তোমরা দুজন সাবধানে থেকো

তোমরা দুজন সাবধানে থেকো

ক্রিনিটি বলল, তোমরা দুজন সাবধানে থেকো। আমি বাইভার্বালটিকে দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে সরে যাব।

নিকি জিজ্ঞেস করল, কেন?

আমরা তাড়াতাড়ি সরে যেতে চাই। যখন তারা বুঝতে পারবে তুমি এই মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছ তখন তারা আমাদের খুঁজতে বের হবে।

আমার মনে হয় খুঁজতে বের হবে না।

কেন?

নিকি ইতস্তত করে বলল, মনে আছে তুমি যখন জীবনরক্ষাকারী ব্যাগটি আমাকে দেখাচ্ছিলে তখন–

তখন কী?।

তখন তুমি আমাকে একটি বিস্ফোরক দেখিয়েছিলে? যেটি আমার ছোঁয়াও নিষেধ?

হ্যাঁ। সেই বিস্ফোরকটার কী হয়েছে?

আমি সেটি ছুঁয়েছি। টাইমারটা সেট করে ত্রিপির ঘরে রেখে এসেছি।

ক্রিনিটি বলল, টাইমারটা কতোক্ষণের জন্যে সেট করেছ?

পনেরো মিনিট। আমার মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে এটি বিস্ফোরিত হবে।

নিকির কথা শেষ হবার আগেই একটি আলোর ঝলকানি মুহূর্তের জন্যে চারদিক আলোকিত করে দেয়, প্রায় সাথে সাথেই দূর থেকে একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। নিকি শিষ দেবার মতো শব্দ করে বলল, দেখেছ? জাতীয় গবেষণাগারের অর্ধেকটা উড়ে গেছে!

ক্রিনিটি বলল, হ্যাঁ। সাত বছরের একটি মানবশিশু এটি ঘটিয়েছে সেটি মনে হয় সাধারণের কাছে কখনো বিশ্বাসযোগ্য হবে না।

ত্রিপি বলল, নিকির বয়স সাত হলেও তার কাজকর্ম বড় মানুষের মতো।

নিকি বিড় বিড় করে বলল, আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট মানুষ থাকতে চাই।

 

ক্রিনিটি সারারাত বাইভার্বালটি চালিয়ে নিয়ে গেল, ভোর রাতে সেটিকে একটি শহরতলীতে থামায়। পুরো শহরতলীটি পরিত্যক্ত, বাড়িঘর বিবর্ণ, গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। তার মাঝামাঝি খানিকটা ফাঁকা জায়গার মাঝে সে বাইভার্বালটি নামিয়ে আনে। তারা দিনটা বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার রওনা দেবে।

ক্রিনিটি কিছু গাছের আড়ালে ঘাসের ওপর বিছানা তৈরি করে তাদের খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার কথা বলল কিন্তু নিকি আর ত্রিপি দুজনেই আবিষ্কার করল তাদের চোখে ঘুম আসছে না। তখন দুজনেই বুনো গাছগাছালিতে ঢেকে যাওয়া এই শহরতলীটি দেখতে বের হলো। একসময় এখানে মানুষ থাকত ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করত এখন কেউ নেই, নির্জন গা ছমছমে একটি পরিবেশ, দেখে নিকি আর ত্রিপি দুজনেই বুকের ভেতর একধরনের হাহাকার অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে ত্রিপি একটি ছোট বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। নিকি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

এই রকম একটি বাসায় আমি থাকতাম।

তোমার মনে আছে?

একটু একটু মনে আছে।

তোমার বাবা-মায়ের কথা মনে আছে?

ত্রিপি কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করল, তারপর বলল, মাঝে মাঝে আমি একজন মহিলাকে স্বপ্নে দেখি, স্বপ্নে আমাকে আদর করে, মনে হয় সেই মহিলাটিই আমার মা।

তার কথা তোমার মনে নেই?

না। শুধু আবছাভাবে একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। আমি মায়ের হাঁটুর ওপর বসে আছি, মা তার চেয়ারে আস্তে আস্তে দুলছে আর গান গাইছে। এটি সত্যি না আমার কল্পনা আমি জানি না।

নিকি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না, দুইজন পাশাপাশি কিছুদূর হেটে যায়। ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তোমার মায়ের কথা তো তুমি জাননো?

আমার জানার কথা না। কিন্তু আমি জানি।

কিভাবে জান?

ক্রিনিটির কাছে আমার মায়ের হলোগ্রাফিক ভিডিও আছে, সে মাঝে মাঝে আমাকে সেটি দেখতে দেয়। সেখানে আমার মা-কে আমি দেখেছি। আমার মা সেখানে যখন কথা বলে তখন মনে হয় সত্যি সত্যি আমার মা আমার সাথে কথা বলছে।

ত্রিপি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি। একটি সত্যিকার মানুষ! তোমার হয় নিকি?

হয়। কেন জান?

কেন?

আমার মা মারা যাবার আগে ক্রিনিটিকে বলে গিয়েছিল যে মানুষেরা বেঁচে আছে সারা পৃথিবী খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করতে হবে। আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

সত্যি?

হ্যাঁ। সে জন্যে আমি সবসময়ই জানতাম আমার অন্য মানুষের সাথে দেখা হবে। তাদের সাথে প্রথম দেখা হলে আমি তাদেরকে কী বলব সেটি অনেকবার মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

যখন আমার সাথে দেখা হয়েছিল তখন কী তুমি সেটি বলেছিলে?

নিকি মাথা নাড়ল। বলল, না। তোমার সাথে যখন আমার দেখা হয়েছে তখন আমার সবকিছু উলট-পালট হয়ে গিয়েছিল আমি কী বলব কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

ত্রিপি বলল, পৃথিবীতে কী আরো মানুষ আছে?

জানি না। মনে হয় আছে।

তাদের সবাইকে কী আমরা খুঁজে বের করতে পারব।

নিকি গম্ভীর সুরে বলল, মনে হয় পারব।

রোবটরা আমাদের করতে দেবে?

নিকিকে খানিকটা দুশ্চিন্তিত দেখায়। সে মাথা চুলকে বলল, সেটিই হচ্ছে মুশকিল। আমি ভেবেছিলাম রোবটরা আমাদের সাহায্য করে। এখন দেখি ঠিক তার উল্টো—রোবটরা আমাদেরকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।

ত্রিপি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি আমরা একজন বড় মানুষ পেতাম তাহলে ভালো হতো তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে বড় মানুষটি সবকিছু আরো ভালো করে করতে পারত। আমরা তো কখনো মানুষ দেখি নি, তারা কী করে কিভাবে চিন্তা করে কিভাবে কাজ করে কিছু জানি না।

ঠিকই বলেছ।

একটু পর দেখা গেল বিবর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি জনপদের একপ্রান্তে একটি গাছের গুড়িতে দুটি শিশু বসে আছে। তারা শিশুর মতো বড় হয় নি, তারা খুব আশ্চর্য একটি জগতের মানুষ। তাদের ভবিষ্যতে কী আছে তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ আছে কী না সেটিও তারা জানে না।

 

অন্ধকার হয়ে যাবার পর বাইভার্বালে করে তারা আবার রওনা দেয়। ভোররাতে তারা বিশ্রাম নিতে থামে। পরদিন সূর্য ওঠার পর আবার তারা রওনা দেয়। বিস্তীর্ণ জনপদ পার হয়ে বিশাল জলাভূমির উপর দিয়ে উড়ে উড়ে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের এলাকায় ফিরে আসে। বাইভার্বালটি যখন তাদের পরিচিত খোলা জায়গাটিতে থামল তখন নিকি বাইভার্বাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ত্রিপির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে থাকি।

ত্রিপি চারদিক দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ে। দীর্ঘ সতি বছর সে যেখানে বড় হয়েছে তার সাথে এই এলাকার কোনো মিল নেই। তার জীবনের বেশির ভাগ কেটেছে বদ্ধ চার দেয়ালের ভেতর। যখন বাইরে গিয়েছে। সেটাও ছিল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে চারদিক খোলামেলা। ত্রিপি সাবধানে বাইভার্বাল থেকে নেমে আসে। নিকি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে পেছনের গাছগুলোকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে বনটা দেখছ সেখানে আমার বন্ধুরা থাকে।

তোমার পশুপাখি বন্ধু?

হ্যাঁ।

তারা এখন কোথায়?

বনের ভেতর কোথাও আছে। আমরা গিয়ে খুঁজে বের করব।

ক্রিভনটি বলল, আমরা অনেক দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। তোমাদের খানিকটা বিশ্রাম নেয়া দরকার।

নিকি বলল, আমরা মোটেও ক্লান্ত নই নিকি।

আমি জানি তোমরা ক্লান্ত নও। কিন্তু আমি বহুদিন থেকে তোমাকে বড় করেছি তোমার শরীরের জৈব অংশটুকু সম্পর্কে আমি তোমার চাইতে বেশি জানি।

নিকি বলল, তুমি কী বলতে চাইছ ক্রিনিটি?।

আমি বলছি যে, তোমরা দুজন একটু বিশ্রাম নাও, সম্ভব হলে খানিকক্ষণ। ঘুমিয়ে নাও। ঘুম থেকে উঠে উষ্ণ পানিতে স্নান করে নতুন পরিচ্ছন্ন কাপড় পর। খাবার টেবিলে বসে গরম ধূমায়িত কিছু খাবার খাও তাহলে তোমাদের মনে হবে তোমরা একধরনের নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছ।

নিকি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে ক্রিনিটি।

ক্রিনিটি বলল, তা ছাড়া তুমি এখন একা নও। তোমার সাথে আছে ত্রিপি। তুমি একভাবে বড় হয়েছ, ত্রিপি সম্পূর্ণ অন্যভাবে বড় হয়েছে। তুমি যদি জোর করে তোমার জীবনযাত্রার পদ্ধতি ত্রিপির ওপর চাপিয়ে দাও সেটি তার পছন্দ নাও হতে পারে।

তাহলে আমি কী করব?

যেটিই করতে চাও ধীরে ধীরে করো। নতুন পরিবেশে ত্রিপিকে মানিয়ে নিতে দাও।

নিকি কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, ঠিক আছে ক্রিনিটি। আমার। মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ।

ক্রিনিটি বলল, আমি মানুষ না হতে পারি, কিন্তু মানুষ কিভাবে চিন্তা করে আমি সেটি অনেক সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছি।

শেষ পর্যন্ত নিকি যখন ত্রিপিকে নিয়ে বের হতে গিয়েছে তখন ক্রিনিটি তাদের দুজনকে থামাল। বলল, তোমরা একটু দাঁড়াও।

নিকি জানতে চাইল, কেন ক্রিনিটি?

নিকি, তোমার গলায় একটি মাদুলি আছে, তাই না?

হ্যাঁ।

কেন আছে বল দেখি?

এটি আমার জন্যে সৌভাগ্য বয়ে আনে। আমাকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।

ক্রিনিটি বলল, ঠিক বলেছ। এখন যেহেতু ত্রিপিও তোমার সাথে থাকবে তার সৌভাগ্যের জন্যে তাকেও একটি মাদুলি দেওয়া দরকার। তাকেও যেন বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে।

ত্রিপি একটু অবাক হয়ে বলল, প্রাচীনকালে মানুষ এগুলো বিশ্বাস করতো, তাদের শরীরে জাদুমন্ত্র দেওয়া মাদুলি থাকতো! তুমিও কী জাদুমন্ত্র জান ক্রিনিটি?

না। আমি জাদুমন্ত্র জানি না। ক্রিনিটি একটি মাদুলি ত্রিপির গলায় ঝুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এই মাদুলিটির মাঝে কোনো জাদুমন্ত্র নেই। কিন্তু কিছু জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আছে। পথেঘাটে তোমাদের কোনো বিপদ আপদ হলে আমি খবর পাব। তোমাদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবস্থা নিতে পারব।

নিকি বলল, সেটিই হচ্ছে জাদুমন্ত্র।

ক্রিনিটি বলল, তুমি ইচ্ছে করলে বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে পার। তারপর সে ত্রিপিকে লক্ষ করে বলল, ত্রিপি, তুমি এই মাদুলিটি গলা থেকে খুলবে না।

ত্রিপি মাদুলিটি ভালো করে দেখে বলল, এটি কী সুন্দর। আমি কখনো এটি গলা থেকে খুলব না।

আর নিকি, তুমি মনে রেখো ত্রিপি এখানে নতুন এসেছে। এখানকার সবকিছু তার অপরিচিত। তাকে তুমি দেখে শুনে রাখবে। তাকে কোনো অপরিচিত পরিবেশে ঠেলে দেবে না।

ঠিক আছে ক্রিনিটি।

তাকে নিয়ে কোনোরকম বিপজ্জনক কাজ করবে না।

করব না।

কোনোরকম ঝুঁকি নেবে না।

নেব না ক্রিনিটি।

তাহলে যাও, আর অন্ধকার হবার আগে ফিরে এস।

নিকি বলল, ফিরে আসব। তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না।

 

বনের ভেতর ঢোকার সাথে সাথেই একটি গাছের ডালে হঠাৎ করে প্রচণ্ড হুঁটোপুটি শুরু হয়ে গেল। ত্রিপি ভয় পেয়ে নিকিকে আঁকড়ে ধরে বলল, ওটা কী?

নিকি হেসে বলল, মিক্কু! আমার বন্ধু।

নিকির সাথে ত্রিপিকে দেখে মিক্কু বিশেষ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, সে কাছে এসে গাছের ডালে বসে সেটি আঁকাতে লাগল। নিকি বলল, মিক্কু, তোমার কোনো ভয় নেই। এটি হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার মতো একজন মানুষ। আমার বন্ধু।

মিক্কু ডাল আঁকানো বন্ধ করে এবারে একটু কাছে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে ত্রিপিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। নিকি হাত বাড়িয়ে বলল, এসো। আমার কাছে এসো।

মিক্কু এবারে লাফ দিয়ে গাছের ডাল থেকে নিকির ঘাড়ে এসে বসে। ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, তুমি বানরে সাথে কথা বলতে পার?

নিকি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, একটু একটু পারি।

কেমন করে পার?

আমি জানি না। অনেক ছোট থাকতে আমি তো এদের সাথে সাথে বড় হয়েছি, তাই আমি ওদের বুঝতে পারি ওরাও আমাকে বুঝতে পারে।

কী আশ্চর্য!

মোটেও আশ্চর্য না। তুমি পারবে।

ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। পারব না। পারবে।

চেষ্টা করলেই পারবে।

ত্রিপি নিকির ঘাড়ে বসে থাকা মিকূকে দেখল, তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, আমার কাছে এসো মিকু।

মিকু মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটি শব্দ করল। নিকি মাথা নেড়ে বলল, না মি, নিকি মোটেও তোমাকে মারবে না! ত্রিপি তোমাকে আদর করবে। যাও, ত্রিপির কাছে যাও।

মিক্কু আরো একবার আপত্তি করল। নিকি তখন মুখ কঠিন করে বলল, যাও বলছি, না হলে আমি তোমার সাথে খেলব না।

মিক্কু এবারে খুব অনিচ্ছার সাথে এবং খুব সতর্কভাবে ত্রিপির কাছে গেল। ত্রিপির ঘাড়ে বসে সে তার চুলগুলো একবার শুকে দেখল। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি নাড়াচাড়া করল তারপর একটু কামড় দিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর তার কানটা ধরে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল, ত্রিপির শুড়শুড়ি লাগছিল, সে হি। হি করে হাসতে শুরু করে।

নিকি বলল, ব্রিপি, তোমার কোনো ভয় নেই। মিক্কু সবাইকে এভাবে পরীক্ষা করে দেখে।

আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না, আমার শুড়শুড়ি লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে মিক্কুকে ঘাড় থেকে নামিয়ে কোলে নেয় তারপর আদর করে বুকে চিপে ধরে, মিক্কু আদরটা উপভোগ করে তার মাথাটা ত্রিপির বুকে লাগিয়ে রাখল।

নিকি বলল, এই দেখো! মিক্কুর সাথে তোমার ভাব হয়ে গেছে।

ত্রিপি মিকুর মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি সবসময় ভাবতাম বনের পশুপাখি অনেক হিংস্র হয়।

নিকি বলল, তুমি যদি হিংস্র হও তাহলে তারাও হিংস্র হবে।

আমি মোটেও হিংস্র হব না।

মিক্কুকে কোলে নিয়ে দুজনে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কাছাকাছি একটি গাছের উপর থেকে হুঁটোপুটির একটা শব্দ শোনা গেল, মিক্কু উত্তেজিতভাবে মুখ তুলে তাকায় তারপর বিচিত্র ভঙ্গিতে চিৎকার করতে করতে ত্রিপির কোল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে গাছের উপর উঠে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়!

ত্রিপি অবাক হয়ে বলল, কী হল? কী হল ওর?

নিকি হি হি করে হেসে বলল, ওদের একদল আরেকদলের গাছ দখল করবে। সে জন্যে সবাই মিলে মারামারি করতে যাচ্ছে।

মারামারি? এই ছোট বানরের বাচ্চা মারামারি করবে?

ওটা ওদের একধরনের খেলা।

কী বিচিত্র খেলা!

হ্যাঁ। নিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খুবই বিচিত্র। কিন্তু খুবই সোজা।

নিকি ত্রিপিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হ্রদের তীরে বালুবেলায় হাজির হয়। সামনে নীল হ্রদের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। খোল আকাশ সেখানে সাদা মেঘ। ত্রিপি সেদিকে তাকিয়ে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে বলল, কী সুন্দর!

নিকি কিছু বলল না। ত্রিপি বলল, নিকি! তোমার কাছে এটা সুন্দর লাগছে না?

নিকি মাথা নাড়ল, লাগছে আসলে আমি তো সবসময় এটা দেখি তাই। এখন আলাদা করে চোখে পড়ে না।

আমি তো বেশিরভাগ সময় থাকতাম একটা ঘরের ভেতর। আমার চারপাশে ছিল ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর রোবট আর যন্ত্রপাতি। শুধু বিকেলবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্যে বের হতাম। সারাদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিকেল হবে!

নিকি বলল, এখন তোমার আর অপেক্ষা করতে হবে না। তোমার ইচ্ছে করলে দিন-রাত বাইরে থাকতে পারবে। তোমার ঘরের ভেতরেই ঢুকতে হবে না।

হ্যাঁ। কী মজা!

ঠিক তখন গাছের উপর দিয়ে একটা কালো পাখি ক ক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে এল। নিকি উপরে তাকায়, তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, হাত নেড়ে বলে, কিকি!

পাখিটা তার মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকে, নীচে নেমে আসে না। নিকি ডাকল, এসো কিকি। এসো।

কিকি উড়তে উড়তে ডাকল, কঁ কঁ।

নিকি বলল, তোমার কোনো ভয় নেই। এ হচ্ছে ত্রিপি। ত্রিপি আমার বন্ধু।

কিকি আবার ডাকল, কঁ। কঁ।

নিকি বলল, এসো কিকি। এসো।

কালো পাখিটা তখন উড়ে এসে নিকির হাতে বসল। গায়ের রং কুচকুচে কালো, লাল চোখ। ঠোঁটগুলো শক্ত এবং ধারালো। ত্রিপি একধরনের বিস্ময়। নিয়ে পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে বলে, আমি কখনো এতো কাছ থেকে কোনো পাখি দেখি নি!

সত্যি?

হ্যাঁ। দেখে মনে হচ্ছে এটা খুব শক্তিশালী পাখি। ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দিয়ে লোহার পাতকে ফুটো করে ফেলতে পারবে?

হ্যাঁ। কিকি খুবই শক্তিশালি পাখি।

আমি কি কিকিকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?

দেখো।

ত্রিপি হাত বাড়াতেই কিকি ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে যেতে চেষ্টা করল, নিকি তখন তার গায়ে হাত দিয়ে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই কিকি। ক্রিপি তোমাকে একটু আদর করবে।

নিকির কথায় আশ্বস্ত হয়ে কিকি একটু শান্ত হলো, ত্রিপি যখন তার গায়ে হাত দিল তখন সে সতর্কভাবে একটু ডানা ঝাপ্টালো কিন্তু উড়ে গেল না। ত্রিপি বলল, ইশ কী মসৃণ এর শরীরটা?

হ্যাঁ। আকাশে উড়তে হয় তো সেজন্যে পাখিদের পালক খুব মসৃণ থাকে।

কিকি বলল, কঁ কঁ।

ত্রিপি নিকিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সবসময় পাখিদের সাথে কথা বলতে পার?

না। সব পাখিদের সাথে পারি না। কিকির সাথে একটু একটু পারি।

ইস! কী মজা!

তুমি আরেকটা মজার জিনিস দেখতে চাও?

দেখাও।

নিকি তখন কিকির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। কিকি তার লাল চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার নিকিকে দেখে বলল, ক কঁ। তারপর ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে গেল।

ত্রিপি জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ কিকিকে?

নিকি উত্তর না দিয়ে একটু হেসে বলল, এক্ষুণি দেখবে।

কিছুক্ষণের মাঝে বনের গাছ থেকে কালো পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে আসতে থাকে। দেখতে দেখতে হাজার হাজার পাখি ক ক করে ডাকতে। ডাকতে তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকে। ত্রিপি অবাক হয়ে পাখিগুলোকে দেখতে থাকে, নিকিকে জিজ্ঞেস করে, কী হচ্ছে নিকি? কী হচ্ছে?

সব পাখি এসেছে তোমাকে তাদের দেশে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য!

আমাকে?

হ্যাঁ, তোমাকে।

ত্রিপি তখন ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠল, দুই হাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ; অনেক অনেক ধন্যবাদ।

পাখিগুলো কী বুঝল কে জানে, তাদের দুজনকে ঘিরে উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে নিচে নেমে আসে তারপর আবার উপরে উঠে যায়। নিকি আর ত্রিপি দুই হাত তুলে পাখিদের সাথে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। অর্থহীন নাচ-কিন্তু তার মাঝে আনন্দের এতটুকু ঘাটতি নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত