অমরত্ব

অমরত্ব

সেই কোন ছোটবেলায় গল্পটা শুনেছিল নির্মল। একটা মানুষের অমর হওয়ার গল্প। মানুষটা যদি সত্যিই অমর হয়ে থাকেন, তাহলে তো তাঁর এখনও বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তিনি কোথায়! তাঁর কাছে গিয়ে সে জেনে নেবে, কী করে অমর হওয়া যায়।

কিন্তু না। হাজার চেষ্টা করেও সে তাঁর খোঁজ পায়নি। যতদূর জেনেছে, ওই লোকটাই প্রথম এবং ওই লোকটাই শেষ। তাঁর আগেও কেউ অমর হননি তাঁর পরেও না। অর্থাৎ উনি একা একাই অমর হওয়ার কৌশলটা বের করেছিলেন। তিনি যদি পারেন, তবে সে কেন পারবে না! কিন্তু কোথা থেকে হাঁটা শুরু করবে সে!

ইতিমধ্যেই সমস্ত জ্যোতিষী তার চষা হয়ে গেছে। কেউ ওর কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। কেউ হেসে উঠেছেন, কেউ আবার ভেবেছেন ছেলেটা নির্ঘাত কোনও পাগল। অমর হওয়ার সত্যিই যদি কোনও রাস্তা থাকত, তাহলে কি তাঁরা অমর হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন না!

নির্মলের মনে হল, জ্যোতিষীরা যখন বলতে পারছেন না, তখন নিশ্চয়ই কোনও মন্ত্রটন্ত্র আছে। যেটা উচ্চারণ করলেই অমর হওয়া যায়। ও একের পর এক কিনতে শুরু করল তন্ত্রমন্ত্রের বই। দিন রাত এক করে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে ও পেল কয়েকটা টোটকা। সূর্য ওঠার আগে সমপরিমাণ স্বর্ণচূর্ণ, পিপুলচূর্ণ আর কালো গরুর চোনা ভাল করে মিশিয়ে লেই করে, সেই লেই মুখে মেখে যার সামনে  গিয়ে দাঁড়ানো যাবে, মুহূর্তের মধ্যে সেই সম্মোহিত হয়ে যাবে। পাওয়া গেল এমন মন্ত্র, যার মুখ মনে মনে কল্পনা করে, সেই মন্ত্র মাহেন্দ্রক্ষণে একশো আট বার জপ করলেই, সে যতই অপছন্দ করুক না কেন, তারপর থেকেই সে তাকে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠবে। তার পিছু পিছু ঘুরবে। শত্রু  হলেও ভক্ত হয়ে যাবে। পাওয়া গেল এমন মন্ত্রও, যে মন্ত্র মাঘীপূর্ণিমার মধ্যরাতে স্নানটান করে নতুন বস্ত্র পরে, ধূপধুনো জ্বেলে সহস্র একবার জপ করলেই মানুষ তো কোন ছার, সমস্ত জীবকুল, দৈত্যকুল এবং ঈশ্বরকুলও বশীভূত হয়ে যাবে।

কিন্তু এসব তো সে চায় না। তাই ওগুলো কীভাবে করতে হয় বা করলেও, আদৌ কোনও ফল পাওয়া যায় কি না, সেটা সে পরীক্ষা করে দেখেনি। সে চায় অমর হওয়ার চাবিকাঠি। কিন্তু না। তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওইসব বইয়ে সেরকম কিছুই পেল না সে। তবে কি প্রাচীন কোনও গ্রন্থে পাওয়া যেতে পারে এর হদিশ!

মনে হতেই নির্মল ছুটল চোদ্দো পুরুষ ধরে তন্ত্রসাধনা করা সিদ্ধপুরুষ শ্যামাকান্ত তর্কালঙ্কারের বাড়ি। কিন্তু সেখানে গিয়ে ধুলোয় ঢাকা পাহাড় প্রমাণ বই ঘেঁটেও কোনও লাভ হল না। খোঁজখবর করে হাজির হল, দীর্ঘদিন তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকা নষ্ট হতে বসা তন্ত্রগ্রন্থের একমাত্র সংগ্রহশালায়। আঁশ বেরিয়ে যাওয়া, তুলো তুলো কাগজের এক একটা পাতা আলতো আলতো করে উল্টিয়েও সন্ধান পেল না তার, যেটা সে হন্যে হয়ে খুঁজছে। একদিন শুনল, পুকুরের মাটি কাটতে কাটতে কোথায় নাকি পাওয়া গেছে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। তার মধ্যেই মিলেছে কতগুলো পোড়া মাটির বাসনপত্র, মূর্তি আর লোহার চেয়েও মজবুত মাটির একটা সিন্দুক। সেই সিন্দুকের ভেতরে পাওয়া গেছে একগাদা তালপাতার পুঁথি। কিন্তু ওগুলো যে কোন যুগের বোঝা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞের দল রওনা হয়ে গেছে।

পুঁথি! তালপাতার পুঁথি! তাও আবার পুরনো দিনের! খবর পাওয়া মাত্র সে ছুটে গেল সেখানে। কিন্তু ওইসব পুঁথি যে কোন হরফে লেখা, সেটাই উদ্ধার করতে পারল না বিশেষজ্ঞেরা। পণ্ডিতেরা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। ফলে ও-ও হাল ছেড়ে দিল।

হঠাৎ একদিন খবরের কাগজের এককোণে ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকে গেল তার। কোথাকার এক কবিরাজ নাকি কী একটা ওষুধ বের করেছেন। সেই ওষুধ টানা সাতদিন খেলেই আর চিন্তা নেই, মৃত্যুর জন্য হাঁসফাঁস করা যন্ত্রণাক্লিষ্ট কর্কট রোগীও একদম সুস্থ হয়ে উঠেছেন। দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে আসছে। প্রতিদিন সকাল থেকে লাইন পড়ে যাচ্ছে তাঁর বাড়ির সামনে।

খবরটা পড়ে নির্মল ভাবতে লাগল, সত্যি, আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্র একসময় কত উন্নত ছিল! তখনকার চিকিৎসকেরা প্রায় মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। প্রায় কেন? মরা মানুষকেও তো বাঁচিয়েছেন বহুবার। মনে নেই? শক্তিশেলে ঘায়েল হয়ে লক্ষণ তখন মরো মরো, পাশেই ছিলেন বানর রাজবৈদ্য সুষেণ। তিনি বলেছিলেন মৃতসঞ্জীবনী গাছের কথা। কোথায় পাওয়া যাবে তাও বলে দিয়েছিলেন। সেইমতো একলাফে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল হনুমান। কিন্তু কোন গাছটা যে মৃতসঞ্জীবনী, বুঝতে না পেরে পুরো গন্ধমাদন পাহাড়টাকেই তুলে এনেছিল সে। সুষেণ তখন ওই গাছের ক’টা পাতা ছিঁড়ে, হাতের তালুতে ডলে, ক্ষতস্থানে লাগাতেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল লক্ষণ।

যে শাস্ত্র মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, সে শাস্ত্র কি জীবিত মানুষকে অমরত্ব দিতে পারে না! নিশ্চয়ই পারে। এই বিশ্বাস থেকেই সে আবার পড়তে শুরু করল চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাচীনগ্রন্থ চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা, অথর্ব বেদ। অথর্ব বেদ পড়তে পড়তে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। আয়ুর্বেদে তখন নাক, কান, গলা, শিশুচিকিৎসা, আকুপাংচার, শল্যচিকিৎসা, এমনকি মনোচিকিৎসারও ব্যবস্থা ছিল! এইজন্যই বুঝি আয়ুর্বেদকে বাংলা করলে দাঁড়ায় জীবন-জ্ঞান। জীবন-জ্ঞানই তো। আয়ু মানে যদি লাইফ হয়, আর ভেদা মানে নলেজ, তার বাংলা তো জীবন-জ্ঞানই হবে, তাই নয় কী? উৎসাহিত হয়ে সে খুঁজতে লাগল স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয়, মগধের রাজা অজাতশত্রুর রাজবৈদ্য জীবক আর ধন্বন্তরীর মতো পণ্ডিত চিকিৎসকেরা কোনও ভুর্জপত্র বা তালপাতায় কিছু লিখে রেখে গেছেন কি না। হয়তো লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ও সেটা খুঁজে পেল না।

সে সময় অনেক চিকিৎসকই অনেক যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অনেকেই সেগুলো লিপিবদ্ধ করে যাননি। যেমন, প্রশান্ত খাস্তগীর। বেশ কয়েক দশক আগে এদেশে এক মহামারীর চেহারা নেয় ঢেপুজ্বর। সেই জ্বরে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হতে লাগল। ঠিক তখনই ওই রোগ নিরাময়ের একটা মোক্ষম ওষুধ তৈরি করে ফেললেন এই দেশেরই এক চিকিৎসক, প্রশান্ত খাস্তগীর। শুনেছি, তাঁর নামে নাকি একটা রাস্তাও হয়েছে কলকাতায়। তিনি নিজেই সেই ওষুধ বানাতেন। নিজের হাতেই রোগীদের দিতেন। কিন্তু কী কী দিয়ে বানাতেন আর তার অনুপাতই বা কী সেটা নাকি কাউকেই বলে যাননি তিনি। লিখেও রেখে যাননি কোথাও।

হয়তো অমর হওয়ার ওষুধও কেউ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এই প্রশান্ত খাস্তগীরের মতো তিনিও হয়তো তা লিখে রেখে যাননি। কিংবা লিখে রেখে গেছেন এমন জায়গায়, যেখানে এখনও মানুষের নাগাল পৌঁছয়নি। যেদিন পৌঁছবে সেদিন হয়তো মাটির সিন্দুকে পাওয়া তালপাতার পুঁথিগুলোর মতোই সেটা যে কোন হরফে লেখা সেটাই বুঝতে পারবে না কেউ। নাহ্‌, চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনও বইতেই পাওয়া গেল না তেমন কিছু।

কিন্তু অমর শব্দটা যখন আছে, তখন সেটা পাওয়ার নিশ্চয়ই কোনও না কোনও একটা রাস্তা তো থাকবেই। সেটা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু কোথায় খুঁজবে সে? কার কাছে! কোনও সাধুসন্তদের কাছে! হ্যাঁ, তাঁদের কাছে পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী!

নির্মল শুনেছে, তারাপীঠ নাকি খুব জাগ্রত। সেখানে প্রচুর লোক সাধনা করেন। তাহলে কি সেখানে ও একবার যাবে! গেলে হয়তো পাওয়াও যেতে পারে তেমন কোনও সাধু, যিনি ওকে বলে দিতে পারেন অমর হওয়ার কোনও কৌশল! মনে হতেই বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে বেরিয়ে পড়ল নির্মল।

তারাপীঠে পা রাখতেই শিহরিত হল সে। এখানেই তো সাধনা করেছিলেন বামাক্ষ্যাপা! ভক্তিতে মন গদগদ হয়ে উঠল। পুজোটুজো দিয়ে শ্মশানের দিকে হাঁটা দিল সে। দূর থেকেই দেখতে পেল, অজস্র ঝুরিটুরি নামা বিশাল একটা অশ্বত্থগাছের তলায় একজন বসে আছেন। মাথায় একগাদা জটাজুটো। কে উনি! তাঁকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল তার। কিন্তু উনি যে কে, কিছুতেই মনে করতে পারল না। গুটিগুটি তাঁর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল, “বাবা, আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে।”

“বল বেটা।”

“বলছি আপনি কি বলতে পারবেন, কী করলে অমর হওয়া যায়?”

উনি আকাশের দিকে মুখ তুললেন। সব তাঁর ইচ্ছে। তার পরেই গান ধরলেন –

কারে দাও মা ব্রহ্মপদ

কারে কারো অধোগামী

সকলই তোমারই ইচ্ছা

ইচ্ছময়ী তারা তুমি

তোমার কর্ম তুমি করো মা

লোকে বলে করি আমি…… জয় মা তারা, জয় মা, জয় মা…

“কাজ কর, কাজ কর…” বলতে বলতে চোখ বুজলেন তিনি।

কাজ কর! সে কি কাজ করে না! প্রচুর কাজ করে। তবে তার এখন সবচেয়ে বড়ো কাজ কী করলে অমর হওয়া যায়, তার সন্ধান করা। যেভাবেই হোক, যার কাছ থেকেই হোক, এটা তাকে জানতেই হবে।

নির্মল উঠতে গিয়ে দেখে, তার পেছনে একজন ভদ্রলোক, সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলা আর দুটো বাচ্চা। ঠিক বাচ্চা নয়, একটা বালক আর একটা বালিকা। দেখে মনে হয়, এই ভদ্রলোকেরই বউ ছেলেমেয়ে। এরা যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে, ও টের পায়নি। ও উঠতেই ভদ্রলোক বললেন, “কী বলছেন, বাবা?”

“বলছেন, জয় মা তারা।”

“ও।”

ভদ্রলোক কথা বলতেই, ও কেমন যেন একটা ভরসা পেল। দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা দাদা, সবথেকে বড়ো সাধু কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?”

“সবথেকে বড়ো সাধু! কে ছোটো কে বড়ো, এ বিচার কে করবে! তবে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি যে ধরনের সাধু খুঁজছেন, সেরকম সাধু এখানে পাবেন না। হিমালয়ে হয়তো পেতে পারেন। শুনেছি, বড়ো বড়ো সাধুরা নাকি হিমালয়ের গুহায় যুগ যুগ ধরে সাধনা করেন।

“হিমালয়ে!”

“না, আপনাকে হিমালয়ে যেতে বলছি না। কাছাকাছির মধ্যে কামরূপ কামাখ্যাতেও যেতে পারেন। ওখানেও নাকি অনেক বড়ো বড়ো সাধু আছেন।”

“কামরূপ কামাখ্যায়!”

“মনে মনে নির্মল ভাবল, শুধু কামরূপ কামাখ্যায় কেন? সামান্য একটা খুন, জালিয়াতি বা বিস্ফোরণের কিনারা করতে সি.আই.ডি. বা ভিজিলেন্সের লোকেরা যদি চিন, জাপান, আমেরিকা যেতে পারেন, তো কীভাবে অমর হওয়া যায়, এটা জানার জন্য কি সে হিমালয়ে যেতে পারবে না! পারবে পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। তবে হাতের কাছে যখন কামরূপ কামাখ্যা রয়েছে, সেখানেই আগে ঢুঁ মারা যাক।

নির্মল গিয়ে পৌঁছল কামরূপ কামাখ্যায়। এটা নাকি তন্ত্রসাধনার সাধনপীঠ। অনেক বড়ো বড়ো সাধুরা এখান থেকেই সিদ্ধ হয়েছেন। যাঁরা সিদ্ধ হয়েছেন তাঁদের কাউকে কি সে পাবে না? নিশ্চয়ই পাবে।

পেল শেষ পর্যন্ত। তিনি নাকি ত্রিকালদর্শী। সব দেখতে পান। ইহকাল পরকাল সব। এমন কোনও প্রশ্ন নেই, যার উত্তর তাঁর অজানা। নির্মল তাঁর চরণে গিয়ে পড়ল। তিনি তখন চোখ বুজে ধ্যানে মগ্ন। তাঁর সামনে কতগুলো ফলমূল, বাতাসা, মঠ, সন্দেশ। ফলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গন্ধ বেরোচ্ছে। মঠ আর বাতাসাগুলো খেয়ে খেয়ে পিঁপড়েরা ফোঁপরা করে দিয়েছে। গিজগিজ করছে পিঁপড়ে।

নির্মল হঠাৎ দেখল, পিঁপড়েগুলো হুড়োহুড়ি করছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে কি ওরা চলে যাচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে ওরা! দেখতে গিয়ে দেখে, পিঁপড়েগুলো সার বেঁধে ওই ত্রিকালদর্শীর পা বেয়ে একচিলতে পোশাক পেরিয়ে, গা বেয়ে উঠে ঠোঁটের ভেতর দিয়ে, নাকের ভেতর দিয়ে, কানের ভেতর দিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে! সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেল, কে যেন তাকে বলছেন, “বাবা এখন ধ্যানে বসেছেন।”

কে বললেন কথাটা! ডানদিকে ঘাড় ঘোরাতেই নির্মল দেখল, পাশেই একজন সাধু দাঁড়িয়ে আছেন। অমনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সে। জিজ্ঞেস করল, “বাবা কখন উঠবেন?”

উনি বললেন, “কয়েক মিনিট হতে পারে, কয়েক সপ্তাহ হতে পারে, কয়েক মাসও হতে পারে। আবার কয়েক বছরও হতে পারে। এমনকি কয়েক যুগ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

“সে কী!”

“হ্যাঁ, বাবা যখন ধ্যানে বসেন, কখন উঠবেন কেউ বলতে পারে না।”

“কিন্তু আমি যে অনেক দূর থেকে এসেছি!”

“কী ব্যাপার, বলুন?”

“না মানে, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।”

“আমাদেরও প্রচুর প্রশ্ন থাকে। উনি ধ্যানে থাকলেও আমরা ওনার সামনে বসে মনে মনে সেই প্রশ্ন করি। উত্তরও পেয়ে যাই।”

“তাই!”

“হ্যাঁ। আপনি করে দেখুন। আপনিও আপনার সব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।”

“সত্যি?”

“পৃথিবীর কিছুই সত্য নয়। সবই অনিত্য। করেই দেখুন না,” বলেই উনি হাঁটা দিলেন। নির্মল ওঁর কথামতো সেই ত্রিকালদর্শীর সামনে আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মনে মনে জানতে চাইল – কী করে অমর হওয়া যায় বাবা?

সব চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে আবার একই প্রশ্ন করল সে – বলো না বাবা, কী করে অমর হওয়া যায়?

টুঁ শব্দটি নেই। অনেকক্ষণ কেটে গেল। ফের মনে মনে বলল সে – বলো বাবা, কী করে অমর হওয়া যায়?

কোনও উত্তর নেই। হাঁটু টনটন করছে। হৃদ্‌পিণ্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌……

উনি যে বললেন, ওনার সামনে বসে মনে মনে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাওয়া যায়! কই, কোনও উত্তর পেলাম না! তাহলে কি উনি এমনি এমনি বললেন! মিথ্যে মিথ্যে! অবশ্য উনি বলেছেন, উত্তর পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই যে পাওয়া যায়, ওটা কিন্তু একবারও বলেননি। তবে কি পরে পাব! দেখা যাক। না হলে তো হিমালয় আছেই। এরপরেই গো টু হিমালয়।

ফেরার ট্রেনে উঠে বসল নির্মল। ট্রেন চলছে। তার সিট পড়েছে মাঝের বাঙ্কে। সে বুঝতে পারছে, এই খোপে সেই কেবল আলাদা। বাকিরা সব একই পরিবারের। এমনকি ওদিকের জানালার মুখোমুখি দুটো সিটের একটায় বসে যে বাচ্চা ছেলেটা বই পড়ছে, আর তার সামনেরটায় হেলান দিয়ে বসে যে মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকটি চোখ বন্ধ করে ঢুলছেন, তাঁরাও এদেরই সঙ্গে। দিনেরবেলা, তাই সিট নামানো হয়নি। সিটের একধারে বসে আছে সে। জানালার দিকে চোখ।

“অমর কমলালেবু খাবি?”

‘অমর’ শব্দটা শুনেই ফিরে তাকাল নির্মল। দেখল, সামনের সিটে ভদ্রমহিলার কোলের উপরে কতগুলো কমলালেবু। উনি একটু ঝুঁকে ওইদিকের জানালার সিটে বই পড়তে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে আবার একই কথা বললেন। ছেলেটি এতই মগ্ন হয়ে বই পড়ছিল যে প্রথমবারটা শুনতেই পায়নি। এবার শুনতে পেল। বলল, “দাও।” বলেই বইটা বন্ধ করে সিটের উপরে রেখে এগিয়ে এল সে। কাছে আসতেই ভদ্রমহিলা তার হাতে দুটো কমলালেবু দিলেন। আড়চোখে নির্মলকে দেখিয়ে বললেন, “আঙ্কেলকে একটা দাও।”

নির্মল বলল, “না না, থাক।”

“থাক কেন? খান না।” ভদ্রমহিলা বলতেই ছেলেটার বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে একটা কমলালেবু নিল নির্মল। মৃদুস্বরে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম অমর?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায় থাকো?”

“কলকাতায়।”

“কোন ক্লাসে পড়ো?”

“সেভেনে।”

“কোন স্কুলে?”

“নব নালন্দা।”

“একটু আগে দেখছিলাম, তুমি একটা বই পড়ছিলে। স্কুলের বই?”

“না না। গল্পের বই।”

“ও, আচ্ছা। আচ্ছা, তোমার  নাম তো অমর, তুমি কি জানো, কী করে অমর হওয়া যায়?”

“হ্যাঁ। মাথা কাত করল ছেলেটা।”

“জানো?” বেশ মজা পেল নির্মল। যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য সে হিল্লি-দিল্লি চষে বেড়াচ্ছে, কেউ বলতে পারছে না, সাধুসন্তরা পর্যন্ত ফেল পড়ে যাচ্ছে, আর এইটুকুন একটা ছেলে, সে বলে কি না জানে কী করে অমর হওয়া যায়! নির্মল তাকে বলল, “বলো তো, কী করে?”

“কাজের মাধ্যমে।”

“কাজের মাধ্যমে?”

“হ্যাঁ। ওই যে বইটা পড়ছিলাম না? সেখানেও তো রয়েছে, নৌকা ডোবার পর সবাইকে একে একে বাঁচিয়ে শেষে এই গল্পের নায়ক জলের তোড়ে নিজেই তলিয়ে গেল জলে। নিজের জীবন দিয়ে সে অমর হয়ে রইল।”

“জীবন দিয়ে অমর!”

“না না, জীবন দিয়ে না। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে লোকেদের বাঁচিয়ে তাঁদের মধ্যেই সে বেঁচে রইল। ভালো কাজ করলে সেই কাজের মধ্যে দিয়েই লোক বেঁচে থাকে। জানেন না? যেমন শাজাহান। শাজাহান তো এখন নেই। কিন্তু তাজমহল গড়ার জন্য তিনি কিন্তু অমর হয়ে আছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ, তিনি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই অমর হয়ে আছেন। যেমন রামকৃষ্ণ, তিনি সবার ঘরে ঘরে আছেন। সবার মনে মনে আছেন। এটাই তো অমর হওয়া!”

“এটা অমর হওয়া!”

“হ্যাঁ। মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। কিন্তু বেঁচে থাকতেই পারে। তার কাজের জন্য। কাজই মানুষকে অমর করে রাখে।”

কাজ! এইজন্যই কি তারাপীঠের ওই সন্ন্যাসী তাকে বলছিলেন, কাজ কর! কাজের মধ্যে দিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে! অমর হয়ে যায়! কামরূপ কামাখ্যার ওই সাধু তাকে ঠিকই বলেছিলেন, ওনার সামনে বসে মনে মনে প্রশ্ন করে দেখুন, ঠিক উত্তর পেয়ে যাবেন।

ও পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে না পেলেও, পেয়েছে। ওর আর হিমালয়ে যাবার দরকার নেই। এখন ওকে কাজ করতে হবে, সত্যিকারের কাজ। যে কাজের মধ্যে দিয়ে ও অমর হয়ে উঠবে। মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকবে সবার মনে, সবার হৃদয়ে। কিন্তু কী করবে সে! কী! ভাবতে ভাবতে জানালার দিকে মুখ করে বাইরের দিকে তাকাল সে। চোখের সামনে থেকে সরে সরে যাচ্ছে, গাছ বাড়ি মাঠ গরু ছাগল ল্যাম্পপোস্ট… কিন্তু ওর চোখে কিছুই পড়ছে না। ও শুধু তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে। কী করা যায়! কী করা যায়! কী!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত