মানুষের ব্যস্ততা

মানুষের ব্যস্ততা

দু’‌হাজার সতেরো শেষ হয়ে নতুন বছর দু’‌‌হাজার আঠারো সাল শুরু হয়ে গেল। আবহমান কালের এই যাওয়া–‌আসার ধারাবাহিকতায় খুব একটা নতুনত্ব কিছু না–‌থাকলেও, এই সন্ধিক্ষণ সারা পৃথিবীর মানুষকে এক অনিবার্য হিসেবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যা সদ্য শেষ হল, আর যা আসন্ন, এই দুইয়ের মধ্যে তুলনার অবকাশ থাকে না, যেহেতু একটা জানা এবং আর একটা অজানা। কিন্তু তুলনামূলক প্রত্যাশা আর পরিকল্পনা ঠিক শুরু হয়ে যায়। তারই প্রস্তুতি হিসেবে বোধহয় উৎসবের আবহ জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ, আলোকসজ্জা–‌আতশবাজি, কোথাও প্রার্থনা, কোথাও আমোদ–‌প্রমোদের ধামাকা।

ভেবে দেখলে অবশ্য (‌‌সময়ের)‌‌ এই বাৎসরিক হিসেব খুবই আপেক্ষিক, কেননা সময় ব্যাপারটা তো আসলে একটা আন্দাজ বা ধারণা। যা সত্যি তা হচ্ছে গতি কিংবা আপেক্ষিক গতি। ‌পৃথিবী গ্রহ যে গতিতে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসে, তার নাম দেওয়া হয়েছে বছর। আবার গ্রহ নিজেই যে গতিতে একপাক ঘুরে নিল, তার নাম দেওয়া হয়েছে দিন। গ্রহের সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি আমরাও।‌‌ আর তার ছন্দে ছন্দে কত রং বদলায়–‌য়–‌য় রং বদলায়.‌..‌‌।

তবে ‘‌নতুন বছর, নতুন বছর করে খুব বেশি হৈচৈ করার কিস্যু নেই;‌ কেননা যতবারই নতুন বছর এসেছে, দেখা গেছে তা তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের বেশি টেঁকেনি’‌। এমন দার্শনিকতা মেশানো কৌতুকভাষ্য অতি বিরল। সময়–‌ব্যাখ্যার বৈজ্ঞানিক দিকটিরও আভাস আছে এই কথায়। সে যাক।

কিন্তু গতি হোক, বা সময়, নামে কী আসে যায়!‌‌‌ আমরা এই গৃহবাসীরা বুঝি, পূর্তি আর পদার্পণের এই সময়টায় আমাদের ধরা–‌ছাড়ার একটা হিসেব বা আবেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এবং হয়তো তা প্রাকৃতিক, অনিবার্য। যা গেছে তাকে যেতে দিতে হবে এবং যা নষ্ট হওয়ার মতো তাকে নষ্ট হতে দিতে হবে। তা না হলে এই গ্রহ আমাদের একটা আঁস্তাকুড় হয়ে উঠত। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।

অতীত অভিজ্ঞতার সার দিয়ে বানানো, চৌরস করা জমির ওপরেই আগামী প্রত্যাশার অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে। ঘটার কথা। আমাদের মতো নির্জন–শীতল–‌শান্ত–মেদুর দেশের অভিবাসীদের পক্ষে সেইসব ভাবনা আর হিসেবের আদর্শ সময় এখন। আটটার আগে ভোর হচ্ছে না, তিনটের মধ্যে আঁধার ঘন হয়ে আসছে। বাংলা হাতের লেখা প্র‌্যাকটিস করার আবাল্য অভ্যাস সত্ত্বেও বুঝি, মেঘ–‌বৃষ্টি–আলো–হাওয়া.‌.‌.‌ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দানের ওপরেই জীবন কতখানি টিকে থাকে। আসলে না–‌চাইতেই কতকিছু যে পেয়ে বসে আছি, না–‌হারালে তা কি আর টের পাওয়া যায়!‌ হাতের লেখা প্র‌্যাকটিস করতে–করতেই মন উড়ুউড়ু.‌.‌.‌ অস্বীকার করি কী করে!‌ কী রঙ্গই চলছে এখন বঙ্গে!‌ আভাস পাই, কেননা যোগাযোগের বিশ্ব ছোট হয়েছে। যাতায়াতের গতি বাড়লেও, দূরত্ব আর কমেনি তো!‌

সুতরাং দেখাসাক্ষাৎ, অংশগ্রহণও সম্ভব না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না। যাই হোক না কেন, এখনও হাতে হাত, চোখে চোখ, আসা–‌যাওয়া, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ব্যতীত তুমি বৃত্তের বাইরে। দিনকাল অবশ্য বদলে গেছে তারপর অনেকখানি। তা সত্ত্বেও সময়, অর্থাৎ আপেক্ষিক গতির নিরিখে, এই যাওয়া–আসার সময়টায় একটা টানাপোড়েনের ব্যাপার ভেতরে–ভেতরে ঘটে। এসব ব্যাপারে কোনওটির সঙ্গেই আর একটির, কিংবা কোনও একজনের সঙ্গে আর একজনের তুলনা সম্ভব নয় যদিও, তথাপি, দিনকাল, রুচি ইত্যাদির নিরিখে টানাপোড়েন বিষয়টাকে একটু তলিয়ে ভাবা যেতে পারে।

এ কথাও অনস্বীকার্য যে, শব, সাধনা এবং শ্মশানের চেহারা, বৈচিত্র‌্য এবং ওসব সম্পর্কে মানসিকতারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এই দূর প্রবাস থেকে নিবিড় ঠান্ডায় আর ছায়া–ঢাকা নির্জনতায় থাকতে–থাকতে (‌বছরের এই সময়টাতেই)‌ বেশ পাখির চোখে দেখার মতো স্বদেশ তথা ভারতের দিকে তাকানো যায়, ভাবা যায়।‌ সেইসঙ্গে অনুভূত হতে শুরু করে পুরনোর সঙ্গে নতুনের, স্বদেশের সঙ্গে প্রবাসের তফাতগুলো।

দেশের সঠিক ইতিহাস যেদিন থেকে আমরা পড়তে পেরেছি, সেদিন থেকেই কিন্তু জেনেছি, নাকি জেনেছিলাম, বিভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন ভারতের বরাবরের লক্ষ্য ছিল। আর্য–‌অনার্য থেকে শুরু করে বহু বিচিত্র জাতির ধারাবাহিক যাতায়াত চলেছিল ভারতবর্ষে। আর সত্যি সত্যি সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হয়ে সবাইকেই আপন করে নিয়েছিলাম আমরা। অন্য জাতি, পর কিংবা অনার্য বলে ভারতবর্ষ কাউকে হটিয়ে দেয়নি। এবং সবাইকে নিয়ে চলতে গিয়েও নিজেদের শৃঙ্খলা আর দেশীয়ভাব খোয়াতে হয়নি। আমাদের সামাজিকতা, ধর্মীয় আচরণের উদারতা, বুদ্ধি–‌বিশ্বাস.‌.‌. ‌সবকিছু দিয়েই আমরা অন্যদের টেনে ধরে রাখতে পেরেছিলাম। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল, তথাকথিত রাষ্ট্রগৌরবের প্রতি ভারতবাসীর উদাসীনতার জন্য। রাষ্ট্রগৌরব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠত। সেই উদ্যোগটা চিরকালই ছিল ইউরোপীয় সভ্যতার অঙ্গ।

ইউরোপ পরকে দূরে রেখে নিজেদের সমাজকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছে.‌.‌. ‌নাকি চেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তঁার ভারতবর্ষ সিরিজের দুরন্ত প্রবন্ধমালায় এইসব ইতিহাস এবং ঘটনার অসাধারণ, বিশদ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা লিখে রেখে গেছেন।

এখন ওই সংক্ষিপ্ত উপরোক্ত সর্গটি আমাদের নিবন্ধে কিঞ্চিৎ প্রক্ষিপ্ত মনে হলেও, আসলে বিশেষ এই সময়টাকে একটু তলিয়ে ভাবার জন্যই ওই উল্লেখ। এক সাল গিয়ে, আর এক সাল আসার এই সময়টাতেই কোথাও একটা মৃদু আলোড়ন টের পাই। ভাবনায়, বোধে, রুচিতে, পুরনো আর নতুনের তুলনামূলকতায়, স্বদেশে–‌প্রবাসে–জাতি–ধর্মে.‌.‌. ‌কত যে প্রভেদ ঘটে গেছে, সেইসব মনে আসে। এই মনে আসার একটা সদর্থক কিংবা ইতিবাচক দিক হল, স্থবির না থেকে নিজেকে এবং নিজের সঙ্গে অন্যদেরও একটু ঝঁাকিয়ে, ঝালিয়ে, ভাবনাচিন্তাকে নাড়াচাড়া করে নেওয়া। সেই অর্থে কোনও নেতা বা নায়ক এখন আর পৃথিবীতে নেই।‌

পৃথিবীর কোনও দেশেই নেই, যঁার দর্শন আর নির্দেশ সমস্ত দেশবাসীকে কোনও নিশ্চিত দিশা দেখাতে পারে। বরং বিভিন্ন নেতা, গুরু, পণ্ডিতদের পরস্পরবিরোধী মতামতে মানুষের আংশিকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং তার থেকে নিজেকে/‌নিজেদের বঁাচানোর দায় নিজেদেরই নিতে হবে। প্রবাসফেরি করতে করতেই বুঝতে পারি, অতীতের সেই ভারতীয় সহনশীলতার মান কীভাবে বদলে গেছে।

সংস্কৃতির যে ব্যাপকতা, যার মধ্যে মিলে‌মিশে থাকে সমাজ–রাজনীতি– অর্থনীতি, দিনে দিনে সেখান থেকে বিশ্বাস–‌রুচি–‌মূল্যবোধ পড়তির দিকে। তথাকথিত বাজারব্যবস্থার প্রভাবে বিকৃতি মিশে যাচ্ছে মানুষের মনে, সংস্কৃতিতে। নির্জনতার মধ্যে মন এখনও উড়ুউড়ু। ‌পূর্তি আর পদার্পণের সন্ধিক্ষণে কত রঙ্গ বঙ্গদেশে। শামিল হওয়ার স্বপ্নে হাতের লেখা প্র‌্যাকটিস শ্লথ হয়ে আসে। কিন্তু একটা আড়ষ্টতা যেন অনুভূতির তলদেশ থেকে উঠে আসে।‌ ‌মনে হয় প্রসারিত হাতগুলোর সংখ্যা আর ব্যাপ্তি কমে আসছে। ‌মানুষ বড় ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। সবাই বলছে আমাকে দেখুন। তার পাশাপাশি সংঘবদ্ধ অসহিষ্ণুতাও যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। নতুন বছর তাকে রুখে দিতে পারবে তো!‌‌‌‌‌‌

 

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত