অপারেশন বাহামা আইল্যান্ড

অপারেশন বাহামা আইল্যান্ড

এক…

“একে আপনি কঠিন ডাইভিং সেশন বলছেন? এ তো পানির মতো সোজা!” রকি বিচ কোভের পানির ওপর মাথা তুলে, টান দিয়ে স্কুবা মাস্কটা খুলে নিয়ে বলল মুসা আমান।

বোটের ডেকে দাঁড়ানো তার ডাইভিং ইন্সট্রাক্টর ডেভিড ওয়াগনারের দিকে তাকিয়ে হাসল। ডেভিডের পাশে দাঁড়ানো আরও দু’জন মানুষ। নিচে থেকে ওপরে তাকিয়ে গ্রীষ্মের উজ্জ্বল আকাশের পটভূমিতে ওদের অস্পষ্ট দেখছে মুসা। তবে মনে হলো তারাও হাসল।

ইনবোর্ড ইঞ্জিনওয়ালা আঠারো ফুট লম্বা বোটটার নাম ‘দ্য ডাইভার’। ইন্সট্রাক্টর ডেভিডই এটার মালিক।

মুসার পাশে পানিতে মাথা তুলল কিশোর পাশা। মাস্ক টেনে খুলে বলল, “বিশটা আন্ডারওয়াটার সিগন্যাল শেষ করেছি।”

পানির ওপর ভেসে থেকে ওয়াটারপ্রুফ প্যাডটা উঁচু করে ধরল মুসা, যেটাতে কিশোরের আন্ডারওয়াটার সিগন্যালগুলো লিখে নিয়েছে সে। এটা স্কুবা-ডাইভিংয়ের একটা বেসিক প্র্যাকটিস, গত গ্রীষ্মে যা বহুবার চর্চা করেছে ওরা। আন্ডারওয়াটার সাইন ল্যাংগুয়েজে যে অনর্গল কথা বলতে পারে দুই গোয়েন্দা, ডেভিড তার মেহমানদের সামনে সেটা প্রমাণ করতে বলেছিলেন ওদের। এটা ওদের পূর্বপরিকল্পিত।

“এসব কাজ আমাদের কাছে কিছু না,” মুসাকে বলতে শুনল কিশোর। চিত-সাঁতার দিয়ে ডেকে ওঠার মইয়ের দিকে এগোচ্ছে দু’জন। “আরেকটু কঠিন কাজ দিলে ভালো হত।”

ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ডেভিড। যেকোনো মডেল পত্রিকার সানট্যান লোশনের বিজ্ঞাপন হওয়ার উপযুক্ত তিনি। বয়স বেশি নয়, তেত্রিশ বছর। সুগঠিত পেশিবহুল শরীর। রোদে পোড়া বাদামি চামড়া। সুদর্শন চেহারা। সোনালি চুল। মাত্র বছরখানেক আগে রকি বিচ স্কুবা-ডাইভিং স্কুলটা খুলেছেন। এরই মধ্যে ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ছাত্রের অভাব নেই।

আবার কিশোর-মুসার দিকে ফিরলেন ডেভিড। হেসে বললেন, “নিজেদের খুব ওস্তাদ ডুবুরি মনে করো, তাই না?” পাশে দাঁড়ানো দু’জন লোককে দেখিয়ে বললেন, “এঁরা হয়তো তোমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন।”

“তাই নাকি?” কিশোরের সঙ্গে মই বেয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল মুসা। “যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে রাজি আছি আমরা।”

ডেভিডের সঙ্গের লোক দু’জনের নাম তাঁর কাছ থেকে আগেই জেনেছে কিশোর ও মুসা। ডানে দাঁড়ানো বালি-রং চুলওয়ালা লোকটার নাম ডাক্তার ওরাম হোল্ডিংস। আর বাঁয়ের ছেলেটা টনি জেরোম। কালো চুল। অস্থির চেহারা। বয়সে তরুণ। বর্তমান তিন গোয়েন্দার বয়সী। পোশাকের ধরন দেখলে অনুমান করা যায়, কোনো বড় শহরে মানুষ।

মুসার শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে সেগুন কাঠের ডেকে।

“তোমরা কতখানি দক্ষ বুঝে গেছি,” মুসার দিকে একটা তোয়ালে বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার হোল্ডিংস। “বলতেই হচ্ছে, তোমরা আমাদের হতাশ করোনি। ভালো ডুবুরি তোমরা।”

কিশোর দেখছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের পরীক্ষা করছেন ডেভিডের দু’জন মেহমান। সে জানে, হোল্ডিংস চিকিৎসক, আর টনি প্রফেশনাল ডাইভার। ডা. হোল্ডিংসও ডাইভিং জানেন। খাকি কাপড়ের ট্রাউজার, টি-শার্ট আর ডেক শু পরা অবস্থায় তাঁকে চিকিৎসকের চেয়ে ডুবুরিই বেশি মনে হচ্ছে, কিংবা অভিযাত্রী। দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিশোর, যে উদ্দেশ্যে এসেছে সে আর মুসা, সেটা সফল হবে তো?

সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনে হয় ওরা পারবে। আপনার ছাত্ররা সত্যিই দক্ষ। তবে ওদের মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে।”

“তাতেও উতরে যাবে ওরা, আমি তো জানি,” হেসে বললেন ডেভিড। “ওদের শরীরে রোগের চিহ্নও পাবেন না।”

“ঘটনাটা কী বলুন তো?” যেন কিছুই জানে না এমন ভান করে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“বলছি, বলছি,” হাত তুলে বললেন ডেভিড। “ডাক্তার হোল্ডিংস আর টনি জেরোম বাহামায় একটা স্পেশাল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন।”

“বাহামায়!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। সেও কিশোরের মতোই অভিনয় করছে।

মুসার দিকে তাকাল একবার কিশোর। বোঝাতে চাইল, অতি অভিনয় করে ফেলো না। তারপর ডেভিডের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, “স্পেশাল প্রজেক্টটা কী?”

“গুপ্তধন শিকার,” ডা. হোল্ডিংস বললেন। “সান্তা হুয়ানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা। ১৬২৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে ডুবে গিয়েছিল এই স্প্যানিশ গ্যালিয়ানটা। গ্যালিয়ান মানে জানো তো? পুরোনো আমলের পালতোলা কাঠের জাহাজ, যেগুলোর পেছনটা অনেক উঁচু করে বানানো হত। রেকর্ড বলে, গ্যালিয়ানটা মেক্সিকো থেকে চল্লিশ টন সোনা আর রূপা নিয়ে যাচ্ছিল।”

“চল্লিশ টন!” মুসা বলল। “সাগরের তলায় পড়ে আছে, তোলে না কেন?”

“বিষয়টা এত সহজ নয়, মুসা,” বোটের রেলিংয়ে হেলান দিলেন ডাক্তার, মুখে হাসি। “শত শত বছরের ঝড়, বালির স্থান পরিবর্তন, শামুক আর সমুদ্রতলের নানা রকম ক্ষয়কারী বস্তু মিলে জিনিসগুলোকে ঢেকে দিয়েছে।”

রকি বিচ কোভের শান্ত পানির দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি, যেন সাগর তাঁর প্রশ্নের জবাব দেবে। বললেন, “ক্যাপ্টেন কুপার, আমাদের প্রজেক্টের প্রধান, বছর দুই আগে ওই গুপ্তধন থাকার প্রমাণ পেয়েছে। চল্লিশ থেকে ষাট ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল জাহাজটা, গ্র্যান্ড বাহামা আইল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্তে। ওখানে এবার নিয়ে তিনবার অভিযান চালিয়েছে সে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি।”

“ইতিমধ্যেই তৃতীয় অভিযানেরও পাঁচটা সপ্তাহ পার করে দিয়েছি আমরা। গত সপ্তাহে, মেটাল ডিরেক্টরের সাহায্যে কিছু ব্যালাস্ট স্টোনের সন্ধান পেয়েছি। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করে মনে হয়েছে, ওগুলো সান্তা হুয়ানেরই জিনিস।”

“বুঝলাম না,” মুসা বলল। “ব্যালাস্ট স্টোনের সঙ্গে গুপ্তধনের সম্পর্ক কী?”

“স্টোন মানে পাথর হলেও ‘ব্যালাস্ট স্টোন’ আসলে পাথর নয়। ওগুলো লোহা দিয়ে তৈরি। পানিতে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জাহাজে বহন করা হত।” মুসার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ডাক্তার। “চার’শ বছর পানির নিচে তলিয়ে থাকার পর ধাতব জিনিস, পোড়ামাটির জিনিস আর চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রই শুধু অবশিষ্ট থাকে। কাঠের জাহাজের কাঠ পচে গিয়ে অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যায়।”

“কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না,” ডাক্তার হোল্ডিংসের দিকে তাকাল কিশোর, “আপনি একজন চিকিৎসক। ডাক্তার হয়ে গুপ্তধন শিকারিদের দলে যোগ দিলেন কেন?”

“গভীর পানিতে ডাইভিং খুব বিপজ্জনক কাজ,” ডাক্তার জবাব দিলেন। “অ্যাক্সিডেন্ট বাদ দিলেও নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়। যার জন্যে চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়ে। যেমন ধরো, পানির নিচে ডুবুরির ট্যাংকের অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়া, কিংবা রক্তে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন বেড়ে গিয়ে বেন্ডে আক্রান্ত হওয়া— এগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দরকার। জাহাজে ডাক্তার না থাকলে কে করবে চিকিৎসা? এছাড়া নানা রকম প্রাণীর আঘাতে, কিংবা প্রবালে কেটে গিয়ে ডুবুরি জখম হতে পারে, তার জন্যও চিকিৎসা দরকার। তবে এ ধরনের প্রাচীন গুপ্তধনের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ আছে বলেই গুপ্তধন শিকারিদের সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়ার প্রধান কারণ। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আমার কাছে নেশার মতো। ক্যাপ্টেন কুপার আমার পুরোনো বন্ধু। ওকে বলতেই লাফিয়ে উঠল সে। খুশি হয়েই আমাকে সঙ্গে নিল। আগের দুটো অভিযানেও সঙ্গে ছিলাম আমি।”

রেলিং থেকে সরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন আবার ডা. হোল্ডিংস। কিশোর-মুসার দিকে তাকিয়ে রইলেন দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। “এবার, তোমাদের কেন ডাকা হয়েছে, সেটা বলি। আমাদের দু’জন ডাইভার দরকার। ডেভিডও আমার বন্ধু। তার অনেক ছাত্র। ভাবলাম, উপযুক্ত লোকের সন্ধান দিতে পারবে। তাই তার কাছেই এসেছি। তোমাদের কথা সে-ই আমাকে বলেছে।”

“আপনাদের এবারের অভিযান কত দিন চলবে?” জানতে চাইল কিশোর।

“ধরো, মোটামুটি সাত সপ্তাহ। কেন?”

“অভিযানের পাঁচ সপ্তাহই কাটিয়ে দিয়েছেন আপনারা। এখন আর লোক দিয়ে কী করবেন?”

চোখ নামালেন ডাক্তার হোল্ডিংস। আবার তুলে বললেন, “আসলে, কখনোই পুরো লোকবল ছিল না আমাদের। টাকার অভাবে লোক নিতে পারছিলাম না। কয়েক দিন আগে আমাদের একজন নিয়মিত ডুবুরিকে হারিয়েছি, তার নাম রবিন মিলফোর্ড। তাতে করে আরও একজন ক্রু কমে গেল।” চট করে মুসার দিকে তাকাল একবার কিশোর। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দু’জনের। লক্ষ করলেন কিনা হোল্ডিংস, বোঝা গেল না। বলেই চলেছেন, “ওকে ছাড়াও চালিয়ে নিতে পারতাম হয়তো, কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম। মাত্র আর দুই সপ্তাহ আছে। এরপর টাকা ফুরিয়ে যাবে। তাই দু-একজন লোক বাড়িয়ে হলেও তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে ফেলতে চাইছে ক্যাপ্টেন।”

“সে জন্য আমাদের নিতে এসেছেন?” চকচক করছে মুসার চোখ। তার এই অস্থিরতা দেখানো ভালো লাগছে না কিশোরের। ওরা যে যেকোনো মূল্যে এই অভিযানে অংশ নিতে চায়, বুঝতে দিতে চায় না ডা. হোল্ডিংসকে। গুপ্তধন উদ্ধার মূল উদ্দেশ্য নয়, ওরা যেতে চায় রবিনকে খুঁজতে।

মুসা কোনো বোকামি করে বসার আগেই তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল কিশোর, “রবিনের কী হয়েছিল?”

“জানি না,” অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ডা. হোল্ডিংস। টনির দিকে তাকালেন। তাঁর ইচ্ছে, জবাবটা টনিই দিক।

“আসলেই আমরা জানি না,” ডাক্তারের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন টনি। “ও স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। একদিন ডাইভিং সেরে জাহাজ থেকে নেমে যাবার পর আর ফেরেনি।”

চুপচাপ ভাবছে কিশোর। রবিন যে নিখোঁজ হয়েছে, খবরটা জানে সে আর মুসা। এটাও জানে, ডা. হোল্ডিংস ডেভিড ওয়াগনারের কাছে এসেছেন রবিনের জায়গায় লোক নিয়োগ দিতে— খবরগুলো রবিনের বাবার কাছে পেয়েছে কিশোররা। রবিন উধাও হয়ে গেলে সেটা মিস্টার মিলফোর্ডকে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন কুপার। গুপ্তধন শিকারিদের জাহাজে আবার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে শুনে গোপনে মিস্টার ওয়াগনারের সঙ্গে দেখা করেছিল কিশোর ও মুসা। তাঁকে অনুরোধ করেছিল, যেকোনোভাবেই হোক, চাকরিটার ব্যবস্থা তিনি যাতে করে দেন। রবিনও মিস্টার ওয়াগনারের ছাত্র। তিনিও চান, রহস্যের কিনারা হোক, রবিন ফিরে আসুক। তাই কিশোর-মুসাকে সহযোগিতা করতে রাজি হয়ে গেছেন।

“ও, হ্যাঁ,” রবিনের অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যই যেন অন্য প্রসঙ্গে গেলেন ডা. হোল্ডিংস, বললেন, “একজন মেরিন আর্কিওলজির ছাত্রীকেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি। তার নাম নিনা জেরাল্ড। আমাদের কাছে এসে অনেক অনুরোধ করেছে। বলল, ম্যারিন আর্কিওলজির ওপর ডক্টরেট করতে চায়। এরকম একটা অভিযানে অংশ নিতে পারলে তার অনেক উপকার হবে। কী আর করা, কাজটা দিয়ে দিলাম। এত কম বেতনে একজন মেরিন আর্কিওলজিস্ট আমরাও পেতাম না। তাছাড়া খুব দক্ষ ডাইভার সে। যাই হোক, এখন আর দু’জন ডাইভার হলেই হয়ে যায় আমাদের।”

ডেভিডের দিকে তাকাল কিশোর। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। মাথা ঝাঁকালেন তিনি। তবে কিশোর কিছু বলার আগেই ডাক্তার হোল্ডিংসের হাত ঝাঁকিয়ে দিতে দিতে মুসা বলল, “তার মানে নিচ্ছেন আমাদের! স্কুলও ছুটি, খুবই ভালো সময়। তা কখন রওনা হচ্ছি আমরা?”

“আরেকটা পরীক্ষা বাকি আছে,” হাসলেন ডাক্তার। “প্রথমে আমাদের দেওয়া কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে ডুব দিতে হবে তোমাদের। তোমরা কী করো দেখার জন্য টনিও যাবে সঙ্গে।”

“কোনো সমস্যা নেই আমাদের,” নির্দ্বিধায় বলল মুসা।

ডেকের ওপরের একটা লকার থেকে ডুবুরির যন্ত্রপাতি বের করল টনি। ওগুলোর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিশোর। বিড়বিড় করল, “সাধারণ জিনিস নয় এগুলো।”

“না হওয়ারই কথা, এত বড় একটা অভিযান,” উত্তেজনায় ফাটছে মুসা। বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল কিশোর। কোনোমতেই অতি অভিনয় চাপা দিতে পারছে না মুসা। “দারুণ সব জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি।” হাঁটু গেড়ে বসে একটা বয়ান্সি কন্ট্রোল জ্যাকেট পরীক্ষা করে দেখতে লাগল সে। “কিশোর, দেখো দেখো, খুব ভালো জিনিস। এই বিসি জ্যাকেটটার জিপার লাগানো পকেট আছে— ভার বহনের জন্য, প্রেশার ভালভ আছে, বাড়তি বাতাসের জোগান দেওয়ার জন্য। এক প্যাকেজে এত কিছু।”

মুসার কথাবার্তা আর আচরণ দেখে ওকে কেমন বোকা বোকা মনে হলো কিশোরের। আশঙ্কা হলো, ডা. হোল্ডিংস না বুঝে ফেলেন।

“তার মানে, তুমি এটাকে ব্যবহার করে দেখতে চাও?” ডাক্তার হোল্ডিংস জিজ্ঞেস করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল মুসা। “হ্যাঁ, চাই।”

মৃদু ঢেউয়ে দুলছে বোট। কিশোর, মুসা ও টনি ডুবুরির পোশাক পরে নিতে লাগল। এয়ার ট্যাংকের স্ট্র্যাপ বাঁধতে ওদের সহযোগিতা করলেন ডা. হোল্ডিংস আর ডেভিড।

“কত গভীরে শেষ ডুবটা দিয়েছিল ওরা?” টনিকে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার।

ক্লিপবোর্ড দেখল টনি। “পঁয়তাল্লিশ ফুট।”

“এটাকে ষাটে নিয়ে গেলে কেমন হয়?” ডাক্তারের প্রশ্ন।

“ভালোই হয়,” জবাব দিল টনি। “ওদের দক্ষতা আরও ভালোভাবে প্রমাণিত হবে।”

গায়ের খাকি পোশাক খুলে নিলেন ডেভিড ওয়াগনার। ভেতরে সুইমিং ট্রাংকস পরে আছেন। বোটের নোঙর তুলে নিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন তিনি।

নিজেদের এয়ার হৌজ, মাউথপিস, আর প্রেশার গজগুলো চেক করে নিচ্ছে কিশোর ও মুসা। সবই ঠিকঠাক আছে বলে মনে হলো ওদের।

কিছু দূর এগিয়ে ডেভিড বললেন, “এই স্পটটা ভালো।” ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন তিনি।

“বাহ্, ফিনগুলোও চমৎকার,” পায়ে ফিনের স্ট্র্যাপ বাঁধতে বাঁধতে কিশোরকে বলল মুসা।

একটা ক্লিপবোর্ড হাতে ওদের দিকে এগোলেন ডা. হোল্ডিংস।

“এখানে পাঁচটা কাজের কথা লেখা আছে, যেগুলো তোমাদের করতে হবে,” প্লাস্টিকে মোড়া এক শিট কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। “পানির নিচে হেডলাইটের আলোতেও লেখাগুলো পড়তে পারবে।”

কাগজটা হাতে নিল মুসা। তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বড় বড় অক্ষরে ছাপা লেখাগুলো পড়ল কিশোর : প্রবেশ, অবতরণ, সাগরতলের বালি না নাড়িয়ে তার ওপর ভেসে থাকা, পরস্পরকে সফলভাবে সংকেত প্রদান এবং সবশেষে নিখুঁতভাবে ওপরে ভেসে ওঠা। কিশোর জানে, তার আর মুসার কাছে এগুলো কোনো ব্যাপারই নয়, বহুবার এসব প্র্যাকটিস করেছে ওরা।

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল মুসা, “কখন শুরু করব আমরা?”

“শুরু করে দিয়েছ,” ক্লিপবোর্ডে আঁকা কয়েকটা বর্গক্ষেত্র দেখালেন ডা. হোল্ডিংস। “পোশাক আর যন্ত্রপাতি পরা থেকে শুরু করে ঠিকমতো সেগুলো পরীক্ষা করা— এটাকেই আমরা ‘প্রবেশ’ বলি। এর জন্য সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছ।”

টনির দিকে তাকালেন তিনি। এখনো ফিনের স্ট্র্যাপ বাঁধায় ব্যস্ত সে। বলল, “ওকে। আমাদের কাজ শেষ। এবার পানিতে নামতে হবে। গুড লাক।”

রেলিংয়ের কাছে পিছিয়ে গেল কিশোর ও মুসা। সহজেই ডিগবাজি খেয়ে উল্টো হয়ে পানিতে পড়ল। জানে, যত বেশি নিখুঁতভাবে কাজগুলো করতে পারবে, তত বেশি নম্বর পাবে, ওদের চাকরি তত পাকা হবে। দক্ষ ডাইভার পানিতে আলোড়ন খুব কম তোলে, সাগরতলকে যতটা সম্ভব কম বিঘ্নিত করে ভেসে বেড়াতে চায়। কিশোর আর মুসাও সেই চেষ্টাই করল। ওদের বিসি জ্যাকেটের ভালভ অ্যাডজাস্ট করল, বাতাস ছাড়ল, তাতে দ্রুত হলো নামার গতি।

পানি এখানে অতি সুন্দর, ঘন নীল, যতই নামছে ওরা, নীলের পরিমাণ বাড়ছে। উপসাগরের তলদেশের সমতল বালির দিকে নেমে চলেছে। অবাক হয়ে ভাবল কিশোর, ক্যারিবিয়ানের ষাট ফুট গভীরে সাগরের চেহারা কেমন হবে? ওপরে তাকিয়ে টনিকেও ওদের দিকে নেমে আসতে দেখল। পানির ওপরে চকচক করছে রোদ। তার পটভূমিতে ধীরে নেমে আসা টনির দেহটাকে অদ্ভুত একটা ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে।

পাঁচটা কাজের দুটো কাজ সফলভাবেই শেষ হয়েছে, ভাবল কিশোর। তিন নম্বর কাজটা হলো সাগরতলের ওপর দিয়ে বালি না নাড়িয়ে ভেসে বেড়ানো। বিসি জ্যাকেটের ভালভ থেকে বাতাস ছাড়ল এমনভাবে, যাতে বেশি দ্রুত না নামে, বালিতে আলোড়ন না ওঠে। চল্লিশ ফুট নামার পর তলদেশ চোখে পড়ল কিশোরের। আরও বিশ ফুট নিচে।

প্রায় ষাট ফুট নেমে ঘুরে মুসার মুখোমুখি হলো, ওদের পায়ের কাছ থেকে তলদেশ মাত্র আর দুই ফুট দূরে। হেডল্যাম্প জ্বেলে দিল ওরা। চারপাশের অপূর্ব দৃশ্য অবাক হয়ে দেখতে লাগল।

টনি নিশ্চয় লক্ষ করছে ওদের, ভাবল কিশোর, ওদের কাজকর্ম নোট করে নিচ্ছে। নিজের কাজে, এমনকি মুসার কাজেও কোনো খুঁত খুঁজে পেল না সে।

তলদেশকে বিঘ্নিত করেনি, এক কণা বালি ওপরে লাফিয়ে ওঠেনি। কিশোর জানে, একমাত্র দক্ষ ডুবুরিই এভাবে ডাইভিং করতে পারে। নিজেদের দক্ষ ভাবতে কোনো দ্বিধা নেই তার।

টনি যখন ওদের কাছে পৌঁছাল, কিশোর লক্ষ করল, সেও বালিকে সামান্যতম বিঘ্নিত করেনি। মুসার দিকে এগিয়ে গেল কিশোর, ওদের কী কী সংকেত দিতে হবে সেটা জানার জন্য। কিন্তু তালিকাটা পড়তে গিয়ে দেখল মুসার হাত কাঁপছে, ঝাঁকি দিচ্ছে জোরে জোরে।

মুসার কী হয়েছে বোঝার জন্য সামান্য পিছিয়ে এলো কিশোর। প্রথমে মুখোশের ভেতর দিয়ে মুসার মুখের ভাব বোঝা কঠিন হলো। তারপর মুসার দুই হাত উঠে গেল গলার কাছে— স্কুবা ডাইভারদের সর্বজনীন সংকেত।

মুসা বোঝাতে চাইছে, ও বাতাস পাচ্ছে না।

তাড়াতাড়ি মুসার প্রেশার গজ পরীক্ষা করে দেখল কিশোর। ‘ফুল’ শো করছে, যা করার কথা। দ্বিধান্বিত হয়ে সহযোগিতার আশায় টনির দিকে তাকাল সে। কিন্তু টনিকে দেখে মনে হলো পাথর হয়ে গেছে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। আরও মরিয়া হয়ে সংকেত দেখাচ্ছে মুসা।

মাথা ঠান্ডা রাখো— নিজেকে বোঝাল কিশোর— নইলে এ ধরনের জরুরি মুহূর্তে ঠিকমতো ভাবতে পারবে না।

কিছু একটা করা দরকার তার।

ডাইভিং টিচার কী কী শিখিয়েছেন, মনে করার চেষ্টা করল কিশোর।

######

দুই…

বাতাস! বাতাস চাই!

চিৎকার করছে যেন মুসার ফুসফুস। গলা চেপে ধরেছে। মন যতই বলছে, আতঙ্কিত হয়ো না, হাত দুটো কথা শুনছে না। মুখোশটা টেনে খুলে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের অভাবে ফুসফুসটা যেন ফেটে যেতে চাইছে। অস্পষ্টভাবে টের পেল কে যেন তার চারপাশে ঘুরছে। ঝটকা দিয়ে হাত বাড়াল সচল মূর্তিটার দিকে, বাতাসের জন্য মরিয়া।

মূর্তিটা কিশোরের। অবশেষে, অক্সিজেন না পাওয়া চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পারল মুসা, কিশোর নিজের মাউথপিসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাতাস!

মহা কৃতজ্ঞতায় মাউথপিসটা চেপে ধরল মুসা। ঢুকিয়ে দিল মুখের ভেতর। ফুসফুসে চলে গেল ঠান্ডা মিষ্টি বাতাসের স্রোত।

উফ্, আরেকটু হলেই গেছিলাম, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, ভাবল সে। চোখ বন্ধ করে মাথাঘোরাটা বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। দরদর করে ঘামছে। স্কুবা পোশাকের ভেতরে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে শরীর। আরেকবার দম নিয়ে মাউথপিসটা কিশোরকে ফিরিয়ে দিল। তারপর দু’জনে উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে।

ওপরে উঠে মইয়ের কাছে যখন পৌঁছাল মুসা, রাগে অন্ধ হয়ে গেছে সে। কিশোরের চেহারাই বলে দিচ্ছে, সেও মুসার মতোই রেগেছে।

“ব্যাপারটা কী?” ডেকে উঠে আসার পর প্রশ্ন করল কিশোর। ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে শরীর থেকে।

মুসাও এর জবাব চাইছে। মুখোশটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে টনির মুখোমুখি হলো। ওদের পেছন পেছন মই বেয়ে উঠে এসেছে সে।

“আমার বাতাসের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল,” চোখে গনগনে আগুন নিয়ে টনির দিকে তাকাল মুসা। “এবং আমার মনে হয় না এটা কোনো দুর্ঘটনা।”

দু’জনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন ডেভিড। “কী হয়েছে?”

“আসলে,” ডেভিডের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করছে টনি, “এটা একটা পরীক্ষা। জরুরি অবস্থা সামাল দিতে পারে কিনা বোঝার জন্য।” মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ওটা ট্রেনিং ট্যাংক। ষাট ফুট নিচে নামার পর আপনাআপনি বাতাস সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। একটা রিলিজ বাটন আছে, সময়মতো আমি ওটা টিপে দিতাম, তাহলেই আবার বাতাস পেয়ে যেতে। বিপদ হত না তোমার।”

স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ডেভিড আর কিশোর। এয়ার ট্যাংকটা খুলে, ডেক থেকে মুখোশটা তুলে, দুটোই ছুঁড়ে ফেলল মুসা ফুট-লকারে।

“আমি কল্পনাই করতে পারিনি এ ধরনের কাণ্ড করবে ওরা!” ডেভিডও ভীষণ রেগে গেছেন।

রাগে গরগর করছে মুসা। “আবার যদি এমন কিছু করে, ভালোমতো শিক্ষা দিয়ে দেব। ট্রেনিং ট্যাংক বের করব আমি।”

টনির সরু হয়ে আসা বাদামি চোখের কঠিন দৃষ্টি যেন মুসার বরফশীতল দৃষ্টির জবাব দিল।

“ঠিক আছে, টনির হয়ে আমি মাফ চাচ্ছি।” কাছে এসে দাঁড়ালেন ডা. হোল্ডিংস। “সত্যিকার বিপদ তোমরা কীভাবে সামাল দিতে পারো, সেটা জানা জরুরি ছিল আমাদের। ডাইভিংয়ের সময় তোমাদের দক্ষতা যে কারও জীবন বাঁচাতে পারে।”

ভারি দম নিলেন তিনি। “সুখবর হলো, তোমরা পরীক্ষায় পাস করে গেছ। খুশিমনেই আমরা তোমাদের সঙ্গে নিতে রাজি আছি, আমাদের অভিযানের বাকি যে দুই সপ্তাহ অবশিষ্ট আছে, তার জন্য। অবশ্যই যদি তোমরা যেতে চাও।”

দ্বিধা করছে মুসা। অপরিচিত এই লোকগুলোকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কিশোরের দিকে তাকাল। সবার অলক্ষ্যে চোখ টিপল কিশোর। মুখে হাসি ফোটাল মুসা। ডা. হোল্ডিংসের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল।

“খুব বেশি বেতন দিতে পারব না আমরা,” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডাক্তার, স্পষ্টই বোঝা গেল। “তবে গুপ্তধন যদি পাওয়া যায়, সেটা সবাই ভাগ করে নেব।”

সাগরতলে ঘটে যাওয়া অঘটনের ধাক্কাটা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে মুসা, আবার আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিশোরের দিকে তাকাল। এখনো সন্দিহান মনে হচ্ছে কিশোরকে। “ভেবে দেখব আমরা,” জবাব দিল কিশোর। “বাড়িতে কথা বলতে হবে। কাল জানাব। কোথায় যোগাযোগ করতে হবে আপনাদের সঙ্গে?”

“আমার একটা টু-সিটার অ্যারোপ্লেন আছে,” ডাক্তার জানালেন। “আমি আর টনি ওটাতে করে ফেরত যাব।”

পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করে ওটার পেছনের সাদা জায়গাটায় খসখস করে লিখলেন তিনি। “এই নম্বরে ফোন কোরো। তোমরা যদি যাও, আমি যাওয়ার আগে এয়ারপোর্টে তোমাদের জন্য দুটো টিকিট রেখে যাব।”

“খুব বেশি তাড়াহুড়ো করছেন,” হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিল মুসা।

“আমাদের কাজের ধারাই এমন,” বালি-রং চুলওয়ালা মানুষটি উজ্জ্বল হাসি হাসলেন। “যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো— সময় নষ্ট না করে।”

***

সেদিন রাতে রবিনের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করল কিশোর ও মুসা। ডিনারে বসল।

“অবশ্যই যাবে না,” সব শোনার পর বললেন রবিনের বাবা রজার মিলফোর্ড। বিশেষ করে পানির নিচে মুসার বাতাসের লাইন কেটে দেওয়ার কথা শুনে। আলুভর্তার বাটিটা মুসার দিকে ঠেলে দিলেন। “এই টনি জেরোম ছোকরাকে মোটেও ভালো মনে হচ্ছে না আমার। ডাক্তার ওরাম হোল্ডিংসও কী ধরনের লোক কে জানে। ওদের সঙ্গে কাজ করার দরকার নেই। গরমের ছুটিতে রকি বিচে থেকে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দ করো। যা করার আমিই করব। বাহামায় আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধু আছে। আমি নিজে তাদের সঙ্গে থেকে রবিনের খোঁজ করব। বাকিটা পুলিশের দায়িত্ব।”

“কিন্তু রবিনকে ফেলে আমরাই বা আনন্দ করব কী করে— ও এখন কোন বিপদের মধ্যে আছে জানি না,” মুখভর্তি মাংসের কিমার ভেতর দিয়ে কোনোমতে বলল মুসা।

তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন মিসেস মিলফোর্ড, “খেয়ে নাও, খেয়ে নাও, পরে কথা বোলো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মি. মিলফোর্ড। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ছেলের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেটা চেপে রেখে কিশোর আর মুসার বিপদের কথা ভেবে ওদের যেতে বাধা দিচ্ছেন।

সেটা বুঝে কিশোর বলল, “আমাদের এই অভিযানের মেয়াদ দুই সপ্তাহ। রবিনকে খুঁজে বের করতে এত দিনও লাগবে না আমাদের।”

“এক ছেলের জন্য আরও দুটো ছেলেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না আমরা,” মিসেস মিলফোর্ড বললেন। মলিন হাসি তাঁর মুখে। “না, বাবা…”

“বাধা দেবেন না, আন্টি,” মুসা বলল। “রবিন আমাদের কী রকম বন্ধু জানেনই তো। ওকে খুঁজে না বের করা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নেই।”

“হ্যাঁ, আন্টি, আমরা যাবই,” জোর দিয়ে বলল কিশোর। “আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমরা সাবধানে থাকব, নিজেদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না, রবিনকেও খুঁজে বের করে আনব।”

ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছলেন মি. মিলফোর্ড। একটা সেকেন্ড চুপ করে থেকে মুখ তুলে তাকালেন কিশোর ও মুসার দিকে। “বেশ। প্রথমে আমি কুপারের ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। ও যদি ভালো লোক হয়, তাহলে তোমাদের যেতে আর বাধা দেব না। তবে…” মুসার মুখে হাসি ফুটতে দেখে তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন তিনি, “তোমাদের কথা দিতে হবে, কোনোখানে যদি সামান্যতম বিপদ দেখতে পাও, আর এগোবে না। এ কাজ থেকে সরে আসবে। কী, কথা দিচ্ছ?”

হাসিটা মাঝপথেই স্থির হয়ে গেল মুসার। কারণ, ও জানে, বিপদ হবেই। আর পিছিয়েও আসবে না। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে না পেরে অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল।

“না, আঙ্কেল,” অস্বস্তি বোধ করছে কিশোরও, “এখন পর্যন্ত কোনো বিপদের গন্ধ তো পাচ্ছি না।” ভাবছে, বিপদ কি সত্যিই নেই? রবিনের হারিয়ে যাওয়াটা রহস্যজনক— যদি সত্যিই নিজে থেকে চাকরি ছেড়ে না দিয়ে থাকে সে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে কোথায় গেল? বাড়িতে খবর দিল না কেন? ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে কেন তার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনতে হলো? তবে কি বেঁচে নেই সে?

চুপ হয়ে আছে সবাই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’জনকে দেখছেন মি. মিলফোর্ড। মিসেস মিলফোর্ডও তাকিয়ে আছেন নীরবে। একমাত্র দেয়ালঘড়িটার টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

অবশেষে কথা বললেন মি. মিলফোর্ড, “বুঝতে পারছি, তোমাদের ঠেকানো যাবে না। ঠিক আছে, যাও, তবে আবারও বলছি, বিপদে জড়াবে না।”

কিশোরের চাচা-চাচি আর মুসার মা-বাবাকে রাজি করাতে কোনো অসুবিধে হলো না ওদের। সুতরাং পরদিন বাহামার উদ্দেশে রওনা হলো দু’জনে।

***

“আরে, দেখো!” কনুই দিয়ে কিশোরকে গুঁতো মারল মুসা। নিচে তাকাল কিশোর। সবজে নীল সাগরের বুকে রত্নের মালার মতো বিছিয়ে আছে এক সারি দ্বীপ। “কোন দ্বীপটাতে নামব আমরা, বলতে পারো?”

মাথা নাড়ল কিশোর। “নাহ্, এয়ারপোর্টটা দেখা গেলে বুঝতাম।”

তবে একটু পরই বুঝতে পারল ওরা, ফ্রিপোর্ট কোনটা।

সিট বেল্টের বাকলেস চেপে ধরল মুসা। ল্যান্ডিংয়ের সময় পরার জন্য।

ফ্রিপোর্ট এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল প্লেন।

প্লেন থেকে নেমে, পাঁচ গেটওয়ালা, দোতলা এয়ারপোর্টের একটা গেটের দিকে এগোতে এগোতে মুসা বলল, “কিশোর, এটাকে তো রকি বিচ এয়ারপোর্টের মতোই লাগছে।”

“এত ভিড় কেন ওখানে, বলো তো?” কাস্টমস এরিয়ার বাইরে জনতার দিকে হাত তুলে বলল কিশোর। তারপর দূরের একটা দেয়ালে ঝোলানো একটা উজ্জ্বল ব্যানার দেখাল। তাতে রঙিন অক্ষরে লেখা : ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল স্পিডবোট রেস। আগামী ৭ থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত।

“তার মানে এ সপ্তাহেই,” মুসা বলল। তার ব্যাগটা কাস্টমস কর্মচারীদের কাউন্টারে তুলে দিল সে। “আগামী রোববারে আমাদের ছুটি থাকলে রেস দেখতে যেতে পারব আমরা।”

মুসার উৎসাহে বাধা দিলেন নীল স্যুট পরা বাদামি চামড়ার গোমড়ামুখো একজন কাস্টমস অফিসার। অধৈর্য ভঙ্গিতে কিশোরের ব্যাগটায় রাখা একটা জিনিসের প্রতি ইঙ্গিত করছেন তিনি। “এক্সকিউজ মি,” রুক্ষস্বরে বললেন, “এটা কী জিনিস, দয়া করে বলবে আমাকে?”

“নিশ্চয়ই,” কালো প্লাস্টিকের বাক্সটা ব্যাগ থেকে টেনে বের করল কিশোর। ভালো করে দেখার জন্য বাড়িয়ে ধরল অফিসারের নাকের কাছে। “এটা একটা পোর্টেবল ডেপথ গজ। এই যে এই বোতামটা টিপলেই…”

কিশোরকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা, অধৈর্য হয়ে বলল, “পরীক্ষা করে দেখতে যদি অনেক সময় লাগে, রেখে দিন, আমরা বাড়ি ফেরার সময় ফেরত নিয়ে যাব।”

“ডেপথ গজ?” মুসার কথা যেন কানেই ঢোকেনি ইন্সপেক্টরের, বাক্সটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

“আমরা একটা স্যালভিজ শিপে চাকরি নিয়ে এখানে এসেছি,” কিশোর বলল। “দ্বীপ থেকে কিছু দূরে সাগরে নোঙর করেছে ওটা।”

“ট্রেজার হান্টার নাকি?” আগ্রহী হয়ে উঠলেন অফিসার। কিশোর লক্ষ করল, অনেকটা শিথিল হয়ে এলো তাঁর টান টান ভঙ্গি। “ওটার কথা পত্রিকায় পড়েছি। তোমরা কি ওটার নতুন ক্রু?”

“হ্যাঁ, স্যার,” কণ্ঠস্বর মোলায়েম করার চেষ্টা করল মুসা। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। “আজ আমাদের প্রথম দিন। আমি চাই না, প্রথম দিনেই কাজে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাক।”

অবশেষে ইন্সপেক্টরের গোমড়া মুখে হাসি ফুটল। ছেলেদের ব্যাগে স্টিকার লাগিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন। হাত নেড়ে ওদের যেতে ইশারা করলেন। রসিকতা করে বললেন, “যদি গুপ্তধন খুঁজে পাও, আমার জন্য কিছু সোনা নিয়ে এসো।”

বেরোনোর দরজার দিকে এগোল ওরা। কাচ লাগানো দরজার বাইরে বেরিয়ে আসতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাতাস আর উষ্ণ রোদ যেন স্বাগত জানাল। এত ভালো লাগল মুসার, বুঝতে অসুবিধে হলো না, কেন এখানে বেড়াতে আসার জন্য পাগল হয়ে থাকে লোকে।

“দেখো,” সামান্য দূরে একজন ক্যাপ পরা লোককে দেখাল সে। লোকটার পিঠে ছাপ মেরে বড় করে লেখা ‘ট্রেজার হান্টার’। “নিশ্চয় আমাদের জাহাজে নিয়ে যেতে এসেছে।”

হাত নেড়ে লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল মুসা।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল লোকটা, মুসার হাতের সঙ্গে বাড়ি খেল।

“আরে…” জবান বন্ধ হয়ে গেল মুসার। লোক নয়, মহিলা। সুন্দরী তরুণী। ধাক্কা লেগে ক্যাপটা পড়ে গেছে। কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে সোনালি চুল। বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল মুসা। “সরি। আপনাকে আমি পুরুষ ভেবেছিলাম। চুলগুলো যেভাবে টেনে নিয়ে ক্যাপ দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন, পেছন থেকে বোঝাই যাচ্ছিল না…”

“ও নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই,” মহিলা বলল। রোদে পোড়া চামড়া। মুখ লাল তিলে ভরা। ঘাড়ের কাছে ঘন চুল সিংহের কেশরের মতো ফুলে আছে। দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি হাসল। “তুমি নিশ্চয় মুসা। নাকি কিশোর?”

“না, আমিই মুসা। ও কিশোর। আর আপনি…?” বিব্রত ভাবটা এখনো পুরোপুরি কাটেনি মুসার। নিচু হয়ে ক্যাপটা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মহিলার হাতে দিল।

“আমি নিনা জেরাল্ড। তোমাদের জাহাজে নিয়ে যেতে এসেছি।” খসখসে, চাপা, মিষ্টি কণ্ঠ মহিলার। “তোমরা রেডি?”

“নিশ্চয়ই।” পার্কিং লটের ভেতর দিয়ে নিনার পেছন পেছন একটা ঘন সবুজ হ্যাচব্যাক কারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। অনুমান করল, নিনা সেই মেরিন আর্কিওলজিস্ট, ডা. হোল্ডিংস যার কথা বলেছিলেন।

গাড়ির পেছনের ডালা তুলে যার যার ব্যাগ ভেতরে রাখল কিশোর ও মুসা।

কিশোরও লক্ষ করছে নিনাকে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, তবে সেই তুলনায় অনেক কম লাগছে।

ড্রাইভিং সিটে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল নিনা। মুসা বসল তার পাশে। পেছনের সিটে উঠে বসল কিশোর।

“এত মানুষের ভিড়, বিশ্বাস করতে পারছি না। এই প্রথম ওরা এখানে একটা মোটর বোট রেসের আয়োজন করল। এ ধরনের বড় বড় অনুষ্ঠান সাধারণত নাসাউতেই হয়।” গাড়ি চালাতে চালাতে বলল নিনা। অ্যাসফল্টে বাঁধানো সরু একটা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। শিগগিরই বেরিয়ে এসে পড়ল পাহাড়ি এলাকায়। সবুজ পাহাড়গুলোর গায়ে ফোঁটার মতো দেখা যাচ্ছে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, ব্যক্তিগত বাড়িঘরগুলো।

“হ্যাঁ, আমরাও বোট রেসিং দেখতে পারব, আশা করছি,” মুসা বলল। “এখন আমাদের বলুন, ট্রেজার হান্টারে থাকতে আপনার কেমন লাগছে? জাহাজে আপনিই কি একমাত্র মহিলা?”

“হ্যাঁ,” জবাব দিল নিনা। “আমার একটা আলাদা কেবিন আছে। ডাঙায়ও একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। তবে ক্যাপ্টেন কুপার, ডা. হোল্ডিংসসহ বাকি পুরুষ ক্রুরা ফুলটাইম জাহাজেই থাকে।”

“আপনি কি রবিন মিলফোর্ডকে চিনতেন?” পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। “তার জায়গায়ই আমাদের নেওয়া হয়েছে।”

“হ্যাঁ, চিনতাম,” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বলল নিনা।

“রবিনের সঙ্গে তো জাহাজে দেখা হয়নি আপনার,” কিশোর বলল। “যত দূর জানি, সে চলে যাবার পর আপনি চাকরি নিয়েছেন।”

“তা ঠিক, আমি জাহাজে চাকরি নেবার আগেই চলে গেছে রবিন।”

“তাহলে কী করে চিনতেন?”

চুপ করে রইল নিনা।

“আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলাম নাকি?” জিজ্ঞেস করল কিশোর।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল নিনা, “আমার মনে হয় নিজে থেকে যায়নি সে।”

“মানে?” ভুরু কোঁচকাল মুসা।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত মুসার দিকে তাকিয়ে রইল নিনা। “সবই বলব। তোমাদের সঙ্গে নিরালায় কথা বলার জন্যই আগ বাড়িয়ে তোমাদের নিতে এসেছি।”

“কিন্তু আপনি তো আমাদের চেনেন না,” মুসা বলল।

বিষণ্ণ হাসি হাসল নিনা। “চিনি। রবিন আমাকে তোমাদের কথা এত বলেছে যে, তোমাদের চেহারা মুখস্থ হয়ে গেছে। তোমরা গোয়েন্দা। রবিনও তিন গোয়েন্দার সদস্য।”

“কিন্তু আমরা এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে আসিনি, এসেছি গুপ্তধন খুঁজতে।” নিনাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা, এখনো বুঝতে পারছে না কিশোর।

“গুপ্তধন খোঁজার ছুতোয় রবিনকেই খুঁজতে এসেছ,” নিনা বলল। “আসলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না।”

“করতে পারার কোনো কারণ আছে কি? আপনাকে তো আমরা চিনিই না।”

“তা ঠিক। আচ্ছা, বলছি…” কথা শেষ করতে পারল না নিনা।

একটা কুকুর এক পাশ থেকে দৌড়ে এসে রাস্তায় উঠল, সোজা নিনার গাড়িটার সামনে।

কুকুরটাকে পাশ কাটানোর জন্য শাঁই করে স্টিয়ারিং ঘোরাল নিনা।

টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে রাস্তার বিপরীত দিকের লেনে চলে গেল নিনার গাড়ি। দেখল, উল্টো দিক থেকে বিশাল একটা ট্রাক ছুটে আসছে ওদের দিকে।

স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ট্রাকের সামনে থেকে সরানোর কথাও যেন ভুলে গেল নিনা। ভয়ানক আতঙ্কে।

তীব্র গতিতে মৃত্যুদূতের মতো ধেয়ে আসছে দৈত্যাকার ট্রাক। পিষে ভর্তা করে ফেলবে ছোট গাড়িটাকে।

#####

তিন

“সরান! সরান!” পেছন থেকে চেঁচাচ্ছে কিশোর। দুই হাতে খামচে ধরেছে সামনের সিটের হেলান।

কিশোরের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যেন জেগে উঠল মুসা। পাশে কাত হয়ে এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে হ্যাঁচকা টানে অনেকখানি ঘুরিয়ে দিল। অ্যাসফল্টের রাস্তায় ঘষা খেয়ে আর্তনাদ করছে রবারের চাকা। পুরো আধপাক ঘুরে গেল গাড়িটা। আতঙ্কিত হয়ে কিশোর দেখছে, ট্রাকের ড্রাইভারও সরার চেষ্টা করছে। শেষ মুহূর্তে নিনার গাড়ির দু-তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে পার হয়ে গেল ট্রাকটা।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ধপাস করে সিটে হেলান দিল কিশোর। নিজেদের লেন পেরিয়ে রাস্তার কিনারে চলে এসেছে নিনার গাড়ি। পাহাড়ের ঢালে উঠে কাত হয়ে আছে। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। জোরে জোরে দু’বার হর্ন বাজাল রেগে যাওয়া ট্রাকের ড্রাইভার, জানালা দিয়ে হাত বের করে নাচাল। তবে না থেমে চলে গেল।

“বাহামায় স্বাগতম,” দুর্বল কণ্ঠে বলল মুসা। নিনার দিকে তাকাল। “আপনি ঠিক আছেন তো?”

থরথর করে কাঁপছে নিনা। অনেক কষ্টে জবাব দিল, “আরেকটু হলেই সবাইকে শেষ করে দিচ্ছিলাম, এই জন্যই রাস্তার দিক থেকে চোখ সরানো উচিত না ড্রাইভারের। আমি সত্যিই দুঃখিত…”

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন। এখনো গা কাঁপছে ওদের। তাকাল উজ্জ্বল সাগরের দিকে। শান্ত ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। আস্তে আস্তে কাঁপুনি কমে এলো ওদের। আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো মুসা, “আপনি রবিনের কথা বলছিলেন।”

ভারি দম নিল নিনা। “তোমরা জানো, থিসিস লেখার উপকরণের জন্য আমি ট্রেজার হান্টারে কাজ নিয়েছি। আসলে তা নয়। আমি জাহাজটায় কাজ নিয়েছি রবিনের কী হয়েছে, জানার জন্য। রবিন আমার কাজিন। তার বয়সী একটা ছোট ভাই ছিল আমার। অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ভাইটার সঙ্গে রবিনের অনেক মিল ছিল। আর তাই বোধহয় রবিনের প্রতি মায়াটা আমার অনেক বেশি।”

কিশোর জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কি আপনার ধারণা কেউ তাকে গুম করে ফেলেছে?”

“জানি না,” কিশোরের দিকে তাকাল নিনা। “আমার ভাই মারা যাবার পর রবিন আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত। জাহাজে চাকরি নেবার পরও লিখেছে। শেষ চিঠিটাতে ইঙ্গিত দিয়েছে সে, তার জীবন এখন হুমকির মুখে।”

“কী কারণে, সেটা জানিয়েছে?”

“না।”

“আপনি জাহাজে চাকরি নেওয়ার পর কিছু জানতে পেরেছেন?”

“নতুন কিছুই না। তাই তোমাদের আসার খবর শুনে এত খুশি হয়েছি যে, নিতে চলে এসেছি। আমি জানি, একমাত্র তোমরাই আমাকে সাহায্য করতে পারবে,” নিনা বলল।

“হুঁ!” মাথা ঝাঁকাল কিশোর। “তবে, আমরা যে গোয়েন্দা, সেটা কারও কাছে ফাঁস করবেন না। তাহলে শত্রুপক্ষের চোখে পড়ে যাব, রবিনকে খোঁজা তখন কঠিন হয়ে যাবে আমাদের জন্য।”

“বলব না,” হাসি ফুটল নিনার মুখে।

“চলুন, এখন যাওয়া যাক,” কিশোর বলল। “ক্যাপ্টেন নিশ্চয় অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। আরেকটা কথা, বাকি পথটা কিন্তু আমি গাড়ি চালাব।”

ড্রাইভিং সিটে বসল কিশোর। পাশের সিটে বসে ওকে পথ দেখাল নিনা। কয়েক মিনিট পরেই ওয়েস্ট এন্ডের মরচে পড়া মেরিনায় গাড়ি ঢোকাল কিশোর। সুইচ ঘুরিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে

তাকিয়ে রইল কাঠের ওয়াকওয়ের কিনারে নোঙর করা সারি সারি বোটের দিকে।

“ওই যে, দ্য ট্রেজার হান্টার!” গাড়ি থেকে নেমে শিস দিয়ে উঠল মুসা। চল্লিশ ফুট লম্বা জাহাজটাও চলে এসেছে মেরিনায়, নোঙর করে রাখা হয়েছে। সাদা রং করা। তাতে পড়ন্ত সূর্যের গোলাপি আলো প্রতিফলিত হয়ে জাহাজটাকেও রাঙিয়ে দিয়েছে।

“কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে নিলামে জাহাজটা কিনেছেন ক্যাপ্টেন কুপার,” নিনা জানাল। “তারপর সারিয়ে-সুরিয়ে প্রায় নতুন বানিয়ে ফেলেছেন। জাহাজটাকে ঝকঝকে রাখার জন্য নাবিকেরাও কম পরিশ্রম করে না।”

“দেখে মনেই হয় না, পুরোনো মাল উদ্ধার করার স্যালভিজ শিপ, একেবারে যাত্রীবাহী ইয়ট,” মন্তব্য করল কিশোর। ব্যাগগুলো বের করার জন্য ঘুরে গাড়ির পেছন দিকে গেল। তারপর নিনাকে অনুসরণ করে মুসাকে নিয়ে গ্যাংপ্ল্যাংক বেয়ে ডেকে উঠে এলো।

“জাহাজে স্বাগতম!” নাটকীয় ভঙ্গিতে হেসে বলল নিনা।

ডেকের ওপর ব্যাগ নামিয়ে রাখল কিশোর। মধ্যবয়সী, গা খোলা, দাড়িওয়ালা, বারমুডা শর্টস আর ডে শু পরা একজন লোক ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, “আমি ক্যাপ্টেন কুপার। আর এই যে ডা. হোল্ডিংসকে তো চেনোই?”

“পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, ক্যাপ্টেন।” ক্যাপ্টেনের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল কিশোর। ইউনিফর্ম পরা, ফিটফাট, জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো লাগছে না তাঁকে, বরং যেন দরিদ্র একজন

মানুষ, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের বন্দরগুলোতে ছোটখাটো কাজ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে।

“এলে তাহলে,” ডা. হোল্ডিংস বললেন মুসার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। “তোমাদের দেখেও খুশি হলাম।”

ডাক্তারকে লক্ষ করল কিশোর। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আছেন। প্রজেক্ট নিয়ে কোনো সমস্যা হলো কিনা কে জানে। পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা ব্যাগগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কোথায় রাখব?”

“চলো, দেখাচ্ছি,” ক্যাপ্টেন বললেন। “এসব রেখে আসার পর পরিচয় করিয়ে দেব ক্রুদের সঙ্গে।”

ক্যাপ্টেনকে অনুসরণ করল কিশোর ও মুসা। সামনে, কিছু দূরে টনি জেরোমকে দেখতে পেল কিশোর। লম্বা, ছিপছিপে, লাল চুলওয়ালা, আঠারো-উনিশ বছর বয়সী একজন নাবিকের সঙ্গে কথা বলছে। একটা কেবিনের বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে টনি। হাসি হাসি ভঙ্গিতে কথা বলছে। কিশোরদের দেখে মাঝপথেই কথা থামিয়ে দিল। হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। দৃষ্টি কঠোর।

“এই যে, টনি!” ক্যাপ্টেন বললেন। “মুসা আর কিশোরের সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছে তোমার। তুমি ওদের থাকার জায়গাটা দেখিয়ে দাও?” দুই গোয়েন্দার দিকে ফিরলেন তিনি। “রোববারে ক্রুদের ছুটি।”

“থ্যাংকস, ক্যাপ্টেন,” মুসা বলল। “পাঁচ মিনিটে আমাদের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে ফেলব।”

“আমি কিশোর পাশা,” টনির সঙ্গীকে বলল কিশোর। লাল চুলওয়ালা ছেলেটার সঙ্গে হাত মেলাল। “ও আমার বন্ধু, মুসা আমান। আমরা রবিন মিলফোর্ডের জায়গায় এসেছি।”

“আমি ডিয়েগো, ডিয়েগো প্যাসাডোনা,” আন্তরিক সহজ ভঙ্গিতে বলল ছেলেটা। “লোকবল বাড়ানোতে ভালো লাগছে। কাজের চাপ কিছুটা হলেও কমবে।”

“এই, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?” অধৈর্য ভঙ্গিতে ডাকল টনি। কম্প্যানিয়নওয়ের দিকে এগোল। দুই ডেক নিচে রয়েছে লিভিং কোয়ার্টার। “এই জাহাজে কারও নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই।”

টনির সঙ্গে সরু কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে নিচের প্যাসেজওয়ের দিকে এগোল কিশোর ও মুসা। পথটা এতই সরু, সামান্য পাশে সরলেও দেয়ালে গা ঠেকে যায়।

প্যাসেজওয়ে অর্থাৎ সরু ভেতর-বারান্দাটার দুই ধারেই কেবিনের সারি। একটা কেবিনের সামনে থামল টনি।

“তোমরা থাকবে কেবিন ছয় আর সাতে,” টনি বলল। “চাবিগুলো দরজার তালায় ঢোকানো আছে।”

নিজের কেবিনে ঢুকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল কিশোর। দেখে অবাক হলো। এতটা সুন্দর ঘর আশা করেনি। কাঠের প্যানেল লাগানো। একটা বাংক, একটা আলমারি, এমনকি একটা লেখার টেবিলও আছে।

“তোমারটা কেমন?” বারান্দায় উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“একেবারে তোমারটার মতো,” জবাব এলো মুসার কাছ থেকে।

“মোট দশটা কেবিন,” টনি জানাল। “নিনার জন্যও আলাদা কেবিন। একটা বাকি আছে। রবিনের জন্যই বোধহয় রাখা হয়েছে, যদি ফিরে আসে।”

“ও কত দিন আগে নিখোঁজ হয়েছে?”

“গত রোববারের আগের রোববারে। দুই সপ্তাহ।” চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল টনি। “কেন?”

“এমনি। তার কী হলো ভাবছি,” জবাব দিল কিশোর।

শ্রাগ করল টনি। “হতে পারে সোনা-টোনা কিছু পেয়ে গেছে, চুপচাপ ওগুলো নিয়ে কেটে পড়েছে, কে বলতে পারে? কিংবা হয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে কাজ ছেড়ে পালিয়েছে।” টনির অস্বস্তিভরা হাসিটাকে হিক্কা ওঠার মতো মনে হলো। “তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল, কিন্তু তাড়াতাড়ি ওপরে যেতে হবে আমাদের, ক্যাপ্টেন চেঁচানো শুরু করার আগেই।”

নিজেদের কেবিনে তালা দিল কিশোর ও মুসা। তারপর টনির পেছন পেছন ওপরে উঠতে লাগল। “এটা খাবার ঘর,” একটা দরজা পাশ কাটানোর সময় টনি বলল। “এটাকে লাউঞ্জ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়, যদি কোনো কারণে আমাদের কাজ বন্ধ থাকে— এখানে বসে আড্ডা দিই।”

ঘরটার ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। ছোট ঘর। তবে আরামদায়ক করে সাজানো। মাঝখানে গোল বড় একটা টেবিল। নিচু তাকভর্তি ম্যাগাজিন। ঠাসাঠাসি করে রাখা কয়েকটা ইজি চেয়ারও আছে।

“বার্নি, আমি তো অবাক হয়ে ভাবছিলাম, তুমি আবার কোথায় গেলে।” টনির কথায় ফিরে তাকাল কিশোর। প্যাসেজওয়ে ধরে একজন মোটাসোটা, হাসিখুশি তরুণকে ওদের দিকে এগোতে দেখল। বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। শরীরটা এমন বেঢপ আকৃতির হয়ে গেছে, সরু প্যাসেজওয়ে দিয়ে কোনোমতে চিপেচুপে চলছে। অবাক হয়ে ভাবল কিশোর, এত বড় শরীর নিয়ে সোনা খোঁজার জন্য কী করে সাগরে ডুব দেয় সে!

“ডিয়েগোর সঙ্গে তাস খেলতে যাচ্ছি,” বার্নি জবাব দিল। “যাবে নাকি তোমরা?”

“না, ছুটির দিনে তাস খেলার চেয়ে অন্য কিছু করতেই ভালো লাগে আমার,” টনি বলল। দুই গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, “বার্নি নিকলসন। আর ও হলো কিশোর পাশা, ও মুসা আমান।” সরে জায়গা করে দিল টনি, যাতে তিনজনে হাত মেলাতে পারে। টনি বলল, “কিশোর আর মুসা জাহাজের নতুন ক্রু।”

হাত মেলানোর পর কিশোর-মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল বার্নি, “আসি। পরে দেখা হবে।”

বার্নির পেছনে কম্প্যানিয়নওয়েতে চেঁচামেচি শোনা গেল।

“হুঁ!” মাথা দুলিয়ে বলল মোটা লোকটা। “পয়জনের মনে হচ্ছে! আমাদের অতীতের রাঁধুনি, আর জাহাজে একমাত্র বাহামিয়ান, এখানকার স্থানীয় লোক।”

“ঠিক বলেছ।” সিঁড়িতে দেখা দিল একজন লোক। বয়স খুব বেশি না, বার্নির চেয়ে দু’এক বছরের বড় হবে। সাদা শার্ট আর স্ল্যাকস পরেছে। তাতে তার কালো চামড়ার কালো রং আরও ফুটে উঠেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “শোনো, আমার আসল নাম কিন্তু পয়জন নয়। ক্রিস ব্রাউন। কেন যে ওরা আমাকে ‘বিষ’ ডাকে, জানি না। বিষাক্ত কিছু করিনি আমি। খাবারেও বিষ মেশাইনি। তবু কিসের ভয়ে তারা আমাকে রান্না করতে দেয় না, তারাই জানে। সাগরে ডুব দেওয়া ছাড়া এখন আমার আর কোনো কাজ নেই। যাই হোক, আমাকে শুধু ক্রিস বলে ডেকো।”

লোকটার সঙ্গে হাত মেলাল মুসা। “তার মানে আপনি বলতে চান, এই স্বর্গের মতো সুন্দর দ্বীপটায় আপনি জন্মের পর থেকে বাস করে আসছেন?”

“হ্যাঁ, সারা জীবন। না না, জীবনের অনেকখানি বাকি আছে এখনো।”

তার কথায় হেসে উঠল কিশোর, মুসা আর টনি। ওরা তিনজন কম্প্যানিয়ন বেয়ে উঠতে লাগল, আর বার্নি ও ক্রিস লাউঞ্জে ঢুকে গেল।

সিঁড়ির গর্ত থেকে মাথা তুলতেই ক্যাপ্টেনের চোখে চোখ পড়ল কিশোরের। রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন ক্যাপ্টেন কুপার। চিন্তিত মনে হচ্ছে তাঁকে।

ডুবন্ত সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো তখন সাগরের পানিকে গোলাপি করে তুলেছে। খানিক পরই লাল হয়ে যাবে।

“আহ্, ক্যারিবিয়ানের বাতাস কী মিষ্টি!” বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে কবিতা পাঠের ভঙ্গিতে বলল মুসা। “আর ওই লাল সাগরের নিচে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে টন টন সোনা…”

কিন্তু মুসার কাব্যচর্চায় বাধা দিলেন ক্যাপ্টেন, চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে হুকুম দিলেন, “আমি চাই, কাল ভোরে সবাই ডেকে হাজির থাকো। টনি, তুমি মুসা আমানের সঙ্গে ডাইভিংয়ে যাবে। আমি এখন কেবিনে যাচ্ছি। তোমাদেরও সেটাই করা উচিত।”

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। “বড় বেশি উত্তেজিত। অস্থির,” বিড়বিড় করল সে।

“হওয়ারই কথা,” মুসা বলল। “টাকা ফুরিয়ে আসছে। এদিকে গুপ্তধনের পাত্তা নেই।”

“তাঁর মেজাজ যখন এই অবস্থায় থাকে, তখন তাঁর সামনে না থাকাই ভালো।” পেছন থেকে শোনা গেল ক্রিসের কণ্ঠ। হাতে এক ট্রে-ভর্তি স্যান্ডউইচ। “এসো কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।”

“থ্যাংকস,” হাত বাড়াল মুসা। “খাব, অবশ্যই যদি আপনি বানিয়ে না থাকেন।”

“আমিই বানিয়েছি, তবে নির্দ্বিধায় খেতে পারো, বিষ মেশাইনি,” ক্রিস জবাব দিল।

কিশোরের নজর তখন ক্রিসের আঙুলের একটা সোনার আংটির দিকে। “সুন্দর,” বলল সে। “দ্বীপ থেকে কিনেছেন?”

ভীষণ চমকে গিয়ে আরেকটু হলেই হাত থেকে স্যান্ডউইচের ট্রে ফেলে দিচ্ছিল ক্রিস। কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, “না। আমাদের পারিবারিক জিনিস।” জোর করে মুখে হাসি ফোটাল বাহামিয়ান। “বহু বছর ধরে আছে।”

আর ওখানে থাকতে চাইল না ক্রিস। যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই নিনার মুখোমুখি হলো। ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে নিনা। তার নজরও আংটিটার দিকে। কিশোর দেখল, অদ্ভুত চাহনি ফুটেছে নিনার চোখে।

“স্যান্ডউইচ?” নিনার দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিল ক্রিস।

পিছিয়ে গেল নিনা। ক্রিসের কালচে বাদামি চোখের দিকে তাকাল। “না,” চাপাস্বরে জবাব দিল সে। “থ্যাংক ইউ।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে গেল ক্রিস। নিনার পাশ কাটাল।

নিনাকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছে। ঘুরে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। একটু আগে ক্যাপ্টেন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকিয়ে রইল সাগরের কালো পানির দিকে।

নিনার কাছাকাছি হলো কিশোর। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

ফ্যাকাশে হয়ে গেছে নিনার মুখ। বিড়বিড় করে বলল, “ওই আংটিটা আমার ভাইয়ের। আমি ওকে জন্মদিনে উপহার

দিয়েছিলাম। ভাইয়ের মৃত্যুর পর আংটিটা আমি রবিনকে দিয়েছিলাম।”

“রবিনের আংটি বিষের হাতে কেন?” ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল কিশোর।

জবাব দিল না নিনা, কিংবা জবাব নেই তার কাছে। একইভাবে কালো সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল।

এগিয়ে এলো মুসা। নিনাকে কিছু বলতে গিয়েও তার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।

কী হয়েছে, মুসাকে জানাল কিশোর।

শোনার পর মুসা বলল, “তার মানে ক্রিসকে এক নম্বর সন্দেহের তালিকায় রাখতে হয় এখন।”

“হ্যাঁ,” কিশোর বলল। “এ নিয়ে পরে ভাবব। আমাদের এখন কেবিনে যাওয়া দরকার। ভোরেই উঠতে হবে আবার।”

চার

পরদিন সকাল ছ’টায় অ্যালার্মের শব্দ ঝাঁকি দিয়ে যেন গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল মুসাকে। সজাগ হতেই কানে এলো জাহাজের ইঞ্জিনের ভারী গুমগুম শব্দ। ডাইভিং সাইটে যাওয়ার জন্য বোধহয় রওনা হয়ে গেছে ট্রেজার হান্টার। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দ্রুত কাপড় পরে তৈরি হয়ে কম্প্যানিয়নওয়ে বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।

“এই, মুসা, এখানে!” তাড়াহুড়া করে ডাইনিং রুমের পাশ কাটাচ্ছে মুসা, এমন সময় ভেতর থেকে ডাক দিল বার্নি নিকলসন। মুসার চোখ এখনো আধবোজা। বার্নি বলল, “ডাইভিং করার আগে তোমাকে বাথরুম সারতে হবে, নাশতা করতে হবে। জাহাজে সবাই আমরা আমাদের যার যার খাবার তৈরি করে নিই, যখন থেকে পয়জন রান্নাঘরে অঘটন ঘটিয়েছে। তার অসাবধানতার কারণে চুলার আগুন রান্নাঘরের দেয়ালে লেগে যায়।” এক মুহূর্ত থেমে বলল, “এসো, আমি তোমাকে একটা ফ্রুট সালাদ বানিয়ে দিই।”

“থ্যাংকস।” ডাইনিং রুমে ঢুকল মুসা। বার্নির সঙ্গে ডিয়েগো, ক্রিস, কিশোর, নিনা সবাইকে দেখতে পেল ওখানে। “আমিই কি সবশেষে এলাম নাকি?”

“তাই তো মনে হচ্ছে,” মোলায়েম সুরে জবাব দিল নিনা। “টনি আর ডোরি ইতিমধ্যেই খেয়ে চলে গেছে।”

“ডোরিটা কে?” একটা খালি চেয়ারে বসল মুসা।

“ডোরি পাউস, আরেকজন ডাইভার। ও পাইলটের কাজও করে। জাহাজ চালানোয় ব্যস্ত থাকে, সে জন্যই জাহাজের অন্য কোথাও খুব একটা দেখা যায় না ওকে। আর টনি চলে গেছে ডেকে, ডাইভিংয়ের জিনিসপত্র গোছাতে।”

“তাই নাকি?” চট করে কিশোরের চোখে চোখে তাকাল একবার মুসা। “তাহলে তো এয়ার সাপ্লাই ভালভটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখে নিতে হয়।”

“হ্যাঁ,” ডিয়েগো বলল। “টনি আমাকে বলেছে, রকি বিচে তোমাদের সঙ্গে কী রসিকতা করেছিল। তার ব্যাপারে সব সময় সাবধান থেকো। ও যে কখন কী করবে, কেউ জানে না।”

আধঘণ্টা পর ডেকে উঠল মুসা। জাহাজটা এখন নোঙর ফেলেছে। ইতিমধ্যে ডাইভিং গিয়ার পরা শেষ টনির। চোখমুখ গম্ভীর।

“কোনো সমস্যা?” জিজ্ঞেস করল মুসা।

এয়ার ট্যাংকটা টনির পিঠে বেঁধে দিতে দিতে কিশোর বলল, “তোমাকে দেখে কেমন যেন লাগছে। অসুস্থ নাকি?”

“আমি ভালোই আছি,” রুক্ষস্বরে জবাব দিল টনি। ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “আজকের কর্মসূচি কী?”

“সাথে করে দুটো মার্কার নিয়ে যাও, জরুরি কিছু খুঁজে পেলে চিহ্ন দিয়ে রাখবে,” ক্যাপ্টেন বললেন। পায়ের কাছ থেকে

সামান্য দূরে রাখা এক বাক্স সাদা রঙের চার কোনা মার্কার দেখালেন তিনি ইঙ্গিতে।

দুটো মার্কার তুলে নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। দশ ইঞ্চি কিউবের মতো জিনিসগুলোর প্রতিটির মাঝখানে কালো রঙে নম্বর লেখা রয়েছে। আরও দুটো মার্কার তুলে নিয়ে টনির হাতে তুলে দিলেন ক্যাপ্টেন। সেগুলো দেখল টনি।

“মুসা, ম্যাগনেটোমিটারের দায়িত্ব তোমার,” যন্ত্রটা মুসার হাতে দিলেন ক্যাপ্টেন। “এটা দিয়ে যদি কোনো ধাতব বস্তু খুঁজে পাও, সেটা তোমার জালের ব্যাগে রাখবে, ওপরে নিয়ে আসবে।”

“দেখতে তো ঘাস কাটার যন্ত্রের মতো লাগছে,” লম্বা হাতল আর মাথার কাছে টিউবওয়ালা যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

“এটা দিয়ে সাগরতলে বাতিল জিনিস খোঁজা হয়,” ক্যাপ্টেন বললেন। “আমেরিকান নেভি এই জায়গাটাকে আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করত। তবে সেগুলো অনেকটাই আমরা পরিষ্কার করে ফেলেছি।”

লম্বা একটা হোস পাইপের মতো জিনিস নিয়ে রেলিংয়ের ওপর ধস্তাধস্তি করছে কালো চুলওয়ালা এক তরুণ।

“ওই জিনিসটা কী?” জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“এয়ার লিফট,” জবাব দিল তরুণ। কথার টানে ওকে দক্ষিণ আমেরিকান বলে মনে হলো। “এটা আসলে এক ধরনের স্যান্ড ভ্যাকুয়াম। এটা দিয়ে জঞ্জাল সরানো হয়, যাতে ডাইভাররা সাগরের তলদেশ খুঁজে দেখতে পারে।”

“তোমার লেকচার শেষ হয়েছে, ডোরি?” বাধা দিল টনি। মুসার দিকে তাকাল। “চলো, আমি রেডি।”

কৌতূহলী চোখে তার ডাইভিং পার্টনারকে দেখতে লাগল মুসা। কী যেন হয়েছে টনির। অতিরিক্ত অস্থির আর অসহিষ্ণু মনে হচ্ছে। রুটিন ডাইভে যাবে। এত উত্তেজিত হওয়ার তো কিছু নেই। তার সঙ্গে যেতে আর উৎসাহ পাচ্ছে না মুসা। কিশোরকে তার কানের কাছে ফিসফিস করতে শুনল, “নিচে গিয়ে সাবধান থেকো।”

সাবধানই রয়েছে মুসা। তার বিসি জ্যাকেটের এয়ার সাপ্লাই ভালভ বারবার পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে, যাতে কোনো রকম বিপদে পড়তে না হয়। জাহাজের কিনারে গিয়ে রেলিংয়ে উঠে বসল, পানির দিকে পেছন করে। তারপর ডিগবাজি খেয়ে পড়ল। মাথা নিচের দিকে করে দ্রুত নেমে চলল স্বচ্ছ নীল পানিতে।

ক্যারিবিয়ান সাগরের পানির নিচের অপূর্ব দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত।

খুব বেশি নিচে নামেনি। এরই মাঝে ওকে ঘিরে ফেলেছে উজ্জ্বল রঙের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছের ঝাঁক। সূর্যের আলো বর্শার মতো হয়ে তেরছাভাবে পানিতে ঢুকছে।

ও আর টনি বিসি জ্যাকেটের বাতাস ছেড়ে ছেড়ে ক্রমশ নিচে নেমে চলল। যতই নিচে নামছে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। চল্লিশ ফুট নিচে সমুদ্রের তলদেশ নজরে এলো। এত নিচেও হেলমেটে লাগানো আলো ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে না। স্বচ্ছ পানিতে রোদ প্রবেশ করে সাদা আর গোলাপি প্রবালে প্রতিফলিত হচ্ছে।

এত সুন্দর দৃশ্য থেকে চোখ সরানো যায় না। জোর করে সরিয়ে কাজে মন দিল মুসা। ম্যাগনেটোমিটারের সুইচ অন করে গুপ্তধন খুঁজতে শুরু করল। এয়ার লিফট হোস হাতে টনি তার পেছনে রয়েছে, বালি আর জঞ্জাল সরানোর জন্য সংকেতের অপেক্ষা করছে।

মিনিট দশেক জায়গাটাতে খোঁজ চালানোর পর মুসার যন্ত্রটার লাল আলো জ্বলে উঠল। জায়গাটার আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলার জন্য টনিকে সংকেত দিল সে।

ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে পরিষ্কার করতে লাগল টনি। শিগগির জিনিসটা দেখতে পেল ওরা। চশমার ধাতব ফ্রেম। তুলে নিয়ে ওটা নিজের কোমরে ঝোলানো জালের ব্যাগে রাখল মুসা, ওপরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার জন্য— যেভাবে ওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এক ঘণ্টা পর জালটা অর্ধেক ভরে ফেলল ধাতব জিনিস দিয়ে, এর কোনোটাই মূল্যবান মনে হলো না তার কাছে। তারপর বড় একটা জিনিস পড়ল ম্যাগনেটোমিটারের আওতায়, পাগল হয়ে উঠল যেন যন্ত্রটা। সংকেতের মাধ্যমে টনি

বোঝানোর চেষ্টা করল, এটা নিশ্চয় ব্যালাস্ট স্টোন। মার্কারের চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে।

হাতের কব্জিতে বাঁধা ডাইভিং ঘড়িটাতে দেখল মুসা, ওদের শিফটের সময় শেষ। জাহাজে ফিরতে হবে। টনিকে ওঠার জন্য সংকেত দিতে গিয়ে দেখে, হাত থেকে হোসটা ফেলে দিয়েছে সে। বুক চেপে ধরেছে, যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায়।

বাতাস পাচ্ছে না নাকি টনি? বিসি জ্যাকেটের এয়ার ভালভে গোলমাল? নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছে? পানিতে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে যতটা দ্রুত সম্ভব সঙ্গীকে সাহায্য করতে এগোল মুসা। টনির ফেস মাস্কের ভেতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। টনির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখ আধবোজা। দ্রুত, কিন্তু নিখুঁতভাবে দু’জনের এয়ার ভালভ অ্যাডজাস্ট করে, টনিকে ঠেলে নিয়ে ওপরে উঠতে লাগল মুসা।

পানির ওপর মাথা তুলে, দু’জনের মাস্ক দুটো টেনে খুলে চিৎকার করে উঠল মুসা। “টনির কিছু হয়েছে! একটা দড়ি ছুঁড়ে দাও। জাহাজে ওকে টেনে তুলতে হবে।”

কাজ শুরু করতে একটা সেকেন্ড দেরি করল না ক্রুরা। ডিয়েগো একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। কিন্তু কিছুটা সামলে নিয়েছে টনি, দড়িটা সরিয়ে দিল। “আমি ঠিক আছি। দম আটকে গিয়েছিল। সকালে বোধহয় বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম।”

মুসাকে অবাক করে দিয়ে মই বেয়েই উঠে যেতে লাগল টনি।

“আস্তে, আস্তে,” ডা. হোল্ডিংস বললেন। হাত ধরে টনিকে ডেকে উঠতে সাহায্য করলেন। “শুয়ে পড়ো। ডোরি, ক্রিস, ওর এয়ার ট্যাংক খোলো। ডিয়েগো, আমার স্টেথো নিয়ে এসো।”

তাকিয়ে আছে মুসা। স্টেথোস্কোপ দিয়ে টনির হার্ট পরীক্ষা করছেন ডাক্তার। গম্ভীর হয়ে গেলেন। অবশেষে সোজা হয়ে বললেন, “টনি, আমার কেবিনে এসো। আরও ভালোমতো চেক করতে হবে। নিনা, তুমিও এসো, আমাকে অ্যাসিস্ট করবে।”

হোল্ডিংস আর নিনা মিলে সাবধানে তুলে নিল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া টনিকে। কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে বয়ে নিয়ে চলল ডাক্তারের কোয়ার্টারে। পেছনে রয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন, রীতিমতো কাঁপছেন তিনি, টনির ফেলে যাওয়া মার্কারগুলো তুলে নিলেন।

“এগুলো স্টোররুমে নিয়ে রাখো,” ডোরিকে বললেন ক্যাপ্টেন। মাঝবয়সী মানুষটাকে দেখছে মুসা, তাঁর জন্য আফসোস হচ্ছে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। “ডিয়েগো আর বার্নি, এবার তোমাদের পালা। ডাইভিংয়ের পোশাক পরো।”

নিজের পোশাক আর যন্ত্রপাতি খুলে রাখল মুসা। তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের হাত থেকে তোয়ালেটা নিল।

“তোমার কী মনে হয়?” তোয়ালে দেওয়ার সময় নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কাঁধ ঝাঁকাল মুসা। এখনো কাঁপছে। “খারাপই মনে হচ্ছে আমার কাছে। হয়তো কিছুই না। তবে পানির নিচে যেভাবে বুক চেপে ধরেছিল, হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।”

***

সারাটা দিনের জন্য মনোবল ভেঙে গেল ক্রুদের। বিকেলের দিকে, শেষ ডাইভারটাও শূন্য হাতে ফিরে আসার পর সাফসুতরো হয়ে যার যার কেবিনে চলে যেতে লাগল ওরা।

টনিকে তার কেবিনের পাশ কাটাতে দেখে ডাক দিয়ে মুসা জিজ্ঞেস করল, “এই, টনি, কেমন লাগছে এখন তোমার? এমন দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে!”

থামল টনি। দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। রসিকতা করল, “আমি ষাঁড়ের মতো শক্তিশালী। অ্যাসিডিটি হয়েছিল, আর কিছু না। আসলেই বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম। ডা. হোল্ডিংস অ্যান্টাসিড দিয়েছেন। এখন ভালো লাগছে। আমাকে সাহায্য করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”

“ও তো আমাকে করতেই হত,” মুসা বলল। “যদিও প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটাও তোমার আরেকটা নাটক কিনা, আমাকে পরীক্ষা করার জন্য।”

“এই, কী বলছ তোমরা?” নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর। “টনি, তুমি এখানে? আমি তো ভেবেছিলাম নিজের ঘরে রেস্ট নিচ্ছ।”

“সেখানেই যাচ্ছিলাম, মুসা ডাকল, তাই দাঁড়ালাম।” বলে চুপ হয়ে গেল টনি। মনে হচ্ছে, কিছু বলতে চায়। বলেই ফেলল, “কয়েক মিনিটের জন্য আমার কেবিনে আসবে? কথা আছে।”

কিশোর-মুসা দু’জনেই অবাক। কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করে মুসা দেখল, টনি বাঁ হাত দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ডান বগলের মাংস চেপে ধরেছে। যেন ব্যথা করছে ওখানটায়।

“চলো।” টনিকে বলল কিশোর। সরু প্যাসেজওয়ে ধরে এগিয়ে চলল তিনজনে। টনি তার কেবিনের দরজার তালা

খোলার সময় দু’জনেই লক্ষ করল, টনির হাত কাঁপছে। চাবিটা পড়ে গেল হাত থেকে। নিচু হয়ে ওটা তুলে টনির হাতে দিল কিশোর।

টনির পেছন পেছন কেবিনে ঢুকতেই বাহুতে তীক্ষ্ণ এক খোঁচা খেল মুসা। লাফ দিয়ে সরে এলো। ঠং করে মেঝেতে পড়ল কী যেন। জিনিসটার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তুলে নিল মুসা। একটা আইস পিক। মাথার দিকটা অতিরিক্ত সরু আর চোখা। দরজার পাশের তাকে রাখা ছিল। চোখা দিকটা দরজার দিকে ফেরানো। এটারই খোঁচা খেয়েছে সে।

টনির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল মুসা, “এটা রেখেছ কেন? আইস বার্গে নামতে হবে ভেবেছিলে নাকি?” আইস পিকের খোঁচা খাওয়া জায়গাটা ডলতে লাগল।

বিব্রত ভঙ্গিতে বলল টনি, “সরি। ঘরে ঢোকার সময় তালা থেকে চাবিটা খুলে আনতে আমি প্রায়ই ভুলে যাই। ঘরের ভেতর আটকা পড়ি। চাবি ছাড়া ভেতর থেকে আর খুলতে পারি না। আমার দরজা খোলার জন্য তখন ডাকাডাকি করতে হয়। বারবার ডাকতে ভালো লাগে না, লোকেও বিরক্ত হয়। তাই আইস পিকটা রেখে দিয়েছি। আটকা পড়লে পিকের চোখা মাথাটা নবের ভেতরের দিকের ফুটোয় ঢুকিয়ে চাপ দিলেই তালাটা খুলে যায়।”

“হুঁ, বুদ্ধিটা ভালোই,” কিশোর বলল। তালার বাইরের দিকে লাগানো চাবিটা খুলে নিয়ে টনির হাতে তুলে দিল।

“এই যে, দেখলে তো, আবার ভুল করলাম,” অস্বস্তিভরা হাসি হাসল টনি। চাবিটা রেখে দিল ডেস্কের ওপর।

“সুতরাং,” ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে পড়ল মুসা, বাকি দু’জন বসল বিছানায়, “এখন তাহলে বলো, টনি, কী বলতে ডেকে এনেছ। কোনো মৎস্যকন্যা তোমাকে দাওয়াত দিয়েছে?”

“আমি রসিকতা করছি না, মুসা,” ভুরু কোঁচকাল টনি। “আমার ধারণা, জাহাজে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে।”

“যেমন?” মুসার মতো হালকাভাবে নিল না ব্যাপারটাকে কিশোর।

“প্রথমে রবিন নিরুদ্দেশ হলো,” জবাব দিল টনি। “আমার ধারণা, ও পালিয়ে যায়নি।”

“তাহলে কোথায় গেল?” স্থির দৃষ্টিতে টনির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল মুসা।

“জানি না। তার কোনো শত্রু থাকতে পারে, তাও মনে হয় না। শান্ত, চুপচাপ, অবসরে বেশির ভাগ সময়ই ঘরে বসে লেখাপড়া করত। নিজেকে নিয়েই থাকত। এমনকি রোববারে ছুটির দিনেও।”

“তোমার কী মনে হয়, ক্যাপ্টেন কুপারই ওকে সরিয়ে দিয়েছেন?” কিশোরের প্রশ্ন।

“তিনি কেন সরাবেন?” টনি বলল। “অন্য কারও কাজ। হয়তো কোনোভাবে কারও পথের কাঁটা হয়ে গিয়েছিল রবিন, তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে…” হিক্কা তুলতে আরম্ভ করল টনি।

টনির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। “তোমার ধারণা, খুন করেছে?”

“রবিনকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তাই না?” ঘুরিয়ে জবাব দিল টনি।

“কিন্তু আমাদের এসব কথা বলছ কেন?” মুসার প্রশ্ন।

টনির মুখটা কালো হয়ে গেল। “কী জানি কেন, তোমাদের ওপর আমার বিশ্বাস জন্মেছে মনে হলো, তোমাদের জানানো দরকার।”

ভুরু নাচাল মুসা। “কী জানাবে?”

আলমারি থেকে দুটো সাদা মার্কার বের করে আনল টনি। “একটা এনেছি পানির নিচ থেকে, আরেকটা যন্ত্রপাতির লকার থেকে। একই রকম দেখতে, তাই না?”

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, “হ্যাঁ।”

“হাতে নিয়ে দেখো।”

দুটো মার্কার দুই হাতে নিল কিশোর। “নিলাম। তো?”

“দুটো মার্কারের ওজন দেখো,” টনি বলল। “ভালোমতো খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে।”

মার্কার দুটোর ওজন বোঝার চেষ্টা করল কিশোর। তারপর বলল, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।” একটা মার্কার উঁচু করে ধরল সে। “এটার ওজন বেশি মনে হচ্ছে।”

“তাতে কী?” বুঝতে পারছে না মুসা।

উত্তেজিত ভঙ্গিতে খুদে ঘরটার ভেতরে পায়চারি শুরু করল টনি। “তাতে অনেক কিছু। আর মাত্র একজন লোককে এ সম্পর্কে বলেছি…” কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না সে।

লাল হয়ে গেল তার মুখ। চিৎকার দিয়ে বুক চেপে ধরল। আতঙ্কিত ভঙ্গিতে মুসা আর কিশোরের দিকে তাকাল। মুহূর্ত পরই মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

চেঁচিয়ে উঠে তার দিকে ছুটে গেল মুসা। কিশোরও লাফ দিয়ে উঠে এলো। টনির একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখতে লাগল। মুসা আঙুল চেপে ধরল টনির ঘাড়ের মোটা শিরার ওপর।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল মুসা।

মাথা নাড়ল কিশোর।

দু’জনেই হতবাক।

পড়ে থাকা টনির দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে।

মারা গেছে টনি।

ওদের চোখের সামনে।

তারা কোনো সাহায্যই করতে পারল না।

#####

পাঁচ

“ধরো তো, উল্টাই,” কিশোর বলল। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।

কী করে মারা গেল টনি?

বিষ খাওয়াল কেউ?

লাভ নেই, বুঝতে পারছে কিশোর। তবু ক্ষীণ আশা, যদি বেহুঁশ হয়ে গিয়ে থাকে টনি, যদি আবার জ্ঞান ফিরে আসে, তাই টনির দেহের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দু’জনে মিলে সাবধানে ওকে চিত করল। আর ঠিক এই সময় কেবিনের দরজায় জোরে জোরে থাবা দিতে লাগল কেউ।

“কী, হচ্ছেটা কী এখানে?” গমগম করে উঠল ক্যাপ্টেনের গলা। “কে চিৎকার করল? এই, দরজা খোলো!”

“মার্কারগুলো আলমারিতে রেখে দাও,” নিচুস্বরে মুসাকে বলল কিশোর।

উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল সে।

টনির দরজার কাছে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। বার্নি আর ডিয়েগো ক্যাপ্টেনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে ডা. হোল্ডিংস। কিশোরের মনে হলো, টনির চিৎকার তাদের কানে গেছে।

“ও মারা গেছে,” টনিকে দেখাল কিশোর।

ভেতরে ঢুকলেন ডা. হোল্ডিংস। টনির নাড়ি দেখলেন। গম্ভীর মুখে তাকালেন কিশোরের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছিল?”

“কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুক চেপে ধরল,” কিশোর জবাব দিল।

“হ্যাঁ,” যোগ করল মুসা। “প্রচণ্ড ব্যথায় বিকট চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। আমরা তার কাছে যাবার আগেই সব শেষ।”

কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন কুপার। “আমরা এখন বন্দরের দিকেই যাচ্ছি। বার্নি, জাহাজের ফোন থেকে পুলিশকে ফোন করো।”

নির্দেশ পালন করতে দৌড়ে চলে গেল বার্নি। কিশোর ও মুসার দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। “তোমরা তোমাদের কেবিনে থাকো, পুলিশ না আসা পর্যন্ত,” কঠিন কণ্ঠে আদেশ দিলেন তিনি। “আর জাহাজে এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।”

“কিন্তু এটা তো আমাদের দোষ নয়,” প্রতিবাদ করল কিশোর। “নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তার।”

মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন। চেহারা কঠিন হয়ে গেছে তাঁর। থমথমে। ডা. হোল্ডিংসের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,

“ডাক্তার, আজ ওকে পরীক্ষা করার সময় হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখেছ?”

“নাহ্, তেমন কিছু তো দেখিনি। প্রচণ্ড অ্যাসিডিটি হচ্ছিল, তার ওষুধ দিয়েছিলাম। কাল দ্বীপে নেমে হাসপাতালে গিয়ে ফুল চেকআপ করিয়ে নিতে বলেছিলাম।”

গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। তাঁর আচরণেই বুঝতে পারল কিশোর, টনির মৃত্যুর কারণ হিসেবে ওদের দু’জনকে সন্দেহ করছেন তিনি। আবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। বুঝতে পারল, ক্যাপ্টেনের সন্দেহ দূর করে নিজেদের সন্দেহমুক্ত করার মতো কোনো প্রমাণ তার কাছে নেই, সেটা একমাত্র পুলিশই পারবে।

“ডাক্তার, তুমি লাশের কাছে থাকো,” ক্যাপ্টেন বললেন। “বাকি সবাই যার যার কেবিনে চলে যাও।”

ট্রেজার হান্টার যখন ওয়েস্ট এন্ড ডকে নোঙর ফেলল, কিশোর তখন বাংকে শুয়ে মনে মনে সারা দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করছিল। ভাবছিল, এর পেছনে কার হাত রয়েছে? মার্কারের কথা ওদের ছাড়া আর কাকে বলেছে টনি? তার মৃত্যুর কারণ সত্যিই হার্ট অ্যাটাক, না খুন?

পুলিশের টু-ওয়ে রেডিওর খড়খড় শব্দ কানে আসতে স্বস্তি বোধ করল কিশোর। প্যাসেজওয়ে ধরে এগিয়ে আসছে। টনির রুমের দিকে যাচ্ছে। “গুড,” বিড়বিড় করে বিছানায় উঠে বসল সে। “এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।”

“কিশোর পাশা?” ডাক শুনে দরজা খুলে দিল সে। পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা বেঁটেখাটো একজন বাহামিয়ান মানুষের মুখোমুখি হলো। “সার্জেন্ট মার্ক নাউলেস,” অফিসার বললেন। “আমার সঙ্গে এসো।”

“কোথায়?” সার্জেন্টকে অনুসরণ করে মুসার রুমে এলো কিশোর। যত তাড়াতাড়ি পুলিশকে বোঝাতে পারে ততই ভালো। ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা তাদের নিজেদের তদন্ত শুরু করতে পারবে।

“তোমাদের থানায় যেতে হবে,” মুসা ও কিশোরকে নিয়ে ডেকে উঠে আসার পর সার্জেন্ট জানালেন।

স্থির হয়ে গেল কিশোর। তাকাল মুসার দিকে। থানায়? তার মানে সত্যিই ওদের সন্দেহ করা হয়েছে?

“রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ, আর কিছু না,” সার্জেন্ট বললেন। “তবে, রাতে তোমাদের ওখানে থাকতে হবে, যতক্ষণ না করোনারের রিপোর্ট হাতে আসছে আমাদের।”

“এটা অন্যায়!” ফেটে পড়ল মুসা।

পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন সার্জেন্ট। হাতকড়া বের করলেন। “না যেতে চাইলে জোর করে নিয়ে যাব।”

এক পা পিছিয়ে গেল মুসা।

মাথা নেড়ে কিশোর বলল, “চলো, যাই।”

রাত দশটায় কিশোর ও মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলো পুলিশের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একই প্রশ্ন : মৃত্যুর আগে কী

বলেছিল টনি, কীরকম আচরণ করেছিল, তারা ওকে কতখানি চেনে, ট্রেজার হান্টারে কী ঘটছে, এ ব্যাপারে ওদের কী ধারণা?

শেষ পর্যন্ত ওদের হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। ওদের সঙ্গে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যা ছিল, সেগুলো রেখে আসতে হয়েছে ক্লার্কের ডেস্কে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা টানতে টানতে এগোল দু’জন।

“আমরা এখানে থাকতে পারব না। ভোরে ক্যাপ্টেন কুপারের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। তাঁর ডাইভিং শিডিউল মিস করা চলবে না।” দুর্বল কণ্ঠে শেষবারের মতো সার্জেন্টের কাছে প্রতিবাদ জানাল মুসা।

“ট্রেজার হান্টারের সমস্ত কাজকর্ম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে, পুলিশের কাছ থেকে নির্দেশ না পেলে বন্দর ছেড়ে যেতে পারবে না,” জানালেন সার্জেন্ট। “কাল সকালেই করোনারের রিপোর্ট চলে আসার কথা। যদি দেখা যায় তাঁর রিপোর্টের সঙ্গে তোমাদের কথা মিলে গেছে, তাহলে তখুনি তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।”

কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়াতে ক্যাপ্টেনের মানসিক অবস্থা কী হয়েছে, অনুমান করতে পারছে কিশোর।

“তোমাদের আটকে রাখার জন্য আমি দুঃখিত,” আবার বললেন সার্জেন্ট।

হাজতের ঘর দেখে অবাক হলো কিশোর। শুধু শিক আর পাথরের মেঝে আশা করেছিল সে। কিন্তু বাহামিয়ান পুলিশ দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি মানবিক। যে ঘরটা ওদের দেওয়া হলো, সেটা জাহাজে ওদের কেবিনের চেয়ে কম আরামদায়ক নয়।

“বাহ্, দারুণ তো,” চার পায়ার বিছানাটা পরীক্ষা করে বলল মুসা। “আমি গোসল করতে যাচ্ছি।”

বাথরুমে শাওয়ারও আছে। অনেকক্ষণ ধরে ভিজে স্নায়ুর উত্তেজনা কমাল সে। ফিরে এসে বিছানায় বসে বিরাট হাই তুলল।

“এতটা ভালো আশা করিনি…” বলতে গিয়ে মস্ত হাই তুলল কিশোর। “তোমার কী অবস্থা জানি না। তবে আমি আর এক মুহূর্ত দেরি করতে পারছি না। আশা করি, জেগে উঠে দেখব, পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলেই যাচ্ছে।”

সকালে উঠে নিজের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটতে দেখে অবাক হলো কিশোর। এতটা আশা করেনি। হাজতের শিকে লাঠির বাড়ি দিয়ে শব্দ করে ওদের জাগাল একজন গার্ড।

“সার্জেন্ট ডাকছেন,” গার্ড জানাল। “চলো।”

তার পেছন পেছন সার্জেন্টের অফিসে এলো দুই গোয়েন্দা, যেখানে কোনো রকম ভানভণিতা না করে ওদের জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিলেন ছোটখাটো মানুষটি।

“করোনারের রিপোর্ট পেয়েছি,” সার্জেন্ট জানালেন। “হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছে টনি জেরোম। অ্যাটাকটা হয়েছিল খুবই মারাত্মক। তার বাড়ি নিউ ইয়র্ক শহরে। ওখানকার মেডিকেল রিপোর্টও জোগাড় করেছি আমরা। তার হার্ট আগে থেকেই ভালো ছিল না, ডাইভিংয়ের অনুপযুক্ত।”

“তার মানে কথাটা ক্যাপ্টেন কুপারের কাছে গোপন রেখেছিল সে,” মুসা বলল। এখনো ঘুমের জড়তা রয়ে গেছে তার চোখেমুখে।

“ডা. হোল্ডিংসকেও জানায়নি,” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না তার। হার্টের এত খারাপ অবস্থা নিয়ে কেন ডাইভিংয়ের মতো বিপজ্জনক কাজ করতে এসেছিল টনি? সোনার লোভে কি তার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিও লোপ পেয়েছিল? আর জাহাজে চাকরি দেওয়ার আগে ডা. হোল্ডিংসই বা মেডিকেল চেকআপের সময় টনির হার্ট খারাপ ধরতে পারলেন না কেন?

“তোমরা এখন যেতে পারো,” উঠে দাঁড়ালেন সার্জেন্ট। “তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও।”

“বলুন, স্যার,” অধৈর্য ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। রাতের দুঃস্বপ্ন পেছনে ফেলে তাড়াতাড়ি বাইরের উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে সে।

“সান্তা হুয়ানের কোনো গুপ্তধন কি জাহাজে তোমাদের চোখে পড়েছে?”

বিস্ময়ে ভুরু উঁচু হয়ে গেল কিশোরের। সার্জেন্টের এত কৌতূহল কেন?

“না,” জবাব দিল মুসা। “ক্যাপ্টেন ভাবছেন, গুপ্তধনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি, তবে এখন পর্যন্ত কোনো দামি জিনিস চোখে পড়েনি আমাদের।”

ভ্রূকুটি করলেন সার্জেন্ট। হতাশ মনে হলো তাঁকে। কিশোর জিজ্ঞেস করল, “কোনো কিছু ভুল হয়েছে, স্যার?”

মাথা নাড়লেন সার্জেন্ট। এগিয়ে এলেন ছেলেদের দিকে। “কথাটা বোধহয় তোমাদের কাছে বলা উচিত হচ্ছে না। তবু

বলছি।” কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললেন, “কারণ, আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের দিয়ে আমার উপকার হবে। আমরা একটা সোনার আংটি পেয়েছি, যেটা আমাদের একজন স্থানীয় অপরাধী— লোকটার নাম ব্যারি গুড— এক সোনার দোকানে বিক্রি করেছে। জিনিসটা দেখে দোকানদারের সন্দেহ হওয়াতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তদন্তের স্বার্থে আমরা তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছি। আমাদের ধারণা, চোরাই মাল, যদিও ব্যারি দোকানদারকে বলেছে, ওটা সান্তা হুয়ানের জিনিস, ট্রেজার হান্টারের এক ক্রুর কাছ থেকে কিনেছে। এ ধরনের আরও জিনিসের জন্য সেই ক্রুকে টাকা দিয়েছে ব্যারি। দোকানদারকে বলেছে, জিনিসগুলো হাতে পেলেই তার কাছে বিক্রি করতে আনবে।”

“ছেলেটার নাম বলেনি?“ জানতে চাইল মুসা।

“রবিন মিলফোর্ড,” জবাব দিলেন সার্জেন্ট মার্ক। “ছেলেটা এখন নিখোঁজ।”

চমকে গেল কিশোর ও মুসা। ধাক্কাটা কাটানোর আগেই আবার বললেন সার্জেন্ট, “যত দূর জানি, এই মিলফোর্ড ছোকরাটা বেঁচে আছে এবং এই দ্বীপেই লুকিয়ে থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।”

আনমনে মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। রবিন বেঁচে আছে শুনে খুশি হয়েছে সে। মুসাও হয়েছে, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নিনাও হবে। কিন্তু অপরাধীদের সঙ্গে হাত মেলানোর খবরটা ওদের বিস্মিত করেছে।

“যা বললাম, কাউকে বলবে না,” সার্জেন্ট বললেন। ছেলেদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন দরজার কাছে। দু’জনের সঙ্গে হাত মেলালেন। তারপর নিচুস্বরে বললেন, “তোমাদের দেখে চালাক-চতুরই মনে হচ্ছে। জাহাজে গিয়ে নজর রেখো। যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে, আমার অনুরোধ, আমাকে জানিয়ো।”

“অবশ্যই, সার্জেন্ট,” চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর।

পার্কিং লটে নিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসা। হাত নেড়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

ছোটখাটো মানুষটিকে গুডবাই জানাল কিশোর ও মুসা। তারপর চলল নিনার ধূলিধূসরিত হ্যাচব্যাকের দিকে।

“কেমন আছ?” ছেলেরা গাড়িতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলে জিজ্ঞেস করল নিনা।

“ভালো!” মুসা বলল। “বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসাটা সত্যি আনন্দের। আমাদের নিতে আসার জন্য ধন্যবাদ, নিনা।”

নিনা জিজ্ঞেস করল, “কোনো খবর আছে?”

“হ্যাঁ!” দ্বিধা করতে লাগল মুসা। রবিনের খবরটা নিনাকে বলবে কিনা বুঝতে পারছে না।

স্টিয়ারিং হুইলে শক্ত হলো নিনার হাত। বেরিয়ে এলো পুলিশ স্টেশনের পার্কিং লট থেকে। “যা বলার বলে ফেলো।” গম্ভীর হয়ে গেছে নিনা, খারাপ কোনো খবর হবে, আঁচ করে

ফেলেছে। “তবে এবার আমি রাস্তার দিক থেকে নজর সরাব না।”

সব কথা নিনাকে খুলে বলল কিশোর। স্তব্ধ হয়ে শুনল নিনা। তারপর রেগে গেল, “দেখো, আমার ভাইকে আমি চিনি। একটা সুতো চুরি করার ছেলেও সে নয়। আর, যেখানেই থাক, লেখার মতো অবস্থায় থাকলে অবশ্যই আমাকে চিঠি লিখত।”

এ ব্যাপারে কিশোর আর মুসাও নিনার সঙ্গে একমত। ওদের ধারণা, রবিন কোনো বিপদের মধ্যে রয়েছে।

“আপনার ভাই কি ব্যারি গুড নামে কারও কথা আপনাকে বলেছে?” কিশোর জিজ্ঞেস করল।

“না।” নিনা জবাব দিল।

কিশোর লক্ষ করল, বন্দর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা। জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছেন?”

“জানো তো, জাহাজের কাজকর্ম আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ?”

“জানি,” মুসা বলল। “ক্যাপ্টেন নিশ্চয় রাগে উন্মাদ হয়ে গেছেন।”

মাথা ঝাঁকাল নিনা। “আদালতে গেছেন, আদেশটা বদলানোর জন্য। এই সুযোগে আমি একটা জিনিস যাচাই করে দেখতে চাই। আজ আমি আড়ালে থেকে ডিয়েগো আর ক্রিসের কথা শুনেছি। রবিনের কথা বলাবলি করছিল ওরা, সে নাকি এই দ্বীপেরই সি শোর নামে একটা হোটেলে আছে।”

“তার মানে, গিয়ে দেখতে চান কথাটা সত্যি কিনা?” মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল আবার নিনা। “জায়গাটা শহরের একটা কুখ্যাত এলাকায়। তাই একা যাওয়ার সাহস পাইনি, তোমাদের সঙ্গে নিয়েছি।”

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। দেখল, এয়ারপোর্ট পার হচ্ছে। দ্বীপের উত্তর দিকে চলেছে। শিগগির, দক্ষিণের পাঁচতারা হোটেলগুলো ও গলফ কোর্স চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল, তার জায়গায় দেখা গেল ছোট ছোট বিল্ডিং, সেগুলোও শেষ হয়ে শুরু হলো ছাউনির মতো করে বানানো বাড়িঘর। একেবারেই বস্তি অঞ্চল। অবশেষে চোখে পড়ল একটা বিল্ডিংয়ের গায়ে বড় একটা সাইনবোর্ড : সি শোর হোটেল। নিচে লেখা, রোজকার ভাড়া রোজ মিটিয়ে দিতে হবে।

“এসে গেছি,” নিনাকে বলল মুসা।

বাড়িটার সামনে ঘাসে ঢাকা জমির ওপর রাখা কতগুলো গাড়ির পাশে গাড়ি পার্ক করল নিনা।

তিনজনেই যখন বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। ধাক্কা খেয়ে মুসার গায়ের ওপর এসে পড়ল নিনা।

কিশোর কিছু করার আগেই নোংরা সোয়েট-শার্ট আর জিনস পরা দু’জন লোক হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো। একজনের হাতে টাট্টু আঁকা, আরেকজনের কানে একটা দুল।

নিনাকে আস্তে করে সরিয়ে দিল মুসা। কিশোর ততক্ষণে লোক দু’জনের পেছনে দৌড়াতে আরম্ভ করেছে। মুসাও পিছু

নিল। হোটেলের সীমার মধ্যেই কতগুলো গাছের জটলার দিকে ছুটেছে লোকগুলো। প্রথম গাছটার কাছে পৌঁছেছে ওরা, এ সময় ডাইভ দিল মুসা। একটা লোকের পা চেপে ধরে ওকে নিয়ে মাটিতে পড়ল।

দ্বিতীয় লোকটার কলার চেপে ধরল কিশোর। তারপর একটা হাত মুচড়ে ধরে ওকে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসতে বাধ্য করল।

“এই, কী করছ…” মুসার লোকটা উঠে বসতে শুরু করল। মুসার গলা পেঁচিয়ে ধরল এক বাহু দিয়ে। কিলবিল করে উঠল তার পেশিবহুল শরীরের পেশি। যে লোকটাকে কিশোর ধরেছে, সেও বাধা দিতে আরম্ভ করল। তাই মুসাকে সাহায্য করতে যেতে পারল না কিশোর।

হোটেলের বারান্দার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে নিনা, সে শব্দ খুব সামান্যই পৌঁছাল কিশোরের কানে।

“কিশোর!” আরও জোরে চেঁচিয়ে বলল নিনা। “তোমার পেছনে!”

এবার শুনতে পেল কিশোর। চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে গেল। দেখল বিশালদেহী এক লোক ধুপধাপ করে লন মাড়িয়ে ওদের দিকে আসছে।

লোকটার হাতে একটা বেজবল ব্যাট। সোজা ছুটছে কিশোরের দিকে।

ছয়

মুসা যাকে ধরেছে, তাকে ছেড়ে দিয়ে কিশোরকে সাহায্য করতে ছুটল মুসা। দেখল, কিশোরও তার লোকটাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু দুই গোয়েন্দাকে অবাক করে, ছাড়া পাওয়া লোক দুটো ওদের আক্রমণ করতে আসার বদলে ঘুরে দৌড় দিল। হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।

“শয়তান! বদমাশ!” চিৎকার করে দুই গোয়েন্দার পাশ কাটিয়ে ব্যাট নাচাতে নাচাতে লোকগুলোর দিকে তেড়ে গেল দৈত্যটা। “চোর! বাটপার! আবার যদি আসিস, মাথা ফাটিয়ে দেব!”

“হচ্ছেটা কী?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। “আপনি আমাদের তাড়া করেননি?”

থেমে গেল লোকটা। হাত থেকে ছেড়ে দিল ব্যাটটা। শব্দ করে ঘাসের ওপর পড়ল ওটা। মুসাকে বলল লোকটা, “তোমাদের তাড়া করব কেন? আমি তোমাদের চিনিই না।”

অবাক হয়ে লোকটার পেছন পেছন সিঁড়ির কাছে ফিরে এলো কিশোর-মুসা। নিনা সিঁড়ির ধাপে বসে কনুই ডলছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“দুই বাটপার খেয়েদেয়ে বলে, টাকা নেই,” দৈত্যটা জবাব দিল। “এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে, বিল দিতে পারে না। তখন ওদের তাড়া করে শরীরটা গরম করে নিই, ব্যায়াম হয়, দিনটা ভালো কাটে।”

বিশাল লোকটার ভুঁড়ি বেল্টের ওপর অনেকখানি ঝুলে আছে। দম নেওয়ার তালে তালে ভুঁড়িটাও দুলছে। কিশোর ও মুসাকে বলল, “তোমাদের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। আমার নাম কামিলা গিবসন।” ঘামে ভেজা মস্ত থাবা বাড়িয়ে দিল দৈত্যটা।

“আমি মুসা আমান,” লোকটার হাত ধরে ঝাঁকাল সে। “ও আমার বন্ধু, কিশোর পাশা। আর ও, নিনা জেরাল্ড।”

লোকটার ওজন কম করে হলেও সাড়ে তিন’শ পাউন্ড, অনুমান করল মুসা। এত ওজনের কারণে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। তিরিশের কাছাকাছি হবে হয়তো।

“এসো না, ভেতরে এসো সবাই, ঠান্ডা খাবে?” হাসিমুখে ওদের আমন্ত্রণ জানাল কামিলা। “লবিতে সোডা মেশিন আছে।”

লোকটাকে অনুসরণ করে কিশোর, মুসা আর নিনা একটা ছোট ঘরে ঢুকল। ভেতরে ছোট একটা কাউন্টার আর একটা সোডা মেশিন। চারটে ক্যান বের করল কামিলা। এক এক করে ওগুলোর ছিপি খুলল।

কামিলার বিশাল থাবায় ধরা একটা ক্যান হাতে নিল মুসা। “ভাবছি, কিছু তথ্য দিতে পারেন কিনা আপনি।” টি-শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল সে।

“তথ্য?” কামিলার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটায় সন্দেহ দেখা দিল।

“হ্যাঁ,” কিশোর বলল। “আমাদের একজন বন্ধুকে খুঁজছি। আমরা খবর পেয়েছি, দুই সপ্তাহ আগে এখানে ছিল সে। হয়তো তার কথা আপনি মনে করতে পারবেন।”

হাসি যেন দুই ভাগ করে দিল কামিলার মুখটা। “এটা তো দেখি আরেক কাহিনি। তোমরা এখানে থাকতে কিংবা খেতে আসোনি, বিনে পয়সার কাস্টমার, এটা আগে জানলে তোমাদের আমি বিনে পয়সায় সোডা খাওয়াতাম না।” মাথার পেছনটা ডলল সে।

“বেশ,” পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা বিশ ডলারের নোট কামিলার দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। “নিন। বিনে পয়সার কাস্টমার আর নই এখন। আপনার লেজারটা একটু দেখতে পারি, আমাদের বন্ধুর নাম লেখা আছে কিনা?”

মাথা ঝাঁকাল কামিলা, হাসিটা লেগেই আছে মুখে। বিশ ডলার পকেটে ভরে কাউন্টারে রাখা লেজার বুকটা ঘুরিয়ে দিল, যাতে কিশোর-মুসা আর নিনা দেখতে পারে। “বিশ ডলারে এই পর্যন্ত। আর কিছু জানতে হলে আরও টাকা লাগবে।”

লেজারের পাতা উল্টে যাচ্ছে কিশোর। তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে মুসা। “এই যে!” হঠাৎ বলে উঠল নিনা। একটা পাতার ওপর আঙুল রাখল।

মুসা আর কিশোরও দেখল। এন্ট্রি করা আছে : ৩১ জুলাই, সোমবার। নাম, রবিন মিলফোর্ড।

দ্রুত আরও সাতটা পাতা উল্টাল কিশোর। “রবিন এখানে তিন দিন থেকেছে। ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট।”

“আর ৩০ জুলাই নিখোঁজ হয়েছে সে,” বিড়বিড় করল নিনা। “মিলে যাচ্ছে। ৩০ তারিখে জাহাজ থেকে বেরিয়ে এখানে এসে উঠেছে। কিন্তু এটা তো তার হাতের লেখা নয়!”

“নিশ্চয়ই না,” ছোট্ট ঘরটায় গমগম উঠল কামিলার বাজখাঁই কণ্ঠ। “এটা তার হাতের লেখা হতে যাবে কেন? আমার হাতের লেখা। কাস্টমারের সইও আমার দরকার নেই। আমি আমার নিজের লেখা পড়ে ওদের নাম জানতে পারলেই খুশি।”

আবার লেজারের দিকে তাকাল মুসা। জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি রবিন মিলফোর্ডের কথা মনে করতে পারছেন?”

“তার সম্পর্কে কী জানতে চাও? ও তোমাদের বন্ধু বলছ?” সামান্য সরু হলো কামিলার চোখের পাতা। “আমি বলেছি, লেজার দেখা ছাড়া অন্য তথ্য জানতে হলে বাড়তি টাকা লাগবে।”

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরও বিশ ডলার বের করল কিশোর। কামিলা ওটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই নোটটা

সরিয়ে নিল। “আমাদের তথ্য দেওয়ার পর টাকাটা পাবেন। আমি বুঝে দেখতে চাই, আপনার তথ্যের কোনো দাম আছে কিনা।”

হাহ্ হাহ্ করে হাসল কামিলা। মাথা নাড়তে লাগল। “চালাক ছোকরা, অ্যাঁ? আমি বুঝতে পারছি না তোমাদের মতো ভালো ছেলেরা রবিন মিলফোর্ডের খোঁজ করছ কেন। যে দু’জন লোককে একটু আগে পালাতে দেখলে, রবিন তার চেয়েও খারাপ। খুব ভালো করে ওকে লক্ষ করেছি আমি।”

“এখানে কেউ তার সঙ্গে দেখা করেছে?” জানতে চাইল কিশোর।

ঘোঁত-ঘোঁত করে নাক টানল কামিলা। “এখানে কেউ কারও সঙ্গে দেখা করে না। রাতে ঘুমাতে আসে। সকালে উঠে চলে যায়। তার মতো ছেলের সঙ্গে যারা দেখা করতে চায়, তারা ডক ফ্রেন্ডে যায়।”

“ডক ফ্রেন্ডটা কী?”

“এয়ারপোর্টের পাশের একটা ডিসকো ক্লাব। এখন, আর কি কিছু জানার আছে তোমাদের?”

মুসা লক্ষ করল, কামিলার চোখ কিশোরের হাতের নোটটার দিকে। ওটা নিয়ে কামিলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নিন। আপনার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।”

“আসলে, একটা ভালো কাজ আরেকটা ভালোকে ডেকে আনে,” দার্শনিক উক্তি ঝাড়ল কামিলা। নোটটা দ্রুত পকেটে

চালান করে দিল। “আমি তথ্য দিয়ে তোমাদের সাহায্য করেছি, তোমরা টাকা দিয়ে আমার উপকার করলে।”

নিনাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর ও মুসা। নিনার গাড়িটার দিকে এগোল। দূর থেকেই গাড়ির উইন্ডশিল্ডে একটা কাগজ আটকানো দেখল মুসা। “ওটা কী?” চলার গতি বাড়িয়ে দিল সে। যে চোরগুলো খাবারের বিল না দিয়ে পালিয়েছিল, ওরাই কি হুমকি দিয়ে মেসেজ লাগিয়ে গেছে?

“অন্য কাগজও হতে পারে,” কিশোর বলল। “বাতাসে উড়িয়ে এনে ফেলেছে।”

কাছে এসে দেখা গেল, বাতাসে আনেনি, উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের নিচে কাগজটা স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। ছোট কাগজের টুকরোটা খুলে নিল মুসা।

“এসব থেকে দূরে থাকবে,” কাগজের লেখা জোরে জোরে পড়ল মুসা। “যা ঘটছে, তার সমাধান করা তোমার সাধ্যের বাইরে।”

“যাদের তাড়া করেছিলাম, তারাই লিখেছে,” বলল সে। “কাপুরুষের দল। সামনাসামনি লাগতে আসার সাহস নেই, কাগজে লিখে হুমকি দেয়।”

“দেখি তো,” হাত বাড়াল কিশোর। মেসেজের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলল। “আশ্চর্য!”

“কী আশ্চর্য?” মুসার প্রশ্ন।

“শুধু ‘তোমার’ সাধ্যের বাইরে লিখল কেন? আমাদের বললে তো বলা উচিত ছিল ‘তোমাদের’ সাধ্যের বাইরে?”

“তাড়াহুড়োয় ব্যাকরণ ভুল করেছে হয়তো।”

কিন্তু মুসার জবাবে কিশোর সন্তুষ্ট হতে পারল না। বলল, “আরেকটা জিনিস, লেখাটা লোকগুলোর নয়। দেখো, চিনতে পারো কিনা?”

মুখ বাড়িয়ে দেখতে এলো মুসা আর নিনা। মেসেজের লেখা দেখে নিনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এমন ভঙ্গিতে গাড়ির গায়ে হেলান দিল, যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

“কী হলো?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল মুসা।

মেসেজটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিল কিশোর। “এখনো চিনতে পারছ না?”

ভালোমতো দেখে মুসার চোখও বড় বড় হয়ে গেল। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “রবিন!”

“হ্যাঁ, রবিন!” গলা কাঁপছে নিনার। “প্রতি সপ্তাহে আমার কাছে চিঠি লিখত সে, বলেছিলাম না?”

“যে অবস্থাতেই থাকুক,” ভারী দম নিয়ে নিনা বলল, “রবিন যে বেঁচে আছে, এতেই আমি খুশি। গাড়িটা এখন তুমি চালাবে, কিশোর? আমি পারব না, পারার অবস্থা নেই।”

গাড়িতে চড়ে কিশোর বলল, “কোথাও থেমে খেয়ে নেওয়া দরকার। তারপর জাহাজে ফিরতে হবে। ক্রুদের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি, বিশেষ করে বিষের সঙ্গে।”

“এতটা বদলে গেল কী করে রবিন, আমি বুঝতে পারছি না,” মনে হলো কেঁদে ফেলবে নিনা। “কোনো দিন কোনো খারাপ কাজ করেনি সে।”

“দুশ্চিন্তা করবেন না, নিনা,” সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল মুসা। “কিসের মধ্যে আছে রবিন, কিছুই জানি না আমরা। তার সঙ্গে দেখা হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

#####

সাত

মেরিনার পার্কিং লটে যখন গাড়ি ঢোকাল কিশোর, অন্ধকার হয়ে আসছে তখন। গাড়ি থেকে নেমে আগে আগে চলল সে। ট্রেজার হান্টারের গ্যাংপ্ল্যাংক বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল তিনজনে।

“কেউ নেই এখানে,” ডেকে উঠে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দুই সঙ্গীকে বলল কিশোর।

“চলো, লাউঞ্জে গিয়ে দেখি,” বলে কম্প্যানিয়নওয়ের দিকে এগোল নিনা।

ছুটির সময় সবাই লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে। ঢুকেই কিশোরের চোখ পড়ল ডিয়েগো আর বার্নির ওপর। চেয়ারে বসে তাস খেলছে। দু’জনের মাঝখানে টেবিলে বড় একটা বাটিতে রাখা পটেটো চিপস, অর্ধেক খালি। এক কোণে একটা আর্মচেয়ারে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে ক্রিস, আর রেডিওতে ক্যারিবিয়ান মিউজিক শুনছে।

সবাইকে বেশ আনন্দিত মনে হলেও আসলে কেউ আনন্দে নেই। কারণ, আগের দিন একটা মৃত্যু ঘটেছে জাহাজে। ওরা আসলে কিছু একটা করে ভুলে থাকার চেষ্টা করছে।

“এই যে, তোমরাও এসেছ!” হাতের তাসগুলো টেবিলে ছড়িয়ে রেখে বলল বার্নি। “ডাইভিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে আদালতে গেছেন ক্যাপ্টেন। তাই আমরা এখানে বসে বিকেলটা কাটানোর চেষ্টা করছি। তোমরা খেলবে?”

“খেলব,” মুসা গিয়ে বসল ওদের সঙ্গে।

তাস শাফল করতে লাগল বার্নি, একটা টুথপিক কামড়াতে কামড়াতে তার হাতের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ডিয়েগো। রান্নাঘর থেকে একটা সোডা নিয়ে এসে নিনাও টেবিলে বসল মুসাদের সঙ্গে। একটা ম্যাগাজিন নিয়ে কিশোর বসল ক্রিসের পাশে। ইজি চেয়ারে বসার সময় ক্রিসের হাতের দিকে তাকাল সে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ক্রিসের আঙুলে আংটিটা নেই।

“আংটিটা হারিয়ে ফেলেছেন?” সবাই তাস খেলায় মন দেওয়ার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মুখ তুলল ক্রিস। “উঁ? না!” অস্বস্তিভরা হাসি হাসল ক্রিস। “যা সব ঘটছে, তাতে আমার মনে হয়েছে আংটিটা হাতে রাখা নিরাপদ নয়। তাই আমি নিরাপদ জায়গায় রেখে দিয়েছি।”

সার্জেন্ট মার্কের কথা মনে পড়ল কিশোরের। তিনি বলেছেন, জাহাজের একজন ক্রু ব্যারির কাছে সোনার আংটি বিক্রি করেছে।

চোখ তুলতেই ডোরিকে দেখতে পেল কিশোর। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢোকানো।

“মনে হচ্ছে অলস সময়ই কাটাতে হবে আমাদের,” বলল সে, তবে নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। কিশোরের ওপর দৃষ্টি স্থির হলো। “তারপর, থানায় কেমন সময় কাটল? তোমাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছিল নাকি?”

বিব্রত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসল কিশোর। “জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। করোনারের রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে টনি।”

বইয়ের তাকে ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্রিস। “এক্সকিউজ মি,” ডোরিকে সরতে ইঙ্গিত করল সে, সরু দরজায় পাশ কাটাতে গেলে গায়ে গা ঠেকে যায়। “আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।”

ওকে যেতে দেখল কিশোর। এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো মুসার সঙ্গে। বুঝতে পারছে, সে যা ভাবছে, মুসাও তাই ভাবছে। ক্রিসের সঙ্গে ডোরির রেষারেষি আছে, নাকি ডোরিকে দেখে কোনো কারণে অস্বস্তি বোধ করছে এককালের রাঁধুনি?

“পয়জনের আচরণে কিছু মনে কোরো না,” ক্রিস চলে গেলে ডোরি বলল। “মাঝেমধ্যে মেজাজি হয়ে ওঠে সে। আর ওকে যে রান্নার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এই মেজাজও তার একটা কারণ।”

ওই মুহূর্তে ক্যাপ্টেনের ভারী পদশব্দ শোনা গেল প্যাসেজওয়েতে। তার সিংহের মতো কেশরওয়ালা মাথাটা উঁকি দিল দরজায়। “গুড ইভনিং,” কর্কশ কণ্ঠে বললেন তিনি। কিশোর লক্ষ করল, ক্যাপ্টেনের পরনে খাকি ট্রাউজার, গায়ে সদ্য ইস্ত্রি করা হাতাকাটা শার্ট। এই প্রথম তাঁকে শার্ট পরা অবস্থায় দেখল কিশোর ও মুসা।

“নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে,” ঘোষণা করলেন তিনি। “কাল সময়মতোই ডাইভিং করতে পারব আমরা। প্রথম শিফটে যাবে ডিয়েগো আর নিনা। বিকেলের শিফটে যাবে কিশোর আর ডোরি। এটা শোনার পর, আমি তোমাদের জায়গায় হলে, ঘুমোতে যেতাম। সকাল ঠিক সাতটায় ডেকে আসবে।”

হঠাৎ যেমন উদয় হয়েছিলেন, হঠাৎ করে আবার উধাও-ও হয়ে গেলেন তিনি।

“যাক, ভালো লাগল শুনে,” হাতের তাসগুলো টেবিলের মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলল বার্নি। “কাল আমাকে ডুব দিতে হবে না, সেটাও একটা খুশির খবর। কী বলো, মুসা?”

“কী জানি, আমি বুঝতে পারছি না,” অনিশ্চিত ভঙ্গিতে নিজের হাতের তাসগুলো বার্নির তাসগুলোর ওপর রাখল মুসা, উল্টো করে। “মাঝেমধ্যে সাগরের তলাতেই নিশ্চিন্ত মনে হয় আমার।”

পরদিন দুপুর। নিনা আর ডিয়েগোর মর্নিং শিফটটায় উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। তারপর যখন ঘণ্টাগুলো ধীরগতিতে পার হতে লাগল, আর ঢেউয়ে দুলন্ত জাহাজটাকে তাতিয়ে আগুন করে দিল ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোদ, ক্যাপ্টেনের মেজাজও তেতে আগুন হতে লাগল।

“এখনো স্যুট পরছ না কেন?” ডেকে দাঁড়ানো কিশোরের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন তিনি। আগে যেখানে তল্লাশি চালিয়েছিল, সে জায়গাটা থেকে পশ্চিমে কিছুটা দূরে সরে এসেছে জাহাজ। ডিয়েগোর কাছে শুনেছে কিশোর, ডা. হোল্ডিংসের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নতুন এই জায়গাটায় খোঁজ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্যাপ্টেন।

দ্বীপ থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙর ফেলল ট্রেজার হান্টার। ডাইভিংয়ের সরঞ্জাম পরে নিল কিশোর। বারবার পরীক্ষা করে দেখল যন্ত্রপাতিগুলো। দুটো বাজে। দুপুরের কড়া রোদে ডেকে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে সে। তার চারপাশে ঢেউগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে আসছে ছোট্ট জাহাজটার দিকে। জাহাজকে দোলাচ্ছে, সেই সঙ্গে দোলাচ্ছে জাহাজের যাত্রীদের।

“এগুলো নাও,” রুক্ষ কণ্ঠে আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। দুটো মার্কার তুলে দিলেন কিশোরের হাতে। “গাধা নবিশের দল! তোমাদের প্রতিটি কথা বলে দিতে হবে নাকি আমার?”

ক্যাপ্টেনের অকারণ ধমককে অগ্রাহ্য করল কিশোর। দুটো মার্কার দুই হাতে নিয়ে ওজন করে দেখল। দুটোই সমান মনে হচ্ছে। মার্কারগুলো বেল্টে ঝুলিয়ে নিল। তারপর ডোরির সঙ্গে একসঙ্গে রেলিংয়ের দিকে পিছিয়ে গেল। কিশোর নিয়েছে এয়ার লিফট আর ডোরি ম্যাগনেটোমিটার।

“রেডি, পার্টনার?” লাজুক সঙ্গীকে বলল কিশোর। ওকে অবাক করে দিয়ে হাসির বদলে ভুরু কোঁচকাল ডোরি। কোনো কারণে খেপে আছে সে। কারণটা কী? ডোরির খেপার পেছনে অশুভ কিছু কাজ করছে কিনা বুঝতে পারছে না।

আপাতত বিষয়টা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে উল্টো হয়ে ডিগবাজি খেয়ে পানিতে পড়ল সে। সাগরের ঠান্ডা পানি বড়ই স্বস্তিদায়ক। যতই নিচে নামতে লাগল, নিঃসীম নীরবতা যেন গ্রাস করল ওকে। এটা ভালো লাগল তার।

সাগরের এই অংশের পানি ঘন নীল। বেশি নিচে নামার আগেই হেডল্যাম্প জ্বালতে হলো। এখানে উজ্জ্বল রঙের মাছের সংখ্যা কম। দু’জনের ল্যাম্পের আলোয় বড় আকারের মাছ দেখতে পেল ওরা, লেজ দুলিয়ে ধীরে ধীরে বিচরণ করছে অদ্ভুত এক নিঃশব্দ জগতে।

ক্যাপ্টেন কি এই জায়গাটার খবর জানেন? হেডল্যাম্পের আলো নিচের দিকে তাক করে সাগরের তলা দেখার চেষ্টা করল কিশোর। সামনে কিছুটা দূরে একটা খাদ। খাদের কিনার তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। সাগরের অতল গভীরে নেমে গেছে তলদেশ। সেখানে ঘন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না।

ডোরির দিকে তাকাল কিশোর। খাদটাকে মনে হচ্ছে তলাবিহীন। সান্তা হুয়ান যদি ওখানে ডুবে থাকে, তাহলে সোনা পাওয়ার আশা চিরতরে ত্যাগ করতে হবে ক্যাপ্টেনকে।

খাদের কিনারে এগিয়ে গেল ডোরি। পেছনে রইল কিশোর। ডোরির আচরণ ওকে বিরক্ত করছে। কিছুটা সময়ের জন্য আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো। খাদের কিনার ধরে উল্টো দিকে এগিয়ে চলল সে। অন্ধকার পানিতে কিছু দেখা কঠিন। সমতল

বালি কিংবা বালির ঢিবিতে কিছু থেকে থাকলে সেটা বোঝাও কঠিন।

হঠাৎ পানিতে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল কিশোরের। দু-এক ফুট সাঁতরে এগিয়ে মাস্কের ভেতর দিয়ে ভালোমতো তাকাল।

একটা শিলাস্তরের নিচ থেকে সাদা রঙের কী যেন বেরিয়ে রয়েছে। ওটার কাছে এসে ধরে টান দিল। সহজেই খুলে এলো জিনিসটা। চিনতে পারল, ট্রেজার হান্টারের একটা মার্কার।

কিন্তু সেটা অসম্ভব, ভাবল কিশোর। ও যত দূর জানে, এখানে কখনো কুপারের জাহাজ থেকে ডাইভিং করা হয়নি।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে, বেল্ট থেকে একটা মার্কার খুলে নিল কিশোর। পাথরের নিচে যে মার্কারটা পেয়েছে, সেটার সঙ্গে ওজন করে দেখল। পানির নিচেও বুঝতে পারল, নতুন মার্কারটার ওজন বেশি। ক্যাপ্টেনের দেওয়া মার্কারটা নতুন মার্কারটার জায়গায় রেখে দিল, আর অপেক্ষাকৃত ভারী মার্কারটা বেল্টে ঝোলাল।

ঠিক এই সময় ডোরিকে চোখে পড়ল। বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে। পানিতে ম্যাগনেটোমিটার নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সাঁতরে এলো কিশোর। অধৈর্য দৃষ্টিতে ডোরি ওকে সংকেত দিতে লাগল কাজ করার জন্য। মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোর বোঝাল, বুঝতে পেরেছে সে। এয়ার লিফট ভ্যাকুয়াম হাতে ডোরিকে অনুসরণ করল।

রহস্যময় মার্কারটা যেখানে পেয়েছে, তার উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওকে ডোরি। বিষয়টা ভালো লাগছে না কিশোরের। ডোরিকে বিশ্বাস করবে কিনা, তাও বুঝতে পারছে না। তবে বিশ মিনিট ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর সিগন্যাল দিতে আরম্ভ করল ম্যাগনেটোমিটার।

বালিতে অর্ধেক দেবে থাকা কঠিন আবরণে ঢাকা দুটো জিনিস দেখা গেল, একেবারে খাদের কিনারে। কিশোর দেখল, জিনিসগুলো ছোট, তবে একই রকম দেখতে। তার কাছে মূল্যবান বলেই মনে হলো।

বালি থেকে সেগুলো খুঁড়ে তুলে নিল সে। হাত উঁচু করল ডোরিকে দেখানোর জন্য। কিন্তু সাঁতরে কাছে আসার সময় কিশোরের হাতে ডোরির হাতের বাড়ি লাগল। পানিতে উড়ে যাওয়ার মতো লাফিয়ে উঠল জিনিস দুটো। থাবা দিয়ে একটা ধরে ফেলল কিশোর, আরেকটা পড়ে গেল গভীর খাদের মধ্যে।

হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় জিনিসটার দিকে তাকিয়ে হতাশা চাপার চেষ্টা করল কিশোর। নিশ্চয় ওটা খুব মূল্যবান। মিউজিয়ামে রাখার মতো, মনে হলো তার।

ডোরির দিকে তাকাল। আফসোস করার ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল ডোরি। তারপর দুর্ঘটনাটার জন্য মাপ চাওয়ার ভঙ্গি করল। মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বাকি একটা জিনিস তার জালের ব্যাগে ভরল। ওঠার সময় হয়েছে, ইঙ্গিতে বোঝাল সে। যে জিনিসটা পেয়েছে, সেটাকে আর হারাতে চায় না। তাই কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

পানির ওপরে মাথা তুলে কিশোর দেখল, ক্যাপ্টেনসহ অনেকেই রেলিংয়ের কিনারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে রয়েছে। ডাইভাররা কী তুলে আনে, দেখার জন্য উদগ্রীব।

“মনে হয় কিছু একটা পেয়েছি,” ডেকে উঠে খোলা বাতাসে দম নিয়ে বলল কিশোর। ব্যাগ থেকে বের করে দেখাল জিনিসটা। তার পাশে দাঁড়ানো ডোরি, ভ্রূকুটিতে কুঁচকে রয়েছে মুখ। সেদিনের জন্য কিশোরের হিরো হয়ে যাওয়াটা বোধহয় সহ্য করতে পারছে না।

“এটাই শুধু পেলে?” কিশোরের হাত থেকে জিনিসটা প্রায় কেড়ে নিলেন ক্যাপ্টেন।

“হ্যাঁ, শুধু এটাই,” জবাব দিল কিশোর। ডোরি কিছু বলল না। দু’জনের কেউই হারিয়ে যাওয়া জিনিসটার কথা বলে ক্যাপ্টেনকে হতাশ করতে চাইল না।

জিনিসটা এক নজর দেখার জন্য ক্যাপ্টেনকে ঘিরে ধরল সবাই। দেখতে অনেকটা ক্রুসের মতো। অতি খুদে জাতের শামুক জমে একটা পিণ্ডের মতো করে ফেলেছে। কিশোর লক্ষ করল, ডোরি আর ডা. হোল্ডিংস জিনিসটার দিকে সন্দেহভরা চোখে তাকাচ্ছেন।

“দেখে ইন্টারেস্টিংই মনে হচ্ছে,” নীরস কণ্ঠে বললেন ডা. হোল্ডিংস। “তবে, সাফটাফ করে শেষে দেখা যাবে হয়তো এর কোনো মূল্যই নেই, নেহাতই একটা আবর্জনা।”

“প্রার্থনা করি, সেরকম কিছু যাতে না হয়,” ক্যাপ্টেন বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন আশার আলো দেখতে পেয়েছেন তিনি। “পয়জন, একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফেলো। কাল রাতে বন্দরে পৌঁছেই আগে এটা ল্যাবে পাঠাব।”

“আই-আই, স্যার,” ক্রিস জবাব দিল জাহাজিদের ভঙ্গিতে।

পিছিয়ে নিনা আর মুসার কাছে সরে এলো কিশোর, ভিড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। নিচুস্বরে বিড়বিড় করে বলল, “এসো আমার সঙ্গে। তোমাদের একটা জিনিস দেখাব।”

নিচতলায় তার কেবিনে ওদের নিয়ে এলো কিশোর। প্রথমেই দরজাটা লাগিয়ে তালা আটকে দিল। পরনে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেগুলো খুলে একটা টেরি ক্লথের তৈরি ঢোলা গাউনের ওপর রাখল। তারপর ব্যাগ হাতড়াতে লাগল। বের করে আনল কালো প্লাস্টিকের বাক্সটা।

“এটার কথা মনে আছে?” মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। “এটাকে তুমি এয়ারপোর্টে ফেলে আসতে চেয়েছিলে?”

“কাজে লাগে না, কী করব,” কৈফিয়তের সুরে জবাব দিল মুসা।

“এবার লাগবে,” কিশোর বলল। “এটা একটা সোনার গজ,” নিনাকে বোঝাল সে। “সোনার ব্যবহার করে এটা পানির গভীরতার নিখুঁত রিডিং দেয়। এছাড়া আরও একটা কাজ করে, আশপাশে আরও কোনো সোনার থেকে থাকলে সেটা শনাক্ত করে। এই বোতামটা টিপে আমি যন্ত্রটা চালু করতে পারি, কিংবা

ন্য কোনো সোনার চালু থাকলে সেটাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারি।”

“আমি মেরিন আর্কিওলজিস্ট, এটা দিয়ে কী হয় জানি আমি,” অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল নিনা। “কী করবে এখন?”

লেখার টেবিলে রাখা রেডিওটা চালু করে দিল কিশোর। শব্দে ভরে গেল ছোট্ট ঘরটা। গাউনের ওপর রাখা যন্ত্রপাতিগুলো থেকে মার্কারটা তুলে নিল সে। রেডিওর পাশে রাখল। কালো যন্ত্রটা তাক করল ওটার দিকে। যন্ত্রের পাশে লাগানো লাল বোতামটা টিপে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে মার্কারটা বিপ বিপ শব্দ করতে লাগল।

মার্কারটার দিকে তাকিয়ে রইল নিনা ও মুসা।

“তার মানে ওটার ভেতর সোনার ভরা আছে,” নিনা বলল।

“হ্যাঁ,” জবাব দিল কিশোর। পানির নিচে জিনিসটা পাওয়ার পরই আন্দাজ করেছিল, এখন নিশ্চিত হলো।

#####

আট

“জাহাজের কেউ গোপনে এই সোনারওয়ালা মার্কার দিয়ে চিহ্ন রেখে এসেছে,” কিশোর বলল। “গুপ্তধন রয়েছে ওখানে।”

“কিন্তু এ কাজ কেন করবে কেউ?” বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা, বোঝার চেষ্টা করছে।

“আমি এখনো শিওর নই,” জবাব দিল কিশোর। কালো বাক্সটা আবার ব্যাগে ভরল। মার্কারটা সযত্নে আলমারিতে লুকিয়ে রাখল।

মুসা তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। বুঝতে পারছে, কী করতে চায় কিশোর। আগামীকাল আবার ডুব দিলে, মার্কারটা যেখানে ছিল সেখানে রেখে আসবে, যাতে সরানো যে হয়েছে টের না পায় কেউ। কেউ বলতে, যে লোক মার্কারটা ওখানে রেখেছে, সে।

“হয়তো ক্যাপ্টেন কুপারই রেখেছেন, নাবিকদের গুপ্তধনের ভাগ দিতে চান না,” নিনা বলল। “হয়তো তিনি সুযোগমতো কোনো সময়ে একা ফিরে এসে সোনারগুলো তুলে নেবেন।”

“হতে পারে,” কিশোর বলল। “কিন্তু তিনিই আজ আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। যে জিনিস তিনি লুকিয়ে রাখতে চান, সোজা সেটার কাছে আমাদের নিয়ে আসবেন কেন?”

মাথা ঝাঁকাল মুসা। “তোমার কথায় যুক্তি আছে। তবে একটা মূল্যবান সূত্র পেয়েছি আমরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো এই বিষয়টার সঙ্গে রবিনের নিখোঁজ হওয়ারও কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, যা আমরা এখনো জানি না।”

নিনার দিকে তাকাল সে। রবিনের কথা উঠতেই বিষণ্ণ হয়ে গেছে নিনা। “আমি যাই। কিছু মুখে দিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব,” বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। “তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?”

“ভালো বলেছেন,” মুসা তার পেছন পেছন দরজার দিকে চলল। কিছু খাওয়া দরকার।

ডাইনিং রুমে এখনো নিজে-নিয়ে-নিজে-খাও পরিস্থিতি চালু আছে। সুতরাং নিজের ইচ্ছেমতো তিনজনের জন্য তিনটে বিরাট সাইজের বার্গার বানাল মুসা। “বার্গারের সঙ্গে চিপস হলে মন্দ হয় না,” খাবারে ভর্তি একটা কাগজের প্লেট বড় টেবিলটায় রেখে নিনার দিকে ঠেলে দিল সে। কিশোরের বার্গারটা নিনারটার চেয়ে বড়। মুসা বলল, “আজ সকালেই দ্বীপ থেকে তাজা টমেটো নিয়ে আসা হয়েছে, আমি দেখেছি। আর ভেতরে যে মাস্টার্ডটা দিয়েছি, ওটা দক্ষিণ ফ্রান্স থেকে আনানো।”

“ধন্যবাদ, শেফ আমান,” সামান্য মাথা নুইয়ে রসিকতার ঢঙে বলল নিনা। “সবই আছে, শুধু বেহালার মিউজিকটা মিস করছি।”

“যদি চান, সেটাও বাজিয়ে শোনাতে পারি,” নিজের প্লেটটা টেবিলে রেখে, চেয়ার টেনে বসল মুসা। “কিন্তু বিফের স্বাদ বেহালার করুণ পোঁ-পোঁতে নষ্ট হয়ে যাবে।”

চেয়ারে বসার পর, মুসা লক্ষ করল, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস। কিশোর, মুসা আর নিনাকে চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে যেতে লাগল সে।

“হেই, ক্রিস, দাঁড়ান দাঁড়ান,” মুসা বলল। “আমরা আপনাকে কামড়াব না। আসুন। কিছু খাবার এখনো অবশিষ্ট আছে, আপনাকেও বার্গার বানিয়ে দিতে পারব।”

দরজা থেকেই জবাব দিল ক্রিস, “এখানে যে কেউ আছে, বুঝতে পারিনি। থাক, নিজের ঘরে গিয়েই খাব।”

“ভেতরে আসুন,” উঠে গিয়ে ক্রিসের সামনে দাঁড়াল কিশোর। “আপনার সঙ্গে কথা আছে।”

“কী কথা?” সন্দিহান হয়ে উঠল ক্রিস।

হাসল কিশোর। “কাল আমরা দ্বীপের উত্তর ধারে গিয়েছিলাম। এলাকাটা নিশ্চয় আপনার চেনা।”

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ক্রিসের। “উত্তর ধারে? ওখানেই তো আমি বড় হয়েছি।”

“তাই নাকি?” মুখের বার্গারটা তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল মুসা। “তাহলে সি শোরের কথা তো আপনি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন।”

“তোমার কী মনে হয়?” হাসল ক্রিস। হাসিটা দুর্বল। বোঝা গেল, এভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে ভালো লাগছে না তার।

“আমার মনে হয়, ওটা একটা হোটেল,” বলল মুসা। “চালায় কামিলা গিবসন নামে একজন লোক।”

মাথা নাড়ল ক্রিস। আবার বারান্দায় পিছিয়ে গেল। “চিনি না। অনেক দিন ওখানে যাই না।”

“কিন্তু কালকেই যে এ ব্যাপারে আপনাকে ডিয়েগোর সঙ্গে কথা বলতে শুনলাম?” রুক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল ক্রিস। সিঁড়ির দিক থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ক্রিস বলল, “অন্য কাউকে বলতে শুনেছ, আমাকে নয়। আমি যাই, পরে দেখা করব।”

দরজায় এসে দাঁড়াল ডিয়েগো, এই সুযোগে পালাল ক্রিস। ডিয়েগো বলল, “কী ব্যাপার, আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল মনে হয়?”

নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা আর নিনা। ডিয়েগোকে দেখে নিরীহই মনে হচ্ছে। কিন্তু মুসা ভালো জানে, এ জাহাজের কাউকেই নিরীহ ভাবা উচিত নয়।

“আমরা সি শোর হোটেলের কথা বলছিলাম,” কিশোর বলল। “তুমি কি জায়গাটা চেনো?”

হেসে উঠল ডিয়েগো। রান্নাঘরের দিকে এগোল। “আমি এ দ্বীপের কিছুই চিনি না। কুপার এমন খাটানো খাটায়, জাহাজ থেকে নামারই সুযোগ পাই না। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমাকে তাস খেলায় ব্যস্ত রাখে বার্নি।”

“গতকাল তুমি সি শোর হোটেল আর রবিন মিলফোর্ডকে নিয়ে পয়জনের সঙ্গে আলোচনা করছিলে,” নিনা বলল।

“অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ আমি নিজের কানে শুনেছি।”

“তাতে কী হয়েছে?” টেবিলের কাছে ফিরে এসেছে ডিয়েগো। হাতে এক ব্যাগ নোনতা বিস্কুট আর সোডা। “আমি বাবা কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই, পেট ছাড়া। পেট ভরল তো সব ভরল।”

খাওয়া শুরু করল ডিয়েগো। ওকে দেখে মোটেও অপরাধীর মতো লাগছে না, মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো সে। তার মতোই দ্রুত খেতে পারে ডিয়েগো। খায়ও বেশি। নিনাও তাকিয়ে আছে ডিয়েগোর দিকে।

ভাইয়ের জন্য উদ্বেগে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে নিনা, মুসা ভাবল। কিশোরের দিকে তাকাল। মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মুসা বুঝল, ডিয়েগোকে নিয়ে সে যা ভাবছে, কিশোরও তাই ভাবছে।

“রেস্টুরেন্ট আজকের মতো বন্ধ,” উঠে দাঁড়িয়ে হালকা ভঙ্গিতে রসিকতার সুরে বলল মুসা। টেবিল থেকে প্লেটগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে লাগল। “ঘুমানোর সময় হয়েছে। কাল হয়তো নতুন কিছুর সন্ধান পাব।”

দুই গোয়েন্দা আর নিনাকে হতাশ করে দিয়ে সকাল-বিকেলের দুটো ডাইভই অসফল হলো। তিনজনের কাউকেই ডাইভিংয়ে পাঠালেন না সেদিন ক্যাপ্টেন। তাই সোনারওয়ালা মার্কারটাও আর জায়গামতো রাখা হলো না। সে রাতে বন্দরে ভেড়ানো হলো জাহাজ, ডা. হোল্ডিংস কিশোরের খুঁজে পাওয়া

জিনিসটা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে গেলেন এবং পরদিন ডাইভিংয়ের জন্য চার্টে আরেকটা নতুন স্থান খুঁজে বের করলেন ক্যাপ্টেন।

শনিবার নাগাদ, ক্যাপ্টেনের মাথার স্থিরতা নিয়ে সন্দেহ হতে লাগল মুসার। গুপ্তধন খুঁজে বের করার জন্য হাতে মাত্র আর একটা সপ্তাহ সময় আছে। আর এ কয় দিনে মুসা বুঝে গেছে এই অপারেশনটার জন্য কী পরিমাণ খরচ হয়।

“আমি যদি কুপার হতাম, আর সাগর থেকেই আয় করতে চাইতাম, তবে গুপ্তধন খোঁজার চেয়ে অনেক সহজ কোনো কাজ খুঁজে বের করতাম,” নিনাকে বলল মুসা। ট্রেজার হান্টার তখন ধীরগতিতে বন্দরের দিকে চলেছে। ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপরে, আকাশের অনেক নিচে ঝুলে রয়েছে যেন গোল চাঁদটা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। অপূর্ব সুন্দর একটা সন্ধ্যা। ডেকে বসে ভীষণভাবে উপভোগ করতে পারত ওরা এই সৌন্দর্য যদি রবিন নিখোঁজ না হত, আর ক্যাপ্টেন কুপার ওদের ঘাড়ে চেপে না থাকতেন।

পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে শুনল মুসা। চেয়ারে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিশোর আসছে। কোনো কারণে অস্থির মনে হচ্ছে ওকে।

“কী হয়েছে?” রেলিংয়ের ওপর পা তুলে দিল মুসা।

“মার্কারটা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় আছি,” নিচুস্বরে জবাব দিল কিশোর। দু’জনের পাশে বসে পড়ল সে। “যে রেখেছে ওটা, সে কিছু বোঝার আগেই আবার আগের জায়গায় রেখে দিতে চাই।”

“হয়তো আগামী হপ্তায় আবার আমরা ফেরত যাব ওখানে,” নিনা বলল। “ক্যাপ্টেন হয়তো পুরো সপ্তাহটাই ওখানে কাটাবেন।”

“যদি যান। কিন্তু যদির ওপর নির্ভর করে ঝুলে থাকতে পারি না আমরা,” কিশোর বলল। “আর তিনি যদি জেনেই থাকেন ওখানে গুপ্তধন আছে, কাউকে সেটা জানতে দিতে না চান, তাহলে সহজে আর যাবেন না।”

“কিন্তু একবার কেন গেলেন, সেটাও রহস্যময়,” মুসা বলল। “কাল আমাদের ছুটি। এক কাজ করি চলো, একটা বোট ভাড়া করে নিজেরাই চলে যাই। সবাই যখন বন্দরে থাকবে, এই সুযোগে আমরা মার্কারটা জায়গামতো রেখে আসব।”

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা মনে পড়ল মুসার। “ভাবছি, মৃত্যুর আগে টনি বলেছে— মার্কারটার কথা আমাদের বাদে আর মাত্র একজন লোককে বলেছে— কাকে বলেছে?”

কিছু বলতে যাচ্ছিল কিশোর, কিন্তু তিনজনকেই চমকে দিয়ে পেছন থেকে বাধা দিল একটা কণ্ঠ, “এই, কিশোর, একটা মিনিট সময় দিতে পারবে?” ওদের দিকে আস্তে আস্তে হেঁটে এলো ডিয়েগো।

“হ্যাঁ, ডিয়েগো,” ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিশোর— ডিয়েগো ওদের কথা শুনে ফেলল কিনা বুঝতে পারছে না। “কাল কী করে কাটাব আমরা, সেই আলোচনা করছিলাম।”

“আমিও তোমাদের এই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে এলাম,” ডিয়েগো বলল, দাঁত খোঁচানোর খিলালটা জিব দিয়ে ঠোঁটের এক

কোণ থেকে আরেক কোণে সরিয়ে দিল সে। “আমি আর বার্নি কাল বিকেলে মোটরবোট রেস দেখতে যাব। তোমরা যাবে?”

“আমরা দিনের বেলা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকব,” মুসা জবাব দিল। নিনাকে চুপ থাকতে ইশারা করল সে। কারণ ডিয়েগো সি শোর হোটেল চেনে না বলাতে তার ওপর সন্দেহ জন্মেছে নিনার। ডিয়েগোর সঙ্গে কথা বললে এখন উল্টোপাল্টা কিছু বলে বসতে পারে, তাতে জটিলতা সৃষ্টি হবে।

“আজ রাতে আমরা ডিসকোতে যাব,” মুসার ইশারাকে উপেক্ষা করে নিনা বলল। “ডক ফ্রেন্ড বারের নাম শুনেছ?”

অবাক হলো ডিয়েগো। “ক্রিস আমাকে ওটার কথা বলেছে। জায়গাটা নাকি একেবারে বুনো।”

“গুড,” কাটা কাটা স্বরে জবাব দিল নিনা। “আমরা আজ রাতে বুনোই হতে চাই।”

জাহাজ ডকে ভিড়তেই তাড়াহুড়া করে নেমে এলো কিশোর, মুসা ও নিনা। নিনার গাড়িতে চড়ল। বুনো হোক বা না হোক, ওই বারে যেতে আগ্রহী মুসা। তার ধারণা, বসে থেকে থেকে শরীরে জমে যাওয়া শক্তির কিছুটা নাচের মাধ্যমে খরচ করতে পারলে শরীর হালকা হবে।

“প্রথমে আমার অ্যাপার্টমেন্টে থামতে চাই, তোমাদের কোনো আপত্তি নেই তো?” গাড়ি চালাতে চালাতে নিনা বলল। “পরনে যা রয়েছে, এসব পরে বারে যেতে চাই না। তোমরা পরিষ্কার শার্ট পরে এসেছ, আমি এই ময়লা পোশাকে গেলে তোমরাই বিব্রত বোধ করবে।”

হেসে উঠল মুসা। “চলুন, যাই। একজন মেরিন আর্কিওলজিস্টের অ্যাপার্টমেন্ট কেমন হয়, দেখে আসি।”

“পানির নিচে পাওয়া পুরোনো অ্যান্টিক আর সামুদ্রিক জীবের স্টাফ করা মূর্তিতে ভর্তি যদি আশা করে থাকো, পাবে না,” নিনা বলল। “মাত্র দুই সপ্তাহ আগে জায়গাটা ভাড়া করেছি আমি। আস্তাকুঁড় হয়ে ছিল, নিজের প্রয়োজনে সাফসুতরো করে নিয়েছি।”

আধঘণ্টা পর মুসা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, ঠিকই বলেছে নিনা, সমুদ্র থেকে পাওয়া কিছুই নেই ঘরে। ছোট্ট ঘরটা ঝকঝকে পরিষ্কার করে রেখেছে। নিনা গেল শাওয়ারে গোসল সেরে কাপড় পরে আসতে। কিশোরকে নিয়ে ঘরটা দেখতে লাগল মুসা। একটা লম্বা সোফার পাশে রাখা টেবিলে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ দেখতে পেল। তাতে নিনার ছবি। সঙ্গে একজন মধ্যবয়সী মহিলা আর একজন ভদ্রলোক, ধূসর হয়ে গেছে চুল। ছবির নিচের লেখাটা জোরে জোরে পড়ল মুসা : আমাদের মেধাবী কন্যাকে। ভালোবাসাসহ— মা ও বাবা।

“ওখানে কী করছ?”

নিনার প্রশ্নে পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল মুসা। বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে নিনা। কালো একটা খাটো পোশাক পরেছে সে। পায়ে কালো হিলওয়ালা জুতো আর লম্বা কালো মোজা। সোনার দুটো লম্বা দুল দুলছে তার রোদে পোড়া চুলের নিচে। “কী, এ নিয়ে পার্টিতে যাওয়া যাবে, পাস করেছি?” ছেলেদের দেখানোর জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে কানের দুল দুটো নাড়ল সে।

“এক্কেবারে এ প্লাস পেয়েছেন,” দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে হেসে বলল মুসা। “আসুন, এখানেই ড্যান্স সেরে নিই!”

ডিসকোর চওড়া ডাবল ডোরটা দিয়ে ঢুকল তিনজনে। দীর্ঘ একটা মুহূর্তের জন্য কানা এবং বধির হয়ে গেল কিশোর, ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে— এত জোরে মিউজিক বাজছে! ড্রামের শব্দ পায়ের নিচের মেঝে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, আর রঙিন বাতিগুলোর আলো রীতিমতো অন্ধ করে দিচ্ছে ওকে।

“আসুন!” প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে মুসার কণ্ঠ কানে এলো কিশোরের, নিনাকে নিয়ে স্বচ্ছ ড্যান্স ফ্লোরের দিকে চলেছে। উজ্জ্বল লাল আর সবুজ নিয়ন বাতিগুলোর আলো মানুষের গায়ের রংও রঙিন করে তুলেছে।

“এমন একটা জায়গায় রবিন আসবে, আমি বিশ্বাস করি না,” নিনা বলল। “তার চরিত্রের সঙ্গে এই দৃশ্য মানায় না।”

“ও নিয়ে ভাববেন না আপনি,” চেঁচিয়ে বলল কিশোর। “আপনারা ওদিকে যান, আমি দেখি কিছু জানতে পারি কিনা।”

এক কিনার ধরে এগিয়ে চলল কিশোর। ঘরের লোকদের দেখতে দেখতে। ডক ফ্রেন্ডকে দ্বীপের যত খারাপ লোকের আড্ডা মনে হলো তার। যারা এখানে নিয়মিত আসে তারা কালো চামড়ার পোশাক পরেছে। তরুণ বয়সীরা পরস্পরকে চিৎকার করে ডাকছে। দরজার কাছে ভিড় করেছে কয়েকজন ট্যুরিস্ট, জনতার বেশি গভীরে ঢোকার সাহস করছে না যেন। গোমড়ামুখো, পেশিবহুল, ভারী দেহের একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। এমন একটা জায়গায় রয়েছে সে, যেখান থেকে পুরো ক্লাবটা দেখা যায়। বুকে নেমট্যাগে নাম লেখা রয়েছে, হারিস। জায়গাটা দেখে কিশোরের মনে হলো, বার কিংবা ক্লাব যাই হোক এটা, গুডের মতো লোকদেরই জায়গা।

“হেই, হারিস,” এমন ভঙ্গিতে লোকটার দিকে এগোল কিশোর, যেন কত পরিচিত। “আজ রাতে ব্যারি গুডকে দেখছি না। আপনি দেখেছেন?”

চোখের পাতা সরু করে কিশোরের দিকে তাকাল হারিস। “কানা নাকি?” বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল সে। “ও তো তোমার পেছনেই।”

হারিসের নির্দেশিত দিকে তাকাল কিশোর। রোগাটে ছিপছিপে একজন লোককে একা বসে থাকতে দেখতে দেখল ড্যান্স ফ্লোরের কাছের একটা টেবিলে। কিশোরকে সেদিকে এগোতে দেখে দু’জন কঠোর চেহারার লোক যেন ভোজবাজির মতো উদয় হলো গুডের পাশে। একজন লোক গুডের হাতে গুঁতো দিয়ে ওকে সতর্ক করে দিল। কিশোরের দিকে মুখ তুলে তাকাল গুড।

“আমাকে কী দরকার?” জিজ্ঞেস করল গুড। খোয়া বিছানো পথে ঘষা খেয়ে খড়খড় করে উঠল যেন তার কণ্ঠ।

অস্বস্তিভরে তাকাল কিশোর। ঝুঁকিটা নিয়েই নিল। মিউজিকের শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, “রবিন মিলফোর্ড বলেছে, আপনাকে এখানে পাওয়া যাবে।”

কিশোর মুখ খুলতেই আচমকা থেমে গেল বাজনার শব্দ। ফলে তার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল।
“কী?” এমনভাবে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গুড, যেন ঠাস করে ওকে চড় মেরেছে কিশোর। হাত মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল। তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকাল। আর কিশোর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপর চড়াও হলো ওরা।

“আরে দাঁড়ান দাঁড়ান!” এক পা পিছিয়ে গেল কিশোর। মরিয়া হয়ে চারপাশে তাকাল। পলকের জন্য দেখতে পেল, মুসা দৌড়ে আসছে তার দিকে। ইতিমধ্যে একজন লোক কিশোরকে জাপটে ধরল। দুই হাত পেছনে টেনে নিয়ে হ্যামারলকে আটকে ফেলল।

“আরে শুনুন শুনুন…” আবার চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কিন্তু তার পেটে ঘুষি মারল আরেকজন।

কিশোরের মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের ওপর। চোখের সামনে পাক খাচ্ছে মেঝেটা।

কথা বলে আর লাভ নেই, পাল্টা আঘাত হানতে হবে, বুঝতে পারল সে।

মাথাটাকে কোনোমতে তুলে সোজা করল। চোখ পড়ল গুডের হাতের ছয় ইঞ্চি লম্বা ফলাওয়ালা ছুরিটার দিকে। স্টিলেটো। মারাত্মক অস্ত্র।

####
নয়

“না না না!” চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে টেবিলের ওপর উঠে পড়ল মুসা। ছিপছিপে অপরাধীটার পিঠে লাথি মেরে তার এক সঙ্গীর গায়ের ওপর ফেলে দিল।

“আঁউ!” করে চেঁচিয়ে উঠল গুডের বডিগার্ড, ছুরিটা বিঁধে গেছে তার বাহুতে। গার্ডের পিঠের ধাক্কা খেয়ে তার বস উড়ে গিয়ে পাঁচ ফুট দূরের টেবিলে চিত হয়ে পড়ল।

কিশোরকে অন্য লোকটার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল মুসা। তারপর প্রচণ্ড এক কারাতে-কিক মারল লোকটার পেটে। ততক্ষণে সারা ঘরে হইচই পড়ে গেছে। যে লোকটার টেবিলে পড়েছে গুড, ওই লোকটা খাচ্ছিল, রাগে একটা কাচের জগ তুলে নিয়ে বাড়ি মারল গুডের মাথায়।

“ভালোই দেখালে, মুসা,” হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশংসা করল কিশোর। নজর গুডের একজন বডিগার্ডের দিকে। মেঝেতে বসে ছুরিবিদ্ধ হাতের পরিচর্যা করছে সে।

মাথা ঝাঁকাল মুসা। সেও হাঁপাচ্ছে। তিন গুন্ডাকে নিয়ে আপাতত আর কোনো ভয় আছে বলে মনে হলো না। দুই বডিগার্ড মেঝেতে, আর ওদের বস একটা টেবিলের পায়ায় হেলান দিয়ে আছে। একজন ওয়েইট্রেস তার মাথায় বরফ ঘষে দিচ্ছে।

“লোকটা কে?” কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
“ব্যারি গুড। সার্জেন্ট মার্ক আমাদের যার কথা বলেছিলেন। আমি ওকে রবিনের নাম বলতেই আক্রমণ করে বসল।”

টেবিলের নিচ থেকে স্টিলেটোটা কুড়িয়ে নিয়েছে নিনা। মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়েই চেঁচিয়ে বলল, “মুসা, সাবধান!”

ঘুরে তাকিয়ে মুসা দেখল গেটের কাছে দাঁড়ানো হারিস মুখ লাল করে ওদের দিকে আসছে। “এই, সবাই চুপ!” ধমকে উঠল সে। হাতের ইশারায় ব্যান্ড-বাদকদের বাজনা বাজানোর নির্দেশ দিল। জ্বলন্ত চোখে কিশোরের দিকে তাকাল। “তোমাদের দেখামাত্র আমি বুঝেছিলাম গোলমাল পাকাতে এসেছ। এখন আমার সঙ্গে তোমাদের বোঝাপড়া আছে।”

দুই গোয়েন্দা, গুড আর নিনাকে প্রায় ঠেলে নিয়ে গিয়ে একটা অফিসে ঢোকাল সে। ঘরটার বেশির ভাগই বাক্সে ভরা। বাক্সগুলো একটার ওপর আরেকটা রাখা, প্রায় ছাদে গিয়ে ঠেকেছে।

“ব্যারি গুড, এসব কাণ্ড আরেকবার ঘটালে তোমার এখানে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেব,” গর্জে উঠল হারিস। “আমি চাই না, তোমার কারণে আরেকবার এই ক্লাবটা বন্ধ হয়ে যাক।”

“ওরাই আমাকে আগে আক্রমণ করেছে,” রাগে জ্বলে উঠল ছিপছিপে লোকটা। “আমি শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি।”

“কথাটা মোটেও ঠিক নয়,” কিশোর বলল, “আমি শুধু ওকে বলেছি, রবিন মিলফোর্ড আমাকে পাঠিয়েছে।”
“হ্যাঁ, এটাই তো যথেষ্ট,” মুখ ভার করে বলল গুড। “আজ রাতে রবিনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। ও আমাকে বলেছে, কয়েকটা লোক আজ আমাকে মারতে আসবে। সে জন্যই আমি তৈরি হয়ে বসে ছিলাম।”

“আজ রাতে রবিন আপনাকে ফোন করেছিল?” নিনার প্রশ্ন।

“তাই তো বললাম, লেডি, নাকি?”

“শেষ কবে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?” মুসা জিজ্ঞেস করল।

সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল গুড। “তাতে তোমার কী?”

“হয়েছে হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে,” বাধা দিল হারিস। “এখন বেরোও এখান থেকে। আমি এখানে আর কোনো মারপিট দেখতে চাই না। বোঝা গেছে?”

ওদের পেছনের দরজা দিয়ে একটা গলিতে বের করে দিল হারিস। গুডের দিকে তাকাল মুসা। টেনেটুনে গায়ের জ্যাকেট ঠিক করছে লোকটা। যেন হারানো সম্মান ফিরে পাবার চেষ্টায়। তারপর গলি ধরে আগে আগে এগিয়ে চলল, গলির মাথায় দাঁড়ানো রঙিন কাচ লাগানো একটা কালো গাড়ির দিকে। ওখানে তার বডিগার্ডরা অপেক্ষা করছে।

“এক মিনিট, মিস্টার গুড,” মোলায়েম স্বরে ডাকল নিনা। গুডের হাত টেনে ধরল।

“কী?” রাগত স্বরে বলল গুড, হাঁটার গতি সামান্য কমাল।
“প্লিজ,” গুডের চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল নিনা, কিন্তু তার দিকে তাকাল না লোকটা। “আমি আপনাকে এটা দিতে এসেছি,” স্টিলেটোটা বাড়িয়ে দিল নিনা।

দম আটকে ফেলল মুসা। নিনাকে বাধা দিতে এগোল। কিন্তু ওকে আটকাল কিশোর। মুসাকে নিয়ে এমনভাবে এগোল, যাতে গুড কিংবা তার সঙ্গীরা ভড়কে গিয়ে আবার কিছু না করে বসে।

“রবিন কোথায় আমাকে বলবেন দয়া করে?” নিনার অনুরোধভরা কণ্ঠ কানে এলো মুসা ও কিশোরের।

বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল গুড। “ওই রবিন ছোকরাটার কথা আমার শোনাই উচিত হয়নি। সে আমাকে পুলিশের ঝামেলায় ফেলেছে।”

“জানি,” আগ বাড়িয়ে বলে উঠল মুসা। “আমাদের সঙ্গেও একই চালাকি করেছে। অ্যান্টিক সোনার জিনিস দেবে বলে টাকা নিয়েছে। দেয়নি।”

মুসার কথা শুনে কান খাড়া হয়ে গেল লোকটার। “হ্যাঁ। আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে। একটামাত্র আংটি নমুনা হিসেবে দিয়ে সেই যে ডুব মেরেছে, আর দেখা করে না।”

“আমাদের আংটিও দেয়নি,” কিশোর বলল। “জিনিসটা কোথায় পেয়েছে, বলেছে আপনাকে?”

“বলেছে। বহুকাল আগে সাগরে ডুবে যাওয়া একটা জাহাজে,” গুড বলল। “ওকে বিশ্বাস করাই উচিত হয়নি আমার। ও বলেছে, আংটিটা যেখান থেকে এনেছে, সেখানে নাকি টন টন সোনা আছে। তবে গোপনে ডুব দিয়ে আনতে হবে।”

“চোরটা তো আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে,” কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল নিনা।

“ও বলেছে, এগুলোর অ্যান্টিক মূল্য সাধারণ সোনার চেয়ে অনেক বেশি,” গুড বলল। “আমারও তাই ধারণা। কিন্তু খালি তো দেব-দেব করছে। দেয়ও না, দেখাও করে না।”

“সামনে পেলে ওর মাথা ভাঙব আমি,” নিজেকে খুব কঠিন লোক বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল মুসা। “ওকে কোথায় পাওয়া যাবে, শুধু বলুন আমাদের। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, যা করার আমরাই করব।”

এক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হলো গুডের মুখ। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। “আমি এখানে তার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকি,” ক্লাবটা দেখাল সে। “আমাদের সমস্ত কথাবার্তা ফোনেই সারা হয়। আর ফোনটা সব সময় সে-ই করে।”

“শিগগির আরেকটা ফোন-কল আশা করছেন?” কিশোর জিজ্ঞেস করল।

ভুরু কোঁচকাল গুড। “বলেছে, আগামীকাল করবে। কিন্তু আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না।”

তুড়ি বাজাল মুসা। “কাল যদি আবার ফোন করে সে, তার সঙ্গে এখানে দেখা করার ব্যবস্থা করবেন। আমরাও আসব। তারপর সবাই মিলে…” ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল মুসা, কী করবে।

ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল গুডের মুখে। “আমার এক বন্ধু আছে, মায়ামি থেকে আসছে কাল। বিশ্বাসঘাতকদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়, জানা আছে। তার হাতেই রবিনকে ছেড়ে দেব।”

চোখের কোণ দিয়ে মুসা দেখল, গুডের কথা শুনে শক্ত হয়ে গেছে নিনা।

“না!” চিৎকার দিয়ে গুডের দিকে এগোল সে। মুখ লাল হয়ে গেছে।

“কী হলো?” অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল গুড।

তাড়াতাড়ি নিনাকে সরিয়ে দিয়ে গুডের সামনে দাঁড়াল মুসা। “উনি বলতে চাইছেন, রবিনকে সরালে লাভটা কী? আমরা তার কাছে টাকা পাই। আপনিও পান। ওকে মেরে ফেললে জীবনেও আমাদের টাকা আর ফেরত পাব না।”

“তাও ঠিক।” গুড বলল।

“তাহলে রবিনকে আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন,” মুসা বলল। “তার ব্যবস্থা আমরাই করতে পারব।”

গলির মাথার কালো গাড়িটার ইঞ্জিন জোরে গোঁ-গোঁ করে ইঙ্গিত দিল। একজন বডিগার্ড গাড়ি থেকে নেমে গুডের দিকে এগোল। অধৈর্য হয়ে পড়েছে বডিগার্ডরা।

কাঁধ সোজা করে দাঁড়াল গুড। “কাল দেখা হবে,” বলে সামনে পা বাড়াল সে।
“শিওর,” জবাব দিল মুসা।
গুডকে গাড়িতে উঠতে দেখল তিনজন। হেডলাইট জ্বলে উঠল। অসংখ্য ছায়ার সৃষ্টি করল গলিটাতে।

গাড়ির দরজাটা বন্ধ হবার আগে মুখ বের করল গুড। “ওই যে, যা বললাম, মায়ামি থেকে আসা আমার বন্ধুটিকে আমি ফোন করব। বলা যায় না, যদি কোনো কারণে তোমরা ব্যর্থ হও, তখন ওকে দিয়ে কাজটা সারতে হবে।”

গাড়ির দিকে নিনা দৌড় দেওয়ার আগেই খপ করে তার কব্জি চেপে ধরল মুসা। চেঁচিয়ে গুডের কথার জবাব দিল, “ভালোই হবে।”

“ও, আরেকটা কথা,” গুড বলল। “আমার মায়ামির বন্ধু তোমাদেরও যাচাই করে দেখবে, তোমরা ঠিক কথা বলছ কিনা। ও যদি কোনো কারণে তোমাদের মধ্যেও দুর্গন্ধ পায়, তাহলে তো বোঝোই কী হবে।”

গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। টায়ারের তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল গাড়িটা।
####
দশ

গুডের গাড়ির শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল।

“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!” গলির একধারের দেয়ালে হেলান দিল নিনা। “আমার ভাই চোর হয়ে গেছে, গোপনে গুপ্তধন তুলে এনে বিক্রি করছে, আমি বিশ্বাস করি না।”

“এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে,” কিশোর বলল। ক্লাব থেকে আসা মিউজিকের ভয়ংকর শব্দ যেন মগজে বাড়ি খাচ্ছে। “তবে একটা জিনিস পরিষ্কার, ভালো জটিলতা তৈরি হয়েছে। একে তো রবিনের উধাও হওয়ার রহস্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একজন বাহামিয়ান গুন্ডা। আর মায়ামি থেকে তার দোস্ত আরেকটা গুন্ডা যদি এসেই পড়ে, তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ হলো।”

নিনার গাড়ির দিকে এগোল ওরা।

“এ তো এক অচেনা রবিন মনে হচ্ছে আমার কাছে,” গাড়ির দরজার তালা খুলতে খুলতে নিনা বলল। “আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে লাগানো মেসেজটার হাতের লেখাটা রবিনের, কোনো সন্দেহ নেই। কে লাগিয়ে দিয়ে গেল?”

“সেটাই তো বুঝতে পারছি না,” কিশোর বলল। বড় রাস্তায় উঠে জিজ্ঞেস করল, “কালকের জন্য একটা বোট ভাড়া করতে পারবেন, যাতে মার্কারটা আগের জায়গায় রেখে আসতে পারি?”

“পারব।” খোলা জানালা দিয়ে পানির ফোঁটা আসতে শুরু করল, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালার কাচ তুলে দিয়ে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চালু করে দিল নিনা।

কী যেন ভাবছে কিশোর। রিয়ারভিউ মিররে নিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কাছে নিশ্চয় রবিনের ছবি আছে। একটা দেখাতে পারবেন?”

“পারব।” চোখ মিটমিট করল নিনা। “আমার অ্যাপার্টমেন্টে যেতে হবে।”

নিনা যখন তার বাসার গলিতে ঢুকল, বৃষ্টির পানির স্রোত বইছে। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত।

“বাপ রে, হঠাৎ একি বৃষ্টি!” এক দৌড়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়ার জন্য তৈরি হলো কিশোর।

“এখানে এরকমই হয়,” নিনা বলল। “গ্রীষ্মকালটাই এখানে বর্ষাকাল। ভেতরে চলো, চা খেতে হবে।”

পানিতে ঝপ ঝপ পা ফেলে এক দৌড়ে এসে বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকল ওরা। নিনার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলে দু’জনকে তোয়ালে এনে দিল সে। নিজেও মাথা মুছে চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকল। ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, “ড্রেসারের ওপরের ড্রয়ারে ছবি আছে। বের করে নাও।”

ড্রয়ার টান দিতে একগাদা ছবি আর খবরের কাগজের পেপারক্লিপিং পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। এগুলো কেন জোগাড় করেছে নিনা? নিশ্চয় রবিনকে খুঁজে বের করতে কাজে লাগানোর জন্য। ক্লিপিংয়ের ছবি পোস্টারে ব্যবহার করতে পারবে। পুলিশকে দেখাতে পারবে।

একটা ছবিতে দুই হাতে একটা ট্রফি ধরে রেখেছে রবিন, সাঁতার প্রতিযোগিতায় জিতেছিল; আরেকটাতে স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক পরা। ওদের চেনা রবিনই যে নিনার কাজিন রবিন, ছবিগুলো দেখে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

“এটা দেখো,” খবরের কাগজের একটা ক্লিপিং তুলে নিয়ে মুসা বলল। দু’জনেই লেখাটা নীরবে পড়ল। এখানকার স্থানীয় একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে খবরটা। ট্রেজার হান্টার যে সান্তা হুয়ানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে কথা লিখেছে। মন্তব্য করেছে, বাহামার সীমানায় পাওয়া সমস্ত গুপ্তধনের মালিক হবে বাহামা।

“এটা নিশ্চয় কুপার জানেন, আর এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায়ও আছেন,” কিশোর বলল।

“এই জন্যই কি গুপ্তধন পাওয়ার জায়গাটা গোপন করে রেখেছেন?” মুসার প্রশ্ন। “কাউকে জানতে দিতে চান না? চুপি চুপি তুলে নিয়ে কেটে পড়ার মতোলবে আছেন?”

“হতেও পারে,” কিশোর বলল। “আমিও জানি, গুপ্তধন যে দেশে পাওয়া যায়, তার মালিক সে দেশের সরকার, অর্থাৎ জনগণ। তবে যে লোক গুপ্তধন উদ্ধার করে, সেও একটা মোটা ভাগ পায়।”

“ক্যাপ্টেন কুপার মোটা ভাগে সন্তুষ্ট নন। হয়তো তিনি পুরোটাই চান।”

কাঠের ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল নিনা।

“ওই ছবিটা আমার খুব প্রিয়,” কিশোরের হাতের একটা ছবি দেখাল সে। তাতে ট্রেজার হান্টারের ক্রুদের গ্রুপ ফটোগ্রাফ ছাপা হয়েছে। “এটা তোলা হয়েছে প্রথম যেদিন রবিনসহ ক্রুরা সবাই জাহাজে উঠেছিল, সেদিন। ক্লিপিংটা রবিনই আমার কাছে ডাকে পাঠিয়েছে।”

ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখল কিশোর। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ডা. হোল্ডিংস আর ক্যাপ্টেন কুপার। তাঁদের দুই পাশে দাঁড়ানো ডোরি, টনি, রবিন, ডিয়েগো, বার্নি আর ক্রিস।

“সবাইকেই তো বেশ খুশি-খুশি লাগছে,” কিশোরের কাঁধের ওপর দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, “তারপর, খুশিটা মিলিয়ে গেছে তখনই, যখন একজন ডাইভার নিখোঁজ হয়েছে, একজন মারা গেছে।” আনমনে ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে নিল সে। “দুটো সন্দেহজনক মার্কার পাওয়া গেছে সাগরের তলায়। একটা পেয়েছে টনি। আরেকটা আমি। আর এই মার্কারগুলো কে রেখেছে, সেটার রহস্য ভেদ হলেই পাওয়া যাবে রবিনের নিখোঁজ হওয়া আর টনির মৃত্যুর জবাব।”

“টনি তো হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে,” মনে করিয়ে দিল মুসা।

“হয়তো এই মার্কার আবিষ্কারই তার মৃত্যুর কারণ।”

“তুমিও তো একটা মার্কার পেয়েছ। তাহলে কি টনির পর তোমাকে খুন করা হবে?”

“জানি না। সাবধান থাকতে হবে।”

“পয়জনকে সন্দেহ হয় আমার,” মুসার হাতে একটা কাপ তুলে দিয়ে অবশিষ্ট কাপটা নিজে নিল নিনা। “আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে সে। সন্দেহ করার আরও কারণ আছে। তার হাতে রবিনের আংটিটা ছিল। সি শোর হোটেল চেনে না, এটাও পুরোপুরি মিথ্যে।”

“আরেক দিক থেকে ভেবে দেখলে কেমন হয়?” মুসা বলল। “ক্রিসও হয়তো আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না।”

কাঁধ ঝাঁকাল নিনা। “হয়তো কাল রাতেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব, রবিন যদি ডক ফ্রেন্ড ক্লাবে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। ইতিমধ্যে, অন্য কাজ করব আমরা। সকালে একটা বোট ভাড়া করব আমি। জাহাজ থেকে তোমাদের তুলে নেব।”

“খুব ভালো হবে,” কিশোর বলল। চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখল ট্রেতে। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। নিনাকে বলল, “রবিনকে নিয়ে আর উদ্বিগ্ন হবেন না আপনি। কালকের মধ্যে ওকে আমরা খুঁজে বের করবই।”

বাইরে বেরিয়ে দেখল ওরা, বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে গেছে। গাড়িতে উঠল ওরা। আচমকা পাশে বসা মুসার হাত আঁকড়ে ধরল নিনা। বলল, “লোকটা কে?”

“কোন লোকটা?” নিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মুসা।

“পাতাবাহারের ঝাড়ের আড়ালে, আমার মনে হলো, আমি কাউকে দেখেছি,” ফিসফিস করে বলল নিনা।

উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল, “ইগনিশনে চাবিটা রেখে গাড়ির পেছনের সিটে এসে বসুন। দরজার তালা লাগিয়ে রাখবেন। আমরা আসছি।”

নিনাকে যা করতে বলা হলো তাই করল সে। পাতাবাহারের ঝাড়টার দিকে দৌড় দিল কিশোর আর মুসা। ওটার আড়ালে কাউকে দেখতে না পেলেও একটা লোককে রাস্তার মোড়ের দিকে দৌড়ে যেতে দেখল কিশোর।

দৌড় দিল সে। পেছন পেছন এলো মুসা। লোকটাকে একটা মোটরবাইকে চড়তে দেখল।

কিশোরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চাইল মুসা। ওকে থামাল কিশোর। “গাড়িতে করে অনুসরণ করলেই ভালো হবে,” নিচুস্বরে বলল সে। মাথা ঝাঁকাল মুসা। গাড়ির কাছে ফিরে এলো দু’জন।

ওদের আসতে দেখেই দরজা খুলে দিল নিনা। নিনাকে পেছনেই বসে থাকতে বলে কিশোর বসল স্টিয়ারিং হুইলে। মুসা তার পাশে। তীব্র গতিতে গাড়ি ঘোরাল কিশোর। কংক্রিটে ঘষা খেয়ে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে চাকার খানিকটা ছাল-চামড়া রাস্তায় রেখে ঘুরে গেল গাড়ির নাক। অনুসরণ করল মোটরবাইকটাকে।

“ওকে ছেড়ো না!” চেঁচিয়ে উঠল নিনা।

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মোটরবাইক আরোহী। হঠাৎ বাঁয়ে মোড় নিয়ে বৃষ্টিভেজা একটা গলিতে ঢুকে পড়ল।

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল কিশোর। তারপর গাড়িটা বাঁয়ে কেটে বাইকের পিছু নিল। চাকার ঘা রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানি ফোয়ারার মতো ছিটাচ্ছে। সরু রাস্তার জটিল এক গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে যেন ছুটে চলল ওরা।

“লোকটাকে চিনতে পেরেছেন?” নিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“না,” জবাব দিল নিনা। “বুঝতে পারছি না ও কে।”

“আরও জোরে!” উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে পড়েছে মুসা। বাঁ দিকে দেখাল। মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেছে আবার বাইকটা। পেছনে রেখে গেছে পানির ছিটের লম্বা রেখা।

ওটার পেছন পেছন এসে বাঁয়ে ঘুরে কিশোর দেখল, সামনে চওড়া, সোজা চলে গেছে হাইওয়ে। স্বস্তি বোধ করল সে। কারণ, হাইওয়েতে গাড়ির সঙ্গে পেরে উঠবে না মোটরবাইক। গ্যাস পেডালে পায়ের চাপ বাড়াল সে। সহজেই বাইকের কাছে চলে যেতে লাগল।

“আরও বাড়াও!” আবার বলল মুসা। উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে আরোহীটি কে।

শক্ত করে স্টিয়ারিং চেপে ধরে আরও গতি বাড়াল কিশোর। বাইকের আরও কাছে চলে এলো। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল লোকটা। এক মুহূর্তের জন্য তার হেলমেটে ঢাকা মুখে হেডলাইটের আলো পড়ল।

“আমি জানতাম!” এতক্ষণে সিটে পিঠ রাখল মুসা। “ও বিষ! আমি শিওর!”

ইতিমধ্যে বাইকের এত কাছে চলে এসেছে গাড়ি, বাইকের পেছনের চাকার পানির ছিটে ভিজিয়ে দিচ্ছে উইন্ডশিল্ড। যতটা সম্ভব গতি বাড়ানোর চেষ্টা করল ক্রিস। খুব সামান্যই এগোতে পারল।

ধরতেই হবে ওকে। কিশোরও গতি বাড়াল। শিগগির গাড়ির ফেন্ডার মোটরবাইকের পেছনের চাকা প্রায় ছুঁয়ে ফেলল। উল্টো দিক থেকে একটা স্টেশন ওয়াগন ছুটে আসছে, হর্ন বাজাচ্ছে পাগলের মতো।

“এখন? ক্রিসকে থামাবে কী করে?” ভেজা উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নিনা। উইন্ডশিল্ডে পানি লেগে থাকার কারণে সামনের গাড়িটাকে অস্পষ্ট, বিকৃত দেখাচ্ছে।

“আমার মনে হয় মোড় নেবে সে,” কিশোর বলল। সামনে হাইওয়ের ডান দিকে একটা গলি আছে। ওটা ঘুরে গিয়ে আবার হাইওয়েতে উঠেছে। “হাইওয়েতে যেখানে উঠেছে, সেখানে গিয়ে বসে থাকব। সে যখন আবার হাইওয়েতে ওঠার চেষ্টা করবে, তখন তার পথ আটকাব।”

কিন্তু কিশোর বলতে না বলতেই ঘটল অঘটন। ডানেই কাটল ক্রিস, পার হয়েও যেত, যদি রাস্তায় পানিতে ঢাকা একটা গর্ত ফাঁদ তৈরি করে না রাখত।

আতঙ্কিত হয়ে দেখল কিশোর, বাইকের সামনের চাকাটা গর্তে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের চাকা লাফিয়ে উঠল শূন্যে, একগাদা পানি আর কাদা ছিটিয়ে দিল গাড়ির উইন্ডশিল্ডে।

কিশোরের এক হাত স্টিয়ারিংয়ে, গাড়িটাকে ডানে ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে আরেক হাতে বোতাম টিপে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চালু করে দিল। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হলো না, বরং কাচের গায়ে এমনভাবে কাদা লেপটে দিল, তার ভেতর দিয়ে কিছুই আর দেখা গেল না। তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে, একপাশের কাচ নামিয়ে সামনে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করল সে।

তবে দেরি হয়ে গেছে। কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়েছে গাড়ি। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর ঘষা খাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ব্রেক কষাতে পিছলে গেছে গাড়ির চাকা। নিনার চিৎকারটা অনেক দীর্ঘ মনে “পারব।” খোলা জানালা দিয়ে পানির ফোঁটা আসতে শুরু করল, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালার কাচ তুলে দিয়ে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চালু করে দিল নিনা।

কী যেন ভাবছে কিশোর। রিয়ারভিউ মিররে নিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কাছে নিশ্চয় রবিনের ছবি আছে। একটা দেখাতে পারবেন?”

“পারব।” চোখ মিটমিট করল নিনা। “আমার অ্যাপার্টমেন্টে যেতে হবে।”

নিনা যখন তার বাসার গলিতে ঢুকল, বৃষ্টির পানির স্রোত বইছে। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত।

“বাপ রে, হঠাৎ একি বৃষ্টি!” এক দৌড়ে বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়ার জন্য তৈরি হলো কিশোর।

“এখানে এরকমই হয়,” নিনা বলল। “গ্রীষ্মকালটাই এখানে বর্ষাকাল। ভেতরে চলো, চা খেতে হবে।”

পানিতে ঝপ ঝপ পা ফেলে এক দৌড়ে এসে বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকল ওরা। নিনার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলে দু’জনকে তোয়ালে এনে দিল সে। নিজেও মাথা মুছে চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকল। ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, “ড্রেসারের ওপরের ড্রয়ারে ছবি আছে। বের করে নাও।”

ড্রয়ার টান দিতে একগাদা ছবি আর খবরের কাগজের পেপারক্লিপিং পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। এগুলো কেন জোগাড় করেছে নিনা? নিশ্চয় রবিনকে খুঁজে বের করতে কাজে লাগানোর জন্য। ক্লিপিংয়ের ছবি পোস্টারে ব্যবহার করতে পারবে। পুলিশকে দেখাতে পারবে।

একটা ছবিতে দুই হাতে একটা ট্রফি ধরে রেখেছে রবিন, সাঁতার প্রতিযোগিতায় জিতেছিল; আরেকটাতে স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক পরা। ওদের চেনা রবিনই যে নিনার কাজিন রবিন, ছবিগুলো দেখে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

“এটা দেখো,” খবরের কাগজের একটা ক্লিপিং তুলে নিয়ে মুসা বলল। দু’জনেই লেখাটা নীরবে পড়ল। এখানকার স্থানীয় একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে খবরটা। ট্রেজার হান্টার যে সান্তা হুয়ানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে কথা লিখেছে। মন্তব্য করেছে, বাহামার সীমানায় পাওয়া সমস্ত গুপ্তধনের মালিক হবে বাহামা।

“এটা নিশ্চয় কুপার জানেন, আর এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায়ও আছেন,” কিশোর বলল।

“এই জন্যই কি গুপ্তধন পাওয়ার জায়গাটা গোপন করে রেখেছেন?” মুসার প্রশ্ন। “কাউকে জানতে দিতে চান না? চুপি চুপি তুলে নিয়ে কেটে পড়ার মতোলবে আছেন?”

“হতেও পারে,” কিশোর বলল। “আমিও জানি, গুপ্তধন যে দেশে পাওয়া যায়, তার মালিক সে দেশের সরকার, অর্থাৎ জনগণ। তবে যে লোক গুপ্তধন উদ্ধার করে, সেও একটা মোটা ভাগ পায়।”

“ক্যাপ্টেন কুপার মোটা ভাগে সন্তুষ্ট নন। হয়তো তিনি পুরোটাই চান।”

কাঠের ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল নিনা।

“ওই ছবিটা আমার খুব প্রিয়,” কিশোরের হাতের একটা ছবি দেখাল সে। তাতে ট্রেজার হান্টারের ক্রুদের গ্রুপ ফটোগ্রাফ ছাপা হয়েছে। “এটা তোলা হয়েছে প্রথম যেদিন রবিনসহ ক্রুরা সবাই জাহাজে উঠেছিল, সেদিন। ক্লিপিংটা রবিনই আমার কাছে ডাকে পাঠিয়েছে।”

ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখল কিশোর। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ডা. হোল্ডিংস আর ক্যাপ্টেন কুপার। তাঁদের দুই পাশে দাঁড়ানো ডোরি, টনি, রবিন, ডিয়েগো, বার্নি আর ক্রিস।

“সবাইকেই তো বেশ খুশি-খুশি লাগছে,” কিশোরের কাঁধের ওপর দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, “তারপর, খুশিটা মিলিয়ে গেছে তখনই, যখন একজন ডাইভার নিখোঁজ হয়েছে, একজন মারা গেছে।” আনমনে ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে নিল সে। “দুটো সন্দেহজনক মার্কার পাওয়া গেছে সাগরের তলায়। একটা পেয়েছে টনি। আরেকটা আমি। আর এই মার্কারগুলো কে রেখেছে, সেটার রহস্য ভেদ হলেই পাওয়া যাবে রবিনের নিখোঁজ হওয়া আর টনির মৃত্যুর জবাব।”

“টনি তো হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে,” মনে করিয়ে দিল মুসা।

“হয়তো এই মার্কার আবিষ্কারই তার মৃত্যুর কারণ।”

“তুমিও তো একটা মার্কার পেয়েছ। তাহলে কি টনির পর তোমাকে খুন করা হবে?”

“জানি না। সাবধান থাকতে হবে।”

“পয়জনকে সন্দেহ হয় আমার,” মুসার হাতে একটা কাপ তুলে দিয়ে অবশিষ্ট কাপটা নিজে নিল নিনা। “আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে সে। সন্দেহ করার আরও কারণ আছে। তার হাতে রবিনের আংটিটা ছিল। সি শোর হোটেল চেনে না, এটাও পুরোপুরি মিথ্যে।”

“আরেক দিক থেকে ভেবে দেখলে কেমন হয়?” মুসা বলল। “ক্রিসও হয়তো আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না।”

কাঁধ ঝাঁকাল নিনা। “হয়তো কাল রাতেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব, রবিন যদি ডক ফ্রেন্ড ক্লাবে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। ইতিমধ্যে, অন্য কাজ করব আমরা। সকালে একটা বোট ভাড়া করব আমি। জাহাজ থেকে তোমাদের তুলে নেব।”

“খুব ভালো হবে,” কিশোর বলল। চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখল ট্রেতে। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। নিনাকে বলল, “রবিনকে নিয়ে আর উদ্বিগ্ন হবেন না আপনি। কালকের মধ্যে ওকে আমরা খুঁজে বের করবই।”

বাইরে বেরিয়ে দেখল ওরা, বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে গেছে। গাড়িতে উঠল ওরা। আচমকা পাশে বসা মুসার হাত আঁকড়ে ধরল নিনা। বলল, “লোকটা কে?”

“কোন লোকটা?” নিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মুসা।

“পাতাবাহারের ঝাড়ের আড়ালে, আমার মনে হলো, আমি কাউকে দেখেছি,” ফিসফিস করে বলল নিনা।

উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল, “ইগনিশনে চাবিটা রেখে গাড়ির পেছনের সিটে এসে বসুন। দরজার তালা লাগিয়ে রাখবেন। আমরা আসছি।”

নিনাকে যা করতে বলা হলো তাই করল সে। পাতাবাহারের ঝাড়টার দিকে দৌড় দিল কিশোর আর মুসা। ওটার আড়ালে কাউকে দেখতে না পেলেও একটা লোককে রাস্তার মোড়ের দিকে দৌড়ে যেতে দেখল কিশোর।

দৌড় দিল সে। পেছন পেছন এলো মুসা। লোকটাকে একটা মোটরবাইকে চড়তে দেখল।

কিশোরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চাইল মুসা। ওকে থামাল কিশোর। “গাড়িতে করে অনুসরণ করলেই ভালো হবে,” নিচুস্বরে বলল সে। মাথা ঝাঁকাল মুসা। গাড়ির কাছে ফিরে এলো দু’জন।

ওদের আসতে দেখেই দরজা খুলে দিল নিনা। নিনাকে পেছনেই বসে থাকতে বলে কিশোর বসল স্টিয়ারিং হুইলে। মুসা তার পাশে। তীব্র গতিতে গাড়ি ঘোরাল কিশোর। কংক্রিটে ঘষা খেয়ে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে চাকার খানিকটা ছাল-চামড়া রাস্তায় রেখে ঘুরে গেল গাড়ির নাক। অনুসরণ করল মোটরবাইকটাকে।

“ওকে ছেড়ো না!” চেঁচিয়ে উঠল নিনা।

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মোটরবাইক আরোহী। হঠাৎ বাঁয়ে মোড় নিয়ে বৃষ্টিভেজা একটা গলিতে ঢুকে পড়ল।

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল কিশোর। তারপর গাড়িটা বাঁয়ে কেটে বাইকের পিছু নিল। চাকার ঘা রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানি ফোয়ারার মতো ছিটাচ্ছে। সরু রাস্তার জটিল এক গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে যেন ছুটে চলল ওরা।

“লোকটাকে চিনতে পেরেছেন?” নিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“না,” জবাব দিল নিনা। “বুঝতে পারছি না ও কে।”

“আরও জোরে!” উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে পড়েছে মুসা। বাঁ দিকে দেখাল। মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেছে আবার বাইকটা। পেছনে রেখে গেছে পানির ছিটের লম্বা রেখা।

ওটার পেছন পেছন এসে বাঁয়ে ঘুরে কিশোর দেখল, সামনে চওড়া, সোজা চলে গেছে হাইওয়ে। স্বস্তি বোধ করল সে। কারণ, হাইওয়েতে গাড়ির সঙ্গে পেরে উঠবে না মোটরবাইক। গ্যাস পেডালে পায়ের চাপ বাড়াল সে। সহজেই বাইকের কাছে চলে যেতে লাগল।

“আরও বাড়াও!” আবার বলল মুসা। উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে আরোহীটি কে।

শক্ত করে স্টিয়ারিং চেপে ধরে আরও গতি বাড়াল কিশোর। বাইকের আরও কাছে চলে এলো। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল লোকটা। এক মুহূর্তের জন্য তার হেলমেটে ঢাকা মুখে হেডলাইটের আলো পড়ল।

“আমি জানতাম!” এতক্ষণে সিটে পিঠ রাখল মুসা। “ও বিষ! আমি শিওর!”

ইতিমধ্যে বাইকের এত কাছে চলে এসেছে গাড়ি, বাইকের পেছনের চাকার পানির ছিটে ভিজিয়ে দিচ্ছে উইন্ডশিল্ড। যতটা সম্ভব গতি বাড়ানোর চেষ্টা করল ক্রিস। খুব সামান্যই এগোতে পারল।

ধরতেই হবে ওকে। কিশোরও গতি বাড়াল। শিগগির গাড়ির ফেন্ডার মোটরবাইকের পেছনের চাকা প্রায় ছুঁয়ে ফেলল। উল্টো দিক থেকে একটা স্টেশন ওয়াগন ছুটে আসছে, হর্ন বাজাচ্ছে পাগলের মতো।

“এখন? ক্রিসকে থামাবে কী করে?” ভেজা উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল নিনা। উইন্ডশিল্ডে পানি লেগে থাকার কারণে সামনের গাড়িটাকে অস্পষ্ট, বিকৃত দেখাচ্ছে।

“আমার মনে হয় মোড় নেবে সে,” কিশোর বলল। সামনে হাইওয়ের ডান দিকে একটা গলি আছে। ওটা ঘুরে গিয়ে আবার হাইওয়েতে উঠেছে। “হাইওয়েতে যেখানে উঠেছে, সেখানে গিয়ে বসে থাকব। সে যখন আবার হাইওয়েতে ওঠার চেষ্টা করবে, তখন তার পথ আটকাব।”

কিন্তু কিশোর বলতে না বলতেই ঘটল অঘটন। ডানেই কাটল ক্রিস, পার হয়েও যেত, যদি রাস্তায় পানিতে ঢাকা একটা গর্ত ফাঁদ তৈরি করে না রাখত।

আতঙ্কিত হয়ে দেখল কিশোর, বাইকের সামনের চাকাটা গর্তে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের চাকা লাফিয়ে উঠল শূন্যে, একগাদা পানি আর কাদা ছিটিয়ে দিল গাড়ির উইন্ডশিল্ডে।

কিশোরের এক হাত স্টিয়ারিংয়ে, গাড়িটাকে ডানে ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে আরেক হাতে বোতাম টিপে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার চালু করে দিল। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হলো না, বরং কাচের গায়ে এমনভাবে কাদা লেপটে দিল, তার ভেতর দিয়ে কিছুই আর দেখা গেল না। তাড়াতাড়ি ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে, একপাশের কাচ নামিয়ে সামনে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করল সে।

তবে দেরি হয়ে গেছে। কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়েছে গাড়ি। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর ঘষা খাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ব্রেক কষাতে পিছলে গেছে গাড়ির চাকা। নিনার চিৎকারটা অনেক দীর্ঘ মনে

হলো কিশোরের কাছে, অথচ এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে ঘটে গেছে ঘটনাগুলো।

অবশেষে থামল গাড়িটা। একটা সরু রাস্তার মাঝামাঝি। মুসা আর নিনার দিকে তাকাল কিশোর। “তোমরা সব ঠিক আছ তো?”

আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল দু’জন। মুসা বেরিয়ে গেল গাড়ি থেকে। তার পরপরই লাফিয়ে নামল কিশোর। চেঁচিয়ে নিনাকে বলল, “আপনি গাড়িতে থাকুন!”

মুসার সঙ্গে দুর্ঘটনার জায়গাটাতে এলো কিশোর। ভয়ংকর দৃশ্য। চিত হয়ে পড়ে আছে মোটর সাইকেলটা। বেঁকেচুরে গেছে। পেছনের চাকাটা বনবন করে ঘুরছে এখনো। প্রায় দশ ফুট দূরে কাদায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে ক্রিস।

পড়ে থাকা দেহটার দিকে দৌড় দিল কিশোর।

“কী অবস্থা তার?” গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল নিনা।

“আপনি বসে থাকুন!” মুসা জবাব দিল। হাঁটু গেড়ে বসল ক্রিসের কাছে। “কিশোর!”

কিশোরের মনে হলো, কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেন বহু দূর থেকে তার কানে ভেসে এলো মুসার ডাক।

“ওকে মেরে ফেললাম নাকি আমরা!” বিড়বিড় করল কিশোর।

####

এগারো

ক্রিসের হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা দেহটার ওপর ঝুঁকল কিশোর। নাড়ি দেখার জন্য হাত বাড়াল। মুসা দেখল, কিশোরের হাতটা কাঁপছে।

দু’জনকেই প্রচণ্ড স্বস্তি দিয়ে, গুঙিয়ে উঠল ক্রিস। নিজেই নিজেকে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার পাশের ঘাসের ওপর। চিত হয়ে শুলো।

মুসা দেখছে, ক্রিসের চোখজোড়া কিশোরের ওপর নিবদ্ধ। কিশোরকে চিনতে পেরেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে বসল, দু’চোখে ভয়।

“প্লিজ, আমাকে মেরো না!” ককিয়ে উঠল সে। “ট্রেজার হান্টারের ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না আমি!”

“কেউ আপনাকে মারতে আসেনি এখানে,” জবাব দিল মুসা। “শুধু আমাদের বলুন, ওভাবে পালাচ্ছিলেন কেন?”

“ওসব প্রশ্ন পরেও করা যাবে,” মুসাকে সাবধান করল কিশোর। “আগে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।”

“না,” বাধা দিল ক্রিস। “আমি যাব না। আমি ঠিকই আছি।” কপাল ডলল। “একটু বসে থাকতে পারলেই ভালো হয়ে যাব।” করুণ দৃষ্টিতে ভাঙাচোরা মোটরবাইকটার দিকে তাকাল সে।

উঠে গিয়ে মোটরবাইকটা সোজা করল মুসা। তারপর ঠেলে নিয়ে এগোল। অদ্ভুতভাবে কোমর দোলাতে দোলাতে এগোল বাইকটা। ওটাকে ওটার মালিকের কাছে এনে রেখে কাত করে রাখল মুসা।
“আমাদের গাড়ির পেছনে তুলে এটাকে যেখানে নিয়ে যেতে চান, নিতে পারব,” ক্রিসকে বলল সে।
গাড়ির দরজা লাগানোর শব্দ কানে এলো তার। ফিরে তাকিয়ে দেখল, গাড়ি থেকে নেমে ওদের দিকে দৌড়ে আসছে নিনা।
“ফ্রিপোর্টে একটা হাসপাতাল আছে,” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। “হাঁটতে পারবেন?”
“হ্যাঁ, পারব। আমার কিছু হয়নি, অহেতুক কেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছেন,” দুর্বল কণ্ঠে বলল ক্রিস।
“অহেতুক নয়,” নিনা জবাব দিল। “আপনার চিকিৎসার দরকার আছে।”
হাত ধরে টেনে তুলল ওকে কিশোর। মুসা আর কিশোরের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াল ক্রিস। দু’জনের সঙ্গে এগোল গাড়ির দিকে। ভাঙা মোটরবাইকটা ঠেলে নিয়ে চলল নিনা।
“প্রথমে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা করাব, তারপর আমাদের কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন আপনি,” মুসা বলল।

গাড়ির সামনের সিটে ক্রিসকে বসানো হলো। কিশোর, মুসা আর নিনা— তিনজন মিলে মোটরবাইকটা তুলে দিল গাড়ির রুফ র‌্যাকে। দড়ি দিয়ে ভালোমতো বাঁধল। নিনা বলল, সে গাড়ি চালাবে। প্রথমে রাস্তার পাশ থেকে পানি এনে উইন্ডশিল্ডটা ধুয়ে নিল। তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে ইগনিশন সুইচে মোচড় দিল। “রাস্তাটা আমার চেনা। তাছাড়া অনেক ধকল গেছে তোমাদের ওপর দিয়ে।”

ভেজা রাস্তায় কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর পাহাড়ি ঢালে উঠে যাওয়া একটা পাকা রাস্তা দেখা গেল, হাসপাতালের দিকে চলে গেছে। ইমার্জেন্সির প্রবেশমুখে এসে গাড়ি থামাল নিনা। জায়গাটাকে হাসপাতাল না বলে রিসোর্ট মোটেল বললেই বেশি মানাবে। বিল্ডিংয়ের সামনে পামগাছের সারি। ‘ইমার্জেন্সি’ লেখা সাইনবোর্ডটা না থাকলে খুঁজেই পাওয়া যেত না ওটা।

“তুমি আরেক পাশে ধরো,” মুসাকে বলে ক্রিসকে সিট থেকে নামিয়ে আনল কিশোর।

“আমি গাড়িটা রেখে আসছি,” বলে পার্কিং লটের দিকে চলে গেল নিনা।

ধরে ধরে ক্রিসকে রিসেপশন এরিয়ায় নিয়ে এলো কিশোর আর মুসা। ধূসর চুলওয়ালা মহিলা রিসেপশনিস্টের দিকে ওদের এগোতে দেখে তাড়াহুড়া করে স্ট্রেচার নিয়ে এলো হাসপাতালের একজন ওর্ডারলি। ক্রিসকে তাতে তুলে নেওয়া হলো।

“আমাদের বন্ধু অ্যাক্সিডেন্ট করেছে,” রিসেপশনিস্টকে বলল মুসা। “মোটর সাইকেলের চাকা গর্তে পড়ে গিয়েছিল।”

একটা প্যাড টেনে নিল রিসেপশনিস্ট। “ওকে এখানে আনো,” ওর্ডারলিকে ডাকল সে। ক্রিসকে দেখিয়ে বলল, “ওকে কিছু প্রশ্ন করতে হবে।”

চাকাওয়ালা স্ট্রেচারে করে যখন ক্রিসকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার ভাবভঙ্গি লক্ষ করতে লাগল মুসা। বাহামিয়ানের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে ওদের পক্ষে বলবে না বিপক্ষে।

“হ্যাঁ, আমার বিমা করানো আছে,” শান্ত ভঙ্গিতে মহিলাকে বলল ক্রিস। আরও কিছু প্রশ্নের জবাব দিল। মহিলা দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাইলে বলল, “বাইক চালানোর সময় সামনের চাকা গর্তে পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, গাড়িতে করে আমার বন্ধুরা পেছনে আসছিল। তারা আমাকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে দেখে তুলে নিয়ে আসে এখানে।”

“ওটা পরে ছিলে বলেই রক্ষা পেয়েছ,” ক্রিসের মাথার কালো হেলমেটটা দেখাল মহিলা। এখনো ওটা পরে আছে ক্রিস। “কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার তোমাকে দেখবেন।” ওর্ডারলিকে ইশারা করল মহিলা।

স্ট্রেচারটা ঠেলে নিয়ে চলল ওর্ডারলি। একটু পরই বারান্দার মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল মুসা, এ সময় ঢুকল নিনা। এগিয়ে এলো সে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল মুসা, “কিন্তু নিনার বাসায় কী করছিল ক্রিস?”

এর সঙ্গে যোগ করল নিনা, “আর তোমাদের দেখে পালাল কেন সে?”

ভ্রূকুটি করল কিশোর। মুসার দিকে তাকাল। “রাস্তায় আমাকে কী বলেছিল মনে আছে?”

“হ্যাঁ। ওকে খুন করার কথা।” ক্রিসের চোখে যে আতঙ্ক দেখেছিল, সেটা মনে পড়ল মুসার।

“এরকম কথা ভাবল কেন ও?” নিনার প্রশ্ন।

“আমাদের ভয়ংকর তাড়া খেয়েছে,” কিশোর বলল। “হয়তো তার মনে হয়েছে, ওকে মারার জন্যই তার পেছনে লেগেছি আমরা।”

“কথাটা সত্যিও হয়ে যেতে পারত,” মুসা বলল। “তবে নিনার ওপর চোখ রাখতে কেন গিয়েছিল, সেটা জানার পর শিওর হতে পারব আমরা।”

“সে যাই হোক, জাহাজে যে খুনখারাবি হচ্ছে, কিংবা হতে পারে, এটা আঁচ করে ফেলেছে ক্রিস,” কিশোর বলল। “আমাদেরও সন্দেহের চোখে দেখছিল সে। ভেবেছে, আমরাও খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারি।”

বারান্দায় পদশব্দ শুনতে পেল মুসা। চোখ তুলে সার্জেন্ট মার্ককে দেখতে পেল। বারান্দার কোণ ঘুরে বেরিয়ে আসছেন। কিশোর আর মুসাকে চিনতে পেরে থেমে গেলেন। ধীরপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।

“তোমরা এখানে?” নিনাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইনি কে?”

“আমি নিনা জেরাল্ড,” হাত বাড়িয়ে দিল নিনা।

“ইনিও ট্রেজার হান্টারে কাজ করেন,” সার্জেন্ট যখন নিনার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন তখন বলল মুসা। “মেরিন আর্কিওলজিস্ট। আমরা এখানে এসেছি জাহাজের আরেকজন ক্রুকে নিয়ে, একটু আগে রাস্তায় মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ইমার্জেন্সিতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার জন্য অপেক্ষা করছি।”

“অ্যাক্সিডেন্ট,” রুক্ষ হয়ে গেল সার্জেন্টের কণ্ঠ। “মনে হচ্ছে, ট্রেজার হান্টারে চাকরি করা খুব ঝুঁকির কাজ। আর যখনই কোনো অঘটন ঘটে, তোমাদের দু’জনকে তার আশপাশে দেখা যায়।”

“আপনি এখানে, সার্জেন্ট?” প্রশ্ন করল কিশোর।

“টনি জেরোমের পরিবার থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, লাশটা যেন ব্রুকলিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি জানতে এসেছি, ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট তাদের সব পরীক্ষা শেষ করেছে কিনা, তাহলে লাশটা আমি নিয়ে যেতে পারি।”

“শেষ হয়েছে?” কিশোর জিজ্ঞেস করল।

দ্বিধা করলেন সার্জেন্ট। “আর একটামাত্র পরীক্ষা বাকি আছে। সোমবারে সেটা শেষ হয়ে গেলেই লাশটা আমি হাতে পাব। পুরো বিষয়টাই আসলে একটা ফর্মালিটি, তবে সেটাও সেরে নেওয়া উচিত, সময় থাকতে থাকতে।” প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করলেন, “জাহাজের অবস্থা কী? গুপ্তধনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে?”

“বুধবারের ডাইভিংয়ে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস পেয়েছি আমরা,” কিশোর জানাল। “ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আমরাও সোমবার নাগাদ ল্যাব-রিপোর্ট পেয়ে যাব।”

“তার মানে আজকের রাতটা আর আগামী দিন তোমাদের ছুটি আছে,” ভুরু কুঁচকে বললেন সার্জেন্ট। “অনেক সময়। আশা করি, এই সময়টাতে ঝামেলামুক্ত থাকতে পারবে তোমরা।”

“কী জানি, স্যার, বুঝতে পারছি না,” জবাব দিল মুসা।

মাথা ঝাঁকালেন ছোটখাটো মানুষটা। কঠিন মেঝেতে জুতোর খটাখট আওয়াজ তুলে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন বারান্দা ধরে।

“সার্জেন্টকে খুব ক্লান্ত লাগছে,” সার্জেন্ট দরজার বাইরে চলে গেলে নিনা বলল।

ভালো লাগেনি নিনারও, সে-ই বলল, “এমন ক্যাটক্যাট করে কথা বললেন কেন?”

“কঠিন সময় যাচ্ছে তাঁর,” কিশোর বলল। “টনির মৃত্যুর পর থেকেই নিশ্চয় তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। একটানা কাজ করতে করতে এখন তিনি ভীষণ ক্লান্ত।”

কিশোরের কথাটা যুক্তিসংগত মনে হলো মুসার কাছেও।

একটু পরই ক্রিসকে দেখতে পেল। একটা হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে আসা হচ্ছে। আবার সেই পুরোনো ‘বিষ’-এ ফেরত এসেছে সে। কিশোরদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

“আজ রাতে আমার কোনো ধরনের গাড়ি চালানো নিষেধ,” কাছে এসে ক্রিস জানাল। “এছাড়া, আমি ভালোই আছি।”

“যাক, বাঁচা গেল, হাসপাতালে যে থাকতে হয়নি আপনার।” দরজার দিকে পা বাড়াল নিনা। “আমি গাড়িটা নিয়ে আসি।”

“এত বড় অ্যাক্সিডেন্ট, অথচ একটা হাড়ও না ভেঙে আপনি থাকলেন কী করে?” রসিকতা করে বলল মুসা।

মাথা নাড়ল ক্রিস। “ডাক্তারের ধারণা, নরম মাটিতে পড়েছিলাম বলে বেঁচে গেছি। তিনি বললেন, বাইকটার কাছ থেকে দূরে ছিটকে পড়াতেও বেঁচেছি। ওটার নিচে পড়লে গেছিলাম।”

“ভালো। তবে এখন আবার হুইলচেয়ার থেকে পড়ে যাবেন না,” মুসা বলল।

হুইলচেয়ার থেকে উঠে কারও সাহায্য ছাড়াই হেঁটে গাড়ির কাছে এলো ক্রিস। তার ঢোকার জন্য গাড়ির দরজা খুলে ধরল মুসা। সামনের সিটে উঠে বসল ক্রিস।

“না, মনে হচ্ছে সত্যিই আপনি ভালো হয়ে গেছেন,” গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল মুসা। কিশোরের সঙ্গে পেছনের সিটে উঠে বসল সে। “এখন কয়েকটা প্রশ্ন করা যাক।”

“হ্যাঁ, ঠিক,” নিনা বলল। “আপনি আমার বাসার কাছে লুকিয়ে থেকে কী করছিলেন?”

“আমি লুকিয়ে থাকিনি,” প্রতিবাদ জানাল ক্রিস। “আমি আপনাকে খবরটা জানাতে গিয়েছিলাম। কিশোর যে জিনিসটা পেয়েছে, ওটার ল্যাব-রিপোর্ট নিয়ে ফিরেছেন ডা. হোল্ডিংস। সাধারণ একটা স্যুভেনির ওটা। ডাক্তারের ধারণা, জাহাজে করে যাওয়ার সময় কোনো ট্যুরিস্টের হাত থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। শুনে ক্যাপ্টেন কুপারের যা মেজাজ হয়েছে।”

“কিন্তু ওরকম জিনিস দুটো ছিল ওখানে, একই রকম দেখতে,” কিশোর বলল। “ডোরির হাতের বাড়ি লেগে একটা জিনিস আমার হাত থেকে খাদের মধ্যে পড়ে গেছে। ওটা আর তুলে আনা যাবে না। প্রশ্ন হলো, একই সঙ্গে একই রকম দুটো স্যুভেনির ট্যুরিস্টের হাত থেকে পানিতে পড়াটা কেমন কাকতালীয় মনে হচ্ছে না?”

কাঁধ ঝাঁকাল ক্রিস। “ডা. হোল্ডিংস জানিয়েছেন, কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে, জিনিস দুটো বিংশ শতাব্দীতে তৈরি।”

“কিন্তু সেটা আজ রাতে বলতে এলেন কেন?” নিনার প্রশ্ন। “সেটা তো সোমবারেও বলতে পারতেন, যখন আমাদের দেখা হত।”

“ক্যাপ্টেনের কথা আমি আড়াল থেকে শুনে ফেলেছি, এখন থেকে ডাবল শিফট চালু করবেন তিনি,” ক্রিস বলল। “আমার মনে হয়েছিল, আপনার এটা জানা দরকার জাহাজে যাবার আগেই। কারণ, আপনি বাসায় থাকেন। আমরা আর যারা জাহাজে থাকি, আজ রাতেই শুনে ফেলতাম।”

“দুই শিফট, পাগল নাকি!” ফেটে পড়ল নিনা। “ক্রুরা এমনিতেই সাধ্যের বাইরে খাটছে।”

“আমি জানি, শুনলে আপনারও খারাপ লাগবে,” ক্রিস বলল। “সে জন্যই তো জানাতে গেলাম।”

“এক মিনিট,” বাধা দিল মুসা। “জানাতে গেলে বেল বাজাননি কেন আপনি? তার বদলে পাতাবাহারের ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন কেন?”

“বেল বাজাতে যাচ্ছিলাম,” ক্রিস বলল। “কিন্তু সুইচে হাত দিতেই দেখি নিনাকে নিয়ে তোমরা দু’জন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছ। তাই তাড়াতাড়ি সরে গেলাম। জাহাজে এতগুলো অঘটন ঘটে যাওয়ার পর সন্দেহটা আর যাচ্ছিল না আমার। মনে হলো, তোমরা দু’জন নিনার কোনো ক্ষতি করবে। তাই লুকিয়ে থেকে দেখতে লাগলাম। খারাপ কিছু ঘটাচ্ছ দেখলেই নিনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। নিনা আমাকে দেখে ফেলাতেই ঝামেলাটা বাধল।”

“নিনাকে সাহায্য করতেই যখন গেলেন, পালালেন কেন?” মুসার প্রশ্ন।

“আমাকে যে ধরে মারবে না তোমরা, সেটাই বা কী করে বুঝব?” বিব্রত হাসি হাসল ক্রিস। “আমার ইচ্ছে ছিল, নিরাপদ কোথাও সরে গিয়ে সাহায্যের জন্য জাহাজে ফোন করব।”

“আমাকে নিয়ে হঠাৎ এত উদ্বেগের কারণ?” রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে প্রশ্ন করল নিনা।

ভ্রূকুটি করল ক্রিস। “আছে, কারণ আছে।” সামনের পকেটে হাত দিল সে। “আমার মনে হলো, এ জিনিসটা আপনার দেখা দরকার।”

অন্ধকারে গলা বাড়িয়ে ক্রিসের হাতের জিনিসটা দেখার চেষ্টা করল মুসা। রাস্তার একটা বাতির পাশ কাটানোর সময় একপলকের জন্য চোখে পড়ল। দম আটকে ফেলার মতো শব্দ করল নিনা। ক্রিসের হাতের জিনিসটা রবিনের আংটি।

“রবিন আমাকে আপনার অনেক ছবি দেখিয়েছে।” মোলায়েম স্বরে নিনাকে বলল ক্রিস। তার হাত থেকে আংটিটা তুলে নিল নিনা। “আপনাকে আমি দেখামাত্র চিনেছি। তার পর থেকেই আপনার ওপর কড়া নজর রাখার চেষ্টা করেছি, যাতে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে। আংটিটাও সযত্নে রেখে দিয়েছি। প্রথমে আঙুলে পরে ছিলাম। তারপর আপনারা দেখে যখন চমকে উঠলেন, তখন খুলে রেখে দিয়েছিলাম। রবিন আমাকে এই আংটিটা দিয়ে গেছে, যদি ওর কিছু হয়ে যায়, তাহলে যেন আপনাকে দিয়ে দিই।”

পেছনের সিটে বসে স্থির দৃষ্টিতে ক্রিসের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। তার ওপর থেকে সন্দেহ সরিয়ে নিতে নারাজ।

“তাহলে সি শোর হোটেলের ব্যাপারটা কী?” প্রশ্ন করল মুসা। “আপনি ডিয়েগোর সঙ্গে ওই হোটেল নিয়ে আলোচনা করছিলেন, আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল নিনা।”

“ওই হোটেলের নাম ছাপা একটা কার্ড পেয়েছি আমি,” ক্রিস জবাব দিল। “ডিয়েগোকে জিজ্ঞেস করছিলাম এ নামে কোনো হোটেল চেনে কিনা। তোমরা যখন আমার কাছে জানতে

চাইলে, অস্বীকার করলাম, তার কারণ তখনো তোমাদের বিশ্বাস করি না।”

“এখন করেন?” জানতে চাইল কিশোর।

“করা কি উচিত?” বলে হাসল ক্রিস। তারপর হালকা কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, এখন বিশ্বাস করি।”

ডকের সামনে এনে গাড়ি থামাল নিনা, যেখানে, কিছু দূরে নোঙর করে আছে ট্রেজার হান্টার। নিনা বাদে অন্য তিনজন নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। নিনা তার অ্যাপার্টমেন্টে যাবে।

গাড়ির ছাদ থেকে ক্রিসের মোটর সাইকেলটা নামাল মুসা আর কিশোর মিলে। আপাতত বাইকটা জাহাজেই রাখতে চায় ক্রিস, পরে সুযোগমতো গ্যারেজে দিয়ে আসবে।

“সাবধানে যাবেন,” মুসা বলল নিনাকে।

“কাল বোটের ব্যবস্থা করে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব,” নিনা বলল।

গাড়ি নিয়ে নিনা চলে গেলে, গ্যাংপ্ল্যাংক বেয়ে ক্রিসকে উঠতে সাহায্য করল মুসা। কিশোর দাঁড়িয়ে রইল মোটরবাইকটার কাছে। মুসা ফিরে এলে, দু’জনে মিলে জাহাজে তুলবে ওটা। হঠাৎ চমকে উঠল কিশোর জাহাজের ওপর থেকে একটা বাজখাঁই কণ্ঠ শুনে।

“ওই যে চোরটা এলো!” গর্জে উঠল কণ্ঠটা। “আবার কোন শয়তানি করবে কে জানে!”

চিৎকার শুনে আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মুসা। সামলে নিয়ে ওপর দিকে তাকাল। গ্যাংপ্ল্যাংকের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন কুপার। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন কিশোরের দিকে। ডক থেকে এসে পড়া আলোয় তাঁর চোখের দৃষ্টি দেখতে পেল মুসা।

এত খেপেছেন কেন ক্যাপ্টেন? অবাক হলো সে। নিশ্চয় কিশোরের তুলে আনা মার্কারটার কথা জেনে গেছেন।

“এই, কোথায় রেখেছ ওটা?” কিশোরের দিকে তাকিয়ে আবার ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। “বলো, জবাব দাও! আমি তোমাকেই বলছি, কিশোর পাশা!”

#####

বারো

“কিসের কথা বলছেন আপনি, ক্যাপ্টেন?” ভাঙাচোরা বাইকটার হ্যান্ডেল শক্ত করে চেপে ধরল কিশোর।

রেগে আগুন হয়ে থাকা ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মগজে ভাবনার ঝড়। হারানো মার্কারটার কথা তিনি জানলেন কী করে? কেন তুলে এনেছে, এই ব্যাখ্যাটাই বা কীভাবে দেবে কিশোর? সার্জেন্ট মার্কের কথাটা মনে পড়ল, “আশা করি, এই সময়টাতে ঝামেলামুক্ত থাকতে পারবে তোমরা।”

রাগে ফুলে যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন। “জিনিসটা তুমি বদলে দিয়েছ, তাই না?”

নিজেকে শক্ত করল কিশোর। “আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“যে ফালতু জিনিসটা তুমি ডা. হোল্ডিংসের হাতে তুলে দিয়েছ, ওটার রিপোর্টটা আমি দেখেছি,” রাগে গরগর করছেন ক্যাপ্টেন।

ফালতু জিনিস! দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল কিশোর। গ্যাংপ্ল্যাংকে দাঁড়ানো মুসার দিকে তাকাল। মুসা কি কিছু আন্দাজ করতে পারছে?

“আপনি কি…” মার্কারের কথা বলতে যাচ্ছিল মুসা।

“হ্যাঁ, ওই জিনিসটা!” আরও জোরে গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন। “পানির নিচ থেকে যেটা তুলে এনেছে তোমার দোস্ত। প্রথম যখন আমার হাতে দিল সে, ঠিকই ছিল ওটা। খালি চোখে দেখেই বুঝেছি, এ যুগের জিনিস নয়, কয়েক’শ বছর আগের বানানো। আমাকে ওটা দেখানোর পর কোনোভাবে বদলে ফেলেছে। আসল জিনিসটার বদলে অন্য ফালতু জিনিস ল্যাবে নিয়ে গেছেন ডা. হোল্ডিংস।”

মোটরবাইকের ওপর দেহের ভার ছেড়ে দিল কিশোর, দুর্বল লাগছে, স্বস্তিতে। মার্কারটা তাহলে খুঁজে পাননি ক্যাপ্টেন! তবে অ্যান্টিকের রিপোর্টটা কিশোরকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।

ক্যাপ্টেন কুপার বলছেন, তুলে আনা জিনিসটা আসল ছিল। কেউ ওটা বদলে একটা সাধারণ জিনিস দিয়ে দিয়েছে। কীভাবে দিল?

“স্যার, আপনিই বলছেন, যে জিনিসটা আমি পেয়েছি, সেটাই আপনার হাতে দিয়েছি,” কিশোর বলল। “আমি বলছি, আমি আপনাকে দেওয়ার পর আর স্পর্শও করিনি। পয়জন ওটা ব্যাগে রেখেছে, আর ডা. হোল্ডিংস ল্যাবে নিয়ে গেছেন।”

“এখন থেকে কোনো জিনিস ডেকে তুলে আনার পর জালের ব্যাগে হাত দেবে না কেউ, শুধু আমি আর ডা. হোল্ডিংস বাদে,” সাবধান করে দিলেন কুপার। এখনো গজগজ করছেন, তবে রাগ কিছুটা কমেছে বলে মনে হলো।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল কিশোর, “ইয়েস, স্যার।”

অ্যান্টিক বদলানোর বিষয়টা তাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সে জিনিসটা ক্যাপ্টেনকে দেওয়ার পর দু’জনের হাত লেগেছে ওটাতে— ক্রিস আর ডা. হোল্ডিংসের। কাকে সন্দেহ করবে?

ক্রিস, না ডা. হোল্ডিংসকে? নিনাকে আংটি ফেরত দিতে যাওয়াটা একটা চালাকিনা তো ক্রিসের? নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরানোর জন্য?

“আর এখন থেকে ডেকে ডাইভিং স্যুট খোলার পর সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে,” কুপার বললেন। “এই অভিযানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কিংবা ঝুঁকিতে ফেলবে, এমন কিছু হতে দেব না আমি।”

“আপনি যা বলবেন তাই হবে, স্যার।” গ্যাংপ্ল্যাংক থেকে জবাব দিল মুসা।

বাইকটা ঠেলে নিয়ে আসছে কিশোর। একা পারবে না। মুসাও এগিয়ে গেল সাহায্য করার জন্য।

“বুঝতে পারছি, রিপোর্টটা আপনাকে প্রচণ্ড হতাশ করেছে, ক্যাপ্টেন,” কিশোর বলল। মুসার সহযোগিতায় ক্রিসের বাইকটা ডেকে ঠেলে তুলে রেলিংয়ের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল। “তবে ডেক থেকে অ্যান্টিক সরানোর কোনো সুযোগই আমি পাইনি। আমিও আপনার মতোই ওই জিনিসটা খুঁজে বের করতে চাই।”

“হুঁ। তবে জিনিসটা কেউ বদলে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” গোঁ-গোঁ করে বললেন ক্যাপ্টেন। অনেকটা নরম হয়েছেন। “এখন যা‌ও, ঘুমাও। তবে, মনে রেখো, তোমাদের তিনজনের ওপর আমি নজর রাখব।” বলে ক্রিসের দিকে তাকালেন তিনি।

“বাপ রে!” নিচের কেবিনে যেতে যেতে মুসা বলল। “এত খেপা খেপতে দেখিনি আর ক্যাপ্টেনকে।”

“এর আগে জিনিস বদলানোর ঘটনাও তো ঘটেনি আর কখনো,” ক্রিস বলল। “তবে আজকের রাতটা যে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কাটল, তাতেই আমি খুশি।” নিজের কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “যাই হোক, তোমরা আমার ব্যবহারে কিছু মনে কোরো না।”

“আপনিও করবেন না,” অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ক্রিসের দিকে।

গভীর চিন্তায় মগ্ন কিশোর। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর সন্দেহ থেকে বাদ দিয়েছিল ক্রিসকে। অ্যান্টিকটা বদলানো হয়েছে শোনার পর আবার সন্দেহ হচ্ছে।

পরদিন সকালে ঝরঝরে দেখা গেল নিনাকে। গোসল সেরে এসেছে। তাজা দেখাচ্ছে। কিশোর আর মুসাকে বলল, “নাশতা যা এনেছি, তা নিয়ে খুঁতখুঁত করতে পারবে না, ঠিক আছে?” গাড়িতে চড়ল সে।

কিশোর আর মুসাও চড়ল। প্যাসেঞ্জার সিটে রাখা ডোনাটের বাক্স আর কমলার রসের বোতল দেখে কিশোর বলল, “এগুলো খেতে হবে, তাই না?”

“পছন্দ না হলে খেয়ো না,” হেসে বলল নিনা।

“না না, পছন্দ হবে না কেন?” তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

“সেই সকাল সাতটায় উঠেছি। বোট ঠিক করে, ডাইভিংয়ের জিনিসপত্র ভাড়া নিয়ে, নাশতা কিনে, তারপর এসেছি। বোটের কাছে যেতে যেতে এগুলো খাব আমরা।”

“কী ধরনের বোট জোগাড় করেছেন?” কিশোরের বাড়িয়ে দেওয়া মাখন লাগানো চকচকে একটা ডোনাটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল মুসা।

“বোট রেসিংয়ের কারণে বোট পাওয়া যাচ্ছিল না। দর্শকেরা সব নিয়ে গেছে। বহু চেষ্টা করে একটা বারো ফুট লম্বা মোটরবোট জোগাড় করতে পেরেছি। এর চেয়ে বড় আর পেলাম না। তবে আমার মনে হয়, এটাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে।” কিশোরের দেওয়া একটা ডোনাট নিনাও নিল। “তবে ওয়েট স্যুট আর এয়ার ট্যাংকগুলো খুব ভালো।”

“ওগুলোই ভালো দরকার। বারো ফুট বোটেই হয়ে যাবে,” কিশোর বলল। তার পাশে নাইলনের ব্যাগে রাখা মার্কারটায় হাত বোলাল। “এখন আমাদের পরিচিত কেউ দেখে না ফেললেই হয়।”

“মনে করিয়ে দিলে,” নিনা বলল। “শহরে ডোরির সঙ্গে দেখা হয়েছে। আজ বিকেলের বোট রেস দেখার জন্য টিকিট কিনতে গিয়েছিল। বলল, আগেভাগেই গিয়ে বসে থাকবে, ভালো জায়গায় সিট নেওয়ার জন্য।”

“নিশ্চয় ডিয়েগো আর বার্নির সঙ্গে যাবে,” মুসা বলল।

“তা জিজ্ঞেস করিনি,” নিনা বলল।

“এই নাও,” পেছনের সিটে বসা সহকারীর দিকে একটা কাগজের ন্যাপকিন ছুঁড়ে দিল কিশোর।

লুক্যাইয়ার রেন্টাল ডকে বাঁধা বোটটা যখন চোখে পড়ল কিশোরের, তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। ফোর-সিটার একটা বোট।

“ওটাই আমাদের,” নিনা বলল। গাড়িটা পার্ক করল।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বোটের পেছনের সিটে রাখা দুটো স্যুট, দুটো ট্যাংক, ফিন, মাস্ক— এসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বলল, “মনে হচ্ছে, সব ঠিকঠাক মতোই আছে।”

কাঠ, ইস্পাত আর সিমেন্টে তৈরি সরু, ঢালু পথ— যাকে পিয়ার বলে, সেটা ধরে এগোল তিনজনে। নেমে এলো বোটের কাছে। “প্রথমে আমি চালাব,” ইনবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো বোটটার দিকে তাকিয়ে মুসা বলল।

মুসার পাশে বসল নিনা। পেছনে বসে যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল কিশোর। বোটে চড়ে ভালো লাগছে তার। আবহাওয়া চমৎকার। গত রাতে ঝড় হয়েছিল, তার কোনো চিহ্নই এখন দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঢেউগুলো সামান্য বেসামাল। এরকম একটা সকালই চেয়েছিল সে। ভাবল, মুসাই বোট চালাক, ও বসে বসে বরং যাত্রাটা উপভোগ করবে।

“জায়গাটা কীভাবে খুঁজে বের করবে?” মুসাকে জিজ্ঞেস করল নিনা। ঢেউয়ের ওপর নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে বোট।

“দেখলে চিনতে পারব,” ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে জবাব দিল মুসা। “ডাঙার কিছু দৃশ্য আমি মনে রেখেছিলাম, ট্রেজার হান্টারে করে যখন দেখেছিলাম।”

কিশোরও দেখছে। কোন জায়গা থেকে মার্কারটা তুলে এনেছে, দেখে বোঝার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু বোট দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে, আরেকটা তো একেবারে সেই জায়গাটাতেই নোঙর করেছে, যেখানে যাচ্ছে তারা। অলস ভঙ্গিতে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সোজা হয়ে বসল কিশোর।

“অদ্ভুত!” চেঁচিয়ে উঠল সে।

তার দিকে ফিরে তাকাল নিনা।

“তাড়াতাড়ি নোঙর তুলে চলে যাচ্ছে ওই বোটটা,মনে হচ্ছে যেন আমাদের দেখেই।”

“হয়তো ভেবেছে, আমরা গিয়ে তার নির্জনতা নষ্ট করব,” নিনা জবাব দিল।

ব্যাখ্যাটা যুক্তিসংগত মনে হলো না কিশোরের। খোলামেলা সাগর, অনেক জায়গা। একটা বাড়তি বোট আরেকটা বোটের কাছাকাছি গেলে নির্জনতা নষ্ট হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ইগনিশনে মোচড় দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল মুসা। ততক্ষণে ওয়েট স্যুট পরে ফেলেছে কিশোর।

সিট থেকে উঠে এসে মুসাও ওয়েট স্যুট পরতে আরম্ভ করল। তার জায়গায় গিয়ে বসল নিনা।

“তীরের দিকে নজর রাখবেন,” মুসা বলল। “কোনো একটা ল্যান্ডমার্ক নজরে রাখবেন…যাতে আমরা কোন জায়গায় আছি বুঝতে পারেন…”

“মুসা,” বাধা দিয়ে বলল নিনা, “আমি একজন মেরিন আর্কিওলজিস্ট। ওসব আমি জানি। বোটও সামলাতে পারব।”

“ও, তাই তো। ভুলে গিয়েছিলাম,” হাসল বিব্রত মুসা।

ইতিমধ্যে পেছনের সিটের নিচ থেকে একটা দড়ি টেনে বের করেছে কিশোর। দড়ির এক মাথা বোটের পাশে আটকানো একটা হুকের সঙ্গে বাঁধল। আরেক মাথায় নোঙর বাঁধল।

“সিগন্যাল দেওয়ার জন্যও এই দড়িটা ব্যবহার করতে পারব,” কিশোর বলল। “নিচে যদি কোনো ঝামেলায় পড়ি, দড়ি ধরে টান দিয়ে নিনাকে বোঝাতে পারব। আবার নিনাও একইভাবে আমাদের সংকেত দিতে পারবে।”

মাথা ঝাঁকাল নিনা।

“আমাদের ট্যাংকে মোটামুটি এক ঘণ্টা চলার মতো বাতাস আছে,” কিশোর বলল। মার্কার ও কালো রঙের সোনার যন্ত্রটা একটা ডাফল ব্যাগে ভরে সঙ্গে নিল।

নিনা বলল, “সাবধানে থাকবে।”

“থাকব।” নাটকীয় ভঙ্গিতে নিনাকে স্যালুট করল মুসা। তারপর বোটের কিনার দিয়ে কিশোরের সঙ্গে পানিতে নামল।

সাগরের নিচের দৃশ্য চিরকালই কিশোরকে মোহিত করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ধীরে শ্বাস নিতে নিতে মাস্কের ভেতর দিয়ে গাঢ় নীল পানিতে বিচিত্র সব মাছ দেখছে। মুসার দিকে তাকাল। সে-ও মুগ্ধ হয়ে পানির নিচের দৃশ্য দেখছে।

ধীরে ধীরে সাগরের তলদেশে নেমে এলো ওরা। দড়ি ধরে দু’বার টান দিয়ে নিনাকে বোঝাল কিশোর, নিরাপদেই নেমেছে ওরা।

বিশ গজ বাঁয়ে তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারল কিশোর। আগেরবার এখানেই নেমেছিল। সাগরের তলদেশের বালি অনবরত জায়গা বদল করে। গত কয়েক দিনে এখানেও বালি সরে গিয়ে জায়গাটার চেহারা অন্য রকম হয়ে গেছে। তবে গভীর খাদটা একটা বিরাট চিহ্ন, ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। খাদের কিনার ধরে আস্তে আস্তে সাঁতরে চলল কিশোর, লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর জন্য।

দশ মিনিট পর মার্কারটা খুঁজে পেল, যেখানে একই রকম দেখতে এক জোড়া জিনিস পেয়েছিল। আবার পেছনে ফিরে সাঁতরাতে শুরু করল, যেখানে সোনারভরা মার্কারটা ছিল।

যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে সহজ হয়ে গেল কাজটা, ভাবল কিশোর। মার্কার বদল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিশোরের সামান্য ওপরে দড়ি ধরে ভেসে রইল মুসা, প্রয়োজন পড়লেই যাতে টেনে নিনাকে সংকেত দিতে পারে।

এত তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যাবে, ভাবেনি কিশোর। তাই উল্টো দিকে কী আছে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। মুসার কাছে এসে তাকে অনুসরণ করতে ইশারা করল।

প্রথমে মনে হলো, অহেতুক সময় নষ্ট। বালির ওপর পড়ে থাকা পাথর কিংবা পাথরের স্তূপগুলোর কোনোটার মধ্যেই কিছু খুঁজে বের করতে পারল না। ওগুলোর চারপাশের বালি সরিয়ে দেখার জন্য এয়ার লিফট দরকার। খুদে শামুকে ছেয়ে থাকা জিনিসগুলো দেখেও ওগুলোর নিচে কী আছে কিছুই বোঝার উপায় নেই।

আবার আগের জায়গাটায় যাওয়ার জন্য ঘুরতে যাবে কিশোর, এই সময় তার কাঁধে টোকা দিল মুসা। ইঙ্গিতে বোঝাল, কিছু দেখাতে চায়।

মুসার সঙ্গে সাঁতরে গেল কিশোর। মুসার দেখানো জিনিসটা দেখল।

বালি থেকে উঁচু হয়ে আছে আরেকটা সাদা রঙের মার্কার। তুলে নিল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল সে। সাধারণ মার্কারের তুলনায় এ মার্কারটাও ভারী। তার মানে এটার ভেতরেও সোনারভরা আছে।

দ্রুত সাঁতরে সামনে এগিয়ে চলল ওরা। শিগগির বালিতে পড়ে থাকা আরেকটা সাদা মার্কার দেখতে পেল মুসা। কিশোরকে দেখাল। পরীক্ষা করে দেখে এবারও মাথা ঝাঁকাল কিশোর, এটার ভেতরেও সোনারভরা।

কিশোর লক্ষ করল, ট্রেজার হান্টার যে পথে এগিয়েছিল, তার উল্টো দিকে চলেছে ওরা। সোনারভরা মার্কারগুলো দেখে নিশ্চিত হলো, গুপ্তধন কোথায় রয়েছে জেনে গেছে কেউ। সেটা গোপন রাখতে চায়। কিন্তু নিজে যাতে চিনে আবার বের করতে পারে, সে জন্য সোনারভরা মার্কার রেখে রেখে চিহ্ন দিয়ে গেছে।

নেই। খাদের কিনার ধরে আস্তে আস্তে সাঁতরে চলল কিশোর, লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর জন্য।

দশ মিনিট পর মার্কারটা খুঁজে পেল, যেখানে একই রকম দেখতে এক জোড়া জিনিস পেয়েছিল। আবার পেছনে ফিরে সাঁতরাতে শুরু করল, যেখানে সোনারভরা মার্কারটা ছিল।

যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে সহজ হয়ে গেল কাজটা, ভাবল কিশোর। মার্কার বদল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিশোরের সামান্য ওপরে দড়ি ধরে ভেসে রইল মুসা, প্রয়োজন পড়লেই যাতে টেনে নিনাকে সংকেত দিতে পারে।

এত তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যাবে, ভাবেনি কিশোর। তাই উল্টো দিকে কী আছে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। মুসার কাছে এসে তাকে অনুসরণ করতে ইশারা করল।

প্রথমে মনে হলো, অহেতুক সময় নষ্ট। বালির ওপর পড়ে থাকা পাথর কিংবা পাথরের স্তূপগুলোর কোনোটার মধ্যেই কিছু খুঁজে বের করতে পারল না। ওগুলোর চারপাশের বালি সরিয়ে দেখার জন্য এয়ার লিফট দরকার। খুদে শামুকে ছেয়ে থাকা জিনিসগুলো দেখেও ওগুলোর নিচে কী আছে কিছুই বোঝার উপায় নেই।

আবার আগের জায়গাটায় যাওয়ার জন্য ঘুরতে যাবে কিশোর, এই সময় তার কাঁধে টোকা দিল মুসা। ইঙ্গিতে বোঝাল, কিছু দেখাতে চায়।

মুসার সঙ্গে সাঁতরে গেল কিশোর। মুসার দেখানো জিনিসটা দেখল।

বালি থেকে উঁচু হয়ে আছে আরেকটা সাদা রঙের মার্কার। তুলে নিল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল সে। সাধারণ মার্কারের তুলনায় এ মার্কারটাও ভারী। তার মানে এটার ভেতরেও সোনারভরা আছে।

দ্রুত সাঁতরে সামনে এগিয়ে চলল ওরা। শিগগির বালিতে পড়ে থাকা আরেকটা সাদা মার্কার দেখতে পেল মুসা। কিশোরকে দেখাল। পরীক্ষা করে দেখে এবারও মাথা ঝাঁকাল কিশোর, এটার ভেতরেও সোনারভরা।

কিশোর লক্ষ করল, ট্রেজার হান্টার যে পথে এগিয়েছিল, তার উল্টো দিকে চলেছে ওরা। সোনারভরা মার্কারগুলো দেখে নিশ্চিত হলো, গুপ্তধন কোথায় রয়েছে জেনে গেছে কেউ। সেটা গোপন রাখতে চায়। কিন্তু নিজে যাতে চিনে আবার বের করতে পারে, সে জন্য সোনারভরা মার্কার রেখে রেখে চিহ্ন দিয়ে গেছে।

কিশোর জানে, আর এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাপ্টেন কুপারের টাকা ফুরিয়ে যাবে। এমনকি হতে পারে, ক্রুদের ভুল পথে পরিচালিত করছেন তিনি, যাতে গুপ্তধনের ভাগ দিতে না হয়? তাহলে কি তিনি নিজেই গোপনে মার্কারগুলোকে রেখে গেছেন? নাকি অন্য কারও কাজ? প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকল কিশোরের মাথায়। তার মনে হলো, গুপ্তধনের খবর ক্যাপ্টেন জানেন না। তাহলে সারাক্ষণ এত খেপে থাকতেন না। অভিযানও চালিয়ে যেতেন না। কাজটা যে করেছে, সে অন্য কেউ।

কিশোরের চোখের দিকে তাকাল মুসা। তারপর কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে ইশারা করল। নিনাকে বলে এসেছে প্রথমবার ডাইভিংয়ে বিশ মিনিটের বেশি থাকবে না ওরা। অথচ ইতিমধ্যেই পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেছে।

যদিও এগিয়ে চলা সোনারের চিহ্ন থেকে সরতে ইচ্ছে করছে না তার, গুপ্তধনগুলো না দেখে যেতে ইচ্ছে করছে না, তবু মার্কার থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে মুসাকে ওপরে ওঠার ইশারা করল কিশোর। একই সঙ্গে বিসি জ্যাকেটের ভালভ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে দিল। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, দড়িটা ধরে রেখেছে মুসা। কিন্তু আরও একটা দৃশ্য তার চোখে পড়ল, যা হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিল তার।

আস্তে হাত বাড়িয়ে মুসার কাঁধ চেপে ধরল কিশোর। আরেক হাত তুলে ওপর দিকে ইঙ্গিত করল।

অবাক হয়ে কিশোরের নির্দেশিত দিকে তাকাল মুসা।

কালো একটা ছায়াকে ওদের মাথার ওপর ঘুরতে দেখল। ঘুরে ঘুরে নেমে আসছে।

রোদের আলো বর্শার মতো হয়ে পানিকে বিদ্ধ করেছে। তার ভেতর দিয়ে তাকাতে গিয়ে চোখ মিটমিট করতে লাগল মুসা।

অস্পষ্ট ছায়াটাকে পরিচিত লাগল।

আরও কাছে এলো। আরও স্পষ্ট হলো ওটা।

পাক খেয়ে খেয়ে ওদের দিকে নেমে আসছে বিশাল এক হাঙর!

#####

তেরো

নাআআআআ!

নিজের নীরব চিৎকারটা যেন নিজের মাথাতেই বেজে উঠল মুসার। হাঙরটার দিকে তাকিয়ে আছে সে, আতঙ্ক দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। নিরস্ত্র অবস্থায় এত বড় একটা হাঙরের বিরুদ্ধে খালি হাতে কিছুই করার নেই ওদের। দড়ি টেনে নিনাকে বোঝাতে পারে, ওরা সমস্যায় পড়েছে। তাতে কোনো লাভ হবে না। এ ব্যাপারে নিনারও কিছু করার নেই, দুর্ভাবনা করা ছাড়া।

হাঙর আছে জানলে আগে থেকে সতর্ক হতে পারত। স্পিয়ার গান নিতে পারত। কিংবা বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার জন্য ইলেকট্রিক পড! হাঙরের কথা ভাবেইনি ওরা। ট্রেজার হান্টার থেকে ডুব দেওয়ার সময় ক্যাপ্টেন কুপারও হাঙরের কথা বলেননি। তার মানে তিনি হাঙরের আশঙ্কা করেননি। তীর থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা। বড় হাঙর সাধারণত তীরের এত কাছাকাছি আসে না।

হাঙরটা আর পনেরো গজ দূরে আছে। ওটাকে তাড়ানোর একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। দ্রুত। কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। অস্থির ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ করছে কিশোর।

কিশোরের বেল্টে ঝোলানো ডাফল ব্যাগটার ওপর চোখ পড়তেই চকিতে বুঝে গেল মুসা, কী করতে হবে।

সোনার ডিটেক্টর! সোনার ওয়েভ ব্যবহার করে হাঙরটাকে চমকে দিতে হবে।

যন্ত্রটা ব্যবহার করতে ইশারা করল কিশোরকে।

হাঙরটা তখন মুসার দিকে এগোচ্ছে।

বড় একটা পাথরের চাঙড় আঁকড়ে ধরল মুসা। গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে দেখছে, নিজের ব্যাগ হাতড়াল কিশোর, সোনারটা বের করে নিল। তারপর দুই হাতে উঁচু করে ধরল।

সোনার ডিটেক্টরের লাল বোতামটা টিপে দিল কিশোর।

কিছুই ঘটল না।

দু’জনেই আতঙ্কিত।

তবে নিজের ভুল বুঝতে পারল কিশোর। এভাবে সরাসরি হাঙরের দিকে তাক করে সোনার ব্যবহার করলে হবে না। জোরালো সোনার ওয়েভ তৈরি করতে হবে। সোনারভরা কোনো একটা মার্কারের কাছে গিয়ে কালো যন্ত্রটা ওটার দিকে তাক করে বোতাম টিপতে হবে। তাতে মার্কারের ভেতরের সোনারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ওয়েভ তৈরি হয়ে হাঙরের গায়ে লাগবে। তখন ভড়কে যেতে পারে হাঙরটা।

মুসার এত কাছে চলে এসেছে ওটা, হাঁ করা মুখের ভেতর দাঁতের সারিগুলোও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। পাথর ছেড়ে দিয়ে এক হাতে চেপে ধরল দড়িটা। খালি হাতেই লড়াই করার প্রস্তুতি নিল।

আবার যন্ত্রের বোতাম টিপল কিশোর।

এবারও প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তারপর হঠাৎ করেই আক্রমণাত্মক দানবটা থমকে গেল। দ্বিধান্বিত। মুসার পেট থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে রয়েছে ওটার মুখ। আচমকা শরীর বাঁকা করে সরে যেতে শুরু করল। কয়েক গজ বাঁ দিকে গিয়ে থামল।

সবে কিছুটা স্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করছে মুসা, এই সময় নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ঘুরে আবার আক্রমণ করতে এলো হাঙরটা।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুসা। আবার সোনারের বোতাম টিপল কিশোর। আবারও শেষ মুহূর্তে আক্রমণ না করে সাঁতরে মুসার পাশ কাটাল হাঙরটা।

তবে, কিশোরের দিকে যাচ্ছে। দ্রুত সাঁতরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। খানিক পরই দেখল, ওকে নয়, যে মার্কারটা তাক করে সোনার টিপেছিল, হাঙরটা ওটার দিকে যাচ্ছে। ওটা থেকেই সোনারের ঢেউ এসে ধাক্কা খেয়েছে হাঙরটার গায়ে। খেপে গিয়ে তাই ওটাকেই শত্রু ভেবে কামড়ানোর চেষ্টা করল হাঙরটা। লেজের ঝাপটায় পানিতে ঘূর্ণি তুলল। তলদেশের বালি ওড়াল মেঘের মতো।

দ্রুত সরে এলো কিশোর। মুসাকে ইশারা করল ওপরে ওঠার জন্য। দড়ি ধরে উঠতে শুরু করল মুসা। পেছনে কিশোর। আশা করল ওরা নিরাপদে নৌকায় না ওঠা পর্যন্ত মার্কারটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে হাঙরটা।

নৌকাটার অবয়ব ছায়ার মতো নজরে এলো ওদের। ওটাকে আবার দেখতে পাবে, আশা করেনি দু’জনের কেউই। মুসার ঠিক

পেছনে রয়েছে কিশোর। দ্রুত সাঁতরে ওপরে উঠছে। নিচের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না, ভয়ংকর কিছু দেখার ভয়ে।

বারবার দড়িতে টান লাগায় ভয় পেয়ে গেছে নিনা। উদ্বিগ্ন হয়ে বোটের কিনারে দাঁড়িয়ে দড়ির সিঁড়ির মাথায় ঝুঁকে রয়েছে। কিশোর আর মুসা পানিতে মাথা তোলামাত্র চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?” হাত বাড়িয়ে দিল ওদের টেনে তোলার জন্য।

“হাঙর!” মুসা বলল।

দম আটকে ফেলল নিনা। প্রথমে মুসাকে, তারপর কিশোরকে পানি থেকে টেনে তুলল। কিছু দূরে হাঙরটার পিঠের পাখনাও পানি ফুঁড়ে ভেসে উঠল।

“ওরে বাবা, কত্ত বড়!” হাঙরটার পাখনার দিকে তাকিয়ে বলল নিনা।

শরীর থেকে যন্ত্রপাতি খুলে ফেলতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। তাকিয়ে রয়েছে হাঙরটার দিকে। বোটের দশ ফুট দূরে ওটার পাখনা যেন ছুরির মতো ঢেউ কেটে ছুটে চলেছে। ধপ করে ডেকের ওপর বসে পড়ল মুসা। বুঝতে পারছে, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছে।

শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে বুঝতে পেরে অবশেষে চলে গেল হাঙরটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। “ভাগ্যিস, সোনারটার কথা মনে পড়েছিল!”

“এটাই তো এয়ারপোর্টে রেখে আসতে চেয়েছিলে?”

“রেখে এলে ভুল করতাম,” মুসা জবাব দিল। “তোমার কোমরে ব্যাগটা ঝুলতে দেখে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোনার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিল নেভি।”

“কী এক্সপেরিমেন্ট?” নিনার প্রশ্ন।

“সোনারকে শার্ক রিপেলেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে কতখানি ফল পাওয়া যায়,” মুসা বলল। “কিন্তু উল্টো ফল হয়েছিল। দেখা গেল, সোনারের শব্দ হাঙর তাড়ানোর পরিবর্তে হাঙরকে বরং ডেকে আনে। তার পরই এই পরীক্ষা বাদ দিয়েছিল ওরা।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ, সোনার ওয়েভে ভড়কে গিয়ে নয়, ওটাকে শত্রু ভেবেই তোমাদের ফেলে ওটাকে আক্রমণ করেছিল হাঙরটা,” নিনা বলল।

“মনে হয়,” মাথা ঝাঁকাল মুসা।

“মার্কারের ভেতর যে সত্যিই সোনার ভরা আছে হাঙরটা এসে তা প্রমাণ করে দিয়ে গেল,” কিশোর বলল। “এক সারি মার্কার দেখতে পেয়েছি আমরা। আমার ধারণা, মার্কারগুলো সোজা সান্তা হুয়ানের দিকে চলে গেছে।”

“তার মানে গোপনে কেউ ওখানে চিহ্ন দিয়ে রেখেছে,” ভ্রূকুটি করল নিনা। “কিন্তু কে?”

“যে গুপ্তধনগুলো একাই মেরে দিতে চায়,” জ্যাকেটের জিপার খুলল মুসা। তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে।

আবার ফিরে এসেছে হাঙরটা। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝেমধ্যে লাফ দিচ্ছে শূন্যে। হাঁ করা চোয়াল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মুসা। মনে হয় যেন খাবারের নেশায় উন্মত্ত।

“ঘটনাটা কী?” বিড়বিড় করল সে।

হাঙরটার গতিবিধি কিশোরও লক্ষ করছে। বোটের কাছ থেকে সামান্য দূরে তার চোখ পড়ল। “হায় হায়, আগে এটা দেখিনি কেন?”

ঢেউয়ের নিচে কতগুলো কালো ছায়ার দিকে হাত তুলল সে। ঢেউয়ের ঝাপটায় হঠাৎ জিনিসগুলোর একটা ওপরে ভেসে উঠল। মাংসের টুকরো। বড় বড় মাংসের টুকরো পানির নিচে ভাসছে।

“কেউ ওগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে গেছে, দড়ির আরেকমাথায় চোখা শিক বেঁধে খুঁটির মতো গেঁথে দিয়েছে সাগরের তলায়, যাতে টুকরোগুলো সরে যেতে না পারে,” কিশোর বলল। “এখানে মাংস রাখার একটাই উদ্দেশ্য। রক্তের গন্ধে হাঙর আসবে। আর হাঙরের ভয়ে এখানে কেউ ডুব দিতে পারবে না। একটা এসেছে। আরও হাঙর আসবে।”

“ওই যে বোটটা আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি করে চলে গিয়েছিল,” মুসা বলল, “ওটাতে করে যে এসেছিল, সে-ই মাংস রেখে গেছে।”

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। “হ্যাঁ। এখন আমি শিওর, আমাদের দেখেই পালিয়েছে, আমরা চিনে ফেলব, তাই।”

“ফিরে যাই, নাকি?” নিনা বলল। “হাঙর ঘোরাফেরা করছে। আজ আর ডুব দেওয়া উচিত হবে না।”

একমত হলো দুই গোয়েন্দা। নোঙরের দড়িটা টেনে তুলতে শুরু করল মুসা। হালকা লাগল। দড়ির পুরোটা উঠে আসার পর বুঝতে পারল কী ঘটেছে। হাঙর কামড়ে দুই টুকরো করে ফেলেছে।

দড়ির কাটা মাথাটা দেখিয়ে মুসা বলল, “আমাদের পায়ের অবস্থাও এমন হতে পারত।”

“পায়ের জায়গায় টাকা খসবে,” মলিন হাসি হাসল কিশোর।

“দড়িটা তিরিশ ডলার, আর নোঙরটা এক’শ,” বোট রেন্টাল অফিসের ক্লার্ক বলল।

“এক’শ তিরিশ!” ভুরু কুঁচকে বলল মুসা। “এ তো দিনে ডাকাতি!”

“জলদস্যুর রক্ত নাকি আপনার শরীরে?” রেগে গেল নিনাও।

কিন্তু নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্লার্ক জবাব দিল, “কমই কেটেছি, নোঙরটা পুরোনো হওয়াতে, নতুন হলে অনেক বেশি দিতে হত।”

তর্ক না করে টাকাটা দিয়ে দিল কিশোর। নিনা আর মুসার সঙ্গে গাড়ির দিকে এগোল। নিনা বলল, “টাকা গেছে, যাক, প্রাণে তো বাঁচলে। দড়িটা তোমাদের ঠিক জায়গায় ভেসে উঠতে সাহায্য করেছে। এর বিনিময়ে ওই কটা টাকা কিছু না।”

কিশোরের প্রতিক্রিয়া শুনতে চাইল নিনা। কিন্তু গভীর চিন্তায় ডুবে আছে গোয়েন্দাপ্রধান। গাড়িতে উঠে বলল, “আপনার একটা পেপারক্লিপিং ধার দেবেন? ট্রেজার হান্টারের ক্রুদের গ্রুপ ফটোগ্রাফ ছাপা ক্লিপিংটা।”

“দেব। কিন্তু কেন?” ইগনিশনে মোচড় দিল নিনা।

“একটা কথা ভাবছি। শিওর না হয়ে এখনই বলব না,” জবাব দিল কিশোর। “আরেকটা কথা, আপনার গাড়িটাও কয়েক ঘণ্টার জন্য ধার দিতে হবে আমাদের।”

“আমাকে রেখে কোথাও যেতে চাও?”

“কোথায়?” মুসা জিজ্ঞেস করল পেছনের সিট থেকে।

“ডক ফ্রেন্ডে। ব্যারি গুডের সঙ্গে কাজ আছে— যদি সে থাকে।”

গাড়িতে অপেক্ষা করছে কিশোর আর মুসা। খবরের কাগজের কাটিং আনতে গেছে নিনা। মুসা ভাবছে, কী করতে চাইছে কিশোর? জানে, এখন প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। সময় না হলে জবাব দেবে না কিশোর। মাঝেমধ্যে এরকম করা তার স্বভাব।

এরকম সময়ে মুসার খুব রাগ লাগে। তবে কিছু করার নেই। তাই আপাতত চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করল।

“এই নাও,” খোলা জানালা দিয়ে কাটা কাগজটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল নিনা। “সত্যিই কি আমাকে সঙ্গে নিতে চাও না?”

“থ্যাংকস,” নিনার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল কিশোর। মুসা বুঝতে পারছে, নিনাকে কেন নিতে চাইছে না সে। ডক ফ্রেন্ড নিনার জন্য বিপজ্জনক জায়গা।

“শিগগির ফিরে আসব আমরা,” নিনাকে বলে ইঞ্জিনে গিয়ার দিল কিশোর।

লাফ দিয়ে ফুটপাতে উঠে পড়ল নিনা। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে হাত নাড়ল মুসা।

নিনার সবুজ হ্যাচব্যাক গাড়িটা যখন ডক ফ্রেন্ডের পার্কিং লটে ঢুকল, মুসা গুনে দেখল, দশটা গাড়ি আছে এখানে। ব্যারির রঙিন কাচওয়ালা কালো গাড়িটা দেখাল সে। “আমাদের আগেই হাজির হয়ে গেছে।”

“আমি জানতাম,” খুশি হয়ে জবাব দিল কিশোর। “সে আসবে।”

দিনের আলোয় ক্লাবটা দেখে হতাশ হলো মুসা। বাড়িটা দেখে এখন মনে হচ্ছে একটা ট্রাক রাখার পুরোনো গ্যারেজ। রাতে আলোর কারণে বদলে যায়।

ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যারিকে চোখে পড়ল মুসার। একটা বুদে বসে কাগজ পড়ছে।

“হাই, ব্যারি,” টেবিলের উল্টো দিকে ব্যারির মুখোমুখি বসে পড়ল কিশোর। “রবিন মিলফোর্ডের কোনো খবর পেলেন? আপনাকে না ফোন করার কথা ছিল?”

চোখের পাতা আধবোজা করে কিশোরের দিকে তাকাল ব্যারি। মুসা লক্ষ করল, ওদের দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হয়নি লোকটা। জবাব দিল, “তার ফোনের অপেক্ষাই করছি। সে জন্যই এখানে এসে বসে আছি।”

“ও ফোন করবে, আপনি শিওর?” মুসা জিজ্ঞেস করল।

“নাহলে কি আসতাম?” রুক্ষ কণ্ঠে বলল ব্যারি। “আমি এখন ব্যস্ত। রাতে আমার সঙ্গে দেখা কোরো, যা কথা ছিল।”

আবার খবরের কাগজের দিকে চোখ নামাল সে। চুপ করে আছে মুসা। কিশোর কী করতে এসেছে, সেটা দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির।

“হ্যাঁ, আপনার মতো একজন মানুষকে এভাবে ঘোরায়, রবিনের সাহস আছে বলতে হবে,” মসৃণ কণ্ঠে কথাটা বলে মুসার দিকে তাকাল কিশোর।

“তা তো নিশ্চয়,” কিশোরের ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে সুর মেলাল মুসা। সল্ট শেকারটা তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর ঘোরাতে শুরু করল। “ও ভাবছে, সহজেই পার পেয়ে যাবে। আপনাকে ঠকিয়ে, আমাদের ঠকিয়ে, সটকে পড়বে।”

ব্যারির মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে।

“যেভাবে ঘোরাচ্ছে আপনাকে, দেখে খারাপই লাগছে আমার,” কিশোর বলল।

“ঠিক।” সল্ট শেকারটা রেখে দিল মুসা। “ভাবুন একবার, গুপ্তধনের টাকাগুলো যদি পেয়ে যায়, নিয়ে সরে পড়বে। কোনো জিনিস, কিংবা আপনার টাকা, কোনোটাই আর ফেরত পাবেন না। মাঝখান থেকে পুলিশি ঝামেলায় জড়াবেন।”

“আজ রাতেই তার ব্যবস্থা করব আমরা,” টেবিলে রাখা খবরের কাগজটায় চাপড় মারল ব্যারি।

“হ্যাঁ। আসলে এ ধরনের লোকের উচিত শিক্ষার দরকার আছে,” কিশোর বলল। ব্যারিকে যতটা সম্ভব রাগাতে চাইছে। “নিজেকে কী ভাবে ও? আমাদের ঠকিয়ে পালাবে?”

আড়চোখে ব্যারির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। অস্বস্তিভরে চেয়ারে বসে শরীর মোচড়ানো শুরু করেছে লোকটা। রাগ বাড়ছে তার, বোঝা গেল।

“দেখুন না, কাগজে ছবি পর্যন্ত ছেপে দিয়েছে, যেন মস্ত এক হিরো। সাগরে ডুব দিয়ে পুরোনো একটা জাহাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে, এসব খবরও ছাপা হচ্ছে।” ব্যারির দেখার জন্য ওর সামনে টেবিলে খবরের কাগজের কাটিংটা বিছাল কিশোর।

ব্যারির চোখ দেখেই কিশোর বুঝল, তার কৌশল কাজে লেগেছে। রেগে আগুন হয়ে গেছে ব্যারি। “কার সঙ্গে খেলতে এসেছ তা তো জানো না,” কাটিংয়ের একটা ছবির ওপর আঙুল ঠেসে ধরল। “রবিন মিলফোর্ড, তোমার ব্যবস্থা আমি আজ রাতেই করব!”

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। আবার তাকাল ছবিটার দিকে। ব্যারি যে ছবিটার ওপর আঙুল রেখেছে, ওটা রবিন নয়, ডোরি পাউস।

চোদ্দো

“এই ছবিটাই রবিন মিলফোর্ডের, আপনি শিওর?” ব্যারির আঙুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

“নিশ্চয়ই!” ব্যারি বলল। চোখ তুলে সন্দেহের চোখে তাকাল কিশোরের দিকে। “কেন, তোমরা কি অন্য কোনো রবিন মিলফোর্ডকে চেনো নাকি? এটা রবিনের ছবি নয়?”

“না না, রবিনেরই, রবিনেরই!” তাড়াতাড়ি বলল কিশোর।

ডোরি পাউসকে ব্যারি রবিন বলছে। অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। কিশোর কী করতে চেয়েছিল, বুঝে ফেলেছে।

ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আস্তে করে ব্যারির আঙুলের নিচ থেকে কাটিংটা টেনে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ভরল। “থ্যাংকস, ব্যারি। আপনি আমাদের অনেক উপকার করলেন!” বলে ব্যারিকে অবাক করে দিয়ে ওর ডান হাতটা ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল। কিছুই না বুঝে শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল ব্যারি।

ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর ও মুসা।

নিনার বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় চুপচাপ গাড়ি চালাল কিশোর। বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারল না মুসা। “তার মানে, ডোরি পাউসই রবিন সেজে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। আসল রবিনকে চেনে না ব্যারি। ডোরিকেই রবিন মনে করেছে। আর তুমি এটা বুঝতে পেরেছিলে?”

“হ্যাঁ,” স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল কিশোর। “এখন বুঝতে পারছ তো, হাঙরকে ডেকে আনার জন্য পানিতে মাংস ভাসিয়ে রেখেছিল কে? আজ সকালে লুক্যাইয়ায় টিকিট কিনতেই গিয়েছিল ডোরি। নিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নিনাকে ডাইভিং স্যুট ভাড়া নিতে দেখে বুঝে ফেলে আমরা ডুব দিতে যাচ্ছি। এটাও অনুমান করে ফেলে, কোন জায়গাটায় ডাইভিং করব। তাই মাংস কিনে নিয়ে ভাসিয়ে রাখে, যাতে রক্তের গন্ধে হাঙর আসে, আমরা ডুব দিতে না পারি। আমাদের দেখে বোট নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়েছে।”

“এখন ওকে আমাদের খুঁজে বের করা দরকার,” গম্ভীর স্বরে বলল মুসা।

“হ্যাঁ। তবে এসব কাজ সে একা করছে বলে মনে হয় না আমার। তার সঙ্গে আরও কেউ আছে। সেই লোকটাকেও খুঁজে বের করতে হবে।”

“রবিনের কী হলো, সেটাও আমাদের জানতে হবে,” মুসা বলল।

“দুশ্চিন্তাটা আমার এখানেই,” জবাব দিল কিশোর। “রবিনের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল ডোরি। তাতে সে সফল হয়েছে। কিন্তু রবিনকে কী করেছে?”

“খুন করেনি তো?”

“করলে অবাক হব না,” জবাব দিল কিশোর। “আমার অনুমান ভুল না হয়ে থাকলে ডোরি এখন পালানোর চেষ্টা করবে। ও বুঝে গেছে, আমরা তার পেছনে লাগব। এখানে থাকতে আর সাহস করবে না।” মোড় নিয়ে নিনার বাসার দিকে এগোল কিশোর।

বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে, নেমে এলো দু’জন। নিনার বাসার বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল নিনা। গোসল সেরে পোশাক বদল করেছে সে। ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছে।

“তাড়াতাড়িই ফিরলে, যাক, ভালোই হলো,” নিনা বলল। “গাড়িটা আমার দরকার। কাজ আছে।”

“কাজে যাওয়ার আগে আমাদের ট্রেজার হান্টারে নামিয়ে

ডোরি পাউসকে ব্যারি রবিন বলছে। অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। কিশোর কী করতে চেয়েছিল, বুঝে ফেলেছে।

ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আস্তে করে ব্যারির আঙুলের নিচ থেকে কাটিংটা টেনে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ভরল। “থ্যাংকস, ব্যারি। আপনি আমাদের অনেক উপকার করলেন!” বলে ব্যারিকে অবাক করে দিয়ে ওর ডান হাতটা ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল। কিছুই না বুঝে শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল ব্যারি।

ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর ও মুসা।

নিনার বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় চুপচাপ গাড়ি চালাল কিশোর। বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারল না মুসা। “তার মানে, ডোরি পাউসই রবিন সেজে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। আসল রবিনকে চেনে না ব্যারি। ডোরিকেই রবিন মনে করেছে। আর তুমি এটা বুঝতে পেরেছিলে?”

“হ্যাঁ,” স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল কিশোর। “এখন বুঝতে পারছ তো, হাঙরকে ডেকে আনার জন্য পানিতে মাংস ভাসিয়ে রেখেছিল কে? আজ সকালে লুক্যাইয়ায় টিকিট কিনতেই গিয়েছিল ডোরি। নিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নিনাকে ডাইভিং স্যুট ভাড়া নিতে দেখে বুঝে ফেলে আমরা ডুব দিতে যাচ্ছি। এটাও অনুমান করে ফেলে, কোন জায়গাটায় ডাইভিং করব। তাই মাংস কিনে নিয়ে ভাসিয়ে রাখে, যাতে রক্তের গন্ধে হাঙর আসে, আমরা ডুব দিতে না পারি। আমাদের দেখে বোট নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়েছে।”

“এখন ওকে আমাদের খুঁজে বের করা দরকার,” গম্ভীর স্বরে বলল মুসা।

“হ্যাঁ। তবে এসব কাজ সে একা করছে বলে মনে হয় না আমার। তার সঙ্গে আরও কেউ আছে। সেই লোকটাকেও খুঁজে বের করতে হবে।”

“রবিনের কী হলো, সেটাও আমাদের জানতে হবে,” মুসা বলল।

“দুশ্চিন্তাটা আমার এখানেই,” জবাব দিল কিশোর। “রবিনের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে চেয়েছিল ডোরি। তাতে সে সফল হয়েছে। কিন্তু রবিনকে কী করেছে?”

“খুন করেনি তো?”

“করলে অবাক হব না,” জবাব দিল কিশোর। “আমার অনুমান ভুল না হয়ে থাকলে ডোরি এখন পালানোর চেষ্টা করবে। ও বুঝে গেছে, আমরা তার পেছনে লাগব। এখানে থাকতে আর সাহস করবে না।” মোড় নিয়ে নিনার বাসার দিকে এগোল কিশোর।

বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে, নেমে এলো দু’জন। নিনার বাসার বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল নিনা। গোসল সেরে পোশাক বদল করেছে সে। ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছে।

“তাড়াতাড়িই ফিরলে, যাক, ভালোই হলো,” নিনা বলল। “গাড়িটা আমার দরকার। কাজ আছে।”

“কাজে যাওয়ার আগে আমাদের ট্রেজার হান্টারে নামিয়ে দিতে পারবেন?” কিশোর বলল।

“দাঁড়াও, আমার মানিব্যাগটা নিয়ে আসি।” মুহূর্ত পরই ফিরে এলো নিনা। ছেলেদের সঙ্গে গাড়ির কাছে চলল।

“কী করে এলে, সেটা কি এখনো আমাকে জানাতে চাও না?” ডকের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল নিনা। “রবিনের কোনো খোঁজ পেয়েছ?”

“এখনো পাইনি। পেলে জানাব।” কিশোর বলল।

হতাশ হলো নিনা। তবে এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করল না।

দশ মিনিট পর ডকে এসে গাড়ি থেকে নামল দুই গোয়েন্দা। “কাজ সারতে বেশি সময় লাগবে না আমার,” নিনা বলল। “বড়জোর আধঘণ্টা।”

জাহাজের দিকে এগোল কিশোর ও মুসা।

ট্রেজার হান্টারের দিকে তাকাল। নির্জন দেখাচ্ছে জাহাজটাকে। ওপরে উঠে কেবিনের দিকে চলল ওরা।

ডোরির কেবিনের কাছে আসতে খোলা দরজার ওপাশ থেকে খুটুরখাটুর শব্দ শোনা গেল।

ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। তাড়াহুড়ো করে একটা ব্যাগে জিনিসপত্র ভরছে ডোরি। সারা ঘর ওলটপালট হয়ে আছে। ড্রয়ারগুলো খোলা। কাপড়চোপড় ছড়ানো-ছিটানো। ব্যাগের পাশে একটা ছেঁড়া, দোমড়ানো চিঠি পড়ে আছে।

“কোথাও যাচ্ছ নাকি?” জিজ্ঞেস করল কিশোর। যেন বৈদ্যুতিক শক খেয়ে চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ডোরি। চোখেমুখে বেপরোয়া ভঙ্গি।

“এই একটু আগে ব্যারি গুডের সঙ্গে কথা বলে এলাম,” শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। “তুমি যে নিজেকে রবিন মিলফোর্ড বলে চালিয়েছ এত দিন, ওকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।”

“মাংস রেখে এসে গভীর সাগরের হাঙরকে যে তীরে ডেকে এনেছ, তাও বুঝে ফেলেছি,” রুক্ষ কণ্ঠে বলল মুসা।

“তোমরা কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না,” ব্যাগে জিনিসপত্র ভরা শেষ করেছে ডোরি, চোখ তুলে তাকাল না। “আমি যাচ্ছি। আর এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। গুপ্তধন পাওয়া যাবে না। কিশোর যে জিনিসটা তুলে এনেছে, ল্যাব-রিপোর্ট বলছে ওটা সাধারণ স্যুভেনির। আমি বুঝে গেছি, ক্যাপ্টেন কুপারের এই অভিযান ব্যর্থ হতে চলেছে।”

“ল্যাব রিপোর্টটা নিশ্চয় ক্যাপ্টেন নিজের চোখে দেখেননি,” কিশোর বলল। “ডা. হোল্ডিংস যা বলেছেন, তাই বিশ্বাস করেছেন। জিনিসটা আসলই। এখন বুঝতে পারছি, সাগরতলে সেদিন দুটো জিনিস পাওয়ার পর কেন তুমি অস্থির হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই আমার হাতে বাড়ি দিয়ে ওগুলো খাদে ফেলে দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু তোমাদের কপাল খারাপ, একটা জিনিস পড়ে গিয়েছিল, আরেকটা রয়ে গিয়েছিলআমার হাতে।” ডোরির চোখে চোখে তাকানোর চেষ্টা করছে সে।

কিন্তু তাকাল না ডোরি। অস্থির ভঙ্গিতে সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দৃষ্টি। পালানোর পথ খুঁজছে।

ডোরির ওপর চোখ রেখে ব্যাগের পাশে বিছানায় রাখা কাগজটা তুলে নিল কিশোর। কিছুটা জায়গা ছেঁড়া।

“ওটা দাও!” নেওয়ার জন্য লাফ দিল ডোরি। “ওটা তোমার জিনিস নয়!”

ডোরিকে ধরে রাখল মুসা। কাগজের লেখাটা পড়ল কিশোর। রবিনের হাতের লেখা, কোনো সন্দেহ নেই। জোরে জোরে পড়ল কিশোর, ডিয়ার নিনা, ট্রেজার হান্টার জাহাজের দু’জন লোক ক্যাপ্টেন কুপারকে ফাঁকি দিয়ে সমস্ত গুপ্তধন মেরে দেওয়ার তালে আছে। আমার কাছে এর প্রমাণও আছে। এখন এর বেশি আর বলতে পারছি না। সামনাসামনি কখনো দেখা হলে বলব। তবে দেখা করা সম্ভব হবে কিনা জানি না। আমাকে ওরা সন্দেহ করে ফেলেছে। যা খুশি ঘটে যেতে পারে আমার। আমি চাই…

এই জায়গায় নোটটা ছেঁড়া। এক পাশ থেকে টান দিয়ে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে।

নিনার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে লেখা মেসেজ রহস্যের সমাধান হয়ে গেল কিশোরের কাছে। তাতে লেখা ছিল : এসব থেকে দূরে থাকবে। যা ঘটছে, তার সমাধান করা তোমার সাধ্যের বাইরে। ওটা রবিনের হাতের লেখা ছিল। কিশোর এখন বুঝতে পারল, এই নোট থেকেই দুটো লাইন ছিঁড়ে নিয়ে গাড়ির উইন্ডশিল্ডে লাগিয়ে দিয়েছিল ডোরি। ওদের বোঝানোর জন্য রবিনই ওদের হুমকি দিয়েছে।

ছেঁড়া জায়গাটা বাদ দিয়ে রবিনের লেখা নোটের বাকি অংশটা পড়ল সে। “আমি তোমার সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছি। যদি বেঁচে থাকি, অবশ্যই দেখা করব। রবিন।”

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। রাগে টগবগ করে ফুটছে যেন মুসা। ডোরির শার্টের কলার চেপে ধরল। “শয়তান! চোর!” গর্জে উঠল সে, “আমি তোর ঘাড় মটকাব আজ! জলদি বল, রবিন কোথায়?”

মরিয়া হয়ে, ব্যাগটা তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে মুসার চোয়ালে বাড়ি মারল ডোরি। মাথা কাত করে বাড়িটা এড়াল মুসা, তবে ডোরির শার্ট ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। “ধরো ওকে!” কিশোরের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডোরি।

বাধা দিতে এগোল কিশোর। কিন্তু আবারও ব্যাগ ঘুরিয়ে বাড়ি মারল ডোরি।

ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল কিশোর। ব্যাগটা বাড়ি খেল প্যাসেজের দেয়ালে। ঝাঁপ দিল কিশোর। ডোরিকে নিয়ে পড়ল প্যাসেজের বারান্দায়।

দৌড়ে এসে এক হাত ধরে ডোরিকে টেনে তুলল মুসা। হাতটা মুচড়ে পেছনে পিঠের ওপর নিয়ে এলো। চাপ দিয়ে ব্যথা দিতে লাগল।

“তোকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি!” রাগে জ্বলছে মুসার চোখ। “বল, রবিনকে কী করেছিস?”

ব্যথায় কুঁচকে গেল ডোরির মুখ। হাত ছোটানোর জন্য ছটফট করতে লাগল। ওকে আবার কেবিনের ভেতর টেনে নিয়ে গেল মুসা।

ডোরির সামনে দাঁড়াল কিশোর। “আমরা জানি, তুমি কারও সঙ্গে মিলে কাজ করছ।” এবার আর কিশোরের চোখের দিকে না তাকিয়ে পারল না ডোরি। “লোকটা কে, তাও আন্দাজ করতে পারছি। এখন তুমি নিজের মুখে বলবে, নাকি পুলিশের হাতে তুলে দেব?”

“পুলিশকে জানানোর সুযোগই পাবে না তোমরা,” পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

শক্ত হয়ে গেল কিশোর। না দেখেও বুঝতে পারল কণ্ঠটা কার। ডা.ওরাম হোল্ডিংস।

“আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম,” কিশোর বলল। “আপনিই ডোরির বস, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

হোল্ডিংসের দিকে পেছন ফিরে থেকেও উল্টো দিকে বাথরুমের দরজার পাল্লায় লাগানো আয়নায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছে কিশোর। ডাক্তারের বাঁ হাতে একটা মেডিকেল ব্যাগ, আর তার ডান হাতে উদ্যত .৩৮ রিভলবার, নলটা তাক করা আছে সোজা কিশোরের মাথার দিকে।

“ডোরিকে ছেড়ে ওই বিছানায় গিয়ে বসো,” মোলায়েম কণ্ঠে বললেন ডাক্তার। “কিশোর, তুমিও যাও।” পিস্তল নেড়ে বিছানা দেখালেন তিনি।

ডোরিকে ছেড়ে দিল মুসা। বিছানার দিকে এগোল। ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় ডলছে ডোরি।

“পুলিশ বিষয়টা জানতে পারবেই,” জোরালো কণ্ঠে বলল কিশোর। “আজ সকালে হাঙরটার দেখা পাওয়ার পর সার্জেন্ট মার্ককে সব জানিয়েছি আমরা। এতক্ষণে বোধ হয় এখানে আসার জন্য রওনা হয়ে গেছেন তিনি।”

“তার মানে তো তাড়াতাড়ি এখান থেকে কেটে পড়া দরকার,” হাসিমুখে জবাব দিলেন ডাক্তার।

মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে যে প্রচণ্ড রাগে ফাটছেন তিনি, বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোর ও মুসার।

“এই দ্বীপ থেকে বেরোতে পারবেন না আপনারা,” কিশোর বলল। “ডক আর এয়ারপোর্টে কড়া নজর রাখবে পুলিশ।”

“আমার প্রাইভেট প্লেনটার কথা বোধহয় ভুলেই গেছ তোমরা। এই দ্বীপে অসংখ্য প্রাইভেট রানওয়েও আছে।”

চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়ল কিশোর। নিজের পালানোর পথ খুব ভালোমতোই করে রেখেছেন ডাক্তার। নিনার কথা ভাবল সে। সময়মতোই আসবে তো, নাকি দেরি করে ফেলবে?

“আমি জানতে চাই, রবিনকে কী করেছেন আপনারা?” সময় নেওয়ার জন্য কথা বলতে চাইল কিশোর। “ও কোথায়?”

হেসে উঠলেন ডা. হোল্ডিংস। “ডোরি, এটা ধরো তো।” রিভলবারটা ডোরির দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। “কেউ নড়লেই গুলি চালাবে।”

গর্বিত ভঙ্গিতে ডাক্তারের হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে দুই গোয়েন্দার দিকে তুলে ধরল ডোরি।
“আমি রবিন মিলফোর্ডের কথা জিজ্ঞেস করছিলাম,” আবার বলল কিশোর।
“রবিন আমাদের কাছে একটা মহাবিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল,” ডাক্তার জবাব দিলেন। “সারাক্ষণ ছোঁক ছোঁক করে বেড়াত। আমাদের অনেক গোপন কথা জেনে ফেলেছিল।”
“ও এখন কোথায়?” রাগে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তার বাহুতে হাত রেখে ওকে শান্ত করতে চাইল কিশোর।
“প্রথমে ওকে একটা পরিত্যক্ত গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,” ডাক্তার জানালেন। “গুদামটার মালিক এক গুন্ডা। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে টাকার অভাবে আছে। ওকে কিছু টাকা দিয়ে বলা হয়েছে, ছেলেটাকে খুন করে যেন গুম করে ফেলা হয়।”
“এখন হয়তো নাসাউয়ের কাছে সাগরে ভাসছে তার লাশ,” হেসে উঠল ডোরি, যেন মস্ত এক রসিকতা, “যদি হাঙরে না খেয়ে ফেলে থাকে।”
পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের। এই আশঙ্কাটাই করছিল সে। কিন্তু এখন সত্যিটা শোনার পর আর মেনে নিতে পারছে না। ইশ্, যদি ভুল হত! কোনোভাবে বেঁচে যেত রবিন!
“এ কথা নিনাকে শোনানো যাবে না,” বিড়বিড় করল মুসা।

“ভয় নেই,” মেডিকেল ব্যাগটা বিছানায় রেখে ওটার পাশে বসলেন ডাক্তার। “কোনো দিন কারও সঙ্গে আর কথা বলার সুযোগ হবে না তোমাদের।”

কালো ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। “এভাবেই আপনি টনি জেরোমকে খুন করেছেন, তাই না? আমার মনে আছে, আপনার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর ও বগলের ভেতরটা ডলছিল।”

“তুমি সবকিছু লক্ষ করো। ভীষণ চালাক ছেলে।” ব্যাগ খুললেন ডাক্তার। “এতটাই নজর তোমার, ও যে বগল ডলছিল, সেটাও নজর এড়ায়নি। ওখানে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম যাতে সুচের দাগ করোনারের চোখে না পড়ে।”

ডাক্তারের মুখোমুখি হলো কিশোর। “আমি এটাও বুঝেছি, আপনি ওকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। তাতে হৃৎপিণ্ডে মারাত্মক অ্যারিদমিয়া হয়, হার্ট অ্যাটাকে মানুষ মারা যায়।”

“তুমি আমাকে বিস্মিত করছ, কিশোর পাশা,” স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার। “দুঃখের বিষয়, তোমার মতো একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে হচ্ছে। তোমার জন্যও আমার খারাপ লাগছে, মুসা, তুমিও একটা সাংঘাতিক ছেলে। রবিনও তোমাদের মতোই বুদ্ধিমান ছিল। এ জন্যই তাকে মরতে হলো।”

ডাক্তারকে ব্যাগ খুলতে দেখছে কিশোর। একটা সিরিঞ্জ আর দুটো ছোট অ্যামপিউলও বের করলেন তিনি। “পটাশিয়াম

ক্লোরাইড পুশ করাটাই ভালো।” কিশোরের দিকে তাকালেন ডাক্তার। “তাই না, তুমি কী বলো?”

“হ্যাঁ,” তিক্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। “ডাইভিংয়ের পর এমনিতেই রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। ময়নাতদন্তের সময় করোনার বিষয়টাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখবেন। সুচের দাগ না দেখলে সন্দেহ করতে পারবেন না ইঞ্জেকশন দিয়ে পটাশিয়াম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“তোমাকে এ প্লাস দেওয়া হলো!” সিরিঞ্জের প্লাস্টিকের খোসা ছিঁড়লেন ডাক্তার। একটা অ্যামপিউল ভেঙে তার ভেতর সিরিঞ্জের সুচ ঢোকালেন।

“এত ঝামেলা না করে এটা ব্যবহার করলেই তো হয়,” রিভলবারটা দেখাল ডোরি।

“অনেক শব্দ হবে,” ডাক্তার বললেন। “গুলির শব্দ শুনে কৌতুহলী হয়ে কেউ দেখতে আসতে পারে। তখন আমাদের বেরোতে অসুবিধে হবে।”

“সোনারের বিষয়টা বুঝে ফেলেছিল টনি, তাই না?” কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলল মুসা। “মার্কারের ভেতর সোনার ভরে চিহ্ন রেখে গুপ্তধনের কাছে যাবার জন্য একটা ভিন্ন পথ তৈরি করেছিলেন আপনারা, আর ক্যাপ্টেন কুপারকে ভুল বুঝিয়ে উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।”

“বাহ্, একদিনেই অনেক কথা জেনে ফেলেছ দেখছি।” কিশোরের দিকে তাকালেন ডাক্তার। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। কঠোর কণ্ঠে বললেন, “এবার শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ফেলো দেখি।”

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। কপালের চামড়া কুঁচকে ফেলেছে মুসা। বাঁচার উপায় খুঁজছে। দৃষ্টি চলে গেল ডোরির দিকে। আস্তে আস্তে দরজার দিকে সরে যাচ্ছে সে, দু’জনকে ভালোমতো রিভলবারের নিশানায় পাওয়ার জন্য। অস্ত্রটা আগের মতোই তুলে ধরে রেখেছে।

কিশোরের বাহুতে সুচটা লাগানোর আগে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন ডাক্তার, “নোড়ো না, চামড়া ঢিল করে দাও, একটুও ব্যথা পাবে না! জাস্ট, পিঁপড়ের কামড়!” সিরিঞ্জের প্লাঞ্জারে চেপে বসছে তাঁর বুড়ো আঙুল।

#####

পনেরো

অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখছে মুসা। অস্বাভাবিক মাত্রায় মারাত্মক পটাশিয়াম ক্লোরাইড কিশোরের শরীরে ঢুকিয়ে দিতে যাচ্ছেন ডাক্তার। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কোনো উপায়ই দেখতে পাচ্ছে না সে।

ঠিক এই সময় দরজার কাছে গুলির শব্দ হলো। বদ্ধ জায়গায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো লাগল শব্দটা। একটা বুলেট ছুটে এসে, মুসার মাথাটাকে অল্পের জন্য মিস করে, পেছনের দেয়ালে গিয়ে বিদ্ধ হলো।

চমকে গিয়ে দরজার দিকে মুখ তুলে তাকালেন ডাক্তার হোল্ডিংস, ডোরিকে পড়ে যেতে দেখলেন। হাত থেকে রিভলবারটা পড়ে পিছলে চলে গেল।

ঘরে ঢুকল ক্রিস। সে-ই পেছন থেকে ডোরির মাথায় ঘুষি মেরেছে। রিভলবারের ট্রিগারে ডোরির আঙুলের চাপ লেগে গুলি বেরিয়ে গেছে। নিশ্চয় বারান্দা দিয়ে আসার সময় ডাক্তারের কথা কানে গেছে ক্রিসের।

কিশোরও বসে নেই। যে মুহূর্তে ডাক্তারের নজর অন্যদিকে ফিরল, তাঁর চোয়ালে ঘুষি মারল। লাফ দিয়ে গিয়ে ডাক্তারের সিরিঞ্জ-ধরা হাতটা ধরে টান মেরে সরিয়ে আনল মুসা।

“কিশোর!” ক্রিস ডাকল। উঠে পড়েছে ডোরি। ক্রিসকে আক্রমণ করেছে।

কিশোরের মার খেয়ে প্রায় নেতিয়ে পড়া ডাক্তারকে ধরে রাখল মুসা, কিশোর চলে গেল ক্রিসকে সাহায্য করতে। পা সোজা করে ক্রিসের মাথা লক্ষ্য করে মারাত্মক এক কারাতে লাথি চালাল ডোরি।

“রিভলবারটা তোলো, কিশোর!” চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

কিন্তু ওটা চলে গেছে বিছানার তলায়। কিশোরের নাগালের বাইরে। ডাক্তারের চোয়ালে প্রচণ্ড আরেক ঘুষি মেরে তাঁকে বিছানায় ফেলে দিল মুসা। ওদিকে ডোরির কারাতে লাথির জবাব কারাতে লাথি মেরেই ঠেকিয়ে ফেলল কিশোর। নেতিয়ে পড়া ডাক্তারকে রেখে ক্রিসকে সাহায্য করতে গেল মুসা। পিটিয়ে আরেকবার ডোরিকে মেঝেতে ফেলল। তার নিচ থেকে গড়িয়ে সরে গেল ক্রিস।

মুসার সরে যাওয়ার সুযোগটা নিলেন ডা. হোল্ডিংস। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন। মুসার ঘাড়ে ভয়ংকর রদ্দা মারলেন। সেই সঙ্গে বাঁ চাঁদিতে এক কারাতে কোপ। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাটিতে পড়ে গেল মুসা। পড়ার আগে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল, রিভলবারটার জন্য ডাইভ দিয়েছে ক্রিস।

ডোরিও মুসার দেহের ওপর দিয়ে রিভলবারটার জন্য লাফ দিল।

চোখের অন্ধকার কাটানোর চেষ্টা করছে মুসা। ক্রিস আর ডোরি একসঙ্গে লাফ দিয়েছে রিভলবারটার জন্য। মুসার মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে পড়ে আছে ওটা। কোনোমতে উঠে দাঁড়াল সে। গা কাঁপছে। ওই অবস্থাতেই লাথি মেরে রিভলবারটা সরিয়ে দিল। টলতে টলতে এগোল ডা. হোল্ডিংসের দিকে।

“গেল কোথায় ওটা?” রিভলবারটা খুঁজছে ডোরি।

ডা. হোল্ডিংসের নাকেমুখে প্রচণ্ড ঘুষি মারল মুসা।

লাফ দিয়ে এসে ডোরির ওপর পড়ল কিশোর। দুই হাতে ধরে টেনে তুলল ডোরিকে। গায়ের জোরে ঘুষি মারল ডোরির পেটে।

ওদিকে ডাক্তারের ডান চোয়ালে আরেকটা ঘুষি মারল মুসা। তারপর ডাক্তারের বাড়িয়ে দেওয়া ডান হাতটা ধরে জুজিৎসুর প্যাঁচ মেরে ঘুরিয়ে আছাড় মারল মেঝেতে।

ময়দার বস্তার মতো ধুড়ুম করে মেঝেতে পড়লেন ডাক্তার। তাঁর ওপর দাঁড়িয়ে দুলছে মুসার শরীর। এই সময় ক্রিস চেঁচিয়ে উঠল, “এই মুসা, রিভলবারটা তোমার পায়ের কাছে।”

নিচে তাকিয়ে রিভলবারটা দেখতে পেল মুসা। নিচু হয়ে তুলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তার আগেই ওটার কাছে পৌঁছে যাবে ডাক্তারের হাত। তাই লাথি মেরে পাঠিয়ে দিল ক্রিসের কাছে।

মুহূর্তে রিভলবারটা তুলে নিল ক্রিস। তুলে ধরল দুই চোরকে লক্ষ্য করে। এতক্ষণে শরীর ঢিল করল কিশোর ও মুসা। জোরে জোরে দম নিতে লাগল।

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, “ফ্রিপোর্টের জেলখানায় আপনাদের জন্য দুটো কামরা বুক হয়ে গেল।”

“শোনো, তোমাদের একটা কথা বলি,” শুকনো কণ্ঠে বললেন ডাক্তার। “এই গুপ্তধনের কথা আমরা কাউকে বলব না। এত সোনা আছে ওখানে, পাঁচজনে ভাগ করে নিলেও অনেক সোনা পাওয়া যাবে।”

“সেটা আমরা জানি,” কিশোর জবাব দিল। “আর এ কারণেই আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে রাজি হয়েছেন ক্যাপ্টেন কুপার।”

“কোনো কথা বলে লাভ নেই আর, ডাক্তার,” দাঁতে দাঁত চেপে বলল মুসা। “জীবনের বাকি সময়টা জেলখানায় বসে একা একা তাস নিয়ে পেশেন্স খেলে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু করার নেই আপনার।”

দুই হাতে মুখ ঢেকে অসহায়ের মতো বিছানায় বসে পড়ল ডোরি। গুঙিয়ে উঠে ডাক্তারকে বলল, “আপনি বলেছিলেন, নিরাপদেই পালিয়ে যেতে পারব আমরা, কিছুই হবে না।”

“শোনো, তোমরা আমার কথাটা ভেবে দেখো,” মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন ডাক্তার।

মেঝেতে পড়ে থাকা ইঞ্জেকশন আর অ্যামপিউলটার ওপর চোখ পড়ল মুসার। এগিয়ে গেল সেদিকে। প্রচণ্ড রাগে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা করে দিল ওগুলোকে।

শান্ত কণ্ঠে ক্রিসকে বলল কিশোর, “পয়জন, রিভলবারটা ঠিকমতো ধরে থাকুন। সার্জেন্ট মার্ককে খবর দিতে হবে। কেসটা শেষ হয়েছে শুনলে তিনি খুশি হবেন।”

“তোমরা না বললে পুলিশকে জানিয়ে এসেছ?” ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

মুচকি হাসল কিশোর।

“নিন, এবার উঠুন,” রিভলবার নাচিয়ে ডাক্তারকে বলল ক্রিস। “আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।”

অস্ত্রটাকে দিকে তাকালেন ডাক্তার। ধীরে ধীরে এগোলেন কেবিনের দরজার দিকে। তাঁকে অনুসরণ করল ডোরি। চোখ নামিয়ে রেখেছে।

ডাক্তার আর ডোরির পেছনে কেবিন থেকে বেরোল ক্রিস। তার পেছনে কিশোর। বিছানা থেকে রবিনের ছেঁড়া চিঠিটা তুলে নিতে হয়েছে বলে মুসা বেরোল সবার পেছনে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে রবিনের জন্য। ওকে খুন করা হয়েছে, মেনেই নিতে পারছে না। কী করে এত বড় দুঃসংবাদটা নিনাকে শোনাবে? রবিনের মা-বাবাকে শোনাবে?

“কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে সোজা হাঁটতে থাকুন,” কিশোরকে বলতে শুনল সে। “কোনো রকম চালাকির চেষ্টা করবেন না।” ওদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে এগোল মুসা।

প্যাসেজটা এতই সরু, পাশাপাশি তিনজন হাঁটা যায় না। কাজেই এক সারিতে সিঁড়ির দিকে এগোল দলটা।

সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছেছেন ডা. হোল্ডিংস, এ সময় মাথার ওপরে ডেকে শোনা গেল পায়ের শব্দ।

“নিনা!” জিজ্ঞেস করল মুসা।

“মুসা, তোমরা নিচে?” সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল নিনা। “সবকিছু ঠিকঠাক আছে?”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে লক্ষ করল, ক্রিসের হাতে একটা রিভলবার। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হচ্ছে?”

“সরুন ওখান থেকে! সরে যান!” চেঁচিয়ে বলল মুসা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। নড়ে উঠলেন ডাক্তার। রিভলবারের সামনে থাকাতে কিছুই করতে পারল না ক্রিস। ডাক্তারকে গুলি করলে নিনার গায়েও লাগার সম্ভাবনা আছে। এই সুযোগটা কাজে লাগালেন ডাক্তার।

লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে নিনার হাত চেপে ধরলেন। হ্যাঁচকা টানে নিয়ে এলেন নিজের গায়ের ওপর। ওকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন। দম আটকে ফেলল মুসা। এখন ক্রিস আর হোল্ডিংসের মাঝখানে রয়েছে নিনা।

“গুলি করবেন না!” ক্রিসকে সাবধান করল কিশোর। অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে ডোরি। ডাক্তারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

“যাক, দাবার চালটা পাল্টে গেল,” সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ডোরি। “পরিস্থিতি চলে এলো আমাদের পক্ষে।”

লাফ দিয়ে গিয়ে তার নাকেমুখে ঘুষি মারার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল মুসা। সামনে এগোতে গেল কিশোর। বাধা দিলেন ডাক্তার।

“আর এক পা এগোলেই মেয়েটার ঘাড় মটকে দেব!” ধমকে উঠলেন ডাক্তার। চোখ জ্বলছে। “আমি সেটা পারি, নিশ্চয় বুঝতে পারছ।”

“নিনার একটা চুলও যদি ছেঁড়েন, আমি আপনার ঘাড় মটকাব!” রাগে অন্ধ হয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

“এখন আর আমাকে ধমক দিয়ে লাভ নেই,” হেসে বললেন ডাক্তার। “ক্রিস, ডোরির কাছে রিভলবারটা ছুঁড়ে দাও। নইলে আমি তোমাদের দেখাব, কীভাবে খালি হাতে একজন মানুষের মেরুদণ্ড দুই টুকরো করে ফেলা যায়। বিশ্বাস করো, আমার কথা না শুনলে আমি সত্যিই সেটা করব।”

নিনাকে ঠেলে নিয়ে সিঁড়ির নিচে নামলেন ডাক্তার। ডোরি এলো তাঁর পেছন পেছন। অসহায় ভঙ্গিতে সাহায্যের আশায় কিশোর ও মুসার দিকে তাকাল ক্রিস।

“আমি মিছে কথা বলছি না,” হুমকি দিলেন ডাক্তার। নিনার মুচড়ে ধরা হাতে চাপ বাড়ালেন। ব্যথায় ককিয়ে উঠল নিনা। “রিভলবারটা দাও ডোরির হাতে। নইলে যা বলছি, করব।”

“দিয়ে দিন!” ক্রিসের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, নিচু হয়ে রিভলবারটা মেঝেতে রাখল ক্রিস। জোরে এক ঠেলা মেরে পাঠিয়ে দিল ডোরির কাছে।

“এখন আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো কাজ করছ তোমরা,” ডাক্তার বললেন।

ডোরি রিভলবারটা তুলে নিতেই নিনাকে জোরে ধাক্কা মেরে কিশোর আর মুসার দিকে ঠেলে দিলেন ডাক্তার। তাড়াতাড়ি ধরে নিনাকে সোজা করল কিশোর।

“এবার হাঁটো,” দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসিয়ে উঠলেন ডাক্তার। “ডোরির কেবিনে যাও। তিনজনেই।”

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল কিশোর-মুসা আর নিনা। ছোট্ট ঘরটায় ফিরে এলো আবার ওরা। আমার জীবনের শেষ সময় কি এসে গেল? মুসা ভাবছে। বিশ্বাস করা কঠিন। রবিনকে খুঁজে বের করতে এসেছিল। এখন রবিন তো গেলই, ওরাও যাওয়ার পথে।

“পকেট খালি করো,” ডাক্তার বললেন। “যা আছে বের করে বিছানার ওপর রাখো।” ভঙ্গি দেখে মনে হলো, খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন। কিশোররা তাদের জিনিসগুলো পকেট থেকে বের করে রাখার পর ওগুলোর মধ্য থেকে শুধু চাবিগুলো তুলে নিলেন তিনি।

“অকারণ সময় নষ্ট,” ডোরি বলল। “গুলি করে দিলেই তো হয়।” রিভলবারটা সামনে বাড়াল সে।

“না। এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়।” চাবিগুলো পকেটে ভরলেন ডা. হোল্ডিংস। দুঃখের সঙ্গে তাকালেন মেঝেতে পড়ে থাকা ভর্তা হওয়া সিরিঞ্জ আর অ্যামপিউলটার দিকে। “যা করতে চেয়েছিলাম, ওটাই ছিল ঝামেলাহীন সমাধান। কিন্তু হলো না যখন কী আর করা।” ডোরিকে হুকুম দিলেন, “লাউঞ্জে গিয়ে যত পত্রিকা আর কাগজ পাও, নিয়ে এসো। জলদি।”

দ্বিধা করতে লাগল ডোরি। ডাক্তার বললেন, “দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও। কেবিনের বারান্দায় কিছু কাগজ ছড়িয়ে ফেলবে।” রসিকতা করলেন, “আগুন জ্বেলে গা গরম করা যাবে।” গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন তিনি।

কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। তারপর নিনার দিকে। চমকের ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

নির্দেশ পালন করতে খুশিমনে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ডোরি।

“বেশ, এখন সবাই মেঝেতে বসে পড়ো,” হুকুম দিয়ে, দরজার দিকে পিছিয়ে যেতে শুরু করলেন ডাক্তার। “খুব সামান্য সময় কষ্ট ভোগ করবে তোমরা তেলের ট্যাংকে আগুন না লাগা পর্যন্ত। তারপর মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাবে।”

বাইরের বারান্দায় ডোরির কাগজ ছিটানোর শব্দ শুনল মুসা। দরজা দিয়ে পিছিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার। নিনার দিকে তাকাল মুসা। ভয়ে সাদা হয়ে গেছে নিনার মুখ।

দরজার দিকে ফিরে তাকাল আবার মুসা। পকেট থেকে একটা দেশলাই বের করলেন ডাক্তার। শেষবারের মতো কেবিনের ভেতর তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন পালানোর কোনো পথ আছে কিনা।

তারপর দেশলাইটা ডোরির হাতে দিয়ে, ঘুরে, চলে গেলেন।

অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল মুসা, কেবিনের চার বন্দীর দিকে তাকিয়ে হাহা করে হাসছে ডোরি। পিশাচের হাসি। গায়ে কাঁটা দিল মুসার। ডোরি আসলে পাগল। চারজন মানুষকে পুড়িয়ে মারার আনন্দে হাসছে। খস করে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালল সে। উঁচু করে ধরে রাখল। আনন্দটা উপভোগ করছে।

“বিদায়, গাধারা,” ডোরি বলল। কাগজের স্তূপের ওপর ছুঁড়ে ফেলল জ্বলন্ত কাঠিটা। তারপর লাগিয়ে দিল কেবিনের দরজা।

কেবিনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল চার বন্দী। মরিয়া হয়ে পালানোর পথ খুঁজতে লাগল।

কিন্তু মুসা আর কিশোর জানে, কোনো পথ নেই। নিনার দিকে তাকাল ওরা।

নিনাও জানে, এই বদ্ধ কেবিন থেকে পালানো অসম্ভব।

ক্রিসও জানে।

যেকোনো মুহূর্তে তেলের ট্যাংকে পৌঁছে যাবে আগুন। পুরো জাহাজটাই বিস্ফোরিত হবে। সেই সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ওদের শরীর।

ষোলো

“পোর্টহোল!” চেঁচিয়ে বলল নিনা।

সঙ্গে সঙ্গে পোর্টহোলের দিকে দৌড় দিল কিশোর। কিন্তু ফোকরটা মাত্র এক ফুট ব্যাসের। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শরীর নিনার, সেও এই ফোকর দিয়ে বেরোতে পারবে না।

ভাবো, নিজেকে বলল কিশোর। মাথা ঠান্ডা রাখো। প্রতিটি সেকেন্ড এখন মূল্যবান। এই জ্বলন্ত নরকে ওদের আটকে রেখে পালানোর পথ করে নিচ্ছেন ডা. হোল্ডিংস আর ডোরি। এখান থেকে বেরোতেও হবে। ওদের ধরতেও হবে।

“ইস্পাতের দরজা,” মুসাকে চিৎকার করে বলতে শুনল কিশোর। তাকিয়ে দেখল, দরজায় পাল্লায় ধাক্কা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মুসা।

দরজার পাশের তাকটার ওপর দৃষ্টি সরে গেল কিশোরের।

ওটার দিকে তাকিয়ে কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। কী? দরজার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু?

হ্যাঁ! টনির ঘর!

তাড়াতাড়ি মুসার দিকে এগোল সে। চেঁচিয়ে বলল, “আইস পিক!”

“কী?” তার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকাল মুসা, যেন পাগল হয়ে গেছে কিশোর।

“আইস পিক!” আবার চেঁচিয়ে বলল কিশোর। “কেবিনে আটকে গেলে যেটা দিয়ে তালা খুলত টনি!”

নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল মুসার। “তাই তো! জাহাজের সমস্ত কেবিনের তালাতেই এ ধরনের সেফটি রিলিজ ব্যবস্থা থাকতে পারে।”

গোল নবটা চেপে ধরল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, “কিন্তু কী দিয়ে খোঁচাব?”

“নিশ্চয় কিছু আছে এখানে,” কিশোর জবাব দিল। খোঁজার জন্য আলমারির দিকে এগোল।

বাধা দিল নিনা। “ওটাতে একটা কুটোও নেই, দেখেছি আমি।”

ঘরের ভেতর ধোঁয়া বাড়ছে। পাগল করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি। কিশোর ভাবছে, কোথাও কিছু একটা নিশ্চয় আছে, যেটা ওদের মুক্ত করতে সাহায্য করবে।

“ওগুলোর মধ্যে কিছু নেই তো?” বিছানায় ফেলে রাখা জিনিসগুলো দেখাল মুসা।

তাকিয়ে রইল কিশোর। চাদরে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে ক্রিসের একটা বলপয়েন্ট পেন। লাফ দিয়ে গিয়ে ওটা তুলে নিল সে।

“ওটার কথাই ভাবছিলাম আমি,” ক্রিস বলল। নাকেমুখে ধোঁয়া ঢুকে গিয়ে কাশতে আরম্ভ করল সে। “কিন্তু তালার ছিদ্রটা বেশি সরু। কলম ঢুকবে না ওটাতে।”

“কালির টিউবটা ঢুকবে,” কলমের ক্যাপ ঘুরিয়ে খুলতে আরম্ভ করেছে ততক্ষণে কিশোর। দরজার তালার কাছে পৌঁছে গেল। “জোরে চাপ দিলেই ঢুকবে।”

টিউবটাকে চেপেচুপে তালার ছিদ্রের মধ্যে ঢোকাল কিশোর। এপাশ-ওপাশ নাড়াচাড়া করতেই ‘কট’ করে একটা শব্দ হলো। খুলে গেল তালার ভেতরের রিলিজ বাটন।

আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল সবাই। কিন্তু চুপ করে নেই কিশোর। শার্টের ঝুল দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল তালার ধাতব গোল নবটা, আগুনে গরম হয়ে গেছে। ডান দিকে মোচড় দিয়ে ঠেলতেই হাঁ হয়ে খুলে গেল দরজা। ওদের আনন্দ খুব ক্ষণস্থায়ী হলো। ঘরের ভেতর লাফিয়ে এসে পড়ল আগুন।

“বিছানার চাদর-কম্বল সব তুলে নাও!” বলেই টান দিয়ে ভারী চাদরটা তুলে নিল কিশোর। মুসা নিল কম্বলটা। কিশোরের চাদরের নিচে ক্রিস, আর মুসার কম্বলের নিচে নিনাকে ঢুকিয়ে নিয়ে আগুনের ভেতর দিয়েই দিল দৌড়।

দরজা পেরিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল কিশোর, “যত গরমই লাগুক, যাই হোক, থেমো না!”

যতটা সম্ভব মাথা নিচু করে রেখে কম্বল আর চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে এক সারিতে ছোটার চেষ্টা করল চারজন। ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধের মতো ছুটল ওরা। সবার আগে রয়েছে কিশোর। কম্প্যানিয়নওয়ে পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে ডেকে ওঠার পর আগুন ধরে যাওয়া কম্বল আর চাদরটা নিয়ে জাহাজের বাইরে পানিতে ছুঁড়ে ফেলল সে।

“ফায়ার এক্সটিংগুইশার!” কাশতে কাশতে বলল ক্রিস। “ওই যে, ডেকেও একটা আছে!” বলতে বলতে ছুটল ওটার দিকে।

“না, থামো!” চেঁচিয়ে বলল কিশোর। “ওই আগুন তুমি একা মোকাবিলা করতে পারবে না!”

কিন্তু লাল রঙের যন্ত্রটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল ক্রিস। “আগুন শুধু কাগজগুলোতে ধরেছে। জাহাজের গায়ে ধরেনি। ওগুলো নিভিয়ে তাড়াতাড়িই চলে আসতে পারব। তোমরা ডাক্তার হোল্ডিংস আর ডোরিকে ধরার চেষ্টা করো। ওরা পালাচ্ছে।”

ফিরে তাকাল কিশোর। সময়মতোই এসেছে। ডকের প্রায় শেষ মাথায় একটা কেবিন ক্রুজারে লাফিয়ে উঠতে দেখল ডা.

হোল্ডিংস আর ডোরিকে। মুসাকে সঙ্গে আসার ইশারা করে গ্যাংপ্ল্যাংকের দিকে দৌড় দিল কিশোর। নিনা ছুটল ওদের পেছনে।

“আপনি থাকুন,” ফিরে তাকিয়ে মুসা বলল। “পারলে পুলিশকে খবর দিন।”

ডক ধরে ছোটার সময় কিশোর দেখল, চলতে শুরু করেছে কেবিন ক্রুজারটা। প্রণালির পানিতে এগিয়ে চলেছে। কোথায় যাচ্ছেন ডাক্তার আর ডোরি? প্রাইভেট প্লেনটা যদি ফ্রিপোর্ট এয়ারপোর্টে থেকে থাকে, তবে সেদিকেই যাবেন। এয়ারপোর্টের ডকটা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। যেতে সময় লাগবে না।

ডোরির হাতে রিভলবার দেখতে পেল কিশোর। কেবিন ক্রুজারটা আরেকটা বোটের আড়ালে চলে গেল। কিশোরকে এখনো দেখেনি ডোরি। মাঝবয়সী এক দম্পতি বোট থেকে মাছ ধরার সরঞ্জাম নামাচ্ছেন ডকে। ডোরি আর ওর হাতের রিভলবারটা মনে হয় দেখেননি।

“মাথা নামিয়ে রাখুন! গোলাগুলি চলতে পারে!” চেঁচিয়ে দম্পতিকে সাবধান করল কিশোর। কিন্তু প্রচণ্ড শব্দে ক্যারিবিয়ান ড্যান্স মিউজিক বাজছে ওঁদের বোটের রেডিওতে। সেই শব্দে কিশোরের কথা কানে গেল না ওঁদের। আবার চিৎকার করে সাবধান করল কিশোর।

মস্ত একটা ভুল হয়ে গেল তাতে। ডোরি ওকে দেখে ফেলল। রিভলবার তুলল।

“শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো!” ডোরিকে রিভলবার তুলতে দেখেই কিশোরের পেছনে দৌড়াতে থাকা মুসা চেঁচিয়ে উঠল।

পরপর দু’বার গুলি করল ডোরি। প্রণালি ধরে ছুটে চলা বোট থেকে লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারল না।

তার আগেই ডাইভ দিয়ে পড়েছে কিশোর। ডকের কাঠের তক্তার ওপর মুখ নিচু করে শুয়ে থাকা কিশোরের মাথার ওপর দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। তার ডানে, মাঝবয়সী দম্পতি এতক্ষণে টের পেয়েছেন বিষয়টা। গুলির শব্দে তাঁরাও চিৎকার দিয়ে নিজেদের টু-সিটার বোটের আড়ালে শুয়ে পড়লেন।

“শুয়েই থাকুন!” চেঁচিয়ে বলল কিশোর। ডাক্তারের বোট থেকে আরও একটা বুলেট ছুটে এলো। গুলিটা বিঁধে গেল ডকের কাঠের তক্তায়, কিশোরের মাথা আর মহিলার পায়ের মাঝামাঝি জায়গায়। চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা।

বোটের ইগনিশনে চাবিটা ঝুলছে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, “বোটের দড়িটা খুলে ফেলো!”

লাফ দিয়ে বোটে উঠে পড়ল সে। ড্রাইভিং সিটে বসল। বোটের মুখ প্রণালির মুখের দিকে। এতে সুবিধেই হলো। বোটটাকে ঘোরাতে গিয়ে আর সময় নষ্ট করতে হলো না। মুসা দড়ি খুলতে শুরু করল। ইগনিশনে মোচড় দিল কিশোর। চেঁচিয়ে বলল, “জলদি ওঠো!”

“এই, কী করছ তোমরা?” রাগে চিৎকার করে উঠলেন বোটের মালিক। মুসার শার্ট খামচে ধরলেন।

টান দিয়ে শার্ট ছাড়াতে চাইল মুসা। না পেরে লোকটাকে জোরে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে লোকটার স্ত্রী।

“সরি, বোঝানোর সময় নেই এখন!” কিশোর বলল। সরে গেল ড্রাইভিং সিট থেকে। সেখানে বসল মুসা। থ্রটল ধরে ঠেলে দিল অনেকখানি। আচমকা গ্যাস পেয়ে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করল বোট।

“অনেকখানি আগে চলে গেছে ওরা,” কিশোর বলল।

টপ গিয়ারে বোটটা অনুসরণ করে চলল মুসা।

বাতাস বেশ জোরালো। পানিতে ঢেউ বেশি।

ঢেউয়ের সাদা ফেনাগুলোর দিকে তাকাল কিশোর। উঁচু উঁচু ঢেউয়ের চূড়ায় ছুটতে গিয়ে ভীষণ লাফাচ্ছে বোটটা। তলায় পানির বাড়ি লেগে ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে। “ঢেউয়ে যা হয় হোক গে। গতি কমিয়ো না। ওদের ধরতে হবে, যে করেই হোক।”

ডা. হোল্ডিংসের কেবিন ক্রুজারের চেয়ে বোটটা ছোট হওয়ায় গতিও বেশি। আস্তে আস্তে কাছে চলে যাচ্ছে। বোটের কিনার খামচে ধরে রেখেছে কিশোর, ঢেউয়ের ঝাঁকিতে যাতে পড়ে না যায়।

আবার গুলি করল ডোরি। ওকে রিভলবার তুলতে দেখেই ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল কিশোর আর মুসা। মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে চলে গেল বুলেট।

কিশোর বলল, “ওদের কাছাকাছি কিছুতেই যেতে পারব না, যতক্ষণ ডোরির হাতে রিভলবার আছে।”

“বাড়তি গুলি না থাকলেই বাঁচা যায়!” মুসা বলল। “ইতিমধ্যেই চারটে গুলি খরচ করে ফেলেছে।”

সামনে তাকাল কিশোর। কেবিন ক্রুজারের কিছুটা সামনে প্রণালিতে কয়েকটা ছোট ছোট বোট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। “রেসিং বোট!” বলল সে। ঢেউয়ের কারণে তীক্ষ্ণ মোড় নিতে গেলেই প্রতিটা বোটের কিনার থেকে ফোয়ারার মতো পানি ছিটকে উঠছে। এক সারি বয়া ওদের গতিপথ নির্ধারণ করছে।

উত্তেজনায় হাসি ফুটল মুসার মুখে। “ইন্টারন্যাশনাল স্পিডবোড কম্পিটিশন! হাহ্! ফ্রিপোর্ট এয়ারপোর্টের ডকে যেতে হলে ওই বোটগুলোর ফাঁক দিয়ে যেতে হবে ডাক্তারকে!”

“হ্যাঁ,” আরও শক্ত করে বোটের কিনার খামচে ধরল কিশোর। “আমাদের যাওয়াটাও সহজ হবে না। ওসব বোটের সারির ফাঁক দিয়ে আমাদেরও যেতে হবে।”

বোটগুলোর যাত্রাপথের দিকে বোট ছুটিয়েছে সে। মরিয়া হয়ে পাগলের মতো বোটগুলোর পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন ডা. হোল্ডিংস।

আরও দু’বার গুলি করল ডোরি। একটা গুলি মিস হলো, আরেকটা গুলি কিশোরদের বোটের ইঞ্জিনের কাউলিং ফুটো করে দিল।

“ছয়টা গুলিই শেষ,” কিশোর বলল। “তার রিভলবারের চেম্বার খালি। চালাও এখন, যত জোরে পারো!”

গতি বাড়িয়ে, ডান দিক থেকে চক্কর দিয়ে, কেবিন ক্রুজারটাকে রেসিং বোটগুলোর যাত্রাপথে মারাত্মক জায়গাটার দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইল মুসা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দুটো বোটই রেসিং বোটগুলোর কাছাকাছি চলে এলো।

শক্তিশালী রেসিং ইঞ্জিনের সঙ্গে মিশে গেল ওদের বোটের ইঞ্জিনের শব্দ। জনতার চিৎকারকে ছাপিয়ে গেল।

বাঁয়ে কাটার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ডা. হোল্ডিংস। তিনিও রেসিং বোটের যাত্রাপথে কিশোরদের বোটটা ঠেলে দিতে চাইছেন। ফোয়ারার মতো পানির ছিটে এসে ক্ষণিকের জন্য প্রায় অন্ধ করে দিতে চাইল দুই গোয়েন্দাকে। ওদের দৃষ্টিপথে বাধার সৃষ্টি করল।

“ওই দেখো!” মুসাকে বলল কিশোর।

পানির ফোয়ারার ভেতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল মুসা, হঠাৎ করেই অনেকখানি বাঁয়ে ঘুরে গেল কেবিন ক্রুজার। আরও যা দেখল মুসা, মোটেও ভালো লাগল না তার। টকটকে লাল একটা রেসিং বোট ঘণ্টায় এক’শ মাইল গতিতে ওদের দিকে ছুটে আসছে।

“সোজা আমাদের দিকে আসছে!” চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

হুইলের ওপর শক্ত হলো মুসার আঙুল।

দ্রুত বেগে ডাক্তারের বোটটার পিছু নিতে গিয়ে কোর্স ভুল করে ফেলেছে বোধহয় মুসা।

আরও শক্ত করে ড্রাইভিং হুইল চেপে ধরল সে। শক্ত হয়ে গেল শরীরের পেশিগুলো। যেকোনো সময় ঘটবে ভয়ংকর সংঘর্ষ।

####

সতেরো

“বাঁয়ে ঘোরো!” কিশোরকে চিৎকার করতে শুনল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিং হুইল বাঁয়ে ঘোরাল সে। একই সঙ্গে পাশ থেকে থ্রটল চেপে ধরল কিশোর। ধাক্কা মেরে সামনে ঠেলে দিল।

স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করল মুসা, সামনের বোটের ড্রাইভারও বোটের নাক ঘুরিয়ে দিল। মাঝখানে কয়েক ইঞ্চি ব্যবধান রেখে তীব্র গতিতে পাশ কাটাল বোট দুটো। বৃষ্টির মতো পানির ছিটা এসে ভিজিয়ে দিল কিশোর ও মুসাকে। রেসিং বোটের ড্রাইভারের চিৎকার শোনা গেল।

“বেচারা!” মনে মনে বলল মুসা। “ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছিল সে, আমাদের জন্য পারল না!”

কিশোর এখন এসব আবেগ নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, “গতি বাড়াও! ওরা তো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে! দেখো, ফ্রিপোর্ট এয়ারপোর্টের ডকে পৌঁছে গেছে প্রায়!”

থ্রটলে হাত দিল মুসা। তীর থেকে চিৎকার, হই-হট্টগোল করছে উত্তেজিত জনতা, সেদিকে কান দিল না। দর্শকদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এখন নেই।

ডা. হোল্ডিংস আর ডোরি সবে তীরে নেমেছে, এই সময় ডকে পৌঁছাল মুসারা। ইঞ্জিনের সুইচ অফ করে দিল মুসা। বোটটা চালু থাকা অবস্থাতেই লাফ দিয়ে তীরে নেমে পড়ল কিশোর। মুসাও লাফিয়ে নামল। চলন্ত বোটটার নাক ডকে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গেল। সেদিকে তাকানোর সময় নেই। দুই চোরকে তাড়া করল ওরা।

একটা হেলিকপ্টারের শব্দ কানে এলো।

ডকের শেষ মাথায় পৌঁছে লাফ দিল কিশোর। উড়ে গিয়ে পড়ল ডাক্তারের গায়ে। তাঁর একটা পা ধরে ফেলল। হ্যাঁচকা টান লেগে মাটিতে আছড়ে পড়লেন ডাক্তার। হামাগুড়ি দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার একজন ভয়ানক খুনি। তাঁর জন্য কোনো মায়া দেখাল না কিশোর। পেছন থেকে চুল ধরে তাঁর মুখটা শক্ত কাঠের ওপর ঠুকে দিল। প্রচণ্ড ব্যথায় ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান হারালেন ডাক্তার।

ওদিকে পেছন থেকে ডোরির কলার চেপে ধরল মুসা। “যাচ্ছ কোথায়, চান্দু!” বলে এক টানে ডোরিকে নিজের দিকে

ঘুরিয়ে ফেলল সে। নাকে-মুখে পরপর গোটা তিনেক ঘুষি খেয়ে কাবু হয়ে গেল ডোরি।

ডাক্তারের জ্ঞান ফিরলে তাঁকে তুলে দাঁড় করাল কিশোর। হাত মুচড়ে ধরল পেছন দিকে। নাক থেকে রক্ত গড়াচ্ছে ডাক্তারের। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছেন। ডোরিকেও একইভাবে ধরল মুসা। ডা. হোল্ডিংস আর ডোরি দু’জনেই বুঝে গেছে কোনো অস্ত্র ছাড়া দুই গোয়েন্দাকে বাধা দিয়ে ঠেকাতে পারবে না আর। বরং বাধা দিতে গেলে অকারণ মার খাবে। তাই, কিছুই আর করার নেই দেখে চুপ করে রইল দু’জনই।

ডোরিকে শক্ত করে ধরে রেখে মুখ তুলে দেখল মুসা, সাদা রঙের একটা হারবার প্রেটল হেলিকপ্টার ওদের দিকেই আসছে। প্যাসেঞ্জার সিটের দরজার পাশে বাতাসে উড়ছে একটা লাল পতাকা। “বোট রেসটা বোধহয় থামিয়ে দেওয়া হয়েছে,” মুসা বলল। “আর আমাদের কারণেই রেসটা বন্ধ করতে হয়েছে। সে জন্যই হেলিকপ্টার আসছে, আমাদের ধরতে।”

কিশোর বলল, “কিন্তু দোষটা আমাদের নয়, আমরা ইচ্ছে করে বোট রেসিং বন্ধ করিনি।”

জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ওদের মাথার ওপর এসে স্থির হলো হেলিকপ্টার। শূন্যে ঝুলে রইল যেন। মেগাফোনে একটা কণ্ঠ চিৎকার করে হুকুম দিল, “তোমাদের চারজনকে অ্যারেস্ট করা হলো!”

কিশোর আর মুসা তাতে কিছুই মনে করল না। পুলিশকে বোঝাতে পারবে ওরা।

ধুলোর ঝড় তুলে পার্কিং লটে এসে ঢুকল দুটো পুলিশের গাড়ি। অপেক্ষা করে রইল কিশোর আর মুসা। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে এলেন তিনজন পুলিশ অফিসার। হাতে উদ্যত পিস্তল। মুসা বলল, “কিশোর, দেখো, সার্জেন্ট মার্কও আছেন।”

“সবাই হাত তুলে দাঁড়াও,” ওপরের হেলিকপ্টার থেকে মেগাফোনে আদেশ এলো। “কেউ নড়বে না!”

পুলিশ কাছে এসে গেছে, আর ধরে রাখার দরকার নেই। ডাক্তার ও ডোরিকে ছেড়ে দিল কিশোর ও মুসা। চারজনেই হাত তুলে দাঁড়াল।

ডকে এসে দাঁড়ালেন দু’জন সশস্ত্র পুলিশ অফিসার। মার্ক রইলেন তাঁদের পেছনে। পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ইশারা করলেন তিনি। আরও তিনজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার দৌড়ে এলেন। চোখের পলকে কিশোর-মুসাসহ অন্য দু’জন অপরাধীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হলো।

“আমি বুঝতে পারছি, ঝামেলা থেকে কখনো তোমরা দূরে থাকতে পারো না,” দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন সার্জেন্ট মার্ক। “এখন চলো, থানায়, সব কথা কাগজে লিখে নিতে হবে।” সবাইকে নিয়ে পুলিশ কারের দিকে এগোলেন তিনি।

ডোরিকে একটা দেঁতো হাসি উপহার দিল মুসা। তারপর সার্জেন্টের দিকে ফিরে বলল, “খুশিমনেই লিখে দেব, স্যার।”

“যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগল,” চার ঘণ্টা পর বলল মুসা, যখন সার্জেন্ট মার্ক ওদের সমস্ত

কাহিনি কাগজে লিখে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন, ওদের ছেড়ে দিলেন।

“নিশ্চয় আর কোনো সন্দেহ নেই আপনার, সার্জেন্ট,” কিশোর বলল। “আগামীকাল বিকেলে ট্রেজার হান্টারে যাওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি আপনাকে, যাবেন নিশ্চয়? সব কথা সবার সামনে খুলে বলে রহস্যটার ইতি টানব।”

“নিশ্চয় যাব,” সার্জেন্ট জবাব দিলেন। “এখন থেকে তোমাদের কোনো কাজেই অনুপস্থিত থাকব না আমি।”

“চোরের দল!” পরদিন ট্রেজার হান্টারের সমস্ত ক্রুর সামনে যখন পুরো কাহিনি বলা শেষ করল কিশোর, গর্জে উঠলেন ক্যাপ্টেন কুপার। “কেন সব সময় ল্যাবরেটরিতে একা যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করত ডাক্তার হোল্ডিংস, এখন বুঝলাম।”

“ল্যাব-রিপোর্ট সম্পর্কে মিথ্যে বলেননি ডাক্তার,” কিশোর বলল। “কারণ আমার তুলে আনা জিনিসটা তিনিই বদলে তার জায়গায় সাধারণ স্যুভেনির দিয়ে এসেছিলেন ল্যাবরেটরিতে। সমুদ্রের নিচে তল্লাশি চালানোর ভার ছিল তাঁর ওপর। প্রথম পাঁচ সপ্তাহ অভিযান পরিচালনার সময় সাগরের নিচে নেমে তিনিও গুপ্তধন খুঁজেছেন। ওই সময়ই সান্তা হুয়ানকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ক্যাপ্টেন কুপারের কাছে খবরটা গোপন রেখেছেন। ডোরিকে গুপ্তধনের অর্ধেক ভাগ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তিনি তাকে তাঁর সহকারী বানিয়েছিলেন। ডোরির সাহায্যে সোনারভরা মার্কারের চিহ্ন দিয়েছেন। তারপর চুপ করে বসে ছিলেন, যত দিন না প্রচণ্ড হতাশ হয়ে গিয়ে এই ভারটা ক্যাপ্টেন নিজের ওপর নিয়ে নিলেন। ডাক্তার তাঁকে ভুল বুঝিয়ে ভুল জায়গায় অভিযান পরিচালনা করাতেন। ডাক্তারের উদ্দেশ্য ছিল, সময় নষ্ট করানো।” দম নেওয়ার জন্য থামল কিশোর।

ঘরে পিনপতন নীরবতা। সহকর্মী ক্রু-মেম্বারদের ওপর চোখ বোলাল মুসা। লাউঞ্জের বড় টেবিলটা ঘিরে বসে আছে ওরা। গত সপ্তাহের জটিলতার পরও কেউ জাহাজ ছেড়ে চলে যায়নি দেখে ভালোই লাগল তার। জাহাজের লোক ছাড়াও আরও লোক আছে ঘরে। সার্জেন্ট মার্ক বাদেও সেই মাঝবয়সী দম্পতি, যাঁদের বোটটা নিয়ে ডাক্তারের কেবিন ক্রুজারটাকে ওরা তাড়া করেছিল, তাঁরাও আছেন। ক্যাপ্টেন তাঁদের দাওয়াত করে এনেছেন। পার্টিটা ভালোই জমেছে, অপরাধীমুক্ত পরিবেশে। এত দিন যে অভিশপ্ত কালো ছায়াটা জাহাজকে ঘিরে ছিল, সেটা আর নেই।

“প্রায় সফল হয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের উদ্দেশ্য,” আবার বলল কিশোর। “আর মাত্র একটা সপ্তাহ ক্যাপ্টেন কুপারকে দিয়ে ভুল জায়গায় অভিযান পরিচালনা করাতে পারলেই তাঁর প্ল্যান সফল হয়ে যেত। কারণ তত দিনে একেবারে ফতুর হয়ে যেতেন ক্যাপ্টেন, তাঁকে দেউলিয়া ঘোষণা করত ব্যাংক, আর তারপর…”

“ক্যাপ্টেন কুপারকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে অভিযান পরিচালনা করতেন ডাক্তার হোল্ডিংস,” কিশোরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল বার্নি। “জানাই আছে, কোথায় আছে গুপ্তধন। সোজা গিয়ে তুলে নিয়ে হাওয়া হয়ে যেতেন।” কিশোর আর মুসার দিকে তাকাল সে। “সরি, ডক ফ্রেন্ডে তোমাদের যাওয়ার কথাটা ডোরিকে বলে দিয়ে ঠিক কাজ করিনি। বোট রেসিং নিয়ে ডোরির সঙ্গে আলোচনা করতে করতে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছিলাম।”

“আর শুনেই ডোরি ঠিক করল, আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে হবে,” কিশোর বলল। “তাই ব্যারি গুডকে মিথ্যে কথা বলে সাবধান করে দিল সে।”

“হ্যাঁ,” কিশোর বলল। “কিন্তু ডোরি কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল, টাকার জন্য সান্তা হুয়ানের জিনিস বিক্রি করতে গিয়ে। ও ভেবেছিল, নিজেকে রবিন বলে চালিয়ে দিয়ে সন্দেহমুক্ত থাকতে পারবে। যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ত ব্যারি, জেরার মুখে রবিনের নাম বলত, ডোরি সন্দেহের বাইরে থাকত। ট্রেজার হান্টার থেকে রবিন নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর রবিন বেঁচে আছে বোঝানোর জন্য তার নামে একটা সস্তা হোটেলের রুমও বুক করেছিল।” অস্বস্তিভরে নিনার দিকে তাকাল সে। যদিও নিনা এখন জানে খবরটা। আগের দিনই ওকে খুব মোলায়েমভাবে দুঃসংবাদটা জানিয়েছে কিশোর ও মুসা।

আঙুলের আংটিটাতে আস্তে আস্তে হাত বোলাল নিনা, একসময় ভাইকে যেটা দিয়েছিল সে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর রবিনকে দিয়েছিল। রবিন আবার বোনকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রিসের হাতে দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল নিনা, “ডাক্তারের শয়তানির কথা জেনে ফেলেছিল রবিন, আর সে জন্যই ওকে জীবন দিতে হয়েছে।” ভারী দম নিয়ে আবার বলল, “যেমন দিতে হয়েছে টনি জেরোমকে, মার্কারে সোনার ভরা আছে, এই খবর জেনে ফেলার জন্য।”

সহানুভূতির সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল মুসা। “টনির হার্টের সমস্যার কথা জানা ছিল ডাক্তার হোল্ডিংসের। এই তথ্যটা ক্যাপ্টেন কুপারের কাছে গোপন করেছিলেন তিনি। তাতে ডাক্তারের প্রতি

কৃতজ্ঞ হয়ে যায় টনি। আর এটাই চেয়েছিলেন ডাক্তার। কাউকে কৃতজ্ঞ করে ফেলে তাকে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করানো। তবে টনি যে ভুলটা করেছিল, যার জন্য তাকে জীবন দিতে হলো, সেটা হলো সোনারভরা মার্কারটা আবিষ্কার করার পর ডাক্তারকে বলে দিয়ে। মৃত্যুর আগে এ কথাটা আমাদের জানাতে চেয়েছিল টনি, কিন্তু সময় পায়নি, তার আগেই ওর মৃত্যু ঘটে। ডোরির মতো লোভী ছিল না টনি। তার মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন না বুঝতে পেরেই পটাশিয়াম ইঞ্জেকশন দিয়ে ওকে খুন করেন ডাক্তার।”
“ভাগ্যিস, লাশটা এখনো রয়েছে আমাদের কাছে,” সার্জেন্ট মার্ক বললেন। “করোনারকে দিয়ে নতুন করে আরেকবার ময়নাতদন্ত করালেই ওকে যে খুন করা হয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।”
“ভেতরে ভেতরে এই কাণ্ড, আর আমরা তোমাদের চোর ভেবেছি,” কিশোর ও মুসাকে বললেন বোটের মালিক মাঝবয়সী মহিলা। “ভেবেছি, তোমরা আমাদের বোট চুরি করে পালাচ্ছ।” অস্বস্তিভরে তাঁর দিকে তাকাল মুসা। এখনো গম্ভীর হয়ে আছেন মহিলা।
“হারবার পেট্রলকে আমরা রিপোর্ট করেছিলাম দুটো চোর আমাদের বোট নিয়ে পালাচ্ছে,” মহিলার স্বামী বললেন। স্ত্রীর বাহুতে হাত রাখলেন। “তবে তোমাদের ব্যাপারে থানায় ডায়েরি করাইনি এখনো, সত্যি কথাটা জেনে নিতে চেয়েছিলাম, কেন বোটটা নিয়েছিলে তোমরা।”
অপরাধবোধটা এতক্ষণে গেল কিশোরের। “আমি সত্যিই দুঃখিত, এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের।

আপনারাই এখন বলুন, কোনোভাবে কি আপনাদের ঋণ শোধ করতে পারব?”

“বোটটার ক্ষতি হয়েছে,” ভদ্রলোক বললেন।

“ও নিয়ে ভাববেন না,” সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন কুপার, এগিয়ে গেলেন দম্পতির কাছে। “আগামী সপ্তাহেই একটা আনকোরা নতুন বোট পেয়ে যাবেন আপনারা, আমার কৃতজ্ঞতার কথা লেখা নোটসহ। আপনাদের বোটটা না পেলে, আর কিশোর-মুসা ওটাকে ওভাবে নিয়ে না গেলে, এতক্ষণ বহু দূরে পালিয়ে যেত শয়তান ডাক্তার আর ডোরি।”

মহিলার মুখে হাসি ফুটতে দেখে স্বস্তি বোধ করল মুসা।

“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, ক্যাপ্টেন কুপার,” মহিলা বললেন। “আপনি একজন ভদ্রলোক।”

“শুনুন, শুনুন,” ক্রুদের দিকে ফিরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল মুসা। “আরও একজনকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।”

ইঙ্গিতে ক্রিসকে দেখাল সে। একটা ইজি চেয়ারে আরাম করে আধশোয়া হয়ে আছে ক্রিস। “আমাদের এই বাহামিয়ান বন্ধুটি যদি না থাকত, ক্যাপ্টেন কুপার তাঁর জাহাজটা হারাতেন।”

“ঠিক,” কিশোর বলল। “আগুনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য জাহাজে ওকে একা রেখে চলে গিয়েছিলাম আমরা।”

প্রশংসায় বিব্রত বোধ করল ক্রিস। নিজের জুতোর দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, “আসলে তেমন কিছু করতে হয়নি আমাকে। কাগজগুলোতেই শুধু আগুনটা লেগেছিল। একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়েই নিভিয়ে ফেলেছি। জাহাজে ধরে গেলে আর ঠেকাতে পারতাম না।”

“তবে হলওয়েটার ক্ষতি হয়েছে। সেটা এমন কিছু নয়। এ সপ্তাহেই মেরামতো করে ফেলতে পারব,” ক্যাপ্টেনকে বলল ডিয়েগো। “পোড়া জায়গাগুলোকে ঘষেমেজে সাফ করে নতুন রং করে নিলেই হয়ে যাবে। আর কাঠ যেখানে যেখানে পুড়েছে, সেগুলো বদলে দিতে হবে। ব্যস।”

ক্রিসের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। তার কাঁধ চাপড়ে দিলেন। “তোমাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই, পয়জন, আমার এই পুরোনো নৌকাটা বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। এটাই আমার সব।”

“তারপর তিনি নিনার কাছে গেলেন। “তোমার ভাই একজন হিরো। গুপ্তধনের তোমার ভাগের সঙ্গে রবিনের ভাগটাও তোমাকে আমি দিয়ে দেব।”

“থ্যাংক ইউ,” বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল নিনা।

“আর সবশেষে, কিশোর আর মুসা! তোমাদের চেয়ে ভালো ক্রু নির্বাচন ডাক্তার হোল্ডিংস আর করতে পারেনি!” দুই গোয়েন্দাদের দুই হাত ধরে উঁচু করলেন ক্যাপ্টেন, বিজয়-সংকেত জানালেন। হাততালিতে ফেটে পড়ল লাউঞ্জের সবাই।

“আপনি সত্যিই একজন ভদ্রলোক, ক্যাপ্টেন কুপার!” আবেগজড়িত কণ্ঠে মুসা বলল। কিশোরের দিকে তাকাল।

কিশোর হাসছে না। গম্ভীর। “আনন্দটা পুরো হত, যদি রবিন এখন আমাদের সঙ্গে থাকত!”

“এই যে আমি এসে গেছি!” দরজা থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ। “তোমরা কি ভেবেছিলে, ডাক্তার হোল্ডিংস আর ডোরির মতো দুটো শয়তান আমাকে গুদামঘরে বেশি দিন আটকে রাখতে পারবে? ওরা আমাকে খুন করার আগেই আমি পালিয়েছি। আরও আগেই আমি দেখা করে ক্যাপ্টেনকে সব জানাতে পারতাম, কিন্তু তিনি তখন আমার কথা বিশ্বাস করতেন না। তাই একটা গোলাবাড়িতে লুকিয়ে থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। একটু আগে খবর পেলাম, হোল্ডিংস আর ডোরি ধরা পড়েছে। শুনেই দৌড় দিয়েছি জাহাজে আসার জন্য।”

দীর্ঘ, স্তব্ধ একটা মুহূর্ত। সবাই যেন বোবা। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।

সবার আগে নীরবতা ভাঙল মুসা। “জানতাম! আমি জানতাম! তুমি মারা যেতে পারো না! তিন গোয়েন্দার এত বড় ক্ষতি তুমি হতে দেবে না!”

দুই হাত বাড়িয়ে রবিনের দিকে ছুটে গেল মুসা। তার পেছনে নিনা। কিশোরও গেল ওদের পেছনে। সবাই হুল্লোড় করে উঠল। ঘরে আনন্দ ও উত্তেজনার ঢেউয়ের যেন বন্যা বইতে লাগল। হাততালি বিস্ফোরিত হতে লাগল মুহূর্তে মুহূর্তে। রবিনকে ফিরে পেয়ে সবাই খুশি।

****************************************** সমাপ্ত *********************************

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত