অর্জুন সমগ্র-ইয়েতির আত্মীয়

অর্জুন সমগ্র-ইয়েতির আত্মীয়

ভানুদা বলেছিলেন, আজকের রাতটা থেকে যাও অর্জুন। রাস্তাটা ভাল নয়, দু ঘণ্টার রাস্তা তিন ঘণ্টাতে যেতে হয়। তা ছাড়া মেঘ জমেছে খুব।

তখন সবে সন্ধে নেমেছে। কথা হচ্ছিল সুভাষিণী চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে। রাতে চাবাগানের কারখানা, অফিস, রাস্তা বিদ্যুতের কল্যাণে দিনের আলোর মতো আলোকিত। কিন্তু পেছনের চাবাগান অন্ধকারে ঝিম মেরে পড়ে আছে। অর্জুন আমাদের দিকে তাকাতেই চটপটি আলো ছড়িয়ে ছুটে গেল এপাশ থেকে ওপাশে।

অর্জুন বলল, আপনি যখন জিপ দিচ্ছেন তখন যেতে তো সমস্যা হবে। ওরা যদি পরশু সকালে যাত্রা শুরু করে তা হলে আজই আমার ওখানে পৌঁছনো দরকার। তা হলে কাল গোটা দিনটায় ওদের সঙ্গে থেকে তৈরি হওয়া যাবে।

ভানুদা আর আপত্তি করেননি। ড্রাইভারকে ডেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যেন ঠিকভাবে জিপ চালায়। সাহেবের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।

ছুটন্ত জিপে বসে কথাটা ভাবতেই ইসি পেল অর্জুনের, ভানুদা তাকেও সাহেব বানিয়ে ছাড়লেন। অবশ্য চা-বাগানের ম্যানেজারদের অধস্তন সাহেব বলে থাকেন। অতএব সাহেবের বন্ধু বা ঘনিষ্ঠরা সাহেব হয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া ভানুদা মনেপ্রাণে বাঙালি হলেও আদব-কায়দায় পুরোদস্তুর সাহেব। কখনও বিদেশে যাননি, কিন্তু একজন ব্রিটিশের জীবন যাপন করেন। আজ সকালে ফোন করে ঘুম থেকে তুলেছিলেন ভানুদা। সুভাষিণী চা বাগান থেকে জলপাইগুড়ির দূরত্ব আড়াই ঘণ্টার পথ। ঘুমজড়ানো চোখে রিসিভার তুলতেই ভানুদার গলা শুনতে পেয়েছিল, গুড মর্নিং, অর্জুনভাই। ঘুম ভাঙালাম মনে হচ্ছে।

না, না। কেমন আছেন ভানুদা? অর্জুন চেঁচিয়েছিল।

তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত? হাতে কোনও কেস আছে?

না। একদম বেকার। কেন?

তা হলে চটপট সুভাষিণীতে চলে এসো। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তোমার খুব ভাল লাগবে। লাঞ্চের মধ্যেই আসতে পারবে?

চেষ্টা করছি।

কিন্তু কিছু কাজ সেরে সুভাষিণীতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এতটা পথ সে তার লাল বাইক চালিয়ে এসেছে। তনুদা তখন অফিসে বসে কাজ করছেন। তিনি যতক্ষণে কাজ সেরে এলেন ততক্ষণে সুভাষিণী চা বাগানটা একপাক ঘুরে দেখে নিয়েছে অর্জুন। চা-বাগানের মধ্যে একটা ফাঁদ পেতে রাখা হয় যাতে হিংস্র জানোয়াররা সেখানে ধরা পড়ে। অর্জুন দেখে এল ফাঁদটা রয়েছে কিন্তু কেউ সেখানে পা রাখেনি।

চায়ের সঙ্গে উপাদেয় জলখাবার খেতে-খেতে কথা হচ্ছিল। ভানুদা বললেন, তুমি তো জানো, আমি এডমন্ড হিলারির টিমে জায়গা পেয়েছিলাম যখন তিনি হিমালয়ে ইয়েতি খুঁজতে গিয়েছিলেন।

জানি। ওই অভিযানের স্লাইডগুলোর কথা এখনও মনে আছে।

এডমন্ড হিলারিসাহেব মারা গিয়েছেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড থেকে একটা টিম এখন কলকাতায় এসেছে। হিলারিসাহেবের টিমের একজন ইয়ং মেম্বার জন বেইলি এই দলের নেতা। জনের বয়স আমার মতনই। কাল রাত্রে কলকাতা থেকে জন আমাকে টেলিফোন করেছিল। ও আমার সাহায্য চাইছিল। কিন্তু ভাই, আমার বয়স হয়েছে। তা ছাড়া চা বাগানের এত সমস্যা যে, ম্যানেজার হয়ে এসব ছেড়ে আমি কোনও অভিযানে যেতে পারি না। আমার কোম্পানি খুশি হবে না; আমারও খারাপ লাগবে। তোমাকে ফোন করার পর আমি জনকে তোমার কথা ফোনে বললাম। আমি বলছি বলে ওর কোনও আপত্তি নেই তোমাকে দলে নিতে। ভানুদা বললেন।

এটা কীসের অভিযান হচ্ছে?

হিলারিসাহেব প্রমাণ করেছিলেন ইয়েতি বলে কিছু নেই। একধরনের তুষার-ভালুক মাঝে-মাঝে মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটাচলা করে। পাহাড়ের লোকজন তাদেরই ইয়েতি বলে থাকে। আমরা একটা গুফায় ইয়েতির মাথা আছে শুনে দেখতে যাই। সেই মাথাটা আর ইয়েতির গায়ের চামড়া বলে ওরা যা দেখিয়েছিল তা লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে ওগুলো ভালুকের মাথা এবং চামড়া। কিন্তু এই ভালুকগুলোর চরিত্র অদ্ভুত। মানুষ যা করে তাই ওরা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। মানুষের মতো হাঁটতে, ওপরের দুটো পা-কে মাঝে-মাঝে হাতের মতো ব্যবহার করতে ওরা খুব ওস্তাদ। জন এই ভালুকগুলোর ওপর ডকুফিল্ম তৈরি করতে এসেছে। ভানুদা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, কে বলতে পারে, তুষার-ভালুক খুঁজতে গিয়ে তোমরা হয়তো তুষারমানবকে খুঁজে বের করতে পারো।

অর্জুনের মনে হয়েছিল ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু একটা কথা ভেবে সে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু ভানুদা, আমি তো কোনওদিন পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিইনি। ছবিতে যা দেখেছি সেটা খুব কঠিন কাজ। দীর্ঘদিন ট্রেনিং না নিলে একদমই সম্ভব নয়। জনসাহেব আমাকে নেবেন কেন?

ভানুদা বলেছিলেন, ঠিকই। যদি অভিযানটা আমাদের মতো পায়ে হেঁটে পাহাড় ভেঙে করা হত তা হলে আমি তোমার কথা জনকে বলতাম না। ওরা ঠিক করেছে কাঠমণ্ড থেকে হেলিকপটারে চড়ে চোদ্দো হাজার থেকে যোলো হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে গিয়ে বেসক্যাম্প করবে। সময় বাঁচানোর জন্যেই এটা

করবে ওরা। তোমাকে কাঠম যেতে হবে কালকেই।

কলকাতা হয়ে গেলে কাল কী করে কাঠমণ্ডুতে পৌঁছব?

তুমি কলকাতায় যাচ্ছ না। আগামীকাল সকাল এগারোটায় ভদ্রপুর থেকে প্লেনে উঠবে। শিলিগুড়ি থেকে জিপে ভদ্রপুর পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েক লাগবে। ভদ্রপুরে পৌঁছে মানিকলাল আগরওয়ালার ডিপার্টমেন্টাল শপে গিয়ে আমার নাম বলবে। আমি ফোন করে দিচ্ছি, টিকিট কাটা থাকবে।

ঠিক আছে। কিন্তু অত উচুতে যে ঠাণ্ডা হবে তার মোকাবিলা করার মতো পোশাক তো আমার নেই। যা আছে তাতে দার্জিলিং-এর শীতকে ম্যানেজ করা যায়। ওখানে কী করব?

এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। জন সব ব্যবস্থা করবে।

জিপ অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যতটা জোরে যাওয়ার কথা ততটা গতি উঠছিল না। রাস্তা এবুড়ো-খেবড়ো। বড় বড় গর্ত বাঁচিয়ে যেতে হচ্ছিল ড্রাইভারকে। এখন ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অথচ মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে না তেমন। আর একটু পরেই জলদাপাড়ার জঙ্গল। অর্জুন ভাবছিল কোথা থেকে কী হয়ে গেল। আগামীকাল সে প্লেনে চেপে কাঠমণ্ড যাবে তা আজ বিকেলেও ভাবেনি। কিন্তু কাঠমণ্ডুতে গিয়ে জনসাহেবকে কোথায় খুঁজে পাবে সেটা তো ভানুদাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। কাঠমণ্ডুতে সে আগে কখনও যায়নি। তারপরেই সে নিজেকে বোঝাল, একটী অভিযান যখন হবে তখন নিশ্চয়ই নেপাল গভর্নমেন্ট সেটা জানবে? খোঁজ পেতে অসুবিধে হবে না।

এখন সত্যি বেকার বসে ছিল সে। সত্যসন্ধানকে জীবিকা হিসেবে নেওয়ার পর তার খাওয়া-পরার অভাব হয়নি। যদিও কলকাতা-দিল্লির অনেক গোয়েন্দা সংস্থা তাকে ভাল টাকা মাইনে দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে যায়নি। মূলত মা এবং জলপাইগুড়ির ওপর টান এর কারণ। এই যে সে কাঠমণ্ড যাচ্ছে, এর জন্যে কোনও অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। কোনও কেস নিয়ে সে যাচ্ছে না। কিন্তু জীবনে অর্থ রোজগার করাই তো সব নয়! এমন সুযোগ তো সহজে পাওয়া যাবে না।

জলদাপাড়ার জঙ্গলে না ঢুকে ডানদিকের রাস্তা ধরে মাদারিহাটের মধ্যে জিপ ঢুকে পড়ল। এবং তখনই বৃষ্টি নামল। এত বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি অনেকদিন দ্যাখেনি অর্জুন। রাস্তা ফাঁকা। দুপাশের বাড়িঘর, দোকানপাট সন্ধে পার না হতেই ঘুমন্ত। কোনওমতে জিপ যখন হাইওয়েতে গিয়ে উঠল, তখন ড্রাইভার বলল, সাব, কুছ দেখাই না যাতা হ্যায়।

হেডলাইট ফগলাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটবেই। অর্জুন বলল, রাস্তা ছেড়ে একপাশে সাইড করে রাখো।

বৃষ্টি পড়ছে, সঙ্গে শিল। জিপের টিনের ছাদে যেন দুরমুশ চলছে। ড়ুয়ার্সে বৃষ্টি একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। অথচ কাল ভোরে বেরোতে গেলে আজ রাত্রেই তাকে জলপাইগুড়িতে পৌঁছতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জামাপ্যান্ট, শীতবস্ত্র নেওয়া ছাড়া মাকে রাজি করাতে হবে। সে অবশ্য টেলিফোনে মাকে বলেছে ওগুলো একটা সুটকেসে গুছিয়ে রাখতে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা বলেনি। পাহাড়ে ওঠার কায়দা না জানা ছেলেকে মা সহজে যেতে দেবেন বলে মনে হয় না।

ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেল কিন্তু বৃষ্টি একই তেজে পড়ে চলেছে। শিলা বৃষ্টি আর হচ্ছে না, এই রক্ষে। প্লাবন না হলে এইসব রাস্তায় জল জমে না। হাওয়া শুরু হতে অর্জুন স্বস্তি পেল। ওই ঝোড়ো হাওয়া নিশ্চয়ই মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সঙ্গে শব্দ হল প্রচণ্ড জোরে। ড্রাইভার হেডলাইট জ্বালাতেই দেখা গেল একটু দূরে একটা বড় গাছ রাস্তার ওপর পড়ে আছে। তার ডালপালায় রাস্তা ঢাকা। এই গাছের নীচে যদি এই জিপটাকে পার্ক করা হত তা হলে…। কল্পনা করতেই শিউরে উঠল অর্জন। ড্রাইভার বলল, সাব, এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। গাড়ি ব্যাক করে গয়েরকাটা দিয়ে চলে যাই।

লোকটা হিন্দিতে কথা বলছিল। যদিও ওটা ঘুরপথ হবে তবু তা ছাড়া তো কোনও উপায় নেই। বৃষ্টির জোর কমে এসেছিল। ড্রাইভার জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় রাস্তা ধরল।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে, তবে তার জোর কমে এসেছে। চারধার নিঝুম। অন্ধকার। কিন্তু অর্জুন জানে দুপাশে চা বাগান ছাড়া কোনও মানুষজন নেই। ঘুরপথে যেতে হচ্ছে বলে সময় বেশি লাগবেই। তার ওপর জিপের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না, এত গর্ত। মিনিট চল্লিশ যাওয়ার পর হঠাৎ নজরে পড়ল, হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল মোটর সাইকেলটাকে। রাস্তার পাশে গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে মুচড়ে পড়ে আছে। আর তার ঠিক তিন হাত দূরে একটি মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, মোটরবাইকটা জব্বর অ্যাকসিডেন্ট করেছে। বৃষ্টির জল লোকটির শরীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল ড্রাইভার স্পিড বাড়িয়ে দিল। শরীরটাকে কাটিয়ে গর্ত উপেক্ষা করে এমনভাবে বেরিয়ে এল যেন ভূতে তাড়া করেছে। অর্জুন চিৎকার করল, আরে! গাড়ি থামাও। লোকটা তো বেঁচে থাকতে পারে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। গাড়ি থামাও।

অনেকটা দূরে চলে এসে ড্রাইভার বলল, নেহি সাব। ওরা ডাকাত হতে পারে। আমাদের ম্যানেজারসাহেব হুকুম দিয়েছেন, রাত্রে কেউ হাত দেখালে অথবা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে পড়ে থাকলে কখনও যেন গাড়ি না থামাই।

কিন্তু এমন ঝড়বৃষ্টির রাত্রে অ্যাকসিডেন্ট হওয়াই তো সম্ভব। অর্জুন রেগে গেল।

ড্রাইভার জিপ থামাল না। মাথা নেড়ে বলল, সাব, লোকটা যদি সত্যি মরে গিয়ে থাকে তা হলে আমরা কিছুই করতে পারতাম না। চোট পেলে নিশ্চয়ই রক্ত বের হত। আমি কোনও রক্তের চিহ্ন দেখতে পাইনি। আর যদি অ্যাক্টিং হয় তা হলে আমরা এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম। এসব রাস্তায় এইরকম ডাকাতি প্রায়ই হয়।

অর্জুন কিছু বলল না আর। ভানুদা তাকে তার লাল বাইকটা ওঁর ওখানে রেখে জিপে করে পাঠিয়েছেন। অর্জুন চেয়েছিল নিজের বাইকে জলপাইগুড়িতে ফিরে যেতে। ভাগ্যিস যায়নি, নইলে এই ঝড়বৃষ্টির অন্ধকার রাস্তায় তার অবস্থা যে ওরকম হত না তা কে বলতে পারে? কিন্তু লোকটার যদি সত্যি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, যদি এখনও ওর শরীরে প্রাণ থেকে থাকে, তা হলে প্রচণ্ড স্বার্থপরের মতো সে চলে এসেছে পাশ কাটিয়ে। বিবেকের দংশন ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠল অর্জুনের কাছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

ভারতবর্ষ থেকে নেপালে যেতে পাশপোর্ট এবং ভিসার প্রয়োজন হয় না। সীমান্ত আছে, সন্দেহজনক ব্যাপার ঘটলে দুদেশের পুলিশ এবং কাস্টমস সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অর্জুনের ক্ষেত্রে কিছুই ঘটল না। শিলিগুড়ি থেকে জিপ তাকে ঠিক নটায় পৌঁছে দিল ভদ্রপুরে। ভদ্রপুর একটি সাধারণ শহর। মানিকলাল আগরওয়ালার দোকান খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বেশ বড় দোকান। প্রচুর বিদেশি জিনিস সাজানো। অর্জুন শুনেছিল নেপালে বিদেশি জিনিস প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়, এখন চোখে দেখল ক্যামে সাবান, জামান। নিভিয়া, ফরাসি পারফিউম, কী নেই! কিন্তু এখানে এসব জিনিস কেনে কারা?

মানিলাল আগরওয়ালা দোকানেই ছিলেন। মধ্যবয়সী স্মার্ট মানুষ। পরনে সাফারি সুট। ভানুদার নাম বলার আগেই বললেন, গুডমর্নিং অর্জুনবাবু। মিস্টার ভানু ব্যানার্জির ফোন পেয়ে আপনার জন্যে টিকিট বুক করে রেখেছি। আজ কোনও সিট ছিল না। একজনকে ক্যানসেল করাতে হল।

সে কী!

আরে, এ-নিয়ে ভাববেন না। এখানে এরকম হয়। আসুন, ভেতরে

আসুন। আপনার নিশ্চয়ই সকালে নাস্তা করা হয়নি। মানিকলাল সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন।

অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু খিদেও পেয়েছিল। ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে সংকোচ কমে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মানিকলাল ওকে একটা খাম দিলেন, আপনার টিকিট। ফেরারটা ওপেন আছে। এখানে এসে আমি থাকি বা না থাকি, দোকানে বললেই আপনাকে শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আচ্ছা, আপনি কাঠমপুতে কদিন থাকবেন?

আমি জানি না। ওখানে যাওয়ার পর জানতে পারব।

আপনি ডোমেস্টিক ফ্লাইটে যাচ্ছেন। কোনও অসুবিধে হবে না। একটা ছোট প্যাকেট দিলে নিয়ে যেতে পারবেন?

কাউকে দিতে হবে?

হ্যাঁ। আসলে যাকে প্যাকেটটা পৌঁছে দিতে পাঠাচ্ছিলাম তার টিকিট ক্যানসেল করতে হল তো! কোন হোটেলে উঠছেন?

সেটাও ওখানে গেলে জানতে পারব।

জানা থাকলে আমার লোকই আপনার হোটেল থেকে নিয়ে যেতে পারত। ঠিকানা লিখে দিলে পৌঁছে দেওয়ার সময় হবে আপনার? দেখুন।

লোকটা এত উপকার করছে দেখে না বলতে পারল না অর্জুন। ভানুদার জিপ ছেড়ে দেওয়া হল। মানিকলাল, তাঁর গাড়িতে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। বেরোবার আগে একটা চৌকো সাদা পিসবোর্ডের বাক্স এগিয়ে দিয়েছিলেন, না, আপনাকে কষ্ট করে পৌঁছে দিতে হবে না। এয়ারপোর্টে আমার লোক এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আমি ফোন করে দিচ্ছি।

কিন্তু তিনি আমাকে চিনবেন কী করে?

এই ফ্লাইটে আপনিই একমাত্র বাঙালি প্যাসেঞ্জার। তবু আপনার নাম-লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে ও বাইরে বেরোনোর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

লোকটার নাম কী?

এস. কে. গুপ্তা। সাদা প্যাকেটটা সুটকেসে ঢুকিয়ে নিয়েছিল অর্জুন।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেন দেখে সে অবাক। কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণের কারণে প্লেন সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই। এমনকী, বাগডোগরা থেকে দমদমে যেসব প্লেন উড়ে যায় তার আভিজাত্য অনেক বেশি। ছোট্ট প্লেন। সাকুল্যে জনাআটেক প্যাসেঞ্জার বসতে পারে। প্রায় খেলনা-খেলনা মনে হয়। একজন বিমানসেবিকা আছেন। তাঁর স্থান পেছন দিকে। প্লেনটা যখন আকাশে উড়ল তখন বুক কাঁপছিল অর্জুনের।

কিন্তু ঠিকমতো পৌঁছে গেল ওরা। কাঠমণ্ডু শহরটা ভ্যালির মধ্যে বলে পাহাড়ি শহর থেকে একটু আলাদা। অথচ পাহাড় চারপাশে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে মানিকলের কথা মনে পড়ল। কিন্তু তার নাম প্ল্যাকার্ডে লিখে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। মিনিটদশেক দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না। এস, কে, গুপ্তার তো এখানেই আসার কথা। হতাশ হয়ে বাইরে বের হতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ঘিরে ধরল অর্জুনকে। সবাই তাকে পৌঁছে দিতে চায়। ওদের মধ্যে একজন বাংলায় কথা বলল, সার, কোথায় যাবেন বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

অর্জুন বলল, আমাকে ভাই আর-একটু অপেক্ষা করতে হবে। একজন এয়ারপোর্টে আসবে।

আপনার কোনও বন্ধু?

না। লোকটার কৌতূহল অর্জুনের পছন্দ হল না! কিন্তু ভিড়টা সরে গেল। তাকে ছেড়ে ট্যাক্সিওয়ালারা অন্য যাত্রী নিয়ে পড়েছে। এখানে কি ট্যাক্সিওয়ালারা বেশি প্যাসেঞ্জার পায় না? অর্জুন দেখল বাঙালি ড্রাইভারটি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। অর্জুন ঠিক করল আর অপেক্ষা করবে না। ফেরার সময় ভদ্রপুরে পৌঁছে মানিকলালকে তার প্যাকেট ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু এখন জন বেইলিকে খুঁজে বের করা তার প্রথম কাজ। নিউজিল্যান্ডের লোকজন নিয়ে এসেছেন অভিযান করতে, খবরটা এখানকার পর্বত অভিযান বিষয়ক দফতর নিশ্চয়ই জানবে। অর্জুন লোকটিকে ডাকল। বাঙালি হওয়ায় ওর কাছে সমস্যাটা বলা সহজ হবে।

লোকটি হাসল, যাবেন সার? দাঁড়ান। গাড়ি নিয়ে আসছি।

পার্কিং লট থেকে গাড়ি চালিয়ে এনে দরজা খুলে দিল ড্রাইভার, কোথায় যাব বলুন?

এখানকার মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট কোথায়?

কেন সার?

নিউজিল্যান্ড থেকে কয়েকজন অভিযাত্রীর আসার কথা। তাঁরা কোথায় উঠেছেন সেটা আগে জানতে হবে।

ও, তাই বলুন। লোকটা একগাল হাসল, এই গোপালকে জিজ্ঞেস করলেই সেটা জেনে যাবেন সার, কোথাও যেতে হবে না। কাল সন্ধের প্লেনে ওরা এসেছে সার। উঠেছে ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসে। আমি তখন এয়ারপোর্টে ছিলাম সার। ওই সাহেবদের সঙ্গে যদি দরকার থাকে তা হলে আপনাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি সার।

বাঃ। আপনি দেখছি বেশ চৌকস লোক। ওখানেই চলুন।

তা সার, কাঠমণ্ডর কোথায় কী হচ্ছে তার সব খবর আপনি এই গোপালের কাছে পাবেন। এই তো, কলকাতার একটা ছেলে পালিয়ে এসেছিল এখানে। তার বাবা আমার ট্যাক্সিতে ওঠায় আমি তাঁকে খবরটা দিয়ে দিলাম। এখানে তো আমার কম দিন হল না। ওই যে গাড়িটা দেখছেন, উলটে আছে, এক ঘণ্টা আগে অ্যাকসিডেন্টে ওর ড্রাইভার মারা যায়। যে জিপটা ওকে ধাক্কা দিয়েছিল তার পাত্তা পুলিশ কখনও পাবে কিনা জানি না। কিন্তু আমি জানি

ওটা একটা ভাড়া করা জিপ।

এত কথা জানলেন কী করে?

আরে আমি তো তখন প্যাসেঞ্জার নিয়ে এয়ারপোর্টে আসছি। পুলিশ ভাববে অ্যাকসিডেন্টে গুপ্তসাহেব মারা গেছেন। কিন্তু অদ্ভুত দিব্যি করে বলতে পারি সার, জিপটা গুপ্তসাহেবের গাড়িটাকে পাশ থেকে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছে যে, উনি কন্ট্রোল রাখতে পারেননি।

অর্জুন সোজা হয়ে বসল, এই গুপ্তসাহেবের নাম কী?

সেটা এখনই বলতে পারব না সার। খোঁজ নিলেই, তা কেন, কালকের পেপারে পেয়ে যাবেন। ড্রাইভার মাথা নাড়ল।

লোকটার টাইটেল যে গুপ্তা তা আপনি জানলেন কী করে?

আরে বাপ। অতবড় ব্যবসায়ী। নেপাল, বুঝলেন, দুনম্বরি ব্যবসায়ীর কাছে স্বর্গের মতো। কিন্তু এই গোপালের ট্যাক্সিতে দুনম্বরি জিনিস সাপ্লাই করতে পারে না কেউ। গুপ্তসাহেবের লোককেও আমি ফিরিয়ে দিয়েছি।

এ হতে পারে না। অর্জুন আবার সিটে হেলান দিল। এস. কে. গুপ্তা একঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে আসতে যাবেন কেন? আর এই গোপালের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে অন্য লোক তাঁকে দুর্ঘটনায় জড়িয়ে মেরে ফেলবে কেন? তার তো জানার কথা নয় উনি এখনই এয়ারপোর্টে আসছেন। কারণ সে ভদ্রপুর থেকে রওনা হওয়ার পর গুপ্তসাহেব ফোনে জানতে পেরেছেন তাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। এ নিশ্চয়ই অন্য লোক।

ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি থামিয়ে গোপাল জিজ্ঞেস করল, কদিন থাকবেন সার? দরকার হলেই বলবেন!

আমি তো বললাম এখনও কিছুই জানি না। কত দিতে হবে?

দুশো দিয়ে দিন সার।

দুশো? রাস্তা তো বেশি নয়।

অন্য কেউ হলে আরও বেশি চাইত। তা ছাড়া আপনার ঘোরাঘুরির ঝামেলা বাঁচিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় যে পৌঁছে দিল সেই গোপালকে একটু দেখবেন না সার। হাসল গোপাল।

রিসেপশনে পৌঁছে অর্জুন জন বেইলির খোঁজ করল। আপনি কি ইন্ডিয়া থেকে আসছেন?

হ্যাঁ।

অর্জুন?

হ্যাঁ।

এনি আইডেন্টিটি কার্ড, প্লিজ?

অর্জুন পাশপোর্ট সঙ্গে নিয়ে এসেছিল কিছু না ভেবেই। সেটা বের করে দেখাল। রিসেপশনিস্ট সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, রুম নাম্বার টু হান্ড্রেড সেভেন। মিস্টার বেইলি কাজে বেরিয়েছেন।

আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

মিস্টার বেইলি আপনার নামে ঘর বুক করেছেন।

ঘরটি সুন্দর। জুতো পরেই খাটে শুয়ে ছিল অর্জুন। নিউজিল্যান্ডের মানুষরা ইংরেজি বলেন। কিন্তু অমল সোম বলেছিলেন ওদের উচ্চারণ বুঝতে বেশ অসুবিধে হয়। জনসাহেবের সঙ্গে তেমন সমস্যা হলে মুশকিলে পড়বে সে। এখন ভরদুপুর। ভাগ্যিস মানিকলাল তাকে প্রচুর খাইয়েছিল, নইলে..। অর্জুন তার সুটকেসের দিকে তাকাল। এবং তখনই এস. কে. গুপ্তার কথা মনে এল। তার কাছে মানিকলালের টেলিফোন নম্বর নেই যে, ভদ্রপুরে জানিয়ে দেবে যে কেউ আসেনি বাক্সটা নিতে। কিন্তু গোপাল যা বলল…।

অর্জুন ঘরের এক কোণে রাখা টিভিটা চালিয়ে দিল। রাজা এবং মন্ত্রীর খবরাখবর দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় কেন্দ্র থেকে। পোখরাতে আরও টুরিস্ট যাতে যান তার জন্যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিরাটনগরের একটা কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। তারপরেই পরদায় ভেসে উঠল সেই দুর্ঘটনায় পড়া গাড়িটির ছবি, যা অর্জুন এখানে আসার পথে দেখে এসেছে। সংবাদপাঠক বললেন, আজ সকাল সাড়ে এগারোটার সময় এক সড়ক দুর্ঘটনায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এস. কে. গুপ্তী নিহত হয়েছেন। জানা গেছে, তিনি এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলেন। তারপরেই অন্য খবর এসে গেল। অর্জুন হতভম্ব হয়ে গেল। ভদ্রপুর থেকে তার প্লেন ছাড়ার আগেই মানিকলাল ফোনে এস, কে, গুপ্তাকে এয়ারপোর্ট যেতে বলেন। সময় যখন সাড়ে এগারোটা তখন বোঝা যাচ্ছে গুপ্তা একটুও সময় নষ্ট করেননি। গোপালের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে আততায়ী গুপ্তাকে পথেই মেরে ফেলতে চেয়েছে। অর্থাৎ আততায়ী গুপ্তার ওপর নজর রাখছিল। এমন হতে পারে গুপ্তার ফোনে সে আড়ি পেতেছিল। এ থেকে প্রমাণিত হয় একটা পুরনো শত্রুতা এদের মধ্যে ছিল। কিন্তু তাই যদি হয় তা হলে আততায়ী গুপ্তাকে খুন করে এয়ারপোর্টে গিয়ে তাকে বলতে পারত যে সে-ই এস, কে, গুপ্তা। অর্জুনের পক্ষে সন্দেহ করা সম্ভব ছিল না। বাক্সটা তখনই সে দিয়ে দিত। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে বাক্সটার প্রতি আততায়ীর কোনও মোহ নেই। তা হলে খুন করল কেন?

অর্জুন হেসে ফেলল। তার স্বভাব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে এখানে এসেছে। সম্পূর্ণ অন্য কারণে। কে কাকে খুন করল তা নিয়ে সে ভাবছে কেন? সে সুটকেস খুলে সাদা পিসবোর্ডের বাক্স বের করল। গোপাল যা বলল তাতে বোঝা যাচ্ছে এস, কে, গুপ্তা বড় ব্যবসায়ী। তিনি কত বড় ব্যবসা করেন তা নিয়ে প্রশ্ন করে কোনও লাভ নেই। কিন্তু মারা গেলে যার কথা টিভিতে বলা হয় তিনি একেবারে সাধারণ মানুষ নন। তা এইরকম লোক মানিকলের ফোন পেয়ে নিজে কেন এয়ারপোর্টে এই বাক্সটা আনতে যাচ্ছিলেন। যে-কোনও লোককে পাঠালেই তো পারতেন।

অর্জুনের মনে হল কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কী এমন বিশেষ জিনিস মানিকলাল পাঠিয়েছেন যে, কর্মচারীদের ওপর বিশ্বাস করতে পারেননি এস, কে. গুপ্তা? এই সময় টেলিফোন বাজল। অর্জুন রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশে কেউ গ্যাঁক গ্যাঁক করে কিছু বলে উঠল।

অর্জুন বুঝতে না পেরে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?

আঃ। দিস ইজ জন। জন বেইলি। তুমি নীচের রেস্টুরেন্টে চলে এসো। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।

সব কথা পরিষ্কার নয়। একটা আনুনাসিক ধ্বনি জড়িয়ে আছে প্রতিটি শব্দের সঙ্গে। কিন্তু অর্জুন অপেক্ষা করল না।

নীচের রেস্টুরেন্টে যেতেই ওদের দেখতে পেল সে। পাঁচজন পুরুষ এবং দুজন মহিলা টেবিলে বসে আছেন। ও কাছে গিয়ে বলল, আমি অর্জুন।

সঙ্গে সঙ্গে লম্বা, একমাথা টাক, রোগা এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত জড়িয়ে ধরলেন, আমি জন। কখন এসেছ তুমি?

এই তো একটু আগে।

আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। একে-একে সবার নাম এবং কে কী কারণে এসেছেন জানিয়ে দিলেন জন বেইলি। অর্জুন শুনল দুজন মহিলার একজন ক্যামেরা চালাবেন। অন্যজন ডাক্তার।

ওঁদের সঙ্গে বসার পর লাঞ্চ এল। কন্টিনেন্টাল খাবার। অর্জুন লক্ষ করল কেউ জল খেলেন না। খাওয়ার পর কোল্ড ড্রিঙ্কের টিন খুললেন। জন এবার বললেন, ভানু আমার বন্ধু। সার হিলারির টিমে আমরা ছিলাম। ওকে রেফার করেছিল ডেসমন্ড ডয়েগ। ডাক্তার অসুস্থ হওয়ার পর ভানু প্রয়োজন হলে ইঞ্জেকশন দিত। খুব ভাল হাত ছিল। পরে জানা গেল সে ওই অভিযানে যাওয়ার আগে কোনওদিন ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ধরেনি। সার হিলারি তাঁর বইয়ে এই ব্যাপারটা লিখেছিলেন। তুমি আমাদের এই অভিযানে কীভাবে সাহায্য করতে পারো?

কথাগুলো বুঝতে পারল অর্জুন। সে বলল, আপনারা একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপারের ছবি তুলতে যাচ্ছেন। আপনাদের সঙ্গী হতে আমি আগ্রহী। আমি জানি না ঠিক কীভাবে সাহায্য করতে পারব।

পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা তোমার নেই?

না।

তুমি ডাক্তার নও?

না।

ওখানকার গ্রামের মানুষদের ভাষা তুমি কি জানো?

নেপালি হলে জানি। তবে সম্ভবত ওরা নেপালি বলে না।

তা হলে তোমাকে নিয়ে আমার কী উপকার হবে?

আপনি ঠিকই বলেছেন। আসলে মিস্টার ভানু ব্যানার্জি…।

ইয়েস। সেখানেই তুমি আসছ। আচ্ছা, বন্ধুরা, তোমরা এখন বিশ্রাম নিতে পারো। আমি আর অর্জুন একটু ঘুরে আসছি। জন উঠে দাঁড়ালেন।

বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। জন এবং অর্জুন সেটায় উঠলে ড্রাইভারকে সরকারি হাসপাতালে যেতে বলা হল। কাঠমণ্ডু খুব সুন্দর সাজানো শহর নয়। অন্তত দার্জিলিং-এর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। রাস্তায় এত ভারতীয় মুখ যে, বিদেশ বলে ভাবতে অসুবিধে হয়। জন বললেন, এবার নিয়ে চারবার আমি এখানে এলাম। শহরটা তেমন বদলায়নি।

হাসপাতালে যে আগেই খবর দেওয়া ছিল তা বুঝতে পারল অর্জুন। ততক্ষণে সে ভেবে নিয়েছে আগামীকালই তাকে ফেরত যেতে হবে। খামোখা পয়সা এবং সময় নষ্ট করে এখানে এল। বিশ্রী লাগছিল তার।

হাসপাতালের সিঁড়িতে স্মার্ট চেহারার এক তরুণ ডাক্তার দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওদের দেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়ালেন, মিস্টার জন বেইলি…

ইয়েস। কেমন আছ ডাক্তার?

আমি ঠিক আছি।

মিট মাই ইয়ং ফ্রেন্ড, অর্জুন।

ডাক্তার করমর্দন করলেন অর্জুনের সঙ্গে। তারপর সিঁড়ি ভেঙে নিজের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। জন কললেন, অর্জুন, এই হ্যান্ডসাম ডাক্তারকে আমি জন্মাতে দেখেছি। ইয়েস! পাহাড় থেকে আমরা নামছিলাম। একটু পেছনে। ছিলেন ওঁর বাবা আর মা। হঠাৎ ওঁর মায়ের শরীর খারাপ হল। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে চারপাশে ঘিরে দেওয়া হল। একটু বাদেই আমরা কান্না শুনতে পেলাম। ওঁর বাবা জানালেন, ছেলে হয়েছে। তারপর কী করা হল জানো? ওই সদ্যোজাত সন্তানকে ওঁরা নিয়ে গেলেন পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর কাছে। অত ওপরে বরফগলা সেই জল তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আচমকা সেই জলে ওঁকে চুবিয়ে পরিষ্কার করে গরম কম্বলে মুড়ে দেওয়া হল। আমরা বাধা দিতে গিয়েছিলাম। হিলারিসাহেব চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। মনে হয়েছিল সদ্যোজাত শিশুটিকে ওঁরা খুন করছেন। কিন্তু যে পাহাড়ি গ্রামে ওঁরা থাকেন তার আচার-অনুষ্ঠান হয়তো ওইরকমই। নইলে যে মহিলার সন্তান যে-কোনওদিন হবে তিনি স্বামীর সঙ্গে দশ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নেমে কাঠমণ্ডুতে আসতে চাইবেন কেন? এই আসাটা যে কীরকম কষ্টকর তা পাহাড়ে ওঠানামায় অভ্যেস যাঁদের আছে তাঁরাই জানেন। কিন্তু কাঠমণ্ডুতে পৌঁছবার আগেই শিশুটির মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রায় দুমাস তাঁকে শুয়ে থাকতে হয়েছিল কাঠমপুর হাসপাতালে। শিশুটির কিছু হয়নি। অবাক হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। সেই শিশুটিই ইনি, আজকের তরুণ ডাক্তার।

ডাক্তার হাসলেন, আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

ওঃ, নো, আমরা কিছুই করিনি। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তোমার দায়িত্ব নিয়েছিল।

জনের কথায় অর্জুন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

জন বললেন, সেবার সার হিলারি আমাদের নিয়ে ইয়েতির সন্ধানে আপার হিমালয় প্রায় চষে ফেলছিলেন। ক্রমশ আমরা যখন হতাশ হয়ে পড়ছি তখন খবর এল এক পাহাড়ি গ্রামে ইয়েতির মাথা আর চামড়া সযত্নে রাখা আছে। আমরা সেখানে গেলাম। মন্দিরে ওগুলো রাখা হয়েছে খুব যত্ন করে। ইয়েতির মাথা বলে যেটা ওরা দেখাল তা দেখে আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল। অথচ অস্বীকারও করতে পারছিলাম না। মাথাটা শুকিয়ে কিছুটা ছোট হয়ে গেলেও তার পুঁচলো মুখ মানুষের মতো নয়। তবে গায়ের চামড়া ইয়েতির হতে পারে। ওই বরফের ওপর থাকতে হলে যতটা লোম থাকা উচিত তা ঠিক আছে। কেউ ইয়েতি দেখেছে কিনা জানতে চাইলে সবাই বলতে লাগল, সে দ্যাখেনি, কিন্তু যে দেখেছে তার কাছ থেকে শুনেছে। আর ওই বস্তুগুলো সংগ্রহ করেছে ওদের পূর্বপুরুষেরা। সার হিলারি ওগুলোকে পরীক্ষা করাতে লন্ডনে নিয়ে যেতে চাইলেন গ্রামপ্রধানরা আপত্তি জানালেন। ওগুলো দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত স্থানচ্যুত করলে গ্রামের মানুষরা বিপদে পড়বে। হয়তো ইয়েতিরা আক্রমণ করবে। আমরা অনেক চেষ্টা করলাম। ভাষা খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। ওই গ্রামের মানুষরা কাঠমণ্ডর নাম শুনেছে কিন্তু সেই শহরটাকে দ্যাখেনি। কলকাতা-লন্ডন সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। শেষপর্যন্ত ওরা নিয়ে এল একজন মানুষকে, যিনি চার হাজার ফুট নীচের এক মিশনারির স্কুলে একবছর পড়েছিলেন। ভদ্রলোক ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। ইয়েস, নো, ভেরি গুড, ব্যাড। তাঁকে ধরে শেষপর্যন্ত গ্রামপ্রধানদের রাজি করালাম। শর্ত হল দুবছরের মধ্যে ওই দুটি বস্তু ফিরিয়ে দিতে হবে। আর সেই ভদ্রলোক আর-একজন গ্রামপ্রধান ওই পবিত্র বস্তু দুটো বয়ে নিয়ে যাবেন।

লন্ডনে পৌঁছে ওঁরা অবাক হয়ে গেলেন। পৃথিবীতে কত জায়গা জনমানবহীন অবস্থায় পড়ে আছে। তবু সেখানে না গিয়ে এত লোক এক জায়গায় ঠাসাঠাসি হয়ে বাস করছে কী করে? ওঁদের ধাতস্থ করতে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করছেন ওগুলো। সেই অল্প ইংরেজি জানা ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তিনি যে দেশে এসেছেন তার প্রধানের জন্যে উপহার নিয়ে এসেছেন। সেটা নিজের হাতে তুলে দিতে চান। কুইন তখন বাকিংহাম প্যালেসে নেই। দেশের বাইরে শুভেচ্ছা-সফরে গিয়েছেন। কোনও দেশের প্রধান মহিলা এ-কথা বোঝাতে গলদঘর্ম হতে হল। তবু বিশেষ ব্যবস্থা করে তাঁকে বাকিংহাম প্যালেসে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সব দেখে মুগ্ধ হয়ে উপহার রেখে ফিরে এলেন তিনি। পরীক্ষার ফল পাওয়া গেল। ওগুলো ভালুকজাতীয় কোনও প্রাণীর মাথা এবং চামড়া। তবে প্রায় দুশো বছরের পুরনো। অতএব জিনিসগুলো সমেত ওঁদের যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তার কিছুকাল বাদে কুইন ভারত এবং নেপাল ভ্রমণে এলেন। সেবার কুইন বিদেশ ভ্রমণ সেরে ফিরে গিয়ে উপহার এবং ঘটনাটা জানতে পেরেছিলেন। তাই কাঠমণ্ডতে যাওয়ার আগে তিনি ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার অভিলাষ জানালেন। খবরটা অত ওপরের দুর্গম গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হল। সেই সময় আমরা দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম ওই গ্রামে। আমাদের সঙ্গেই ওঁরা যাত্রা করলেন। যেহেতু কুইন তাঁর স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে কাঠমণ্ডতে এসেছেন তাই তিনি তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিলেন। সে-সময় ভদ্রমহিলার সন্তান আসন্ন। অথচ পাহাড় ভেঙে নামতে তিনি পিছপা হননি। তার পরের ঘটনাটা আগেই বলেছি। স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করে ভদ্রলোক কুইনের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কুইন সব শুনে খুব অবাক হয়ে গিয়ে ঘোষণা করলেন, ওই শিশুর পাঁচ বছর বয়স হলেই তার সব দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নেবে। তাকে পড়াশুনো করিয়ে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হবে। অতএব ডাক্তার, আপনি যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে চান তা হলে কুইনের কাছে জানাতে পারেন। এসব গল্প তোমাকে শোনালাম অর্জুন, কারণ এক্ষেত্রে তোমার সাহায্য দরকার। ভানু জানিয়েছে তুমি সাহায্য করতে পারবে।

অর্জুন অবাক হয়ে তাকাল।

ডাক্তার বললেন, আমাদের গ্রামের মন্দির থেকে ওই পবিত্র বস্তু দুটো চুরি গিয়েছে। তার পরেই গ্রামের মানুষের মধ্যে নানান অশান্তি আরম্ভ হয়েছে। কেউ-কেউ প্রচার করছে সাহেবরা ওগুলোকে বিদেশে নিয়ে গিয়েছিল বলে চুরি হল। এটা বলার সময় কেউ মনে রাখছে না এর মধ্যে তিন দশকের ওপর সময় চলে গিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে মিস্টার জন বেইলি তাঁর দল নিয়ে ওখানে গেলে আতিথ্য পাবেন না। বরং উলটোটা হওয়ারই সম্ভাবনা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?

ডাক্তার হাসলেন, পুলিশ? মিস্টার অর্জুন, ওখান থেকে খুব কাছের পুলিশ স্টেশন অন্তত দেড়দিনের হাঁটা-পথ। গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই। খবর দিলেও কোনও পুলিশ সেখানে যাবে না। কারণ গিয়ে কিছুই করতে পারবে না।

কাউকে কি সন্দেহ করছেন?

না। তিরিশ বছর আগে কেউ কাঠমণ্ডতে আসত না। এখন অবস্থা বদলেছে। কিছু কিছু ছেলে এখানে আসা-যাওয়া করে। তারা লোভের ফাঁদে পা দিতে পারে। আমার জন্ম হওয়ার আগে থেকেই সার হিলারির দৌলতে সবাই জেনে গিয়েছে ওখানে ইয়েতির মাথা এবং চামড়া আছে। বিজ্ঞানীরা যতই বলুন ওগুলো নীল রঙের ভালুকের, কেউ-কেউ এখনও সেটা বিশ্বাস করেন না। ডাক্তার বললেন।

কিন্তু এগুলো চুরি করে এনে বিক্রি করবে কোথায়?

নেপালে যেমন পৃথিবীর সব দেশের জিনিস আসছে তেমনই বাইরেও যাচ্ছে। কিছু মনে করবেন না, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই বাজারটা কন্ট্রোল করছে। ডাক্তার বললেন, এসব আমার অনুমান। এমন হতে পারে যে চুরি করেছে সে এখন পর্যন্ত কাঠমণ্ডতে আনতে পারেনি জিনিসগুলো।

জন বললেন, লুক অর্জুন। আমরা এসেছি ওই নীল ভালুকের ছবি তুলতে। কিন্তু পাহাড়ের মানুষরা যদি বাধা দেয় তা হলে সেটা সম্ভব নয়। ভানু তোমার কথা আমাকে বলেছে। তোমার ওপর ওর খুব বিশ্বাস। তুমি যদি ওই হারানো ভালুকের মাথা আর চামড়া খুঁজে দিতে পারো তা হলে আমরা গ্রামবাসীদের সেটা ফেরত দিয়ে আসব। এই কারণেই যে আমরা যাচ্ছি সেটা এদের বুঝিয়ে বলব। তুমি আমার দলের সদস্য হয়ে ওই কারণেই যাচ্ছ। বুঝতে পারলে?

কিন্তু আমি যদি খুঁজে না পাই?

তুমি নাকি এখনও ব্যর্থ হওনি?

তার মানে এই নয় যে, কখনও হব না। জিনিসগুলো যদি দেশের বাইরে চলে গিয়ে থাকে তা হলে আমার কিছুই করার নেই।

লেটস ট্রাই। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? অ্যান্ড ওয়েল, ওগুলো যদি খুঁজে বের করতে পারো তা হলে আমি তোমাকে পাঁচ হাজার ইউ. এস. ডলার পারিশ্রমিক হিসেবে দেব। ডান? হাত বাড়ালেন জন।

হাত মেলাল অর্জুন। তারপর ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, চুরি কতদিন আগে হয়েছে? আপনি জানলেন কী করে?

ঠিক দশদিন আগে। গ্রাম থেকে লোক এসেছিল খবর দিতে। ডাক্তার বললেন, দশদিন আগে এক সকালে চুরি ধরা পড়ে।

তা হলে তো গ্রামের লোক এখানে আসার আগেই চোর পৌঁছে গেছে।

না। লোকটি রওনা হয়েছিল সেই দুপুরেই। পথে চার রাত ওকে বিভিন্ন গ্রামে কাটাতে হয়। ও খোঁজ নিয়ে দেখেছে গত এক সাল ওপর থেকে কেউ নামেনি। এইসব বরফজমা পাহাড়ি পথে রাতের বেলায় কোনও গ্রামে আশ্রয়

নিয়ে কেউ আসতে পারে না। তবে হ্যাঁ, পরে আসতে পারে। তার খোঁজ নেওয়া হয়নি।

যে লোকটি খবর দিতে এসেছিল সে এখানে আছে?

না। গ্রামে ফিরে গেছে।

লোকটার নাম কী?

উঘি।

কাঠমণ্ডুতে যারা কিউরিওর ব্যবসা করে, বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে, তাদের কাউকে চেনেন?

না। তবে নাম জানি। যেমন, হরিকিষেন রুংতা, শেঠ বাবুলাল আর এস, কে. গুপ্ত। এঁদের অন্য ব্যবসার সঙ্গে কাঠমন্ডুতে কিউরিওর দোকানও আছে।

এস. কে. গুপ্তা? নামটা উচ্চারণ করল অর্জুন।

হ্যাঁ। এরা খুব প্রতাপশালী মানুষ। আমার জগতের নয়।

আজ একজন এস, সে, গুপ্তা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। ওঁর মৃতদেহ পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। তিনি যদি ইনি হন তা হলে তো আপনি খবর পেতেনই। তাই না?

দাঁড়ান। আমি আজ লাঞ্চের পর ডিউটিতে এসেছি। এসেই আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। মিস্টার বেইলি নিউজিল্যান্ড থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁকে চুরির কথা ফ্যাক্স করে জানিয়ে দিই। তবু তিনি আসছেন বলে আমি একটু টেনশনে ছিলাম। ডাক্তার টেলিফোন তুললেন। স্পষ্ট ইংরেজিতে কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম আজ অ্যাকসিডেন্টে কেউ মারা গিয়েছে। বডি আইডেন্টিফাই হয়েছে? উত্তরটা শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, মাই গড! হ্যাঁ, একই লোক। যদি এটা সাধারণ অ্যাকসিডেন্ট হয় তা হলে অন্য কথা। নইলে আরও কিছু খুনের জন্যে আমাদের তৈরি থাকতে হবে।

গাড়িতে উঠে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা কবে রওনা হচ্ছি?

কাল সকালে। আজ কারগো ফ্লাইটে মালপত্র আসার কথা। আটজন শেরপাকে বুক করেছি। একটা হেলিকপটার দুবারে সবাইকে পৌঁছে দেবে। আমরা তোমার ব্যবস্থা যাতে গ্রামেই করা যায় সেই চেষ্টা করব। পাহাড়ে ওঠানামা করতে হবে না তোমাকে। জন বললেন।

অর্জুন চুপচাপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এস, কে, গুপ্তা যদি অপরাধ জগতের লোক হন তা হলে মানিকলালও একই গোত্রের। একথা নিশ্চয়ই ভানুদার জানা নেই। জানলে তিনি মানিকলালকে অনুরোধ করতেন না। এস, কে. গুপ্তা খুন হলেন কেন? ওই ইয়েতির মাথা নিয়ে গোলমাল?

গেস্ট হাউসে ফিরে জন নিজের ঘরে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, সন্ধে সাতটার সময় সবাই আমার ওখানে আসছে। তুমিও এসো। জুতো, পোশাক দেখে নিয়ে যাবে। নিজস্ব জিনিসপত্র যতটা সম্ভব কম সঙ্গে নেবে। বাই।

পাঁচ হাজার ডলার! তার মানে দুলক্ষ টাকা! পাওয়ার কোনও চান্স নেই। অথচ সামনে প্রলোভন রয়েছে। কী কাণ্ড!

ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে অর্জুন বাক্সটার দিকে তাকাল। কী আছে ওর মধ্যে? গাঁজা, চরস, অথবা অন্য কোনও ড্রাগ? সঙ্গে-সঙ্গে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার। এয়ারপোর্টে যদি কাস্টমস তাকে বাক্স খুলতে বলত এবং ওইসব নিষিদ্ধ জিনিস পেত তা হলে কত বছর কাঠমণ্ডুর জেলে কাটাতে হত তা ঈশ্বরই জানেন। ওটা যে তার বাক্স নয় একথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারত না সে। এই কারণেই বলা হয়, কখনও অজানা বা অচেনা লোকের দেওয়া জিনিস প্যাকেট খুলে না দেখে সঙ্গে নিয়ে যেয়ো না।

বাক্সটা খুলে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অর্জুনের। তার পরেই মনে হল মানিকলাল জানে সে ভানুদার লোক। জেনেশুনে সে বিপদে পড়ে এমন জিনিস কি সঙ্গে দেবে? এমন হতে পারে ভানুদার লোক বলেই সে এস, কে, গুপ্তাকে নির্দেশ দিয়েছিল অন্য কাউকে না পাঠিয়ে নিজে এয়ারপোর্টে গিয়ে যেন অর্জুনকে রিসিভ করে। হয়তো তাই। বাক্সটা খুলে যদি দেখা যায় কোনও নিরীহ জিনিস রয়েছে তা হলে লজ্জার শেষ থাকবে না। ওটা এমনভাবে প্যাক করা যে, খুললেই বোঝা যাবে।

অর্জুন উঠল। টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুলে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই নামটা পেয়ে গেল, শেঠ বাবুলাল অ্যান্ড সন্স। একবার গৈলে হয় লোকটার কাছে। তার মন বলছে কথা পাড়লে কিছু কাজের কথা কানে আসবে।

এখন প্রায় বিকেল। এই শহরে বোধহয় তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামে। একটা জ্যাকেট চড়িয়ে অর্জুন বেরিয়ে এল। আসার আগে পিসবোর্ডের বাক্সটাকে তার সুটকেসে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করৈ রাখল।

লবি পেরিয়ে বাইরে বের হতেই সে শুনতে পেল, হ্যালো!

সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল লাঞ্চ টেবিলের দুই মহিলার একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। মহিলার পরনে নীল জিন্স আর সাদা শার্ট। কাঁধে ব্যাগ। জন বলেছিলেন, ইনি ক্যামেরায় ছবি তুলবেন।

মহিলা কাছে আসতেই অর্জুন বলল, হ্যালো। কেমন আছেন?

ফাইন। যে-কোনও নতুন জায়গায় প্রথম দিন আমার ভাল লাগে। ঘরে বসে বোর হচ্ছিলাম। জুডি, ডাক্তার, ওষুধের লিস্ট মেলাচ্ছে। আমি ডানা।

ডায়না?

ও নো। ডানা। কোথায় যাচ্ছেন?

এই একটু ঘুরে বেড়াতে। কাঠমণ্ডুতে আমি আজ প্রথম এসেছি।

তাই? চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক। আপত্তি নেই তো?

না না। চলুন।

অর্জুনের মনে হল এটা ভাল হল। সঙ্গে বিদেশিনী থাকলে তাকেও টুরিস্ট ছাড়া কিছু ভাববে না এখানকার মানুষ। ওরা ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান। বলেই তার খেয়াল হল, সরি! আমি ক্যামেরাম্যান বলে ফেললাম।

দ্যাটস ওকে! এইসব ব্যাপার পুরুষদের একচেটিয়া ছিল বলে শব্দগুলোর দখল তারা নিয়ে নিয়েছে। হ্যাঁ। আমি তিনটে ফিল্মে স্বাধীনভাবে কাজ করেছি। আপনার মতোই আমি পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিইনি। কী হবে জানি না। তবে ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর। আপনি তো প্রাইভেট ডিটেকটিভ?

না। অর্জুন মাথা নাড়ল।

না মানে? ডানা অবাক!

আমি সত্যান্বেষী। সত্য অন্বেষণ করাই আমার কাজ।

আই সি। কিন্তু পার্থক্যটা কী?

পার্থক্য আছে। একজন স্টিল ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাম্যানের পার্থক্য আছে। আবার ফিল্মের ক্যামেরাম্যানরাও আছেন। তাই না?

ও আচ্ছা। ডানা বলল, জন যখন বলল একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর দলের সঙ্গে যাচ্ছে, তখন ভেবেছিলাম খুব ভারী চেহারার বয়স্ক মানুষের কথা। আপনাকে দেখে কিন্তু মনেই হয় না।

অর্জুন এত জোরে হেসে উঠল যে, ডানা কথা শেষ না করে হাসিতে যোগ দিল। তারপর বলল, আমি কিন্তু একই বেটা ক্যামেরায় ছবি তুলব।

সেটা কী?

হাইসেন্সেটিভ ভিডিও ক্যামেরা।

অর্জুন একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল, চলুন, ট্যাক্সিতে শহরটা চক্কর দিই। তা হলে তাড়াতাড়ি সব দেখা হয়ে যাবে।

ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করলে ডানা বলল, ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে এলাম না বলে খুব আফসোস হচ্ছে। শহরটা সত্যি সুন্দর।

অর্জুন হিন্দিতে ড্রাইভারকে রাস্তাটার নাম বলল।

ডানা জিজ্ঞেস করল, আপনি এখানকার ভাষা জানেন?

এখানে ভারতীয় ভাষাগুলো চলে। দুদেশের কিছু মানুষ একই ভাষায় কথা বলে।

সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম দেখল অর্জুন। তারপরই শেঠ বাবুলাল অ্যান্ড সন্স দোকানটা চোখে পড়ল।

ট্যাক্সি থামাতে বলল সে। তারপর ডানাকে বলল, চলুন নামি। এই দোকানটার কথা আমি শুনেছি। কিউরিও শপ। বিখ্যাত দোকান!

ইজ ইট? ডানা উৎসাহী হল।

দোকানটার বাইরের সাজগোজ বলে দিচ্ছে বিদেশি খদ্দেরদের আকর্ষণ করার চেষ্টা আছে। ওরা ভেতরে ঢুকল। দরজায় দুজন দ্বাররক্ষী তাদের সম্ভাষণ করল। বিরাট হলঘর। তাতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বস্তু শিল্পসম্মতভাবে সাজানো রয়েছে। একজন সুন্দরী নেপালি এগিয়ে এল, গুড আফটারনুন। আমি কি

আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

ডানা বলল, ধন্যবাদ। আমরা কি একটু ঘুরে দেখতে পারি?

নিশ্চয়ই। কিন্তু কোন ব্যাপারে আপনাদের আগ্রহ যদি বলেন…।

অর্জুন বলল, পাহাড়ের দেশে এসেছি। পাহাড়ের যে-কোনও জিনিস..!

আসুন আমার সঙ্গে।

ওরা সুন্দরীকে অনুসরণ করে যে ঘরটিতে পৌঁছল সেখানে কাচের বাক্সে সাজানো রয়েছে মুগ্ধ হওয়ার মতো সামগ্রী। সুন্দরী বলল, এই যে অ্যাশট্রে বলে যা মনে হচ্ছে এটা কিন্তু প্রকৃতি করেছে। আট হাজার ফুট ওপরে এক ঝরনার মধ্যে পড়ে ছিল সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে। পাথরটির বিশেষত্ব হল মাঝখানের গর্তটা কালো, কিন্তু এর চারপাশে চারটে রঙের সমন্বয়।

ডানা জিজ্ঞেস করল, কত দাম?

সুন্দরী একগাল হাসল, মাত্র দুহাজার পাঁচশো ডলার।

ডানা চোখ বড় করল।

সুন্দরী বলল, যে অভিযাত্রী এটিকে সংগ্রহ করে এনেছেন তার নাম শুনলে অবাক হয়ে যাবেন এবং এটিকে নিজের সংগ্রহে রাখতে ওই দামকে খুব অল্পই মনে হবে আপনাদের। অভিযাত্রীর নাম তেনজিং নোরগে।

অর্জুন বলল, দেশে ফিরে গিয়ে পাঁচজনকে এ কথা বলে কতখানি বিশ্বাস করাতে পারব জানি না। আচ্ছা, এমন কোনও জিনিস নেই, এই ধরুন ইয়েতির কোনও অঙ্গ বা তাদের ব্যবহৃত কোনও জিনিস পেতে পারি কি?

ইয়েতি? সুন্দরীর চোখ স্থির।

হ্যাঁ।

সরি। আমি এব্যাপারে আপনাদের কোনও সাহায্য করতে পারছি না।

আচ্ছা, এ কথা তো বলতে পারবেন, তেমন কিছু কি খুব দামি হবে?

অবশ্যই।

অর্জুন ডানাকে বলল, দেখুন, তেমন কোনও জিনিস পেয়ে যান কিনা। পেলে বিক্রি করলে বড়লোক হয়ে যাবেন।

ডানা হাসল, কিছু বলল না।

সুন্দরী বলল, কাঠমণ্ডতে আপনারা পাবেন না।

অর্জুন বলল, না, না। আমরা কাল এক অভিযানে রওনা হচ্ছি। ওই যেসব জায়গা ইয়েতিদের এলাকা বলে বলা হয়ে থাকে সেখানেই যাব।

অর্জুন ডানাকে নিয়ে এগোচ্ছিল, সুন্দরী পাশে চলে এল, এক্সকিউজ মি। আপনারা কোথায় উঠেছেন?

ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউস।

আপনার নামটা জানতে পারি?

অর্জুন।
সন্ধে সাতটায় জনের ঘরে সবাই চলে এল। অর্জুনকে নিয়ে আটজন। এই ঘরটি বেশ বড়। বেডরুম ওপাশে। শীতবস্ত্র হিসেবে অর্জুনকে যা দেওয়া হল তার ওজন কম নয়! কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়ার ব্যাগ, যাতে সমস্ত সম্পত্তি থাকবে এবং নিজেকেই বইতে হবে। বরফের ওপর হাঁটার জুতো, চশমা, স্টিক, গ্লাভস। সবই ঠিকঠাক মিলে গেল শরীরের সঙ্গে। জন বললেন, প্রত্যেকে ব্যক্তিগত জিনিস যা ওপরে নিয়ে যাচ্ছি না তা এই ঘরে রেখে যাব। এনি কোশ্চেন?

ডানা জিজ্ঞেস করল, আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। এসব বহন করে ক্যামেরা স্ট্যান্ড, ফিল্ম নিয়ে কি আমি হাঁটতে পারব?

সরি ডানা। তোমাকে বলা হয়নি, একজন লোক ওগুলো ভোমার হয়ে বইবে। সবসময় তোমার পাশে-পাশে সে থাকবে। যখনই প্রয়োজন হবে তুমি ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারবে। ওয়েল, আজ আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার করে নেব। কাল সকাল আটটায় সবাই যেন লবিতে চলে আসি। জন বললেন।

ডিনার শেষ করে ঘরে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল অর্জুন। এই অভিযানে জন সঙ্গে কোনও অস্ত্র নিচ্ছেন কিনা জিজ্ঞেস করেনি সে। নিরাপত্তার ব্যাপারটা কি একটুও ভাবছেন না তিনি। অর্জুন সঙ্গে কোনও অস্ত্র আনেনি। বিদেশে অস্ত্র এনে কী বিপদ হবে কে জানে! এখন ঘটনা যেদিকে গড়াল তাতে মনে হচ্ছে সঙ্গে কিছু থাকলে ভাল হত। সুটকেসটাকে রেখে যেতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ল সেই বাক্সটার কথা। বাক্সটাও সুটকেসে থেকে যাবে।

এইসময় টেলিফোন বাজল। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল অর্জুন, হ্যালো।

একটি পুরুষকণ্ঠ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি অর্জুন?

হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?

আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার সঙ্গে বসে কথা বলা যেতে পারে?

কী ব্যাপারে বলুন তো?

সেটা টেলিফোনে না বলাই ভাল।

আপনি গেস্ট হাউসের লাউঞ্জে আসতে পারেন?

না। আমি যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনার ঘরে পৌঁছে যাই তা হলে কি আপনার আপত্তি হবে?

আসুন।

রিসিভার নামিয়ে রেখে অর্জুন হাসল। শেষপর্যন্ত মানিকলাল তাকে খুঁজে বের করেছে। মানিকলের পক্ষে আজ কাঠমণ্ডতে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই, কারণ একমাত্র ফ্লাইটে সে চলে এসেছে। তা হলে এস, কে, গুপ্তার মৃত্যুসংবাদ পেয়েই মানিকাল সুদূর ভদ্রপুর থেকে কাঠমণ্ডর কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছে তাকে খুঁজে বের করতে। এর অর্থ হল, বাক্সটায় খুব দামি কিছু রয়েছে। যে-ই আসুক, মানিকলাল অথবা এস. কে. গুপ্তার লিখিত নির্দেশ সঙ্গে না নিয়ে এলে সে বাক্সটা হস্তান্তর করছে না। দ্বিতীয়টা অবশ্য সম্ভব নয়। এস, কে, গুপ্তা লেখার সুযোগ আর কখনওই পাবেন না।

দরজায় শব্দ হল। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলতেই এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে পঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন, অর্জুন?

ইয়েস?

ভদ্রলোক চট করে হিন্দিতে চলে এলেন, আমার মনে হচ্ছে আপনি যখন ভারতীয় তখন আমরা হিন্দিতেই কথা বলতে পারি। ভেতরে আসব?

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক চেয়ার টেনে বসলেন, আমার নাম প্রবীণলাল। আজ বিকেলে আপনারা আমার দোকানে দয়া করে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।

আপনার দোকানে?

আজ্ঞে। শেঠ বাবুলাল অ্যান্ড সন্স আমারই দোকান। শেঠ বাবুলাল আমার বাবা। তিনি গত হয়েছেন বছরপাঁচেক হল। কিন্তু এখানকার মানুষের মুখে তিনি এখনও বেঁচে আছেন। আমি যা কিছু করছি সবই তাঁর আশীর্বাদে।

ভদ্রলোক দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে পিতৃদেবকে শ্রদ্ধা জানালেন।

অর্জুন কল্পনাই করেনি তার খেলাচ্ছলে ঘুরে আসা এতটা কার্যকর হবে। সে গম্ভীর গলায় বলল, বলুন।

আমার ছোট্ট দোকান আপনি দেখে এসেছেন। এখানেই জন্ম, কর্ম আমার। কাঠমণ্ডুতে কোথায় কী হচ্ছে, কী পাওয়া যাচ্ছে তার খবর রাখতে হয় এই ব্যবসা বানাতে গেলে। মিস্টার জন বেইলির নেতৃত্বে একটা অভিযান হচ্ছে এই খবরটা জানতাম। এরকম তো কতই হয়! মাথা ঘামাইনি তাই। আপনি চলে আসার পর খবর নিয়ে জানলাম অভিযানটা হচ্ছে ইয়েতিদের ছবি তুলতে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন হিলারিসাহেব পাহাড় থেকে ঘুরে এসে বলেছিলেন ইয়েতি বলে কিছু নেই। নীল রঙের একধরনের ভালুককেই লোকে ইয়েতি বলে ভুল করছে। কিন্তু একথা পাহাড়ের মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে ইয়েতি আছে। আপনিও তাই মনে করেন জেনে ভাল লাগল। প্রবীণলাল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরলেন।

অর্জুন মাথা নেড়ে না বলে, কী করে মনে হল?

আরে, ইয়েতি আছে বিশ্বাস না করলে আপনি দোকানে খোঁজ করবেন কেন? প্রবীণলাল বললেন, এই দলে আপনিই একমাত্র ভারতীয়। আরে আমিও তাই। এখানে পড়ে আছি পেটের দায়ে। আপনার সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চাই।

কীরকম?

যদি সত্যি ইয়েতির কোনও নিদর্শন খুঁজে পান তা হলে আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিক্রি করবেন না। দামের জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না।

প্রস্তাবটা আপনি আমাদের নেতা জনসাহেবকে দিচ্ছেন না কেন?

সাহেবদের আমি বিশ্বাস করি না।

কিন্তু আমি দলের সঙ্গে যাচ্ছি। নেতা যা বলবেন তাই করতে হবে। আপনি বলছেন ওগুলোর ভাল দাম হবে। তা হলে লোক পাঠিয়ে নিজেরাই নিয়ে আসছেন না কেন?

সম্ভব না। নেপাল সরকারের অনুমতি ছাড়া ওখানে যাওয়া যায় না।

কিন্তু বরফের ওপরের গ্রাম থেকে লোকজন এখানে আসে বলে শুনেছি।

ওখানকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে ওই আইন চালু নেই। আরে মশাই, সেই চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়। কিন্তু কাজ হয়নি। আর আপনি যদি সাহায্য করতে চান তা হলে নেতাকে না জানালেই হল।

এখন পর্যন্ত কেউ আনতে পারেনি?

না। বাজারে একটা খবর চালু হয়েছে যে, ইয়েতির মাথা নাকি কাঠমণ্ডুতে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি না। মাথা নাড়লেন প্রবীণলাল।

আর কেউ কি এসবের ব্যবসা করেন এখানে? বলেই যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে অর্জুন বলল, হ্যাঁ, কী নাম যেন, এস, কে, গুপ্তা, তাই না?

আচমকা প্রবীণলালের চোখ ছোট হয়ে গেল, ওকে আপনি চেনেন?

না। টিভিতে নাম শুনলাম। অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন। তখন পরিচয় দেওয়ার সময় বলা হল উনি কিউরিও নিয়ে ব্যবসা করতেন। অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল অর্জুন।

প্রবীণলালের টানটান মুখ আস্তে-আস্তে সহজ হল। হাসি ফুটল মুখে। মাথা নেড়ে বললেন, তাই বলুন। আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আরে মশাই, অন্যায় করলে ভগবান ঠিক শাস্তি দিয়ে দেন।

ওকে আপনি চিনতেন?

বিলক্ষণ। কেউ মারা গেলে দুনাম করতে নেই, কিন্তু যা সত্যি তা চিরকালই সত্যি। হিটলার যে খুনি ছিলেন তা মারা গেছেন বলে কি বলব না? ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার ছিল মশাই। ওই ইয়েতির মাথার গল্পটা ওই চালু করেছিল। যাক গে, আপনার সঙ্গে সব কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত। উঠে দাঁড়ালেন প্রবীণলাল। তারপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে সামনে ধরলেন, এটা নিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করুন। এটা অ্যাডভান্স।

কী এটা?

সামান্য টাকা। রাস্তায় খরচ করবেন।

আপনি হয়তো জানেন না আমরা এখান থেকে হেলিকপ্টারে যাচ্ছি। যেখানে নামব সেখানে বরফ আর ফাঁকা পাহাড়। মানুষ যেখানে হাতে গোনা। সেখানে দোকান কোথায় পাব খরচ করার! ইয়েতিরা নিশ্চয়ই দোকান খোলেনি? অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আপনাকে তো আগেই বলেছি আমাদের দলনেতার সঙ্গে কথা বলতে। ঠিক আছে, যদি ইয়েতিদের কিছু খুঁজে পাই তা হলে কাঠমণ্ডুতে ফিরে আপনাকে ফোন করব। আপনার সঙ্গে কার্ড আছে?

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে পার্স থেকে কার্ড বের করে দিলেন। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কয়েক সেকেন্ড বাদে অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এল। ওপর থেকে দেখতে পেল প্রবীণলাল হেঁটে গাড়িতে উঠলেন। দুজন লোক গাড়ির সামনের সিটে উঠে পড়ল। তার মানে ভদ্রলোক দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। একজন কিউরিও ব্যবসায়ীর দেহরক্ষীর কখন প্রয়োজন হয়?

সকালে জন বেইলির ঘরে সবাই জিনিসপত্র রাখার পর তিনি একটা ম্যাপ দেখিয়ে বোঝাতে লাগলেন ঠিক কোন জায়গায় আজ হেলিকপটার নামছে। দলের অন্য সবাই এর আগেই মাপের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা একবার নজর বুলিয়ে মাথা নেড়ে সরে যাচ্ছিলেন। এধরনের ম্যাপ অর্জুন আগে কখনও দ্যাখেনি। তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। পাশে দাঁড়ানো ডানা যখন হেসে বলল, ম্যাপ দেখে আমি কী করব। আপনি যখন যেমন বলবেন তাই করব।

জন মাথা নাড়লেন, নো। নট অ্যাট অল। ধরো, তুমি ওখানে গিয়ে পথ হারালে। কাউকে খুঁজে পাচ্ছ না। তখন এই ম্যাপ, কম্পাস তোমার জীবন বাঁচাবে। বুঝলে মাই লিটল লেডি!

পর্বত অভিযানের কাহিনী অনেক পড়েছে অর্জুন। পাহাড়ে ওঠার আগে যে প্রস্তুতি নিতে হয় তা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রচুর মালপত্র, খাবার, এলাহি ব্যাপার। কুলির মাথায় চাপিয়ে সেসব নিয়ে আসা হয় বেসক্যাম্পে। সেখান থেকে মূল অভিযান শুরু হয়। কুলিরা ফিরে যায় আর শেরপারা দায়িত্ব নেয়। তখন যে-যার জিনিস বহন করে। রীতিমতো গলদঘর্ম হওয়ার ব্যাপার।

এয়ারপোর্টের যে প্রান্তে হেলিকপটার দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে কাঠের বাক্সের পাহাড় দেখতে পেল অর্জুন। বাক্সের ওপর জিনিসগুলোর নাম লেখা। জন পাইলটের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আটজন শেরপা আর আটজন সদস্য। এখন সবাই হালকা পোশাক পরে আছে। অর্জুন লক্ষ করল শেরপারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। নিউজিল্যান্ডের মানুষগুলো গম্ভীর মুখে হেলিকপটার দেখছে। ডানাকে বাদ দিলে এঁদের প্রত্যেকেই পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন। অর্জুন জুডির দিকে তাকাল। এই মহিলা ডাক্তার। সঙ্গে একটা বড় চামড়ার ব্যাগ আর রুকস্যাক নিয়ে এসেছেন। ইনিও বোধহয় কথা কম বলেন। জন ফিরে এলেন, তিনটে ট্রিপ দিতে হবে। প্রথম ট্রিপে জিনিসপত্রের সঙ্গে আটজন যাবে। জন শেরপা আর আমাদের দুজন। তিনি একজন স্বাস্থ্যবান সদস্যকে ডেকে নিলেন। হেলিকপটারের পেছন দিকটায় অনেক জিনিস ধরল। জন বাকি সাতজনকে নিয়ে উড়ে গেলেন।

এখন সকাল সাড়ে আটটা। সাড়ে নটার আগে হেলিকপটারের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। সবাই ফিরে গেল এয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর ভেতর। যে -দুজন শেরপা থেকে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে ভাব জমাল অর্জুন। এরা দুজনেই এভারেস্টের অ্যাডভান্স ক্যাম্প পর্যন্ত উঠেছে। পিকে ওঠার সুযোগ এখনও পায়নি। ওরা আক্ষেপ করে বলল মাঝখানে যেমন ঘন-ঘন অভিযান হত এখন তেমন হয় না। অভিযান হলেই তাদের রোজগার বেড়ে যায়।

অর্জুন ওদের কফি খাওয়াচ্ছিল। ডানা এসে যোগ দিল। অর্জুন বলল, দ্যাখো ভাই, আমি এতকাল সমান জমিতে হেঁটে এসেছি। পাহাড়ে চড়ার কোনও অভিজ্ঞতা আমার নেই। তোমরা আমাকে সাহায্য কোরো।

একজন শেরপা মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করল, সাহেব কি সত্যি সাহায্য চাইছেন?

সত্যি। একশোবার সত্যি।

তা হলে আপনার ভার আমরা নিলাম। তরুণ শেরপাটি হাসল।

হেলিকপটারে চেপে পায়ের তলায় পাইনগাছের মাথা দেখতে ভারী ভাল লাগছিল। দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে গাছগাছালি। এতদিন যেসব প্লেনে অর্জুন উঠেছে তারা উড়ে গেছে তিরিশ হাজার বা তার বেশি ফুট উঁচু দিয়ে। নীচে তাকালে শুধু মেঘের এবড়ো-খেবড়ো মাঠ। মাঝে-মাঝে সেখানে কুয়ো এবং পুকুর দেখা যায়। কিন্তু এইভাবে প্রায় গাছের মাথা ছুঁয়ে পাহাড়ের ঔদ্ধত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কখনওই হয়নি। এইসব জায়গা দিয়ে যদি হেঁটে যেতে হত তা হলে পাহাড়ের পর পাহাড় ভাঙতে হত। অর্জুন মাথা নাড়ল।

পেছন থেকে ডানা জিজ্ঞেস করল, এনি প্রব্লেম?

ওই পাহাড়টায় একটাও গাছ নেই। শুধুই পাথর।

ডানা বলল, আমাদের ভো উঠতে হচ্ছে না।

পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। মাঝে-মাঝে এক-একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। চাষের খেত। পাহাড়ের ঢালু জমিতে ফসল ফলাবার চেষ্টা হয়েছে। আর তারপরেই হেলিকপ্টার যেই ঘুরে গেল অমনই বরফ নজরে এল। সামনের পাহাড়টা অন্যদের চেয়ে বেশ উঁচু। তার গায়ে ছোপ-ছোপ বরফ লেগে রয়েছে। সেটাকে পাশ কাটাতেই বরফের পৃথিবী শুরু হয়ে গেল।

হেলিকপটারে ওঠার আগে যতটা সম্ভব শীতের পোশাক পরে নিয়েছিল সবাই। এখন চোখে বড় গগল্স উঠল। ওপর থেকে বরফ দেখতে কী মায়াময় লাগে। ওপর থেকেই ওরা জনসাহেবদের দেখতে পেল। প্রথম ফ্লাইটে নিয়ে আসা জিনিসপত্রগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। জনসাহেব হাতে একটা পতাকা নিয়ে নাড়ছেন। পাইলটকে নির্দেশ দিচ্ছেন কোথায় নামতে হবে। যে-কোনও জায়গায় হেলিকপটার নামানো যায় না। যে বরফকে ওপর থেকে শক্ত বলে মনে হয়, সামান্য চাপ পড়তেই সেটা ফাঁক হয়ে যাবে। অর্জুন পরে শুনেছিল আগের হেলিকপটার থেকে দড়ির সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জন এবং শেরপারা তাই বেয়ে নীচে নেমে অনেক পরীক্ষার পর স্থির করেছিল জায়গাটা, যেখানে হেলিকপটার নামতে পারে।

হেলিকপটার স্থির হতেই ওরা নেমে এল। জিনিসপত্র নামানো হলে হেলিকপটার আবার আর-একটা ট্রিপ দেওয়ার জন্যে ফিরে এল। পরনে পর্বতারোহীর পোশাক, চোখে চশমা, মাথায় টুপি। অর্জুনের মনে হল এখানে তেমন শীত নেই। বরফের ওপর দাঁড়িয়েও শরীর কনকন করছে না। সে দেখল শেরপারা অনেক হালকা শীতবস্ত্র পরে কাজ করছে। সমস্ত জিনিসপত্র পাহাড়ের গায়ে নিয়ে যাওয়ার পর শেরপাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁবু টাঙবার হুকুম দিলেন জনসাহেব। পাহাড়ের আড়াল বাতাস আটকে রেখেছে। শেরপাদের সঙ্গে সাহেবদের হাত লাগাতে দেখে অর্জুন এগিয়ে গেল। কিন্তু জনসাহেব হাত নেড়ে নিষেধ করলেন, তোমাকে ওসব করতে হবে না।

কেন? অর্জুন জানতে চাইল।

কারণ, তুমি জানো না কীভাবে টেন্ট টাঙাতে হয়। তাই না?

কথাটা সত্যি। কিন্তু মেয়েরা ছাড়া সবাই যখন পরিশ্রম করছে তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগে। অর্জুন দেখল, ডানা একটা বাক্স খুলে ফেলেছে এর মধ্যে। সেখানে ছবি তোলার নানান সরঞ্জাম। ক্যামেরা ডানা হাতছাড়া করেনি কখনও। দেখা গেল আর একটি ক্যামেরাকে প্রচুর যত্নে বাক্সে রাখা হয়েছে। বাক্স পড়ে গেলে অথবা ধাক্কা লাগলেও যেন ক্যামেরার কোনও ক্ষতি না হয়, তার ব্যবস্থা রয়েছে।

ক্যামেরায় ক্যাসেট ঢুকিয়ে ফোকাস ঠিক করছিল না। তারপর অর্জুনকে ক্যামেরায় ধরল। অর্জুন হেসে বলল, ছবি দেখে কেউ বুঝতে পারবে না কার ছবি তোলা হয়েছে। সে টুপি আর গগল্স দেখাল। ডানা চিৎকার করে বলল, একটু হাঁটো। অর্জুন হাঁটল। তার ছবি তুলে ডানা কাছে এসে বলল, এবার যারা তোমাকে চেনে তারা বুঝতে পারবে। প্রত্যেক মানুষের াঁটার ভঙ্গিটা তার নিজস্ব।

আজকের দিনটা জিনিসপত্র গোছাতেই গেল। শেরপাদের জন্যে দুটো বড় তাঁবু, আর দলের সদস্যদের জন্যে চারটে। মেয়ে দুজন এক তাঁবুতে, জনের সঙ্গে অর্জুন। পায়ের তলায় বরফের ওপর নাইলনের কার্পেট। একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, দুটো হ্যামক, অর্জুন নামকরণ করল ঝুলন্ত বিছানা। এ ছাড়া রান্না, স্টোর এবং বেশ কিছুটা দূরে ল্যাট্রিন এবং টয়লেটের জন্যে আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা হল। টিনের খাবারে হাত না দিয়ে প্রথম দিন শেরপাদের রান্না করা খিচুড়ি আর ডিমভাজা দিয়ে লাঞ্চ সারা হল।

লাঞ্চের পর জনসাহেব বললেন, এখান থেকে খুব কাছে যে গ্রামটা সেটা মাত্র কুড়ি মিনিটের রাস্তা। হেলিকপ্টার আসা-যাওয়া করছে; আমরা এসেছি তবু কেউ খোঁজখবর করতে এল না। বুঝতেই পারছ আমাদের আপ্যায়ন করার কোনও ইচ্ছে ওদের নেই। এখন শত্রুতা করলে কতটা করবে সেটা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। তাই কখনওই ক্যাম্প ফাঁকা করে আমরা বেরিয়ে যাব না। অন্তত দুজন পাহারায় থেকে যাবে।

একজন সদস্য জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি আত্মরক্ষার জন্যে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারি?

জন মাথা নাড়লেন, না। কখনওই নয়। কোনও মানুষের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না। শুধু হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে ওগুলোর প্রয়োজন।

অধিনায়কের এই আদেশ খুবই পছন্দ হল অর্জুনের। কিন্তু সেইসঙ্গে অস্বস্তিও হল। এঁরা সবাই নিউজিল্যান্ডের মানুষ। নিশ্চয়ই কলকাতা বা কাঠমন্ডু থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেননি। অথচ বোঝাই যাচ্ছে এঁদের সঙ্গে অস্ত্র আছে। কী করে নিয়ে এলেন। বিদেশ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসা কি বেআইনি নয়?

বিকেলের মধ্যে জায়গাটাকে একটা ছোট্ট বসতি বলে মনে হচ্ছিল। শেরপারা বেরিয়েছিল খোঁজখবর নিতে। তারা ফিরে এসে জানাল আশপাশের বরফ বেশ শক্ত হয়ে আছে। হাতে লাঠি নিয়ে সহজেই গ্রামের দিকটায় যাওয়া যেতে পারে। আর এই খোঁজাখুঁজির সময় তুষার-ভালুকের পায়ের চিহ্ন তাদের চোখে পড়েনি।

জনসাহেব এতে হতাশ হলেন না। সবাইকে নির্দেশ দিলেন ভোর ছটার মধ্যে তৈরি হতে।

সন্ধে নামল ঝুপ করে। সূর্য ড়ুবে গেলেও একধরনের আলো নেতিয়ে রইল বরফের ওপর। আর আকাশটা কী চমৎকার নীলে ভরে গেল। এমন পরিষ্কার আকাশ কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ল না অর্জুনের। লোকালয়ে মানুষের তৈরি নোংরা ধোঁয়া যে আকাশের চেহারা কতটা বদলে দিতে পারে তা এখানে এলেই বোঝা যায়। ঝটপট খাওয়াদাওয়া সেরে যে-যার তাঁবুতে ঢুকে গেল।

জনসাহেব টেবিলে একটা ব্যাটারিচালিত আলো জ্বেলে লেখা শুরু করলেন! ঝুলন্ত বিছানায় মানিয়ে নিতে সময় লাগল অর্জুনের। সন্ধের পর ঠাণ্ডা বাড়তে শুরু করেছে। ভারী শীতবস্ত্র খুলে রেখে পুলওভার পরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অর্জুন। শরীর গরম হতে একটু সময় লাগল।

লিখতে লিখতে জনসাহেব মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আলো জ্বললে ঘুমোতে অসুবিধে হবে না তো?

না, না। তবে এই সময়ে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই তো, তাই ঘুম কখন আসবে জানি না। শুয়ে-শুয়ে অর্জুন কথা বলল।

অভ্যেস। অভ্যেস হয়ে গেলেই অসুবিধে হবে না। জনসাহেব বললেন, ওয়েল, তুমি নিশ্চয়ই চিন্তা করছ কীভাবে কাজ শুরু করবে!

চিন্তা করার মতো কিছু পাইনি।

তার মানে?

আজ এখানে আসার পর চারপাশে শুধু বরফ ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। এই বরফের ভেতর যদি কেউ লুকিয়ে রেখে থাকে জিনিসগুলো, তা হলে সূত্র

পেলে খুঁজে বের করা অসম্ভব।

ঠিক কথা। তা হলে কাল কীভাবে শুরু করবে?

শেরপাদের কাছে জেনেছি তিনটে গ্রাম আছে আমাদের কাছাকাছি। যে-গ্রামের মন্দির থেকে ওগুলো চুরি গিয়েছে, সেটি খুব কাছেই। আমি প্রথমে ওখানেই যাব। তারপর দেখা যাক।

কিন্তু মনে রেখো ওরা আমাদের এখন বন্ধু বলে ভাবছে না।

দেখা যাক। অর্জুন কথাটা বলতেই জনসাহেব আবার লেখার দিকে মন দিতে চাইলেন। অর্জুন সেটা লক্ষ করে একটু সময় নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, মিস্টার বেইলি, আপনি এই দলের নেতা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

জনসাহেব মাথা নাড়লেন, শিওর।

দলের কারকার সঙ্গে অস্ত্র আছে?

অস্ত্র?

হ্যাঁ। তখন আপনি নিষেধ করলেন সেগুলো ব্যবহার করতে।

ও, হ্যাঁ। অভিযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যে আমরা একটা শক্তিশালী রিভলভার আর রাইফেল এনেছি। ভারত এবং নেপালের গভর্নমেন্টের অনুমতি নিয়েই ওই দুটো অস্ত্র আনা হয়েছে।

ওগুলো কোথায় আছে?

এখানে। এই তাঁবুতে। ওই বাক্সে। জনসাহেব অবাক হলেন, কেন বলো তো?

আপনি নিশ্চিত, অন্য সদস্যরা কেউ নিজের অস্ত্র নিয়ে আসেননি?

জনসাহেব বললেন, তুমি ভুলে যাচ্ছ, কাঠমন্ডুতে হয়নি, কিন্তু কলকাতায় আমাদের কাস্ট করতে হয়েছিল। ওখানকার সিকিউরিটি আমাদের ভালভাবে চেক করেছে। কেউ যদি সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে আসতে চেষ্টা করে তা হলে তখনই তার ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। তাই না?

অর্জুন আর কথা বাড়াল। কিন্তু তার অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্ত্র তো ইচ্ছে করলে কাঠমন্ডু থেকেও কেনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, যারা শুধু ভালুকের ছবি তুলতে এসেছে তারা অস্ত্র কেন কিনবে? কিন্তু যে লোকটি জনসাহেবকে প্রশ্ন করেছিল, তার ভাবভঙ্গি ভাল লাগেনি অর্জুনের।

একসময় আলো নিভিয়ে জনসাহেব তাঁর ঝুলন্ত বিছানায় উঠে পড়লেন। পৃথিবীর কোথাও কোনও শব্দ নেই। তারপর হঠাৎই শব্দটা শুরু হল। নেই-টাকে মিথ্যে করতে সে যেন জানান দিল। প্রথমে শব্দটা কী তা বুঝতে পারছিল না অর্জুন। তারপর আওয়াজ বাড়তেই বুঝতে পারল, হাওয়া বইছে। সোঁ-সোঁ শব্দটা যেন ছুটে চলেছে পাগলের মতো। অথচ তাদের তাঁবুতে কোনও কম্পন নেই। অর্থাৎ পাহাড় তাদের আড়াল করে রেখেছে। শব্দটা একসময় কমে গিয়ে মিলিয়ে গেল। আর তখন থেকে টুপটাপ তুষার পড়তে লাগল তাঁবুর ওপর। এক রাত্রে কত তুষার পড়ে?

সকালটা চমৎকার। দুজন শেরপা ছাড়া আর কাউকে ক্যাম্পে দেখতে পেল না অর্জুন। ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সবাই বেরিয়ে গেছে। এই তুষারের রাজ্যে কোথায় ভালুকমশাইরা আস্তানা গেড়েছেন তাই খুঁজে দেখবে সবাই। বেরিয়ে যাওয়ার আগে জনসাহেব তাকে ডাকেননি। অভিযাত্রীদের মধ্যে মিলিটারির শৃঙ্খলা থাকে বলে পড়েছিল অর্জুন, দেখা যাচ্ছে কথাটা খাঁটি।

একজন শেরপা তাকে এক মগ চা আর বিস্কুট এনে দিল। ধোঁয়া ওঠা চা মুখে দিতে-দিতেই তেজ হারাচ্ছে। অর্জুন দেখল আর একজন শেরপা ঝুলঝাড়ার মতো একটা কিছু দিয়ে তাঁবুর গায়ে রাতে পড়া তুষার সরিয়ে দিচ্ছে।

চা শেষ করে মগটা কিচেনে পৌঁছে দিয়ে আসার সময় অর্জুন দেখল জুডি তাঁবু থেকে বের হচ্ছে। তা হলে জুডিও যায়নি। সে হেসে বলল, গুড মর্নিং। জুড়ি গম্ভীর মুখেই বলল, ইয়েস, গুড মর্নিং।

তুমি ওদের সঙ্গে গেলে না কেন?

জুডি তাকাল। তার চশমার বড় কাচে আলো পড়ল, ভোরের আলো। বলল, আমার কাজ ছবি তোলা নয়, কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা করা। আর সেটা ক্যাম্পেই করা সহজ।

তোমার কি মনমেজাজ ঠিক নেই?

বাজে কথা বলতে বা শুনতে আমি পছন্দ করি না।

জুডি অন্যদিকে তাকাল। ডাক্তার-মহিলাকে ফুটিয়ে লাভ নেই, অর্জুন শেরপাদের কাছ থেকে স্টিক চেয়ে নিয়ে হাঁটতে বের হল। হাকা ধাতব সরু স্টিকের মাথায় ইংরেজি টি অক্ষর বসানো। সামনে চাপ দিলে বোঝা যায় তুষারে পা কতখানি ড়ুববে।

হাঁটতে ভাল লাগছিল অর্জুনের। এখনও পায়ের তলায় হাল্কা তুষারে ঢাকা শক্ত বরফ পাওয়া যাচ্ছে। শেরপারা যেদিকে বলেছিল সেদিকে মিনিট পনেরো হাঁটার পর গ্রামটাকে দেখতে পেল সে। পাহাড়ের ওদিকটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বরফ পড়েছে। কালো মাটি বা পাথর দেখা যাচ্ছে তাই। খুব ছোট গ্রাম নয়। দূর থেকেই মানুষের চলাফেরা নজরে এল। পাহাড়ের আড়ালে তাঁবু ফেলেছেন বলে জনসাহেব হাওয়ার দাপট থেকে দলকে বাঁচাতে পেরেছেন। আর এই গ্রামটা তৈরি হয়েছে পাহাড়ের আর-একটা দিকে যাতে হাওয়া বা তুষারঝড় পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে। এবং সেই কারণেই মাটি দেখা যাচ্ছে, তুষার সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে পারেনি।

গ্রামের সীমানায় পা রেখে অর্জুন প্রথমে কাউকে দেখতে পেল না। যেটুকু নেপালি ভাষা তার জানা ছিল তাই সম্বল করে সে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইল।

এইসময় চারজন লোক পাহাড়ের আড়াল ছেড়ে এগিয়ে এল তার দিকে। পাহাড়ের মানুষের মুখে আপাত সারল্য সবসময় থাকে। এদের দেখে শত্রু বলে মনে হল না অর্জুনের। এবা কোন ভাষায় কথা বলে তা অর্জুনের জানা নেই। নেপালি হলে সে কাজ চালিয়ে দেবে। কিন্তু তাকে অবাক করে একজন হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে এসেছ?

আমি জলপাইগুড়িতে থাকি। অর্জুন সত্যি কথাই বলল।

লোকগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল নিজেদের মধ্যে। বোঝাই যাচ্ছে নামটা তারা কখনওই শোনেনি। এদের সম্পর্কে যা জেনেছে তাতে তো পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গার নাম এদের শোনার কথা নয়।

অর্জুন বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

তুমি কি কাঠমন্ডু থেকে হেঁটে আসছ?

না। ওই অভিযাত্রীদের সঙ্গে হেলিকপটারে এসেছি।

ও। তা হলে তোমার সঙ্গে আমাদের কোনও কথা নেই।

কেন?

কারণ ওই সাদা চামড়ার লোকদের আমরা বিশ্বাস করি না।

কিন্তু আমার চামড়া তো সাদা নয়।

লোকগুলো আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলল। তারপর ইশারা করল অর্জুনকে। ওদের অনুসরণ করে এগোতে গিয়ে অবাক হল অর্জুন। ট্রানজিস্টার বাজছে। বিদেশি গানের সুর। এই গ্রামে বিদ্যুৎ থাকার কথা নয়। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রেডিয়ো এসে গিয়েছে। যারা ইদানীং কাঠমণ্ডুতে যায় তাদের দৌলতেই এটা সম্ভব হয়েছে। বাচ্চা মেয়েরা তাকে দেখছিল আগ্রহ নিয়ে। পাথর এবং সিমেন্ট দিয়ে তৈরি কিছু বাড়ি নজরে এল। বাকিগুলো কাঠের। পাহাড়ের ওপর উঠে আসায় এদিকে পায়ের তলায় বরফ নেই। গ্রামটি মোটেই হতশ্রী নয়। জনসাহেব বলেছিলেন এদের রোজগার ফসল লিয়ে। যখন বরফ পড়ে না তখন পাহাড়ে ফসল ফলায় এরা। আর জঙ্গলের কাঠ তো রয়েছেই।

একটা গুহার সামনে সুন্দর চাতালে দশবারোজন মানুষ বসে ছিল। এই চারজন এগিয়ে গিয়ে তাদের খবরাখবর দিল। অর্জুন দেখল গুহার মুখটা সুন্দর সাজানো। যারা বসে ছিল তাদের একজন তাকে এমন ভাষায় জিজ্ঞেস করল যার একটা শব্দও বোধগম্য হল না। এবার প্রথম লোকটি সেটি হিন্দিতে অনুবাদ করে বলল, আমাদের প্রধান জানতে চাইছেন তুমি ওই সাদা চামড়াদের সঙ্গে কেন এসেছ?

অর্জুন বলল, আমি সমতলের মানুষ। পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই। ওদের সঙ্গে হেলিকপটারে না এলে এখানে আসতে পারতাম না।

লোকটি সেটা প্রধানকে শুনিয়ে দিতে তিনি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন। দোভাষী জানাল, তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্য কী?

আমি শুনেছি তোমাদের পবিত্র দুটি বস্তু চুরি গেছে। ওগুলো কারা চুরি করেছে এবং কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে আমি চাই।

তুমি কি পুলিশ?

না। আমি সত্যসন্ধানী। প্রকৃত সত্যি খুঁজে বের করাই আমার কাজ।

এই খবর তোমাকে কে দিল?

তোমাদের গ্রামের এক ছেলে, যিনি এখন কাঠমণ্ডর ডাক্তার।

এবার ওরা আলোচনায় বসল। বেশ কিছুক্ষণ ওরা কথা বলল। তারপর দোভাষী বলল, তুমি যার কথা বললে সে ছেলেবেলা থেকেই সাদা চামড়াদের সঙ্গে থেকে নিজের বিশেষত্ব হারিয়েছে। এই গ্রামে সে খুবই কম আসে। ওর বাবা-মা পর্যন্ত ছেলের কাছে গিয়ে থাকতে চায় না। ওকে আমরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না।

উনি কিন্তু তোমাদের কথা খুব ভাবেন। তা ছাড়া তোমরা কি চাও না হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলোকে ফিরে পেতে?

নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু হারিয়ে যায়নি। চুরি করা হয়েছে।

এ-বিষয়ে তোমরা নিঃসন্দেহ?

নিশ্চয়ই। ওই পবিত্র গুহায় ওগুলো রাখা ছিল। কিছুদিন আগে সেগুলো উধাও হয়ে গেল। অথচ ওই পবিত্র মাথা আর গায়ের চামড়া যুগ-যুগ ধরে আমাদের পুর্বপুরুষেরা রক্ষা করে এসেছিলেন। যতদিন ওগুলো নিরাপদে ছিল ততদিন ওই গ্রামে কোনও অশান্তি হয়নি।

কিন্তু যে বা যারা চুরি করবে, তাদের স্বার্থ কী?

প্রধানকে দোভাষী প্রশ্নটা জানাতে তিনি খেপে গিয়ে উত্তেজনা প্রকাশ করলেন। দোভাষী বলল, আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সাদা চামড়ার দল এসে তখনকার প্রধানকে রাজি করিয়ে ওই পবিত্র জিনিসগুলো নিয়ে গিয়েছিল তাদের দেশে। এগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্যে গ্রামের দুজন পুরুষ সঙ্গে গিয়েছিল। তখনই সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে গেছে ওগুলোর কথা। ওরা অবশ্য ঠিকঠাক ফিরিয়ে দিয়েছিল তবু ওগুলোকে দেখতে পরের বছরগুলোতে সাদা চামড়াদের আসা-যাওয়া চলছিল। বহু টাকা দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছিল কেউ-কেউ। আমরা বিক্রি করিনি। সেই লোভে চোর চুরি করল। এর জন্যে যারা দায়ী সেই সাদা চামড়াদের সঙ্গে আমরা কোনও সহযোগিতা করব না।

অর্জুন বলল, তোমাদের গ্রামের ছেলে এখন ডাক্তার। তিনি কখনওই তোমাদের ক্ষতি চাইবেন না। ওই পবিত্র জিনিসগুলো খুঁজে বের করতে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি সাদা চামড়ার মানুষ নই।

দোভাষী বলল, তুমি পুলিশ নও। দেখে মনে হচ্ছে শরীরে তেমন শক্তি নেই। নিজেই বললে পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতাও নেই। তুমি কী করে খুঁজে বের করবে?

অর্জুন চারপাশে তাকাল। একটা বিশাল পাথর দেখতে পেল সে। ওটাকে সরানো দূরের কথা, নড়াবার শক্তি তার নেই। সে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের গ্রামের কেউ ওই পাথরটাকে কিছুটা সরাতে পারবে?

দোভাষী বলল, পাগল। কারও ক্ষমতা নেই ওটাকে সরাবার। তিনটে মানুষ একসঙ্গে চেষ্টা করেও পারবে না।

আমি যদি সরিয়ে দিই?

তুমি! একা। দোভাষী জানাতেই সবাই হেসে উঠল।

অর্জুন চারপাশে তাকাল। একটা কোদালের মতো জিনিস নজরে এল। সে ওটাকে তুলে পাথরের পেছনে চলে এল। বিরাট পাথর দাঁড়িয়ে আছে মাটির ওপর। সে কোদাল চালাল। সবাই ভিড় করে এল তার চারপাশে। প্রায় মিনিট পনেরো লাগল গর্তটাকে বড় করতে। একেবারে পাথরের ধার ঘেঁষে যতটা সম্ভব কাছে গর্তটাকে নিয়ে গেল সে। তারপর উলটো দিকে গিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে পাথরটাকে ঠেলতেই সেটা নড়ে কাত হয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে জনতা গুগুন করে উঠল। অর্জুন দোভাষীকে বলল, তা হলে দেখলে, শুধু শক্তি দিয়ে যেটা সম্ভব নয়, একটু বুদ্ধি খরচ করলে সেটা সম্ভব হয়।

এই একটি ঘটনায় অর্জুনকে ওদের গ্রহণ করা সহজ হয়ে গেল। চাতালে বসিয়ে ওরা ওকে চমরি গাইয়ের দুধ খাওয়াল। অর্জুন দোভাষীকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের পবিত্র জিনিসগুলো চুরি হয়েছে কোনখান থেকে?

ওকে ওরা গুহার মধ্যে নিয়ে গেল। সে অবাক হয়ে দেখল গুহার প্রান্তে বেদির ওপর বিশাল শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ এরা শৈব? কিন্তু চারপাশে বৌদ্ধমন্দিরের স্মারকচিহ্ন ছড়ানো। ডানদিকে একটা উঁচু পাথর দেখাল দোভাষী। ইয়েতির মাথা এবং ছাল তার ওপর রাখা ছিল। বিদেশ থেকে ফেরার সময় একটা কাচের বাক্স আনা হয়েছিল। ওগুলো তার মধ্যে সংরক্ষিত ছিল।

এই গুহায় ঢোকার অন্য কোনও পথ নেই। যে চুরি করেছে তাকে আসতে হবে সামনে দিয়েই। সন্ধের আগে গুহার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। চুরি হয়েছে রাতেই, কারণ সকালে মন্দিরের দরজা খোলার পরই এগুলোকে আর দেখা যায়নি। অথচ গুহার মুখ বন্ধ ছিল সারারাত।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এই গ্রামের সবাই কি এই মন্দিরে পুজোর জন্যে আসেন?

দোভাষী জানাল, হ্যাঁ। এখন পর্যন্ত আসে তবে আগের মতো সবাই পুজো দেয় না। বিশেষ করে যারা কাঠমণ্ডুতে গিয়েছে তাদের কেউ-কেউ আলাদা হয়ে গিয়েছে।

পুজোর পুরোহিত কে?

তিনি অসুস্থ। এই কারণে পুজো বন্ধ আছে। ওই পবিত্র জিনিসগুলো চুরি গিয়েছে বলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি সুস্থ হলে আবার পুজো হবে।

আর যদি মারা যান তা হলে নতুন পুরোহিত ঠিক করা হবে।

অমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?।

গ্রামপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে দোভাষী তাকে নিয়ে গেল যে বাড়িতে, তাকে বাড়ি বলা চলে না। কাঠের ঘরটির অবস্থা খুবই করুণ। তবে ঢালু ছাদ এখনও মজবুত। সম্ভবত তুষারের চাপ সহ্য করার জন্যেই ওটুকু রয়েছে। দরজা ভেজানো। দোভাষী সেটাকে ঠেলতেই খুলে গেল। ছোট্ট ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে এল। দোভাষী তার নিজের ভাষায় কিছু বলে অর্জুনকে ইশারা করল ভেতরে ঢুকতে। কোনওরকমে মাথা নিচু করে ভেতরে কতেই অর্জুন দেখতে পেল আপাদমস্তক কম্বল এবং ভেড়ার লোম সমেত চামড়ার নীচে কেউ শুয়ে রয়েছে। লোকটির মাথার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধা।

দোভাষী বলল, চুরি যাওয়ার খবর শোনার পর থেকে সেই যে জ্বর এসেছে তা আর কমছে না। এখন জ্বর বেড়েছে, কথা বলার শক্তি নেই।

অর্জুন মুখ থেকে চাপা সরিয়ে দিতে বলল। দোভাষী সেটা জানাতে বৃদ্ধা কম্বল গলার ওপর নামিয়ে দিল। অর্জুন দেখল ভাঙাচোরা এক বৃদ্ধের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ। নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। সে কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর ভালই। সে দোভাষীকে জিজ্ঞেস করল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?

দোভাষী বলল, তিনদিনের পথ। নিয়ে যেতে-যেতে মরে যাবে।

তা হলে কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না?

হচ্ছে। পাশের গ্রামে একজন মানুষ আছেন, যিনি গাছের পাতা-শেকড় দিয়ে অসুখ সারান। তিনি এসে দেখে গেছেন তিনদিন আগে। তাঁর ওষুধই খাওয়ানো হচ্ছে। দোভাষী বলল।

কিন্তু তাতে তো কাজ হচ্ছে না।

কী করা যাবে। অভিশাপ লেগেছে এই গ্রামের ওপর।

অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এবার গ্রামের মেয়ে-পুরুষ-বুড়োর দল যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাকে দেখছে। অর্জুন তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে তারা হাসল। অর্জুন দোভাষীকে বলল, কাঠমপুর হাসপাতালের ডাক্তার কোন বাড়িতে থাকতেন? ওঁর বাবা-মা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন?

তুমি সেখানে যেতে চাও?

হ্যাঁ।

দোভাষী তাকে নিয়ে এল শেষপ্রান্তে। এখানে বরফ নেই। দূরে তুষারের মাঠ পড়ে রয়েছে। বাড়িটি সুন্দর। দেখলেই বোঝা যায় গৃহস্থের অবস্থা ভাল। বাড়ির সামনে কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। দোভাষী ডাকতেই এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। লম্বা, মঙ্গোলিয়ান চোখ-মুখ, কিন্তু হাঁটাচলায় অসুস্থতা ধরা পড়ে।

দোভাষী বলল, ইনি ইংরেজি জানেন। বিদেশ ঘুরে এসেছেন। তুমি যার কথা বললে ইনি তার বাবা।

অর্জুন ইংরেজিতে বলল, আমার নাম অর্জুন, আপনার ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আপনি যখন ইংরেজি জানেন তখন কথা বলতে অসুবিধে হবে না।

ভদ্রলোক শুন্যে হাত চালালেন, নো ইংলিশ। ওনলি ইয়েস অ্যান্ড নো। নো হ্যাবিট। হিন্দি গোড়া-থোড়া।

অর্জুন হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, আপনিই তো লন্ডনে গিয়েছিলেন?

জি। কুইন্স হাউস। ভেরি বিগ। হাম আভি সিক। ভেরি সিক।

কী হয়েছে আপনার?

হার্ট অ্যাটাক। আমার ছেলে বলেছে ঘরের বাইরে না যেতে, ওঠানামা না করতে। আমার ছেলে ডাক্তার। বলে শ্বাস নিলেন, আচ্ছা, কুইন কি মরে গেছেন? খুব ভাল মেয়ে ছিলেন।

না। উনি ভাল আছেন। ওঁর ছেলের বউ মারা গিয়েছে। তা আপনি যখন অসুস্থ তখন ছেলের কাছে গিয়ে থাকেন না কেন? সেখানে ভাল চিকিৎসা হত। এখানে তো ডাক্তার নেই।

না, না। দিস ইজ গুড। এই জায়গা আমার জায়গা। এখান থেকে গেলে আমি মরে যাব। হাসলেন বৃদ্ধ, তা ছাড়া এই অসুখের যা-যা ওষুধ লাগে, সব ছেলে আমাকে দিয়ে গিয়েছে।

আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই মন্দির থেকে ইয়েতির মাথা আর চামড়া চুরি হয়ে গিয়েছে। শুনেছেন?

শুনেছি। ভেরি স্যাড।

কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?

বৃদ্ধ একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, যার খুব টাকার লোভ সে নিয়েছে। হিলারি বলেছিল ওগুলো ভালুকের, ইয়েতি বলে কিছু নেই। কিন্তু তবু লোকে বিশ্বাস করে ইয়েতি আছে! যারা বিশ্বাস করে তাদের কাছে বিক্রি করলে লোভী লোকেরা প্রচুর টাকা পাবে।

এই লোভী লোকদের নাম বলতে পারেন?

কী করে বলব কখন কার লোভ হচ্ছে। এই যে এ, এরও লোভ হতে পারে। এখন তো সব কাঠমণ্ডুতে গিয়ে সিনেমা দ্যাখে।

ওগুলো চুরি গিয়েছে বলে গ্রামের সবাই সাদা চামড়াদের ওপর রেগে গেছে। কিন্তু তারা চুরি করেনি। আপনার কী মনে হয়?

আমি জানি না।

আপনি তো বিদেশ গিয়েছিলেন ওগুলো নিয়ে। তখন কেউ চুরি করতে পারেনি। এত বছর পর চুরি হল। সাদা চামড়ার লোক চুরি করতে এত বছর অপেক্ষা করত? কী মনে হয়?

আমি জানি না। শুধু জানি ওরা যেসব জায়গায় থাকে সেখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে না। রাস্তায় চলতে গেলে একের সঙ্গে অন্যের ধাক্কা লাগে। ওরকম জায়গায় মানুষ ভাল হতে পারে না।

তা হলে ওদের কুইনকে ভাল মেয়ে বললেন কেন?

ও হো। কুইন যে বাড়িতে থাকে সেখানে ভিড় নেই। বিশাল বাড়ি, বাগান। কত বড়বড় ঘর।

দোভাষী চুপচাপ শুনছিল। এবার সে তাড়া দিল ফেরার জন্যে। অর্জুনের মনে পড়ল বৃদ্ধ একটু আগে বলেছেন যে, তাঁর ছেলে অনেক ওষুধ দিয়ে গেছে। সে বলল, আপনার ছেলে কী কী ওষুধ দিয়েছে দেখতে পারি?

বৃদ্ধ কোনওরকমে ঘরে গেলেন। তারপর ফিরে এলেন একটা টিনের বাক্স নিয়ে। বাক্সটা খুললে হার্ট এবং প্রেশারের ওষুধ দেখতে পেল অর্জুন। প্রায় তিন মাসের ব্যবস্থা করা আছে। তারপর নানান ক্যাপসুল আর ট্যাবলেট নজরে এল। তা থেকে দুটো ক্রোসিন ট্যাবলেট তুলে নিয়ে বাক্সটা ফেরত দিল অর্জুন। আবার আসবে জানিয়ে সে দোভাষীর সঙ্গে ফিরে আসছিল। পুরোহিতের ঘরের সামনে পৌঁছে ও দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। একটা ক্রোসিন ট্যাবলেট বের করে সে দোভাষীকে বলল, এইটে জল দিয়ে খাইয়ে দাও।

এটা খেলে যদি মরে যায়? দোভাষীকে খুব নার্ভাস দেখাল।

তা হলে আমাকে মেরে ফেলল। যদি উনি মরে যান এই কদিনের অসুখের জন্যে মারা যাবেন, ট্যাবলেটের জন্যে নয়।

দোভাষীর কথায় বৃদ্ধা ট্যাবলেটটা জলের সঙ্গে খাইয়ে দিল বৃদ্ধকে। অর্জুন কম্বল এবং ছাল কোমরের নীচে নামিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে।

গুহার কাছে ফিরে এসে অর্জুন দোভাষীকে বলল, এই গ্রামের যেসব ছেলে কাঠমণ্ডুতে গিয়েছে তারা সবাই এখন এখানে আছে?

হ্যাঁ। দোভাষী মাথা নাড়ল। চুরির পর কেউ গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়নি?

হলে তো আমরা তাকেই চোর বলে বুঝতে পারতাম।

যে লোকটি খবর দিতে গিয়েছিল সে ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ। গতকাল ফিরেছে।

আপনারা কাকে সন্দেহ করেন?

কারও নাম বলতে পারব না। তবে এর পেছনে সাদা চামড়াদের বুদ্ধি আছে। ওদের একটা দল চুরি যাওয়ার পরেই গ্রামের এত কাছে তাঁবু ফেলল কেন? নিশ্চয়ই পবিত্র জিনিসগুলোকে চোর কাছেপিঠের বরফের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। ওরা সেটা জানে, তাই নিয়ে যেতে এসেছে।

অর্জুন হেসে ফেলল। দোভাষী রেগে গেল, হসছ কেন?

দ্যাখো, ওদের এই অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এক বছর আগে। এখানে আসতে যেসব অনুমতি পাওয়া দরকার তার ব্যবস্থা করতে সময় লেগেছিল। তোমাদের পবিত্র জিনিসগুলো যদি চুরি না হত তা হলেও ওরা আসত। এই আসার সঙ্গে চুরির কোনও সম্পর্ক নেই। ওরা এসেছে তুষার-ভালুকের ছবি তুলতে। অর্জুন ধীরে ধীরে লোকটাকে বোঝাতে চেষ্টা করল।

তুষার-ভালুক? তার ছবি তুলবে ওরা?

হ্যাঁ। তাতে নিশ্চয়ই তোমাদের আপত্তি নেই।

দোভাষী গুহার সামনে বসা মানুষগুলোকে খবরটা জানাতে তারা হো-হো করে হেসে উঠল। দোভাষী বলল, যাক, আমাদের কাজটা সহজ হয়ে গেল। আমাদের আর কিছুই করতে হবে না।

তার মানে?

এই তুষার-ভালুকগুলো খুব চালাক। প্রচণ্ড বুদ্ধি ওদের। আর শক্তিও খুব বেশি। ওদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া সহজ নয়। শেষ হয়ে যাবে সাদা চামড়ারা। তার ওপর এবার সঙ্গে দুটো মেয়েকে নিয়ে এসেছে। দ্যাখো। দোভাষী মাথা নাড়ল, যাক গে, তুমি বুদ্ধি খরচ করে চোরকে ধরতে পারবে?

অর্জুন জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। কয়েকটা ছেলে সেই বড় পাথরের নীচে অর্জুনের খোঁড়া গর্তটাকে এতক্ষণে বিশাল করে ফেলেছে। সে চেঁচিয়ে ওদের নিষেধ করল। ছেলেগুলো সূক্ষেপ করল না। অর্জুন দোভাষীকে বলল, ওদের বারণ করো, নইলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

লোকটা বুঝতেই পারল না কথাটা। হলদে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। এবার ছেলেগুলো একসঙ্গে পাথরটাকে পেছন থেকে ঠেলতেই সেটা নড়ে উঠল। যেহেতু তার নীচে মাটির বাঁধন নেই, তাই গড়িয়ে গেল তৈরি করা গর্তে। এবং সেই চাপে গর্ত ডিঙিয়ে ঢালু জমিতে পড়ে মুহূর্তেই দ্রুতবেগে পাক খেতে-খেতে নামতে লাগল নীচের দিকে। চারধার থেকে চিৎকার উঠল। নীচের মানুষজন ছুটে পালাতে লাগল। একটা মুরগি পালাতে পারল না। অনেক ভাঙচুর করে পাথরটা নীচে বরফের ওপর যখন আছড়ে পড়ল, তখন দেখা গেল মুরগির শরীরটা কাগজের মতো মাটির ওপর আটকে আছে। ওর যে রক্ত মাংস হাড় ছিল তা আর বোঝা যাচ্ছে না। চারপাশের মানুষ যেন মূক হয়ে গেছে। কারও যেন সাড়া নেই।

অর্জুন বলল, আমি ওদের নিষেধ করেছিলাম। তুমিও কিছু বললে না। ভাগ্য ভাল, কোনও মানুষ ওই পাথরের সামনে পড়েনি।

দোভাষী কিছু বলার আগেই গ্রামপ্রধানরা চিৎকার করে উঠল। সবাই দুহাত আকাশে ছুড়ে কিছু বলছে। সেটা যে উল্লাসের অভিব্যক্তি তা বুঝতে সময় লাগল। লোকগুলো ছুটে এসে অর্জুনের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াল।

দোভাষী বলল, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

কেন?

আমরা তো বটেই, আমাদের পূর্বপুরুষরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ওই পাথরটাকে ওখানে দেখে এসেছে। আমরা সবাই জানি ওটা একটা শয়তান। এই মন্দিরের বাইরে শয়তানটা যুগ-যুগ ধরে বসে আছে। যখনই কেউ ঝগড়া আর মারপিট করে তখনই দেখা গেছে ওই পাথরটার পাশে সে গিয়েছিল। আমাদের কারও ক্ষমতা হয়নি ওটাকে সরাবার। তোমার জন্যে শয়তানটাকে গ্রাম থেকে দূর করে বরফের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হল। এখন ও ক্ষতি করবে যারা বরফের ওপর বাস করে তাদের। তুমি আমাদের খুব উপকার করেছ।

এরকম কাকতালীয় ঘটনা অর্জুন কল্পনা করেনি। এক লহমাতে সে গ্রামের মানুষের প্রিয়জন হয়ে গেল। প্রধানের নির্দেশে একঘটি দুধ আর চমরি গাইয়ের দুধ থেকে তৈরি শক্ত দুরপি পরিবেশন করা হল। খিদে পেয়ে গিয়েছিল অর্জুনের। কৌতূহলী দৃষ্টিগুলো নস্যাৎ করে সে খেয়ে নিল। প্রধানের সঙ্গে কথা বলে দোভাষী বলল, আমরা এখন বিশ্বাস করি যে তুমি চোর ধরে দিতে পারবে। আর যেহেতু তুমি ওই সাদা চামড়াদের সঙ্গে এসেছ তাই এবার ওদের কোনও ক্ষতি করব না আমরা। তবে তুমি ওদের বলে দিও আমাদের গ্রামে যেন না ঢোকে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এই দলের দুই ভদ্রমহিলা যদি আসতে চান?

দোভাষী আবার আলোচনা করতে গেল। ওদের ভাষা না বুঝলেও অনুমান করা যাচ্ছে ওরা একমত হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত দোভাষী ফিরে এসে বলল, মেয়েদের আমরা শ্রদ্ধা করি। তাদের ওপর আমাদের কোনও রাগ নেই। তবে তুমি যদি সঙ্গে থাকে তা হলেই আমরা মেয়েদের এখানে আসতে দিতে পারি।

অর্জুন যখন তাঁবুতে ফিরে এল তখন বেলা বারোটা। অতটা পথ বরফ ভেঙে এলেও এবার তার তেমন কষ্ট হয়নি। লোকগুলোর দেওয়া পির একটা টুকরো তখন গালে ছিল। বস্তুটি দুগ্ধজাত কিন্তু প্রচণ্ড শক্ত। মুখে রাখলে একটা স্বাদ পাওয়া যায়। গলে খুব ধীরে ধীরে। নরম হয় অনেকক্ষণ রাখার পরে। অর্জুনের মনে হল এই বস্তুটি নিশ্চয়ই বাড়তি এনার্জি জোগায়।

ক্যাম্পে কেউ ফিরে আসেনি। এখন মাথার ওপর সূর্য এবং খুব হালকা রোদ। শেরপা দুজন এগিয়ে এল। একজন জিজ্ঞেস করল, কতদুরে গিয়েছিলেন সার?

গ্রামে।

আপনি একা গিয়েছিলেন বলে আমরা চিন্তা করছিলাম।

থ্যাঙ্ক ইউ। অর্জুন মাথা নেড়ে দেখল জুডি তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকাল। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ ভাল নেই।

অর্জুন এগিয়ে গেল, একাএকা খুব বিরক্ত লাগছে, তাই না?

সেটাই স্বাভাবিক।

আমি তোমার কাছে একটা সাহায্য চাই।

জুডি কথা না বলে তাকাল। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

আমি কাছাকাছি একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার মানুষগুলো এমনিতে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। কিন্তু এক বৃদ্ধ পুরোহিত প্রচণ্ড অসুস্থ। গায়ে বেশ জ্বর। এদের এখানে চিকিৎসা করা হয় আদিম পদ্ধতিতে। অত জ্বর দেখে আমি একটা ক্রোসিন ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছি। অর্জুন বলল।

ক্রোসিন ট্যাবলেট। জুড়ি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

এটা এক ধরনের প্যারাসিটামল দেওয়া অ্যানালজেসিক ট্যাবলেট।

তুমি কি ডাক্তারি পড়েছ?

না।

তা সত্ত্বেও ওষুধ দিয়ে দিলে?

অর্জুন জানে জুডি ঠিক কথা বলছে। কিন্তু এ-দেশের মানুষ সামান্য জ্বরজারিতে কিছু নিরীহ ওষুধ খেয়েই থাকে। সামান্য পেট খারাপ হলে কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না। কিন্তু জুডিকে এসব কথা বোঝানো বৃথা।

সে বলল, আমি জানতাম জ্বর বেশি হলে ওষুধটা কাজে দেয়।

কী ধরনের জ্বর। যদি অন্য কোনও ইনফেকশনে জ্বর আসে তা হলে কোনও কাজই দেবে না। আমাদের প্রত্যেকের নিজের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকা উচিত। জুড়ি মাথা নাড়ল।

সরি। এটা সবসময় সত্যি নয়। আমি যদি দেখি এই মুহূর্তে তুমি অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছ, যেহেতু আমি ডাক্তার নই তাই অক্সিজেন মাস্ক তোমার মুখে লাগিয়ে দেব না? তুমি মারা গেলেও আমার এক্তিয়ারের বাইরে যাব না? যে লোকটাকে ওষুধ দিয়েছি তার পেটে এখন পর্যন্ত কোনও ওষুধ পড়েনি। ও ওইভাবে ভুগে মরে গেলেও ওষুধ পড়বে না। বরং ট্যাবলেটটা খেয়ে যদি ওর একটুও উপকার হয় তাহলে ওর অনেক উপকার হবে।

জুডি অবাক হয়ে অর্জুনের দিকে তাকিয়েছিল।

অর্জুন বলল, তুমি ডাক্তার। লোকটাকে একবার দেখবে?

জুড়ি অন্যদিকে তাকাল, আমার যেতে আপত্তি নেই। তবে জনের অনুমতি চাই।

ঠিক আছে। জন এলে ওকে বলব।

অর্জুন নিজেদের তাঁবুতে চলে এল। জুডি তাকে পছন্দ করছে না কেন? ডানার মতন সহজ মেয়ে ও নয়। প্রথম থেকেই দূরত্ব রেখে চলেছে। জন যদি আপত্তি করে তা হলে আর কী করা যাবে।

চেয়ারে বসে অর্জুন সমস্ত ঘটনাটা ভাবার চেষ্টা করল। আজ গ্রামে গিয়ে একটাই উপকার হয়েছে। ওরা তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু মুণ্ডু এবং চামড়া যা গ্রামের মানুষের কাছে পবিত্র জিনিস, তা কে কীভাবে চুরি করল তার বিন্দুমাত্র হদিস পায়নি। এ যেন সমুদ্রে পড়ে যাওয়া একটা আধুলিকে খুঁজে বের করা। গ্রামের লোকগুলোকে দেখে বোঝাই যায় ওরা অসৎ নয়। অন্তত নিজেরা যা পবিত্র মনে করে তা টাকার লোভে বাইরের লোকের কাছে বিক্রি করবে না। বিক্রি যদি করেও তা হলে সেই টাকা রাখার এবং খরচ করার কোনও রাস্তা ওদের জানা নেই। একটা মস্ত পাথরকে যারা শয়তান বলে মনে করে তাদের ধূর্ত বলা চলে না। অর্জুনের মনে হল পুরোহিতের কথা। ঘটনার দিন থেকেই লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কেন? তবে কি ও এমন কিছুর সাক্ষী যার জন্যে প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। এবং সেই কারণেই অসুস্থতা? অর্জুন সঙ্গে-সঙ্গে ভাবনাটাকে বাতিল করল। প্রথম চিন্তায় যে ভাবনা মাথায় আসে সেটাকে আঁকড়ে ধরলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল পথে হাঁটতে হয়।

আসতে পারি?

অর্জুন দেখল জুড়ি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই!

এসো। দ্বিতীয় খালি চেয়ারটা দেখিয়ে দিল অর্জুন। আই অ্যাম সরি।

ঠিক আছে।

আসলে আমি খুব ডিস্টার্বভ।

কেন?

অভিযানে যখন যোগ দিয়েছিলাম তখন ভাবিনি এমন অলসভাবে সময় কাটাতে হবে। এখানে আমার কিছুই করার নেই, যতক্ষণ কেউ অসুস্থ না হয়। অথচ ডানাকে দ্যাখো, সবাই ব্যস্ত ওকে নিয়ে। ওর সাফল্যের ওপর এই অভিযানের সাফল্য নির্ভর করছে। নিশ্বাস ফেলল জুডি।

ব্যাপারটা তুমি অন্যভাবেও দেখতে পারে।

কীরকম?

তোমার ওপর অভিমান নির্ভর করে আছে। ধরো, ডানা বা জন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। তুমি যদি চিকিৎসা করে ওদের সুস্থ করতে না পারে তা হলে অভিযান বাতিল হয়ে যাবে। তাই না?

তা ঠিক। কিন্তু আমি কখনওই চাই না ওরা অসুস্থ হোক।

এইসময় বাইরে কথাবার্তা শোনা গেল। ওরা বাইরে এসে দেখল দলের সবাই ফিরে এসেছে। জন এগিয়ে এলেন, গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কীরকম দেখলে?

তোমাদের ওপর খুব রেগে আছে ওরা। ভাবছে তোমরাই ওগুলো চুরি করিয়েছ। আমি অনেক বুঝিয়েছি।

জন বললেন, কী ঘটেছে সব খুলে বলে। ডিটেলসে।

অর্জুন বলল।

জন ওর হাত ধরলেন, অনেক ধন্যবাদ।

তোমাদের কোনও কাজ হল?

এবার ভানা এগিয়ে এল, অনেকটা ঘুরেছি। তুষার-ভালুকরা বোধহয় আগেই খবর নিয়েছিল। কেউ ছবি তুলতে এগিয়ে আসেনি।

জন বললেন, রাবিশ। আমি দুটো ভালুকের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছি। চারটে পা নয়, দুটো পায়ের ছাপ। এখান থেকে মিনিট পনেরো উত্তরে। তার মানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলেছে ও দুটো। তার ওপর রাত্রে তুষার পড়েছে। দিনের বেলার টাটকা ছাপ নজরে আসেনি। এর থেকে প্রমাণিত হয় ওরা মাইল দুয়েকের মধ্যেই আছে। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। তুমি আবার কবে গ্রামে যাবে?

অর্জুন বলল, আমি আজ যেতে চাই।

কেন?

ওই পুরোহিতকে বাঁচাতেই হবে।

কিন্তু লোকটার অসুখ কী, তা তো জানো না।

সেইজন্যে জুডিকে নিয়ে যেতে চাই।

জুডিকে? না, না।

না কেন?

ওরা আমাদের পছন্দ করছে না। জুডির ক্ষতি করতে পারে।

আমি কথা দিচ্ছি সেটা করবে না।

তা ছাড়া জুড়ি খুব নিয়ম মেনে চলে। আমার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে অভিযানের সদস্যদের সে চিকিৎসা করবে। বাইরের লোককে দেখতে আমি তাকে বাধ্য করতে পারি না।

জুডি যদি নিজে যেতে রাজি হয়?

জন অবাক হয়ে তাকালেন, তাই নাকি? তা হলে যাও তোমরা।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে ওরা রওনা হল। ডানার খুব ইচ্ছে ছিল সঙ্গে যাওয়ার। কিন্তু জন নিষেধ করলেন। সকালে এতটা পরিশ্রম করার পর আবার বরফ ঠেঙিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আগামীকাল ভোরের আগেই বেরোতে হবে তাঁদের।

এখানে সন্ধে নামে ঝুপ করে। তবু হাতে ঘণ্টা তিনেক সময় আছে। জুডির ওষুধের বাক্সটা অৰ্জুন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম হাঁটার সময় জুডি ফানি, ইন্টারেস্টিং ইত্যাদি শব্দ বলছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চুপ করে গেল। অর্জুন ঘড়ি দেখল। একটু একটু করে তাদের ওপরে উঠতে হচ্ছে। পায়ের তলায় জমাট তুষার থাকায় হাঁটতে হচ্ছে পা টেনে-টেনে। হাতে সময় আছে। সূর্যাস্তের আগেই তাদের ফিরে আসতে হবে। সে বলল, হেলিকপটারে না এসে পুরো পথটা যদি পায়ে হেঁটে আসতে হত তা হলে আমি কিছুতেই আসতাম না।

আমিও না। এই প্রথম হাসি দেখা গেল জুডির মুখে।

চলো, ওই পাহাড়ের বাঁকটা ঘুরলেই গ্রামে পৌঁছে যাব।

গ্রামের পথে উঠতেই চিৎকার শুনতে পেল ওরা। দু-তিনটে বাচ্চা মাথার ওপরে হাত তুলে চেঁচাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। ওরা এগোতেই তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। জুড়ি ভয় পেল, কী ব্যাপার? আমরা বিপদে পড়ব না তো?

উপকার করতে গিয়ে বিপদে পড়লে যিশু কী করতে বলেছেন?

সরি। আবার উপকার করার বাসনা আমার নেই।

গ্রামে ঢুকতেই বয়স্কদের এগিয়ে আসতে দেখল ওরা। দোভাষী ওই দলে নেই। সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। এই ভাষা অর্জুনের জানা নেই। ব্যাপারটা ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল। জুড়ি বলল, তুমি এদের ভাষা আগেরবার কী করে বুঝলে?

তখন দোভাষী ছিল।

তা হলে শেরপাদের একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। ওরা নিশ্চয়ই বুঝবে।

লোকগুলো চুপ করতেই অর্জুন জুডিকে ইশারা করে এগোল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে ওরা হাঁটছে আর লোকগুলো পেছনে আসছে। এবং প্রতি পদক্ষেপে ওদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। দোভাষী কোথায় গেল। সে যদি না থাকে তা হলে একমাত্র ভরসা হচ্ছে ডাক্তারের বাবা।

পুরোহিতের ঘরের সামনে পৌঁছে সে জুডিকে বলল, পেশেন্ট এখানে থাকে। আমার সঙ্গে এসো।

জনতাকে বাইরে রেখে ওরা ভেতরে ঢুকল।

লোকটি ঘুমোচ্ছে। তার পাশে বসা বৃদ্ধা অর্জুনকে দেখে দুহাত তুলে কিছু বলতে লাগল। ব্যাপারটা আশীবাদের মতো বলে মনে হল অর্জুনের। অর্জুনের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে জুড়ি পরীক্ষা আরম্ভ করল। প্রথমে নাড়ি দেখল। তারপর স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করল। এইসময় লোকটি চোখ খুলল। কিন্তু সে এত ক্লান্ত যে, বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, জ্বর কত?

জুড়ি মাথা নাড়ল, এখন জ্বর নেই।

তা হলে ওষুধ কাজ করেছে, তাই না?

হয়তো। কিন্তু সেটা সাময়িক। জ্বর আবার আসবে।

কী করে বুঝলে?

ওর বুকে কফ বসে আছে। হার্ট বিট নর্মাল নেই। এখনই রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। বলেই জুডির খেয়াল হল, সেটা তো এখানে সম্ভব নয়। হসপিটাল কতদূরে? সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না?

একদিনে পৌঁছনো যাবে না। আগে এলে আমাদের হেলিকপটারে পাঠানো যেত। হেলিকপটার আসবে তিনদিন বাদে।

তা হলে? জুডিকে চিন্তিত দেখাল।

এভারেস্টের একশো গজ নীচে যদি কেউ অসুস্থ হয় ডাক্তার হিসেবে তার চিকিৎসা যেভাবে করবে, এর ক্ষেত্রে তাই করো।

অর্জুনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জুডি লোকটার চোখের পাতা সরিয়ে টর্চ দিয়ে দেখল। তারপর পেট টিপতে লাগল। লোকটা বলল উঃ।

জুড়ি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, কোথায় ব্যথা লাগছে? এখানে?

অর্জুন হেসে ফেলে অবাক হল! জুডি দ্বিতীয়বার চাপ দিতেই লোকটা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, ওখানেই লাগছে।

এইসময় ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ। অর্জুন বলল, আপনি এতদূরে আসতে পারলেন?

না এসে উপায় নেই। যে লোকটা হিন্দি জানত সে গিয়েছে সাত মাইল দৃরের গ্রামে। এদের কথা তোমরা বুঝতে পারছ না বলে বাধ্য হয়ে আমাকে ডেকে এনেছে। এমনিতে এরা আমাকে পছন্দ করে না। চুরি যাওয়ার পর তো একঘরে করে রেখেছে।

কেন?

আমার ছেলে সাহেবদের স্কুলে পড়েছে। ডাক্তার হয়েছে। গ্রামের বাইরে জন্মেছে। আমি একটু ইংরেজি জানি। তাই। ছেলে কত বলেছে তার ওখানে গিয়ে থাকতে। কিন্তু আমি যাব না। এই গ্রাম আমার প্রাণ, এখানেই জন্মেছি, এখানেই মরতে চাই।

অর্জুন বৃদ্ধের সঙ্গে জুভির আলাপ করিয়ে দিল। বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, ইউ ডক্টর?

ইয়েস।

ম্যারেড?

নো।

গুড। তারপর পুরোহিতকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাড?

ইয়েস। জুড়ি মাথা নাড়ল।

বৃদ্ধ এবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে বলল, এই যে শুনলাম তোমার দেওয়া ওষুধ খেয়ে ও ভাল হয়ে গিয়েছে, জ্বর সেরে গেছে? আমি বললাম, ওই ওষুধ আমার ছেলে আমাকে দিয়েছিল। তা হলে?

ইনি ডাক্তার। যা বলছেন ঠিকই বলছেন।

বৃদ্ধ গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। ওঁর ইংরেজির শব্দভাণ্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। জুড়ি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, একে কী খাওয়ানো হচ্ছে?

বৃদ্ধ বুঝতেই পারলেন না কথাগুলো। অর্জুন হিন্দিতে বলতে তিনি পুরোহিতের পাশে বসা মহিলাকে প্রশ্নটা করলেন। জবাব শুনে জানালেন, জল ছাড়া কিছুই খেতে চাইছে না।

জুডি বলল, একে বলে মাংসের স্টু করতে। আজ চার ঘণ্টা অন্তর এক কাপ করে স্টু খাওয়াবে। কাল যদি জ্বর না আসে মশলা ছাড়া সেদ্ধ খাবার দেবে। এর লিভারে ব্যথা হয়েছে। কোনওরকম পরীক্ষা ছাড়া রোগ ধরা সম্ভব নয়। হার্টের কন্ডিশন ভাল নয়। জ্বর না এলে যেন ঘরের বাইরে যায়। এই ঘরে দেখছি হাওয়া ঢোকার উপায় নেই। কথা শেষ করে জুড়ি ব্যাগ থেকে শিশি বের করে ইঞ্জেকশন তৈরি করল। তারপর লোকটার হাতে ওষুধ ঢুকিয়ে দিল। মুখে একটু ভাঁজ পড়ল লোকটার। একবার তাকাল। বৃদ্ধ তাকে ওদের ভাষায় বোধহয় সান্ত্বনা দিল। জুড়ি চারটে ক্যাপসুল বের করে অর্জুনের হাতে দিল, আজ দুটো একসঙ্গে, সুপ খাওয়ানোর পর, আর কাল সকালে কিছু খাইয়ে খাওয়াতে বলবে।

অর্জুন বৃদ্ধকে সব বুঝিয়ে দিল। এমনকী সুপ কী করে তৈরি করতে হবে সেকথাও। বৃদ্ধ সেটা তর্জমা করে দিলে মহিলা মাথা নেড়ে ক্যাপসুলগুলো হাত পেতে নিল। বাইরে বেরিয়ে আসতে প্রধান এগিয়ে এসে তিনবার মাথা ঝুঁকিয়ে কিছু বলল। বৃদ্ধ তর্জমা করল, প্রধান বলছে তোমার কাছে সবাই কৃতজ্ঞ। তুমি একবেলাতেই পুরোহিতের জ্বর সারিয়ে দিয়েছ। এখন থেকে তোমাকে ওরা বন্ধু বলে মনে করছে। তাই তোমাদের কিছু খাওয়াতে চায় সবাই।

অর্জুন বলল, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছি। তা ছাড়া সন্ধের আগেই ফিরে যেতে হবে।

বৃদ্ধের তর্জমায় কান দিল না লোকগুলো। ওদের নিয়ে আসা হল মন্দিরের সামনে। বসার জায়গা এনে দিল। মেয়েরা জুডিকে দেখছিল কৌতূহলী চোখে। কেউ-কেউ এগিয়ে এসে ওর গায়ে হাত বোলাল। জুডি বিব্রত হলেও মুখে হাসি রেখেছিল। এইসময় খাদ্যদ্রব্য এল। বড়বড় ঘটিতে চমরি গোরুর দুধ, পোড়া মাংস আর প্রচুর পরিমাণে ছুরপি। অর্জুনের অনুরোধে দুধে চুমুক দিয়ে ছুরপি নিল জুড়ি। অর্জুনও মাংস খেল না। অনেক সাধাসাধিতেও নয়। এ কোন প্রাণীর মাংস আন্দাজ করা মুশকিল। আকৃতি দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্রাণীটি ছোট নয়।

দুধটাও শেষ করতে পারল না ওরা। ছুপিগুলো পকেটে রেখে রওনা হল ওরা। অর্জুন দেখল চারজন গ্রামবাসী ওদের সঙ্গে চলেছে। প্রচুর পরিমাণে শীতবস্ত্র পরে ওদের দিকে তাকিয়ে সংকোচ হচ্ছিল তার। কম্বল জাতীয় বস্তু শরীরে জড়িয়ে হাঁটছে। মাথায় কিছু নেই। পায়ে টায়ারের চটি। ওরা ওদের এগিয়ে দিতে চলেছে বুঝতে পেরে নিষেধ করল অর্জুন। ওরা শুনছিল না। অনেক চেষ্টার পর ওদের ফেরত পাঠাতে পারল সে।

জুড়ি চুপচাপ দেখছিল। ওরা চলে যেতে সে বলল, আমি না বলে পারছি না এই মানুষগুলোর মন খুব ভাল।

অর্জুন বলল, চিরকালই নিঃস্ব মানুষেরা ভাল হয়।

কেন?

ওদের মনে জটিলতা থাকে না।

জন বলছিল ওরা আমাদের ওপর খুব রেগে আছে। হয়তো ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু কিছুই করল না। জুডি হাঁটতে-হাঁটতে বলল।

উপকার পেলে এরা মনে রাগ পুষে রাখে না।

জুডি হাসল, আচ্ছা তুমি কি প্রাইভেট ডিটেকটিভ? জন যখন বলেছিল তখন আমি ভেবেছিলাম শার্লক হোমসের মতো কেউ পাইপ হাতে আসবে। তোমাকে দেখে খুব হতাশ হয়েছিলাম। তুমি ওদের চুরি হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো উদ্ধার করতে পারবে?

জানি না। আজ দুবার ওখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনও কু পাইনি।

তা হলে?

দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে?

আচ্ছা, গল্পের বইয়ে দেখেছি গোয়েন্দারা কখনও ব্যর্থ হয় না। তাই না?

ব্যর্থ হলে পাঠক সেই গোয়েন্দার গল্প আর পড়বে না।

তুমি কি কখনও ব্যর্থ হয়েছ?

অনেকবার। তবে আমার ভাগ্য ভাল, সেগুলো প্রচারিত হয়নি।

দিনটা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সূর্যদেব পশ্চিমের আকাশে আরও কিছুক্ষণ হয়তো থাকবেন কিন্তু পাহাড় তাঁকে আড়াল করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। অর্জুন দেখল হঠাৎ বরফের চেহারা বদলে গেল। অপূর্ব এক মায়াময় আলো এখন চারপাশে ছড়িয়ে। এই আলোতে কোনও তেজ নেই। ন্যাতানো, মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মতো অস্বস্তিকর অর্জুন বলল, তাড়াতাড়ি। সন্ধে নেমে গেলে খুব মুশকিল হবে।

কী হবে?

রাস্তা হারিয়ে ফেললে সারারাত এখানে বেঁচে থাকব না।

এখানে রাস্তা কোথায়?

বাঃ, আমাদের পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি না?

তখনও ক্যাম্প নজরে পড়ছে না। হঠাৎ জুড়ি দাঁড়িয়ে গেল।

অর্জুন পেছনে ছিল, জিজ্ঞেস করল, কী হল?

কোনদিকে যাব? এদিকেও ছাপ ওদিকেও ছাপ।

অর্জুন দেখতে পেল। নরম বরফে পায়ের ছাপ পড়েছে। দুদিকে দুটো লাইন। ডানদিকের ছাপটা এই অবধি এসে আবার ফিরে গিয়েছে। সেই ছাপ মানুষের পায়ের নয়।

অর্জুন বলল, একটু ওপাশে গিয়ে দেখি। এসো।

ওটা তো আমাদের পায়ের ছাপ নয়।

না। ওরা খানিকটা হেঁটে একটা বরফের টিলার ওপর উঠে এল। সামনেই পাহাড়, মাঝখানে দুটো ফুটবল-মাঠের মতো জায়গা বরফে ঢাকা। হঠাৎ জুডি অর্জুনের হাত শক্ত করে চেপে ধরে চাপা গলায় বলল, লুক, লুক!

জুডির হাত লক্ষ করে অর্জুন দেখল, বরফের ওপর একটা কালো প্রাণী হেঁটে যাচ্ছে। আলো কমে যাওয়ায় এবং দূরত্ব থাকায় স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু প্রাণীটি তাদের দিকে পেছন ফিরে হেঁটে আচমকা কোথায় মিলিয়ে গেল। জুড়ি চিৎকার করে উঠল, ইয়েতি! আই অ্যাম শিওর। ইটস ইয়েতি।

অর্জুন কোনও কথা বলতে পারল না। নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কী করে?

জুড়ি বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে চলো। জনকে বলতে হবে ব্যাপারটা। এখনই যদি ওই পায়ের চিহ্ন ধরে খোঁজা যায় তা হলে পৃথিবীর আশ্চর্যতম আবিষ্কারটা করে ফেলব আমরা।

ক্যাম্পে পৌঁছবার শেষদিকটায় প্রায় অন্ধকারে হাতড়াতে হয়েছিল। তাঁবুর আলো তাদের পৌঁছতে সাহায্য করল। জন খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, এ কী কাণ্ড। তোমরা এত দেরি করলে? চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এখনই আমরা রওনা হচ্ছিলাম তোমাদের খুঁজতে। ওরা কি তোমাদের আটকে রেখেছিল?

জুড়ি প্রবলভাবে মাথা নাড়ল, নো, নো। ওরা খুব ভাল লোক। ফিরে আসার সময় এমন একটা জিনিস দেখলাম যা তোমরা ভাবতে পারবে না।

কী জিনিস?

ইয়েতি। উত্তেজিত গলায় বলল জুডি।

দলের অন্য সদস্যরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ডানা বলল, জন, তুমি বলেছিলে ইয়েতি বলে কিছু নেই। তোমরা ওর আগে প্রমাণ করেছ। তা হলে ডক্টর জুডি সেটাকে দেখলেন কী করে?

জুডি রেগে গেল, অর্জুনকে জিজ্ঞেস করো।

সবাই অর্জুনের দিকে তাকাল। অর্জুন বলল, আমি একটা প্রাণীকে হেঁটে যেতে দেখেছি। বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। অনেকটা দূরে ছিল ও, আমাদের দিকে পেছন ফেরা। ওটা যে ঠিক কী, তা বলতে পারব না।

জন বললেন, জুড়ি ভুল করছে। হয়তো আশপাশের কোনও গ্রামের মানুষ যাচ্ছিল। ওরা সন্ধের সময়েও আসা-যাওয়া করতে অভ্যস্ত।

অর্জুন মাথা নাড়ল, না। ওই প্রাণী মানুষ নয়। ওর পায়ের ছাপ অনেক বড় এবং গোল।

কথাটা শোনামাত্র জন চেঁচামেচি করে শেরপাদের ডাকতে লাগলেন। তারা এলে জন বললেন, আমার মনে হচ্ছে তুষার-ভালুক আমাদের খুব কাছে চলে এসেছে। অর্জুনরা ওর পায়ের ছাপ দেখে এসেছে। এখন না গেলে রাত্রে যে তুষার পড়বে তাতে আর কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। চলো, বেরিয়ে পড়ি।

শেরপাদের নেতা বলল, আপনি আদেশ করলে আমরা যেতে বাধ্য। কিন্তু আপনার তো অভিজ্ঞতা আছে সার। অন্ধকারে টর্চ নিয়ে গেলেও বরফের ওপর হেঁটে যাওয়া উচিত নয়।

আমি জানি। কিন্তু এমন সুযোগ সবসময় পাওয়া যায় না।

শেরপাদের নেতা অর্জুনের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনতে চাইল। অর্জুন বলার পর লোকটা মাথা নাড়ল, সার, সুযোগ আবার পাওয়া যাবে।

কী করে বলছ?

জানোয়ারটা মানুষের পায়ের ছাপ পর্যন্ত এসে ফিরে গিয়েছে। ও এক ছিল। গ্রামের মানুষদের সম্পর্কে ওদের তেমন কৌতূহল নেই। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে নিশ্চয়ই আছে। এই কারণেই আবার ফিরে আসবে। নরম বরফের ওপর ওরা চার পায়ে হাঁটে বলে বিপদে পড়ে না। আমরা পড়তে পারি।

জুড়ি বলল, কিন্তু ওটা দুপায়ে হাঁটছিল।

ও নিজের পায়ের ছাপ দেখে ফিরে যাচ্ছিল বলে জানত দু পায়ে হেঁটে গেলে বিপদে পড়বে না। ওরা মানুষকে নকল করে দু পায়ে হাঁটে যখন ইচ্ছে হয়।

যে-যার তাঁবুতে চলে গেলে জনকে পুরোহিতের কথা বলল অর্জুন। জন মন দিয়ে শুনে বললেন, এটা খুবই মানবিক কাজ কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।

কীরকম?

লোকটার আয়ু যদি সত্যি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তা হলে কোনও চিকিৎসায় কাজ হবে না। তা ছাড়া হসপিটালে যেভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব তা এখানে জুডি করতে পারবে না। লোকটা মরে গেলে ওদের মনে হবে তোমাদের দেওয়া ওষুধ খেয়ে মারা গেল। তাই না?

আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ক্রোসিন ট্যাবলেট খেয়ে লোকটার জ্বর কমে গিয়েছিল। জুড়ি বলেছে অবশ্য, ওর অবস্থা ভাল নয় কিন্তু এখনও মারা যাওয়ার আশঙ্কা নেই। ওকে সুস্থ করে তুলতে হবেই। সাময়িকভাবে হলেও সুস্থ করা দরকার। অর্জুন জোর গলায় বলল।

কেন?

মন্দির থেকে জিনিসগুলো যে রাত্রে চুরি হয় তারপরেই লোকটা অসুখে পড়ে। আমি জানি না সেই রাত্রে পুরোহিত মন্দিরে ছিল কিনা।

ইন্টারেস্টিং।

একটু পরেই ঝড় শুরু হল। দিনের আকাশ পরিষ্কার ছিল। কিন্তু সন্ধের কিছু পরেই যে প্রকৃতি রুদ্র চেহারা নেবে, ভাবা যায়নি। পাহাড়ের আড়ালে থাকায় সরাসরি ঝড়ের আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে না তাঁবুগুলোকে। কিন্তু তার শোঁ-শোঁ আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল কয়েকশো রাগী বাইসন দৌড়ে যাচ্ছে। জন বিড়বিড় করে বললেন, দিস ইজ ব্যাড। খুব খারাপ। এরকম ওয়েদার আমি পছন্দ করছি না।

ঘড়িতে এখন মাত্র সাতটা বেজে দশ। অর্জুন তাঁবুর দরজা খুলে বাইরে তাকাল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সামনের পৃথিবীতে যে তাণ্ডব চলছে তা বুঝতে পারা যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন শেরপা দৌড়ে তাদের রাতের। খাবার নিয়ে এল।

জন লোকটাকে বললেন, তোমরা খুব ভাল পরামর্শ দিয়েছ। তখন বের হলে খুব বিপদে পড়তাম। লোকটা খুশি হয়ে চলে গেল।

খাওয়া শেষে প্রাকৃতিক কাজ করতে বাইরে বের হতে হল। ঠাণ্ডা বেড়ে গেছে খুব। জন বললেন, তুষারঝড় হচ্ছে। সকালে কোনও পায়ের চিহ্ন খুঁজে পাব না।

শুতে যাওয়ার আগে জন সবকটা তাঁবু ঘুরে এলেন। ঝুলন্ত বিছানায় শুয়ে আজ অর্জুনের খুব রোমাঞ্চ লাগছিল। এতদিন বইয়ের পাতায় যা পড়ে এসেছে আজ তা বাস্তবে ঘটছে। আজকের তুষারঝড় অথরা এস্কিমোদের নিয়ে কত কাহিনী লেখা হয়েছে। বাংলা কোনও গল্প-উপন্যাসে এসব পাওয়া যায়নি। অথচ হিমালয় কত কাছে। এক ঘণ্টা উড়ে গেলেই বরফের রাজত্বে পৌঁছনো যায়। আচ্ছা, যদি ওই প্রাণীটা সত্যি ইয়েতি হয়?

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে-ভারতে কখন ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল চিৎকার শুনে। শেরপারা চেঁচাচ্ছে। তাদের গলা দাপিয়ে জনের কণ্ঠস্বর কানে এল, ডোন্ট শুট। কেউ বন্দুকের আওয়াজ কোরো না।

ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নীচে নেমে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি শীতবস্ত্র জড়িয়ে বাইরে এসে অর্জুন দেখল মশালের মতো আলো হাতে নিয়ে শেরপারা তখনও চেঁচিয়ে চলেছে। দলের অন্য সদস্যরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তাকে দেখে ডানা এগিয়ে এসে বলল, এতক্ষণে ঘুম ভাঙল!

কী হয়েছে? অর্জুন ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না।

তুষার-ভালুক এসেছিল। শেরপারা বলছে দুটোকে দেখেছে।

কোথায়?

আমাদের তাঁবু আঁচড়াচ্ছিল। আমার ঘুম ভেঙে যেতে চিৎকার করি। তখন শেরপারা বেরিয়ে পড়ে ওদের তাড়ায়।

তুমি দেখেছ?

বা রে! আমি দেখব কী করে? আমি তো তখন তাঁবুর ভেতরে ছিলাম।

এইসময় একজন সদস্য এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এত তাঁবু ছিল, কিন্তু তোমাদেরটায় ওরা পৌঁছল কেন?

ডানা মাথা নেড়ে বলল, জানি না।

অর্জুন বলল, আমার মনে হয় ওদের কেউ আহত অথবা অসুস্থ হয়েছে।

ডানা চোখ বড় করল, তার মানে?

ওরা বোধহয় ডাক্তারের কাছে এসেছিল।

সবাই মজা পেয়ে হেসে উঠল। শুধু জুড়ি রাগত ভঙ্গিতে বড়বড় পা ফেলে তার তাঁবুর ভেতর চলে গেল! ডানা বলল, হয়ে গেল। তোমার সঙ্গে ঘুরে আসার পর ও আজই একটু ভাল মুডে ছিল, তুমি তার বারোটা বাজিয়ে দিলে।

প্রাণীগুলো এখন কাছাকাছি নেই বোঝার পর জন সবাইকে নিয়ে মিটিং করলেন। শুধু জুডি তার তাঁবু থেকে বের হল না।

জন বললেন, আমি শুনেছি এই ধরনের ভালুকরা মানুষকে নকল করতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু নিজে থেকে আক্রমণ করে বলে শুনিনি। এমন হতে পারে খাবারের গন্ধ পেয়ে ওরা এখানে চলে এসেছিল। আমরা কখন ঘুমোচ্ছি, কখন জেগে আছি এই পার্থক্যটা ওরা করতে পেরেছে। তাই আত্মরক্ষার জন্যে আমাদের একজন সদস্য আর একজন শেরপা প্রত্যেক রাত্রে জাগবে। যে জাগবে সে পরের দিন বিশ্রাম পাবে। যারা জাগবে তারা সন্দেহজনক কিছু দেখলেই চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দেবে।

একজন সদস্য জিজ্ঞেস করলেন, সেটা দেখতে হলে তো খোলা আকাশের নীচে বসে থাকতে হয়। তা কি সম্ভব?

জন মাথা নাড়লেন, তা সম্ভব নয়। তিনি আর একটা তাঁবু খাটাতে বললেন যার সামনের দিকটা খোলা থাকবে। মাথার ওপর এবং পেছনের পাহাড়ের দিকটায় আড়াল থাকবে। দুপাশের আড়াল দেখার কাজে অসুবিধে ঘটাবে না। ওরা যখন তাঁবু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন অর্জুন জুড়িদের তাঁবুতে গেল।

ভেতরে আসতে পারি?

কী ব্যাপার? জুডি একটা চেয়ারে বসে ছিল।

আমি তোমার সঙ্গে রসিকতা করেছিলাম। তুমি রেগে গেছ বলে আমি

দুঃখিত।

হ্যাঁ, আমি তো এখানে রসিকতার বস্তু।

তার মানে?

সারাটা সন্ধে ডানা আমাকে খেপিয়েছে ইয়েতি দেখেছি বলে। তারপর তুমিও–। কথা শেষ করল না জুডি।

আচ্ছা, যদি ইয়েতি বলে কিছু থাকে, যাকে দেখেছি সে যদি সত্যি ইয়েতি হয় আর আহত হয়ে তোমার কাছে চিকিৎসার জন্যে আসে তা হলে তুমি তার চিকিৎসা করবে না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

জুডি অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, অবশ্যই।

রসিকতাকে ওইভাবে নাও না! সত্যি আমি তোমাকে আহত করতে চাইনি। আমি বলি কী, জন চাইছে দুজন করে রোজ রাত জাগুক। আমাদের তো কাল সকালে কোনও কাজ নেই, তাই আমরাই প্রথমদিন পাহারাটা দিই। কি, তোমার আপত্তি আছে?

আমি?

হ্যাঁ। আমিও থাকব। যদি আবার ওরা আসে তা হলে দেখে বুঝতে পারব শ্বেত-ভালুক না ইয়েতি, কোনটা ঠিক।

দ্যাটস এ গ্রেট আইডিয়া। উঠে দাঁড়াল জুডি।

অবশ্য জন রাজি হবে কিনা জানি না।

কেন?

এত হেলে থাকতে মেয়েদের এই দায়িত্ব দিতে চাইবে কি?

ওকথা বললে আমি প্রতিবাদ করব।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে জুডি সোজা জনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, জন, আজ রাত্রে আমি পাহারা দিতে চাই। তোমার আপত্তি আছে?

জন জুডির মুখের দিকে তাকালেন, বিন্দুমাত্র নয়।

এমন উত্তর জুড়ি আশা করেনি। সে অর্জুনকে দেখল, তারপর বলল, আমি তো ক্যাম্পে সারাদিন বসেই থাকব। দলের সবাই কাজে যাবে। তাই আমার রাত জাগতে কোনও অসুবিধে হবে না।

জন মাথা নাড়লেন, সেকথা ঠিকই। তবে ডানাকে তোমার সঙ্গে দিতে পারছি না।

ডানা বলল, আমার মনে হয় অর্জুন জুডির সঙ্গে থাকতে পারে।

অর্জুন বলল, আমার আপত্তি নেই।

একটা রাইফেল দেওয়া হল ওদের। বলা হল বিপজ্জনক কিছু দেখতে পেলে শূন্যে গুলি ছুড়তে কোনও অবস্থাতেই যেন তুষার-ভালুককে আঘাত করা হয়।

জুডি এবং অর্জুন বসে ছিল সদ্য নির্মিত ছাউনির নীচে। ওদের পেছনে পাহাড়ের আড়াল। একপাশে ক্যাম্পের বিছানাগুলোতে যে-যার মতো আরামে ঘুমোচ্ছে। যে-কোনও প্রাণীকে ওদের তাঁবুর দিকে পৌঁছতে হলে ওদের সামনে দিয়ে এগোতে হবে। অর্জুন সমস্ত শরীর মুড়ি দিয়ে বসেও ঠাণ্ডা এড়াতে পারছিল না। মাথার ওপর আচ্ছাদন রয়েছে, কিন্তু সামনের খোলা অংশ দিয়ে ঠাণ্ডা যেন হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে। সে জুডির দিকে তাকাল। ওকে এখন মেয়ে বলে আলাদা করা যাবে না। দুটো চেয়ারে সারারাত জেগে বসে থাকতে হবে ওদের। সামনের অন্ধকার এখন অনেক চোখ-সয়ে গেছে। আকাশে মেঘ নেই। ওই তুষার-ঝড়ের পর একটা দারুণ ঝকঝকে আকাশ অজস্র তারা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এত দ্রুত প্রকৃতির চেহারা বদলে যায়।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নিউজিল্যান্ডে এমন ঠাণ্ডা পড়ে?

জুডি মাথা নাড়ল, না। এইসময় স্লিপিং ব্যাগের ভেতর যারা আছে তারা সত্যি ভাগ্যবান। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।

কী?

ইয়েতিদের গায়ে নিশ্চয়ই খুব জোর হয়? ইয়েতিদের কেউ দ্যাখেনি।

যেন ভগবানকে সবাই দেখেছে! এমন কথা বলো!

তা হলে নিশ্চয়ই হয়। এই বরফের ওপর দুর্বল প্রাণী বাঁচতে পারে না।

উঃ কী ঠাণ্ডা! তুমি সিগারেট খাও?

খেতাম। এখন চেষ্টা করছি না খেয়ে থাকতে।

কিন্তু এই ঠাণ্ডায় একটা সিগারেট ধরালে ভাল হত।

সরি। আমার সঙ্গে প্যাকেট নেই।

তারপর কোনও কথা নেই। দুজনেই চুপচাপ। অর্জুন দেখল আকাশের তারারা বরফের ওপর জোনাকি-জোনাকি-আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এখন অন্ধকার তেমন নেই। এই বরফের পৃথিবীটাকে কী মায়াময় মনে হচ্ছে এখন। অথচ এইসময় ওখানে বেড়াতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। কোথায় বরফের খাদের ওপর তুষার জমে আছে, পা দিলেই তলিয়ে যেতে হবে।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল অর্জুন, জুডির হাত তাকে স্পর্শ করা মাত্র সে দেখতে পেল, গুঁড়ি মেরে কিছু এগিয়ে আসছে ডানদিক থেকে। না, ওরা ইয়েতি তো দূরের কথা, বড়সড় কোনও জানোয়ারও নয়। একসঙ্গে চারটে। প্রথমে মনে হয়েছিল কুকুর, কিন্তু তারপর চিনতে পারল! বড় লোমওয়ালা চারপেয়ে জন্তুগুলো শেয়াল ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই বরফের ওপর শেয়াল

কোত্থেকে এল?

জুডি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী করবে?

কিছু না। শুধু দেখে যাও। ফিসফিস করে বলল অর্জুন।

শেয়াল চারটে শেষপর্যন্ত সাহসী হয়ে এগোতে লাগল। তারপর হঠাৎই ওদের একজন ঘুরে মুখ ওপরে করে নাক টানতে লাগল। জলপাইগুড়িতে যে শেয়াল অর্জুন দেখেছে তার চেয়ে অনেক বড় এবং শক্তিশালী এরা। অর্জুন আচমকা হ্যাট বলে চেঁচিয়ে উঠতেই ওরা ছিটকে অনেকটা দূরে চলে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। এবার ওরা বুঝতে পেরেছে মানুষ জেগে আছে। একজন দুই থাবায় বরফ ছিটোল। একজন গোঁ-গোঁ করতে লাগল রাগে। ঠিক তখনই দূরে, বহু দূরে অদ্ভুত একটা আওয়াজ হল। যেন কিছু ডেকে উঠল। অস্পষ্ট আওয়াজ। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া হল খুব। শেয়াল চারটে দ্রুত মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।

জুড়ি জিজ্ঞেস করল, কীসের আওয়াজে ওরা ভয় পেল?

অর্জুন বলল, বোধহয় আরও বড় কোনও জন্তু।

জুডি বলল, আমি ভাবতেই পারছি না এই আদিগন্ত বরফের রাজ্যে জন্তুগুলো কী করে থাকে? খায় কী?

নিশ্চয়ই প্রকৃতি ওদের খাবার জোটায়। মেরুদেশের তুষার-ভালুকরা শুনেছি সিল মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার ওদের খাওয়ার পর যেটুকু পড়ে থাকে তাই খেয়ে বাঁচে শেয়ালজাতীয় প্রাণীরা। অর্জুন বলল।

আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ। জ্যোৎস্নায় চারপাশ স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে। জুড়ি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না জন কেন বরফের ওপর ক্যাম্প করল। ওই ওপাশের পাহাড়ে তো শুকনো জায়গা অনেক পড়ে আছে, যেমন ওই গ্রামটা, ওরকম কোনও জায়গায় ক্যাম্প করলে পায়ের নীচে এত ঠাণ্ডা হত না!

আমি জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, এখানে ক্যাম্প করলে তুষার-ভালুকের কাছাকাছি থাকা যাবে। বরফের ওপর দিয়ে সোজা এখানে ওরা চলে আসতে পারে।
সারারাত জেগে দিনের আলো ফুটলে ঝুলন্ত বিছানায় গিয়েছিল অর্জুন। ঘুম যখন ভাঙল, তখন দুপুর। ক্যাম্প ফাঁকা। অভিযাত্রীরা বেরিয়ে গেছে অনুসন্ধানে। তৈরি হয়ে এক মগ চা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে সে গেল জুডির তাঁবুতে। দুবার ডেকেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না তখন বুঝল মেয়েটা এখনও গভীর ঘুমে

এখানে স্নান করার বালাই নেই। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে বেশ কষ্ট হয়। আজ ব্রেকফাস্ট খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অর্জুন দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল। ওই ভারী জুতো, মোজা থেকে টুপি পর্যন্ত সমস্ত শরীর ভারী শীতবস্ত্রে মুড়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে মোটেই স্বচ্ছন্দ নয় সে। তবে গতকালের চেয়ে আজ একটু জোরে পা ফেলতে পারছে। অভিযাত্রীরা এদিকে যায়নি! কিন্তু গতকাল সে আর জুড়ি যে আসা-যাওয়া করেছিল তার কোনও চিহ্ন বরফের ওপর নেই। গত রাত্রে বয়ে যাওয়া তুষারঝড় এবং শেষে পড়া মিহি তুষার সেসবের ওপর যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ফলে যে জায়গা থেকে সেই অজানা প্রাণীর পায়ের চিহ্ন শুরু হয়েছিল তার হদিস পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

গতকালের মতো আজও গ্রামবাসীরা তাকে দেখে উল্লসিত হল। অর্জুন দেখল, দোভাষী হাসিমুখে এগিয়ে আসছে, আমি তোমার ওখানে যাব বলে ভাবছিলাম।

কেন? অর্জুন অবাক হল।

আমাদের পুরোহিত উঠে বসেছে, কথা বলেছে। শুনলাম গতকাল তোমার সঙ্গে একজন মহিলা এসেছিলেন, তিনি ভাল ওষুধ দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম না বলে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হয়েছিল, তাই না?

না, তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি। তবু লোকটাকে হতাশ করল না অর্জুন।

সে সোজা চলে গেল পুরোহিতের বাড়িতে। পেছনের ভিড়টাকে বাইরে রেখে দোভাষীর সঙ্গে ভেতরে ঢুকল অর্জুন। তাদের দেখে পুরোহিত উঠে বসে একগাল হাসল। কিন্তু সেই মহিলা চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন রাগত ভঙ্গিতে। অর্জুন কারণ জানতে চাইলে দোভাষী বলল, সুস্থ হতেই পুরোহিত নাকি আর সুপ খেতে চাইছে না। অথচ ওই খেয়েই তো সুস্থ হয়েছে। তাই ওর বউ রাগারাগি করছে।

অর্জুন পুরোহিতের শরীর ছুঁয়ে দেখল, একদম স্বাভাবিক উত্তাপ। আপাতচোখে মনে হচ্ছে সুস্থ। কিন্তু জুডি বলেছে অবিলম্বে ওকে হাসপাতালে ভর্তি না করলে ফল খারাপ হবে। এই সুস্থতা খুবই সাময়িক।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কথা বলতে পারবে?

দোভাষী তর্জমা করতেই লোকটা চটপট জবাব দিল। কথাবার্তা বলতে লাগল তর্জমার মাধ্যমে, কথা বলা কী, আমি এখন দৌড়তে পারি। কিন্তু আমার বউ কিছুতেই এই ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছে না।

উনি ভালই করছেন। তুমি তো পুরোহিত?

হ্যাঁ। আমার বাবাও এই কাজ করত।

তোমার ছেলেমেয়েরা কোথায়?

কেউ নেই। আমার ছেলেমেয়ে নেই।

যে রাত্রে মন্দির থেকে চুরি হল সে রাতে তুমি ওখানে ছিলে? লোকটি চট করে মাথা নামিয়ে নিল।

অর্জুন বলল, সবাই বলছে তুমি ছিলে। ভোরবেলায় তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপরই জ্বর আসে ঠিক তো?

লোকটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

তুমি কি রোজ মন্দিরে থাকতে?

না।

তা হলে সেদিন ছিলে কেন?

আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নটা কী মনে নেই। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর খুব খারাপ লাগছিল। বউকে বললাম মন্দির থেকে ঘুরে আসি। তাতে মন ভাল হয়ে যাবে। তাই মন্দিরে গিয়েছিলাম।

তখন কটা বাজে?

এখানে সময় কেউ বলতে পারবে না। তবে রাত শেষ হতে বেশি দেরি ছিল না। চাঁদ আকাশের অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল।

তখন মন্দিরে কেউ ছিল?

না।

মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল?

হ্যাঁ। আমি গিয়ে খুলি।

তারপর?

মন্দিরে প্রদীপ জ্বলছিল। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল। বাইরে কিছু নড়ছে। তাকিয়ে দেখি ওই শয়তানের পাথরটার ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ভয়ংকর ভূত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল, পেটে যন্ত্রণা শুরু হল। আমি চিৎকার করতে গেলাম কিন্তু কোনও শব্দ বের হল না। এইসময় ভূতটা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি আর কিছু মনে করতে পারছি না। ওঃ! লোকটার শরীর আবার কেঁপে উঠল।

তুমি কি জানো মন্দির থেকে পবিত্র মাথা আর চামড়া চুরি গিয়েছে?

আমাকে বউ বলেছে।

কে চুরি করেছে জানো?

আমি জানি না। সত্যি বলছি জানি না।

ভয়ংকর ভূতটাকে দেখতে কেমন?

লোকটা চোখ বন্ধ করল, লম্বা, বিশাল চেহারা, মুখটা বীভৎস। গায়ে লম্বা লোম ছিল। হেঁটে আসছিল পাহাড়টাকে আড়াল করে।

কোনও কথা বলেছে?

না। বললেও আমি শুনিনি। আমার কোনও হুঁশ ছিল না।

বাইরে বেরিয়ে এসে অর্জুন দোভাষীকে বলল, ওকে যদি বাঁচাতে চাও তা হলে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাও।

কেন? ও তো ভাল হয়ে গেছে! দোভাষী অবাক!

এটা খুব সাময়িক। সেই রাত্রে ও মনে ধাক্কা খেয়েছিল। হয়তো সেই কারণে বুকের রোগ হতে পারে। ওর পেটে যে ব্যথা আছে তা এতদিন চাপা ছিল বলে নিজেই টের পায়নি। এখন এইসব বড় হয়ে উঠবে।

কিন্তু হাসপাতাল তো অনেকদূরে।

নিয়ে যাওয়া যাবে না?

ওখানে নিয়ে যেতে বাহকদের যে টাকা দিতে হবে তা পুরোহিতের নেই। যদি সত্যি হয় তোমার কথা তা হলে ওর এখানেই মরে যাওয়া উচিত, তাতে ও শাস্তি পাবে।

বুঝতে পারছি। যদি আমাদের হেলিকপটার এর মধ্যে আমাদের ক্যাম্পে আসে তা হলে ওকে কাঠমপুর হাসপাতালে পাঠাতে পারি। এতে নিশ্চয়ই তোমরা আপত্তি করবে না?

ওখানে একা গেলে ও মরে যাবে। কথা বলার লোকই পাবে না।

পাবে। তোমাদের গ্রামের একটা ছেলে ওখানকার ডাক্তার। অর্জুন বলল, সে ওর দেখাশোনা করবে।

দোভাষীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে প্রস্তাবটা পছন্দ করছে না। বলল, এই ব্যাপারটা নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমরা তো এখানে জন্মেছ। যে-কোনও কাজে কোথাও যেতে হলে বরফের ওপর দিয়ে যেতে হয়। তুমি কখনও তুষার-ভালুক দেখেছ?

অনেকবার দেখেছি। কতবার দেখেছি মনে নেই।

ওরা এখানে আসে?

একসময় ওরা খুব জ্বালাত। ফসল নষ্ট করে দিত। ওপরের পাহাড়ে ভুট্টা যখন পাকত তখন হামলা করত। আমরা ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না।

তারপর?

আমরা লক্ষ করেছিলাম ওরা মানুষকে খুব নকল করে। দূর থেকে কোনও মানুষকে হাঁটতে দেখলেই ওরা পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর রেখে হেঁটে চলে। ওই যে ডানদিকের বরফের পাহাড়ের ওপাশে ওদের ডেরা। ভুলেও কেউ ওদিকে যাই না। একবার আমরা বিকেলের দিকে ওই পাহাড়ের নীচে গেলাম দল বেঁধে। একটা বড় পাত্রে জল রেখে দুটো দলে আলাদা হয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট করতে লাগলাম। পুরোটাই ছিল অভিনয়। মার খেয়ে যে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সে-ও সেটা অভিনয় করেই করছিল। তারপর সবাই ওই পাত্রে মুখ লাগিয়ে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল। আমরা জানতাম ওরা নিশ্চয়ই আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করছে। চলে আসার আগে ওই জলের সঙ্গে খুব কড়া মদ মিশিয়ে দিলাম। ওরকম মদ একপাত্র খেলে মানুষ একদিনরাত ঘুমিয়ে থাকবে। ওখান থেকে সরে এসে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা লক্ষ করছিলাম। সেদিন ছিল চাঁদের রাত। তাই অন্ধকার নামল না। জ্যোৎস্নায় ওপর থেকে নেমে এল গোটাচারেক ভালুক। আমরা যেখানে যুদ্ধ করেছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দিল ওরা। একেবারে হুবহু নকল করছিল ওরা। তারপর ক্লান্ত হলে আমাদের মতো পাত্রে মুখ ড়ুবিয়ে পান করতে লাগল একের পর এক। কিছুক্ষণ বাদে দেখলাম ওরা টলছে এবং শেষ পর্যন্ত মাটিতে পড়ে গেল। আমরা তখন ছুটে গিয়ে নেশায় অজ্ঞান হওয়া ভালুকদের মেরে ফেললাম। ওদের চামড়া খুব কাজে লেগেছিল। দুদিন ধরে মাংস খেয়েছিল গোটা গ্রাম। তারপর থেকে ওরা আর ঝামেলা করেনি।

ঘটনাটাকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও অর্জুন কিছু বলল না। দোভাষী যে পাহাড়টাকে তুষার-ভালুকের এলাকা বলে দেখিয়েছিল সেদিকটা ভালভাবে দেখে রাখল।

সন্ধের আগেই ক্যাম্পে ফিরে এল অর্জুন।

ক্যাম্পের খবর ভাল। অভিযাত্রীদের একটা দল পায়ের চিহ্ন দেখে অন্তত আধ মাইল দূরে তুষার-ভালুকদের একটা দলকে দেখতে পেয়েছে। ডানা টেলিফোটোতে তার ছবি তুলেছে। কিন্তু মুভি ক্যামেরায় সেই ছবি ওঠেনি, ওঠার কথাও নয়। স্টিল ছবি কাঠমণ্ডতে না পাঠালে প্রিন্ট হবে না। দ্বিতীয় দিনেই এই সাফল্যে সকলে খুব খুশি। সকলে এই নিয়ে কথা বলছিল। অর্জুন

তাঁবুতে ফিরে চেয়ারে বসতেই জুডি এল, লোকটার কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। এখন কথা বলছে, উঠে বসেছে।

কিন্তু…।

আমি বলেছি আজও, ওরা হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইছে না। আচ্ছা, এমন হতে পারে না, কোনও কিছু দেখে শক পেয়েছে লোকটা। আর তা থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্বর এসেছিল। অর্জুন জানতে চাইল।

হতে পারে। কিন্তু ওর পেটে যে ব্যথা আছে সেটার পরীক্ষা হওয়া উচিত। জুড়ি বেরিয়ে গেল।

একটু বাদে জন এলে অর্জুন আজকের ঘটনাটা জানাল। জন বললেন, হেলিকপটারে লোকটাকে কাঠমণ্ডর হাসপাতালে পাঠাতে তাঁর আপত্তি নেই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, পুরোহিত লোকটার কথা কি বিশ্বাস করছ?

না করার তো কিছু নেই।

ও যা বর্ণনা দিয়েছে বলছ, সেরকম প্রাণী তো গোরিলা জাতীয় কিছুর সঙ্গে মিলছে। ঠাণ্ডার ধারেকাছে গোরিলা থাকে না বলে শুনেছি। এই অঞ্চলে তো নয়ই। মনে হচ্ছে লোকটা ভুল দেখেছে।

আমারও তাই মনে হয়েছে। তবে যাই দেখুক, লোকটা খুব ভয় পেয়েছে। আর সেই রাতের আগন্তুকই জিনিসগুলো চুরি করেছে।

তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ওর পরিচয় কী?

আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্জুন বলল, আচ্ছা, বলুন তো, আপনার এই দুদিন কোনদিকে গিয়েছিলেন?

জন একটা ম্যাপ দেখালেন। এটা কোনও ছাপা ম্যাপ নয়। এখানে আসার পর জন নিজেই ম্যাপটা তৈরি করেছেন।

অর্জুন ম্যাপটা দেখল। তারপর উলটোদিকের একটা অংশ দেখাল, আমার মনে হয় এই অঞ্চলে গেলে ওদের দেখা পেয়ে যাবেন।

কেউ তোমাকে বলেছে?

হ্যাঁ। গ্রামে যে লোকটা দোভাষীর কাজ করছে সে বলছিল।

হুম। ঠিক আছে।

গতরাত্রে পাহারা দেওয়ার সময় আমরা কয়েকটা শেয়ালকে দেখেছি। আর একটা বড় প্রাণীর গর্জন শোনামাত্র তারা পালিয়েছিল। আওয়াজটা এসেছিল ওইদিক থেকে। তাই বলছিলাম, শেরপাদের রাজি করিয়ে রাত্রে ওদিকে যাওয়া যায় না?

দেখলে তো, শেরপারা রাজি হয়নি। জন গম্ভীর গলায় বললেন।

মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। কী কাণ্ড, শেয়াল ডাকছে। এই বরফের রাজ্যে কয়েকটা শেয়াল পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছে। গতরাত্রে ঠাণ্ডা কী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। এখন এই স্লিপিং ব্যাগের আরাম থেকে বেরোতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। তাঁবুর ভেতর কোনও আলো নেই। কিন্তু অর্জুনের মনে হল শেয়ালরা মিছিমিছি ডাকবে কেন? ওদের তো গলা সাধার কোনও দায় নেই।

অন্ধকারে পাশের ঘুমন্ত বিছানা থেকে জনের গলা ভেসে এল, তুমি কি শেয়ালের ভাষা বুঝতে পারো?

না। অর্জুন হাসল।

তা হলে চলো, বাইরে বেরিয়ে দেখা যাক।

কৌতূহল যে হচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু শীতের কথা ভেবে উদ্যোগ নেয়নি অর্জুন। এবার স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে যাবতীয় পোশাক এবং জুতো-মোজা পরে নিল অন্ধকারেই জনের গলা শুনতে পেল, রেডি?

হ্যাঁ।

তাঁবুর বাইরে অদ্ভুত দৃশ্য। আজকের জ্যোৎস্না গতরাতের চেয়েও জোরালো। কী চকচকে দেখাচ্ছে পৃথিবীটাকে। বরফের ওপর জ্যোৎস্না পড়ায় একটা হলদে আলো ছিটকে উঠেছে। আজ রাত্রে যারা পাহারায় ছিল তারা এগিয়ে এল।

জন জিজ্ঞেস করলেন, কিছু দেখেছ?

ফ্রেমিং বললেন, তেমন কিছু নয়। কয়েকটা শেয়াল অনেকক্ষণ থেকে ঘুরঘুর করছিল আশপাশে। হঠাৎই ওরা দূরে চলে গিয়ে এইভাবে ডাকাডাকি করছে। জন অর্জুনকে বললেন, ডানাকে ঘুম থেকে তোলা যায় কিনা দ্যাখো তো।

মেয়েটা যে এমন ঘুমকাতুরে, তা জানতে পারল অর্জুন। ক্যাম্পের সবাই যখন জেগে গিয়েছে তখনও ওর সাড়া নেই। শেষপর্যন্ত জুড়ি ওর ঘুম ভাঙাল। পোশাক পরে বাইরে এসে অর্জুনকে দেখে ডানা হাসল, কী ব্যাপার? যুদ্ধ হচ্ছে নাকি?

জন জিজ্ঞেস করলেন, ডানা, তাকিয়ে দ্যাখো তো, এই আলোয় ছবি তুলতে পারবে?

ডানা চারপাশে ঘুরে দেখল। তারপর বলল, বেটাতে তুলতে পারব। অবশ্য কতটা ভাল হবে তা বলতে পারছি না।

ফিল্ম উঠবে না?

না। ভিডিওতেই তুলতে হবে।

গো। গেট রেডি। কুইক।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শেরপাদের নিয়ে পুরো দলটা। শুধু জুডি আর অর্জুনকে কেউ কিছু বলল না। অর্জুনের খারাপ লাগছিল। জনসাহেব তাকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন।

প্রায় জনশূন্য ক্যাম্পে জুড়ি অর্জুনের পাশে এসে বলল, এইসময় আমার খুব খারাপ লাগে। আমার যেন কোনও প্রয়োজনই নেই।

তুমি তো অভিযাত্রী নও, তাদের ডাক্তার। কিন্তু আমি ভাবছি ওরা ওইদিকে গেল কেন? অর্জুন হাত তুলল।

কারণ ওইদিক থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছিল।

অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর বলল, চলো, একটু হেঁটে আসি।

সানন্দে। জুডি খুশি হল।

হাঁটতে-হাঁটতে জুড়ি বলল, এখানে খুব ভাল স্কেটিং করা যায়। কীরকম স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হচ্ছে, তাই না?

অর্জুনের হাতে স্টিক ছিল। প্রতিটি পা বাড়াবার আগে সে সামনের বরফ পরীক্ষা করে নিচ্ছিল। সে কিছু বলল না।

জুডি জিজ্ঞেস করল, আমরা উলটোদিকে যাচ্ছি, না?

হ্যাঁ। দোভাষী বলেছিল ওই বরফের পাহাড়ের দিকে তুষার-ভালুকদের দেখতে পাওয়া যাবে। আমি জনকে বলেছি, কিন্তু তিনি…।

আমার মনে হয়, এবার ফেরা উচিত। জুডি বাধা দিল। কেন?

আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। আর শেয়ালগুলো হঠাৎ চুপ করে গিয়েছে। গতরাত্রে ওদের একটার দাঁত দেখেছি আমি। ভালুকের বদলে

শেয়ালও যদি আমাদের আক্রমণ করে তা হলে, বুঝতেই পারছ।

অর্জুন বলল, আমার মনে হয় তুমি একাই ফিরে যেতে পারবে।

তুমি?

আমি আর একটু দেখতে চাই।

অগত্যা জুড়ি কাঁধ নাচাল, তোমাকে একা ছাড়তে খারাপ লাগছে, বেশ, চলো।

সূর্যকে মাথায় রেখে দিন চেনা যায়। কিন্তু চাঁদের বেলায় হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিল। অর্জুন দেখল গুঁড়ি গুঁড়ি তুষার গতকালের মতো নীচে নেমে আসছে না। অর্থাৎ আজ রাত্রে যদি প্রকৃতির মেজাজ পালটায় তা হলে পায়ের চিহ্ন থাকবে।

গ্রামের কাছাকাছি এসে অর্জুন ডানদিকে ঘুরল। এখানে উঁচু-নিচু হয়ে বরফের ঢেউ চলে গিয়েছে পাহাড়ের বুক পর্যন্ত। এই পথেই সেই অজানা জন্তুটা হেঁটে গিয়েছিল। বারংবার পরীক্ষা করতে হচ্ছে বরফ। দু-দুবার ঘুরে যেতে হয়েছে আলগা বরফ সামনে থাকায়। দুই ঢিপির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওরা আকাশ ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। কী মসৃণভাবে বরফের ঢিপি তৈরি হয়েছে। একমাত্র পায়ের চিহ্ন ছাড়া পৃথিবীর চেনা পরিবেশে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

অর্জুন বুঝতে পারছিল একটু বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। ঠিক তখনই গর্জন কানে এল। ভয়ংকর ক্রুদ্ধ না হলে এরকম গর্জন করা সম্ভব নয়। এবং ওই গর্জন ছোটখাটো জন্তুর পক্ষে করাও সম্ভব নয়। ওরা চারপাশের উঁচু বরফের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। তা হলে নিশ্চয়ই যে গর্জন করছে সে তাদের দেখে করেনি। এবার গর্জনটার আওয়াজ আরও বেড়ে গেল। একটি নয়, একাধিক জন্তু রাগ দেখাচ্ছে। অর্জুন ধীরে-ধীরে ওপরে উঠছিল। হঠাৎ তার ডান পা বরফের মধ্যে ঢুকে গেল। উত্তেজনায় পরীক্ষা করতে ভুলে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে মুক্ত করতে পারল সে। জুড়ি চাপা গলায় বলল, লেটস গো ব্যাক। অর্জুন ওই স্বরে বলল, জাস্ট ওপরে উঠে চারপাশে নজর বুলিয়ে ফিরে যাব।

ধীরে ধীরে ওরা উঁচু টিলার ওপর যেতেই অর্জুন বসে পড়ল এবং জুড়িকে জোর করে টেনে বসাল। চোখের সামনে অদ্ভুত দৃশ্য। টিলা থেকে নেমে যাওয়া বরফের উপত্যকায় দুটি বিশাল চেহারার ভালুক পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গর্জন করছে। কিছুটা দূরে একটি ভালুক নিরীহ মনে বসে আছে। একেবারে মানুষের ভঙ্গিতে দুজন এগিয়ে গেল পরস্পরের দিকে। তারপর ফ্রিস্টাইল কুস্তি শুরু হয়ে গেল। যে বসে আছে সে ওসব লক্ষ না করে পাশ থেকে কিছু একটা টেনে নিল। লড়াই থেকে চোখ সরিয়ে অর্জুন দেখল জটির হাতে বলের চেয়ে বড় একটা জিনিস।

কিছুক্ষণ লড়াই করার পর একটা জন্তু যে আহত হয়েছে বোঝা গেল তার কানফাটানো চিৎকারে। তারপর সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে দৌড়ে গেল ওপাশের পাহাড়ের দিকে। বিজয়ী ভালুক আনন্দে বরফের ওপর একবার গড়াগড়ি দিয়ে নিতেই দর্শক উঠে দাঁড়াল। তারপর হাতের বস্তুটি ছুড়ে দিল বিজয়ীর দিকে। সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাশে পড়ল। এবার বিজয়ী এসে আলিঙ্গন করল দর্শককে। তারপর দুজনে চারপায়ে হেঁটে চলে গেল ওপাশে।

মিনিটপাঁচেক চুপচাপ বসে রইল ওরা। চারপাশে কোনও শব্দ নেই। অর্জুন দেখল দর্শক ভালুকের ছুড়ে দেওয়া বস্তুটি পড়ে আছে তখনও। ওটা পাথর বা কাঠ নয়। তা হলে কী? জুডিকে সেখানে বসেই লক্ষ রাখতে বলে সে নামতে লাগল। সে যখন নীচে নেমে এসেছে তখন ওপর থেকে জুভি চেঁচিয়ে সাবধান করল। অর্জুন দেখল সেই আহত ভালুকটা আবার ফিরে এসেছে। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তাকে দেখেও কিছু না বলে ভালুকটা এগিয়ে যাচ্ছিল বস্তুটির দিকে।

অর্জুন দ্রুত একটা বরফের চাঙড় তুলে ছুড়ে মারল ভালুকটার দিকে। সেটা গিয়ে লাগল ঠিক মাথায়। অন্য সময় হলে নিশ্চয়ই সে ছুটে আসত, ছিঁড়ে ফেলত অর্জুনকে। কিন্তু এখন কাতর চোখে তাকাল। অর্জুন দ্বিতীয়বার আঘাত করতেই সে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকে। অর্জুন দৌড়ে গিয়ে বস্তুটি তুলে নিল। তারপর যতটা সম্ভব জোরে উঠে এল ওপরে। এসে বলল, লেটুস গো।

জুডি জিজ্ঞেস করল, ওটা কী?

বুঝতে পারছি না। এটা কোনও কিছুর মাথা। তারপরেই খেয়াল হল। হতেই সে হুররে বলে চিৎকার করে উঠল।

জনসাহেবদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। সে রাত্রে তাঁরা কিছু শেয়ালের ছবি তুলেছিলেন। ওঁরা ফিরেছিলেন ভোরের মুখে। ফিরেই অর্জুনদের অভিযানের কথা শুনে আফসোসে মাথা চাপড়েছিলেন। তারপর অর্জুনের বয়ে আনা বস্তুটি দুহাতে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেম, এই তো, এই সেই মাথা। একটু ক্ষতি হয়েছে দাঁত বসানোর জন্যে। এই মাথাটাকেই এরা ইয়েতির মাথা বলে নিশ্চয় হিলারিকে দেখিয়েছিল। তার মানে ওই আহত ভালুকটাই চুরি করেছিল মন্দির থেকে। তা হলে ওর কাছেই চামড়াটা আছে। গ্রেট ডিসকভারি।

সকাল হতেই সবাই মিলে গ্রামে গিয়ে মাথাটা ফিরিয়ে দিতেই উৎসব শুরু হয়ে গেল। সবাই এসে অর্জুনদের চমরি গাইয়ের দুধ খাওয়াতে লাগল। ওরা চুরি যাওয়া জিনিস ফিরে পাবে, ভাবেনি। ডানা বলল, এই পাওয়াটা নেহাতই অ্যাকসিডেন্ট। জুড়ি বলল, বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারই অ্যাকসিডেন্ট থেকে হয়েছে। অৰ্জুন বলেছিল, পুরোহিতের মুখে বর্ণনা শুনে আমি সন্দেহ করেছিলাম তুষার-ভালুককে। লোকটার বর্ণনার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ভালুকটা ওগুলো যাকে উপহার দিয়েছিল তাকে গায়ের জোরে পেতে পারেনি বলেই আমরা পেয়ে গেলাম।

গ্রামবাসীদের অনুরোধে জনসাহেব ক্যাম্প সেখানে নিয়ে গেলেন। হেলিকপটার এলে অর্জুন পুরোহিতকে নিয়ে রওনা হল। চামড়াটা পাহাড়েই আছে এটা জানার পর তার কিছু করার নেই। আসার সময় জনসাহেব অনেক ধন্যবাদ আর পারিশ্রমিকের চেক ওর হাতে দিয়ে দিলেন। অসুস্থ পুরোহিতকে তার স্ত্রী সমেত হাসপাতালে পৌঁছে ওদের গ্রামের ডাক্তার ভদ্রলোককে দায়িত্ব দিয়ে দিল। এবার ফিরে যেতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসে পৌঁছে ভাল করে স্নান করল অর্জুন। তারপর জনসাহেবের ঘর খুলিয়ে সুটকেসটা বের করে নিল। তারপর নিজের ঘরে ওটাকে নিয়ে এল। আগামীকাল ভদ্রপুরে ফিরে যাওয়ার প্লেনের টিকিট চাইল সে টেলিফোনে। কিন্তু প্লেনের অফিস থেকে জানাল কোনও সিট আগামী তিনদিন খালি নেই। অর্জুন নিজের নাম এবং হোটেলের নম্বর জানিয়ে

অনুরোধ করল কেউ ক্যানসেল করলেই যেন তাকে জানানো হয়।

অনেকদিন পরে ঘুমিয়েছিল সে পা ছড়িয়ে, টেলিফোন বাজতেই ঘুম ভাঙল। রিসিভার তুলতেই প্রবীণলালের গলা শুনতে পেল, আরে মশাই, আপনি ফিরে এসেছেন একথা জানাবেন তত! কাজ হয়েছে?

কী কাজ?

যা বলেছিলাম।

হ্যাঁ, প্রমাণ হয়েছে ইয়েতি বলে কোনও প্রাণী নেই।

হুঁ। কিছুই পাননি?

না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমার খবর পেলেন কী করে?

পেয়েছি। কালই ভদ্রপুরে যাবেন?

যাব তো, কিন্তু টিকিট নেই।

হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।

মিনিট পনেরো পরেই ফোন এল প্লেনের অফিস থেকে, আজ যেতে পারবেন সার। আর এক ঘণ্টা বাদে ফ্লাইট।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে টিকিট নিতেই দেখল প্রবীণলাল দুজন দেহরক্ষী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সামনে এসে বললেন, আমার জন্যে কিছুই নিয়ে এলেন না?

কিছু না পেলে কী করব বলুন?

আমি কিন্তু খালি হাতে ফিরে যাব বলে আসিনি।

আমার কিছুই করার নেই।

বাঃ, আপনার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলাম আমি, আমার জন্যে আপনি কিছু করবেন না? এস. কে. গুপ্তার জন্যে আপনি একটা প্যাকেট ভদ্রপুর থেকে এনেছিলেন, সেটা কোথায়? চোয়াল শক্ত হয়ে গেল প্রবীণলালের।

আপনি জানলেন কী করে?

আপনাকে অনেক প্রশ্ন করার সুযোগ দিয়েছি। উত্তর দিন।

অন্যের জিনিস আপনাকে দেব কেন?

কারণ আমি জিনিসটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব।

প্যাকেটটার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। একটা দেহরক্ষী সুটকেসটার দিকে হাত বাড়াতেই সে বাধা দিতে গিয়ে দেখল দ্বিতীয়জন রিভলভার তাক করেছে। অতএব চাবি দিতেই হল। প্যাকেট বের করে নিয়ে গেল প্রবীণলাল। আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। অর্জুন চেঁচামেচি করে পুলিশ ডেকে ব্যাপারটা বলতেই লোকটা জানাল তাকে থানায় গিয়ে ডায়েরি করতে হবে। সেটা করতে গেলে এই প্লেন চলে যাবে। আবার কবে টিকিট পাওয়া যাবে কে জানে!

ভদ্রপুর এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নেমে অর্জুন অবাক! মানিকলাল আগরওয়ালা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সে কাছে যেতেই ভদ্রলোক করমর্দন করে বললেন, আপনার ট্রিপ কীরকম হল?

ভাল। কিন্তু আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।

কেন?

আপনার জিনিস পৌঁছে দিতে পারিনি।

হ্যাঁ। খুব স্যাড। এস. কে. গুপ্তা খুন হয়ে যায়।

কিন্তু ওই প্যাকেটটাও আমার কাছে নেই।

জানি। তাই তো আপনাকে রিসিভ করতে এলাম।

বুঝলাম না!

যে আপনার কাছ থেকে ওটা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে সে পরে রেগে গিয়ে আমায় ফোন করে গালাগাল করেছে। ওই বলল এই ফ্লাইটে আপনি আসছেন। তাই এলাম। প্যাকেটে কিছুই ছিল না। একগাদা খবরের কাগজ আর একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, এটা ভোলার জন্য ধন্যবাদ।

সে কী। কেন?

আমি জানতাম, ওই প্যাকেট আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে। আপনি ভানু ব্যানার্জির লোক। আপনাকে বিপদে ফেলতে চাইনি। অথচ প্যাকেট নিয়ে না গেলে গুপ্তা আমার ওপর রেগে যেত। ভেবেছিলাম পরে তার সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম না। চলুন। আপনার জিপ তৈরি।

শিলিগুড়ির পথে ফিরে যাচ্ছিল অর্জুন। এই লোকগুলোর সঙ্গে ওই তুষার-ভালুক, যে চুরি করে কাউকে খুশি করতে চেয়েছিল, তার কি কোনও মিল আছে? না, অর্জুন মাথা নাড়ল। ওই চোর ভালুকটা অনেক সরল, সহজ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত