আত্মার বাড়ি

আত্মার বাড়ি

আহাদ কার নিয়ে বাড়ি থেকে বাসায় ফিরছে। রাস্তার দুই পাশে তাকালে দেখে, মাঠের পর মাঠ ধান ক্ষেতে ভরা। কখনও আবার দেখে, গাছের পর গাছ দিয়ে বাগান ভরা। আবার কখনও দেখে, ফুল ও ফলে নার্সারী ভরা। প্রকৃতির সুন্দর্য দেখতে দেখতে তার মনটাকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে, রাতের আগমন ঘটে। আহাদ রাতের সুন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। কখনও জোঁনাকীর আলো দেখে, আবার কখনও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে। সে যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যায়। হঠাৎ তার কারটা নষ্ট হয়ে পড়ে। বাহিরের দিকে তাকাতেই বাহিরের পরিবেশটা দেখে আহাদের মনটা কি রকম করে যেন ওঠে। কারণ গাড়িটা যে জায়গায় নষ্ট হয় ঐ জায়গাটাতে কোনো ঘর-বাড়ি নেই, গাড়ি ঠিক করার মতো কোনো গ্যারেজও নেই। কি করেই বা থাকবে? জায়গাটা যে ঘন জঙ্গলের মাঝ পথে। যে জায়গাটাতে দিনের বেলায় ভয়ে দুই তিন জন লোক একত্রে ছাড়া একা কেউ আসে না, সেখানে রাত্রের বেলায় কি করে থাকবে?

চারপাশ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন; ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ তার কানে আসতে থাকে, বিভিন্ন ধরণের এক অদ্ভুদ শব্দও কানে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে হালকা গরম হাওয়া তার কানের পাশ দিয়ে বয়ে যেতে থাকে। আবার তার মনে হয় কে যেন পিছন থেকে তাকে ডাকছে। পিছনে তাকালেই দেখে, কেউ সেখানে নেই। আবার দেখে, কে যেন সামনে দিয়ে যাচ্ছে ভয়ে চোখ বন্ধ করে আবার তাকালে দেখে সেখানে কেউ নেই। আবার কখনও দেখে, বিড়াল হেটে কিছু দূর যাওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার সাথে এসব কি হচ্ছে? বুঝতে পারছে না, ভয়ে তার শরীর ঘামতে থাকে। শব্দ শুনতে শুনতে কখনও পিছনে বা সামনে তাকায়। আবার কখনও বামে বা ডানে তাকায়। সে যেন একটা ঘোরের মাঝে পড়ে গেছে। চিৎকার করে মানুষদের কে ডাকতে চায় কিন্তু পারে না। তখন তার মনের মাঝে অজানা এক ভয় ডুকে যায়।

আহাদ কি করবে? কিভাবে গ্যারেজ খুঁজে পাবে? কিভাবে এ জায়গা থেকে মুক্তি পাবে? কখন বাসায় ফিরবে? সে জানে না। আহাদ অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু অন্য কোনো গাড়িও আসে না। হঠাৎ দেখে, মেইন রোড থেকে ভিতরের দিকে এক রাস্তা। ঐ রাস্তা দিয়ে অনেক্ষণ হাটার পর একটা বাড়ি পায়। বাড়িটার দিকে ভাল করে তাকালে দেখে, এটা কোনো সাধারণ বাড়িনা রাজবাড়ি। বাড়িটা পেয়ে মনে মনে অনেক খুশি হয়।

রাজ বাড়িটার বিভিন্ন রুমে ও বাহিরে অসংখ্য মোমবাতি জ্বালানো। মোমবাতি গুলো এতো সুন্দর করে সাজানো দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে যায়। একটা সুন্দর ঘ্রাণ তার নাকে পায়। চোখটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাসে ঘ্রাণটা নেয়।তারপর চোখের পাতিটা খুলতেই দেখে বাড়িটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। রাজবাড়িটা একটা ভয়ংকর রূপ নিয়ে আছে। সে দেখে, বিভিন্ন রকমের ছায়া মূর্তি তার সামনে দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে। এসব দেখে, তার শরীরটা থর থর করে কেঁপে ওঠে। মনের মাঝে ভয়টা আরও বাড়তে থাকে। এখন বাড়িটাকে দেখে তার মনে হচ্ছে; বাড়িটা দেরশ দুইশো বছরের পুরনো রাজবাড়ি। বাড়ির বিভিন্ন ধরণের লতাপাতার চিহ্নই তা বলে দিচ্ছে। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আবার তাকিয়ে দেখে, সব কিছু আগের মতই আছে কোনকিছু পাল্টাইনি। আহাদ আবার চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে দেখে, এখন কোনো কিছু পাল্টায়নি সব আগের মতই আছে। মনে মনে বলে, ‘মনে হয় মনের ভুলে অন্যকিছু দেখেছি।’ কিন্তু বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটা একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারণ বাড়ির আশে পাশে ভিতরে কোনো লোকের সাড়া শব্দ পাচ্ছে না। ধীর পায়ে গেইটের কাছে যায়।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাড়ির চারপাশের পরিবেশটা দেখে তারপর বলে, ‘বাড়ির ভিতরে কেউ আছেন? আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?’ এভাবে আহাদ দুইবার ডাক দেয়। কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে কোন সাড়া শব্দ পায় না, পাঁচ
ছয় মিনিট চলে যায়। তারপরেও কারো কোনো সাড়া শব্দ আসে না। তারপর আবার দুইবার ডাক দেয়। তবুও কেউ
আসে না। আরও চার পাঁচ মিনিট চলে যায়। তারপর আরও কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করে। যখন চলে আসতে যাবে তখনেই বাড়ির ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ শুনে। সে দেখে,
একটা মেয়ে সাদা ড্রেসে এক হাতে মোমবাতি ও অন্যহাতে একটা পুতুল নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে তার দিকে
এগিয়ে আসছে। আহাদ মেয়েটার মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটার
ড্রেস-আপ দেখে তার শরীর টা শিউরে ওঠে। কারণ সে সাদা পোশাক দেখেছে, কিন্তু এরকম সাদা পোশাক কখনও দেখেনি; তার মাঝে মেয়েটার টুপির জন্য তার মুখটাও ঠিক মতো দেখতে পারছে না। এই জন্য সে আবার ভয় পেতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে বাড়ির ভিতরে যাবে কি যাবেনা, এটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। আবার মনে মনে বলে, ‘এতো বড় রাজ প্রাসাদে এই ‌মেয়েটা কি একা? না অন্য কেউ আছে! আর থাকলে সাথে কেন আসল না?’ এসব নিয়ে সে ভাবতে থাকে।

মেয়েটা আহাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থেকে আহাদকে দেখছে, কিছুক্ষণ পর তাকে হাতে ইশারা করে তার সাথে যাওয়ার জন্য। মেয়েটার এ-রকম আচরণে অনেকটা অবাক হয়। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার ভিতরে চলে যেতে থাকে। কোনো উপায় পেয়ে মেয়েটাকে অনুসরণ করে ভিতরে যেতে থাকে। আহাদ ভিতরে যাওয়ার সময় খেয়াল করে, বাড়িটা কিরকম যেন নীরব হয়ে আছে। এখন পর্যন্ত সে কাউকে দেখতে পায়নি। মেয়েটার সাথে সে একটা রুমে আসে, মেয়েটা তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে অন্য রুমে চলে যায়। আহাদ মনে মনে ভাবে, মেয়েটা হয়তো কথা বলতে পারে না, তাই হাতের ইশারার মাধ্যমে তাকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু সে এটা জানে না যে, এই মানুষটা একটা আত্মা। মোম বাতির আলোতে রুমের চারপাশটা দেখতে থাকে আর
ঐ মেয়েটার খবরের জন্য অপেক্ষায় থাকে। হঠাৎ তার শরীরটার মাঝে একটা ক্লান্ত ভাব অনুভব করে, সে চেয়ারটার মাঝে হেলান দিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলে।

আহাদ চোখটা বন্ধ করতেই যে, অন্য কিছু দেখবে বা তার চোখের সামনে অন্য কিছু ভাসবে কল্পনাই করতে পারেনি। চোখটা বন্ধ করতেই রুমের ভিতরে সে একটা করুণ সুর শুনতে পায়। সে দেখে যে, একটা সাদা কাপড়ের লাশ উল্টা ভাবে তার চোখের সামনে জুলতেছে। এটা দেখে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ভয়ে ঘামতে থাকে। হঠাৎ করে লাশটা
তার চোখের একেবারে কাছে এসে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। আহাদ দেখে ‌যে, চোখের ভিতরে আরও দুইটা মানুষ এক জন আর এক জনের মাথার মগজ কাটছে আর খাচ্ছে ও তাদের মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে ঐ লাশটার চোখ দিয়ে বেয়ে বেয়ে পড়ছে। এটা দেখে আহাদ সহ্য করতে পারেনি; সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।(এতক্ষণ চোখ বন্ধ অবস্থায় এ গুলো দেখছিল)

আহাদ সাথে সাথে চোখ খুলে, সে দেখে যে অন্ধকার রুমে বসে আছে। তখনেই শুনতে পায় রুমের এক পাশ থেকে
একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে। আবার আর একপাশ থেকে একটা মেয়ের দৌড়াদৌড়ি ও হাসির আওয়াজ
ভেসে আসছে। সে আর এক পাশ থেকে একটা মেয়ের কিছুকথা শুনতে পায়।কথা গুলো এরকম
– ‘আমাকে মেরো না আমাকে ছেড়ে দাও! তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাব তবুও আমাকে মেরো না!আমাকে ছেড়ে দাও!’
তখন অন্য একজন বলে
– ‘তোকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, তোকে মেরে ফেলতেই হবে। কেন তুই ছেলে হয়ে জন্ম গ্রহণ করলি না? তাহলেই তো বাঁচতে পাড়তি।’
তখন মেয়েটার একটা চিৎকার শুনে, ঐ দিকে তাকাতেই একটা রক্ত মাখা মাথা দেখে। তারপর দেখে যে,মাথাটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা দেখে আহাদ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিছুক্ষণ পর আবার শুনে কে যেন কাঁদতেছে, সে ভয়ে ভয়ে চোখ
খুলে দেখে এখন আর তার সামনে কিছু নেই। তারপর ঐ কান্নার শব্দের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যতই কাছে যেতে থাকে কান্নার শব্দটা দূরে সরে যেতে থাকে। একটা সময় দেখে যে, ঐ মেয়েটাই বসে থেকে কাঁদতেছে। ধীর পায়ে মেয়েটার কাছে যায়। সে মেয়েটাকে যখন ধরতে যাবে ঠিক তখনেই মেয়েটা তার দিকে মাথাটা
উল্টো করে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সে দেখে যে, মেয়েটার চোখ আছে কিন্তু মাথা নেই। চোখের চারপাশ থেকে রক্ত বেয়ে
বেয়ে পড়তেছে। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাতে চায় কিন্তু পারে না। সে দেখে যে, শূণ্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে উপরে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না, চারদিকে তাকালে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখে। আহাদ
কিভাবে এই জায়গা থেকে পালাবে ভাবতে পারছে না,বুঝতে পারছে না।তারপর একটা চিৎকার দিয়ে
জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

এই মেয়েটা হলো একটা আত্মা। এই মেয়েটাকে দিনের বেলায় অনেকেই দেখেছে। আবার অনেকেই তাকে দেখেনি। অনেকেই ভুল করে আসে বা অনেককেই এই মেয়েটা নিয়ে আসে। এই বাড়িটাতে যেই আসে সেই এই বিপদে পড়ে। কিন্তু কেন এসব হয়? কেন এসব ঘটে তার সঠিক কারণ কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যারা এখানে এসেছে, তাদের মাঝে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। আবার অনেকেই বেঁচে গেছে। কিন্তু এই রাজবাড়িটা কেন অভিশপ্ত হল তার সঠিক কারণ কেউ বলতে পারে না। শুধু সবাই এটাই জানে যে, এটা হলো আত্মার বাড়ি।

সকাল বেলা অন্য বাস যখন এই রাস্তা দিয়ে যায় তখন আহাদের গাড়িটা দেখে।ঐ বাস ওয়ালারা ও এলাকার লোকেরা জানে এই জায়গাটা খারাপ- এছাড়া অন্য কেউ জানে না। শহরে যাওয়ার দুইটা রাস্তা- একটা হল এই রাজবাড়ির পাশ দিয়ে আর একটা হলো অন্য এক গ্রাম দিয়ে। আর রাতের বেলায় এই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি চলাচল করে না। ঐ বাসের লোকেরা অনেক খোঁজার পর আহাদকে রাজবাড়ির বাহিরে পায়। কিছুক্ষণ পরে তারর জ্ঞান ফিরে। রাতের দৃশ্য গুলো মনে হতেই তার শরীরটা শিউরে ওঠে। তাকে কেউ আর প্রশ্ন করেনি। বাসের লোকেরাই তাকে শহরে নিয়ে যায়। কিন্তু তার মনে একটাই প্রশ্ন এই বাড়িটা কেন আত্মার বাড়ি হলো? কেন এই বাড়িটা এরকম অভিশপ্ত হলো? তার সাথেই বা কেন এরকম করল? দূর আকাশে তাকিয়ে থেকে এই প্রশ্নগুলো ভেবে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত