দায়মুক্তি

দায়মুক্তি

এই ঘটনাটা যখন লিখছি তখন রাত দুইটা বেজে দশ মিনিট!
নিজের প্রতি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকেই অপরাধটা আমার করা, অন্তত আমার দৃষ্টিতে আমার কাছাকাছি বুদ্ধিমান মানুষের দেখা আমি পাইনি। আপনারা হয়ত বলতে পারেন অপরাধের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এইসব কথা বলছি আমি, বলতেই পারেন! সেই অধিকার আপনাদের আজ থেকে আছে।
আমার অপরাধটা কি?
আমি বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় একজন লেখকের অতি কাছের মানুষ ছিলাম। চোখ বন্ধ করে তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। এতটা বিশ্বাস করতেন যে, আমি তার স্বাক্ষর, হাতের লেখা হুবহু নকল করতে পারি সেটা জানার পর, তার সমস্ত ব্যাংকের লেনদেনের দায়িত্ব তিনি আমাকেই দেন। আমি কখনো সেই বিশ্বাসের নড়চড় করিনি।
স্বাভাবিক ভাবেই তার কাছে আসা ভক্তদের সমস্ত চিঠি, জরুরি কাগজপত্র আমার কাছেই থাকত। আমি ঠিক করতাম কোনটা আগে তিনি দেখবেন, কোনটা পরে।
আপনারা জানেন তার সৃষ্টি করা একটা চরিত্র পরাবাস্তব রহস্য নিয়ে কাজ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিটা গল্পই সত্য এবং তিনি নিজেই গল্পগুলো সমাধান করতেন। হ্যাঁ! তিনিই সেই ব্যাক্তি।
এই রহস্য গুলো সমাধান করার সময় উনি একেবারে চরিত্রে ভেতর ঢুকে যেতেন, তাই শেষ দিকে তিনি যখন বেশী অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন আমি চেষ্টা করতাম এই ধরণের কেসগুলো থেকে তাঁকে দূরে রাখতে।
দুঃখজনকভাবে চিঠিটা তাঁকে আমার আর দেখানো হয়নি।
তিনি জানতেই পারেন নি, একজন পাঠিকা তাঁর কাছে সাহায্য চেয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন।
আর একটা লোভ ও আমার ছিল, কোনভাবে তার আগেই রহস্যগুলো সমাধান করতে পারি কিনা। দু একটা হয়ত পারতাম, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই মানুষটার বিশ্লেষণী ক্ষমতার কাছে আমি হার মেনে নিতাম।
আপনারা আগে চিঠিটা পড়ে নিন…
“শ্রদ্ধেয় স্যার,
সালাম নিবেন। এই চিঠিটা আপনাকে আজ কেন লিখছি আমি জানি না। আমি এই পৃথিবীর কোন বাস্তবতাকে এখন আর বিশ্বাস করিনা। তবুও মানবীয় কৌতূহল মেটানোর শেষ একটা আশা থেকেই হয়ত আপনার দ্বারস্থ হওয়া।
পুরো চিঠিতে একবর্ণ মিথ্যাও আমি লিখব না এবং কথা দিচ্ছি আপনার এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করব না।
আমার বয়স ২৭ বছর। আমাদের দেশের মেয়েদের তুলনায় আমি বেশ সুন্দরী। তাই ১৭ বছর বয়সেই আমার বিয়ে হয় একজন ব্যাংকারের সাথে। আমার স্বামীও বেশ সুদর্শন ছিলো। সমস্যাটা শুরু হয় বাসর রাত থেকে। রাতের যে কোন এক মুহুর্তে আমি আবিষ্কার করি আমার স্বামীর পেছনেই একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। মশারী টানানো ছিলো না, ডীম লাইট জ্বলছিল। তাই আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার স্বামীর ছায়াই হয়ত। কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ পরেও দেখলাম ছায়াটা একই জায়গায়, এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ঘন কালো একটা প্রতিমূর্তী। ভয়ে আমার শরীর কাঁপা শুরু হল। স্বামী ভাবলেন হয়ত প্রথম রাত বলে এমন হচ্ছে।
সে আমাকে ঘুমাতে বলে পাশের রুমে চলে যেতে চাইল। আমি নতুন বউ, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষকে লজ্জার মাথা খেয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমার ভয় লাগছে।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই আমি ছায়াটাকে দেখতাম। স্বাভাবিকভাবেই আমার আচরণে জড়তা থাকত। আমার স্বামীর বিষয়টা পছন্দ হতো না। সে নিজেও দ্বিধায় ভুগত আমাদের সম্পর্ক নিয়ে।
এর মাঝে ওর ট্রান্সফার হয়ে গেল। আমি ভয়ে আমার শাশুড়ির সাথে রাতে ঘুমাতাম। তিন-চার দিন ঘুমানোর পরও যখন দেখলাম সেই কালো ছায়াটা আসে নি। তখন আমি নিজের রুমে ঘুমাতে গেলাম।
এবং সেটাই আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল ছিলো, সম্ভবত!
গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। রুমের গুমোট পরিবেশ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম সেই অশরীরীটা এসেছে। আমি সামনে তাকালাম কিছু নেই, পাশ ফিরতেই কালো ছায়ামূর্তীটা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেটা আমার সাথে আমার স্বামীর মত আচরণ করতে চাইছিল। আমি প্রাণেপণে চিৎকার করছিলাম, হাতপা ছোড়াছুঁড়ি করছিলাম। কিন্তু একফোঁটা শব্দও আমার মুখ দিয়ে বের হয় নি।
এমন সময় ফজরের আজান শুরু হল, আর আমার শরীর আস্তে আস্তে হালকা হয়ে গেল। সেই ঘটনার পর থেকে আমি আমি শাশুড়ির সাথেই ঘুমাতাম।
প্রায় পনের দিন পর আমার স্বামী আসে। আচ্ছা, আমার স্বামীর নামটাই তো আপনাকে বলা হয়নি। ওর নাম রুহুল আমীন, ডাকনাম রুহ। নামটা আদর করে ওর দাদি রেখেছিলেন।
কথাটা কিভাবে লিখব বুঝতে পারছিনা, সে রাতে ওই অশরীরীটা আমার স্বামীর শরীরে মিশে যায় লাইট নেভানোর একটু পরপরই, আমার চোখের সামনে!
আমি ওকে বাঁধা দিতে থাকি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে, বুঝতেই পারছেন ব্যার্থ হই। ও খুবই অসন্তুষ্ট হয় আমার উপর। কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিলো না। সকাল হতেই আমার তলপেটে ব্যাথা শুরু হয়, এবং আমাদের প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়।
দুইদিন পর রুহ চলে গেলো, কিন্তু আমি আর আমার শ্বাশুড়ির সাথে ঘুমাতে গেলাম না। অশরীরীটার নাম ছিলো মারিদ্দ।
প্রতিরাতে সে আমার সাথে ঘুমাতো, আমি তাকে বাঁধা দিতাম না। সে আমাকে কখনো তার চেহারা দেখতে দিতো না। তার চেহারা দেখতে গেলেই আমি অন্ধ হয়ে যেতাম, শুধু চোখ বরাবর চোখ রাখলে এক অসীম জগতে হারিয়ে যেতাম যেন। আমি প্রতিরাতে তার জন্য অপেক্ষা করতাম নতুন বউ সেজে। তার শরীরে সবসময় হাসনাহেনা ফুলের মত একধরণের সুগন্ধি লেগে থাকে।
শাশুড়ি ভাবত আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। প্রচুর কবিরাজ, ওঝা দেখিয়েছেন তিনি, কোন লাভ হয়নি।
এর পরের বার আমার স্বামী যখন আসল, আমার সাঁজগোজ দেখে বেশ খুশী হল। কিন্তু রাতে ঘুমের মাঝে হঠাৎ তীব্র ভয় পেয়ে পাশের রুমে চলে যায়। রুহ সরে যাওয়ার পর মারিদ্দ আসল। ফজরের আগ পর্যন্ত আমার সাথে ছিলো।
আমার আর সন্তান হয়নি। রুহ এর জন্য আমার মায়া হত। ওর তো কোন দোষ নেই। দিনদিন তার শরীর খারাপ হতে লাগল। ও চাকরী ছেড়ে দিলো কয়েকমাস পর।
এই চিঠি লেখার সময় সে আমার সাথেই আছে, একই ছাদের নীচে, কিন্তু পাশে নেই। ও আমাকে ভয় পায়। সবাই ওকে পরামর্শ দেয় আমাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আমাকে ছেড়ে যায় না। প্রতিরাতে কাছে এসে ভয় পেয়ে পেয়ে সরে যায়।
আমি দিনের বেলায় রুহ কে দেখে অনুশোচনায় ভুগি। সে অনেকটা অবুঝ মানুষিক রোগীর মত আচরণ করে আজকাল। নিজে নিজে কথা বলে। আমাকে একই সাথে তীব্র ভয় পায় ও ভালোবাসে।
আমি এখন কি করব?
ইতি,
ইতি
আপনার পাঠিকা।”
এই চিঠিটা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। তার কয়েক মাস পরেই স্যার মারা যান।
স্যার মারা যাওয়ার পর কৌতূহল সামলাতে না পেরে চিঠির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ওই বাড়িতে যাই। ঠিকানাটা এই শহরেরই। আত্মবিশ্বাস ছিলো এই রহস্যটা আমি সমাধান করতে পারব।
আমি রুহুল আমীন সাহেবের অফিসের কলিগ পরিচয়ে গিয়ে ঘুরে আসি ওনাদের বাড়ি থেকে। উনি স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে চিনতে পারেন নি। একা একা বিড়বিড় করছিলেন। উনার স্ত্রী, আসলেই অত্যন্ত সুন্দরী। দু একবার সামনে এলেন ভদ্রতার খাতিরে। তিনি একটু আড়াল হতেই কোন প্রকার ভূমিকায় না যেয়ে সরাসরি ওনাকে স্বপ্নের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি।
উনি প্রশ্ন শুনে নিরবে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। উনার চোখের ভেতর এক অজানা হাহাকারময় ভাষা, যেটা ভয় আর ভালোবাসার সংমিশ্রণ।
সেদিন ঘরে ফিরে এসে আমি কিছুতেই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। যে করেই হোক এই রহস্যটার সমাধান আমাকে করতেই হবে। আগামীকাল আবারও যাবো রুহুল আমীন সাহেবের বাসায়।
ঠিক মধ্যরাতে এক অজানা অপার্থিব ভয়ে আমার ঘুম ভাঙল চিৎকার দিয়ে। আমার মনে হল, এই ঘড় ছেড়ে পালাতে হবে, এখুনি! আমার মৃত্যুভয়ের মত অনুভূতি হচ্ছে।
অনন্যা! আমার বউ তখনো জেগে ছিলো। অনেক সাধনার পর আমাদের প্রথম সন্তান তার গর্ভে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো।
আমি তার দু হাত জড়িয়ে ধরলাম। তার পুরো শরীরে জ্বর, অনেক জ্বর।
আমি অনন্যাকে একমনে অনুরোধ করছিলাম বিড়বিড় করে, প্লীজ অনন্যা মারিদ্দ কে কাছে আসতে দিয়ো না তুমি।
অনন্যা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আমার? এমন আচরণ কেন করছি?
একই প্রশ্ন তো আমি নিজেকেই করছি!
আমি ওই রুম থেকে রিডিং রুমে এসে পুরো ঘটনা লিখলাম এখন। ফজর হয়ে হয়ে আসছে। অনন্যা একবারও আমাকে ডাকতে আসেনি।
এখন রাত আড়াইটা, আমি এই লেখাটা যথাযথ জায়গায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।
যদি আমি মানুষিক ভারসাম্য হারাই, এবং আমাকে যদি আপনারা চিনতে পারেন। তবে আমার স্ত্রী অনন্যা আর আমার সন্তানকে বাঁচানোর আবেদন করছি।
আর যদি সুস্থ থাকি, তবে এই রহস্যের সমাধান আমিই করব।
আপনারাই বলুন তো আমার এখন কি করা উচিত?
আমি কি অপরাধি?
স্যার থাকলে এখন কি বলতেন?
=====
…………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত