কি তাহলে সেই নেসি?

বিকটাকার প্রাণীটির গলা এত লম্বা যে সে ইচ্ছে করলে অনায়াসে খাড়ির ওপর থেকে আমাদেরও টুপ করে মুখে তুলে নিতে পারে।

হয়তো সেই ভয়েই প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের আড়ালে লুকোতে গেল। তারপর তাকে মাই গড বলে ছিটকে সরে আসতে দেখলুম। সরে এসে আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। বললুম, কী হল প্রিয়বর্ধন?

প্রিয়বর্ধন একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে বলল, সাবধান জয়ন্ত, এই বিচ্ছু গাছগুলোকে চিনে রাখো। ব্যাটারা ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে সামুদ্রিক ঈল মাছের মতো। জোর বেঁচে গেছি।

ঝোপগুলোকে এড়িয়ে আমরা খোলা মাঠ ধরে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম।…

সেদিন রাতে পূর্ণিমা। কিওটা বনভূমি যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় মাতাল হয়ে উঠেছে। যেদিকে কান পাতি, সঙ্গীত শুনতে পাই। অপার্থিব যেন সেই সঙ্গীত। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে আর মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যেন পরীরা নেমে এসে নাচ-গানে জমিয়ে তুলেছে দ্বীপটাকে। প্রিয়বর্ধনের ওদিকে লক্ষ্য নেই। সে ক্যাম্পখাটে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার পাহারা দেওয়ার পালা। কিন্তু কিসের জন্য এই সতর্ক পাহারা কে জানে? তবু মন মানে না বলেই ক্যারিববাদের ফেলে-যাওয়া একটা রাইফেল হাতে রেখেছি।

একসময় রাইফেলটা রেখে উঠে দাঁড়ালুম। পূর্ণিমারাতের বনভূমির মধুর অর্কেস্ট্রা প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য কিছুটা এগিয়ে গেলুম।

তাহলে এমনি সব রাতেই প্রাচীন যুগে নাবিকরা কিওটা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গীত শুনতে পেত। সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপে আদিম অদিবাসীরা এই দ্বীপের কথা শুনে হয়তো কোহাও রঙ্গো রঙ্গো পুঁথি রচনা করেছিল। কিন্তু এ-দ্বীপ এখনও সবাই খুঁজে পায় না—শুধু আমাদের মতো দৈবাৎ কেউ এখানে এসে পড়ে। তল্লাটের কোনও-কোনও দ্বীপে আদিম অধিবাসীরা অবশ্য এ-দ্বীপ কোথায়, তা ভালই জানে। তারা এখানে পুজো দিতে আসে। কিন্তু সভ্য মানুষের কাছে এর খোঁজ দিতে চায় না। আমরা সেদিন তাদের পাল্লায় পড়েছিলুম। আমার খোঁজে বেরিয়ে কর্নেল যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তবেই এখান থেকে উদ্ধার হওয়ার আশা। নইলে বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে।

আজ রাতে মনে হচ্ছিল, তা যদি হয়, তো হোক। কিওটার বৃক্ষরা আমার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যেই আমি আমৃত্য বরং থেকে যেতে রাজি।

জ্যোৎস্নায় খোলা মাঠ ঝলমল করছে। আবছাকালো দুধারের অরণ্যে অর্কেস্ট্রা বাজছে আর বাজছে। কত বিচিত্র সুর। গম্ভীর, সূক্ষ্ম। চড়া বা খাদে। ডাইনে এগিয়ে উঁচু উঁচু গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলুম। এলোমেলো হওয়া বইছে আর ডালপালা নড়ছে—ওই বুঝি তাদের নাচ। বৃক্ষমর্মরধ্বনির কথা কবিতায় পড়েছি। কিন্তু এতো তা নয়—এ এক আশ্চর্য মধুর ঐকতান। কে শেখাল এই সঙ্গীতের ভাষা। তা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে গিয়ে আমাকে আবেগে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

কতক্ষণ তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম জানি না, একসময় প্রিয়বর্ধনের চিৎকারে আচ্ছন্নতা কেটে গেল। সে উত্তেজিতভাবে ডাকডাকি করছিল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! তুমি কোথায়?

কোনও বিপদ ঘটেছে ভেবে দৌড়ে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম। প্রিয়বর্ধন পুবের দিকে হাত তুলে বলল, একটা আলো দেখতে পাচ্ছ, জয়ন্ত? নিশ্চয় কোনও জাহাজ নোঙর করেছে। আলোটা একজায়গায় রয়েছে তখন থেকে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে তোমাকে ডাকলুম। সাড়া না পেয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ছিল আলোটা।

আলোটা এক জায়গায় আছে। তবে মাঝে মাঝে ঢেউয়ে আড়াল হচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। প্রবাল-পাঁচিলের ভাঙা অংশটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বহুদূরের ওই আলো। আমরা তাকিয়ে রইলুম সেদিকে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছিলুম। হাওয়াটা ক্রমশ বাড়ছে। অথচ আকাশ পরিষ্কার। এদিকে সারা দ্বীপ জুড়ে অর্কেস্ট্রার বাজনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিওটার বনভূমি যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। একসময় হওয়ার ঝাঁপটানি এমন প্রবল হল যে ক্যাম্পের দড়ি ছিঁড়ে খুঁটি উপড়ে কোথায় উড়ে গেল। আমরা বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়লুম ঝড়ের ধাক্কায়। দুহাতে কানও ঢাকতে হল। প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দ আর অর্কেস্ট্রার শব্দ মিলে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। বলয়সাগরের জল উপচে এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। একসময় ওই প্রলয় আলোড়ন যখন ধীরে ধীরে কমে গেল, তখন চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে।

শেষ রাতে সব শান্ত হয়ে গেল। তখন ক্ষীণ সুরে শুধু বেহালার বাজনা কানে আসছিল। বড় করুণ সেই সুর। এ যেন শোকসঙ্গীত শুনতে পাচ্ছি। কার হৃদয়ের গভীর শোক কান্নার সুরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে। দূরে থমথম করছে আবছাকালো বনভূমি। মৃত্যুশোকের স্তব্ধতা রূপ নিয়েছে বুঝি।

তখনও জানতুম না, জানার উপায় ছিল না, একই শোকসঙ্গীত কেন। কেনই বা এত আলোড়ন।

একটু বেলা হলে দূরের সমুদ্র থেকে কুয়াশা কেটে গেল। তখন জাহাজটা দেখতে পেলুম। আমরা শুকনো পাতা ডালপালা জড়ো করে আগুন জ্বেলে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলুম। কিন্তু ততক্ষণে তিনটে মোটর বোট প্রবাল পাঁচিলের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। তিনটে বোটেই একদল করে মানুষ। বোটগুলো যেভাবে ওরা ভাঙন পার করল, তাতে বুঝলুম ওরা এর আগেও দ্বীপে সম্ভবত এসেছে। ওরা তাহলে কারা?

প্রিয়বর্ধন নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল। এতক্ষণে ফিসফিস করে বলল, কিয়াং এসে গেছে! জয়ন্ত, একশোটা ক্যারিবো একটা কিয়াংয়ের সমান। তবে মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে ওদেরও কী হয় দেখে নিও। আর একটা কথা। কিয়াংয়ের সঙ্গে আমরা ভাব জমাবো। ওরা যখন মারা পড়বে মাকড়সা-ক্যাকটাসের হাতে, তখন আমরা ওদের বোট নিয়ে ওদের জাহাজে চলে যাব।

কিয়াংয়ের চেহারা বেঁটে হলেও প্রকাণ্ড। সে নিচে লাফিয়ে পড়ে হা-হা করে হেসে বলল, আরে? রাজবংশের প্রাইভেট সেক্রেটারিমশাই যে! আর এই ছোকরা বুঝি সেই টেকো দাড়িয়ালা ঘুঘু বুড়োর শাগরেদ? কী? রোজারিওর গুপ্তধন হাতাতে পেরেছো তোমরা?

প্রিয়বর্ধন একগাল হেসে বলল, না স্যার! তবে গুহার ভেতর রোজারিওর কবর দেখতে পেয়েছি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত