মারাত্মক ঝুঁকি

মারাত্মক ঝুঁকি

সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির জন্য ওই দিকে জায়গা আছে?’
আরে বাই, বিত্রে নেটওক পাই না, এহেনেই কন না…’
‘ম্যাডাম, ভেতরে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান চলছে, এখানে গাড়ি দাঁড়ানো যাবে না।’
আইচ্ছা, বিত্রে যাইতাছি, গিয়া কী করুম?’
দাঁড়াব না, কিন্তু রাখব কোথায়?’
কী?…জোরে কন বাই, চিল্লাচিল্লির মইদ্দে কিচ্ছু হুনা যায় না…, সিয়েনজি…হ, পিছে একটা বাক্সের মইদ্দে, কিয়ের তার? সিয়েনজির থে তার ভাইরৈছে?’
ম্যাডাম, গাড়িটা…প্লিজ!’
‘বুজি না, বাই, পরিষ্কার কইরা কন। সিয়েনজির বাক্সে আবার তার কিয়ের? ইলেকটিরির তারের মথন? ওইটারে কী করুম?’
লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল ক্যাপ্টেন নিশা, সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের দরজা দিয়ে নামল জুনুন, ওর সহকারী। মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকা মাঝবয়সী লোকটার থেকে চোখ সরাচ্ছে না ওরা। এগিয়ে আসা সিকিউরিটি অফিসারকে এসএসএফের বিশেষ দায়িত্বের কার্ড বের করে দেখাল নিশা এক ঝলক, বলল, ‘গাড়িটা সরিয়ে রাখুন, কুইক।’
‘তারে টান দিয়া আর একটার লগে জোরা দিমু? ওইটা কই আছে?’
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে ধরল নিশা, মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে লাইন কেটে দিল। ঠেলে বেজমেন্ট কারপার্কের দিকে নিয়ে যেতে যেতে জানতে চাইল, ‘গাড়ি কই?’
বিত্রে…নিচে। কেলা, কিউছে? কুনু অন্যায় উইছে নিকি?’

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?’

‘গারির মালিক। হ্যায় আমারে কয়, সিয়েনজি থাকে যেই বাকসের মইদ্যে, ওইটার বিত্রের থে কী বলে দুইটা তার ভাইরৈছে, ওইটিরে জোরা দিলে গাড়িটা চলব বেশি। এহেকবার এহেক কথা কয়, সাউন্ড অইব না, গ্যাস বলে কম খরচা অইব। জুম্মন মিস্ত্রির পোলা আমি, ভুট্টু ডেরাইবর নাম কইলে চাংখার পুলের থে লয়া বেচারাম দেউরি হুদ্দা বেবাকটিতে খারায়া যায়, আর আমারে উই গারি চালান হিগায়! আমি তাও কই, আপনে আহেন, যহন চলব তহন ঠিক করুম। কয়, না, ওই গেরেজে রাইখাই তার জোরা দেওন লাগব। কয়, আমি ফোনে আছি, তুমি ঠিক করো। আরে বাই, ওইহানে তো নেটওক থাকে না, আমি কী করুম?’

ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল নিশার। সিএনজি সিলিন্ডারের কাভার বক্স…দুই তার জোড়া দিতে হবে গাড়ি বেজমেন্টে রেখেই…

‘সর্বনাশ!’

‘আগে ঠিক করেন নাই কেন?’

‘আরে, আমি তো এই গারি চালাই না…, হের ডেরাইবর বার্টেম হসপিটালের গেরেজের মইদ্যে গারি থুয়া গেছে গা কুন কামে। এটার লেইগা, কুনহানে বলে পাইছে আমার নম্বর, অ্যালা আমারে কল দিছে। কয়, তিন আজার ট্যাকা দিব। খালি গারিটা চালায়া লয়া সেরাটন—থুক্কু, এই রূপসী বাংলা হোটেলের নিচে গেরেজের মইদ্যে ডুকাইবার কইছে, তারপর বলে মুক্তাগাছা যাইব মন্ডা কিনতে।’

‘চলুন তো দেখি, কোন গাড়ি?’

একটা বেশ পুরোনো স্টেশন ওয়াগন। পেছনে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার ঢাকা দেওয়া বাক্সটাকে। বাউন্ডারি গেট দিয়ে ঢোকার সময় গাড়ির নিচে অস্বাভাবিক কিছু লাগানো আছে কি না, ছোট আয়না দিয়ে চেক করা হয়, পেছনের ডালা খুলে দেখা হয়। কিন্তু…এই বাক্স নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

এখন ওরা ঘামাতে লাগল।

বাক্সটায় কোনো দিকেই গ্যাস যাওয়া-আসার কোনো টিউব দেখা যাচ্ছে না, দুই পাশেই বন্ধ। একটা ইমার্জেন্সি বাল্ব থাকার কথা, যেখানে চাবি ঘুরিয়ে প্রয়োজনে গ্যাস বন্ধ করা যায়, সেটাও নেই।

‘আরি হালায়, এইটা তো দেহি শেষবিদায় ইস্টোরের মুর্দার বাক্স!’

‘ওকে,’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নিশা, ‘আমার ফোনে নেটওয়ার্ক পাব, ওই লোকের নম্বর বলুন, আমি ধরে দিচ্ছি—এটাতেই কথা বলুন। আর শুনুন, ও যা-ই বলুক, কিছু ধরবেন না।’

লোকটা ধরল ফোন, ভুট্টু তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা দিল, এটা পাশের এক ড্রাইভারের ফোন, এটায় নেটওয়ার্ক আছে, অতএব কথা বলা যাবে। গাড়িতে উঁকি মারতেই লোকটার কথামতো বাক্সের নিচের দিকে একটা হলুদ তারের একটুখানি মাথা দেখা গেল। তার নির্দেশমতো ভুট্টু জানাল, সে ওই তার টেনেছে, হ্যাঁ, দ্বিতীয় তারটাও বেরিয়ে এসেছে। হ্যাঁ, মাথার স্কচটেপ খুলেছে, জোড়া দিল, বিস্মিত লোকটাকে মিথ্যা নিশ্চিত করল ভুট্টু, এবার কী করবে জানতে চাইল সে। একটু সময় নিয়ে চিন্তিত গলায় তার খুলে আবার টেপ লাগিয়ে রাখতে নির্দেশ দিল সেই লোক। লাইন কেটে দিল।

লাউড স্পিকারে সবাই শুনল সব। এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল, ভয়ানক কোনো বিস্ফোরকই আছে ওই বাক্সে। গাড়িবোমা!

ভুট্টু তার জোড়া দিয়েছে শুনে ভীষণ অবাক হয়েছে লোকটা। কারণ…সে নিজেই ‘শুনতে’ পাবে বলে আশা করছিল?

যাক, আগের কাজ আগে। ফোনে জায়গামতো জানিয়ে দিল নিশা ঘটনাটা, এক্সপ্লোসিভ ডি-অ্যাকটিভেটিং টিম এসে পড়বে এক্ষুনি।

‘হালায় সিকিরিটির গিঠ্ঠু তো দেহা যায় বিত্রে ঢিলা!’

‘আপনি কি তাকে দেখেছেন?’ ওপরে যেতে যেতে প্রশ্ন করল নিশা।

‘না, কেমনে? কথা খালি তো টেলিফোনে। মাগার একটা মানুষ…হ ম্যাডাম, উই এহেনে আছিল! আমি বাউন্টিরির বিত্রে ডুইকা ওই গেইটের সামনে সোলো করছি, গেরেজে নামুম, আৎকা আমার সামনে আয়া এক ব্যাটা খামাখাই আমারে হাত দিয়া খেদায়া কয়, ওই দিকে, গেরেজে…নিচে নিচে। আমার এমুন জিদ লাগছিল…ব্যাট্টা, গারিটা কি তর বাপের! অহনে হিসাব মিলতাছে, বাপের না, গারি অরই। গেরেজে ডুকনটা কনফাম অহনের লেইগা উই এহেনে খারায়া আছিল।’

‘লোকটা কেমন, দেখলে চিনবেন?’

‘হ-অঅ, বাইট্টা কইরা, কালা। নেতাগো মথন ঢিলা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরসে।’

‘হুম্, আসুন দেখি আমার সাথে।’

বেজমেন্টের একজিট দিয়ে হেঁটে বের হচ্ছিল ওরা। পশ্চিম দিকে বাউন্ডারির গেটের দিকে চেয়ে হঠাৎ জমে গেল ভুট্টু, ‘ম্যাডাম, ওই দিকে দেহেন!’

সাদা পাঞ্জাবি পরা বেঁটেখাটো এক লোক চেকিংয়ের জন্য এইমাত্র থামা একটা গাড়ির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

পালাচ্ছে নাকি!

ছুটে যেতে গিয়েও থেমে গেল নিশা। গাড়ি থেকে নামল একজন লম্বা-চওড়া লোক, তাকে কিছু বোঝাচ্ছে বেঁটে লোকটা।

ওরা দুজনেই হাঁটছে, থেমে গেল। তাগড়ার কথা শুনে বেঁটে লোকটা ফোন বের করল, বাটন চেপে কানে ধরল। জুনুনকে ওই দিকে ইশারা করে ভুট্টুকে নিয়ে আবার ভেতরে সরে গেল নিশা। ফোন ভাইব্রেট করছে, একটু আগে করা সেই নম্বরটাই। একটু বুঝিয়ে ভুট্টুকে ফোনটা দিল নিশা।

‘হ্যালো ভুট্টু, তুমি কোথায়?’

‘গেরেজে, গারি…খুলুম? আবার টেরাই করুম?’

‘না না না! শোনো, গ্যারেজ থেকে বাইরে চলে যাও। গাড়িতে একদম হাত দিয়ো না, বুঝেছ?’

‘ও ও, আইচ্ছা।’

‘শাহবাগ মোড়ে অপেক্ষা করো, আমি আসতেছি।’ লাইন কেটে দিল লোকটা।

হুম্।

ভুট্টুর দিকে চাইল নিশা, ওকে আবার গ্যারেজে ফেরত পাঠাল।

দ্রুত বাইরে গিয়ে জুনুনকে দেখতে পেল তাকিয়ে আছে সামনে। আরও এগিয়ে দেখল সেই লম্বা-চওড়া লোকটা বেঁটেকে নিয়ে হোটেলের ভেতরে ঢুকছে। জুনুনকে নিয়ে নিশাও পেছনে দাঁড়াল। পকেট থেকে মোবাইল ফোন, সিগারেট প্যাকেট, চাবির রিং—এসব বের করে সিকিউরিটির সামনে ট্রের ওপর রাখল লোকটা, নিজে হেঁটে গেল স্ক্যানিং গেটের ভেতর দিয়ে। তারপর ট্রে থেকে নিয়ে আবার পকেটে ভরল বড়সড় মোবাইল ফোন, চাবি ইত্যাদি।

সরু হয়ে উঠল চিলের চোখ, মোবাইল ফোনটা…খাপে ভরা ফোনসেটটা…! চট করে জুনুনকে বলল ব্যাপারটা, ‘ওই জিনিসটা একটু দেখতে চাই…চেষ্টা করে দেখবে নাকি একবার?’

নিঃশব্দে হাসল জুনুন মনের মতো একটা কাজ পেয়ে।

ও ছিল একজন পেশাদার পকেটমার। এখন ভালো হয়ে গেছে, কিন্তু তাই বলে দক্ষতা তো হারায়নি।

কিন্তু…, জায়গাটা বেশ ফাঁকা এবং লোকটাও বেশ সাবধানী। তা ছাড়া পকেটের জিনিসটা তার খুবই দরকারি, যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে, তাই পকেটের ওপর দিয়েও প্রায় ধরেই আছে সে। এর মধ্যে হোঁচট খেল একটি কিশোরী মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে। মেয়েটা পড়ে গেছে, কিন্তু লোকটা এগিয়ে গেল ভ্রুক্ষেপ না করে। পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করল জিনিসটার অস্তিত্ব…নেই। আরে!…নেই মানে? দ্রুত ঘুরল সে, ওই তো…ওই মেয়েটাই…শালা পকেটমার! প্রায় দৌড়ে গেল সে মেয়েটার দিকে, কিন্তু ওরা সচরাচর যেমন কয়েকজন মিলে আসে, একজন আরেকজনের কাছে পাচার করে দেয়; এ-ও তা-ই করল, তার সামনের যে মেয়েটাকে দিল খুদে শয়তানিটা…পরিষ্কার দেখা গেল। আসলে মেয়েটা লুকাচ্ছে না, হাতে নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

মানে কী এসবের?

সতর্ক হয়ে গেল লোকটা। পেছনে হতচকিত বেঁটেকে নিয়ে থমকে দাঁড়াল।

কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

দেখতে ঠিক মোবাইলের খাপের মতো বক্সটা খুলল ক্যাপ্টেন নিশা। ভেতরে সুন্দর একটা ছোট্ট রিভলভার। কাছ থেকে ব্যবহার করলে খুবই মারাত্মক অস্ত্র। ও কি এবার নিজের হাতেই মারতে চেয়েছিল? কাকে? কেন?

মুখে দুই আঙুল পুরে তীক্ষ শিস বাজাল জুনুন, দুদ্দাড় করে ছুটে আসছে নিরাপত্তা দলের চৌকস লোকজন…।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত